শ্রাবণ মাস। ঘন কালো মেঘে ছেয়ে আছে আকাশ। সামযিক বিরতির পর আবার শুরু হয়েছে হালকা চালে। প্রায় সারাদিন ধরেই লাগাতার বৃষ্টি হয়ে চলেছে। মাঝে মাঝে একটু বিরতি নিলেও সেটা দীর্ঘস্থাযী হচ্ছে না। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল শান্তা, আটটা বাজে। রাত বেশি না হলেও চারপাশটা ঝিমিয়ে আছে। সেটা অতিবৃষ্টির কারণে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। এই দুর্যোগের মধ্যে কে আর সাধ করে বাইরে বেরুবে!

চিপস আর কফির কাপ হাতে টিভি খুলে বসল শান্তা। শান্তা কুলকার্নি। মারাঠি মেয়ে বাঙালি ছেলে সুমিত সেনকে বিয়ে করে এখন পুরোদস্তুর বাঙালি বউ। দুজনেই সফটওয্যার ইঞ্জিনিয়ার। বেঙ্গালুরুতে পড়ার সময় আলাপ, আলাপ থেকে প্রেম, তারপর বিয়ে। এখন শুনতে সহজ মনে হলেও, বিয়ের পিঁড়িতে বসতে দুজনকে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছিল।

শান্তার পরিবার বেশ গোঁড়া। প্রথমে যথেষ্ট আপত্তি তুলেছিল, যদিও শেষ পর্যন্ত মেনে নিতে বাধ্য হয়। তার পিছনে ছিল শান্তার অদম্য জেদ আর ছোটোমামা সুনীল আপ্তের ফুল সাপোর্ট।

সুমিতদের আদি নিবাস কৃষ্ণনগরে। ওখানেই থাকে পুরো ফ্যামিলি। সুমিতরা কর্মসূত্রে কলকাতাতেই থাকে। উইকএন্ডে চলে যায় বাড়িতে। দুএকদিন খুব হই-হুল্লোড় করে কাটিয়ে আসে। প্রথমে একটু অসুবিধা হলেও এখন বাংলাটা বেশ ভালোই বলে শান্তা।

ফোন বেজে উঠল চেনা রিং টোনে। টিভির সাউন্ড মিউট করে দিল শান্তা। প্রথমে ভেবেছিল সুমিতের ফোন। সুমিত এই মুহূর্তে দিল্লিতে। বিশেষ একটা কনফারেন্সে যোগ দিতে গিয়েছে, অফিস থেকেই পাঠিয়েছে। অচেনা নম্বর দেখে ভ্রু-টা ঈষৎ কোঁচকাল শান্তার। এই সময় আবার কে ফোন করল?

রিসিভ করে বলল, হ্যালো… কে বলছেন?

ওপার থেকে ভেসে এল গম্ভীর পুরুষ কন্ঠ, আপনি কী শান্তা কুলকার্নি বলছেন?

শান্তা অবাক হয়ে বলল, হ্যাঁ বলছি… আপনি কে বলছেন বলুন তো, ঠিক চিনতে পারছি না।

মাইসেল্ফ অবিনাশ রুদ্র। আপনি আমাকে চিনবেন না কিন্তু আমি আপনাকে চিনি। আমি কয়েকটা জরুরি কথা বলার জন্য আপনাকে ফোন করেছি। কথাগুলো আপনার পক্ষে খুবই ইম্পর্ট্যান্ট। হয়তো আপনার শুনতে খুব একটা ভালো লাগবে না, তবুও বলতে বাধ্য হচ্ছি। কারণ আমার মনে হয়েছে কথাগুলো আপনাকে বলা দরকার।

শান্তা এবার সত্যি সত্যি ভীষণ অবাক হল। ভেতরে ভেতরে একটা অদম্য কৌতূহল তৈরি হচ্ছে তার, বেশ বুঝতে পারছে। লোকটা কে? কী এমন গুরুত্বপূর্ণ কথা বলতে চায় যাতে শান্তার খারাপ লাগতে পারে?

আপনি ঠিক কী বলতে চাইছেন বলুন তো… আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।

সেটাই তো বলতে যাচ্ছি। একটু মন দিয়ে শুনুন প্লিজ। মিষ্টার সুমিত সেন আপনার হাজব্যান্ড, তাই তো?

হ্যাঁ। কী হয়েছে সুমিতের? কোনও বিপদ টিপদ…

আরে না না… সেসব কিছু না। বহাল তবিয়তেই আছেন তিনি। বাই দ্য ওয়ে আমার কথাটা কিন্তু ওনাকে নিয়ে। আপনি কি জানেন সুমিতবাবু এখন কলকাতাতেই আছেন?

তড়াক করে লাফিয়ে উঠল শান্তা।

কী যা তা বলছেন আপনি? আপনার উদ্দেশ্যটা কী বলুন তো? সুমিত এখানে আসবে কোথা থেকে?

বসুন… বসুন… বুঝতে পারছি উত্তেজনায় আপনি দাঁড়িয়ে পড়েছেন। সেটাই স্বাভাবিক। মাথা ঠান্ডা করে আমার বাকি কথাগুলো শুনুন প্লিজ।

লজ্জা পেল শান্তা। লোকটার কি এক্সট্রা চোখ আছে? আবার বসে পড়ল সোফাতে।

দেখুন ম্যাডাম আমি আপনার শুভাকাঙ্ক্ষী। তাই ফোনটা করেছি। অন্যের ফ্যামিলি ম্যাটার নিয়ে মাথা ঘামানোর কোনও ইচ্ছাই আমার নেই। আপনার স্বামী সুমিত সেন, পায়েল মিত্র নামে একটা মেয়ের সাথে অবৈধ সম্পর্কে জড়িত… সেটা কি আপনি জানেন?

শান্তা যেন হাজার ভোল্টের শক্ খেল। কোনও কথাই মুখ দিয়ে বের হল না।

আপনার বাকরুদ্ধ অবস্থা দেখে বুঝতে পারছি, আপনি এসব কিছুই জানেন না। আমি কিছুটা আন্দাজ করেছিলাম, আপনাকে বোকা বানানো হচ্ছে।

শান্তা বলল, আমি বিশ্বাস করি না। আপনি যে সত্যি বলছেন তার প্রমাণ কী?

জানতাম আপনি একথাই বলবেন। আপনি হয়তো ওকে মনপ্রাণ দিয়ে ভালোবাসেন। বিশ্বাস করেন। ভালোবাসার মানুষ সর্ম্পকে এসব কথা শুনলে মেনে নিতে কষ্ট হয় বৈকি। কিন্তু ম্যাডাম সত্যি তো সত্যিই, তাকে অস্বীকার করবেন কী করে?

এতটা কনফিডেন্স নিয়ে বলছেন। আপনার কাছে কী প্রমাণ আছে?

না সেরকম কোনও প্রমাণ নেই। আমার চোখ দুটোই প্রমাণ। কোনও ছবি তুলে রাখিনি, ভয়ে রেকর্ডও করিনি। তবে আপনি চাইলে ওদের হাতে-নাতে ধরতে পারেন।

মানে?

মানেটা খুব সহজ ম্যাডাম। ওরা কোথায় আছে আমি জানি। ঠিকানাটা দিয়ে দিচ্ছি। সেখানে চলে যান, হাতে নাতে ধরে ফেলতে পারবেন। আপনি চাইলে আমি আপনাকে সাহায্য করতে পারি। তবে…

আপনি কোথায় থাকেন?

ওরা যে-ঠিকানায় আছে তার আশেপাশেই। এখন ভেবে দেখুন কী করবেন।

শান্তা অন্যমনস্ক ভাবে বলল, ঠিক আছে আপনি ঠিকানাটা পাঠিয়ে দিন।

ফোন কেটে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ল শান্তা। সুমিত এত বড়ো বিশ্বাসঘাতকতা করল তার সাথে! কনফারেন্সের নাম দিয়ে এত বড়ো মিথ্যাচার? মাত্র দুবছরের মধ্যে সমস্ত ভালোবাসা উবে গেল? অথচ এই ভালোবাসা রক্ষার জন্য শান্তাকে কী লড়াইটাই না লড়তে হয়েছিল একদিন। নিজের কাছের মানুষগুলোকে দূরে ঠেলে দিতে পিছপা হয়নি। বিশ্বাস করতে মন চাইছে না, তবুও কেন জানি মন বলছে এটাই সত্যি। একটা অজানা অচেনা লোক আগ বাড়িয়ে মিথ্যে বলতে যাবে কেন? যদি অন্য কোনও অভিসন্ধি থাকত, তাহলে শান্তাকে ফোন না করে সুমিতকে ফোন করত। শান্তাকে এসব জানিয়ে ওর অন্য কিছু লাভ আছে বলে মনে হল না। অর্থাৎ সান্ত্বনা খুঁজে কোনও লাভ নেই। সত্যিটা নির্মম হলেও রূঢ় বাস্তবতা নিয়ে তার সামনে দাঁড়িয়ে, মুখ ফেরানোর আর কোনও উপায় নেই।

ফোন খুলে দেখল ইনবক্সে ঠিকানা পাঠিয়ে দিয়েছেন অবিনাশ রুদ্র। সল্টলেকের একটা বাড়ির ঠিকানা। ওই এলাকা ভালো করেই চেনে শান্তা। খুঁজে পেতে খুব একটা সমস্যা হবে না। মনে মনে ডিসিশন নিয়ে ফেলল, সত্যটাকে যাচাই করে দেখা দরকার। ঘরের পোশাক পালটে জিন্স আর টপ পরে নিল শান্তা। ঘর বন্ধ করে নেমে এল গ্যারেজে। গাড়ি বের করতে গিয়ে একবার মনে হল, এই দুর্যোগের রাতে এভাবে একা যাওয়াটা কি ঠিক হচ্ছে? পরক্ষণেই মনে হল, কাকে নেবে সাথে? যত বন্ধুই হোক, এসব খবরে এক ধরনের বিকৃত আনন্দ উপভোগ করে সবাই। তাছাড়া ওদের সুখী বিবাহিত জীবন নিয়ে জেলাসি করার লোকের অভাব নেই।

এখন এরকম একটা খবর ওদের হাতে এসে পড়লে জীবন অতিষ্ট করে ছাড়বে। সুতরাং খবরটার সত্যতা যাচাই তার নিজে করাই ভালো বলে মনে হল শান্তার। যাকে সাথে নিয়ে যাবে সেও তো দেখবে সত্যিটা, দেখেশুনে সে কি মৌন হয়ে থাকবে? কানাঘুষোয় ঠিক বেরিয়ে পড়বে সব। সেরকম কোনও বন্ধুর কথা মনে পড়ল না শান্তার, যে এই মুহুর্তে তাকে সাহায্য করতে পারে। দাঁতে দাঁত চেপে গাড়ি বের করে ফেলল শান্তা। সিচুযেশন যাই হোক নিজেই হ্যান্ডেল করবে। কঠিন পরিস্থিতি সে জীবনে কম দেখেনি!

অঝোর ধারায় বৃষ্টি শুরু হয়েছে আবার। রেইনকোট, ছাতা দুটোই সঙ্গে নিল শান্তা। ইস্টার্ন বাইপাস ধরে গাড়ি চলল যথাসম্ভব দ্রুত বেগে। ড্রাইভিংটা খারাপ করে না শান্তা। প্রথমে শেখার ইচ্ছেই ছিল না, সুমিত জোর করে ভর্তি করে দিয়েছিল পরিচিত একটা ড্রাইভিং স্কুলে। বলেছিল আমরা দুজন মানুষ, কত ধরনের বিপদ আপদ হয়, রাতবিরেতে কিছু হলে কোথায় ড্রাইভার খুঁজে বেড়াবে? শেষ পর্যন্ত এই কাজে লাগছে! মেজাজটা তিরিক্ষে হয়ে উঠল শান্তার। স্পিড বাড়িয়ে দিল আরও।

অন্যদিনের তুলনায় আজ গাড়ির ঢল অনেকটা কম। নিজ নিজ বাড়িতে বর্ষা রাতের মজা উপভোগ করছে শহরবাসী। একটু আগে শান্তাও সেটাই করছিল। একটা ফোন এসে দমকা বাতাসের মতো এতদিনের বিশ্বাসকে এক নিমেষে তছনছ করে দিয়ে গেল। এই বিশ্বাস আর কি ফিরে আসবে কোনও দিন! ভেতরটা মুচড়ে উঠল কিন্তু চোখ ঝাপসা হতে দিল না কিছুতেই।

এই এলাকাটা বেশ নির্জন। বাড়ি আছে বটে কিন্তু বাইরে কোনও লোকজন নেই। ঠিকানা কনফার্ম করার জন্য কাউকে জিজ্ঞেস করবে তার কোনও উপায় নেই। নিরুপায় হয়ে শান্তা ফোন করল অবিনাশ রুদ্রকে। ওর ইন্সট্রাকশন অনুযাযী সামনের মোড় ঘুরতেই দেখতে পেল হলুদ রঙের ছিমছাম দোতলা বাড়িটা। এটাই তাহলে পায়েল মিত্রের বাড়ি! মিস্টার সুমিত সেনের শান্তির জায়গা! একরাশ ঘৃণা ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাইল যেন শান্তার গলা দিয়ে। তেতো ঘৃণাটাকে গলাধঃকরণ করে নিয়ে শান্তা বলল, আপনি আসছেন তো?

আমার আসাটা কি ঠিক হবে ম্যাডাম? ব্যাপারটা আপনাদের পার্সোনাল ম্যাটার… আগে আপনি গিয়ে ব্যাপারটা বুঝুন। সমস্যা হলে ডাকবেন, অবশ্যই যাব। আসলে আমি…

শান্তা ওকে থামিয়ে দিয়ে বলল, বুঝেছি… ঠিক আছে আমি দেখছি।

 

রাস্তার ধার ঘেঁষে গাড়ি দাঁড় করাল শান্তা। গাড়িতে বসেই রেইনকোট পরে নিল। আশেপাশের বাড়িগুলোতে আলো জ্বলছে। তবে রাস্তায় একটা লোকও নেই। পুরো শুনশান। গাড়ির দরজা খুলে বাইরে বের হতেই বৃষ্টি-ভেজা হাওয়ার ঝাপটা লাগল মুখে। এলোপাথাড়ি বৃষ্টি রেইনকোট ভেদ করে ভিজিয়ে দিচ্ছে শরীর। ছাতাটাও খুলে নিল শান্তা। প্রায় দৌড়ে বাড়ির গেটের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। গেটের গ্রিলে হ্যাজবোল্ট লাগানো। তবে কোনও তালা লাগানো নেই। হ্যাজবোল্ট খুলে ভেতরে ঢুকে পড়ল শান্তা। গেট পেরিয়ে একফালি লন। নানা রকম দেশি-বিদেশি গাছের সম্ভার। একটা সময় শান্তারও খুব গাছের শখ ছিল। নানা কাজের চাপে সেসব হারিয়ে গিয়েছে।

কলিং বেল টিপল। দুতিনবার টেপার পরেও কোনও সাড়া পাওয়া গেল না। ভেতরে আলো জ্বলছে, তার মানে লোক তো অবশ্যই আছে। তবে কি ওরা বুঝে গিয়েছে, শান্তা এখানে এসে পড়েছে? বারান্দায় কোনও সিসিটিভি ক্যামেরা লাগানো আছে কিনা ভালো করে দেখল শান্তা। কিন্তু সেরকম কিছু নজরে পড়ল না। এমনও হতে পারে হিডেন ক্যামেরা লাগানো আছে। সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে আরও দুবার কলিং বেল টিপল। কোনও সাড়া নেই। দরজায় কড়া নেড়ে বেশ জোরেই ডাকল এবার, ভেতরে কেউ আছেন?

না এভাবে ওরা সাড়া দেবে না। দরজায় বেশ জোরে ধাক্কা দিল শান্তা। কাপুরুষ কোথাকার! ধরা পড়ার ভয়ে লুকিয়ে পড়েছে অন্য একটা মেয়ে শাড়ির আঁচলের তলায়! কিন্তু কী আশ্চর্য! ধাক্কা দিতেই দরজা হাট করে খুলে গেল। শান্তা ভেবে পেল না, এটা কী ধরনের কাণ্ড হল? যদি ওরা টেরই পেয়ে থাকে তবে দরজা খুলে রাখবে কেন? নাকি কোনও গোপন পথে পালিয়ে গিয়েছে?

পায়ে পায়ে ভেতরে ঢুকে পড়ল শান্তা। সুসজ্জিত ড্রযিংরুম। ড্রযিংরুম পেরিয়ে প্রশস্ত হলঘর। দুদিকে বেডরুম। মাঝ বরাবর সিঁড়ি। মেজেনাইন ফ্লোর পর্যন্ত আলাদা একটা ঘোরানো সিঁড়ি। সবগুলো ঘরেই আলো জ্বলছে, অথচ মানুষের কোনও সাড়া শব্দ নেই। এবার কী করবে, কিছুই বুঝে উঠতে পারল না শান্তা। আবার ফোন করল অবিনাশ রুদ্রকে।

এটা কী হল? আমার সাথে এসব করলেন কেন? আমারই ভুল… একজন অচেনা অজানা লোককে বিশ্বাস করে…

অবিনাশ রুদ্রের গলায় অবিশ্বাসের সুর, ওরা নেই ভিতরে? হতেই পারে না, আমার ইনফরমেশন কখনও মিথ্যে হয় না! আমি নিজের চোখে দেখেছি। আপনি ভালো করে দেখুন।

শান্তা বিরক্ত গলায় বলল, আর দেখার কিছু নেই। ফাঁকা বাড়ি, খোলা দরজা, একটা লোকেরও সাড়াশব্দ নেই। এভাবে আমাকে হ্যারাস করার জন্য আপনাকে পস্তাতে হবে। আপনি আমাকে চেনেন না অবিনাশবাবু।

বিশ্বাস করুন ম্যাডাম, আমি কোনও ভুল ইনফরমেশন দিইনি। আপনি ভালো করে দেখুন। ওরা যদি পালিয়ে গিয়ে থাকে কোনও না কোনও সূত্র অবশ্যই পাবেন। আমি ফোনে আছি, আপনি দেখুন…।

এভাবে অন্যের বাড়িতে ঢুকে সার্চ করা আমার ভালো লাগছে না। তবুও এতটা এসেছি যখন একবার দেখছি। এই মুহূর্তে ড্রযিংরুমে দাঁড়িয়ে আছি। সেরকম সন্দেহজনক কিছুই নজরে পড়ছে না। দেয়ালে এক বয়স্ক দম্পতির ছবি টাঙানো রয়েছে, ওঁরা কারা?

আমি কী করে বলব? পায়েল মিত্রের বাবা-মা হতে পারেন। এরপরে কোন ঘর?

হলঘর… তারপরে পরপর তিনটি বেডরুম। হলঘরে এসেছি। সোফা, আলমারি, শো কেস, টি টেবিল এসব দিয়ে ভর্তি।

তাহলে আপনি বেডরুমে যান। ওরা পালালেও বেশিক্ষণ হয়নি, তাজা প্রমাণ কিছু না কিছু ঠিক পাবেন। গো ফাস্ট।

ঢুকেছি। একদম সামনের বেডরুমে আছি এই মুহুর্তে। কেমন জানি একটা ভ্যাপসা গন্ধ বের হচ্ছে ঘরটা থেকে। মনে হয় কেউ শোয় না এই ঘরে। দীর্ঘ দিন ফাঁকা পড়ে থাকলে যেমন গন্ধ হয় ঠিক সেরকম।

তাহলে পরেরটায় যান।

এসেছি। সুযোগ পেয়ে ভালোই বাঁদর নাচাচ্ছেন। এখানে তো উলটো কেস। বিছানা পুরো এলোমেলো। মনে হয় কেউ শুয়েছে কিন্তু শোওয়ার পর আর বিছানা গুছিয়ে রাখেনি। এখানে কোনও কিছুই নেই যেটা আপনার তাজা প্রমাণ হতে পারে।

শেষ বেডরুমটা দেখুন। লাস্ট ট্রাই। ওখানেও যদি কিছু না পান তাহলে আমি দোষ স্বীকার করে নেব। আপনি যা শাস্তি দেবেন মাথা পেতে নেব। মিথ্যে বলে আমার কী লাভ ছিল বলুন? আমি আপনার ভালোর জন্যই…

ভালো করতে গিয়ে আমার কতটা ক্ষতি করে দিলেন আপনি জানেন? আপনাকে আমি জেল খাটিয়ে ছাড়ব। এক সেকেন্ড… ওখানে ওটা কী?

আপনি কী পরের ঘরে ঢুকে পড়েছেন? মনে হচ্ছে কিছু একটা পেয়েছেন! পেতেই হবে… আমি নিশ্চিত জানি, ওরা ওই বাড়িতেই ছিল। কী পেলেন ম্যাডাম?

আহা… অত উতলা হচ্ছেন কেন? আমাকে ভালো করে দেখতে দিন আগে। দুটো চায়ের কাপ… অর্ধেক চা রয়েছে দুটো কাপেই। পাশে বিস্কুটের টুকরো। মনে হয় কিছুক্ষণ আগেই কেউ খেয়েছে। টেবিলের ওপাশে ওটা কী? আমার ছবি… আশ্চর্য আমার ছবি এখানে এল কী করে!

কী, এবার নিশ্চয়ই কনফার্ম হলেন, আমি মিথ্যে বলিনি। একটু আগে তো হাত দিয়ে আমার গর্দান নিতে যাচ্ছিলেন। এবার বিশ্বাস হল তো?

স্ট্রেঞ্জ! ছবির উপর এগুলো কী? কিছু একটা লেগে রয়েছে যেন।

কী আবার হবে, বিস্কুটের গুঁড়োটুরো হবে হয়তো।

না না অন্য কিছু। দাঁড়ান একটু মুখে দিয়ে দেখি, জিনিসটা কী?

অদ্ভুত একটা শব্দ হল। তারপর সব চুপ।

অবিনাশ রুদ্র বেশ জোরেই বলে উঠলেন, কী হল ম্যাডাম? হঠাৎ চুপ করে গেলেন কেন? আর ইউ ওকে? অবশ্য যে ধাক্কাটা খেলেন, কথা বলবেনই বা কী করে? ভগবান আপনাকে শান্তি দিন।

দুই

আইসি প্রিয়প্রসাদ দেব গম্ভীর মুখে সাব ইন্সপেক্টর উত্তম সাহার দিকে তাকিয়ে বললেন, ব্যাপারটা কিছু বুঝতে পারছেন সাহাবাবু?

ভীষণ গোলমেলে লাগছে স্যার। সত্যি কথা বলতে আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। ভদ্রমহিলা এখানে থাকেন না। এখানকার কেউ দেখেওনি তাকে। এই বাড়ির সাথে কোনও কানেকশন নেই। অথচ উনি দুর্যোগের রাতে এখানে এলেন এবং মারা পড়লেন। এখানে এলেনই বা কেন? আর মারাই বা পড়লেন কেন? এটা খুন না আত্মহত্যা, সেটাও তো বোধগম্য হচ্ছে না।

আইসি দেব অন্যমনস্ক ভাবে বললেন, প্রাথমিক রিপোর্ট অনুযাযী এটা খুন তাতে কোনও সন্দেহ নেই। তবে কীভাবে খুন হলেন সে বিষয়ে যথেষ্ট ধোঁয়াশা রয়েছে। বাইরে ওর গাড়ি দাঁড় করানো। সম্ভবত নিজেই গাড়ি চালিয়ে এখানে এসেছিলেন। লাশের পাশে ওর মোবাইল পড়ে রয়েছে। আত্মহত্যার জন্য অজানা অচেনা একটা বাড়িতে এসে পড়বেন, এটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে উনি এখানে এসেছিলেন অথবা ওকে ডেকে আনা হয়েছিল। আমার অনুমান মিথ্যে না হলে এটা নিঃসন্দেহে প্রি-প্ল্যানড মার্ডার। যাই হোক ঘরটা সার্চ করে কিছু পাওয়া গেল?

সেরকম কিছু না। সার্চ চলছে।

পুরো বাড়িটা ভালো করে দেখুন। যে-ঘরে খুন হয়েছে লাশ নিয়ে যাবার পর সিল করে দিন। একটা জিনিসেও কেউ হাত না দেয়। বাড়ির মালিক কোথায়?

বাইরের ড্রযিংরুমে বসে আছেন। ইযং ছেলে। ভয়ে রীতিমতো কাঁপছেন।

ঠিক আছে, আমি ওর সাথে কথা বলছি, আপনি এদিকটা দেখুন।

পায়ের শব্দ পেয়ে চমকে উঠলেন বাড়ির মালিক। চোখে মুখে আতঙ্ক মেশানো বিস্ময়। আইসি দেবকে দেখে উঠে দাঁড়ালেন। আইসি বললেন, রিলাক্স মিস্টার…

দেবদূত… দেবদূত ঘোষ।

আপনি এই বাড়ির মালিক?

আজ্ঞে না স্যার। এই বাড়ির মালিক আমার মেসোমশাই ধীমান তালুকদার। আমি তো জাস্ট বাড়ি পাহারা দিচ্ছিলাম। এভাবে ফেঁসে যাব স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি। এরকম একটা কাণ্ড ঘটবে জানলে কিছুতেই রাজি হতাম না। বিশ্বাস করুন স্যার আমি কিচ্ছু জানি না, কিচ্ছু করিনি।

তাহলে অত ভয় পাচ্ছেন কেন? আপনি সবকিছু একটু খুলে বলুন প্লিজ। আমাকে একটু বুঝে নিতে দিন।

বলছি স্যার। বাড়িটা আমার মেসোমশাইয়ের। ওরাই থাকেন এখানে। ওদের দুই ছেলে বিদেশে থাকে। গত পরশু মাসি মেসো দুর্গাপুরে গিয়েছেন একটা বিয়ের নেমতন্ন রক্ষা করতে। ওরা যখন বাইরে কোথাও যান, আমি রাতে এসে এখানে থাকি। বলতে পারেন পাহারা দিই আর কী। দেখতেই পাচ্ছেন এদিকটা একটু নির্জন। ফাঁকা বাড়ি পেলে মাঝে মাঝেই চুরিটুরিও হয়। এর আগেও অনেকবার থেকেছি। কোনও দিন কিছু হয়নি। কিন্তু এবার…

দুহাতে মুখ ঢাকলেন দেবদূত। সাতাশ-আটাশ বছরের গাট্টা গোট্টা যুবক। জিম করা শরীর। টাইট গেঞ্জি ভেদ করে পেশিগুলো ফুটে উঠেছে। চওড়া মুখমণ্ডল। একটু ভোঁতা টাইপের নাক। গালে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। সামনের দিকের চুল বেশ হালকা।

দেখুন দেবদূতবাবু এসব ঘটনা তো বলেকয়ে ঘটে না। আপনার অবস্থাটা বুঝতে পারছি। তবে অযথা ভয় পাবেন না। আপনি যদি কিছু না করে থাকেন তবে আপনার কোনও ভয় নেই। পুলিশ আপনার পাশে থাকবে। কিন্তু যেহেতু এই ঘটনার সঙ্গে আপনি সরাসরি জড়িয়ে আছেন, কিছু প্রশ্নের মুখোমুখি হওয়া, কিছু আইনি ফর্মালিটি মেনে চলতেই হবে। আমি আশা রাখি আপনি সব রকমের সহযোগিতা করবেন।

নিশ্চয়ই স্যার।

আপনি আজ সকাল কটার দিকে এখান থেকে বেরিয়েছিলেন?

সাড়ে নটা-দশটা হবে। অন্যদিন আগেই উঠে পড়ি, আজ বৃষ্টির জন্য ঘুম ভাঙতে একটু দেরি হয়ে যায়। সকালে চা খেয়ে কোনও রকমে স্নান সেরেই বেরিয়ে পড়ি।

আপনি কী করেন?

ফুলবাগানে আমার একটা ভ্যারাইটি স্টোর্স আছে স্যার।

আর আপনাদের বাড়িটা কোথায়?

ফুলবাগানেই স্যার। উপেন্দ্র কিশোর সরনিতে।

এখান থেকে যাওয়ার পর কী কী করেছেন একটু ডিটেলসে বলুন।

এখান থেকে সোজা বাড়িতে যাই। কিছু খেয়ে চাবি নিয়ে দোকানে চলে যাই। আমার দোকানের কর্মচারী রাজেশ একটু দেরিতে আসায় আমি নিজেই দোকান খুলে ঝাড়াপোছা করে ধূপধুনো দিই। রাজেশ এলে দোকানে বসিয়ে আমি কিছু দরকারি কাজ সারতে বাইক নিয়ে বেরিয়ে পড়ি। ফিরতে ফিরতে অনেকটা বেলা হয়ে যায়। রাজেশ খেয়ে আসার পর আমিও খেতে চলে যাই বাড়িতে। খাওয়ার পর কিছুটা বিশ্রাম নিয়ে আবার চলে আসি দোকান। আটটার দিকে দোকান বন্ধ করে বাড়ি গিয়ে মাকে তাড়াতাড়ি খেতে দিতে বলি। কারণ বৃষ্টির জন্য আমি এখানে আসতে দেরি করতে চাইছিলাম না। তবুও বেরোতে বেরোতে সাড়ে নটা বেজে গেল। বাবা মা দুজনেই বলেছিল, এই দুর্যোগের মধ্যে আজ আর যাওয়ার দরকার নেই। কিন্তু আমি শুনিনি। আমার ভয় ছিল, কিছু একটা অঘটন ঘটে গেলে ওদের কাছে মুখ দেখাতে পারব না। দাযিত্বটা আমি নিজে থেকেই নিয়েছিলাম। কিন্তু এরকম একটা অঘটন ঘটবে… আমি এখনও বিশ্বাস করতে পারছি না। সবকিছু একটা দুঃস্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে।

এখানে এসে কী দেখলেন?

দেখি সামনের গ্রিলের গেট কিছুটা খোলা। বাড়ির সামনে একটা দামি গাড়ি দাঁড় করানো। বারান্দায়, ভেতরে সব জায়গায় লাইট জ্বলছে। ভীষণ অবাক লাগল। কারণ সকালবেলা বেরিয়ে যাওয়ার সময় আমি নিশ্চয়ই লাইট জ্বেলে যাইনি, তবে কীভাবে জ্বলল? একবার মনে হল, তাহলে নিশ্চয়ই মেসো-মাসি ফিরে এসেছেন। কারণ বাড়ির চাবি একটা আমার কাছে আর একটা ওদের কাছে থাকে। তবুও খটকা গেল না। মেসোমশাই ভীষণ প্যাংচুয়াল লোক, এই রকম দুর্যোগের রাতে আমাকে এরকম হয়রানি করাবেন বলে বিশ্বাস হচ্ছিল না। যদি এসেই থাকেন তাহলে নিশ্চয়ই ফোন করে সেকথা জানিয়ে দিতেন। একথা ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ মনে হল, চোর ঢোকেনি তো? পরক্ষণেই মনে হল, চোর কখনও লাইট জ্বেলে চুরি করে? বাইরের দামি গাড়িটাও সংশয়ে ফেলে দিল। আর বেশি না ভেবে ভেতরে ঢুকে পড়লাম। একরাশ বিস্ময় নিয়ে এ-ঘর ও-ঘর করতে করতে পৌঁছে গেলাম ওই বেডরুমে যেখানে লাশটা পড়ে ছিল। পড়ে থাকার ভঙ্গিমা দেখেই বুঝেছিলাম দেহে প্রাণ নেই। এতটাই ঘাবড়ে গিয়েছিলাম যে কী করব, কী করা উচিত কিছুই বুঝে উঠতে পারিনি প্রথমে। একটু পরে বাবা আর ভাইকে ফোন করে সব জানালাম। ওরা বলল, তুই এক্ষুনি পুলিশকে ফোন কর, আমরা আসছি। ফোন করার পনেরো কুড়ি মিনিটের মধ্যেই আপনারা চলে এলেন।

আপনি লাশ দেখেছেন, মহিলাকে চেনেন?

জীবনে কোনও দিন দেখিনি স্যার। চেনা তো দূরের কথা। উনি কেন এখানে এলেন? কীভাবে মরলেন? কিছুই বুঝতে পারছি না।

প্রাথমিক ভাবে মনে হচ্ছে বিষ প্রযোগে হত্যা। পোস্টমর্টেম রিপোর্ট না পাওয়া পর্যন্ত কোনও কিছুই কনফার্ম বলা যাবে না। শুধু শুধু তো কেউ খুন হয় না, মোটিভ একটা থাকেই। ইনভেস্টিগেশন শুরু হয়েছে, ধীরে ধীরে সব বেরিয়ে আসবে।

ঘরে ঢুকলেন একজন তরুণ পুলিশ অফিসার। আইসি দেবের দিকে তাকিয়ে বললেন, লাশ আইডেন্টিফাই করা গিয়েছে স্যার। সি ওয়াজ শান্তা কুলকার্নি। স্বামীর নাম সুমিত সেন। দুজনেই সফটওয্যার ইঞ্জিনিয়ার। ওর মোবাইল থেকেই ডেটাগুলো পেয়েছি। গাড়িটা ওর হাজব্যান্ড সুমিত সেনের নামে।

আইসি দেব চিন্তিত মুখে বললেন, ওর স্বামীকে ফোন করেছিলেন?

হ্যাঁ স্যার। উনি এখন দিল্লিতে। দুদিন আগে একটা কনফারেন্সে যোগ দিতে গিয়েছেন। শুনে কান্নায় ভেঙে পড়লেন। আমি সান্ত্বনা দিয়ে বললাম, আপনি চলে আসুন অ্যাজ আর্লি অ্যাজ পসিবল।

খুব ভালো করেছ। গুড জব। ওকে আমাদের দরকার হবে। একটা বিষয় বারবার মনে স্ট্রাইক করছে, বুঝলে বিকাশ…

কোন বিষয় স্যার?

মোবাইলের বিষয়। যদি কেউ ওকে সাথে করে নিয়ে এসে থাকে তাহলে তার পক্ষে মোবাইলটা সরিয়ে দেওয়াটাই বেশি সেফটি ছিল না? তোমার কী মনে হয়?

আপনি ঠিকই বলেছেন স্যার। আমার হিসেবে এর পিছনে দুটো কারণ থাকতে পারে। প্রথমত, সে জানে মোবাইলে এমন কোনও ডেটা নেই যাতে সে বিপদে পড়তে পারে। দ্বিতীয়ত, পুলিশকে মিসগাইড করা। কোনও কিছু না পেয়ে কনফিউজড পুলিশও একসময় ভাবতে শুরু করবে, ইটস আ সুইসাইড কেস। আমার কিন্তু দ্বিতীয় সম্ভবনটাই বেশি জোরালো মনে হচ্ছে।

গুড অর্বজারভেশন। আমিও তোমার সাথে একমত। ইচ্ছে করেই মোবাইল সরানো হয়নি। তবে ওতে কিছুই নেই সেটা বলা যাবে না। ওটা থানায় নিয়ে চলো। আর মিত্রকে একটু পাঠিয়ে দাও ওর বয়ানটা লিখে নিক। দেবদূতের দিকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বিকাশকে নির্দেশ দিলেন আইসি দেব।

তারপর দেবদূতকে বললেন, অনেক রাত হল। বয়ান লিখিয়ে আপনি বাড়ি চলে যেতে পারেন। এ বাড়ি আপাতত পুলিশ পাহারা দেবে। ফরেনসিক ভিজিট না হওয়া পর্যন্ত আমরা কোনও রকম রিস্ক নেব না। তবে এই মুহূর্তে আপনি শহর ছেড়ে কোথাও যাওয়ার চেষ্টা করবেন না। আপনার মেসোমশাইকে জানিয়েছেন ব্যাপারটা? না জানিয়ে থাকলে জানিয়ে দিন।

পরের দিন বিকেলেই থানায় হাজির হলেন সুমিত সেন। বিধ্বস্ত চেহারা। চোখের নীচে কালি। সঙ্গে তার এক বন্ধু এসেছেন। আইসি দেব তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পরখ করে নিলেন একবার। দীর্ঘকায় সুদর্শন যুবক। ত্রিশ বত্রিশ বছর বয়স হবে হয়তো। বেশ ফর্সা গায়ের রং। একমাথা ঝাঁকড়া চুল। টিকালো নাক। গালে একদিন বা দুদিনের না কাটা দাড়ির কালচে আভাস। চশমা বারবার ভিজে যাচ্ছে চোখের জলে।

আইসি দেব গম্ভীর মুখে বললেন কন্ট্রোল ইওরসেল্ফ মিস্টার সেন। ঘটনাটি আপনার কাছে কতটা বেদনাদায়ক, বুঝতে পারছি। সরি টু সে, ইটস আ কোল্ড ব্লাডেড মার্ডার বলেই মনে হচ্ছে আমাদের। ইনভেস্টিগেশন শুরু হয়েছে। আশা করি খুব শীঘ্রই সত্যটা বেরিয়ে আসবে। এবিষয়ে আপনার কিছু বলার আছে?

আমি কিছুই বুঝতে পারছি না অফিসার। শান্তা ভীষণ মিশুকে স্বভাবের মেয়ে ছিল। কখনও কোনও কনট্রোভার্সিতে জড়াত না। অসম্ভব হেল্পফুল মেন্টালিটি। ওকে কেউ কেন খুন করতে যাবে?

তাহলে তো ধরে নিতে হয় উনি সুইসাইড করেছেন। সেরকম কোনও কারণ আছে বলে কি আপনি মনে করেন?

না। সুইসাইড করার মতো কোনও কারণও আমি দেখছি না। সবসময় পজিটিভ চিন্তা করত। কখনও ডিপ্রেসড হতে দেখিনি।

আইসি দেব মৃদু হেসে বললেন, বিনা কারণে এই জগতে কিছু হয় না। অকারণটাও একটা কারণ হয়ে যায় কোনও কোনও সময়। আপনাকে এই মুহূর্তে খুব টায়ার্ড লাগছে, তাই বেশি বিরক্ত করব না।

বেল টিপে কাউকে ডাকলেন আইসি দেব। পাশের ঘর থেকে উত্তম সাহা এলে তাকে বললেন, সাহাবাবু আপনি ওদের বুঝিয়ে দিন। আপনারা ওনার সাথে যান, কিছু জরুরি ফর্মালিটিজ করতে হবে।

পোস্টমর্টেম রিপোর্ট-এ আইসি দেবের ধারণাই সত্যি প্রমাণিত হল। পটাশিয়াম সায়ানাইডে মৃত্যু হয়েছে শান্তা কুলকার্নির। ফরেনসিক এক্সপার্টরাও ওই ঘর থেকে তার নমুনা পেয়েছে। টি টেবিলে শান্তার যে ছবিটা পাওয়া গিয়েছে তাতেই ছিল বিষের ছোঁয়া। সেখান থেকেই আঙুলে করে নিজের মুখে পুরেছিলেন নিজের মৃত্যুর কারণ। শান্তার ডান হাতের তর্জনীর মাথাতেও পাওয়া গিয়েছে বিষের অস্তিত্ব। কিন্তু ওই ঘরে দেবদূত ছাড়া আর কোনও সন্দেহজনক ব্যক্তির ফরেনসিক প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তাহলে বিষ মেশানো ছবিটা ওখানে রাখল কে? দেবদূত? নাকি শান্তা নিজেই? তাই যদি হয় তবে এটা নিঃসন্দেহে আত্মহত্যার কেস।

চিন্তান্বিত মুখে চায়ের কাপে চুমুক দিলেন আইসি দেব। উলটো দিকে বসে আছেন উত্তম সাহা। তার মুখেও চিন্তার ছাপ। হঠাৎ বলে উঠলেন, আপনি কী দেবদূতকে সন্দেহ করছেন স্যার?

কিছুটা হলেও করতে বাধ্য হচ্ছি সাহাবাবু। ওই ঘরে যদি অন্য কেউ ঢুকে না থাকে তাহলে বিষ মেশানো ছবিটা রাখল কে? ছবিটা প্ল্যান করে আগে থেকেই কেউ রেখেছিল। কারণ শান্তা কুলকার্নি গাড়ি করে বিষ সমেত ছবি নিয়ে এসে আবার নিজেই সেই বিষ চেখে দেখবেন, সেটা তো হতে পারে না, তাই না?

তা ঠিক। তবে এটাও ঠিক ফরেনসিক টিমকে ধোঁকা দেওয়া কী খুব কঠিন কাজ? পাকা ক্রিমিনালরা কী দিয়ে কী হয়, কোনও কোনও ক্ষেত্রে পুলিশের চেয়ে বেশি জানে। আমি কী বলতে চাইছি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন স্যার।

ইয়েস। পয়েন্টটা আপনি বেশ ভালো ধরেছেন। আর এসব প্রমাণ লোপাটের জন্য অফুরন্ত সময়ও সে পেয়েছে। এবার প্রশ্ন আসছে, শান্তা কুলকার্নি হঠাৎ করে এই বাড়িতে এলেন কী করে? এমনও হতে পারে কোনও মিথ্যে ইনফরমেশন দিয়ে তাকে এবাড়িতে ডেকে আনা হয়েছিল।

আমারও কিছুটা সেরকমই মনে হচ্ছে। কিন্তু একটা খটকা আছে। শান্তার তর্জনীর মাথায় লেগে থাকা বিষ প্রমাণ করে, সে নিজেই নিজের মুখে বিষ পুরেছিল। এমন নয় তো, ওকে ভুল বুঝিয়ে মানে ওটা কোনও খাদ্যবস্তু, এসব বলেটলে খাওয়ানো হয়েছিল বিষটা?

হতেই পারে। আমাদের এখন প্রথম কাজ হল, শান্তা এবাড়িতে কেন এসেছিলেন সেটা খুঁজে বের করা। এই প্রশ্নের উত্তর পেলে অনেক কিছুই পরিষ্কার হয়ে যাবে। আপনি একটা কাজ করুন, সুমিত সেনের ব্যাকগ্রাউন্ড যাচাই করুন। আর সেই সাথে দেবদূতের পেছনে একজন ইনফর্মার লাগিয়ে দিন। সব রকম ট্রাই করতে হবে আমাদের।

এই সময় হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢুকলেন সাব ইন্সপেক্টর বিকাশ। আইসি দেব ওকে সামনের চেয়ার দেখিয়ে বললেন, বোসো বিকাশ। তোমাকে খুব এক্সাইটেড লাগছে। এনিথিং রং?

বিকাশ বলল, তা বলতে পারেন। শান্তা কুলকার্নির মোবাইল থেকে একটা দারুণ জিনিস পাওয়া গিয়েছে স্যার।

কী জিনিস?

শান্তা ওর মোবাইলে লাস্ট কল রেকর্ড করেছিলেন। মৃত্যুর সময়, ওই কল টাইম, সব মিলে যাচ্ছে। এইমাত্র আমি পুরোটা শুনে এলাম। সাইবার এক্সপার্ট বিশ্বাসকে বলে এসেছি আপনার মোবাইলে পাঠিয়ে দিতে। শুনলে আপনি চমকে যাবেন। অবিনাশ রুদ্র নামে একজন ব্যক্তি শান্তাকে ডেকে এনেছিলেন এই বাড়িতে। পায়েল মিত্র নামে একটা মেয়ের সাথে ওর স্বামী সুমিত সেনের পরকীয়া ধরিয়ে দেবেন বলে। শান্তা তার কথা বিশ্বাস করে চলে আসেন। অবিনাশ ফোনে ফোনেই ওকে নিয়ে যান ওই ঘর পর্যন্ত। কথায় কথায় শান্তাকে দিয়ে বিষটা খাওয়ান। সম্পূর্ণ অভিনব পদ্ধতিতে খুন, অন লাইন মার্ডার। ক্রাইম ইতিহাসে বোধহয় প্রথম। ওদের কথাবার্তা শুনে আমি তো স্টান্ট হয়ে গিয়েছি স্যার। হোয়াট আ ব্রেন!

মোবাইল বেজে উঠল বিকাশের। পকেট থেকে বের করে স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে বলল, বিভাসের ফোন। মনে হয় পাঠিয়ে দিয়েছে স্যার। আপনি মোবাইল খুলুন। আমি ওকে বলে এসেছিলাম পাঠানো হলে একটি মিসকল দিস।

মোবাইল খুলে নোটিফিকেশন দেখে আইসি দেব বললেন, হ্যাঁ, পাঠিয়েছে মনে হচ্ছে। দাঁড়াও ওপেন করি।

তিনজনে গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনতে লাগলেন অবিনাশ রুদ্র ও শান্তা কুলকার্নির রেকর্ড করা কথোপকথন। শেষ হবার পর আইসি দেবের কোঁচকানো ভ্রু স্বাভাবিক হতে অনেকটা সময় লাগল।

উত্তম সাহা প্রথম কথা বললেন, এ তো মারাত্মক ব্যাপার স্যার। রীতিমতো লোকেশন সেট করে চিত্রনাট্য মেনে সিনেমা বানানোর মতো ব্যাপার। বিকাশ ঠিকই বলেছে। একদম অভিনব স্টাইল। পাকা মাথার কাজ। সবচেয়ে বড়ো কথা, শান্তা ম্যাডাম বুদ্ধি করে কল রেকর্ড না করলে কিছুই বুঝতে পারতাম না।

আইসি দেব বললেন, অবিনাশ রুদ্র লোকটা কে? ওই নম্বর ধরে কিছু বের করতে পেরেছ বিকাশ?

সিমটা অবিনাশ রুদ্রের নামেই আছে। কিন্তু সেই অবিনাশ রুদ্র এক বছর আগে মারা গিয়েছেন। বুঝতেই পারছেন ব্যাপারটা কী হয়েছে? সুতরাং এই সূত্র ধরে এগোনোর রাস্তা নেই ধরে নেওয়া যায়।

আইসি দেব আপন মনেই বলে উঠলেন, আমার মনে হয় এই কল রেকর্ডের ব্যাপারটা নকল অবিনাশ রুদ্র জানে না। হয়তো তার ভাবনাতেও আসেনি শান্তা একরকম একটা কাণ্ড করে বসবে। তাহলে ফোনটা কিছুতেই রেখে যেত না।

বিকাশ বলল, আমারও তাই মনে হচ্ছে স্যার। এই অ্যাডভান্টেজ আমাদের কাজে আসতে পারে।

একদম ঠিক বলেছ। তবে ব্যাপারটা আপাতত গোপন রাখতে হবে। কাউকে কিচ্ছু বলার দরকার নেই। বিকাশ তুমি শান্তার ফোন থেকে পুরো এক মাসের কলারস লিস্ট বের করে দিতে বলো ওদের। তারপর সেটা ভালো করে ভেরিফাই করো। সামান্য কোনও সন্দেহজনক কিছু পেলেই আমাকে দেখাও। আমার মন বলছে, এটা কিন্তু আর পাঁচটা সাধারণ খুনের কেস নয়, এর পিছনে বড়োসড়ো কোনও ষড়যন্ত্র লুকিয়ে আছে।

তিন

কয়েক দিন যেতে না যেতেই আবার খুন। একই স্ক্রিপ্ট, শুধু লোকেশনটা আলাদা। এবার পদ্মপুকুর থেকে একটু ভেতরে, সদ্য নির্মিত একটি ফ্ল্যাটে। লোকাল থানার আইসি সরাসরি সুইসাইড কেস বলে দেগে দিয়েছেন। খবরটা সংবাদপত্রে খুব ছোট্ট করে ছাপা হয়েছে। ইলেকট্রনিক্স মিডিয়াও সেরকম কোনও গুরুত্ব দেয়নি।

কিন্তু খবরটা পড়েই নড়েচড়ে বসলেন আইসি দেব। বিকাশ আর উত্তম সাহা ঢুকতেই খবরের কাগজটা দেখিয়ে বললেন, আমার কথা কেমন মিলে গেল দেখলে? এখনও পাবলিক, মিডিয়া সেভাবে বুঝে উঠতে পারেনি। তবে সেটা হতে আর বেশি বাকি নেই। ওরা খেপলে পুলিশের ঘুম মাথায় উঠবে, তুমি মিলিয়ে নিও।

বিকাশ গম্ভীর মুখে বলল, লোকাল থানার আইসি ব্যাপারটা এত লাইটলি নিলেন কেন, বুঝে উঠতে পারছি না। উনি কি কিছুই বুঝতে পারলেন না?

কী জানি। কিন্তু আমার মনে হয় উনি ভুল করছেন। এখনই এই কেস নিয়ে সিরিয়াসলি না ভাবলে, পরে পুরো পুলিশ ডিপার্টমেন্টকে ল্যাজে গোবরে হতে হবে। আমাদের থানাতেই যেহেতু প্রথম কেস, আমাদেরকেই বেশি ইনিশিয়েটিভ নিতে হবে। যাতে ভবিষ্যতে এক্সপ্ল্যানেশন দিতে কোনও অসুবিধায় পড়তে না হয়।

আপনার কথা একদম সত্যি স্যার। আপনি লিড করুন, আমরা তদন্তে কোনও ফাঁক রাখব না।

গুড। সাহাবাবু আর মিত্রকে ডাকো। সবাই মিলে একটু ডিসকাস করে নিই। একটা গাইডলাইন ঠিক করে নেওয়া দরকার।

তিনজন অফিসারকে নিয়ে জরুরি বৈঠকে বসলেন আইসি দেব। পদ্মপুকুরের ঘটনা উল্লেখ করে প্রথমেই বললেন, এটাকে আর বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলতে রাজি নই আমি। একই পদ্ধতিতে দু-দুটো খুন, আর যে হবে না গ্যারান্টি দিয়ে বলা যাবে না। তাই নতুন করে কিছু ঘটার আগেই আমাদের তদন্ত শেষ করতে হবে।

উত্তম সাহা বললেন, এ বিষয়ে আপনি কিছু ভেবেছেন স্যার?

হ্যাঁ। কীভাবে এগোব, কাদের সাহায্য নেওয়া যেতে পারে, এসব নিয়ে মনে মনে একটা প্ল্যান করেছি। আমার মনে হয় দুটো খুনের মধ্যে অবশ্যই একটা লিঙ্ক আছে। পদ্মপুকুরের ভিকটিম এরকম কোনও ফোন পেয়েছিল কিনা, তিনিও কল রেকর্ড করেছিলেন কিনা এইসব তথ্যগুলো আমাদের জানা দরকার।

মিত্র বললেন, চান্স কম। হঠাৎ করে কোনও আজেবাজে কল এলে কজন আর সেটা রেকর্ড করার কথা ভাবে?

আইসি দেব বললেন, শান্তার উপস্থিত বুদ্ধির জন্য আমরা এটা পেয়েছি। আমার মনে হয় ওরা এরকম কিছু পায়নি। পেলে ওখানকার আইসি হুট করে সুইসাইড বলে দেগে দিতেন না। তোমার কী মত বিকাশ?

আমি আপনার সাথে একমত স্যার। নিশ্চয়ই ওরা ভিকটিমের ফোন কল ঘাঁটাঘাঁটি করে ফেলেছে এতক্ষণে। ওরা কতদূর কী জানল আমাদের জানা দরকার। দুটো ঘটনার মধ্যে আদৌ কোনও লিঙ্ক আছে কিনা, থাকলেও কতটা আছে, তার একটা আভাস পাওয়া যাবে। তাছাড়া মোটিভ অফ ক্রাইম সম্পর্কে কোনও ধারণাই নেই, সেটাও জানা দরকার। সব মিলিয়ে ওই ঘটনাটাকেও একসাথে বিশ্লেষণ করা জরুরি বলেই আমার মনে হয়।

ক্রমশ…

 

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...