কয়েদি

আজকাল শব্দটা সারা দিনরাত মাথার ভিতর বাজতে থাকে। ধুপ ধুপ ধুপ… আওয়াজটা ঘুমের মধ্যেও শুনতে পায় সরতাজ। রাত যত গভীর হয়, চারপাশের ক্রমবর্ধমান নৈঃশব্দের সাথে সাথে শব্দটার তীব্রতাও বাড়তে থাকে। মাথার ভিতরকার স্নায়ুগুলি যেন সব জট পাকিয়ে গেছে, মুক্তির আশায় প্রাণপণ টানছে, ছিঁড়ে বেরিয়ে যেতে চাইছে মাথার খুলি ভেদ করে। একটা বিস্ফোরণের অপেক্ষায় আছে সরতাজ। একটা ঘোরতর বিস্ফোরণ প্রয়োজন, যেটা তার নামের জায়গায় সেঁটে থাকা নম্বরটাকে ধ্বংস করে দেবে।

সরতাজ সিং, গাঁও সুলহানি, জেলা ফিরোজপুর, পঞ্জাব প্রদেশ। শব্দবন্ধগুলো মনে হয় যেন গত জন্মের কোনও বিস্মৃতপ্রায় অতীতের ছায়া। এখন সরতাজ শুধুই কয়েদি নম্বর একশো সাইত্রিশ। দিনের বেলা ঘন্টার পর ঘন্টা জেলের কমিউনিটি কিচেনের রাবণের চিতার মতো দাউদাউ করে জ্বলতে থাকা আগুনের সামনে দাঁড়িয়ে পাহাড়প্রমাণ ডেকচিতে ডাল সবজির জাউ রাঁধে সরতাজ। গনগনে ধোঁয়ায় চোখ জ্বালা করে। দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসে সরতাজ সিং-এর। সেই ধোঁয়ার ভিতরে কখনও কখনও একটা চেনা মুখ ভেসে উঠেই মিলিয়ে যায়।

বড়ো আবছা সে মুখ, এখন আর মনে পড়ে না স্পষ্ট। শুধু সেই ধোঁয়ার ভিতর থেকে ঝিকিয়ে ওঠা নাকছাবিটা স্পষ্ট দেখতে পায় সরতাজ। লম্বা ভারী হাতাটা ডালের ভিতর চালাতে চালাতে মাথার ভিতরটা প্রাণপণে হাতড়াতে থাকে সে। দরদর করে লবণাক্ত ঘাম গড়ায় তার মাথা, গলা, বুক, পিঠ বেয়ে জিভে ঠেকে নোনতা স্বাদ। সরতাজ এলোমেলো হয়ে জড়িয়ে যাওয়া স্মৃতির তন্ত্রী ঘেঁটে চলে। কবে কোথায় পথের কোন বাঁকে দেখা হয়েছিল সেই চেনা মুখের সাথে, কিছুতেই মনে পড়ে না।

এগারো বছর কম সময় নয়। সরতাজ সিং এগারোটা বছর এই জেলের উঁচু দেয়ালের ও-প্রান্তের পৃথিবীকে দেখেনি। আজকাল আর মনে পড়ে না বাইরের পৃথিবীর কথা। মাথার ভিতরে সব যেন ধোঁয়াটে লাগে। বেশি ভাবতে গেলে মাথায় খুব যন্ত্রণা হয়। দীর্ঘদিন ধরে জেলের ভেতরে অমানুষিক শারীরিক নির্যাতন চলেছে তার উপরে।

জেলের ডাক্তারসাহেব বলেছেন, সরতাজ সিং-এর মস্তিষ্কের স্নায়ুগুলো শুকিয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। স্মৃতিশক্তির উপর ঢেকে যাচ্ছে কুয়াশার অস্বচ্ছ আবরণ। আজকাল মাঝে মাঝে বুকের বাঁ দিকে অসহ্য যন্ত্রণা হয়। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে তখন। বয়স বাড়ছে সরতাজ সিং-এর। তার পাহাড়ের মতো বিশাল দেহটা দেখে নতুন কয়েদিরা সম্ভ্রমের দৃষ্টিতে তাকায়, পুরোনোরা মুখ দিয়ে চুক চুক শব্দ করে মাথা নাড়ে। আহা, এই সরতাজ সিং-এর নামে একদিন গোটা ফিরোজপুর জেলা কাঁপত। কত যে খুন জখম তোলাবাজির কেস ছিল তার নামে, সে হিসাব বোধ করি সে নিজেও রাখত না। ক্ষমতাসীন দল, বিরোধী দল সকলেই সমীহ করে চলত এই সরতাজ সিংকে।

সরতাজ সিং-এর কোনও দলের দরকার হতো না, দলেদের দরকার হতো তাকে। সে নিজেই ছিল একটা প্রতিষ্ঠান। সেসবও দিন ছিল, যখন সরতাজ সিং ছিল ফিরোজপুরের মুকুটহীন সম্রাট।

আজ আর সেই রামও নেই, সেই অযোধ্যাও নেই। সরতাজ সিং-এর সিংহের কেশরের মতো দাড়িতে পাক ধরেছে। কালোর মাঝে মাঝে রূপোলি রেখা ভেসে উঠেছে। তার সেই আগেকার রুক্ষ কঠোর দৃষ্টি আজকাল কেমন যেন ক্লান্ত, করুণ দেখায়। কখনও কোনও অলস বিকেলে জেলের হেঁশেলের বারান্দায় বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে আপন মনেই বিড়বিড় করে চলে সরতাজ। কী যে বলে, কাকে দোষারোপ করে কে জানে!

নিজের হাতের তালু উলটেপালটে দেখে। কী যেন খুঁজে চলে খাঁজে কড়া পড়া দুই হাতের রেখায়। কখনও আবার গলা ছেড়ে গান ধরে পঞ্জাবের মাটির সুরে। অন্য কয়েদিরা আসা যাওয়ার পথে থমকে দাঁড়ায় কিছু মুহূর্তের জন্য। অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে তার দিকে। সেই গান কান পেতে শোনেন আরেকজন, তিনি জেলর গগনজিত কপূর। মাথার ভিতরে সেই সুর গুমরে মরে তাঁরও। সরতাজ সিং-এর গান শুনে তিনিও ফিরে যান তাঁর ফেলে আসা অতীতে।

ভাতিন্ডা থেকে ফিরোজপুরে বদলি হয়ে এসে সরতাজ সিং-এর নাম কানে আসতে দেরি হয়নি গগনজিত কপূরের। তাঁকে এটাও বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছিল, জলে বাস করে কুমীরের সাথে শত্রুতা চলে না। সরতাজ সিংকে ভয় পায় না, এমন লোক ফিরোজপুরে নেই। সুতরাং নবাগত অফিসারকে যে সরতাজকে ভয় হোক বা সমীহ, কিছু একটা করতেই হবে তা তো বলে দেওয়ার অপেক্ষা রাখে না।

গগনজিত কপূরও শুরু শুরুতে সরতাজ সিংকে সমঝে চলার চেষ্টাই করেছিলেন। দেশি কাট্টা, ম্যাগাজিনের অবৈধ চোরাচালানের বিশাল রমরমা ব্যাবসা ছিল সরতাজ সিং-এর। পুলিশ, প্রশাসন সবাই ছিল তার হাতের মুঠোয়। ভোটের আগে ক্ষমতাসীন ও বিরোধী, দুই দলের ফান্ডেই সরতাজ সিং-এর অনুদান জমা হতো। সাথে তাদের হাতে হাতে ঘুরত সরতাজ সিং-এর কারখানায় তৈরি দেশি অস্ত্র। দুই হাতে জলের মতো টাকা ছড়াত সরতাজ। নেতা মন্ত্রীরাও ছিল তার কৃপাধন্য। সরতাজ সিং-এর হাত যার মাথার উপর, গদিও তারই খাতে বরাদ্দ হতো।

কিন্তু দিন কারও একরকম যায় না। কোন ছিদ্রপথে সরতাজ সিং-এর ইস্পাত-দৃঢ় হৃদয়ে ভিতর এক চিলতে তুলতুলে নরম দুর্বলতা গোপনে ঘাঁটি গাড়তে শুরু করেছিল, তা সে বোধ করি নিজেও জানতে পারেনি। নইলে সরতাজ সিং-এর কি নারীর অভাব? এতদিন যারা তার বিছানা গরম করেছে, তারা তো সরতাজ সিং-এর সামান্য ইশারার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকত। প্রেম ভালোবাসার মতো দুর্বলতা তার ছিল না কোনও দিন। আর ঠিক সেই কারণেই সে ছিল অপ্রতিরোধ্য। কিন্তু তারপর একদিন সব ওলোট পালট হয়ে গেল হঠাৎই। সরতাজ সিং প্রেমে পড়ল।

গগনজিত কপূর উঠে গিয়ে খোলা জানলার সামনে দাঁড়ালেন। বাইরে আকাশে ঘন কালো মেঘ করেছে। বৃষ্টির ছাঁট সূচের মতন এসে বিঁধছে তাঁর চোখেমুখে। তবু জানলাটা বন্ধ করতে ইচ্ছে করছে না। সরতাজ সিং আজ আবার গাইছে। বুকের ভিতরকার কোন চোরা কুঠুরিতে লুকিয়ে রাখা তীব্র যন্ত্রণা গলে গলে মিশছে সেই সুরে। জেলখানার উঁচু প্রাচীরের গায়ে ধাক্কা খেয়ে ফিরছে সেই সুর, অনুরণিত হচ্ছে এক সুতীব্র হাহাকার। গগনজিত বেশ শব্দ করে জানলাটা বন্ধ করে দিলেন। ঠিক যতটা জোরে শব্দ হলে সংগীতের শব্দ ভেঙে চুরে যায়, তার চেয়ে বেশি শক্তি প্রয়োগ করলেন তিনি। বুকের ভিতরটা তোলপাড় করছে। চেয়ারে বসে দুই হাতে মাথার চুল খামচে ধরলেন জেলরসাহেব।

চাঁদনি মেয়েটা চাঁদের মতোই সুন্দর ছিল। সহজ সরল পঞ্জাবি মেয়ের মদ-মাতাল হাড়বজ্জাত বাপটা মেয়েকে পাত্রস্থ করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছিল। মেয়ের বিয়ে দিয়ে কিছু আদায় উশুল করে নেবার ধান্দায় ছিল বুড়ো। অন্তত এমন চটকদার মেয়ের পরিবর্তে কয়েক মাসের মতো পাঁইটের ব্যবস্থা তো হয়ে যেত।

বস্তিতে লুকোনো চোরাই মালের রেড করতে গিয়ে চাঁদনির দেখা পেয়েছিলেন গগনজিত কপূর। কয়েক মুহূর্তের জন্য দৃষ্টি স্থির হয়েছিল মেয়েটার মুখে। অভিজ্ঞ দৃষ্টি বুলিয়ে বুঝে নিয়েছিলেন, একে দিয়ে তাঁর কাজ হবে। এই মেয়ে হবে তাঁর টোপ। সরতাজ সিংকে বঁড়শিতে গাঁথতে পারলে প্রোমোশন তাঁর পাকা, কেউ আটকাতে পারবে না। শুধু প্রোমোশনের লোভ নয়, সরতাজ সিং-এর মতন সাক্ষাৎ শয়তানকে শিক্ষা দেওয়ার একটা সুতীব্র ইচ্ছে পেয়ে বসেছিল তাঁকে।

পুলিশের উর্দি গায়ে চাপিয়ে শয়তানটাকে সেলাম ঠোকার অসহায়তা আর সহ্য হচ্ছিল না। চাঁদনির বাপটাকে টোপ গেলাতে অসুবিধে হয়নি। টাকা আর মদের বোতল পেয়ে বুড়ো খুশি মনে কন্যেকে জবাই হতে পাঠিয়েছিল। চাঁদনি বুড়ো বাপের হাতে পায়ে ধরেছিল, বুড়োটা দুবার হ্যাট হ্যাট করে লাথি মেরে টলতে টলতে গুনগুন করে গান ধরে, ঘর থেকে বেরিয়ে গেছিল সেদিন। একবারের জন্যও ফিরে তাকায়নি মেয়ের দিকে।

সরতাজ সিং-এর মতো পাক্কা খেলুড়েও চাল চিনতে ভুল করেছিল। চাঁদনিকে নিজে হাতে করে ট্রেনিং দিয়েছিলেন গগনজিত কপূর। একটা সোজা সরল বস্তির মেয়েকে ঘষে মেজে পুলিশের চর হিসেবে গড়ে তোলার কাজটা সহজ ছিল না। কিন্তু কপূরসাহেব সেই অসাধ্যই সাধন করেছিলেন। সরতাজ সিংকে প্রেমের জালে জড়িয়ে তার সব গোপন খবর তুলে দিতে হবে পুলিশের হাতে। খুব অল্প সময়ে সব শিখে নিয়েছিল চাঁদনি, হয়ে উঠেছিল পুলিশের শিক্ষিত চর। সে তখনও জানত না, কোন কাজের জন্য তৈরি করা হচ্ছে তাকে। নির্মোহ, বীতস্পৃহ মন নিয়ে খুব অল্প সময়ে মধ্যে সব শিখে নিয়েছিল চাঁদনি।

সময় থেমে থাকে না। সরতাজ সিং-এর দিকে চাঁদনিকে এগিয়ে দেওয়ার জন্য ছোট্ট একটা নাটকের দরকার ছিল, সেটাও মসৃণ ভাবে উতরে গেছিল। মাঝরাত্তিরে কোনও অনাথিনী যদি দুর্বৃত্তদের হাত থেকে পালিয়ে সরতাজ সিং-এর আশ্রয় ভিক্ষা করে, সর্বশক্তিমান সরতাজ কি তাকে ফিরিয়ে দিতে পারে? সরতাজ সেই মুহূর্তে কল্পনাও করতে পারেনি, ত্রস্ত চড়ুই পাখির মতো তিরতির করে প্রাণভয়ে কাঁপতে থাকা মেযেটা শুধুই অভিনয় করছে। কিংবা হয়তো সত্যিই সে অভিনয় করছিল না। সরতাজ সিং-এর মতো ভয়ংকর মানুষের হাতে নিজেকে তুলে দেওয়ার মুহূর্তে নরম মেযেটা হয়তো সত্যিই শঙ্কা, লজ্জায় কেঁপে উঠেছিল।

হায় মোহ! মোহের কারাগার থেকে নিজেকে রক্ষা করা কি আর এতই সহজ? ইতিহাস সাক্ষী, এই রিপুর কারণে বারবার রক্তক্ষয় হয়েছে, বদলে গেছে পৃথিবীর মানচিত্র। দুটি মানুষের বুকেও মোহের প্লাবন উত্তাল হয়ে উঠছিল সেই দিনগুলোয়। ভযংকর সরতাজ, কুখ্যাত সমাজবিরোধী সরতাজ, যার ভয়ে সারা ফিরোজপুর কাঁপে, শিশুর মতো হৃদয়ে আশ্রয় খুঁজে চলেছিল আরেকটি হৃদয়ে একটা সাধারণ মেয়ের প্রতি অন্ধ মোহ ধীরে ধীরে বদলে দিচ্ছিল তাকে। আর আরেকজন, যিনি নিজের হাতে চাঁদনিকে তুলে দিয়েছিলেন শয়তানের হাতে, তাঁরও বুকের ভিতর যে কী ভীষণ ঝড় চলছিল, তা সেদিন আর কেউ জানতে পারেনি।

একদিকে চাঁদনির প্রতি তাঁর অদম্য আকর্ষণ, অপরদিকে তাঁর কর্তব্য, প্রতিদিন একটু একটু করে ক্ষয় করছিল তাঁকে। কখনও মনে হতো, থাক আর দরকার নেই, ফিরিয়ে নিয়ে আসি তাকে। আবার মনে হতো আর তো মাত্র কটা দিন। চাঁদনি তার দায়িত্ব সুচারুরূপেই পালন করে চলেছে। গত দুই মাসে সরতাজের একখানা বড়ো কনসাইনমেন্ট ধরা পড়েছে। আরও কিছু মালপত্র উদ্ধার হয়েছে সীমান্তের গ্রামগুলি থেকে। সরতাজ সিং-এর ব্যাবসায় একটা বড়োসড়ো ধাক্কা দেওয়া গেছে। এইখান থেকে ফিরে আসা যায় না।

হায়, যদি সেদিন তিনি ফিরিয়ে আনতেন চাঁদনিকে। গত এগারো বছর ধরে এই প্রশ্নটাই নিজেকে বারবার করেছেন গগনজিত কপূর। কেন? কীসের পেছনে ছুটছিলেন তিনি? কী পেতে চেয়েছিলেন? সরতাজ সিং-এর মতন পাষণ্ডের দিকে সব জেনেশুনে কেন ঠেলে দিয়েছিলেন চাঁদনিকে? আর চাঁদনি? তাকে তো তিনি নিজের হাতে দক্ষ চর হিসেবে গড়ে তুলেছিলেন। নিজের হাতে যত্ন করে শিখিয়েছিলেন চরবৃত্তির প্রথম আবশ্যিক পাঠ, একজন সুদক্ষ চরের হৃদয় থাকতে নেই। প্রেম, দয়া-মায়ার মতন হৃদয়াবেগের কোনও জায়গা নেই সেই কাজে। সে কী করে এত বড়ো ভুল করল? বোকা মেয়েটা কী করে সরতাজ সিং-এর মতো একটা পাষণ্ডের জালে নিজেকে জড়িয়ে ফেলল?

এরকমই ভাবেন গগনজিত কপূর, ভাবতে ও বিশ্বাস করতে প্রাণপণ চেষ্টা করেন। হয়তো নিজেকে সান্ত্বনা দেওয়ার এই চেষ্টাটাই তিনি চালিয়ে যাচ্ছেন গত এগারোটা বছর ধরে। ভেবে শান্তি পান যে, চাঁদনি সত্যিই ভালোবাসেনি সরতাজকে। শুধু ক্ষণিকের জন্য আত্মবিস্মৃত হয়েছিল। সরতাজ ওকে মিথ্যে প্রেমের স্বপ্ন দেখিয়ে প্রলুব্ধ করেছিল, বোকা মেয়েটা একটা ভুল করেছিল। নইলে সরতাজের প্রেমে পড়তে পারে না সে। চাঁদনি শুধু তাঁর, গগনজিত কপূরের। নিষ্ফল আক্রোশে অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন গগনজিত।

চাঁদনির তরফ থেকে সবরকম খবরের সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেছিল। নরম কোমল মেযেটা নাগিনির মতো ফোঁস করে মাথা তুলেছিল। তেজোদৃপ্ত স্বরে গগনজিত কপূরের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে জানিয়েছিল, আর কোনও ভাবেই সরতাজের বিরুদ্ধে তাকে ব্যবহার করা যাবে না। সরতাজকে সে ভালোবাসে।

ভালোবাসে! এত বড়ো কথা? চাঁদনি সরতাজ সিংকে ভালোবাসে? একটা সমাজবিরোধী, দাগি অপরাধী, সাক্ষাৎ শয়তানের দূত, চাঁদনি নাকি ভালোবাসে তাকে! সারা শরীরের রক্ত প্রবল বেগে মস্তিষ্কের দিকে ছুটতে থাকে গগনজিত কপূরের। প্রচণ্ড ক্রোধে উন্মাদ হয়ে ওঠেন তিনি। চাঁদনিকে যে-নরক থেকে তুলে এনেছিলেন তিনি, সেখানকারই যোগ্য সে। নইলে স্বেচ্ছায় কেউ সরতাজ সিং-এর কণ্ঠলগ্না হতে চায়?

ছি ছি, একটা নরকের কীট, সে কি না দংশন করবে গগনজিত সিং-এর বাগানের ফুলকে! সেই মুহূর্তে তিনি ভুলে যান, তিনি নিজেই তো সেই উদ্দেশ্যে চাঁদনিকে পাঠিয়েছিলেন সরতাজ সিং-এর কাছে। ভুলে যান, তখন চাঁদনি তাঁর কাছে ছিল শুধু তাঁর উদ্দেশ্যপূরণের, উপরে ওঠার সিঁড়ি। নিস্ফল আক্রোশে নিজের হাত কামড়াতে থাকেন গগনজিত কপূর।

সরতাজ সিং তার জীবনে মেয়েমানুষ কম দেখেনি। তবে এতদিন নারীদেহ তার কাছে শুধুই ছিল ভোগের উপকরণ, রাত শেষ হলে উচ্ছিষ্টের মতন যাকে আস্তাকুঁড়ে ছুড়ে ফেলা যায়। কিন্তু চাঁদনি মেযেটা অন্যরকম। আজকাল সরতাজের একটা সুস্থ জীবন পেতে খুব ইচ্ছে করে। একটা সুখী গৃহকোণ, চাঁদনিকে নিয়ে নিশ্চিন্ত জীবনের প্রতি বড়ো লোভ হয় সরতাজের। প্রথমবার কোনও নারীকে তার শুধু শরীর নয়, আস্ত একটা মানুষ বলে মনে হয়। যার নরম চোখে চোখ রেখে কাটিয়ে দেওয়া যায় একটা গোটা জীবন।

চাঁদনিকে নিয়ে এই ফিরোজপুর, এই অপরাধের জগৎ ছেড়ে দূরে কোথাও চলে যাবে সরতাজ। এখানে থাকলে তার অপরাধ, তার কলঙ্কিত অতীত, তার পিছু ছাড়বে না। চাঁদনিও তাই চায়। অর্থের অভাব নেই তার। দুজনে মিলে নতুন কোনও জায়গায় তাদের সুখের নীড় গড়ে তুলবে। ভাবতে ভাবতে তৃপ্তিতে সরতাজ সিং-এর ঠোঁটের কোণে হাসি খেলে যায়। বক্ষলগ্না প্রেয়সীর কপালে চুমু খায় স্নেহভরে।

 

বাইরে বৃষ্টি থেমে গেছে। দীর্ঘ জ্যৈষ্ঠদিনের শেষের এই বৈকালিক বর্ষণ শীতলতার পরশ বুলিয়ে গেছে তাপদগ্ধ মৃত্তিকার বুকে। কিন্তু দীর্ঘ এগারো বছর ধরে যে-প্রচণ্ড দাহ চলছে গগনজিত কপূরের বুকের ভিতর, তা নিভবে কোন শান্তিজলে?

সন্ধ্যা নেমেছে। সরতাজ সিং-এর গান থেমে গেছে কখন। কয়েদিদের নম্বর মিলিয়ে একে একে সেল-এ ঢোকানো হচ্ছে। সেদিনও এমনই এক গ্রীষ্মের সন্ধ্যা ছিল। দিন শেষে আজকের মতোই বৃষ্টি হয়েছিল সেদিনও। গোটা ফিরোজপুর শহরটা সেদিন সেজেছে আলোর মালায়। সরতাজ সিং-এর বিয়ে বলে কথা, উত্সবই হবে বই কি।

পুলিশ চৌকির নিঃসঙ্গ কেবিনে বসে একটার পর একটা সিগারেট শেষ করে চলেছিলেন গগনজিত কপূর। আহ্, অপেক্ষার প্রহর কী দীর্ঘ! আজ চাঁদনি ফিরে আসবে, বিয়েবাড়ির আলো নিভে যাবে, বাজনা থেমে যাবে। সরতাজ সিং-এর মোহজাল ছিন্ন করে চাঁদনি ছুটে আসবে গগনজিতের কাছে, তাঁর বাহুডোরে ধরা দেবে তাঁর প্রেয়সী।

এতক্ষণে তো সরতাজ সিং-এর কাছে খবর পৌঁছে যাওয়ার কথা। যাকে ভালোবেসে সরতাজ সিং জীবনসঙ্গী বানাতে চলেছে, সে শুধুমাত্র একজন পুলিশের চর। আগাগোড়াই মিথ্যে দিয়ে সাজানো, পুরোটাই তার অভিনয়। নিজের মনেই একা বসে মিটিমিটি হাসতে থাকেন কপূরসাহেব।

জলদি চলুন স্যার, সরতাজ সিং তার হবু স্ত্রীকে বিয়ে মণ্ডপ থেকে তুলে টানতে টানতে জিপে বসিয়ে কোথায় নিয়ে গেছে। মেয়েটাকে কিছু করে না ফেলে।

খবরটা পেয়ে পায়ের নীচ থেকে মাটি সরে গেছিল গগনজিত কপূরের। প্রাণপণ দ্রুতগতিতে গাড়ি ছুটিয়েছিলেন তিনি। তবু দেরি হয়ে গেছিল, খুব দেরি হয়ে গেছিল সেদিন। গিয়ে কী দেখেছিলেন তিনি? চাঁদনির রক্তাক্ত নিথর দেহটা মাটিতে পড়ে আছে। সরতাজ সিং একটা ভারী কাঠের বাটাম দিয়ে তার গায়ে আঘাতের পর আঘাত করে চলেছে, ভোঁতা শব্দ হচ্ছে, ধুপ ধুপ ধুপ…।

রক্তে ভেসে যাচ্ছে চারিদিক। সরতাজ সিং-এর চোখে উন্মাদের দৃষ্টি। আট দশজন সেপাই মিলেও ধরে রাখতে পারছিল না তাকে। পাগলের মতো চিত্কার করে চলেছিল সরতাজ সিং, কেন? কেন? কেন? সেই চিত্কার কপূরসাহেবের কানে সেদিন হাহাকারের মতো শোনাচ্ছিল। দুই হাতে নিজের কান চেপে ধরে মাটিতে বসে পড়েছিলেন তিনি।

এগারো বছর কেটে গেছে। ফিরোজপুর ছেড়ে আর যাওয়া হয়নি গগনজিত সিং-এর। ওপরতলায় সমস্ত যোগাযোগকে কাজে লাগিয়ে এই জেলেই রয়ে গেছেন তিনি। পদটা হয়তো জেলার কিন্তু তিনি নিজে জানেন, সরতাজের মতন তিনিও কয়েদি এখানে! চাঁদনি এক অদৃশ্য সম্পর্কে বেঁধে দিয়ে গেছে তাঁদের দুজনকে। এই তাঁদের শাস্তি। সরতাজকে ঘৃণা করেন তিনি, প্রবল ঘৃণা। আর সেই ঘৃণাই এগারো বছর ধরে চাঁদনিকে বাঁচিয়ে রেখেছে গগনজিত কপূরের বুকের ভিতর।

স্যারজি, জলদি আসুন, জেলের নিরাপত্তারক্ষীর ডাকে সম্বিত ফিরে পেলেন জেলরসাহেব। ভ্রু কুঁচকে তাকালেন তার দিকে।

কী হয়েছে?

স্যার, কয়েদি নম্বর একশো সাইত্রিশ…, বলে থেমে যায় নিরাপত্তারক্ষী।

কয়েদি নম্বর একশো সাইত্রিশ, সরতাজ সিং, গাঁও সুলহানি, জেলা ফিরোজপুর, পঞ্জাব, দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে আছে জেলের হেঁশেলের বারান্দায়। ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি। যেন অনেকদিন পরে স্মৃতির আস্তর সরিয়ে দেখা মিলেছে সেই নাকছাবি ঝিকিয়ে ওঠা নরম মুখের। সরতাজ সিং-এর চোখের দৃষ্টি আজ স্থির, শান্ত। সব কষ্ট, সব যন্ত্রণা থেকে তার মুক্তি মিলেছে এতদিনে।

মাথার টুপিটা খুলে হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন জেলর গগনজিত কপূর, নিস্পন্দ নিশ্চল। জেলের দেয়ালগুলো যেন কাছে এগিয়ে আসছে তাঁর দিকে, ঘিরে ধরছে তাঁকে। আকাশের দিকে মুখ তুলে তাকালেন গগনজিত। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। একটু বাতাস চাই তাঁর, একটু বাতাস…

ক্যানভাস

দুচোখের পাতা অর্ধেক খুলতে না খুলতেই হুড়মুড় করে এসে পড়ল সাত সকালের সোনালি রোদের ছটা। বিছানার পাশের জানলার ভারী পর্দাগুলো সরানো। এ নিশ্চয়ই অয়নের কাজ। এত বারণ করি তবুও শুনবে না। আমাকে বিরক্ত করে যে ও কী আনন্দ পায় কে জানে! এত রাগারাগি, চ্যাঁচামেচি কিছুতেই ওর কিছু যায় আসে না। সবসময় ওই এক ভালোমানুষের ভাবমূর্তি, অসহ্য!

ওকে যত দেখছি ততই অবাক হয়ে যাচ্ছি আমি। কী ধাতুতে গড়া! কম তো অত্যাচার করি না। বিয়ের আগেই জানিয়েছিলাম আমার আর রূপমের খোলামেলা সম্পর্কের কথা। যাতে ও এই বিয়েতে রাজি না হয়। কিন্তু কোথায় কী! আমার কোনও কথারই কোনও ফল হয়নি। তিন মাস হয়ে গেল বিয়ে, এখনও ওকে ছুঁতে পর্যন্ত দিইনি আমার শরীর। তবুও সে একই রকম নিরুত্তাপ! আমার মেজাজ, অহেতুক ঝগড়াঝাঁটি, জিনিসপত্র ভাঙা সব সহ্য করছে নিঃশব্দে।

বাবা যেদিন আমার বিয়ের ভাবনার কথা প্রথম বলেছিল পিকলুদাকে, সঙ্গে সঙ্গে সে প্রস্তাব করেছিল তার শান্তশিষ্ট সহকর্মী অয়নের নাম। সব দেখে শুনে বাবা-মা একবারে রাজি হয়ে যায়। আমার আপত্তির পরোয়া কেউ করেনি। রূপমও তখন ছিল না আমার কাছে। দিন কাটাচ্ছিল কলকাতার কোনও এক রিহ্যাবে।

সন্ধে নামলেই অন্ধকার ব্যালকনিতে বসে থাকি আজকাল। আকাশের অগুনতি তারাদের ভিড়ে হারিয়ে ফেলতে ইচ্ছে করে নিজেকে। আজও বেতের হেলানো চেয়ারটায় বসে একমনে ভাবছিলাম রূপমের কথা। আজ প্রায় ছমাস হতে চলল, দেখা হয়নি আমাদের। কোথায় আছে, কেমন আছে তাও জানি না আমি।

কী করছিস এখানে? তারা গুনছিস? পেছন থেকে চুপি চুপি বলল ঝুম্পাদি, আমার পিসতুতো দিদি।

আরে, তুমি কখন এলে? পিকলুদা আসেনি?

এসেছে। ওই তো ড্রযিংরুমে আছে অয়নের সঙ্গে। কিন্তু গুনগুন একি চেহারা হয়েছে তোর? ফ্যাকাশে চোখমুখ, এলোমেলো চুল!

ধুস! ছাড়ো তো। সাজগোজটা কোনও কালেই আমার দ্বারা ঠিক হয় না।

সে আমি জানি। তাই বলে একটু পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন তো হয়ে থাকবি। অয়ন কী ভাবে বলতো? আহত স্বরে বললাম, অয়ন কী ভাবে! আচ্ছা, আমার ভাবনার পরোয়া কেউ কখনও করেছে ঝুম্পাদি? তোমরা তো জানতে যে রূপমকে ছাড়া আমি বাঁচব না। তবুও জোর করে, রীতিমতো ব্ল্যাকমেল করে বাড়ির সকলে মিলে আমাকে ঝুলিয়ে দিলে অয়ন পুরকায়স্থ নামক এক নিপাট ভদ্রলোকের গলায়!

তুই একটা আস্ত পাগল রে গুনগুন! এখনও ওই বদমেজাজি, নেশাখোর ছেলেটার কথা ভাবছিস? নিজেও কষ্ট পাচ্ছিস, আর অয়নকেও কষ্ট দিচ্ছিস।

তোমরা জানো না, রিহ্যাবে যাবার আগে রূপমকে আমি কথা দিয়েছিলাম, ওর জন্যে অপেক্ষা করব। কথা না রাখতে পারার জ্বালায় জ্বলে যাচ্ছি আমি প্রতিটা দিন, প্রত্যেক মুহূর্তে। আমার জীবনে আর কোনও রং অবশিষ্ট নেই গো ঝুম্পাদি। স্রেফ পড়ে আছি একটা ফাঁকা ক্যানভাসের মতো।

আমার সামনে এসে দাঁড়াল ঝুম্পাদি। বলল, এখন কথা খেলাপির জন্যে কষ্ট পাচ্ছিস আর রূপমকে বিয়ে করলে অনুশোচনার আগুনে জ্বলে পুড়ে মরতিই রে বোকা মেয়ে।

 

( ২ )

ড্রাইভিং সিটে বসে আছে পিকলুদা। পাশে অয়ন। পেছনে আমি আর ঝুম্পাদি।

জায়গার নামটা যেন কী?

ওই তো শামুকতলা থেকে কিছুটা দূরে। গ্রামের নাম একটা বলেছিল বটে রঞ্জন কিন্তু সেটা ঠিক মনে পড়ছে না। ওদের পৈতৃক বাড়ি ওখানে। ঝুম্পাদির প্রশ্নের উত্তরে বলল পিকলুদা।

দেখেছিস এই একজন মানুষ! কোথায় যাচ্ছি না যাচ্ছি ঠিক মতো না জেনেই রওনা হওয়ার জন্যে তৈরি। বলি জায়গাটার নামটা তো শুনবে খেয়াল করে। তাহলে গুগল ম্যাপে একটু সার্চ করে দেখতাম। গলায় বেশ ঝাঁঝ নিয়ে বলে উঠল ঝুম্পাদি।

পিকলুদাও দমবার পাত্র নয়। আরে রাখো তো তোমার গুগল ম্যাপ-ট্যাপ। বিরাট টেক স্যাভি হয়েছে আজকাল! শামুকতলা বাজারে পৌঁছে ফোন করতে বলেছে রঞ্জন। ওখানে আমাদের জন্যে অপেক্ষা করবে ও। তারপর নিয়ে যাবে গন্তব্যে। স্ত্রী, ছেলেমেয়েদের কলকাতায় রেখে অনেকদিন বাদে দেশের বাড়িতে এসেছে রঞ্জন, আমার ইউনিভার্সিটির রুমমেট। সেদিন ফোনে আমন্ত্রণ জানাল ওদের গ্রামের বাড়িতে দু-একটা দিন সপরিবারে কাটিয়ে যাবার। এই উইক-এন্ডে তিনদিন পরপর ছুটি আছে। তাই লুফে নিলাম প্রস্তাবটা। কম খরচে ছোটোখাটো একটা আউটিং হয়ে যাবে। ঠিক কিনা বল, গুনগুন?

জোর করে মুখে একটা হাসি টেনে এনে পিকলুদার কথায় সম্মতি জানালাম আমি। ঝুম্পাদিরা নিঃসন্তান। তাই ঘোরাফেরা, হইচই করেই চেষ্টা করে নিজেদের জীবনের শূন্যতাটাকে ভরিয়ে রাখতে। আজকাল ওদের সঙ্গী হয়েছি আমি আর অয়ন। আমাদের মাঝখান দিয়ে বয়ে চলা অন্ধকার নদীটাকে আলোয় ভরাতে চায় ওরা।

 

( ৩ )

একটু দূরেই ভুটান পাহাড়। পাশ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে একটা নাম না জানা পাহাড়ি ঝোরা। ধারে কাছে ঘরবাড়ি বিশেষ নেই। নৈঃশব্দের ভিড়ে একাকী দাঁড়িয়ে আছে কাঠের তৈরি দোতলা বাড়িটা। চারপাশে কত রকমের ফুলের গাছ। নিকোনো উঠোন। গ্রামের বাড়ি হলেও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। রুচির ছাপ স্পষ্ট।

সন্ধের মুখে দোতলার ঘরে চলছিল গল্পগুজব। রঞ্জনদা দামি স্কচের বোতল খুলে বসেছেন। ওঁকে সঙ্গ দিচ্ছে পিকলুদা আর অয়ন। রাঁধুনি সোমরাজ প্লেটে সাজিয়ে দিয়ে গিয়েছে কুচো চিংড়ির পকোড়া আর ফ্রায়েড কাজু। কফির কাপ হাতে আমি আর ঝুম্পাদি নির্বাক দর্শক। কথায় কথায় রঞ্জনদা বলছিলেন অকৃতদার বিরাজকাকু আমাদের দূর সম্পর্কের আত্মীয়। ওনার বাবা ডিফেন্সে ছিলেন, তাই বহুদিন ওনারা গ্রামছাড়া। পনেরো বছর আগে হঠাৎ বিরাজকাকু ফিরে আসে এখানে। বাবা গত হয়েছেন। মা অথর্ব। অকূল সমুদ্রে খাবি খাচ্ছি একলা আমি। বিরাজকাকুকে পেয়ে যেন হাতে চাঁদ পেলাম। সব দাযিত্ব ওঁর কাঁধে চাপিয়ে নিশ্চিন্তে চলে গেলাম কলকাতা, রুজিরুটির টানে। বিরাজকাকু না থাকলে সব সাত ভূতে খেত এতদিনে। শিল্পী মানুষ তো, তাই খুব শৌখিন। যত্ন করে আগলে রেখেছে আমার পৈত্রিক ভিটেমাটি, জমিজিরেত।

রঞ্জনদার একটু টিপসি লাগতে শুরু করেছে সবে। মাঝে মাঝেই বাঁক বদলাচ্ছে কথার স্রোত। সেই সময় ঘরে ঢুকলেন ঢোলা পাজামা-পাঞ্জাবি পরা, একমাথা কাঁচাপাকা চুলের ভদ্রলোক।

আরে বিরাজকাকু আসুন আসুন, আপনার জন্যেই অপেক্ষা করছি। তাঁকে দেখে বলে উঠল পিকলুদা।

অয়ন-এর সঙ্গে তো পরিচয় হয়েছে। এই আমার মিসেস ঝুম্পা আর ওটি আমার শ্যালিকা গুনগুন।

আমার দিকে তাকাতেই ভদ্রলোক কেমন যেন চমকে উঠলেন। অবাক চোখে দেখছিলেন আমাকে। সেই দৃষ্টিতে যে কী ছিল বলে বোঝানো যাবে না। রাগ? দুঃখ? ভয়? আনন্দ? নাকি অন্য কিছু? ঠিক বুঝতে পারছিলাম না। গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল আমার! ভদ্রলোক আর দাঁড়ালেন না। দ্রুত পায়ে বেরিয়ে গেলেন ঘর থেকে।

রাতে ঘুমোতে যাবার আগে অয়নকে বললাম আচ্ছা বিরাজকাকু ওভাবে কেন দেখছিলেন আমাকে?

কী জানি! রঞ্জনদা বলছিলেন উনি একটু আপনভোলা গোছের মানুষ।

আমার কেমন যেন ভয় ভয় করছে। ওঁর চোখ দুটো মনে পড়লেই কাঁটা দিচ্ছে গায়ে কে জানে আবার মাথাটাথা খারাপ কী না? এই পাণ্ডববর্জিত জায়গায় একা থাকেন। বেশ সন্দেহ হচ্ছে।

একটা অভয় দেবার হাসি হেসে অয়ন বলল অত ভেবো না। আমি, মানে আমরা সকলে আছি তো। কিছু হবে না। ঘুমিয়ে পড়ো। মোটা চাদরটা আমার গায়ে টেনে দিয়ে পাশ ফিরে শুয়ে পড়ল অয়ন।

 

( ৪ )

ঘুমের ওষুধ ছাড়া আজকাল ঘুম আসে না সহজে। কিন্তু কাল রাতে বেমালুম ভুলে গিয়েছিলাম ওষুধ খাবার কথাটা। তবুও অনেকদিন পর নিখাদ শান্তির ঘুম ঘুমিয়েছি আমি। হয়তো এই শান্ত পরিবেশে এসে অস্থির মনটাও বিরতি নিয়েছে কিছুক্ষণের জন্য। হঠাৎ আমার চোখ পড়ল নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে থাকা অয়নের দিকে। শিশুর মতো সারল্য ছড়িয়ে আছে সারা মুখে।

ভোরের দিকে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গিয়েছে। হালকা মেঘের আস্তরণ ফুঁড়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে সূর্য। সকাল সকাল বৃষ্টিস্নান সেরে আরও বেশি সবুজ হয়ে উঠেছে গাছগাছালি। কখনও কখনও মেঘছেঁড়া রোদ এসে পড়ছে তাদের গায়ে। ভেজা শরীরে রোদের আদর মেখে ঝিকমিক করে উঠছে বৃষ্টিধোয়া পাতাগুলো। পরক্ষণেই কোথা থেকে এক টুকরো মেঘ এসে বিষাদের পর্দা টেনে দিচ্ছে সেই সোহাগি আলোর প্রবাহপথে।

রৌদ্র-ছায়ার খেলা দেখতে দেখতে নেমে এলাম সিঁড়ি দিয়ে একটা ঘরের কাছে এসে থেমে গেল পা দুটো। দরজাটা হাট করে খোলা। জানলা দিয়ে একফালি আলো এসে পড়ছে একটা ক্যানভাসের ওপর। দেখি হাতে রঙের প্যালেট আর পয়েন্টেড তুলি নিয়ে বিরাজকাকু একমনে তাকিয়ে আছেন ফাঁকা ক্যানভাসটার দিকে। শুনেছিলাম সব শিল্পীর কাছেই তাঁর সৃষ্টি নিছক কাজ নয়, সাধনা। হয়তো বিরাজকাকু সে রকমই কোনও সাধনায় মগ্ন হয়ে আছেন। মনে মনে সৃষ্টি করে চলেছেন নতুন কিছু। একটু পরেই যা তুলির টানে মূর্ত হয়ে উঠবে এই শূন্য ক্যানভাসের ওপর। পায়ের শব্দ শুনে ঘাড় ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকালেন বিরাজকাকু। সেই একই রকম দুর্বোধ্য চাহনি।

 

আলিপুরদুয়ার জেলার এই অঞ্চলে অনেক জনজাতির মানুষের বাস। এদের পূর্বপুরুষরা অনেকেই খ্রিস্টান হয়ে গিয়েছিলেন একটা সময়। তাই গ্রামের মাঝে তৈরি হয়েছে একটা বড়োসড়ো প্রটেস্টান্ট গির্জা। দুপুর দুপুর চার্চ, সিমেট্রি ঘুরে আমরা সবে ফিরেছি। এমন সময় সোমরাজ এসে বলল কাকাবাবু সেই সকাল থেকে ঘরের দরজা বন্ধ করে রেখেছেন। খাওয়াদাওয়া কিছুই করেননি। আপনারা একবার ডাকবেন? শরীরটরির ঠিক আছে কিনা দেখবেন একটু?

সেকি! বিরাজকাকু তো কখনও এমন করেন না। শঙ্কিত গালায় বললেন রঞ্জনদা।

বিস্তর হাঁকডাকের পর অবশেষে খুলল দরজা। এদিক ওদিক শূন্য দৃষ্টি নিয়ে দেখে বিরাজকাকুর চোখ স্থির হল আমার চোখের দিকে। একটা অস্বস্তি ক্রমশ ঘিরে ধরছিল আমাকে। একটু একটু করে আমার কাছে এগিয়ে আসছিলেন বিরাজকাকু। বাড়তে থাকা হৃদকম্পটা টের পাচ্ছিলাম ভালো ভাবে। নিজের অজান্তেই কখন যেন শক্ত করে ধরে ফেলেছি আমার পাশে দাঁড়ানো অয়নের হাতটা।

কোথায় ছিলে তুমি এতদিন? সেই যে আমাকে ম্যারেজ রেজিস্ট্যারের অফিসের সামনে অপেক্ষা করতে বলেছিলে, মনে পড়ে? তুমি আর এলে না তো! কত খুঁজেছি তোমায়। বন্ধু, পড়শিরা বলল, তোমার বাড়ির লোকেরা নাকি তোমাকে অন্য কোথাও নিয়ে গিয়েছে। সেখান থেকে বিয়ে হবে তোমার। সত্যিই হয়েছিল? জানো, সব ছেড়ে এসেছি আমি। সেই শহর, পুরোনো রাস্তা, গলি, চৌমাথা যা কিছু তোমার কথা মনে করাত, স…ব।

খড়খড়ে গলায় বলা কথাগুলো শুনে আমার সারা শরীরটা কাঁপছিল। মনে হচ্ছিল আমার সামনে বিরাজকাকু নয় রূপম দাঁড়িয়ে আছে। আজ যদি সে ফিরে আসে তবে এভাবেই অভিযোগের তিরে বিদ্ধ করবে আমাকে। কাঁপুনিটা যত বাড়ছিল, তত শক্ত করে ধরছিলাম অয়নের হাতটা। সকলেই হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে আছে।

বিহ্বল ভাবে কথা বলছেন শুধু বিরাজকাকু, তুমি প্রায়ই অভিযোগ করতে আমি কত কিছু আঁকি কিন্তু কখনও তোমার ছবি আঁকি না। বিশ্বাস করো, তুমি চলে যাবার পর আমি আর অন্য কিছু আঁকতে পারিনি। রং তুলির আঁচড়ে শুধু ধরে রাখতে চেয়েছি তোমাকে। কিন্তু ব্যর্থ হয়েছি বারবার। দিনের পর দিন অসহায় ভাবে দাঁড়িয়ে থেকেছি ফাঁকা ক্যানভাসের সামনে। এতদিন ধরে যে-ব্যর্থতার কষ্ট বয়ে বেড়াচ্ছিলাম তার থেকে আজ হয়তো মুক্তি পাব আমি। সেই চোখ, সেই মায়াভরা দৃষ্টি… সব অতীত আমার সম্মুখে। আমি পারব এবার। দেখে নিও ঠিক পারব তোমার ছবি আঁকতে। এসো আরফিন, বসো এখানে।

রঞ্জনদা অসহিষ্ণু ভাবে বললেন, ও আরফিন নয়, গুনগুন। অয়নের স্ত্রী।

বিরাজকাকু ভুরু কুঁচকে তাকালেন। তারপর শান্ত গলায় বললেন, তুই জানিস না রঞ্জন, ডিব্রুগড়ে আমাদের বাড়ির পাশে থাকত ওরা। আরফিন, আমার আরফিন।

আবার আরফিন! বললাম না ওর নাম…

জানি না হঠাৎ অয়নের কী হল। রঞ্জনদাকে থামিয়ে দিয়ে বলে উঠল ছেড়ে দিন রঞ্জনদা, এসব বুঝবেন না বিরাজকাকু। দেখছেন না একটা ঘোরের মধ্যে আছেন উনি, বন্দি হয়ে আছেন ভালোবাসার মায়াজালে। আরফিন এখনও ভীষণ ভাবে জীবন্ত ওনার অনুভবে। তাকে ফিরে পাবার ইচ্ছে এতটাই প্রবল যে বাদামি চোখ আর বড়ো বড়ো আঁখিপল্লবের গুনগুন ওনার কাছে ধরা দিচ্ছে আরফিন হিসেবে। সেদিনের আরফিন আর আজকের গুনগুনের মধ্যে যে পনেরোটা বছরের ফারাক, সে খেয়াল ওনার নেই। একটা ইলিউশনকে আঁকড়ে বাঁচতে চাইছেন উনি। আসুন না আমরা বাঁচতে দিই ওনাকে।

বিরাজকাকুর দিকে মুখ ফিরিয়ে অয়ন বলল, হ্যাঁ আরফিন, ও আপনারই আরফিন। আঁকুন বিরাজকাকু। ঘুমিয়ে থাকা শিল্পীমনকে জাগিয়ে তুলুন আবার। শূন্য ক্যানভাস ভরে উঠুক রঙে রঙে।

বিরাজকাকু মুগ্ধ হয়ে দেখে চলেছেন আমাকে। আর আমি, অয়নকে। কোথা থেকে একটা হালকা হাওয়া এসে ছুঁয়ে গেল আমাদের। ভেতরের কাঁপুনিটা থেমে গিয়েছে কখন যেন। অয়নের বাম হাতটা কিন্তু এখনও রয়েছে আমার ডান হাতের ভেতর, নির্বিকারে উষ্ণতা বিনিময় করছে তারা একে অপরের সঙ্গে।

 

নিজভূমে পরবাসী

ঊর্মিলা হন্তদন্ত হয়ে ক্যাব-এ উঠে পড়ল। তার কপালে, চিবুকে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। হাজারও বিরক্তি মুখে মেখে প্রাণেলও উঠে পড়ল একই গাড়িতে। মে মাসের সূর্যের প্রখর তেজে চারিদিক ঝলসে যাচ্ছে। প্রাণেল সিটে বসেই রুক্ষ্ম ঝলসানো গলায় ঊর্মিলাকে বলল, কি যে করো সারাদিন! ছেলেটার দিকে নজর দিতে পারো না। ও দিন দিন উচ্ছৃঙ্খল হয়ে যাচ্ছে। ভালো স্কুলে প্রচুর টাকা দিয়ে অ্যাডমিশন করা নয়, ছেলে গোল্লায় গেলে গার্জিয়ান মিটিং-এ অপমান হজম করা।

ঊর্মিলা নিরুত্তাপ দৃষ্টিতে জানালার বাইরে তাকিয়ে ছিল। প্রাণেলের কথার প্রত্যুত্তর দেবার প্রয়োজন সে বোধ করল না। ঊর্মিলার কাছ থেকে কোনও প্রত্যুত্তর না পেয়ে প্রাণেল গলার স্বর চড়িয়ে বলল, কী হল! কথা বলছ না কেন! নিজের ত্রুটিগুলো চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছি বলে ঠিক মানতে পারছ না।

ঊর্মিলা আর চুপ করে থাকতে পারল না। প্রাণেলের চোখে চোখ রেখে বেশ ভারী গলায় সে বলল, আমি সারাদিন বাড়িতে বসে থাকি বুঝি চাকরি ফেলে! আমার না হয় মা হিসাবে অনেক ত্রুটি আছে, একথা আমি মেনেই নিলাম। তুমি বাবা হয়ে কোন কর্তব্যটি পালন করো শুনি? একটা কম্পিউটার সেন্টারে পাঁচ ঘন্টার পার্ট টাইম জব করে বাড়িতে বসে আয় করো। যে-টাকা ইনকাম করো তাতে ডাল-ভাতের খরচা হয় না। আজ আমি প্রাইভেট ব্যাংক-এ জব করছি বলে সংসারের চাকা গড়গড়িয়ে চলছে।

প্রাণেল বলল, ও তুমিই যেন পৃথিবীতে একা মহিলা যে ইনকাম করে সংসার চালাচ্ছ! এখন সব মহিলাই রোজগার করে স্বামীদের হেল্প করার জন্য, তাতে হয়েছে কি!

ঊর্মিলা বলল, বাহ্ চমৎকার! দুহাতে রোজগার করে সংসারের জন্য উপার্জন করব আবার কথাও শুনব! প্রাণেল বলল, কথা শুধু শুনছ কি! সে হতাশ গলায় বলল, আমি সংসারের জন্য খুব বেশি টাকা আনতে পারি না বলে, প্রায় রোজই খোঁটা শুনতে হয়। ক্যাব এসে পড়ল তাদের নির্দিষ্ট গন্তব্যে। ঊর্মিলা আর প্রাণেল দুজনেই গাড়ি থেকে নেমে বাড়ির ভিতরে ঢুকল।

ঊর্মিলা বলল, প্রাণেল, তোমাকে যখন ভালোবেসে বিয়ে করেছিলাম, তখন সকলের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হয়েছিল। বিয়ের পর সতেরো বছর সংসারের জন্য ঘরে বাইরে লড়াই করছি। এতদিন পর তোমার সঙ্গে লড়াই করতে ভালো লাগে না। ভালোবাসার মানুষের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আমি আগেই হেরে বসে আছি। বড্ড ক্লান্ত লাগে আজকাল। আর আমি পারছি না।

প্রাণেল নিশ্চুপ থেকে একটু হালকা নিঃশ্বাস ছাড়ল। ঊর্মিলা বলল, সামনের বছর ছেলে মাধ্যমিক দেবে। তার যদি নিজে থেকে পড়াশোনার কোনও আগ্রহ না থাকে তাহলে আমার বা তোমার কী দোষ! সারাক্ষণ ওই কম্পিউটার অথবা মোবাইলে মুখ গুঁজে বসে থাকে ঋক। দ্যাখো ওই করে চোখটা খারাপ হবে। আর বাদবাকি অঙ্গে জং ধরে যাবে অল্প বয়সে। কত বলি একটু খেলাধুলা কর বাইরে বেরিয়ে কিন্তু কে কার কথা শোনে! কী যে মোহ লাগিয়ে দেয় আধুনিক যন্ত্রগুলো, কে জানে! যন্ত্রগুলো দিনরাত ছেলেমেয়েদের শৈশব-কৈশোরকে অযথা নির্দয় ভাবে নিষ্পেষণ করতে থাকে। ভাগ্যিস আমাদের সময়ে এসব ছিল না। এত মন-মগজ ঘুরিয়ে দেওয়ার জিনিস থাকলে পরীক্ষায় পাশটুকু হতো না। আজকাল বাচ্চারা এত অল্প বয়সে হাতের নাগালে সবকিছু পেয়ে যায় যে, তাদের ভালোমন্দ বোধটুকু তৈরি হওয়ার সময় পায় না।

প্রাণেল ঊর্মিলার কথা ভ্রূক্ষেপ না করে ঘরে জামা ছাড়তে ছাড়তে বিরক্তিভরে বলল, যা গরম পড়েছে আর পারা যাচ্ছে না। যতদিন যাচ্ছে গরম বাড়ছে। কথা বলতে বলতে ফ্রিজে রাখা ঠান্ডা জলের বোতল বার করে ঢকঢক করে খেল। স্বস্তির নিঃশ্বাস নিয়ে বলল, আহ! কী যে তেষ্টা পেয়েছিল!

ঊর্মিলা প্রাণেলের উপর স্বাভাবিক অধিকারবশত উগ্র গলায় বলল, রোদ থেকে ফিরে ওই বরফ ঠান্ডা জল খাওয়ার মজা বুঝবে। একে তো আরামপ্রিয় শরীর। দিনের পর দিন শরীর অতিরিক্ত আরাম পেয়ে সহ্য ক্ষমতা হারিয়ে ফেলছে। কথায় বলে না, যত্নের ধানে পোকা লাগে তোমারও হয়েছে তাই।

প্রাণেল হাওয়ায় ওড়া হাসি হেসে বলল, তোমার এই চোখ মুখ লাল করা শাসনটা আমার খুব ভালো লাগে, তাই শরীরের উপর নির্বিচারে নির্যাতন করি। তুমি কি এখন বেরোবে?

ঊর্মিলা বলল, আর ভালো লেগে কাজ নেই। ভালো লাগতে লাগতে ভালোলাগা একসময় তলানিতে দাঁড়াবে, তখন মন্দলাগার ভিড়ে ভালোলাগাকে আলাদা করতে পারবে না। ঋকের স্কুলে গার্জিয়ান মিটিংয়ে জন্য ছুটি নিয়েছি তো আজ। কথা শেষ করেই সে রান্না ঘরের কাজে ব্যস্ত হয়ে গেল।

প্রাণেল দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল চারটে বেজে গেছে। সময়গুলো কেমন ঝড়ের বেগে বয়ে গেল। পার হয়ে গেল ঊর্মিলার সঙ্গে তার দীর্ঘ সতেরো বছর। ঋকও হু হু করে বড়ো হয়ে গেল। ঊর্মিলার সঙ্গে সঙ্গে তার নিজের বয়সও বাড়ল। চব্বিশ বছরের সেই ঊর্মিলাই আজ বয়সের হাত ধরে চল্লিশের দোরগোড়ায় এসে উপনীত হয়েছে। প্রাণেলকে ভালোবেসে চব্বিশ বছরে বাবার ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসে ঊর্মিলা।

সবে সে তখন এমবিএ করে ব্যাংক-এ চাকরি পেয়েছে। তারপর দু-একটা ব্যাংক পরিবর্তন করেছে সে, জব লাইফে আত্মতুষ্টির জন্য। সে যাই হোক সংসারের বোঝার ভার প্রাণেলের চেয়ে তার ঘাড়েই পড়েছে বেশি। সেই চাপেই বোধ হয় চব্বিশ বছরের ছেলেমানুষি আবেগ সব বিদায় নিতে শুরু করেছে নীরবে। ঊর্মিলা তা নিজেও বুঝতে পারেনি হয়তো। ঘরে বাইরে একা হাতে সবটুকু সামলাতে গিয়ে নিজের দিকে তাকাবার সময় পর্যন্ত নেই।

ঊর্মিলার যখন বিয়ে হয় সত্যিই সে তখন সুন্দরী। সাদা কাগজের মতো গায়ে রং। মেদহীন ছিপছিপে চেহারা। মাঝারি উচ্চতা। দেবী প্রতিমার মতো একঢাল ঘন ঢেউখেলানো চুল পিঠ পর‌্যন্ত বিস্তৃত। মুখশ্রীটি পানপাতার মতো। ঝিনুকের খোলের মতো চোখে বাদামি তারা। সে রূপের ঝলকানি কমে এসেছে। গায়ের রং আর উচ্চতা ছাড়া সবকিছুরই পরিবর্তন হয়েছে।

মেদহীন চেহারা কিছু অপ্রয়োজনীয় চর্বি এসে দখল করেছে। মুখের মধ্যে হাজার ক্লান্তি দিনের শেষে জমা হয়েছে। বাদামি তারার চোখ দুটো উজ্জ্বলতা হারিয়ে নিস্তেজ হয়ে গেছে। ঢেউখেলানো চুলে ঢেউয়ে গতি কমে আসায় বব ছাঁট হয়েছে। প্রাণেলের অবশ্য ঢেউয়ে গতি কমা পিঠ পর্যন্ত চুলই পছন্দের ছিল।

ঊর্মিলা প্রথমদিকে প্রাণেলের পছন্দের গুরুত্ব দিয়েছিল। পরে চাকরির উন্নতিতে সে কর্পোরেট দেখনদারিকেই গুরুত্ব দিয়েছে। সে নিয়ে প্রাণেলও খুব বিরোধিতা করেনি। সে শুধু হাসতে হাসতে বলেছিল, চুলের উপর এভাবে রাগ দেখাতে পারলে! একটুও কষ্ট হল না তোমার! আমার সারা জীবনের শান্তির ঘুম গেল। যে-ঘ্রাণে আমি ঘুমোই, আবার নতুন সকালে জেগে উঠি সেটার উপর এতটা জুলুম না করলেও পারতে।

ঊর্মিলা সেদিন খুব হেসে বলেছিল, তুমি আমার রাগ তো পছন্দ করো। তোমার মনে হয় রাগটা মেয়েদের অলংকারের মতো। তোমার উপরে তো সবসময় রাগ করতে পারি না। আর রাগ করলেও স্থায়ীত্ব কম। তাই চুলের উপর চিরস্থায়ী রাগ বর্তালাম।

ঊর্মিলার পায়ের শব্দে অতীত সরে গিয়ে বর্তমান এসে পড়ল প্রাণেলের সামনে। প্রাণেল বলল, কী করছিলে এতক্ষণ রান্নাঘরে! আমি কখন থেকে সোফায় বসে আছি চায়ের প্রতীক্ষায়। ঋক এখনও বাড়ি ফেরেনি? ঊর্মিলা ম্যাক্সিতে ঘাম মুছতে মুছতে বলল, তোমার ছেলের খাবার ব্যবস্থা করলাম। ঋক এখুনি ফিরবে। সাড়ে চারটে বাজছে। চাউমিন রেডি করে ক্যাসারোলে ভরে রাখলাম। একটু সরে বসো, ফ্যানের তলায় এমন বসেছ হাওয়া পাই না আমি। প্রাণেল একটু নড়েচড়ে বসল ঊর্মিলার কথায়।

ঋক হন্তদন্ত হয়ে স্কুলের ব্যাগ কাঁধে নিয়ে এমন ভাবে ঘরে ঢুকল যে, দেখে মনে হল সে রাজ্য জয় করে ফিরেছে। প্রাণেলের নিজের ছেলেকে আজ বড়ো অচেনা লাগে। ঋকও আজকাল প্রাণেলের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রেখেই কথা বলে। প্রাণেল ভাবে মাঝেমাঝে বাবা-মার সঙ্গেও এত মেপে কথা বলা যায়! তবু এ যুগের ছেলেমেযো বোধ হয় প্রয়োজন ব্যতীত কথা বলতে চায় না।

ঋক আগে অবশ্য এরকম ছিল না। সে বরাবর হাসিখুশি প্রাণচঞ্চল স্বভাবের ছিল। মা হলেও ঊর্মিলার সঙ্গে তার যথেষ্ট সখ্যতা ছিল। প্রাণেল শাসন করলেও সে শাসন ভালোবাসা মিশ্রিত ছিল বলে, তা ঋকের মনে কখনও অপমান বোধ তৈরি করতে পারেনি। তার সুকুমার মুখটা দেখলে প্রাণেলের পুত্রস্নেহ বিগলিত হতো। ঊর্মিলার মতো দেখতে হওয়ায় সকলেই বলাবলি করত, ঋক জন্ম থেকেই মায়ের রূপ পেয়েছে। মাতৃমুখী পুত্র নাকি খুব সুখী হয় ইত্যাদি। এখন সেই ঊর্মিলাই হয়তো ছেলেকে ঠিক বুঝে উঠতে পারে না। ঊর্মিলার সঙ্গেও কথাবার্তা যে খুব বেশি হয়, তা নয়।

ঋক যেন গত চার বছরে নিজেকে কেঁচোর মতো বাবা-মার থেকে গুটিয়ে নিল। ঊর্মিলার খুব কষ্ট হয় ছেলের এই স্বভাবে। প্রিয়জনের পরিবর্তনকে সে কখনও-ই মানতে পারে না। সে প্রাণেলের হোক বা ঋকের। মুখ ফুটে কিছু না বললেও আড়ালে চোখের জল ফেলে। কতবার প্রাণেল তা লক্ষ্য করেছে। প্রাণেলের কোনও পরিবর্তিত আচরণে খারাপ লাগলে এক আধবার নীচু গলায় বলত, সকলেই পরিস্থিতির সঙ্গে পালটাচ্ছে। আমি নিজের লোকদের কাছে অপরিচিত হয়ে উঠতে পারছি না বলে এত কষ্ট। আমিও যেদিন তোমাদের কাছে অচেনা হয়ে যাব, সেদিন তোমাদেরও আমাকে মেলাতে অসুবিধে হবে।

পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে ঊর্মিলা একটু হলেও আজ শিখেছে। বাধ্য হয়ে আবেগের কিছু অংশ তাকে কাটছাঁট করতে হয়েছে। তাই প্রাণেল সংসারের খুব বেশি দাযিত্ব না নিলেও সে নিশ্চুপ থাকে। ঋকের খারাপ ব্যবহারের কোনও জবাব সে দেবার প্রয়োজন মনে করে না। ঊর্মিলা নির্দ্বিধায় নিজের কাজ করে যাওয়াটাকেই লক্ষ্য মনে করে। সব ভুলে প্রতিদিনের মতো ছেলের জন্য সে যত্ন সহকারে খাবার বানিয়ে রেখেছে।

ঋক বেশ বিরক্তি ভরা গলায় বলল, আমার চাউমিন করেছ?

ঊর্মিলা শান্ত গলায় বলল, হ্যাঁ করেছি। তুই যেদিন যা খেতে চেয়েছিস কোনদিন তোকে দেওয়া হয়নি! আমি আমার সাধ্যমতো তা করে দিয়েছি।

ঋক ঝাঁঝালো গলায় বলল, থামো কত দাও আমার জানা আছে! ছোটোলোকের মতো আগের সপ্তাহে টানা মুড়ি খেয়েছি। ডিসগাস্টিং।

ঊর্মিলা এবার একটু চড়া সুরে বলল, আগের সপ্তাহে আমার অফিসে কাজের চাপ ছিল তুই জানতিস। আর মুড়ি বুঝি ছোটোলোকের খাবার!

ঋক বলল, একদম তাই। মা, তুমি শুধু দুহাতে রোজগার করেই গেলে, স্ট্যাটাস মেনটেন করতে শিখলে না। তোমরা বাবা সত্যিই পারো।

ঊর্মিলা ছেলের এ কথার প্রত্যুত্তর দেবার প্রয়োজন না মনে করে বলল, হাত মুখ ধুয়ে খেতে বস। ডাইনিং টেবিলে খাবার দিচ্ছি। তোকে খাবার দিয়ে বাবাকে চা করে দেব।

ঋক বাথরুম যেতে যেতে বলল, মা, তুমি না অতিরিক্ত কথা বলো। আমি কি জানতে চেয়েছি বাবার জন্য তুমি কী করবে! আমার খাবার টেবিলে রেখে দাও। আমি খেয়ে নেব। আমি কি বাচ্চা ছেলে নাকি! ঋক বাথরুমে চলে গেল।

ঊর্মিলা ঋকের জন্য খাবার ঠিক করে চায়ে জল বসাল। সে ভাবল সত্যিই ঋক বাচ্চা ছেলে নয়, অনেক বড়ো হয়েছে। তার ইচ্ছে ছিল ছুটির দিনে ঋককে খাবার টেবিলে সঙ্গ দেবে। কিন্তু তার সব ইচ্ছা হাওয়ায় বুদবুদের মতো নিমেষে মিলিয়ে গেল।

চা হয়ে গেছে। ঊর্মিলা চায়ে কাপ হাতে নিয়ে প্রাণেলের কাছে গিয়ে বলল, ধরো। প্রাণেল বলল, তুমি খাবে না! ঊর্মিলা বলল, খাব। রান্নাঘর থেকে কাপটা নিয়ে আসি। প্রাণেল শশব্যস্ত হয়ে বলল, তুমি বসো। আমি এনে দিচ্ছি। ঘেমে নেয়ে গেছ পুরো।

প্রাণেলের প্রায়ই ইচ্ছে করে ভালো রোজগার করে ঊর্মিলাকে বিশ্রাম দিতে। ঊর্মিলাকে দেখে তার বুকটা চিনচিন করে ওঠে। বড়োলোক বাবার খোলস ছেড়ে কতদিন আগে ঊর্মিলা তার কাছে চলে এসেছে। তার কাছে আসার পর থেকেই সংসারের হাড়িকাঠে ঊর্মিলা নিজেকে বলি দিয়েছে। ভালোবেসে কী পেয়েছে ঊর্মিলা তা কোনওদিন হিসাব করেনি প্রাণেল। সে হিসাব করেনি বলেই মাঝেমধ্যে কারণে-অকারণে নিজের মেজাজকে জাহির করতে গিয়ে নিদারুণ আঘাত দিয়ে ফেলেছে ঊর্মিলাকে। তার কাজের জন্য পরে সে অনুতপ্তও হয়েছে।

ঊর্মিলার হাতে চা তুলে দিয়ে প্রাণেল বলল, ঋক খেয়েছে?

ঊর্মিলা কী যেন চিন্তা করছিল। সে হকচকিয়ে বলে উঠল, খেয়ে নেবে হাত মুখ ধুয়ে আমি রেডি করে রেখেছি।

প্রাণেল একটু তিক্ততার সঙ্গে বলল, কখন বাথরুম ঢুকেছে। এখনও বেরোবার নাম নেই। কী যে করে ঘন্টার পর ঘন্টা বাথরুমে, আমার মাথায় ঢোকে না। প্রাণেলের কথা শেষ হতেই বাইরে প্লেটের শব্দ হল। ঋক খেতে বসেছে।

চা শেষ হয়ে আসা প্রায় শূন্য কাপ হাতে নিয়ে ঊর্মিলা জানলার কাছে এল। বাড়ির বাইরে বড়ো রাস্তায় গাড়িগুলো সাঁ সাঁ করে ছুটে চলেছে। ল্যাম্পপোস্টের আলো অনিচ্ছা সত্ত্বেও জ্বলে উঠল। ঊর্মিলার বুকের ভিতর একরাশ অপরিমেয় শূন্যতা। প্রাণেল তার সঙ্গে যেমন ব্যবহার করুক না কেন, তা ক্ষণস্থায়ী। ঊর্মিলা এটা ভালো ভাবে জানে দিনের শেষে প্রাণেলের শেষ আশ্রয় সে-ই। প্রাণেল সেই নিরাপদ আশ্রয় হারাতে চায় না। ঋক তো ঊর্মিলার নিজের রক্ত। রক্ত কি শরীর ছাড়া আশ্রয় পায়! যদি না পায় তাহলে ঋক কেন ঊর্মিলার কাছে দিন দিন অপরিচিত হয়ে উঠছে! ঊর্মিলা নিজের সন্তানকে আশ্রয় দেবার পরিবর্তে কি তার কাছে আশ্রয় খুঁজছে! নিজের সন্তান ঋক স্ট্যাটাস মেনটেন শেখায় তাকে।

ঊর্মিলা স্ট্যাটাস মানে যতটুকু বোঝে তা হল তার সামাজিক পদমর‌্যাদা। সে সেটা অনেক বছর আগে তার শিক্ষক-বাবার কাছ থেকে অজান্তেই শিখে ফেলেছে। সৎ পথে মাথা উঁচু করে সম্মানের সঙ্গে সমাজে বেঁচে থাকাকেই বরাবর গুরুত্ব দিয়েছে ঊর্মিলা। আজকালকার ছেলেমেয়ে হয়তো একেই মিডল ক্লাস মেন্টালিটি বলে বিদ্রুপ করে। ঋক যে-স্ট্যাটসের কথা বলে, সেটা কী বস্তু ঊর্মিলার জানা নেই।

বাবা-মার কাছ থেকে সন্তানকে বোধ হয় অনায়াসে পৃথক করতে পারে এই স্ট্যাটাস। বহু কষ্টে উপার্জিত বাবা-মার অর্থ, বিলাসবহুল রেস্তোরাঁ, হোটেল, সিনেমা হল অথবা শপিংমলে নির্দ্বিধায় বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে খরচা করাকে স্ট্যাটাস বলে। তাই খাবারের বিভাজনও ঋকের কাছে ছোটোলোক-বড়োলোক দিয়ে হয়। বড়োলোকি ছাঁচে নিজেকে ফেলে ঋক। সেই ছাঁচে ঊর্মিলাকে ফেলতে পারছে না বলেই কি এত দূরত্ব!

ঊর্মিলা ভাবে ঋকের মতো ছেলেরা কি কোনও দিন ঘাম ঝরিয়ে সংসারের সবার জন্য পরিশ্রম করতে পারবে! শেষ জীবনে ঋকের মধ্যে কি আশ্রয় খুঁজে নিতে পারবে সে! আশ্রয়হীন হয়ে যাবার ভয় কি তাকে প্রতিনিয়ত সাপের মতো তাড়া করে বেড়াচ্ছে! বুঝতে পারে না সে। হয়তো বুঝতেও চায় না। শুধু মাতৃত্বের দাবি নিয়ে বারবার সে করাঘাত করে ঋকের দরজায়। তার উদ্ভ্রান্ত মন ছুটে চলে সন্তান পিপাসায়। নিজের রক্তের মায়া যে কী, তা ঋক কবে বুঝবে! এই চার বছরে কি একবারও তার মনে হয়েছে মা ঊর্মিলার কথা? দূরের নিস্তেজ আলোর মতো নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছে না তো সম্পর্কগুলো? এসব ভাবতে ভাবতে ঊর্মিলা শূন্যতার বুকে একটা নিরাশার দীর্ঘশ্বাস ফেলে।

প্রাণেল ঊর্মিলার কাঁধে আলতো হাত রেখে বলল, কী হয়েছে ঊর্মি! কখন থেকে খালি চায়ে কাপ হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছো এক ভাবে। বলো কী হয়েছে। ঋক কিছু বলেছে তোমায়?

ঊর্মিলার ভালো লাগল অনেকদিন পর প্রাণেলের মুখ থেকে ঊর্মি ডাকটা শুনে। বিয়ে প্রথম তিন বছর এই নামটা যেন অজ্ঞাত শৃঙ্খলে তাকে আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে ফেলেছিল। যাইহোক সময়ে সঙ্গে সঙ্গে সে শৃঙ্খল ক্রমশ শিথিল হয়েছে।

ঊর্মিলা সব গোপন করে, হাসির মতো হাসি না এনে ঠোঁট একটু চওড়া করে বলল, কিছু হয়নি। আর ঋক কী বলবে আমাকে।

প্রাণেল যেমনই মানুষ হোক না কেন, কেউ ঊর্মিলার মুখের উপর কথা বলেছে শুনলে মাথা ঠিক রাখতে পারে না। ভীষণরকম প্রতিক্রিয়া হয়। সব শুনলে সে ঋককে বকবে। হয়তো ঋকের গায়ে হাত তুলতেও দ্বিধা করবে না। ঋকের ইদানীং অপমানবোধটাও সাংঘাতিক তৈরি হয়েছে।

প্রাণেল ব্যঙ্গের হাসি হেসে বলল, তোমায় কিছু না বললেই ভালো। গুণী ছেলে বোধ হয় এখন নিজের ঘরে ঢুকেছেন। তাকে বলো গিয়ে আজ গার্জিয়ান মিটিং-এ কী কী শুনতে হয়েছে আমাদের।

ঊর্মিলা বলল, ঋককে বলব বইকি! তুমি মাথা গরম করছ কেন! আমি যাচ্ছি। ঊর্মিলা ঘর থেকে বিরক্তির সঙ্গে বেরিয়ে গেল।

ঋকের ঘরে গিয়ে ঊর্মিলা দেখল ঋক মোবাইলে গেম খেলছে। ঊর্মিলা ঘরে পা দিতেই সে তিক্ততার সঙ্গে বলল, তুমি এ সময়ে আমার ঘরে! কিছু দরকার আছে?

ঊর্মিলার মুখটা কেমন ম্লান হয়ে গেল ঋকের কথায়। দাঁতে দাঁত চেপে মুখটা কঠিন করে ঊর্মিলা বলল, আমি তোর ঘরে আসতে পারি না নাকি! দরকার আছে বলেই আরও তোর কাছে আসার প্রয়োজন হয়েছে।

ঋক গেমটায় হেরে গেছে এমন মুখ করে বলল, অফ কোর্স আসতে পারো। কিন্তু ডিসিপ্লিন মেনে নক করা উচিত ছিল। কী দরকার সেটা সরাসরি বলো ভমিকা না করে। ঊর্মিলার রুচিতে আঘাত লাগছিল ঋকের সঙ্গে কথা বলতে। তার মনে হচ্ছিল মা হিসাবে ঠাস করে গালে একটা থাপ্পড় কষাতে। নিজের মেজাজ সামলে নিয়ে সে বলল, তোর স্কুলে আজ গার্জিয়ান মিটিং ছিল। সেখানে কী হল তুই একবারও জানার প্রয়োজন মনে করলি না বলে আমি আগ বাড়িয়ে জানানোর কথা ভাবলাম।

ঋক একটু থতমত খেয়ে বলল, আমি ওসব শুনে কী করব! স্কুলে গার্জিয়ান মিটিং ছিল যেতে বলেছিলাম তোমাদের। গেছ তোমরা আর-পাঁচটা গার্জিয়ানের মতো। ব্যস মিটে গেছে। স্কুলের সমস্যা বাড়িতে আনছ কেন!

ঊর্মিলা উঁচু গলায় বলল, শুনতে হবে ঋক। তুই অন্যায় করলে হাজারবার শুনতে হবে। তুই কী মেটার কথা বলছিস! তোদের স্কুলের হেডমাস্টার তমালবাবু বলেছেন যে, তুই তোদের জুনিয়ার ব্যাচের মীনা নামে একটি মেয়েকে প্রায়ই টিজ করিস। গত সপ্তাহে তোর ব্যাগ থেকে তোর বন্ধু রণিতের টাকা পাওয়া গেছে। তমালবাবু বললেন যে, তুই চোরের খাতায় নাম লিখিয়েছিস। আর উনি যা তোর পড়াশোনার নমুনা বললেন, তা শুনে আমার নিজের লজ্জা লাগছিল। তুই প্রায় দিনই ক্লাস অফ করে বাইরে কোথাও ঘুরতে বেরিয়ে যাস কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে। এগুলো কি সত্যি ঋক, আমি জানতে চাই। তোর বাবা ভীষণ আপসেট।

ঋক পুলিশের হাতে ধরা পড়া চোরের মতো ভয় পেয়ে বলল, মা, তুমি নিজের ছেলেকে কি বিশ্বাস করো না! ওই শালা হারামি তমালবাবু কী বলল তার কথা শুনে নাচছ!

ঊর্মিলা আর সহ্য করতে পারল না। ঋকের গালে গায়ে জোরে ঘৃণার সঙ্গে থাপ্পড় মেরে বলল, চুপ। একদম চুপ। ছি ছি, কী মুখের ভাষা শিক্ষক সম্পর্কে! আমাকে তুই শিক্ষা দিস স্ট্যাটাসের। তোকে ছেলে বলে পরিচয় দিতে কষ্ট হয় আমার। পড়াশোনা বাদই দিলাম। তাই বলে মেয়েদের টিজ করবি, চুরি করবি! পড়াশোনা সবার দ্বারা হয় না ভদ্র স্বভাব-আচরণটা তো তৈরি করতে হয়।

ঊর্মিলা আর ঋকের চিতকার তিরের ফলার মতো প্রাণেলের কানে বিঁধছিল। সে থাকতে না পেরে ঋকের ঘরে ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়ে গেল। অনেকদিন পর ঊর্মিলার চোখ মুখ লাল করা রাগি চেহারাটা সে দেখতে পেল। ঋক তখন বিড়বিড় করে রাগে গজরাচ্ছে।

ক্ষুব্ধ গলায় ঋক বলল, ছেলে বলে পরিচয় দিতে ইচ্ছে না করে দিও না। একদম অপমান করবে না আমাকে। সারাদিন তো চাকরির নাম করে উড়ে উড়ে বেড়াও। নিজের ছেলের সঙ্গে এরকম আচরণ কোন ভদ্রতায় পড়ে? দুপয়সা কামাচ্ছ বলে তোমার খুব দেমাক। আমি তোমার ওই পয়সায় ইয়ে করি বুঝলে। আমার কাছে কৈফিয়ত চাইছ কোন সাহসে!

ঊর্মিলা তীব্র কঠিন গলায় বলল, সন্তান বেপথে গেলে তাকে শাসন করতে মায়ের সাহস লাগে না, মাতৃত্বের অধিকার থাকলেই চলে। সারাদিন অক্লান্ত পরিশ্রম করে সংসারের জন্য টাকা আনাটা তোর উড়ে বেড়ানো মনে হতে পারে। এত ফুটানি করিস মা দুপয়সা ইনকাম করে তাই। তুই পাঁচটাকা ইনকাম করে তবে আমার টাকায় ইয়ে করিস। আমার টাকার দেমাক যদি হয়ে থাকে সেটা রক্ত, ঘাম ঝরিয়ে উপার্জিত। তোর মতো চুরি চামারির পয়সা বা হাত পেতে অন্যের কাছ থেকে নেওয়া নয়।

প্রাণেল এই প্রথমবার ঊর্মিলার চেহারার ও মনের ভাঁজে ভাঁজে ঋকের জন্য ঘৃণা, অভিমান দেখল। ঋকের এই চার বছরের পরিবর্তিত পর্বে সে বহু অন্যায় করেছে। অকথা-কুকথা ঊর্মিলাকে বলেছে। ঊর্মিলা বোবার মতো নিশ্চুপ থেকেছে। সে বিনা প্রতিবাদে সব মেনে নিয়েছে। তার মনের ভিতরের জমাটবাঁধা দুঃখ-কষ্ট মাঝেমধ্যে উগরেছে প্রাণেলের কাছে। কিন্তু সে ঋকের সঙ্গে কোনও তর্ক-বিতর্ক করেনি। এতদিনের জমাটবাঁধা দুঃখ-কষ্ট আগ্নেয়গিরির লাভার মতো স্ফুরিত হতে লাগল।

ঋকের ঊর্মিলাকে অপমান করাটা প্রাণেল ভালো চোখে নিল না। প্রাণেল ঊর্মিলার পক্ষ নিয়ে প্রতিবাদে গর্জে উঠে ঋককে বলল, তোর মাথার ঠিক আছে তো! কী যা তা কথা বলছিস মাকে। ছোটোলোকের বাড়ির মতো ঝগড়া করছিস।

ঋক প্রাণেলকে তাচ্ছিল্যের সুরে বলল, এই তুমি তোমার ঘরে যাও তো। তুমি প্রথম থেকে ছিলে না তাই জানো না কিছু। মা সামান্য একটা স্কুলের গার্জিয়ান মিটিং নিয়ে তিলকে তাল করছে।

প্রাণেল শান্ত গলায় ঋককে বলল, তুই তোর মায়ের সঙ্গে হাজার খারাপ ব্যবহার করলেও আজও তোকে নিয়ে কেউ কোনও খারাপ কথা বললে তোর মায়ের খারাপ লাগে। আফটার অল তোরই মা তো।

ঊর্মিলা তখনও খাটের হাতল ধরে রাগে গজর গজর করছিল। বিমর্ষ মুখে সে যেন নিজেকেই দোষারোপ করছিল। হঠাৎ ক্ষিপ্ত গলায় সে প্রাণেলের উদ্দেশ্যে বলল, তুমি কিছু বোলো না ছেলেকে। ওর আর কিছু হবার নেই। শুধু শুধু তুমি ছেলের কাছে অপমানিত হও আমি স্ত্রী হিসাবে তা মেনে নেব না। যে নিজের ভালোমন্দ নিজে বুঝতে চায় না তাকে বোঝাবার কোনও দরকার নেই।

ঋক ঊর্মিলার কথায় খ্যাপা কুকুরের মতো ক্ষেপে উঠল। তার দুটো চোখ আগুনের মতো দপ করে জ্বলে উঠল। সে রুক্ষ্ম স্বরে ঊর্মিলাকে বলল, বাবার আবার মান-অপমান বোধ! তোমার টাকায় খেয়েপরে আমাকে জ্ঞান দিতে আসে। আমি তো সবাইকে অপমান করি। আমি বিন্দুমাত্র ব্যবহার জানি না। আর বাবা যখন কথায় কথায় তোমাকে অপমান করে, তোমার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করে, তখন তোমার কিছু লাগে না বলো! অ্যাকচুয়ালি বাবা একটা মেরুদণ্ডহীন লোক। আত্মসম্মান বলে কোনও কিছু আছে নাকি বাবার?

ঋকের কথা শুনে প্রাণেল ভিতর থেকে খোলা ছাতা বন্ধ হওয়ার মতো দমে গেল এই ভেবে যে, ঊর্মিলার মতো স্ত্রীকেও সে অপমান করে। ঋকের মতোই সেও তো ঊর্মিলাকে প্রতিপদে আঘাত করে। সে ভাবল ঋকের কথাগুলো তো খুব ভুল নয়।

প্রাণেলের অপমানটা ঊর্মিলা হজম করতে পারল না। সে ঋকের গালে সপাটে চড় মেরে বলল, তোর এত অধঃপতন হয়েছে ঋক! তুই তোর বাবাকে অপমান করছিস। ছোটো করছিস। নিজেও ছোটো হচ্ছিস। বাবা না হয় মেরুদণ্ডহীন। আমার রোজগারের টাকায় খায়-পরে। তার কোনও মুরোদ নেই। তোর তো মেরুদণ্ড আছে। তোর মুরোদটা দ্যাখা। আমি মা হয়ে সেটা দেখি।

প্রাণেলের বুকের ভিতরটা কেমন ছ্যাঁৎ করে উঠল সন্তানের মুখ থেকে অযোগ্যতার কথা শুনে। এখুনি বুঝি সাপের খোলস ছাড়ার মতো তার বাইরের আবরণ খসে গিয়ে ভিতরের দুর্বলতাগুলো উন্মুক্ত হয়ে পড়বে। ঋকের মুখ থেকে বেফাঁস কথা বেরিয়ে পড়বে এই দুর্ভাবনা, এই শঙ্কার তাড়া খেয়ে সে ঊর্মিলাকে বলল, চলো ও ঘরে। মাথা ঠান্ডা করো। গায়ে হাত তুললে সমস্যার সমাধান হবে না। আর তুমিও ঊর্মি, ঋকের মতো বাচ্চা হয়ে গেলে নাকি। চলো, বেরিয়ে এসো ঘর থেকে। প্রাণেল ঊর্মিলার হাত ধরে ঋকের ঘরের বাইরে নিয়ে চলে এল।

ঋকও যুদ্ধের ময়দান ছেড়ে পালিয়ে যাবার পাত্র নয়। সে মায়ের সঙ্গে দ্বন্দ্ব যুদ্ধে নেমেছে। যুদ্ধে জয়ীর মতো গলা হাঁকিয়ে সে বলল, আরে যাও যাও। বউয়ে প্রতি দরদ উথলে উঠছে একেবারে। আমার কী মুরোদ আছে না আছে দেখাব তোমাদের। আমাকে চড় মারলে তো তার ফল ভালো হবে না, বলে দিলাম।

ঋকের ঘরের মধ্যে চিৎকার করে বলা কথাগুলো প্রাণেল আর ঊর্মিলার কানে গেল। ঊর্মিলা হতাশ ভাবে বলল, ঋক এতটা বেপরোয়া, এতটা নির্দয় হয়ে গেল! প্রাণেল নীরব হয়ে রইল। নীরবতা ভেঙে তার মতামতের অপেক্ষা ঊর্মিলা করে না।

ঊর্মিলা জোর করায় প্রাণেল রাতের খাবার খেল। ঊর্মিলার খাওয়ায় রুচি ছিল না। মায়ের সঙ্গে কথা কাটাকাটির পর ঋক সেই যে দরজা বন্ধ করেছে, আর খোলেনি। মা তাকে ডাকতে গেলে ঘরের ভিতর থেকেই সে জানিয়েছে খিদে নেই। রাতের বিছানায় শুতে গিয়ে নানা রকম দুর্ভাবনা ঊর্মিলাকে অক্টোপাসের মতো জড়িয়ে ধরে। ঘুম আসে না সহজে। প্রাণেলকেও মাঝেমাঝেই অচেনা লাগে তার। প্রাণেল নিরলস ভঙ্গিতে জানলার কাছে দাঁড়িয়ে অকারণ ঘন ঘন সিগারেট খায়।

ঊর্মিলা একবার দুহাত বাড়িয়ে ডাকে প্রাণেলকে, কী হল! রাতদুপুরে এত সিগারেট খাচ্ছ কেন! শোবে এসো।

প্রাণেল হতাশার সুরে বলল, আচ্ছা ঊর্মি, আমি মেরুদন্ডহীন লোক বলো! এই যে সিগারেট টানছি সেটার খরচাও তোমাকে জোগাতে হয়। এমন লোককে ভালোবেসে আপশোশ হয় না তোমার?

ঊর্মিলার মন মেজাজ একদম ভালো ছিল না। তাই প্রাণেলের কথাগুলো এড়িয়ে বলল, শুতে এসো। তোমাকে ছাড়া আমার ঘুম আসে না জানো। তবু দূরে দাঁড়িয়ে আছ। কাছে এসো আমার। প্রাণেল বলল, তুমি শোও। আমি বাথরুম থেকে আসছি হাত মুখ ধুয়ে

ঊর্মিলা কথা বাড়াল না। সারা পৃথিবী নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে। ঊর্মিলার মনে হল কেবল সেই জেগে আছে একাকী। সে নিজেও জানে প্রাণেল ঘুম পাড়ালেও আজ তার ঘুম আসবে না। পরক্ষণেই ঋকের চিন্তা মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। কী করছে ঋক এখন! ছেলেটা কি ঘুমিয়ে পড়ল! সারারাত কি না খেয়ে থাকবে ছেলেটা! আগে একদম খিদে সহ্য করতে পারত না ঋক। বড়ো হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পুরোনো অভ্যাসের চরিত্র বদলাল। ঊর্মিলার বুকটা কোনও এক অজ্ঞাত ব্যথায় মোচড় দিয়ে উঠল। ঋকের গায়ে এই প্রথমবার হাত তুলল সে। তবু তার মনে হল সন্তানকে আঘাত করা মানে নিজেকে আঘাত করা। ঋক কি আদৌ বুঝবে সেকথা!

নানা দুর্ভাবনাকে প্রশ্রয় আশ্রয় দিয়ে ঊর্মিলা শোবার ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এল। তার কপালে চিবুকে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। ঘুম তার আজ হবে না। বাইরে বেরিয়ে ডাইনিং টেবিলে রাখা জলের গেলাস থেকে কয়েক ঢোক জল খেয়ে একটা হালকা নিঃশ্বাস ছাড়ল। তারপর অনেক সংশয় নিয়ে ঊর্মিলা ঋকের ঘরের দিকে পা বাড়াল। দরজাটা বোধ হয় শোওয়ার আগে ভেজিয়ে রেখেছিল ঋক। ঊর্মিলা হাত দিয়ে ঠেলতেই ক্যাঁচ করে একটা মৃদু শব্দ করে দরজাটা খুলে গেল। ঘরটার দখল নিয়েছে একটা থমথমে অন্ধকার।

ঊর্মিলা আপন মনেই বলল, নাইট বাল্বটাও জ্বালেনি ঋক। কী যে করে না ছেলেটা। একদম এই দিকটা বাবার মতো হয়েছে। নাইট বাল্ব জ্বালতেই অন্ধকার সরে গিয়ে স্নিগ্ধ আলোয় ভরে উঠল ঘর। বাল্বের পরিমিত আলোয় দেখল, এলোমেলো বিছানায় ঋক অচৈতন্য অবস্থায় ঘুমাচ্ছে। ঋকের ম্লান মুখের দিকে তাকিয়ে সে কিছু একটা ভেবে স্মিত হাসল। তারপর তার স্নেহের হাতটা বেশ কিছুক্ষণ ছেলের মাথায় বুলিয়ে দিল। ঋকও ঘুমের ঘোরে স্নেহের স্পর্শ পেয়ে নড়েচড়ে উঠল। ঊর্মিলা তার কপালে একটা স্নেহচুম্বন করে ঘরের দরজা ভেজিয়ে বাইরে বেরিয়ে এল।

ঊর্মিলা বাইরে এসে দেখল প্রচণ্ড ঝড় উঠেছে। মিশমিশে কালো আকাশ ভেদ করে মেঘ তীব্র ভাবে গর্জন করছে। ঊর্মিলা বাইরের দরজা জানালা বন্ধ করতে করতে হাঁক পাড়ল, প্রাণেল, একবার বাইরে এসো। প্রচণ্ড মেঘ করেছে। ঝড় উঠেছে। ঊর্মিলা তার নিজের ডাকের কোনও প্রত্যুত্তর না পেয়ে বিরক্তিভরে বলল, আমার পোড়া কপাল! লোকটা বোধ হয় কুম্ভকর্ণের মতো ঘুমোচ্ছে। দরজা জানালা বন্ধ করতে গিয়ে ছাঁটের জলে কিছুটা ভিজে গেল ঊর্মিলা। ভিজে জামাকাপড় বদলে ফেলে শোবার ঘরে ঢুকল সে।

ঊর্মিলা ঘরে ঢুকে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে যাবে এমন সময় দেখল, প্রাণেল বিছানায় নেই। শোবার ঘরে প্রাণেল আসেনি। ঝড় বৃষ্টির রাতে ঊর্মিলা উচ্চস্বরে প্রাণেলের নাম ধরে চিৎকার করল। কিন্তু কোনও লাভ হল না। সারা বাড়ির দমবন্ধ করা নীরবতা তাকে হাঙরের মতো গিলতে চাইল। সে ঊর্ধশ্বাসে বাথরুমে গেল। সেখানেও গিয়ে সে দেখল প্রাণেল নেই। রান্নাঘরের দরজা, ছাদের দরজা সব বন্ধ। সংশয়পূর্ণ গলায় ঊর্মিলা নিজেই বলে উঠল, কোথায় গেল প্রাণেল! ঋকের ঘরে তো যাবার কথা নয়। আমি তো ঋকের ঘরে এতক্ষণ ছিলাম।

ঊর্মিলার এবার নজরে পড়ল উত্তরে রান্নাঘরের পাশে গেস্ট রুমে। গেস্ট রুমের মৃদু আলোর রেখা ভেজানো দরজা ভেদ করে বাইরে আসছে। ঊর্মিলা হাঁপ ছেড়ে বলল, শোবার ঘরে আমি বিরক্ত করব ভেবে গেস্টরুমে লোকটা ঘুমানো বাদ দিয়ে সিগারেট খাচ্ছে। কী লোক বাবা। দেখাচ্ছি মজা।

ঊর্মিলা একরাশ অভিযোগ মাথায় নিয়ে গেস্টরুমের ভেজানো দরজা সজোরে ঠেলে বলল, কী ব্যাপার এত রাতে এ ঘরে! কথা শেষ করেই ঘরের চারদিকে তাকিয়ে ঊর্মিলার কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে এল। নাইট বাল্বের মৃদু আলোয় যা দেখল তাতে তার নিজের চোখকেই বিশ্বাস হল না। সে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে বলল, ঋক, কোথায় তুই! আমার এ কি সর্বনাশ হল! কান্নায় জড়িয়ে এল ঊর্মিলার গলা। সেই সময় ঋক বোধ হয় বাথরুম গিয়েছিল। সে ঘুম চোখে বাথরুম থেকে বেরিয়ে এল।

মায়ের তীব্র আর্তনাদ শুনে ছুটে এসে বলল, রাত দুটো বেজে গেছে। এত রাতে চিৎকার করছ কেন! ঊর্মিলা গেস্টরুমের সামনে বসেছিল। অশ্রুভেজা দু’চোখে ধরা গলায় প্রাণেলের দিকে আঙুল তুলে সে বলল, দ্যাখ ওদিকে তাকিয়ে ঋকের ঘুমের ঘোর কেটে গিয়েছিল। সে ঊর্মিলাকে জড়িয়ে ধরে অস্ফুট কণ্ঠে ডাকল, বাবা! প্রাণেলের নিথর দেহটা সিলিং ফ্যানের তলায় ঝুলছে। প্রাণেলের গলায় প্যাঁচানো রয়েছে ঊর্মিলার একটা শাড়ি। গত বছর পুজোর সময় প্রাণেল নিজের হাতে গড়িয়াহাট মার্কেট থেকে ঊর্মিলার জন্য কিনে এনেছিল।

ঋক ঊর্মিলাকে বলার মতো ভাষা খুঁজে পাচ্ছিল না। মনে মনে ঋক ভাবল, সন্ধ্যায় বাবাকে খুব অপমান করেছে। এই সবকিছুর জন্য ঋক যেন নিজেকে দায়ী করল। তারপর সে গলা ছেড়ে অঝোরে কাঁদতে লাগল। ঋক ঘরের টিউব লাইট জ্বেলে মাকে ছেড়ে ঘরের খাটের কাছে গিয়ে দাঁড়াল। খাটের কাছে যেতেই বাবার হাতে লেখা বালিশের উপর একটি খোলা চিঠি ঋকের নজরে পড়ল। ঋক চিঠিটা হাতে তুলে বলল, মা, এই দ্যাখো বাবা চিঠি লিখে রেখেছে এখানে।

ঊর্মিলা কাঁদতে কাঁদতে বলল, কী লিখেছে লোকটা! নিশ্চয়ই অনেক অভিযোগ করে গেছে আমার বিরুদ্ধে। ঊর্মিলার কথা বলতে কষ্ট হচ্ছিল। প্রাণবাযু কে যেন ভিতর থেকে শুষে নিচ্ছে। ঋক চিঠিটা পড়তে শুরু করল। চিঠিতে লেখা কথাগুলো ছিল—

প্রিয় ঊর্মি,

তোমার বিরুদ্ধে কোনও রাগ অভিমান অভিযোগ আমার কোনও দিনই ছিল না। আজও নেই। আমার মেরুদণ্ডহীনতা আমার অপদার্থতার জন্য আমি নিজেই দায়ী। তোমার উপর সব ভার চাপিয়ে আমি বোঝা বাড়িয়ে চলেছিলাম। তুমি এ জীবনে যা দিয়ে আমাকে, তা হয়তো আমার কোনও জন্মের পুণ্যের ফল। তোমার মতো স্ত্রী পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। তবু কারণে-অকারণে কত আঘাত কত কষ্ট দিয়েছি তোমায়। সেকথা সব ভাবলে আমার নিজের উপর ঘৃণা হয়। ঋকের উপর তুমি এত অভিমান কোরো না। ছেলেটা হাজার হলেও এই মেরুদণ্ডহীন অপদার্থ বাপটার ছেলে বলে, তোমাকে না বুঝে আঘাত দেয়। যেদিন ছেলেটা বুঝবে হয়তো আমারই মতো অনুশোচনার আগুনে দগ্ধ হবে। আমার ঋক যখন একদিন বাবা হবে তখন হয়তো বুঝবে বাবার মর্ম। ওকে তুমি আমার মতো নয়, তোমার মতো তৈরি কোরো, যাতে ওর ছেলেমেয়ে কোনও দিন ওর মেরুদণ্ডহীনতা অপদার্থতা চোখে আঙুল দিয়ে দেখাতে না পারে। আমি তো সে ভাবে ভালো স্বামী, ভালো বাবা হয়ে উঠতে পারলাম না। আমায় ক্ষমা কোরো। তোমাকে মুক্তি দিলাম ঊর্মি। আর একটা কথা তোমাকে বলা হয়নি। চন্দ্রকোণায় আমার ভাগের পৈতৃক সম্পত্তি বিক্রির কুড়ি লাখ টাকায় তোমার আর ঋকের নামে একটা এলআইসি করে ছিলাম। ঋকের জন্য আমার অনেক আশীর্বাদ রইল। ওকে তুমি মানুষ কোরো। তোমরা ভালো থেকো।

চিঠি পড়া শেষ করে ঋক ঊর্মিলার কাছে বসে পড়ল। কাঁদতে কাঁদতে সে বলল, মা, বাবার মৃত্যুর জন্য আমি দায়ী। বাবা আমার কাছ থেকে পাওয়া অপমান সহ্য করতে পারেনি। আমাকে তুমি শাস্তি দাও।

ঊর্মিলা কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, শাস্তি আমি দেবার কে! ওই লোকটা দেখছিস না আমাদের শাস্তি দিয়ে চলে গেল। সব ব্যথা বুকে নিয়ে আমার ভার কমিয়ে আমাকে মুক্তি দিয়ে গেছে। যাবার আগে তোকে প্রাণভরে আশীর্বাদ করে গেছে। নিজেকে অপরাধী ভাবিস না। আমার কাছে শাস্তি ভিক্ষে করার চেয়ে তোর বাবার শেষ ইচ্ছে পূরণ কর। তুই মানুষের মতো মানুষ হলে তোর বাবার আত্মা শান্তি পাবে। কথা বলতে বলতে ঊর্মিলার গলা থমকে গেল। মনে হল একটা বোবা কান্না মণ্ড পাকিয়ে গলাকে আড়ষ্ট করে দিল।

ভোর হয়ে এসেছে প্রায়। দেয়াল ঘড়িতে সাড়ে চারটে বেজে গেছে। ঝড় বৃষ্টি থেমে গিয়েছে। নীল আকাশ থেকে স্নিগ্ধ নরম আলো ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে। ভোরের দুচারটে দূরপাল্লার ট্রেন অজানা পথে হুইসেল বাজিয়ে দুর্বার গতিতে ছুটে চলেছে। পাড়ার অলিতেগলিতে কিছু কুকুর তারস্বরে ডেকে উঠল।

স্বামী প্রাণেলকে ছাড়া নতুন একটা সকাল আসছে ঊর্মিলার জীবনে। বাবা ছাড়া ঋকের নতুন অধ্যায়ে সূচনা হবে। এ যেন ঋকের পুনর্জন্ম। ঊর্মিলা ছেলেকে বুকে আঁকড়ে জলভরা দুচোখে অস্পষ্ট ভাবে হয়তো উপলব্ধি করল দূরের অনাগত দিনগুলি।

অপত্য

অফিস ফেরত রোজই একবার করে থানায় ঘুরে আসে দেবেশ। আজ তিন মাস যাবৎ এই চলে আসছে। এই কয়েকদিনের ধকলেই আদ্যোপান্ত বুড়ো হয়ে গেছে মানুষটা। মাথায় এখন কাঁচার তুলনায় পাকারই আধিক্য। চোয়াল ভেঙে গালদুটো ভিতর দিকে ঢুকে গেছে। চোখের নীচে একরাশ কালি। দেখলেই বোঝা যায় বেশ কয়েকরাত ঠিক করে ঘুমোয়নি।

আজও রুটিনের বড়ো একটা হেরফের হয়নি। অফিস চলাকালীন ইন্সপেক্টর তপন সিকদারের ফোন পেয়ে কয়েকঘন্টা আগেই থানায় ছুটে গিয়েছিল দেবেশ। বড়োবাবু অসীম জোয়ারদারের ঘরের বাইরে বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর, যে-খবরটা নিয়ে ফিরেছিল দেবেশ, তাতে তাকে আরও বিমর্ষ দেখাচ্ছিল।

স্বামীর অপেক্ষাতেই বারান্দায় পায়চারি করছিল কাবেরী। তার নজর আটকে ছিল বাইরের মূল ফটকের দিকে। দেবেশকে ঢুকতে দেখেই তাড়াহুড়ো করে দরজাটা খুলে দেয় সে। এক মিনিটও ব্যয় না করে প্রশ্ন করে বসে, ‘কোনও খবর পেলে?’ স্ত্রী-র কথার কোনও সদুত্তর দিতে পারে না দেবেশ। কেবল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। চুপচাপ জুতোটা খুলে ঘরের ভিতর ঢুকে যায়। সামনে থাকা সোফাটার উপরে ব্যাগটা রেখে মাথা নীচু করে বসে পড়ে। সেই প্রশ্নটা আবার তিরের মতো কানে এসে বেঁধে। ‘বললে না তো, কোনও খবর পেলে?’

উত্তরটা হয়তো কাবেরীরও অজানা নয়, তবু মন যে মানে না। দেবেশের কাছেও যে কোনও উত্তর নেই। কী জবাব দেবে দেবেশ, স্ত্রী-র চোখের দিকে তাকাতে পারে না সে। কোনওমতে নিজেকে সামলে নিয়ে ধীর কণ্ঠে বলে, ‘না’। একটা অস্ফুট স্বর কানে আসে কাবেরীর। পাথরের মূর্তির মতো স্থির হয়ে থাকে সে। দীর্ঘ তিনমাস যাবৎ একই কথা শুনতে শুনতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে সে। পুলিশের অক্ষমতা নিয়ে বারবার প্রশ্নও তুলেছে। ক্রমশ নিরাশা যেন গ্রাস করে ফেলছে তাদের। তাদের যে আর কিছুই করার নেই। সাধ্য অনুযায়ী সবরকম চেষ্টা তো করল এতদিন। দিনরাত থানায় পড়ে থেকেছে। এদিক-সেদিক ছুটেছে। আত্মীয়, বন্ধুবান্ধব কম করেনি। খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন পর্যন্ত দিয়েছে। এখন সবই উপরওয়ালার হাতে।

সোফার পাশে কাবেরীকে ওভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কষ্ট যেন দ্বিগুণ বেড়ে যায় দেবেশের। গলা শুকিয়ে আসে তার। খানিক স্বস্তি পেতে সামনের টি-টেবিলে ঢেকে রাখা জল ঢক ঢক করে খেয়ে নেয় সে। তারপর কাবেরীকে কাছে ডেকে বসিয়ে বলে, ‘আজকে অসীমবাবু আবার একটা নতুন খবর দিলেন।’

‘নতুন খবর!’ মুখে যেন একশো ওয়াটের বাল্ব জলে ওঠে কাবেরীর। কিন্তু সেই আলো আবার নিভেও যায়। মনের মধ্যে আশঙ্কার মেঘ জমতে শুরু করে। ভাবে, যে-কথাটা তারা কিছুতেই মন থেকে স্বীকার করতে পারছে না, তাহলে কী অবশেষে সেটাই সত্যি হয়ে দাঁড়াল। মনটা কেমন যেন কু-গাইতে থাকে। সবকিছু এলোমেলো হয়ে যায়। উদ্বিগ্ন ভাবে স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।

‘ঋকের বন্ধুরা পুলিশের মারের চাপে স্বীকার করেছে যে, তারা আমাদের ঋককে এ-পৃথিবী থেকে সরিয়ে ফেলেছে।’ বলতে বলতে গলা কেঁপে ওঠে দেবেশের। জল চিকচিক করে ওঠে চোখের কোণায়।

কথাটা শোনামাত্রই হাউহাউ করে কেঁদে ওঠে কাবেরী। থামানোর চেষ্টাও করে না দেবেশ। যদিও সান্ত্বনা দেওয়ার মতো ভাষা তার কাছে নেই। মেয়েরা তো কেঁদে-কেটে খানিক হালকা হতে পারে, কিন্তু পুরুষরা তো সেটাও পারে না। মিনিট কয়েক এভাবেই কেটে যায়। মাথা নীচু করে কপালে হাত দিয়ে বসে থাকে দেবেশ। সম্বিৎ ফেরে কাবেরীর গোঙানির শব্দে। তাড়াতাড়ি উঠে একগ্লাস জল বাড়িয়ে দেয়। তারপর আবার বলতে শুরু করে, ‘বডি পাওয়া যায়নি, তবে কিছু হাড়গোড় উদ্ধার করেছে। ওটা দেখে তো সনাক্ত করা সম্ভব নয়।’

কাতরস্বরে কাবেরী বলে ওঠে, ‘তাহলে কী করে ওরা এত নিশ্চিত হচ্ছে যে, ও-ই আমাদের ঋক। এমনও তো হতে পারে ওটা অন্য কেউ। ওরা ভুল ভাবছে।’ শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখের জল মোছে কাবেরী।

‘হ্যাঁ, ওদের ধারণা ভুল প্রমাণিত হতেই পারে। সেই কারণেই তো ওরা ডিএনএ টেস্ট করে দেখতে চাইছে। কাল একবার থানায় গিয়ে ব্লাড স্যাম্পেল দিয়ে আসতে বলেছে।’

‘ব্লাড স্যাম্পল?’ কেমন যেন চমকে ওঠে কাবেরী। একমুহূর্তেই আতঙ্কের কালো মেঘ ছেয়ে যায় কাবেরীর চোখেমুখে।

‘ভয় পাচ্ছ কেন, এমনও তো হতে পারে তোমার ধারণাই ঠিক। ও আমাদের ঋক নয়।’

দেবেশের সান্ত্বনা কাজে আসে না। ছটফট করতে থাকে কাবেরী। দেবেশ ভাবে ছেলে হারানোর শোক একজন মা-কে অস্থির করে তুলেছে। কোনওরকমে শান্ত করে ওষুধ খাইয়ে শুইয়ে দেয় কাবেরীকে। তারপর নিজে ড্রইং রুমে আরাম কেদারায় গা এলিয়ে দিতেই বহু পুরোনো কথা মনের মধ্যে ভিড় করে আসে।

দেবেশের পারিবারিক ব্যাকগ্রাউন্ড বেশ ভালো। সম্ভ্রান্ত পরিবার। বাবা রিজার্ভ ব্যাংক-এ চাকরি করতেন। মা হাউজওয়াইফ হলেও যথেষ্ট কোয়ালিফায়েড। তখনকার দিনে এমএ পাশ করাটা চাট্টিখানি কথা নয়। শুধুমাত্র সংসার আর বাচ্চাকে ভালোবেসে কেরিয়ারের কথা ভাবেননি। সংসার আর ছেলেকে নিয়েই স্বাচ্ছন্দ্যে কাটিয়েছেন। প্রভাব প্রতিপত্তি, বৈভবের মাঝে কখনও হারিয়ে ফেলেননি নিজেকে। ছেলেকেও ঠিক নিজের মনের মতো করে মানুষ করেছেন। দেবেশ যখন বছর আঠাশের তখনই মারা যান দেবেশের বাবা। তখন সবে সবে রেলে-র চাকরিতে জয়েন করেছে দেবেশ। পড়াশোনায় বরাবরই ভালো ছাত্র হিসাবে কলেজে নামডাক ছিল। চাকরিটাও পেয়ে যায় জীবনের প্রথম পরীক্ষাতে বসেই। সংসার বলতে মা আর ছেলে। ছেলে অফিস বেরিয়ে যাওয়ার পর বড়ো একাকী বোধ করতেন দেবেশের মা। তাই যুদ্ধকালীন তৎপরতায় পছন্দ করা পাত্রীর সঙ্গে ছেলের বিয়ে দিয়েছিলেন। দেবেশের বাবা তাঁর ছোটোবেলার বন্ধুর একমাত্র মেয়ের সাথে ছেলের বিয়ে একরকম পাকা করেই রেখেছিলেন। বাবার পছন্দ করা পাত্রী কাবেরী-র সাথেই বিয়ে হয়েছিল দেবেশের। অবশ্য দেবেশও যে বিয়ের আগে কাবেরীকে দেখেনি এমন নয়। একই কলেজে পড়াশোনা করেছে, বেশ কয়েকবার আলাদা করে কথাও বলেছে। বিয়ের আগে বার দুয়েক কলেজের বাইরে দেখাও করেছে তারা।

দেবেশের মা উমাদেবী ভেবেছিলেন বউমাকে একেবারে মেয়ের মতো করে রাখবেন। ঘুরবেন, ফিরবেন, গল্প করবেন। নাতি-নাতনি নিয়ে সুখে সংসার করবেন। কিন্তু ভাবনা তো ভাবনাই। বাস্তবের সঙ্গে এর তফাত অনেকটা। প্রথম প্রথম সব ঠিক থাকলেও দিনকতক পর উমাদেবী বুঝতে পারেন তাঁর আধুনিক মনস্ক বউমার মন সংসারের তুলনায় বাইরের দিকেই বেশি। সবসময় বন্ধুবান্ধব, পার্টি। সমাজসেবার নামে এখানে সেখানে বেরিয়ে পড়া।

উমাদেবী বউমার এই যখন-তখন বেরিয়ে পড়া, রাত করে বাড়ি ফেরা নিয়ে মাঝেমধ্যেই আপত্তি তুলতেন। এই নিয়ে শাশুড়ি-বউমার টুকটাক অশান্তিও লেগে থাকত। তবে এসব ব্যাপারে বড়ো একটা মাথা ঘামাত না দেবেশ। বরং তার ধারণা ছিল সংসারের চাপ পড়লে কাবেরী নিজে থেকেই ক্লাব, পার্টি এসমস্ত ছেড়ে দেবে। তখন বাচ্চার টানে নিজেই সংসারের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেবে। কাজেই শুধু শুধু অশান্তি করে লাভ কী। এরকম তো অনেক মেয়েই ভাবে বাচ্চা নিলে তার ফিগার নষ্ট হয়ে যাবে। আগের মতো আর আকর্ষণীয় থাকবে না। কিন্তু ক’টা মেয়ে এই ভাবনা-চিন্তায় অনড় থাকতে পারে। একবার মা হলে এসমস্ত তাদের আর খেয়ালই থাকে না।

কিন্তু কাবেরীর ক্ষেত্রে এমনটা হয় না। বিয়ের পাঁচ বছর পরে পুত্রসন্তানের জন্ম দেওয়ার পরেও কাবেরীর স্বভাবে কিছুমাত্র রদবদল ঘটে না।

মাস তিনেক বাড়িতে থাকার পর শাশুড়ি আর আয়ার ভরসায় আবার আগের মতো ক্লাব, পার্টি করতে শুরু করে সে। বয়সের ভারে আয়ার সাহায্য নিতে হয়েছে ঠিকই তবে যতদিন উমাদেবী বেঁচেছিলেন ততদিন ঋক-কে উনিই সামলেছেন। কিন্তু মানুষের মৃত্যুর কথা কে বলতে পারে, যখন ঋকের বছর দশ বয়স তখনই একদিন হঠাৎ করে বুকে ব্যথা। আধ ঘন্টাও সময় দেননি। ডাক্তার নিয়ে আসতে আসতেই সব শেষ। তার পর থেকেই ঋক বড়ো একা। কারও সাথে তেমনভাবে কথা বলে না। সারাক্ষণ হয় টিভি দেখে নয়তো বাচ্চাদের পত্রিকা হাতে বসে থাকে। সে যেন নিজের একটা আলাদা পৃথিবী বানিয়ে ফেলেছে, সেখানে কারওর অবাধ প্রবেশ নিষেধ। দেবেশ আপ্রাণ চেষ্টা করে ছেলেকে খুশি করার, যার জন্যই ছেলের পছন্দের এটা-ওটা-সেটা নিয়ে আসে। সন্ধেবেলা অফিস থেকে ফিরে ছেলের হোমওয়ার্ক করানো, তাকে খাওয়ানো, খেলা করা সবশেষে ঘুম পাড়ানো, সমস্তটাই নিজে হাতে করার চেষ্টা করত দেবেশ। কিন্তু তবু কোথাও যেন একটা ফাঁক থেকেই যেত। রাত দশটার পরে কখনও বা তারও পরে কিটি পার্টি সেরে ফিরত কাবেরী। তখন তার এমন হুঁশ থাকত না যে একমাত্র ছেলের ঘরে গিয়ে তার সাথে দুটো কথা বলে বা মমত্ব উজাড় করে দেয়। কখনও তো ঠিক করে এটা জানার চেষ্টা করেনি যে, তার নাড়ি ছেঁড়া সন্তান কীভাবে বড়ো হচ্ছে, তার কোনও অসুবিধা হচ্ছে কিনা, মায়ের জন্য তার মন কাঁদে কিনা। কোনওদিন কাছে ডেকে সুখ-দুঃখের কথাও যেমন বলেনি তেমনি আদর করে ছেলের পাশে বসে তাকে খাওয়ায়ওনি। মা-ছেলের মধ্যে সেই বন্ডিং-টাই কোনওদিন তৈরি হয়নি। হওয়ার কথাও নয়। বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে ঘুরতে গিয়ে মল থেকে চারটে দামিদামি জামাকাপড় এনে দিয়েই কর্তব্য শেষ হয়ে যায় না, কাজেই দূরত্ব তৈরি হওয়াটাও অস্বাভাবিক নয়।

বছরের পর বছর চলে যায়। কিন্তু কাবেরীর মধ্যে কোনও পরিবর্তন আসে না। ঋকও এখন বছর সতেরোর। বারো ক্লাসের ছাত্র। তারও লাইফস্টাইলে আমূল পরিবর্তন ঘটেছে। সে ও রাত করে বাড়ি ফিরতে শিখেছে। নজর এড়ায়নি দেবেশেরও। খেয়াল করে দেখেছে বাড়ি ফিরেই সে, সোজা নিজেকে ঘরের মধ্যে বন্দি করে নেয়। হাজার ডাকাডাকি করলেও দরজা খোলে না। বিভিন্ন রকম টালবাহানা করে এড়িয়ে যায়। কখনও বলে শরীর ভালো নয়, কখনও খেতে ইচ্ছে করছে না বলে ডিনার টেবিলে একসঙ্গে বসে রাতের খাবার খাওয়ার ব্যাপারটা কাটিয়ে দেয়। ব্যাপারটা ভাবিয়ে তোলে তাকে। মনস্থির করে, এই নিয়ে ছেলের সাথে কথা বলবে।

সেইমতো পরদিন সকালবেলা খাবার টেবিলে ছেলেকে পাকড়াও করে দেবেশ। ‘তুই রোজ রোজ দেরি করে বাড়ি ফিরছিস। অর্ধেক দিন বাড়িতে খাচ্ছিস না। ব্যাপারটা কী বলতো? অত রাত পর্যন্ত থাকিস কোথায়? পড়াশোনাটাই বা কেমন চলছে সেটাও তো বুঝতে পারছি না। সামনের বছর বোর্ড দিবি, মাথায় আছে সেটা?’

‘আমাকে নিয়ে একদম চিন্তা কোরো না। স্কুলের পর পাপানদের বাড়িতে আমরা সবাই একসাথে পড়াশোনা করি। সেইজন্যই ফিরতে দেরি হয়।’

‘পাপান-টা কে? এর নাম তো আগে কখনও শুনিনি। থাকে কোথায়?’

‘তুমি কী সবাইকে চেনো নাকি। ও বাপ্পাদের বাড়ির কাছে থাকে।’

ঋকের কথা পুরোপুরি বিশ্বাস না করলেও আর কথা বাড়ায় না দেবেশ। কিন্তু ছেলের গতিবিধির ওপর নজর রাখতে শুরু করে। কয়েকদিনের মধ্যে দেবেশ বুঝে গিয়েছিল ছেলে কোনও অসৎ সঙ্গের পাল্লায় পড়েছে। মাঝে দু-দিন তো ঠিকভাবে হেঁটে চলে বাড়ি ফিরতে পারেনি। কোনও রকমে এদিক-ওদিক করতে করতে সোজা নিজের ঘরে। দেবেশের বারবার ডাকা সত্ত্বেও উত্তর করেনি ঋক। পরদিন সকাল পার হয়ে দুপুর গড়াতে তবে তার ঘুম ভেঙেছে।

চিন্তায় দেবেশের ঘুম উড়ে গিয়েছিল। একমাত্র ছেলে। এইভাবে চলতে থাকলে কেরিয়ার, ভবিষ্যৎ সব শেষ হয়ে যাবে। একেবারে অন্ধকারের মধ্যে ডুবে যাবে ছেলেটা। এই প্রসঙ্গে কাবেরীর সঙ্গেও কথা বলেছে দেবেশ। হালকা হওয়ার বদলে আশ্চর্যই হয়েছে। ‘এখন এনজয় করবে না তো কবে করবে, এই তো বয়স। তাছাড়া রোজ তো আর এমনটা করছে না। মাঝেমধ্যে এক-আধটা দিন হতেই পারে। এগুলো ধরলে কী চলে। খেলনা নিয়ে খেলার বয়স তো আর নেই। কাজেই এই বয়সে একটু অন্যরকম কিছু করার ইচ্ছে জাগবে সেটাই স্বাভাবিক। এই নিয়ে অযথা টেনশন নিও না।’

সত্যিই একেবারে অন্যরকম কিছুই করে দেখাল ঋক। দেবেশ তো দূর, কাবেরীও বোধহয় এরকমটা কখনও কল্পনা করেনি।

কোনওরকমে এইচএস পাশ করেছে ঋক, কিন্তু নাম্বার এতটাই কম পেয়েছে যে ভালো কোনও কলেজে ভর্তি করানোটাই বড়োরকমের সমস্যা হয়ে দাঁড়াল। এখন তো বাচ্চারা কম্পিটিশনের কারণে বিভিন্ন কোচিং ক্লাস নিয়ে আটানব্বই শতাংশ পর্যন্ত মার্কস তুলছে। নব্বই শতাংশ পেয়েও ভালো কলেজে অ্যাডমিশন পেতে রীতিমতো হিমশিম খেতে হচ্ছে তাদের। সেখানে ঋকের নম্বর তো একেবারে চল্লিশ

শতাংশের কোটায়। দেবেশ নিজের সোর্স লাগিয়ে কোনওমতে একটা কলেজে অ্যাডমিশনের ব্যবস্থা করিয়েছিল ঠিকই, কিন্তু ভর্তি করলেই তো হবে না, পড়াশোনাটাও তো জরুরি। জোর করে তো কারওর উপর কোনও কিছু চাপিয়ে দেওয়া সম্ভব নয়। ছেলে বড়ো হয়ে গেলে তার গায়ে হাত তোলাও সম্ভব নয়। তাতে হিতে বিপরীত হতে পারে। কত বুঝিয়েছে। ততদিনে ড্রাগস, মদে নিজেকে ডুবিয়ে ফেলেছে ঋক।

বাবা-মা যতরকম ভাবে ছেলেকে শোধরানোর চেষ্টা করে দেবেশ, কাবেরীও ঠিক ততটাই করেছিল। ঋক-এর নেশায় আসক্ত হওয়ার পর থেকে কাবেরীর মধ্যে অনেক চেঞ্জ এসেছে। এখন ক্লাব, পার্টির নামও মুখে আনে না। কোথাও একটা অপরাধবোধ কাজ করতে থাকে তার মধ্যে। মুখে না বললেও মনে মনে নিজেকে দূষতে থাকে সে। ভাবে সে যদি সোশ্যালাইজ না করে আর পাঁচটা মায়ের মতো আদর-স্নেহে লালনপালন করত ছেলেকে, সবসময় তার পাশেপাশে থাকত– তাহলে বোধহয় ছেলেটা এভাবে নষ্ট হয়ে যেত না।

একাধিক ডাক্তারের পরামর্শ নিয়েছে। এমনকী প্রয়োজনে রি-হ্যাব সেন্টারের কথাও ভেবেছে তারা। এতে ফল আরও উলটোই হয়েছে। রি-হ্যাবের নাম শুনে বাড়ি ফেরা বন্ধ করে দিয়েছে ঋক। রাতের পর রাত বন্ধুদের সঙ্গে তাদের ভাড়া করা বাসায় পড়ে থেকেছে। তারাও ঋকের মতো ড্রাগ অ্যাডিকটেড। পড়াশোনার নামে বাড়ির থেকে দূরে থাকে। আর এই সমস্ত করে বেড়ায়। অথচ বাবা-মায়েরা এই ভেবে বুকের উপর পাথর চেপে রাখে যে, তাদের বাচ্চারা পড়াশোনা করে নিজেদের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল করছে।

দেবেশের হাতে আর কিছুই ছিল না। কাবেরীর অবস্থা তো আরও করুণ। আপশোশ করা ছাড়া আর কোনও পথ দেখছিল না সেও। কতদিন এমন হয়েছে ছেলেকে খুঁজতে, এই ক্লাব, সেই ক্লাব, এই বন্ধুর বাড়ি, সেই বন্ধুর বাড়ি করে বেড়িয়েছে। কখনও ছেলেকে বেহুঁশ অবস্থায় নিয়ে ফিরেছে। আবার কখনও নিরাশ হয়ে ফিরেছে খালি হাতে। এমনও দিন গেছে খাটের মধ্যে বেহুঁশ ছেলেকে পড়ে থাকতে দেখে, ঘরের কোণায় বসে রাতের পর রাত কাটিয়েছে দুজনে। চোখের জল ফেলেছে। ঋকের এই বিপথে যাওয়ার আসল কারণটা কী, সেটা বিলক্ষণ জানত দেবেশ। সেই নিয়ে যে ক্ষোভও রয়েছে যথেষ্ট। কিন্তু এখন আর সেই বিতর্কেও গিয়ে লাভ নেই। কোনও কিছুই আর কাজে আসবে না।

শেষমেশ ঠিক হল ঋককে জোর করেই রি-হ্যাব-এ পাঠানো হবে। সেইমতো সমস্ত কথাবার্তা পাকা করা হল। এর মাঝেই ঘটল এক বিপত্তি। হঠাৎ একদিন একটা নিউজ চ্যানেলে বারবার ঋকের সঙ্গে তার কয়েকজন বন্ধুকে আপত্তিকর অবস্থায় একটা ঘরে পড়ে থাকতে দেখাল। বেশ কয়েকজন একেবারে বিবস্ত্র। খবর করা হচ্ছে, শহরের স্বচ্ছল পরিবারের বেশ কয়েকটি বখে যাওয়া ড্রাগ অ্যাডিকটেড সমকামী ছেলেদের কুকীর্তি নিয়ে। একের পর এক ফোন। হাজারো প্রশ্ন। কী জবাব দেবে দেবেশ। লজ্জায় মাথা কাটা যাবার উপক্রম হয়েছিল তাদের। কী করবে সে। ড্রাগ, মদের নেশা না হয় ছাড়াতে পারবে। কিন্তু তাই বলে সমকামীতা! এটা একজন বাবা-মায়ের কাছে মারাত্মক লজ্জার। এর আগেও নেশার কারণে ঋক যখন মায়ের বালা চুরি করে বিক্রি করে দিয়েছিল, তখনও বোধহয় এতটা শক্ড হয়নি তারা, যতটা এখন। পরিস্থিতি যে কখন কাকে কোথায় নিয়ে ফেলে। তবু ছেলে তো। হাল তো ছেড়ে দেওয়া যায় না। ঘটনাস্থল থেকেই পুলিশ তুলে নিয়ে গিয়েছিল ঋকদের। সেখান থেকে ছাড়িয়ে এনে সোজা রি-হ্যাব। তারপর দীর্ঘদিন কাউন্সেলিং।

মাস ছয়েক পরে ঋক যখন বাড়ি ফিরে আসে, তখন একেবারে স্বাভাবিক। দেবেশ – কাবেরী কল্পনাই করতে পারেনি যে ঋক আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারবে। টাইমে খাওয়াদাওয়া, পড়াশোনা, বেড়ানো। ছেলেকে নিয়ে বেশ ভালোই ছিল তারা। মাস দেড়েক এভাবেই কেটে গেল।

একদিন সকালে সকলে মিলে ব্রেকফাস্ট করতে বসেছে, ঠিক সেই সময়ে ঋকের ফোনটা বেজে উঠল। সেই দিন বিকেলে ‘ঘন্টাখানেকের মধ্যে ফিরে আসব’ বলে সেই যে বাড়ির বাইরে বেরোল আর বাড়িমুখো হয়নি ছেলেটা। বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়পরিজন, ক্লাব– কোনও হদিশ মেলেনি তার। নিরুপায় হয়ে থানায় গিয়ে মিসিং ডায়েরি করে এসেছিল দেবেশ। তারপর কেটে গেছে আরও তিনটে মাস। নিরন্তর মনের সাথে যুদ্ধ করতে করতে এখন খানিকটা ধাতস্থ হয়ে গেছে তারা।

প্রথমদিকে তো পুলিশ সেভাবে গুরুত্ব দেয়নি। তারা ভেবেছিল ছোটো ছেলে রাগ করে বাড়ি থেকে পালিয়ে গেছে। টাকা-পয়সা ফুরিয়ে গেলেই আবার বাড়ি ফিরে আসবে। কিন্তু ঋক-এর পাস্ট লাইফের ঘটনা শুনে দেবেশের সঙ্গে সঙ্গে তাদেরও মনে হয়েছে এটা নিছক কোনও সাধারণ ঘটনা হতে পারে না, অন্য রহস্যের গন্ধ পায় তারাও। সেইমতো তারা তদন্ত করতে থাকে। ঋক-এর সমস্ত বন্ধুবান্ধবদের থানায় ডেকে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।

তারপর থেকে দেবেশ রোজই একবার করে থানায় গিয়ে খোঁজখবর নিয়ে আসে। বড়োবাবু অসীম জোয়ারদার কতবার বলেছেন এভাবে রোজ-রোজ থানায় না যেতে। কোনও খবর হলে উনি নিজেই ফোন করে ডেকে নেবেন। কিন্তু একজন বাবার মন কী আর সে-সব মানে। আশায় বুক বেঁধে রোজই ছুটে যায়।

আর আজ তো একেবারে ছেলের মৃত্যুর সম্ভাবনা প্রায় নিশ্চিত করে দিলেন জোয়ারদার সাহেব। ঋকের বন্ধুদের কথা অনুযায়ী দুর্ঘটনাস্থল থেকে পুলিশ কিছু অস্থি পেয়েছে। যেহেতু ঋকের বডি পাওয়া যায়নি, সেই কারণেই ডিএনএ টেস্ট জরুরি হয়ে পড়েছে। তাই তাকে আর কাবেরীকে থানায় যেতে হবে, সেখান থেকে হাসপাতালে। পুরোনো স্মৃতি রোমন্থন করতে করতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছে দেবেশ। ঘুম ভাঙে সকালবেলা বংশী দুধওয়ালার বেলের আওয়াজে। কথামতো সকাল সকাল থানার উদ্দেশে বেরিয়ে পড়ে দেবেশ আর কাবেরী।

এর প্রায় একমাস পরে বেলা এগারোটা নাগাদ থানা থেকে বড়োবাবুর ফোন আসে। দেবেশ তখন অফিসের ফাইলে মুখ গুঁজে আছে। ‘ডিএনএ টেস্ট-এর রিপোর্টটা চলে এসেছে। একবার থানায় চলে আসুন।’

‘রিপোর্টে কী আছে?’ উদ্বেগজনক ভাবে প্রশ্ন করে দেবেশ।

‘আপনি থানায় এলে তো সবই জানতে পারবেন।’ বেশ গম্ভীর শোনায় জোয়ারদারের গলা।

জোয়ারদারের ফোন পাওয়ামাত্রই ফাইল-টাইল ভুলে বাড়ির পথে রওনা দিয়েছিল দেবেশ। অফিস থেকে বেরোনোর আগেই কাবেরীকে সমস্তটা জানিয়ে রেডি হয়ে থাকতে বলেছিল সে। সেই মতো দুজনে হাজির হয়েছিল থানায়। কাবেরীর মধ্যে একটা অস্বস্তির ছাপ দেখা গেলেও আজ দেবেশ অনেক স্থিতধী। যেন সবকিছুর জন্যই সে প্রস্তুত।

থানার আর এক ইন্সপেক্টর দেবেশকে সঙ্গে করে নিয়ে যায়। আর কাবেরীকে সেইখানেই অপেক্ষা করতে বলে। দেবেশকে ভিতরের একটি ঘরে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে বড়োবাবু অসীম জোয়ারদারও উপস্থিত রয়েছেন। একটু অবাক হয় দেবেশ। তারপর ধীর কণ্ঠে বড়োবাবুকে জিজ্ঞেস করে, ‘তাহলে কী…?’ বলেই ধপ করে বসে পড়ে চেয়ারে।

দেবেশবাবুর মনের অবস্থা আঁচ করতে পারেন অসীম জোয়ারদার। তারপর বলতে শুরু করেন, ‘দেখুন দেবেশবাবু, আমাদেরও বলতে খারাপ লাগছে, কিন্তু সত্যিটা তো সামনে আনতেই হবে। ব্যাপারটা সত্যিই খুব সিরিয়াস, তাই আপনাকে জানানোটা জরুরি। ডিএনএ টেস্ট-এর রিপোর্ট অনুযায়ী যে ব্যক্তির অস্থি পেয়েছিলাম, সেটা ঋকেরই।’

ক্ষণিকের একটা ঝটকা লাগলেও, বুকের উপর পাথর রেখে প্রশ্ন করেছিল বড়োবাবুকে, ‘কিন্তু ওর হত্যার পিছনে কোনও সঠিক কারণ তো থাকবে। সেগুলো আমি জানতে চাই অসীমবাবু। কেন এত

নৃশংসভাবে মারা হল আমার ওই একরত্তি ছেলেটাকে?’

‘আপনি তো জানতেন-ই যে আপনার ছেলে, আর-পাঁচটা ছেলের মতো স্বাভাবিক নয়। একাধিক ছেলের সঙ্গে তার সমকামী সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। যাই হোক, যে ছেলেগুলো ধরা পড়েছে এরা তাদেরই একটা গ্রুপ। একটা সময় ঋকের এদের সঙ্গেই সম্পর্ক ছিল। সারাদিন হেরোইনের নেশায় বুঁদ হয়ে থাকত ছেলেগুলো। ওদেরই মধ্যে ম্যাক বলে একটি ছেলে, শহরের নামি উকিল অভিষেক জালানের একমাত্র বখাটে ছেলে। সে নিজেও নেশায় বুঁদ হয়ে থাকে আর অন্যদের নেশা করার জন্য টাকা ধার দেয়। নতুন নতুন পার্টনারের ব্যাপারেও তার প্রবল আগ্রহ। ঋক-কে খুব মনে ধরেছিল তার। তাই কখনও টাকা চাইত না ঋকের কাছ থেকে। রি-হ্যাব থেকে ফেরার পর ঋকের নেশা ছেড়ে দেওয়া, তার সঙ্গ ছেড়ে দেওয়াটা মেনে নিতে পারেনি সে। রি-হ্যাব থেকে ফেরার পর ঋককে বারবার ফোন করেছে তার কাছে ফিরে যাওয়ার জন্য। ঋক রাজি না হওয়াতেই এই বিপত্তি। সে শর্ত দিয়েছিল, হয় তাকে টাকা ফেরত দিতে হবে, নয়তো আগের মতো সঙ্গ দিতে হবে। টাকা ফেরতের ব্যাপারটা তো অজুহাত মাত্র, তার উদ্দেশ্যই ছিল ঋককে পাওয়া। কল লিস্ট দেখে আমরা জানতে পেরেছি, সেদিনের ওই ফোনটা ম্যাক-এরই ছিল। সে-ই ডেকেছিল তাকে। টাকাপয়সা নিয়ে ব্ল্যাকমেল করতে শুরু করেছিল ঋক-কে। একপ্রকার বাধ্য হয়েই ঋক সেদিন জানাতে গিয়েছিল, টাকা সে ধীরে ধীরে শোধ করে দেবে। ঋক-কে না পেয়ে সেদিন জোশের মাথায় গুলি চালিয়ে দিয়েছিল ছেলেটি। তারপর বাকি বন্ধুদের সহায়তায় লাশ গায়েব করে দিয়েছিল।’ অসীমবাবুর কথাগুলো শেলের মতো বুকে এসে বিঁধছিল দেবেশের। চোখ দিয়ে টপটপ করে জল পড়ে জামার উপরের দিকে বেশ খানিকটা অংশ ভিজে গিয়েছে। সহানুভূতি দেখাতে, অসীমবাবু দেবেশের কাঁধে হাত রাখেন। দেবেশের দিকে একগ্লাস জল এগিয়ে দিয়ে আবার বলতে শুরু করেন, ‘দেবেশবাবু আর একটা কথা জানানোর ছিল। জানি না, কথাটা বলার এটাই উপযুক্ত সময় কিনা, তবুও ডিউটির খাতিরে আমাকে বলতেই হবে। নয়তো আদালতে জেরার সময়ে আপনি জানতেই পারবেন।’

নিজেকে খানিক শক্ত করার চেষ্টা করে দেবেশ। ‘কী ব্যাপার বলুন না। এই কষ্টটা যখন সহ্য করতে পেরেছি, তখন আর কোনও কিছুই আমাকে ছুঁতে পারবে না। আপনি বলুন।’

‘দেবেশবাবু, ঋক কাবেরীদেবীর ছেলে এটা যেমন সত্যি, তেমনি রিপোর্ট অনুযায়ী এটাও সামনে এসেছে যে, ঋক আপনার ঔরসজাত সন্তান নয়।’

একমুহূর্তেই চোখের সামনে অন্ধকার নেমে আসে দেবেশের। মাথাটা ঘুরে যায় তার। যেন কেউ সপাটে তার গালে একটা চড় কষিষে দিয়েছে।

কিছুক্ষণ ওইভাবেই ঘোরের মধ্যে বসে থাকে দেবেশ। ইন্সপেক্টরও তার মনের কথা বুঝে চুপ করে যান।

খানিক পরে কাবেরীর চিৎকারে সম্বিৎ ফেরে দেবেশের। ‘আমাকে কেন ভিতরে যেতে দেওয়া হচ্ছে না।’

কী যেন ভাবে দেবেশ। তারপর হাতজোড় করে বড়োবাবু অসীম জোয়ারদারকে বলে, ‘অসীমবাবু, যা হওয়ার হয়ে গেছে। আমাদের ঋক আর কোনওদিন আমাদের কাছে ফিরে আসবে না। কিন্তু আপনার কাছে আমার রিকোয়েস্ট, আমি এতদিন যে-মিথ্যেটাকে সত্যি ভেবে বেঁচে এসেছি, বাকি জীবনটাও সেটা নিয়েই কাটাতে চাই। এটা আমার আর কাবেরীর দাম্পত্যের জন্যও জরুরি।’

‘ঠিক বুঝলাম না দেবেশবাবু।’

‘প্লিজ অসীমবাবু, আপনি আমার স্ত্রীকে এটা কখনওই জানতে দেবেন না যে আমি জেনে গেছি যে ঋক আমার আপন সন্তান নয়।’

কী যেন ভেবে মাথা চুলকে নেন অসীম জেয়ারদার। দেবেশকে আশ্বস্ত করে বলেন, ‘ঠিক আছে। কথা দিচ্ছি, আমি আমার সাধ্যমতো চেষ্টা করব। চেষ্টা করব আপনার স্ত্রীকে সাক্ষী না বানাবার।’

‘অশেষ ধন্যবাদ অসীমবাবু। আপনার ঋণ আমি কোনওদিনও শোধ করতে পারব না।’ কৃতজ্ঞতা জানাতে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা বড়োবাবুর হাতদুটো চেপে ধরে দেবেশ।

কিছুক্ষণ পর একেবারে বিধবস্ত অবস্থায় থানা থেকে কাবেরীকে নিয়ে বের হয় দেবেশ। কাবেরী পাগলের মতো করতে থাকে। বারবার জিজ্ঞাসা করতে থাকে, ‘কী হল? বড়োবাবু কী বলছেন? ডিএনএ রিপোর্ট-এ কী এল। ওটাই আমাদের ঋক?’

গাড়িতে উঠে কাবেরীর মাথা নিজের কাঁধের উপর টেনে নেয় দেবেশ। তারপর খুব ধীর কণ্ঠে বলে, ‘কাবেরী নিজের মনকে শক্ত করো। যা হওয়ার হয়ে গেছে। তোমার ঋক যে পথে এগিয়ে গিয়েছিল তাতে ভগবান বোধহয় এটাই সঠিক মনে করেছেন।’

হাউহাউ করে কেঁদে ফেলে কাবেরী। বাধা দেয় না দেবেশ। শুধু শক্ত করে ধরে রাখে তাকে।

 

শেষবারের মতো

সকাল সকাল উঠে পড়া গীতার বরাবরের অভ্যাস। আজকের দিনটাও তার ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু ঘুম ভাঙার পরেও বিছানা ছাড়তে আজকে কিছুতেই ইচ্ছে করছে না গীতার। কীরকম যেন আলসেমি লাগছে। এপাশ ওপাশ করতে করতে অজয়ের দিকে পাশ ফিরল।

অঘোরে ঘুমোচ্ছে অজয়। গীতার স্বামী। অজয়ের উপর চোখ পড়তেই গীতার মনটা আশ্চর্য রকমের দ্রব হয়ে উঠল।

অজয়ের কপালে তপ্ত ঠোঁটের চুম্বন এঁকে দিয়ে বিছানা থেকে নামবার জন্য পা বাড়াতেই অজয়ের বলিষ্ঠ বাহু এক ঝটকায় গীতাকে নিজের শরীরের উপরে এনে ফেলল। অজয়ের শরীরের উষ্ণতা গীতার স্বাভাবিক বোধবুদ্ধিকে গ্রাস করে নেওয়ার উপক্রম করল। তাও নিজেকে সংযত করার চেষ্টা করল গীতা। অজয়ের বলিষ্ঠ বাহুর বন্ধন থেকে গীতা নিজেকে আপ্রাণ ছাড়াবার চেষ্টা চালাতে চালাতে কপট রাগ দেখাল।

‘আঃ কী করছ কী? সকাল হয়ে গেছে খেয়াল নেই?’

‘তো কী হয়েছে? আমি নিজের বউয়ের সঙ্গে প্রেম করছি সেটাও দোষের?’ অজয়ের চোখে দুষ্টুমির হাসি চিকচিক করে ওঠে।

‘না, ছাড়ো আমাকে। আজকে থেকে আমাকে মর্নিং ওয়াকে যেতেই হবে। বুঝতে পারছি অসম্ভব ওয়েট পুট অন করছি।’

‘তাই জন্যই তো তোমার শরীরের এ টু জেড আমাকে মেপে রাখতে হবে নয়তো বুঝব কী করে যে সত্যি সত্যি হাঁটতে যাচ্ছ নাকি বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা মেরে বাড়ি ফিরে চলে আসছ।’

‘তাহলে সঙ্গে যাচ্ছ না কেন আমার উপর নজর রাখতে?’

‘এক বছর আগে যখন এই বাড়িতে তুমি নতুন বউ হয়ে এসেছিলে, তখনই কোনওদিন তোমাকে সন্দেহ করিনি তাহলে আজকে নতুন করে কেন শুরু করব?’

‘হ্যাপি ম্যারেজ অ্যানিভার্সারি’, গীতা নিজের আনন্দ চেপে রাখতে না পেরে অজয়ের বুকে মুখ লুকোয়।

‘গীতা, আমি প্রমিস করছি আমাদের বিবাহিত জীবনের সুখ, আনন্দ আমি কোনওদিন এতটুকুও ফিকে হয়ে যেতে দেব না। সারাজীবন আমি তোমাকে সুখে রাখবার চেষ্টা করে যাব।’

আনন্দে গীতার চোখে জল চলে আসে। পাছে অজয় এই আনন্দাশ্রু দেখে ফেলে, লজ্জায় গীতা অজয়ের বুকে মুখ গুঁজে রাখে।

গীতা হাতের ঘড়ির দিকে তাকায়। একঘণ্টা কেটে গেছে। ঘামে শরীর চপচপ করছে। বাড়ি থেকে যখন বেরিয়েছিল তখন আকাশ সবে ফরসা হতে শুরু করেছে। এখন ভালো রোদ উঠে গেছে। গীতা বাড়ির দিকে পা বাড়ায়।

বাড়ি পেৌঁছোতেই অজয় লেবু মধুর জল এগিয়ে দেয় গীতার দিকে। অজয়ের এই ছোটো ছোটো জিনিসের খেয়াল রাখার স্বভাবটা গীতার বড়ো ভালো লাগে। গীতা চেয়ারে বসে লেবু মধুর জলের গেলাসে ঠোঁট লাগায়।

অজয় চোখ দিয়ে গীতাকে খানিকটা মেপে নেয়, ‘বাঃ, একদিনেই তো তোমাকে বেশ খানিকটা রোগা লাগছে।’

‘মিথ্যা কথা বোলো না তো। একদিনে কেউ আবার রোগা হয় নাকি?’

‘কথাটা আজকে তোমার মিথ্যা মনে হলেও, এক মাস বাদে কিন্তু আমার কথা যে সত্যি হবেই এটা আমি এখনই বুঝতে পারছি।’

‘না গো, তোমার চোখে নিজেকে সুন্দর রাখার জন্য তো বটেই, নিজের শরীর স্বাস্থ্যের কথা ভেবেও আমাকে যেমন করে হোক রোগা হতেই হবে।’

‘গুড। আচ্ছা এখন বলুন তো ম্যাডাম, তৈরি হয়ে বেরোতে আপনার কতটা সময় লাগবে?’

‘তার মানে তুমি বলতে চাও, আজকের এই বিশেষ দিনে আমার সাজতে-গুজতে কতটা সময় লাগবে?’

‘ঠিক ধরেছ, বিশেষ দিনের বিশেষ সাজ তো।’

‘তুমি সবসময় অভিযোগ করো সাজতে আমি একটু বেশি সময় নিই। দেখো আজ তুমি অভিযোগ করার সুযোগই পাবে না।’

তৈরি হয়ে দুজনে দোতলা থেকে একতলায় নেমে আসে। সত্যি ওদের দুজনের দিক থেকে চোখ ঘোরানো যাচ্ছিল না। ভগবান যেন দুজনকে বানিয়েছেন একে অপরের জন্যে। একতলায় গীতার শ্বশুর শাশুড়ি, ভাসুর-জা আর এক ননদ থাকে।

প্রথমেই গীতার জা অলকা দুজনকে ‘হ্যাপি ম্যারেজ অ্যানিভার্সারি’ উইশ করে। গীতা নিজের পার্স থেকে জা-য়ের পছন্দের একটা চকোলেট বার করে ওর হাতে ধরিয়ে দেয়।

কয়েক সপ্তাহ ধরেই গীতার ননদ শিখা ওদের সঙ্গে কথাবার্তা বলছিল না। সামান্য কারণে ও, অজয় আর গীতার উপর রেগেছিল। কারণ কী ঘটেছিল গীতার জানা নেই কিন্তু এক-দুবার চেষ্টা করেছিল দিদির রাগ ভাঙানোর, কিন্তু শিখা যেন প্রতিজ্ঞা করে নিয়েছিল কথা না বলার।

আজ যখন ওরা দুজন একসাথে বসার ঘরে এসে ঢুকল দেখল শিখা সোফায় বসে টিভি-তে খবর দেখছে। ওদেরকে দেখে শিখা সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে দরজার দিকে পা বাড়াতেই, গীতা এসে শিখার পথ আগলে দাঁড়াল।

ঘটনার আকস্মিকতায় শিখা খানিকটা হকচকিয়ে গিয়েছিল। গীতার দিকে দৃষ্টি দিতেই গীতা বলল, ‘দিদি, তুমি আজ আমাদের আশীর্বাদ করবে না? আজ আমাদের বিয়ের একবছর পূর্ণ হল।’ এই বলে গীতা শিখার পা ছুঁয়ে প্রণাম করল। অজয়ও এগিয়ে এসে দিদির পা ছুঁয়ে প্রণাম করল।

গীতা দিদির হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলল, ‘দিদি, আমরা যা অন্যায় করেছি সেটা ভুলে গিয়ে আমাদের ক্ষমা করে দাও প্লিজ। আজকের দিনে মুখ ঘুরিয়ে থেকো না।’ হঠাৎ-ই কান্নায় গলা রুদ্ধ হয়ে আসার ফলে গীতার গলা দিয়ে আর একটা শব্দও বেরোয় না।

গীতার হঠাৎ করে ক্ষমা চাওয়ায় দুজনের মধ্যে গড়ে ওঠা দেয়ালটা এক ঝটকায় ভেঙে যায়। শিখা একটা কথাও মুখ ফুটে বলতে পারে না। শুধু নিজের ভাইয়ের বউকে দুই হাত বাড়িয়ে কাছে টেনে নেয়। দুজনের মনের যত অভিমান সব চোখের জলে ধুয়ে মুছে পরিষ্কার হয়ে যায়। শিখা দুজনকে বিবাহবার্ষিকীর শুভেচ্ছা জানিয়ে বাথরুমের দিকে পা বাড়ায়।

শিখা বেরিয়ে যেতেই অজয়ের মা-বাবা ঘরে এসে ঢোকেন। গীতার কান্নাভেজা চোখ দেখে ভুল ধারণা করে বসেন। অজয়ের মা নির্মলা বউমার দিকে তীক্ষ্ন দৃষ্টি নিক্ষেপ করেন, ‘কী বউমা, আজকের দিনেও তোমরা ঝগড়াঝাঁটি করছ? একটা দিন তো অন্তত আমার ছেলেটাকে শান্তিতে থাকতে দাও। কী পাও বলো তো এইসব করে?’

গীতার চোখে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ মুহূর্তের জন্য দেখা দিয়ে আবার মিলিয়ে যায়। অজয়ের মুখে হাসি দেখে নিজেকে সামলে নেয় গীতা।

‘আমাদের মধ্যে তো কোনও ঝগড়া হয়নি, মা। তুমি ভুল বুঝেছ,’ অজয় ঝুঁকে মা আর বাবার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে।

অজয়ের দেখাদেখি গীতাও শ্বশুর-শাশুড়িকে প্রণাম করে। ওর শ্বশুরমশাই প্রকাশবাবু চুপ করে থাকেন। শাশুড়ি নির্মলা আশীর্বাদ করেন ঠিকই কিন্তু মেশিনের মতো হাতটা বাড়িয়ে শুধু গীতার মাথাটা একবার ছুঁয়ে নেন। এর পরেও উনি নিজের বিরক্তি চাপতে পারেন না, ‘আজ সকাল সকাল দুজনে সেজেগুজে কোথায় চললে? একটা দিনও কি বাড়িতে থাকা যায় না? তোমাদের জন্য লুচি, তরকারি আর পায়েসের ব্যবস্থা করছিলাম। এখন ওগুলো কে খাবে বলো তো?’ নির্মলার প্রশ্নবান যে গীতাকে উদ্দেশ্য করেই নিক্ষেপ করা সেটা কারও বুঝতে অসুবিধা হয় না।

‘আঃ নির্মলা, বলতে শুরু করলে তুমি যে আর থামতেই চাও না। কী হবে এসব বলে? এরপর দেখবে বউমা রাগ করে দুই-তিন মাসের জন্য বাপের বাড়ি চলে গেছে।’ প্রকাশবাবুর কথার তীর্যক ভঙ্গী গীতাকে আঘাত করে।

অজয়ের মৃদ্যু হাতের স্পর্শ নিজের কাঁধে অনুভব করে গীতা মনে খানিকটা বল পায়। ধীর মৃদু স্বরে উত্তর করে, ‘না বাবা, ভবিষ্যতে এরকম ভুল আর কখনও করব না।’

‘আমিও আজ একটা প্রতিজ্ঞা করেছি বাবা।’ অজয়ের গলা শুনে সকলের চোখ গিয়ে পড়ে অজয়ের উপর।

প্রকাশবাবু জিজ্ঞেস করেন, ‘কী প্রতিজ্ঞা করেছ তুমি?

‘এই যে তুমি সবসময় আমাদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে বলো, আমি আর গীতা ঠিক করেছি সিরিয়াসলি ব্যাপারটা নিয়ে নিজেদের মুড আর খারাপ করব না।’

‘অজয়, এই বাড়িতে থাকতে হলে এখানকার নিয়মকানুন তো তোমাকে মেনে চলতেই হবে।’

‘বাবা প্লিজ, আজকের দিনে এইসব কথা কি তোমার না বললেই নয়? আজ এসব ভালো লাগছে না,’ এই বলে অজয় বাবাকে জড়িয়ে ধরে। ‘আজ আমরা ঠিক করেছি বাইরে কোথাও ঘুরেফিরে একটা ফিল্ম দেখব, তারপর বাইরেই কোথাও খেয়ে নেব। সন্ধেবেলায় সিদ্ধার্থর ওখানে পার্টি রয়েছে। বন্ধুরা সবাই মিলে আমাদের পার্টি দিচ্ছে। ওরা তোমাদেরও নেমন্তন্ন করতে আসবে। প্লিজ তোমরা ঠিক সময় পেৌঁছে যেও আর আমাদের গিফট্-টা আনতে ভুলো না কিন্তু।’

এইবলে অজয় গীতার হাতটা চেপে ধরে সদর দরজার দিকে পা বাড়ায়।

‘সকাল সকাল ছেলেটা কোনও নেশা-টেশা করেছে নাকি? দেখলে ছেলের ব্যবহারটা?’ নির্মলার কথার মধ্যেই ফুটে উঠল অজয়ের প্রতি বিরিক্তির মনোভাব।

পনেরো কুড়ি মিনিট বাদে অজয়ের মোটরবাইকটা যেখানে এসে দাঁড়াল সেটা একটা দশতলা ফ্ল্যাটবাড়ি। অজয়ের সঙ্গে গীতাও বাইক থেকে নেমে লিফটের দিকে এগোল। ‘তুমি দশ মিনিট বাদে উপরে এসো। আমি আগে গিয়ে পরিস্থিতিটা সামলাই নয়তো শুধুশুধু তোমাকে আবার অপমানিত হতে হবে,’ এই বলে গীতার গালে একটা আলতো টোকা মেরে অজয় লিফটের ভিতরে ঢুকে গেল।

আটতলায় উঠে যে-ফ্ল্যাটটার সামনে গিয়ে অজয় কলিংবেল বাজাল, তার দরজাটা একটু পরেই খুলে সামনে এসে দাঁড়াল অর্চনা। অর্চনা অজয়ের অফিসেই কাজ করে। সকলেই জানে টানা তিনবছর অজয়ের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক ছিল অর্চনার। অনেক বছর আগেই স্বামীর সঙ্গে অর্চনার ডিভোর্স হয়ে গেছে। অজয়ের থেকে বয়সেও দুবছরের বড়ো অর্চনা।

‘আরে তুমি। আজ তোমাকে এখানে দেখব আশা করিনি। যাক তোমাকে দেখে অসম্ভব আনন্দ হচ্ছে’, এই বলে অজয়ের হাত ধরে টেনে নিয়ে গিয়ে সোফাতে বসিয়ে দিল অর্চনা।

অর্চনার হাত ছাড়িয়ে নিয়ে অজয় সোফাতে গুছিয়ে বসল, ‘কী করছিলে?’

‘এই ঘরদোর পরিষ্কার করছিলাম। কেন কোথাও বেড়াতে যাবার কথা ভাবছ? তাহলে বলো তৈরি হয়ে আসি।’

‘আগে এক কাপ কফি তো খাওয়াও, তারপর দেখছি।’ অজয়কে দেখে মনে হচ্ছিল আজ ওর কাছে অফুরন্ত সময় রয়েছে।

‘গীতা কি এখনও বাপের বাড়িতেই রয়েছে?’

‘না, গতকাল সকালেই বাড়ি ফিরে এসেছে।’

‘বাবা, শেষমেশ মাথা নীচু করতে রাজী হয়েছে?’

‘সময়, অনেক মানুষকেই বদলে দেয় অর্চনা।’

‘গীতার পক্ষে বদলানো অসম্ভব। তোমাদের দুজনের এতদিনে ডিভোর্স নিয়ে নেওয়া উচিত ছিল। না তোমরা একে অপরকে ভালোবাসো আর না তোমাদের চরিত্রগত কোনও মিল রয়েছে। স্বভাবেও তোমরা একদম আলাদা।’

‘ধরো ডিভোর্স হয়েও গেল, কিন্তু আমার একাকিত্ব কীভাবে কাটবে?’

‘কেন আমি তো আছি।’ অর্চনা সোফায় বসে অজয়ের গলাটা জড়িয়ে ধরে নিজের দিকে ওকে টানার চেষ্টা করে।

‘কিন্তু তুমি তো দ্বিতীয়বার বিয়ের রাস্তা মাড়াবে না বলে প্রতিজ্ঞা করেছ।’

‘প্রথম বিয়ের পরে যা বাজে অভিজ্ঞতা হয়েছে, এখন বিয়ের নাম শুনলেই ভয় লাগে। তাই বলে তুমি চিন্তা কোরো না। প্রেমিকার ভূমিকা যে আমি ভালো ভাবেই পালন করতে পারব সে বিশ্বাস আমার নিজের ওপর আছে। কী বলো অজয়?’

‘উত্তরটা কফি খাওয়ার পরেই দেব।’

অজয়ের গাছাড়া ভাবটা ইচ্ছে করেই উপেক্ষা করে অর্চনা রান্নাঘরের দিকে প্রস্থান করে।

কফি বানিয়ে আনতে আনতে ফ্ল্যাটের কলিংবেলটা আর একবার বেজে ওঠে। কফির কাপটা অজয়ের সামনে নামিয়ে রেখে অর্চনা সদর দরজাটা খুলে দেয়।

সামনে গীতাকে দেখেই অর্চনার মেজাজটা চড়াক করে গরম হয়ে ওঠে। কিছু বলার জন্য মুখ খোলার আগেই পিছন থেকে অজয়ের গলা ভেসে আসে, ‘ওঃ তুমি এসে গেছো। ভেতরে চলে এসো।’

অর্চনা সামান্য সরে দাঁড়িয়ে গীতাকে ফ্ল্যাটের ভিতরে ঢুকতে দেয়। ফ্ল্যাটে ঢেকার দরজাটা বন্ধ করে অর্চনা অজয়ের শরীর ঘেঁসে সোফার উপর বসে পড়ে।

‘অজয়, ওকে বলে দাও লাস্ট টাইমের মতো অশান্তি করে একটা সিন না ক্রিয়েট করে। সেদিন ওরকম চ্যাঁচামেচির পর প্রতিবেশীদের সামনে চোখ তুলে দাঁড়াতে পর্যন্ত লজ্জা করছিল।’ অর্চনার কথায় শুধু রাগ নয় একটা ভীতিও ফুটে উঠছিল।

‘আমি অশান্তি করতে এখানে আসিনি। কিন্তু সেদিনও আমার যা প্রশ্ন ছিল আজও সেই প্রশ্নই আমি তোমাকে করতে চাই। অজয় বিবাহিত জেনেও কেন তুমি ওকে পেতে চাইছ?’ গীতা নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ না হারিয়েই অর্চনাকে প্রশ্নটা করে।

‘তোমাকে তো সেদিনই অজয় এর পরিষ্কার উত্তর দিয়েছিল। আমরা দুজন পরস্পরকে ভালোবাসি। তোমাদের দুজনের সম্পর্কটা যে ক্রমশ খারাপের দিকে যাচ্ছে, তার জন্য আমি নই, তুমিই পুরোপুরি দায়ী।’

অজয় এতক্ষণ চুপচাপ ওদের কথা শুনছিল, এবার মুখ খোলে, ‘অর্চনা সত্যিটা গীতার কাছে লুকোবার চেষ্টা কোরো না। স্বীকার করো যে গত তিনবছর ধরে আমাদের মধ্যে গভীর সম্পর্ক গড়ে উঠেছে।’

অর্চনা চমকে অজয়ের দিকে তাকায়। চোখে মুখে ওর স্পষ্ট ফুটে ওঠে রাগ।

‘অর্চনা, বিবাহিত পুরুষের সঙ্গে সম্পর্ক রাখাটা অনুচিত। সমাজের নিয়মের বাইরে এটা। এছাড়াও তোমার এই জেদের জন্য আমাদেরও বিবাহিত জীবনের সুখশান্তি নষ্ট হতে বসেছে। তুমি প্লিজ অজয়ের জীবন থেকে সরে দাঁড়াও।’ গীতার ধীর কণ্ঠস্বরে শুধু অর্চনা নয়, অজয়ও বেশ আশ্চর্য হয়। ভোররাত্রে বাহুবন্ধনে আবদ্ধ গীতার সঙ্গে এখন সামনে দাঁড়িয়ে থাকা গীতার কোনও মিল খুঁজে পায় না অজয়।

‘আমাকে অজয় ভালোবাসে। ওর জীবনে আমার প্রয়োজন আছে। সেই জন্যই আজও আমাদের সম্পর্ক অটুট রয়েছে। তোমাদের অসফল বিয়ের জন্য আমাকে দোষী ঠাওর করার কোনও অর্থ হয় না।’ রুক্ষভাবে অর্চনা উত্তর করে।

‘তাহলে তো অজয়কেই ঠিক করে নিতে হবে আমাদের দু’জনের মধ্যে থেকে ও কাকে জীবনসঙ্গী হিসেবে বেছে নিতে চায়। ও যদি তোমাকে বেছে নেয়, তাহলে আমি কথা দিচ্ছি চিরজীবনের মতো তোমাদের দু’জনের জীবন থেকে আমি সরে দাঁড়াব।’

‘আগের বারও অজয় নিজের ইচ্ছে তোমাকে জানিয়ে দিয়েছিল। তুমিই জেদ করে একলাই এখান থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল। আজকের দিনটা অজয়ের আমার কাছে আসা এটাই প্রমাণ করে যে, ও আমাকে ছাড়া থাকতে পারবে না।’

‘ঠিক আছে। আমি না হয় এখনই অজয়ের কাছ থেকে জেনে নিই এখন ও কী চায়।’

‘জিজ্ঞেস করো।’

‘আর ও যদি জীবনসঙ্গী হিসেবে আমাকে বাছে তাহলে তোমাকে কথা দিতে হবে তুমি ওর জীবন থেকে সরে দাঁড়াবে।’

‘এটা কখনওই হবে না।’ আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে অর্চনা উত্তর দেয়।’

‘আর যদি এরকমই হয়, তাহলে?’

সম্মুখ সমরে আহ্বান করার গীতার এই ভঙ্গিমা অর্চনা-কে মনে মনে দুর্বল করে তোলে।

দু’জনেই অজয়ের দিকে ঘোরে। অজয়ের মুখে লেগে থাকা হাসি কাউকেই বুঝতে দেয় না কাকে ও জীবনসঙ্গী হিসেবে বেছে নিয়েছে।

খানিকক্ষণ চুপ থেকে অজয় অর্চনার পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। সঙ্গে সঙ্গে অর্চনার চোখেমুখে ফুটে ওঠে বিজয়ীর অভিব্যক্তি।

‘গতবার তোমাদের দু’জনের ঝগড়ায় আমি তোমাকে সাপোর্ট করেছিলাম কিন্তু আজ আর সেটা সম্ভব নয় অর্চনা। আমি যদি দ্বিতীয়বার আবার এই একই ভুল করি তাহলে সারা জীবনের জন্য গীতাকে হারিয়ে ফেলব। তোমার সঙ্গে আমার পথ চলা এতদূর পর্যন্তই ছিল। গীতার সঙ্গে নতুন জীবন শুরু করতে হলে তোমার থেকে তো আমাকে দূরে যেতেই হবে।’ অর্চনার হাতে সামান্য চাপ দিয়ে অজয় নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে গীতার দিকে ফেরে।

‘আমার মনে হয় তোমার জীবন থেকে অজয়ের সরে যাওয়াই ভালো। আর সেটা তোমার মঙ্গলের জন্যই। অর্চনা, অতীতের সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগ করতে না পারলে নতুনকে কীভাবে আমন্ত্রণ জানানো যাবে?  মনে রেখো, এটাই ভালো হল তোমাদের জন্য’, এই বলে গীতা অজয়ের হাত ধরে অর্চনার ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে আসে। অজয়কে আটকাবার সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয় অর্চনার।

দোকানে বসে দু’জনেরই পছন্দের ঢাকাই পরোটা, আলুর তরকারি আর মিষ্টি খেয়ে বেরিয়ে এসে সোজা ওরা পা বাড়ায় গীতার বাপের বাড়ির দিকে। বাপের বাড়ির সামনে বাইক থেকে নেমে দাঁড়াতেই গীতা যেন আবেগে ভেসে যেতে থাকে।

‘কী হল, দাঁড়িয়ে পড়লে যে। ভেতরে যাবে না?’

‘এই এক সপ্তাহ আগে যখন মায়ের কাছে এসেছিলাম তখন কেমন একটা নিঃসঙ্গ একাকিত্বে ভুগছিলাম। সবসময় মনে হচ্ছিল সবাই যেন আমার মনের ভিতরটা স্পষ্ট পড়তে পারছে। আমার ব্যথার জায়গাটা সকলের যেন জানা হয়ে গেছে। আজ মনটা খুব ভালো লাগছে জানো। আমি এই আনন্দের মুহূর্তগুলো আর হারাতে চাই না।’

‘আমরা আবার নতুন করে জীবন শুরু করতে চলেছি গীতা। কথা দিচ্ছি, আনন্দ খুশিতে তোমার জীবন ভরিয়ে দেব।’ অজয় গীতার কাঁধটা জড়িয়ে ধরে শ্বশুরবাড়ির দরজায় গিয়ে দাঁড়ায়।

গীতার মা-বাবা, দাদা-বউদি এসে ওদের দু’জনকে প্রথম বিবাহবার্ষিকীর শুভেচ্ছা জানিয়ে বাড়ির ভিতরে নিয়ে যায়। এতদিন পরে জামাই বাড়ি এসেছে অথচ কীভাবে ওদের দু’জনকে স্বাগত জানাবে, গীতার বাড়ির লোকেরা বুঝে পায় না। এক সপ্তাহ আগে পর্যন্ত ওদের জানা ছিল জামাই আর মেয়ের মধ্যে সম্পর্কের টানাপোড়েন চলছে। এর মধ্যে যে সব ঠিক হয়ে গেছে তা ওদের ধারণাও ছিল না।

সবাই একসঙ্গে বসবার ঘরে বসে গল্পগুজব করতে করতে গীতার মা বন্দনা মেয়েকে নিয়ে ভিতরের ঘরে চলে যান। গীতার বউদিও রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ায়। অজয় শ্বশুর এবং শ্যালকের সঙ্গে বসেই গল্প করতে থাকে।

প্রায় কুড়ি মিনিট পর গীতা মায়ের সঙ্গে বসবার ঘরে এসে ঢোকে। গীতা মাকে চেয়ারে বসিয়ে অজয়ের পাশে এসে বসে।

‘শুনছ, মা না আমায় নিয়ে খুব চিন্তায় রয়েছে। আমি কীরকম আছি, সুখে আছি কিনা এই নিয়ে নানা দুশ্চিন্তা আর কী! আমি তো বুঝিয়েছি, এখন তুমিই পারো মায়ের চিন্তা দূর করতে।’ বন্দনা মেয়ের কথা শুনে জামাইয়ের সামনে লজ্জায় পড়ে যান।

‘মা, গীতাকে নিয়ে কী এত চিন্তা করছেন?’ অজয় খুব সিরিয়াস হয়েই শাশুড়িকে প্রশ্নটা করে।

‘না-না বাবা, সেরকম কিছু নয়। একটাই মেয়ে। চিন্তা তো হয়ই।’

এরই মধ্যে গীতা বলে ওঠে, ‘মা, শুধু তো চিন্তা নয়, আমি কীভাবে ভালো থাকতে পারি সেই পরামর্শগুলোও আমার সঙ্গে সঙ্গে অজয়কেও দাও। দ্যাখো না ও কী বলে।’

মেয়ের কথা শুনে বন্দনা যেন একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়েন। মেয়েকে থামাবার প্রয়াস বিফল হলে মুখের হাসি বজায় রেখেই অজয়কে বলেন, ‘গীতা বরাবরই একটু বোকা, মনের কথা গুছিয়ে বলতে পারে না। তোমাদের দু’জনেরই জীবনে যাতে খুশি বজায় থাকে তাই আমি গীতাকে বলেছিলাম, সংযুক্ত পরিবারে থেকে যখন তোমাদের দুজনের মধ্যে ব্যবধান বাড়ছে তখন উচিত হচ্ছে ওই বাড়ি ছেড়ে অন্য কোথাও দু’জনের আলাদা করে সংসার পাতা উচিত। এক বছর ধরে তোমাদের সম্পর্কের টানাপোড়েনের ঘটনা তো সকলেরই জানা। মা হয়ে এটুকু চাওয়াটা কি অন্যায়?’

‘না মা, অন্যায়টা আসলে আমার,’ গম্ভীর ভাবে অজয় শাশুড়ির কথার উত্তর দেয়। ‘তবে বিবাহিত জীবনের দ্বিতীয় ধাপের শুরুতে আমরা দুজনেই অতীতকে ভুলে নতুন করে জীবন শুরু করার প্রতিজ্ঞা করেছি। আপনাদের আশীর্বাদটুকুই এখন শুধু দরকার।’

‘মা তোমাকেও একটা প্রমিস করতে হবে। এবার থেকে কিছু বোঝাবার হলে আমাকে একলা নয়, অজয় সঙ্গে থাকলে তবেই বলবে।’ গীতাও কিছুটা সিরিয়াস হয় কারণ মায়ের স্বভাব তার অজানা নয়।

‘আর একটা কথা’, অজয় বলে, ‘এটাও আমরা ঠিক করেছি সকলের কথাই আমরা শুনব। কিন্তু আমরা দু’জন মিলে যা ডিসিশন নেব সেটাই মেনে চলব। এটাতে কেউ ব্যথা পেলেও আমাদের কিছু করার নেই।’

‘আমি তো গীতাকে যা বলেছি, সবই ওর ভালোর জন্যই। ও যদি সেটা না মানে তাহলে সেখানে আমার কিছু বলার নেই।’

‘মা প্লিজ। এখন থেকে আমার জন্য নয়, আমাদের ভালো কীসে হবে ভাবতে শুরু করো।’

বন্দনা কথা না বাড়িয়ে, মেয়ের দিকে তীর্যক দৃষ্টি নিক্ষেপ করে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ান।

এতক্ষণ গীতার বাবা সুব্রতবাবু এবং দাদা সৌম্য দু’জনেই মুখ বন্ধ করে বসে সব শুনছিলেন। বাড়ির গৃহিনী ভিতরে যেতেই দুজনে উঠে এসে অজয়কে জড়িয়ে ধরেন। দুজনের চোখেই আনন্দ যেন উপচে পড়ছিল।

‘অজয়, আমার মনের বোঝা আজ তোমরা দুজনে মিলে হালকা করে দিলে। আশীর্বাদ করি তোমাদের এই সদ্বুদ্ধি আজীবন বজায় থাকুক।’ সুব্রতবাবুর গলা রুদ্ধ হয়ে আসে।

হাসিঠাট্টার মধ্যে দিয়ে ওদের চারজনের আড্ডা জমে ওঠে। দুপুরে সকলে একসঙ্গে খেতে বসলে গল্পগুজবের মধ্যে দিয়ে সকালের টেনশন অনেকটা সহজ হয়ে আসে। বিশ্রামের পর অজয়, বন্ধু সিদ্ধার্থর বাড়ির পার্টিতে সকলকে নিমন্ত্রণ জানিয়ে গীতাকে নিয়ে শ্বশুরবাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে।

অজয়ের চারজন বন্ধু মিলে সিদ্ধার্থর বাড়িতে গীতা আর অজয়ের বিবাহবার্ষিকীর পার্টিটার আয়োজন করেছিল। সিদ্ধার্থর বউ সুচেতা গীতাকে সাজানোর দায়িত্ব নিয়েছিল। গীতাকে সাজিয়েগুজিয়ে যখন বার করল সত্যিই ওর দিক থেকে চোখ ফেরানো যাচ্ছিল না।

অজয় আর গীতারই পার্টিটা দেওয়া উচিত ছিল কিন্তু প্রায় ভেঙে যাওয়া দু’জনের বিবাহিত জীবন নতুন করে জোড়া লাগার আনন্দে বন্ধুরাই পার্টিটার আয়োজন করেছিল। নিমন্ত্রিত সকলেই প্রায় উপস্থিত ছিল পার্টিতে। হাসি, আড্ডা আর সকলের শুভেচ্ছায় পার্টি জমে ওঠে। হইচই মিটতে মিটতে রাত প্রায় বারোটা। অতিথিরা সকলেই তখন চলে গেছেন। শুধু পাঁচ বন্ধু আর তাদের ফ্যামিলি তখনও গল্পে মশগুল।

হাতঘড়ির দিকে চোখ পড়তেই অজয় উঠে দাঁড়ায়, ‘আর না, এইবার বাড়ি যাওয়া দরকার। অনেক রাত্তির হল। তোদের সকলকে অনেক ধন্যবাদ এত ভালো একটা পার্টি আয়োজন করার জন্য। চলো গীতা, এর পরে গেলে বাড়িতেও আর ঢুকতে পারব না।’

সকলকে শুভরাত্রি জানিয়ে অজয় আর গীতা যখন বাড়ি ঢুকল তখন রটা বেজে গিয়েছে। শোবার ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করতেই গীতা অজয়ের কাছে নিজেকে সঁপে দেয়। হাতের বেষ্টনী এতটুকুও আলগা না করে অজয় জিজ্ঞেস করে, ‘কেমন কাটল আজকের দিনটা?’

‘অসম্ভব ভালো। এই দিনটার কথা কোনওদিনও ভুলতে পারব না।’

‘আমিও না। আমি প্রমিস করছি কোনওদিন তোমাকে আর দুঃখ দেব না। অতীতটা আজ আমার কাছে স্বপ্ন। আমার বাস্তব এখন তুমি। ভুল করেছি আর ভুল ভেঙেও গেছে। আমি ধীরে ধীরে বুঝতে পারছিলাম, অর্চনা আর আমার সম্পর্ক আসলে কোনও পরিণতিতে পেৌঁছোবে না। কারণ ও কখনও চায় না আমার বউ হয়ে সংসার করতে। ক্ষণিক সুখের চাহিদা মিটে গেলেই ও খুশি। দাম্পত্য মানে যে আগলে রাখা, আঁকড়ে থাকা, এই আবেগটা ওর মধ্যে দেখিনি। দেখেছি শুধু তোমার কাছ থেকে কেড়ে নেওয়ার, যেন কোনও বাজি জেতার আনন্দ। আমার ভুল আমি বুঝতে পেরেছি। আমি শুধু প্রায়শ্চিত্ত-ই করতে চাই না গীতা, তোমার জীবনটাও ভালোবাসায় ভরিয়ে তুলতে চাই। আমাকে সেই সুযোগটুকু দেবে তো গীতা?’

উত্তর না দিয়ে গীতা অজয়ের বুকের কাছে আরও ঘন হয়ে আসে। টের পায় অজয়ের উষ্ণ নিঃশ্বাস নিজের ঠোঁটে এসে লাগছে। ঘরের আলোটা কখন নেভানো হয়েছে গীতা টের পায় না। শুধু ওদের উষ্ণ ভালোবাসার সাক্ষী হয়ে থাকে ঘরের নাইট বাল্বটা।

চেতন-অচেতন

দোতলার ঝুল বারান্দা থেকে দৃশ্যটা দেখে মামির চক্ষু ছানাবড়া!

– এই হাঁদারাম, কী করছিস, কী করছিস– বলতে বলতে দ্রুত সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে আসেন। তারপর কান ধরে হিড়হিড় করে টানতে টানতে ঋজুকে ড্রয়িংরুমে মামার কাছে নিয়ে গিয়ে ঝাঁঝের সঙ্গে বলেন– এই শুনছ, দ্যাখো, একে নিয়ে তো আর পারা যায় না।

– কী, করেছে কী গর্দভটা?

– আর করেছে! শোনো, পুজোর নতুন শার্ট প্যান্টটা একটা ভিখিরি ছেলেকে… সঙ্গে আবার ফ্রিজ খুলে মিষ্টির প্যাকেটটাও!

মামা গর্জে ওঠেন– সে কী! এভাবে দানছত্র করতে কে বলেছে?

ঋজুর কাঁদো কাঁদো স্বর– ও যে চাইল মামা!

গালে এক চড় বসিয়ে চিৎকার করে বলেন– চাইলেই দিতে হবে, অপদার্থ কোথাকার! ক্ষমতা কতটুকু বুঝতে হবে না! এখন যদি কেউ কেঁদে কেটে আমার কাছে বাড়িটা চায়, আমি কি দিতে পারব?

তোতলাতে তোতলাতে ঋজু বলে– না মানে… আমার তো পুরোনো দুটো আছে কিন্তু ওর তো একটাও নেই!

চোখ পাকিয়ে মামা বলেন– খবরদার! আর যেন এরকম না শুনি! ওর কাছে নেই, তুই কি দেখে এসেছিস? এক্বেবারে রাম বোকা! ছোটো ভাইটাকে দেখেও শেখে না! ভাগ এখান থেকে। মনে রাখবি নিজে যখন উপার্জন করবি, তখন যতখুশি দানছত্র করবি। কিন্তু এখন নয়।

আপনমনে গজগজ করেন মামা– হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে, মাথার ঘাম পায়ে ফেলে সংসার ঠেলতে হচ্ছে। তার ওপর আবার দানছত্র করে পুণ্য অর্জন করা! যত্তসব…!

মামি পিঠে দুটো কিল দিয়ে বলেন– আর যদি কোনওদিন এরকম কিছু দেখি, তবে ওদের সঙ্গে তোকেও বাইরে পাঠিয়ে দেব। ঋজু দু’হাতে চোখ মুছতে মুছতে নিজের ঘরের দিকে চলে যায়।

জন্মলগ্নে মাকে হারিয়েছে ঋজু। তার বছর খানেক ঘুরতে না ঘুরতে এক দুর্ঘটনায় বাবাকেও। এই মামা ছাড়া সাতকুলে আর কেউ নেই। মামা নিজে এক ছোটো কারখানায় ছোটো কর্মী মাত্র। বাড়িটা পৈত্রিক সূত্রে। তিনজনের সংসার মামা মামি আর তাদের একমাত্র সন্তান সানু। ভালো নাম সান্নিধ্য। ঋজুর চেয়ে বছর দুইয়ের ছোটো। সব্বার স্নেহ ভালোবাসার সান্নিধ্যে তিলতিল করে বড়ো হয়ে ওঠা বুদ্ধিমান মেধাবী সান্নিধ্য। ঋজু এ’বাড়িতে পরগাছা। পান থেকে চুন খসলে কপালে জোটে কিল চড় ঘুসি। পোশাকি নাম সমৃদ্ধ। অনেক শখ করে বাবা তাঁদের ছোট্ট সংসারের নতুন অতিথির নাম রেখেছিলেন সমৃদ্ধ। আজ কপালগুণে সেই সমৃদ্ধ সব খুইয়ে এ বাড়ির একটা বাড়তি বোঝা।

কালের নিয়মে একসময় বড়ো হয়ে ওঠে সমৃদ্ধ। তবুও খুব সাদাসিধে। আলাভোলা। পরীক্ষার রেজাল্ট বরাবর-ই কোনওক্রমে, টেনেটুনে। এদিকে প্রায় প্রতি ক্লাসে প্রথম দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে সান্নিধ্য এখন ভালো নামজাদা কলেজে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে। আর দু’বেলা সানুর সঙ্গে তুলনার খোঁচা খেতে খেতে একসময় নিজের পায়ে দাঁড়াবার চেষ্টায় ব্যস্ত ঋজু। যদিও মামা-মামি একটা ব্যাপারে একমত যে, এই ছেলে কোনওদিন ভালো কিছু করতে পারবে না। এত ভুলো মনের, হাবাগোবা ছেলের দ্বারা বড়ো কিছু অসম্ভব। এব্যাপারে হয়তো শত্রু মিত্র সব্বাই একমত। মামা মাঝে মাঝে দুঃখ করে বলেন– হঠাৎ যদি আমার মৃত্যু হয়, ঋজুটাকে কে দেখবে?

মামি সায় দেন– আমিও তাই ভাবি, ভবিষ্যতে এই ছেলের কী হবে? আমাদের মৃত্যুর পর এটা সানুর বোঝা হয়ে থাকবে না তো?

মামার গম্ভীর স্বর– মস্তিষ্কের বিশেষ কোনও কোশ বা অনুকোশ অকেজো হয়ে পড়লে, এরকম হয় হয়তো। মামি বলে ওঠেন– কাজ তো করে একটা প্লাস্টিক কারখানায় কিন্তু সেখানেও ক’দিন করতে পারবে কে জানে! মাধ্যমিকের যা রেজাল্ট! উচ্চমাধ্যমিকে পি ডিভিশন ছিল বলে রক্ষে, নইলে…। পাস কোর্সে বি.এ। তা-ও কোনওক্রমে। মামা একটা ছোট্ট স্বস্তির নিশ্বাস ছেড়ে বলেন– যাক তবু তো গ্র্যাজুয়েট।

মামি আবার গজগজ করে ওঠেন– জানো আজও কারখানায় বেরোবার মুখে টিফিন কৌটো নিতে ভুলে গেল! সব গুছিয়ে এলাম, তবুও…! কী যে হবে এর!

মামাও সুর মিলিয়ে বলে ওঠেন– হ্যাঁ, আমিও লক্ষ্য করেছি, দিন দিন যেন এটা বেড়ে যাচ্ছে। এই তো রোববার সকালে দোকানে পাঠালাম একটা ব্লেড আনতে, আর ছেলে কিনা একটা পাউরুটি নিয়ে হাজির। সত্যি ভাবনার বিষয়! মামি আবার বলেন– আর বলো কেন, গত পরশু সানুটার জন্মদিন ছিল, তাই ঋজুকে বললাম, একটু তাড়াতাড়ি কারখানা থেকে ফিরতে, বলেও গেল তাড়াতাড়ি ফিরবে অথচ বেমালুম ভুলে ফিরল সেই রাত দশটায়। এমন ছেলে দেখিনি বাবা! না লাগে হোমে, না লাগে যজ্ঞে।

কারখানায় ক’দিন ধরেই ঝামেলা চলছে। একটা জরুরি ফাইল খুঁজে পাচ্ছে না ঋজু। অথচ গত তিনদিন আগেই দত্ত সাহেব ফাইলটা ওর হাতে দিয়ে বলেছিল– এটা খুব জরুরি। নেক্সট ফ্রাইডে ফ্যাক্টরির বোর্ড মিটিং। অর্ডারটা বড়ো সাহেবকে দিয়ে তখন স্যাংশন করিয়ে নিতে হবে। এটা রাখুন। কাল আমাকে দিয়ে দেবেন। এর আগেও দত্ত সাহেব অনেক জরুরি ফাইল ঋজুর হাতে তুলে দিয়েছেন। ঋজুও সততার সঙ্গে দায়িত্ব নিয়ে, সেই দায়িত্ব যথাযথ পালন করেছে। কোথাও কোনওরকম ভুল হয়নি। বরং ওর সততা আর দায়িত্ববোধকে সব্বাই বেশ তারিফ করেছেন।

অথচ পরশু দিনের ফাইলটা ওর কাছ থেকে বেমালুম লোপাট হয়ে গেল! এটা কী ওর মনের ভুল না কাজের গাফিলতি? নিজেকে নিজে সান্ত্বনা দেয়– নাহ্, এটা মোটেই ওর গাফিলতি নয়। কারখানায় এসে কাজে কখনও ফাঁকি দেয় না সে। ফাইলটা নিয়ে, সেটা যত্ন করেই রেখেছিল, তবুও…! চারদিক তন্নতন্ন করে খোঁজা হ’ল। কোথাও নেই…! সেই থেকে কারখানার দত্তসাহেবের কাছে দু’চক্ষের বিষ হয়ে উঠল। এদিকে ওর এক সহকর্মী কমল, নিজের দুঃখ দুর্দশার কথা ওর কাছে সাতকাহন করে ফেনিয়ে ফেনিয়ে বলে ওর মাইনের পুরো টাকাটা নিয়ে কারখানা ছেড়ে কেটে পড়ল। বাড়িতে মামা মামির কাছে কী কৈফিয়ত দেবে ভেবে পায় না ঋজু। মামির বাক্যবাণে প্রাণ ওষ্ঠাগত। ঘরে বাইরে কেমন যেন কোণঠাসা অবস্থা। আপন মনে বিড়বিড় করে ঋজু– ধ্যুস, কিচ্ছু ভাল্লাগে না। কী যে করি! কোথায় যে যাই!

মামি মুখ ঝামটা দিয়ে বলেন– এত বোকা, পৃথিবীতে দু’টো নেই। মামা শুধরে দিয়ে বলেন– না না বোকা নয় ঋজু। তবে খুব নরম মনের ছেলে। কারও দুঃখ কষ্ট সহ্য করতে পারে না। মামি আবার চড়া গলায় বলেন– ওই একই হ’ল। নির্বোধ যারা তাদেরই মন নরম হয়, ওসব নরম-ই বলো আর সরল-ই বলো সব এক-ই। নইলে এই তো দু’দিন আগে, পল্টু নামে কারখানার এক ছেলেকে নিজের টিফিন খাইয়ে নিজে সারাদিন ঢোক ঢোক করে জল গিলে রাতে বাড়ি ফিরল। সে নাকি টিফিন আনেনি, খিদেতে ছটফট করছিল তাই…। এমন বোকা কেউ দেখেছে!

মনে মনে ভাবে ঋজু– আর আজ? আজও ভুল হয়ে গেল আবার। মুহূর্তের অন্যমনস্কতায় ফেরার পথে, চেনা ট্রেন ছেড়ে অচেনা ট্রেনে উঠে পড়ল। প্রায় প্রতি রোববার-ই এদিক-ওদিক বেরোয় সমৃদ্ধ। বাড়িতে মন বসে না। মামা-মামির তির্যক কথার চোটে এদিক-ওদিক ছুটে বেড়ায়। তাছাড়া সান্নিধ্যটাও হয়েছে সে’রকম। কেবল পড়ার বই-এ মুখ গুঁজে বসে থাকা, আর কেরিয়ার তৈরি করা– এর বাইরে দুনিয়াটা যেন নিরস গদ্যময়।

ধ্যুস কিস্যু ভাল্লাগে না। যেদিকে চোখ যায়, চলে যেতে ইচ্ছে করে সমৃদ্ধের। তাই ফেরার তেমন তাগিদও ছিল না। যাবে শিয়ালদা চলে গেল সোদপুর। ভিড় ঠেলে স্টেশনে নামতেই টনক নড়ল। কোথা থেকে এক সুন্দরী মেয়ে সামনে এসে, একমুখ হাসি নিয়ে বলল– এই তো শান্তনু কোথায় ছিলে এতদিন! চলো চলো আমার সঙ্গে এসো, যেতে যেতে সব শুনব।

ঋজুকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে হাত ধরে টানতে টানতে সামনের দিকে নিয়ে চলে। ঋজু যখন দিশেহারা, আমতা আমতা করে কিছু বলতে যাচ্ছে, মেয়েটি তখন হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে, ওকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরে, ঠেলে নিয়ে চলল। কিছুটা গিয়ে একটু থেমে মেয়েটা বলে– হাঁদারামের মতো অমন করে কী দেখছ? আমাকে চিনতে পারছ না, মনে হচ্ছে? আর অভিনয় কোরো না। ধরা পড়ে গেছ। এবার লক্ষ্মী ছেলের মতো চলো তো।

দিশেহারা মন নিয়েও, স্মৃতি হাতড়াবার চেষ্টা করল সমৃদ্ধ। কিন্তু না। চিনতে পারল না। ফলে মনে উঠল দ্বিধা আর সংশয়ের দোলাচল। আপনমনেই প্রশ্নের ঝড় উঠল একসময়– খারাপ মেয়ে নয়তো? রাত তো বেশ হয়েছে। শীতের রাত। চারদিক সুনশান। ঋজু ক্রমশ মেয়েটিকে এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করল। কিন্তু ততক্ষণে মেয়েটি রিকশা ডেকে, নিজে আগে উঠে, হাত ধরে সমৃদ্ধকেও রিকশায় ওঠার জন্য টানাটানি শুরু করে। আশেপাশের কয়েকজন রিকশাওয়ালা, অটোওয়ালা এসে ভিড় জমায়। অগত্যা একসময় সিন-ক্রিয়েটের ভয়ে রিকশায় উঠে বসে ঋজু। কিন্তু মেয়েটিকে সত্যি সত্যি চিনতে পারে না। অথচ আসতে বাধ্য হল। মেয়েটি যেভাবে জড়িয়ে ধরেছে, হাত ধরে টানছে, তাতে গভীর অন্তরঙ্গতা ফুটে ওঠে। প্রতিবাদের ভাষা থাকে না। তাছাড়া প্রতিবাদ করতে গেলে হয়তো মেয়েটি তর্কাতর্কি শুরু করবে, পরে হয়তো কান্নাকাটিও জুড়ে দেবে। লোক জড়ো হবে– এই ভয়েও ঋজু শেষ পর্যন্ত বেশি কথা বলে না।

সমৃদ্ধ তবুও একসময় প্রতিবাদের গলায় মিনমিনিয়ে বলে– দেখুন আপনি বোধহয় কোথাও ভুল করছেন।

– ভুল! না না আমি কোনও ভুল করছি না। তবে মাত্র সাত বছরে তুমি আমাকে ভুলে গেলে? এ-ও কি সম্ভব? আমাদের এত বছরের সম্পর্ক! তবে চিরদিন-ই তুমি ভুলো মনের, হাঁদারাম। এখন-ও সেরকম-ই আছো। কোনও পরিবর্তন নেই। কথা না বলে, মুখ বুজে চলো তো!

এই মুহূর্তে সমৃদ্ধের মনে হল কে যেন তাকে মাদক খাইয়ে বেহুঁশ করে দিয়েছে। হাত পা কেমন যেন আলগা আলগা লাগছে। শরীরটা অবশ। মামা-মামি, ঘরবাড়ি, সব যেন ক্রমশ ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। শরীরে শরীর ছুঁয়ে ওরা যখন রিকশায় পাশাপাশি বসল, সমৃদ্ধের মন তখন আরও বেশি অসাড়। এই প্রথম একজন অল্পবয়সি মেয়ের ছোঁয়া। মনে ওঠে সাত সমুদ্রের ঢেউ। অনেকটা পথ যাবার পর আমতা আমতা করে বলে সমৃদ্ধ– আচ্ছা আমরা কোথায় চলেছি…?

মেয়েটি হেসে ওঠে ওর প্রশ্ন শুনে। এই হাসির মধ্যে আর যাই হোক, কিন্তু ছলনা নেই। এ যেন বিশ্বজয়ের আনন্দে গর্বিত হাসি। হাসতে হাসতেই বলল– আর পারি না। সত্যি সত্যি তুমি একটা ক্যাবলাকান্ত। কোথায় আর যাব এত রাতে? বাড়ি যাচ্ছি। তুমি আমাদের বাড়ি চেন না? তুমি না আমার বাবার প্রিয় ছাত্র ছিলে? সব ভুলে গেলে? সত্যি তোমার হলটা কী বলো তো? মগজ ধোলাই হয়েছে নাকি? গঙ্গার ধারে আমাদের বাড়ি। তুমি রোজ সে বাড়িতে যেতে, সব ভুলে গেছ? পরীক্ষার পরও নানান ছুতো করে আমাদের বাড়ি আসতে, শুধু একবার আমাকে দেখার জন্য। তবে এতটাই হাঁদা ছিলে বাড়ির সবার সঙ্গে কত কথা, শুধু আমার সঙ্গে কথা বলতে গেলেই তোতলাতে, মনে আছে?

সমৃদ্ধের মুখে কোনও ভাষা নেই। ভাষা যেন কোথায় হারিয়ে গেছে। তেরছা চোখে বারবার মেয়েটিকে দেখার চেষ্টা করছে। আর মনের অতল গহ্বরে, স্মৃতির ঘেরাটোপ থেকে ওর মুখটা তুলে আনার চেষ্টা করছে। কিন্তু যতবার চেষ্টা করছে, ততবার-ই ব্যর্থ হচ্ছে। অগত্যা অসহায় ভাবে ভ্যাবলার মতো চারদিকে তাকাচ্ছে। স্মৃতিকে উস্কে দেবার জন্য প্রকৃতি যদি সামান্যতম সাহায্য করে, এই আশায়। কিন্তু শীতের রাত। বেশিরভাগ বাড়ির দরজা জানালা বন্ধ। অন্ধকার যেন অন্ধকারকে ছুঁয়ে ঘন হয়ে আছে। কিছু ঠাহর করা অসম্ভব। মনে মনে ভাবে সমৃদ্ধ, মেয়েটি ভালো-ই নাটক জানে। এমনকী ওর বাচনভঙ্গিতে কোনও জড়তা নেই। অভিনয়ে এতটুকু আড়ষ্টতা নেই। কখন কী বলতে হবে, সব মুখস্ত। মুহূর্তে আবার মনে ঝড় ওঠে, সবটাই কি অভিনয়? এই যে শীতের রাতে গঙ্গার ধার দিয়ে রিকশায় যাচ্ছে, তাতে ওর একটু আগে শীত করছিল। মেয়েটি যেহেতু ওর গা ঘেঁষে বসেছিল তাই ওর ঠক ঠক করে কাঁপা বুঝতে পেরে, তক্ষুনি নিজের গায়ের শালটা খুলে, ওর গায়ে জড়িয়ে দিল। বারণ করেও সে আটকাতে পারল না। এটাও কি অভিনয়! ওর চোখ দুটো ছলছল করে উঠেছিল। ভাগ্যিস অন্ধকার ছিল!

সমৃদ্ধ স্মৃতি হাতড়ে সমানে মেয়েটিকে খোঁজার চেষ্টা করে। কিন্তু স্মৃতির ঘরে শুধুই ধোঁয়াশা। গাঢ় অন্ধকার। মেয়েটিকে কখনও দেখেছে কিনা সন্দেহ। প্রেম তো বহু দূরের কথা! মেয়েটি কিন্তু তার সবরকমের সুযোগ-সুবিধার প্রতি খেয়াল রাখছে। ব্যাগের চেন খুলে দুটো লজেন্স ওর হাতে দিল। গায়ের শালটা দিল! বারবার জল তেষ্টা পেয়েছে কিনা জানতে চাইছে। এই মুহূর্তে সমৃদ্ধের নরম মনটা একটু একটু করে নিজের বশ হারিয়ে দুর্বল হয়ে পড়ছে। ওর এত বয়সের জীবনে এভাবে কেউ কোনওদিন ওর প্রতি নজর দেয়নি। মামা-মামির সংসারে, জ্ঞান বয়স থেকেই ও একটা পরগাছা, আপদ বিশেষ। সেও যে কারও প্রিয় পাত্র হতে পারে, এটা এই প্রথম সমৃদ্ধ অনুভব করল। তবে কী ইদানীং ওর সব স্মৃতি ক্রমশ বিস্মৃতির গহ্বরে চলে যাচ্ছে! হলটা কি তার! একজন মানসিক ডাক্তারের সঙ্গে পরামর্শ করা প্রয়োজন।

এসব সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতেই তারা গঙ্গার ধারে একটা পুরোনো বাড়ির সামনে দাঁড়াল। সমৃদ্ধ তাড়াতাড়ি রিকশাভাড়া মিটিয়ে দিল। রিকশাওয়ালা তক্ষুনি উলটোদিকে চলা শুরু করল। মেয়েটি দ্রুত পায়ে এগিয়ে সদরের কড়া নাড়ে। মুহূর্তের মধ্যে বেরিয়ে এলেন বনেদি চেহারার এক প্রৌঢ়া। মুখে চোখে উৎকণ্ঠা। মেয়েটির দিকে এক ঝলক তাকিয়েই বলে ওঠেন– কোথায় গিয়েছিলি সুমি? এত দেরি হ’ল যে!

তারপর পাশে দাঁড়ানো সমৃদ্ধকে দেখে উদ্বেগে দিশাহারা ভাবে ব্যাকুল স্বরে বলে ওঠেন– আবার একজনকে…! সুমি মাথা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলে– এবার ভুল করিনি মা। দ্যাখো ভালো করে দ্যাখো ও শান্তনু। পরক্ষণে একটু চড়া সুরে ডাকে, এই শান্তনু এদিকে এসো। আলোর দিকে মুখ করে দাঁড়াও। এবার দেখে বলো তো মা, আমি ভুল করেছি কি না?

মা জোরে জোরে ঘাড় নেড়ে কান্নায় ভেঙে পড়তে পড়তে প্রতিবাদের গলায় বললেন– ওরে সুমি ও শান্তনু নয়। তোকে কতবার বলেছি শান্তনু মারা গেছে। তবুও তুই বিশ্বাস করবি না! তবু এই বার বার ভুল করে…!

ভয়ংকর ক্ষেপে ওঠে সুমি। যে-মেয়েকে কিছুক্ষণ আগেও হাসি খুশি দেখাচ্ছিল, উচ্ছল উজ্জ্বল লাগছিল, মুহূর্তে কে যেন তার মুখে কালি লেপে দিল! মাথা ঝাঁকিয়ে কড়া চোখে মায়ের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে ওঠে– বিশ্বাস করো মা এবার আমি ভুল করিনি। ভুল করিনি মা। ও শান্তনু… শান্তনু।

এই সময় ভেতর ঘর থেকে এক যুবক বেরিয়ে এল। সমৃদ্ধের-ই সমবয়সি। বেশ ভালো চেহারা। কাছে এসে উৎকণ্ঠা নিয়ে বলল– আবারও এক-ই ভুল করলি সুমি?

– না রে দাদা আমি তো কোনও ভুল করিনি। তারপর সমৃদ্ধের দিকে ঘুরে বলে ওঠে, তুমি ওকে চিনবে না শান্তনু। ও আমার মাসতুতো দাদা সুব্রত।

মা বলে ওঠেন– ওকে ঘরে নিয়ে যা সুব্রত।

– না না আমি শান্তনুকে না নিয়ে ঘরে ঢুকবই না। সমৃদ্ধ-র হাতটা শক্ত করে ধরে রেখেছে সুমি। কেমন যেন বেপরোয়া ভঙ্গি, উন্মত্ত ক্ষিপ্ত চেহারা। মেয়ের হাত মা কিছুতেই ছাড়াতে পারছেন না। অগত্যা সুব্রত ওর পেশিবহুল শরীরের সব শক্তি প্রয়োগ করে। গর্জে উঠে বলে– শোন সুমি ও সত্যিই শান্তনুর মতো দেখতে, কিন্তু ও শান্তনু নয়। বোঝার চেষ্টা কর। শান্তনু আর নেই।

কিন্তু কে কার কথা শোনে! সুমি তখন-ও চ্যাঁচাচ্ছে– আমি যাব না। শান্তনুকে ছেড়ে আমি কিছুতেই যাব না। নাছোড়বান্দা সুমিকে একসময় জোর করেই টানতে টানতে ভেতরের ঘরে ঢুকিয়ে বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে দেয় সুব্রত। ভেতরে তখন প্রলয় কাণ্ড চলছে। হাতের কাছে যা যা ছিল সব ছুড়ে ছুড়ে ভাঙছে সুমি। কোনও কাণ্ডজ্ঞান নেই। বৃদ্ধ বাবা-মা, দাদা, কত বোঝাবার চেষ্টা করছে বাইরে থেকে। যত শান্ত করার চেষ্টা চলছে তত-ই হিংস্র নেকড়ের মতো জিনিসপত্রগুলো তছনছ করছে। ভেতরের ঝড়ের তাণ্ডবে বাইরের সবাই চমকে উঠছে। বেকুবের মতো এককোণে দাঁড়িয়ে আছে সমৃদ্ধ। যেন কিংকর্তব্যবিমূঢ় এক জড়পিণ্ড।

মা একটু এগিয়ে ওর কাছে এসে ফিস ফিস করে বলেন– এভাবেই চলছে বাবা। এরপরই ও জ্ঞান হারাবে। দেখা ছাড়া কিচ্ছু করার নেই আমাদের। ওরা দু’জনে দু’জনকে খুব ভালোবাসত। বিয়ের দিন-ও ঠিক হয়ে গিয়েছিল। অনেক চিকিৎসা করেছি। কিন্তু…! মনোরোগ! তেমন কোনও তাৎক্ষণিক মেডিসিন নেই। অনেক ধৈর্য ধরে দীর্ঘদিন চিকিৎসা করাতে হবে। কিন্তু আমাদের বয়স হয়েছে। দুজনেই অসুস্থ। সুব্রত চলে যাবে। তখন আমাদের পক্ষে…! কী জানি কী হবে! ডাক্তারের মতে এভাবে চলতে থাকলে একসময় ও সম্পূর্ণ উন্মাদ হয়ে যাবে, বলেই কান্নায় ভেঙে পড়লেন মা। ভেতরে তখন হুলুস্থুলু কাণ্ড! দরজার খিল দিয়ে বাড়ি দিচ্ছে আলমারি, ড্রেসিং টেবিলের উপর। ঝনঝন করে কাচ ভাঙ্গার আওয়াজ। সুব্রত তাড়াতাড়ি দরজাটা খুলতেই দরজার ডাসাটা ছুড়ে মারল ওকে লক্ষ্য করে। তারপর দাঁত কিড়মিড় করে ছুটে এল ওর দিকে। চোখ দিয়ে যেন আগুন বেরোচ্ছে।

সমৃদ্ধ যাবার জন্য পেছন ঘুরেছে। হঠাৎ শুনতে পায় গোঁ গোঁ আওয়াজ। মুখ দিয়ে গ্যাঁজলা বেরোচ্ছে। চোখ উলটে ধড়াস করে মেঝেতে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যায় মেয়েটি। ছুটে আসে সব্বাই। সমৃদ্ধও দ্রুত ঘরে এসে ওর মুখে চোখে জল ছেটায়। পাখার হাওয়া করে জ্ঞান ফেরায়। প্রথমে সুমি কারোকে চিনতে পারে না। চারদিকে চোখ বোলায়। হঠাৎ একসময় সমৃদ্ধের দিকে দৃষ্টি স্থির হয়। শার্টটা দুহাতে চেপে ধরে, টেনে টেনে বলে– আর পালাতে পারবে না। এইতো আমি ধরে রেখেছি। সুমির মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে শান্ত স্বরে সমৃদ্ধ বলে– না সুমি আর ভয় নেই। আমি আর কোথাও যাব না। মামা-মামি সান্নিধ্য-র মুখটা এক ঝলক ভেবে নিয়ে ধীরে ধীরে আবার বলে– উঠে পড়ো, তোমার শান্তনু তোমার কাছেই ফিরে এসেছে। সব্বাই একসঙ্গে অপলক দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকায়। সুমি ফ্যাল ফ্যাল করে অসহায় দৃষ্টি মেলে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে।

তবু মনে রেখো…

পাবলিশারের দফতর থেকে এক কপি একটুকরো আকাশ সবেমাত্র হাতে পেল আঁচল। বইটা নাড়াচাড়া করতে করতে নতুন বইয়ের ঘ্রাণ নিল। কবি তোর্সা বসু নামটা ছাপার অক্ষরে দেখে চোখটা ঝাপসা হয়ে আসছে। নিউ সার্কুলার রোডের নতুন সাজানো ফ্ল্যাটটা যতই আপন হোক, সে আর সুতীর্থ বিয়ের পর প্রথম সংসার পেতেছিল মালিনী নিবাস-এই। ভাড়া বাড়ি হলেও আজও কেন জানি বড্ড নিজের!

মালিনী রায়চৌধুরী বছর ষাটের ডাকসাইটে সুন্দরী। স্বামী বেণুলাল রায়চৌধুরী অবসরপ্রাপ্ত উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মী। ইজিচেয়ারে গা এলিয়ে হাতে খবরের কাগজ নিয়ে তাঁর দিন কাটে। এক গেলাস জল গড়িয়ে খাবার অভ্যাস কোনও কালেই নেই। সারাজীবনে, যা কিছু সঞ্চয় করেছেন, তার রক্ষনাবেক্ষণের দাযিত্ব স্ত্রী মালিনীদেবীর হাতে ন্যস্ত করে তিনি নিশ্চিন্ত। এসব মাথায় রাখা মানেই তো উর্বর মস্তিষ্ককে কষ্ট দেওয়া। অতএব, জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ সবই সামলাতে হয় মালিনীদেবীকেই। নিন্দুকেরা বলে, মালিনীদেবীর শ্যেন দৃষ্টি এড়িয়ে একটি পিঁপড়েরও প্রবেশাধিকার নেই মালিনী নিবাস-এ। যদি বা আচমকা প্রবেশ করে ফেলে, তত্ক্ষণাৎই মালিনীদেবীর সম্মার্জনী আঘাতে তার ভবলীলা সাঙ্গ হয়।

বেশ মনে পড়ে আঁচলের, যারা মালিনী নিবাস-এ বাসন সাফাই আর কাপড় ধোয়ার দাযিত্বে বহাল হতো, তাদের মুখগুলো দিন কুড়ি পর পর বদলাতে থাকত। কারও তেল চিটচিটে বাসন ধোয়া তো কেউ কাপড় নিংড়ানোর কোনও ছিরি জানত না। মাঝে একবার মালিনীদেবীর তীব্র হাঁটু ব্যথার দরুন, একমাসের জন্য যে-কজন রন্ধনশিল্পী বহাল হয়েছিল তাদের কারওরই মালিনীদেবীর মাপ করা তেল-মশলায় রান্নার পারদর্শিতা ছিল না।

 

মালিনী নিবাস-এ দুটি প্রাণী। কর্তা ও গিন্নী। অনেক যত্ন নিয়ে বড়ো করেছেন একমাত্র ছেলে অবিনাশকে। সে-ও বদলি নিয়ে ভিনরাজ্যের বাসিন্দা। তার স্ত্রী তিতির সাফ জানিয়েছে, মালিনী নিবাস-কে ধুলোমুক্ত করার জন্য সে পৃথিবীতে জন্মায়নি। তার করার মতো অনেক কাজ রয়েছে।

মাঝে মাঝে ছুটিছাটায় একবেলার জন্য অবিনাশ আসত। কিন্তু স্ত্রী, পুত্র শ্বশুরালয়ে থাকায় অবিনাশের বিশেষ থাকা হতো না। এতে মালিনীদেবীর বিশেষ ভ্রুক্ষেপ নেই।

তেল-নুন-লকড়ি নিয়ে তিনি দিব্যি আছেন। বরং এ যেন একদিকে ভালোই। অন্যের আজেবাজে কাজ তার বরাবরই না-পসন্দ। খালি মাঝে মাঝে এক মাত্র নাতি তাতানের জন্য ভেতরটা হু হু করে এই যা! সাধ করে জিভেগজা, খুরমা, আচার বয়ম ধরে বানিয়ে রোদে দেন। সংরক্ষণ করেন, যদি কখনও তার দাদুভাই আসে! কিন্তু কালের নিয়মে একসময় তাতে ছাতা ধরে। তবু মালিনীদেবী প্রাণে ধরে কাউকে দিতে পারেন না।

মালিনী নিবাস-এর একমাত্র ভাড়াটে সুতীর্থ বসু আর তার ছোট্ট ছেলে বাবিনের প্রতি মালিনীদেবী বরাবরই স্নেহশীলা। কিন্তু সুতীর্থর বাউন্ডুলে লেখিকা বউ, আঁচলের উড়নচণ্ডী স্বভাব দেখে রেগে গজগজ করে বলতেন, মেযোনুষের অত সংসার ফেলে বাউন্ডুলেপনা ভালো লাগে না বাপু! বলি পাতাকে পাতা হিজিবিজি লিখলে সংসারের কোনও উপকার হয়? তার চেয়ে ঝুলগুলো তো একটু ঝাড়তে পারে? নেহাৎ পড়েছিল অমন ভালো ছেলেটার হাতে! আহা গো, বাচ্চাটা কেমন শুকনো মুখে ঘুরে বেড়ায়!

প্রতিদিনের মতোই একদিন মালিনী নিবাস-কে ধুলোমুক্ত করতে করতে, সেরিব্রাল অ্যাটাকের শিকার হয়ে শয্যাশাযী হলেন মালিনীদেবী। বাঁ দিকটা কোনও জোর নেই। ভাগ্যিস আঁচল এসে ধরেছিল, নইলে সে যাত্রা ফিরতেন না। সবই অদৃষ্ট নইলে কে ভেবেছিল, তার মতো দাপুটে মহিলাকেও কাজের মাসি আর আয়াদের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হবে।

এদিকে পিঁপড়ে, আরশোলা, ছুঁচো মনের সুখে বাসা বেঁধেছে মালিনী নিবাস-এ। বেণুলাল খুব একটা এদিকে আসেন না। রোগীর ঘরে আসতে তাঁর গা ঘিনঘিন করে। পরিচিত কেউ যদি জিজ্ঞেস করত, মাঝে মাঝে ভুলেই যান, ডান না বাঁ কোন দিকে অসাড় মালিনীদেবীর। না এসব করলেও বেণুবাবু যথেষ্ট কর্তব্যবান। কারণ চিকিৎসা ও পরিচর্যার যাবতীয় আর্থিক ভার তো তাঁরই। শুধু শুধু খোঁজ নিতে গিয়ে নিজের সুস্থ শরীরকে অসুস্থ করে বিপদ বাড়ানো বই-তো নয়!

বিশেষ কেউ আসে না মালিনীদেবীর ঘরে। এভাবে বেঁচে থাকার চেয়ে মৃত্যু তাঁর কাছে অনেক স্বস্তির। অবিনাশ একবেলার জন্য এসেছিল। চোখ ফেটে জল আসে মালিনীদেবীর। সামনে আলমারীর ওপরে তাঁদের বিয়ে ছবি। আজ পঁয়ত্রিশ বছর ধরে বেঢপ বেণুলালের সঙ্গে নিজের জুটিটাকে মানানসই করতে, নিজেকে ভেঙেচুরে ফেলেছেন সেই কবেই! এই পুতুল খেলার নেশার মতো সংসারের নেশায় বুঁদ হয়ে সব কষ্ট ভুলেছেন। নয়তো এই স্বার্থপর, বাতিকগ্রস্ত, বদমেজাজি লোকটার সঙ্গে থাকতেন কীভাবে? মাঝে মাঝে বিভিন্ন মহিলা কলিগের সঙ্গে মাখোমাখো গল্প কানে এসেছে। শুনেও শোনেননি, বুঝেও বোঝেননি। সব কষ্ট থেকে পালানোর একটাই জায়গা ছিল। আজ আর সেটাও রইল না।

ও মাসি আমি কিন্তু ফল, হরলিক্স আনিনি, এই দ্যাখো বকুল ফুল। খুশি? বলেই হেসে ওঠে আঁচল। আঁচলের চুলের শ্যাম্পু আর পারফিউমের গন্ধে সতেজ লাগে মালিনীর। পর্দা সরাতেই ঘরে একরাশ রোদ্দুর হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পড়ল।

এই দ্যাখো মাসি আমার মোবাইলে, একি! মাসি তুমি কাঁদছ?

চাঁপা কলির মতো আঙুল দিয়ে চোখ মুছিয়ে দিয়ে আঁচল স্বভাবসুলভ ভাবে বলে চলে, এটা ওয়ে ম্যাগাজিন। আমি এডিটর। সেদিন কাগজওয়ালার পুরোনো খবরের কাগজের স্তূপে, তোমার কবিতার খাতাগুলো পাই। মেসো মনে হয় বোঝেননি। আমি কিন্তু আরও ছাপব মাসি! আসলে তুমি যতই খিটখিট করো, আলমারী ঠাসা রবীন্দ্র রচনাবলীর সম্পূর্ণ সেট আর ঝাড়ু দিতে দিতে রবিবাসরীয় পড়া দেখেই বুঝেছিলাম।

ফ্যালফ্যাল করে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকেন মালিনীদেবী। আঁচল বলে চলে, বারীন সেনের মতো লেখক তোমার বন্ধু? উনি পড়ে নিজে আমায় ফোন করেছেন। ভাবতেই পারছি না! কত বেস্টসেলার লিখেছেন উনি।

 

ঈষৎ বেঁকে যাওয়া, বলিরেখায় ভরা মুখটায় কে যেন আবির ছড়িয়ে দিল। লাজুক হেসে একটু জড়ানো স্বরে বলে চলেন, এক কালে বারীনদার সাথে কত চিঠি, কবিতা দেওয়া-নেওয়া হয়েছে। মামার সংসারে মানুষ তো! বারীনদা তখনও প্রতিষ্ঠা পায়নি। তোর মেসোর ভালো চাকরি। (একটু থেমে) আচ্ছা আঁচল আমি কি আর আগের মতো জোর ফিরে পাব না রে? শুয়ে বসে খুব কষ্ট হয়। আমাকে একটু তোর মতো ফোন দিয়ে টাইপ শিখিয়ে দে না। নতুন করে লিখি।

খুব কষ্ট হয় আঁচলের। জোর করে হেসে বলে, একটু ভালো হও তারপর। এখনও তো অসুস্থ তুমি।

ধুর! আর ভালো হব নাকি! শোন না, আমার এই সোনার চুড়ি দুটো রাখ।

এ মা! কেন?

আরে সে লোক এখন টাকা পয়সা নিজের হাতে করে নিয়েছে। সময় থাকতে সরিয়ে রাখিনি আমিও যেমন! শোন না, কবিতাগুলোর একটা বই করে দিবি মা! এটা দিয়ে হবে তো? আর একটা কথা, কবির নাম দিবি তোর্সা বসু। আমার বাপের দেওয়া ডাকনাম। বাপের পদবী।

তুমি ওটা রাখো মাসি, আমি নিজে করে দেব। চাকরি করি তো না কি! একটু সময় দাও।

শোন না যাবার আগে বাবিন সোনার জন্য আমের আচার নিয়ে যাস কিন্তু।

চোখটা মুছে মোবাইলের গ্যালারি থেকে মালিনী মাসিমার ছবিটা বের করে আঁচল আপন মনেই বলে, আজ বইমেলার ৪ নম্বর স্টলে তোমার এক টুকরো আকাশ থাকবে। তোমার কথা ভুলিনি মাসি, একটু দেরি হয়ে গেল! গুছিয়ে নিতে সময় লেগে গেল।

ঘূর্ণাবর্ত

ভালো ছাত্রছাত্রীরা গোলাপবাগ আর তারাবাগের মায়া কাটাতে না পেরে একটার পর একটা কোর্সের জন্য পরীক্ষায় বসে, আর কোনওটা না কোনওটা উৎরে গিয়ে ফের অ্যাডমিশন পেয়ে যায়, আর সবান্ধবে হোস্টেল জীবন দীর্ঘায়িত করে চলে। তাছাড়া ছাত্র সংসদের নেতা হওয়ার একাধিক সুবিধার মধ্যে একটি হল বছরের পর বছর সাংগাঠনিক কাজের উদ্দেশ্যে ছাত্রাবাস দখল করে থাকা যায়।

কৃষাণু রায়ের দুটো খুঁটিই মজবুত। এমকম করার পর এমবিএ-তে ভর্তি হয়েছে। এমবিএ-তে সুযোগ পাওয়াটা কঠিন, কিন্তু পেলে প্রথম শ্রেণিতে পাস না করাটাই বিরলতমের মধ্যে বিরলতম ঘটনা– এই আপ্তবাক্য স্মরণে রেখে ক্যাম্পাস কাঁপিয়ে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে আছে। দ্বিতীয় প্রাপ্তি হোস্টেলের প্রাথমিক লিস্ট বেরোনোতেও সংসদের দাদা-দিদিদের ভূমিকা অগ্রণী। মেয়েদের ছাত্রীনিবাস ছাত্রী সংখ্যার অনুপাতে নিতান্ত অপ্রতুল। তাই নতুন ভর্তির সঙ্গে সঙ্গে কৃষাণুদের পেছনে নতুন নতুন মেয়েরা ঘুরে বেড়ায় যাতে আবাসন তাড়াতাড়ি জোটে।

সুতরাং প্রথমটায় সিক্তাই কৃষাণুর সাক্ষাত ও সহযোগিতা প্রার্থী ছিল। পরবর্তীকালে দেখা গেল নিজের বিভাগের নতুন ছাত্রীটির আবাসনিক সুবন্দোবস্তের জন্য কৃষাণুর তৎপরতাই বেশি। কারণ প্রতিদান প্রাপ্তির ব্যাপারে তার আত্মবিশ্বাস চিড় খায়নি। কৃষাণুর টানেই সিক্তা ইংরেজির ছাত্রী হয়েও সাহস করে ফাইনান্সে স্পেশালাইজেশন নেবে স্থির করে, কাছাকাছি এক জায়গায় ম্যানেজারিয়াল অ্যাকাউন্টেন্সির টিউশনি নিচ্ছে। টিউশনি ছাড়াও তারাবাগের গাছের তলায়, ঝিলের পাড়ে, কৃষ্ণসায়র পার্কে ও মাঝেমধ্যে কৃষাণুর হোস্টেলেও ডেবিট, ক্রেডিট, ফান্ড ফ্লো, ব্রেক ইভেনের কোচিং চলে। ছাত্রীর গাফিলতি থাকলেও শিক্ষক শিক্ষাদানে ও গুরুদক্ষিণা আদায়ে যথেষ্ট দায়িত্বশীল।

‘জানিস নাইনটি এইটের পর আমাদের ডিপার্টমেন্ট আর একাঙ্ক নাটক প্রতিযোগিতায় পার্টিসিপেট করেনি। যতসব ডেঁপোর দল। আমাদের বিরাট পড়াশোনো, প্রজেক্ট, সেমিনার, ক্যাম্পাসের চাপ– তাই নাকি নাটকের সময় নেই। আমরা এবার এই প্রোডাকশনটা নামাবই। এই নিয়ে এসকে স্যারের সঙ্গে হেডুর লেগে গিয়েছিল। এসকে হেড থাকার সময় নাটক হয়েছিল তো।’

‘কিন্তু নাটকের ক’দিন পরেই ফার্স্ট সেমেস্টার। তোর কাছে সাবজেক্টগুলো খুব অপরিচিত না হলেও আমার কাছে একেবারে নতুন। অ্যাকাউন্টেন্সির এ জানি না। ম্যানেজারিয়াল ইকোনোমিক্সে এত অঙ্ক জানলে আমি অ্যাডমিশন টেস্টই দিতাম না।’

‘আরে সবাই পাস করবে। তুই ঘাবড়াচ্ছিস কেন? নাটকটা যেন না ধ্যাড়ায়, এমজি আর তার চামচাদের উচিত জবাব দিতে হবে।’

নাটকের মহড়া চলে তারাবাগেই, বিশ্ববিদ্যালয়ের অতিথিনিবাসে। শনি রবিবার স্বর্গ দর্শনের লোভ দেখালেও সিক্তা হোস্টেলে থাকতে চায় না। সপ্তাহের শেষে বাড়ি না ফিরলে তারাবাগের বৃন্দাবনকে আন্দামানের দ্বীপান্তর মনে হয়। কৃষাণুর মাসে একবার বাড়ি গেলেই চলে। আগে একজনের সঙ্গে ব্যান্ডেল পর্যন্ত একসাথে যেত বলে গন্তব্য হাওড়া হলেও মেইন লাইনের লোকাল বা মেইল ধরত। এখন সে মুখপুস্তিকার বন্ধুতালিকায় কোনওক্রমে টিকে আছে। বড্ড কেঁদেছিল মেয়েটা সেদিন। ভাবতেই পারছিল না এত কিছুর পর এত সহজে কেউ সব শেষ করে দিতে পারে। ভগবান মেয়েদের চোখে কত জল ভরে পাঠান কে জানে? সিক্তাও তো– দুদিন দেখা না হলে কি ফোন না ধরলেই চোখ ছলছল, আবার একটু বেশি দেখতে চাইলেও প্রবল বাধা, জোর করে কেঁদে ফেলে যেন কী না কী অনাসৃষ্টি হয়ে গেল!

‘আজ হোস্টেলে রাতের মিল অফ রাখিস। অতনুদার বাড়িতে রাত জেগে রিহার্সাল হবে।’

‘কালকেই তো স্টেজ রিহার্সাল, তাহলে আজ আবার… ওকে, গেটপাস করিয়ে রাখি।’

‘ধুর! কাল ওই মশার আড়তে কখন আমাদের পালা আসবে বসে থাকতে হবে। আজ একেবারে ফুল এনার্জি দিয়ে, বুঝলি? গেটপাসের কী দরকার? তুই তো এমনিতেই শনি রবি থাকিস না। বোধহয় এই প্রথম শনিবার বাড়ি ছুটছিস না। চল না। সবাই মিলে জমিয়ে আড্ডা দেব।’

পরিচালক অতনু সান্যালের বাড়িতে সন্ধে ছটা নাগাদ বাণিজ্য প্রশাসন বিভাগের নাট্যশিল্পীর দল পেৌঁছে গেল। মহড়া চলল রাত সাড়ে দশটা পর্যন্ত। অতনুদার মা বেশ সমারোহ করে সবাইকে সান্ধ্য জলখাবার থেকে রাতের মাংস ভাত খাওয়ালেন। সোমা, দিলীপ, সমরেন্দ্রর বাড়ি বর্ধমান শহরেই। ওরা খেয়েদেয়ে চলে গেল। সিক্তা একটু অবাক হল শুনে ওদের কারোরই নাকি অতনুর বাড়ি থেকে যাওয়ার কথা হয়নি। কারণ বিশাল সিলেবাস, টার্ম পেপার, সামনে পরীক্ষা। বাকিরা বিদায় নিতে সিক্তার মুখখানা আরও ভাবিত হয়ে উঠল।

‘কী ভাবছ? এখন নাটকে কনসেনট্রেট করো সিক্তা। আরে কৃষাণু রায়ের বান্ধবীর চিন্তা কীসের? এই তোরা বেশি রাত করিস না। সিক্তা, রেবতীর ঘরে একা শুতে ভয় করবে না তো? বোনটা আজই মাসির বাড়ি গেল।’ কথাগুলো বলে অতনু স্নানঘরে ঢুকে গেল ব্রাশ মুখে।

কৃষাণু কী চমৎকার বিন্দাস থাকতে পারে! পাশের ঘরে অতনুদার সঙ্গে তার হাসিমশকরার শব্দ একটু পরেই স্তিমিত হয়ে এল। অতনুদার নাক ডাকছে। সিক্তার ঘুম আসছিল না। বান্ধবের কথায় নেচে এসব নাটক ফাটক নিয়ে মাতা কি উচিত হল? বাড়ি না গেলে কিছুতেই হোস্টেলে পড়াশুনো করতে পারে না সিক্তা। অনেককেই দেখেছে নিরুপদ্রবে দল বেঁধে পড়বে বলে টানা ছুটির দিনগুলোতেও হোস্টেলে থেকে যায়। এপাশ ওপাশ করতে করতে চোখে তন্দ্রা লেগে গিয়েছিল কখন– গায়ে একটা স্পর্শে চমকে জেগে উঠল।

‘ঘুমোসনি?’ কৃষাণুর মৃদু গলার প্রশ্ন।

‘আসছে না। নিজের জায়গা ছাড়া অস্বস্তি হয়। তুই মশারি খুলে মাথা অর্ধেকটা ঢুকিয়েছিস? মশা কামড়াবে যে আমায়। কী করছিস? ওই ঘরে যা, কেউ দেখে ফেললে উলটোপালটা ভাববে।’

‘কে দেখবে? শুনছিস না, অতনুদার নাসিকা গর্জন। ওই আওয়াজে কারও ঘুম হয়? তাই তো এ ঘরে এলাম দেখতে ম্যাডাম নিদ্রিত না জাগ্রত।’

‘আমার অনেক পড়া বাকি। নাটকটা মঞ্চস্থ হওয়ার আগে সেদিকে মন দিতে পারব না। জিএম স্যার এমনিতেই আমাদের ওপর খচা। তার ওপর রেজাল্ট খারাপ হলে…। এসকে-র সঙ্গে টাএ, আর তার রিপার্কেশন পড়বে আমাদের ওপর। এই মশা ঢুকবে কিন্তু। ও ঘরে যা না।’

‘বাবা! এমন করে তাড়িয়ে দিচ্ছিস? এবার মশা ঢোকার রাস্তা বন্ধ।’ কৃষাণু পুরোপুরি খাটে উঠে মশারি গুঁজে দিল।

‘ও কী?’ সিক্তা আঁতকে উঠল। ‘এই বিছানায় ঢুকলি কেন? প্লিজ…। এ ঘরে কেউ দেখে ফেললে খুব খারাপ হবে। আমারও তো ঘুম আসছে না। আমি কি অন্য ঘরে হানা দিয়েছি?’

‘অতনুদার মা বাবা দোতলায়। অতনুদার ঘুম বিউগল বাজালেও ভাঙবে না। এক কাজ করি চ। দালানের সিঁড়িতে বসি। উঠোনে চমৎকার জোছনা।’

অগত্যা। সিঁড়িতে বসে সিক্তার হাত ধরে ইকিড়মিকিড় খেলছে কৃষাণু। হাতের আঙুল কখনও কখনও ম্যাও মারতে গেলাম ভঙ্গিতে ওপর নীচ করছে। অস্বস্তি আর ভালোলাগা নিয়ে একটু আড়ষ্ট হয়েও নিজেকে ছেড়ে রেখেছে সিক্তা। বাধ সাধল মশা। ‘বাপরে! এখানে বসা যায় নাকি? ম্যালেরিয়া ডেঙ্গু চিকুনগুনিয়া সব একসাথে ধরবে। আমি ঘরে যাচ্ছি।’

হাত ধরে টেনে নিজের কাছে বসাতে গেল কৃষাণু। সিক্তা প্রায় হুমড়ি খেয়ে ওর কোলের ওপর পড়ল। গালে মুখ চেপে কৃষাণু বলল, ‘বাড়িতে জানিয়েছিস?’

‘কী জানাব?’ কথাটায় একটু নাড়া খেল সিক্তা। সঙ্গে শিরশিরানি।

‘যার জন্য কিছুদিন মেলামেশার পরেই মেয়েরা প্যানপ্যান করতে থাকে। সারাজীবন কি এভাবে খোলা বারান্দায় মশার কামড় খাব নাকি? মশারিতে ঢোকার পারমিশনটা চাই তো? লিগাল পারমিশন।’

কৃষাণুর মধ্যে বামপন্থী রাজনৈতিক বিশ্বাসের পাশাপাশি একটা প্রতিষ্ঠান বিরোধী প্রবণতাও ফুটে ওঠে প্রায়ই। যেন প্রচলিত সব কিছু বোগাস, প্রথা ভাঙাই বীরত্ব। সংস্কারকে গুঁড়িয়ে ফেলার নামই প্রগতি। সংস্কারটা ভালো না মন্দ জানার দরকার নেই। আধুনিক এক মহিলা কবির একটা কবিতা প্রায়ই শোনায়– ‘বেশ করি নিশিক্লাবে যাই বেশ করি আমি মাল খাই বেশ করি রাত করে ফিরি এসব ছাড়পত্র বুঝি তোর? মনে ক্লেদ পেশি ভরা জোর যখন তখন পশুগিরি? পাঁচ বছরের কচি মেয়ে কাঁদে মাকে দেখতে না পেয়ে বিক্ষত কেন তার শ্রোণী? সেও কি পেশায় মেতে আছে? ইশারায় ডেকেছিল কাছে? অস্ত্রে শান পড়ল যখনই?’ শেষ অনুচ্ছেদের প্রশ্নটার চাইতে প্রথম লাইনকটার দৃপ্ত ঘোষণা কৃষাণুকে বেশি আকর্ষণ করে বোঝা যায়। ওই সোচ্চার ঘোষণার মধ্যে যে ক্ষোভ লুকিয়ে আছে বিনা প্ররোচনাতেও লালসার শিকার হওয়ার প্রতি, সেটা কি বোঝে না? যেন সিক্তার মদে প্রবল বিরাগ, সিগারেটের গন্ধে এলার্জি– মানে সে যথেষ্ট সাহসি নয়।

এক সময় এই দলের দাদা-দিদিরাই ছাত্রীদের জন্য শালীনতার নানা সীমানা বেঁধে দিয়েছিল। ক্যাম্পাসের বক্তৃতায় প্রায়ই শোনা যেত ‘অপসংস্কৃতি’ শব্দটা। তখন ‘চোলিকে পিছে’ও ছিল অপসংস্কৃতি, ‘দূরদর্শনের পাঁচটি নতুন চ্যানেল যেন চেতনার বুকে ছুরিকাঘাত’। আজ তো ‘ছত্রাক’ ও সংস্কৃতির অঙ্গ কারণ কেবল আর ইন্টারনেটে ব্যাক্টিরিয়া, ভাইরাস, প্রোটোজোয়া’দের অবাধ বিস্তার। যে-ছেলেটা বান্ধবীকে কথায় কথায় শোনায়, ‘তুই যথেষ্ট বোহেমিয়ান নোস। আমার সাথে তাল মেলাতে গেলে কিন্তু প্রথা ভেঙে ছুটতে হবে। টিভি সিরিয়ালের ঘোমটা টানা বহুরানি, শাঁখা নোয়া চুড়ির জবরজং আমার পোষাবে না। বুক ফুলিয়ে বলতে পারা চাই আমি একে ভালোবাসি, এর সঙ্গে থাকব, কার বাপের কী?’– তার সাথে সম্পর্ক চাইলেও, মুখ ফুটে সমাজ স্বীকৃত চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের কথা তাই কোনওদিন বলতে পারেনি সিক্তা, পাছে বন্ধুত্বটাও হাতছাড়া হয়। আড়ালে আবডালে কৃষাণুর খাইখাই আদরটায় উত্যক্ত হয়েছে যত, উত্তপ্ত হয়েছে তার চেয়ে ঢের বেশি। কিন্তু সীমা ছাড়ানোটার ব্যাপারটা যেন বৈধতার শর্তেই আটকে থেকেছে। যার ফলে শুনেছে ‘তুই টিপিক্যাল মিডলক্লাস গাঁইয়া, এই, ওই, সেই’। সেই ছেলের মুখে আজ এ কী কথা? ভেতরটা অদ্ভুত ভালোলাগায় কেঁপে উঠল।

আর একটু নিশ্চিত হওয়ার জন্য প্রশ্ন করল, ‘লিগাল পারমিশন মানে? কাগজে কলমে সাক্ষী রেখে পরস্পরকে পার্টনার হিসাবে গ্রহণ?’

‘শুধু কাগজ কলম কেন, তোর আমার বাড়িতে চাইলে প্যাঁপ্যাঁপ্যাঁপ্যাঁ– প্যাঁপ্যাঁপ্যাঁ– প্যাঁ– ’

এই চিরকালীন বহু ঘটিত ব্যাপারটা, পৃথিবীর কত স্ত্রী পুরুষই তো করেছে, কেউ নিজের পছন্দে কেউ অন্যের কথায়। কেউ স্বেচ্ছায়, কেউ বাধ্য হয়ে। কিন্তু কৃষাণুর সঙ্গে মিশে সিক্তাও দায়বন্ধনহীন সহবাস কিংবা বিচ্ছেদকে নিজের প্রেমের নিয়তি হিসাবে ধরে নিয়ে অহরহ একটা অস্বস্তিতেই থাকে। বাড়িতে কী বলবে? মা, ‘আমি একজনের সঙ্গে লিভ টুগেদার করতে চাই!’ কীভাবে বলবে? আর বাবাকে? সেই প্রতিষ্ঠান বিরোধী মানুষের মুখে এই সেকেলে ব্যপারটার উল্লেখই এক অদ্ভুত শিহরণ সৃষ্টি করছে।

‘কী বললে? আবার বলো?’

কৃষাণু সিক্তাকে গাঢ়ভাবে আলিঙ্গন করে ঠোঁটদুটোকে যেন শুষে নিতে লাগল। আধ মিনিট পর বাঁধন আলগা করে বলল, ‘মশার কামড়ে আপাতত এই টুকুই। বাকিটা লাইসেন্স পেলে উসুল করে নেব। ভেবে দেখলাম, তোকে ছাড়া থাকা সম্ভব নয়। পুরোপুরি এবং পাকাপাকি ভাবে পেতে যদি রেজিস্ট্রারের সামনে শপথ নিতে হয় নেব, যদি মাথায় টোপরও পরতে হয় তো তাই সই। কিন্তু তোকেই চাই। এবার যা, বর কনের কারও ডেঙ্গু হলে সব ফুটুস। আপাতত নাটকটাও নামানো দরকার। আমি অতনুদার নাকডাকা শুনি। তুই একটু ঘুমোনোর চেষ্টা কর।’

আর ঘুম? দু চোখে অত স্বপ্ন জড়ো হলে কি ঘুম আসে? নিজের কানকে বিশ্বাস হচ্ছিল না। অথচ অবিশ্বাসের কিছু নেই। পৃথিবীতে ওরাই প্রথম ভালোবেসে বিয়ে করতে চলছে না। লাইসেন্স পেলে উসুল করার কথাটা মনে পড়লে শিরদাঁড়া দিয়ে একটা শিরশিরে স্রোত বয়ে যাচ্ছে। গালে ঘাড়ে ঠোঁটে কৃষাণুর আদর, শরীরের আনাচ-কানাচ অভিমুখী হাতের স্পর্শ হঠাৎ একটা অনুচ্চারিত শব্দে অমৃত হয়ে গেল– বিয়ে। কারণ কৃষাণু ওকেই চায়। কিন্তু সত্যিই শেষ রক্ষা হবে তো?

নাটক পর্ব অতিক্রান্ত। কুশীলবদের অভিনয় সহ গোটা প্রযোজনাটাই বেশ প্রশংসিত হল। কদিন কিছু ক্লাস কামাই হলেও অনুমতিক্রমে উপস্থিতির খাতায় ওদের হাজিরার রেকর্ড আছে। কিন্তু অনেকদিন না পড়ায় অনেক কিছু বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে। বাণিজ্য অর্থনীতির ছদ্মবেশে গাদা গাদা ক্যালকুলাস খাঁড়ার মতো ডিফারেন্সিয়েশন, ইন্টিগ্রেশন, লিমিট, ডট ডট ইত্যাদি বাগিয়ে ঘাপটি মেরে আছে কে জানত? এইসব আঙ্কিক দংশন থেকে মুক্তি পেতেই তো বিজ্ঞান নিয়ে উচ্চমাধ্যমিক পাস করার পর ইংরিজিতে অনার্স নিয়েছিল সিক্তা। আবার ওই কিম্ভূত চিহ্নগুলোর খপ্পরে পড়তে হল? পড়ায় ক্ষতিপূরণের জন্য এখন এর তার শরণাপন্ন হতে হচ্ছে। কৃষাণুর কাছে কাজের চেয়ে অকাজ হয় বেশি, যার জেরে রাত জেগে পড়া আর রাতের ঘুম দুটোই ভোগে যায়।

এরই মধ্যে কেন্দ্রীয় সরকারের সন্ত্রাস দমন নীতির বিরুদ্ধে ভারতের কোণে কোণে ছাত্রদের বিক্ষোভ। কৃষাণু ব্যস্ত হয়ে পড়ল মিটিং মিছিল পরিচালনায়। সিক্তাকেও যখন তখন ক্লাস কামাই করিয়ে নিয়ে যায়। উত্তপ্ত বক্তৃতা পড়ে মতামত চায়। সিক্তা বলল, ‘আর সময় নেই। সামনেই শীতের ছুটি, মোটে সাত দিনের। এখনই বন্ধুদের কাছ থেকে যা কালেক্ট করার করে নিতে হবে। ছুটিতে কাউকে পাব না। ছুটির পরেই পরীক্ষা। আমি অত ব্রেইনি নই। অলরেডি নাটকের জন্য পিছিয়ে গেছি। আর মিছিলে পথনাটিকায় পার্টিসিপেট করতে পারব না।’

‘এত সেলফিশ কেন তুই? শুধু নিজের কথা ভাবছিস? যাদের দেশদ্রোহী স্ট্যাম্প দিয়ে অ্যারেস্ট করা হল, যারা নিজভূমে পরবাসী হয়ে ইন্ডিয়ান আর্মির হাতে শহিদ হচ্ছে তাদের কথা ভাববি না?’

‘একটা কথা বলে রাখি। তোর সঙ্গে সারা জীবন কাটাতে চাই বলে তোর বিচিত্র রাজনৈতিক স্ট্যান্ডকেও অ্যাকসেপ্ট করে নেব ভাবিস না। ইডিওলজিকালি আমি এই আজাদির আন্দোলন, অ্যান্টি ইন্ডিয়ান স্লোগান শাউটিং কোনওটাই সমর্থন করছি না। আমাদের দেশের সরকার যারা চালায় তাদের হয়তো অনেক দোষ আছে, অনেক ভুল নীতিও আছে আমাদের সংবিধানে। নর্থ-ইস্টে সেনা যা করে তার নিশ্চই প্রতিকার হওয়া দরকার। কিন্তু সেগুলো রেকটিফাই করার পদ্ধতি শত্রু দেশগুলোর ষড়যন্ত্রে কি সন্ত্রাসে মদত দেওয়া নয়? দ্যাখ বলতে গেলে অনেক তর্ক হবে। আমি শুধু বলতে চাই, যে মিশনটা আমি সাপোর্টই করি না, তার জন্য নিজের শ্রম, সময়, পড়াশোনা নষ্ট করব কেন? তুই এই নিয়ে স্টুডেন্টদের খ্যাপাচ্ছিস খ্যাপা, আমার পছন্দ না হলেও তোকে তো বাধা দিচ্ছি না। আমাকেও জোর করিস না।’

‘পথনাটিকায় অভিনয় না করিস, অ্যাটলিস্ট প্রসেশনে চল।’

‘কেন ভিড় বাড়াতে? স্যরি।’

‘ভুলে যাস না, তুই কিন্তু এখনও ফিফ্থ ইয়ার। আমি এখন তোর ক্লাসমেট হলেও তোর চেয়ে সিনিয়র, তিন বছর গোলাপবাগে আছি। তোকে সারদা হোস্টেলে পার্মানেন্ট বোর্ডার করেছি কিন্তু আমিই।’

‘ভয় দেখাচ্ছিস? তোদের জুলুমবাজিতে এসে অবধি প্রায় দিন মিটিং, মিছিলে হাজির থাকতে হয়েছে। আমাদের হোস্টেলের মেস কমিটি কিন্তু বলেছে যাদের ছুটির পরেই পরীক্ষা তাদের মিছিলে যাওয়া বাধ্যতামূলক নয়।’

‘শেষবারের মতো জানতে চাইছি। যাবি কিনা?’

‘আমায় ছেড়ে দে কৃষাণু। আমি পারব না। শরীরটাও ভালো নেই। গলায় কষ্ট হচ্ছে। গা ম্যাজম্যাজ করছে।’

‘গা ম্যাজম্যাজানির টনিক আমি জানি। একটু ফিজিওথেরাপিতে ফ্রেশ হয়ে যাবি।’

‘প্লিজ আমায় জোর করিস না।’

‘তোর ওপর আমার এটুকু জোর নেই? তাহলে আজ এখানেই বাইবাই বলি?’

প্রথমে কথাটা বুঝতে পারেনি সিক্তা। বোঝার পরও ভাবল রাগের মাথায় বলছে। পালটা রাগ দেখিয়ে বলল, ‘তোর খুশি’। কিন্তু মনে খচখচানি নিয়ে হোস্টেলে ফিরল।

পরেরদিন শনিবার। সিক্তা ব্যাগপত্তর নিয়ে ক্লাসে। শেষ ক্লাসটা শেষ হতেই স্টেশন ছুটবে। কতদিন পরে বাড়ি যাচ্ছে! সাত দিনের ছুটি, আর বিরাট পাঠ্যসূচি। গতকালের খচখচানি নিয়ে কৃষাণুকে খুঁজল। রিডিং রুমে অয়নদের সঙ্গে হেসে হেসে গল্প করছে। একবার চোখাচোখি হল। আবার তাকিয়ে দেখে কৃষাণু নেই। ক্লাসে ঢুকেও কথা নেই। সিক্তার কথার জবাব দিল না। ছুটির আমেজে বেশিরভাগ ক্লাস হল না। কৃষাণুও বিকেলে ছুটি পর্যন্ত সিক্তাকে যেন দেখতেই পেল না।

গোলাপবাগ থেকে যখন স্টেশনগামী বাসে চড়ল, তখন চোখ ছাপিয়ে জল আসছে। মাত্র দু’দিন আগে যে পাকাপাকি গাঁটছড়ার কথা বাড়িতে জানানোর প্রস্তাব দেয়, প্রেয়সীকে পাওয়ার জন্য ছটফট করে, এতটাই ছটফটানি যে এখনও সিক্তার শরীরে কৃষাণুর নিশ্বাসের উত্তাপ লেগে আছে, আজ সেই মানুষটার চাওনি মরা মাছের মতো অভিব্যক্তিহীন হয়ে গেল? ব্যক্তিগত সম্পর্কের চেয়ে রাজনৈতিক অবস্থানটাই বড়ো হয়ে গেল? বিয়ে সংসার বন্ধন সবই সাময়িক আবেগ, আজাদিটাই সত্যি?

পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য যেখানে মনে হচ্ছিল সাত দিনের বদলে মাস খানেক ছুটি পেলে ভালো হতো, সেখানে বই হাতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অন্যমনস্ক কেটে যাচ্ছে, রাত জেগে যত না পড়া হচ্ছে বালিশ ভিজছে তার দশগুন। কৃষাণু ফোন করা তো দূর, ধরেওনি, মিস্ড কল দেখে ফিরতি কল করেনি। এমনকী ফেসবুক কি হোয়াটস্অ্যাপে জাগ্রত থাকলেও নীরব থেকেছে। সিক্তার সেই প্রথম মনে হল কবে ছুটি শেষ হবে। একবার মনে হয়, এই যে মান খুইয়ে একতরফা যোগাযোগের চেষ্টা করে প্রত্যাখ্যাত হল, মুখোমুখি হলে পালটা উপেক্ষা দেখিয়ে প্রতিশোধ তো নিতে হবে। আবার কখনও সেই অসম্পূর্ণ উষ্ণ মুহূর্তগুলো হ্যাংলার মতো আবার ফিরে পেতে ইচ্ছে করে। হে ঈশ্বর! কী ভাবে সময় নষ্ট করছে মেয়েটা? প্রথম সেমেস্টার উৎরোবে তো?

পরীক্ষার পর সবাই হইহই করে সিনেমা দেখতে গেল। সঙঘমিত্রা, ভাস্বতী, মৃণালরা বলল সঙ্গে যেতে। কিন্তু সিক্তা যার সঙ্গের অপেক্ষায়, সে অন্য বন্ধুদের সাথে সিনেমা দেখে এসেছে শুনে পা থেকে মাথা টলে গেল। শরীর ভালো লাগছে না বলে হোস্টেলে ফিরে বিছানায় শুয়ে রইল। রুমমেট রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মৃন্ময়ী সন্ধে থেকে লক্ষ্য করে রাতে মাথায় হাত বুলিয়ে গালে গাল রেখে বলল, ‘জানি ভুলে যা বললেই ভোলা সম্ভব নয়, তবু মনে হয় তোর সেটাই করা উচিত। কৃষাণুদার জীবনে তুই প্রথম নোস, দ্বিতীয়ও নোস। ওই মারকাটারি চেহারা আর পারসোনালিটি নিয়ে গত তিন বছরে এ রকম অনেককেই কাঁদিয়েছে। কলেজে পড়তেও। আমিও তো সিটি কলেজেই পড়তাম না।’

‘আগে বলিসনি কেন?’

‘বললেই কি তুই শুনতিস? তাছাড়া ওকে যারা চেনে আমাদের সিনিয়রদের কেউ কেউ বলছিল, কৃষাণুর নৌকা তাহলে এই ঘাটে পাকাপাকি নোঙর করল। ওদের মনে হয়েছিল তুইই শেষতম। আমারও তাই মনে হতো, আর তোকেও বেশ খুশি খুশি দেখাত।’

‘একটু আধটু আমিও শুনেছিলাম। ও তো দুঃখ করত ওর কোনও রিলেশন টেকেনি। তাই আমাকে ভীষণ ভাবে আঁকড়ে ধরেছিল। এমনকী বিয়েতে বিশ্বাস না করলেও নাটকের ঠিক আগেটায় আমায় বিয়ের প্রস্তাবও দেয়। দু দিনের মধ্যে একটা তুচ্ছ ব্যাপারকে অজুহাত করে…। নিজে না ঠকলে, মনের ভেতর থেকে চাড় না এলে অন্যের কাউন্সেলিং-এ মোহ থেকে সরে আসা মুশকিল রে!’ আবার গলা ধরে এল। ‘আই স্টিল বিলিভ ও জেদের বশে নিজেকেও শাস্তি দিচ্ছে। ইফ নট মি, ইটস্ নান।’

‘কেঁদে নে, কেঁদে হালকা হ।’

মাস ছয়েক ধরে তারা রুমমেট। কিন্তু আজ প্রথম মৃন্ময়ীকে ভীষণ ভালো বন্ধু মনে হল। একটা বিছানা খালি পড়ে রইল। শীতের রাতে একই কম্বলের তলায় পরস্পরের শরীরের ওম্ ভাগাভাগি করে দুই বন্ধু ঘুমিয়ে পড়ল।

ফেব্রুয়ারির গোড়ায় সেমিনার। বিজ্ঞাপন যোগাড়, ডেলিগেট আহ্বান, অতিথি আমন্ত্রণের প্রস্তুতি পুজোর পর থেকেই শুরু হয়ে গিয়েছিল। সিক্তাও কোনও একটি কমিটির সদস্য, তবে তার বিশেষ কাজ নেই। থাকলে এই একঘেয়ে ছিঁচকাদুনে জ্বালা ভুলে থাকা যেত। বদলে, বিভাগের অনেক ছাত্র, সহপাঠী থেকে সিনিয়র তার হাফ-সোল খাওয়া নিয়ে টিটকিরি দিচ্ছে, ‘বিরহিণী রাধার কোনও কাজে মন নেই।’ কৃষাণু দারুণ ব্যস্ত, সদা হাস্যময়। সম্পর্ক ব্যাপারটাই ছেলেদের কাছে ছেলেখেলা। গভীর ভাবে জড়িয়ে পড়া, তাই নিয়ে কষ্ট পাওয়া এইসব মেয়েলি ন্যাকামি। ‘স্টে কু-ল’ হল এই যুগের মন্ত্র, জীবন যেভাবে আসবে তাকে সেইভাবে নাও। যতদিন ভালো লাগবে ততদিন থাকো, তারপর গা ঝাড়া দাও। আবার কিছু প্রত্যাখ্যাত প্রার্থী আনন্দে ফুটছে ভেতর ভেতর। বস কেটে গেছে এবার বুঝি তাদের পালা। কার কপালে সিকে ছেঁড়ে, সেটাই দেখার। এসএমএস থেকে ফেসবুক, হোয়াটস্অ্যাপে বার্তার ছড়াছড়ি। কেউ বা নতুন বান্ধবী জুটিয়ে হিংস্র আনন্দে– বেশ হয়েছে!

সেমিনারের দ্বিতীয় দিন রাতের খাওয়ার পর সিক্তা একা একা খোলা আকাশের নীচে দাঁড়িয়েছিল। ভেতরের হইচই আর মশকরা ভালো লাগছিল না। হঠাৎ পেছন থেকে একটা গরম কোট কে চাপিয়ে দিল। চমকে ফিরে তাকাতেই দেখে কৃষাণু! ‘তোর না ঠান্ডা লাগার ধাত। শিশির পড়ছে, এভাবে বাইরে দাঁড়িয়ে আছিস যে? ভাস্বতীদের হলে হোস্টেলে চলে যাস। ততক্ষণ ভেতরে বোস।’

বিহ্বলতা কাটিয়ে বলতে গেল, ‘তাতে তোর কী?’– কিন্তু গলা বুঁজে এল। নাটকের মহড়ার সময় সিক্তা গলা আর নাক নিয়ে বেশ নাকাল থাকত। মশার ধূপ, ঠান্ডা, সিগারেটের ধোঁয়া সবেতেই অ্যালার্জি। বেশি কথা বললেও কষ্ট। তাই নিয়ে কৃষাণু পেছনে লাগত, আর উপদেশ দিত, ‘সব তোর ম্যানিয়া, মুক্ত হয়ে বাঁচ, দেখবি সব রোগ পালিয়েছে।’ ওর মনে আছে? মানে মনে রেখেছে? তার আর মনে হচ্ছে না ঠান্ডার ভয়টা সিক্তার বাতিক? উলটে নিজের ব্লেজার সিক্তার গায়ে চালিয়ে দিল! আর সবার মধ্যে থেকেও লক্ষ্য করেছে সিক্তা ম্যারাপ বা ডিপার্টমেন্ট কোথাও নেই, বাইরে অন্ধকারে একা?

এই চোখের জল মস্ত বিড়ম্বনার বস্তু। এই অবস্থায় সবার মাঝে গিয়ে বসে কী করে? চুপচাপ কৃষাণুকে অনুসরণ করে ভেতরে ঢুকেও নির্জনতার খোঁজ। কৃষাণু ওকে রেখে আবার হইহুল্লোড়ের মধ্যে ফিরে গেল। একান্তে পেয়েও সিক্তার কাছে থাকল না, কথাও বলল না আর। ও শুধু দয়া দেখাতে এসেছিল? ব্লেজারটা খুলে তনয়ের হাতে দিয়ে বলল, ‘কৃষাণুকে দিয়ে দিস।’ তারপর সোজা জ্যোৎস্নার আলোয় গাছগাছালির আলো-আঁধারির ভেতর দিয়ে, দু বছর আগে যেখানে এক ছাত্রীর অচৈতন্য ক্ষত-বিক্ষত দেহ পাওয়া গিয়েছিল, তারাবাগ গোলাপবাগের মধ্যেকার সেই কাঠের সেতু পেরিয়ে একাই হোস্টেলে পৌঁছে গেল।

গেটপাস ভাস্বতীদের কাছে। দারোয়ান ভূত দেখার মতো অবাক হলেও সিক্তার উদ্ভ্রান্ত রূপ দেখে দরজা খুলে দিল। সিক্তা তিনতলায় ওর ঘরে ছুটল। ওর এখন অনেক অনেক কান্না বাকি আছে। আজ মৃন্ময়ী নেই। ভালোই হয়েছে। যে যন্ত্রণার সান্ত্বনা হয় না, সে একাকিত্বই খোঁজে।

পরের দিন রাজবাটী থেকে হেঁটে ফেরার পথে একটা রিক্শার দিকে চোখ পড়তে থমকে যেতে হল। বুকে ছুরি মারলেও বুঝি কম যন্ত্রণা হতো। কৃষাণুর পাশে মৃন্ময়ী। দুজনের তন্ময়তা একটাই সম্পর্ক সূচিত করে। আগুন সর্বভুক, আর পিঁপড়ের পাখা গজানোই নিয়তি।

সোনা মামিমার গল্প

স্বর্ণলতা সোনা মামিমার ভালো নাম। ডাকনাম সোনা। উনি আমার মামার প্রথম পক্ষের স্ত্রী। কেউ বলে, স্বর্ণলতা থেকে ছোটো করে সোনা হয়েছে। আবার কেউ বলে, কাঁচা সোনার মতো গায়ের রঙের জন্য এই নাম শ্বশুরবাড়ির লোকেরা দিয়েছে। মামিমা মানুষ হিসেবে খুব ভালো। আমাদের খুব ভালোবাসতেন। বছরে অন্তত একবার আমাদের বাড়ি আসতেনই। আর সেই দিনগুলো ছিল, বিশেষ করে আমার কাছে খুব মজার– মহা আনন্দের।

মামিমার বাপের বাড়ি কলকাতার শোভাবাজারে। আমার মায়ের বাড়ি কিন্তু অজপাড়াগাঁ। বাস থেকে নেমে হয় গরুর গাড়ি, নয়তো পালকিতে চেপে যেতে হতো প্রায় পাঁচ মাইল। মাঝে পড়ে নদী। নদীর ওপারে বনের প্রান্ত ঘেঁষা গ্রাম। নাম মধুবন। বন-প্রকৃতির কোলে আদরের দুলালির মতো গ্রামটি। মনকাড়া এখানের প্রাকৃতিক শোভা।

তবে প্রকৃতিপ্রেমিক বা কবি-সাহিত্যিকদের মন কেড়ে নিলেও, কলকাতার মানুষের পক্ষে এই বিভুঁইয়ে এসে মানিয়ে নেওয়া প্রায় অসম্ভব। আমারই মাঝে মাঝে ভালো লাগত না। মায়ের সাথে গেলেও বাড়ি ফেরার জন্য মন কাঁদত। মায়ের তো বাপের বাড়ি, জন্মভূমি। তার ভালো লাগলেও আমার কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগত। থাকতে মন চাইত না।

সোনা মামিমার ক্ষেত্রে ঘটে ছিল তাই। মামিমা কলকাতার মানুষ। শৈশব-কৈশোর কাটিয়ে ষোলোয় পা দিয়েই এসে পড়েন মামা বাড়ির কুলবধূ রূপে মধুবনে। সে এক ইতিহাস। মায়ের মুখে শোনা ওই চমকপ্রদ ঘটনা।

গ্রামের মধ্যে সবচেয়ে ধনীর বাড়ি। ছেলে শিক্ষিত। চাকুরে। এসব দেখেই মামিমার বাবা গণ্ডগ্রাম হওয়া সত্ত্বেও এখানে মেয়ের বিয়ে দিয়েছিলেন। প্রথমবার যখন বধূবেশে মামিমা এবাড়িতে পা দেন তখন তো হইচই, লোকজনে ভরা শ্বশুরবাড়ি তাঁর মন্দ লাগেনি। কিন্তু অষ্টমঙ্গলার পর বিপরীত ছবি। সব ফাঁকা ফাঁকা লাগে তাঁর। মন বসে না কোনওকিছুতেই। বাড়ির একমাত্র বউ মামিমা। শ্বশুর, শাশুড়ি আর স্বামী নিয়ে তাঁর ছোট্ট সংসার। তার উপর স্বামী সারাদিন থাকে বাইরে। মধুবন থেকে অনেকখানি দূরে তার চাকরিস্থল। ফিরতে ফিরতে হয় সন্ধে।

পাড়াপড়শির বাড়িতে বেড়াতে যাবার চল তেমন ছিল না। সিনেমা দেখতে গেলেও অনেক কাঠ খড় পোড়াতে হতো। সারা দিন শাশুড়ি আর বউ। এছাড়া জনা কতক মুনিশ-মানদার। আর বাড়ির পুরোনো ঝি মানদা। তবে আমার মা যখন বাপের বাড়ি যেত, সে সব দিনগুলো মামিমার খুব আনন্দে কাটত। কিন্তু তা তো বছরে মাত্র একবার কি দু’বার।

দিনের বেলা যদিও বা হইচই হাসি আনন্দে কেটে যেত, সন্ধের পর থেকে মামিমার একা একা খুব কষ্ট হতো। বাড়ির পিছনের পুকুর পাড়ের বাঁশ-ঝাড় থেকে মাঝে মাঝে শিয়াল ডেকে উঠত। তার সঙ্গে প্যাঁচা আর ঝিঁঝির ডাক। ফলে মামিমার শ্বশুরবাড়িতে মন টিকত না। বাপের বাড়ি গেলে আর আসতে চাইতেন না।

মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে তেমন মন নেই তার একটাই কারণ, মেয়ে ভয় পায়। এমন অজপাড়াগাঁয়ে থাকা তার পক্ষে দুরূহ। মামা আনতে গেলে, এবার থাক না, আর ক’টা দিন যাক তারপরে যাবে বলে মামিমার বাবা মামাকে দু’একবার ঘুরিয়েও দেন। দাদুর রাগ হয়। কড়া ভাষায় বেয়াইকে পত্র দেন।

– যদি আপনার মেয়েকে না পাঠান তাহলে আবার ছেলের বিয়ে দেবার কথা ভাবব।

পত্র পেয়েই মামিমার বাবা তখন নিজে এসে দাদুকে অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে অনুরোধ করেন– আপনি যদি মাসে একবার অন্তত মেয়েকে দিন দুয়ের জন্যও বাপের বাড়ি যাবার অনুমতি দেন তাহলে আমাদের পাঠাতে কোনও বাধা নেই। আসলে শহরে মানুষ তো, তাই একটু অসুবিধে হচ্ছে। বিশেষ করে সন্ধ্যার দিকে ভয় পায়। পরে পরে অবশ্য সব ঠিক হয়ে যাবে।

– ঠিক আছে। আমি বউমার কাছে দিন-রাতের জন্য একজন কাজের মেয়ে রাখার ব্যবস্থা করে দেব। আপনারা মেয়ে পাঠিয়ে দিন। নচেৎ ছেলের বিয়ে দিতে বাধ্য হব।

কতকটা মনমরা হয়েই মামিমা আসেন শ্বশুরবাড়িতে। দাদু কিন্তু তার কথার খেলাপ করেননি। একজন দাসীর বন্দোবস্ত করে দিয়েছিলেন। তবে সেই মেয়ের সঙ্গে কি গল্পই বা করবে মামিমা? গ্রামের মানুষের গল্প বলতে তো চোর-ডাকাত, নয়তো ভূত-পেত্নি। এতে মামিমার ভয় আরও বেড়ে যেতে থাকে।

সেবার দু’দুটি ঘটনা মামিমার শ্বশুরবাড়িতে থাকার বাধা হয়ে দাঁড়ায়। বলতে দ্বিধা নেই, মামিমার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়।

দিদিমা, মামিমাকে খুব ভালোবাসতেন। তবে বেশিক্ষণ সময় দিতে পারতেন না। মাঝে মাঝে সন্ধ্যার পর মামিমাকে নিয়ে ছাদে উঠে হাঁটতেন। কখনও কখনও মাদুর পেতে বসে গল্প করতেন। পাশের বাড়ির রাঙা দিদিমাও এই আসরে কোনও কোনওদিন যোগ দিত। এতে মামিমারও খুব ভালো লাগত।

এরকম একদিন মামার আসতে দেরি দেখে দিদিমা মামিমাকে নিয়ে ছাদ থেকে মামা আসছেন কিনা দেখছিলেন। কিন্তু নীচের থেকে কারও ডাকে দিদিমা নেমে গেলে মামিমা দূরে বয়ে যাওয়া নদীর দিকে উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন। কারণ ওই পথেই তো মামা বাড়ি ফিরবেন।

নদীর ওই পাড়ে দিগন্তবিস্তৃত ধানখেত। আর এপারে মামাদের বিশাল আম বাগান। মামিমা জীবনে এত বড়ো আম বাগান দেখেননি। যখন আম ঝরানো হতো তখন ঝাঁকা ঝাঁকা আম আসত মামাদের বাড়িতে।

নদীর থেকে হঠাৎ সোনা মামিমার দৃষ্টি পড়ে আম বাগানে। পাশে দাঁড়িয়ে কাজের মেয়ে নন্দা। শুক্লপক্ষ চলছিল। তাই ছাদ থেকেও বাগানটিকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। সেই আলোতে মামিমা হঠাৎ দেখতে পান, একটি মেয়ে সাদা কাপড়ে সারা গা ঢেকে বাগানের ভিতরের দিকে দৌড়োচ্ছে। ওই দৃশ্য নন্দাকে দেখালে সে ভূত ভূত বলে চিৎকার করে মূর্ছা যায়। মামিমাও চোখ ঢেকে বসে পড়েন। কিন্তু দিদিমা এসে কোনও কিছুই দেখতে পাননি।

ঠিক এর দিন দুই পরে আরও একটি ঘটনা ঘটে মামিমার চোখের সামনে। এক বিরাট ডাকাতি হয় মামাদের পাশের বাড়িতে। দলটি নাকি চল্লিশ জনের। হাতে মশাল নিয়ে রণপা চেপে এসেছিল। প্রায় দু’ঘন্টা ধরে ডাকাতি করে সেই সাথে গৃহস্থকে মারধোর দিয়ে সর্বস্বান্ত করে দলটি চলে যায়।

এসব দেখে মামিমা কান্নাকাটি শুরু করেন। ফলে কয়েক দিনের জন্য মামিমাকে বাপের বাড়িতে রেখে আসতে হয়। তারপর থেকে মামিমা আর মধুবনে আসেননি। বাপের বাড়ির লোকেরাও আর পাঠাতে চায়নি। বিশেষ করে মামিমার বাবা তো মেয়ের নামে বেশ কিছু টাকা ও বসতবাড়ি সংলগ্ন একটি বাড়িও কিনে দিয়েছিলেন। তাই মামা আনতে গেলে উনি বলেন– মেয়ে যখন ওখানে থাকতেই পারবে না তখন আর জোর করে ওখানে পাঠাই কি করে বাবা? এখানেই থাক। নইলে কবে দেখব মেয়েটা ভয়ে মারাই গেছে।

সব জানার পর দাদু প্রায় জেদ নিয়ে সেই মাসেই মামার বিয়ে দেন। এ বিয়েতে নাকি মামার মত ছিল না। কিন্তু বাপের মুখের ওপর কথা বলার সাহস তখনকার ছেলেদের ছিল না। তাই বিয়েটিও হয়ে যায়। এরপর থেকে মামাবাড়ির সাথে যোগাযোগ উঠে যায় সোনা মামিমার। তবে দিদিমা যতদিন বেঁচে ছিলেন ততদিন নাকি সোনা বউয়ের জন্য কাঁদতেন। সে বউ এখনকার বউয়ের চেয়ে রূপেগুণে সব দিকেই সেরা ছিল তাঁর কাছে। মামাও বোধ হয় মামিমাকে একেবারে ভুলতে পারেননি।

নতুন মামিমার তিন ছেলের পর, একমাত্র মেয়ে পুষ্পদি। বড়ো ছেলে যে-বছর এম.এ. পড়ার জন্য কলকাতার কলেজে ভর্তি হয় সেবছরই মামা মারা যান। এরপর ওই ছেলেই সোনা মামিমার সাথে যোগাযোগ করে মামিমাকে জোর করে মাঝে মধ্যে বাড়িতে নিয়েও আসে। এখন বয়সের জন্যই হোক আর নিঃসন্তান বলেই হোক ছেলেদের কাছে থেকেও যেতেন কিছুদিন করে। সৎ ছেলেমেয়েদের ভালোবাসতেন খুব। ছেলেমেয়েরাও সোনামা বলতে অজ্ঞান। মা তো কাজ-যোগের বাড়ি হলে মামিমাকে আমাদের বাড়ি আনতে পাঠাতেন। উনি নিজেও বছরে একবার অন্তত আসতেন।

আমরা ছোটোরা যখন মামিমাকে দেখলাম তখন তিনি বিগত যৌবনা একজন বিধবা। তবে দুধে আলতা গায়ের রং তখনও মামিমাকে অন্যের থেকে আলাদা করে রেখেছে। পিঠ ভর্তি কালো চুল। মুখে একটা কমনীয় মাধুর্য।

শ্বশুরবাড়ি মামিমার এখন ভালো লাগে। তাছাড়া মধুবনের এখন অনেক উন্নতি হয়েছে।  গ্রামের পাশ দিয়ে পাকা রাস্তা। দিনে তিন চারটি বাস যাতায়াত করে। ঘরে ঘরে বিজলি বাতি। ল্যান্ড ফোনও এসেছে চার-পাঁচটি ঘরে।

মামার বড়ো ছেলের বিয়ে। কিছুদিন আগে একমাত্র মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে ধুমধাম করে, বড়ো ঘরে। সেবারও মামিমা এসেছিলেন। বেশ কয়েকভরি গয়না দিয়ে মেয়েকে আশীর্বাদ করেছিলেন। এবার এসেছেন মামার ছোটো ছেলের সাথে। বিয়েটা বেশ জাঁকজমক করেই হচ্ছে। আত্মীয় কুটুম্ব এসেছে প্রচুর। কেউ বাদ যায়নি। মায়ের বয়স হলেও মাকে নিয়ে আমরা গিয়েছি।

বিয়ের দিন বরযাত্রী সহ দাদা যখন যাত্রা করল রাত তখন প্রায় আটটা। বরযাত্রীরা বাসে আর দাদা ট্যাক্সিতে। পুষ্পদি-সহ আমরা মেয়েরা যাওয়ার জন্য বায়না ধরলেও, বড়োরা তা বাতিল করে দেয়। কারণ মেয়ের বাড়ি যাওয়ার পথে ভীষণ জয়পুরের জঙ্গল। অতএব রিস্ক নেওয়া উচিত নয়। বিফল মনোরথ হয়ে আমরা রয়ে গেলাম।

খাওয়াদাওয়ার পর রাতে পুষ্পদি সহ আমরা কয়েকজন সোনা মামিমার সাথে বৈঠকখানায় শুয়েছি। বাড়িতে পুরুষ বলতে কয়েকজন বুড়ো। মা-মামিরা সব ওপর ঘরে শুয়েছে। পুরুষের চেয়ে মেয়েরা সংখ্যায় বেশি। সারাদিন খাটাখাটনির জন্য অনেকেই ঘুমিয়ে পড়েছে। আমরা দু’চারজন তখনও জেগে। মামিমার মুখে গল্প শুনছি। আসলে মামিমা খুব জমিয়ে গল্প বলতে পারতেন। রাত বাড়ার সাথে সাথে গল্পও বেশ জমে উঠেছে। গল্প শোনার মাঝেই আমার একটু তন্দ্রা মতো এসেছিল, সেই সময়ই কানে এল ত্রাহি ত্রাহি চিৎকার।

– বাবা গো, মেরে ফেললে গো। কে আছো বাঁচাও।

জেগে উঠে বিছানায় বসলাম। বুঝতে অসুবিধা হল না যে আমাদের বাড়িতেই ডাকাত পড়েছে। ভয়ে কাঁপতে থাকি। কি হবে এবার? দেখি পুষ্পদি ভয়ে সোনা মামিমার কোলে মাথা গুঁজে বসে। বিয়ে বাড়ি বলে কথা। মেয়েদের সবারই গায়ে কিছু না কিছু গয়নাগাটি রয়েছে। বিশেষ করে পুষ্পদির গায়ে। ওর তো আবার নতুন বিয়ে হয়েছে। মামিমা মুহূর্তের মধ্যে সকলের গয়নাপত্তর খুলিয়ে নিয়ে কাপড়ে জড়িয়ে বৈঠকখানার দরজা একটু ফাঁক করে চারদিকে দেখেই ছুটে বেরিয়ে গেলেন। পুষ্পদি সাথে সাথে মামিমার নির্দেশমতো দরজা বন্ধ করে দিল। আসলে বৈঠকখানাটা ছিল বাড়ির একেবারে বাইরের দিকে। তাই হয়তো এই দুঃসাহসিক কাজটা করতে পারলেন মামিমা।

আমাদের তারস্বরে চিৎকার চ্যাঁচামেচির ফলে ডাকাত দলটি আর বৈঠকখানার দিকে এল না। তার উপর সারা পাড়া জেগে উঠেছে। ধরা পড়ার ভয়ে দলটি চম্পট দিল। কিন্তু যাবার সময় আশা মতো গয়নাগাটি আর টাকাকড়ি না পেয়ে অনেক আসবাবপত্র ভাঙচুর করে গেল। তবু নগদ টাকা, গয়নাপত্তর খুব কমও তো পায়নি। কেবল সোনা মামিমার সাহসিকতা আর বুদ্ধিমত্তার জন্য আমাদের, বিশেষ করে পুষ্পদির গায়ের বহুমূল্য অলংকারগুলি রক্ষা পেল।

পরের দিন সকালে সব ঘটনা জানাজানি হলে শুধু মামাবাড়িতে নয়, গোটা পাড়ায় আলোড়ন পড়ে গেল। ওই অন্ধকার রাতে পুকুর পাড়ে বাঁশবনের ঝোপে সোনা মামিমা একাকী রাত কাটালেন কী করে? ভাবতে আমারও দেহে শিহরণ জাগে। অথচ ওই বাঁশবনের পুকুরের ভয়ে মামিমা একদিন সংসার ছেড়ে ছিলেন। কেমন যেন রহস্যময়। তাইতো অনেকে প্রশংসা করলেও নিন্দুকেরা কটূক্তি করতে ছাড়ল না।

– এই সাহসের সিকিভাগ যদি দেখাত সেদিন, তাহলে তো আর এ বাড়ি ছাড়তে হতো না। মেয়ে কিনা ভয় পায়। নাকি বাপির বাড়িতে অন্য কিছু ছিল?

নিন্দুকেরা যাই বলুক, সেদিন আর এদিন যে অনেক তফাত, অনেকটা সময়, তা তারা বোঝে না।

তবে মামিমা এই নিন্দা বা প্রশংসার কোনওটিতেই কর্ণপাত করেননি। তিনি যা করেছেন ওই মুহূর্তে তাঁর যা মনে হয়েছে। ভালো মন্দ বিবেচনার সময় কোথায়?

– এ সব কথা তোমরা আর আমায় জিজ্ঞাসা কোরো না। ভগবানই আমাকে বুদ্ধি ও সাহস জুগিয়েছেন। নইলে কি পারতাম। সবই তাঁর ইচ্ছা।

এরপর আর কেউ কোনও কথা বলার সাহস পায়নি।

অষ্টমঙ্গলা শেষ। আমরা বাড়ি ফেরার জন্য তৈরি হচ্ছি। মামিমাও পরের দিন কলকাতায় বাপের বাড়ি ফিরে যাবেন। কিন্তু দুই মামিমা, পুষ্পদি আর নতুন বউদি সেদিনটা থেকে যাবার জন্য এমন ভাবে অনুরোধ করতে থাকলেন যে, মা সিদ্ধান্ত বদলাতে বাধ্য হলেন। বিশেষ করে আবার কবে একসাথে দেখা হবে কে জানে? আমারও ভালো লাগল এই সিদ্ধান্ত।

সন্ধ্যাবেলা আমরা ছোটদার ঘরে নতুন বউদির গান শুনছি। মা আর দু’মামিমা ছাদে গল্প করছেন। হঠাৎ কাকতালীয় ভাবে সোনা মামিমার চোখে পড়ে পঁয়ত্রিশ বছর আগেকার সেই একই রকম ঘটনা। শাড়ি পরা একটি মেয়ে আম বাগানের ভিতর দিয়ে একাকী দৌড়োচ্ছে। তবে এর শাড়িটা রঙিন। এটা দেখেই তিনি, মা ও ছোটো মামিমাকে দেখালেন। এবার আর সোনা মামিমা ভয় পেলেন না। বরং বিয়েবাড়ির অন্যান্যদের জানালেন। তখনও বাড়িতে লোক কম ছিল না। ঘটনা শুনে সবাই ছুটল বাগানের দিকে। পাড়ার লোকেরাও ওদের সঙ্গ নিল।

প্রায় আধ ঘন্টা পরে সকলে ফিরল, সঙ্গে নিয়ে একটি রঙিন শাড়ি পরা অল্পবয়সি মেয়েকে। মেয়েটি পাড়ারই সম্ভ্রান্ত বোসবাবুর ছোটো মেয়ে। সে তার প্রেমিকের সাথে ঘর বাঁধার উদ্দেশ্যে এই রাত্রিতে একাকী বেরিয়েছিল বাড়ি ছেড়ে। ভালোবাসে তাকে সে। অথচ বাবা-মায়ের ইচ্ছে তার বিপরীত। তাই তার এই সিদ্ধান্ত।

এরপর যা হয় তাই। মেয়েটিকে সকলে মিলে বুঝিয়ে সুঝিয়ে বাবা-মায়ের কাছে রেখে আসে। ঘটনাটা যাই হোক, সোনা মামিমার ভাবনা কিন্তু দানা বাঁধল পঁয়ত্রিশ বছর আগের ঘটনায়। সেই মেয়েটিও নিশ্চয় ভূত বা পেত্নি ছিল না। হয়তো এরকমই একটি সাধারণ মেয়ে। নিজের ভালোবাসার জনকে পেতে রাতের বেলা বেরিয়েছিল অভিসারে। আর সেটিকে অন্যভাবে ভেবেই তার জীবন আজ রিক্ত, শূন্য। ভাবতে ভাবতেই তার চোখে জল এসে যায়।

এই ঘটনার পর সোনা মামিকে আর শত অনুরোধেও এখানে রাখা যায়নি। অনুতাপে দগ্ধ মামিমার হয়তো মনে হয়েছিল একটি ভুল সিদ্ধান্ত কীভাবে তার জীবনের সব কিছু কেড়ে নিয়েছে। ওই ভুলের জন্যই তার এত ভালো স্বামীর ঘর করা হয়নি। সব কিছু পেয়েও সে আজ নিঃস্ব। এই ভাবনার মাঝেই বাঁধভাঙা কান্নায় ভেঙে পড়েন সোনা মামিমা।

রজনি বৃত্তান্ত

কথা হচ্ছিল ঘুঘুডাঙার দিঘির পাড়ে প্রাচীন বটগাছের সিমেন্ট বাঁধানো চত্বরে বসে গুটি পাঁচেক মাতব্বরের মধ্যে। ঘুঘুডাঙা গাঁয়ে সনাতন হাজরা হ’ল গিয়ে লায়েক। গলা খাঁকারি দিয়ে সে-ই কথাটা পেড়েছিল। ওহে মেয়েমানুষ তো লয় চামার। দজ্জাল মেয়েছেলে। ধম্মকম্ম বলে কিস্যু নাই। গলা তুলে গাল পাড়া মন্দ কথা বলা, এর বাইরে…। বাকি কথাটা লুফে নিল ভজন সামন্ত, কিস্যু নাই কিস্যু নাই। দিনকাল বদল হইচে গো, নইলে এমন মেয়েছেলেকে গাঁয়ে রাখাও কাজের কথা নয়। অমনি বাকি তিনজন তালে তাল মেলাল। হরিহর সামন্ত, শুধু এক কদম এগিয়ে বলল, বাপটা আর সোয়ামিটা কী অমনি অমনি ধেনো খেয়ে নেশায় বুঁদ হয়ে থাকে। সনাতন ঘুরে বলল, ওই ঘরজামাইটার কথা বলতিছ? ও তো ক্লীব, শ্বশুরের সম্পত্তির লোভে বউ-এর লাথিঝ্যাঁটা খায়। আর ওকে তাল দেয় বিষ্ণু হাজরা মানে শ্বশুরটা। হরিহর অমনি গলা তুলে বলল, সে গুড়ে বালি। ওই খান্ডারনি বউয়ের হাত থেকে সম্পত্তি গ’লে ওর হাতে যেতে যেতে মাধব মানে মেধো এমনিই অক্বা পেয়ে যাবে।

শীতের দুপুরে রোদ্দুর যেন পালাব পালাব করে। দিঘির ও’পারে তালবনে সুয্যি ঠাকুর জাল গুটোচ্ছে। সেদিক পানে চেয়ে থাকতে থাকতে সনাতন বলল, চল হে একটু পরেই হিম পড়বে। এই বুড়োবেলায় সব সইতে পারি হিম সইতে পারব না।

যাকে নিয়ে এত কথা সেই রজনি তখন সাঁঝের আকাশের দিকে চেয়ে গাল পাড়ছে, একবার ঘর এসো, মুখে নুড়ো জ্বেলে দেব। হাটে যাবার নাম করে সেই সকালে দুটিতে বেইরেছে, এতখানি বেলা পার হয়ে সুয্যি পাটে বসল, ফেরার নাম নেই। হেঁসেলের উনুনে দুটোকেই পুড়িয়ে মারব। গঙ্গাজলে ভাইস্যে দেব ওই বুড়োটাকে আর পোড়ামুখো জামাইটাকে। খিড়কির চৌকাঠে একটা ছায়া চুপিসারে ঢুকতে গিয়ে কেমন থমকে দাঁড়াল। রজনি আকাশমুখো, ভাগ্যিস। কে জানি রজনিকে বলেছিল, আকাশমুখো সব কথা বহু দূর তক্ শোনা যায়। ছায়া আরও এক পা রাখতেই খড়ের গাদার ওপর রাখা কাটারিটা টিউবওয়েলের বাঁধানো শানে পড়ে ঠনঝন শব্দ করে উঠল। সেদিক পানে চেয়ে রজনি তিরিক্ষি চেঁচিয়ে বলে উঠল, এসো ওই কাটারিতে তোমাদের টুকরো টুকরো করব।

ছায়া এবার ফুটফুটে চাঁদের আলোয় দাঁড়াল। বিষ্ণু হাজরা। একটু টাল খেয়েছিল। ধেনোটা বুকের ভেতর থেকে তখনও পেট অবধি নামেনি। এইসময় মেয়েটা এমন তেড়ে উঠল যে চমকে আবার পিছু হঠতে গিয়ে প্রায় কাটারিতে পা দিয়ে ফেলেছিল। সামলাতে গিয়ে টিউবওয়েল-এর হাতলটা ধরে ফেলল। রজনি খানিক থমকে গিয়ে আবার সুর তুলল, বলি ল্যাজটা কোথায়?

বিষ্ণু হাজরা অমনি যেন খানিক ফুরসত পেয়ে একরকম নীচু গলায় বলল, মেধো সেই কোন দুপুরে আমার সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়ে কোথায় যে গেল, বলল তো হাটে যাচ্ছি…।

কোথায় গড়াগড়ি দিচ্ছে? তুলে আনতে পাল্লে না? এবার তুমি এসো, তোমায় দেখি খানিক। মেয়ের রণচণ্ডী মূর্তি দেখে নেশা ছুটে গেছে বিষ্ণু হাজরার। মনে খানিকটা বল সঞ্চয় করে বলল, একটু ঠান্ডা হ মা। হাট তো এখনও পুরোপুরি শেষ হয়নি। ঠিক ফিরে আসবে। তুই বরং উনুনে আঁচ দে। বিষ্ণু হাজরা মনে মনে আওড়াল, আঁচ দেবে কী, মেয়েটা তো নিজেই আঁচ হয়ে আছে।

তারপরেই মনে হ’ল, তাই তো ছোঁড়়াটা গেল কোথা! সে কী সত্যি-ই হাটে গেছে! ধেনোর ঠেকেও তো যায়নি। তাহ’লে!

মেধো তখন অনেক দূরে। আশমান গাঁ আর চাঁপাডাঙা ছাড়িয়ে ফুলটুসি গাঁয়ের মখমল বাজারের থেকে পোয়া মাইল দূরে এক সাধু আসন গেড়েছে। তাতেই লোক হামলে পড়েছে। সাধুর নাকি মোক্ষম দিব্যদৃষ্টি। অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ– সব গড়গড়িয়ে বলতে পারে। এত ভিড়ের মধ্যে সাধুর নাগাল পাওয়া কঠিন। বেশ খানিক পিছনে দুটো থান ইটের ওপর দাঁড়িয়ে মেধো ঠাওর করতে চাইছে। এই সাধুর খবর সে পেয়েছিল তার ছেলেবেলার বন্ধু পঙ্কার কাছ থেকে। পঙ্কা বলেছিল, একবার গেলেই টের পাবি। স্বয়ং বিশ্বনাথের চ্যালা।

তোর যা দুঃখ, যা গিয়ে বল। কিছু একটা তো হবেই। ধেনো খেয়ে তো আর সাধুর কাছে আসা যায় না, তাই ধেনোর ঠেকে যাবার আগেই বাবা শ্বশুরকে বলেছে, হাটে যাচ্ছে। তবে ভেবেছিল সাধুর সঙ্গে দেখা করে বাজার থেকে আনাজপত্র কিনে ফিরবে। কিন্তু এত ভিড় ভাবনার বাইরে ছিল। ইতিউতি দাঁড়িয়ে কোনওভাবেই যেন তার দর্শন মেলে না। তেমন একটা গাছও নেই যার ওপর চড়ে সাধুর দর্শন পাওয়া যায়। অনেকে দূর দূর থেকে এসেছে। কারও মানত ফলেনি, কারও ব্যাবসা মন্দগতিক– হাজারও সমস্যা। পঙ্কা বলেছিল, সব তুড়ি মেরে সমাধান করে দেবে সাধুবাবা। অগত্যা বেশ খানিক দূরে মোটা গুঁড়ির একটা তেঁতুল গাছের আড়ালে বসে থাকে ঠায়। তাছাড়া সব কথা তো সবার মাঝে বলাও যায় না। কথাগুলো পেরাইভেট কিনা।

সন্ধের পর একটু একটু করে ফাঁকা হচ্ছে। ইয়াব্বড়ো একটা চাঁদ ফুলকো লুচির মতো আকাশে ফুটে উঠল। শাল্লা মশার ভনভন, পোকামাকড়, সাপও থাকতে পারে। তারমধ্যেই একটু ঘুম ঘুম পাচ্ছে। চোখদুটো রাবারের মতো চিপসে যাচ্ছে। তন্দ্রা তন্দ্রা ভাবটা একটু কাটতেই হঠাৎ কেউ কোথাও নেই। সাধু একলা বসে। বুক পর্যন্ত সাদা কাশফুলের মতো দাড়ি, কাঁধ থেকে বুক পিঠ পর্যন্ত নেমে এসেছে সাদা জটা। সাধু মহারাজ একটা কল্কেতে সুখটান দিতে দিতে চোখ বুজে আছে। ধুনির আলো আর চাঁদের আলোতে সাধুর পদ্মাসন থেকে পা দুটো খুলে ছড়িয়ে বসে থাকার কায়দাটা খুব চেনা ঠেকল। আরে ভুতোদা না! এই বসার ধরনটা এই গাঁ ছাড়িয়ে আরও দশ গাঁয়ের পর মেধোর জন্মভিটে হরিশপুরে কে না চেনে! আর ওই দাড়ি গোঁফের আড়ালে মুখটাও তো…! এইরকম আয়েশ করে বসতে আর কাউকেই জানে না মেধো। শুধু সে নয়, গাঁয়ের সব্বাই…।

হামাগুড়ি দিয়ে খানিকটা এগোতেই জলের মতো পরিষ্কার হয়ে গেল। ভুতোদা-ই তো। ভুতোদা বলে ফসকা গলায় প্রায় চেঁচিয়ে উঠেছিল। কোনওরকমে নিজেকে সামলে নিল। শুধু শুধু বেমক্বা সব কেঁচিয়ে দিলে হয় না। এখনও বাজারের লোক হয়তো সব ঘরমুখো হয়নি। কিন্তু ফসকে যাওয়া ওইটুকুতেই ভুতোদা এদিক-ওদিক চাইতে চাইতে চাপা গলায় বলল, কে কে বটে?

বুনো গাছগাছালির ওপর হামাগুড়ি দিতে গিয়ে হাঁটু দুটোর নুনছাল উঠে গিয়েছিল। জ্বালা করছে। তবু শেষবার চেষ্টার মতো করে শরীরটা একরকম ছুড়ে দিল মেধো।

আমি গো আমি। চিনতে পাচ্ছো ভুতোদা? আমি হলেম গে হরিশপুরের মাধব হুই। বাপের নাম কেষ্টচরণ হুই। মায়ের নাম…।

বলতে হবে না। তো এ তল্লাটে কি কচ্ছিস?

আমি হলেম গ্যে ঘুঘুডাঙা গাঁয়ে বিষ্ণু হাজরার ঘরজামাই গো।

ছ্যাঃ ঘরজামাই। পুরুষ মানুষের কলঙ্ক।

মেধো এবার গুছিয়ে বসে ঘনিষ্ট গলায় শুধাল, তুমি সাধু হলে কবে থেকে? বে থা করনি এ’কথা জানি। কিন্তু তাই বলে সাধু!

কল্কেতে টান দিয়ে খানিক ধোঁয়া উগরে দিয়ে ভুতো বলল, আমি হলেম ভূতানন্দ স্বামী। গৃহীর নাম সাধুর হয় না। তো বল তোর সমিস্যি কী।

সমিস্যি তো একটাই। বউটা বড়ো দজ্জাল। উঠতে বসতে গাল পাড়ে। আগে অমনটি ছেল না। ছেলেপুলে হ’লনি তো। তাতেই এমন তিরিক্ষি হয়ে গেল।

শুধু তোরেই গাল দেয়?

না গো ওর বাপটারেও দেয়। দোষের মধ্যি আমরা পুরুষ মানুষ তো বটে, একটু আধটু…।

কথা শেষ হবার আগেই ভুতো বলে, মেয়েছেলের দোষ আছে? মানে খারাপ বাড়িতে যাস নাকি? তা হ’লে তো…।

ছিঃ কী যে বলো। তুমি না সাধু। এই যেমন ধরো গিয়ে তুমি কল্কেতে টান দাও আর আমরা সারাদিন পরে একটু ধেনো খাই। সেটা কি খুউব দোষের?

দোষ? দোষ গুণের বিচার করার আমি কে রে। সবই ওই ওনার– বলে একটা হাত তুলে আকাশের দিকে তর্জনী তুলে দেখাল ভুতো। তোর ছেলেপুলে?

হয়নি। আর তার জন্যই তো এত গোল। হাকিম বদ্যিও কম হয়নি। তো ওই যে বললে না সবই তেনার ইচ্ছে। এবার গলাটা খাদে নামিয়ে বলল, দাও না।

কী? ছেলেপুলে?

না গো। ওতেও শান্তি হবে না। তোমার পায়ে ঠাঁই দাও। কথাটা বলে ভুতোর ছড়ানো পা দুটো ধরতে যাবে অমনি দ্রুত পা সরিয়ে নিয়ে ভুতো বলল, অত সোজা। সাধু হব বললেই সাধু হওয়া যায় নাকি? মেধো দ্বিতীয়বার শরীরটা ছুড়ে দিয়ে ভুতোর দুটো পা-ই ধরে ফেলল।

আঃ ছাড় ছাড়, সাধু হলে শ্বশুরের ভিটে জমি পুকুর এ’সব যে হাতছাড়া হয়ে যাবে রে।

হাতছাড়া হয়েই আছে ধরে রাখো। অমন দজ্জাল বউ না-মরা ইস্তক কিচ্ছুটি পাবার যো নেই। সংসারে ঘেন্না ধরে গেছে। তারপর আর একটু এগিয়ে ভুতোর পায়ের পাতা থেকে হাঁটু অবধি দলাই মলাই করতে করতে মেধো কেমন যেন আবেশ বিভোর গলায় বলল, তোমার সেবা করব। আমারে দীক্ষে দাও।

সেবা করবি? তা হ’লে কর। কল্কেটা একটু সাজিয়ে দে। বাবা বিশ্বেশ্বর কী বলেন দেখি। মেধো অমনি হাত বাড়িয়ে কল্কেটা নিল।

দু’টান মারতেই ভুতোর কেমন ফুরফুরে উদার হয়ে গেল মনটা। তোকে আমার চ্যালা করে দিলাম যাঃ। ক’দিন এ’ধার ও’ধার আমার সঙ্গে ঘুরে দেখ, তারপর না হয় দেখা যাবে। সংসারের এঁটেল মাটি গা থেকে আগে খসুক, দীক্ষা হবে।

মেধো গদগদ গলায় বলল, হবে বইলছ। তাইলে এট্টু পেসাদ…। ভুতো কল্কেটা বাড়িয়ে দিল। মেধো চোখ বুজে এক দমে খানিক টেনে বুকের মধ্যে ধরে রেখে তারপর ধোঁয়া ছাড়ল। ব্যাস হয়ে গেল, পাপ তাপ সব ছাড়িয়ে ভেতরটা কেমন যেন উদাস বাউল পারা। কোথায় পড়ে রইল রজনি, জমি জমা ভিটে– সব কেমন শূন্যে মিলিয়ে গেল। শুধু ধোঁয়ার কুন্ডলীর ভেতর যেটুকু দেখা যায়, ভূতানন্দ স্বামী।

দুই

রাতে ঘুম হয় না বিষ্ণু হাজরার। ঘোলাটে চোখ দুটো পেঁয়াজের পাতলা খোসার মতো যেন ভাসছে। ছেলেটা যে কর্পূরের মতো উবে গেল। আকাশপটে বাসি কদমফুলের মতো তখন শুকতারাটা ফুটেছে। আপন মনে বিড়বিড় করে বিষ্ণু হাজরা, তোমায় বইলছি তো সব তোমার নামে নেকাপড়া করি দিব, তা বুঝি বিশ্বাস হ’লনি। তোমার হলি তো মেয়েটারও হ’ল নাকি! তারপরেই মনে হ’ল বেবাক কোথাও নেশার ঘোরে পড়ে নেই তো! তবে নেশার ঠেকগুলো তো এ’কদিন ঘুরে দেখে নিয়েছে। তো সে কোথায়! তাহ’লে কী…! বুকটা ছ্যাঁৎ করে ওঠে।

পাশের ঘরে শুয়ে অমনি এ’পাশ ও’পাশ করে জেগে আছে রজনি। মানুষটা গেল কোথা! যা গাঁয়ের ছিরি ফুঁসলিয়ে নিয়ে গেল না তো! কথাটা মনে হতেই ধড়মড় করে উঠে কপাট খুলে দাঁড়ায়। আকাশে চাঁদ ফ্যাক ফ্যাক করে হাসছে। জ্যোৎস্না গলে গলে পড়ছে উঠোনের মাটিতে। রাগে জ্বলে ওঠে রজনি, রঙ্গ হচ্ছে! তামাশা! তারপরেই কেমন যেন ভেঙে পড়ল, কোথায় খুঁজবে মানুষটাকে। বাপটা কি ঘুমে নিঃসাড়, না তারই মতো…! ভেতরের কপাট আবজানই ছিল।

পড়ে পড়ে ঘুমুচ্ছ? ভাবো কি আমি তোমায় ছাড়ি দিব? মানুষটাকে কোথায় রাখি এয়েচ? দিনরাত মদ গিলেও শান্তি হয়নি? শেষে বেচি দিলে মানুষটারে! বিষ্ণু হাজরা হাতের মুদ্রায় জানান দেয়, সে জানে না। এমন কাণ্ড কোনও বাপে করতি পারে!

তারপরেও সব যেমন চলছিল তেমনি সব ঠিকঠাক। সকালের প্রথম রোদ্দুর উঠোনে চুঁয়ে পড়েছে। রজনি তখন কোমরে আঁচল গুঁজে অন্য মূর্তি। পারলে রাঙা রোদ্দুর ঝাঁটা দিয়ে উপড়ে ফেলে। বিষ্ণু হাজরা এক পা দু’পা করে খানিকটা এগোতেই রজনি রণং দেহী ভঙ্গিতে সামনে এসে দাঁড়াল, ভেবেছ কী? ওই আবাগির ব্যাটার সঙ্গে খালাস হই যাতি পাল্লে না। হাড় জুড়োত।

আঃ, আমি কী তার জানি! আমায় কি বলেকয়ে গেছে?

এমনি এমনি হাওয়ায় গায়েব হয়ে গেল? কেমন করে ভূত ছাড়াতি হয় তোমাদের আমার জানা আছে।

তারে খুঁজতি গেলেও তো যাতি হয়।

তো যাও। সঙের মতো দাঁইড়ে না থেকে খুঁজি আনো। মানুষটারে না নিয়ে ফিরলি তোমার একদিন কি আমার একদিন।

চিন্তায় বিষ্ণু হাজরার ভ্রূ কুঁচকে ওঠে, বাগদিপাড়া, দুলেপাড়া, মালাপাড়া কোনওটাতেই তো বাদ দেয়নি। তাহ’লে! মাথা নাড়তে নাড়তে বিষ্ণু হাজরা বেরিয়ে যেতেই ভজন সামন্তের ছোটো ছেলে পটলা হাঁফাতে হাঁফাতে হাজির। সববনাশ হই গ্যাছে। গাঁয়ের কে যেন দেখেছে, মানুষটা এক সাধুবাবার সঙ্গে বাঁকা নদী পার হয়ে কোথায় যেন…!

তা কেউ বারণ করলে না?

বারণ করবে কিগো। সাধুবাবা যে তখন বাণ মারিছে। সব বেবাক দাঁইড়্যে…!

রজনির মুখ থেকে কথা সরে না। কোথা গেল মানুষটা! কতদূর!

বিষ্ণু হাজরা ফিরল বেশ খানিক রাতে। সারাদিন খুঁজে বেরিয়েছে। একে তাকে জিগ্যেস করেছে। ফুলটুসি গাঁয়ের কয়েকজন অবশ্য সাধুর কথা বলেছে। কিন্তু তাতে কি হদিস মেলে! দু’একজন হেসে তামাশা করে বলেছে, তা তোমরা বাপ-বেটি মিলি মানুষটারে খেদানোর ভালো কল ঠাউরেছ তো! এখন হাপিত্যেস করার যাত্রা নাই বা করলে। বিষ্ণু হাজরা কোনও উত্তর দেয়নি। কী-ই বা উত্তর দেবে!

ঘরে ফিরতেই রজনির সামনাসামনি। পাল্লে না সাধুটারে পুঁতি রাখতি? ভণ্ড আমার সংসারটারে তুক করিছে, আর তুমি বেবাক ঘরে ফিরলে? যাও না কেনে বাঁকা নদী পার হই তারে খুঁজে আনতি।

বিষ্ণু হাজরা চুপচাপ দাওয়ায় মাদুর পেতে শুয়ে পড়ল। মেয়েটার জন্য কষ্ট হচ্ছে। এত শোক কি ও সইতে পারে! বাইরের কপাট ধরে তখনও রজনি দাঁড়িয়ে।

পরের দিন পুলিশ চৌকিতে হাজির বাপ-বেটি। সব শুনে বড়োবাবু হাসল, তো আমি কী করব। জামাই পালিয়েছে নিজের ইচ্ছেয়। নিজের ইচ্ছেয় সংসার ত্যাগ করেছে, তো আমি কী করব? এতক্ষণ চুপ করে শুনছিল, হঠাৎ জ্বলে উঠল রজনি, তাই তো পুলিশ তো হাবাগোবা, শুধু ঘুষ নিবে, সাধুকে জেলে পুরবে আর চোরকে ছেড়ে দিবে। বড়োবাবু হুঙ্কার দিয়ে বলল, খবরদার মুখ সামলে।

চোপ, বিষ নেই তো কুলোপানা চক্বর। ঝাঁটা মারি অমন আবাগির ব্যাটাকে।

হনহন করে বেরিয়ে এল রজনি, বাপটা পেছু পেছু একরকম ছুটতে ছুটতে পাঞ্চেত বিডিও আপিস ঘুরেও কোথাও কোনও হদিস পেল না।

ঘরে ফিরে রজনি কেমন যেন থিতিয়ে গেল। চুপ করে দাওয়ায় খুঁটি ধরে বসে রইল।

তিন

এতসব কাণ্ড যখন তখন হর-কী পাউরির ঘাটে বসে কল্ কল্ জল দেখছে মেধো। পাশে বসে গুরু ভূতানন্দ স্বামী। দীক্ষান্তে মেধো এখন তার চ্যালা।

কেমন লাগছে তোর?

ভালোই, তবে…।

কী তবে?

নিরামিষ এত ভাল্লাগে না।

এ তো দেবস্থান। এ’সব কথা বলাও পাপ। এরপর তো তোর গেরুয়া বসন হবে।

ও যখন হবে, হবে। তাই বলে…।

চুপ করে থাকে ভূতানন্দ। চোখ বুজে মনে মনে বলে, সংসারের গন্ধ গা থেকে খসতে তো সময় লাগবেই। মুখে বলল, তাঁর ভজনা কর। তিনিই পথ দেখাবেন।

শাল্লা ঠিক সেইসময়-ই দজ্জাল বউটার কথা মনে হ’ল। বউটার জন্য কেমন যেন দুঃখ হচ্ছে। কেন হচ্ছে এমনটা! এমনটা কি সবার হয়! সংসার কি এমনিই পেছন থেকে টানে! কথাগুলো শুধোতে গিয়েও শুধোল না। শুধোলে তো সেই ওপরের ওনাকেই দেখিয়ে দেবে ভুতোদা, থুরি ভূতানন্দ।

তারপর কংখল। মা আনন্দময়ীর আশ্রম। ভজন, গীত, স্তোত্র, খাওয়া বলতে মালসায় খিচুড়ি ভোগ। বাকি সময়টা মাধুকরী– ভিক্ষে চেয়ে পেট ভরা। শাল্লা পেট চটকে ঠাকুর ঠাকুর। নিকুচি করেছে ঠাকুরের। একবার মনে হয়েছিল ফিরে যায় গাঁয়ে। অমনি মনে হ’ল রজনির কথা। যা খান্ডারনি হাত-পা ভেঙে নুলো করে দেবে। শাল্লা জলে কুমির তো ডাঙায় বাঘ। মাঝেমধ্যে কোনও গাঁয়ে গিয়ে আসন পাতলেও তো হয়। কলাটা মুলোটা ফলটা কম তো হয় না।

চাঁদ দেখছিল ভূতানন্দ। মেধো শুধিয়েই ফেলল, কবে যাবে?

কোথায়?

এই কোনও গাঁয়ে।

বোশেখের আগে নয়। তার আগে এলাহাবাদ। মাঘী স্নান।

মাঘী স্নান!

সারা মাঘ মাস স্নান চলবে আর ঠাকুরের নাম সংকীর্তন সঙ্গে মাধুকরী।

এই হয়েছে এক গেরো। দুটো কথা সহ্য করে গাঁয়ে থাকলে ভালো হতো। ভূতানন্দ ওর দিকে ফিরে চাইল। তারপর গুনগুন করে গেয়ে উঠল, পাগলা মনটারে তুই বাঁধ…। ঝুলি থেকে একটা কল্কে বের করে বলল, নে সাজ তো।

দুটো টান দিতেই গুরু খুশ্ তো চ্যালা খুশ্।

চার

সময় যেন ডাকহরকরা। নিদানের চিঠি তার হাতে ধরা। কখনও বা সে গাঁয়ের চপলা শ্যামলাবরণ মেয়ে। ঘণ্টা বাজে দ্বিতীয় প্রহর থেকে তৃতীয় প্রহর।

শূন্য ঘরে রজনি একা। তার শরীরেও সময় কখন গুটিগুটি প্রবেশ করেছে। গত বিশ বছরের জোয়াল এখন তার কাঁধে। বিষ্ণু হাজরা দেহ রেখেছে তা-ও দশ বছর পার। আনমনা বসে থাকতে থাকতে শোনে কোথায় যেন কোনও বৈরাগী গান ধরেছে, এ জীবন নদীর পারা যতই ভাবো যায় না ধরা। হবে হয় তো। শূন্য ঝাঁপি শূন্যই থেকে যায়, কেউ তো এক আনিও দিল না।

রাত্রে মোহন এল। মোহন রজনির জ্যাঠতুতো ভাইয়ের ছেলে। বলল, পিসি হয় না।

কী হয় না?

খড়ের গাদায় সূচ খোঁজা যায়? যায় না। সব ধম্মস্থানই তো খুঁজলে, পেলে?

রজনি মোহনের দিকে এক ঝলক দেখে নিয়ে বলল, হয় কী না হয় সে আমি বুঝব। তোকে যেতে হবে না।

আমি কি তা-ই বলেছি?

গেলে যাবি না গেলে যাবি না। কারও জন্য কিছু…। এই যে একটা গোটা মানুষ হারিয়ে গেল তার জন্য…! রজনি থেমে গেল।

তারপর শুধু চলা আর চলা। কখনও হূষিকেশ কখনও এলাহাবাদ আবার কখনও মথুরা। কোথাও নেই। রুদ্রপ্রয়াগ। মন্দিরে গান হচ্ছে, হ্যায় জীবন কি নৈয়া তুমহারে হাওয়ালে, জিধার চাহো হম কো উধর লে চলো তুম। গানের সুর, নদীর আবিরগোলা জল– সব একাকার।

মোহন পিছন থেকে ডাকল, পিসি। রজনি সাড়া দিল না। ও তখন অনেক দূরে। মানুষ হারিয়ে যাবার সুলুক সন্ধান যেন এখন ও জানে। মোহন বলল, যাবে পিসি?

কোথায়?

সাধুভান্ডারা। ভক্তের ভোগ দান সাধু বিলিয়ে দেবে সবার মধ্যে। যাবে? রজনি অস্ফুটে বলল, যাব।

সার বেধে ভক্তের দল। ডিমের কুসুমের মতো সূর্য তখন পুব আকাশে। পিসি-ভাইপো সেই সারে দাঁড়িয়ে। একজন একজন করে এগিয়ে যাচ্ছে। ধীর পায়ে রজনি এগিয়ে এসেছে। এক ব্রহ্মচারী। শ্বেত শুভ্র বসনের সঙ্গে পক্ব কেশ শুভ্র শ্মশ্রুমণ্ডিত মুখমন্ডলী একাকার। চোখদুটো যেন দূর পারের কান্ডারি। তন্ময় হয়ে দেখছে রজনি। চেনা মুখটা কত যেন অচেনা। মনে মনেই বলল, কে তুমি?

একেবারে সামনে এসে দাঁড়াল রজনি। করজোড়ে আঁচলের কাপড় গলায় জড়িয়ে প্রণতভঙ্গিতে রজনি মাথা নীচু করল। ব্রহ্মচারী কেঁপে উঠল। অস্থির এক ভাব। হাত তুলতে গিয়েও যেন থমকে গেল।

দেব দর্শন। রজনি মনে মনেই বলল, তোমায় মুক্তি দিলাম ঠাকুর। মোহন কিছুই টের পায়নি।

বিহান তখনও ফুটেছে কী ফোটেনি। ব্রহ্মচারী এসে দাঁড়িয়েছেন মন্দির লাগোয়া ধরমশালার দোরগোড়ায়। কেয়ারটেকার বাবুটি আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে সব শুনে বলল, উ লোগ তো চলা গিয়া।

অস্পষ্ট অন্ধকারে ব্রহ্মচারী দাঁড়ালেন নদীর সঙ্গমস্থলে। পুব পাড়ে তখন সূর্য ওঠার প্রস্ততিপর্ব। দু’হাত বুকের ওপর প্রণামের ভঙ্গিতে রেখে তিনি মন্ত্র উচ্চারণের মতো বললেন, এবার গেরুয়া বসনের অধিকার দাও হে প্রভু।

অন্তরালে স্বামী ভূতানন্দ হয়তো হাসলেন।

পড়ার জন্য সীমাহীন গল্প-নিবন্ধসাবস্ক্রাইব