ঊর্মিলা হন্তদন্ত হয়ে ক্যাব-এ উঠে পড়ল। তার কপালে, চিবুকে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। হাজারও বিরক্তি মুখে মেখে প্রাণেলও উঠে পড়ল একই গাড়িতে। মে মাসের সূর্যের প্রখর তেজে চারিদিক ঝলসে যাচ্ছে। প্রাণেল সিটে বসেই রুক্ষ্ম ঝলসানো গলায় ঊর্মিলাকে বলল, কি যে করো সারাদিন! ছেলেটার দিকে নজর দিতে পারো না। ও দিন দিন উচ্ছৃঙ্খল হয়ে যাচ্ছে। ভালো স্কুলে প্রচুর টাকা দিয়ে অ্যাডমিশন করা নয়, ছেলে গোল্লায় গেলে গার্জিয়ান মিটিং-এ অপমান হজম করা।

ঊর্মিলা নিরুত্তাপ দৃষ্টিতে জানালার বাইরে তাকিয়ে ছিল। প্রাণেলের কথার প্রত্যুত্তর দেবার প্রয়োজন সে বোধ করল না। ঊর্মিলার কাছ থেকে কোনও প্রত্যুত্তর না পেয়ে প্রাণেল গলার স্বর চড়িয়ে বলল, কী হল! কথা বলছ না কেন! নিজের ত্রুটিগুলো চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছি বলে ঠিক মানতে পারছ না।

ঊর্মিলা আর চুপ করে থাকতে পারল না। প্রাণেলের চোখে চোখ রেখে বেশ ভারী গলায় সে বলল, আমি সারাদিন বাড়িতে বসে থাকি বুঝি চাকরি ফেলে! আমার না হয় মা হিসাবে অনেক ত্রুটি আছে, একথা আমি মেনেই নিলাম। তুমি বাবা হয়ে কোন কর্তব্যটি পালন করো শুনি? একটা কম্পিউটার সেন্টারে পাঁচ ঘন্টার পার্ট টাইম জব করে বাড়িতে বসে আয় করো। যে-টাকা ইনকাম করো তাতে ডাল-ভাতের খরচা হয় না। আজ আমি প্রাইভেট ব্যাংক-এ জব করছি বলে সংসারের চাকা গড়গড়িয়ে চলছে।

প্রাণেল বলল, ও তুমিই যেন পৃথিবীতে একা মহিলা যে ইনকাম করে সংসার চালাচ্ছ! এখন সব মহিলাই রোজগার করে স্বামীদের হেল্প করার জন্য, তাতে হয়েছে কি!

ঊর্মিলা বলল, বাহ্ চমৎকার! দুহাতে রোজগার করে সংসারের জন্য উপার্জন করব আবার কথাও শুনব! প্রাণেল বলল, কথা শুধু শুনছ কি! সে হতাশ গলায় বলল, আমি সংসারের জন্য খুব বেশি টাকা আনতে পারি না বলে, প্রায় রোজই খোঁটা শুনতে হয়। ক্যাব এসে পড়ল তাদের নির্দিষ্ট গন্তব্যে। ঊর্মিলা আর প্রাণেল দুজনেই গাড়ি থেকে নেমে বাড়ির ভিতরে ঢুকল।

ঊর্মিলা বলল, প্রাণেল, তোমাকে যখন ভালোবেসে বিয়ে করেছিলাম, তখন সকলের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হয়েছিল। বিয়ের পর সতেরো বছর সংসারের জন্য ঘরে বাইরে লড়াই করছি। এতদিন পর তোমার সঙ্গে লড়াই করতে ভালো লাগে না। ভালোবাসার মানুষের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আমি আগেই হেরে বসে আছি। বড্ড ক্লান্ত লাগে আজকাল। আর আমি পারছি না।

প্রাণেল নিশ্চুপ থেকে একটু হালকা নিঃশ্বাস ছাড়ল। ঊর্মিলা বলল, সামনের বছর ছেলে মাধ্যমিক দেবে। তার যদি নিজে থেকে পড়াশোনার কোনও আগ্রহ না থাকে তাহলে আমার বা তোমার কী দোষ! সারাক্ষণ ওই কম্পিউটার অথবা মোবাইলে মুখ গুঁজে বসে থাকে ঋক। দ্যাখো ওই করে চোখটা খারাপ হবে। আর বাদবাকি অঙ্গে জং ধরে যাবে অল্প বয়সে। কত বলি একটু খেলাধুলা কর বাইরে বেরিয়ে কিন্তু কে কার কথা শোনে! কী যে মোহ লাগিয়ে দেয় আধুনিক যন্ত্রগুলো, কে জানে! যন্ত্রগুলো দিনরাত ছেলেমেয়েদের শৈশব-কৈশোরকে অযথা নির্দয় ভাবে নিষ্পেষণ করতে থাকে। ভাগ্যিস আমাদের সময়ে এসব ছিল না। এত মন-মগজ ঘুরিয়ে দেওয়ার জিনিস থাকলে পরীক্ষায় পাশটুকু হতো না। আজকাল বাচ্চারা এত অল্প বয়সে হাতের নাগালে সবকিছু পেয়ে যায় যে, তাদের ভালোমন্দ বোধটুকু তৈরি হওয়ার সময় পায় না।

প্রাণেল ঊর্মিলার কথা ভ্রূক্ষেপ না করে ঘরে জামা ছাড়তে ছাড়তে বিরক্তিভরে বলল, যা গরম পড়েছে আর পারা যাচ্ছে না। যতদিন যাচ্ছে গরম বাড়ছে। কথা বলতে বলতে ফ্রিজে রাখা ঠান্ডা জলের বোতল বার করে ঢকঢক করে খেল। স্বস্তির নিঃশ্বাস নিয়ে বলল, আহ! কী যে তেষ্টা পেয়েছিল!

ঊর্মিলা প্রাণেলের উপর স্বাভাবিক অধিকারবশত উগ্র গলায় বলল, রোদ থেকে ফিরে ওই বরফ ঠান্ডা জল খাওয়ার মজা বুঝবে। একে তো আরামপ্রিয় শরীর। দিনের পর দিন শরীর অতিরিক্ত আরাম পেয়ে সহ্য ক্ষমতা হারিয়ে ফেলছে। কথায় বলে না, যত্নের ধানে পোকা লাগে তোমারও হয়েছে তাই।

প্রাণেল হাওয়ায় ওড়া হাসি হেসে বলল, তোমার এই চোখ মুখ লাল করা শাসনটা আমার খুব ভালো লাগে, তাই শরীরের উপর নির্বিচারে নির্যাতন করি। তুমি কি এখন বেরোবে?

ঊর্মিলা বলল, আর ভালো লেগে কাজ নেই। ভালো লাগতে লাগতে ভালোলাগা একসময় তলানিতে দাঁড়াবে, তখন মন্দলাগার ভিড়ে ভালোলাগাকে আলাদা করতে পারবে না। ঋকের স্কুলে গার্জিয়ান মিটিংয়ে জন্য ছুটি নিয়েছি তো আজ। কথা শেষ করেই সে রান্না ঘরের কাজে ব্যস্ত হয়ে গেল।

প্রাণেল দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল চারটে বেজে গেছে। সময়গুলো কেমন ঝড়ের বেগে বয়ে গেল। পার হয়ে গেল ঊর্মিলার সঙ্গে তার দীর্ঘ সতেরো বছর। ঋকও হু হু করে বড়ো হয়ে গেল। ঊর্মিলার সঙ্গে সঙ্গে তার নিজের বয়সও বাড়ল। চব্বিশ বছরের সেই ঊর্মিলাই আজ বয়সের হাত ধরে চল্লিশের দোরগোড়ায় এসে উপনীত হয়েছে। প্রাণেলকে ভালোবেসে চব্বিশ বছরে বাবার ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসে ঊর্মিলা।

সবে সে তখন এমবিএ করে ব্যাংক-এ চাকরি পেয়েছে। তারপর দু-একটা ব্যাংক পরিবর্তন করেছে সে, জব লাইফে আত্মতুষ্টির জন্য। সে যাই হোক সংসারের বোঝার ভার প্রাণেলের চেয়ে তার ঘাড়েই পড়েছে বেশি। সেই চাপেই বোধ হয় চব্বিশ বছরের ছেলেমানুষি আবেগ সব বিদায় নিতে শুরু করেছে নীরবে। ঊর্মিলা তা নিজেও বুঝতে পারেনি হয়তো। ঘরে বাইরে একা হাতে সবটুকু সামলাতে গিয়ে নিজের দিকে তাকাবার সময় পর্যন্ত নেই।

ঊর্মিলার যখন বিয়ে হয় সত্যিই সে তখন সুন্দরী। সাদা কাগজের মতো গায়ে রং। মেদহীন ছিপছিপে চেহারা। মাঝারি উচ্চতা। দেবী প্রতিমার মতো একঢাল ঘন ঢেউখেলানো চুল পিঠ পর‌্যন্ত বিস্তৃত। মুখশ্রীটি পানপাতার মতো। ঝিনুকের খোলের মতো চোখে বাদামি তারা। সে রূপের ঝলকানি কমে এসেছে। গায়ের রং আর উচ্চতা ছাড়া সবকিছুরই পরিবর্তন হয়েছে।

মেদহীন চেহারা কিছু অপ্রয়োজনীয় চর্বি এসে দখল করেছে। মুখের মধ্যে হাজার ক্লান্তি দিনের শেষে জমা হয়েছে। বাদামি তারার চোখ দুটো উজ্জ্বলতা হারিয়ে নিস্তেজ হয়ে গেছে। ঢেউখেলানো চুলে ঢেউয়ে গতি কমে আসায় বব ছাঁট হয়েছে। প্রাণেলের অবশ্য ঢেউয়ে গতি কমা পিঠ পর্যন্ত চুলই পছন্দের ছিল।

ঊর্মিলা প্রথমদিকে প্রাণেলের পছন্দের গুরুত্ব দিয়েছিল। পরে চাকরির উন্নতিতে সে কর্পোরেট দেখনদারিকেই গুরুত্ব দিয়েছে। সে নিয়ে প্রাণেলও খুব বিরোধিতা করেনি। সে শুধু হাসতে হাসতে বলেছিল, চুলের উপর এভাবে রাগ দেখাতে পারলে! একটুও কষ্ট হল না তোমার! আমার সারা জীবনের শান্তির ঘুম গেল। যে-ঘ্রাণে আমি ঘুমোই, আবার নতুন সকালে জেগে উঠি সেটার উপর এতটা জুলুম না করলেও পারতে।

ঊর্মিলা সেদিন খুব হেসে বলেছিল, তুমি আমার রাগ তো পছন্দ করো। তোমার মনে হয় রাগটা মেয়েদের অলংকারের মতো। তোমার উপরে তো সবসময় রাগ করতে পারি না। আর রাগ করলেও স্থায়ীত্ব কম। তাই চুলের উপর চিরস্থায়ী রাগ বর্তালাম।

ঊর্মিলার পায়ের শব্দে অতীত সরে গিয়ে বর্তমান এসে পড়ল প্রাণেলের সামনে। প্রাণেল বলল, কী করছিলে এতক্ষণ রান্নাঘরে! আমি কখন থেকে সোফায় বসে আছি চায়ের প্রতীক্ষায়। ঋক এখনও বাড়ি ফেরেনি? ঊর্মিলা ম্যাক্সিতে ঘাম মুছতে মুছতে বলল, তোমার ছেলের খাবার ব্যবস্থা করলাম। ঋক এখুনি ফিরবে। সাড়ে চারটে বাজছে। চাউমিন রেডি করে ক্যাসারোলে ভরে রাখলাম। একটু সরে বসো, ফ্যানের তলায় এমন বসেছ হাওয়া পাই না আমি। প্রাণেল একটু নড়েচড়ে বসল ঊর্মিলার কথায়।

ঋক হন্তদন্ত হয়ে স্কুলের ব্যাগ কাঁধে নিয়ে এমন ভাবে ঘরে ঢুকল যে, দেখে মনে হল সে রাজ্য জয় করে ফিরেছে। প্রাণেলের নিজের ছেলেকে আজ বড়ো অচেনা লাগে। ঋকও আজকাল প্রাণেলের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রেখেই কথা বলে। প্রাণেল ভাবে মাঝেমাঝে বাবা-মার সঙ্গেও এত মেপে কথা বলা যায়! তবু এ যুগের ছেলেমেযো বোধ হয় প্রয়োজন ব্যতীত কথা বলতে চায় না।

ঋক আগে অবশ্য এরকম ছিল না। সে বরাবর হাসিখুশি প্রাণচঞ্চল স্বভাবের ছিল। মা হলেও ঊর্মিলার সঙ্গে তার যথেষ্ট সখ্যতা ছিল। প্রাণেল শাসন করলেও সে শাসন ভালোবাসা মিশ্রিত ছিল বলে, তা ঋকের মনে কখনও অপমান বোধ তৈরি করতে পারেনি। তার সুকুমার মুখটা দেখলে প্রাণেলের পুত্রস্নেহ বিগলিত হতো। ঊর্মিলার মতো দেখতে হওয়ায় সকলেই বলাবলি করত, ঋক জন্ম থেকেই মায়ের রূপ পেয়েছে। মাতৃমুখী পুত্র নাকি খুব সুখী হয় ইত্যাদি। এখন সেই ঊর্মিলাই হয়তো ছেলেকে ঠিক বুঝে উঠতে পারে না। ঊর্মিলার সঙ্গেও কথাবার্তা যে খুব বেশি হয়, তা নয়।

ঋক যেন গত চার বছরে নিজেকে কেঁচোর মতো বাবা-মার থেকে গুটিয়ে নিল। ঊর্মিলার খুব কষ্ট হয় ছেলের এই স্বভাবে। প্রিয়জনের পরিবর্তনকে সে কখনও-ই মানতে পারে না। সে প্রাণেলের হোক বা ঋকের। মুখ ফুটে কিছু না বললেও আড়ালে চোখের জল ফেলে। কতবার প্রাণেল তা লক্ষ্য করেছে। প্রাণেলের কোনও পরিবর্তিত আচরণে খারাপ লাগলে এক আধবার নীচু গলায় বলত, সকলেই পরিস্থিতির সঙ্গে পালটাচ্ছে। আমি নিজের লোকদের কাছে অপরিচিত হয়ে উঠতে পারছি না বলে এত কষ্ট। আমিও যেদিন তোমাদের কাছে অচেনা হয়ে যাব, সেদিন তোমাদেরও আমাকে মেলাতে অসুবিধে হবে।

পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে ঊর্মিলা একটু হলেও আজ শিখেছে। বাধ্য হয়ে আবেগের কিছু অংশ তাকে কাটছাঁট করতে হয়েছে। তাই প্রাণেল সংসারের খুব বেশি দাযিত্ব না নিলেও সে নিশ্চুপ থাকে। ঋকের খারাপ ব্যবহারের কোনও জবাব সে দেবার প্রয়োজন মনে করে না। ঊর্মিলা নির্দ্বিধায় নিজের কাজ করে যাওয়াটাকেই লক্ষ্য মনে করে। সব ভুলে প্রতিদিনের মতো ছেলের জন্য সে যত্ন সহকারে খাবার বানিয়ে রেখেছে।

ঋক বেশ বিরক্তি ভরা গলায় বলল, আমার চাউমিন করেছ?

ঊর্মিলা শান্ত গলায় বলল, হ্যাঁ করেছি। তুই যেদিন যা খেতে চেয়েছিস কোনদিন তোকে দেওয়া হয়নি! আমি আমার সাধ্যমতো তা করে দিয়েছি।

ঋক ঝাঁঝালো গলায় বলল, থামো কত দাও আমার জানা আছে! ছোটোলোকের মতো আগের সপ্তাহে টানা মুড়ি খেয়েছি। ডিসগাস্টিং।

ঊর্মিলা এবার একটু চড়া সুরে বলল, আগের সপ্তাহে আমার অফিসে কাজের চাপ ছিল তুই জানতিস। আর মুড়ি বুঝি ছোটোলোকের খাবার!

ঋক বলল, একদম তাই। মা, তুমি শুধু দুহাতে রোজগার করেই গেলে, স্ট্যাটাস মেনটেন করতে শিখলে না। তোমরা বাবা সত্যিই পারো।

ঊর্মিলা ছেলের এ কথার প্রত্যুত্তর দেবার প্রয়োজন না মনে করে বলল, হাত মুখ ধুয়ে খেতে বস। ডাইনিং টেবিলে খাবার দিচ্ছি। তোকে খাবার দিয়ে বাবাকে চা করে দেব।

ঋক বাথরুম যেতে যেতে বলল, মা, তুমি না অতিরিক্ত কথা বলো। আমি কি জানতে চেয়েছি বাবার জন্য তুমি কী করবে! আমার খাবার টেবিলে রেখে দাও। আমি খেয়ে নেব। আমি কি বাচ্চা ছেলে নাকি! ঋক বাথরুমে চলে গেল।

ঊর্মিলা ঋকের জন্য খাবার ঠিক করে চায়ে জল বসাল। সে ভাবল সত্যিই ঋক বাচ্চা ছেলে নয়, অনেক বড়ো হয়েছে। তার ইচ্ছে ছিল ছুটির দিনে ঋককে খাবার টেবিলে সঙ্গ দেবে। কিন্তু তার সব ইচ্ছা হাওয়ায় বুদবুদের মতো নিমেষে মিলিয়ে গেল।

চা হয়ে গেছে। ঊর্মিলা চায়ে কাপ হাতে নিয়ে প্রাণেলের কাছে গিয়ে বলল, ধরো। প্রাণেল বলল, তুমি খাবে না! ঊর্মিলা বলল, খাব। রান্নাঘর থেকে কাপটা নিয়ে আসি। প্রাণেল শশব্যস্ত হয়ে বলল, তুমি বসো। আমি এনে দিচ্ছি। ঘেমে নেয়ে গেছ পুরো।

প্রাণেলের প্রায়ই ইচ্ছে করে ভালো রোজগার করে ঊর্মিলাকে বিশ্রাম দিতে। ঊর্মিলাকে দেখে তার বুকটা চিনচিন করে ওঠে। বড়োলোক বাবার খোলস ছেড়ে কতদিন আগে ঊর্মিলা তার কাছে চলে এসেছে। তার কাছে আসার পর থেকেই সংসারের হাড়িকাঠে ঊর্মিলা নিজেকে বলি দিয়েছে। ভালোবেসে কী পেয়েছে ঊর্মিলা তা কোনওদিন হিসাব করেনি প্রাণেল। সে হিসাব করেনি বলেই মাঝেমধ্যে কারণে-অকারণে নিজের মেজাজকে জাহির করতে গিয়ে নিদারুণ আঘাত দিয়ে ফেলেছে ঊর্মিলাকে। তার কাজের জন্য পরে সে অনুতপ্তও হয়েছে।

ঊর্মিলার হাতে চা তুলে দিয়ে প্রাণেল বলল, ঋক খেয়েছে?

ঊর্মিলা কী যেন চিন্তা করছিল। সে হকচকিয়ে বলে উঠল, খেয়ে নেবে হাত মুখ ধুয়ে আমি রেডি করে রেখেছি।

প্রাণেল একটু তিক্ততার সঙ্গে বলল, কখন বাথরুম ঢুকেছে। এখনও বেরোবার নাম নেই। কী যে করে ঘন্টার পর ঘন্টা বাথরুমে, আমার মাথায় ঢোকে না। প্রাণেলের কথা শেষ হতেই বাইরে প্লেটের শব্দ হল। ঋক খেতে বসেছে।

চা শেষ হয়ে আসা প্রায় শূন্য কাপ হাতে নিয়ে ঊর্মিলা জানলার কাছে এল। বাড়ির বাইরে বড়ো রাস্তায় গাড়িগুলো সাঁ সাঁ করে ছুটে চলেছে। ল্যাম্পপোস্টের আলো অনিচ্ছা সত্ত্বেও জ্বলে উঠল। ঊর্মিলার বুকের ভিতর একরাশ অপরিমেয় শূন্যতা। প্রাণেল তার সঙ্গে যেমন ব্যবহার করুক না কেন, তা ক্ষণস্থায়ী। ঊর্মিলা এটা ভালো ভাবে জানে দিনের শেষে প্রাণেলের শেষ আশ্রয় সে-ই। প্রাণেল সেই নিরাপদ আশ্রয় হারাতে চায় না। ঋক তো ঊর্মিলার নিজের রক্ত। রক্ত কি শরীর ছাড়া আশ্রয় পায়! যদি না পায় তাহলে ঋক কেন ঊর্মিলার কাছে দিন দিন অপরিচিত হয়ে উঠছে! ঊর্মিলা নিজের সন্তানকে আশ্রয় দেবার পরিবর্তে কি তার কাছে আশ্রয় খুঁজছে! নিজের সন্তান ঋক স্ট্যাটাস মেনটেন শেখায় তাকে।

ঊর্মিলা স্ট্যাটাস মানে যতটুকু বোঝে তা হল তার সামাজিক পদমর‌্যাদা। সে সেটা অনেক বছর আগে তার শিক্ষক-বাবার কাছ থেকে অজান্তেই শিখে ফেলেছে। সৎ পথে মাথা উঁচু করে সম্মানের সঙ্গে সমাজে বেঁচে থাকাকেই বরাবর গুরুত্ব দিয়েছে ঊর্মিলা। আজকালকার ছেলেমেয়ে হয়তো একেই মিডল ক্লাস মেন্টালিটি বলে বিদ্রুপ করে। ঋক যে-স্ট্যাটসের কথা বলে, সেটা কী বস্তু ঊর্মিলার জানা নেই।

বাবা-মার কাছ থেকে সন্তানকে বোধ হয় অনায়াসে পৃথক করতে পারে এই স্ট্যাটাস। বহু কষ্টে উপার্জিত বাবা-মার অর্থ, বিলাসবহুল রেস্তোরাঁ, হোটেল, সিনেমা হল অথবা শপিংমলে নির্দ্বিধায় বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে খরচা করাকে স্ট্যাটাস বলে। তাই খাবারের বিভাজনও ঋকের কাছে ছোটোলোক-বড়োলোক দিয়ে হয়। বড়োলোকি ছাঁচে নিজেকে ফেলে ঋক। সেই ছাঁচে ঊর্মিলাকে ফেলতে পারছে না বলেই কি এত দূরত্ব!

ঊর্মিলা ভাবে ঋকের মতো ছেলেরা কি কোনও দিন ঘাম ঝরিয়ে সংসারের সবার জন্য পরিশ্রম করতে পারবে! শেষ জীবনে ঋকের মধ্যে কি আশ্রয় খুঁজে নিতে পারবে সে! আশ্রয়হীন হয়ে যাবার ভয় কি তাকে প্রতিনিয়ত সাপের মতো তাড়া করে বেড়াচ্ছে! বুঝতে পারে না সে। হয়তো বুঝতেও চায় না। শুধু মাতৃত্বের দাবি নিয়ে বারবার সে করাঘাত করে ঋকের দরজায়। তার উদ্ভ্রান্ত মন ছুটে চলে সন্তান পিপাসায়। নিজের রক্তের মায়া যে কী, তা ঋক কবে বুঝবে! এই চার বছরে কি একবারও তার মনে হয়েছে মা ঊর্মিলার কথা? দূরের নিস্তেজ আলোর মতো নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছে না তো সম্পর্কগুলো? এসব ভাবতে ভাবতে ঊর্মিলা শূন্যতার বুকে একটা নিরাশার দীর্ঘশ্বাস ফেলে।

প্রাণেল ঊর্মিলার কাঁধে আলতো হাত রেখে বলল, কী হয়েছে ঊর্মি! কখন থেকে খালি চায়ে কাপ হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছো এক ভাবে। বলো কী হয়েছে। ঋক কিছু বলেছে তোমায়?

ঊর্মিলার ভালো লাগল অনেকদিন পর প্রাণেলের মুখ থেকে ঊর্মি ডাকটা শুনে। বিয়ে প্রথম তিন বছর এই নামটা যেন অজ্ঞাত শৃঙ্খলে তাকে আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে ফেলেছিল। যাইহোক সময়ে সঙ্গে সঙ্গে সে শৃঙ্খল ক্রমশ শিথিল হয়েছে।

ঊর্মিলা সব গোপন করে, হাসির মতো হাসি না এনে ঠোঁট একটু চওড়া করে বলল, কিছু হয়নি। আর ঋক কী বলবে আমাকে।

প্রাণেল যেমনই মানুষ হোক না কেন, কেউ ঊর্মিলার মুখের উপর কথা বলেছে শুনলে মাথা ঠিক রাখতে পারে না। ভীষণরকম প্রতিক্রিয়া হয়। সব শুনলে সে ঋককে বকবে। হয়তো ঋকের গায়ে হাত তুলতেও দ্বিধা করবে না। ঋকের ইদানীং অপমানবোধটাও সাংঘাতিক তৈরি হয়েছে।

প্রাণেল ব্যঙ্গের হাসি হেসে বলল, তোমায় কিছু না বললেই ভালো। গুণী ছেলে বোধ হয় এখন নিজের ঘরে ঢুকেছেন। তাকে বলো গিয়ে আজ গার্জিয়ান মিটিং-এ কী কী শুনতে হয়েছে আমাদের।

ঊর্মিলা বলল, ঋককে বলব বইকি! তুমি মাথা গরম করছ কেন! আমি যাচ্ছি। ঊর্মিলা ঘর থেকে বিরক্তির সঙ্গে বেরিয়ে গেল।

ঋকের ঘরে গিয়ে ঊর্মিলা দেখল ঋক মোবাইলে গেম খেলছে। ঊর্মিলা ঘরে পা দিতেই সে তিক্ততার সঙ্গে বলল, তুমি এ সময়ে আমার ঘরে! কিছু দরকার আছে?

ঊর্মিলার মুখটা কেমন ম্লান হয়ে গেল ঋকের কথায়। দাঁতে দাঁত চেপে মুখটা কঠিন করে ঊর্মিলা বলল, আমি তোর ঘরে আসতে পারি না নাকি! দরকার আছে বলেই আরও তোর কাছে আসার প্রয়োজন হয়েছে।

ঋক গেমটায় হেরে গেছে এমন মুখ করে বলল, অফ কোর্স আসতে পারো। কিন্তু ডিসিপ্লিন মেনে নক করা উচিত ছিল। কী দরকার সেটা সরাসরি বলো ভমিকা না করে। ঊর্মিলার রুচিতে আঘাত লাগছিল ঋকের সঙ্গে কথা বলতে। তার মনে হচ্ছিল মা হিসাবে ঠাস করে গালে একটা থাপ্পড় কষাতে। নিজের মেজাজ সামলে নিয়ে সে বলল, তোর স্কুলে আজ গার্জিয়ান মিটিং ছিল। সেখানে কী হল তুই একবারও জানার প্রয়োজন মনে করলি না বলে আমি আগ বাড়িয়ে জানানোর কথা ভাবলাম।

ঋক একটু থতমত খেয়ে বলল, আমি ওসব শুনে কী করব! স্কুলে গার্জিয়ান মিটিং ছিল যেতে বলেছিলাম তোমাদের। গেছ তোমরা আর-পাঁচটা গার্জিয়ানের মতো। ব্যস মিটে গেছে। স্কুলের সমস্যা বাড়িতে আনছ কেন!

ঊর্মিলা উঁচু গলায় বলল, শুনতে হবে ঋক। তুই অন্যায় করলে হাজারবার শুনতে হবে। তুই কী মেটার কথা বলছিস! তোদের স্কুলের হেডমাস্টার তমালবাবু বলেছেন যে, তুই তোদের জুনিয়ার ব্যাচের মীনা নামে একটি মেয়েকে প্রায়ই টিজ করিস। গত সপ্তাহে তোর ব্যাগ থেকে তোর বন্ধু রণিতের টাকা পাওয়া গেছে। তমালবাবু বললেন যে, তুই চোরের খাতায় নাম লিখিয়েছিস। আর উনি যা তোর পড়াশোনার নমুনা বললেন, তা শুনে আমার নিজের লজ্জা লাগছিল। তুই প্রায় দিনই ক্লাস অফ করে বাইরে কোথাও ঘুরতে বেরিয়ে যাস কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে। এগুলো কি সত্যি ঋক, আমি জানতে চাই। তোর বাবা ভীষণ আপসেট।

ঋক পুলিশের হাতে ধরা পড়া চোরের মতো ভয় পেয়ে বলল, মা, তুমি নিজের ছেলেকে কি বিশ্বাস করো না! ওই শালা হারামি তমালবাবু কী বলল তার কথা শুনে নাচছ!

ঊর্মিলা আর সহ্য করতে পারল না। ঋকের গালে গায়ে জোরে ঘৃণার সঙ্গে থাপ্পড় মেরে বলল, চুপ। একদম চুপ। ছি ছি, কী মুখের ভাষা শিক্ষক সম্পর্কে! আমাকে তুই শিক্ষা দিস স্ট্যাটাসের। তোকে ছেলে বলে পরিচয় দিতে কষ্ট হয় আমার। পড়াশোনা বাদই দিলাম। তাই বলে মেয়েদের টিজ করবি, চুরি করবি! পড়াশোনা সবার দ্বারা হয় না ভদ্র স্বভাব-আচরণটা তো তৈরি করতে হয়।

ঊর্মিলা আর ঋকের চিতকার তিরের ফলার মতো প্রাণেলের কানে বিঁধছিল। সে থাকতে না পেরে ঋকের ঘরে ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়ে গেল। অনেকদিন পর ঊর্মিলার চোখ মুখ লাল করা রাগি চেহারাটা সে দেখতে পেল। ঋক তখন বিড়বিড় করে রাগে গজরাচ্ছে।

ক্ষুব্ধ গলায় ঋক বলল, ছেলে বলে পরিচয় দিতে ইচ্ছে না করে দিও না। একদম অপমান করবে না আমাকে। সারাদিন তো চাকরির নাম করে উড়ে উড়ে বেড়াও। নিজের ছেলের সঙ্গে এরকম আচরণ কোন ভদ্রতায় পড়ে? দুপয়সা কামাচ্ছ বলে তোমার খুব দেমাক। আমি তোমার ওই পয়সায় ইয়ে করি বুঝলে। আমার কাছে কৈফিয়ত চাইছ কোন সাহসে!

ঊর্মিলা তীব্র কঠিন গলায় বলল, সন্তান বেপথে গেলে তাকে শাসন করতে মায়ের সাহস লাগে না, মাতৃত্বের অধিকার থাকলেই চলে। সারাদিন অক্লান্ত পরিশ্রম করে সংসারের জন্য টাকা আনাটা তোর উড়ে বেড়ানো মনে হতে পারে। এত ফুটানি করিস মা দুপয়সা ইনকাম করে তাই। তুই পাঁচটাকা ইনকাম করে তবে আমার টাকায় ইয়ে করিস। আমার টাকার দেমাক যদি হয়ে থাকে সেটা রক্ত, ঘাম ঝরিয়ে উপার্জিত। তোর মতো চুরি চামারির পয়সা বা হাত পেতে অন্যের কাছ থেকে নেওয়া নয়।

প্রাণেল এই প্রথমবার ঊর্মিলার চেহারার ও মনের ভাঁজে ভাঁজে ঋকের জন্য ঘৃণা, অভিমান দেখল। ঋকের এই চার বছরের পরিবর্তিত পর্বে সে বহু অন্যায় করেছে। অকথা-কুকথা ঊর্মিলাকে বলেছে। ঊর্মিলা বোবার মতো নিশ্চুপ থেকেছে। সে বিনা প্রতিবাদে সব মেনে নিয়েছে। তার মনের ভিতরের জমাটবাঁধা দুঃখ-কষ্ট মাঝেমধ্যে উগরেছে প্রাণেলের কাছে। কিন্তু সে ঋকের সঙ্গে কোনও তর্ক-বিতর্ক করেনি। এতদিনের জমাটবাঁধা দুঃখ-কষ্ট আগ্নেয়গিরির লাভার মতো স্ফুরিত হতে লাগল।

ঋকের ঊর্মিলাকে অপমান করাটা প্রাণেল ভালো চোখে নিল না। প্রাণেল ঊর্মিলার পক্ষ নিয়ে প্রতিবাদে গর্জে উঠে ঋককে বলল, তোর মাথার ঠিক আছে তো! কী যা তা কথা বলছিস মাকে। ছোটোলোকের বাড়ির মতো ঝগড়া করছিস।

ঋক প্রাণেলকে তাচ্ছিল্যের সুরে বলল, এই তুমি তোমার ঘরে যাও তো। তুমি প্রথম থেকে ছিলে না তাই জানো না কিছু। মা সামান্য একটা স্কুলের গার্জিয়ান মিটিং নিয়ে তিলকে তাল করছে।

প্রাণেল শান্ত গলায় ঋককে বলল, তুই তোর মায়ের সঙ্গে হাজার খারাপ ব্যবহার করলেও আজও তোকে নিয়ে কেউ কোনও খারাপ কথা বললে তোর মায়ের খারাপ লাগে। আফটার অল তোরই মা তো।

ঊর্মিলা তখনও খাটের হাতল ধরে রাগে গজর গজর করছিল। বিমর্ষ মুখে সে যেন নিজেকেই দোষারোপ করছিল। হঠাৎ ক্ষিপ্ত গলায় সে প্রাণেলের উদ্দেশ্যে বলল, তুমি কিছু বোলো না ছেলেকে। ওর আর কিছু হবার নেই। শুধু শুধু তুমি ছেলের কাছে অপমানিত হও আমি স্ত্রী হিসাবে তা মেনে নেব না। যে নিজের ভালোমন্দ নিজে বুঝতে চায় না তাকে বোঝাবার কোনও দরকার নেই।

ঋক ঊর্মিলার কথায় খ্যাপা কুকুরের মতো ক্ষেপে উঠল। তার দুটো চোখ আগুনের মতো দপ করে জ্বলে উঠল। সে রুক্ষ্ম স্বরে ঊর্মিলাকে বলল, বাবার আবার মান-অপমান বোধ! তোমার টাকায় খেয়েপরে আমাকে জ্ঞান দিতে আসে। আমি তো সবাইকে অপমান করি। আমি বিন্দুমাত্র ব্যবহার জানি না। আর বাবা যখন কথায় কথায় তোমাকে অপমান করে, তোমার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করে, তখন তোমার কিছু লাগে না বলো! অ্যাকচুয়ালি বাবা একটা মেরুদণ্ডহীন লোক। আত্মসম্মান বলে কোনও কিছু আছে নাকি বাবার?

ঋকের কথা শুনে প্রাণেল ভিতর থেকে খোলা ছাতা বন্ধ হওয়ার মতো দমে গেল এই ভেবে যে, ঊর্মিলার মতো স্ত্রীকেও সে অপমান করে। ঋকের মতোই সেও তো ঊর্মিলাকে প্রতিপদে আঘাত করে। সে ভাবল ঋকের কথাগুলো তো খুব ভুল নয়।

প্রাণেলের অপমানটা ঊর্মিলা হজম করতে পারল না। সে ঋকের গালে সপাটে চড় মেরে বলল, তোর এত অধঃপতন হয়েছে ঋক! তুই তোর বাবাকে অপমান করছিস। ছোটো করছিস। নিজেও ছোটো হচ্ছিস। বাবা না হয় মেরুদণ্ডহীন। আমার রোজগারের টাকায় খায়-পরে। তার কোনও মুরোদ নেই। তোর তো মেরুদণ্ড আছে। তোর মুরোদটা দ্যাখা। আমি মা হয়ে সেটা দেখি।

প্রাণেলের বুকের ভিতরটা কেমন ছ্যাঁৎ করে উঠল সন্তানের মুখ থেকে অযোগ্যতার কথা শুনে। এখুনি বুঝি সাপের খোলস ছাড়ার মতো তার বাইরের আবরণ খসে গিয়ে ভিতরের দুর্বলতাগুলো উন্মুক্ত হয়ে পড়বে। ঋকের মুখ থেকে বেফাঁস কথা বেরিয়ে পড়বে এই দুর্ভাবনা, এই শঙ্কার তাড়া খেয়ে সে ঊর্মিলাকে বলল, চলো ও ঘরে। মাথা ঠান্ডা করো। গায়ে হাত তুললে সমস্যার সমাধান হবে না। আর তুমিও ঊর্মি, ঋকের মতো বাচ্চা হয়ে গেলে নাকি। চলো, বেরিয়ে এসো ঘর থেকে। প্রাণেল ঊর্মিলার হাত ধরে ঋকের ঘরের বাইরে নিয়ে চলে এল।

ঋকও যুদ্ধের ময়দান ছেড়ে পালিয়ে যাবার পাত্র নয়। সে মায়ের সঙ্গে দ্বন্দ্ব যুদ্ধে নেমেছে। যুদ্ধে জয়ীর মতো গলা হাঁকিয়ে সে বলল, আরে যাও যাও। বউয়ে প্রতি দরদ উথলে উঠছে একেবারে। আমার কী মুরোদ আছে না আছে দেখাব তোমাদের। আমাকে চড় মারলে তো তার ফল ভালো হবে না, বলে দিলাম।

ঋকের ঘরের মধ্যে চিৎকার করে বলা কথাগুলো প্রাণেল আর ঊর্মিলার কানে গেল। ঊর্মিলা হতাশ ভাবে বলল, ঋক এতটা বেপরোয়া, এতটা নির্দয় হয়ে গেল! প্রাণেল নীরব হয়ে রইল। নীরবতা ভেঙে তার মতামতের অপেক্ষা ঊর্মিলা করে না।

ঊর্মিলা জোর করায় প্রাণেল রাতের খাবার খেল। ঊর্মিলার খাওয়ায় রুচি ছিল না। মায়ের সঙ্গে কথা কাটাকাটির পর ঋক সেই যে দরজা বন্ধ করেছে, আর খোলেনি। মা তাকে ডাকতে গেলে ঘরের ভিতর থেকেই সে জানিয়েছে খিদে নেই। রাতের বিছানায় শুতে গিয়ে নানা রকম দুর্ভাবনা ঊর্মিলাকে অক্টোপাসের মতো জড়িয়ে ধরে। ঘুম আসে না সহজে। প্রাণেলকেও মাঝেমাঝেই অচেনা লাগে তার। প্রাণেল নিরলস ভঙ্গিতে জানলার কাছে দাঁড়িয়ে অকারণ ঘন ঘন সিগারেট খায়।

ঊর্মিলা একবার দুহাত বাড়িয়ে ডাকে প্রাণেলকে, কী হল! রাতদুপুরে এত সিগারেট খাচ্ছ কেন! শোবে এসো।

প্রাণেল হতাশার সুরে বলল, আচ্ছা ঊর্মি, আমি মেরুদন্ডহীন লোক বলো! এই যে সিগারেট টানছি সেটার খরচাও তোমাকে জোগাতে হয়। এমন লোককে ভালোবেসে আপশোশ হয় না তোমার?

ঊর্মিলার মন মেজাজ একদম ভালো ছিল না। তাই প্রাণেলের কথাগুলো এড়িয়ে বলল, শুতে এসো। তোমাকে ছাড়া আমার ঘুম আসে না জানো। তবু দূরে দাঁড়িয়ে আছ। কাছে এসো আমার। প্রাণেল বলল, তুমি শোও। আমি বাথরুম থেকে আসছি হাত মুখ ধুয়ে

ঊর্মিলা কথা বাড়াল না। সারা পৃথিবী নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে। ঊর্মিলার মনে হল কেবল সেই জেগে আছে একাকী। সে নিজেও জানে প্রাণেল ঘুম পাড়ালেও আজ তার ঘুম আসবে না। পরক্ষণেই ঋকের চিন্তা মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। কী করছে ঋক এখন! ছেলেটা কি ঘুমিয়ে পড়ল! সারারাত কি না খেয়ে থাকবে ছেলেটা! আগে একদম খিদে সহ্য করতে পারত না ঋক। বড়ো হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পুরোনো অভ্যাসের চরিত্র বদলাল। ঊর্মিলার বুকটা কোনও এক অজ্ঞাত ব্যথায় মোচড় দিয়ে উঠল। ঋকের গায়ে এই প্রথমবার হাত তুলল সে। তবু তার মনে হল সন্তানকে আঘাত করা মানে নিজেকে আঘাত করা। ঋক কি আদৌ বুঝবে সেকথা!

নানা দুর্ভাবনাকে প্রশ্রয় আশ্রয় দিয়ে ঊর্মিলা শোবার ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এল। তার কপালে চিবুকে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। ঘুম তার আজ হবে না। বাইরে বেরিয়ে ডাইনিং টেবিলে রাখা জলের গেলাস থেকে কয়েক ঢোক জল খেয়ে একটা হালকা নিঃশ্বাস ছাড়ল। তারপর অনেক সংশয় নিয়ে ঊর্মিলা ঋকের ঘরের দিকে পা বাড়াল। দরজাটা বোধ হয় শোওয়ার আগে ভেজিয়ে রেখেছিল ঋক। ঊর্মিলা হাত দিয়ে ঠেলতেই ক্যাঁচ করে একটা মৃদু শব্দ করে দরজাটা খুলে গেল। ঘরটার দখল নিয়েছে একটা থমথমে অন্ধকার।

ঊর্মিলা আপন মনেই বলল, নাইট বাল্বটাও জ্বালেনি ঋক। কী যে করে না ছেলেটা। একদম এই দিকটা বাবার মতো হয়েছে। নাইট বাল্ব জ্বালতেই অন্ধকার সরে গিয়ে স্নিগ্ধ আলোয় ভরে উঠল ঘর। বাল্বের পরিমিত আলোয় দেখল, এলোমেলো বিছানায় ঋক অচৈতন্য অবস্থায় ঘুমাচ্ছে। ঋকের ম্লান মুখের দিকে তাকিয়ে সে কিছু একটা ভেবে স্মিত হাসল। তারপর তার স্নেহের হাতটা বেশ কিছুক্ষণ ছেলের মাথায় বুলিয়ে দিল। ঋকও ঘুমের ঘোরে স্নেহের স্পর্শ পেয়ে নড়েচড়ে উঠল। ঊর্মিলা তার কপালে একটা স্নেহচুম্বন করে ঘরের দরজা ভেজিয়ে বাইরে বেরিয়ে এল।

ঊর্মিলা বাইরে এসে দেখল প্রচণ্ড ঝড় উঠেছে। মিশমিশে কালো আকাশ ভেদ করে মেঘ তীব্র ভাবে গর্জন করছে। ঊর্মিলা বাইরের দরজা জানালা বন্ধ করতে করতে হাঁক পাড়ল, প্রাণেল, একবার বাইরে এসো। প্রচণ্ড মেঘ করেছে। ঝড় উঠেছে। ঊর্মিলা তার নিজের ডাকের কোনও প্রত্যুত্তর না পেয়ে বিরক্তিভরে বলল, আমার পোড়া কপাল! লোকটা বোধ হয় কুম্ভকর্ণের মতো ঘুমোচ্ছে। দরজা জানালা বন্ধ করতে গিয়ে ছাঁটের জলে কিছুটা ভিজে গেল ঊর্মিলা। ভিজে জামাকাপড় বদলে ফেলে শোবার ঘরে ঢুকল সে।

ঊর্মিলা ঘরে ঢুকে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে যাবে এমন সময় দেখল, প্রাণেল বিছানায় নেই। শোবার ঘরে প্রাণেল আসেনি। ঝড় বৃষ্টির রাতে ঊর্মিলা উচ্চস্বরে প্রাণেলের নাম ধরে চিৎকার করল। কিন্তু কোনও লাভ হল না। সারা বাড়ির দমবন্ধ করা নীরবতা তাকে হাঙরের মতো গিলতে চাইল। সে ঊর্ধশ্বাসে বাথরুমে গেল। সেখানেও গিয়ে সে দেখল প্রাণেল নেই। রান্নাঘরের দরজা, ছাদের দরজা সব বন্ধ। সংশয়পূর্ণ গলায় ঊর্মিলা নিজেই বলে উঠল, কোথায় গেল প্রাণেল! ঋকের ঘরে তো যাবার কথা নয়। আমি তো ঋকের ঘরে এতক্ষণ ছিলাম।

ঊর্মিলার এবার নজরে পড়ল উত্তরে রান্নাঘরের পাশে গেস্ট রুমে। গেস্ট রুমের মৃদু আলোর রেখা ভেজানো দরজা ভেদ করে বাইরে আসছে। ঊর্মিলা হাঁপ ছেড়ে বলল, শোবার ঘরে আমি বিরক্ত করব ভেবে গেস্টরুমে লোকটা ঘুমানো বাদ দিয়ে সিগারেট খাচ্ছে। কী লোক বাবা। দেখাচ্ছি মজা।

ঊর্মিলা একরাশ অভিযোগ মাথায় নিয়ে গেস্টরুমের ভেজানো দরজা সজোরে ঠেলে বলল, কী ব্যাপার এত রাতে এ ঘরে! কথা শেষ করেই ঘরের চারদিকে তাকিয়ে ঊর্মিলার কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে এল। নাইট বাল্বের মৃদু আলোয় যা দেখল তাতে তার নিজের চোখকেই বিশ্বাস হল না। সে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে বলল, ঋক, কোথায় তুই! আমার এ কি সর্বনাশ হল! কান্নায় জড়িয়ে এল ঊর্মিলার গলা। সেই সময় ঋক বোধ হয় বাথরুম গিয়েছিল। সে ঘুম চোখে বাথরুম থেকে বেরিয়ে এল।

মায়ের তীব্র আর্তনাদ শুনে ছুটে এসে বলল, রাত দুটো বেজে গেছে। এত রাতে চিৎকার করছ কেন! ঊর্মিলা গেস্টরুমের সামনে বসেছিল। অশ্রুভেজা দু’চোখে ধরা গলায় প্রাণেলের দিকে আঙুল তুলে সে বলল, দ্যাখ ওদিকে তাকিয়ে ঋকের ঘুমের ঘোর কেটে গিয়েছিল। সে ঊর্মিলাকে জড়িয়ে ধরে অস্ফুট কণ্ঠে ডাকল, বাবা! প্রাণেলের নিথর দেহটা সিলিং ফ্যানের তলায় ঝুলছে। প্রাণেলের গলায় প্যাঁচানো রয়েছে ঊর্মিলার একটা শাড়ি। গত বছর পুজোর সময় প্রাণেল নিজের হাতে গড়িয়াহাট মার্কেট থেকে ঊর্মিলার জন্য কিনে এনেছিল।

ঋক ঊর্মিলাকে বলার মতো ভাষা খুঁজে পাচ্ছিল না। মনে মনে ঋক ভাবল, সন্ধ্যায় বাবাকে খুব অপমান করেছে। এই সবকিছুর জন্য ঋক যেন নিজেকে দায়ী করল। তারপর সে গলা ছেড়ে অঝোরে কাঁদতে লাগল। ঋক ঘরের টিউব লাইট জ্বেলে মাকে ছেড়ে ঘরের খাটের কাছে গিয়ে দাঁড়াল। খাটের কাছে যেতেই বাবার হাতে লেখা বালিশের উপর একটি খোলা চিঠি ঋকের নজরে পড়ল। ঋক চিঠিটা হাতে তুলে বলল, মা, এই দ্যাখো বাবা চিঠি লিখে রেখেছে এখানে।

ঊর্মিলা কাঁদতে কাঁদতে বলল, কী লিখেছে লোকটা! নিশ্চয়ই অনেক অভিযোগ করে গেছে আমার বিরুদ্ধে। ঊর্মিলার কথা বলতে কষ্ট হচ্ছিল। প্রাণবাযু কে যেন ভিতর থেকে শুষে নিচ্ছে। ঋক চিঠিটা পড়তে শুরু করল। চিঠিতে লেখা কথাগুলো ছিল—

প্রিয় ঊর্মি,

তোমার বিরুদ্ধে কোনও রাগ অভিমান অভিযোগ আমার কোনও দিনই ছিল না। আজও নেই। আমার মেরুদণ্ডহীনতা আমার অপদার্থতার জন্য আমি নিজেই দায়ী। তোমার উপর সব ভার চাপিয়ে আমি বোঝা বাড়িয়ে চলেছিলাম। তুমি এ জীবনে যা দিয়ে আমাকে, তা হয়তো আমার কোনও জন্মের পুণ্যের ফল। তোমার মতো স্ত্রী পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। তবু কারণে-অকারণে কত আঘাত কত কষ্ট দিয়েছি তোমায়। সেকথা সব ভাবলে আমার নিজের উপর ঘৃণা হয়। ঋকের উপর তুমি এত অভিমান কোরো না। ছেলেটা হাজার হলেও এই মেরুদণ্ডহীন অপদার্থ বাপটার ছেলে বলে, তোমাকে না বুঝে আঘাত দেয়। যেদিন ছেলেটা বুঝবে হয়তো আমারই মতো অনুশোচনার আগুনে দগ্ধ হবে। আমার ঋক যখন একদিন বাবা হবে তখন হয়তো বুঝবে বাবার মর্ম। ওকে তুমি আমার মতো নয়, তোমার মতো তৈরি কোরো, যাতে ওর ছেলেমেয়ে কোনও দিন ওর মেরুদণ্ডহীনতা অপদার্থতা চোখে আঙুল দিয়ে দেখাতে না পারে। আমি তো সে ভাবে ভালো স্বামী, ভালো বাবা হয়ে উঠতে পারলাম না। আমায় ক্ষমা কোরো। তোমাকে মুক্তি দিলাম ঊর্মি। আর একটা কথা তোমাকে বলা হয়নি। চন্দ্রকোণায় আমার ভাগের পৈতৃক সম্পত্তি বিক্রির কুড়ি লাখ টাকায় তোমার আর ঋকের নামে একটা এলআইসি করে ছিলাম। ঋকের জন্য আমার অনেক আশীর্বাদ রইল। ওকে তুমি মানুষ কোরো। তোমরা ভালো থেকো।

চিঠি পড়া শেষ করে ঋক ঊর্মিলার কাছে বসে পড়ল। কাঁদতে কাঁদতে সে বলল, মা, বাবার মৃত্যুর জন্য আমি দায়ী। বাবা আমার কাছ থেকে পাওয়া অপমান সহ্য করতে পারেনি। আমাকে তুমি শাস্তি দাও।

ঊর্মিলা কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, শাস্তি আমি দেবার কে! ওই লোকটা দেখছিস না আমাদের শাস্তি দিয়ে চলে গেল। সব ব্যথা বুকে নিয়ে আমার ভার কমিয়ে আমাকে মুক্তি দিয়ে গেছে। যাবার আগে তোকে প্রাণভরে আশীর্বাদ করে গেছে। নিজেকে অপরাধী ভাবিস না। আমার কাছে শাস্তি ভিক্ষে করার চেয়ে তোর বাবার শেষ ইচ্ছে পূরণ কর। তুই মানুষের মতো মানুষ হলে তোর বাবার আত্মা শান্তি পাবে। কথা বলতে বলতে ঊর্মিলার গলা থমকে গেল। মনে হল একটা বোবা কান্না মণ্ড পাকিয়ে গলাকে আড়ষ্ট করে দিল।

ভোর হয়ে এসেছে প্রায়। দেয়াল ঘড়িতে সাড়ে চারটে বেজে গেছে। ঝড় বৃষ্টি থেমে গিয়েছে। নীল আকাশ থেকে স্নিগ্ধ নরম আলো ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে। ভোরের দুচারটে দূরপাল্লার ট্রেন অজানা পথে হুইসেল বাজিয়ে দুর্বার গতিতে ছুটে চলেছে। পাড়ার অলিতেগলিতে কিছু কুকুর তারস্বরে ডেকে উঠল।

স্বামী প্রাণেলকে ছাড়া নতুন একটা সকাল আসছে ঊর্মিলার জীবনে। বাবা ছাড়া ঋকের নতুন অধ্যায়ে সূচনা হবে। এ যেন ঋকের পুনর্জন্ম। ঊর্মিলা ছেলেকে বুকে আঁকড়ে জলভরা দুচোখে অস্পষ্ট ভাবে হয়তো উপলব্ধি করল দূরের অনাগত দিনগুলি।

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...