রূপান্তর

আজ থেকে প্রায় আট মাস আগে বিয়ের দিন মৃন্ময়ীদেবীর সঙ্গে ঐশীর প্রথম দেখা। মৃন্ময়ীদেবী শতদ্রুর পিসিমা। থাকেন মেদিনীপুরে। বিয়ের শতব্যস্ততায় তখন ওনার সঙ্গে ঠিকমতো পরিচয় ঘটেনি ঐশীর। আজ আট মাস পর ওনার পদধূলি পড়তে চলেছে এ-বাড়িতে। থাকবেনও প্রায় মাসখানেক। খবরটা পাওয়া মাত্রই বাড়িতে বেশ একটা শোরগোল পড়ে গেল।

ওনার দাপুটে স্বভাব সম্পর্কে কমবেশি শ্বশুর, শাশুড়ি, বরের কাছে গল্প শুনেছে সে। যদিও কিয়দংশ তারও দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। বিয়ের সময়তেই পুরোহিতের ভুল মন্ত্রোচ্চারণে একেবারে দক্ষযজ্ঞ বাধিয়েছিলেন, পুরোহিতকে এই মারতে যান তো সেই মারতে যান… তারপর ঐশীর বাবা আর মৃন্ময়ীদেবীর ছোটোভাই রমাকান্তবাবুর মধ্যস্থতায় তিনি খানিক শান্ত হয়েছিলেন।

সেই কোন ছোটোবয়সে তিনি বিধবা হয়ে বাবার ভিটেতে গিয়ে উঠেছিলেন। এখনও ওই ভিটেই যক্ষের মতো আগলে রেখেছেন তিনি। বাবা সংস্কৃতের টোল চালাতেন, ফলে মেয়েও তাতে বেশ চৌকশ। বাবা গত হয়েছেন, ছোটোভাই তো পড়াশোনা চলাকালীন-ই কলকাতায় চলে এসেছিলেন। তারপর আর ওমুখো হননি। কালেভদ্রে বেড়াতে বা প্রয়োজনে গেছেন কখনও সখনও। গ্রামের ওই প্রাসাদোপম বাড়ির বাসিন্দা বলতে বড়োভাই, ভাই বউ, আর তিনি। ভাইয়ের এক মেয়ে। তার বিয়ে হয়ে সে শ্বশুরবাড়িতে। আর এক ছেলে ছিল বটে, তবে সে আর বেঁচে নেই। বছর সাতেক আগে বিনা নোটিশে দু-দিনের জ্বরে সব শেষ। সেই থেকেই বড়োভাই শয্যাশায়ী। বিঘের পর বিঘে জমিজমা, চাষবাস সবই এখন মৃন্ময়ীদেবীর রক্ষণাবেক্ষণে।

ছুটির দিন। একটু বেলা করেই ঘুম থেকে উঠেছে ঐশী। রোজই তো সেই ১০টা – ৬টার ডিউটি। সকালে উঠে কাকচান সেরে কোনওরকমে নাকেমুখে গুঁজে ছোটা। একদিন এর অন্যথা হলে বেশ ভালোই লাগে। ঘুম থেকে উঠতে উঠতে আজ সোয়া নটা বেজে গেছে তার। তারপর বাড়তি মেদ ঝরাতে ট্রেড মিলে মিনিট কুড়ি হাঁটা। অন্যান্য দিনের তুলনায় ছুটির দিনেই একটু স্বাস্থ্যসচেতনতা বাড়ে আর কী! হাঁটতে হাঁটতেই কানে এল এক প্রৌঢ়ার গলা। এ গলা সে আগেও কোথাও শুনেছে। কিন্তু কোথায়?… উৎসাহবশত বসার ঘরে আসতেই দেখল শ্বশুর-শাশুড়ি, শতদ্রু সবাই মিলে সেই পিসিকে ঘিরে দাঁড়িয়ে রয়েছে।

দীপ্তিময়ের সেই টানা চোখ। বয়সের কারণে ত্বকে খানিক শিথিল ভাব এলেও, এককালে যে অপরূপা সুন্দরী ছিলেন, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। যেমনি লম্বা দীর্ঘকায়া তেমনি রংও যেন ফেটে পড়ছে। হাঁ করে তাকিয়েছিল ঐশী। হুঁশ ফিরল তাঁর রাশভারী গলার আওয়াজে। ভারী গলায় তিনি কাদের যেন দুষছেন। ‘বেআদব সব ছেলেপুলে। একটু শিক্ষেদীক্ষে নেই গো, বড়োদের সম্মান পর্যন্ত করতে জানেনে সব। সক্বাল না হতে হতে বেহায়াদের মতো হাত ধরাধরি করে… ছি ছি ছি…।’

পিসিশাশুড়ির কথায় হাসি পেলেও নিজেকে সংযত করে তাঁর দিকে এগিয়ে গেল ঐশী। দু-পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে জিজ্ঞাসা করল, ‘কেমন আছেন পিসিমা?’

এই নাকি তাঁর নাতবউ! পরনে ট্রাউজার আর ঢলা গেঞ্জি। ঘেমে নেয়ে একাকার। দেখেই মৃন্ময়ীদেবীর চক্ষু চড়কগাছ।

‘থাক থাক। আর প্রণাম করতে হবে না।’ বলেই কয়েকপা পিছিয়ে গিয়ে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘বলি বেলা তো কম হল না, এখনও নাওয়া-খাওয়া হয়নি বুঝি?’

‘না আসলে একটু ব্যায়াম করছিলাম। আপনার আওয়াজ শুনে চলে এলাম। এবার…’

‘তা বেশ করেছ, এবার নেয়ে এসো দিকি।’

‘যাচ্ছি পিসিমা। তার আগে আপনার পছন্দের এককাপ চা বানিয়ে আনি। মার কাছ থেকে শিখেছি দেড় চামচ চিনি আর কড়া লিকার, তাইতো?’ বলেই হাসল ঐশী।

‘হ্যাঁ হ্যাঁ, তুই চা বসা, আমি আসছি।’ সুমিত্রাদেবী বউমাকে বাঁচানোর আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়েও সফল হন না। কথাটা কানে যাওয়া মাত্রই গলা ভারী করে ভাজের দিকে তাকিয়ে, ‘ও তুমিও বুঝি এই মেয়ের পাল্লায় পড়ে শহুরে আদবকায়দা রপ্ত করেছ। ম্লেচ্ছদের মতো নাওয়া-ধোওয়া না করেই রান্নাঘরে ঢুকছ?’

‘না-না দিদি একদমই তা নয়। আমিই চা বানিয়ে নিয়ে আসছি।’ বলেই রান্নাঘরের দিকে হাঁটা দিয়ে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন তিনি।

‘আপনার সঙ্গে অনেক গল্প করার আছে পিসিমা, আমি চটপট স্নান সেরে আসছি’, বলেই পিসিমাকে একবার জড়িয়ে ধরে ঐশী ছুটে পালাল স্নানঘরের দিকে।

‘কী মেয়েরে বাপু! বাপের বাড়ি থেকে কি কোনও রীতিনীতিই শিখে আসেনি? তা রমা তোরাও তো দেখছি আশকারা দিয়ে দিয়ে একেবারে মাথায় তুলে রেখেছিস। সংসারের আচার-ব্যবহার কিছু শেখা, নয়তো পরে তোদেরই ভুগতে হবে এই বলে দিচ্ছি।’ চা-আসা পর্যন্ত রমাকান্তবাবু আর শতদ্রুর এইভাবেই ক্লাস নিতে থাকলেন মৃন্ময়ীদেবী।

মৃন্ময়ীদেবীর বিপক্ষে গিয়ে কিছু বলার ক্ষমতা দুজনের কারওরই ছিল না। দিদির কথার প্রেক্ষিতে রমাকান্তবাবু শুধু এটুকুই বললেন, ‘তুমি যখন এসেই গেছ, তুমিই ওকে শিখিয়ে-পড়িয়ে নিও। আচ্ছা দিদি তুমি বোসো, আমি একবার বাজারটা ঘুরে আসছি’, বলে উঠতে যাবেন এমন সময় সুমিত্রাকে দেখে, ‘ওই তো সুমিত্রা এসে গেছে। তুমি চা খাও, আমি এক্ষুনি আসছি’, বলেই রমাকান্তবাবু বাইরে বেরিয়ে গেলেন। শতদ্রুও পিসিমার ব্যাগ-পত্র গেস্টরুমে রাখার বাহানায় ঘর থেকে সরে পড়ল। অগত্যা সুমিত্রাদেবী-ই বসে রইলেন ননদের উপদেশাবলি শোনার জন্য।

সন্ধেবেলা সকলে একসঙ্গে বসে চা-জলখাবার খেতে খেতে নানান আলোচনা চলছে। গল্পের আসর বেশ জমে উঠেছে। গ্রামের নগেনখুড়ো থেকে শীতের নলেন গুড়– কোনওকিছুই বাদ নেই। খাওয়াদাওয়ার কথা উঠতেই ঐশী হঠাৎই হাহা করে হেসে উঠল। হাসতে হাসতে বলল, ‘বাবা মনে আছে চিন্নাস্বামী আর তার পরিবারের কথা, সেই দিল্লি যাওয়ার সময় ট্রেনে?’

‘আরে হ্যাঁ হ্যাঁ, মনে আবার থাকবে না! চিন্নাস্বামীর হাতির মতো চেহারার ছেলেটিকে বলে কিনা দিনদিন রোগা হয়ে যাচ্ছে। একদম নাকি খায় না। অথচ ট্রেন ছাড়ার পর থেকে একটা মুহূর্ত মুখ থেমে থাকেনি তার। বোধহয় দশজনের খাবার সে একাই খেয়ে নিয়েছে ততক্ষণে।’ বলেই শ্বশুর, বউ মিলে হেসে লুটোপুটি খেতে থাকল।

হাসিতে রাশ টানলেন পিসিমা। ‘আহ্ ঐশী একটু আস্তে। ভুলে যেও না এটা তোমার শ্বশুরবাড়ি। এখানে কেউ তোমার বন্ধু নয়।’

কেউ কিছু বলার আগেই ঐশী অকপটভাবে বলে বসল, ‘মা-বাবার থেকে বড়ো বন্ধু আবার কেউ হয় নাকি পিসিমা? বাপি ছিল আমার সব থেকে প্রিয় বন্ধু আর এখানে বাবা-মা। কী বলো বাবা?’

উত্তর দেওয়া দূরস্থান, ঐশীর কথাতেই বিষম খেয়ে কাশতে কাশতে শ্বাস ফুলে উঠল রমাকান্তবাবুর। এই বুঝি দিদি ঝাঁপিয়ে পড়ল বেচারির উপর। হলও তাই।

‘বড়োদের মুখে মুখে কথা বলাটা মোটেই শোভনীয় নয় ঐশী। তাদের সম্মান করতে না পারো, অন্তত অনাদর কোরো না।’ বেচারিকে এমন ধমক দিলেন যে বাড়ির সকলের মুখ মুহূর্তে ফ্যাকাশে হয়ে গেল।

ঐশী জিভ কাটল, ‘ছি ছি পিসিমা, এমন বলবেন না। আমি আপনাকে হার্ট করতে চাইনি, আসলে দোষটা আমার বাপির। আপনার সঙ্গে যখন আমার বাপির দেখা হবে, আপনি খুব করে শাসন করে দেবেন তো। ওনার অপত্যস্নেহেই আমি বিগড়ে গেছি। ছোটো থেকে উনি-ই আমাকে শিখিয়েছেন, সবকিছু বন্ধুর মতো ওনার সাথে খোলাখুলি আলোচনা করতে। সেই অভ্যাসটাই থেকে গেছে। এখানেও তাই বাবার সঙ্গে কথা বলতে বলতে, ভুলেই যাই যে উনি আমার শ্বশুরমশাই। ওনার সামনে বেশি কথা বলা সাজে না আমার।’ কথাগুলো বলে মাথা নীচু করে অপরাধীর মতো বসে রইল সে। ঐশীর মাথা নীচু করার ভঙ্গি দেখে শ্বশুর, শাশুড়ি, শতদ্রু – সকলেই হেসে ফেলল।

‘এই মেয়ের পাল্লায় পড়ে তোমাদেরও মাথা খারাপ হয়ে গেছে দেখছি।’ সকলকে হাসতে দেখে রাগে গজগজ করতে করতে নিজের ঘরে চলে গেলেন মৃন্ময়ীদেবী।

মৃন্ময়ীদেবী আসার পর থেকে এ-বাড়িতে বেশ একটা অদ্ভুতরকম পরিবেশ তৈরি হয়েছে। ওনার কাজই যেন ঐশীর দোষত্রুটি খুঁজে বার করা। তারপর তাকে ভৎসনা করা। বাড়ির অন্য সদস্যরা তাঁর হ্যাঁ-তে হ্যাঁ না মেলালেই মুখ ব্যাজার করে সেই একই সাবধানবাণীর পুনরাবৃত্তি, ‘প্রশ্রয় দিয়ে মাথায় তোলা হচ্ছে মেয়েটাকে।’

দিন দশেক এইভাবেই কেটে গেল। এরই মধ্যে হঠাৎ একদিন মায়াপুর থেকে খবর এল সুমিত্রাদেবীর ছোটোকাকা মারা গেছেন। দাহ হওয়ার আগে শেষবারের মতো দেখতে হলে এখুনি রওনা দিতে হবে। তখুনি শতদ্রু বাবা-মাকে নিয়ে গাড়িতে রওনা দিল মায়াপুরের উদ্দেশে। ফিরতে ফিরতে কাল সন্ধে হয়ে যাবে। বাড়িতে এখন ঐশী আর পিসিমা।

ভাই-ভাজ-ভাইপো রওনা দেওয়ার ঘন্টাখানেক পরে হঠাৎ ওনার মনে হল সময়টা ভালো যাচ্ছে না, তাই একবার মন্দিরে ঘুরে আসা দরকার। ফিরে আর কিছু খেলেনও না। ঐশী বারবার অনুরোধ করাতে জানালেন, ভোগ খেয়ে ফিরেছেন।

বিকেল থেকেই পিসি বারবার বাথরুম যাওয়া-আসা করছেন। সন্ধ্যার পর সেই আনাগোনার মাত্রা আরও বেড়ে গেল। সঙ্গে যোগ হল বমি। ঠিক করে দাঁড়ানোর ক্ষমতাও নেই ওনার। সন্ধে গড়িয়ে রাত হতে চলল। বাড়িতে কেউ নেই। বাড়াবাড়ি হলে ঐশীর একার পক্ষে সামলানো মুশকিল হয়ে দাঁড়াবে। তাই দেরি না করে একটা রিকশা ডেকে এনে পিসিমাকে নিয়ে সোজা চলে গেল ডাক্তারখানায়।

চেম্বারে বেশ ভিড়। সকলেই অপেক্ষা করছেন তাদের পালা কখন আসবে। কিন্তু ততক্ষণ অপেক্ষা করলে পিসির অবস্থা আরও খারাপের দিকে যাবে। তাই একমুহূর্ত দেরি করা যাবে না ভেবে, সোজা পিসিমাকে নিয়ে ডাক্তারের রুমে ঢুকে গেল ঐশী। পাশ থেকে অপেক্ষারত অন্যান্য পেশেন্টদের বাড়ির লোকের দু-এক কথা কানে গেল বটে, ‘এভাবে হয় না, সিরিয়াল অনুযায়ী দেখাতে হয়। সব কিছুরই একটা নিয়ম আছে। আমরাও তো রোগী নিয়ে অপেক্ষা করছি।’

তাদের দিকে না তাকিয়েই ঐশী জবাব দিল, ‘নিয়ম-ই সিরিয়াস পেশেন্টদের আগে চেক-আপ করা।’ বলে পিসিকে নিয়ে ভিতরে ঢুকে গেল সে। ডাক্তারবাবু পেশেন্ট-এর অবস্থা দেখে আর দ্বিমত করলেন না। সঙ্গে সঙ্গে চেক-আপ করে প্রয়োজনানুযায়ী ইঞ্জেকশন দিয়ে ওষুধপত্র লিখে দিলেন।

বাড়িতে ফেরার পর প্রেসক্রিপশন মাফিক তিনটে ট্যাবলেট খাওয়ানোর পরে খানিক স্বস্তি পেলেন মৃন্ময়ীদেবী। ওআরএস জলে গুলে বারেবারে একটু একটু করে পিসিমাকে খাওয়াতে থাকল ঐশী। ঘন্টা দুয়েক পর অবস্থার খানিক উন্নতি হলে মৃন্ময়ীদেবী ঐশীর দিকে তাকালেন, ‘যদি রাতবিরেতে আবার বাড়াবাড়ি হয় তাহলে…’ মৃন্ময়ীদেবীর চোখেমুখে তখন চিন্তার ভাঁজ।

‘আমি তো আছি। আপনি চিন্তা করছেন কেন? কিছু হবে না। আপনি ঘুমানোর চেষ্টা করুন’, বলে পিসিমার মাথায় হাত বোলাতে থাকল ঐশী। বউমার আত্মবিশ্বাসে মৃন্ময়ীদেবীর সমস্ত টেনশন দূর হয়ে গেল। শিশুর মতো ঐশীর কোলের কাছে এগিয়ে গিয়ে চোখ বুজে ঘুমানোর চেষ্টা করলেন তিনি।

মায়াপুর থেকে ফোন এলে তাদেরও সকলকে ভরসা দিল ঐশী, ‘চিন্তার কিছু নেই, এদিকটা আমি সামলে নেব।’

রাত্রে মৃন্ময়ীদেবী যতবারই চোখ খুলেছেন, বিছানার পাশে ঐশীকে পেয়েছেন। সারারাত জেগে মেয়েটা সেবা করেছে পিসিশাশুড়ির। মাঝে মাঝে চামচে করে নুন-চিনির জল দিয়েছে, খেতে না চাইলে ধমক দিয়েও খাইয়েছে। রাত দেড়টা নাগাদ ওনার শরীরটা বোধকরি আবার গুলিয়ে উঠেছিল, সামলাতে না পেরে বিছানাতেই কাপড়েচোপড়ে বমি করে ফেলেছিলেন তিনি। অপ্রস্তুতে পড়ে গেলেন তিনি। পিসিমাকে ইতস্তত বোধ করতে দেখে ঐশী সামান্য হাসে, ‘কেন এত সংকোচ করছেন। ঠিক আছে হয়ে গেছে। বরং উঠে গিয়ে ভালোই হয়েছে, এইবার একটু হালকা বোধ করবেন।’

এক এক করে ওনার কাপড় ছাড়ানো, ভিজে তোয়ালে দিয়ে গা পরিষ্কার করা, ফ্রেশ কাপড় পরানো, বিছানার চাদর বদলানো সব হাসিমুখে সেরে ফেলল ঐশী। তারপর ওনার মাথায় এমন ভাবে হাত বুলিয়ে দিল যে মিনিট পনেরোর মধ্যেই উনি ঘুমিয়ে পড়লেন।

সকাল সাতটায় মৃন্ময়ীদেবী ঘুম ভাঙতে দেখলেন ঐশী তার মাথার পাশে বসে খাটে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। ঘাড়টা কাত হয়ে গেছে। স্নেহের হাত মাথায় রাখতেই চমকে উঠল সে। ধড়ফড়িয়ে উঠল, ‘আপনি ঠিক আছেন তো পিসিমা? শরীর কেমন? আর বমি হয়নি তো?’ যেন ঘুমিয়ে পড়ে সে এক বিরাট অপরাধ করে ফেলেছে, সেই অস্বস্তিতে একসঙ্গে প্রশ্ন করে ফেলল ঐশী।

‘ওরে থাম থাম, আমি একদম ঠিক আছি। শেষবার বমি হওয়াতে শরীরটা বেশ হালকা হয়ে গেছে। এখন আর কোনও কষ্ট নেই। দ্যাখ একদম ফিট। আমার কথা ছাড়, তোর উপর দিয়ে অনেক ধকল গেল, এবার আরাম করগে যা তো। একটু ঘুমিয়ে নে। সারারাত ঠায় মাথার সামনে বসে ছিলি। আমি সব দেখেছি।’

‘আগে স্নান সেরে তোমার জন্য কিছু খাবার বানাই, তারপর না হয়…’

‘না না তোকে কিছু করতে হবে না। আমি সব করে নেব। তুই ঘুমুতে যা দিখি।’

‘কিন্তু’,

ঐশীকে থামিয়ে দিয়ে মৃন্ময়ীদেবী আদেশ দেবার মতো ভঙ্গিতে বললেন, ‘কিন্তু-টিন্তু কিছু নয়, তোকে বলছি না তুই শুতে যা।’

এই এক রাতেই ঐশী আর মৃন্ময়ীদেবীর সম্পর্ক এক গভীর বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছে। স্নেহপরবশ হয়ে ঐশী যে কখন তার পিসিমার কাছে তুমি থেকে তুই হয়ে গেছে, তা বোধকরি তিনিও টের পাননি। সত্যিই সময়ই পারে সবকিছু বদলাতে।

আদেশ অমান্য না করে পিসিমার খাটেই গুটিশুটি মেরে শুয়ে পড়ল ঐশী। রান্নাঘরে যাওয়ার আগে বউমাকে ওভাবে শুতে দেখে একখানা চাদর চাপিয়ে মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দিয়ে গেলেন তিনি।

ঐশীর উঠতে উঠতে মৃন্ময়ীদেবীর ভাত-ডাল-আলু-পোস্ত সমস্ত কিছু কমপ্লিট। দুপুরে দুজনে একসঙ্গে লাঞ্চ সেরে দেদার গল্পে মেতেছে।

‘একটা কথা খুব জানতে ইচ্ছে করে, ঠিক ঠিক উত্তর দেবে কি? যদি দাও তা হলে বলি। আসলে তুমি আসার পর থেকেই প্রশ্নটা মনের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে।’

‘ভণিতা না করে কী বলবি বল দিকি?’

‘না দ্যাখো, আমরা প্রতিমাসে পার্লার ঘুরে আসছি, কত কত টাকা গচ্ছা দিয়ে আসছি, তবুও ত্বকে কোনও উজ্জ্বলতা নেই। আর তোমার এই বয়সেও এত গ্ল্যামার, রহস্যটা কী বলোতো?’ হাসতে হাসতে বলল ঐশী।

ঐশীর কানটা ধরে বলেন, ‘পিসিশাশুড়ির পিছনে লাগা হচ্ছে অ্যাঁ? ওরে মুখপুড়ি আমাদের সময় ওসব পার্লার ফার্লার ছিল না বটে, কিন্তু মা ঘষে ঘষে সর-বেসন মাখাতেন, বুঝলি।’

‘সত্যি বলছি তোমাকে দেখলে কেউ বলবেই না যে, তুমি বাবার থেকেও বড়ো। কী সুন্দর দেখতে তোমায়।’ মুগ্ধ চোখে তাকায় ঐশী।

‘নে আর আমড়াগাছি করতে হবে না।’ বলে মৃন্ময়ীদেবীও তার কৃত্রিম গাম্ভীর্য ভেঙে হেসে ফেললেন।

মায়াপুর থেকে ফেরার পর দুজনকে পাশাপাশি বসে এভাবে হাসিঠাট্টা করতে দেখে সকলেই হতবাক। পরিবেশ হালকা বুঝে রমাকান্তবাবু তো বলেই বসলেন, ‘একি রে বাবা, কোনও ভুল বাড়িতে ঢুকে পড়লাম না তো? নয়তো এমন মিরাকেল – ভাবাই যায় না!’

পাশে বসে থাকা বউমার গলা জড়িয়ে গালে একটা চুমু খেয়ে মৃন্ময়ীদেবী বললেন, ‘দ্যাখ রমা তুই আর তাচ্ছিল্য করিসনি বাপু। এমনিই আমি মরমে মরে আছি। আমার সত্যিই চিনতে ভুল হয়েছিল রে – এ যে একেবারে খাঁটি হিরে।’ বলেই চিবুকে একটু হাত বুলিয়ে বলেন, ‘জানিস কাল সারারাত ঠায় মেয়েটা মাথার কাছে বসে সেবা করেছে আমার। খাব না বলেছি বলে ধমক পর্যন্ত দিয়েছে। ঠিক আমার মায়ের মতো। আমার জন্য ডাক্তারখানায় কম রাগারাগি করেনি, ডাক্তারও বাধ্য হয়েছে আমাকে দেখতে। খুব বুঝেছি তোরা কেন এই পাগলিটাকে এত ভালোবাসিস।’ বলতে বলতে চোখের কোণায় জল ভরে আসে মৃন্ময়ীদেবীর। ‘মেয়েটাকে তো অকথা-কুকথা কম বলিনি, হাসিমুখে সব সয়েছে। আজকালকার দিনে এমন বউ পাওয়া সত্যিই ভাগ্যের রে। সত্যিই ভাগ্যের!’ আবেগবিহ্বল হয়ে চোখ মুছলেন পিসিমা। মৃন্ময়ীর এই রূপান্তরে সকলেই বেশ হতবাক। পাষাণের ভেতরেও যে এত টলটলে জলের এক হ্রদ ছিল তা কে জানত!

 

শয়তানের মুখোশ

‘বাবা এ বাবা দমে জ্বালা কইরছ্যে। ইটা ঢুইকব্যেক লাই। ছোটো বঠে। বাবা এ…’

‘দেখছিস মাপ লিচ্ছি তবু কানের গড়াটায় সেই ঘ্যেনের ঘ্যেনের কচ্চিস। টুকু দাঁড়া ন, মাপটা লিয়েলি।’

‘বাবা এ বাবা…’ এবার ঘুমটা ভেঙে যায় দুলালের। এখন ঘরময় অন্ধকার, দাঁত বিছিয়ে খিলখিল করে হাসছে। বিছানা থেকে উঠে লাইটটা জ্বালায় দুলাল। অন্ধকারের দাঁতগুলো যে যার মতো ঘরের দেয়ালে লুকিয়ে পড়ে। ঘামে শরীরটা ভিজে গেছে দুলালের। মাটির কলশি থেকে গ্লাসে জল গড়িয়ে ঢক-ঢক শব্দে জলটা গিলে নেয় দুলাল। বাতাসি আলুথালু শরীর বিছিয়ে ঘুমোচ্ছে এখন। ব্লাউজের ফাঁক দিয়ে বাতাসির চুপসে যাওয়া বুকদুটো বেরিয়ে পড়েছে বাতাসের খোঁজে। বালিশের তলা থেকে বিড়ির বান্ডিল আর দেশলাইটা নিয়ে একটা বিড়ি ধরায় দুলাল। বিড়ির ধোঁয়ায় ঘরটা আরও গুমোট হয়। দুলালের কানে স্বপ্নে শোনা কথাগুলো আবার ভিড় করে আসে…

১)

ভাদ্রমাসের মাঝামাঝি থেকেই কাজের চাপ বাড়তে থাকে দুলালের। এই দুটো মাস নিঃশ্বাসটাও গুনে-গুনে নিতে হয় ওকে। বাতাসি কাজে তেমন পটু না হলেও দুলালকে যথেষ্ট সাহায্য করে। মুখোশগুলোকে সময় মতো রোদে দেওয়া, পরিমাণমতো রোদ পাওয়ার পর সেগুলোকে তুলে ঘরে রাখা। দোকানে দোকানে গিয়ে অর্ডার নিয়ে আসা। সময় মতো অর্ডারের মাল দোকানে দিয়ে আসা। বাতাসি না থাকলে দুলালের একার পক্ষে সবদিক সামলানো সম্ভব হতো না।

পুরুলিয়ার মাহাত পাড়ায় গিয়ে দুলাল মাহাতোর নাম বললে যে কেউ ওর ঘরটা দেখিয়ে দিতে পারবে। রাজ্যপাল আর মুখ্যমন্ত্রীর কাছে বেশ কয়েকবার পুরস্কার পেয়েছে দুলাল। সেবছর দুর্গা পূজার সময় বাথানির মাঠে মরা মহিষ বানিয়ে শকুন নামিয়ে দিয়েছিল দুলাল। সেদিনের পর থেকে ছেলেবুড়ো সবাই ওকে এক নামে চেনে। তবে দুলাল মাটির কাজে খুব একটা আগ্রহ দেখায় না। ছৌনাচের মুখোশ বানাতেই ও বেশি ভালোবাসে। সারা বছর ধরেই মুখোশ বানাতে হয় ওকে। দুর্গা পূজার আগের কটা মাস খুব কাজের চাপ পড়ে যায়। নানান জায়গা থেকে অর্ডার আসে।

প্রতিদিনের মতো আজকেও দুলাল সকাল সকাল নিজের কাজ নিয়ে বসেছিল। আপন মনে রং করছিল একটা মুখোশ। বাতাসি মুখোশের সাইজ অনুযায়ী পেপার কাটছিল দুলালের পাশে বসেই। ঠিক এমন সময় একটা লোক ঢুকল ঘরের ভেতর। অদ্ভুত চেহারা লোকটার। কাঁচাপাকা চুল, গাল ভর্তি খোঁচা খোঁচা দাড়ি, ঠোঁটের কোণায় হাসির রেখা ঝুলে আছে। কাঁধে একটা ঝোলা ব্যাগ। পরনে আলখাল্লা ধরনের একটা পাঞ্জাবি। দুলাল কিছুক্ষণ চেয়ে দেখল লোকটাকে, তারপর বলল, ‘পূজার আগে আর লতুন অডার লিব লাই।’ লোকটা কিছুই বলল না। হাসি মুখে তাকিয়ে রইল একটা মুখোশের দিকে। কথাটা বলার পর দুলাল ভেবেছিল লোকটা হয়তো কিছু বলবে। লোকটা চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে দেখে দুলাল এবার জিজ্ঞেস করল, ‘কীসের মুখশ চাই?’

এবার উত্তর দিল লোকটা, ‘আমি মুখোশ কিনতে আসিনি।’

‘তাহলে কী জন্যে আইচেন?’ জিজ্ঞেস করল দুলাল।

‘এমনি।’

লোকটার কথার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারে না দুলাল। আর কথা না বাড়িয়ে বাতাসিকে চোখের ইশারায় ঘরের ভেতর ঢুকতে বলে, আবার নিজের কাজে মন দিল। বাতাসি কিছুক্ষণ অবাক হয়ে চেয়ে রইল দুলালের দিকে। তারপর চুপচাপ ঘরের ভেতরে চলে গেল। হাতে ধরে থাকা মুখোশটায় রং দেওয়া হলে দুলাল তাকিয়ে দেখে লোকটা নেই। কখন বেরিয়ে গেছে। লোকটার মতিগতি বোধগম্য হল না দুলালের। এমন তো কত লোকেই আসে-যায় ওসব নিয়ে বিশেষ কিছু ভাবার সময় হয় না দুলালের। আজকের এই লোকটাকে দেখে কেমন যেন একটা খটকা লাগল ওর।

হাতের রং করা মুখোশটাকে উঠোনের রোদে নামাতে গিয়ে দুলাল খেয়াল করল সদর দরজার কোণায় একটা প্যাকেট পড়ে আছে। প্যাকেটটা কুড়িয়ে থমকে গেল দুলাল। একবান্ডিল পাঁচশ টাকার নোট রাখা আছে প্যাকেটটার ভেতর। বুকটা ছ্যাঁক করে উঠল দুলালের। কোনও বদ মতলব নিয়ে আসেনি তো লোকটা? নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করল কয়েকবার। কোনও উত্তর পেল না। একবার ভাবল প্যাকেটটা নিয়ে গিয়ে লোকাল থানায় দিয়ে আসবে। শেষ পর্যন্ত সাহস হল না দুলালের। পুলিশের চক্বরে পড়লে বিপদের সম্ভাবনাই বেশি। শেষ পর্যন্ত অনেক চিন্তা ভাবনা করে প্যাকেটটা ঢুকিয়ে রেখে দিল একটা মুখোশের ভেতর। যদি লোকটা আবার আসে তাহলে ওকে ফিরিয়ে দেবে…

২)

নানান কাজের চাপে টাকার প্যাকেটটার কথা মাথাতেই ছিল না দুলালের। মনে পড়ল মুখোশটা বিক্রি করতে গিয়ে। মুখোশটা হাতে নিয়েও টাঙিয়েই রেখে দিল দেয়ালে। বেশ কিছুদিন হল পূজা পেরিয়ে গেছে। এখন কাজের তেমন চাপ নেই বললে চলে। দুলাল ভেবেছিল লোকটা হয়তো আবার কিছু দিনের ভেতর কোনও কুপ্রস্তাব নিয়ে আসবে। কিন্তু লোকটা সেই যে গেল আজও এল না। প্যাকেটটার কথা দুলাল বাতাসিকেও বলেনি। দুলাল জানে বাতাসি টাকার গন্ধ পেলে সেটা শেষ না করে শান্তিতে বসবে না।

দিন দিন কাজের পরিমাণ যতই কমছিল ততই বেশি মনে পড়ছিল টাকার প্যাকেটটার কথা। শেষ পর্যন্ত দুলাল যখন নিশ্চিত হল লোকটা আর আসবে না তখন হাত দিল টাকার প্যাকেটটায়। ওই টাকা খরচা করে ঘরের চাল-ডাল যেমন এল, ঠিক তেমন ভাবেই মুখোশের রং তুলিও এল। বিনা পরিশ্রমের টাকা খরচা করতে বিশেষ সময় লাগল না। মাস দুয়েকের ভেতরেই দুলাল শেষ করে ফেলল টাকাগুলো। টাকাটা শেষ হওয়ার কয়েক সপ্তাহ পর আবার হাজির হল লোকটা। লোকটা যে আবার কোনও দিন আসতে পারে সেটা কল্পনা করেও দেখেনি দুলাল। লোকটাকে দেখামাত্রই দুলাল মনে মনে ঠিক করে নিল লোকটা টাকার কথা বললে টাকাটার কথা পুরোপুরি অস্বীকার করে যাবে। কিন্তু আশ্চর্য, লোকটা টাকার কোনও কথাই বলল না। সেদিন যেমন নীরবে বেরিয়ে গিয়েছিল ঠিক তেমন ভাবেই বেরিয়ে গেল আজকেও। তবে আজকে আর কোনও টাকা রেখে গেল না লোকটা।

এবার বেশ চিন্তায় পড়ল দুলাল। কে এই লোকটা? কেন আসে ওর কাছে? কী করাতে চায় ওকে দিয়ে? নিজেই নিজেকে প্রশ্নে প্রশ্নে অস্থির করে দুলাল। কিন্তু উত্তরগুলো কিছুতেই ধরা দিল না ওর হাতে। শেষ পর্যন্ত বাতাসিকে পুরো ঘটনাটা খুলে বলল দুলাল। ওর একার পক্ষে আর চাপ নেওয়া সম্ভব হচ্ছিল না। তবে বাতাসিকে বলেও বিশেষ কিছুই লাভ হল না দুলালের। বাতাসি এমন কোনও পথ বলতে পারল না যে পথে ভাবলে মানসিক শান্তি পায় দুলাল।

৩)

আজকে আর রাতজেগে কাজ করতে ইচ্ছে করছিল না দুলালের। বেশ কিছুদিন হল শরীরটাও সাথ দিচ্ছে না ওর। বাতাসির সঙ্গে কথা বলতে বলতে নিজের অজান্তেই ঘুমিয়ে পড়েছিল। ঘুমটা ভাঙল আবার সেই স্বপ্নটা দেখে। অনেক চেষ্টা করেও আর ঘুম এল না ওর। শেষ পর্যন্ত ঘরের কপাট খুলে বাইরে বেরিয়ে আসতে হল ওকে। একটা বিড়ি ধরিয়ে বসল ঘরের বারান্দায়। আজকে আকাশ জুড়ে চাঁদ উঠেছে। চাঁদের আলোয় ঝলমল করছে বারান্দায় ঝুলিয়ে রাখা মুখোশগুলো। ঘরের পিছন দিকের বাঁশ বাগান থেকে ডাহুকের ডাক ভেসে আসছে। এমন রাত মানুষের মনে নেশা ধরিয়ে দেয়। দুলালের ভেতরটাও আপন খেয়ালে গুনগুন করে ওঠে,

‘আইজ চাঁদ চইল্যেছে আকাশ গায়ে জোছনা বিছ্যায়ে

আইজ বুকের ভেতর প্রেমের খেলা দুবুক লাচ্যাইয়ে।

তুই ঘর ভিতরে ঘুমাই আছিস আমি বেকার বাজাই বাঁশি

আর কবে বুঝবি লো তুই আমি কীসের লাইগ্যে আসি?’

দুলাল গানটা থামিয়ে দিতেই দরজার বাইরে থেকে গানের পরের লাইন দুটো ভেসে আসে,

‘ওলো সখী তুই উঠার আগেই ভোর হইয়্যে যায় পাছে

আয়-না-গো তুই বাতাস হইয়্যে আমার বুকের কাছে।’

গানের শেষ দুটো লাইন শুনে দুলাল অবাক হয়ে যায়। দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে কে এই গান গায়? এই গান তো দুলালের বানানো গান। এই গান অন্য কারুর জানার কথা নয়। আর এক মুহূর্ত দেরি না করে দৌড়ে গিয়ে বাইরের দরজাটা খুলল দুলাল। দরজাটা খুলেই দেখল সেই লোকটা দাঁড়িয়ে আছে। চাঁদের আলোয় দুলাল পরিষ্কার দেখতে পেল লোকটা হাসছে। সরাসরি জিজ্ঞেস করল দুলাল, ‘এতো রাইত্যে কী জন্যে আইচেন?’

‘একটা মুখোশ চাই আমার।’

‘না আমি আপনারে কোনও মুখশ দিব লাই।’

লোকটা হাসতে থাকে। নিস্তব্ধ রাত্রিতে ভয়ংকর শোনায় সেই হাসির শব্দ। দুলাল নিজের কান দুটোকে প্রাণপণে চাপা দিয়ে চিৎকার করে বলে, ‘আমি দিব লাই মুখশ। কোনও মুখশ দিব লাই।’

লোকটা হাসি মুখেই বলে, ‘মুখোশটা বানিয়ে ফ্যাল্। ওই মুখোশটা তোকে বানাতেই হবে।’ কথাগুলো বলেই লোকটা স্টেশনের দিকে হাঁটতে শুরু করে। দুলাল কান দুটোকে চাপা দিয়ে চোখ বন্ধ করে কপাট কোণে দাঁড়িয়ে থাকে। লোকটাকে আর দেখা যায় না। বাতাসি দুলালকে টেনে ঘরের ভেতরে নিয়ে এসে কপাট বন্ধ করে দেয়।

৪)

পরের দিন সকাল সকাল বাতাসি কয়েকটা মুখোশ নিয়ে বাজারে বেরিয়ে পড়ে। এই মুখোশগুলো রমেন গাঙ্গুলি অর্ডার দিয়েছিল। মুখোশগুলো কলকাতায় যাবে। আজকে বাজারে আরও একটা কাজ আছে বাতাসির। দুটো কাজ সেরেই ও ফিরবে। বাতাসি বাড়ির বাইরে বেরিয়ে যাওয়ার পরই ভাঙা আলমারিটা থেকে দুলাল একটা মুখোশ বের করে আনে। আজ অনেক বছর পর দুলাল আবার বের করেছে মুখোশটা। সেদিন সারারাত কাজ করেও মুখোশটা শেষ করতে পারেনি দুলাল। সেই রাতের পর আর হাত দেওয়া হয়নি মুখোশটায়। আজকে যে ভাবেই হোক মুখোশটার অসমাপ্ত কাজটা ওকে শেষ করতে হবে। গতকাল রাতেই দুলাল বুঝতে পেরেছিল লোকটা কোন মুখোশটা নিতে চায়। আজ থেকে সাত বছর আগে একজন লোক এসেছিল দুলালের কাছে। একটা শয়তানের মুখোশ বানাতে বলেছিল দুলালকে। কাজটা নিয়েছিল দুলাল। কিন্তু শেষ আর করতে পারেনি।

মুখোশটায় রং করতে করতে দুলাল শুনতে পায়, ‘বাবা এ দমে জ্বালা কইরছ্যে। ইটা ঢুইকব্যেক লাই। ছোটো বঠে। বাবা এ…’

মাঝে মাঝে রং তুলি ফেলে কান দুটোকে চাপা দেয় দুলাল। কয়েক মিনিট পর কান ছেড়ে আবার কাজে মন দেয়। প্রায় ঘন্টা খানেক এভাবে চলার পর মুখোশটার কাজ শেষ হয়। একটা অদ্ভুত আনন্দ হয় দুলালের ভেতর। এর আগে কোনও মুখোশ বানিয়ে এতটা আনন্দ হয়নি ওর। যেমন বানাতে চেয়েছিল অবিকল তেমনই মুখোশ বানিয়েছে দুলাল।

মুখোশটা দুহাতে নিয়ে দুলাল ওটাই ভাবছিল কতক্ষণে লোকটা আসে। ও এলেই ওর হাতে মুখোশটা ধরিয়ে দিয়ে বিদায় করবে ওকে। মুখোশটা কমপ্লিট হওয়ার পর সেই লোকটা দরজার সামনে এসে দাঁড়ায়। হাসি মুখে দুলালকে জিজ্ঞেস করে, ‘হয়েছে?’

‘হইচ্যে। কিন্তু এই মুখশটা লিয়ে যাবার পর আর আসা চইলব্যেক লাই আমার বাড়ি।’ দুলাল বলে।

লোকটা কোনও কথা না বলে মুচকি হেসে দুলালের কাছে এগিয়ে আসে। দুলাল শক্ত করে ধরে রাখে মুখোশটা। কয়েকপা পিছিয়ে গিয়ে দূরের থেকেই মুখোশটা দেখায় লোকটাকে। লোকটার পছন্দ হয়েছে বুঝতে পারে দুলাল।

লোকটা হাসি মুখে অস্ফুট সুরে বলে, ‘শয়তানের মুখোশ।’

যখন বাতাসি ঘরে ঢোকে তখনও দুলাল লোকটার সঙ্গে গল্প করছে। আজকে বাতাসির সঙ্গে আরও একজন এসেছে।

পুলিশ?

না পুলিশ নয়, মনের ডাক্তার। বিশিষ্ট মনোরোগ বিশেষজ্ঞ সুবিমল সরকার। ডাক্তারকে বাতাসি আঙুল বাড়িয়ে দেখায় দুলাল কেমন ভাবে নিজেই নিজের সঙ্গে গল্প করছে। শুধু তাই নয় দুলাল গল্প করছে সম্পূর্ণ দুরকম ভাবে। একটা ওর নিজের ভাষা। অন্যটা শহরের। বাতাসি দুলালের কাছে যেতে চাইলে সুবিমল বাধা দিয়ে ফিসফিস করে বলে, ‘ওকে মুখোশটা দিতে দাও।’

দুলালের কল্পনায় তৈরি লোকটা যখন কথা দেয় ও আর আসবে না, তখন দুলাল মুখোশটা শূন্যে তুলে ধরে। তারপর লুটিয়ে পড়ে মাটিতে। বাতাসি আর সুবিমল সরকার মিলে দুলালকে ঘরের ভেতর নিয়ে আসে। সুবিমল বলে, ‘ভয়ের কিছু নেই। আশা করি আজকের পর আর এই সমস্যা হবে না। তবে ওই মুখোশটা যেন ওর চোখে আর না পড়ে। পারলে ওটাকে পুড়িয়ে দিও।’

৫)

বাতাসি উঠোনে গিয়ে মুখোশটা হাতে নিয়ে অবাক হয়ে যায়। অবিকল নিজের মুখোশ বানিয়েছে দুলাল। কাঁচাপাকা চুল, গালভর্তি খোঁচা খোঁচা দাড়ি, ঠোঁটের কোণায় হাসির রেখা ঝুলে আছে। মুখোশ হাতে নিয়ে বাতাসি ডাক্তারের সামনে তুলে ধরে। মুখোশটাকে দেখার পর কয়েক মিনিট চিন্তা করে সুবিমল। কোনও একটা হিসেব মেলানোর চেষ্টা করে। কিছুক্ষণ পর সুবিমল বাতাসিকে জিজ্ঞেস করে, ‘আচ্ছা দুলাল নিজের মুখোশ বানাল কেন? তোমার কী মনে হয়?’

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাতাসি বলে, ‘যেদিন রাইত্যে আমাদের ছেল্যাডারে সাপে কাইট্যে ছিল সেদিন একটা লোক আছিল একটা অডার লিয়ে। একটা শয়তানের মুখশের অডার। সেই অডারের কাইজটাই রাইত্যের বেলায় কচ্চিল দুলাল। আমি ঘুমোচ্চিলাম। তাতাই আমাকেও তুইল্যেছিল, উঠি লাই। উয়ার বাপও কাইজ ছ্যাইড়ে উঠে লাই। যখন জাইনত্যে পাইল্লম তাতাইকে সাপে কাইট্যাছে, তখন সব শেষ। সেদিন থ্যেইক্যেই তাতাই-এর বাপ ক্যেমন যেন হইয়ে গেছ্যে।’

‘আচ্ছা সেদিন তুমি টাকার বান্ডিলটা কোথায় রেখেছিলে?’

‘ওই কপাট কুনট্যায়।’ আঙুল বাড়িয়ে দেখায় বাতাসি।

‘দুলাল টাকাগুলো নিয়ে কোথায় রেখেছিল বলতে পারবে?’

‘একটা মুখশের ভিতর‍্। দাঁড়ান লিয়ে আসচি।’

বাতাসি মুখোশটা নিয়ে এসে সুবিমলের হাতে দেয়। সুবিমল মুখোশটা বেশ কিছুক্ষণ নাড়াচাড়া করার পর বলে, ‘আচ্ছা এই মুখোশটার ভেতর আরেকটা ছোট্ট মুখোশ কেন আছে?’

এবার চুপ করে যায় বাতাসি। কী বলবে কিছুই বুঝে উঠতে পারে না। বুকের ভেতরে লুকিয়ে রাখা পু্রোনো ব্যথাটা চোখের পাতা ঠেলে বেরিয়ে আসতে চায়।

বাতাসিকে চুপ করে থাকতে দেখে সু্বিমল বলে, ‘আমাকে মুখোশ রাখার ঘরটায় একবার নিয়ে চলুন।’

না বলতে পারে না বাতাসি। মুখোশ ঘরে নিয়ে আসে সুবিমল ডাক্তারকে। ঘরটায় ঢুকে অবাক হয়ে যায় ডাক্তার। সারা ঘরটা জুড়ে কয়েক’শ মুখোশ রাখা আছে। দেব-দেবীদের মুখোশ থেকে শুরু করে পশু-পাখি কিছুই বাদ নেই। কিন্তু একটা দেয়াল জুড়ে ঝুলছে অদ্ভুত কিছু মুখোশ। প্রতিটা মুখোশের ভেতর একটা করে ছোটো মুখোশ আছে। একটা মুখোশ হাতে নিয়ে ভেতরের ছোটো মুখোশটাকে বের করার চেষ্টা করে ডাক্তার। পারে না। বড়ো মুখোশটার ভেতর ছোটো মুখোশটাকে এমন ভাবেই ঢোকানো আছে যে, দুটোকে আলাদা করা যাচ্ছে না কিছুতেই। সুবিমল অবাক চোখে বাতাসিকে আবার জিজ্ঞেস করে, ‘তুমি নির্ভয়ে বলতে পারো। আমি কাউকে কিছু বলব না। কেন বড়ো মুখোশটার ভেতর ছোটোটাকে লুকিয়ে রেখেছে দুলাল?’

শাড়ির আঁচলে চোখের জল মুছে বাতাসি বলে, ‘তাতাইকে সাপে কামড়্যায় নায়, ডাক্তারবাবু।’

‘তাহলে?’

‘সাত বছর আগে সেদিন যে লোকটা আইছিল, সে বইল্যেছিল…’

‘শয়তানের মুখোশ বানাতে। তারপর?’

‘মুখশটা মাপে ঠিক হচ্যিল লাই। তাতাই-এর বাপ তাই তাতাইকে মুখশটা পরাই মাপটা ঠিক করত্যে গ্যেইছিল…’ কান্নায় বাতাসির কথাগুলো ঠোঁটের ফাঁকে ফাঁকে জড়িয়ে যায়। কয়েক সেকেন্ড সময় নিয়ে ভেতরের কান্নাটাকে গিলে ফেলার চেষ্টা করে বাতাসি বলে, ‘তাতাই বারবার বইল্যেছিল, দমে জ্বালা কইরছ্যে। ইটা ঢুইকব্যেক লাই। ছোটো বঠে। উয়ার বাপ কথাগুল্যান কানেই নিল লাই। আর খুলত্যে পারে নাই মুখশটা। মাছের মতো ছটপট্যাই ছটপট্যাই মইরে ছিল তাতাই…’ নিজেকে আটকাতে পারে না বাতাসি। সাত বছর ধরে জমিয়ে রাখা চোখের জল আজ আর কোনও বাধা মানতে চাইছে না।

সুবিমল একটা মুখোশকে টেনে ছেঁড়ার চেষ্টা করে। পারে না। প্রতিটা কাগজের মুখোশের ভেতর টিনের পাত দেওয়া আছে। সুবিমল খেয়াল করে দেখে সব মুখোশগুলোর গঠন এক নয়। অধিকাংশ মুখোশের পিছন দিকটায় কিছু নেই, ফাঁকা। গোটা কুড়ি-পঁচিশ মুখোশ আছে যেগুলোর পিছনটাও সুন্দর ভাবে বানানো। তবে আশ্চর্যের বিষয় এই কুড়ি-পঁচিশটা মুখোশ শয়তানের মুখোশ।

সুবিমল সরকার আগে তো একজন মানুষ, পরে ডাক্তার। ওর বাড়িতেও বছর পাঁচেকের একটা মেয়ে আছে। তাই ওর পক্ষে দুলাল কিংবা বাতাসির যন্ত্রণার জায়গাটা বোঝা কঠিন নয়। এতক্ষণে সুবিমল বুঝতে পারে, কেন দুলাল শয়তানের মুখোশে নিজের রূপ এঁকেছে। কেন শয়তানের মুখোশের ভেতর একটা করে ছোট্ট মুখোশ ঢোকানো রয়েছে।

দুলাল এখনও অচেতন ভাবে বিছানায় পড়ে আছে। সুবিমল দুলালের নাকের কাছে আঙুল নিয়ে গিয়ে দেখে গরম নিঃশ্বাস পড়ছে কিনা। না নিঃশ্বাস স্বাভাবিক। এখন কোনও দুঃস্বপ্ন দেখছে না দুলাল। বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার আগে সুবিমল বাতাসিকে বলে, ‘চিন্তা কোরো না। দুলাল ওই বাজে স্বপ্নটা বা ওই লোকটাকে আর কখনওই দেখবে না। তবে হাঁ জ্ঞান ফেরার পর যদি কাঁদে তো ওকে মন খুলে কাঁদতে দিও।’ কথাটা বলে বাড়ির বাইরে বেরিয়ে গিয়েও আবার একবার ফিরে আসে সুবিমল, ‘আরেকটা কথা। শয়তানের ওই মুখোশটা, যেটা দুলালের নিজের মুখের আকৃতি, সেটা যেন আর দুলালের চোখে না পড়ে। ওটাকে দূরে কোথাও পুড়িয়ে দিও কিংবা মাটি চাপা দিয়ে দিও।’

সুবিমল চলে যাওয়ার পর বাতাসি দরজার কোণায় দাঁড়িয়ে দুলালের মুখটা একবার উঁকি দিয়ে দেখে। কিছু একটা খোঁজার চেষ্টা করে। তারপর মুখোশটা নিয়ে বাড়ির পিছন দিকের দরজা দিয়ে বেরিয়ে যায়। আর কোনওদিন দুলালের চোখে পড়বে না শয়তানের মুখোশটা।

 

সংক্রমণ

হ্যাঁচ্চো!

উফ, এই তো ঠিক বেরোনোর মুখে তোমার শুরু হল।

আমি কি ইচ্ছে করে দিলাম নাকি! হাঁচি আসলে কী করব?

ভাল্লাগে না ধুর! নাকটা টিপে ধরতে পারো না?

আচ্ছা এত কুসংস্কার কেন তোমার? হাঁচি দেওয়া যাবে না, বিড়াল রাস্তা কাটা যাবে না, ডাকা যাবে না পেছন থেকে… একের পর এক! পারা যায় না।

পারতে হবেও না। আমার বিশ্বাস আমায় নিয়ে থাকতে দাও। তোমায় ভাবতে হবে না।

কথা বলাই মুশকিল।

বলোই বা কতটুকু? সারাদিন তো কাজ, কাজ আর কাজ!

কাজ না করলে খাব কী ম্যাডাম?

ঢং!

তো এবার হয়েছে বেরোব এখন? না আরও টাইম পাস করতে হবে হাঁচি দেওয়ার অপরাধে।

এসো এবার। দুগ্গা দুগ্গা!

হাসতে হাসতে অফিসের উদ্দেশে রওনা দেয় মলয়, আটশো বর্গফুট এই ফ্ল্যাট-বাড়িতে দোলন এখন একেবারে একা।

পাঁচতলা এই বিল্ডিং-এ আলো বাতাস খুবই কম ঢোকে। গুমোট লাগে দোলনের। জানলা-দরজাগুলো খুলে সামান্য আলো ঢোকানোর চেষ্টা করে সে। ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়ায়। রেলিং-এ হাত দিয়ে নীচে ছড়িয়ে থাকা শহরটা দেখার চেষ্টা করে। পাঁচ বছর হয়ে গেল সে এই বিরাট শহরের বাসিন্দা অথচ আজও একে নিজের বলে ভাবতে পারল না। সব যেন কেমন প্রাণহীন! ছোট্ট একটুকরো বারান্দায় বেশ কয়েকটা ফুল গাছ লাগিয়েছে দোলন। এই বারান্দাটাই তাকে বাড়ির স্মৃতিকে মনে করায়। সামান্য হলেও এই প্রাণহীন শহরে এক চিলতে নিজের গ্রাম গড়ে তুলেছে দোলন।

মলয় দোলনকে স্পেস দেয়। থাকতে দেয় নিজের মতো করে। দোলনের ভালো লাগে খুব। তবু কেন জানি না, কিছুতেই বুঝতে পারে না, এই পাঁচবছরে শহরটার মতো মলয়কেও তেমন করে আপন ভাবতে পারল না দোলন।

॥ ২ ॥

কী চ্যাটার্জী? তিনদিন তো ছুটি পেলে, তা বউদিকে নিয়ে কোথাও যাওয়া-টাওয়ার প্ল্যান করলে নাকি?

টেবিলে পড়ে থাকা ফাইলগুলো ডেসপ্যাচ করার আগে আরও একবার চোখ বুলিয়ে দেখছিল মলয়। কাল শুক্রবার, ম্যানেজিং ডিরেক্টরের একজন মারা যাওয়ায় হঠাৎ একটা ছুটি পাওয়া গিয়েছে, তারপর শনি-রবি। ইচ্ছে করলেই কাছে-পিঠে কোথাও ঘুরে আসা যায়। ফাইল থেকে মুখ তোলে মলয়। তারপর হেসে বলে নাহ, যাওয়া হবে না দাদা।

আরে ঘুরে এসো। মন্দারমণি, শঙ্করপুর অথবা ডায়মন্ড হারবারও যেতে পারো! যাওনি তো বউদিকে নিয়ে কোথাও।

একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করে মলয়। মুখে বলে হবে না গো বোসদা। অন্য কাজ আছে।

অভিজ্ঞ বোসবাবু আর কথা বাড়ান না, মলয়ের কাঁধে হাত দিয়ে আলতো চাপ দেন শুধু।

বোসবাবু চলে গেলে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে মলয়। দোলনের কথা মনে পড়ে তার। মনে মনে ভাবে যাওয়া তো যেতই কিন্তু দোলন কিছুতেই রাজি হবে না। কিছু না কিছু বাহানা বানাবেই। পাঁচবছর বিয়ে হয়েছে তাদের, কিন্তু দোলনকে আজও চিনতে পারে না মলয়। কী চায় মেয়েটা? আদৌ কি কিছু চায়? সারাদিন বাড়িতে বসে বসে মলয়ের ফেরার অপেক্ষায় রান্নাবান্না করে, ঘর পরিষ্কার করে, পুজো করে আর তার সংসার সামলায়। কিন্তু কিছুতেই বাড়ি থেকে বেরোতে চায় না। প্রথম প্রথম খুব জোর করত মলয়। মনের মতো করে সাজাতে চাইত দোলনকে। শেষ পর্যন্ত সে হেরেই গেল।

গ্রামের মেয়ে দোলন। এক ঘটক মলয়ের মাকে ছবিটা দিয়ে গিয়েছিল। এক ঝলক দেখেই পছন্দ হয়ে যায় তার। অমন টানা টানা চোখ, টিকোলো নাক, দুধে আলতা গায়ের রং মলয়ের না করার কোনও কারণ ছিল না। বিয়ের পর পরই কলকাতায় নিয়ে আসে মলয় দোলনকে। আর তখনই মলয় টের পায় দোলন যত সুন্দরী তার চাইতেও বড়ো কথা সে অসম্ভব কুসংস্কারাচ্ছন্ন এবং ঘরকুনো, আনস্মার্ট একটা মেয়ে।

তবু ভালো মানুষ মলয় সবটা মেনে নিয়েছিল। বিয়ের পর পর দু’একটা পার্টিতেও নিয়ে গিয়েছিল প্রায় জোর করেই। স্বাভাবিক ভাবেই অন্যান্যদের কাছে হাসির পাত্র হয়েছে সে। যদিও এসব কিছুই দোলনকে বুঝতে দেয়নি কোনওদিন মলয়। শুধু ওদের দূরত্ব বেড়েছে ক্রমে ক্রমে। সব আছে কিন্তু কী একটা যেন নেই! হয়তো দোলনও তা টের পায় কিংবা পায় না, কে জানে!

একবার দিঘাও বেড়াতে গিয়েছিল তারা। মলয় অবাক হয়ে দেখেছিল বাড়ির পুরো ঠাকুর ঘরটাই তুলে এনেছে দোলন হোটেলের রুমে। মুহূর্তে একসঙ্গে সমুদ্রস্নানের আমেজ মাটিতে মিশে গিয়েছিল তার। ব্যস! সেই শেষ! আর কোথাও যাওয়ার কথা বলেনি কোনওদিন। দোলনও যেতে চায়নি।

॥ ৩ ॥

বৃহস্পতিবারের পুজো সারতে সারতে আজ বেশ বেলা হয়ে গেল দোলনের। সকাল থেকে না খাওয়া কাপড় ছেড়ে রান্নার আয়োজনে লেগে পড়ে দোলন। মলয় দুপুরে আসে না। ফিরতে ফিরতে বেশ রাত হয়। তবু রোজ নানা রকম রান্না করে দোলন। টেবিলে সাজিয়ে রাখে। আজ শরীরটা বিশেষ ভালো নেই। ডাল আর চাল মিশিয়ে তার মধ্যে দুটো খোসা ছাড়ানো আলু দিয়ে দেয়। অবশ্য না খেলেও হয়। এমনি কতদিন সে উপোস করে থাকে।

দোলন আভেনে কুকারটা বসিয়ে বাইরের ঘরে সোফায় গিয়ে বসে। মাথার দুপাশের রগটা দপদপ করে ওঠে। ঘাড়েও প্রচন্ড চাপ। মলয়কে কি একটা ফোন করবে? ভাবতে ভাবতেই মাটিতে লুটিয়ে পড়ে দোলন।

অফিস ছুটি হলে বাসস্ট্যান্ড-এ এসে দাঁড়ায় মলয়। আকাশে ঘন কালো মেঘ। যখন তখন ঝেঁপে বৃষ্টি নামবে। এত সুন্দর ওয়েদার, একটু লাল জলে গলা ভেজালে বেশ হতো। কিন্তু বাড়িতে দোলন গোপালের আসন পেতেছে, সেসব ঢোকানো বারণ। মনে মনে বিরক্ত হয় মলয়। সত্যি দোলন তার ভালোমানুষির বড়ো বেশি সুযোগ নিচ্ছে না তো? অন্য কেউ হলে! দোলনের উপর রাগ বাড়তেই বন্ধু অনিরূদ্ধকে ফোন করে মলয়। তারপর উলটো দিকের বাসে চড়ে চলে যায় ওদের পুরোনো ঠেকে, বন্ধ করে দেয় মোবাইলের সুইচ।

রাত বাড়তে থাকে, পাল্লা দিয়ে বৃষ্টি। মলয়ের বেশ নেশা হয়েছে আজ। তার মধ্যেই টের পায় আজ বাড়াবাড়িটা বেশিই হয়ে গেল বোধহয়। বন্ধু অনিরূদ্ধকে বলে, আমায় বাড়ি দিয়ে আসবি রে, বড্ড দেরি হয়ে গেল। দোলন ভয় পাবে।

অনিরূদ্ধর কয়েক পেগেও সমস্যা হয় না। সে গাড়ি স্টার্ট দেয়। জানলার কাচে হেলান দিয়ে চোখ বুঁজে বসে আছে মলয়। মনে মনে অস্থির হয়ে উঠেছে সে। হঠাৎই সাংঘাতিক ভাবে গাড়িটা পাশ কাটায় অনিরূদ্ধ। মলয় চমকে উঠে বলে, কী হল রে?

আরে একটা কালো বিড়াল! এমনিতেই বৃষ্টি, ভালো দেখা যাচ্ছে না।

মলয় চিন্তিত গলায় বলে, মারলি নাকি?

অনিরূদ্ধ স্টিয়ারিং ঘোরাতে ঘোরাতেই সহজ ভাবে বলে, নাহ, মরেনি ব্যাটা একটুর জন্য। রাস্তাটা পেরিয়ে গেল।

মলয় উত্তেজিত হয়ে বলে উঠল, সেকি? রাস্তা কাটল নাকি? থামলি না কেন?

অনিরূদ্ধ মলয়ের ছোটোবেলার বন্ধু। তার জীবনের কথা সে জানে সবটাই। অবাক চোখে বন্ধুর দিকে তাকায় সে, কিরে তুইও কি দোলনের মতো…।

থতমত খেয়ে যায় মলয়। তাড়াতাড়ি বলে, আরে না রে, ওই বললাম আর কী!

কিন্তু সারা রাস্তা মনটা খচখচ করতেই থাকে তার।

॥ ৪ ॥

কয়েকবার কলিংবেল বাজানোর পরও যখন ওপাশ থেকে দোলন দরজা খোলে না, তখন ডুপ্লিকেট চাবিটা বের করে মলয় ব্যাগ থেকে। ঘর অন্ধকার, দোলন কি তবে ঘুমিয়ে পড়েছে? গা ছমছম করে ওঠে! নেশাটাও অনেকটাই কেটে গেছে এতক্ষণে। আলো জ্বালিয়ে দোলনকে ডাকতে গিয়ে চোখে পড়ে সোফার উপর আড়াআড়ি ভাবে পড়ে আছে দোলন। মুখ দিয়ে সাদা ফেনা বেরিয়ে শুকিয়ে গিয়েছে অনেকক্ষণ। ছুটে গিয়ে দোলনের মাথাটা কোলে তুলে নেয় মলয়। ততক্ষণে দোলনের শরীর বরফের চাইতেও ঠান্ডা হয়ে গেছে।

মলয় দিশেহারা হয়ে পড়ে। সকালেই তো সুস্থ ছিল মেয়েটা! হঠাৎ কী এমন হল যে… পাগলের মতো দোলনের নাম ধরে ডাকতে থাকে মলয়।

না, আর কোনওদিন সাড়া দেয়নি দোলন। পাঁচবছরের দাম্পত্যের মায়া এক ঝটকায় ছেড়ে দিয়ে সে চলে গিয়েছে অনেক দূরে। মলয় বুঝতে পারে, দোলনের কাছাকাছি পাশাপাশি থেকেছে কিন্তু ওর মনের হদিশ পায়নি কোনওদিন। পাওয়ার চেষ্টাও করেনি। এমনকী মেয়েটা নিজের যত্ন নিত কিনা তাও জানে না মলয়। নির্ঝঞ্ঝাট ভালো মানুষ বলে নিজেকে নিয়ে গর্ব করত মলয়। আজ তা ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে দোলন নামে গ্রামের কুসংস্কারাচ্ছন্ন মেয়েটা।

দিন পেরিয়ে যায় মলয় টের পায় দোলন ছেড়ে গেলেও তাকে দিয়ে গিয়েছে তার যাবতীয় বিশ্বাস, ধ্যান ধারণা।

এমবিএ পাশ করা ঝকঝকে ছেলেটা আজকাল গোপালকে খাইয়ে অফিস যায়। পেছন থেকে কেউ ডাকলে দুমিনিট দাঁড়ায় আর বেরোবার মুখে হাঁচি এলে নাক টিপে ধরে, ঠিক যেমন করে ধরতে বলত দোলন।

দোলনের রেখে যাওয়া কুসংস্কার ছোঁয়াচে রোগের মতো সংক্রমিত হয় মলয়ের মনে। মলয় জানে এই রোগ থেকে সে আর আজীবন মুক্তি পাবে না।

ভিওয়ানির রহস্য

শ্যামলের জীবনটা যেন কেমন একঘেয়ে হয়ে উঠেছিল। পড়াশোনা শেষ করে চাকরি না পেয়ে টিউশন করে আর কতদিন চলবে! এসব ভাবতে ভাবতে একদিন দিল্লিতে একটা ইন্টারভিউ পেয়ে গেল। দিল্লির কনটপ্লেস-এ ইন্টারভিউতে সিলেক্টও হয়ে গেল। জানতে পারল, চাকরিটা হরিয়ানার ভিওয়ানিতে। প্রথমে ভেবেছিল যাবে না। পরে ভেবে দেখল, ঘুরেই আসা যাক না। নতুন একটা জায়গা দেখেই আসা যাক। ভালো না লাগলে ফিরে আসবে নিজের রাজ্যে।

বাবা-মা ও বন্ধুদের উৎসাহে বেরিয়ে পড়ল ভিওয়ানির উদ্দেশে। প্রথমে ট্রেনে করে দিল্লি পৌঁছোল, সেখান থেকে বাসে করে নানারকম অভিজ্ঞতা নিয়ে ভিওয়ানিতে নিজের গন্তব্যস্থলে পৌঁছোতে অনেক সময় লেগে গেল। ওখানে পৌঁছে তার নামে অ্যালট করা কোয়ার্টারও পেয়ে গেল। কোয়ার্টার-এ জিনিসপত্র রেখে দেখল ঘড়িতে চারটে বেজে গেছে। দুপুরের খাওয়া অবশ্য পথে একটা ধাবাতেই করে নিয়েছিল।

অনেক দূরের জার্নি বলে বাসওয়ালারা মাঝপথে এক জায়গায় বাস থামিয়ে বলেছিল, যাদের খিদে পেয়েছে তারা এই ধাবাতেই দুপুরের খাওয়া খেয়ে নিতে পারেন। তবে সময় মাত্র ১৫ মিনিট দেওয়া হবে। তার মধ্যে খেয়ে বাসে এসে বসতে হবে। শ্যামলও সে সুযোগ ছাড়েনি। কারণ বুঝতে পেরেছিল এখন না খেলে ওখানে গিয়ে আজ লাঞ্চ কপালে নাও জুটতে পারে, তাই খাওয়াটা সেরে নিয়েছিল। তবে সে যা খাওয়া তা অন্য সময় হলে হয়তো ফ্রিতেও খেতে চাইত না। তবুও কোনও উপায় নেই ভেবে খেতেই হল!

ঘড়ির দিকে তাকিয়ে ভাবল এবার আশেপাশে একটু ঘুরে দেখে আসা যাক। রাতের খাবারটা কোথায় খাবে ইত্যাদি। কারণ কোম্পানি থেকে থাকার জায়গাটা ফ্রি দিয়েছিল কিন্তু ভেতরে রান্নার কোনও জায়গা ছিল না। তাছাড়া সোমবার থেকে জয়েনিং বলে রোববারে এসে পৌঁছোবার ফলে, অফিসের থেকে খোঁজও নেওয়া যাবে না। এসব ভাবতে ভাবতে বেরিয়ে পড়ল। ভাবল ফেরার পথে রাতের খাবারটাও খেয়ে ফিরবে।

কোয়ার্টার থেকে বেরোবার সময় একজনকে জিজ্ঞাসা করে জানল, তাদের এই জায়গা থেকে শহর একটু দূরেই, তাই রিকশাতেই যাওয়া ভালো। দেরি না করে একটা রিকশা নিয়ে শহরে পৌঁছে গেল। গিয়ে দেখল সেখানে বেশকিছু দোকানপাট আছে ঠিকই কিন্তু সে হিসেবে এটাকে শহর বললে একটু অপমানই করা হবে মনে হয়।

হঠাৎ নজরে পড়ল একটা দোকানে কুলফি মালাই বিক্রি হচ্ছে। লোভ সামলাতে না পেরে ঢুকে পড়ল সেখানে। কুলফিটা খেয়ে দাম দিতে গিয়ে দেখল যে, অতদূরের রিকশা ভাড়া নিয়েছে মাত্র দশ টাকা আর কুলফি নিল চল্লিশ টাকা। বেশ বুঝতে পারছিল ইচ্ছে থাকলেও এ শখ রোজ পূরণ করা যাবে না। এরপর অনেক দোকান-বাজার ঘুরে খাবারের দোকানের খোঁজে এগোতে লাগল।

হাঁটতে হাঁটতে কখন যেন লোকালয়ে গলিতে ঢুকে পড়েছিল খেয়াল নেই। হঠাৎ একটা বিকট চিৎকারে প্রায় আত্মারাম খাঁচা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জোগাড়। পরক্ষণেই দেখল কতকগুলো মযূর এক ছাদ থেকে অন্য ছাদে লাফিয়ে যাচ্ছে আর ওই অদ্ভুত বিকট চিৎকার করছে। সন্ধে হয়ে গেছে তাই তারাও ফিরে যাচ্ছে তাদের বাসায়।

মনে মনে ভাবল, ঈশ্বরের কী অদ্ভুত সৃষ্টি! মযূর দেখতে এত সুন্দর কিন্তু তার আওয়াজ যে এত কর্কশ, তা না শুনলে কেউ বিশ্বাস করবে না। একসাথে প্রায় চল্লিশ-পঞ্চাশটা মযূর ডেকে ওঠাতে শ্যামল প্রথমটা খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিল। এ ধরনের বিকট আওয়াজ সে কখনও শোনেনি। যখন সে খাবার হোটেলে গিয়ে পৌঁছোল তখন সন্ধে হয়ে গেছে।

হোটেলে গিয়ে শুনল আজ স্পেশাল ডিশ হল, ক্ষীর। শুনেই জিভ দিয়ে জল বেরিয়ে আসছিল শ্যামলের। মনটা আনন্দে ডগমগ করে উঠল। কিন্তু এই আনন্দ বেশিক্ষণ স্থাযী হল না। এই ক্ষীর খাওয়ার অভিজ্ঞতা সে কখনও-ই ভুলবে না!

ক্ষীর খেয়ে বুঝতে পারল যে, এখানে দুধের পায়েসকে ক্ষীর বলা হয়। আর সেটা দুধের পায়েসও বলা চলে না। সেটা একেবারে দুধ-ভাত ছাড়া আর কিছু নয়। প্রথম দিনই এমন ক্ষীর খাওয়াতে এখানে বাইরে খাওয়ার উৎসাহটা একটু কমে গেল।

সেখান থেকে কোয়ার্টারে ফেরার সময় থেকেই গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি শুরু হল। কোয়ার্টারে যখন ফিরে এল তখন বৃষ্টির গতিও অনেক বেড়ে গেছে। বৃষ্টির শাব্দিক অনুভূতিটা বরাবরই তার কাছে বেশ আনন্দময় কিন্তু আজ যেন কেমন একটা গা শিরশির করা ব্যাপার আছে বলে মনে হচ্ছে। এমনিতেই শীত পড়তে শুরু করেছে। শীতকে আরও জমিয়ে তুলতে আবার বৃষ্টি শুরু হয়েছে। সুতরাং গা শিরশির করাটাই স্বাভাবিক।

ঘরে দুটো জানলা। আজ যেন কেন দুটো জানলাই বন্ধ করতে ইচ্ছে হচ্ছে শ্যামলের। দুমিনিটের ভেতরেই জানলা দুটো বন্ধ করে এসে চেয়ারে বসতেই, বারান্দার দিকের জানলাতে হঠাৎ খট করে শব্দ হল। চমকে উঠল শ্যামল। বারান্দাটা গ্রিল দিয়ে ঘেরা। ওখানে তালাও নিজে লাগিয়ে এসেছে। তাই সেখানে কেউ ঢোকার প্রশ্নই ওঠে না। এমনকী তালাটা সে বাড়ি থেকেই নিয়ে এসেছিল। নিজের তালা-ই লাগিয়েছে।

মোটা কাঠের জানলা। এমনিতেই এখন বন্ধ। তাই বৃষ্টির দিনে এমন জোরে খট করে শব্দ করাটা মোটেই স্বাভাবিক নয়। শ্যামলকে বেশি ভাবতে সময় দিল না ওপাশের কেউ। আবার খট করে শব্দ হল। শ্যামল ভাবতে লাগল, যেহেতু বারান্দাটা পুরো গ্রিল দিয়ে ঘেরা ও তালা দেওয়া, তাই গ্রিল পেরিয়ে আসা কারও-র পক্ষে সম্ভব নয়। এই দুর্ভেদ্য সুরক্ষা ভেদ করে জানলায় এসে ধাক্কা মারার কথা নয়।

শ্যামল চেঁচিয়ে উঠল কে… কে ওখানে? কিন্তু এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া গেল না। জানলায় আবার খট করে আওয়াজ হল। শব্দটা ক্রমশ যেন বাড়তে শুরু করল।

( ২ )

একে তো শীতের রাত, তার ওপর এই জায়গায় সে একেবারে নতুন। ভাবল এখানে সে নতুন, কেউ হয়তো ভয় দেখানোর জন্য এসব করছে। বিছানায় শুয়ে পড়ল কিন্তু শুয়ে ঘুম আসছিল না। আওয়াজটা ক্রমশ বাড়ছিল। বিছানায় শুয়ে ঘেমে নেয়ে অস্থির হয়ে গেল সে।

অন্যদিকের জানলাটায় কেউ ধাক্কা দিলে সে অন্তত বুঝতে পারত যে, এই বৃষ্টির দিনে হয়তো কোনও আগন্তুক বাইরে দাঁড়িয়ে ধাক্কা দিচ্ছে। কিন্তু গ্রিল দিয়ে ঘেরা এই জানলাটায় কেউ ধাক্কা দেবে কি করে! কিছুতেই এ কথাটা তার মাথায় ঢুকছিল না। তাছাড়া শোওয়ার আগে তালা দিয়ে বন্ধ করে এসেছে। এসব আবোল তাবোল চিন্তা করতে করতে তার সব কিছুই যেন কেমন গুলিয়ে যেতে লাগল।

জানলাটায় ধাক্কাটা এবার থেমে থেমে আসছে। অনবরত ধাক্কা দিয়ে মানুষ যেমন ক্লান্ত হয়ে যায়, মনে হচ্ছে ওপাশের কেউ তেমনি ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। আসলে ওপাশে কি কেউ আছে, না পুরোটাই তার মনের ভুল! হয়তো শুধু বৃষ্টিই হচ্ছে, আসলে হয়তো জানলায় কোনও ধাক্কার শব্দ হচ্ছে না। পুরোটাই তার মনের ভুল নয়তো!

শ্যামল এগিয়ে যায় জানলার দিকে, কান খাড়া করে আওয়াজটা শোনার চেষ্টা করে। কিন্তু একি, সত্যিই তো মনে হচ্ছে কেউ কয়েক সেকেন্ড পর পর একই তালে ঠক ঠক করে চলেছে। এবার তার মনে হতে লাগল হয়তো মনের ভুলে সে গ্রিলের তালাটাই লাগাতে ভুলে গেছে আর সেই সুযোগ নিয়ে কেউ হয়তো ঢুকে পড়েছে বারান্দায়। কিন্তু এত রাতে কে হতে পারে? তবে কি চোর! আর চোর হলে সে জানলায় কেন ধাক্কা দেবে। চোর হলে তো নিঃশব্দে আসবে। জানিয়ে আসবে কেন!

শ্যামলের মাথায় নানা প্রশ্ন এসে ভিড় করতে শুরু করেছে। কেউ কি তাকে ভয় দেখানোর জন্য এসব করছে? নাকি কোনও বোবা লোক বিপদে পড়ে জানলায় খট খট আওয়াজ করছে? নাকি অন্য কোনও প্রাণী? মনে পড়ে যায়, একবার তার বাড়িতে গ্রিলের ফাঁক দিয়ে ভাম-বিড়াল ঢুকে গিয়েছিল বারান্দায়। সেরকম কিছু নয়তো?

প্রথমে ভেবেছিল দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে দেখবে। কিন্তু পরক্ষণে ভাবল না এত রাতে এই অজানা জায়গায় সেটা হয়তো ঠিক হবে না। এসব নানা অজানা আশঙ্কায় শ্যামল অনুভব করল, ওর বুকের ভেতরটা কেমন যেন হাপরের মতো ওঠানামা করছে। কোনও চোর-ডাকাত নয়তো!

চিৎকার করে সে কি লোকজন জড়ো করবে? এবার সে জোরে চেঁচিয়ে ওঠে, কে ওখানে? কিন্তু কোনও উত্তর এল না। এত রাতে জানলার শব্দ এবং নিজের ধারণা সম্বন্ধে স্পষ্ট ভাবে নিশ্চিত হতে পারল না বলেই, চিৎকার করতে তার ভীত-সন্ত্রস্ত সত্ত্বা বারণ করে দিল।

( ৩ )

এবার মনে হল বৃষ্টির তালে তালে কেউ যেন নাচছে আর তার পায়ে নূপুর ও হাতের চুড়ির আওয়াজ যেন তালে তালে বাজছে। এতে শ্যামলের মাথার ভেতরে কেমন যেন এক বিভ্রান্তির সৃষ্টি হতে লাগল। ভেবে কূল-কিনারা পাচ্ছে না। সত্যিই কি কেউ বাইরে নাচছে, না এসব তার মনের ভুল!

এমনিতে শ্যামল খুব একটা ভয় পাওয়ার ছেলে নয়। এর আগে পাড়ায় কেউ মারা গেলে অনেক গভীর রাতেও তাকে নিয়ে দাহ করে এসেছে। সামাজিক পরোপকারে তার জুড়ি নেই। জানলার শব্দটাও থেমে গেছে নূপুরের ও হাতের চুড়ির আওয়াজের সাথে সাথে। তার মনে হচ্ছে কেউ নাচছে তার বারান্দায়, ঠিক জানলার পাশে। মাথাটা কেমন যেন বন বন করে ঘুরছে মনে হচ্ছে।

কল্পনায় সে দেখতে পেল রাজা-বাদশাদের হারেমখানার কোনও নর্তকী যেন সুযোগ পেয়ে আজ এই বারান্দায় এসে তার আসর বসিয়েছে। খালি তফাত হল, ঘরভর্তি শ্রোতা নেই। শ্রোতা শুধু একজন। আর সেটা হল সে নিজে।

ঘরের আলোটা জ্বলছে। শ্যামল আয়নাটার দিকে এগিয়ে গেল। হঠাৎ নিজের মুখ দেখতে গিয়ে চমকে উঠল। আয়নায় এক নারীমূর্তি। এ কী করে সম্ভব। পেছন ফিরে দেখল, জানলার কপাট কখন খুলে গেছে বুঝতেই পারেনি। মনে হল কোনও এক নারী মূর্তি যেন জানলা থেকে সরে গেল। অন্য জানলাটা কিন্তু বন্ধই রয়েছে। নিমেষেই ঘোর কেটে যায়। বুঝতে পারে, সে ঠিকই শুনেছে এবং দেখেছেও ঠিকই। আবার সেই নারী মূর্তি যেন তার জানলা দিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে। এরপর আর তার কিছুই মনে নেই।

( ৪ )

যখন জেগে উঠল তখন বুঝতে পারল, সে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল। তখনও বারান্দার দিকের জানলাটা হাট করে খোলা। অথচ অন্যদিকের জানলাটা এখনও বন্ধই রয়েছে। রাতের ঘটনাটা তাহলে কি শুধুই তার মনের ভুল নাকি সত্যি!

গতকাল রাতের ঘটনাটা মনে করতেই আবার যেন কেমন একটা ভয় এসে বাসা বাঁধছিল। জানলা দিয়ে দেখা যাচ্ছে বাইরে ভোরের আলো ফুটে উঠেছে। তাই মনেও একটু সাহস পেল। বাইরে থেকে কিছু লোকের কোলাহলও এসে কানে পৌঁছোল।

শ্যামল ধীর পায়ে বারান্দায় পা রাখল। দেখল গ্রিলের গেটে যে-তালাটা গতকাল রাতে লাগিয়েছিল সেটা এখনও বন্ধই আছে। এটা দেখে ভাবল, তাহলে গতকালের ঘটনাটা হয়তো মনের ভুল হতে পারে। কিন্তু তার এই ধারণা বেশিক্ষণ স্থাযী হল না, নিমেষেই বদলে গেল। বারান্দায় কিছু পড়ে থাকতে দেখে এগিয়ে গিয়ে নীচে তাকিয়ে দেখল একটা গলার চেন ও একটা লকেট পড়ে আছে।

এগুলো দেখার পর শ্যামলের মন থেকে অনেকটাই বিভ্রান্তি কেটে গেল। কারণ সে নিশ্চিত যে গতকাল কেউ এখানে এসেছিল। তবে ওই লকেট ও গলার চেনটা তোলার সাহস তার হল না। কেউ যে এসেছিল তার প্রমাণ তার সামনে হাজির রয়েছে। ভাবল ব্যাপারটা প্রতিবেশীদের কাউকে জানালে হয়তো কিছু হদিশ পাওয়া যেতে পারে। বাড়ি থেকে বেরিয়ে বাইরে এসে দেখল পাশের কোয়ার্টারের সামনে বেশ কিছু লোক জড়ো হয়ে কী সব যেন আলোচনা করছে।

( ৫ )

সেখানে পৌঁছে যা শুনল তা শুনে একেবারে হতভম্ব হয়ে গেল শ্যামল। শুনল গতকাল পাশের বাড়ির মেয়েটি বৃষ্টি শুরু হওয়ার পর আত্মহত্যা করেছে। আর আশেপাশের অনেক বাড়িতেই ওর উপস্থিতি অনুভব করেছে প্রতিবেশীরা। প্রায় একই রকম ভাবে যেরকম শ্যামল অনুভব করেছে।

প্রতিবেশীদের আলোচনার বিষয়ে একটা কথা সবাই বলছিল যে, গতকাল রাতে তাদের বাড়িতে কেউ এসেছিল। কিন্তু শ্যামল লক্ষ্য করল সবাই অনেক কথা বললেও তাদের বাড়িতে কেউ গলার চেন ও লকেট পেয়েছে বলে বলল না। ব্যাপারটা ভেবেই রাতের সেই অনুভূতি যেন আবার শীতল হয়ে নেমে গেল শ্যামলের মেরুদণ্ড বেয়ে। ভয়ে ভাবনায় কেমন যেন একটা অস্বস্তি অনুভব করতে শুরু করল শ্যামল।

শ্যামলের খালি মনে হতে লাগল, আবার যদি রহস্যমযী সেই মেয়েটি রাতে তার কাছ থেকে ফেলে যাওয়া লকেট ও চেনটা ফেরত চাইতে আসে, তখন কী হবে?

 

সুপর্ণার গোপন পাণ্ডুলিপি

অভিরূপ তাকিয়ে দ্যাখে– একজন যুবতি তাঁর খোঁজ করছে। ইশারায় পাশের লোকটিকে সে উঠে যেতে বলে। সামান্য বিরক্ত হয়ে লোকটি উঠে যায়। যদিও মুখে প্রকাশ করার সাহস পায় না। সম্পাদক ব’লে কথা। তাছাড়া রবিবারের পাতার দায়িত্বে সে। সামান্য লেখা ছাপানোর জন্যও তেল মারতে হয়। কখনও ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা। ফ্রিল্যান্সাররা মাছির মতো সর্বক্ষণ ঘুরঘুর করে তার পেছনে। অভিরূপ বেশ মজা পায়, উপভোগও করে। চশমার ফাঁক দিয়ে ফের একবার যুবতিকে দ্যাখে। চেনা কি? প্রেসক্লাবে বা অন্য কোথাও ট্রামেবাসে কিংবা পথ চলতে গিয়ে হঠাৎ? মনে পড়ছে না। মোটামুটি সুন্দরী, একটা আলগা জৌলুস আছে। একান্তে নিভৃতে কথা বলা যায়। যুবতিটি নমস্কার ক’রে সামনের চেয়ারে বসে। অভিরূপ একটা সিগারেট ধরায়। যুবতি বলে– আমার নাম সুপর্ণা। সুপর্ণা মজুমদার।

– আমার কাছে? আমাকে চেনেন?

নীলাদি পাঠিয়ে দিলেন। নীলা সরকার। আমাদের পাশের ফ্ল্যাটেই থাকেন। আপনাদের অফিসে চাকরি করেন। শিল্পসংস্কৃতির পাতা দ্যাখেন। সিডি ক্যাসেট ইত্যাদি রিভিউ করেন। আর তাছাড়া আপনি বাংলা সাহিত্যের এতবড়ো একজন নামজাদা লেখক। এ-বছর বইমেলায় কোন্ এক পত্রিকার পক্ষ থেকে আপনার গল্পগ্রন্থের উদ্বোধনও হল। ‘ভালোবাসার ঋতুস্নান’ আমি পড়েছি। সত্যিই অন্যধারার। এছাড়া সোপান, জীবনানন্দ পুরস্কার… অভিরূপ লক্ষ্য করে– সুপর্ণা বেশ তৈরি হয়েই এসেছে। বেশ স্মার্ট।

– আমার গল্প আপনার ভালো লাগে?

সুপর্ণা ঠোঁটটা একবার জিভে বুলিয়ে নিয়ে বলে– ভালো লিখলে কেন লাগবে না। ইদানীং বাংলা গল্পের যা ছিরি! সস্তা প্রেমের গল্প। রিয়েলি ট্র্যাশ।

প্রশংসা শুনতে কার না ভালো লাগে। বিশেষত কোনও সুন্দরী যুবতির মুখোমুখি ব’সে। সুপর্ণা ব’লে চলে– আপনার গল্পের স্টাইলই আলাদা। বেশ ভাবায়। বিষয়ও বেশ গম্ভীর, সিরিয়াস।

– আর্ট ফিল্মের মতো কি?

– আর্ট-কমার্শিয়াল বুঝি না। তবে দর্শকের মতো পাঠকের সংখ্যাও হাতেগোনা মুষ্টিমেয় হয় যদি, ক্ষতি কী? দে আর ইনডিড্ কমিটেড্।

– বাঃ, তফাতটা সত্যিই ধরেছেন তো! আসলে কী জানেন, পাঠকই তো সব। তা, এদের সংখ্যাই যদি আর্ট ফিল্মের মতো হাতেগোনা হয়, চিন্তা হয় বই-কি। ওদের সার্টিফিকেট-ই তো আসল।

অভিরূপ সিগারেটটা অ্যাশট্রেতে ফেলে বলে– কী খাবেন, কফি না চা? সুপর্ণা সামান্য ইতস্তত করে। অভিরূপ অর্ডার দেয়। কফিতে হালকা চুমুক দিয়ে সুপর্ণা বলে– একটা গল্প এনেছিলাম।

অভিরূপ এবার চাঁছাছোলা অফিসিয়াল ভঙ্গিতে জবাব দেয়– ফাইলে অনেক গল্প জমা হয়ে আছে। প্লিজ ডোন্ট টেক ইট আদারওয়াইজ। সুপর্ণা কিছুটা হতাশ হয়। অভিরূপ বলে চলে– আপনার লেখা কোথাও পড়েছি বলে মনে হয় না। আই মিন কোনও লিট্ল ম্যাগাজিনে। হাত পাকানোর ওগুলোই তো আসল জায়গা।

সুপর্ণা বলে– দু’একটা জায়গায় পাঠিয়েও ছিলাম। মেম্বার হতে হবে। বিজ্ঞাপন-টন জোগাড় করে দিলেও চলে। গ্রুপিং আছে। একটা লেখা ছাপানোর জন্য যে এত কসরৎ, আগে জানতাম না। অভিরূপ চশমার উপর ভ্রূ কুঁচকে বিস্মিত হয়ে জানতে চায়– তাই না-কি? সুপর্ণা বলে চলে– আসলে নীলাদির উৎসাহে… শুনেছি আপনি বড়ো ভালো…। অভিরূপ হঠাৎ হো হো ক’রে হেসে ওঠে। হাসি থামিয়ে বলে– কিছু মনে করবেন না। কথা দিতে পারছি না। নির্বাচিত হলে ছাপা হবেই।

– কতদিন পরে জানতে পারব?

– মাস তিনেক।

এর মধ্যে রোগা লম্বা এক গাল দাড়ি, কাঁধে ঝোলানো শান্তিনিকেতনি ব্যাগ নিয়ে এক যুবক কাচের ঘরের বাইরে অপেক্ষার পর মোটামুটি অধৈর্য হয়ে দরজা সামান্য ঠেলে মুখ বাড়িয়ে বলল– অভিদা…

অভিরূপ খানিকটা বিরক্ত হয়ে বলে– তুমি!

– আজ্ঞে আমার গল্পটা।

– বললাম না বাইরে অপেক্ষা করতে।

– আজ্ঞে ছ’মাস হয়ে…

– কী জ্বালাতন! কী যেন নাম গল্পটার?

– ‘বসুন্ধরা তুমি দিলে’।

– ও। কিছু মনে কোরো না, আর একটা গল্প জমা দিও। কোথায় যে রেখেছি…

যুবকটি আদ্যন্ত বিস্মিত ও হতাশ হয়ে মাথা নেড়ে বিদায় নেয়।

সুপর্ণা বিনীতভাবে বলে– বাব্বা, আপনাকে কতকিছু ফেস করতে হয়।

– সম্পাদকের দায়িত্ব সাংঘাতিক।

হঠাৎ ক্রিং ক্রিং শব্দে ফোন বেজে ওঠে। অভিরূপ রিসিভার তুলে বলে– হ্যালো। ওপাশ থেকে কণ্ঠস্বর শোনা যায়– সুকান্ত বলছি।

– কে সুকান্ত?

– সুকান্ত বসু। এর মধ্যে ভুলে গেলেন। গত শনিবার চাংওয়া বার-এ কত আড্ডা মারলাম। আপনার মাইরি দম আছে। তিন পেগ এক নিঃশ্বাসে সোডা না-মিশিয়ে…

– মনে পড়েছে।

– আমার গল্পটা।

– যাবে। আগামী সপ্তাহে অথবা তার পরের সপ্তাহে। ডেফিনেটলি।

– ধন্যবাদ।

সুপর্ণা বলে– আজ উঠি তাহলে। অভিরূপ প্রত্যুত্তরে বলে– উঠবেন? চলুন আপনাকে এগিয়ে দিই।

– নো থ্যাঙ্কস্। তার কোনও দরকার হবে না।

– ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড, আপনার ফোন নম্বর…

সুপর্ণা ফোন নম্বর দেয়।

রবিবারে স্বভাবতই ঘুম ভাঙে দেরিতে। একটা ফুরফুরে আয়েশি ভাব জড়িয়ে থাকে সারা দেহে। বেড-টি হাতে নিয়ে সুপর্ণা টিভির সুইচ অন করে। ‘গুডমর্নিং কলকাতা’ হচ্ছে। এর আগে, ঘুম থেকে উঠেই খবরের কাগজটা নিয়েই সাপ্লিমেন্টটা আগে খুলে দেখত। ভিতরে ভিতরে একটা চাপা উত্তেজনা। গল্পটা প্রকাশিত হল কি-না। মাসখানেক ধরে একই অভ্যাস। ছাপা হচ্ছে না। ক্রমশ আশা ছেড়েই দিয়েছিল। হঠাৎ ছোটোভাই বিল্টু ঘরে ঢোকে কাগজ নিয়ে– দিদি তুই তো ছুপা রুস্তম মাইরি! সুপর্ণা কিছু বুঝতে পারে না।

– তোর গল্প ছাপা হয়েছে। আমরা কেউ জানিই না!

– কই দেখি? সুপর্ণা বিল্টুর কথা বিশ্বাসই করতে চায় না– ইয়ার্কি মারিস না। বিল্টু রসিকতা করে– মহাশ্বেতা নাকি আশাপূর্ণা?

– দে আমার কাগজটা। বিল্টু দেয় না– উহুঁ, এত বড়ো সুখবর। বল কী খাওয়াবি?

– তুই যা চাইবি।

– কী করে ম্যানেজ করলে গুরু?

সুপর্ণা মুখ ফসকে বলে ফ্যালে– অভি…

– অভি…।

– অভিরূপ। অভিরূপ ভট্টাচার্য।

– বাঃ দিদি জবাব নেই। একেই বলে এক ঢিলে দুই পাখি।

– এই ভালো হচ্ছে না বিল্টু।

সুপর্ণা টান মেরে কাগজটা ছিনিয়ে নিতে চেষ্টা করে। কাড়াকাড়িতে হঠাৎ ফ্যাড়ফ্যাড় করে ছিঁড়ে যায় কাগজটা। রাগ সামলাতে না-পেরে বিল্টুর গালে ঠাস করে একটা চড় মারে। নিজেও শিশুর মতো কাঁদতে কাঁদতে বলে– এ কী করলি তুই? আমার জীবনের প্রথম গল্প। …হঠাৎ ফোন বেজে ওঠে। রিসিভার তুলে সুপর্ণা বলে– হ্যালো!

– গুড মর্নিং মিস মজুমদার। কীরকম সারপ্রাইজ দিলাম? এবার, খুশি তো?

– ও মিঃ ভট্টাচার্য! কী অকৃতজ্ঞ আমি! ছিঃ ছিঃ! ফোনটা আমারই আগে করা উচিত ছিল। প্লিজ এক্সকিউজ মি।

– তাতে কি? এটা তো আমার কর্তব্য। আপনার প্রতিভার মূল্যায়ন হওয়া উচিত।

– সো কাইন্ড অফ ইউ, মিঃ ভট্টাচার্য। আপনি এত ভালো…

অভিরূপ হঠাৎ হো হো করে হেসে ওঠে।

– জীবনের প্রথম গল্প ছাপা হল, অথচ…

– হোয়াটস্ রং উইথ ইউ, মিস মজুমদার?

– ভাইয়ের সঙ্গে কাড়াকাড়ি করতে গিয়ে কাগজটা ছিঁড়ে…

– ও এই ব্যাপার। কতগুলো কমপ্লিমেন্টারি কপি লাগবে?

– একটাই যথেষ্ট।

– পেয়ে যাবেন। এইবারে অভিরূপ ঝোপ বুঝে কোপ মারার কথা বলে– আপনার গল্পটা অসাধারণ। আয়্যাম সো মুভ্ড। আপনার প্রতিভা আছে। আই ওয়ান্ট টু এক্সপোজ ইউ। বাংলা সাহিত্যে মহিলা লেখকের সংখ্যা হাতে গোনা। আরও লিখুন। আমি ছাপব। সম্ভব হলে রেগুলার কোনও কলাম। আয়্যাম অলওয়েজ উইথ ইউ। আপনি অসাধারণ।

সুপর্ণা নিরুত্তর। গ্যাস বেলুনের মতো হাওয়ায় ভাসতে থাকে শুধু। চোখের সামনে নাচতে থাকে প্রতিষ্ঠা, প্রশংসা, পুরস্কার।

এর মধ্যে আরও দুটো গল্প প্রকাশিত হয়েছে। পার্ক স্ট্রিটের অলি পাবের দো-তলায় এক নির্জন আলোছায়ার অন্ধকারে কোণের টেবিলে বসে দুজনে। কথা জড়িয়ে আসছে অভিরূপের। সুপর্ণার কাঁধে মাথা। হাত জড়িয়ে বুকের খুব কাছাকাছি। সুপর্ণা সোডামিশ্রিত তরলের অবশিষ্টাংশ গলায় ঢেলে বলে– অভি, আমি স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসি। আমাকে স্বপ্ন দ্যাখাও। প্লিজ। অভিরূপ মাথা নেড়ে, শুধু বলে– হুঁ।

– কবে দ্যাখাবে?

– আজ কাল পরশু। যেদিন দেখতে চাইবে।

– সেই স্বপ্নটা… মঞ্চে আমি শুধু একা আর হলভর্তি লোক। শুধু হাততালি আর হাততালি।

– ক্যামেরা ভিডিও।

– ফ্ল্যাশের আলো আমার একদম সহ্য হয় না। চোখ ধাঁধিয়ে যায়।

– অন্ধকারই ভালো, কী বলো?

অভিরূপ হালকা করে সুপর্ণার ঠোঁটে চুমু খায়। সুপর্ণা আপত্তি করে না।

– আমার পরের গল্পের নায়ক কে জানো?

– না।

– অভি। আমার অভি। কী, ছাপবে তো?

– সাবধান! বেশি অশ্লীল যেন না হয়।

– সুপর্ণা হঠাৎ পাগলের মতো হো হো করে হেসে ওঠে। অভিরূপ ঘড়ি দ্যাখে– ইটস টু লেট। সুপর্ণা আবদারের ভঙ্গিতে বলে– আর একটু থাকো না, প্লিজ অভি। নাইট ইজ টু ইয়াং। অভিরূপ তার হাত ধরে টানে– চলো!

– কোথায়!

– কেন, আমার ফ্ল্যাটে। সুপর্ণা নেশারু লাল লাল চোখে জানতে চায়– আমার সব গল্প ছাপবে তবে?

– গল্প, উপন্যাস, কবিতা, প্রবন্ধ, রিভিউ, ফিচার, আর্টিকল যা দেবে সব।

– না শুধু গল্পই দেব। আমি সুচিত্রা ভট্টাচার্য হতে চাই।

– আচ্ছা তা-ই হবে। সুচিত্রা সেন বানাব তোমায়।

– সুচিত্রা সেন নয়, সুচিত্রা ভট্টাচার্য। প্রমিস?

– প্রমিস। আমার কথামতো চলো, আমি তোমায় বিখ্যাত করে দেব।

– সত্যি বলছ। মাইরি?

– প্রতিষ্ঠা প্রশংসা পুরস্কার তোমার পায়ের কাছে আদুরে বিড়ালছানার মতো গা ঘষবে।

– দারুণ মজা, তাই না!

– কদিন অপেক্ষা করো, ধারাবাহিক লেখার ব্যবস্থা করে দেব।

– আমি জানি তুমি খুব ভালো। তোমায় বিশ্বাস করি।

অভিরূপ সুপর্ণার মাখনের মতো নরম তুলতুলে গালে মুখ ঘষে বলে– প্লিজ সুপর্ণা, আর দেরি সহ্য করতে পারছি না। লেট আস…। সুপর্ণা ফের আদুরে গলায় বলে– আমায় কোনওদিন ছেড়ে যাবে না অভি।

– ধ্যাৎ, কী যে বলো!

– তোমরা পুরুষ মানুষেরা সব পারো। আমার চেয়ে আরও সুন্দরী আরও ভালো গল্পকার তোমার কাছে আসবে। সেদিন নিশ্চয়ই আমায় ভুলে যাবে। অভিরূপ নিরুত্তর। সুপর্ণা বলে চলে– আমার সঙ্গে বিট্রে কোরো না অভি। আই কান্ট টলারেট। তোমার বিশাল মহীরুহ জড়িয়ে অর্কিডের মতো শোভাবর্ধনের স্পর্ধা করি না, পায়ের তলায় ঘাসের বিছানাই আমার শান্তিনিকেতন। দেওয়া-নেওয়ার খেলায় আমায় ব্যবহার কোরো না। আমার ভিতরেও একটা সুন্দর মন আছে, প্রেম-ভালোবাসা আছে। মেয়েদের কাছে নষ্ট হওয়া যত সহজ, ভালো হওয়া ততটাই কঠিন। আমি স্বপ্ন দেখি অভি। বিখ্যাত হতে চাই। জানি, পথে অনেক চড়াই উৎরাই। তবু যে-কোনোও ভাবে চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। নদীতে ভাসমান পোড়া কাঠ বা গলিত মরদেহ আঁকড়ে ধরেও মানুষ বেঁচে থাকে। অভিরূপ তখনও নিরুত্তর। তার এক হাতে মদের গ্লাস আর অন্য হাত জড়িয়ে সুপর্ণার কোমর।

প্রধান সম্পাদক অলোকেশ ঘোষ সিগারেটের রাংতায় মোড়া জর্দা পান খুলে মুখে পোরে। পানের বোঁটায় লাগানো চুন সামান্য জিভে ঠেকিয়ে পিক ফ্যালে টেবিলের পাশে রাখা পিতলের পিকদানিটাতে। বিশাল টেকো মাথায় হাত বোলায়। সামনে বসা অভিরূপ লক্ষ্য করে, তার মুখটা ক্রোধ আর বিরক্তিতে ভরা। বুকটা অজানা আশঙ্কায় হঠাৎ কেঁপে ওঠে। চিফ এডিটর বলে কথা। অলোকেশ ফের একবার পিকদানিতে পিক ফেলে বলে– এসব কী শুরু করেছ অভি? অভিরূপ আমতা আমতা করে বলে– কী স্যার?

– সুপর্ণা মজুমদার কে?

– নতুন লিখছে।

– দেড় মাসের মধ্যে পর পর তিনটে গল্প!

– ভালো লিখছে স্যার তাই।

– শাট্ আপ। এটা অফিস, ব্রথেল নয়। মিস মজুমদার তোমার পেয়ারের লোক হতে পারে, কিন্তু তার সুযোগ নিয়ে কেউ যা খুশি তাই করবে? গোটা রবিবারের পাতার দায়িত্ব দিয়েছি বলে কি হাতে আকাশ পেয়েছ? কী ভাবো কী নিজেকে? দিবাকর মুখার্জির কাছে তো সামান্য ফ্রিল্যান্স করতে। এখন সম্পাদক হয়ে কি আরও দুটো পা গজিয়েছে?

অলোকেশ ফের একবার পিকদানিতে পিক ফেলে বলে– কফিহাউসে প্রায়ই তোমার নামে অভিযোগ শুনি। গল্প জমা নিয়ে ছাপো না। কখনও বলো, হারিয়ে গেছে। বিনয়দের গ্রুপটা তো তোমার উপর প্রচণ্ড রকম চটে আছে। কোনদিন আচমকা মেরে বসবে। লজ্জা-ঘৃণা কি কিছুই নেই?

অভিরূপ মাথা নীচু করে চুপচাপ বসে থাকে। এত অপমানিত সে জীবনে কখনও হয়নি। চোখ-কান দিয়ে যেন আগুনের হলকা বেরোচ্ছে। এসি চলছে। তবুও ঘাম ছুটছে দরদর করে। অলোকেশ না থেমে বলে চলে– ইদানীং সময় নেই, অসময় নেই যখন খুশি বেরিয়ে যাচ্ছ। কে এক বেঁটে মতো দীপক দাস না কুণ্ডু ডাকলেই বার-এ গিয়ে ঢুকছ। মাল খেয়ে ঢুকছ ডিউটি আওয়ার্সে। একের পর এক অভিযোগ। অভি তোমার যোগ্যতা আছে, প্রতিভা আছে, নিষ্ঠা আছে। এভাবে নিজের সর্বনাশ কোরো না। ম্যানেজিং কমিটির বোর্ডে ডিসিশন নেওয়া হয়েছিল, তোমায় ইমিডিয়েট স্যাক করা হবে। আমিই কিন্তু বলে-কয়ে কোনওরকমে বাঁচিয়ে দিয়েছি। তোমাকে গুয়াহাটিতে আমাদের ব্রাঞ্চ অফিসে ট্রান্সফার করা হল। কালই জয়েন করবে। উইশ ইউ গুড লাক অভি।

সপ্তাহখানেক অভিরূপের কোনও খোঁজ নেই। সুপর্ণা ভেবে কোনও কূলকিনারা পায় না। সে এখনও স্বপ্ন দ্যাখে। প্রতিষ্ঠা প্রশংসা পুরস্কার তার চোখের সামনে নাচতে থাকে। অথচ অভি নেই। কে গল্প ছাপবে? জলজ্যান্ত মানুষটা ভোজবাজির মতো উধাও হয়ে গেল। মনে মনে সে অন্যরকম ভেবেছিল। ওর শরীরের গন্ধ আজও সারা গায়ে লেপটে থাকে। কথা দিয়েছিল অভি। তার জীবনের গল্পের নায়ক হিসাবে ভেবেছিল। তবে কি? সন্দেহ দানা বাঁধে ক্রমশ। তবে কি সব পুরুষই সমান, সব সম্পাদকেরই একই মানসিকতা? দেওয়া-নেওয়ার খেলা শুধু, মদ আর মেয়েমানুষ কেবল? সুপর্ণার খুব কাঁদতে ইচ্ছা করে। কিন্তু না, হেরে গেলে চলবে না। এ লাইনে টিকে থাকতে হলে আরও কত নীচে নামতে হবে, কে জানে? অন্তর্বাসের ভিতর তার নতুন গল্পের পাণ্ডুলিপিটা আলতো করে ঢুকিয়ে নেয়। সুপর্ণা এখন পুরোপুরি প্রস্তুত। সে সরাসরি কাগজের অফিসে আসে। অভির ঘরে ঢোকে। কিন্তু অভি নেই। অভির বসবার চেয়ারে অন্য একটি যুবক। অভির চেয়েও আরও সুন্দর দেখতে, আরও সুপুরুষ। সুপর্ণা জিভ দিয়ে ঠোঁটটা আলতো করে চেটে নেয়। যুবকটি ফাইল থেকে চোখ না সরিয়ে বলে– কী চাই? সুপর্ণা টেবিলের উপর ঝুঁকে পড়ে। ইচ্ছাকৃতভাবে বুকের আঁচলটা খসে পড়ে। বাঁকা হাসি হেসে বলে– গল্প। সুপর্ণার দিকে না তাকিয়ে যুবকটি নির্লিপ্তভাবে বলে– রেখে যান। সুপর্ণা ভিতরে ভিতরে ক্রমশ অধৈর্য হয়ে ওঠে। তার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করার ভঙ্গিতে বলে– অন্তত একবারটি দেখবেন না আমায়, আমি কি লিখেছি? ফাইল থেকে এবারও চোখ না সরিয়ে যুবকটি একইরকম নির্লিপ্তভাবে জবাব দেয়– গল্পের পাণ্ডুলিপি যখন, গল্প ছাড়া আর কি হতে পারে? আর তাছাড়া আমার কাছে গল্পই বিচার্য, গল্পকার নয়। হতবাক সুপর্ণা খসে-পড়া বুকের আঁচলটা আস্তে আস্তে তুলে নেয়।

দিতি-ও বাঁচতে চায়

হাতে ধরা ব্লাড স্যাম্পল-এর শিশি দুটো আর রিকুইজিশন স্লিপটা সেন্ট্রাল ব্লাড ব্যাঙ্কের কোলাপ্সিবল গেটের ফাঁক দিয়ে এগিয়ে দেয় নীলাদ্রি। ও পাশে থাকা ভদ্রলোক স্যাম্পল জমা নিয়ে এগিয়ে যেতে যেতে জানিয়ে দিল, ‘ঘন্টা খানেক পরে আসুন’।

কাল সকাল আটটায় দিতির অপারেশন। অত সকালে ব্লাড জোগাড় করা যাবে কিনা নিশ্চয়তা নেই। খামোকা টেনশন না পুষে, অমিতকে নিয়ে নীলাদ্রি তাই আগের দিন-ই এসেছে ব্লাড ব্যাঙ্কে। ব্লাড স্যাম্পল জমা দিয়ে এখন খানিকটা রিলিভড্। এলোমেলো চুল বাঁ হাতে ঠিক করতে করতে, সিগারেটের লম্বা টানের ধোঁয়ার সাথে, টেনশন হালকা করে হাওয়ায় মিশিয়ে দেয় নীলাদ্রি।

‘টেস্ট করতে, গ্রুপ মেলাতে এটুকু সময় তো লাগবেই। এক ঘন্টা এখানে দাঁড়িয়ে থেকেই বা করবি কী! চল একটু হেঁটে হেদুয়ায় গিয়ে বসি’– অমিত ঘুরে, সিঁড়ি ভেঙে নামতে থাকে। অমিতের সঙ্গে পা মিলিয়ে নীলাদ্রিও মানিকতলা মোড় পেরিয়ে হেদুয়ার দিকে এগিয়ে চলে। রবিবারের শান্ত বিকেলে বড়ো রাস্তাগুলো যেন ক্লান্ত বিবশ হয়ে শুয়ে আছে। এই ফাঁকা শান্ত রাস্তাঘাট হঠাৎ করে নীলাদ্রিকে দিতি-র কথা মনে করিয়ে দেয়। অপারেশন হয়ে যাওয়ার পর অনেকবার দিতিকেও এরকমই বিবশ হয়ে শুয়ে থাকতে দেখেছে নীলাদ্রি। অ্যানিস্থেশিয়ার ঘোর কাটে না তখনও, আধো ঘুমে আচ্ছন্ন। হসপিটালে দিতিকে দেখতে অনেকেই আসে। জানতে চায় কেমন আছে সে। কিছুক্ষণ থেকে খোঁজ খবর নিয়ে ফিরে যায় তারা। কিন্তু দিতি কিছুই বুঝতে পারে না। জানতে পারে না কারা কারা এসেছিল ওকে দেখতে। কাটাছেঁড়া – অপারেশন – ব্যান্ডেজ – ড্রেসিং – ভয় – টেনশন সবগুলো মিলে যায় অ্যানিস্থেশিয়ার ঘোরে। হসপিটালের ধবধবে সাদা বেডে, ফ্যাকাশে দিতি তখন ঘোরের মধ্যে শুয়ে।

নীলাদ্রিকে অনেকক্ষণ চুপ থাকতে দেখে, অমিত বলে, ‘কী ভাবছিস? গ্রুপ মিলিয়ে ব্লাড পাওয়া যাবে কিনা! চিন্তার কিছু নেই, এখানে না পাওয়া গেলে পিপলস্-এ যাব, সেখানে না পাওয়া গেলে লায়ন্স এ…’, হঠাৎ থেমে প্রশ্ন করে, ‘আচ্ছা দিতির ব্লাড গ্রুপ কী জানিস?’

‘জানি ‘বি’ পজিটিভ।’

‘তোর?’

‘বি পজিটিভ।’

‘আমারও। তাহলে তো চিন্তার কিছু নেই। কোথাও না পাওয়া গেলে আমরা তো আছিই।’

অমিত যেন সত্যিই চিন্তামুক্ত হল। নীলাদ্রিও অমিতের কথায় ভরসা পায়। রক্ত চাই– রক্ত। এক বোতল, দু বোতল, তিন… চার। নেই শুনলেই মাথায় হাত। পৃথিবীতে এই একটা জিনিসের জন্য মানুষকে মানুষের উপরই নির্ভর করতে হয়। যার কোনও বিকল্প নেই। টাকা পয়সায় যার মূল্য নির্ধারণ করা যায় না।

পৃথিবী জুড়ে যুদ্ধ, সন্ত্রাস, হিংসা– রক্ত হোলির এক বিভৎস উৎসব, কত রক্তের অপচয়। অথচ এই রক্তের জন্য, জীবনের জন্য কত না কাতর চাহিদা আর উৎকণ্ঠার অপেক্ষা। কিছু মানুষ আছে এখনও, যারা মানুষের জন্য ভাবে, চায় সব মানুষ সুস্থ হয়ে বেঁচে থাকুক এই সুন্দর পৃথিবীতে। তারাই তো অকৃপণ হয়ে দান করে দেহের লাল তরল অংশ– অমূল্য ধন ‘রক্ত’।

যেদিন লাল মারুতি চেপে পাঁচ-ছ’ জন এসে মালঞ্চ সিনেমা হলের সামনে সত্যকেই প্রকাশ্যে গুলি করে মেরে রেখে গেল। সেদিন রক্তে ভেজা ফুটপাতে দাঁড়িয়ে নীলাদ্রি, রাজনৈতিক ধিক্বার সভায় কোনও একজন নেতার মুখে শুনেছিল, ‘এসব বরদাস্ত করা হবে না। প্রতিবাদ, প্রতিরোধ, প্রতিশোধ হবেই। রক্তের বদলে রক্ত চাই। আরও রক্ত।’

হঠাৎই ঘটনাটা মনে পড়ে গেল নীলাদ্রির। নিজের মনে প্রশ্ন করে, ‘আচ্ছা, ওই যারা সত্যকে মেরে রাস্তায় রক্ত ছিটিয়ে গেল বা যে নেতারা রক্তের বদলে রক্ত চাইছিল, ওরা কি কখনও কাউকে রক্ত দেয়? তাহলে এত রক্ত আসে কোথা থেকে? যারা দেয় তারা নিশ্চয়ই দেওয়া-নেওয়ার হিসাব করে না। রক্তের বদলে রক্ত চাই বলে না।’

‘তুই কখনও ব্লাড ডোনেট করেছিস?’ নীলাদ্রির প্রশ্নে অমিত খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে উত্তর দেয়, ‘না, দিইনি। অফিসে একবার হেল্থ চেক-আপ ক্যাম্প হয়েছিল। সেখানে ব্লাড গ্রুপ টেস্ট করিয়েছি।’

‘আমি দু-একবার ব্লাড দিয়েছি, কিন্তু দিতি দিত– বছর বছর, ক্লাবের ব্লাড ডোনেশন ক্যাম্পে। ব্লাড নেওয়ার জন্য কার্ডগুলো তো ক্লাব থেকেই আনলাম।’

হাঁটতে হাঁটতে হেদুয়ার কাছে এসে বাঁদিকের বড়ো বিল্ডিংটার দিকে আঙুল তুলে অমিত নীলাদ্রিকে বলে, ‘এই স্কটিশে ভারতবর্ষের দু-দুজন বিখ্যাত ব্যক্তি পড়াশুনা করেছেন, যারা পৃথিবীর কাছে ভারতবর্ষকে নতুন করে পরিচিত করেছেন, গর্বের আসনে বসিয়েছেন। বলতো কে সেই দুজন?’

নীলাদ্রির মাথাটা যেন ফাঁকা ডিব্বা, সব ভুলে বসে আছে। অমিতের মুখের দিকে বোকা বোকা ভাবে তাকিয়ে থাকে।

‘স্বামী বিবেকানন্দ আর নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু।’

উত্তর না দিতে পারায় নীলাদ্রি লজ্জাবোধ করে। ‘সরি! এটা বলা উচিত ছিল।’

কথা বলতে বলতে ওরা হেদুয়ায় ঢুকে পড়েছে। নীলাদ্রি ঘড়ি দেখে নেয়, এক ঘন্টা হতে কত দেরি আছে।

‘দিতিটা কি বল তো! সব কিছু ভুলে, নিজের গায়ে আগুন লাগাল ও! মৃত্যুকে এত কাছের মনে হল? কী দুঃসাহস!’

অমিতের কথায় নীলাদ্রি চকিতে ফিরে দাঁড়ায়– ‘না রে, মৃত্যুর কাছে এসে মানুষের বেঁচে থাকার ইচ্ছা যে কত প্রকট হয়ে ওঠে, দিতিকে তখন দেখলে বুঝতিস। জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে বেঁচে থাকার জন্য আকুল হয়ে ওঠে মানুষ– আমি দেখেছি।’

সুইমিং পুলের রেলিংয়ের ধারে দাঁড়িয়ে আছে নীলাদ্রি আর অমিত। সামনেই ডাইভ দেওয়ার জন্য ঢালাই করা জায়গাটা, যার একাংশ ঝুলে আছে পুলের মধ্যে। সেখানে বসে একজন অল্পবয়সি বউ আপন মনে শাড়িতে অ্যাপ্লিকের কাজ করছে। বোধহয় স্টাফ কোয়ার্টারে থাকে। বাদ দেওয়া টুকরো কাপড়গুলোর কিছু কিছু হাওয়ায় উড়তে উড়তে সুইমিং পুলের জলে এসে পড়ছে। ওই টুকরোগুলো উড়ে গিয়ে জলে পড়ছে কিনা বা জল নোংরা করছে কিনা সে ভাবনা নেই– স্বার্থপরের মতো বউটি নিজের কাজে মগ্ন। বেঁচে থাকার অদম্য ইচ্ছা বা মৃত্যুর জন্য দুঃসাহসী প্রয়াস। কোনও ক্ষেত্রেই বোধহয় মানুষ ভাবে না অন্যের কথা।

নীলাদ্রি আর অমিত পার্কের এপাশ থেকে ওপাশ ঘুরে বেড়াচ্ছে। পার্কের এক পাশে গোল হয়ে বসে আছে এক ঝাঁক তরুণ-তরুণী। পাশের কলেজ হোস্টেল থেকেই বোধহয় এসেছে ওরা। কোনও বিশেষ আলোচনা বা পরিকল্পনায় তারা মশগুল। এরকম সুশৃঙ্খল ভাবে ওদের বসে থাকতে দেখে নীলাদ্রির বেশ ভালো লাগে। চারিদিকের অশালীন গুলতানি, ছন্নছাড়া অসহিষ্ণু চেনা সমাজ থেকে পৃথক ভালো কিছু দেখে মনটাও যেন শান্তি পায়। নীলাদ্রি মনে মনে ভাবে, এদের মতো মানুষেরাই নিশ্চয়ই মানুষের জন্য রক্ত দেয়।

একটু এগিয়ে এসে গাছতলায় সিমেন্ট বাঁধানো বেঞ্চটায় এসে বসে নীলাদ্রি-অমিত। আগে থেকেই একজন বয়স্ক ভদ্রলোক বসে আছেন ওখানে। পরিপাটি পোশাক, পাট ভাঙা ধুতি-পাঞ্জাবি পরনে, চোখে সোনালি ফ্রেমের চশমা, কেয়ারি করে চুল আঁচড়ানো, গলাবন্ধ ফুল হাতা সোয়েটার পরা।

সামনে দিয়ে অন্য একজন বয়স্ক ভদ্রলোক হাতে ধরা বন্ধ ছাতায় ভর দিয়ে ধীর পায়ে এগিয়ে চলেছেন। তার উদ্দেশ্যে পাশে বসা ভদ্রলোক হাঁক ছাড়েন, ‘দাদা কত হল?’

ভদ্রলোক কানে কম শোনেন, থেমে, এগিয়ে এসে জিজ্ঞাসা করেন, ‘কী বললেন, কীসে বদহজম হল?’

‘না না, বয়স কত হল?’

‘এই তো একানব্বই। শয়ে পড়তে এখনও নয় নয় করে ন’টা বছর বাকি।’

‘তা প্রায় টেনে এনেছেন। আমার তো একাশি, আমার থেকে পুরো দশ বছর এগিয়ে। আমরা কি আর পারব, আপনার মতো?’

মৃদু হেসে ভদ্রলোক উত্তর দেন, ‘যা ঠান্ডা পড়েছে।’

পাশের ভদ্রলোক উত্তর দেন, ‘দেখুন কী হয়?’

নীলাদ্রি ঘড়ি দেখে, অমিত শোনে, ‘আর কত বাকি?’

‘এখনও আধ ঘন্টা।’

অন্য একজন ধোপদুরস্ত ভদ্রলোক পাশে এসে বসলেন। তার পায়ের কেডস্টিও ধবধবে সাদা। আগের সেই ভদ্রলোক পাঞ্জাবির পকেট থেকে নস্যির কৌটো বের করতে করতে প্রশ্ন করেন, ‘ক পাক হল?’

নস্যির কৌটো বের করার সময় পকেটে রাখা খুচরো পয়সাগুলো ঝনঝন করে বেজে ওঠে।

‘এই তো সবে এক পাক দিয়ে এসে বসলাম।’

নস্যি নিয়ে পরিষ্কার রুমাল দিয়ে নাক, হাত মুছে ভদ্রলোক সোজা হয়ে বসেন।

‘ঘোষবাবুকে দেখলেন? এখনও বেশ শক্ত-সমর্থ্যই আছেন। একানব্বই চলছে!’

‘ভাইপোদের কাছে থাকেন। ভালো চাকরি করতেন, ভালো পেনশন। বিয়ে থা তো করেননি। সাংসারিক চিন্তাভাবনা নেই। সুস্থ থাকারই কথা।

‘আপনার কত চলছে?’

‘ক’দিন আগে সত্তর পার হলাম।’

‘আমার থেকে তো অনেক ছোটো। যান সন্ধে হওয়ার আগে তাড়াতাড়ি আরও দু-চার পাক ঘুরে আসুন। ভালো করে বাঁচতে হবে। কত কী আরও দেখবার আছে।’

‘না না, আর দেখবার ইচ্ছে নেই। ঘরে-বাইরে যা চলছে। তাড়াতাড়ি গেলেই বাঁচি।’

‘মানুষ হয়ে এসেছেন, অত তাড়াতাড়ি করে লাভ কী? যতদিন মানুষ হয়ে বেঁচে থাকা যায় সেটাই ভালো। মরলে পরে কে যে কী হবে কে জানে!’

‘ওই দেখুন বাচ্চা ছেলেমেয়েগুলো ব্লাড ডোনেশন ক্যাম্পের প্রোগ্রাম সেট করছে, আর আমরা রক্তচোষারা বসে আছি শুধু সময়ের অপেক্ষায়।’ একটু থামেন। ‘আচ্ছা, মানুষের জন্য কোনওদিন রক্ত দিয়েছেন?’

সংক্ষিপ্ত উত্তর– ‘না’।

ভদ্রলোক তবুও থামেন না, ‘সে কি কথা।’ মানুষইতো কেবল মানুষের জন্য রক্ত দিতে পারে। জীবজন্তু, কীটপতঙ্গ ওরা কিন্তু পারে না। একবার চেষ্টা করে দেখুন না।’

‘আমাদের চেষ্টার দিন তো শেষ। আমাদের রক্ত সব শুকিয়ে গেছে। না হলে এত অনাচার, এই খারাপ সময়ে একটুও গরম হয় না কেন রক্ত?’ নীলাদ্রি-অমিতের দিকে ফিরে বলে, ‘এখন চেষ্টা করবে এরা। চারিদিকে লড়াই। অনেক অনেক রক্তের দরকার।’ বেঞ্চ থেকে উঠে ভদ্রলোক এগিয়ে যান। পাশের ভদ্রলোক অমিতের দিকে তাকিয়ে বলেন, ‘যাই যাই করছে। ওসব মিথ্যে মুখোশ। মরতে কেউ-ই চায় না। মরতেই যদি চায় তাহলে প্রতিদিন পার্কে এসে পাঁচ পাক ঘুরছে কেন? বাঁচতে চায় বলেই তো শরীরটাকে সতেজ রাখার চেষ্টা। রক্ত ফুরিয়ে গেলে দেখবে রক্ত চাইবে। এক বোতল, দু বোতল, তিন বোতল…।’

হাত ঘড়িতে সময় দেখে নীলাদ্রি উঠে দাঁড়ায়।

অমিত শোনে, ‘আর কত বাকি?’

‘মিনিট দশেক।’

বেঞ্চ ছেড়ে অমিতও উঠে দাঁড়ায়। পাশের ভদ্রলোককে উদ্দেশ্য করে বলে, ‘আমাদের দুজনেরই বি পজিটিভ। কখনও রক্ত লাগলে বলবেন।’

পার্কের রাস্তা– মানিকতলা মোড়– সেন্ট্রাল ব্লাড ব্যাঙ্ক, পায়ে পায়ে শেষ হয় নীলাদ্রি অমিতের রাস্তা।

ব্লাড ব্যাঙ্ক থেকে ব্লাড কালেক্ট করে হসপিটালের ফ্রিজে সেই ব্লাড ঢুকিয়ে রেখে নিশ্চিন্ত হয়ে নীলাদ্রি অমিতকে নিয়ে দিতির কেবিনের দরজা খুলে দাঁড়ায়, দরজা খোলার হালকা শব্দে দিতি ঘুরে তাকায় ওদের দিকে।

দিতির চোখে-মুখে আবার একবার দেখতে পায় বেঁচে থাকার আকুল আগ্রহ – ‘ব্লাড পেয়েছ?’

 

স্নেহ

অর্ক মায়ের চিন্তিত মুখের দিকে তাকিয়ে অধৈর্য হয়ে ওঠে। ও জানে মা অনেকদিন ধরেই মাসিকে ফোনে চেষ্টা করছে কিন্তু মাসিকে কিছুতেই ফোনে ধরা যাচ্ছে না। আর মাসির খবর কয়েকদিন না পেলেই মায়ের কী অবস্থা হয় আন্দাজ করে নিয়েই অর্ক বলে, ‘মাসির চিন্তা করা বন্ধ করো এবার। মা, তুমি খুব ভালো করেই জানো মাসি ভালো আছে বলেই এখন তোমার ফোনও ধরছে না, তোমাকে একটা ফোন করারও প্রয়োজন মনে করছে না। কোনও প্রবলেম হলে কাঁদতে কাঁদতে আগে তোমাকেই ফোন করত।’

সুচরিতা অর্কর কথার কোনও প্রত্যুত্তর দিতে পারে না শুধু চোখের দিকে তাকিয়ে একবার দেখে নেয়। আজকালকার ছেলে, ইমোশন খুব কম, তবে জীবনের উঁচু-নীচু পথটাকে অনেক ভালো ভাবে বোঝে, চেনে ওরা। তবে সেটা সুচরিতার কাছে কষ্টের নয়, গর্বের।

সুচরিতা বোঝে আজকের দিনে ওর নিজের ভালোমানুষি স্বভাবটাকে নিয়ে লোকেরা হাসিঠাট্টাই করবে, আড়ালে সকলে নিরেট, বুদ্ধিহীন বলবে। অথচ সত্যিই তো ছোটোবেলায় এত বুদ্ধি ছিলটাই বা কোথায় যে এক-দু’বার সাক্ষাতেই কাউকে বুঝে ফেলবে। জয়েন্ট ফ্যামিলিতে বড়ো হওয়ার কারণে, বড়োদের মধ্যে সুচরিতার থাকার সুযোগ হয়নি। পরিবারের অন্যান্য বাচ্চাদের সঙ্গেই মিলেমিশে মানুষ হয়েছে। বড়োরা কীভাবে ঘরসংসার সামলাচ্ছেন সেটা ঘুণাক্ষরেও সুচরিতা কখনও বুঝতে পারেনি। অথচ এখন তিন-চার সদস্যের পরিবারে বাচ্চারা বড়ো হচ্ছে কিন্তু সবদিকেই তাদের তীক্ষ্ণ  নজর। কারও সঙ্গে দুটো কথা বলেই ওরা বুঝে ফেলে মানুষটা কেমন।

‘আজই আমি মাসিকে দোকানে শপিং করতে দেখেছি। হয়তো অফিসে তাড়াতাড়ি ছুটি হয়ে গিয়েছিল। মাসির সঙ্গে আরও দুজন ছিল। ওদের সকলের হাতেই অনেকগুলো করে ব্যাগ ছিল।’

‘তোর সঙ্গে কোনও কথা হয়েছে?’

‘না, আমি ফুটপাথে একটা দোকানে বসে বন্ধুদের সঙ্গে চা খাচ্ছিলাম। মাসিকে একটা দোকান থেকে বেরিয়ে আর একটা দোকানে ঢুকতে দেখলাম।’

‘তুই তো ভুলও দেখে থাকতে পারিস।’

‘কেন, আমি কি অন্ধ, নাকি চোখে কম দেখি যে মাসিকে দেখে চিনতে পারব না?’

‘তাহলে কথা বললি না কেন?’

‘বাব্বা! মাসি হেসে গড়িয়ে পড়ে বন্ধুদের সঙ্গে গল্প করতে এতটাই ব্যস্ত ছিল যে আমাকে দেখতেই পায়নি। দিব্যি খোশমেজাজে ছিল… আর যেই তুমি ফোন করো অমনি মাসির কান্নাকাটি আরম্ভ হয়ে যায় যেন ওর চেয়ে দুঃখী সারা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে আর একটাও নেই। মাসির যখন ভালো সময় যায় তখন কই, তোমাকে তো বলতে আসে না অথচ যেই সামান্য প্রবলেমের আঁচ পায় ওমনি তোমার কাছে এসে কান্নাকাটি শুরু করে দেয়। মা, মাসির চিন্তা করা ছাড়ো। ফোন আসেনি মানে ধরে নাও মাসি বহাল তবিয়তে আছে।’

সুচরিতা শাসনের ভঙ্গিতে অর্কর দিকে চোখ ফেরায়। কথা ঘোরাবার চেষ্টা করে কারণ সুপর্ণার নামে আরও দুটো বাজে কথা অর্কর মুখ থেকে শুনতে সুচরিতার ভালো লাগছিল না। অথচ মনে মনে সুচরিতা ভালো করেই জানে অর্কর প্রতিটা কথা সত্যি। ও ঠিকঠাকই চিনেছে নিজের মাসিকে। সুপর্ণার এটা বরাবরের স্বভাব। সাধারণ সমস্যাকে বাড়িয়ে বলতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করে না অথচ কোনও আনন্দের খবর থাকলে এমনভাবে সকলের কাছে চেপে যাবে যে অন্য লোকে মনে করবে দুঃখ ছাড়া মেয়েটার জীবনে সুখশান্তি একেবারেই নেই।

সুপর্ণাকে যতবার সুচরিতা এটা নিয়ে বলতে চেষ্টা করেছে প্রত্যেকবারই ওর একটাই উত্তর শুনে এসেছে, ‘তুই জানিস না দিদি, আমার ভালো কেউ সহ্য করতে পারে না। সকলে আমাকে হিংসা করে। ভালো কিছু আমার জীবনে ঘটলে অন্যের নজর লেগে যায়, তাই কাউকে আমি কিছু জানতে দিই না।’

সুচরিতা আশ্চর্য হয় সুপর্ণার কথা শুনে। আশ্চর্য, নিজের দিদিকেও বলা যায় না। তার মানে কি সুপর্ণা বলতে চায় ছোটো বোনকে দিদি হিংসা করছে? অথচ দিনরাত সুচরিতার একটাই চিন্তা, ছোটো বোনটা কীভাবে ভালো থাকবে? কী করে ওকে আরও সাহায্য করা যাবে?

সুচরিতার মনে পড়ল, এই তো কয়েকদিন আগেই সুপর্ণা কাজের মেয়েটার হাত দিয়ে একটা চিঠি পাঠিয়েছিল কিছু টাকা চাই লিখে। সংসার থেকে বাঁচিয়ে বাঁচিয়ে সুচরিতা সামান্য কিছু টাকা জমিয়ে রাখে দুর্দিনের কথা মাথায় রেখে। ভেবেছিল বোন এলে ওখান থেকেই কিছু টাকা সুপর্ণাকে দিয়ে দেবে। ও ভালো করেই জানে ওই টাকা সুপর্ণা কবে ফেরত দেবে কোনও ঠিক নেই। আদৌ দেবে কিনা সেটাও অজানা।

এই ভাবেই দুই বোন মানুষ হয়েছে। দশ বছরের ছোটো সুপর্ণা। বোধবুদ্ধি হওয়ার পর থেকেই মা-বাবার কাছে সমানে শুনে এসেছে, ছোটো বোনের সব দায়িত্বই সুচরিতার। বোনকে চোখে চোখে রাখা, সঙ্গে করে স্কুল নিয়ে যাওয়া, টিফিন খেয়েছে কিনা দেখা, বোনকে আগলে আগলে রাখা সবই করেছে সুচরিতা। বিয়ের পরেও এর অন্যথা হয়নি। বাবা-মায়ের মৃত্যুর পরেও সুপর্ণার দায়িত্ব সুচরিতার ঘাড়েই এসে পড়েছে। সুচরিতা নিজেই বুঝতে পারেনি কবে থেকে ও বড়ো দিদির খোলস ত্যাগ করে সুপর্ণার মা হয়ে উঠেছে। অবশ্য এই নিয়ে সুচরিতার স্বামী এবং ছেলে প্রচুর হাসিঠাট্টাও করেছে, কিন্তু সুচরিতা কখনও প্রতিবাদ করেনি।

‘সুচি, তুমি প্রয়োজনের তুলনায় বেশি ভালোমানুষ। নিজের বোনকে ভালোবাসো ক্ষতি নেই কিন্তু এতটা স্বার্থপরও ওকে করে তুলো না যে ওর নিজের চরিত্রই একদিন ওর সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়াবে। মা-বাবাও শক্ত হাতে সন্তানের অন্যায়ের প্রতিবাদ করে, তাকে শাসন করে কিন্তু তাই বলে কি তারা তাদের সন্তানের শত্রু? তাহলে তুমি কেন সুপর্ণার সব দোষ ঢাকবার চেষ্টা করো?’

‘আমি ওকে কী বলব? ও নিজে পড়াশোনা করেছে, ব্যাংকে চাকরি করে। ও বাচ্চা মেয়ে নয় যে ওকে বোঝাব। সবারই স্বভাবের কিছু না কিছু বৈশিষ্ট্য থাকে।’

‘যদি আলাদা আলাদা স্বভাবের কথাই বলো তাহলে ওকে ওর স্বভাব নিয়েই থাকতে দাও। ওর নিজের স্বভাবের জন্য যা কিছু সমস্যা সেটা সুপর্ণার একার, সেটা সমাধানের দায়িত্বও ওর উপরে কেন ছেড়ে দিচ্ছ না? সেখানে তুমি কেন ওকে প্রশ্রয় দিচ্ছ? আমার আপত্তিটা এখানেই।’

শেখরের কথাটা ফেলতে পারে না সুচরিতা কারণ সুচরিতা জানে শেখর সত্যি বলছে। কিন্তু মনকে কীভাবে বোঝাবে সুচরিতা। বোনের প্রতি গভীর মমতাবোধ সবসময় সুচরিতাকে দুর্বল করে তোলে। এই যে সুপর্ণা টাকা চেয়েছে সেটা শেখরকে এখনও বলতে পারেনি সুচরিতা। মনে মনে ঠিক করে রেখেছে নিজের জমানো টাকা থেকেই সুপর্ণাকে কুড়ি হাজার টাকা এখন দিয়ে দেবে। কিন্তু কেনই বা এই টাকার দরকার সুপর্ণার, নিজের মনকেই সুচরিতা প্রশ্ন করে। সুপর্ণা ব্যাংকে চাকরি করে, মাইনেও খারাপ নয়। তাহলে? আর কতদিন সুপর্ণাকে এইভাবে সাহায্য করে যেতে হবে? মনে মনে বিরক্ত হয় সুচরিতা। কেন ও সুপর্ণার মুখের উপর ‘না’ বলতে পারে না? বেশ বুঝতে পারে সুচরিতা, সুপর্ণা ওর ভালোমানুষির সুযোগ নিয়ে ওকে ব্যবহার করছে।

শেখর বহুবার সুচরিতাকে বোঝাবার চেষ্টা করেছে যে সুপর্ণা ওকে নিজের কাজ গুছোবার জন্য খালি ব্যবহার করছে। সুপর্ণার এই স্বভাবের জন্য সুচরিতা অনেকটাই দায়ী। বোনের অন্যায় কোনওদিন সুচরিতা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়নি উপরন্তু সকলের সামনে ঢাকবারই চেষ্টা করেছে। এমন অনেক সম্পর্ক রয়েছে যেগুলো ছাড়া জীবন এগোতে চায় না অথচ সম্পর্কগুলো শুধু ব্যথাই দেয়। দেওয়ার ইচ্ছেটা কেমন যেন নেশা ধরিয়ে দেয়। আর পিছন ফিরে কিছুতেই তাকানো যায় না। অথচ যে পাচ্ছে, তার কিছুতেই আর আশ মেটে না। গোগ্রাসে সারা পৃথিবীটাকে যেন গিলে খেতে চায়।

সুপর্ণার বয়স প্রায় পঁয়ত্রিশ ছুঁই ছুঁই। অথচ নিজেকে বদলাবার কোনও চেষ্টা নেই ওর। সুচরিতা ভাবে, সুপর্ণা কখনও কি বদলাবে? হয়তো না। অথচ ওর জন্য সুচরিতার সংসারে মাঝেমধ্যেই অশান্তির ঝড় বয়ে যায়। আশকারা তো সুচরিতাই দিয়েছে। যখন তখন এসে কেঁদে পড়া, টাকা ধার চাওয়া, সুচরিতার জীবনে নাক গলানো এগুলো সুপর্ণার অভ্যাস হয়ে গেছে। সন্তানকে শাসন করা যায়, গায়ে হাতও তোলা যায়। কিন্তু একটা বয়সের পরে কেউ কথা শুনবে কি শুনবে না সেটা পুরোটাই তার মানসিকতার উপর নির্ভর করে। কিন্তু সব জেনেশুনে চুপচাপ বসে থাকাটাও বোকামি। গায়ে হাত তুলে শাসন করা না-ই বা গেল কিন্তু শাসনের ভঙ্গিতে হাত তো তোলাই যেতে পারে, শরীরে না ঠেকালেই হল।

সুচরিতাও মনে মনে দৃঢ় হল, এভাবে আর সুপর্ণার অন্যায়গুলোতে সায় দেওয়া যায় না। বিকেলে সুপর্ণার বাড়ির রাস্তা ধরল। শেখরের ফিরতে রাত হবে, অতএব অর্কই মা-কে অটোতে উঠিয়ে দিল। গলির মুখটাতে অটো থেকে নেমে ভাড়া মিটিয়ে দিল সুচরিতা। সুপর্ণাকে অগ্রিম কিছু জানায়নি ফোন করে যা এতদিন করে এসেছে ও। ফ্ল্যাটের সামনে এসে কলিংবেল বাজায় সুচরিতা। অল্প অপেক্ষার পরই দরজা খুলে দাঁড়ায় সুপর্ণা। দিদিকে হঠাৎ সামনে দেখে সুপর্ণার চোখ বিস্ফারিত হয়ে ওঠে, ‘দিদি তুই?’

সুচরিতার পেছনে আরও কেউ আছে কিনা একবার ভালো করে দেখে নিয়ে সুপর্ণা শুকনো গলায় আবার জিজ্ঞেস করে, ‘দিদি তুই? একটা ফোন করিসনি কেন?’

‘ভাবলাম তোকে একটা সারপ্রাইজ দেব, তাই চলে এলাম। ভিতরে আসতে বলবি না… নাকি দরজার বাইরেই দাঁড়িয়ে থাকব?’

সুপর্ণাকে পাশ কাটিয়েই সুচরিতা বসার ঘরে পা দেয়। সোফাতে সুপর্ণার কোনও সহকর্মী বসে আছে দেখে সুচরিতা থমকায়। ঘরে চোখ বুলোতেই চোখে পড়ে কার্পেটের উপর কাগজ পেতে হোটেল থেকে আনানো খাবার রাখা আছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। প্লেটে খাবার নিয়ে গুছিয়ে সুপর্ণাকে কোনওদিন খেতে দেখেনি সুচরিতা। এখনও সেই অভ্যাস রয়ে গেছে সুপর্ণার। সুচরিতার চোখ পড়ে সোফায় বসা ভদ্রলোকের হাতেও হোটেলেরই খাবারের একটা বাক্স ধরা। চামচে করে সরাসরি বাক্স থেকেই খাওয়া হচ্ছিল সেটা বুঝতে ভুল হয় না। একটু লজ্জা অনুভব করে। সুপর্ণা নিজে এভাবে খায় ঠিক আছে তাই বলে অতিথির বেলাতেও একই নিয়ম?

সোফায় এসে বসে সুচরিতা। ওর মনে হয়, ভদ্রলোক যেন ওকে দেখে খানিকটা অস্বস্তিতে পড়েছেন। ব্যবহারটা কেমন যেন অসহজ মনে হয়।

সুপর্ণা ঘরে এসে বসতেই সুচরিতা চোখ ফেরায় ওর দিকে, ‘নিজেরই তো বোনের বাড়ি… শুধু শুধু ফোন করতে ইচ্ছে করল না। বসে বসে হঠাৎ মনে হল অনেকদিন ফোনে তোর সঙ্গে কথা হয়নি, তোকে দেখিনি। ব্যস চলে এলাম অটো ধরে। তুই কেমন আছিস? তোর কোথাও বেরোনোর নেই তো এখন?’

সুচরিতার মনে হয় সুপর্ণাকে একটু শুকনো লাগছে দেখতে। পাশের ভদ্রলোকটিও কেন জানি না উশখুশ করতে থাকেন। দু’জনকে দেখেই সুচরিতার মনে হয় যেন ওদের জীবনে একটা সাংঘাতিক অঘটন ঘটে গেছে।

‘কী হয়েছে, তোর শরীর ঠিক আছে তো?’

সুচরিতা জিজ্ঞেস না করে পারে না।

‘হ্যাঁ, মাঝে একটু শরীরটা খারাপ হয়েছিল। দিদি, ইনি ব্যাংকে আমার সহকর্মী। নাম সৃজিত। আমার শরীর খারাপের খবর শুনে আমাকে দেখতে এসেছেন।’

সুচরিতা স্পষ্ট বুঝতে পারে সুপর্ণা মিথ্যা কথা বলছে। ওর নিজের করা প্রশ্নটাই সুপর্ণার মুখে উত্তর জুগিয়েছে এটা কাউকে এসে বলে দেওয়ার দরকার নেই। সুচরিতা শরীর খারাপের প্রশ্নটা না তুললে হয়তো সুপর্ণার ঠোঁটে সদুত্তর কিছু জুটত না।

ছোটো থেকে সুপর্ণাকে দেখছে তাই ওকে বুঝতে এতটুকু অসুবিধা হয় না সুচরিতার। প্রত্যেকটা গতিবিধি ওর চেনা। অনেকটা বয়সের পার্থক্য দুই বোনের মধ্যে। সুচরিতার জন্মের পর দশ বছর পর্যন্ত ওর মা-বাবা দ্বিতীয় সন্তানের কথা চিন্তাতেও আনেননি। সুচরিতার নিঃসঙ্গতার কথা ভেবে এবং ওর বারো মাস অসুস্থ থাকার কারণে বাড়ির বড়োরা ওদের পরামর্শ দেন দ্বিতীয় সন্তানের জন্য। কারণ বাড়িতে আর সকলেরই দুটি করে সন্তান ছিল। সুচরিতা একা হওয়ার কারণে খেলার কোনও সঙ্গী ছিল না ফলে ও ধীরে ধীরে খিটখিটে স্বভাবের হয়ে উঠছিল। সুচরিতার এই সমস্যার একমাত্র সমাধানের রাস্তা ছিল বাড়িতে ভাই কিংবা একটা বোন হওয়া।

ভাই, বোন হওয়ার আগে থেকেই সুচরিতার মা-বাবা ওকে বোঝাতে শুরু করেন বাড়িতে নতুন অতিথি এলে সুচরিতার দায়িত্ব অনেক বেড়ে যাবে। সত্যি সত্যিই সুপর্ণার জন্মের পর সুচরিতার শৈশব হারিয়ে গেল সুপর্ণার প্রতি কর্তব্য পালনে। সকলে এসে একটাই কথা সুচরিতাকে বলে গেল, ‘তুই বড়ো দিদি, দশ বছরের বড়ো। তোকে বোনের দায়িত্ব নিতে হবে বই-কি।’ ব্যস সুচরিতাও, বোনের কীসে ভালো, তাতেই নিজেকে সমর্পণ করে দিল। দশ বছরের মেয়েটার ঘাড়ে সুপর্ণা নামের দায়িত্ব বেশ শিকড় গেড়ে বসল।

‘সুচি, তুমি ওর মা নও… তোমারা তো একই মায়ের পেটের বোন, তাহলে তুমি এত কেন চিন্তা করো ওকে নিয়ে?’ কতবার শেখর সুচরিতাকে বোঝাবার চেষ্টা করেছে।

কিন্তু সুচরিতার অবচেতনে গভীরভাবে ওর মা-বাবা এটাই রোপণ করে দিয়েছিলেন যে সুচরিতার প্রয়োজনেই সুপর্ণাকে সংসারে নিয়ে আসা হয়েছে। ছোটোবেলার কোনও কথা সুচরিতা ভোলেনি। একসঙ্গে যখন খেতে বসত, তখন হঠাৎ যদি সুপর্ণা বিছানা ভিজিয়ে ঘুম থেকে উঠে পড়ত অথবা খিদের জ্বালায় কান্নাকাটি জুড়ে দিত, খাবার ফেলে রেখে সুচরিতাকেই দৌড়োতে হতো। এখন সুচরিতার মাঝেমধ্যেই মনে হয় ওই কাজগুলো সত্যিই কি ওর করার কথা ছিল? ওগুলো তো মা-বাবার দায়িত্ব হওয়া উচিত ছিল। বোনকে পৃথিবীর আলো দেখিয়ে তারা সুচরিতার কাছে কী প্রমাণ করার চেষ্টা করেছিলেন? সুচরিতার জীবনে যে সঙ্গীর অভাব ছিল সেটার অভাব পূরণ করে তারা কি সুচরিতার উপকার করতে চেয়েছিলেন? এই ভার আজ পঁয়ত্রিশ বছর ধরে সুচরিতা বয়ে চলেছে। এখন বড়ো ক্লান্ত বোধ করে সুচরিতা। মা-বাবার প্রতি এই কর্তব্যের থেকে কবে মুক্তি পাবে সুচরিতা? সুপর্ণার ডাকে চিন্তার জাল ছিঁড়ে বর্তমানে ফিরে আসে সুচরিতা–

‘এই দিদি, কী ভাবছিস তুই? কোনও কথা বলছিস না কেন?’

সোফায় পড়ে থাকা প্যাকেটগুলোর উপর চোখ চলে যায় সুচরিতার। শহরের নামি কয়েকটা দোকানের নাম লেখা প্যাকেটগুলোয়। অর্ক সত্যি কথাই বলেছিল, বুঝতে পারে সুচরিতা। শরীর খারাপটা বাহানা মাত্র, আসলে সুপর্ণা ঘোরা-বেড়ানো, মার্কেটিং নিয়েই ব্যস্ত ছিল। দিদির একটা খোঁজ নেওয়া দরকার, সেটা ওর মনেও আসেনি।

সুচরিতা লক্ষ্য করে দুটো, তিনটে পোশাক ইতিউতি চেয়ারের উপর পড়ে রয়েছে। দেখে তো নতুনই মনে হচ্ছে। হয়তো সুপর্ণা পরে পরে দেখছিল আর নয়তো পরে দেখাচ্ছিল!

হঠাৎই সুচরিতার মনে হয়, তাহলে কি বসে থাকা পুরুষটির সঙ্গে সুপর্ণার কোনও গভীর সম্পর্ক রয়েছে নয়তো কোনও বাইরের পুরুষের উপস্থিতিতে সুপর্ণা পোশাক বদলাবার মতো নির্লজ্জ আচরণ করে কী করে?

‘তোর কি জ্বর হয়েছিল? ক্লাইমেট বদলাচ্ছে… চারদিকে ভাইরাল চলছে, একটু সাবধানে থাকতে পারিস তো’, এই বলে সুচরিতা চেয়ার থেকে জামাকাপড়গুলো উঠিয়ে একটা জায়গায় জড়ো করে। ঠিক সেই মুহূর্তে সোফায় বসা ভদ্রলোকও উঠে দাঁড়িয়ে পড়ে, ‘আচ্ছা সুপর্ণা আমি এখন বেরোচ্ছি।’

‘আপনি উঠছেন কেন, বসুন না… খাবারটা তো এখনও শেষ হল না। সুপর্ণা, তুইও এসে এখানে একটু বস না,’ সুচরিতার গলার স্বরে এমন একটা আদেশের সুর ছিল যে ওরা দু’জনেই চমকে সুচরিতার দিকে তাকায়।

ভদ্রলোক কোনও কথা না বলে দরজার দিকে পা বাড়ান। সুপর্ণাকে দেখেও একটু আনমনা মনে হয় সুচরিতার।

‘অসুস্থ ছিলি যদি তাহলে হোটেলের খাবারগুলো খাচ্ছিস কেন?’ না চাইতেও সুচরিতার চোখ চলে যায় পড়ে থাকা খাবারের কৌটোতে। তেলের মধ্যে মাংসের টুকরোগুলো ভাসছে, একটা কোনও সবজি আর রুমালি রুটি পড়ে রয়েছে। ‘তোর সঙ্গে একটু দরকার ছিল, তাই আর আসার আগে তোকে ফোন করিনি। আমার কিছু টাকার দরকার… অর্কর একটা কোর্সে ভর্তি হওয়ার জন্য। তোর কাছে প্রায় পঞ্চাশ হাজার টাকার মতো পাই।’

মুহূর্তেই সুপর্ণার মুখের চেহারা বদলে যায়, বিবর্ণ রং ধারণ করে। কারণটা সুচরিতা জানে তাই আবার জানার চেষ্টা করে না। সুপর্ণাকে টাকা দিয়ে এই প্রথম টাকা ফেরত চাইল সুচরিতা। সুপর্ণাও টাকা নিয়ে কোনওদিন ফেরত দেওয়ার প্রয়োজন মনে করেনি। সুচরিতা খুব খুঁটিয়ে সুপর্ণার চোখের ভাষা পড়বার চেষ্টা করে কারণ ও বুঝতে পেরেছিল এখানে এসে সুপর্ণার সন্ধেটা মাটি করে দিয়েছে।

আপশোশ হয় সুচরিতার। একই মা-বাবার সন্তান হয়েও দুই বোনের চরিত্র কতখানি আলাদা। একই বাড়ির পরিবেশ কীভাবে দুজনের রক্তে আলাদা প্রভাব ফেলল?

‘আমার কাছে টাকা কোথায়?’ সুপর্ণা অস্ফুটে বলে।

‘কেন? একলা ফ্ল্যাটে থাকিস। তোর স্বামী আর ছেলে দুজনেই অন্য শহরে রয়েছে। তোর পুরো খরচা ভাস্কর পাঠায়। তোর নিজের মাইনের পুরোটা যায় কোথায়? নিজের জন্য একটা পয়সাও তো খরচ করিস না।’

সুপর্ণা অবাক হয়ে যায় দিদির কথা শুনে। সবসময় ওর হয়েই সুচরিতা মুখ খুলেছে তাহলে আজ হঠাৎ দিদি বিপক্ষে কী করে চলে গেল। অথচ সুচরিতা সবসময়েই চেয়েছে সুপর্ণা বিপথে না যাক। প্রতিদিন ভেবেছে, সুপর্ণা এবার নিজেকে বদলাবে। ওর স্বামী, ছেলে সকলেই ওর আচরণে বিরক্ত। সুচরিতারও বাড়ির কেউ সুপর্ণাকে পছন্দ করে না। একমাত্র ওই ঢাল হয়ে সুপর্ণাকে আগলেছে। সেই ঢাল-ই আজ তির হয়ে সুপর্ণাকে আঘাত করতে উদ্যত।

‘একটু একটু করে সংসার থেকে বাঁচিয়ে টাকা জমিয়েছি… অর্কর ভর্তির জন্য অনেকগুলো টাকা লাগবে এটা তো তুই জানতিস। আমাকে সাহায্য করতে হবে না কিন্তু আমার টাকাগুলো ফিরিয়ে দে। আমার তাতেই কাজ মিটে যাবে,’ উঠে দাঁড়ায় সুচরিতা।

সুপর্ণাকে দেখে মনে হচ্ছিল কাটলেও এক ফোঁটা রক্ত মাটিতে পড়বে না। মরা মানুষের মতো ফ্যাকাসে চেহারা হয়েছে ওর। ও স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি সুচরিতা এতটা মুখরা হয়ে উঠতে পারে, এতটা নির্দয় ভাবে সুপর্ণার সঙ্গে কথা বলতে পারে। সুপর্ণার স্ন্দুর সন্ধের শেষটার যে এমন পরিণাম হতে পারে, সেটা ও কল্পনাও করতে পারেনি।

‘দ্যাখ না দিদি, ভাস্কর কিছুই বুঝতে চায় না…’

ভাস্করকে খুব ভালো করেই জানে সুচরিতা। সুপর্ণা বরাবরই স্বামীকে ডমিনেট করে এসেছে। নিজের ইচ্ছে ওর উপর চাপাতে চাপাতে ভাস্করের জীবনটাকে দুর্বিষহ করে তুলেছিল। ছেলেটাকেও কোনওদিন আদর করে কাছে টানার চেষ্টা করেনি। বাড়ির বাইরেই সময় কাটিয়েছে বেশি। তাই চাকরির বদলি হওয়াতে ভাস্কর যে খুশিই হয়েছিল সেটা সুচরিতার অজানা নয়। চাকরির দোহাই দিয়ে সুপর্ণা ওদের সঙ্গে যেতে অস্বীকার করে। আর এই সুপর্ণাকে এতদিন, এতবছর ধরে সুচরিতা সকলের চোখের আড়ালে স্নেহ মমতা দিয়ে সিঞ্চন করে এসেছে। আজ আপশোশ হয় সুচরিতার।

দম আটকে আসতে থাকে ওর, সুপর্ণার ফ্ল্যাটের ভিতরে। একটা নেগেটিভ এনার্জি সুচরিতাকে সদর দরজার দিকে ধাক্বা মারতে থাকে। নিজের বোনের প্রতি এই ধরনের মনোভাব কোনওদিন সুচরিতা আগে ফিল করেনি। নিজেই ও সবথেকে বেশি দোষী। ঘৃণা হতে থাকে নিজের উপরেই সুচরিতার।

‘দিদি আর একটু বস না।’

‘না সুপর্ণা… আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে। তোর সঙ্গে আমার এইটুকুই কাজ ছিল’, বলে সুপর্ণার হাত ঝটকা দিয়ে সরিয়ে সুচরিতা বাইরে বেরিয়ে আসে। বাধভাঙা অশ্রু গড়িয়ে পড়তে থাকে সুচরিতার দুই গাল বেয়ে। কী যেন আশায় একবার মুখ ফিরিয়ে দেখে, ফেলে আসা বাড়িটার দিকে। ওকে পেছন থেকে ডাকার মতো একটা মানুষের মুখও চোখে পড়ে না। গভীর শ্বাস নেয় সুচরিতা। এই তো বেশ ভালো হল। টাকা ফেরত পাবার আশা কম তবে ‘দিদি কিছু টাকা দে’ বলে হাত বাড়ানো সুপর্ণাকে আর দেখতে হবে না। হঠাৎই সুচরিতা বুঝতে পারে ঘাড়ের ভারী বোঝাটা কখন যেন হালকা হয়ে গেছে। একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে অটো ধরতে এগিয়ে যায় সুচরিতা।

আই অ্যাম নট ভার্জিন

মোবাইলে অ্যালার্ম বাজতেই শ্রীতমা ধড়ফড় করে ঘুম থেকে উঠে বসে। প্রায় মরার মতো ঘুমোচ্ছিল। কাল অনেকটা ধকল গিয়েছে। অ্যালার্ম না দিলে হয়তো উঠতেই পারত না। কাল রাত্রে পার্টি করতে অত দূর যাওয়া উচিত হয়নি। ফিরতে ফিরতে রাত দুটো বেজে গিয়েছিল। আজ সকালে অডিশন আছে। মোনালিসাটা ছাড়ল না, জোর করে নিয়ে গেল। ওর বয়ফ্রেন্ডের বার্থডে পার্টি, যেতেই হবে। লং ড্রাইভে যাবে কোলাঘাট, ওখানে শের-এ-পাঞ্জাব-এ খানাপিনা, পার্টি হবে।

মোনালিসা, শ্রীতমা স্কুল-জীবন থেকে বন্ধু। এক সঙ্গে কলেজেও পড়েছে। মোনালিসা ব্যাংকে চাকরি করে, এখন কলকাতায় পোস্টিং। খাওয়াদাওয়ার প্রতি বিশেষ আকর্ষণ না থাকলেও, লং ড্রাইভে যাওয়ার লোভটা ছাড়তে পারল না শ্রীতমা। এটা ওর খুব পছন্দের। কখনও কখনও কার বুক করে একলাই বেরিয়ে পড়ে লং ড্রাইভে। মাঝে মাঝে শ্রীতমা স্বপ্ন দেখে লং ড্রাইভে এক অনন্ত যাত্রায় চলেছে সে। কখনও গন্তব্যে পৌঁছোতে পারে কখনও বা পৌঁছানোর আগেই ঘুম ভেঙে যায়।

লং ড্রাইভ শেষে বিস্তীর্ণ নীল সমুদ্র কিনারে সে একা। ঢেউ এর দিকে তাকিয়ে অপেক্ষায় থাকে অন্য কারও। যাকে সে চেনে না, জানে না, দেখেনি কখনও। আলস্য ঝেড়ে উঠতে উঠতে কাল রাত্রির পার্টির মজাগুলো মনে পড়ে খুশির রেখা দেখা দেয় শ্রীতমার মুখে।

মোনালিসার বয়ফ্রেন্ড ঈশান ইঞ্জিনিয়র, আইআইএম থেকে এমবিএ করেছে। মাইক্রোসফট-এ বড়ো পোস্টে চাকরি করে। স্মার্ট, হাসিখুশি ছেলে। কাল মজা করে বলছিল, আগে দেখা হলে সে শ্রীতমাকেই প্রোপোজ করত। ঈশানের কথা শুনে মোনালিসা একপ্রস্থ পিটিয়ে নেয় তাকে।

পার্টিতে ঈশানের বন্ধু সূর্য ছিল সঙ্গে। ইঞ্জিনিয়রিং আর এমবিএ ঈশানের সঙ্গে করেছে, এখন সিঙ্গাপুরে বড়ো মাইনের চাকরি করে। ছুটিতে বাড়ি এসেছে। বন্ধুর বার্থডে পার্টি তো মিস করা যায় না কোনও ভাবেই! চারজনে মিলে বেশ এনজয় করেছে কাল। পার্টি শেষে ফেরবার পথে সূর্য‌ শ্রীতমাকে প্রোপোজ করে। মোনালিসা উস্কায়, হ্যাঁ করে দে।

শ্রীতমা হেসে উড়িয়ে দেয়, এটা লালজল পানের আফটার এফেক্ট। দেখবে সকাল হলেই ঘোর কেটে যাবে।

সূর্য‌ শ্রীতমার হাতে হাত রেখে বলে, নো বেবি, ইটস রিয়েল।

বাঁকা হেসে শ্রীতমা হাতের উপর থেকে  সূর্য‌র  হাত নামিয়ে দেয়। বিভিন্ন পার্টিতে এমন ঘটনা অনেক বার ফেস করেছে সে, এমন কথা অনেকবার শুনেছে। পরের দিন তারাও ভুলে যায়, শ্রীতমাও আর মনে করার চেষ্টা করে না।

কাল রাত্রে সকলের সঙ্গে সেও অল্প ড্রিংক করেছিল। তবুও ঘুম ভেঙে সকালে সূর্য‌র মুখটা, সূর্য‌র কথাগুলো কেন যে মনে পড়ে গেল! গত রাত্রির স্মৃতি ঠেলে সরিয়ে রেখে বেড থেকে নেমে আসে শ্রীতমা।

বাথরুম থেকে একেবারে স্নান সেরে বেরোয় সে। সকাল নটা থেকে অডিশন। ফ্রিজ থেকে দুধ বের করে ইন্ডাকশন অ্যাভেনে চাপায় গরম করার জন্য। বেডরুমে এসে ওয়ার্ডরব থেকে নতুন কেনা ওয়েস্টার্ন ড্রেসটা বের করে পরে, হালকা প্রসাধন করে।

ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে ঘুরে ফিরে দেখে নেয় নিজেকে। পাঁচ পাঁচ হাইটে, চৌত্রিশ-ছাব্বিশ-ছত্রিশ ফিগারটা বেশ মোহময়ী লাগছে এই নতুন ওয়েস্টার্ন ড্রেসটায়। শরীরে চেপে বসা ড্রেসটা স্পষ্ট করে রেখেছে শরীরের বিভিন্ন কার্ভ। চনমনে সেক্সি-সেক্সি ফিল হচ্ছে ভিতর থেকে।

কিচেনে গিয়ে গরম দুধ দিয়ে কর্নফ্লেক্স খেয়ে বেরোনের জন্য রেডি হয় শ্রীতমা। ড্রেসের সঙ্গে মানানসই সিলভার কালারের পেনসিল হিল শু-টা টেনে নিয়ে সোফায় বসে পা গলিয়ে উঠে এসে আরও একবার নিজেকে দেখে নেয় ড্রেসিং টেবিলে। এখন সে আরও দীর্ঘাঙ্গী, পাঁচ ফুট পাঁচ নয়।

পোশাকের সঙ্গে মানানসই আগে থেকে বের করে রাখা হাত ব্যাগটা তুলে নেয়। চেন খুলে হ্যান্ড স্যানিটাইজার, সারফেস স্যানিটাইজার স্প্রে ব্যাগে ঢোকায়। নিজে পরে নেয় ডিজাইনার মাস্ক। মোবাইল অ্যাপে ক্যাব বুক করে ফ্ল্যাটের দরজা লক করে, নীচে নামার জন্য লিফ্ট-এ চড়ে শ্রীতমা।

নাকতলায় গলির মধ্যে পাঁচতলা বিল্ডিংটার, তিনতলার ওয়ান বিএইচকে এই ফ্ল্যাটে শ্রীতমা আছে বছর দেড়েক হবে। যখন প্রথম ছবির কাজ শুরু হল, তখন থেকে। ফ্ল্যাটের সামনের সরু রাস্তায় ক্যাব ঢোকে না, সেজন্য ভাড়াটা একটু কম। কাছেই বড়ো রাস্তা, অসুবিধা হয় না । এগিয়ে এসে বড়ো রাস্তায় দাঁড়াতে হয়, এই যা।

প্রথম ছবিতে সে লিড রোল করেছিল। ছবিটা ভালো বিজনেস করেছিল। তার অভিনয়ে প্রশংসাও হয়েছিল। এর পর পরই দ্বিতীয় ছবিটার অফার পেল। ভালো রেমুনারেশনে কন্ট্যাক্ট হয়েছে। প্যান্ডেমিকের জন্য এখন শুটিং বন্ধ আছে, অসুবিধাটা সেখানেই। ফ্ল্যাটের ভাড়া, ইলেকট্রিক বিল, নিজের খাওয়াদাওয়া ও অন্য সব খরচা তো আর বন্ধ নেই। সেজন্য অন্য কাজের ব্যাপারে যোগাযোগ করতে হচ্ছে।

সকাল সকাল একগাদা হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজ ঢুকেছে। লিফটে নামতে নামতে মেসেজগুলো দেখে নেয় শ্রীতমা। এতক্ষণ দেখার সময় পায়নি। চেনাজানা লোকজনের গুড মর্নিং মেসেজে ভরা। অচেনা একটা নাম্বার থেকেও মেসেজ এসেছে, সঙ্গে রেড হার্ট লাভ সিম্বল। শ্রীতমা হাসে, কোন পাগলের কাজ কে জানে!

লিফট থেকে বেরিয়ে হাঁটতে-হাঁটতে বড়ো রাস্তার দিকে এগোয়। অ্যাপ ক্যাবের ড্রাইভারের ফোন ঢুকছে। শ্রীতমা ফোন ধরে বলে, মেন রোডে কালী মন্দিরের সামনে থাকছি। কতক্ষণে আসছেন? হ্যাঁ হ্যাঁ আসুন। শ্রীতমা আবার মোবাইলটায় চোখ রাখে। ভাবতে থাকে, অচেনা নাম্বার থেকে কে মেসেজ পাঠাল।

বড়ো রাস্তায় এসে দাঁড়াতে লোকজন ঘুরে ঘুরে দেখছে শ্রীতমাকে। ব্যাগ থেকে সানগ্লাস বের করে পরে নেয়। ক্যাব সামনে এসে দাঁড়াতে দরজা খুলে সারফেস স্যানিটাইজার ক্যাবের ভিতরে স্প্রে করে উঠে বসে। শ্রীতমাকে স্প্রে করতে দেখে ড্রাইভার বলে, ম্যাম, আমি এখনই গাড়ি বের করেছি। ভালো করে স্যানিটাইজ করে এনেছি। ভয়ের কিছু নেই। আমাদেরও তো প্রাণের মায়া আছে! সারাদিনে কত রকমের প্যাসেঞ্জার চড়ছে।

শ্রীতমা হুম বলে চুপ করে যায়। ব্যাগ পাশে রেখে সিটে হেলান দিয়ে বসে। অডিশনের জন্য কনসেন্ট্রেট করার চেষ্টা করে। একটু এগোতে না এগোতে ফোন বেজে ওঠে। বিরক্ত হয়ে ফোন ধরে। রিচা ফোন করছে। ওর প্রথম ফিলম লাভ মি-তে সেকেন্ড লিড ছিল রিচা।

গুড মর্নিং। কী করছিস বল।

আর কী! বসে আছি। তোর খবর বল।

আমিও বসেই ছিলাম। এই ক’দিন হল একটা ওয়েব সিরিজে কাজ করছি। লিড রোল। ভালো পেমেন্ট করছে। একটু আধটু বোল্ড সিন আছে, এই যা। এমনিতে ইউনিটটা ভালো, সব লোকজনও বেশ ভালো। একটু থেমে রিচা বলে, তুই ওয়েব সিরিজ করবি?

এখনও ভাবিনি। ফিলমের শুট শিগগিরি শুরু হবে বলছে। দেখি, ফিলমের শুট শুরু হয়ে গেলে তো আর হবে না। না হলে হয়তো…

বলিস। বড়ো প্ল্যাটফর্মে এদের একটা নতুন প্রোজেক্ট আসছে। আমি যোগাযোগ করিয়ে দেব।

শ্রীতমা মিষ্টি করে বলে, থ্যাংকস।

রিচার ফোনে অন্য একটা ফোন ঢুকছে। একটা ইম্পট্যান্ট ফোন আসছেরে। পরে ফোন করছি, বলে রিচা ফোন কাটে।

শ্রীতমা সময় দেখে। এখনও মিনিট চল্লিশ হাতে আছে। আধ ঘন্টার মধ্যেই হয়তো পৌঁছে যাবে নিউটাউন। আজ ওখানেই অডিশন। সিটে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে বসে থাকে শ্রীতমা।

শুরুর দিন থেকে ফিলম কেরিয়ারের আজ পর্যন্ত জার্নিটা ভেসে ওঠে শ্রীতমার মনে। পরিস্থিতির চাপে সে যে এক অনিশ্চিত পথে চলতে শুরু করেছিল বছর কয়েক আগে, তা কি আর এক অনিশ্চয়তার দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে তাকে!

শ্রীতমা সবে মাত্র গ্র‌্যাজুয়েন শেষ করে মাস্টার্সে ভর্তি হয়েছে, সে সময় বাবা হঠাৎ ক্যান্সারে মারা গেলেন। আগে থেকে কিছুই বোঝা যায়নি। ছোটো ভাইটা এইচএস পড়ছে। বাবা দুর্গাপুর স্টিল প্ল্যান্টের কর্মী ছিলেন। একটা নিজস্ব বাড়ি বানিয়ে রেখে গিয়েছেন, এইটাই ভরসার। মাথার উপর একটা ছাদ আছে। বাবা মারা যাওয়ার পর মা সামান্য পেনশন পান। জমানো টাকা বলতে তেমন কিছু নেই। সে টাকায় সংসার চালিয়ে দুই ভাই-বোনের পড়াশোনা চালানো খুবই কঠিন। তখন থেকেই কোনও ভাবে ইনকাম করার চিন্তাটা শ্রীতমার মাথায় চেপে বসে।

পাঁচ ফুট পাঁচ-এর দীঘল শরীর, সুন্দর মুখশ্রী আর নজর কাড়া ফিগারের জন্য রাস্তায়, এলাকার ছেলেদের চোখ সব সময় তার উপর পড়ে থাকত। বান্ধবীরাও তার রূপের প্রশংসা করত। সে নাকি বাংলা ফিলম ইন্ডাস্ট্রির নায়িকার আকাল মেটাতে সক্ষম। ছোটোবেলা থেকে শ্রীতমা নাচ শিখেছে আর বড়ো হয়ে কলেজে পড়ার সময় থেকে দুর্গাপুরের নামি নাটকের গ্রুপে নিয়মিত অভিনয় করছে। কলকাতাতেও বেশ কয়েকটা শো করে গিয়েছে। তাই শ্রীতমার মনেও আশা জাগে, হয়তো সত্যিই সে পারবে!

তখন মাস্টার্স-এর ফার্স্ট ইয়ার। খবরের কাগজে একটা বিজ্ঞাপন দেখে নিজের ফটো আর রেজিউমে মেল করে পাঠায় শ্রীতমা। কলকাতার একটা নামি শপিং মলের হোর্ডিং-এর জন্য মডেল চেয়ে বিজ্ঞাপন ছিল। কয়েক দিনের মধ্যে অ্যাড এজেন্সি থেকে রিপ্লাই পেল, সে শর্ট লিস্টেড হয়েছে। ফাইনাল সিলেকশনের জন্য কলকাতায় এসে অডিশন দিতে হবে। সিলেক্ট হয়েছিল। সেই শুরু।

অ্যাড এজেন্সির মালিক সার্থকদার সঙ্গে একটা ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠল। সার্থকদার রেফারেন্সে প্রায় প্রতি মাসে একটা দুটো মডেল শুট-এর অ্যাসাইনমেন্ট পেয়ে যেত। পেমেন্টও খারাপ নয়। আসা যাওয়ার খরচ বাদ দিয়ে আট-দশ হাজার টাকা। সংসারের, নিজের আর ভাইয়ের পড়াশোনার খরচ অনেকটাই মিটে যেত সে টাকায়। এমন করেই দুই আড়াই বছর চলে গেল। মাস্টার্সের ফাইনালের আগে মাস কয়েক ব্রেক দিয়েছিল, পরীক্ষাটা ঠিকমতো দেওয়ার জন্য।

মাস্টার্সের রেজাল্ট বেরনোর আগেই একদিন সার্থকদার ফোন, এবার পাকাপাকি ভাবে কলকাতাতে চলে এসো।

শ্রীতমা আশ্চর্য হয়ে প্রশ্ন করে, কেন, কী হল আবার?

কেন আবার কি! তুমি ফিলমের হিরোইন হচ্ছো। আমাদের হাউস থেকে একটা ফিলম প্রোডিউস করছি। আর সেটাতে তোমাকে ছাড়া আর কাকে নিই বলো? তোমার অপোজিটে টলিউডের হট হিরো কাজ করবে। নামটা বলছি না। ওটা এখন সারপ্রাইজ হিসাবেই থাক।

শ্রীতমা খুশিতে লাফিয়ে ওঠে। সামনে থাকলে হয়তো সার্থককে জড়িয়ে ধরে একটা চুমু খেয়ে নিত। ফোনেই থ্যাংক ইউ সো মাচ বলে একটা চুমু ছুড়ে দেয়।

সে এবার টলিউডের নায়িকা হবে। যে টলিউডে সুচিত্রা সেন, সুপ্রিয়া দেবী, অপর্ণা সেন, সন্ধ্যা রায়, মহুয়া রায় চৌধুরী, ঋতুপর্ণা, শতাব্দী, ইন্দ্রাণী, এই সময়ে মিমি, নুসরত, শ্রাবন্তী, শুভশ্রী কাজ করছে, সেই টলিউডে তার নামটাও নায়িকা হিসাবে যুক্ত হয়ে যাবে। উচ্ছ্বসিত হয়ে শ্রীতমা ঘরময় নেচে বেড়ায়। সার্থকদার কাছে সে চিরঋণী হয়ে গেল।

সত্যিই এখন আর দুর্গাপুর থেকে যাওয়া আসা করে কাজ করা যাবে না। মডেলিং শুট-এর সময় এক দুদিনের কাজ থাকত। কোনও ভাবে ম্যানেজ হয়ে যেত। সিনেমা, সিরিয়ালে তো তা সম্ভব নয়। কখন কল টাইম দেবে কে জানে। কলকাতায় সেটেল করার কথা শুনেই মা ঝামেলা করতে শুরু করেছে, এবার একেবারে গোল্লায় যাবে, বিয়ে টিয়ে আর হবে না।

শ্রীতমাও থামে না, না হোক বিয়ে তাই বলে তো সে তার কেরিয়ার নষ্ট করবে না। এমন সুযোগ কজন পায়?

চেনাজানা ব্রোকারের মাধ্যমে সার্থক-ই ফ্ল্যাটটার ব্যবস্থা করে দিয়েছিল আর অ্যাডভান্স রেন্ট পেমেন্টটাও। ডেবিউ ফিলম হলেও ভালোই পেমেন্ট করেছিল সার্থকদা। হয়তো তাকে বিশেষ পছন্দ করত বলেই।

ফিলমের অফারটা পেয়ে যেন স্বপ্নের দুনিয়াটা শ্রীতমার হাতের মুঠোয় চলে এসেছে। বেশ কয়েকটা মাস ঘোরের মধ্যে দিয়ে কাটল। মহরত থেকে শুরু করে শুটিং এর প্রতিটা দিন, বিদেশে গানের শুটিং, প্রিমিয়ার শো, প্রেস মিট অন্য এক দুনিয়ায় পৌঁছে দিল শ্রীতমাকে। বাস্তব যেন পিছনে ফেলে আসা অতীত। লাইট, ক্যামেরা, অ্যাকশন গ্ল্যামারের জগত্টাই এখন আসল শ্রীতমার কাছে।

প্রথম ছবির ঘোরটা কাটতে না কাটতে দ্বিতীয় ছবির অফারটা পেয়ে গেল প্রভাসদার রেফারেন্সে। প্রথম ছবির ডিওপি প্রভাসদার সঙ্গে শ্রীতমার সম্পর্কটা গভীর হয়েছিল মরিশাসে।  গানের শুট করতে গিয়ে সার্থকদার অনুপস্থিতে তখন প্রভাসদাই শ্রীতমার ফ্রেন্ড, ফিলজফার, গাইড।

কীভাবে লাইট নিলে, কেমন লুক দিলে ফিলমে তাকে আরও সুন্দর দেখাবে, আলাদা করে সে সব টিপ্স দিত প্রভাসদা। আর নিজের হাতে ক্যামেরার কারসাজি তো করতই। ভবিষ্যতে কীভাবে ক্যারেক্টার বুঝে ফিলম সাইন করবে, সে সব অ্যাডভাইস দিত। এত কিছুর পর কিছু প্রত্যাশা তো থেকেই যায়! ইউনিটের লোকের মুখে রং মাখানো গসিপ হয়তো সার্থকের কানেও পৌঁছেছিল।

প্রভাসদার রেফারেন্সে অন্য হাউসের ফিলমে কাজ শুরু করার পর থেকে সার্থকদা শ্রীতমার ফোন ধরাই বন্ধ করে দিল। শ্রীতমা অফিসে দেখা করতে গেলেও দেখা করেনি। মিটিং-এ বিজি আছে বলে অ্যাভয়েড করেছে। রিসেপসনিস্টকে দিয়ে সে রকমই বলেছিল। এসব হওয়ার পর থেকে শ্রীতমার মনটাও কয়েকদিন বেশ খারাপ ছিল। নতুন লোকজনের সঙ্গে নতুন কাজ শুরু করার পর থেকে মনটাও অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে উঠেছিল।

শ্রীতমা শিখে গিয়েছে ফিলম ইন্ডাস্ট্রিতে সম্পর্ক ভাঙা-গড়ায় মনখারাপ করতে নেই। কিন্তু হঠাৎ করে শুটিং বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এখন সব দিক থেকে মুশকিল হয়ে গিয়েছে। সবে মাত্র একটা ফিলম রিলিজ করেছে। ইন্ডাস্ট্রিতে সে রকম চেনাজানা পরিচিতি হয়ে ওঠেনি এখনও, যে ডেকে ডেকে কাজ দেবে। এখনও ফ্রেশ ফেস বা স্ট্রাগলিং অ্যাক্ট্রেস বলা যায়।

জমানো টাকা খরচ করতে করতে প্রায় শেষ। শুধু তো নিজের খরচা নয়, বাড়ির জন্যও কিছু টাকা পাঠাতে হয়। ভাইটা কলেজে পড়ছে তার পড়াশুনার খরচও আছে। ফিলমের শুটিং শুরু হয়নি। এখন শুধু মডেল শুট, ওয়েব সিরিজ আর সিরিয়ালের শুটিং হচ্ছে। তাও অনেক বাধা নিষেধ মেনে।

শ্রীতমার পরিচিত ইন্ডাস্ট্রির মেয়েরা, যারা বিভিন্ন ছোটোখাটো প্রোজেক্টে কাজ করত, অ্যালবাম, শর্ট ফিলম-এ অ্যাক্টিং করত, তাদের অনেকেই আজকাল ওয়েব সিরিজের কাজ করছে শুনেছে। ভালো পেমেন্ট কিন্তু ওয়েব সিরিজগুলোর সবই প্রায় অ্যাডাল্ট কন্টেন্টে ভরপুর।

হাজার লোকের সামনে নিজের নগ্ন শরীর দেখিয়ে উপার্জনে তার ঘোর আপত্তি। আর বাড়ির লোকজন সে এমন কিছু করছে জানতে পারলে একেবারে অনর্থ হয়ে যাবে! এমনিতেই দুর্গাপুর ছেড়ে যখন থেকে কলকাতায় ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে থাকছে, তখন থেকেই বাড়ির সঙ্গে ঝামেলা। শ্রীতমা বোঝাতে পারে না ফিলমের কাজ আসা-যাওয়া করে হয় না, কলকাতায় একটা থাকার জায়গার দরকার।

এই সময় কিছু অ্যাডের কাজ বা মডেল শুট-এর কাজ পেলে ভালো হতো। কিন্তু সার্থকদার সঙ্গে সম্পর্কটা খারাপ হয়ে যাওয়ার পর থেকে অ্যাড বা মডেলিং-এর কাজ সে তেমন আর পায়নি। সব জায়গাতেই তো সেটিং আর কমপ্রোমাইজের গল্প। ফিলমে লিড রোল করার পর একদম ছোটোখাটো অ্যাডে কাজ করাটা ঠিক হবে না। তার স্ট্যাটাসে সেটা মানাবে না। বড়ো কোনও ব্র‌্যান্ডের অ্যাড হলে ঠিক আছে। কিন্তু সেরকম যোগাযোগ এখনও হয়নি।

প্রভাসদা বলেছে এমএনসি কোম্পানির একটা নামি ব্র‌্যান্ডের অ্যাড করার কথা চলছে। সেটা হলে শ্রীতমাকে সেখানে প্লেস করবে। বিগ বাজেট, ভালো পেমেন্ট পাবে। সেও কবে হবে কে জানে! কিছু তো একটা করতে হবে। না হলে চলবে কী করে। আজকের অডিশনের খবরটা পেয়েছে পরিচিত এক প্রোডাকশন ম্যানেজার রাজুদার কাছ থেকে।

পৌঁছোতে পৌঁছোতে প্রায় নটা বেজে গেল। তাড়াহুড়ো করে পৌঁছে দেখে বিভিন্ন বয়সের অনেক ছেলে মেয়ের ভিড়। শ’খানেক তো হবেই। বড়ো প্রোডাকশন হাউস, অফিসটাও বড়ো। বিভিন্ন চ্যানেলে এদের অনেকগুলো সিরিয়াল চলছে। বাংলার এক নম্বর পপুলার চ্যানেলে নতুন একটা পিরিয়ড ড্রামা শুরু হচ্ছে তার জন্য অডিশন। অনেকগুলো ফিমেল ক্যারেক্টারের প্রয়োজন। পনেরো-কুড়িটা তো লিড ক্যারেক্টারই আছে। শ্রীতমা নাম রেজিস্টার করিয়ে অপেক্ষা করে।

প্রভাসের ফোন ঢোকে, হ্যালো, কোথায় আছো? কী করছ? মেসেজেরও রিপ্লাই দিলে না!

পরে ফোন করছি, বলে শ্রীতমা ফোন কেটে দেয়। শ্রীতমা জানে এই কেয়ারিং-এর আড়ালে আসলে নজরদারি করছে প্রভাসদা। ইচ্ছা করেই কিছু বলেনি ওকে। শুনে হয় নানান নেগেটিভ কথা বলত, নয়তো সঙ্গে চলে আসত। কাজের জায়গায় লেজুড় নিয়ে ঘোরা একদমই পছন্দ নয় শ্রীতমার।

এখানে আসা মেয়েদের দেখেই বোঝা যাচ্ছে, বেশিরভাগই শহরতলীর কোনও না কোনও জায়গা থেকে এসেছে। সঙ্গে মা বা অন্য কোনও অভিভাবক। চেহারা পোশাকআশাক দেখে বোঝা যাচ্ছে সকলেই প্রায় মধ্যবিত্ত ঘরেরই মেয়ে, শুরুর দিনের তারই মতো। সে যেমন কিছু ইনকাম করে সংসারে সাহায্য করবে বলে মডেলিং-এর পথ বেয়ে অভিনয় জগতে ঢুকে পড়েছিল। হয়তো এদের অনেকেই সে রকম পরিস্থিতির মধ্যেই বড়ো বড়ো স্বপ্ন সাজিয়ে এসেছে আজকের অডিশনে। আজকের পর এদের মধ্যে অনেকেরই হয়তো ভবিষ্যৎ জীবন বদলে যাবে। আবার অনেকেরই স্বপ্ন ভঙ্গ হবে। হয়তো এই অডিশনের গণ্ডি পার হতে মেনে নেবে অনেক কিছু।

যার কাছে শ্রীতমা অডিশনের জন্য নাম লেখাল সে তাকে চিনতে পারেনি। মনে মনে একটু অভিমান-ই হয় তার। তার একটা ফিলম রিলিজ হয়েছে। শহর জুড়ে হোর্ডিং পড়েছিল তবুও…। শ্রীতমা একপাশে সরে এসে বসার জন্য সাজিয়ে রাখা একটা চেয়ার টেনে বসে।

এক এক করে নাম ডাকা হচ্ছে, ভিতরে ঢুকে অডিশন দিয়ে বেরিয়ে আসছে। প্রত্যেকের ভিন্ন অভিব্যক্তি চোখ মুখে স্পষ্ট ফুটে উঠছে। কেউ ঘেমে নেয়ে অস্থির। ঘটনার আকস্মিকতায় কারও মুখে কালো মেঘের ছায়া। কেউ বা ফিরছে দুষ্টু হাসি মেখে শরীরী ভঙ্গিতে হরিণী চপলতা নিয়ে। উপস্থিত মেয়েদের মধ্যে পোশাকে প্রসাধনে শ্রীতমাই শ্রেষ্ঠ বলা যেতে পারে।

অপেক্ষায় থাকা মেয়েদের অনেকেই ঘুরে ফিরে শ্রীতমাকে দেখছে। ওরা ওর সাজ পোশাক, ওর সৌন্দর্য দেখছে নাকি ওদের মধ্যে কেউ কেউ ওকে রিকগনাইজ করতে পেরেছে লাভ মি ফিলমের নায়িকা হিসাবে। একটু প্রাউড ফিল করে।

শ্রীতমা নিজেকে আলাদা করে নেওয়ার জন্য মোবাইল নিয়ে ঘাঁটাঘাটি শুরু করে। ফেসবুক পেজ ঘুরে ফিরে দেখে অস্থির সময়টুকু কাটানোর জন্য। ঘন্টাখানেক হয়ে গেল। কেমন যেন সাফোকেটেড লাগছে শ্রীতমার। নিজেকে ভ্যালুলেস, ছোটো মনে হচ্ছে। সে তো ফিলমের হিরোইন। সিরিয়ালের একটা ক্যারেক্টার পাওয়ার জন্য এভাবে এতক্ষণ বসে থাকতে হবে! ভাবে প্রোডাকশন ম্যানেজার রাজুদাকে ফোন করে একটু ঝাড় দেবে, এ কোথায় আসতে বললে? এখানে তো দেখছি গরু ছাগল সব সমান। আলাদা কোনও ট্রিটমেন্টই নেই। আগে জানলে আসতাম না। আবার পরক্ষণেই ভাবে, রাজুদার কি আর দোষ। হেল্পিং মাইন্ড নিয়ে তো খবরটা দিয়েছে।

শ্রীতমা ভাবে এত এত মেয়ের এত কাজের অভাব! এত অর্থের অভাব, তবেই না! হলগুলো খোলা থাকলে সে সিরিয়ালে নাম না লিখিয়ে আবার মঞ্চের নাটকে ফিরে যেত। কিন্তু সমস্যাটা তো সেই অর্থের। অর্থের জন্যই আজ মেয়েগুলো ওয়েব সিরিজে অভিনয়ের নামে সফট পর্ন করছে। হয়তো পর্দায় যা দেখানো হচ্ছে পর্দার পিছনে করতে হচ্ছে তার থেকেও বেশি।

অনেকটা সময় অভিনয় অভিনয় করে কাটিয়ে দেওয়ার পর এখন আর ফেরবার জায়গা নেই। মনে প্রাণে বাঁধা পড়ে গিয়েছে এখানে। শুধু বেঁচে থাকার জন্য কিছু একটাকে আঁকড়ে ধরা। অভিনয়ের জায়গাটা দিন দিন ছোটো হয়ে আসছে। শরীর প্রদর্শনই এখন মুখ্য অভিনয়। সরকারই তো ব্যবস্থা করে দিয়েছে ওটিটি প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে এমন সব কনটেন্ট সকলের হাতের মধ্যে পৌঁছে দিতে। পছন্দ মতো অ্যাপ ডাউনলোড করে সাবস্ক্রাইব করো। তারপর মোবাইলে হাত ছোঁয়ালেই কত না ওয়েব সিরিজ, শর্ট ফিলম। গুলে যাও ঘোলা দুনিয়ায়!

বসে বসে উলটোপালটা ভাবতে ভাবতে শ্রীতমা শুনতে পেল তার নাম ডাকছে। চেয়ার ছেড়ে উঠে সপ্রতিভ ভাবে এগিয়ে রিসেপসনিস্ট-এর সামনে যেতে, সে দেখিয়ে দিল কোন ঘরে যেতে হবে। পারমিশন নিয়ে শ্রীতমা অডিশন রুমে ঢোকে। সুন্দর করে সাজানো অফিসরুমের একটা ওয়ালে লাগানো ডিসপ্লে বোর্ডে এদের হাউসের পপুলার সিরিয়ালগুলোর বিভিন্ন ফোটো লাগানো আছে। ফলস সিলিং-এ লাগানো ডিজাইনার এলইডি লাইটগুলো ঘরের মধ্যে একটা মায়াবি পরিবেশ সৃষ্টি করছে। এ পরিবেশ যেন সম্মোহিত করার জন্য।

বড়ো এগজিকিউটিভ টেবিলের ও পাশে কাঁচাপাকা চুলের সুদর্শন যে-ভদ্রলোক বসে, উনি দেবাদিত্য বোস। সিরিয়ালের নামি পরিচালক। টেবিলের পাশে বসা অন্য জন হাউসের প্রোডাকশন কন্ট্রোলার।

শ্রীতমাকে ওরা বসতে বলে। ঘরে ঢোকা থেকে বসা পর্যন্ত ওদের নজর শ্রীতমার শরীর জুড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কী কী করেছে, এখন কী করছে রুটিন প্রশ্ন করে। নানা রকম হ্যাজানো প্রশ্ন কথাবার্তা শুরু করে। শ্রীতমা ভাবে নিশ্চয় পছন্দ হয়েছে ওকে, তাই এতটা সময় নিচ্ছে।

মাথা গরম করা প্রশ্নটা হঠাৎ উড়ে আসে।

আর ইউ ভার্জিন?

শ্রীতমা নিজেকে সামলে নিতে কয়েক সেকেন্ড সময় নেয়। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। শরীরের সব রক্ত মাথায় চড়ে ধাক্কা দিচ্ছে। বার্স্ট করে শ্রীতমা…হাউ ডেয়ার ইউ আস্ক মি সাচ রাবিশ?

ওরা থতমতো খেয়ে গিয়ে আমতা আমতা করে কথা ঘোরানোর চেষ্টা করে। শ্রীতমার চিৎকার বাইরে থেকেও শোনা যাচ্ছে।

শ্রীতমা আরও রেগে টেবিলের সামনে ঝুঁকে পড়ে, চোয়াল শক্ত করে জবাব দেয়, নো। আই অ্যাম নট দ্যাট। আই অ্যাম নট ভার্জিন।

প্রোডাকশন কন্ট্রোলার কোনও মতে বলে সরি, আপনাকে সিলেক্ট করতে পারলাম না।

ইয়োর সিলেকশন! মাই ফুট। সজোরে দরজা খুলে গট গট করে বেরিয়ে যায় শ্রীতমা। অডিশন রুমের দরজাটা নিস্তব্ধতা ভেঙে সশব্দে বন্ধ হয়। শ্রীতমার সদর্পে চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে বাইরে উপস্থিত সকলে।

বাড়ি ফিরে হাতব্যাগ, জুতো, জামা এদিক ওদিক ছুড়ে ফেলে দিয়ে সোফায় হতাশ শরীর এলিয়ে দেয় শ্রীতমা। সকালে লাভ মেসেজ করা সেই অচেনা নাম্বার থেকে ফোন কল আসছে। শ্রীতমা ফোন ধরে খিঁচিয়ে ওঠে, কে রে বো…দা সকাল থেকে ডিস্টার্ব করছিস?

সরি টু ডিস্টার্ব ইউ। আমি সূর্য‌। পরশু সিঙ্গাপুর ফিরে যাচ্ছি। তার আগে কি একবার দেখা করা যায়?

শ্রীতমা উত্তর না দিয়ে চুপ করে থাকে। এর মধ্যে প্রভাসদার ফোন ঢুকছে।

শ্রীতমা রিকল করতে থাকে প্রথম কবে সে ভার্জিনিটি লুজ করেছিল কার সঙ্গে! তারপর… তারপর…

সে কি সূর্য‌কে, প্রভাসদাকে বলে দেবে, আই অ্যাম নট ভার্জিন। তারপরেও কি প্রভাসদা তাকে কাজ খুঁজে দেবে! আগের মতো গাইড করবে? তার পরেও কি সূর্য‌ তাকে বলবে, বেবি আই লাভ ইউ?

শ্রীতমা মোবাইল হাতে নিয়ে বসে থাকে। কে জানে অন্য প্রান্তে সূর্য‌ বা প্রভাসদা উত্তরের অপেক্ষায় এখনও লাইনে আছে কিনা!

ক্যানভাস

দুচোখের পাতা অর্ধেক খুলতে না খুলতেই হুড়মুড় করে এসে পড়ল সাত সকালের সোনালি রোদের ছটা। বিছানার পাশের জানলার ভারী পর্দাগুলো সরানো। এ নিশ্চয়ই অয়নের কাজ। এত বারণ করি তবুও শুনবে না। আমাকে বিরক্ত করে যে ও কী আনন্দ পায় কে জানে! এত রাগারাগি, চ্যাঁচামেচি কিছুতেই ওর কিছু যায় আসে না। সবসময় ওই এক ভালোমানুষের ভাবমূর্তি, অসহ্য!

ওকে যত দেখছি ততই অবাক হয়ে যাচ্ছি আমি। কী ধাতুতে গড়া! কম তো অত্যাচার করি না। বিয়ের আগেই জানিয়েছিলাম আমার আর রূপমের খোলামেলা সম্পর্কের কথা। যাতে ও এই বিয়েতে রাজি না হয়। কিন্তু কোথায় কী! আমার কোনও কথারই কোনও ফল হয়নি। তিন মাস হয়ে গেল বিয়ে, এখনও ওকে ছুঁতে পর্যন্ত দিইনি আমার শরীর। তবুও সে একই রকম নিরুত্তাপ! আমার মেজাজ, অহেতুক ঝগড়াঝাঁটি, জিনিসপত্র ভাঙা সব সহ্য করছে নিঃশব্দে।

বাবা যেদিন আমার বিয়ের ভাবনার কথা প্রথম বলেছিল পিকলুদাকে, সঙ্গে সঙ্গে সে প্রস্তাব করেছিল তার শান্তশিষ্ট সহকর্মী অয়নের নাম। সব দেখে শুনে বাবা-মা একবারে রাজি হয়ে যায়। আমার আপত্তির পরোয়া কেউ করেনি। রূপমও তখন ছিল না আমার কাছে। দিন কাটাচ্ছিল কলকাতার কোনও এক রিহ্যাবে।

সন্ধে নামলেই অন্ধকার ব্যালকনিতে বসে থাকি আজকাল। আকাশের অগুনতি তারাদের ভিড়ে হারিয়ে ফেলতে ইচ্ছে করে নিজেকে। আজও বেতের হেলানো চেয়ারটায় বসে একমনে ভাবছিলাম রূপমের কথা। আজ প্রায় ছমাস হতে চলল, দেখা হয়নি আমাদের। কোথায় আছে, কেমন আছে তাও জানি না আমি।

কী করছিস এখানে? তারা গুনছিস? পেছন থেকে চুপি চুপি বলল ঝুম্পাদি, আমার পিসতুতো দিদি।

আরে, তুমি কখন এলে? পিকলুদা আসেনি?

এসেছে। ওই তো ড্রযিংরুমে আছে অয়নের সঙ্গে। কিন্তু গুনগুন একি চেহারা হয়েছে তোর? ফ্যাকাশে চোখমুখ, এলোমেলো চুল!

ধুস! ছাড়ো তো। সাজগোজটা কোনও কালেই আমার দ্বারা ঠিক হয় না।

সে আমি জানি। তাই বলে একটু পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন তো হয়ে থাকবি। অয়ন কী ভাবে বলতো? আহত স্বরে বললাম, অয়ন কী ভাবে! আচ্ছা, আমার ভাবনার পরোয়া কেউ কখনও করেছে ঝুম্পাদি? তোমরা তো জানতে যে রূপমকে ছাড়া আমি বাঁচব না। তবুও জোর করে, রীতিমতো ব্ল্যাকমেল করে বাড়ির সকলে মিলে আমাকে ঝুলিয়ে দিলে অয়ন পুরকায়স্থ নামক এক নিপাট ভদ্রলোকের গলায়!

তুই একটা আস্ত পাগল রে গুনগুন! এখনও ওই বদমেজাজি, নেশাখোর ছেলেটার কথা ভাবছিস? নিজেও কষ্ট পাচ্ছিস, আর অয়নকেও কষ্ট দিচ্ছিস।

তোমরা জানো না, রিহ্যাবে যাবার আগে রূপমকে আমি কথা দিয়েছিলাম, ওর জন্যে অপেক্ষা করব। কথা না রাখতে পারার জ্বালায় জ্বলে যাচ্ছি আমি প্রতিটা দিন, প্রত্যেক মুহূর্তে। আমার জীবনে আর কোনও রং অবশিষ্ট নেই গো ঝুম্পাদি। স্রেফ পড়ে আছি একটা ফাঁকা ক্যানভাসের মতো।

আমার সামনে এসে দাঁড়াল ঝুম্পাদি। বলল, এখন কথা খেলাপির জন্যে কষ্ট পাচ্ছিস আর রূপমকে বিয়ে করলে অনুশোচনার আগুনে জ্বলে পুড়ে মরতিই রে বোকা মেয়ে।

 

( ২ )

ড্রাইভিং সিটে বসে আছে পিকলুদা। পাশে অয়ন। পেছনে আমি আর ঝুম্পাদি।

জায়গার নামটা যেন কী?

ওই তো শামুকতলা থেকে কিছুটা দূরে। গ্রামের নাম একটা বলেছিল বটে রঞ্জন কিন্তু সেটা ঠিক মনে পড়ছে না। ওদের পৈতৃক বাড়ি ওখানে। ঝুম্পাদির প্রশ্নের উত্তরে বলল পিকলুদা।

দেখেছিস এই একজন মানুষ! কোথায় যাচ্ছি না যাচ্ছি ঠিক মতো না জেনেই রওনা হওয়ার জন্যে তৈরি। বলি জায়গাটার নামটা তো শুনবে খেয়াল করে। তাহলে গুগল ম্যাপে একটু সার্চ করে দেখতাম। গলায় বেশ ঝাঁঝ নিয়ে বলে উঠল ঝুম্পাদি।

পিকলুদাও দমবার পাত্র নয়। আরে রাখো তো তোমার গুগল ম্যাপ-ট্যাপ। বিরাট টেক স্যাভি হয়েছে আজকাল! শামুকতলা বাজারে পৌঁছে ফোন করতে বলেছে রঞ্জন। ওখানে আমাদের জন্যে অপেক্ষা করবে ও। তারপর নিয়ে যাবে গন্তব্যে। স্ত্রী, ছেলেমেয়েদের কলকাতায় রেখে অনেকদিন বাদে দেশের বাড়িতে এসেছে রঞ্জন, আমার ইউনিভার্সিটির রুমমেট। সেদিন ফোনে আমন্ত্রণ জানাল ওদের গ্রামের বাড়িতে দু-একটা দিন সপরিবারে কাটিয়ে যাবার। এই উইক-এন্ডে তিনদিন পরপর ছুটি আছে। তাই লুফে নিলাম প্রস্তাবটা। কম খরচে ছোটোখাটো একটা আউটিং হয়ে যাবে। ঠিক কিনা বল, গুনগুন?

জোর করে মুখে একটা হাসি টেনে এনে পিকলুদার কথায় সম্মতি জানালাম আমি। ঝুম্পাদিরা নিঃসন্তান। তাই ঘোরাফেরা, হইচই করেই চেষ্টা করে নিজেদের জীবনের শূন্যতাটাকে ভরিয়ে রাখতে। আজকাল ওদের সঙ্গী হয়েছি আমি আর অয়ন। আমাদের মাঝখান দিয়ে বয়ে চলা অন্ধকার নদীটাকে আলোয় ভরাতে চায় ওরা।

 

( ৩ )

একটু দূরেই ভুটান পাহাড়। পাশ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে একটা নাম না জানা পাহাড়ি ঝোরা। ধারে কাছে ঘরবাড়ি বিশেষ নেই। নৈঃশব্দের ভিড়ে একাকী দাঁড়িয়ে আছে কাঠের তৈরি দোতলা বাড়িটা। চারপাশে কত রকমের ফুলের গাছ। নিকোনো উঠোন। গ্রামের বাড়ি হলেও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। রুচির ছাপ স্পষ্ট।

সন্ধের মুখে দোতলার ঘরে চলছিল গল্পগুজব। রঞ্জনদা দামি স্কচের বোতল খুলে বসেছেন। ওঁকে সঙ্গ দিচ্ছে পিকলুদা আর অয়ন। রাঁধুনি সোমরাজ প্লেটে সাজিয়ে দিয়ে গিয়েছে কুচো চিংড়ির পকোড়া আর ফ্রায়েড কাজু। কফির কাপ হাতে আমি আর ঝুম্পাদি নির্বাক দর্শক। কথায় কথায় রঞ্জনদা বলছিলেন অকৃতদার বিরাজকাকু আমাদের দূর সম্পর্কের আত্মীয়। ওনার বাবা ডিফেন্সে ছিলেন, তাই বহুদিন ওনারা গ্রামছাড়া। পনেরো বছর আগে হঠাৎ বিরাজকাকু ফিরে আসে এখানে। বাবা গত হয়েছেন। মা অথর্ব। অকূল সমুদ্রে খাবি খাচ্ছি একলা আমি। বিরাজকাকুকে পেয়ে যেন হাতে চাঁদ পেলাম। সব দাযিত্ব ওঁর কাঁধে চাপিয়ে নিশ্চিন্তে চলে গেলাম কলকাতা, রুজিরুটির টানে। বিরাজকাকু না থাকলে সব সাত ভূতে খেত এতদিনে। শিল্পী মানুষ তো, তাই খুব শৌখিন। যত্ন করে আগলে রেখেছে আমার পৈত্রিক ভিটেমাটি, জমিজিরেত।

রঞ্জনদার একটু টিপসি লাগতে শুরু করেছে সবে। মাঝে মাঝেই বাঁক বদলাচ্ছে কথার স্রোত। সেই সময় ঘরে ঢুকলেন ঢোলা পাজামা-পাঞ্জাবি পরা, একমাথা কাঁচাপাকা চুলের ভদ্রলোক।

আরে বিরাজকাকু আসুন আসুন, আপনার জন্যেই অপেক্ষা করছি। তাঁকে দেখে বলে উঠল পিকলুদা।

অয়ন-এর সঙ্গে তো পরিচয় হয়েছে। এই আমার মিসেস ঝুম্পা আর ওটি আমার শ্যালিকা গুনগুন।

আমার দিকে তাকাতেই ভদ্রলোক কেমন যেন চমকে উঠলেন। অবাক চোখে দেখছিলেন আমাকে। সেই দৃষ্টিতে যে কী ছিল বলে বোঝানো যাবে না। রাগ? দুঃখ? ভয়? আনন্দ? নাকি অন্য কিছু? ঠিক বুঝতে পারছিলাম না। গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল আমার! ভদ্রলোক আর দাঁড়ালেন না। দ্রুত পায়ে বেরিয়ে গেলেন ঘর থেকে।

রাতে ঘুমোতে যাবার আগে অয়নকে বললাম আচ্ছা বিরাজকাকু ওভাবে কেন দেখছিলেন আমাকে?

কী জানি! রঞ্জনদা বলছিলেন উনি একটু আপনভোলা গোছের মানুষ।

আমার কেমন যেন ভয় ভয় করছে। ওঁর চোখ দুটো মনে পড়লেই কাঁটা দিচ্ছে গায়ে কে জানে আবার মাথাটাথা খারাপ কী না? এই পাণ্ডববর্জিত জায়গায় একা থাকেন। বেশ সন্দেহ হচ্ছে।

একটা অভয় দেবার হাসি হেসে অয়ন বলল অত ভেবো না। আমি, মানে আমরা সকলে আছি তো। কিছু হবে না। ঘুমিয়ে পড়ো। মোটা চাদরটা আমার গায়ে টেনে দিয়ে পাশ ফিরে শুয়ে পড়ল অয়ন।

 

( ৪ )

ঘুমের ওষুধ ছাড়া আজকাল ঘুম আসে না সহজে। কিন্তু কাল রাতে বেমালুম ভুলে গিয়েছিলাম ওষুধ খাবার কথাটা। তবুও অনেকদিন পর নিখাদ শান্তির ঘুম ঘুমিয়েছি আমি। হয়তো এই শান্ত পরিবেশে এসে অস্থির মনটাও বিরতি নিয়েছে কিছুক্ষণের জন্য। হঠাৎ আমার চোখ পড়ল নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে থাকা অয়নের দিকে। শিশুর মতো সারল্য ছড়িয়ে আছে সারা মুখে।

ভোরের দিকে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গিয়েছে। হালকা মেঘের আস্তরণ ফুঁড়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে সূর্য। সকাল সকাল বৃষ্টিস্নান সেরে আরও বেশি সবুজ হয়ে উঠেছে গাছগাছালি। কখনও কখনও মেঘছেঁড়া রোদ এসে পড়ছে তাদের গায়ে। ভেজা শরীরে রোদের আদর মেখে ঝিকমিক করে উঠছে বৃষ্টিধোয়া পাতাগুলো। পরক্ষণেই কোথা থেকে এক টুকরো মেঘ এসে বিষাদের পর্দা টেনে দিচ্ছে সেই সোহাগি আলোর প্রবাহপথে।

রৌদ্র-ছায়ার খেলা দেখতে দেখতে নেমে এলাম সিঁড়ি দিয়ে একটা ঘরের কাছে এসে থেমে গেল পা দুটো। দরজাটা হাট করে খোলা। জানলা দিয়ে একফালি আলো এসে পড়ছে একটা ক্যানভাসের ওপর। দেখি হাতে রঙের প্যালেট আর পয়েন্টেড তুলি নিয়ে বিরাজকাকু একমনে তাকিয়ে আছেন ফাঁকা ক্যানভাসটার দিকে। শুনেছিলাম সব শিল্পীর কাছেই তাঁর সৃষ্টি নিছক কাজ নয়, সাধনা। হয়তো বিরাজকাকু সে রকমই কোনও সাধনায় মগ্ন হয়ে আছেন। মনে মনে সৃষ্টি করে চলেছেন নতুন কিছু। একটু পরেই যা তুলির টানে মূর্ত হয়ে উঠবে এই শূন্য ক্যানভাসের ওপর। পায়ের শব্দ শুনে ঘাড় ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকালেন বিরাজকাকু। সেই একই রকম দুর্বোধ্য চাহনি।

 

আলিপুরদুয়ার জেলার এই অঞ্চলে অনেক জনজাতির মানুষের বাস। এদের পূর্বপুরুষরা অনেকেই খ্রিস্টান হয়ে গিয়েছিলেন একটা সময়। তাই গ্রামের মাঝে তৈরি হয়েছে একটা বড়োসড়ো প্রটেস্টান্ট গির্জা। দুপুর দুপুর চার্চ, সিমেট্রি ঘুরে আমরা সবে ফিরেছি। এমন সময় সোমরাজ এসে বলল কাকাবাবু সেই সকাল থেকে ঘরের দরজা বন্ধ করে রেখেছেন। খাওয়াদাওয়া কিছুই করেননি। আপনারা একবার ডাকবেন? শরীরটরির ঠিক আছে কিনা দেখবেন একটু?

সেকি! বিরাজকাকু তো কখনও এমন করেন না। শঙ্কিত গালায় বললেন রঞ্জনদা।

বিস্তর হাঁকডাকের পর অবশেষে খুলল দরজা। এদিক ওদিক শূন্য দৃষ্টি নিয়ে দেখে বিরাজকাকুর চোখ স্থির হল আমার চোখের দিকে। একটা অস্বস্তি ক্রমশ ঘিরে ধরছিল আমাকে। একটু একটু করে আমার কাছে এগিয়ে আসছিলেন বিরাজকাকু। বাড়তে থাকা হৃদকম্পটা টের পাচ্ছিলাম ভালো ভাবে। নিজের অজান্তেই কখন যেন শক্ত করে ধরে ফেলেছি আমার পাশে দাঁড়ানো অয়নের হাতটা।

কোথায় ছিলে তুমি এতদিন? সেই যে আমাকে ম্যারেজ রেজিস্ট্যারের অফিসের সামনে অপেক্ষা করতে বলেছিলে, মনে পড়ে? তুমি আর এলে না তো! কত খুঁজেছি তোমায়। বন্ধু, পড়শিরা বলল, তোমার বাড়ির লোকেরা নাকি তোমাকে অন্য কোথাও নিয়ে গিয়েছে। সেখান থেকে বিয়ে হবে তোমার। সত্যিই হয়েছিল? জানো, সব ছেড়ে এসেছি আমি। সেই শহর, পুরোনো রাস্তা, গলি, চৌমাথা যা কিছু তোমার কথা মনে করাত, স…ব।

খড়খড়ে গলায় বলা কথাগুলো শুনে আমার সারা শরীরটা কাঁপছিল। মনে হচ্ছিল আমার সামনে বিরাজকাকু নয় রূপম দাঁড়িয়ে আছে। আজ যদি সে ফিরে আসে তবে এভাবেই অভিযোগের তিরে বিদ্ধ করবে আমাকে। কাঁপুনিটা যত বাড়ছিল, তত শক্ত করে ধরছিলাম অয়নের হাতটা। সকলেই হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে আছে।

বিহ্বল ভাবে কথা বলছেন শুধু বিরাজকাকু, তুমি প্রায়ই অভিযোগ করতে আমি কত কিছু আঁকি কিন্তু কখনও তোমার ছবি আঁকি না। বিশ্বাস করো, তুমি চলে যাবার পর আমি আর অন্য কিছু আঁকতে পারিনি। রং তুলির আঁচড়ে শুধু ধরে রাখতে চেয়েছি তোমাকে। কিন্তু ব্যর্থ হয়েছি বারবার। দিনের পর দিন অসহায় ভাবে দাঁড়িয়ে থেকেছি ফাঁকা ক্যানভাসের সামনে। এতদিন ধরে যে-ব্যর্থতার কষ্ট বয়ে বেড়াচ্ছিলাম তার থেকে আজ হয়তো মুক্তি পাব আমি। সেই চোখ, সেই মায়াভরা দৃষ্টি… সব অতীত আমার সম্মুখে। আমি পারব এবার। দেখে নিও ঠিক পারব তোমার ছবি আঁকতে। এসো আরফিন, বসো এখানে।

রঞ্জনদা অসহিষ্ণু ভাবে বললেন, ও আরফিন নয়, গুনগুন। অয়নের স্ত্রী।

বিরাজকাকু ভুরু কুঁচকে তাকালেন। তারপর শান্ত গলায় বললেন, তুই জানিস না রঞ্জন, ডিব্রুগড়ে আমাদের বাড়ির পাশে থাকত ওরা। আরফিন, আমার আরফিন।

আবার আরফিন! বললাম না ওর নাম…

জানি না হঠাৎ অয়নের কী হল। রঞ্জনদাকে থামিয়ে দিয়ে বলে উঠল ছেড়ে দিন রঞ্জনদা, এসব বুঝবেন না বিরাজকাকু। দেখছেন না একটা ঘোরের মধ্যে আছেন উনি, বন্দি হয়ে আছেন ভালোবাসার মায়াজালে। আরফিন এখনও ভীষণ ভাবে জীবন্ত ওনার অনুভবে। তাকে ফিরে পাবার ইচ্ছে এতটাই প্রবল যে বাদামি চোখ আর বড়ো বড়ো আঁখিপল্লবের গুনগুন ওনার কাছে ধরা দিচ্ছে আরফিন হিসেবে। সেদিনের আরফিন আর আজকের গুনগুনের মধ্যে যে পনেরোটা বছরের ফারাক, সে খেয়াল ওনার নেই। একটা ইলিউশনকে আঁকড়ে বাঁচতে চাইছেন উনি। আসুন না আমরা বাঁচতে দিই ওনাকে।

বিরাজকাকুর দিকে মুখ ফিরিয়ে অয়ন বলল, হ্যাঁ আরফিন, ও আপনারই আরফিন। আঁকুন বিরাজকাকু। ঘুমিয়ে থাকা শিল্পীমনকে জাগিয়ে তুলুন আবার। শূন্য ক্যানভাস ভরে উঠুক রঙে রঙে।

বিরাজকাকু মুগ্ধ হয়ে দেখে চলেছেন আমাকে। আর আমি, অয়নকে। কোথা থেকে একটা হালকা হাওয়া এসে ছুঁয়ে গেল আমাদের। ভেতরের কাঁপুনিটা থেমে গিয়েছে কখন যেন। অয়নের বাম হাতটা কিন্তু এখনও রয়েছে আমার ডান হাতের ভেতর, নির্বিকারে উষ্ণতা বিনিময় করছে তারা একে অপরের সঙ্গে।

 

অপত্য

অফিস ফেরত রোজই একবার করে থানায় ঘুরে আসে দেবেশ। আজ তিন মাস যাবৎ এই চলে আসছে। এই কয়েকদিনের ধকলেই আদ্যোপান্ত বুড়ো হয়ে গেছে মানুষটা। মাথায় এখন কাঁচার তুলনায় পাকারই আধিক্য। চোয়াল ভেঙে গালদুটো ভিতর দিকে ঢুকে গেছে। চোখের নীচে একরাশ কালি। দেখলেই বোঝা যায় বেশ কয়েকরাত ঠিক করে ঘুমোয়নি।

আজও রুটিনের বড়ো একটা হেরফের হয়নি। অফিস চলাকালীন ইন্সপেক্টর তপন সিকদারের ফোন পেয়ে কয়েকঘন্টা আগেই থানায় ছুটে গিয়েছিল দেবেশ। বড়োবাবু অসীম জোয়ারদারের ঘরের বাইরে বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর, যে-খবরটা নিয়ে ফিরেছিল দেবেশ, তাতে তাকে আরও বিমর্ষ দেখাচ্ছিল।

স্বামীর অপেক্ষাতেই বারান্দায় পায়চারি করছিল কাবেরী। তার নজর আটকে ছিল বাইরের মূল ফটকের দিকে। দেবেশকে ঢুকতে দেখেই তাড়াহুড়ো করে দরজাটা খুলে দেয় সে। এক মিনিটও ব্যয় না করে প্রশ্ন করে বসে, ‘কোনও খবর পেলে?’ স্ত্রী-র কথার কোনও সদুত্তর দিতে পারে না দেবেশ। কেবল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। চুপচাপ জুতোটা খুলে ঘরের ভিতর ঢুকে যায়। সামনে থাকা সোফাটার উপরে ব্যাগটা রেখে মাথা নীচু করে বসে পড়ে। সেই প্রশ্নটা আবার তিরের মতো কানে এসে বেঁধে। ‘বললে না তো, কোনও খবর পেলে?’

উত্তরটা হয়তো কাবেরীরও অজানা নয়, তবু মন যে মানে না। দেবেশের কাছেও যে কোনও উত্তর নেই। কী জবাব দেবে দেবেশ, স্ত্রী-র চোখের দিকে তাকাতে পারে না সে। কোনওমতে নিজেকে সামলে নিয়ে ধীর কণ্ঠে বলে, ‘না’। একটা অস্ফুট স্বর কানে আসে কাবেরীর। পাথরের মূর্তির মতো স্থির হয়ে থাকে সে। দীর্ঘ তিনমাস যাবৎ একই কথা শুনতে শুনতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে সে। পুলিশের অক্ষমতা নিয়ে বারবার প্রশ্নও তুলেছে। ক্রমশ নিরাশা যেন গ্রাস করে ফেলছে তাদের। তাদের যে আর কিছুই করার নেই। সাধ্য অনুযায়ী সবরকম চেষ্টা তো করল এতদিন। দিনরাত থানায় পড়ে থেকেছে। এদিক-সেদিক ছুটেছে। আত্মীয়, বন্ধুবান্ধব কম করেনি। খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন পর্যন্ত দিয়েছে। এখন সবই উপরওয়ালার হাতে।

সোফার পাশে কাবেরীকে ওভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কষ্ট যেন দ্বিগুণ বেড়ে যায় দেবেশের। গলা শুকিয়ে আসে তার। খানিক স্বস্তি পেতে সামনের টি-টেবিলে ঢেকে রাখা জল ঢক ঢক করে খেয়ে নেয় সে। তারপর কাবেরীকে কাছে ডেকে বসিয়ে বলে, ‘আজকে অসীমবাবু আবার একটা নতুন খবর দিলেন।’

‘নতুন খবর!’ মুখে যেন একশো ওয়াটের বাল্ব জলে ওঠে কাবেরীর। কিন্তু সেই আলো আবার নিভেও যায়। মনের মধ্যে আশঙ্কার মেঘ জমতে শুরু করে। ভাবে, যে-কথাটা তারা কিছুতেই মন থেকে স্বীকার করতে পারছে না, তাহলে কী অবশেষে সেটাই সত্যি হয়ে দাঁড়াল। মনটা কেমন যেন কু-গাইতে থাকে। সবকিছু এলোমেলো হয়ে যায়। উদ্বিগ্ন ভাবে স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।

‘ঋকের বন্ধুরা পুলিশের মারের চাপে স্বীকার করেছে যে, তারা আমাদের ঋককে এ-পৃথিবী থেকে সরিয়ে ফেলেছে।’ বলতে বলতে গলা কেঁপে ওঠে দেবেশের। জল চিকচিক করে ওঠে চোখের কোণায়।

কথাটা শোনামাত্রই হাউহাউ করে কেঁদে ওঠে কাবেরী। থামানোর চেষ্টাও করে না দেবেশ। যদিও সান্ত্বনা দেওয়ার মতো ভাষা তার কাছে নেই। মেয়েরা তো কেঁদে-কেটে খানিক হালকা হতে পারে, কিন্তু পুরুষরা তো সেটাও পারে না। মিনিট কয়েক এভাবেই কেটে যায়। মাথা নীচু করে কপালে হাত দিয়ে বসে থাকে দেবেশ। সম্বিৎ ফেরে কাবেরীর গোঙানির শব্দে। তাড়াতাড়ি উঠে একগ্লাস জল বাড়িয়ে দেয়। তারপর আবার বলতে শুরু করে, ‘বডি পাওয়া যায়নি, তবে কিছু হাড়গোড় উদ্ধার করেছে। ওটা দেখে তো সনাক্ত করা সম্ভব নয়।’

কাতরস্বরে কাবেরী বলে ওঠে, ‘তাহলে কী করে ওরা এত নিশ্চিত হচ্ছে যে, ও-ই আমাদের ঋক। এমনও তো হতে পারে ওটা অন্য কেউ। ওরা ভুল ভাবছে।’ শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখের জল মোছে কাবেরী।

‘হ্যাঁ, ওদের ধারণা ভুল প্রমাণিত হতেই পারে। সেই কারণেই তো ওরা ডিএনএ টেস্ট করে দেখতে চাইছে। কাল একবার থানায় গিয়ে ব্লাড স্যাম্পেল দিয়ে আসতে বলেছে।’

‘ব্লাড স্যাম্পল?’ কেমন যেন চমকে ওঠে কাবেরী। একমুহূর্তেই আতঙ্কের কালো মেঘ ছেয়ে যায় কাবেরীর চোখেমুখে।

‘ভয় পাচ্ছ কেন, এমনও তো হতে পারে তোমার ধারণাই ঠিক। ও আমাদের ঋক নয়।’

দেবেশের সান্ত্বনা কাজে আসে না। ছটফট করতে থাকে কাবেরী। দেবেশ ভাবে ছেলে হারানোর শোক একজন মা-কে অস্থির করে তুলেছে। কোনওরকমে শান্ত করে ওষুধ খাইয়ে শুইয়ে দেয় কাবেরীকে। তারপর নিজে ড্রইং রুমে আরাম কেদারায় গা এলিয়ে দিতেই বহু পুরোনো কথা মনের মধ্যে ভিড় করে আসে।

দেবেশের পারিবারিক ব্যাকগ্রাউন্ড বেশ ভালো। সম্ভ্রান্ত পরিবার। বাবা রিজার্ভ ব্যাংক-এ চাকরি করতেন। মা হাউজওয়াইফ হলেও যথেষ্ট কোয়ালিফায়েড। তখনকার দিনে এমএ পাশ করাটা চাট্টিখানি কথা নয়। শুধুমাত্র সংসার আর বাচ্চাকে ভালোবেসে কেরিয়ারের কথা ভাবেননি। সংসার আর ছেলেকে নিয়েই স্বাচ্ছন্দ্যে কাটিয়েছেন। প্রভাব প্রতিপত্তি, বৈভবের মাঝে কখনও হারিয়ে ফেলেননি নিজেকে। ছেলেকেও ঠিক নিজের মনের মতো করে মানুষ করেছেন। দেবেশ যখন বছর আঠাশের তখনই মারা যান দেবেশের বাবা। তখন সবে সবে রেলে-র চাকরিতে জয়েন করেছে দেবেশ। পড়াশোনায় বরাবরই ভালো ছাত্র হিসাবে কলেজে নামডাক ছিল। চাকরিটাও পেয়ে যায় জীবনের প্রথম পরীক্ষাতে বসেই। সংসার বলতে মা আর ছেলে। ছেলে অফিস বেরিয়ে যাওয়ার পর বড়ো একাকী বোধ করতেন দেবেশের মা। তাই যুদ্ধকালীন তৎপরতায় পছন্দ করা পাত্রীর সঙ্গে ছেলের বিয়ে দিয়েছিলেন। দেবেশের বাবা তাঁর ছোটোবেলার বন্ধুর একমাত্র মেয়ের সাথে ছেলের বিয়ে একরকম পাকা করেই রেখেছিলেন। বাবার পছন্দ করা পাত্রী কাবেরী-র সাথেই বিয়ে হয়েছিল দেবেশের। অবশ্য দেবেশও যে বিয়ের আগে কাবেরীকে দেখেনি এমন নয়। একই কলেজে পড়াশোনা করেছে, বেশ কয়েকবার আলাদা করে কথাও বলেছে। বিয়ের আগে বার দুয়েক কলেজের বাইরে দেখাও করেছে তারা।

দেবেশের মা উমাদেবী ভেবেছিলেন বউমাকে একেবারে মেয়ের মতো করে রাখবেন। ঘুরবেন, ফিরবেন, গল্প করবেন। নাতি-নাতনি নিয়ে সুখে সংসার করবেন। কিন্তু ভাবনা তো ভাবনাই। বাস্তবের সঙ্গে এর তফাত অনেকটা। প্রথম প্রথম সব ঠিক থাকলেও দিনকতক পর উমাদেবী বুঝতে পারেন তাঁর আধুনিক মনস্ক বউমার মন সংসারের তুলনায় বাইরের দিকেই বেশি। সবসময় বন্ধুবান্ধব, পার্টি। সমাজসেবার নামে এখানে সেখানে বেরিয়ে পড়া।

উমাদেবী বউমার এই যখন-তখন বেরিয়ে পড়া, রাত করে বাড়ি ফেরা নিয়ে মাঝেমধ্যেই আপত্তি তুলতেন। এই নিয়ে শাশুড়ি-বউমার টুকটাক অশান্তিও লেগে থাকত। তবে এসব ব্যাপারে বড়ো একটা মাথা ঘামাত না দেবেশ। বরং তার ধারণা ছিল সংসারের চাপ পড়লে কাবেরী নিজে থেকেই ক্লাব, পার্টি এসমস্ত ছেড়ে দেবে। তখন বাচ্চার টানে নিজেই সংসারের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেবে। কাজেই শুধু শুধু অশান্তি করে লাভ কী। এরকম তো অনেক মেয়েই ভাবে বাচ্চা নিলে তার ফিগার নষ্ট হয়ে যাবে। আগের মতো আর আকর্ষণীয় থাকবে না। কিন্তু ক’টা মেয়ে এই ভাবনা-চিন্তায় অনড় থাকতে পারে। একবার মা হলে এসমস্ত তাদের আর খেয়ালই থাকে না।

কিন্তু কাবেরীর ক্ষেত্রে এমনটা হয় না। বিয়ের পাঁচ বছর পরে পুত্রসন্তানের জন্ম দেওয়ার পরেও কাবেরীর স্বভাবে কিছুমাত্র রদবদল ঘটে না।

মাস তিনেক বাড়িতে থাকার পর শাশুড়ি আর আয়ার ভরসায় আবার আগের মতো ক্লাব, পার্টি করতে শুরু করে সে। বয়সের ভারে আয়ার সাহায্য নিতে হয়েছে ঠিকই তবে যতদিন উমাদেবী বেঁচেছিলেন ততদিন ঋক-কে উনিই সামলেছেন। কিন্তু মানুষের মৃত্যুর কথা কে বলতে পারে, যখন ঋকের বছর দশ বয়স তখনই একদিন হঠাৎ করে বুকে ব্যথা। আধ ঘন্টাও সময় দেননি। ডাক্তার নিয়ে আসতে আসতেই সব শেষ। তার পর থেকেই ঋক বড়ো একা। কারও সাথে তেমনভাবে কথা বলে না। সারাক্ষণ হয় টিভি দেখে নয়তো বাচ্চাদের পত্রিকা হাতে বসে থাকে। সে যেন নিজের একটা আলাদা পৃথিবী বানিয়ে ফেলেছে, সেখানে কারওর অবাধ প্রবেশ নিষেধ। দেবেশ আপ্রাণ চেষ্টা করে ছেলেকে খুশি করার, যার জন্যই ছেলের পছন্দের এটা-ওটা-সেটা নিয়ে আসে। সন্ধেবেলা অফিস থেকে ফিরে ছেলের হোমওয়ার্ক করানো, তাকে খাওয়ানো, খেলা করা সবশেষে ঘুম পাড়ানো, সমস্তটাই নিজে হাতে করার চেষ্টা করত দেবেশ। কিন্তু তবু কোথাও যেন একটা ফাঁক থেকেই যেত। রাত দশটার পরে কখনও বা তারও পরে কিটি পার্টি সেরে ফিরত কাবেরী। তখন তার এমন হুঁশ থাকত না যে একমাত্র ছেলের ঘরে গিয়ে তার সাথে দুটো কথা বলে বা মমত্ব উজাড় করে দেয়। কখনও তো ঠিক করে এটা জানার চেষ্টা করেনি যে, তার নাড়ি ছেঁড়া সন্তান কীভাবে বড়ো হচ্ছে, তার কোনও অসুবিধা হচ্ছে কিনা, মায়ের জন্য তার মন কাঁদে কিনা। কোনওদিন কাছে ডেকে সুখ-দুঃখের কথাও যেমন বলেনি তেমনি আদর করে ছেলের পাশে বসে তাকে খাওয়ায়ওনি। মা-ছেলের মধ্যে সেই বন্ডিং-টাই কোনওদিন তৈরি হয়নি। হওয়ার কথাও নয়। বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে ঘুরতে গিয়ে মল থেকে চারটে দামিদামি জামাকাপড় এনে দিয়েই কর্তব্য শেষ হয়ে যায় না, কাজেই দূরত্ব তৈরি হওয়াটাও অস্বাভাবিক নয়।

বছরের পর বছর চলে যায়। কিন্তু কাবেরীর মধ্যে কোনও পরিবর্তন আসে না। ঋকও এখন বছর সতেরোর। বারো ক্লাসের ছাত্র। তারও লাইফস্টাইলে আমূল পরিবর্তন ঘটেছে। সে ও রাত করে বাড়ি ফিরতে শিখেছে। নজর এড়ায়নি দেবেশেরও। খেয়াল করে দেখেছে বাড়ি ফিরেই সে, সোজা নিজেকে ঘরের মধ্যে বন্দি করে নেয়। হাজার ডাকাডাকি করলেও দরজা খোলে না। বিভিন্ন রকম টালবাহানা করে এড়িয়ে যায়। কখনও বলে শরীর ভালো নয়, কখনও খেতে ইচ্ছে করছে না বলে ডিনার টেবিলে একসঙ্গে বসে রাতের খাবার খাওয়ার ব্যাপারটা কাটিয়ে দেয়। ব্যাপারটা ভাবিয়ে তোলে তাকে। মনস্থির করে, এই নিয়ে ছেলের সাথে কথা বলবে।

সেইমতো পরদিন সকালবেলা খাবার টেবিলে ছেলেকে পাকড়াও করে দেবেশ। ‘তুই রোজ রোজ দেরি করে বাড়ি ফিরছিস। অর্ধেক দিন বাড়িতে খাচ্ছিস না। ব্যাপারটা কী বলতো? অত রাত পর্যন্ত থাকিস কোথায়? পড়াশোনাটাই বা কেমন চলছে সেটাও তো বুঝতে পারছি না। সামনের বছর বোর্ড দিবি, মাথায় আছে সেটা?’

‘আমাকে নিয়ে একদম চিন্তা কোরো না। স্কুলের পর পাপানদের বাড়িতে আমরা সবাই একসাথে পড়াশোনা করি। সেইজন্যই ফিরতে দেরি হয়।’

‘পাপান-টা কে? এর নাম তো আগে কখনও শুনিনি। থাকে কোথায়?’

‘তুমি কী সবাইকে চেনো নাকি। ও বাপ্পাদের বাড়ির কাছে থাকে।’

ঋকের কথা পুরোপুরি বিশ্বাস না করলেও আর কথা বাড়ায় না দেবেশ। কিন্তু ছেলের গতিবিধির ওপর নজর রাখতে শুরু করে। কয়েকদিনের মধ্যে দেবেশ বুঝে গিয়েছিল ছেলে কোনও অসৎ সঙ্গের পাল্লায় পড়েছে। মাঝে দু-দিন তো ঠিকভাবে হেঁটে চলে বাড়ি ফিরতে পারেনি। কোনও রকমে এদিক-ওদিক করতে করতে সোজা নিজের ঘরে। দেবেশের বারবার ডাকা সত্ত্বেও উত্তর করেনি ঋক। পরদিন সকাল পার হয়ে দুপুর গড়াতে তবে তার ঘুম ভেঙেছে।

চিন্তায় দেবেশের ঘুম উড়ে গিয়েছিল। একমাত্র ছেলে। এইভাবে চলতে থাকলে কেরিয়ার, ভবিষ্যৎ সব শেষ হয়ে যাবে। একেবারে অন্ধকারের মধ্যে ডুবে যাবে ছেলেটা। এই প্রসঙ্গে কাবেরীর সঙ্গেও কথা বলেছে দেবেশ। হালকা হওয়ার বদলে আশ্চর্যই হয়েছে। ‘এখন এনজয় করবে না তো কবে করবে, এই তো বয়স। তাছাড়া রোজ তো আর এমনটা করছে না। মাঝেমধ্যে এক-আধটা দিন হতেই পারে। এগুলো ধরলে কী চলে। খেলনা নিয়ে খেলার বয়স তো আর নেই। কাজেই এই বয়সে একটু অন্যরকম কিছু করার ইচ্ছে জাগবে সেটাই স্বাভাবিক। এই নিয়ে অযথা টেনশন নিও না।’

সত্যিই একেবারে অন্যরকম কিছুই করে দেখাল ঋক। দেবেশ তো দূর, কাবেরীও বোধহয় এরকমটা কখনও কল্পনা করেনি।

কোনওরকমে এইচএস পাশ করেছে ঋক, কিন্তু নাম্বার এতটাই কম পেয়েছে যে ভালো কোনও কলেজে ভর্তি করানোটাই বড়োরকমের সমস্যা হয়ে দাঁড়াল। এখন তো বাচ্চারা কম্পিটিশনের কারণে বিভিন্ন কোচিং ক্লাস নিয়ে আটানব্বই শতাংশ পর্যন্ত মার্কস তুলছে। নব্বই শতাংশ পেয়েও ভালো কলেজে অ্যাডমিশন পেতে রীতিমতো হিমশিম খেতে হচ্ছে তাদের। সেখানে ঋকের নম্বর তো একেবারে চল্লিশ

শতাংশের কোটায়। দেবেশ নিজের সোর্স লাগিয়ে কোনওমতে একটা কলেজে অ্যাডমিশনের ব্যবস্থা করিয়েছিল ঠিকই, কিন্তু ভর্তি করলেই তো হবে না, পড়াশোনাটাও তো জরুরি। জোর করে তো কারওর উপর কোনও কিছু চাপিয়ে দেওয়া সম্ভব নয়। ছেলে বড়ো হয়ে গেলে তার গায়ে হাত তোলাও সম্ভব নয়। তাতে হিতে বিপরীত হতে পারে। কত বুঝিয়েছে। ততদিনে ড্রাগস, মদে নিজেকে ডুবিয়ে ফেলেছে ঋক।

বাবা-মা যতরকম ভাবে ছেলেকে শোধরানোর চেষ্টা করে দেবেশ, কাবেরীও ঠিক ততটাই করেছিল। ঋক-এর নেশায় আসক্ত হওয়ার পর থেকে কাবেরীর মধ্যে অনেক চেঞ্জ এসেছে। এখন ক্লাব, পার্টির নামও মুখে আনে না। কোথাও একটা অপরাধবোধ কাজ করতে থাকে তার মধ্যে। মুখে না বললেও মনে মনে নিজেকে দূষতে থাকে সে। ভাবে সে যদি সোশ্যালাইজ না করে আর পাঁচটা মায়ের মতো আদর-স্নেহে লালনপালন করত ছেলেকে, সবসময় তার পাশেপাশে থাকত– তাহলে বোধহয় ছেলেটা এভাবে নষ্ট হয়ে যেত না।

একাধিক ডাক্তারের পরামর্শ নিয়েছে। এমনকী প্রয়োজনে রি-হ্যাব সেন্টারের কথাও ভেবেছে তারা। এতে ফল আরও উলটোই হয়েছে। রি-হ্যাবের নাম শুনে বাড়ি ফেরা বন্ধ করে দিয়েছে ঋক। রাতের পর রাত বন্ধুদের সঙ্গে তাদের ভাড়া করা বাসায় পড়ে থেকেছে। তারাও ঋকের মতো ড্রাগ অ্যাডিকটেড। পড়াশোনার নামে বাড়ির থেকে দূরে থাকে। আর এই সমস্ত করে বেড়ায়। অথচ বাবা-মায়েরা এই ভেবে বুকের উপর পাথর চেপে রাখে যে, তাদের বাচ্চারা পড়াশোনা করে নিজেদের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল করছে।

দেবেশের হাতে আর কিছুই ছিল না। কাবেরীর অবস্থা তো আরও করুণ। আপশোশ করা ছাড়া আর কোনও পথ দেখছিল না সেও। কতদিন এমন হয়েছে ছেলেকে খুঁজতে, এই ক্লাব, সেই ক্লাব, এই বন্ধুর বাড়ি, সেই বন্ধুর বাড়ি করে বেড়িয়েছে। কখনও ছেলেকে বেহুঁশ অবস্থায় নিয়ে ফিরেছে। আবার কখনও নিরাশ হয়ে ফিরেছে খালি হাতে। এমনও দিন গেছে খাটের মধ্যে বেহুঁশ ছেলেকে পড়ে থাকতে দেখে, ঘরের কোণায় বসে রাতের পর রাত কাটিয়েছে দুজনে। চোখের জল ফেলেছে। ঋকের এই বিপথে যাওয়ার আসল কারণটা কী, সেটা বিলক্ষণ জানত দেবেশ। সেই নিয়ে যে ক্ষোভও রয়েছে যথেষ্ট। কিন্তু এখন আর সেই বিতর্কেও গিয়ে লাভ নেই। কোনও কিছুই আর কাজে আসবে না।

শেষমেশ ঠিক হল ঋককে জোর করেই রি-হ্যাব-এ পাঠানো হবে। সেইমতো সমস্ত কথাবার্তা পাকা করা হল। এর মাঝেই ঘটল এক বিপত্তি। হঠাৎ একদিন একটা নিউজ চ্যানেলে বারবার ঋকের সঙ্গে তার কয়েকজন বন্ধুকে আপত্তিকর অবস্থায় একটা ঘরে পড়ে থাকতে দেখাল। বেশ কয়েকজন একেবারে বিবস্ত্র। খবর করা হচ্ছে, শহরের স্বচ্ছল পরিবারের বেশ কয়েকটি বখে যাওয়া ড্রাগ অ্যাডিকটেড সমকামী ছেলেদের কুকীর্তি নিয়ে। একের পর এক ফোন। হাজারো প্রশ্ন। কী জবাব দেবে দেবেশ। লজ্জায় মাথা কাটা যাবার উপক্রম হয়েছিল তাদের। কী করবে সে। ড্রাগ, মদের নেশা না হয় ছাড়াতে পারবে। কিন্তু তাই বলে সমকামীতা! এটা একজন বাবা-মায়ের কাছে মারাত্মক লজ্জার। এর আগেও নেশার কারণে ঋক যখন মায়ের বালা চুরি করে বিক্রি করে দিয়েছিল, তখনও বোধহয় এতটা শক্ড হয়নি তারা, যতটা এখন। পরিস্থিতি যে কখন কাকে কোথায় নিয়ে ফেলে। তবু ছেলে তো। হাল তো ছেড়ে দেওয়া যায় না। ঘটনাস্থল থেকেই পুলিশ তুলে নিয়ে গিয়েছিল ঋকদের। সেখান থেকে ছাড়িয়ে এনে সোজা রি-হ্যাব। তারপর দীর্ঘদিন কাউন্সেলিং।

মাস ছয়েক পরে ঋক যখন বাড়ি ফিরে আসে, তখন একেবারে স্বাভাবিক। দেবেশ – কাবেরী কল্পনাই করতে পারেনি যে ঋক আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারবে। টাইমে খাওয়াদাওয়া, পড়াশোনা, বেড়ানো। ছেলেকে নিয়ে বেশ ভালোই ছিল তারা। মাস দেড়েক এভাবেই কেটে গেল।

একদিন সকালে সকলে মিলে ব্রেকফাস্ট করতে বসেছে, ঠিক সেই সময়ে ঋকের ফোনটা বেজে উঠল। সেই দিন বিকেলে ‘ঘন্টাখানেকের মধ্যে ফিরে আসব’ বলে সেই যে বাড়ির বাইরে বেরোল আর বাড়িমুখো হয়নি ছেলেটা। বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়পরিজন, ক্লাব– কোনও হদিশ মেলেনি তার। নিরুপায় হয়ে থানায় গিয়ে মিসিং ডায়েরি করে এসেছিল দেবেশ। তারপর কেটে গেছে আরও তিনটে মাস। নিরন্তর মনের সাথে যুদ্ধ করতে করতে এখন খানিকটা ধাতস্থ হয়ে গেছে তারা।

প্রথমদিকে তো পুলিশ সেভাবে গুরুত্ব দেয়নি। তারা ভেবেছিল ছোটো ছেলে রাগ করে বাড়ি থেকে পালিয়ে গেছে। টাকা-পয়সা ফুরিয়ে গেলেই আবার বাড়ি ফিরে আসবে। কিন্তু ঋক-এর পাস্ট লাইফের ঘটনা শুনে দেবেশের সঙ্গে সঙ্গে তাদেরও মনে হয়েছে এটা নিছক কোনও সাধারণ ঘটনা হতে পারে না, অন্য রহস্যের গন্ধ পায় তারাও। সেইমতো তারা তদন্ত করতে থাকে। ঋক-এর সমস্ত বন্ধুবান্ধবদের থানায় ডেকে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।

তারপর থেকে দেবেশ রোজই একবার করে থানায় গিয়ে খোঁজখবর নিয়ে আসে। বড়োবাবু অসীম জোয়ারদার কতবার বলেছেন এভাবে রোজ-রোজ থানায় না যেতে। কোনও খবর হলে উনি নিজেই ফোন করে ডেকে নেবেন। কিন্তু একজন বাবার মন কী আর সে-সব মানে। আশায় বুক বেঁধে রোজই ছুটে যায়।

আর আজ তো একেবারে ছেলের মৃত্যুর সম্ভাবনা প্রায় নিশ্চিত করে দিলেন জোয়ারদার সাহেব। ঋকের বন্ধুদের কথা অনুযায়ী দুর্ঘটনাস্থল থেকে পুলিশ কিছু অস্থি পেয়েছে। যেহেতু ঋকের বডি পাওয়া যায়নি, সেই কারণেই ডিএনএ টেস্ট জরুরি হয়ে পড়েছে। তাই তাকে আর কাবেরীকে থানায় যেতে হবে, সেখান থেকে হাসপাতালে। পুরোনো স্মৃতি রোমন্থন করতে করতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছে দেবেশ। ঘুম ভাঙে সকালবেলা বংশী দুধওয়ালার বেলের আওয়াজে। কথামতো সকাল সকাল থানার উদ্দেশে বেরিয়ে পড়ে দেবেশ আর কাবেরী।

এর প্রায় একমাস পরে বেলা এগারোটা নাগাদ থানা থেকে বড়োবাবুর ফোন আসে। দেবেশ তখন অফিসের ফাইলে মুখ গুঁজে আছে। ‘ডিএনএ টেস্ট-এর রিপোর্টটা চলে এসেছে। একবার থানায় চলে আসুন।’

‘রিপোর্টে কী আছে?’ উদ্বেগজনক ভাবে প্রশ্ন করে দেবেশ।

‘আপনি থানায় এলে তো সবই জানতে পারবেন।’ বেশ গম্ভীর শোনায় জোয়ারদারের গলা।

জোয়ারদারের ফোন পাওয়ামাত্রই ফাইল-টাইল ভুলে বাড়ির পথে রওনা দিয়েছিল দেবেশ। অফিস থেকে বেরোনোর আগেই কাবেরীকে সমস্তটা জানিয়ে রেডি হয়ে থাকতে বলেছিল সে। সেই মতো দুজনে হাজির হয়েছিল থানায়। কাবেরীর মধ্যে একটা অস্বস্তির ছাপ দেখা গেলেও আজ দেবেশ অনেক স্থিতধী। যেন সবকিছুর জন্যই সে প্রস্তুত।

থানার আর এক ইন্সপেক্টর দেবেশকে সঙ্গে করে নিয়ে যায়। আর কাবেরীকে সেইখানেই অপেক্ষা করতে বলে। দেবেশকে ভিতরের একটি ঘরে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে বড়োবাবু অসীম জোয়ারদারও উপস্থিত রয়েছেন। একটু অবাক হয় দেবেশ। তারপর ধীর কণ্ঠে বড়োবাবুকে জিজ্ঞেস করে, ‘তাহলে কী…?’ বলেই ধপ করে বসে পড়ে চেয়ারে।

দেবেশবাবুর মনের অবস্থা আঁচ করতে পারেন অসীম জোয়ারদার। তারপর বলতে শুরু করেন, ‘দেখুন দেবেশবাবু, আমাদেরও বলতে খারাপ লাগছে, কিন্তু সত্যিটা তো সামনে আনতেই হবে। ব্যাপারটা সত্যিই খুব সিরিয়াস, তাই আপনাকে জানানোটা জরুরি। ডিএনএ টেস্ট-এর রিপোর্ট অনুযায়ী যে ব্যক্তির অস্থি পেয়েছিলাম, সেটা ঋকেরই।’

ক্ষণিকের একটা ঝটকা লাগলেও, বুকের উপর পাথর রেখে প্রশ্ন করেছিল বড়োবাবুকে, ‘কিন্তু ওর হত্যার পিছনে কোনও সঠিক কারণ তো থাকবে। সেগুলো আমি জানতে চাই অসীমবাবু। কেন এত

নৃশংসভাবে মারা হল আমার ওই একরত্তি ছেলেটাকে?’

‘আপনি তো জানতেন-ই যে আপনার ছেলে, আর-পাঁচটা ছেলের মতো স্বাভাবিক নয়। একাধিক ছেলের সঙ্গে তার সমকামী সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। যাই হোক, যে ছেলেগুলো ধরা পড়েছে এরা তাদেরই একটা গ্রুপ। একটা সময় ঋকের এদের সঙ্গেই সম্পর্ক ছিল। সারাদিন হেরোইনের নেশায় বুঁদ হয়ে থাকত ছেলেগুলো। ওদেরই মধ্যে ম্যাক বলে একটি ছেলে, শহরের নামি উকিল অভিষেক জালানের একমাত্র বখাটে ছেলে। সে নিজেও নেশায় বুঁদ হয়ে থাকে আর অন্যদের নেশা করার জন্য টাকা ধার দেয়। নতুন নতুন পার্টনারের ব্যাপারেও তার প্রবল আগ্রহ। ঋক-কে খুব মনে ধরেছিল তার। তাই কখনও টাকা চাইত না ঋকের কাছ থেকে। রি-হ্যাব থেকে ফেরার পর ঋকের নেশা ছেড়ে দেওয়া, তার সঙ্গ ছেড়ে দেওয়াটা মেনে নিতে পারেনি সে। রি-হ্যাব থেকে ফেরার পর ঋককে বারবার ফোন করেছে তার কাছে ফিরে যাওয়ার জন্য। ঋক রাজি না হওয়াতেই এই বিপত্তি। সে শর্ত দিয়েছিল, হয় তাকে টাকা ফেরত দিতে হবে, নয়তো আগের মতো সঙ্গ দিতে হবে। টাকা ফেরতের ব্যাপারটা তো অজুহাত মাত্র, তার উদ্দেশ্যই ছিল ঋককে পাওয়া। কল লিস্ট দেখে আমরা জানতে পেরেছি, সেদিনের ওই ফোনটা ম্যাক-এরই ছিল। সে-ই ডেকেছিল তাকে। টাকাপয়সা নিয়ে ব্ল্যাকমেল করতে শুরু করেছিল ঋক-কে। একপ্রকার বাধ্য হয়েই ঋক সেদিন জানাতে গিয়েছিল, টাকা সে ধীরে ধীরে শোধ করে দেবে। ঋক-কে না পেয়ে সেদিন জোশের মাথায় গুলি চালিয়ে দিয়েছিল ছেলেটি। তারপর বাকি বন্ধুদের সহায়তায় লাশ গায়েব করে দিয়েছিল।’ অসীমবাবুর কথাগুলো শেলের মতো বুকে এসে বিঁধছিল দেবেশের। চোখ দিয়ে টপটপ করে জল পড়ে জামার উপরের দিকে বেশ খানিকটা অংশ ভিজে গিয়েছে। সহানুভূতি দেখাতে, অসীমবাবু দেবেশের কাঁধে হাত রাখেন। দেবেশের দিকে একগ্লাস জল এগিয়ে দিয়ে আবার বলতে শুরু করেন, ‘দেবেশবাবু আর একটা কথা জানানোর ছিল। জানি না, কথাটা বলার এটাই উপযুক্ত সময় কিনা, তবুও ডিউটির খাতিরে আমাকে বলতেই হবে। নয়তো আদালতে জেরার সময়ে আপনি জানতেই পারবেন।’

নিজেকে খানিক শক্ত করার চেষ্টা করে দেবেশ। ‘কী ব্যাপার বলুন না। এই কষ্টটা যখন সহ্য করতে পেরেছি, তখন আর কোনও কিছুই আমাকে ছুঁতে পারবে না। আপনি বলুন।’

‘দেবেশবাবু, ঋক কাবেরীদেবীর ছেলে এটা যেমন সত্যি, তেমনি রিপোর্ট অনুযায়ী এটাও সামনে এসেছে যে, ঋক আপনার ঔরসজাত সন্তান নয়।’

একমুহূর্তেই চোখের সামনে অন্ধকার নেমে আসে দেবেশের। মাথাটা ঘুরে যায় তার। যেন কেউ সপাটে তার গালে একটা চড় কষিষে দিয়েছে।

কিছুক্ষণ ওইভাবেই ঘোরের মধ্যে বসে থাকে দেবেশ। ইন্সপেক্টরও তার মনের কথা বুঝে চুপ করে যান।

খানিক পরে কাবেরীর চিৎকারে সম্বিৎ ফেরে দেবেশের। ‘আমাকে কেন ভিতরে যেতে দেওয়া হচ্ছে না।’

কী যেন ভাবে দেবেশ। তারপর হাতজোড় করে বড়োবাবু অসীম জোয়ারদারকে বলে, ‘অসীমবাবু, যা হওয়ার হয়ে গেছে। আমাদের ঋক আর কোনওদিন আমাদের কাছে ফিরে আসবে না। কিন্তু আপনার কাছে আমার রিকোয়েস্ট, আমি এতদিন যে-মিথ্যেটাকে সত্যি ভেবে বেঁচে এসেছি, বাকি জীবনটাও সেটা নিয়েই কাটাতে চাই। এটা আমার আর কাবেরীর দাম্পত্যের জন্যও জরুরি।’

‘ঠিক বুঝলাম না দেবেশবাবু।’

‘প্লিজ অসীমবাবু, আপনি আমার স্ত্রীকে এটা কখনওই জানতে দেবেন না যে আমি জেনে গেছি যে ঋক আমার আপন সন্তান নয়।’

কী যেন ভেবে মাথা চুলকে নেন অসীম জেয়ারদার। দেবেশকে আশ্বস্ত করে বলেন, ‘ঠিক আছে। কথা দিচ্ছি, আমি আমার সাধ্যমতো চেষ্টা করব। চেষ্টা করব আপনার স্ত্রীকে সাক্ষী না বানাবার।’

‘অশেষ ধন্যবাদ অসীমবাবু। আপনার ঋণ আমি কোনওদিনও শোধ করতে পারব না।’ কৃতজ্ঞতা জানাতে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা বড়োবাবুর হাতদুটো চেপে ধরে দেবেশ।

কিছুক্ষণ পর একেবারে বিধবস্ত অবস্থায় থানা থেকে কাবেরীকে নিয়ে বের হয় দেবেশ। কাবেরী পাগলের মতো করতে থাকে। বারবার জিজ্ঞাসা করতে থাকে, ‘কী হল? বড়োবাবু কী বলছেন? ডিএনএ রিপোর্ট-এ কী এল। ওটাই আমাদের ঋক?’

গাড়িতে উঠে কাবেরীর মাথা নিজের কাঁধের উপর টেনে নেয় দেবেশ। তারপর খুব ধীর কণ্ঠে বলে, ‘কাবেরী নিজের মনকে শক্ত করো। যা হওয়ার হয়ে গেছে। তোমার ঋক যে পথে এগিয়ে গিয়েছিল তাতে ভগবান বোধহয় এটাই সঠিক মনে করেছেন।’

হাউহাউ করে কেঁদে ফেলে কাবেরী। বাধা দেয় না দেবেশ। শুধু শক্ত করে ধরে রাখে তাকে।

 

পড়ার জন্য সীমাহীন গল্প-নিবন্ধসাবস্ক্রাইব