ছেলেধরা

আমি উত্তমকুমার।

হাবরা থানার সেকেন্ড অফিসার টেবিল থেকে মুখ তুলে দুটো ভ্রূ যথাসম্ভব কাছাকাছি আনলেন। তাঁর চোখের শ্লেষ ও বিরক্তির জিজ্ঞাসায় কিছুটা থতমত, টেবিলের অপর প্রান্তের দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তি গড়গড় করে বলতে থাকে– মানে আমি উত্তমকুমার দাম। আজ ২টো ২০-র বনগাঁ লোকালে আমার পিক্পকেট হয়েছে। হাজার দেড়েক টাকা ছাড়াও ওয়ালেটে ছিল ব্যাংকের ডেবিট কার্ড। আর পকেটের মোবাইলটাও গেছে। হাবরা থানার সেকেন্ড অফিসারকে এটুকু বলতেই ঘেমে একসার। আসলে থানা-পুলিশ নিয়ে তার দুর্বলতা আছে।

সেদিনও ঘেমে নেয়ে দুপুর রোদের ভেতর এক সংবাদপত্রের অফিসের বিজ্ঞাপন বিভাগে ঢুকে কাগজে লেখা টুকরোটি দিয়েছিল। ‘আমি উত্তমকুমার দাম। বয়স পঁয়ত্রিশ। অবিবাহিত। কর্পোরেট সংস্থায় চাকুরে। বিবাহে ইচ্ছুক। দ্রুত যোগাযোগ করুন।’সেদিন মঙ্গলবার, পরের রোববারের কাগজে বেরিয়ে যাবে বিজ্ঞাপন। সুইং ডোর ঠেলে পথে নেমে পড়ে। দেখা যাক। নীরদ চৌধুরির কথাটা প্রেমে ল্যাং খাবার পর প্রতিদিনই চোখের সামনে ভেসে উঠছে– ‘বাঙালিরা কোনও কাজ নিজে নিজে করতে পারে না, এমনকী নিজের বিবাহটাও নয়।’ দেখা যাক। গোটা ব্যাপারটাই নিজের হাতে করব। ছাঁদনাতলা থেকে রাঁধুনি– সব নিজের হাতে করব। এমনকী করবীকে নিজের হাতেই বিয়ের আমন্ত্রণপত্রটি দিয়ে চা খেয়ে আসব। বিয়ের একটা ডেট ঠিক করে ফেলা যাক। ১৮ অগ্রহায়ণ। শুক্রবার। ঠিক থাকল। না অন্য কেউ দিন ঠিক করবে না। যে মেয়ে বিয়ে করবে তাকেও ওই দিনেই বিয়ে করতে হবে। কোনও পালটাপালটি নয়। কলেজ স্ট্রিটে গিয়ে আজই কার্ডের নমুনা টমুনা দেখে আসতে হবে। বিয়ের কার্ড অন্তত শ’পাঁচেক ছাপতে হবে। রাসবিহারী কানেক্টরে বোসপুকুরের কাছে বিয়ে বাড়িটার যেন কী নাম– ‘নীলিমা’! অগ্রিম দিয়ে আসতে হবে। ভাবতে ভাবতে দুপুর রোদের ভেতর হেঁটে হেঁটেই ডালহউজি নিজের অফিসে ফিরে আসে।

বেশ ছটফট করছে সে। বুকের ভেতর অশান্তি নামে নাছোড় এক পদার্থ গড়িয়ে গড়িয়ে ছেয়ে যাচ্ছে সমস্ত শরীরে। রক্তের প্রবাহ পথে, তার মনে হচ্ছে সমস্ত শরীরেই এই আনচান ভাবটা ঢুকে পড়েছে। মনে পড়ছে গত পরশু দিন বিকেল বেলায় ওই যে শব্দের ছোবল কানের ভেতর দিয়ে মরমে প্রবেশ করল– তারপর থেকেই এই অস্থিরতা। গত দুবছরে কতদিনই তো রেস্তোরাঁয় বসে চা-কফি খেতে খেতে পায়ের আশ্লেষে হূদয়ের আকুলতা প্রকাশ করেছে উত্তম। তাতে তো সায়ই দিয়েছে করবী, ওর নগ্ন দু-পা আরও প্রলম্বিত করে। অথচ পরশু শান্তনুর কথাটা তুলে পার্ক স্ট্রিটের ফেলিনি-তে টেবিলের তলায় পা দিয়ে পায়ে ছোঁয়া লাগাতেই, খাঁচার বাঘিনীর মতো গর্জে উঠেছে করবী। ইউ রাসকেল্ হোয়াই আর ইউ প্রেসিং সো হার্ড! মাইন্ড ইট দ্যাট ইউ আর অ্যাবভ থার্টি-ফাইভ, হোয়ারআজ  আই এম টোয়েন্টি টু অনলি। থতমত উত্তম করুণ করে বলেছিল– মানে!

কোনও মানে নেই। সব কথার উত্তর তোমাকে দিতে হবে তার কোনও মানে নেই। শান্তনুও আমার ভালো বন্ধু, তার সাথে আমি সিঙ্গাপুরে যেতেই পারি। বড়ো কথা কোম্পানি আমাদের পাঠাচ্ছে সিঙ্গাপুরে, কোম্পানির স্বার্থেই। উত্তম ভালো করে জানে না কী কোম্পানি, তাদের কী ব্যাবসা সিঙ্গাপুরে। একটা দম নিয়ে পুনরায় করবী বলে, তোমার গায়ে জ্বালা হচ্ছে যখন, লেট মি সে টাটা, বাই। করবী টেবিলটাকে এমন পুশ্ করে উঠে পড়েছিল যে ঝুঁকে থাকা উত্তমের বুকে এসে সজোরে ধাক্বা মারে। উত্তম কোনও কথা বলতে পারেনি। বুকে হাত বোলাতে বোলাতে করবীর তেজী ভঙ্গির ক্ষীপ্র গমনটিকে চোখে গেঁথেছিল, বুঝে উঠতে পারেনি। যেভাবে ভারী কোনও আঘাত প্রথমে সমস্ত ইন্দ্রিয়কে অনুভবহীন করে দেয়– কিছু পরে মস্তিষ্কের নিউরনে যন্ত্রণা পাঠাতে থাকে, তেমনই।

বিয়ে করল উত্তমকুমার। পাত্রীও তার পছন্দের। নম্রস্বভাব। সুশ্রী, সুন্দরী। বিয়ের পরেই প্রেম করবে ভাবল সে। অনেক ভালোবাসবে। ওকে ভালোবেসেই বুকের জমানো অন্ধকার দূর করে ফেলবে। বিয়ের রাতে তৃণাকে উত্তম এক অবসরে জিজ্ঞাসা করেছে– কি, বর পছন্দ? মুখে সলজ্জ হাসি টেনে মাথা নেড়ে ইতিবাচক মতামত জানিয়েছে। উত্তম জানিয়েছে দিন দশেকের মধ্যেই তারা বেরিয়ে পড়বে হানিমুনে। কাঠমান্ডু যাবে। সেখান থেকে ফেরার পথে বেনারস, লখনউ হয়ে একমাস পরে বাড়ি ফিরবে। দশ লাখ টাকা খরচ করবে হনিমুন টুরে।

এসব শোনার পর তৃণা আরও ঘনিষ্ঠ হয়ে বসেছিল উত্তমের। মেয়েবাড়িতে এর বেশি এগোনো যায় না। শুধু ছোঁয়াছুঁয়ি আর আকার-ইঙ্গিতে ভালো লাগা ব্যক্ত করা যায়। বউভাত ও তার পরের কয়েকদিন উত্তমের অসাধারণ কেটেছে। বউভাতে করবীও এসেছিল শান্তনুকে নিয়ে। উত্তম করবীকে নিয়ে বউ-এর সাথে আলাপ করিয়েছে। উদ্দেশ্য আরও কাছ থেকে দ্যাখো, দ্যাখো কে বেশি সুন্দরী– তুমি না আমার বউ। খুব বয়স নয় তৃণার, ২৫-এর কাছাকাছি হবে। উত্তম করবীর মুখের নানা পরিবর্তন দেখে নিজেকে তারিফ করেছে। করবীকে বিট্ করতে পারার এই আনন্দেই যেন কটা দিন চলে গেল। এরপর দ্বিরাগমনের প্রথা ট্রথা কাটিয়ে অফিসে জয়েন করেছে। হনিমুন ট্রিপের জন্য গোছগাছ।

এসময় উত্তমের জন্য আবার একটি ভয়ংকর আঘাত অপেক্ষা করে ছিল। অফিস ফেরত দেখে বউ বাড়ি নেই। বৃদ্ধা মা জানায় সকাল বেলায় এগারোটা নাগাদ ট্যাক্সি ডেকে একটা বড়ো সুটকেশ নিয়ে বউ বাপের বাড়ি চলে গেছে। উত্তম ফোন বাজায় কেউ ফোন ধরে না। উদ্বিগ্ন উত্তম ঠিক করেছে সকাল হলেই সে শ্বশুড়বাড়ি যাবে খোঁজখবর নিতে। পরের দিন সকালের ঘুম ভাঙে তার কলিং বেলের আওয়াজে। ঘুম চোখেই দরজা খুলে দাঁড়িয়ে দেখে একজন পুলিশ অফিসার, সঙ্গে দু-তিনজন কনস্টেবল।

– আপনি উত্তমকুমার দাম?

ভ্যাবাচ্যাকা উত্তম কিছু না বুঝেই ঘাড় নাড়ে।

আপনি আমার সঙ্গে চলুন, কড়েয়া থানায়। আপনার উপর বধূ নির্যাতনের অভিযোগ আছে। আপনাকে দেখে সম্ভ্রান্ত মনে হয়, কিন্তু টাকার জন্য এরকম ফুটফুটে মেয়ের শরীরে সিগারেটের ছ্যাঁকায় বীভৎস দাগ করে দিতে পারেন? ক্যাশ টাকা দিয়েছিল ওরা তিন লাখ, আর আপনার আরও দু লাখের ডিমান্ড ছিল!

উত্তমের মাথায় কিছু ঢুকছে না। একটা বড়ো বিপদ যে আসছে বুঝতে পারল। মোবাইল থেকে সঙ্গে সঙ্গে ফ্রেন্ড-ফিলসফার অফিসের শম্ভুদাকে ফোন করে বলল, কড়েয়া থানায় আসতে। শম্ভুদা ওকে জামিনে ছাড়িয়ে আনল বটে তবে উত্তমের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে তিন লাখ টাকা নিঃশব্দে চলে গেল ওর বউ, মানে তৃণা নামে সেই মেয়েটির বাড়িতে। সোনা-গয়না বিয়ের দামি উপহার সামগ্রী-সহ আরও লাখ দুয়েক টাকার জিনিস মেয়েটা সুটকেস ভর্তি করে নিয়ে গিয়েছিল। হাজতেই ডিভোর্স পেপার সই হয়ে গিয়েছিল। এই তিন লাখের এক লাখ নিঃসন্দেহে থানার বড়োবাবু পেয়েছিল। না হলে এত নিখুঁত, সাজানো নাটক করা যেত না। থানার বাইরে চার-পাঁচজন মহিলাকে ও দেখেছিল পোস্টার হাতে স্লোগান দিতে– নারীনির্যাতনকারী উত্তমকুমার দামের শাস্তি চাই। এত দ্রুত, এত সকালে চলে এসেছে ওরা! বড়োবাবুও খুব ভালোমানুষের মতো উপদেশ দিয়েছে ওদের টাকাটা ফিরিয়ে দিন, আর বিয়েটা যখন ভেঙেই যাবে এখনই ডিভোর্স পেপারে সইটই করে মানসম্মান বাঁচান। এখনও লোক জানাজানি হয়নি তেমন। উত্তম বোঝাতেই পারেনি যে পণ নিয়ে ও বিয়ে করেনি। আর বধূ-নির্যাতনের কথা তো দূরঅস্ত, একটু জোরে বউয়ের নাম ধরে ডাকাও হয়ে ওঠেনি তখনও।

টাকার ক্ষতি, ক্ষতি নয়, নিজের উপর থেকে বিশ্বাসটাই চলে গেল। বুক ভেঙে গেছিল, শোবার ঘর থেকে এক সপ্তাহের মধ্যে বাইরেই বের হয়নি। এক সময়কার কলকাতার মাঠের ডাকসাইটে স্টপার ছিল। যত গোল করেছে তার চেয়ে ঢের বেশি করিয়েছে। কিন্তু এখন পরপর গোল খেয়ে যাচ্ছে। করবীকে টেক্বা দিতে তেমন কোনও খোঁজখবর না নিয়েই খুব দ্রুত বিয়েটা সেরেছিল। কিন্তু কী করে পারল মেয়েটা! আজও ভেবে পায় না। এখন হাবরা থানায় ডিউটিরুমে বসে এফআইআর লেখাতে লেখাতে উত্তমের মনে পড়ছিল এসব কথা। পাশের কনস্টেবল দাদার কাছ থেকে বিড়ি চেয়ে একটা বিড়ি ধরাল। মাথাটা উত্তর কলকাতার ট্র্যাফিক জ্যামের মতো জমাট হয়ে আছে।

এখন সে বিড়ি খায়। বলে, বিড়ি না ফুঁকলে মাটির কাছাকাছি যাওয়া যায় না। আমার কাজই মাটির সাথে, মাঠের সাথে– বলে অল্প করে হাসে। এবছর উত্তম বড়ো ক্লাবের স্পটার। গোদা কথায় ছেলেধরা। ফুটবল মরশুমের আগে কলকাতার মাঠের বড়ো ক্লাবগুলির রিক্রুটারদের কাছে ওর ডিমান্ড এখন বেশ। গত নয় বছর ও এই ছেলেধরা, মানে স্পটারগিরি করছে। আচমকাই এই কাজটা শুরু হয়। করবীর কাছ থেকে আঘাত ও বিয়ের পর বউ পালানো ও থানা-পুলিশ ইত্যাদির ধাক্বায়, উত্তমকুমার বেশ গভীর একটা ডিপ্রেশনের মধ্যে পৌঁছে গিয়েছিল। অফিসে যেত মাসে হাতে গোনা কয়েকদিন। মানুষজন পছন্দ করত না। নিজের কাছে নিজেকেই লুকোতে চাইত। সারাদিন গোটা কলকাতার খোলা মাঠের কোণটোনে বসে কাটিয়ে, অনেক রাতে ঘরে ফিরত। এরকম করতে করতে গোটা কলকাতার মাঠের ফুটবল খেলা দেখে ফেলেছিল সে বছর। একদিন উত্তর কলকাতার একটা মাঠে স্কুল ফুটবল দেখছিল। একটা বছর ১৪-১৫ ছেলের খেলা ওকে নাড়িয়ে দেয়। স্টপার। খেলা শেষে নাম জিজ্ঞাসা করে। ওর নাম হাসান। বস্তিতে থাকে। দেশবন্ধু স্কুলের ক্লাস নাইনের ছাত্র। উত্তম ছেলেটার ভেতর একদম নিজের গড়ন দেখল। বেশ লম্বা। ছ’ফুটের উপর হবে। দারুণ সম্ভাবনা। রাতে ঘুম হল না। পরের দিন অফিসে গিয়ে শম্ভুদাকে বলল, ওই ছেলেটিকে একটা ক্লাব দিতে হবে। সেই শুরু। ছেলেটিও ইতিমধ্যে ভারতীয় জার্সি গায়ে দিয়ে ফেলেছে।

গত দু’বছরে কলকাতার মাঠের তাঁবুগুলোতে তার নাম একটা বিষয়। এভারেডি ইলেভেন ২ঙ্মঙ্মজ্জ-এর ক্লাব ফুটবলের হিসেব-টিশেব সব বদলে দিয়েছে। চারটে বড়ো ক্লাবকেই গোল মেরে দিয়েছিল। দু’টোর সাথে ড্র, দুটো জয়। সেই এভারেডির দুটো স্টপারই এবছর, ২০০৭-এ গোটা ভারতের মাঠ শাসন করছে। বিড়িখোর উত্তমই ওই স্টপার দুটোর স্পটার ছিল। এবছর বড়ো ক্লাবের স্পটার হিসেবে তিনটে জায়গাতে অ্যাসাইনমেন্ট আছে। গোলকিপার, ডিপ ডিফেন্স আর তার নিজস্ব প্রিয় জায়গা স্টপার পজিশনের জন্য। মোটা টাকার চুক্তি। বছরে বিশ লাখ। দশ লাখ টাকা অ্যাডভান্স পেয়েছে। অফিসে হাজিরা খাতায় সই করে দু-এক কাপ চা খেয়ে, শম্ভু-দার সঙ্গে একবার দেখা করে কেটে পড়ে। প্লেয়ার কোটায় চাকরি হয়েছিল বছর ষোলো আগে। গ্রুপ ডি। এখন পদোন্নতি হয়েছে। গ্রুপ সি। ওর শুধু আসা-যাওয়া। কাজের মধ্যে নিয়ম করে শম্ভুদার সঙ্গে কিছুটা সময় কাটানো। এই মানুষটাকে ও প্রাণ দিয়ে ভালোবাসে আর শ্রদ্ধা করে। শ্রদ্ধা করারই মতো।

প্রথম দিন শম্ভুদার কাছে গল্পটা শুনেই সে আপ্লুত হয়ে গিয়েছিল। গল্পটা শম্ভুদার স্ত্রী আত্রেয়ীকে নিয়ে যতটা, তার চেয়ে ঢের শম্ভুদা নিজেই। লাখোটিয়া কম্পিউটার সেন্টার, কলকাতার প্রথম যুগের কম্পিউটার ট্রেনিং সেন্টারের অন্যতম। সেখান থেকে এক বছরের কোর্স করেই এন্টালির ডাকাবুকো বিএ পাস শম্ভু রাহা, এই কোম্পানির কম্পিউটার অপারেটরের চাকরিটি পায়। মাঝে মধ্যেই শম্ভুদার সহকর্মী দীপকের খোঁজ করে অফিসের ল্যান্ড ফোনে কল আসত আত্রেয়ীর। দীপক অফিসে বেশ অনিয়মিত ছিল, তাই ফোনটা ধরতেন শম্ভুদাই। প্রথম প্রথম আড়ষ্ট আলাপ, ক্রমশ বন্ধুত্ব। তারপর অন্তরঙ্গতা। এদিকে অনিয়মিত হওয়ার কারণে দীপকের চাকরিটি গেল। একদিন আত্রেয়ী চাইল দেখা সাক্ষাৎ হোক। শম্ভুদা বলল, বেশ। কোথায়, কখন তা আত্রেয়ী ঠিক করে। প্রথম দিন ছিল শনিবার, ধর্মতলায় মেট্রো সিনেমার সামনে, সন্ধ্যা সাড়ে পাঁচটায়। কিন্তু কী করে চিনব, শম্ভুদা জিজ্ঞাসা করেছিল। আত্রেয়ী জানায় সে কালো রঙের চুড়িদার পরবে।

শম্ভুদা বলেছিল, আমি থাকব পিংক টি-শার্ট আর ব্লু জিনসে। শনিবার দুটোর পরেই ছুটি। শম্ভুদা ক্লাব, ক্যান্টিন করতে করতে চারটে বাজিয়েছে মাত্র। আরও দেড় ঘন্টা! সময় আর কাটতেই চায় না। অফিস থেকে এসপ্ল্যানেড হেঁটে দশ মিনিটের পথ। আর এই বিশেষ দিনে তো হাঁটা যায় না, ট্যাক্সি করতে হবে। শম্ভুদা সাড়ে চারটের মধ্যেই চলে এসেছে। এত আগে কী করবে, ফুটপাথে বইপত্রের দোকান থেকে বইপত্র দু-একটা তুলে তুলে দেখছে। ইতিমধ্যে সিনেমার শো ভেঙেছে। অনেক মানুষ। খুঁজে পাবে তো! মনে মনে একটা আশঙ্কাও তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। সাড়ে পাঁচটা বেজে গেছে, কই কালো-চুড়িদারে কাউকে তো দেখা যাচ্ছে না। শম্ভুদা মনে মনে ভাবল, আমার ঘড়িটা ঠিক আছে তো! ঠিক এখানটাতেই তো বলেছিল! তখনও মোবাইল ফোনের যুগ চালু হয়নি। ফলে প্রতীক্ষার দীর্ঘতা অস্বস্তি বুনে চলে মাথার ভেতর। প্রায় একঘন্টা কেটে গেছে, সাড়ে ছ’টা নাগাদ নীল শিফন শাড়ি পরা একটা মিষ্টি মেয়ে তার দিকে এগিয়ে এল। ঘন্টাখানেক আগেই ওই দীর্ঘাঙ্গী সুশ্রী মেয়েটা ওর চোখে পড়েছে। শম্ভুদা ভেবেছিল সিনেমা দেখতে এসেছে, ওর সঙ্গীর জন্য অপেক্ষা করছে। মেয়েটি জিজ্ঞাসা করল, আপনি শম্ভু রাহা?

হ্যাঁ। কিন্তু আপনি?

মেয়েটি হেসে জবাব দেয়, সে-ই আত্রেয়ী। বড়ো একটা শ্বাস নিয়ে শম্ভুদা অনেকক্ষণ ওর চোখে তাকিয়ে ছিল। কোনো অনুযোগ করেনি। পোশাক পালটানোর কারণও জিজ্ঞাসা করেনি। পরে অবশ্য জেনেছিল, ইচ্ছা করেই আত্রেয়ী নিজের পোশাকের ভুল বিবরণ দিয়েছিল যাতে না-দেখা পরিচয়ের শম্ভুদাকে অপছন্দ হলে নিঃশব্দে কেটে পড়তে পারে। শম্ভুদা বলল কোথায় বসে কথা বলা যায়! চলুন কাছেই কাফে দ্য মণিকা-র দোতলায় কফি খেতে খেতে গল্প করা যাক। কফি খেতে খেতে শম্ভুদা আত্রেয়ীর রূপে মজে যায়। বলে সংশয় ছিল, না না-দেখা আত্রেয়ীর ঘোর, দেখা আত্রেয়ী এসে যদি নষ্ট করে দেয়। কিন্তু এখন দেখছি আমার ভাবনা পেরিয়েও আপনি অপরূপা। আত্রেয়ী অল্প হাসে এবং ঘড়ির কাঁটা দ্রুত সাড়ে আটটা পার করে দেয়। আত্রেয়ী উঠব উঠব করে। শম্ভুদা বলে, রাত হয়ে গেছে। চলুন, আপনাকে পৌঁছে দিয়ে আসি। আত্রেয়ী সশব্যস্ত হয়ে বলে, না না আমি একাই যেতে পারব। শ্যামবাজার। আপনি আমাকে একটা ট্যাক্সি ধরে দিন শুধু। তারপর হাতব্যাগ খুলে ব্যাগের ভেতর খুঁজতে খুঁজতে মুখ চুন করে বলে, কিন্তু আমার মানিপার্স বাড়িতে ফেলে এসেছি। শম্ভুদা ব্যস্ত সমস্ত হয়ে নিজের মানিব্যাগ থেকে পাঁচশো টাকা বার করে হাতে গুঁজে দিয়ে তাকে ট্যাক্সিতে তুলে দেয়। এরপর প্রায় প্রতিদিনই শম্ভুদার বিকেল কেটেছে আত্রেয়ীর সাথে আড্ডায়। কখনও সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউয়ের কফিহাউসে, কখনও ইডেনে, কখনও গঙ্গার ঘাটে, কখনও সেন্ট্রাল লাইব্রেরির চত্বরে, কখনও মেট্রো সিনেমা হলে। প্রায় একবছর শম্ভুদা হাবুডুবু। এই হাবুডুবুতে শম্ভুদা নজর করেনি আত্রেয়ী তার বাড়ির ঠিকানা, পরিবার পরিজন নিয়ে কোনও কথাই বলেনি কোনও দিন। কিন্তু প্রতিদিনই আত্রেয়ী হাত পেতে তার কাছ থেকে দুশো-পাঁচশো টাকা নিয়ে গেছে। এই রহস্যটা ভেঙেছিল দুর্গাপুজোর সময়। হঠাৎ কলেজস্কোয়ারের ঠাকুর দেখতে এসেছিল, ভিড়ের ভেতর একটু ছাড়াছাড়ি হয়েছে। শম্ভুদা সবিস্ময়ে লক্ষ্য করে, একটা ছেলে আত্রেয়ীর হাত ধরে টানাটানি করছে। শম্ভুদা কাছে এসে সজোরে এক থাপ্পড়। ছেলেটি ছিটকে পড়ে, আর সোরগোল ফেলে দেয়। এন্টালিতে থাকা শম্ভুদাকে কলেজস্কোয়ারের অনেকেই চেনে। তখনই ও জানতে পারে, আত্রেয়ী বউবাজারের হাড়কাটাগলির যৌনকর্মী। পাঁচ মিনিটেই সামলে নিয়েছিল এই সত্যতার ঝটকা।

তারপর সেই প্যান্ডেল থেকে সোজা লালবাজার। পরিচিত পুলিশ অফিসারকে সব ব্যাপারটা খুলে বলে। রাত্রেই পুলিশ রেইড ক’রে হাড়কাটাগলি থেকে এক মাসি সহ গোটা চারেক মাস্তানকে তুলে আনে। লালবাজারে আত্রেয়ীকে দেখিয়ে অফিসার বলেছিল, এ আমার বোন, এর দিকে আর কোনও দিন চোখ তুলে যদি তাকিয়েছিস তোরা, মার্ডার কেসে সোজা সবকটাকে যাবজ্জীবন ফাঁসিয়ে দেব। তারপর দিনই কোর্ট-ম্যারেজ। ওই অফিসার তার নিজের বোনের পরিচয়ে পরিচিত করিয়ে শম্ভুদার বাড়িতে আত্রেয়ীকে তুলে দিয়েছিল। তিন ছেলেমেয়ে নিয়ে শম্ভুদার সুখী পরিবার এখন! শম্ভুদা সে গল্পও করে। শম্ভুদার এই সোজা-সাপটা খাদহীন ভালোবাসার কাহিনিকে আদর্শ মেনেছে উত্তম।

উত্তম, মানে উত্তমকুমার দাম এই মধ্য-চল্লিশেও মেদহীন ধনুকের ছিলার মতো শরীর রেখেছে। মাথায় কদমছাঁট চুল। শহর, শহরতলীর কোথায় কোন পাড়ায় ফুটবল টুর্নামেন্ট সেসব ওর এখন মুখস্থ। কলকাতার মাঠে কম যায়। জেলায় জেলায় খেলোয়াড় হিসেবে নিজের পরিচয়ের সুযোগে সোর্স কাজে লাগায়। যেভাবে পুলিনের কথায় আজ দুটো কুড়ির বনগাঁ লোকালে উঠে যাবে হাবরা। পুলিন হাবরা লিগ ম্যাচে রেফারিগিরিও করে। আজ সবুজ সংঘ ও প্রগতির ম্যাচ। সোর্স পুলিন টেলিফোনে প্রথমে নাটা দেবাশিসের কথা বলেছিল। অসাধারণ ট্যালেন্ট। বল পায়ে চুম্বকের মতো লেগে থাকে আর দারুণ প্রেডিক্ট করতে পারে। মাঠে নামলেই একটা না একটা গোল করবেই। উত্তম সরাসরি নাকচ করে দেয়। পাঁচ ফুট সাত ইঞ্চির নীচের কোনও প্লেয়ার নিয়ে ও ভাববে না। ফুটবল বডি গেমও।

ক্রমে যত দিন যাচ্ছে, বিদেশিরা যত আসছে তত রাগবির মতো হতে চলেছে ফুটবল। শরীর কতটা ধকল নিতে পারবে তা কিছুটা উচ্চতা নির্ভরও। সোর্স পুলিন দু’নম্বরটির কথা জানায়। সবুজ সংঘের গোপাল। ভালো হাইট, আর ফুটবলারের চেয়ে বেশি ও দৌড়বীর। এমন চোঁ চোঁ দৌড় লাগায় এদিক ওদিক মনে হয় কিছু একটা যেন হতে চলেছে। অথচ বল হয়তো উলটো দিকে আছে। উত্তম সোর্সের এই তথ্যটাকেই আজকের প্রাইম হিসেবে ঠিক করেছে। চোখে মুখে কিছুটা উল্লাস। এরকমই খুঁজছিল। নাস্তানাবুদ করা স্প্রিন্টার। তারপর ফুটবল তো কোচের হাতে পড়লে কথা বলবে।

উত্তম যা ভেবেছিল তার চেয়ে বেশি। এ একদম ইউরেকা। ছেলেটা একটাও গোল করেনি। কিন্তু ওর টিম দু’গোলে জিতল। বিরতির পরপরই ছেলেটা মাঝমাঠ ক্রস করে হঠাৎ লেফ্ট উইং থেকে

চোঁ-চোঁ করে দৌড় লাগাল রাইট উইং-এর দিকে। দু’টো ডিফেন্ডার কেটে গেল। পেছন থেকে ওই নাটা ছেলেটা সম্ভবত উইথড্রয়াল স্টপার খেলছিল– গোল মেরে দিল মাখনে ছুরি দেবার মতো। ব্রিলিয়ান্ট! গোলটা হবার পরে উত্তম চ্যাঁচাল, তারপর পকেটে হাত দিল পেন আর কাগজ নেবে বলে। কী যেন নাম! হাত চালিয়ে বুক পকেটে পেন, ছোটো ডায়েরি খুঁজে না পেয়ে চোখ নামাল।

আরে আশ্চর্য! আমি তো পেন-টেন নিয়েই বেরিয়েছি। কী মনে করে পেছনের পকেটে হাত দিয়ে দেখে লেপাপোছা। অর্থাৎ জিনসের হিপ্পকেটে তখন কিছুই নেই। উত্তমের বুকটা ছ্যাঁৎ করে ওঠে। সোর্স পুলিনের জন্য হাজার খানেক টাকা ছাড়াও যাতায়াতের খরচ ইত্যাদির জন্য আরও শ’পাঁচেক ছিল। এসবিআই ডেবিট কার্ড, জরুরি কাগজপত্র, কিছু তথ্য, নোট– এতক্ষণের আনন্দে এসময় ভাঁটার টান।

বনগাঁ লাইনের ভিড়। শিয়ালদা থেকেই বসার জায়গা পায়নি। ভেতরের দিকে দাঁড়িয়ে ছিল মনে পড়ছে। দমদম আসতে চারপাঁচজন তরুণী ভিড় ঠেলে ঢুকে পড়েছিল। সকলেই খুব উচ্ছ্বল। নিজেদের ভেতর নানারকম কথাবার্তা চালাচ্ছিল। টুকরো ইংরেজি, হিন্দি, বাংলা মিশিয়ে। মাই নেম ইজ খান থেকে ম্যানিকিউর সবই তাদের বিষয়। উত্তম এসময় খেলাপাগল। নারী নিয়ে তেমন মাথাব্যথা নেই। ও মাঠের কথা ভাবতে ভাবতে চলেছে। ভিতরে একটা আর্জ। এবছর এই বড়ো তিনটি ক্লাবের জন্য অন্তত গোটা পাঁচ-ছয় সোনার ছেলে তুলে দিতে হবে। আনকোরা কিন্তু সলিড। বড়ো ক্লাবগুলিরও তাতে লাভ। দু’তিন বছর খুব কম পয়সায় এদেরকে কাজে লাগাতে পারে। হিসেবে অন্তত কোটি টাকার ফয়দা। উত্তমের মনে হচ্ছে আজ একটা হিল্লে হবে।

একটা মেয়ে ওর গা ঘেঁষে দাঁড়িয়েছে। ভিড়ের ভেতর প্যাসেজেও ডাবল লাইন। মেয়েটির সমুন্নত বুক মাঝে মাঝেই ওর খোলা কনুই ঘষে দিচ্ছিল। উত্তম একবার তাকাতেই মেয়েটি মিষ্টি হাসে। দীর্ঘ সুশ্রী চেহারার। চুড়িদারে লোকাট ফ্রেম। উত্তাল বুকের অনেকটাই প্রকাশমান। ডান দিকের অপেক্ষাকৃত শ্যামাশ্রী মেয়েটি একটু চেপে দিলে ও আরও একটু বাঁয়ে এই সুন্দরীর দিকে ঘেঁষে আসে। এ মেয়েটি তেমন নড়ে না আর তার কোমল বুক সেঁটে উত্তমের গোটা বাহুতে লগ্ন হয়ে যায়। এবার মেয়েটির দেহ থেকে একটা সুগন্ধ টের পায় যা ওর চেনা চেনা লাগে। উত্তমের তখন কাঠকাঠ ভাব। হাত-পা নড়ানোর জায়গা রাখেনি সপ্রতিভ মেয়ে দুটো। জগন্নাথপম অবস্থা। এই স্থির অবস্থায় উত্তম অনুভব করে দুদিক থেকেই দু’টো মেয়ে বুক মেলে ওকে ঘঁষে চলেছে।  ও কোনও দিকে তাকাতে পারছে না। অসহায়ের মতো নিম্নগামী মুখমণ্ডল। উত্তম মাঠের ফুটবল, বল দখল, পজিশন মেকিং– এসবের ভেতর ভাবনা চারিয়ে দিয়ে রাস্তাটুকু পার করে দিতে চাইল।

এই মেয়েগুলিই কি ওকে এতখানি বিপদে ফেলল! এত সুন্দর সুন্দর কথা বলছিল মেয়েগুলো– তবে সেটা ট্র্যাপ! অন্তত ডেবিট কার্ড আর মোবাইল ফোনের জন্য থানায় কমপ্লেইন লজ করতেই হবে। পুলিনকে নিয়ে তাই ও হাবরা থানায় এসে বসেছে।

বিড়ি ফুঁকতে ফুঁকতে হঠাৎ ওর মনে ঝিলিক দিল– বাঁদিকে যে-মেয়েটি বেশি লগ্ন ছিল, একটু বেশি বয়সের, সে কোনও কথা বলছিন না কেন! মেয়েটি হাসবার জন্য মুখ ঘোরাতেই ওর চোখ পড়েছিল কানের নীচের তিলটির ওপর। তখন মাঠের ভাবনায় মত্ত থাকায় ফোকাস্ড ছিল নতুন ছেলে রিক্রুটিং নিয়ে। চুলটা মাথার উপরে চুড়ো করে রেখেছিল সে। ফলে মুখটা একটু গোল লাগলেও ওই তিলটি তো ওর চেনা। ওই-ই কি করবী! বাবুঘাটে কতবার ওই তিলের উপরেই চুম্বন রেখেছে সে। না না, তা কী করে সম্ভব! করবী পকেটমারের গ্যাং করেছে! উত্তমের এই একলা একা জীবনের নেপথ্যে দাঁড়িয়ে থাকা একটি স্নিগ্ধ প্রতিমা প্রতীম করবী পকেটমার!

থানায় বসে শিউরে উঠল। গা সিরসির করতে লাগল। ওই নিষ্পাপ মুখমণ্ডলের মেয়েটি, যাকে একদিন এই জীবন তুলে দেবে ভেবেছিল, সোনারপুরের ওই গ্রাম্য মেয়ে করবী নিশ্চয়ই ওকে চিনেছে। এখনও সেরকম ছিমছাম চেহারা উত্তমের। শুধু দুটো জুলফির কাছের কিছু চুল পেকেছে। তবুও ও আমার পকেট কাটল! এখন নিশ্চিত হচ্ছে ওই যে চেনা চেনা লাগছিল গন্ধটা, তা করবীই ব্যবহার করত। ভিক্টোরিয়ার মাঠে সন্ধ্যায় অনেকবার করবীই উত্তমের ঝাঁকড়া মাথা ওর আধখোলা বুকে টেনে নিয়েছে। সুগঠিত স্তনের খাঁজে নাক গুঁজে গেছে। কিন্তু উত্তম কখনও শরীরে হাত দেয়নি। শুধু ওর বুকের ওই মিষ্টি গন্ধটা ও প্রাণ ভরে নিত। ও চেয়েছিল অপাপ করবীকে গৃহলক্ষ্মী করবে।

এসময় উত্তমের খুব শীতবোধ হতে থাকে। গা-হাত-পা ছেড়ে দেয়। থানার বেঞ্চে এলিয়ে পড়ে। পুলিন দাস ফুলস্কেপ সাদাকাগজ কিনে এনে মোবাইলে মিসিং কমপ্লেইন ডায়েরি লেখাতে লেখাতে পেছন ফিরে তাকিয়ে বুঝে যায় শরীর খারাপ হয়েছে উত্তমের। থানার গায়েই হাবরা হাসপাতাল। ধরাধরি করে সেখানে নিয়ে যায়। পুরোনো দিনের খেলোয়াড় পরিচয়ে খুব দ্রুত ডাক্তার অ্যাটেন্ড করে। সেরিব্রাল অ্যাটাক। ম্যাসিভ। ডাক্তার রেফার করে এনআরএস। অ্যাম্বুলেন্স দেয়। মুখে অক্সিজেন সিলিন্ডার। সোর্স পুলিন দাস, হাবরা হাসপাতালের একজন নার্স ও অচেতন উত্তম যশোর রোড ধরে চলেছে। এসময় উত্তম দেখে, সাদা পোশাকের এক মিষ্টি মেয়ে, মুখটা খুব চেনা চেনা, কোনও পরি হবে, তার কপালে আলতো করে দু’টো চুমু খেল। আর কানের কাছে মুখ নামিয়ে ফিসফিস করে বলল, আমি তোমাকে ভালোবাসি উত্তম। এই প্রথম উত্তম তার সারাজীবনের কাঙিক্ষত শব্দকটি শুনতে পেল। এবং এই প্রথম তার কান্না পেল। বোজা চোখের দুই কোল ঘেঁষে দুফোঁটা জল গড়িয়ে নামল সাদা চাদরে ঢাকা বালিশের উপর।

এনআরএস-এর এমার্জেন্সির ডাক্তার কয়েক মিনিট দেখেই বললেন, অনেকক্ষণ আগেই প্রাণ দেহ ছেড়ে বেরিয়ে গেছে।

 

কুড়ি বছর আগে পরে

খুব গরম আজ।

একটা কোল্ড ড্রিংক্ আনি? – আরে না না। ঠিক আছে। বরং একটু ঠান্ডা জল পেলে ভালো হয়।

– হ্যাঁ হ্যাঁ নিশ্চয়ই…

বলে লোকটা জল আনতে গেল। লোকটার চামচাগিরি এই গরমে একদমই ভালো লাগছিল না। কিছুক্ষণের জন্য মুক্তি। আমি একটু একা থাকতে চাইছিলাম।

পার্কটার এককোণে বিরাট স্টেজ করেছে। বড়ো বড়ো স্ট্যান্ড ফ্যান চললেও গরমের তাতে বিশেষ যাচ্ছে-আসছে না। কারণ স্টেজটার মাথায় ত্রিপল। যেটা থাকলে হাওয়া চলাচল করতে পারে না। ফলে গরম আরও বেড়ে যায়। যদিও পার্কটায় প্রচুর বড়ো বড়ো গাছ ভর্তি। বিশ বছর আগেও জায়গাটা এমনই ছিল। আসার সময় দেখছিলাম সেই বাড়িটা এখনও একই ভাবে আছে, কুড়ি বছর আগের মতো।

আসলে আজ এখানে আমার সংবর্ধনা। সরকারের সর্বোচ্চ সাহিত্য সম্মান প্রাপ্ত হবার পর এরকম অনেক জায়গাতেই আমার এমন সংবর্ধনা পর্ব চলছে। তবে অধিকাংশ আমন্ত্রণই আমি গ্রহণ করছি না। যেগুলো কোনও ভাবেই এড়াতে পারছি না কেবল সেগুলোতেই যাচ্ছি। ওরা যখন আজকে এখানে আসার জন্য আমন্ত্রণ করেছিল তখন জায়গাটার নাম শুনে এককথায় রাজি হয়ে যাই। কারণটা কি? কারণ হল, কুড়ি বছর আগে এখানে আমি থাকতাম।

সেই লোকটা একটা মিনারেল ওয়াটারের বোতল নিয়ে আবার হাজির হল। সাথে একটা দামি সিগারেট প্যাকেট। আমার দিকে সেসব বাড়িয়ে দিয়ে বলল,

– নিন স্যার।

জলটা বেশ ঠান্ডা। গলায় ঢালতেই শরীরটা জুড়িয়ে গেল। এবার একটা সিগারেট ধরালাম।

– আপনি এখানে আসতে এককথায় রাজি হয়ে যাবেন আমরা ভাবতেও পারিনি…

লোকটা আবার আহ্লাদে গদগদ হয়ে বকতে লাগল। যে-ক্লাবটা আমায় সংবর্ধনা দিচ্ছে ও তার সেক্রেটারি। নিমন্ত্রণ করার সময় যখন এসেছিল তখন জেনেছিলাম ও এই এলাকার সব থেকে বড়ো চালের কারবারি। ও সবসময়, মানে আমি যে দু’বার দেখলাম দুধসাদা জামা প্যান্ট জুতো পরে থাকে। কুড়ি বছর আগে অবশ্য ও এত সাদা জামা প্যান্ট পরত না। সিগারেটটা টানতে টানতে মনে পড়ে গেল কুড়ি বছর আগের কথা। তার আগে সিগারেট প্রায় খেতামই না বলা চলে। এখানে এসেই ধরেছিলাম একরকম। সিগারেট ধরাতে দেখলেই সুতপা রাগ করত খুব।

– আগে তো খেতে না। হঠাৎ ধরলে কেন?

অনুযোগ করেছিল ও। ভাবত টেনশন থেকেই আমার এই সিগারেট ধরা।

আস্তে আস্তে পার্কটার নির্জনতা কমে আসছে। টুকটাক করে লোকজন আসতে শুরু করেছে। মাইকে ঘোষণা চলছে– আর কিছুক্ষণ পরেই আমাদের অনুষ্ঠান শুরু হয়ে যাবে। বিখ্যাত সাহিত্যিক হীরক মিত্র আমাদের মধ্যে এসে গেছেন…

বাড়িটা সেই একইরকম আছে। কোথাও কোনও বদল নেই। শুধু রংটা বেশ আবছা হয়ে গেছে। দু’একটা সবুজ পাতা এদিক ওদিক কার্নিশে দেখা যাচ্ছে। পুরোনো পুরোনো একটা ভাব এসেছে বাড়িটার শরীরে। যখন প্রথম এখানে এসেছিলাম তখন বাড়িটা সবে হয়েছে মাত্র। যাকে বলে সদ্যোজাত। আমরাই প্রথম ব্যবহার করি তিনতলার ফ্ল্যাটটা।

বাড়িটা সাহাদের। আমাদের চুক্তি হয়েছিল বড়ো ভাই শংকর সাহার সাথে। তিন ভাইয়ের যৌথ সম্পত্তি। আগে টিনের বাড়ি ছিল। কলোনি এলাকা। তখনই সবে শেষ হয়েছিল টিনের বাড়ি থেকে ফ্ল্যাট বাড়িতে উত্তরণের। পুরো এলাকাটাই এরকম ছিল। আস্তে আস্তে বদল ঘটেছিল কলোনির চরিত্রে।

সুতপা ভাবত আমি সিগারেট খাই টেনশনের জন্য। আমি কিছুতেই ওকে বোঝাতে পারতাম না যে আমার কোনও টেনশন নেই। সামান্য একটু-আধটু টেনশন থাকলেও ওটা বলার মতো বা ভাবার মতো কিছু না। অমন একটু-আধটু সকলেরই থাকে। আসলে সুতপা যবে থেকে আমার জীবনে এসেছিল তবে থেকে আমার সব টেনশন ভ্যানিশ হয়ে গেছিল। একটা সময় অবধি আমার অনেক অনেক বাঁচতে ইচ্ছে করত। সুতপা আসার পর সে ইচ্ছেটা চলে গেছিল। কথাটার ভুল মানে করলে হবে না। যেটা ঘটনা হয়েছিল, সেটা হল সুতপা আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়। আর ভালো জিনিসের দীর্ঘায়ু হয় না। আমি তাই বুঝতে পারতাম এর কোথাও একটা শেষ আছে। আর সেই শেষের আগে চলে যেতে পারলে ভালো। মানে সুখ ফুরোবার আগে পালাও। ফলত, আগে সিগারেট খাবার যে অস্বস্তিটা ছিল, এসব ভাবনায় তা হারিয়ে গেল। সুতপা ভাবত আমি হতাশা থেকে মৃত্যুর কথা ভাবছি। আসলে ব্যাপারটা একদমই উলটো।

স্টেজের সামনের চেয়ারগুলো প্রায় ভরে গেছে। মাইকের গমগমানি বেড়েছে। স্থানীয় কলেজের একদল ছাত্র-শিক্ষক আমাকে আলাদা কোণে নিয়ে গিয়ে কিছুক্ষণ বকাল।

আমরা সবাই স্টেজে উঠলাম। আমার বাঁদিকে স্থানীয় এমএলএ। ডানদিকে ক্লাব প্রেসিডেন্ট, সেক্রেটারি। শুরুতেই একদল লাল পাড় শাড়ির যুবতি কোরাস গাইল। তারা নেমে যেতে শুরু হল পরের পর ভাষণ পর্ব। ভক্তি গদগদ ভাব নিয়ে এমএলএ, ক্লাব-এর সেক্রেটারি, প্রেসিডেন্ট বলে গেল। সবই আমার প্রশংসা, ওদের ক্লাব কত মহান! একটি কমবয়সি ছেলে আমার লেখা থেকে পাঠ করে শোনাল। তারপর আমার হাতে মানপত্র, ফুলের স্তবক, মিষ্টি– আরও কী সব তুলে দেওয়া হল। সেক্রেটারি আমার কানের কাছে মুখ এনে বলল– ফুলের ভিতর টাকার খামটা আছে।…

কুড়ি বছর আগে সাহাদের ফ্ল্যাটটায় আমি ঘর বেঁধেছিলাম সুতপার সাথে। একটা স্বপ্নের মধ্যে দিয়ে কেটে যাচ্ছিল দিনগুলো। মাত্র তো একটা মাস আমরা ছিলাম। তবু এখনও ভাবলে মনে হয় অনেকদিন।

আমরা দুজনে একটু একটু করে ফ্ল্যাটটাকে সাজাচ্ছিলাম। প্রতিদিন কিছু না কিছু হাতে করে কিনে নিয়ে ঘরে ঢুকতাম। পর্দা, পাপোশ, ফুলদানি, বেডকভার আরও কতো কি! এমনকী দুটো খতম হওয়া রেড ওয়াইনের বোতলে দুটো মানি প্ল্যান্টও এনে লাগাল সুতপা। ওর জন্য আমি পছন্দ করে কিনে এনেছিলাম একটা লাল রঙের নাইটি। প্রতিদিন গল্প করতে করতে রাত ভোর হয়ে যেত আমাদের। রাত্রির গাঢ় অন্ধকার কাটিয়ে যখন সূর্যের হালকা আমেজ দেখা যেত, পাখিদের ডাক শোনা যেত, তখন আমরা ঘুমিয়ে পড়তাম তৃপ্তির আমেজ মেখে। আমরা দুজনে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম বাকি জীবনটা একসাথে কাটাব। সে প্রতিজ্ঞা শেষ অবধি সুতপা রাখলেও আমি পারিনি। মাত্র একমাস পরেই আমাদের এই তিল তিল করে গড়ে তোলা স্বপ্নমহল ভেঙে চুরমার হয়ে গেছিল।

এবার আমায় বলতে ডাকা হল। আমি আয়োজক এবং স্থানীয় মানুষদের অভিনন্দন জানিয়ে বলা শুরু করলাম।

‘আপনাদের সকলকে আমার আন্তরিক শুভেচ্ছা জানাই। এই পাড়াটা আমার অত্যন্ত প্রিয় পাড়া। এই পার্ক আমায় অনেক স্মৃতি মনে পড়ায়। আপনারা হয়তো কেউ জানেন না এই পাড়াটায় আমি একসময় থেকে গেছি।’  আমার এই কথায় চারদিকে একটা বিস্ময়ের গুনগুন শুরু হল। এই তথ্য কেউই জানত না। না জানাটাই স্বাভাবিক। বা ভুলে যাওয়াটা। আয়োজক দাদারা মনে হল সবথেকে বেশি অবাক-অপ্রস্তুত হল। এতক্ষণ ওদের ভাষণে মনে হচ্ছিল আমার বিষয়ে ওরা সব জানে। মানে পাবলিককে তাই বোঝাচ্ছিল আর কী। আমি বলা থামালাম না।

– আজ থেকে কুড়ি বছর আগে এই পাড়ায় আমি এসে উঠেছিলাম একটি ভাড়া বাড়িতে। সেই বাড়িটা আজও আছে একই ভাবে। কিছুদিন ছিলাম। মাস খানেকের মতো। এই সময়েই আমি ‘লাইফলাইন চলছে’বলে গল্পটা লিখেছিলাম। এই বাড়িতে বসেই। আপনারা জানেন যা এখন দু-দুটি ইউনিভার্সিটির সিলেবাসে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এবং দেশি-বিদেশি মিলিয়ে অন্তত পনেরোটি ভাষায় অনুদিত হয়েছে। তাই বিশ বছর পর আজ যখন আমি এই গলিতে পা রাখলাম, আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। আমি বুঝতে পারলাম আরও একটি গল্পের জন্ম হতে চলেছে… গোটা পার্কটা স্তব্ধ হয়ে শুনছিল আমার কথা। একটা চিনতে না পারা পোকা পার্কের সব থেকে উঁচু গাছটার টঙে ভনর ভনর করলেও শোনা যাবে এমন এক স্তব্ধতা। বলতে বলতে আমার মন পার্কের আকাশের দিকে উড়ে যেতে লাগল। আমি হারিয়ে যেতে লাগলাম বিশ বছর পিছনে…

আমি হীরক মিত্র। আমার সব থেকে দীর্ঘস্থায়ী পেশা লেখা। যা আমি আজও করে চলেছি। দীর্ঘস্থায়ী পেশা কথাটা বললাম এই কারণে যে, তার আগে আমি অনেক কিছু করেছি। কম্পিউটার অপারেটর, টিউশন, রাজনীতি আরও কত কিছু। কিন্তু শেষ অবধি বুঝলাম আমার দ্বারা ওই লেখাটাই হবে। দুম করে কোনও কিছু ছেড়ে নতুন কিছু শুরু করে দেওয়াটা আমার মজ্জাগত। কলেজ জীবনে হঠাৎ গ্র্যাজুয়েশন শেষ না করে একটা সেলসের কাজে ঢুকে পড়েছিলাম। পয়সাটা খুব দরকার মনে হয়েছিল সে সময়। বছর খানেক কাজটা করার পর আমারই মনে হল অন্তত গ্র্যাজুয়েশনটা রাখা প্রয়োজন। সারাজীবন একটা খিঁচ থেকে যাবে। বয়স থাকতে থাকতে করে ফেলা জরুরি। চাকরি ছেড়ে আবার কলেজে ঢুকে পড়লাম। একদম ফার্স্ট ইয়ার থেকে। পাশ করার পর ভাবলাম ফোটোগ্রাফার হব। কোর্স-এ ভর্তিও হলাম। কিন্তু লাস্টে পরীক্ষা দিলাম না। ভেবে দেখলাম ফোটোগ্রাফির প্রাইমারি ইনভেস্টমেন্ট আমার পক্ষে অনেক। অনেক কিছু কিনতে হবে গোড়াতেই। তারপর কম্পিউটার অপারেটর হলাম। কিছুদিন পর সেটাও ছেড়েছুড়ে রাজনীতিতে। ট্রেড ইউনিয়নে হোলটাইমার। তাও ছাড়লাম নেতাদের কারবার দেখে। লাস্টে এই লেখা।

লিখতে লিখতেই আলাপ হয়ে গেল সুতপার সাথে। বিবাহিত। তবে স্বামীর সাথে থাকত না। পেশায় আর্কিটেক্ট। ইন্ডিয়ান রেলে।

ও-ও লিখত। তবে আমার মতো গদ্যের লোক ছিল না। কবিতা লিখত। খারাপ লিখত না। অনেকেই চিনত। প্রথম দেখাতেই ভালোবেসেছিলাম ওকে। লভ অ্যাট ফার্স্ট সাইট আর কী। বুঝেছিলাম এই আমার মানুষ। এর জন্যই আমি অপেক্ষায় ছিলাম এতদিন। এর জন্যই জন্মেছি আমি। তখন আমার বছর চল্লিশ বয়স। ভবঘুরে মানুষ। তিনকুলে কেউ নেই। একটা বাড়ি আছে। তাতে থাকি, আর ভাড়ার টাকায় ভাত-বিড়ি হয়ে যায়। কিছুদিন মেশার পর বুঝলাম, ওরও আমাকে ভালো লেগে গেছে। সে সময়ে ওর বর সমানে চেষ্টা চালাচ্ছিল ওকে ফিরিয়ে নিতে। নরমে গরমে নানা ভাবে। সুতপা আমার থেকে বছর তিনেকের ছোটো। অর্থাৎ বয়সটা কম নয়। বাড়বে আরও। একা থাকার যন্ত্রণাও বাড়বে। তাই ও প্রায় সিদ্ধান্ত করেই ফেলেছিল বরের কাছে ফিরেই যাবে। সমস্যা যা আছে মানিয়ে নেবে। ঠিক এরকম একটা সময়ে ওর জীবনে আমি ঢুকে পড়লাম। সুতপার সব ভাবনা চিন্তা সিদ্ধান্ত আমূল বদলে গেল রাতারাতি। ডিভোর্সের মামলা করল ও। ওর বর এরকম পাকা গুটি কেচে যাওয়ায় ব্যাপক খেপল। চাকরি করা বউ কে আর ছাড়তে চায়। আমাদের পিছনে পড়ে গেল লোকটা।

ডিভোর্সের মামলা চলতে লাগল অনন্তকাল ধরে। কবে কি হবে জানি না। আদৌ হবে কিনা বুঝতে পারছিলাম না। তাহলে আমরা কী এভাবেই কাটাব বৃদ্ধবয়স অবধি! শেষমেশ দুজনে একদিন ঠিক করে ফেললাম গোপনে বিয়েটা সেরে একসাথে থাকা শুরু করব। যা আইনের চোখে মান্যতা পায় না। আর সুতপার বর জানতে পারলে এটা নিয়ে ঝামেলা পাকাবেই। যা হয় হোক, আগুনকে সাক্ষী রেখে আমি সুতপার সিঁথি রাঙিয়ে দিলাম এমনই এক বৈশাখে। তারপর এসে উঠলাম সাহাদের তেতলায়।

সংবর্ধনা সভা শেষ হয়ে গেছে। আমি স্টেজ থেকে নেমে এসে মাঠের মধ্যে চেয়ার টেনে বসলাম। সাথে সাথে চারপাশে গুণমুগ্ধদের জটলা তৈরি হল। যাদের মধ্যে অনেকেই আমার নিয়মিত পাঠক, সামনে পেয়ে নানান প্রশ্ন করতে চায়। আবার অনেকে শুধু আমার নামটুকুই জানে। বইপত্তর কিছু পড়েনি। একজন বিখ্যাত লোকের

সংস্পর্শে আসতে ভিড় করেছে শুধু।

এখন আমি সত্যিই একজন বিখ্যাত জন। প্রায়দিনই নানা অনুষ্ঠানে মন্ত্রীদের সাথে আমাকে ডাকা হয়। প্রায় সব পুজো সংখ্যাতেই আমার গল্প বা উপন্যাস থাকে। বিভিন্ন সরকারি কমিটি, আকাদেমিতে আমার নাম থাকা প্রায় বাধ্যতামূলক পর্যায়ে। কুড়ি বছর আগে যখন এখানে থাকতাম তখন আমায় প্রায় কেউ চিনত না। কলেজ স্ট্রিট, নন্দন চত্বরে ফেকলুর মতো ঘুরে বেড়াতাম। কাঁধে ব্যাগ, মুখে বিড়ি, না-কাটা দাড়ি। সুতপার যে আমাকে কী দেখে ভালো লেগেছিল, জানি না।

অনেকগুলো অটোগ্রাফের খাতা আমার সামনে এখন। একটা একটা করে সারতে লাগলাম সেগুলো। এমএলএ মশায় আমার সামনে চেয়ার টেনে বসলেন।

– আমি এখানে চল্লিশ বছর ধরে রাজনীতি করছি। দু’বারের এমএলএ। তার আগে কাউন্সিলারও ছিলাম বহুদিন। আপনার মতো একজন বিখ্যাত মানুষ এখানে থেকে গেছেন অথচ আমরা কেউ সেটা জানতাম না!

ওনার এই অবাক হওয়া দেখে আমিও হেসে বললাম, আপনিও আমায় চিনতেন। মনে করতে পারছেন না।

– চিনতাম! কোন বাড়িটায় থাকতেন বলুন তো?

– পার্কের উলটোদিকের ওই বাড়িটায়। সাহাদের বাড়ি। তেতলায়। এমএলএ সাহেব জট ছাড়াতে না পেরে একটা সিগারেট ধরিয়ে ফেললেন। তারপর ক্লাব প্রেসিডেন্টকে বললেন, শংকরদা? তোমার কিছু মনে পড়ছে?

– নাহ্, তবে যেদিন ওনার বাড়িতে প্রোগ্রামটার ব্যাপারে যাই, সেদিন ওনাকে সামনে থেকে দেখে খুব চেনা চেনা লাগছিল। কোথায় যেন দেখেছি। মনে করতে পারছি না।…

আস্তে আস্তে ভিড়টা হালকা হয়ে এল প্রায়। মাথারা ছাড়া সকলে চলে গেছে একরকম। আমরা ক’জন মিলে পার্কের কোণের ক্লাবঘর খুলে বসলাম। সেক্রেটারি হাত কচলে বলল, একটু জলখাবারের আয়োজন রাখা হয়েছে। বসুন একটু।

এমএলএ সাহেবের কাজ ছিল। কিন্তু উনিও যেন আটকা পড়ে গেছেন আমার সম্বন্ধে পুরোটা জানার কৌতূহলে।

সুন্দর কাচের প্লেটে গরম গরম ফিশফ্রাই এল। সেক্রেটারি আমার একদম সামনে এসে বলল, স্যার, এমন সুযোগ তো বারবার আসে না, আপনি অনুমতি করলে একটু হুইস্কি দিয়ে সেবা করি।

আমি হেসে বললাম,

– তাও আছে! ঢালুন এক পেগ…

প্রথম পেগ শেষ করেই এমএলএ আমায় চেপে ধরলেন,

– দাদা আর হেঁয়ালি করবেন না। বলুন না, আপনার সাথে আগে কি আমার কখনও মোলাকাত হয়েছিল?

কৌতূহলে ওর গোল গোল চোখগুলো চকচক করছিল ওর দু’হাতের তিনজোড়া আংটির মতোই। আমি একটা সিগারেট ধরিয়ে লম্বা টান মেরে বললাম, আজ থেকে কুড়ি বছর আগে সাহাদের তেতলায় আমি থাকতাম। একটা ঘটনার পর আপনার নেতৃত্বে একদল ছেলে এসেছিল আমার ফ্ল্যাটে…

…আমার এখনও মনে আছে দরজাটাকে ঢাকের মতো দুমদুম করে বাজিয়েছিল ওরা ‘দরজা খুলুন’ বলে চিৎকার করে। সুতপা ভয়ে সিঁটিয়ে গেছিল ঘরের কোণে। আমি দরজা খুলে বেরিয়ে এসে বলেছিলাম, এভাবে দরজা ধাক্বাচ্ছেন কেন, এটা ভদ্রলোকের বাড়ি।

প্রায় তেড়ে আসার ভঙ্গিতে ওরা বলেছিল, চোপ। বড়ো একেবারে ভদ্দোলোক এয়েছে। শুনে রাখুন, এটা ভদ্দোরলোকের পাড়া। সব শিক্ষিত মান্যগণ্য লোকেরা এখানে থাকে। এসব নষ্টামি এখানে চলবে না। তিনদিনের মধ্যে পাড়া ছেড়ে চলে যাবেন…

পরে শুনেছিলাম সেদিন দুপুরে সুতপার স্বামী এসে বাড়িতে হুজ্জোত করে গেছিল, যখন আমি বা সুতপা কেউ ছিলাম না।

ক্লাবঘরটা মর্গের ঠান্ডা ঘরের মতো হয়ে গেল যেন। অসম্ভব নিস্তব্ধতা। এমএলএ, ক্লাব প্রেসিডেন্ট, সেক্রেটারি সবাই মাথা নীচু করে বসে। আমি নিজেই বোতল থেকে আরেকটা পেগ ঢেলে নিলাম গ্লাসে। এক চুমুকে সেটা শেষ করে উঠে পড়লাম।

– আচ্ছা চলি তাহলে। ভালো থাকবেন।

পার্কের গেট অবধি ওরা সবাই চুপ করে অনুসরণ করল আমাকে। সংবর্ধনায় পাওয়া ফুল, মালা ও যাবতীয় সব কিছু ক্লাবঘরেই পড়ে রইল। সেটা দেখেও ওরা কেউ কিছু বলতে সাহস করল না। আমি গেটের কাছে এসে বললাম, আপনাদের আর আসতে হবে না। আমি একটু সাহাদের বাড়ি ঘুরে যাব, যদি আপনাদের আপত্তি না থাকে।

এমএলএ ভদ্রলোক আমার দু’হাত জড়িয়ে ধরে বললেন, কি বলছেন! আপত্তি! আমাদের ক্ষমা করে দেবেন। কুড়ি বছর আগে কম বয়সের তেজে অনেক কিছু বলে ফেলেছিলাম আমরা, জানি আপনি সে অপমান কোনওদিনও ভুলতে পারবেন না। তবু ছোটো ভাই ভেবে ক্ষমাঘেন্না করে দেবার চেষ্টা করবেন।

আমি মাননীয় এমএলএ-র পিঠে হাত রেখে বলি, আমি কিছু মনে রাখিনি। তাহলে কি আসতাম? মনে রেখে কি হবে বলুন, তাতে তো কিছু বদলাবে না।

ক্লাব সেক্রেটারি ছলছলে চোখে জিজ্ঞেস করল, বউদি এখন কেমন আছেন? উনি কি আপনার সাথেই আছেন?

আমি একটা সিগারেট ধরালাম। মানা করার জন্য তো আর সুতপা নেই। ওরা আমার উত্তরের জন্য প্রতীক্ষারত। পার্কের গেটে দাঁড়িয়ে পরপর দু’তিনটে টান মারলাম সিগারেটে। হুইস্কির নেশাটা বেশ জাঁকিয়ে বসেছে মাথায়। সন্ধ্যা নেমে এসেছে পুরোপুরি। পার্কটা এখন নিকষ কালো। সোডিয়াম ভেপারের আলো তাতে খুব বেশি নাক গলাতে পারছে না বড়ো বড়ো গাছপালার জন্য। আমি ওদের সকলের দিকে তাকিয়ে বললাম, সেদিনের ঘটনার পরদিন আপনাদের বউদি, মানে আমার সুতপা রেললাইনে সুইসাইড করেছিল।

 

ধন্যবাদ

ঘড়িটাতে প্রায় নিভে যাওয়া টর্চের আলো ফেলতেই সুনন্দর একটা ঝটকা লাগল। অন্ধকারে এগারোটা বেজে গেছে। বাজবে না-ই বা কেন, সেই কতক্ষণ আগে সাড়ে দশটা দেখে গুটিগুটি পায়ে শেষ মোমবাতিখণ্ডটা জ্বালিয়ে, খাওয়া শেষ করেই নিভিয়ে দিয়েছে। কিছুটা গাফিলতি থেকেই ঘরে আর মোমবাতি কিনে রাখেনি। সেরকম দরকারও পড়েনি। কোনওদিন এই তিন বছরে দু পাঁচ মিনিটের জন্য কারেন্ট গেলেও সেটা ধরা ছোঁয়ার মধ্যে নয়। কিন্তু গত রাতে ঝড়ে সব লন্ডভন্ড হয়ে যাওয়ার পর, কত যে ইলেকট্রিকের পোল উপড়ে পড়েছে তার কোনও হিসেব নেই। সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কোথাও তার ছিঁড়েছে তো কোথাও গাছের ডাল বা আস্ত একটা গাছই পড়ে গেছে পোলে ।

সকালে স্কুলে যে যার খুশি মতো কারেন্টের কথা বলতে আরম্ভ করেছিল। তবে ইতিহাসের তাজমুল সাহেব একটু আশার কথা শোনাল, ‘ম্যাক্সিমাম কালকের দিন, কারেন্ট চলে আসবে, জোর কাজ হচ্ছে।’ সবাই শুনে বলে উঠল, ‘আপনার মুখে ফুল চন্দন পডুক।’ সুনন্দ কিছু মন্তব্য করেনি, যে বিষয় জানে না, সে বিষয়ে কোনও রকমের মন্তব্য করা থেকে সবসময় নিজেকে সরিয়ে রাখে। তাছাড়া মাত্র তিনবছর হল এখানে এসেছে। এখনও এখানকার ইতিহাস ভূগোল সম্পর্কে কোনও জ্ঞান হয়নি বলে নিজে মনে করে। কারেন্ট না থাকলেও অর্থদফতরের একটা বিশেষ বিজ্ঞপ্তির জন্য স্কুলের সবাই বারবার মোবাইলের নেট খুলেছে। সেখানে সুনন্দের মোবাইলটাও বাদ পড়েনি। বাড়িতেও মা, ঝুমা এমনকী বিটকুর সাথে কথাও বলেছে, সকালে সন্ধেবেলাতেও। ঝুমা কারেন্টের কথাও জিজ্ঞেস করেছে। আসেনি, শুনে বলেছে, ‘তাহলে তাড়াতাড়ি খেয়ে শুয়ে পড়ো।’

‘সেটা এমনিতেই করতে হবে। যা দু-এক টুকরো মোমবাতি আছে তা দিয়ে কোনও রকমে খাওয়াটুকু হবে।’ সুনন্দ বলে।

ঝুমা প্রতিবারের মতো সেই একই রেকর্ড করা কিছু বুলি আউড়ে ফোন বন্ধ করে। সুনন্দ ফোনটা কাটবার সময় লক্ষ্য করে চার্জ শেষ। ইন্ডিকেটরটাও ব্রিম করছে। উপায় না দেখে ফোনটা পুরোপুরি বন্ধ করে চেয়ারে চোখ বন্ধ করে বসে থাকে। মাঝে একবার উঠে মোম জ্বেলেই খান চার রুটি তৈরি করে দুধ গরম করে নেয়। তরকারি করতে আর ইচ্ছে করে না। আধপো দুধ, একটা মিষ্টি, তিনটে রুটি খাওয়া হয়ে যাবে। একটা বাড়তি করা থাকল। কোনদিন কীরকম খিদে থাকে। না হলে সকালে ভুলো তো আছেই। প্রতি সকালে গোপালদা দুধ দিতে আসার সময় ওটাও চলে আসে, লেজ নাড়ে। সুনন্দ রুটি, বিস্কুট কিছু একটা দিলে খেয়ে পালিয়ে যায়, পরের দিনের আগে আর ওর পাত্তা পাওয়া যায় না। এই বাড়িতে ভাড়া আসার মাস কয়েক পর থেকেই ভুলোর রুটিন মোটামুটি এই রকম। অবশ্য মাঝে কোনওসময় আর ঘুরতে আসে কিনা সুনন্দ জানে না। সারাদিন স্কুল, ফিরে সামনের লাইব্রেরিতে ছোটোখাটো একটা আড্ডা দিয়ে, রুটি তৈরি করে খেয়ে ঘুমিয়ে পড়া। বেশির ভাগ শুক্রবার বাড়ি চলে যায়, ফেরে হয় রবিবার রাতে না হয় সোমবার সকালে। এই প্রোগ্রাম বদল বলতে মাঝে মাঝে স্কুলের কোনও স্যার বা দিদিমণিদের বাড়িতে গেট টুগেদার, তাও সব সময় যায় না।

প্রথম প্রথম ভাড়ার এক কামরার এই ঘরটাও গিলে খেতে আসত। কোনওদিন বাবা-মাকে ছেড়ে একা থাকেনি। ভালো কাজ পেয়েও ভিন রাজ্যে যায়নি। তবে সব সময় তো সবকিছু নিজের মর্জি মতো হয় না। বাবা মারা গেল। সেই বছরই আবার স্কুলে চাকরি পেল। প্রথম বছরটা প্রতিদিন আড়াইশো কিলোমিটার আপ ডাউন যাতায়াত করে শরীরের কলকব্জা সব ঢিলে হতে আরম্ভ করল। তারপরেই স্কুলের কয়েকজন স্যার দিদিমণির পরামর্শে বাড়ি ভাড়া করে মাকে এনে রাখলেও, মায়ের শরীর মন কোনওটাই জায়গাটার সাথে খাপ খাওয়াতে পারল না। অগত্যা আবার ডেলি-প্যাসেঞ্জারি। তারপরেই ঝুমা এল, এক বছরের মাথায় বিটকু। বিটকু জন্মাবার পরেও কয়েকটা মাস

ডেলি-প্যাসেঞ্জারি করে বাধ্য হয়ে স্কুলের কাছাকাছি ঘর ভাড়া নিল, একটাই ঘর সঙ্গে বাথরুম। বাড়ি মালিকের সাথে দেখা হওয়ার কোনও উপায় নেই। তবে ভাড়া দেওয়ার সময় প্রায় কান কামড়ে বলে দিয়েছিল, ‘সামনের স্কুলের মাস্টার তাই ঘরটা দিলাম, না হলে একা পুরুষ মানুষকে কোনওমতেই ঘর ভাড়া নয়।’ সুনন্দ কথাগুলো ঝুমাকে বলতেই সে কি হাসি। মজা করে বলে উঠল, ‘তাহলে আমি সব থেকে নিশ্চিন্ত, কিছু হলে ঠিক খবর পেয়ে যাব, ফোন নম্বরটা দিয়ে আসতে হবে।’

আবার বৃষ্টি নামল। সন্ধে থেকে একভাবে হয়ে কিছু সময়ের জন্য বিরতি নিয়ে আবার। মাঝে কয়েকটা ঘন্টা হুডুম হাডুম থাকলেও বৃষ্টিটা পড়েনি। সুনন্দ ঘরে চেয়ারে বসে বসে পাশে গোয়ালঘরের ছাদে বৃষ্টির ফোঁটা পড়বার শব্দ শুনতে পেল। জানলার পর্দা টেনে মশারি খাটিয়ে শুতে যাবে, এমন সময় দরজার কড়া নাড়াবার শব্দ পেল। সুনন্দ প্রথমবার কোনও আমল না দিয়ে আগের মতোই শোওয়ার ব্যাবস্থা করতে লাগল। কিন্তু আবার শব্দটা পেতে চেয়ার ছেড়ে দরজার কাছে দাঁড়াল। ঠিক বিপদে পড়লে কেউ কড়া নাড়লে যেমন শব্দ করে, তেমনি শব্দ।

চেষ্টা করেও মনের ভুল এটা নিজেকে বোঝাতে পারল না। দরজাটাও খুলতে সাহস হল না। কানের বা মনের কোনও ভুল নয় তো? তাও দরজার কাছে দাঁড়িয়ে রইল কিছু সময়। আবার সব চুপচাপ। অন্ধকার এখন আরও প্রকট। ঘরের ভিতরটা আরেকবার দেখে নিল। একটু গিয়ে দরজার উলটো দিকের জানলার পর্দা সরিয়ে বাইরেটা দেখবার চেষ্টা করল। সেই অন্ধকার, আর মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ ঝলকানি। দরজার কড়াটা আবার নড়ে উঠল। সুনন্দ আস্তে আস্তে দরজার কাছে গিয়ে কাঁপা গলায় ‘কে…?’ জিজ্ঞেস করতে ওপাশ থেকে একটা মেয়েলি গলা শুনল, ‘একটু দরজাটা খুলবেন, খুব বিপদে পড়ে গেছি।’

মেয়ের গলা পেয়ে রীতিমতো ঘাবড়ে গেল। মেয়েটিরও গলাতে শব্দগুলো জড়িয়ে যাচ্ছিল। পাশের বাড়ির কাকুর কি কোনও বিপদ হল? বউদি এসেছে নাকি না, বউদি হলে তো নাম ধরে ডাকত। কিছুসময় দরজার কাছে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল, বাইরের কড়া নড়ে উঠল আবার।

আস্তে আস্তে দরজাটা একটু ফাঁক করে বাইরেটা দেখার চেষ্টা করল, কিন্তু মেঘে ঢাকা। অন্ধকার রাত্রি চোখ দুটো আটকে দিল। কিছু বুঝতে পারল না। কিছু সময় পরেই একটা গলা শুনতে পেল, ‘ভিতরে আসব, বাইরে খুব বৃষ্টি পড়ছে , দরজাটা ভালো ভাবে খুলুন।’

–আপনি কে, হঠাৎ আমার এ ঘরে তাও রাত্রিবেলা?

–সব পরে বলছি আপনি আগে দরজাটা খুলুন।

সুনন্দ দরজাটা ভালো ভাবে খুলে কিছু বলবার আগেই আগন্তুক ঘরের ভিতর সুনন্দকে পাশ কাটিয়ে তাড়াতাড়ি ঢুকে দরজার কাছে, সুনন্দের বিপরীতে বাঁদিক থেকে হাত পাঁচ দূরে দাঁড়িয়ে, বলে উঠল, ‘একটা গামছা টামছা কিছু দিতে পারবেন?’

সুনন্দের ঘোর তখনও কাটেনি। অন্ধকার হলেও চোখের সামনে দিয়ে একজন ভিতরে ঢুকল। রোগা নয় বোঝা গেল, সুনন্দের শরীরের সঙ্গে  হালকা ধাক্বা লাগল। চুড়িদার বা পাঞ্জাবি কিছু একটা পরে আছে।

আগন্তুকের পোশাকের জল গায়ে লাগার পরে দরজার ছিটকিনিটা তখনও না লাগিয়ে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বলল ,‘আপনি এভাবে ঘরে ঢুকে গেলেন?’

–দেখছেন না বাইরে কি অবস্থা!

–বাইরে এমন অবস্থা তো আমার বাড়িতে এলেন কেন? আর বাড়ি ছিল না?

–আসলে রাস্তার থেকে এই বাড়িটাই সামনে পেলাম, আলোও জ্বলছিল একটু আগে।

–আমি এ বাড়িতে একা থাকি।

–সেটা আমি বাইরে থেকে কীভাবে জানব?

–এবার তো জানলেন, তাহলে আসুন এবার। আমি আপনাকে পাশের বাড়ির বউদির কাছে দিয়ে আসছি।

–ভয় পাচ্ছেন? আপনার অতো ভয় কীসের?

–দিনকাল তো ভালো নয়।

–সে ভয় তো আমারও থাকবার কথা।

বাইরের বৃষ্টির ঝাপটা খোলা দরজা দিয়ে ঘরের ভিতর আসছে দেখে মেয়েটি বলে উঠল, ‘দরজাটা লাগিয়ে দিন, জল আসছে।’ সুনন্দ বুঝল মেয়েটির কথাগুলো একটু স্বাভাবিক হয়েছে। একটু আগেই হাঁপাচ্ছিল।

ঘরের ভিতরটা অন্ধকার। সুনন্দ মেয়েটিকে ভালো করে দেখতে না পাবার জন্য মেয়েটির বয়স, কালো না ফরসা, মুখ শরীর কিছুই বুঝল না।

–আপনি এত রাতে আমার দরজায় কড়া নাড়লেন, ঘরে ঢুকলেন, কি অসম্ভব আতান্তরে পড়লাম বলুন তো।

–সব বলছি, তার আগে কিছু একটা দিন মাথাটা মুছতে হবে। একটু খাবার জল পাওয়া যাবে?

একটু কষ্ট করে হেঁটে আগন্তুককে একটা বোতল ধরিয়ে বললাম, ‘জলটা নিন, গামছা দিচ্ছি।’ পিছনের দিকে ফিরতেই মেয়েটির জল পানের শব্দ শুনতে পেল। তার পরে একটা তৃপ্তির শব্দ এল, ‘আঃ।’

সুনন্দর হাত থেকে গামছা নিয়ে মাথাটা মুছে বলে উঠল, ‘আমি নন্দিতা। যাত্রাাদলে কাজ করি, কুশপুর গ্রামে যাচ্ছিলাম, কমলপুর চেনেন? এখান থেকে এক কিলোমিটার হবে নাকি?

–আরও বেশি। আমাদের স্কুলে ছাত্র-ছাত্রী আসে।

–ও আপনি স্যার? কোন স্কুলে পড়ান?

–এই গ্রামের হাইস্কুলে।

–যাই হোক। কমলপুরে আমার মাসি থাকে। ওখানে দেখা করে ভেবেছিলাম হেঁটে বা ভ্যানে কুশপুরে চলে যাব। বেরিয়েও ছিলাম। মাঝরাস্তায় এই বৃষ্টি।

–আপনি কি পাগল, রাত্রিবেলা এই গ্রামে ভ্যান কোথায় পাবেন?

–না না, রাত্রিবেলা নয়। আমি সন্ধের আগেই বেরিয়ে ছিলাম।

–তাহলেও এই গ্রামে-ঘরে এমনি ভাবে সন্ধেবেলাতে একা বের হতে নেই।

–আসলে আমি তো এদিককার কিছু জানি না। মাসিও একা থাকে। বাসে চেপেছিলাম। ঠিক চললে তাড়াতাড়ি পৌঁছে যেতাম। কিন্তু মাঝরাস্তায় বাস খারাপ। বাসেই বলল, ‘ভ্যান পেয়ে যাবেন।’ ভ্যানের আশায় হাঁটতে হাঁটতে অনেক দূর চলে এলাম। মোবাইলে চার্জ নেই, তার উপর জল ঢুকে গেছে, দলের কারোর সাথে কথাও বলতে পারলাম না। মাঝরাস্তায় বৃষ্টি নামতে একটা মন্দিরে দাঁড়ালাম।

–কোন দিকে

এই বাড়ির পূর্ব দিকে মনে হয়।

–পূর্ব দিকে কোনও মন্দির নেই, উত্তরে আছে, ধর্মরাজের মন্দির।

–যাই হোক, সেই মন্দিরের চাতালে বসেছিলাম।

–আপনি তো অদ্ভুত, একে অন্ধকার, তার উপর এই বৃষ্টি, আর আপনি একা মন্দিরে বসেছিলেন! যে-কোনও রকম বিপদ হতে পারত।

–প্রথমে একাই ছিলাম, তাতে অসুবিধা হয়নি, কিছুক্ষণ পরে কোথা থেকে তিন-চারজন ছেলে এসে বিরক্ত করতে আরম্ভ করল, তাই পালিয়ে এদিকে চলে এলাম। আপনাদের গ্রামে তো সন্ধেবেলাতেই রাত্রি নেমে আসে দেখছি।

–আপনি এখানে কখন এসেছেন?

–আধঘণ্টা হবে।

–এখন এগারোটার বেশি বাজে, এই বৃষ্টিতে কি সবাই বাইরে নাচবে? কারেন্ট নেই, খেয়ে শুয়ে পড়েছে। আপনি কটার সময় মাসির বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলেন?

–ক’টা হবে, সাড়ে ছটা, সাতটা।

–তখন তো বৃষ্টি পড়ছিল।

–সেই রকম জোরে পড়েনি।

–আপনার কথাবার্তাতে কীরকম সন্দেহ হচ্ছে। গ্রামে রাতেরবেলা কেউ বের হয় না, তারপর ওই মন্দিরেও সন্ধেবেলা কেউ যায় না।

–স্যার পৃথিবীর সব কিছু কি অঙ্কের নিয়মে হয়?

কিছু সময় দুজনেই চুপ থাকল। বাইরে তখনও সমানে বৃষ্টি পড়ছে, কমবার কোনও লক্ষণই নেই। মাঝে মাঝে বিদ্যুতের ঝলক ঘরের ভিতরের অন্ধকারকে কাঁপিয়ে আরও অন্ধকার করে, অদৃশ্য হয়ে নিজে সেই আগন্তুককে আরও রহস্যের চাদরে ঢেকে দিচ্ছে।

–আমি আজকের রাতটা আপনার ঘরে থাকব।

নিঃশব্দ অন্ধকার ঠেলে কথাটা কানে যেতেই সুনন্দের গলাতেও বজ্রপাত হল– মানে?

–মানে, যেটা বললাম।

–ক্ষ্যাপা পেয়েছেন নাকি আমাকে?

–কাল সকালেই চলে যাব।

–শুনুন একা থাকি, তাতে আবার স্কুলটিচার, কেউ জানতে পারলে আমাকে পিটিয়ে পায়েস বানিয়ে দেবে, সঙ্গে উপরি পাওনা বদনাম। বাড়ি থেকেও বের করে দেবে।

–এই যে বললেন আপনি এখানে একা থাকেন, তাতে আপনাকে কে বের করবে?

– বাড়ির লোক জানতে কতক্ষণ।

–কে আছে বাড়িতে?

–মা, বউ, ছেলে।

–তার মানে আপনি বউকে ভয় পান।

– আপনি খুব বাজে বকছেন।

–কেউ কিছু জানতে পারবে না, আমি খুব ভোরেই বেরিয়ে যাব।

–যত ভোরেই বের হন, এটা হতে পারে না। এমনি ভাবে রাতে আপনাকে আমি থাকতে দিতে পারি না।

–আপনি এক কাজ করুন, বউয়ের ফোন নম্বরটা দিন। আমি সব জানিয়ে দিচ্ছি।

–আপনি তো আমাকে আচ্ছা ঝামেলাতে ফেললেন, এটা সম্ভব নয়। আপনি প্লিজ বোঝবার চেষ্টা করুন। দরজা খুলে দিচ্ছি আপনি বাইরে চলে যান। সুনন্দর গলার উষ্মা বাড়তে লাগল।

–আপনি আস্তে আস্তে কথা বলুন, সবাই চলে আসবে।

সুনন্দ একপা এগিয়ে দরজার ছিটকিনিটা খুলতে গিয়ে ডান হাতে আরেকটা নরম হাতের ছোঁয়া পেল, সেই সঙ্গে ডান কানে একটা ফিসফিস হাওয়া, ‘আমাকে বের করে দেবেন না প্লিজ।’

সুনন্দর সারা শরীর ঝন্ঝন্ করে উঠল। ছিটকিনি থেকে হাতটা সরিয়ে দরজার ডানদিকে পিঠ দিয়ে দাঁড়াতেই সামনের জন বলে উঠল, ‘এই মুহূর্তে আমি যদি বাইরে বাঁচাও বাঁচাও বলে চিৎকার করি, কী হবে বলুন তো?’

–মানে! কথাটা বলবার সময় সুনন্দ ঢোঁক গিলল।

–মানে কাল সকালের আগেই আপনার স্কুল, বাড়ি, সবাই জানতে পারবে আপনি…

–কিন্তু আমি তো আপনাকে কিছু করিনি।

–রাতটা থাকি। কাল আলো ফোটার আগে বেরিয়ে যাব, কেউ কিছু জানতে পারবে না, কথা দিলাম।

সুনন্দ একটা শ্বাস ফেললেও বৃষ্টির শব্দে নিজের জায়গায় ঢাকা পড়ে গেল। কিছু সময় চুপ থেকে বলল, ‘আপনি কিন্তু ভোর তিনটে সাড়ে তিনটের সময় বেরিয়ে যাবেন, এখানে চারটে সাড়ে চারটে নাগাদ সবাই উঠে পড়ে। কেউ দেখতে পেলে আমাকে সুইসাইড করতে হবে।

–আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন। আপনি আমার এত উপকার করলেন আর আমি এইটুকু করব না?

সুনন্দ সামনের দিকে এগোতেই মেয়েটি বলে উঠল, ‘আপনার ঘরে শাড়িটাড়ি তো নেই। আমার সালায়োরটা ভিজে জবজব করছে। এখানটাও ভিজে গেছে। এটা পড়ে থাকলে তো সমস্যা।

– লুঙ্গি চলবে ?

–লুঙ্গি! দারুণ। যাত্রাতে অনেকবার পরেছি। তাছাড়া র‍্যাপার তো পরি।

–তাহলে লুঙ্গি আর একটা শার্ট দিয়ে দিচ্ছি। তবে আর একটা সমস্যা হবে। আপনি এই ভিজে জামা কাপড়গুলো নিয়ে কী করবেন, এখানে তো রাখা যাবে না।

–না না এখানে রাখব কেন? চার পাঁচ ঘন্টাতে জল ঝরে যাবে, তারপর আমি পরে চলে যাব। সুনন্দ অন্ধকার হাতড়ে দেয়ালে ঝোলানো দড়ি থেকে লুঙ্গি আর শার্ট নিয়ে আগের মতোই অন্ধকার হাতড়ে এসে মেয়েটির হাতে দিয়ে বলল, ‘এই যে, সোজা আস্তে আস্তে হেঁটে বাথরুমে গিয়ে পোশাকটা ছেড়ে নিন।’

–অত দূর যাওয়া যাবে না। আপনার ঘরটা পুরো ভিজে যাবে। আমি এখানে চেঞ্জ করে নিচ্ছি, আপনি একটু দূরে দাঁড়ান।

–বাথরুমে গেলে ভালো হতো না?

–এখানেও খারাপ হবে না।

সুনন্দ সেই ছায়ানারীর কথামতো চেয়ারে বসল। অন্ধকারে ছায়ানারীর পোশাক বদলানো না- দেখতে পেলেও, বুঝতে পেরে চোখদুটো বন্ধ করে নিল। বন্ধ চোখেও মাঝে মাঝে ভালো দেখা যায়।

কিছু সময় পরে কানে এল, ‘ঘরে কিছু খাবার হবে?

কথাটা শুনে সুনন্দ চোখ খুললে সামনেটা আরও অন্ধকার হয়ে গেল।

কিছু বললেন?

–ঘুমিয়ে গেছিলেন?

না না, চোখ বন্ধ করে বসেছিলাম।

–ও! কিছু খাবার হবে?

–একটা রুটি আছে। মুড়ি হতে পারে। আর তো কিছু নেই।

–চিনি গুড় কিছু?

–চিনি আছে।

–ব্যস ব্যস। একটা রুটি চিনি মুড়ে দিয়ে দিন। প্লেট-ফেট দিতে হবে না।

–তা কি করে হয়, আমি প্লেটেই দিচ্ছি, আপনি ততক্ষণ ভিজে জামাটামাগুলো বাথরুমে মেলে দিয়ে আসুন। সোজা, আস্তে আস্তে হাঁটুন অসুবিধা হবে না। আমার টর্চটারও ব্যাটারি শেষ হয়ে গেছে।

–ভালোই হয়েছে, মাঝে মাঝে অন্ধকার ভালো।

কিছুসময় পর একটা জোরে শব্দ আর তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে উফ্ কথাটা শুনেই সুনন্দ ঘাড় ঘুরিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘কি হল, কোথায় ধাক্বা লাগল?’

–এই যে শক্ত মতন কিছুতে।

–বিছানা, একটু আস্তে আস্তে চলুন।

আগন্তুক বাথরুমে গেলে সুনন্দ একটা প্লেটে চারটে বিস্কুট, রুটি, চিনি নিয়ে বিছানাতে রেখে বলল, ‘এই বিছানাতে রাখলাম, খেয়ে নেবেন।’

আবার চেয়ারের জায়গায় ফিরে বসতেই বাথরুম থেকে ছায়ানারীর গলার আওয়াজ পেল, ‘বাথরুমে মেলব কোথায়?’

–একটা দড়ি আছে, দেয়ালের দিকে, সাবধানে দেয়াল ধরে ধরে যাবেন। চেয়ারে বসে থাকবার কিছুসময় পরেই কাঠের আলমারির উপর কিছু একটা পড়বার আওয়াজ পেয়ে চমকে উঠে বলল ‘কিছু ফেললেন নাকি?’

– এখানে ধাক্বা লাগল।

–আপনি ওদিকে গেছেন কেন, সোজা যেভাবে গেছিলেন সেভাবেই চলে আসুন। আস্তে আস্তে আসুন, বিছানাতে খাবার দেওয়া আছে।

চেয়ারে বসেই সুনন্দ পায়ের আওয়াজ এবং কিছুপরে বিছানার ক্যাঁচ ক্যাঁচ আওয়াজ পেল। কিছু সময় পরে মেয়েটি বলে উঠল, ‘আপনি বিস্কুটও দিয়েছেন, ভালো।’

সুনন্দের কানে চেবানোর আওয়াজ এল।

–আপনার বাড়িতে বউ মা আর ছেলে, বাঃ বেশ ছোটো পরিবার।

প্রথমবার কথাটার কোনও জবাব না পেয়ে আগন্তুক খেতে খেতেই বলে উঠল, ‘ঘুমিয়ে গেলেন?’

–আপনি তো ঘুমের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছেন।

–আপনি রেগে গেছেন?

–কী হবে আপনার এই সব জেনে?

–মাত্র তো কয়েক ঘন্টা, চাপ নেবেন না।

–আপনার খাওয়া হয়ে গেছে?

–হ্যাঁ।

–শুয়ে পডু়ন। আমি মশারি টাঙিয়ে দিচ্ছি।

–আপনি?

–আমার কথা অনেক ভেবেছেন, ঘুমোন।

–ছিঃ ছিঃ। তা কি করে হয়। তার থেকে আপনি ঘুমোন আমি বসে থাকি। আমার রাত জাগা অভ্যাস আছে।

–বিছানাতে শুলে আমি আর উঠতে পারব না। ভোরে আপনাকে ডাকতেও পারব না। ।

–বাঃ বাঃ আপনি সেই একই কথা ভাবছেন। আমি তো আপনাকে কথা দিয়েছি।

–ঠিক আছে আপনি শুয়ে পড়ুন।

–আমি কি এই বিছানাতে শোবো?

–তাছাড়া, মাটিতে শুতে পারবেন না, জায়গাও নেই।

কিছুসময় দুজনেই চুপচাপ। বাইরে বৃষ্টির সাথে ঝড় উঠেছে। মাঝে মাঝে বিদ্যুতের আলো। ঘরের ভিতর দুজন অচেনা অল্প জানা মানুষদের একে অপরের কাছে কিছুসময়ের জন্য দৃশ্যমান করেই আবার নিজেকে লুকিয়ে দিচ্ছে।

–শুনুন না, আমার খুব খারাপ লাগছে, আপনি এইভাবে সারারাত বসে থাকবেন, আর আমি শুয়ে থাকব। তার থেকে আপনি শুয়ে পড়ুন।

–অনেক জ্বালিয়েছেন এবার একটু ক্ষ্যামা দিয়ে শান্তিতে বসতে দিন। রাতে ঘরে ঢুকেছেন, খেতে পেয়েছেন, শুতে পেয়েছেন, এবার ঘুমোন। আমাকে শুধু চাদরটা বের করে দিন। বালিশের নীচে পাবেন।

চাদর ঢাকা নিয়ে পাদুটো সোজা করে বসতে সুনন্দ স্পষ্ট বুঝতে পারল আগন্তুক শুয়ে পড়েছে।

সুনন্দ চোখ দুটো বন্ধ করে নিল। এই অন্ধকার বৃষ্টির রাতে ঝুমা থাকলে অন্যরকম সমীকরণ তৈরি হতো। সুনন্দ চারদিকটা আরেকবার দেখে নিল। ছায়ানারী শুয়ে আছে। সুনন্দের শরীরের অনেক অঙ্ক, অসমীকরণ ঝাঁপাঝাঁপি আরম্ভ করলেও উত্তর নেই, পাতা উলটে সমাধান করবার উপায় নেই। এক একটা দিনের উচ্চতা, দূরত্ব বাকি সব দিন বা রাতের সূচক ছাড়িয়ে যায়। উত্তর মেলে না, শুধু পাতার পর পাতা ব্যর্থ কষা। সমীকরণ, অসমীকরণের গ্রাফ, লগ, বা পাটিগণিতে শরীর নষ্ট হয়, পায়জামা, লুঙ্গি ভিজে দাগ হলেও শুধু জয় জগন্নাথ বলে রণে ভঙ্গ দেওয়ার অঙ্ক শিখে নেওয়ার মধ্যেই তো সব গ্রাফ, সব জটিল বিষয়ের মিল!

–মাস্টারদা, ও মাস্টারদা।

বাইরের আওয়াজে থতমত খেয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল সুনন্দ। ঘরের ভিতরে সব আলো জ্বলছে। মশারিটা এখনও খাটানো রয়েছে। তার মানে গতরাতের মেয়েটা এখনও শুয়ে আছে। মাথার ভিতরটা দপ্দপ্ করতে লাগল। জীবন, জীবিকা সবের বারাটো বেজে যাবে। তাড়াতাড়ি রান্নাঘর থেকে দুধের বাটি নিয়ে দরজার কাছে আসতেই জলে হালকা পিছলে গেলেও সামলে নিয়ে, ছিটকিনি খুলে ডান হাতটা বের করে দুধ নিল।

–কি ব্যাপার মাস্টারদা, আজ এত ঘুম, কখন থেকে ডাকছি।

–কাল সারারাত কারেন্ট ছিল না, ঘুম হয়নি, ভোরে ঘুমিয়ে গেছি।

বেশি কথা আর না বাড়িয়ে দরজায় ছিটকিনিটা লাগিয়ে দিল। মেয়েটা কথা রাখল না। বলেছিল ভোরে চলে যাবে। এবার কী হবে? সুনন্দ মশারির কাছে আসতেই দেখল বিছানা ফাঁকা। মেয়েটা? বাথরুমে!

সুনন্দ বাথরুমের কাছে এসে দরজায় টোকা দেওয়ার জন্য হাত বাড়াল। কিন্তু টোকা দিতেই দরজা খুলে গেল। তাহলে মেয়েটা!

চোখ পড়ল বাথরুমের দেয়ালের টাঙানো দড়িটাতে, ওই তো, লুঙ্গি, শার্ট।

তাহলে মেয়েটা! চলে গেল? না, তাহলে তো দরজার ছিটকিনিটা ভিতর থেকে দেওয়া থাকত না। কেমন পাগল পাগল লাগছে নিজেকে। মেয়েটা তো গতকাল রাতে ঘরে এসেছিল, অন্ধকার হলেও সুনন্দ এতটা ভুল দেখেনি।

সুনন্দ রুটির জায়গাটা খুলল, কী আশ্চর্য এই তো রুটিটা আছে। কিন্তু কাল রাতে নিজে একটা প্লেটে মেয়েটাকে রুটিটা দিয়েছিল, তাহলে!

মশারিটা তাড়াতাড়িতে খুলতে গিয়ে দুটো দড়ি ছিঁড়ে ফেলল। দলা পাকিয়ে একপাশে সরিয়ে রেখে বিছানাতে হাত দিল। এই তো পায়ের দিকটা ভিজে। বালিশটাও সাঁতস্যাত করছে। চাদরটা কুঁচকে আছে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে কেউ শুয়ে ছিল।

সুনন্দর শরীরে একটা অসমীকরণের স্রোত বইতে আরম্ভ করলেও, এবারেও কোনও সমাধান বা উত্তর মেলাতে পারল না। বালিশটা সরাতে একটা ভাঁজ করা ছোটো কাগজ দেখতে পেল। হাতে নিয়ে খুলতেই বুঝল বাসের টিকিট। ভাড়ার টাকা কিছু না লেখা থাকলেও টিকিটের নীচের দিকে ধন্যবাদ লেখাটাতে চোখদুটো আটকে গেল।

 

আলোয় ফেরা

‘মিত্রা, তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নাও। এখুনি বেরোতে হবে। একটা ফ্ল্যাটের সন্ধান দিল এজেন্ট। এখন না গেলে যার ফ্ল্যাট সে চলে যাবে’, শংকর তাড়া লাগাল বউকে।

আজ এক সপ্তাহ হল শংকর আর মিত্রা বেঙ্গালুরু থেকে দিল্লি এসে হোটেলে উঠেছে। শংকর বেঙ্গালুরুর চাকরি ছেড়ে আরও ভালো প্যাকেজ পেয়ে দিল্লি এসেছে। বরের সঙ্গে থাকবে বলে মিত্রা ওখানকার চাকরিটা ছেড়ে দিয়েছে। ও জানে এখানে সেটল করে ঠিক একটা চাকরি ও জোগাড় করে নেবে। বেঙ্গালুরুর ফার্নিশড ফ্ল্যাটটাও ওরা আসার সময় ছেড়ে দিয়ে এসেছে। ওরা ঠিকই করে রেখেছে নিজস্ব ফ্ল্যাট না হওয়া পর্যন্ত ফার্নিশড ফ্ল্যাট-ই ভাড়া নিয়ে থাকবে। এতে সুবিধা হচ্ছে, গুচ্ছের জিনিসপত্র কিনে টানা-হ্যাঁচড়ার কোনও প্রশ্ন নেই। শুধু নিজেদের ব্যবহার্য জামাকাপড় এবং দৈনন্দিন কিছু জিনিস ছাড়া শিফটিংয়ের সময় গুচ্ছের জিনিস বইতে হয় না। সুতরাং দিল্লিতে আসা থেকে ওরা নতুন ফ্ল্যাটের সন্ধানে রয়েছে। কয়েকটা দেখেওছে কিন্তু কোনওটাই ফার্নিশড ছিল না। হোটেলে থাকতেও ওদের আর ভালো লাগছিল না।

নতুন ফ্ল্যাটটা দেখেই দুজনেরই পছন্দ হয়ে গেল। নতুন ফার্নিচারে সাজানো দুটো বেডরুম, ড্রয়িং কাম ডাইনিং, ঝকঝকে মডার্ন কিচেন, বাথরুম– সবই প্রশংসার যোগ্য কিন্তু মিত্রার সবথেকে পছন্দ হল ফ্ল্যাটের সঙ্গে লাগোয়া সার্ভেন্ট কোয়ার্টারটা দেখে। বাড়িওয়ালা জানালেন, ওই সোসাইটিতে প্রত্যেকটি ফ্ল্যাটের সঙ্গে একটি করে সার্ভেন্ট কোয়ার্টার আছে। তাতে একটি রুম সঙ্গে লাগোয়া বাথরুম এবং রান্নাঘর। কোয়ার্টারে ঢোকার রাস্তাও আলাদা।

ফ্ল্যাটে যে কাজ করবে সে পরিবারের সঙ্গে ওখানে থাকতে পারবে পরিবর্তে কম টাকায় তাকে ওই ফ্ল্যাটের সব কাজ করতে হবে। এটাই নাকী ওই সোসাইটির নিয়ম। যারা এই শর্তে কাজ করতে ইচ্ছুক তারা সিকিউরিটি গার্ডের কাছে নিজেদের মোবাইল নম্বর দিয়ে রেখেছে সুতরাং যোগাযোগ করতে হলে সিকিউরিটি গার্ডের সঙ্গে কথা বলতে হবে।

সব দেখেশুনে সঙ্গে সঙ্গে হ্যাঁ করে দিল শংকর। মিত্রার মুখ দেখে বুঝতে পারছিল ওরও খুব পছন্দ হয়েছে পুরো ব্যবস্থা। টাকা দিতে যাওয়ার একটা দিন ধার্য করে ওরা স্বামী-স্ত্রী বেরিয়ে এল সোসাইটি থেকে। মিত্রা আনন্দ চেপে রাখতে পারল না। বাইরে পা দিয়েই বলল, ‘আমার দারুণ পছন্দ হয়েছে ফ্ল্যাটটা, বিশেষ করে সার্ভেন্ট কোয়ার্টার থাকায় চাকরি করাটা খুব সুবিধা হবে তাই না?’

ছোট্ট একটা ‘হ্যাঁ’ বলেই শংকর চুপ করল।

‘এখানে শিফট করেই একজন কাজের লোক রেখে নেব। তাহলে অফিস জয়েন যখন করব কোনও চিন্তা থাকবে না আর অফিস থেকে ফিরেও রান্না করার ঝামেলায় পড়তে হবে না’, মিত্রা আনন্দ কিছুতেই চাপতে পারে না।

তিন দিনের মাথায় শংকর আর মিত্রা নতুন ফ্ল্যাটে শিফট করল। মিত্রা এসেই সিকিউরিটি গার্ডের সঙ্গে কথা বলে চার-পাঁচজন পরিচারিকার নম্বর নিজের মোবাইলে সেভ করে রাখল, সময় করে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করবে বলে।

একটু গুছিয়ে বসতেই মিত্রা কাজের লোক খুঁজতে লেগে পড়ল। দুটো তিনটে ফোন করার পর একজনকে পছন্দ হল কিন্তু তার এক মাসের বাচ্চা আছে শুনে পিছিয়ে গেল আবার। অতটুকু বাচ্চা নিয়ে পুরো বাড়ি কীভাবে মেয়েটি সামাল দেবে ভেবে পেল না মিত্রা। অগত্যা তাকেও না করতে হল।

শংকর অফিসের জন্য তৈরি হচ্ছে দেখে মিত্রা রান্নাঘরে ঢুকল। মনটা পড়ে রইল কাজের লোকের চিন্তায়। কী জানি কটা দিন আর অপেক্ষা করতে হবে? আনমনা হয়েই দরজা অবধি এগিয়ে গেল মিত্রা, শংকরকে সিঅফ করতে। দরজা বন্ধ করে সোফায় এসে বসল। এখনও ঘরদোর পরিষ্কার করা হয়নি। মনে মনে কাজের একটা লিস্ট ছকে নেয় ও। সিকিউরিটি গার্ডের কাছ থেকে আরও কটা নম্বর জোগাড় করে নিয়ে আসতে হবে। সুতরাং দেরি না করে সোফা ছেড়ে উঠে পড়ে। তক্ষুনি ডোর বেলটা বেজে ওঠে। মিত্রা দরজার দিকে এগোয়। দরজা খুলতেই দ্যাখে সামনে দাঁড়িয়ে মাঝবয়সি একটি মহিলা। বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। সুতির ছাপা একটি শাড়ি পরনে। গায়ের রং শ্যামলা এবং ছিপছিপে শরীর।

মিত্রাকে দেখে মহিলাটি হাত তুলে নমস্কার জানাল। কিছু জিজ্ঞাসা করার আগেই মিত্রার জিজ্ঞাসু এবং উৎসুক মুখ দেখে মহিলাটি বলল, ‘ম্যাডাম, আমার নাম শ্যামা। থাকার জন্য আমার ঘরের খুব দরকার। আপনি লোক খুঁজছেন কাজের জন্য। আমি এখানে কাজ করতে রাজি আছি। আমার স্বামী তিনবছর আগে মারা গেছে, দুটো মেয়ে আছে। মেয়েদের বিয়ে হয়ে গেছে। পাশেই বস্তিতে একটা ঘর ভাড়া নিয়ে থাকি। আগে অনেক বাড়িতে ঘুরে ঘুরে কাজ করতাম কিন্তু এখন আর পারি না। এখন একটা বাড়িতে থেকে সেখানেই রাত-দিনের কাজ করতে চাই। এটুকু বলতে পারি আমাকে নিয়ে বা আমার কাজ নিয়ে আপনাকে নালিশ করতে হবে না। সারাদিন পরিশ্রম করতে আমার কোনও অসুবিধা নেই।’

মহিলাটির কথাবার্তা শুনে, মিত্রার মহিলাটিকে ভালোই মনে হল, তবে কয়েকটা প্রশ্ন আগে থেকে জিজ্ঞেস করে নেওয়াটা উচিত মনে হল মিত্রার। জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি কি জানো, এখানে সার্ভেন্ট কোয়ার্টারে থাকতে হলে, তোমাকে কম টাকায় বাড়ির কাজ করতে হবে? তাহলে তোমার মাসে চলবে কী করে?’

‘সে চিন্তা নেই ম্যাডাম। ছয় মাস বাদে বাদে গ্রাম থেকে আমার চাল, ডাল গম সব আসে। গ্রামে আমাদের জমিজমা কিছু আছে। এছাড়া আমার দুই জামাইও খুব ভালো। টাকাপয়সা দিয়ে ওরা সবসময় আমাকে সাহায্য করে। আমার শুধু থাকার জন্য ঘরের খুব দরকার।’

‘ঠিক আছে, তুমি কবে থেকে আসতে পারবে? মিত্রা জিজ্ঞেস করল।’

‘ম্যাডাম, কাল বাদে পরশু সকালেই আমি জিনিসপত্র নিয়ে চলে আসব’, বলে শ্যামা চলে গেল। মিত্রাও দরজা বন্ধ করে ভিতরে আসতে আসতে অনেকটা হালকা বোধ করল। মহিলাটি একাই থাকবে সুতরাং ওর নিজের ঝামেলা খুব একটা থাকবে না, ফলে মিত্রার সংসারে ও ভালোমতোই সময় দিতে পারবে। শংকরকে ফোন করে সুখবরটা দিতে হবে ভেবে মিত্রা মুঠোফোনটা হাতে তুলে নিল।

একদিন পরই শ্যামা নিজের জিনিসপত্র নিয়ে মিত্রার কাছে হাজির হল। মিত্রা সার্ভেন্ট কোয়ার্টারের চাবি খুলে দিয়ে শ্যামার হাতে চাবিটা ধরিয়ে দিল। হাতমুখ ধুয়ে জিনিসপত্র রেখে শ্যামা মিত্রার ফ্ল্যাটে চলে এল এবং বাড়ির সব কাজ বুঝে নিল। শ্যামার গোছালো কাজ দেখে মিত্রা নিশ্চিন্ত বোধ করল এবং নিজের চাকরির জন্য খোঁজখবর নিতে শুরু করে দিল। দেখতে দেখতে একটা মাসের মধ্যে তিনটে ইন্টারভিউ দেওয়া হয়ে গেল মিত্রার। মাস কাটতেই হঠাৎই শ্যামার ব্যবহারে কিছু অসংগতি মিত্রার চোখে ধরা পড়তে আরম্ভ করল।

গ্রামের থেকে চাল, ডাল, গম আসে, শ্যামার কাছে এই গল্প প্রথমে বিশ্বাসই করেছিল মিত্রা। কিন্তু রোজ রোজ যখন জিনিস চাওয়া আরম্ভ করল শ্যামা তখনই মিত্রার সন্দেহ হওয়া শুরু হয়। ধীরে ধীরে সাহস বাড়তে থাকে শ্যামার। মিত্রাকে কিছু না জানিয়েই রান্নাঘর থেকে চাল, আটা, ডাল, ফ্রিজ থেকে দুধ, সবজি নিয়ে যেতে আরম্ভ করল ও।

একদিন মিত্রা এই নিয়ে একটু চ্যাঁচামেচি করতেই শ্যামাও গলার জোর বাড়াল, ‘আমি কি চুরি করেছি নাকি? আপনার সামনেই তো বার করেছি। এখানে কাজ করছি আর গ্রাম থেকেও এখনও কেউ চাল, ডাল দিতে আসেনি। এই অবস্থায় আপনার থেকে নেব না তো আর কোথায় যাব?’

মিত্রা রাগের মাথায় আর কিছু না বলে চুপ করে গেল।

কিন্তু ধীরে ধীরে শ্যামার চাহিদা বাড়তে আরম্ভ করল। কখনও বিছানায় পাতার জন্য চাদর চেয়ে বসে আবার কখনও কোথাও যাওয়ার দরকার হলে মিত্রার থেকে শাড়ি চেয়ে বসে। শুধু চাওয়া নয়, প্রতিটা কথায় মিত্রার আচার আচরণ নিয়ে টিটকিরি দেওয়া শুরু করে দিল। কখনও মিত্রা সিঁদুর পরে না বলে কথা শোনাত তো কখনও বাড়িতে পুজোপাঠ করে না বলে তাচ্ছিল্য করা শুরু করে দিল। অথচ কাজের কথা মিত্রা কিছু বললে, না-শোনার ভান করত। টাকাপয়সাও মাঝেমধ্যেই চাওয়া শুরু করল। মিত্রা দিতে না চাইলে মেজাজ দেখিয়ে ফ্ল্যাট ছেড়ে চলে যেত শ্যামা। মিত্রার কাছে সব শুনে শংকর ওকে ছাড়িয়ে দেওয়ার কথা বললেও মিত্রা কিছুতেই মনস্থির করতে পারছিল না শ্যামাকে নিয়ে ও কী করবে।

একদিন ফোনে যখন ব্যস্ত মিত্রা, ডোরবেল বেজে ওঠে। শ্যামাকে ডেকে দরজাটা খুলে কে এসেছে দেখতে বলে মিত্রা। ঝনঝন করে রান্নাঘর থেকে বাসন পড়ার শব্দ পায়। মিত্রা বুঝতে পারে দরজা খুলতে বলায় শ্যামা রেগে বেসিনে বাসন ছুঁড়ে দিয়ে দরজা খুলতে গেছে। বিরক্ত বোধ করে মিত্রা। সঙ্গে সঙ্গেই একটা প্যাকেট হাতে করে নিয়ে উপস্থিত হয় শ্যামা। ‘নিন, ধরুন, দরজাটা আপনিও তো খুলে দিতে পারতেন… এই ভাবে কাজই তো শেষ করতে পারব না… সারাদিনটা কি এখানেই কাটাব আমি?’

রাগ সামলে প্যাকেট খোলায় মন দেয় মিত্রা। অনলাইনে বুক করা নতুন জুতোটা পাঠিয়েছে। প্যাকেট খুলতেই নতুন জুতো দেখে শ্যামা চুপ থাকতে পারে না, ‘বাবাঃ, শু-র‍্যাক-টা তো আগে থেকেই উপচে পড়ছে, আবার একটা জুতো কিনলেন? একেবারে বাজে খরচা। এর জন্য আপনাদের কাছে টাকা রয়েছে আর আমরা গরিব মানুষরা একটা জিনিস নিলেই আপনাদের মাথা খারাপ হয়ে যায়।’

শ্যামার স্পর্ধা দেখে মিত্রা অবাক হয়ে গেল। কয়েক মাসের মধ্যে শ্যামার চরিত্রের এই পরিবর্তন মিত্রার মাথায় আগুন ধরিয়ে দিল। মুহূর্তের মধ্যে মিত্রা, শ্যামাকে কাজ থেকে বরখাস্ত করে দিল আর চার ঘণ্টা সময় দিল কোয়ার্টার ছেড়ে দেবার জন্য।

শ্যামাও রাগ দেখাতে ছাড়ল না, ‘দরকার নেই আমার এরকম কাজের। আমি মেয়ে জামাইয়ের কাছে আরামে থাকব… লোক রেখে দেখুনই না… বুঝতে পারবেন’, বলে দুড়দাড় করে কোয়ার্টারে ঢুকে গেল। খানিক্ষণ পরেই মেয়ে, জামাই এসে শ্যামাকে নিয়ে গেল। যাওয়ার সময় মিত্রা, কোয়ার্টারের চাবিটা ওদের কাছ থেকে চেয়ে নিল।

রাগের মাথায় শ্যামাকে ছাড়িয়ে দিয়ে আর এতগুলো কথা বলে বড়ো ক্লান্ত অনুভব করছিল মিত্রা। বাড়ির পড়ে থাকা সমস্ত কাজ সেরে মিত্রা একটু গড়িয়ে নিতে বিছানায় এসে বসে। ক্লান্ত শরীরে কখন যে চোখ বুজে এসেছিল ও নিজেও বুঝতে পারেনি। দরজায় ধাক্বা শুনে ঘুমটা ভাঙে ওর। বাইরেটা বেশ অন্ধকার হয়ে এসেছে। শংকরের ফেরার সময় তো এখনও হয়নি। তবে কে এল এই অসময়ে? উঠতে ইচ্ছে করছিল না, জোর করে উঠল।

দরজা খুলে দেখল তেইশ-চব্বিশ বছরের একজন যুবতি মেয়ে। দেখে মনে হচ্ছিল নতুন বিয়ে হয়েছে বেশ হাসি মুখ। পাশেই দাঁড়িয়ে একটি যুবক। মিত্রার মনে হল মেয়েটির স্বামী নিশ্চয়ই।

‘দিদি, আমার নাম সীমা, এ হল রানা… আমার… আমি কাজের জন্য এসেছি।’

ছেলেটি হাতজোড় করে মিত্রাকে নমস্কার জানাল। দুজনের মুখের উপর একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে মিত্রা জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি কী করে জানলে আমি কাজের জন্য লোক খুঁজছি? আমার লোক তো আজ সকালেই ছেড়ে গেছে। আমি তো এখনও কাউকে কিছু জানাইনি পর্যন্ত’, কথা শেষ করে মিত্রা দুজনকে ভিতরে এসে কথা বলার জন্য ইশারা করল। দুজনে ভিতরে এসে দরজার গা ঘেঁষে দাঁড়াল।

‘দিদি, আপনার কাছে আমার পিসি এতদিন কাজ করছিল। আজকে রেগে গিয়ে আপনাকে কী বলেছে জানি না কিন্তু বাড়ি গিয়ে নিজেকেই দোষারোপ করছিল। পিসি খুব ভালো করেই জানে ওকে আপনি আর কাজে নেবেন না তাই আমাকে এখানে কাজের কথা বলল’ সীমা মিত্রার উত্তরের অপেক্ষা করতে লাগল।

‘ও… তাই বলো! তোমাকে তাহলে শ্যামা আমার কাছে পাঠিয়েছে? তুমি পারবে সব কাজকর্ম ঠিক করে করতে?’ মেয়েটির ব্যবহার মিত্রার ঠিকই মনে হল অগত্যা মেয়েটিকে কাজে বহাল করার কথা ঠিক করে নিল মিত্রা।

‘দিদি, আমি এই হাউজিং-এ আমার ভাসুর-জায়ের সঙ্গে সার্ভেন্টস কোয়ার্টারে থাকি, বাইরের একটা কাজও করি… কিন্তু দিদি থাকার খুব অসুবিধে হচ্ছে। আমার জায়ের দুটো বাচ্চা সঙ্গে আবার আমরা দুজন। একটা ঘরে গাদাগাদি করে কোনওমতে থাকা। এখানে আপনার কাছে কাজ করলে থাকার অসুবিধে থাকবে না। এবার যদি আপনি আমাকে রাখেন।’

সীমাকে রাখার সিদ্ধান্ত আগেই মনে মনে নিয়ে নিয়েছিল মিত্রা। সুতরাং মুখে বলল ‘ঠিক আছে, তোমরা তাহলে চলে এসো। যখন আসবে চাবিটা আমার কাছ থেকে চেয়ে নিও।’

রাত্তিরেই একটা খাট আর কিছু জামাকাপড় নিয়ে সীমা, রানার সঙ্গে মিত্রার সার্ভেন্টস কোয়ার্টারে চলে এল।

পরের দিন সকালেই রানা নিজের কাজে চলে গেলে সীমা মিত্রাদের ফ্ল্যাটে চলে এল। মিত্রার কাছ থেকে সব কাজ বুঝে নিয়ে মিত্রাকে জোর করে বসিয়ে দিল, ‘দিদি, আপনি বসে থাকুন, আমি সব কাজ করে দেব। যদি মনে হয় কাজটা ঠিকমতো হয়নি তাহলে আমাকে ডেকে শুধু বলে দেবেন।’

রবিবার সাধারণত সীমা, অর্ধেক দিনের ছুটি চেয়ে নিত মিত্রার কাছে। দুপুরে কাজ সেরে বরের সঙ্গে কোথাও না কোথাও বেড়াতে যেত ও। কখনও সিনেমা দেখতে, কখনও এমনি ঘুরতে অথবা আত্মীয়স্বজনদের বাড়িও যেত ওরা। কখনও কখনও বেরোত যখন, মিত্রার চোখেও পড়ত। সীমার সাজগোজ দেখে মিত্রার একটু অবাকই লাগত কারণ ইমিটেশন গয়না থেকে মেক-আপ, পোশাক-আশাক কিছুতেই কোনও খামতি ওর চোখে পড়ত না। এত সব করার টাকা কোথা থেকে আসে বুঝতে পারত না মিত্রা।

মিত্রা যখনই এ বিষয়ে সীমার সঙ্গে কথা বলত, একই উত্তর শুনত, ‘দিদি, আমাদের নতুন বিয়ে হয়েছে… ও সেজেগুজে থাকা খুব পছন্দ করে। সাজগোজের বেশিরভাগ জিনিসই তো ওই কিনে আনে।’

বেশি মাথা ঘামায়নি মিত্রা এই নিয়ে। এটা ওদের ব্যক্তিগত জীবন, যতক্ষণ বাড়ির কাজ ঠিকমতো হয়ে যাচ্ছে এইসব ব্যাপারে মাথা ঘামাবার কোনও কারণ নেই মিত্রার। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চাকরি খুঁজে জয়েন করাটাই মিত্রার লক্ষ্য। এই নিয়েই আপাতত ও ব্যস্ত থাকতে চায়।

ল্যাপটপ-টা খুলে মেলগুলো চেক করতে বসে মিত্রা। হতাশ হয়, কোনও মেল ঢোকেনি দেখে। কী করবে ভেবে না পেয়ে অনলাইন শপিং সাইটগুলো একটার পর একটা দেখতে শুরু করে। অবসাদ কাটাবার একমাত্র উপায় শপিং, সুতরাং তাতেই মনোযোগ দেওয়ার চেষ্টা করে সে। হঠাৎ চোখ আটকায় একটা কুর্তা দেখে। কিনলে বেশ খানিকটা রিবেট পাওয়া যাবে দেখে প্লাস্টিক কার্ডটা নেওয়ার জন্য উঠে দাঁড়ায়। মনে করার চেষ্টা করে পার্সটা কোথায় রেখেছে। খেয়াল হয় কাল থেকে ড্রয়িংরুমের টিভির পাশেই পড়ে রয়েছে পার্সটা। তাড়াতাড়ি ড্রয়িংরুমের দিকে পা বাড়ায়। কিন্তু ঘরে ঢুকেই যে দৃশ্য চোখে পড়ে, তা দেখে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে মিত্রা। সীমা সোফায় গা এলিয়ে বসে মিত্রার পার্সটা নিয়েই ঘাঁটাঘাঁটি করছে। সীমার পিঠ মিত্রার দিকে থাকায় ও মিত্রাকে দেখতে পায়নি। মিত্রা সোফা অবধি পৌঁছোতে পৌঁছোতে সীমা পার্স থেকে টাকা বার করে ব্লাউজের ভিতর ঢুকিয়ে নেয়। মিত্রাও বিন্দুমাত্র শব্দ না করে পিছন থেকে সীমার হাতটা ধরে ফেলে। চুরি করতে গিয়ে হাতেনাতে ধরা পড়াতে সীমা ঘাবড়ে যায়।

‘দিদি, তুমি!’ মিত্রার মুখ-চোখ দেখে সীমা তোতলাতে থাকে, ‘আমা…কে ক্ষমা করে দাও। আমি কখনও চুরি করি না… আজ শরীরটা ঠিক নেই তাই ডাক্তার দেখাতে যাব… টাকার দরকার ছিল, তাই এই টাকাটা… আর কখনও হবে না দিদি’। ব্লাউজের ভিতর থেকে পাঁচশোর নোটটা বার করতে করতে সীমা বলে।

‘তোমার শরীর খারাপ? কিন্তু সকাল থেকে তো দেখে কিছু মনে হয়নি, বরং আনন্দেই আছ বলে মনে হচ্ছিল। এখন বুঝতে পারছি বাথরুম থেকে শ্যাম্পু, কন্ডিশনার কীভাবে এত তাড়াতাড়ি শেষ হচ্ছে? কয়েকটা লিপস্টিকও আমি খুঁজে পাচ্ছি না। তারপর তো আরও আছে, মাঝেমধ্যেই কাজ করতে করতে কোয়ার্টারে চলে যাও… এখন বুঝতে পারছি যাওয়ার কারণ। আমি আর কিছু জানতে চাই না। তোমাকে আর কাজ করতে হবে না। যত তাড়াতাড়ি পারো কোয়ার্টার খালি করে দাও’, রাগে আর কথা বলতে পারে না মিত্রা। ইচ্ছে হয় এখুনি পুলিশ ডেকে সীমাকে ওদের হাতে তুলে দিতে।

সন্ধেবেলায় শংকর বাড়ি ফেরার পরেই সীমা এসে কোয়ার্টারের চাবি মিত্রাকে ধরিয়ে গেল। চুপচাপ স্বামী-স্ত্রী জিনিসপত্র নিয়ে বেরিয়ে যায়।

আবার সেই কাজের লোকের সমস্যা। মিত্রা মুষড়ে পড়ল তবুও প্রতিজ্ঞা করল এবার আর কোনওরকম তাড়াহুড়ো করবে না। দেখেশুনে তবেই বাড়িতে কাজের লোক ঢোকাবে। সিকিউরিটি গার্ডকেও ফোন করে একটু চেনাশোনা লোকের খোঁজ করতে অনুরোধ করল।

রবিবার শংকরের অফিস ছুটি, ফলে উঠতে একটু দেরিই হয়েছে। মুখ ধুয়ে চা বানিয়ে মিত্রা শোবার ঘরে ঢোকে। শংকর তখনও বিছানা ছাড়েনি। বেডসাইড টেবিলে চায়ের ট্রে টা নামিয়ে বিছানায় গুছিয়ে বসে মিত্রা। কাপটা এগিয়ে দেয় শংকরের দিকে। এই একটা দিনই শংকরের সঙ্গে বেশ কিছুটা সময় কাটাতে পারে মিত্রা। নয়তো রোজই তো সকালে উঠেই অফিস যাওয়ার তাড়া। আর প্রাইভেট চাকরিতে ফেরার কোনও ঠিক নেই।

সবে গল্প করতে করতে চায়ের কাপটা শেষ করেছে, এমন সময় কলিং বেলটা কারও আসার বার্তা জানায়। এই সময় কে রে বাবা! অজান্তেই ঘড়ির দিকে চোখটা চলে যায় মিত্রার। সবে আটটা বাজছে।

বিরক্ত হয়েই বিছানা ছেড়ে দরজার দিকে পা বাড়ায় ও। হয়তো সিকিউরিটি গার্ড কাউকে পাঠিয়েছে সকাল সকাল, ভেবে খানিকটা স্বস্তি অনুভব করে মিত্রা।

দরজা খুলতেই দ্যাখে সামনে দাঁড়িয়ে পঁয়ষট্টি-সত্তর বছর বয়সি বৃদ্ধ দম্পতি। সঙ্গে রয়েছে ছোটোখাটো চেহারার কুড়ি-একুশ বছরের একটি যুবতি।

মিত্রাকে দেখতেই বৃদ্ধটি হাতজোড় করে বলে, ‘ম্যাডাম, আমি রিটায়ার্ড সরকারি চাপরাশি। বহুদিন ধরে কৈলাশ কলোনিতে একটি ফ্যামিলির সঙ্গে রয়েছি। আমার বউ আগে ওখানে কাজ করত এখন বয়স হয়ে যাওয়াতে আমার এই নাতনি ওদের সব কাজ করে।’

‘আচ্ছা এটি আপনার নাতনি?’ মিত্রা প্রশ্ন করে।

‘হ্যাঁ ম্যাডাম। আমরা ওই সাহেবের বাড়ির সার্ভেন্টস কোয়ার্টারে এতদিন ধরে রয়েছি। এই মাসে ওই সাহেব দিল্লির বাইরে বদলি হয়ে যাচ্ছেন। সুতরাং আমাদেরও কোয়ার্টার ছাড়তে হবে। শহরে বাড়িভাড়া নিয়ে থাকার ক্ষমতা নেই আমাদের। আমার পেনশনে সংসারটা চলে কোনওরকমে। তাই এখানে কোয়ার্টার পাওয়া যাবে শুনেই আমি এসেছি।’

‘আপনাদের ছেলে, ছেলের বউ কোথায় থাকে? নাতনি তো দেখছি আপনাদের সঙ্গেই থাকে।’

‘ম্যাডাম, আমাদের ভাগ্যের কথা আর বলবেন না। মেয়েটির জন্মের সময়ই ওর মা মারা যায়। কয়েক বছর বাদেই মাত্র কয়েকদিনের জ্বরে আমার ছেলে…’ বলতে বলতে বৃদ্ধের গলা

ধরে আসে।

‘আপনাদের নাম কী’, মিত্রা জানতে চায়।

‘আমার নাম রতন আর আমার স্ত্রী সারদা। নাতনির নাম ওর বাবাই রেখেছিল রেশমি।’

‘একটু দাঁড়ান, আমি আসছি’, বলে মিত্রা শোবার ঘরে এসে ঢোকে। শংকর ততক্ষণে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়েছে। শংকরকে রতনের সম্পর্কে সব বলে মিত্রা। দুজনেরই মনে হয় ওদের সার্ভেন্ট কোয়ার্টারে রাখলে কোনওরকম অসুবিধায় পড়তে হবে না। বৃদ্ধের কথায় মিত্রা বুঝে গিয়েছিল রেশমিই ওর কাছে কাজ করবে। সুতরাং বাইরে এসে মিত্রা ওদের জানিয়ে দেয়, ওদের কাজে বহাল করতে ও রাজি।

সন্ধের আগেই রতন, স্ত্রী এবং নাতনিকে নিয়ে মিত্রার কাছে হাজির হল। মিত্রা কোয়ার্টারের দরজা খুলে দিয়ে ওদের সবকিছু বুঝিয়ে দিল। মিত্রার মনেও সামান্য আশার সঞ্চার হল, ওর মনে হল এবারটা শ্চিয়ই ওর কাজের লোকের ভাগ্য সুপ্রসন্ন হবে।

পরের দিন দরজা খুলতেই সকালে, মিত্রা দেখে রতন আর সারদা দরজায় দাঁড়িয়ে। কী ব্যাপার জিজ্ঞেস করতেই রতন জানায়, ‘ম্যাডাম, রেশমির জ্বর এসেছে। ওর বদলে আমরা দুজন মিলে কয়েকদিন আপনার কাজ করে দেব।’

বয়স্ক মানুষকে দিয়ে কাজ করাতে মিত্রার খুবই খারাপ লাগছিল কিন্তু ওর কাছে কোনও উপায়ও ছিল না। ওদের কাজটাও ঠিক পছন্দ হচ্ছিল না মিত্রার।

দু সপ্তাহ কেটে যাওয়ার পরেও যখন রেশমি কাজ করতে এল না, মিত্রার সন্দেহ হতে লাগল, ওরা মিথ্যা কথা বলে কোয়ার্টার পাওয়ার লোভে এখানে ঢোকেনি তো? মেয়েটা হয়তো অন্য কোনও বাড়ির কাজ ধরেছে।

এইভাবে তো চলতে পারে না, এই ভেবে মিত্রা ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে কোয়ার্টারের দরজায় কড়া নাড়ল। রতন আর সারদা তখন মিত্রার ফ্ল্যাটে কাজ করছিল। দরজার কড়া নাড়তেই রেশমি এসে দরজা খুলে দিল। মিত্রার ওকে দেখে এতটুকুও অসুস্থ বলে মনে হল না।

‘তুমি তো দেখছি দিব্যি সুস্থ আছ, তাহলে কাজে আসছ না কেন?’ মিত্রা জানতে চাইল।

‘না… মানে… আমার…. আমি একটু….’ রেশমি তোতলাতে থাকে।

মিত্রা কথা না বাড়িয়ে নিজের ফ্ল্যাটে এসে দরজা বন্ধ করতে যাবে, চোখে পড়ল তিরিশ-পঁয়ত্রিশ বছরের একটি লোক রতনদের কোয়ার্টার থেকে বেরিয়ে লিফটের দিকে যাচ্ছে। আশ্চর্য হয়ে গেল মিত্রা। ওদের কাছে কোনও আত্মীয়স্বজনের কথা মিত্রা তো কিছু শোনেনি। তাহলে পুরুষটি কে হতে পারে? চোরের মতন লুকিয়ে পড়ারই বা কী দরকার বুঝে পেল না মিত্রা। কিন্তু মিত্রা মনে মনে স্থির করে নিল, এই রহস্যের অনুসন্ধান ওকে করতেই হবে।

লক্ষ্য রাখা শুরু করল মিত্রা। রতন আর সারদা কাজ করতে সকালেই এসে যেত। ওরা কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লেই মিত্রা খেয়াল করত, প্রত্যেকদিনই আলাদা আলাদা পুরুষমানুষ কোয়ার্টারে আসছে। মিত্রা, কয়েকদিন পর পর নতুন নতুন পুরুষকে কোয়ার্টারে আসতে দেখে ভয় পেয়ে গেল, ওখানে এরা দেহব্যাবসা ফেঁদে বসেনি তো? শংকরকে জানানোটা সবথেকে আগে দরকার।

একদিন বাড়ি ফিরে আসার পর মিত্রা শংকরকে সবকিছু খুলে বলল। শংকর সব শুনে প্রচণ্ড রেগে গেল, ‘প্রথম দিনই তোমার আমাকে সব খুলে বলা উচিত ছিল। এতগুলো দিন হয়ে গেল। কিন্তু দোষ চাপালেই তো হবে না! হাতেনাতে ওদের ধরতে হবে। তুমি একটু চোখ কান খোলা রেখো। হতে পারে এটা একটা র‍্যাকেট।’

পরের দিন অফিস থেকে ছুটি নিয়ে শংকর বাড়িতেই থেকে গেল। রোজের মতোই রতন আর সারদা এসে কাজে লেগে পড়ল। মিত্রা আগেই নিজেকে তৈরি রেখেছিল, ওদের কাজের মাঝেই মিত্রা জিজ্ঞেস করল, ‘কী ব্যাপার রতনদা? আপনার নাতনির অসুখ এতদিনেও ঠিক হল না? আপনারা আমাকে গাধা ভেবেছেন? আজ আমি সত্যিটা না জেনে ছাড়ছি না।’

কথার মাঝেই শংকরও এসে দাঁড়াল মিত্রার পাশে, ‘হ্যাঁ, রতনদা আজকে উত্তর তো তোমাকে দিতেই হবে। আর একবার আমার সঙ্গে তোমাদের কোয়ার্টারে চলো। আমি একটা ছোটো আলমারি ওখানে রাখব। জায়গাটা তাই আমি আগে একটু দেখে নিতে চাই।’

‘কিন্তু সাহেব… এখুনি…’, রতনের কিন্তু কিন্তু ভাব দেখে শংকর ধমক দিয়ে উঠল জোরে।

শান্ত স্বভাবের শংকরের অগ্নিমূর্তি দেখে রতন ভয় পেয়ে গেল। সারদা ভয়ে রতনের হাত জড়িয়ে ধরল, ‘তুমি এনাদের সব কথা বলে দাও… এভাবে আমি আর সহ্য করতে পারছি না।’

ততক্ষণে রতন নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়েছে। ও বলতে শুরু করে, ‘সাহেব, আমরা মিথ্যা বলেছিলাম, রেশমির বিয়ে হয়ে গেছে। আমাদের জামাই খুব বাজে লোক। সবসময় মদ খেয়ে থাকে। যখন বিয়ে হয় জামাইয়ের একটা ছোটো চায়ের দোকান ছিল। বিয়ের পর আমাদের মেয়ের যে-কটা গয়না ছিল সব বিক্রি করে দিল। যখন দোকানটাও বিক্রি করে দিল তখন রেশমিকে দিয়ে খারাপ খারাপ কাজ করাত। আমরা মেয়েটাকে নিজেদের বাড়ি নিয়ে আসি কিন্তু সেখানেও সে আমাদের পিছু ছাড়ল না। ওখানেও লোক পাঠাত জামাই। আপনাদের এখানে কোয়ার্টার পেতেই একরকম লুকিয়েই এখানে পালিয়ে আসি… কিন্তু এখানকার ঠিকানাও ও কী করে জোগাড় করল জানি না, এখানেও লোক পাঠানো…’, চোখের জল আর ধরে রাখতে পারে না রতন।

‘পুলিশে জানাওনি কেন’, শংকর প্রশ্ন করে।

‘ও শাসিয়ে গিয়েছিল, পুলিশে জানালে আমাদের মেয়েটাকে মেরে দেবে’, ভীত রতন স্বীকার করে।

‘ভাবা যায়, মাত্র একটা লোক এতগুলো মানুষকে ভয় দেখিয়ে খারাপ কাজ করাতে বাধ্য করছে?’ শংকরের উক্তিটা মিত্রার উদ্দেশ্যে হলেও অনেকটা স্বগতোক্তির মতোই শোনাল।

‘সাহেব, রেশমি ছাড়া আমাদের আর কেউ নেই। আমরা ওকে প্রচণ্ড ভালোবাসি। ওই জানোয়ারটা আমাদের জীবন নরক করে তুলেছে’, করুণ শোনায় রতনের স্বর।

মুহূর্ত দেরি না করে সারদা আর রতনকে সঙ্গে নিয়ে শংকর পুলিশের কাছে রিপোর্ট লিখিয়ে আসে। পরের দিনই রেশমির স্বামীর পুলিশের হাতে ধরা পড়ার খবর আসে। খবরটা শুনেই রতনের পরিবারের মুখে হাসি ফোটে। শংকর আর মিত্রা দুজনেই অনুভব করে, লজ্জা গ্লানির জীবন পিছনে ফেলে আজ এই গরিব পরিবারটি রৌদ্রজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্বপ্ন নিয়ে বাঁচার প্রতীক্ষায় উন্মুখ হয়ে রয়েছে।

 

মরমির কথা

অসমের শান্ত সুন্দর প্রকৃতি যেমন খেয়ালি, মরমিও তেমনি খেয়ালি চরিত্রের হয়েছে। কখন কী মুডে থাকে বোঝা মুশকিল। এই হাসিখুশি উচ্ছল, তো পরমুহূর্তেই থমথমে বিষাদ কালো মুখ। ওর সঙ্গে বেশ বুঝেশুনে কথা বলতে হয়। কখন কী ভেবে বসে কে জানে। একবার বর্ষার সময়ে বেশ কিছুদিন অসমে দিদির বাড়িতে থেকেছিলাম। তখন দেখেছি প্রকৃতির খামখেয়ালিপনা কাকে বলে।

ঘুম থেকে উঠে হয়তো দেখলাম ঝকঝকে সুন্দর একটা দিন, চারদিকে সোনা রোদ্দুর ছড়িয়ে আছে। দেখেই আমি এদিক ওদিক ঘুরে বেড়ানোর ছক করে ফেলেছি। কিন্তু পরক্ষণেই আমার সমস্ত প্ল্যানের ওপর জল ঢেলে আকাশে দেখা দিল মেঘের ঘনঘটা! এমনটা প্রায়ই হতো। আবার বৃষ্টি দেখে দিদি হয়তো খিচুড়ির আয়োজন করেছে, একটু পরেই দেখা গেল মেঘ-বৃষ্টি দূরে ঠেলে সূর্যিদেব প্রবল তেজে বিরাজমান হয়েছেন মধ্য গগনে। তখন গনগনে গরমে খিচুড়ি হয়ে উঠত অসহ্য। যতদিন ওখানে ছিলাম মেঘ-রোদ্দুরের খেলা দেখেই কেটেছে। এখন মরমিকে দেখে আমার সেই স্মৃতি মনে এসে যায়। অসমে জন্ম ও বেড়ে ওঠা বলেই হয়তো প্রকৃতির এই খেয়ালিপনাটুকু ওর চরিত্রে গেঁথে আছে।

মরমি আমার বড়দির একমাত্র সন্তান। বড়দির শ্বশুরালয় অসমের গৌরীপুরে। বিয়ে ইস্তক দিদি সেখানেই আছে। মরমিও ওখানেই জন্মেছে। এতদিন পড়াশোনা, বড়ো হয়ে ওঠাও সেখানেই। এখন কলকাতায় এসে যাদবপুর ইউনিভার্সিটিতে কম্প্যারেটিভ লিটারেচার নিয়ে পড়ছে। যাদবপুরেই হোস্টেলে থাকে ও। আমি ওর মামা তো বটেই, ইউনিভার্সিটির নথিতে লোকাল গার্জেনও। ও হোস্টেলে থাকলেও মামা হিসেবে যতটা সম্ভব খোঁজখবর রাখার চেষ্টা করি।

ছুটি-ছাটায় বাড়িতে নিয়ে আসি ওকে। আর প্রতি রবিবার বা শনিবারে নিয়ম করে আমি ওর হোস্টেলে দেখা করতে যাই। কতদিন ওকে বলেছি, ছুটির দিনগুলোতে সবসময় আমার বাড়িতে চলে আসতে। সারা সপ্তাহ তো হোস্টেলের ওই আধসেদ্ধ খাবার খেতে হয়, সপ্তাহান্তে একদিন না হয় বাড়িতে এসে একটু ভালোমন্দ খাওয়াদাওয়া করল।

প্রথম প্রথম মরমি আসতও। কিন্তু ইদানীং আর সেভাবে আসেই না। অনেক বলার পরে হয়তো এক আধদিন এল। আমি সপ্তাহে একদিন ওর ওখানে যাই বলেই যা একটু দেখা হয়, খোঁজখবর পাই। আজকাল যেন মনে হয়, আমি ওর হোস্টেলে গেলে ও যে খুব একটা খুশি হয় সেটা নয়। আমাকে পাশ কাটাতে পারলেই যেন বাঁচে। সেদিন তো বলেই ফেলল, ‘ওফ মামা, তুমি কি আমাকে এখনও সেই ছোট্টটি ভাবো যে সবসময় পিছে পিছে থাকতে হবে? আমার বন্ধুরা এই নিয়ে হাসাহাসি করে জানো?’

আমি বলি, ‘জানি তুই এখন অনেক বড়ো হয়ে গেছিস, কিন্তু আমাদের কাছে এখনও সেই ছোটোটিই আছিস। আর এতে বন্ধুদের হাসাহাসির কী হল? আমি তোর সুবিধা অসুবিধা না দেখলে কে দেখবে? এখানে তোর আর কে আছে? বড়দি আমার ওপরে কত ভরসা করেই না তোকে এখানে পড়তে পাঠিয়েছে।’

আর কথা বাড়ায়নি। তবে আমি বেশ বুঝতে পারি, আমার ওখানে ঘনঘন যাওয়াটা ওর খুব একটা পছন্দের নয়। তবু যাই। নিজের কর্তব্যবোধেই যাই। হাজার হোক নিজের একমাত্র বোনঝি বলে কথা। যখন যাই তখন মাঝেমধ্যে ওর পছন্দের মোগলাই, চিকেন কাটলেট বা চাউমিনও সাথে করে নিয়ে যাই। পছন্দের জিনিসগুলো পেলে ভারি খুশি হয় মেয়েটা। আর ওকে খুশি দেখলে আমার মধ্যেও খুশির স্রোত বয়ে যায়। মরমিটা যেন একেবারে আমার কৈশোরের বড়দি। সেই গভীর টানা টানা দুটো চোখ, আর তেমনি সেই দুধে আলতা গায়ের রং। সুন্দরী বলেই গৌরীপুরের সেই বনেদি পরিবারে এক দেখাতেই বড়দির বিয়ে হয়ে গেছিল।

মরমিও বড়দির মতোই সুন্দরী হয়েছে। হয়তো বড়দির থেকেও খানিক বেশি। জামাইবাবুর মতো সুঠাম ও দীর্ঘাঙ্গীও হয়েছে। আর এত সুন্দরী বলেই ওকে নিয়ে আমার চিন্তাও বেশি। সুন্দরীরা সহজেই নজরে পড়ে যায় যে। যা দিনকাল পড়েছে, মেয়েদের জন্যে নিরাপত্তা বলতে আর কিছুই রইল না। টিভি বা পত্র-পত্রিকা খুললে চারদিকে একই খবর –শ্লীলতাহানি, ধর্ষণ, খুন এসব ছাড়া যেন আর খবরই নেই! কলেজ, ইউনিভার্সিটির পরিবেশও তো তথৈবচ। এমনকী স্কুলেও নানারকম যৌন অপরাধের ছড়াছড়ি।

সাত থেকে সত্তর, নারী শরীর হলেই হল, একদল নরপিশাচ সবসময় জিভ লকলকিয়ে আছে। সবচাইতে বড়ো কথা, যারা এসব জঘন্য কাণ্ড ঘটাচ্ছে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তারা দাগি ক্রিমিনাল নয়। স্কুল শিক্ষক, রিসার্চ গাইড, তুখোড় সাংবাদিক, এমনকী মহামান্য বিচারপতির বিরুদ্ধে পর্যন্ত ধর্ষণ বা শ্লীলতাহানির অভিযোগ শোনা যাচ্ছে! কোথায় যাবে সাধারণ মানুষ? এ দেশে সত্যিই বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে।

নাঃ, এসব ভেবে আর কাজ নেই। আমি অতি সাধারণ মানুষ। আমার ভাবনায় কোনও সুরাহা হওয়ার নয়। বরং যত ভাবব, কেবল নিজের শান্তিই বিঘ্নিত হবে। আমি শুধু নিজের কথা ও নিজের পরিবার, প্রিয়জনের কথা ভাবতে পারি। সেজন্যে মরমিকে সবসময় পই পই করে বলে যাই সাবধানে থাকতে, আর বুঝেশুনে চলতে। কোনও অসুবিধে হলেই যেন আমাকে জানায়। মরমি বাধ্য মেয়ের মতো মাথা নাড়ে বটে কিন্তু মুখ দেখে মনে হয় না আমার কথার খুব একটা গুরুত্ব দিচ্ছে। একদিন তো বিরক্ত হয়ে বলেই ফেলল, ‘মামা, তুমি না বড়ো ওভার প্রোটেকটিভ’!

শুনে আমি রাগ করিনি। এটা মরমির দোষ নয়, যুগের দোষ আর বয়েসের ধর্ম। এ যুগের ছেলেমেয়েরা গুরুজনদের তেমন শ্রদ্ধা সন্মান করে না। সারাক্ষণ মুখে কেবল ইংরেজির খই ফুটছে। গুরুজনেরা যেটা বলবে, সেটার বিরোধিতা করা যেন এদের অবশ্য করণীয় কর্তব্য হয়ে উঠেছে। সেজন্যে এদের কিছু বোঝাতে যাওয়া বৃথা। চোরে না শোনে ধর্মের কাহিনি। আমাদের শুধু কর্তব্য করে যাওয়া। বাকিটা ভবিতব্য।

বিনতা মানে আমার স্ত্রী হয়তো ঠিকই বলে, কলির হাওয়া লেগে গেছে মেয়েটার। এখন কলকাতা শহর চিনেছে, বন্ধু-বান্ধব হয়েছে, এখন কি আর মামা-মামির নীরস সান্নিধ্য ভালো লাগে? কথাটা যে মিথ্যে নয়, এর প্রমাণ প্রতি পদে পদেই পাই। প্রায়ই ফোন করলে শুনি, বন্ধুদের সাথে শপিং মলে, নয়তো মাল্টিপ্লেক্সে ছবি দেখতে গেছে। কখনও কখনও দল বেঁধে কলকাতার আশেপাশেও ঘুরে এসেছে জানতে পারি। আজকাল মরমির হাবভাব আচার আচরণ দেখলেও বোঝা যায়, অসমের সেই সিধেসাদা সরল মেয়েটি আর সে নেই। যুগের হাওয়া স্পষ্ট। দেখে খারাপই লাগে। এই প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের মধ্যে সর্বস্তরেই যে একটা অবক্ষয় চলছে, সেটা আমাকে ভীষণ ভাবায়। অবশ্য ভেবেই বা কী করব? যে যুগ চলেছে, ঘোর কলি, এতে তো শুধু অবক্ষয় আর অবনতিই দৃশ্য হওয়ার কথা ।

এ পর্যন্ত তবু সব ঠিকই ছিল। অনেক বলতে বলতে বহুদিন পরে গতকাল সন্ধেতে মরমি আমাদের বাড়ি এসেছে। শনি, রবির ছুটিটা কাটিয়ে সোমবার হোস্টেলে ফিরে যাবে। মেয়েটা এলে আমাদের স্বামী-স্ত্রী-র গুমোট সংসারেও যেন প্রাণবায়ু আসে। বিনতাও ওকে সন্তানের মতোই স্নেহ করে। ও আসছে বলে কত কি খাবার বানিয়ে রেখেছে আগে থেকেই। প্রতিবারই তাই করে। অথচ যার জন্যে করে সে তো খায় পাখির মতো যৎসামান্য।

আজকালকার ছেলেমেয়েরা এমন রূপ সচেতন যে, ফিগার বা ত্বক খারাপ হয়ে যাওয়ার ভয়ে কত চর্বচোষ্য আর অমৃতের স্বাদ হেলায় ত্যাগ করে চলে। মরমির মধ্যে সবসময় মোটা হয়ে যাওয়ার ভয়। সেজন্যে একেবারে খেতে চায় না মেয়েটা। আর খেলেও ফলমূল আর স্যালাডে পেট ভরিয়ে রাখে। একদিকে অবশ্য ভালো এই ভেজালের যুগে মানুষ যত প্রকৃতিতে ফিরে যায় ততই মঙ্গল। তবু ভাবি এই বয়েসেই যদি ছেলেমেয়েরা মন ভরে না খাবে, তবে কখন খাবে। আমাদের মতো বুড়ো বয়সে, নানা রোগে ব্যাতিব্যস্ত হলে খেতে ইচ্ছে করলেও তো কত কিছু পেটে সইবে না। কিন্তু ওরা সেটা বুঝলে তো। মরমির সাথে থাকলে নতুন প্রজন্মের সাথে আমাদের ভাবধারার বিস্তর ফারাক প্রতি মুহূর্তে প্রকট হয়ে ওঠে।

আমার চাইতে ওর মামির সাথেই মরমির অন্তরঙ্গতা বেশি। মরমিকে পেলে বিনতাও যেন গল্পের ঝুলি খুলে বসে। ওদের হাসি ঠাট্টায় ভরে থাকে ঘর। ওদের আড্ডায় আমি বিশেষ গুরুত্ব না পেলেও ওদের খুশি আমার মধ্যেও এনে দেয় চোরা সুখ। কিন্তু গতকাল আমার কৌতুহলী মন এমন কিছু একটা আবিষ্কার করে ফেলেছে যে, কাল রাত থেকেই প্রচণ্ড অস্থিরতায় আছি। কী করব ভেবে পাচ্ছি না। এমন একটা বিষয় যে মরমির সাথেও সরাসরি কথা বলতে বিবেকে বাধছে। নিজের বোনঝি বলে বিনতাকেও জানাতে জড়তা হচ্ছে। লজ্জা ঘেন্নায় আমার মাথা নত হয়ে গেছে। এত অধঃপতন হয়ে গেছে মেয়েটার! অথচ ওকে দেখলে কে বলবে যে এমন একটা কাণ্ড বাঁধিয়ে বসে আছে?

বাড়িতে আসার পর থেকে ওকে একেবারেই স্বাভাবিক দেখছি। দিব্যি খাচ্ছে দাচ্ছে, গপ্পো, হাসি ঠাট্টা করছে! চোখে মুখে কোনও টেনশনের নামগন্ধ নেই। এসব কী এখন এতই জলভাত হয়ে গেছে এই প্রজন্মের কাছে? সব যেন আমার ভাবনার অতীত। বড়দিকে ব্যাপারটা জানানো দরকার। দিদিই পারবে নিজের মেয়েকে শাসন করতে। তবে তার আগে আমি প্রমানসহ মরমিকে হাতেনাতে ধরতে চাই।

কাল যখন মরমি ওর মামির সাথে গপ্পো গুজবে মশগুল ছিল, পাশের ঘরে টেবিলের ওপরে ওর মোবাইল ফোনটা রাখা ছিল। তখন একটা মেসেজ রিসিভের ‘বিপ’শব্দ শুনে মোবাইলটার প্রতি আমার দৃষ্টি আকর্ষণ হল। নিছকই কৌতূহলবশত ওটা হাতে তুলে নিই। নজর পড়ে, নতুন একটা এসএমএস এসেছে। আমি সেটা খুলে পড়তেই অবাক হয়ে যাই। একটা নার্সিংহোমের ঠিকানা! মরমিকে রবিবার ঠিক সকাল ন’টার মধ্যে ওখানে উপস্থিত থাকতে বলা হয়েছে। নার্সিংহোম যাবে কেন মরমি? ওখানে কী কাজ থাকতে পারে? মনে নানা ভাবনার উথাল-পাতাল চলতে লাগল। দ্রুত ওর মেসেজ বক্সে গিয়ে অন্যান্য মেসেজগুলো পড়তে লাগলাম। সেগুলোর মধ্যে তাৎক্ষণিক কেবল দুটো মেসেজ পেলাম যেটা নার্সিংহোমের সাথে সম্পর্কযুক্ত। একটাতে মরমিকে প্রশ্ন করা হয়েছে, ওর রক্তের গ্রুপ কী? দ্বিতীয়টি মরমির জবাব। নিজের রক্তের গ্রুপ জানিয়ে মরমি নার্সিংহোমের ঠিকানা জানতে চেয়েছে। অসংখ্য মেসেজের ভিড়ে এই রিলেটেড আর কোনও মেসেজ আমি পেলাম না। কিন্তু এটুকু তথ্যই আমার জন্যে সাংঘাতিক।

রক্তের গ্রুপ জানতে চাওয়া কেন? তবে কি মরমি এমন কিছু করাতে চলেছে যার জন্যে রক্তের প্রয়োজন হতে পারে? শেষ পর্যন্ত মেয়েটা এমন কাণ্ড বাধিয়ে বসল যে, নার্সিংহোমে ছুটতে হচ্ছে! আর পাপ কাজ বলেই কি আমাদের জানাতে সাহস করেনি? আমার মধ্যে সীমাহীন প্রশ্ন দানা বেঁধে উঠেছে। মাথাটা সেই থেকে ঝিম ধরে আছে। কিছুতেই নিজেকে স্থির রাখতে পারছি না। আজকাল ভাব-ভালোবাসার নামে যেমন খুল্লামখুল্লা যথেচ্ছ যৌনাচার চলছে সর্বত্র, তাতে কোনওকিছুই আর অস্বাভাবিক নয়। মাঝে একটা পত্রিকায় পড়েছিলাম, সম্প্রতি সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, এই প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের কাছে যৌন সম্পর্কের রাখঢাক ব্যাপারটা অনেকটাই উঠে গেছে। ‘কৌমার্য’ বা ভার্জিনিটি শব্দগুলো অভিধানে বিলীন হতে বসেছে। কৌমার্য রক্ষা করার ধারণাটাই নাকি অনেক আধুনিকার কাছে এখন সাপ্রেশনের আর-এক নাম। ভাবি কোথায় চলে যাচ্ছে সমাজ! বৃহত্তর সমাজের কথা না হয় ছেড়েই দিলাম, এখন তো ঘরেই এ অভিজ্ঞতা হওয়ার দুর্ভাগ্য ঘটছে।

মরমি তখনও মেসেজটি দেখেনি। তবে আগের মেসেজেই যখন নার্সিংহোমের ঠিকানা জানতে চেয়েছিল, সুতরাং এটা নিশ্চিত যে, ওখানে যাওয়ার জন্যে ও মানসিক ভাবে প্রস্তুত। আমার ধারণা, ওর সাথে যুক্ত ছোকরাটিই মেসেজ প্রেরক। সেই সমস্ত ব্যাবস্থাপনা করেছে। নিজের পাপ ঢাকতে এসব তো করতেই হবে। তবে আমি মেয়েটাকে যত দেখছি, ততই অবাক হচ্ছি। চিন্তা ভাবনা বা টেনশনের লেশমাত্র নেই ওর চেহারাতে! এসব এতই জলভাত হয়ে গেছে এদের কাছে?

ঠিক করেছি মরমিকে হাতেনাতে ধরব। ‘টোটাল কিওর’ নার্সিংহোম আমার চেনা। মরমি ওখানে গেলেই আমিও পিছু নেব। সেজন্যেই সকালে দায়সারা প্রাত ভ্রমণ করেই তাড়াহুড়ো করে বাজার সেরে বাড়ি ফিরেছি। এসেই দেখি, যা ভেবেছিলাম ঠিক তাই। মরমি আমি আসার আগেই বেরিয়ে গেছে। ওর মামিকে নাকি বলে গেছে, প্রফেসর ডেকেছেন, তাই কোচিং-ক্লাস এ পড়তে যাচ্ছে। ফিরতে দেরি হবে আর বেশি দেরি হলে এখানে না এসে ও সরাসরি হোস্টেলেই ফিরে যাবে। বিনতা ঘরে মন বিষণ্ণ করে বসে আছে। স্বাভাবিক, কতদিন পরে মেয়েটা এসেছিল, অথচ রাত পোহাতেই এমন আকস্মিক চলে গেল। মনটা আমারও খারাপ লাগছে। কিন্তু তার চাইতে উদ্বিগ্নতা ও অস্থিরতা অনেক বেশি। আমি বাজার রেখেই বিনতাকে তেমন কিছু না জানিয়েই বেরিয়ে পড়লাম।

‘টোটাল কিওর’নার্সিংহোম খুব একটা দূরে নয়। বড়োজোর মিনিট কুড়ির পথ। দুবার অটো পালটাতে হয় কেবল। তবে আজ বারবার সিগনাল আর ট্র্যাফিক জ্যামে আটকে অনেকটাই সময় লেগে গেল। নার্সিংহোমে যখন পৌঁছলাম, ন’টা বেজে গেছে। গেট দিয়ে টোটাল কিওর-এর চত্বরে ঢুকেই চারদিকে তাকিয়ে মরমিকে খোঁজার চেষ্টা করলাম। বিনতার কথা মতো মরমি আমারও প্রায় একঘন্টা আগে ঘর থেকে বেরিয়েছে। সুতরাং অনেক আগেই ওর পৌঁছে যাওয়ার কথা। কিন্তু খোলা চত্বরে কোথাও ও নজরে এল না। অগত্যা দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলাম।

রিসেপশনের সামনেই ভিজিটরস এনক্লেভ-এ অনেকেই বসে আছে। আমি ওখানেও মরমির দেখা পেলাম না। অথচ আমি শতকরা একশো ভাগ নিশ্চিত যে কোচিং-ক্লাস এর নাম করে মরমি এখানেই এসেছে। এ ধরনের অনেক প্রাইভেট নার্সিংহোমেই চলে যত অবৈধ কাণ্ডকারখানা। কিছু কিছু গাইনি, এমনকী হাতুড়ে পর্যন্ত মালামাল হয়ে যাচ্ছে শুধু অন্যের পাপ ধুয়ে ধুয়ে। আমি জানি শুধু মরমিই নয়, সেই ছোকরাটিও এখানেই আছে।

কোথাও মরমির দেখা না পেয়ে অগত্যা রিসেপশনের দিকে এগিয়ে গেলাম। মরমি নিশ্চয়ই ভেতরে ঢুকে গেছে। রিসেপশনিস্ট মেয়েটিকে বললাম, একজন পেশেন্টকে দেখতে এসেছি, নাম মরমি ঘোষ।

মেয়েটি কম্পিউটারে চোখ রেখে বলল, সরি, এই নামে কোনও পেশেন্ট নেই এখানে।

– কী বলছেন কী? ভালো করে দেখুন, নামটা নিশ্চয়ই আছে। ও এখানেই আছে আমি জানি। আমি উত্তেজিত হয়ে বলি।

– না স্যার, আমাদের পেশেন্ট লিস্টে এমন কোনও নাম নেই। মেয়েটি একইরকম শান্ত হয়ে জানায়।

টের পাচ্ছি, আমার হূদ্কম্পন ক্রমশ বেড়ে চলেছে, কপালে চিন্তার ভাঁজগুলো গাঢ় হচ্ছে, হাতের তালু ঘেমে উঠেছে। ওরা যাই বলুক, আমি নিশ্চিত মরমি এখানেই আছে। তবে কি এসব অবৈধ কাজগুলো অফ দ্য রেকর্ড হয়? যার জন্যে ওর নাম পেশেন্ট লিস্টে নেই? নাকি মরমি নাম ভাঁড়িয়ে আছে? এও কী সম্ভব? আমি এবারে অনুনয়ের সুরে বলি, দেখুন ম্যাডাম, একটু আগেই সে এখানে এসেছে। লম্বা করে, খুব ফরসা, …সুন্দরী একটি মেয়ে…

মেয়েটি মৃদু হাসল। বলল, দেখুন অনেকেই তো এখানে আসছেন, কারও চেহারা দেখে তো মনে রাখা সম্ভব নয়। আমরা যা রেকর্ডে আছে সেটুকুই বলতে পারি। আমার মনে হয় আপনার কিছু একটা ভুল হচ্ছে।

আমি প্রায় হতাশ, তীরে এসে এভাবে তরি ডুববে ভাবতেও পারিনি। কী করব ভেবে পাচ্ছি না। অসহায়ের মতো সেখানেই দাঁড়িয়ে আছি। ঠিক তখনই পাশে বসে থাকা অপর রিসেপশনিস্ট মেয়েটি জিজ্ঞাসা করল, একটু দাঁড়ান, কী নাম যেন বলেছিলেন আপনি?

– মরমি। মরমি ঘোষ। আমি শশব্যস্ত হয়ে বলে উঠি।

– হ্যাঁ হ্যাঁ নামটা যেন একটু আগেই শুনেছি। একটু আনকমন নাম বলে কানে গেঁথে আছে।

আমি আশার ঝলক দেখতে পেয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালাম। মেয়েটি কম্পিউটার স্ক্রীন-এ কিছুক্ষণ চোখ রেখে বলতে লাগল, একজন মরমি ঘোষ আছেন। বয়স একুশ। কিন্তু তিনি তো পেশেন্ট নন।

– হ্যাঁ হ্যাঁ ওর কথাই বলছি। সবে একুশ হয়েছে ওর। আমি একরকম উল্লাসেই বলে উঠি।

– কিন্তু তিনি তো পেশেন্ট হিসেবে এখানে আসেননি।

– তবে কী জন্যে এসেছেন? আমি সবিস্ময় প্রশ্ন করি।

– উনি এসেছেন থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত একটি ছ’বছরের শিশুকে রক্ত দিতে।

– রক্ত দিতে? কোন শিশুকে? সে কে হয় ওর? আমার বিস্ময় আর প্রশ্নের অন্ত নেই।

মেয়েটি বলে চলে, শিশুটির কেউ হন না উনি। খুব গরিব ঘরের একটা শিশু। আকস্মিক রক্তের প্রয়োজন হওয়ায় পত্রিকায় আবেদন করেছিল শিশুটির পরিবার। খুব রেয়ার রক্তের গ্রুপ কিনা, তাই ডোনার পাওয়াই কঠিন। সেই আবেদনেই সাড়া দিয়ে মিস মরমি ঘোষ রক্ত দিতে এসেছেন।

যা শুনছি, নিজের কানকেই যেন বিশ্বাস করতে পারছি না। মাথার থেকে একটা ভার যেন আকস্মিক নেমে গেছে। সেই সঙ্গে নিজের হীন্মন্যতার বোঝায় নিজেই নত হয়ে যাচ্ছি। ইশ, কী ভুলটাই না করে চলছিলাম! কেবল অন্ধকারটুকুই দেখে গেলাম এতদিন! নতুন প্রজন্মের এই অপরূপ রূপটি নিজের অজ্ঞতা আর হীন্মন্যতার দরুন দৃষ্টির অগোচরেই থেকে গেছিল। টলমল পায়ে ভিজিটরস এনক্লেভ-এ এসে বসি। মরমির জন্যে অপেক্ষা করছি। মেয়েটাকে সাথে করেই বাড়ি ফিরব। রক্ত দিচ্ছে, এখন ওর পুষ্টিকর খাওয়া ও যত্নের বিশেষ প্রয়োজন। ভাবছি, মেয়েটাকে বুকে জড়িয়ে মনে মনে ওর থেকে ক্ষমা চেয়ে নেব।

 

আত্মজ

রবিদার চায়ের দোকানে বসে সিগারেট টানছিল। ভাবনায় সলিলদা। যাওয়াটা ঠিক হবে? কিছুদিন হল খবর পাঠাচ্ছে। রাস্তায় দেখা হয়েছিল, প্রসঙ্গ তুলতে বলল, বাড়ি আয়। সব কথা রাস্তায় হয় না।

কী কথা কে জানে! হতে পারে সেদিনের জের। বউদি হয়তো কানে তুলেছে। ভয় হচ্ছে। সংকোচও।

পাগলিটার চিৎকার কানে আসে। অশ্রাব্য ভাষায় গাল দিচ্ছে। তেড়ে যাচ্ছে কারও দিকে। হুটোপাটি পালানোর শব্দ। হা হা হো হো…

বিভাসের অস্বস্তি হয়। ভাবনায় চিড় খাচ্ছে। কিছুতেই অনুমান করতে পারছে না সলিলদার বিষয়টা। ভদ্রলোকের সাথে দীর্ঘদিনের পরিচয়। তাকে স্নেহ করেন। তাঁর পরামর্শেই কন্ট্রাকটারি ব্যাবসায় নেমেছে। নিজে পিডব্লউডি-র অফিসার হওয়ায় কন্ট্রাক্ট পেতে সমস্তরকম সাহায্য করেন। বিনিময়ে এতটুকু সুবিধা নেননি কখনও। ভয় হচ্ছে, পাছে সম্পর্কে চিড় ধরে। কেন যে মরতে গৌরী বউদির সাথে সেদিন খারাপ ব্যবহার করল!

‘মর মর খান্কির বাচ্চারা…’

পাগলিটা গালাগাল দিচ্ছে। মাথার প্রতিটি কোশে আঘাত করে শব্দগুলো। রক্তক্ষরণ টের পায়। শেষ হয়ে আসা সিগারেটটা ছুড়ে ফেলে আরও একটা ধরায়। নিজেকে যথাসম্ভব শান্ত রাখার চেষ্টায় পুরোনো ভাবনায় ফিরে আসতে চায়। দিন পনেরো আগের ঘটনা, ব্যাবসায়িক প্রয়োজনে সলিলদার বাড়়ি যেতে হয়েছিল। সলিলদা তখন বাড়িতে ছিলেন না। গৌরী বউদি ভেতরে ডাকলেন।

অনিচ্ছা সত্ত্বেও সেদিন বসতে হয়েছিল বিভাসকে। ভদ্রমহিলাকে সে পছন্দ করে না। কেবল গৌরী বউদি কেন, কোনও মহিলাকেই সে সহ্য করতে পারে না। ঘৃণা করে। আর গৌরী বউদিকে তো অপছন্দ করার যথেষ্ট কারণ আছে। সেজেগুজে সারাদিন পটের বিবি, দিনভোর বিউটিপার্লার-ফেসিয়াল-ম্যানিকিয়োর কিংবা টিভি সিরিয়াল… শো-কেসের পুতুল যেন একটা। কেন জানে না, গৌরী বউদিকে দেখলে মনোকামিনীর কথা মনে পড়ে। ভদ্রমহিলাকে মা ভাবলেই গা ঘিনঘিন করে। সজ্ঞানে ‘মা’ শব্দটা কখনও উচ্চারণ করেনি সে। ভবিষ্যতেও করবে না।

মাথার ভিতর ঘুণপোকার উপস্থিতি টের পায়। বিভাস তবু সামলে নিতে পারত। সামাজিক ভদ্রতা রক্ষা করতে বহু অভ্যাসে, নিজের সঙ্গে লাগাতার যুদ্ধ চালিয়ে ইদানীং এ ক্ষমতা সে অর্জন করেছে। আচরণে কোনও প্রভাব পড়তে দেয় না। গৌরী বউদি বিয়ের প্রসঙ্গ তুলতেই সব গোলমাল হয়ে গেল। জানে এ প্রসঙ্গে সে বিরক্ত হয়। একাধিকবার বলেছে, কোনও মেয়ের সাথে এক ছাদের তলায় সারাজীবন কাটানো তার পক্ষে অসম্ভব। সেদিন এমন বাড়াবাড়ি করতে লাগল বউদি যে, নিজেকে আর ঠিক রাখতে পারেনি। বেশ দু’কথা শুনিয়ে, রাগ দেখিয়ে উঠে এসেছিল। পরে অবশ্য অনুতপ্ত হয়েছে।

গৌরী বউদি নিশ্চয় অপমানিত হয়েছিল। কথাটা হয়তো সলিলদার কানে তুলেছে। হতে পারে এই জরুরি তলব…

পাগলিটাকে ঘিরে ছেলেগুলোর অসভ্যতা বাড়ছে। বাড়ছে চিৎকার চ্যাঁচামেচি। সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে পাগলির খিস্তি-খেউড়… সেই সাথে মাথার ভেতর একটা চিনচিনে ব্যথার অনুভব। রবিদার চায়ের দোকানের সামনেই আইল্যান্ড, তিন রাস্তার সংযোগস্থল। মাঝখানে রবীন্দ্রমূর্তি। মূর্তির নীচে পাগলির বর্তমান ঠিকানা। কিছু কংক্রিটের বেঞ্চ আছে চারপাশে। সকাল-সন্ধে এখানেই আড্ডা মারে ছেলেগুলো। সকলে শিক্ষিত, ভালো পরিবারের। চাকরি জোটাতে না পেরে বাড়ি বাড়ি ছাত্র পড়ায়, বাকি সময়টা এখানেই। এদের কাছ থেকে এ ধরনের আচরণ মেনে নিতে পারে না বিভাস।

চায়ের দোকান থেকে বেরিয়ে পায়ে পায়ে পার্কের গেটের মুখে এসে দাঁড়ায়। পাগলিটার একটা হাত স্ফীত পেটের উপর, অন্যহাতে একটা লাঠি– কখনও এর দিকে তেড়ে যাচ্ছে তো কখনও অন্যজনের দিকে। তাড়া খেয়ে প্রথমজন দৌড়ে পালাচ্ছে তো দ্বিতীয়জন এগিয়ে আসছে… পাগলির গর্ভস্থ সন্তান চুরি করার ভয় দেখাচ্ছে। আর তাতেই পাগলির আক্রোশ। পরনের কাপড় অর্ধেকের বেশি মাটিতে লুটোচ্ছে, উপরিভাগ সম্পূর্ণ অনাবৃত।

পাগলির ভারী তলপেটের দিকে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত ঘষে বিভাস। অসুস্থ শরীরে এমন দৌড়-ঝাঁপ… ভদ্দর ঘরের বউ হলে বিছানায় কেতরে থাকত। একটা রাস্তার পাগলিকেও, কারা যে এসব করে! আজব দেশ মাইরি!

–কী হচ্ছে এখানে? এত চিৎকার কীসের?

বিভাস প্রায় গর্জন করে ওঠে। মুহূর্তে স্তব্ধ হয়ে যায় চারপাশ। ছেলেগুলোর সাথে সাথে পাগলিটাও থতমত খেয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকে। সকলের চোখে ভয়।  এলাকায় একটা ‘দাদা’ ইমেজ আছে বিভাসের।

বিভাস তখনও পাগলিটার দিকে তাকিয়ে। এই প্রথম এত কাছ থেকে, সময় নিয়ে পাগলিটাকে দেখছে। এখানে নতুন এসেছে, শরীরে বয়ে এনেছে বীজ। বয়স তিরিশ-পঁয়ত্রিশের মধ্যে। গায়ের রং একসময় ফর্সা ছিল। এখন রোদেপোড়া তামাটে। ছাই-ভস্ম মাখা চুলে জট পাকাতে শুরু করেছে। মাঝে মাঝে আঙুল ডুবিয়ে চুলকোচ্ছে। এসবের মধ্যেও বেশ একটা ঢলঢলে ভাব আছে চেহারায়। সবচেয়ে মারাত্মক পাগলির চোখদুটো। কী এক মায়ায় যেন তার দিকে অদ্ভূত ভাবে তাকিয়ে আছে। হয়তো ভরসা খুঁজছে।

চোখের এই আকুতি আগে কখনও দেখেনি বিভাস। নিজেকে সে নিষ্ঠুর, পাষাণ হূদয় হিসাবে ভাবতেই  অভ্যস্ত। তবু বুকের মধ্যে কেমন একটা অনুভূতি, শিরশির করে শরীর। পাগলিটার দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারে না। অস্বস্তি হয়। চোখ ফিরিয়ে ছেলেগুলোর দিকে তাকায়। ভয়ে চুপসে যাওয়া মুখগুলোর দিকে তাকিয়ে, নিজেকে যথাসম্ভব সামলে নিয়ে বলে, তোরা সব শিক্ষিত না?

– সরি বিভাসদা, ভুল হয়ে গেছে…

বিভাস কথা বাড়াল না। শব্দ করে থুতু ফেলল একদলা। পাগলিটার দিকে তাকাল। তখনও তার দিকে তাকিয়ে। চোখে করুণ আর্তি। বিভাস চোখ সরিয়ে নিল। সকলকে চমকে দিয়ে যেভাবে আচমকা ঢুকেছিল সেভাবেই আবার বেরিয়ে এল। রবিদার চায়ের দোকানে এসে ঢুকল।

–এরা কি ভদ্দরলোকের ছেলে!

দোকানে খদ্দের ছিল না, সমস্ত ঘটনা লক্ষ্য করেছে রবিদা। ভিতরে ক্ষোভ জমে ছিল, এতক্ষণে মুখ খুলল, কী বলব বলো! ব্যাবসা করে খাই, কিছু বলতেও পারিনে–

–একটা চা দিও।

মুড অফ হয়ে আছে। কথা বলতে ভালো লাগছে না। রবিদার কথায় সরাসরি উত্তর দিল না।

–কি অমানবিক ব্যাপার বলো তো! চা দিতে দিতে রবিদা আবার আক্ষেপ করল।

যে-কোনও কারণেই হোক, বিভাস জানে, পাগলিটার উপর একটু সহানুভূতি আছে রবিদার। যখনই দোকানে এসে হাত পাতে, কেকটা রুটিটা… যা হোক কিছু একটা দেবে। ফেরায় না কখনও। বাড়ি থেকে বউদির বাদ দেওয়া একটা কাপড়ও এনে দিয়েছে।

চা খেতে খেতে মানুষটাকে খেয়াল করছিল বিভাস। তার দিক থেকে কোনও সাড়া না পেয়ে মুখ গোমড়া করে আছে। পরিবেশটা আরও গুমোট হয়ে ওঠে। বিভাসের ভালো লাগে না। উঠে পড়ে সে। সলিলদার বাড়ি থেকে বরং ঘুরে আসবে।

কাঁধ অবধি ঝাঁকড়া চুলে ঢেউ তুলে অভ্যর্থনা জানালেন গৌরী বউদি। বাব্বা, এতদিনে মনে পড়ল! আমি ভাবলাম রাগ করেছ, আর বুঝি আসবেই না। এসো ভেতরে এসো–

বিভাস অবাক হল। এমন প্রত্যাশা ছিল না। বরং উলটোটা আশঙ্কা করেছিল। ভয়ে ভয়ে ছিল। ফুরফুরে মেজাজে দেখে ভারটা নেমে গেল।

বিভাসকে বসার ঘরে বসিয়ে ভিতরে চলে গেলেন তিনি। যাওয়ার আগে বলে গেলেন, একটু বোসো। দাদা আসছে। বাথরুমে ঢুকেছে।

মিনিট দশেক পরে সলিলদা এলেন। স্নান সেরে ধোপদুরস্ত হয়ে এসেছেন। পেছনে গৌরী বউদি, তবে ভেতরে ঢুকলেন না। দরজায় দাঁড়িয়ে রইলেন পর্দা ধরে!

–সারাদিন কী এমন রাজকার্য থাকে, খবর দিয়েও পাওয়া যায় না!

–কিছুদিন আগেই তো এলাম। তাছাড়া আপনার সঙ্গে দেখা হচ্ছে–

– সব কথা সব জায়গায় হয় না। কই গো, এবার বলো কী বলবে বলছিলে।

শেষ কথাগুলো বউদিকে উদ্দেশ্য করে। বউদি মুখ নামিয়ে নিলেন। মেঝেতে ডান পায়ের বুড়ো আঙুলের আঁচড় কাটতে কাটতে সংকোচ জড়ানো গলায় বললেন, তুমি বলো। চায়ের জল চাপিয়ে এসেছি–

কথা শেষ করে ধীর পায়ে পর্দার আড়ালে চলে গেলেন তিনি।

কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে মুখ তুললেন সলিলদা। সরাসরি বিভাসের দিকে তাকিয়ে বললেন, কাজের কথায় আসি। মন দিয়ে শুনবে, বিষয়টা অনুভব করার চেষ্টা করবে।

বিভাস কিছু অনুমান করতে পারে না। বুঝতে পারে না সলিলদার মতো মানুষের কী এমন দরকার থাকতে পারে তার কাছে, যে জন্যে এত হেঁয়ালি। চুপ করে থাকাটাই শ্রেয় মনে হয়।

–কিছুদিন হল তোমার বউদি খুব করে ধরেছে। চেষ্টা করলে তুমিই নাকি ওর সমস্যার সমাধান করতে পারো। আমিও ভেবে দেখলাম, খুব একটা ভুল বলেনি।

–সমস্যাটা কী? বিভাস কৌতূহল চাপতে পারে না।

–বলছি। তার আগে কথা দিতে হবে, সমস্ত রকম হেলপ পাব তোমার কাছে।

–সম্ভব হলে নিশ্চয় পাবেন।

সলিলদা গম্ভীর, তুমি তো জানো, প্রায় বারো বছর হল আমাদের বিয়ে হয়েছে। সন্তানাদি কিছু হল না। হওয়ার সম্ভাবনাও নেই। গৌরীকে দু-দুবার অপারেশন করিয়েছি। নিট লাভ জিরো। তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, এবার অ্যাডপ্ট করব। সেই দু’বছর হতে চলল। বিভিন্ন জায়গায় নাম লিখিয়ে রেখেছি, এখনও কোনও জায়গা থেকে গ্রিন সিগনাল আসেনি। সব জায়গায় লম্বা লাইন। যতদিন যাচ্ছে ভরসা হারিয়ে ফেলছি।

বিভাস বোঝে না এসব অতি ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ তার সাথে কেন! জিজ্ঞাসাও করতে পারে না। অস্বস্তি হয় তার।

–কিছুদিন আগে একটা পাগলির কথা বলেছিলে না? অচমকা প্রসঙ্গ বদলে ফেলেন, তোমাদের ওই রবীন্দ্রপার্কে থাকে…

–হ্যাঁ, কিন্তু…

–শুনেছি সে প্রেগন্যান্ট। তো, এর মধ্যে একদিন গিয়েছিলাম। দেখলাম তাকে। সাত-আট মাস তো হবেই, বেশিও হতে পারে। দেখে কষ্ট লাগে।

বিভাস ধন্দে পড়ে। এর মধ্যে আবার পাগলি এল কোত্থেকে! বিষয়টা কেমন জট পাকিয়ে যাচ্ছে। গালে রেখে কথা বলছে সলিলদা। অস্বস্তি হচ্ছে।

–তোমাকে একটা কাজ করতে হবে, সলিলদা আবার মুখ খোলেন, কিছুদিন একটু চোখে চোখে রাখতে হবে পাগলিটাকে। তুমি তো বেশিরভাগ সময় ও দিকেই থাকো, প্রয়োজনে একজন লোক রাখবে দেখাশোনা করার জন্য।

–আপনার কথা কিছু বুঝতে পারছি না।

–বলছি, সব খুলে বলছি। প্ল্যানটা আমার নয়, তোমার বউদির। তবে আমার সম্মতি আছে। আমরা ঠিক করেছি, পাগলির বাচ্চাটাকে আমরা অ্যাডপ্ট করব।

–এটা কী করে সম্ভব?

–তুমি হেলপ করলেই সম্ভব।

– তা বলে একটা রাস্তার পাগলির বাচ্চা!

–সন্তান সন্তানই। সে যার হোক, যেখানকার হোক।

–তা নয়, আমি ভাবছি…, ইতস্তত করেও শেষ পর্যন্ত কথাটা বলে ফেলল, আমাদের দেশে একটা রাস্তার পাগলিও প্রেগন্যান্ট হয়, এর থেকে লজ্জার আর কী হতে পারে! আর এ জন্যে যে বা যারা দায়ী, শিশুটার শরীরে সেইসব পশুর রক্ত রয়েছে।

–রক্তের পরিচয় কী সব! শিক্ষা, পরিবেশ… এসবের কোনও মূল্য নেই। তাছাড়া কোনও হোম থেকে বাচ্চা অ্যাডপ্ট করলেও তার জন্ম পরিচয় আমরা জানতে পারব না। সেখানেও তো এ ধরনের পথ শিশুদেরই ঠাঁই হয়…

–আমি রক্তের পরিচয় নয়, রক্তের সম্পর্কের কথা বলছি। জিনকে তো অস্বীকার করা যায় না।

–আমরা আমাদের ভালোবাসা দিয়ে আমাদের মনের মতো করে মানুষ করে নেব। বিভাস বোঝে, সলিলদা এ বিষয়ে আর কোনও তর্ক চাইছে না। একরকম সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেছে। মাথাটা আবার টিপটিপ করতে শুরু করে তার।

–তুমি শুধু পাগলিটাকে চোখে চোখে রাখবে। দেখবে কোনও অসুবিধা না হয়। আর নিয়মিত খবরগুলো দিতে থাকবে। পারবে না?

–চেষ্টা করব। অনিচ্ছা সত্ত্বেও রাজি হল সে।

–চেষ্টা নয়, পারতেই হবে–

গৌরী বউদির গলা। দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে আবার। চোখ দুটো চিকচিক করছে। বিভাস অবাক হয়, ঠিক দেখছে তো! গৌরী বউদির চোখে জল! ভদ্রমহিলা তাহলে কাঁদতে জানে! তাও সন্তানের জন্য!

বিভাস উঠে দাঁড়ায়। দুপুর গড়িয়ে যাচ্ছে। বেরোতে হবে।

–বিষয়টা তাহলে তোমার উপরেই ছেড়ে দিলাম।

–আপনিও আর একবার ভাবুন।

কথা শেষ করে বেরিয়ে আসে বিভাস।

মাঝে মাঝে রবিদার দোকানে আসছে সলিলদা। দীর্ঘক্ষণ কাটাচ্ছে। ইতিমধ্যে রবিদার সাথে বেশ ভাব জমিয়ে ফেলেছে। রবিদাকেও জানিয়েছে বিষয়টা। রবিদা খুশি এমন একটা সিদ্ধান্তে। অকুণ্ঠ সাধুবাদ সহ সমস্তরকম সাহায্যের আশ্বাস দিয়েছে।

দোকানে খদ্দের না থাকলে পাগলিটাকে দেখতে যায় রবিদা। পাগলির সুবিধা-অসুবিধার দিকে সজাগ দৃষ্টি রাখে। সময় পেলে বিভাসও যায়। সলিলদার সিদ্ধান্ত হঠকারী মনে হলেও, তাকেও যেন কী এক নেশায় পেয়েছে। মাঝে মাঝে পার্কের ভিতরে ঢুকে যায়। খুঁটিয়ে লক্ষ্য করে পাগলিটাকে। ছেলেগুলোর সাথেও ভাব হয়েছে। সেদিনের সেই ঘটনার পর আর তারা পাগলিটাকে উত্যক্ত করেনি। বরং পাগলির সুবিধা-অসুবিধার দিকে নজর রাখছে। তবুও একটা অঘটন ঘটে গেল।

পার্কের বাইরে রিকশা স্ট্যান্ড। চালকরা মাঝে মাঝে ভিতরে গিয়ে বসে কাজের চাপ না থাকলে। তাস খেলে, গল্প গুজব করে। সেদিন কেউ একজন পাগলিকে রাগানোর জন্যে বলেছিল, তোর বাচ্চাকে নিয়ে নেব। পাগলি ইট ছুড়ে তার মাথা ফাটিয়ে দিয়েছে।

ঘটনাটা জানানোর জন্যে তখনই সলিলদার বাড়ি গিয়েছিল বিভাস। সবটা শুনে গম্ভীর হয়ে গেল সলিলদা। বউদির মুখেও দুশ্চিন্তার ছায়া।

–কাজটা কি সহজ হবে?

–দেখা যাক। সলিলদার সংক্ষিপ্ত উত্তর।

আরও একটা সংশয় কিছুদিন হল বিভাসের মনে উঁকি মারছে। পাগলিটাকে নিয়ে হয়তো একটু বেশিই ভাবছে, যা আগে কখনও কারও ক্ষেত্রে হয়নি। কাজটা কি ঠিক হচ্ছে? এতদিন সলিলদাকে বলতে সাহস হয়নি। আজ হঠাৎ আবেগের বশে বলে ফেলল, আমরা বোধহয় অন্যায় করছি।

–কীসের? সলিলদার চোখে সংশয়।

–এভাবে কারও বাচ্চা…

কথা শেষ করতে পারে না, সলিলদার চোখে চোখ পড়তেই থেমে যায়। সলিলদা কিছুক্ষণ চুপ থেকে মুখ খোলে, একটা বাচ্চা, আনওয়ানটেড বেবি, এভাবে ফুটপাথে বেড়ে উঠবে! যার ভবিষ্যৎ বলে কিছু নেই। সেটা অন্যায় নয়? তাকে ভদ্রসমাজে মানুষের মতো বাঁচার অধিকার দেওয়াটা অন্যায়?

গৌরী বউদি পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন। এবার তিনিও মুখ খুললেন, নিজেকে দিয়ে ভাবো না, তোমার মাসি যদি দায়িত্ব না নিতেন, তোমার ভবিষ্যৎ কী হতো কল্পনা করেছ কখনও? তিনি কি অন্যায় করেছেন?

–এখানে ব্যাপারটা অন্যরকম।

–কিচ্ছু অন্যরকম না। দুটি ক্ষেত্রেই নির্ভর করছে একটা শিশুর ভবিষ্যৎ। বিনিময়ে সন্তানহীনা সন্তান পাচ্ছে। তিনি তো তোমাকে তোমার মায়ের অভাব কোনওদিন বুঝতে দেননি। তার আত্মত্যাগ, ভালোবাসা… এসব অস্বীকার করতে পারবে?

স্বীকারও করেনি কোনওদিন। আসলে ভাবেইনি মনোময়ীকে নিয়ে। হতে পারে সে মনোকামিনীর বোন, গৌরী বউদির কথায় নাড়া খেল একটু। প্রসঙ্গটা মাথার মধ্যে ঘুরতে থাকল। মনোময়ী সত্যিই বিস্ময়কর।

বিভাসের বয়স তখন দু’বছর। মা মনোকামিনী বিনোদ বিশ্বাসের এক বন্ধুর সঙ্গে পালাল। আর ফেরেনি। নিঃসন্তান মনোময়ী ততদিনে বিধবা হয়েছেন। শ্বশুরবাড়ি থেকে বিতাড়িত হয়ে বাপের সংসারে। অন্যদিকে দু’বছরের শিশু সন্তান নিয়ে বিনোদ বিশ্বাসের মানসিক অবস্থাও তখন শোচনীয়। এমন সময় মনোময়ী এসে সংসারের হাল ধরেছিলেন। কোলে তুলে নিয়েছিলেন বিভাসকে। সেই থেকে এ বাড়িতে। এমন নয় যে অস্তিত্বের সংকটে তিনি একাজ করেছেন। মনোময়ীর বাবা অর্থাৎ বিভাসের দাদামশায়ের আর্থিক অবস্থাও ভালো। ইচ্ছা করলেই জীবনটা অন্যরকম হতে পারত। তবু কোন স্বার্থে তিনি এখানে রয়ে গেলেন? বিভাসকে মায়ের অভাব কোনওদিন বুঝতে দেননি। বিভাসের জন্যে তার উৎকণ্ঠা বা দুশ্চিন্তাও অস্বীকার করার মতো নয়। কীসের টানে এই ত্যাগ স্বীকার? প্রশ্নগুলো মাথার ভেতরে পাক খায়। চিনচিন ব্যথাটা টের পায় আবার।

–তোমার মাসির কথা না হয় বাদ দিচ্ছি। এবার সলিলদা। দু’জনে যেন পরিকল্পনা করে তাকে আজ ধরেছে। বললেন, কিন্তু ওই পাগলি? পাগলিটার ক্ষেত্রে কী বলবে? যে-সন্তান এখনও পৃথিবীর আলোই দেখল না, তার জন্যে এখনই একজনের মাথা ফাটিয়ে ফেলল?

বিভাস চুপ করে রইল। কথাগুলো একেবারে উড়িয়ে দিতে পারছে না। ভাবাচ্ছে। ভাবাচ্ছে বলেই সলিলদার কাছে ছুটে এসেছে সংবাদটা জানানোর জন্যে। পাগলিটাও ভাবাচ্ছে। কী এক আকর্ষণে সময় পেলেই ছুটে যাচ্ছে পাগলিটাকে দেখতে। কীসের টানে? এই মুহূর্তে মনে হল, হঠাৎই মাথায় এল ভাবনাটা, পাগলির গর্ভস্থ সন্তানের সঙ্গে কোথায় যেন তারও একটা যোগসূত্র আছে। নইলে এমন টান অনুভব করবে কেন? কিন্তু সূত্রটা ধরতে পারছে না…

পাগলির জন্যে আরও অনেক ব্যবস্থা নিয়েছেন সলিলদা। পাশের হোটেলে বলে রেখেছেন, কাজের ছেলেটা দু’বেলা শালপাতার থালায় ভাত দিয়ে যায়। এক ডাক্তার বন্ধুকে এনে দেখিয়েছে দুদিন মাঝরাতে। একদিন জোর করে দুটো ইনজেকশন দিয়েছেন তিনি। ডেলিভারির জন্যে নার্সিংহোমও ঠিক করে রেখেছেন, পেইন উঠলেই…

দিন যত এগোচ্ছে, পাগলিটার উপর তাদের সতর্ক দৃষ্টি তত তীক্ষ্ণ হচ্ছে। বিভাস যদিও মানসিক ভাবে এখনও কোনও সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি।

আরও একটা ঘটনা সেদিন খুব স্ট্রাইক করল। পার্কের এক কোণে বসে আনমনে সিগারেট টানছিল। হঠাৎ পাগলিটার গলা কানে আসতে দেখল পাগলিটা তার স্ফীত তলপেটে হাত বোলাচ্ছে আর নাকি সুরে গাইছে–

খোকা ঘুমোল পাড়া জুড়োল

বর্গি এল দেশে

বুলবুলিতে ধান খেয়েছে…

হঠাৎ বর্গির প্রসঙ্গ কেন? কথাগুলো কি তাকে উদ্দেশ্য করে। তাদের অভিসন্ধি কিছু অনুমান করেছে? যেজন্যে এখন থেকেই গর্ভস্থ সন্তানকে সাবধান করছে। নিজেকে বর্গি বলে মনে হল বিভাসের। –অন্যায়! মনে মনে আবার বিড়বিড় করল, সলিলদা অন্যায় করছে। খবরটা তাকে জানানো দরকার।

বিভাস তখনই বাইক নিয়ে ছুটল।

আর মাত্র কয়েকটা দিন। খাওয়া-ঘুম ছুটেছে সলিলদার।

খাওয়া-ঘুম ছুটেছে বিভাসের। রবিদা এখন রাতে দোকানেই থাকছে। রাতবেরাতে কিছু একটা ঘটলে সঙ্গে সঙ্গে মোবাইলে জানাবে। রবিদার মোবাইল ছিল না, সলিলদা ব্যবস্থা করে দিয়েছে। খবর পাওয়া মাত্র ছুটে আসবে। ড্রাইভারকেও সেইভাবে বলে রেখেছে।

সেদিন সন্ধ্যা থেকে আকাশের মুখ ভার। মাঝে মাঝে টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছে। মাঝে মাঝে প্রবল। রাত দশটা পর্যন্ত রবিদার দোকানে কাটিয়ে গেল সলিলদা। লক্ষণ সুবিধার নয়। যাওয়ার আগে বারবার রবিদাকে সাবধান করে গেল। বিভাসকেও বলে গেল মোবাইল খোলা রাখতে।

বাড়ি ফিরে নিশ্চিন্ত হতে পারছিল না বিভাস। রবিদাকে পুরোপুরি ভরসা করা যায় না। সন্ধ্যার পর নেশায় বুঁদ হয়ে থাকে। বৃষ্টির কারণে আজ আবার বেশি টেনেছে।

এগারোটার পর মুষলধারে নামল। প্রবল বৃষ্টির শব্দে কানে তালা লাগার জোগাড়। অস্থির পায়চারি করছিল ঘরের মধ্যে। দুর্যোগের মধ্যেই যদি কিছু একটা ঘটে যায়।

আধ ঘণ্টা হতে চলল, বৃষ্টি থামার লক্ষণ নেই। বরং বাড়ছে। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে মাঝে মাঝে। উলটোপালটা হাওয়া। আকাশ যেন ভেঙে পড়েছে। ইতিমধ্যে জল জমেছে বাড়ির সামনে। ব্যাং ডাকছে। সবমিলে অদ্ভুত একটা শব্দ। বিভাসের মনে হল, দূরে কোথাও অসংখ্য মানুষ চিৎকার করছে। কে জানে এদের মধ্যে পাগলিটাও আছে কিনা!

বিভাস আর থাকতে পারে না। দরজা খুলে বাইরে আসে। সোজা রাস্তায়। দ্রুত পা চালায় পার্কের দিকে। হাতে টর্চ। ভয় রবিদাকে নিয়ে, যদি ঘুমিয়ে পড়ে! রবিদা কী শুনতে পাবে পাগলির চিৎকার? সম্ভাব্য বিপদের আশঙ্কায় সে আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। হাঁটার বেগ বাড়িয়ে দেয় যথাসম্ভব। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তাকে পৌঁছোতে হবে।

বাড়ি থেকে পার্কের দূরত্ব মাইলখানেক। হাঁটা পথে মিনিট পনেরো-কুড়ি। অথচ পথ যেন শেষ হচ্ছে না। অন্তহীন পথ হেঁটে চলেছে সে। কতদিন, কত মাস, বছর, যুগ ধরে… কিংবা তারও বেশি সময়… তবু গন্তব্যে পৌঁছোতে পারছে না।

বিভাস দৌড়োতে শুরু করে।

বৃষ্টিতে ঝাপসা সবকিছু। সঙ্গে ঝোড়ো হাওয়া। বিদ্যুতের আস্ফালন। টর্চের আলো বৃষ্টি ভেদ করে বেশিদূর পৌঁছোয় না। মাঝে মাঝে হোঁচট খায় রাস্তার জল জমা খানাখন্দে। তবু ভ্রুক্ষেপ নেই। পাগলের মতো সে ছুটছে। ছুটতে ছুটতে যখন পার্কের কাছাকাছি, দূর থেকে বাচ্চার কান্নার শব্দ কানে আসে। তবে কী…

সন্দেহ সত্যি। রবিদা অঘোরে ঘুমোচ্ছে। সলিলদা নেই। এদিকে রবীন্দ্রনাথের পায়ের গোড়ায় সদ্যজাতের কান্না। ভিতরে ঢুকে টর্চের আলো ফেলতেই চমকে গেল। রক্তে ভাসছে চারপাশ। একপাশে বেহুঁশ হয়ে পড়ে আছে পাগলিটা, অন্যপাশে রক্তজলে মাখামাখি একতাল মাংস পিণ্ড। গলায় তীব্র চিৎকার। একটু দূরেই ওত পেতে বসে আছে দুটো রাস্তার কুকুর। চোখের তারায় লোভের ঝিলিক।

যে-কোনও মুহূর্তে ঝাঁপিয়ে পড়বে। এমন বীভৎস দৃশ্যের মুখোমুখি আগে কখনও হয়নি। শিউরে উঠল সে। অস্ফূটে কাতরে উঠল, মাগো–

বহু বছর বাদে সে ‘মা’ শব্দটা উচ্চারণ করল। নিজের অজ্ঞাতেই। তারপর টর্চ হাতে তেড়ে গেল কুকুর দুটোর দিকে। যে-কোনও মূল্যেই হোক এদের সে রক্ষা করবে। নইলে সে নিজের কাছেই মিথ্যে হয়ে যাবে। মিথ্যে হয়ে যাবে তার অস্তিত্ব।

 

অন্য নদীর গল্প

অফিস থেকে বাড়ি ফিরে আসবার সঙ্গে সঙ্গে মা বলল, ‘শৌভিকের একটা চিঠি এসেছে, রেজিস্ট্রি পোস্টে। পিওনটা মহা পাজি, আমাকে কিছুতেই দিতে চাইছিল না। অনেক করে বলবার পর দিল।’ রেজিস্ট্রি পোস্টের ব্যাপারটা শুনেই আমার একটু খটকা লাগল। এই তো দিন সাতেক আগে ওর সাথে ফোনে কথা হল। শুধু বলল, ‘বাড়িতে একটা ছোটো অনুষ্ঠান হবে, ইনভাইট করব।’ কিন্তু সেদিনও তো চিঠির ব্যাপারে কিছু বলেনি।

শৌভিক আমার কলেজের বন্ধু। আমরা দুজন কলেজ থেকে ইউনিভার্সিটি পর্যন্ত একসঙ্গে থেকেছি, খেয়েছি, পড়েছি। আমাদের দুজনের বাড়িও কাছাকাছি ছিল। আমি থাকতাম তেঘড়িয়া, আর ওরা কেষ্টপুরে। এখন অবশ্য ওরা এক নম্বর গেটের কাছে নতুন বাড়ি কিনেছে, আর আমাকে আসতে হয়েছে বীরভূম জেলার এক গ্রামে। শৌভিক চাকরির চেষ্টা করেনি। ইউনিভার্সিটি থেকে বেরিয়ে পারিবারিক ব্যাবসার খুঁটি ধরে বেশ জাঁকিয়ে বসেছে। ওর দাদার আবার পারিবারিক ব্যাবসা ছাড়াও আরও কী সব ব্যাবসা রয়েছে। তাদের বউরাও পারিবারিক ব্যাবসাতে সাহায্য করে। ওর দাদার এক মেয়ে, পড়াশোনার সূত্রে বাইরে থাকে। শৌভিকের এখনও পর্যন্ত সন্তান হয়নি। বাড়িতে একা থাকে শৌভিকের মা। কাকু বছর তিন আগে মারা যান।

কলেজ বা ইউনির্ভাসিটিতে পড়বার সময় প্রায় দিনই সময়ে অসময়ে ওর বাড়ি চলে যেতাম, কতদিন ওদের বাড়িতে থেকেছি, খেয়েছি তার হিসেব নেই। এখন অবশ্য আর সেরকম ভাবে ওদের বাড়িতে থাকা হয় না, সেরকম ভাবে কেন বলব, একরকম হয়ই না। ইউনিভার্সিটির পাঠ শেষ হওয়ার পরের কয়েক বছর বেকারত্বের জ্বালা রগড়াতে রগড়াতে সরকারি চাকরি পেলাম। তবে খুব ভালো চাকরি নয়, পঞ্চায়েত অফিসের সহায়কের চাকরি। প্রথম সপ্তাহে বাড়ি থেকে যাতায়াত করলাম। কিন্তু সপ্তাহের শেষে মনে হল, এই তেঘড়িয়া থেকে বাসে বাদুড় ঝুলে হাওড়া স্টেশন, সেখান থেকে ট্রেনে বোলপুর স্টেশন, তারপর বাস থেকে নেমে সাইকেল, এত সবের পর অফিস করে বাড়ি ফিরতাম প্রায় জাম্বি হয়ে। কোনওদিন আটটা বাজত, কোনওদিন নটা। তারপর কারওর ভালো কথাও খারাপ লাগত।

আমার বাবার কোনও ব্যাবসা ছিল না। বাবাও আমার মতো সরকারি কর্মচারি ছিল, তবে কেন্দ্রীয়। চাকরি জীবনে সংসার খরচ, আমাদের দুই ভাইয়ের পড়াশোনার খরচ বাদ দিয়ে যে-ক’টা টাকা বাবা জমাতে পেরেছিল, তা দিয়ে একতলার এই বাড়িটা ছাড়া আর কিছু হয়নি। তাও আবার চাকরি শেষ হবার ছয়মাস আগে কাউকে কিছু না বলে, বাবা চলে গেল। আমি, দাদা পিতৃহারা হলাম। দাদার পড়াটা সেই সময় শেষ হয়ে গেছিল। কিন্তু দাদা স্থানীয় একটি রাজনৈতিক সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েছিল। কম্পিউটার নিয়ে পড়াশোনা করবার সুবাদে দাদা বিভিন্ন কোম্পানিতে চাকরির জন্য ইন্টারভিউ দিচ্ছিল। সেই অবস্থাতেই বিশেষ প্রভাব খাটিয়ে একটি বড়ো কোম্পানির চেন্নাই অফিসে পোস্টিং নিয়ে দাদা চলে গেল। ফোন করত, চিঠি লিখত, কিন্তু মায়ের মন তো, চোখের আড়াল হলেই চোখের জল ফেলত। আমি আমার সাধ্যমতো চেষ্টা করলেও খুব বেশি বোঝাতে পারতাম না। এর মধ্যেই আমার বেকারত্বের জ্বালা আরম্ভ হল। একই বাড়িতে থেকেও কিছুটা অসামাজিক হয়ে পড়লাম। নিজের চাকরির পরীক্ষার প্রস্তুতির মধ্যে, কোথা দিয়ে যে সময় চলে গেল বুঝতেই পারলাম না। এই সময় মা আরও একা হয়ে গেলেও আমার কিছু করবার ছিল না। মাঝে মাঝে শৌভিকদের বাড়িতে কাকিমাকে দেখলেই নিজের মায়ের কথা মনে পড়ে যেত।

শৌভিকদের বড়ো বাড়ি, তবে সবাই ব্যস্ত, ব্যতিক্রম শুধু কাকিমা। বয়সে কাকিমা মায়ের থেকে কয়েক বছরের বড়ো। ওদের বাড়িতে গেলেই কাকিমাকে দোতলার ব্যালকনিতে বসে থাকতে দেখতাম। ‘কেমন আছো?’ জিজ্ঞেস করলেই, এক বুক হতাশা নিয়ে বলত, ‘এই বাড়িটার মতো।’

তারপরেই কাকু মারা যাওয়ার পরে কীভাবে শূন্যতা, একাকিত্ব, কাকিমাকে গ্রাস করেছিল, তার বর্ণনা দিতে আরম্ভ করত। আমার তখনই নিজের মায়ের কথা মনে পড়ে যেত।

বাড়ি ফিরে মায়ের পাশে বসে কিছুক্ষণ গল্প করতে ইচ্ছে করত, করতামও। সেই দিন থেকে পরের কয়েকটা দিন নিয়ম করে বসে গল্প করবার মাধ্যমে মায়ের সাথে সময় কাটাতাম।

কয়েক দিন পরেই অবশ্য মা বলে উঠত, ‘তুই তোর পড়াশোনা কর, আমি ঠিক আছি।’ আমি আবার বাধ্য ছেলের মতো পড়াশোনাতে মন দিতাম।

এমনি ভাবেই চলছিল। তারপরেই চাকরি পেলাম। অফিসের কাছে একটা বাসা দেখে মাকে বললাম, ‘কাজের খুব চাপ, এবার থেকে আমার বাড়ি ফিরতে রাত্রি বারোটা, একটা হতে পারে।’

ভীতু মনের মা সঙ্গে সঙ্গে জিজ্ঞেস করল, ‘ওখানে থাকবার কোনও ব্যবস্থা করতে পারবি না? না হলে তো তুই অসুস্থ হয়ে যাবি।’

আমি একটা বাড়ি নেওয়ার কথা জানাতেই মা বলে উঠল, ‘তাহলে তো আর অসুবিধা নেই। তুই ওখানেই চলে যা। আগে তো তোর শরীর।’

জিজ্ঞেস করলাম, ‘আর তুমি? তোমারও তো বয়স বাড়ছে।’

তুই আমার কথা ভাবিস না। আমি ঠিক থাকব। তাছাড়া চুয়ান্ন বছর বয়সটা কোনও বয়স নয়, তোর কাছে মাঝে মাঝে গিয়ে তো থাকব। বুকুর কাছেও চলে যাব।

তার থেকে তুমিও আমার সঙ্গে চলো। এই ঘরটা তালাবন্ধ থাক। শনি, রবি তো আমার ছুটি, চলে আসব। তাছাড়া আরও তো ছুটি আছে, ছুটি থাকলেই এখানে চলে আসব।

তা হয় না, এটা তোর বাবার তৈরি বাড়ি। এখানে আশেপাশের সবাই আমাকে চেনে। প্রয়োজনে বিপদে আপদে আমার পাশে দাঁড়াতে পারবে। তাছাড়া তোর বাড়িতে থাকলেও সারাটা দিন তো তুই অফিসে থাকবি। আমাকে ঘরের মধ্যে ভূতের মতো একাই থাকতে হবে। ওখানে একা থাকবার থেকে এখানে একা থাকাটাই ভালো।

এরপর আমি আর কোনও কথা না বলে, আমার নেওয়া বাড়িতে চলে গেলাম। প্রথম প্রথম একাই রান্না বা অন্য কাজকর্ম করতাম। মাস দেড় পরে একটা রান্না করবার ছেলে পেলাম। ছেলেটি প্রতিদিন সকাল সন্ধে রান্না করে দিয়ে যেত। আমি রবিবার রাত্রে বাড়ি থেকে অফিসের গ্রামে চলে এসে আবার শুক্রবার কোলকাতা ফিরে যেতাম। থাকল একা মা, আর বাবার তৈরি করা বাড়ি।

এমনিভাবেই পাঁচ মাস কাটল। এই পাঁচ মাসে চাকরির জায়গায় বেশ সুনাম অর্জন করলাম। প্রধান থেকে পার্টির স্থানীয় নেতাদের সাথে সখ্যতা বাড়ল। সেই সঙ্গে নতুন আরেক উপদ্রব আরম্ভ হল। অবশ্য এই উপদ্রবে শরীর মন, ভবিষ্যতের এক অলীক আনন্দের জন্য বেশ শিহরিত হয়ে উঠত। কিন্তু মা, দাদা জীবিত, তাই এই ব্যাপারে নিজেই কোনও সিদ্ধান্ত নিয়ে নিতে আমার মরালিটিতে বাধল। দাদা তখনও পর্যন্ত সংসার করেনি।

এই সব সাতপাঁচ ভেবেই মায়ের অনিচ্ছা সত্ত্বেও, আমার বাড়িতে কয়েকদিনের জন্যে মাকে নিয়ে এলাম। দুদিনের মাথায় শৌভিকের এই চিঠি।

হাত মুখ ধোয়ার আগেই খাম খুলে চিঠিটা বের করে পড়লাম। মা পাাশ থেকে জিজ্ঞেস করল, ‘কী লিখেছে?’

‘সামনের শনিবার ওদের বাড়িতে নিমন্ত্রণ করেছে। অবশ্যই যাওয়ার জন্য লিখেছে। তোমাকেও নিয়ে যেতে বলেছে।’

আমি জানি, মা শেষের কথাগুলো শোনেনি। এত তাড়াতাড়ি কলকাতাতে ফেরার কথা শুনে, মনে মনে বেশ খুশি হয়ে গেছে। বুঝলাম যে-কাজে মা এসেছিল সেটা এবারে খুব বেশি দূর এগোতে পারবে না। সেই শনিবার আমি একাই সন্ধেবেলা শৌভিকদের বাড়ি পৌঁছলাম। আগেই জানতাম, বাড়িতে কিছু একটা উৎসব হচ্ছে। এটা অবশ্য নতুন কিছু নয়। ওরা প্রায় দিন বিভিন্ন কারণে উৎসব করে, তা সে নিজেদের বিবাহবার্ষিকী হোক, বা ছেলে মেয়েদের জন্মদিন, ওদের বাড়ি আলোতে সেজে ওঠে, সেই সঙ্গে এলাহি খাওয়াদাওয়া। শৌভিকদের বাড়িতে কোনও অনুষ্ঠান মানেই, আমার নিমন্ত্রণ পাকা। মায়েরও থাকে, তবে মা, সব অনুষ্ঠানে যায় না।

শৌভিকদের বাড়ি পৌছনো মাত্রই বউদি এগিয়ে এসে আমাকে ঘরের ভিতর নিয়ে গেল। আমি বউদিকে বললাম, ‘আমাকে যে শৌভিক এমনি আসতে বলল। কিন্তু তোমাদের বাড়িতে তো দেখছি বড়ো কিছু অনুষ্ঠান হচ্ছে। আমি কিন্তু কী অনুষ্ঠান কিছুই জানি না, কোনও কিছু উপহার আনতে পারিনি।’

আমার কথা শেষ হওয়ার আগেই শৌভিকের বউদি বলে উঠল, ‘আমরা এই অনুষ্ঠানের বিষয়ে কাউকে বলিনি। সবাইকে অবাক করে দেওয়ার জন্যেই শুধু চিঠি দিয়ে নিমন্ত্রণ করলেও কী অনুষ্ঠান সে বিষয়ে কিছুই জানানো হয়নি। আর তুমি তো আমাদের ঘরের লোক, তুমি আবার উপহার কি আনবে?’ আমি আর কথা না বাড়িয়ে খাওয়াতে মন দিলাম।

নিমন্ত্রিতদের সংখ্যা খুব বেশি নয়। একশো দশ পনেরো হবে। আমার তো সবাইকে মনে হল আমারই মতো অবাক হওয়াদের দলে।

কিছু সময় পরে শৌভিকের সাথে দেখা হল। মা, না আসবার কারণ জিজ্ঞেস করতেই শৌভিক বলল, ‘আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করো ব্রাদার উত্তর পেয়ে যাবে।’

অন্য সব অনুষ্ঠানের মতো এবারেও ওদের বাড়িতে খাবারের অঢেল আয়োজন। সেইসব খাবার টুকটাক খেতে খেতে অন্য সবার সাথে কথা বলছি, এমন সময় শৌভিকের দাদা মাঝখানে দাঁড়িয়ে আমাদের সবাইকে অনুষ্ঠানে আসবার জন্য ধন্যবাদ জানাল।

আমাদের মধ্যে থেকে একজন বলে উঠল, ‘আরে, আমরা তো কেউই কোন অনুষ্ঠানে এসেছি, সে সব কিছুই জানি না, সেটা আগে বল।’

দাদা মুচকি হেসে আমাদের আরও কিছুসময় অপেক্ষা করতে বলে ভিতরে চলে গেল।

অবশ্য আমাদের খুব বেশি সময় অপেক্ষা করতে হল না, কিন্তু তারপর যা দেখলাম, প্রথমে আমার নিজের চোখ দুটোকেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। এরকম কিছু একটা দেখব, তা স্বপ্নেও ভাবিনি। আমার মতো যারা নিমন্ত্রত হয়ে এসেছিল, তারা প্রায় সকলেই কয়েকটা মুহূর্তের জন্য বাকরুদ্ধ হয়ে গেল। একটা চাপা গুঞ্জনও আরম্ভ হল।

আমি কারওর সাথে কোনও কথা আলোচনা না করলেও সব কিছু দেখে অবাক হয়ে গেলাম। চোখ বন্ধ করলেও ভেসে উঠল একটাই ছবি, কনের সাজে কাকিমা, পাশে ষাটোর্দ্ধ এক ভদ্রলোক, সঙ্গে শৌভিকদের বাকি সবাই।

মা একা থাকবে বলে, আমি বেশিক্ষণ থাকতে পারলাম না। অল্প একটু খেয়ে, মায়ের জন্যে খাবার পার্সেল করে তাড়াতাড়ি বাড়ির দিকে পা বাড়ানোর প্রস্তুতি নিলাম। শৌভিকের থেকে বিদায় নেওয়ার সময় জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী করে সব হল?’

শৌভিক খুব স্বাভাবিক ভাবেই বলল, ‘তুই তো জানিস, আমরা সবাই ব্যাবসা নিয়ে ব্যস্ত থাকি। দাদার মেয়েটাও হস্টেলে। একা থাকতে থাকতে মা ডিপ্রেশনের পেশেন্ট হয়ে যাচ্ছিল। আর কয়েক দিন চললে অন্য রকম বিপদ হয়ে যেতে পারত। ডাক্তার দেখালাম। ডাক্তার বললেন, কম্পানির প্রয়োজন। কিন্তু আমাদের মধ্যে সেরকম কে কম্পানি দেবে বলতো? একটা আয়া ঠিক করলাম। মায়ের সাথে সবসময় থাকত, তার সাথেই মর্নিংওয়াকে বের হতো। এই মর্নিংওয়াকের সময় কাকুর সাথে আলাপ পরিচয়। মায়ের সাথে বন্ধুত্ব হল। বাড়িতে কাকু আসতে লাগলেন। দেখলাম কাকু বাড়িতে আসাতে মা বেশ হাশিখুশি থাকত, সাজগোজ করত। একদিন কাকুই প্রস্তাবটা মাকে দিলেন। মা প্রথমে আপত্তি করেছিল। কাকু তখন দাদার সাথে কথা বলেন। এরপর আমরা সবাই আলোচনা করতে বসি। আলোচনাতে অনেক কিছু কনফিউশন মিটিয়ে তারপর এই অনুষ্ঠান।’

শৌভিক সেদিন ব্যস্ত ছিল। আমাকে বলল, ‘পরে আরেকদিন আসবি, চুটিয়ে আড্ডা দেব।’ তারপরেই ওদের সবাইকে বিদায় জানিয়ে, মোবাইলে কাকিমা আর নতুন কাকুর একটা ছবি তুলে, বাসস্ট্যান্ডের দিকে পা বাড়াতেই, কানে এল নিমন্ত্রিতদের মধ্যে মাঝবয়সি এক মহিলা মোনোপজ সংক্রান্ত আলোচনা করতে করতে গাড়িতে উঠছে।

আমাদের হয়তো সব বয়সেই বিশেষ কারওর কম্পানির প্রয়োজন হয়। অনেক সময় এই কম্পানি ছেলে, মেয়ে, নাতি, নাতনি দিয়ে পূরণ করা যায় না। আমরা এত কিছু বুঝি না, বুঝতে চাইও না। ইনফ্যাক্ট আমার নিজের মায়ের ব্যাপারেও এতসব ভাবার প্রয়াজন আছে বলে, মনে করিনি। এমনকী মায়ের কাছে গেলে এরপরেও অন্য কিছু ভাবব।

বাড়ি ফিরতেই মা জিজ্ঞেস করল, ‘কিরে, শৌভিকদের বাড়িতে কী ছিল?’

আমি খুব স্বাভাবিক ভাবেই বললাম, ‘কাকিমার বিয়ে।’

‘কী বাজে বকছিস! বড়োদের নিয়ে কেউ এমনি কথা বলে?

মা রেগে গেল। আমি সঙ্গে সঙ্গে মাকে সবকিছু ভালো ভাবে বলে, কিছুক্ষণ আগে মোবাইলে নেওয়া কাকিমাদের ছবিটা দেখালাম। মা সব কিছু দেখে কোনও কথা না বলে নিজের ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ল। আমি জামাকাপড় বদলে একটু ইতস্তত করে মায়ের ঘরে গিয়ে বললাম, ‘ঘুমোলে?’

মা শুয়ে শুয়েই উত্তর দিল, ‘না, কিছু বলবি?’

‘দাদাকে একটা ফোন করব?’

‘কেন?’

‘না, মানে তুমিও তো একা থাকো, তাই ভাবছিলাম…’

মা কিছু সময় চুপ করে শুয়ে থাকল। আমিও আর কোনও কথা না বলে আস্তে আস্তে মায়ের ঘর থেকে বের হওয়ার জন্যে পা বাড়াতেই মা বলল, ‘বুকু আজ ফোন করেছিল, পরের সপ্তাহে আসছে।’

 

চোরাবালি

গ্যাসে পাউরুটি সেঁকতে সেঁকতে স্ত্রী অনসূয়ার কথাই ভাবছিল দেবল। পনেরো দিন হল বাপের বাড়ি গিয়েছে অনু, আর এরই মধ্যে হাঁপিয়ে উঠেছে সে। কটা মাস কীভাবে কাটাবে জানা নেই দেবলের।

মা হতে চলেছে অনু। বিয়ের পর বাপের বাড়িতে মাত্র তিনবারই যেতে পেরেছে সে। দেবলকে একা রেখে যেতে কিছুতেই মন চায় না অনুর। এবার দেবলই একপ্রকার জোর করে অনুকে বাপের বাড়ি পাঠিয়েছে। ওখানে থাকলে অনুর ঠিকমতো দেখাশোনা হবে। অফিস থেকে দেবলের ফেরার কোনও ঠিক থাকে না। এতক্ষণ এই অবস্থায় অনুকে বাড়িতে একা রাখতে দেবলের মন সায় দেয়নি। তাছাড়া ডাক্তারের কথামতো এইসময় একটু বিশেষ যত্নেরও প্রয়োজন  অনুর।

যথারীতি রোজকার মতো ডিম-পাউরুটি দিয়ে ব্রেকফাস্ট সেরেই, দেবল অফিস পেঁছোল। লাঞ্চটা আজকাল বাইরেই সারে। অনু থাকতে টিফিন প্যাক করে ব্যাগে ভরে দিত। সারাদিন অফিসে কাটিয়ে বাড়ি যখন ফিরল দেবল, নিজেকে অসম্ভব ক্লান্ত মনে হচ্ছিল। জিরিয়ে নিতে সোফায় এসে বসল। ক্লান্তিতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছে খেয়াল নেই। ঘুম ভাঙল ফোনের একনাগাড়ে বেজে চলা ক্রিং ক্রিং শব্দে। অনুর ফোন। তাড়াতাড়ি উঠে বসল হ্যালো।

এত দেরি হল ফোন ধরতে? নিশ্চয়ই ঘুমিয়ে পড়েছিলে? এক কাজ করো বাইরে থেকে খাবার আনিয়ে নাও। বাড়িতে কিছু আর করতে হবে না, চিন্তিত লাগল অনুকে।

অনু ফোন ছেড়ে দিলে হাতমুখ ধুয়ে দেবল ফ্রেশ হয়ে নিল। সবে ফোনটা নিয়ে খাবারের অর্ডার দিতে যাবে, কলিংবেলটা বেজে উঠল। মনে মনে বিরক্ত হল, এই সময় কে আবার এল?

দরজা খুলতেই দেখল তিরিশ-বত্রিশ বছর বয়সি একটি তরুণী দরজায় দাঁড়িয়ে ফরসা, বেশ সুন্দরী। এক মুখ হাসি লেগে রয়েছে ঠোঁটের কোণায়।

আপনি?

আমি মিতা, আপনাদের ঠিক উপরের ফ্লোরেই থাকি।

কিন্তু আপনাকে তো আমি কোনও দিন…

দেবলের কথা শেষ হওয়ার আগেই মিতা বলে উঠল, হ্যাঁ, আপনি আমাকে চেনেন না। কিন্তু আমি আপনাকে চিনি। অনুর হাজব্যান্ড আপনি। অনু ডেলিভারির জন্য বাপের বাড়ি গেছে।

মিতার কথা শুনতে শুনতে একটা কথাই দেবলের মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগল, ওদের সম্পর্কে মহিলা এত কথা কী করে জানলেন? এছাড়াও একই বিল্ডিং-এ থেকেও কী করে দেবল মহিলাকে চেনে না?

এত চিন্তা করতে হবে না। মাত্র একমাস আগেই এখানে শিফট হয়েছি আমি। কিছুই খবর রাখেন না দেখছি। আগে যারা থাকত তাদের জায়গায় এসেছি। অবশ্য আপনি সকালে অফিস বেরিয়ে যান, ফেরেন দেখি সেই সন্ধেবেলায়। আর আমাকে কী বাইরেই দাঁড় করিয়ে রাখবেন? ভিতরে আসতে বলবেন না?

ওহ! সরি, প্লিজ ভিতরে আসুন। দেবল মিতাকে বসার ঘরে সোফায় এনে বসায়।

সারাক্ষণ বাড়িতে দমবন্ধ হয়ে আসে না আপনার? বড়ো শহরের এই এক অসুবিধা। অন্যান্য সুবিধা তো প্রচুর আছে কিন্তু জায়গা অত্যন্ত সীমিত আর লোকগুলোও বড়ো স্বার্থপর। নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকে। অপরের জন্য কোনও সময় নেই।

মিতার কথা শুনে দেবল হেসে ফেলে।

আরে আমি আপনার খাবার নিয়ে এসেছি। কথায় কথায় সেটা দিতেই ভুলে গেছি, বলে মিতা হাতে রাখা কাপড় ঢাকা থালাটা সোফার সামনেই টেবিলে নামিয়ে রাখল।

খাবার দেখে অস্বস্তি বোধ করছিল দেবল। কিন্তু কিছু বলার আগেই মিতা বলে উঠল, আমি জানি আপনি বলবেন এসবের কী দরকার ছিল? আরে আমি নিজের জন্য খাবার বানাচ্ছিলাম ভাবলাম, আপনারটাও বানিয়ে নিই।

মিতাকে হাসতে দেখে দেবলও মুখে হাসি টেনে আনে।

কথায় কথায় দেবল জানতে পারে, মিতা লখনউ-এর মেয়ে ওর স্বামী দুবাইতে ব্যাবসা করেন। এতদিন ওখানেই ছিল মিতা কিন্তু নিজে কিছু করবে ভেবে দেশে ফিরে আসে। এখানে একটি এনজিও-র সঙ্গে যুক্ত সে।

ঠিক আছে আজ চলি। বাসনের চিন্তা করবেন না। সকালে এসে আমি নিয়ে যাব। মিতা চলে গেল। দেবল একদৃষ্টে মিতার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে চিন্তায় ডুব দিল।

সকালে বাসন নেওয়ার অছিলায় গরম গরম আলুর পরোটা আর এক বাটি দই জোর করে ধরিয়ে দিয়ে গেল দেবলের হাতে। দেবল প্রতিবাদ করলে, মিতা বলল, দেবলকে দেখে ওর মৃত দাদা অক্ষয়ের কথা মনে পড়ে যায়। সুতরাং দেবল কিছুই আর বলে উঠতে পারে না।

 

এরপর থেকে রোজই কিছু না কিছু খাবার বানিয়ে দিয়ে যেতে আরম্ভ করে মিতা। অনু কিছু ভুল না ভেবে বসে, এই ভেবে বলব না বলব না করেও, শেষমেশ সবকিছু খুলে বলে দেবল।

সব শুনে অনু বলে, হ্যাঁ মনে পড়েছে, আমার এখানে চলে আসার আগেই ভদ্রমহিলা ওখানে শিফট করেন। অল্পবিস্তর আলাপ হয়েছিল। যাক বাড়ির তৈরি খাবার পাচ্ছ, আমি নিশ্চিন্ত। কিন্তু দেখো ওই খাওয়া অবধি, ওর থেকে বেশি কিন্তু এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা কোরো না। নিজের রসিকতায় অনু নিজেই হেসে ওঠে।

কখনও পোলাও-মাংস তো কখনও লুচি-তরকারি আবার কখনও সাদামাটা ঘরোয়া খাবার রোজই কিছু না কিছু দেবলের কাছে আনা আরম্ভ করল মিতা। কিছু বললেই বলে, আপনার জন্য আমারও তো খাওয়া হচ্ছে।

এত কিছু খেয়ে ফিট থাকেন কী করে বলুন তো? জিজ্ঞেস করেই বসে দেবল।

কেন, রোজ হাঁটা এবং জিম দুটোই করি নিয়ম করে।

বাঃ, তাহলে চলুন কাল থেকে আমিও আপনাকে সঙ্গ দেব, দেবল বলে।

উৎফুল্ল হয়ে ওঠে মিতা। এরপর রোজই সকালে দুজনে একসঙ্গে হাঁটতে বেরিয়ে যেত আর সন্ধেবেলায় জিম যাওয়াটা ওদের রুটিন হয়ে দাঁড়াল।

ধীরে ধীরে মিতা আর দেবলের বন্ধুত্ব গাঢ় হয়ে উঠতে লাগল। বিশ্বাস থেকে মিতার উপর একটা নির্ভরতা গড়ে উঠল। কথায় কথায় একদিন আগত সন্তানকে নিয়ে স্বপ্ন দেখার কথা শেয়ার করছিল দেবল, খেয়াল করল মিতা কিছুটা উদাস। কারণ জিজ্ঞেস করতে দেবল জানতে পারল, ডাক্তাররা নাকি জানিয়ে দিয়েছেন, মিতা কোনও দিনও মা হতে পারবে না। তবে ওদের স্বামী-স্ত্রীর ইচ্ছে কোনও অনাথ শিশুকে নিয়ে এসে মানুষ করা। এটা জানার পর মিতার প্রতি দেবলের মনে সম্মানের জায়গাটা আরও বেড়েছে।

সেদিন বিকেল থেকেই বৃষ্টি। আকাশ কালো করে শুধু মেঘের গর্জন। ছুটির দিন। অনুর কথা খুব মনে হচ্ছিল দেবলের। ও যদি বাড়িতে থাকত এই বৃষ্টির মরশুমে ছুটত গরম গরম পকোড়া ভাজতে। থালা ভরে দেবলের সামনে এনে রেখে দিত। নিজের হাত পুড়িয়ে পকোড়া ভাজতে মন চাইল না দেবলের। বিকেলে বারান্দায় দাঁড়িয়ে বৃষ্টিভেজা প্রকৃতির সৌন্দর্যে  বুঁদ হয়ে রইল।

ফোনটা বাজতেই চিন্তায় ছেদ পড়ল। মিতার ফোন, পকোড়া বানাচ্ছি। চলে আসুন আমার ফ্ল্যাটে।

যাক বাঁচা গেল। সত্যিই খুব পকোড়া খেতে ইচ্ছে করছিল। আমি এখনই আসছি, বলে দেবল ফোন ছেড়ে দিল।

মিতার ফ্ল্যাটে পৌঁছোতেই সঙ্গে সঙ্গে প্লেট ভর্তি করে পকোড়া হাজির। দেবলকে বসিয়ে মিতা পকোড়ার সঙ্গে গরম গরম চা বানিয়ে আনল। চা আর পকোড়ার সঙ্গে ওদের আড্ডাও বেশ জমে উঠল।

হঠাৎ-ই খেয়াল হল বাইরে বেশ অন্ধকার হয়ে গেছে।, আড্ডা মারতে মারতে খেয়ালই হয়নি। উঠব উঠব করেও কিছুতেই ওঠা হয়ে উঠছিল না। মাথাটাও কেমন জানি ঘুরছে বলেই মনে হল দেবলের। মিতা জোর করল, ডিনার খেয়ে যেতে হবে। বারণ করা সত্ত্বেও কথা কানে তুলল না মিতা। রান্নাঘরের দিকে চলে গেল।

হেঁটে একটু হাত-পাগুলো ছাড়িয়ে নিতে ইচ্ছে হচ্ছিল দেবলের। সেই কখন থেকে এক ভাবে সোফায় বসে আছে। উঠে দাঁড়াতেই মাথাটা জোরে ঘুরে গেল দেবলের। চারপাশটা অন্ধকার হয়ে এল। জ্ঞান হারিয়ে সোফায় লুটিয়ে পড়ল দেবল।

খানিক পরে মিতা এসে ঘরে ঢুকল। দেবলের ওই অবস্থা দেখে ঠোঁটের কোণায় হাসি ফুটে উঠল। কোনও ভাবে টানতে টানতে দেবলের বেহুঁশ শরীরটাকে শোবার ঘরে এনে বিছানায় শুইয়ে দিল। নিজেকে আয়নায় ভালো করে দেখল মিতা। যে-কোনও পুরুষমানুষের হুঁশ উড়ে যাওয়ার মতোই রূপ। ঘরের আলো নিভিয়ে দেবলের পাশে এসে শুয়ে পড়ল মিতা।

 

পরদিন সকালে ঘুম ভাঙতেই লক্ষ্য করল দেবল, মিতার নগ্ন শরীরটাকে ও বাহুবন্ধনে শক্ত করে জড়িয়ে রেখেছে। এ কী করে সম্ভব? চমকে উঠে বসল দেবল। ঘটনাস্রোত মনে করার চেষ্টা করল কিন্তু সব অন্ধকার।

ততক্ষণে মিতাও উঠে বসেছে। চাদর দিয়ে ঢেকে নিয়েছে নিজেকে। দেবলের বিস্ফারিত দুই চোখের দিকে তাকিয়ে অশ্রুসজল হয়ে উঠল ওর দুই চোখ। দেবলের দিকে তাকিয়ে বলল, কাল রাতে কী হয়েছিল তোমার? এর আগে কখনও এভাবে জবরদস্তি করোনি। আমি তোমাকে বিশ্বাস করেছিলাম। কাল রাতে তোমার শরীরের জোরের সঙ্গে আমি পেরে উঠিনি।

লজ্জায় চোখ তুলে তাকাতে পারল না দেবল। নিজের প্রতি নিজেরই ঘেন্না হল। যে ওকে দাদার আসনে বসিয়েছিল, তাকেই ও নিজের বাসনার শিকার করল। এই ভুল ও কী করে করল? যে কিনা কোনও দিন অন্য মহিলাদের দিকে চোখ তুলে তাকায়নি পর্যন্ত। ভুল করে ফেলেছে, কী করেই বা সেটা শুধরানো যায়?

দেবলের ইচ্ছে হচ্ছিল ফোন করে মিতার কাছে ক্ষমা চায় কিন্তু সাহসে কুলোল না। মিতা ফোন করা পুরোপুরি বন্ধ করে দিয়েছিল। দেবলের ভয় করতে লাগল, মিতা যদি ওর উপর ধর্ষণের অভিযোগ নিয়ে আসে তাহলে অনু আর সমাজের সামনে কী করে সে মুখ দেখাবে? ফোনে অনুর সঙ্গে রোজই কথা হতো দেবলের কিন্তু এই ঘটনার কথা দেবল কিছুতেই অনুকে বলতে পারল না।

 

একদিন হঠাৎ নিজে থেকেই মিতা এসে হাজির হল দেবলের কাছে। দেবল ওকে দেখেই আমতা আমতা করে বলে উঠল, মিতা আমিই তোমার কাছে আসতাম ক্ষমা চাইতে।

কীসের ক্ষমা দেবল? সেদিনের ঘটনায় না তোমার দোষ ছিল আর না আমার। ঘটনাটা হওয়ার ছিল হয়ে গেছে। দুর্ঘটনা ভুলে যেতে পারলেই ভালো। আমি মন থেকে ওটা মুছে ফেলেছি।

মিতার কথা শুনে দেবলের মধ্যে যেন প্রাণ এল। মনে হল, সত্যিই মিতার মতো মেয়ে হয় না!

দেবল, আমি একটা অন্য কাজে তোমার কাছে এসেছি। হঠাৎ আমার কিছু টাকার দরকার হয়ে পড়েছে। এই মুহূর্তে এত টাকা আমার কাছে নেই। আমি তাড়াতাড়িই তোমাকে টাকাটা ফিরিয়ে দেব, বলে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে মিতা দেবলের দিকে তাকাল।

কত টাকা?

পঞ্চাশ হাজার। টাকা এসে গেলেই আমি তোমার টাকা ফিরিয়ে দেব, দেবলের চোখে চোখ রাখে মিতা।

দোষী দোষ ঢাকতে কী না করে? যখন-তখন প্রযোজনের জন্য বাড়িতে চল্লিশ হাজার মতো রেখেই দেয় দেবল। সেই টাকাটাই বার করে এনে মিতার হাতে তুলে দিয়ে বলল, এই মুহূর্তে আমার কাছে চল্লিশ হাজারই আছে মিতা। টাকাটা দিয়ে দেবলের মনে হল, কিছুটা হলেও ওর অপরাধের বোঝা হালকা হয়েছে।

 

সেই শুরু। এরপর থেকে মাঝেমাঝেই মিতা কখনও দশ-বিশ হাজার টাকা দেবলের কাছে চাইতে শুরু করল। দিয়ে দিত দেবল, কিন্তু কত দিন? কুবেরের ধন নেই ওর কাছে! সুতরাং একদিন দেবলকে না বলতেই হল মিতার মুখের উপর। মিতাও চুপ করে থাকল না।

না শোনার অভ্যাস নেই মিতার। ফোঁস করে উঠল। তুমি কী ভেবেছ দেবল? ওই রাতের ঘটনা আমি ভুলে গিয়েছি? সেদিন তুমি যা কিছু করেছ তার সব প্রমাণ আমার কাছে আছে। দেখতে চাও? বলে নিজের ফোনে রেকর্ড করা পুরো ভিডিও-টা তুলে ধরল দেবলের সামনে। ভিডিও-তে পরিষ্কারই দেখা যাচ্ছে দেবল মিতার সঙ্গে জবরদস্তি করার চেষ্টা করছে আর মিতা ওর হাত থেকে নিজেকে বাঁচাবার চেষ্টা করছে। সবকিছু দেখে ঘেমে উঠল দেবল।

কী বলো দেবল? ভিডিও-টা নিয়ে পুলিশের কাছে যাব, না সোশ্যাল প্ল্যাটফর্মে ভাইরাল করে দেব? ভালোই হবে, অনুও দেখবে তোমার আসল রূপ, বাঁকা হাসি হেসে বলে মিতা।

শিউরে ওঠে দেবল। যে ওকে দাদা বলে মেনেছিল তার কাছ থেকে এরকম ব্যবহার? ভাবতে পারেনি দেবল। সে মিতাকে কারণটা সরাসরি জিজ্ঞাসা করে। উত্তরও পায়।

একটা বড়ো বাড়ি দেখেছি। পঞ্চাশ লাখ দাম বলছে। তোমাকে দিতে হবে টাকাটা। একবারে নয়, কিছু কিছু করে দিলেই চলবে কিন্তু দিতে তো তোমাকে হবেই। নয়তো আমি কী করতে পারি এতক্ষণে নিশ্চয়ই বুঝে গেছ, শ্লেষের ভঙ্গিতে বলে মিতা।

খুব ভালো করেই বুঝেছে দেবল, ওর সঙ্গে আলাপ করাটা মিতার একটা কৌশল ছিল। অনুর কথাগুলো মনে পড়ল, কাউকে ভালো করে না জেনেশুনে ভরসা কোরো না। এটা যে কত বড়ো সত্যি আজ টের পাচ্ছে দেবল।

অনু ডেলিভেরির জন্য হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে শুনেই দেবল কয়েক দিনের ছুটি নিয়ে কানপুর রওনা হল। অনুর বাপের বাড়ি ওখানেই। কিন্তু দেবল পৌঁছনোর আগেই অনু ফুটফুটে পুত্রসন্তানের জন্ম দিয়েছে। সুতরাং হাসপাতালে পৌঁছে নিজের সন্তানকে দেখে গত কয়েক মাসের দুশ্চিন্তা ঝেড়ে ফেলে স্ত্রী আর নবজাত সন্তানকে নিয়ে মেতে উঠল দেবল। এদিকে ছুটিও ফুরিয়ে আসছিল। অনুর ইচ্ছে ছিল দেবলের সঙ্গেই ফিরে যায় কলকাতায়। কিন্তু ডাক্তারের কথামতো আরও একমাস কানপুরে মা-বাবার কাছে থেকে যেতে বাধ্য হল অনু। দেবল ফিরে এল একাই।

আবার সেই মিতার মুখোমুখি হওয়া। সেই টাকার জন্য চাপ। ভিডিও ভাইরাল হওয়ার ভয়। দমবন্ধ হয়ে আসতে লাগল দেবলের। পরিত্রাণ পাওয়ার কোনও রাস্তা দেখতে পেল না সে।

এক মাস বাদেই অনু ফিরে এল সন্তানকে নিয়ে এসে অবাক হল দেবলের ব্যবহারে। যে-সন্তানকে নিয়ে এতদিন এত স্বপ্ন দেখেছে দেবল, সেই সন্তানকে কোলে নেওয়া তো দূরে থাক, তার একটু কান্নায় বিরক্ত হয়ে উঠতে লাগল দেবল। নতুন খেলনা কিনে আনার কথা বললে রেগে উঠত বলত, বাজে খরচ করা বন্ধ করো অনু।

শুধু এটুকুই নয়, অনুর থেকেও দূরে দূরে থাকতে আরম্ভ করল দেবল। অনু কাছে আসার চেষ্টা করলে, অন্য ঘরে চলে যাওয়াটা রোজকার ঘটনা হয়ে দাঁড়াল।

 

সেদিন দেবলের ছুটি। রোজকার থেকে একটু ধীরে ধীরেই বাড়ির কাজ সারছিল অনু। দেবের মোবাইলটা অনেক্ষণ থেকে বাজছে। এত সকালে কোথায় গেল দেব? এদিক ওদিক চাইল অনু। নাঃ আশেপাশে কোথাও নেই। বাধ্য হয়ে হাত মুছে মোবাইলটা ধরল। হ্যালো বলার আগেই ওধার থেকে নারীকণ্ঠ ভেসে এল, দুদিন ধরে সমানে ফোন করছি, ফোন ধরছ না কেন? দ্যাখো আমাকে রাগিয়ে দিও না। তাহলে আমি বাধ্য হব ভিডিও-টা ভাইরাল করে দিতে। তখন তোমার অবস্থা কী হবে ভেবে দেখেছ একবার? আমার এখুনি পনেরো লাখ টাকা চাই। আর যখনই টাকার কথা বলব, এসে দিয়ে যেও। আর আজ রাত্রে একবার ফ্ল্যাটে এসো আমার শরীর জ্বলে যাচ্ছে, হঠাৎই ফোনটা কেটে গেল।

অনুর পায়ে তলার মাটি সরে গেল। মহিলা কে? দেবলের কাছে কেন টাকা চাইছে? কোন ভিডিও ভাইরাল করার ভয় দেখাচ্ছে? রাত্রিতে কেন দেবলকে ফ্ল্যাটে ডাকল? এরকম নানা প্রশ্ন এসে অনুর মাথায় ভিড় করতে শুরু করল। ইচ্ছে হল সঙ্গে সঙ্গে দেবলের মুখোমুখি হতে কিন্তু আটকাল নিজেকে। আগে ব্যাপারটা বুঝতে হবে, ঘটনার শুরুটা জানতে হবে, তবেই কোনও পদক্ষেপ করা সম্ভব।

দেবল বাইরে থেকে ফিরলে, আজ অনেক দিন পর ওর মুখের দিকে চেয়ে দেখল অনু। সত্যি কত রোগা হয়ে গেছে। চোখের তলায় কে যেন কালি ঢেলে দিয়েছে। অনু নিজেকেই দোষারোপ করল, কেন লোকটার দিকে এতদিন ভালো করে তাকায়নি? কী এমন দুঃখ বুকে চেপে বসে আছে, যেটা ওকেও বলতে পারেনি দেবল?

দেব? অনেকটা সাহস বুকের মধ্যে ভরে নিয়ে অনু তাকাল দেবলের দিকে। আমাকেও বলবে না, তোমার কী হয়েছে? আমরা তো কথা দিয়েছিলাম, কেউ কাউকে কোনও কথা লুকোব না। তাহলে এত বড়ো ঘটনা তুমি কী করে লুকিয়ে রাখলে?

ছ্যাঁত করে উঠল দেবলের বুকটা। অনু কি তাহলে সব জেনে গেল? সবকিছু অনুর কাছে খুলে বলার জন্য দেবলের মনটা উদ্বেল হয়ে উঠতে লাগল। কিন্তু মুখ ফুটে একটা শব্দও বেরোল না।

বলো না দেব, কে ওই মহিলা, যার সঙ্গে কথা বলার জন্য তোমাকে বাড়ির বাইরে যেতে হয়? আজ তুমি না থাকাতে আমি ফোন ধরেছিলাম। যতক্ষণ তুমি না বলবে আমাকে, আমি কী করে জানব কেন তোমাকে মহিলা বিরক্ত করছেন? প্লিজ আমাকে খুলে বলো, হয়তো তাহলে তোমাকে কিছু সাহায্য করতে পারব।

অনুর কথায় দেবের চোখ জলে ভরে এল। নিজেকে আর আটকে রাখতে পারল না দেবল। কী কী ঘটনা ওর সঙ্গে ঘটেছে সব খুলে বলল দেবল।

এত কিছু হয়ে গেছে, তুমি আমাকে জানাওনি? কীসের ভয় ছিল তোমার, যে আমি তোমাকে ভুল বুঝব? আমি তোমার স্ত্রী, এতদিনে তুমি আমাকে এটুকুই চিনেছ? তোমার সুখ-দুঃখের সঙ্গী আমি, একটু তো ভরসা করতে পারতে আমাকে। যাই হোক, যা হবার হয়েছে। আমি তোমাকে ঠিক এই চোরাবালি থেকে টেনে বার করবই।

সারাটা দিন ধরে ভাবল অনু। রাতে খেতে বসে মনে মনে ঠিক করে রাখা প্ল্যানটা জানাল দেবলকে।

সত্যিই অনু, তুমি যেটা করবে ভাবছ সেটা আদৌ কি হওয়া সম্ভব? তুমি জানো না ওই মহিলা কতখানি চালাক, শঙ্কিত চোখে প্রশ্নটা করে দেবল।

অবশ্যই হবে দেব তবে আমাদের একটু ধৈর্য ধরতে হবে, দেবলের হাতে হাত রেখে ওকে ভরসা দেয় অনু।

প্ল্যান অনুযায়ী অনু, মিতার সঙ্গে বেশি করে মিশতে আরম্ভ করল, যাতে বন্ধুত্বটা আরও গাঢ় হয়। যখন অনু বুঝল মিতা এখন ওকে বিশ্বাস করতে আরম্ভ করেছে তখন ও শেষ চালটা দিল।

আজ ছেলেকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাব। হয়তো দেরি হবে ফিরতে, দেবল ফিরলে তুমি বাড়ির চাবিটা দিয়ে দিও আর পারলে কিছু খাইয়ে দিও, নয়তো বেচারা খিদে পেটে নিয়ে বসে থাকবে। হাত জোড় করে বলে অনু। মিতার মনে হয় আকাশের চাঁদ আপনিই এসে ওর হাতে ধরা দিয়েছে।

আরে হাত জোড় কেন করছ অনু। চাবি দিয়ে দেব আর তোমার বরকে পেট ভরে খাইয়ে দেব। চিন্তা কোরো না।

মিতাকে হাসতে দেখে গা জ্বলে উঠল অনুর। মনে মনে বলল অনু, হেসে নাও এখন যত খুশি। তুমি আমার দেবকে কাঁদিয়েছ মিতা, আমি তোমাকে উচিত শিক্ষা দেব।

অফিস থেকে ফিরে নিজের বাড়িতে মিতাকে দেখে দেবল অবাক হবার ভান করল। মিতা তুমি আমার বাড়ির ভিতর, কী করছ?

তোমার অনু আমার হাতে তোমাকে সঁপে দিয়ে গেছে দেবল। রহস্যময় হাসিতে মুখ ভরে উঠল মিতার। চাবির গোছাটাকে আঙুলে ঘোরাতে ঘোরাতে দেবলের খুব কাছে ঘেঁষে এল মিতা।

প্লিজ বন্ধ করো তোমার ফালতু নাটক। কেন করছ তুমি এরকম আমার সঙ্গে? তুমিই বলেছিলে আমার মধ্যে তুমি তোমার দাদাকে দেখতে পাও। তাহলে আমার সঙ্গে এসব করতে তোমার লজ্জা করে না?

ইচ্ছে করেই দেবল আবার ওই একই প্রসঙ্গ টেনে আনল। সেদিন তোমার ফ্ল্যাটে আমাকে প্ল্যান করেই ডেকেছিলে, তাই না? চা-পকোড়ার নাম করে নেশার ওষুধ মিশিয়ে দিয়েছিলে চায়ের মধ্যে? ধর্ষণ আমি করিনি, তুমি করেছিলে আমাকে। বলো আমি মিথ্যা বলছি?

হ্যাঁ, তুমি ঠিকই বলছ। পুরোটাই আমার প্ল্যান ছিল। নেশার ওষুধ খাইয়ে শোবার ঘরে নিয়ে গিয়ে তোমার জামাকাপড় নিজের হাতে খুলে তোমাকে বিছানায় শুইয়ে দিয়েছিলাম। তুমি ঠিকই বলেছ, আমিই তোমাকে ধর্ষণ করি। কিন্তু একথা তুমি কী করে প্রমাণ করবে দেবলবাবু? ভিডিও-তে যা দেখা যাচ্ছে সেটাই সত্যি বলে সবাই ধরবে। যেদিন তোমাকে আমি বড়ো গাড়িটা করে যেতে দেখেছিলাম, সেদিনই ঠিক করে নিই, তোমাকে কোনও ভাবে ফাঁসাতে হবে। সত্যিই বলছি দেবল, এই দেশলাই বাক্সর মতো ফ্ল্যাটে দম আটকে আসছে। বড়ো বাড়ি, গাড়ি হবে। চাকরবাকর থাকবে আর পর্যাপ্ত শারীরিক সুখ, দেবে তো আমাকে দেবল?

আচ্ছা এইসব এইজন্যই তুমি করেছ যাতে আমাকে ব্ল্যাকমেল করতে পার?

হ্যাঁ দেবল। পঞ্চাশ লাখ টাকা আমাকে দিয়ে দাও, তারপর তুমি তোমার রাস্তায় আর আমি আমার রাস্তায়। তুমি তো টাকা দিতে ঝামেলা করছ।

আর আমি যদি টাকা না দিই?

তুমি আমার হাত থেকে রেহাই পাবে না। চেঁচিয়ে ওঠে মিতা। অনু যে বাইরে দাঁড়িয়ে সব শুনছে এবং ও পুলিশ নিয়ে এসেছে ভাবতেও পারেনি মিতা।

 

এবার তুই আমাদের হাত থেকে রেহাই পাবি না। অনেক ঘোল খাইয়েছিস। হঠাৎই মহিলা পুলিশ দেখে ঘাবড়ে যায় মিতা।

দেবল কিছু বলে ওঠার আগেই মিতা নকল অশ্রু ঝরাতে ঝরাতে বলে ওঠে, অফিসার এই লোকটা আমাকে ধর্ষণ করেছে আর এখন ব্ল্যাকমেল করার চেষ্টা করছে। বলছে ওর কথা না শুনলে ওর কাছে রেকর্ড করে রাখা ভিডিও ভাইরাল করে দেবে।

কোন ভিডিও-টা? যেটা উনি নন, তুই বানিয়েছিস? তোকে খুব ভালোমতন চিনি, বলে মহিলা পুলিশটি অনুদের দিকে তাকিয়ে বললেন, এই মহিলা এক নম্বরের ঠগ, জোচ্চোর। বহু লোককে এভাবে ঠকিয়েছে। অনেক দিন ধরেই পুলিশ একে খুঁজছিল। এর আসল নাম মিতা নয়, সোনম।

মিতার ফ্ল্যাট থেকে পুলিশ লাখ লাখ টাকা আর অনেকগুলো ভিডিও উদ্ধার করল। মিতাকে এবং ভিডিওগুলো পুলিশ নিজেদের হেফাজতে নিয়ে বেরিয়ে গেল। অনুদের বাড়ি ছেড়ে যাবার সময় মিতার চাহনি একটাই কথা দেবলকে বলে গেল, তোমাকে আমি ছাড়ব না।

থ্যাংকস অনু। তুমি যদি শেষ চালটা না চালতে তাহলে যে আমার কী হতো জানা নেই। হয়তো চোরাবালি-ই গ্রাস করত আমাকে। দেব অনুকে নিজের কাছে টেনে নিল। অনুও সম্পূর্ণ ভাবে নিজেকে দেবের হাতে সঁপে দিল।

 

দাগ

সকাল সকাল ঘরটার অবস্থা দেখে সুচিত্রার গলা ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছিল। ছেলে তো সেই সকাল সাতটার আগেই স্কুলের জন্য রওনা হয়ে গেছে। প্রতিদিনই স্কুলবাস আসে বাড়ির দরজায়। আর অরুণাভও তো অফিসের জন্য বেরিয়ে গেল। কিন্তু বাড়ি খালি বলে, সুচিত্রার কিন্তু কোনও বিশ্রাম নেই। দু-কামরার ফ্ল্যাটটাকে বাপ-ব্যাটা মিলে আস্তাকুঁড় বানিয়ে রেখেছে যেন। চারিদিকে জামা কাপড় ছড়িয়ে রেখে গেছে। ছেলে রুমন পড়াশোনা যত না করেছে, তার থেকে বই-খাতা ছড়িয়েছে বেশি। সারা মেঝেতে দলাপাকানো কাগজ ছড়িয়েছে। এগুলো সব পরিষ্কার করে, ঘর-দোর গুছিয়ে তুলতে তুলতে সুচিত্রা জানে পাক্বা দু-তিন ঘন্টা লেগে যাবে। কোথা থেকে শুরু করবে ভেবে পাচ্ছিল না সুচিত্রা।

বাথরুমে ঢুকে ভেজা টাওয়েল এবং অরুণাভ-র ছাড়া শার্ট আর গেঞ্জিটা বার করে ওয়াশিং মেশিনে ফেলতেই যাচ্ছিল সুচিত্রা, খাটের পাশে রাখা মোবাইলটা বেজে উঠল। বিরক্ত হল ও। এই অসময়ে কার ফোন হতে পারে? সব রাগ গিয়ে পড়ল মোবাইল কোম্পানিগুলোর উপর। ওরা ছাড়া এই অসময়ে আর কে-বা হতে পারে! লেটেস্ট গানের কলার টিউন দিচ্ছে বলে ফোন করে করে জ্বালিয়ে যাবে। পুরো ব্যাপারটাই সুচিত্রার বুজরুকি কারবার ছাড়া কিছু মনে হয় না।

বিরক্ত হয়েই হাতটা নাইটিতে মুছে নিয়ে সুচিত্রা ফোনটা তুলে নিল। কলার আইডি দেখে সুচিত্রার রাগ মুহূর্তে জল হয়ে গেল। বিলাসপুর থেকে ননদের ফোন। একটু চিন্তিতও হল সুচিত্রা। দিদি সাধারণত দুপুরের দিকেই ফোন করে। আজ কী হল যে এত সকাল সকাল ফোন করছে?

‘হ্যালো দিদি, কেমন আছ? আজ এত সকাল সকাল ফোন করেছ সব ঠিক আছে তো?’

‘না সুচিত্রা, সব মনে হচ্ছে ঠিকঠাক নেই।’

‘কী হয়েছে’, খারাপ খবর শোনার আশঙ্কায় ঘাবড়ে গেল সুচিত্রা। যত খারাপ খবর সব কি এই সকালেই আসতে হয়?

‘তনুর শরীরটা মনে হয় ভালো নেই। সেদিন ফোন করেছিলাম ও ঘরে ছিল না। ওর রুমমেট বলল, সারারাত নাকি তনু ঘুমোয় না। জিজ্ঞেস করলে বলে ঘুম আসছে না। শরীরে অস্বস্তি হচ্ছে।’

‘কবে থেকে এটা হচ্ছে?’

‘দুই-তিন মাস ধরে চলছে’ , কেঁদে ফেলে দিদি।

‘দিদি, শুধু শুধু কাঁদছ কেন? আমাকে আগেই তো বলতে পারতে, আমি একবার গিয়ে খোঁজ করে আসতাম। ঠিক আছে আমি আজই একবার চলে যাব।’ঘড়ির দিকে তাকায় সুচিত্রা, ‘দিদি এখন নটা বাজে, একটু পরেই ওর কলেজ শুরু হয়ে যাবে। বিকেল ছাড়া ওর সঙ্গে দেখা হবে না। ওর সঙ্গে দেখা করে আমি তোমাকে রাতে ফোন করে দেব।  চা-জলখাবার খেয়েছ?’

‘না…’

‘সে কী? যাও, নিশ্চিন্তে খাওয়াদাওয়া করো। আমি বাড়ির কাজ সেরে রুমন আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করে বেরোব। তুমি এখন ফোন ছাড়ো। আমিও কাজ সেরে স্নান করে নিই।’ সুচিত্রা মোবাইল বন্ধ করে।

বাড়ির কাজ করতে করতে সুচিত্রার মাথায় ঘুরতে থাকে তনু মানে দিদির মেয়ে তানিয়ার কথা। শেষবার যখন দেখা হয়েছিল তখন তনুর শরীর তো ঠিকই মনে হয়েছিল। বাড়ির এবং আত্মীয়স্বজনের সবকটি ছেলেমেয়ের মধ্যে তনুই সবথেকে ভালো পড়াশোনায়। এছাড়াও প্রচণ্ড পরিশ্রমী এবং খেলাধূলাতেও খুবই ভালো। রুমনকে সবসময় পরামর্শ দেয় সুচিত্রা, ওর দিদির থেকে কিছু শেখার জন্য কিন্তু রুমনের পড়াশোনাতে মন আছে বলেই মনে হয় না সুচিত্রার। প্রতি মাসে পাঁচ-ছয় হাজার টাকা ওর টিউশনের পিছনেই খরচ করে সুচিত্রা আর অরুণাভ।

তাড়াতাড়ি বাড়ির কাজ আর রান্নাবান্না সেরে স্নান সেরে নিল সুচিত্রা। রুমনের বিকেলের জলখাবারের জন্য কড়াইশুঁটির কচুরি তৈরি করে ক্যাসারোলে তুলে রেখে দিল সুচিত্রা, যাতে ছেলেটা বিকেলে ‘খিদে খিদে’করে পঞ্চাশবার ফোন না করে। কয়েকটা তনুর জন্যেও প্যাক করে গুছিয়ে নিল। মেয়েটা বড়ো ভালোবাসে এইসব খেতে। হস্টেলে পাবেই বা কোথায়? দিদির এই মেয়েটাকে বড়ো ভালোবাসে সুচিত্রা। আজকালকার দিনে এমন মেয়ে খুব একটা চোখে পড়ে না। সুচিত্রা চাইছিল তনুকে সারপ্রাইজ দিতে তাই ওকে ইচ্ছে করেই ফোন করল না। একটার মধ্যে রুমন স্কুল থেকে বাড়ি ঢুকলে মা-ব্যাটায় দুপুরের খাবার খেয়ে রুমনকে সব বুঝিয়ে, সুচিত্রা তনুর হস্টেলে যাবার জন্য বেরোল। বাসস্ট্যান্ড অবধি পৌঁছোতে পৌঁছোতে অরুণাভকেও সবকিছু জানিয়ে রাখল সুচিত্রা।

তনুর হস্টেল, শহর থেকে একটু দূরে। দু’বার বাস বদলে যেতে হয়। ওর হস্টেলে যখন পৌঁছোলো সুচিত্রা, তখন চারটে বেজে গেছে। হস্টেল থেকে মেয়েরা বেরিয়ে কেউ কেউ টিউশন নিতে যাচ্ছে।

মুখেই দেখা হল তনুর রুমমেটের সঙ্গে। আগেই আলাপ হয়েছিল সুচিত্রার সঙ্গে, নাম সঞ্চিতা। সুচিত্রাকে দেখেই হাসিমুখে এগিয়ে এল, পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করল।

‘কেমন আছো?’ আশীর্বাদের ভঙ্গিতে সঞ্চিতার মাথায় হাত রাখল সুচিত্রা।

‘ভালো, মামিমা। আপনার আজকে আসার কথা ছিল? তনু জানে আপনি আসবেন?’

‘না, ওকে জানাইনি, সারপ্রাইজ দেব বলে। কিন্তু ও কোথায়?’ সুচিত্রা জিজ্ঞেস করে।

‘ও রুমে আছে,’ বলে সঞ্চিতা চলে গেল।

সুচিত্রা সিঁড়ি দিয়ে উঠে ওয়ার্ডেনের ঘরের দিকে পা বাড়াল। রেজিস্টারে সাইন করে তবেই তনুর ঘরে যাওয়ার পারমিশন পাবে।

সাইন করে তনুর রুমের সামনে গিয়ে অভ্যাসবশত দরজাটা হাত দিয়ে ঠেলতেই দরজাটা সামনের দিকে কিছুটা খুলে গেল। ঘরটা অন্ধকার। তনু সিলিঙের দিকে দৃষ্টি মেলে চুপচাপ শুয়ে আছে। বাইরের নিভু নিভু আলোয় ঘরের ভিতরের অবয়ব অস্পষ্ট, ধোঁয়াটে। সুচিত্রা পা টিপে রুমে ঢুকে দরজা ভেজিয়ে দিল। তনু কিছুই টের পেল না। ধীর পায়ে সুচিত্রা ওর মাথার পিছনে দাঁড়িয়ে দুই হাতে তনুর চোখ চেপে ধরল।

‘কে… কে?’ ভয় পেয়ে চেঁচিয়ে ওঠে তনু।

‘বল তো কে…’

‘ও… মামি, তুমি।’ গলার আওয়াজ চিনতে পেরে ওর সারা মুখে হাসি ছড়িয়ে যায়। বিছানা থেকে উঠে লাইট জ্বালায় তনু।

সুচিত্রা খাটের পাশে গিয়ে বসে। হাতটা ভিজে ভিজে ঠেকে, ‘কীরে কাঁদছিলি নাকি?’

‘না তো মামি’, তাড়াতাড়ি করে চোখের জল মোছবার চেষ্টা করে তনু।

ভালো করে তাকায় সুচিত্রা ওর দিকে। তনুর চোখ লাল হয়ে ফুলে উঠেছে। মুখটাও শুকনো, চোখের কোলে কালি পড়েছে। চুলগুলো অবিন্যস্ত, অগোছালো।

‘কী রে, কী হয়েছে তোর?’ চিন্তিত সুচিত্রা তনুর কাছে ঘেঁষে আসে। ‘সকালে তোর মা ফোন করেছিল, বলল, তুই নাকি খুব অসুস্থ। আমার কাছেও তো চলে আসতে পারতিস বা বাড়িতেও ক’দিন ঘুরে আসতে পারতিস। ডাক্তার দেখিয়ে ওষুধ খাচ্ছিস?’

‘আরে আরে দাঁড়াও মামি, একসঙ্গে কত প্রশ্ন করছ। আমি একদম ঠিক আছি, চিন্তা করার মতো কিচ্ছু হয়নি। তুমি বসো, আমি চা নিয়ে আসি , অগোছালো চুলটা হাতে পাকিয়ে খোপা করতে করতে তনু খাট থেকে নামার উপক্রম করে।

সুচিত্রা ওকে আটকে দেয়, ‘আমি চা খেয়েই এসেছি। তুই এখানে চুপচাপ বস, এখন কোথাও তোকে যেতে হবে না।’ হাতের ব্যাগটা থেকে বার করে টিফিন কৌটো-টা তনুর হাতে ধরিয়ে দেয় সুচিত্রা, ‘নে খেয়ে নে, কড়াইশুঁটির কচুরি আছে। আলুর দম আর মিষ্টি দিয়ে আজ খেয়ে নে। যেদিন প্ল্যান করে আসব তোর অর্ডারি রসোগোল্লার পায়েস নিশ্চয়ই নিয়ে আসব।’

অন্যদিন হলে সুচিত্রার হাত থেকে প্রায় কেড়েই কৌটো খুলে বসত তনু কিন্তু আজ সুচিত্রা আশ্চর্য হল, তনু কৌটোটা সরিয়ে রাখল, ‘এখন ইচ্ছে করছে না মামি, পরে খেয়ে নেব। কৌটো-টা টুলের উপর রাখতে গিয়ে হাত লেগে তনুর একটা পড়ার বই মাটিতে পড়তেই, বইয়ের ভিতর থেকে একটা ওষুধের পাতা ছিটকে কিছুটা দূরে গিয়ে পড়ল। সুচিত্রা চট্ করে ওষুধটা তুলে নিল। নামটা দেখে বুঝতে পারল ওটা ঘুমের ওষুধ। তনুর দিকে তাকিয়ে সুচিত্রা বলল, ‘কী রে তোর ঘুম হয় না? ঘুমের ওষুধ খাস কেন?’

তনু, সুচিত্রার চোখের দিকে তাকাতে পারে না। ‘না-না সেরকম কোনও ব্যাপার নয়। তুমি বসো, আমি দৌড়ে চা নিয়ে আসি।’

‘তুই খাবি?’ সুচিত্র প্রশ্ন করে।

‘না, আমি খাব না।’

‘তবে আমার কাছে বস। আমাকে তাড়াতাড়ি বেরোতেও হবে। পড়াশোনা কেমন চলছে তোর?’

‘তেমন কিছু নয়।’

সুচিত্রা লক্ষ্য করল, তনু কিছুতেই ওর চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলছে না। অথচ আগে সুচিত্রা এলেই ওর গলা জড়িয়ে ধরে রাজ্যের গল্প জুড়ে দিত তনু। বন্ধুরা কী করল, ক্লাসে কী হল, ওকে কে কী বলল, এ সব খুলে না বললে তনুর নাকি ঘুম আসত না। অথচ আজ এত চুপচাপ। প্রথম থেকেই সুচিত্রার সঙ্গে ওর বন্ধুর সম্পর্ক আর সুচিত্রারও মনে এই মেয়েটির প্রতি একটা ভালোবাসা সেই কবেই গড়ে উঠেছে।

কিন্তু আজ সুচিত্রার পরিবেশটা অন্যরকম মনে হল। যা প্রশ্ন করছে সেই উত্তরটুকুই খালি পাচ্ছে, আর বাকি সময়টা কিছু একটা চিন্তায় ডুবে যাচ্ছে তনু। সুচিত্রা ভেবে পেল না কীভাবে তনুর মনে কী চলছে সেটা জানবে কিন্তু কিছু যে একটা গোপনে ঘটে চলেছে সেটা বেশ ভালোই বুঝতে পারছিল সুচিত্রা। এরই মধ্যে তনুর রুমমেট সঞ্চিতাও রুমে ফিরে এল।

‘মামিমা, আপনি তনুকে সঙ্গে করে বাড়ি নিয়ে যান। সারা রাত ঘরের মধ্যে পায়চারি করে, জিজ্ঞেস করলে বলে ঘুম আসছে না। ওকে আমিই ঘুমের ওষুধ খেতে বলেছি। খাওয়া-দাওয়া ঠিকমতো করে না, পড়াশোনাও লাটে তুলে দিয়েছে। ওর রোগটা মনে হয় ‘প্রেমরোগ , বলে হাসতে থাকে সঞ্চিতা।

‘চুপ কর সঞ্চিতা। মামির সামনে মুখে যা আসছে বলে যাচ্ছিস , রেগে যায় তনু।

‘আরে আমাকে নামটা বলিসনি ঠিক আছে কিন্তু মামিকে তো ছেলেটার নাম বলে দে। হতে পারে মামি তোকে এবারের মতো প্রেমসমুদ্রে হাবুডুবু খাওয়ার থেকে বাঁচাতে সাহায্য করবে। নে… নে, মেলা নাটক না করে মামিকে সব বলে দে। আমি বরং বাইরে চলে যাচ্ছি , বলে সঞ্চিতা দুজনকে কথা বলার সুযোগ করে দিয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল।

‘ইডিয়েট একটা , তনুর স্বগতোক্তি সুচিত্রারও কানে এসে পৌঁছোল।

সঞ্চিতার কথাগুলোই সুচিত্রার সত্যি মনে হল। ও তনুর দুটো হাত নিজের হাতে নিয়ে বলল, ‘কোনও ছেলেকে পছন্দ করিস তো বল, আমি দিদির সঙ্গে কথা বলব।’

‘না কেউ নেই , হাতটা সরিয়ে নিল তনু।

সুচিত্রা ওর থুতনিটা হাত দিয়ে তুলে ধরল, ‘সত্যি করে বল কী হয়েছে, আমি তোর মামি। কিছু তো একটা তোর মনের উপর চেপে বসেছে সেটা বেশ বুঝতে পারছি। আর সেই জন্যই তুই ঘুমের ওষুধ খাচ্ছিস। আমার উপর বিশ্বাস রাখ, তোর কোনও কথা কেউ জানবে না। তুই আমাকে বন্ধু ভাবিস তো… তাহলে বল, তুই কোনও ভুল কাজ করেছিস কি? কারও কাছে খুলে বললে মন হালকা হবে আর তাছাড়া হয়তো আমিও তোকে কিছু সাহায্য করতে পারব। প্রেম ট্রেমের চক্বরে পড়েছিস নাকি হস্টেলের কোনও প্রবলেম…?’ দশ পনেরো মিনিট ধরে বারবার একই কথা সুচিত্রা বলতে লাগল যাতে তনু আসল সত্যিটা ওর কাছে খুলে বলে।

অনেক চেষ্টা করেও সুচিত্রা তনুর পেট থেকে কথা বার করতে সফল হল না। একটু রাগও হল ওর, ‘ঠিক আছে, তনু, তোর যখন আমার উপর এতটুকু বিশ্বাস নেই আর ঠিকই যখন করেছিস আমাকে কিছুই বলবি না, তাহলে শুধু শুধু এখানে বসে থেকে কী লাভ আমার? এখন আমি তাহলে চললাম, ভালো থাকিস , বলে সুচিত্রা উঠে দাঁড়াবার উপক্রম করে।

‘মামি…’, তনু সুচিত্রার হাতটা আঁকড়ে ধরে। ওর চোখ দিয়ে অঝোরে জল পড়তে থাকে। সুচিত্রা তনুর চোখে জল দেখে ভিতরে ভিতরে ঘাবড়ে গেলেও কথা বার করার জন্য চিন্তাটা মুখের মধ্যে প্রকাশ হতে দেয় না, ‘কেন, আমি এখানে বসে আর কী করব , আমাকে বাড়িও তো ফিরতে হবে। নয়তো রুমনকে পড়ানোর সময় পেরিয়ে যাবে।’

কথা শেষ হওয়ার আগেই তনু সুচিত্রাকে জড়িয়ে ধরল। ওর কাঁধে মাথা রেখে হাউহাউ করে কেঁদে উঠল ও, ‘মামি, আমি একটা ভুল করে ফেলেছি।’

‘কী ভুল করেছিস?’ সস্নেহে সুচিত্রা প্রশ্নটা করে।

‘একজনের সঙ্গে আমি সম্পর্কে…’

আজকালকার মেয়ে প্রেমে পড়েছে হতেই পারে কিন্তু তনু, সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ার কথা বলাতে সুচিত্রার হাত-পা কাঁপতে শুরু করে। তনুর উপর প্রচন্ড রাগ হতে থাকে সুচিত্রার কিন্তু ও ভালো করেই জানে এখন বকাঝকা আরম্ভ করলে তনু সত্যি কিছুতেই ওর কাছে খুলে বলবে না।

তনুর হাত ধরে সুচিত্রা ওকে খাটে বসিয়ে নিজেও ওর সামনে এসে বসল। এই অবস্থায় রাগারাগি করলে সুচিত্রা জানে, এই মেয়ে কিছু একটা করে বসতে পারে, সুতরাং খুব সাবধানে সব কথা ওর পেট থেকে বার করতে হবে।

ধীরে ধীরে তনু শান্ত হলে সুচিত্রা ওকে পুরো ঘটনা খুলে বলতে বলে। তনুর মুখ থেকে সব ঘটনা শুনে মোটামুটি একটা ছবি পরিষ্কার হয়ে যায় সুচিত্রার, যে তনু পরিস্থিতির শিকার।

তনুর হস্টেলের ঠিক পাশেই ‘চন্দন স্টেশনারি শপ’ যেখান থেকে তনু প্রয়োজনীয় খাতা, পেন কেনার সঙ্গে সঙ্গে নোট্‌স, সার্টিফিকেট ইত্যাদি ফোটোকপি করাত। হস্টেলের সব মেয়েরাই ওই দোকানটা থেকেই এসব কেনাকাটা করে। এছাড়াও ওখানে কুরিয়ার, ফোনবুথ এবং ছবি তোলার জন্য একটা স্টুডিও-ও একসঙ্গে ছিল।

দোকানের মালিক চন্দনের বাড়িতেই নীচের তলাটা জুড়ে দোকানটা রমরমিয়ে চলত। দোকান দেখার জন্য একটা লোকও ছিল কিন্তু চন্দনের বউ রীতাও সকাল থেকেই দোকানে এসে বসত।

রোজ প্রায় আসা-যাওয়াতে, হস্টেলের অন্য মেয়েদের মতোই তনুর বন্ধুত্ব হয়ে যায় রীতা এবং চন্দনের সঙ্গে। কখনও দোকান খালি থাকলে রীতা তনুকে বসিয়ে স্ন্যাক্স, চা খাইয়ে তবে ছাড়ত। রীতার চার আর সাত বছরের দুটি ছেলে। ওদের জন্য রীতা ভালো একজন টিউটারের সন্ধানে ছিল।

রীতা সঞ্চিতার কাছে টিউটারের জন্য বলে রেখেছিল। সঞ্চিতার নিজের কোনও সময় ছিল না কারণ ওর বন্ধুবান্ধব, পার্টি ইত্যাদি নিয়ে ব্যস্ততার কারণে ও ঘুরে ঘুরে বেড়াত। ফলে ও তনুকে পড়াবার জন্য বলাতে তনু সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে গেল। বাচ্চাদের পড়ানোর কাজটা এমনিতেই তনুর খুব পছন্দের ছিল তার উপর হস্টেলের পাশে বলে ওর আরও সুবিধা হল। রীতার বাচ্চাদের পড়াবার দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিল।

দুই সন্তানের বাবা চন্দন, কিন্তু ওর চেহারা দেখে বয়স বোঝার কোনও উপায় ছিল না। সুপুরুষ চেহারা, দেখলে আঠাশ-তিরিশের বেশি বলে মনে হয় না। তনুর বয়সও কুড়ি-একুশের বেশি নয় এবং যথেষ্ট সুন্দরীও বলা চলে। বাচ্চাদের পড়াতে পড়াতে মাঝেমধ্যেই তনু লক্ষ্য করত যেতে-আসতে আড়চোখে চন্দন ওকে লক্ষ্য করছে। তনুও যে, যৌবনের আকর্ষণকে অগ্রাহ্য করতে পারত এমন নয়। চন্দনের স্ত্রী এবং সন্তান আছে সব জেনেও ওর প্রতি দুর্নিবার আকর্ষণ বোধ করত ও।

হঠাৎই একদিন মায়ের অসুস্থতার খবর পেয়ে রীতা ছোটো ছেলেকে নিয়ে বাপের বাড়ি চলে গেল তাড়াহুড়ো করে। এদিকে শহরে ধর্মীয় গন্ডগোলের কারণে দোকানপাট বন্ধ করিয়ে দিল মন্ত্রীর চ্যালাচামুণ্ডারা। অগত্যা দোকান বন্ধ রাখতে বাধ্য হল চন্দন। বাড়ির কাজে মন দিল। রীতা কিছুই গুছিয়ে যাওয়ার সময় পায়নি, চন্দন সেগুলো সবই গুছিয়ে তুলে রাখল।

এর দুদিন পর তনু নিয়মমতো পড়াতে গিয়ে দেখল চন্দনের দোকান বন্ধ রয়েছে। এতদিনে কখনও ও দোকান বন্ধ হতে দেখেনি, তাই অবাক হল। বাড়িতে ঢুকে চন্দনের কাছ থেকে রীতা আর দোকানের সব খবর শুনল তনু। ছোটো ভাই না থাকাতে চন্দনের বড়ো ছেলে কিছুতেই পড়তে রাজি হচ্ছিল না, তনু ওকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে পড়তে বসাল। এরই মধ্যে চন্দন তনুকে চা আর চানাচুর দিতে এল। চন্দনকে বাড়ির পোশাকে প্রথম দেখল তনু।

‘রীতাদি কবে ফিরবে?’ কাপ হাতে নিতে গিয়ে চন্দনের আঙুলের সঙ্গে তনুর আঙুল ছুঁয়ে গেল। তনুর শরীরে বিদ্যুৎ খেলে গেল।

‘কাল বা পরশু ফিরবে রীতা , নিজের চা-টা নিয়ে চন্দন ওখানেই একটা চেয়ার টেনে বসল।

‘চা-টা খুব ভালো হয়েছে , তনু হেসে বলল।

‘বাঃ বাঃ, আপনার মতো ম্যাডামের আমার বানানো চা যে ভালো লেগেছে সেটা জেনে ভালো লাগছে , চন্দন হাসল।

তনুর ছাত্র যেই দেখল বাবা আর দিদি গল্পে ব্যস্ত, ও ওমনি চেয়ার ছেড়ে বাইরে খেলতে বেরিয়ে গেল।

‘আরে রাতুল… কোথায় পালাচ্ছিস…’। তনু কাপ রেখে তাড়াহুড়ো করে রাতুলের পিছনে দৌড়োতে গিয়ে চেয়ারের পায়ে পা জড়িয়ে সামনে হুমড়ি খেয়ে পড়ার উপক্রম হতেই চন্দন চট্ করে ওকে ধরে ফেলল। ‘কী হল ম্যাডাম, শেষে আমার বাড়িতে হাত-পা ভেঙে আমাকে কেস দেওয়ার চেষ্টায় আছেন নাকি?’ বলে তনুকে খাটে বসাল চন্দন।

তনু কিছুতেই চন্দনের চোখের দিকে তাকাতে পারছিল না। ওর বুকের ভিতর যেন হাতুড়ির ঘা পড়ছিল। চন্দনের শরীরের এতটা কাছাকাছি এসে ওর সারা শরীরে শিহরণ উঠছিল। স্পষ্ট বুঝতে পারছিল তনু, ও যদি চন্দনের চোখে চোখ রাখে তাহলে চন্দনকে নিজের করে পাওয়ার আকুতি স্পষ্টই ওর চোখে ফুটে উঠবে। বুড়ো আঙুলে সামান্য চোট পেয়েছিল তাই সামনে থেকে চোখ সরিয়ে আঙুলের উপর সম্পূর্ণ মনোনিবেশ করল তনু।

‘আঙুলটা ব্যথা করছে?’ চন্দন জিজ্ঞেস করল।

‘হ্যাঁ।’

‘দাও আমি ঠিক করে দিচ্ছি , চন্দন তনুর বুড়ো আঙুলটা ধরে এক ঝকটায় জোরে টানল। তনুর গলা দিয়ে সামান্য চিৎকার বার হল, ব্যস ব্যথা একদম গায়েব।

‘নাও, ঠিক হয়ে গেছে। তোমার মুখের থেকে পা আরও বেশি সুন্দর, তুলোর মতো নরম এবং ফরসা ’, তনুর পায়ে হাত রেখে চন্দন সরাসরি তাকাল তনুর চোখে।

তনুর শরীরে নতুন করে শিহরণ খেলে গেল। নিজের অস্বস্তি ঢাকতে তনুর মনে হল কিছু বলা দরকার, ‘আপনাকেও তো সকলে হ্যান্ডসাম বলে। বাড়ির পোশাকেও আপনি সুপুরুষ আর জানেনই তো লোমশ চেহারার পুরুষ সব মেয়েদেরই পছন্দ।’

কথাগুলো বলার সঙ্গে সঙ্গেই তনু বুঝতে পারে ভুল বলে ফেলেছে। লজ্জায় লাল হয়ে ওঠে ও, ‘ও… ও… ভেরি সরি… আমি ঠিক এটা বলতে চাইনি।’

চন্দনের কাছে তনুর মুখের এই প্রশংসাটুকু প্রেম নিবেদন বলেই মনে হল। হঠাৎ-ই চন্দন নীচু হয়ে তনুর ঠোঁট স্পর্শ করল। চন্দনের তপ্ত নিঃশ্বাসের উত্তাপে তনুর প্রতিরোধ বাষ্প হয়ে উবে গেল। দু’জনেই বুঝতে পারছিল যেটা ঘটতে চলেছে সেটা অন্যায় কিন্তু এটাকে আটকাবার মানসিকতা দুজনের মধ্যে কারওরই ছিল না।

শারীরিক ক্ষুদা তৃপ্ত হতেই সম্বিৎ ফেরে দুজনেরই। নিজের আচরণে তনু লজ্জায় চন্দনের সঙ্গে চোখ মেলাতেও ইতস্তত করে। কোনও রকমে অবিন্যস্ত পোশাক ঠিক করে নিয়ে বেরিয়ে আসে তনু। রাতুলকে কোথাও দেখতে পায় না। হস্টেলে ফিরে এসে নিজের প্রতি ঘৃণা এবং সঙ্গে ভয় তনুকে ঘিরে ফেলে। নিজেকে শতবার দোষারোপ করতে থাকে যে পড়াশোনা শিখে এরকম নির্বুদ্ধিতার পরিচয় কীভাবে দিতে পারল ও।

বাচ্চাদের পড়ানো ছেড়ে দিল তনু। রীতা ফিরে এসে জিজ্ঞেস করলে তনু বলে দিল ওর শরীর ভালো নয় তাই পড়ানোর ধকল নিতে পারছে না।

চন্দনের মনেও শান্তি ছিল না। তনুর ক্ষতি করার জন্য নিজেকেই অপরাধী ভেবে নিল। কীভাবে মেয়েটার কাছে ক্ষমা চাইবে তার কোনও উপায় বার করতে পারল না চন্দন। তার উপর তনুর বাড়িতে আসা ছেড়ে দেওয়াতে এবং দোকানেও আসা যাওয়া বন্ধ করে দেওয়াতে তনুর সঙ্গে দেখাই হতো না ওর।

তনুর জীবনও দুর্বিষহ হয়ে উঠতে লাগল। যে ভুল একবার করে ফেলেছে তার পরিণাম যে কত ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারে সেটা ভেবেই সারারাত ঘুমোতে পারত না তনু। মা-বাবার বিশ্বাস ভাঙার গ্লানি কুরে কুরে খেতে লাগল তনুকে। একবার যদি সমাজে বদনাম হয়ে যায় তাহলে আত্মহত্যা করা ছাড়া আর উপায়ই বা কী আছে, সেই চিন্তাতেই তনুর শরীর দিন দিন ভেঙে পড়তে লাগল।

‘মামি, প্লিজ, মা-বাবা যেন এই কথা জানতে না পারে , কাঁদতে কাঁদতে তনু সুচিত্রার দুহাত শক্ত করে জড়িয়ে ধরল।

‘বিশ্বাস রাখ তনু, কেউ জানবে না। শুধু একটা কথা বল কোনওরকম শারীরিক অসুবিধা কিছু মনে হচ্ছে কি?’ সুচিত্রার গলার স্বরে আশঙ্কা প্রকাশ পায়।

‘না।’

‘এখন এই পুরো ঘটনাটা মন থেকে মুছে ফেলার চেষ্টা কর। খুব বড়ো ভুল করেছিস সন্দেহ নেই। কিন্তু ভবিষ্যতেও যদি নিজেকে ঠিক না করিস তাহলে আমার থেকে খারাপ কেউ হবে না। চট্ করে দু-তিনটে জামাকাপড় গুছিয়ে ব্যাগে ভরে নে। আমার সঙ্গে আমার বাড়ি যাবি এখন।’

‘কিন্তু…’

‘কোনও কিন্তু নয়। আমি ওয়ার্ডেনের কাছ থেকে তোর এক সপ্তাহের ছুটি মঞ্জুর করিয়ে নিয়ে আসছি। কাল তোকে একটা জায়গায় নিয়ে যাব কারণ আজ অনেক রাত হয়ে গেছে , বলে সুচিত্রা ওয়ার্ডেনের ঘরের দিকে চলে গেল।

রাস্তায় যেতে যেতে সুচিত্রা বলল, ‘তনু এই পুরো ঘটনাটা কারও কাছে বলবি না এমনকী বন্ধুবান্ধবকে-ও না। আমি জানি, তোরা সব কথা শেয়ার করিস কিন্তু এটা কাউকে বলবি না।’

বাড়ি ঢুকতেই তনুকে দেখে রুমন খুশিতে লাফিয়ে উঠল। অরুণাভ তনুর চেহারা দেখে উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘কী রে চেহারা এত খারাপ হয়েছে কেন? হস্টেলে কিছু খাস না?’

তনুর সঙ্গে সুচিত্রার চোখাচোখি হল, তনু উত্তর দিল, ‘না, না খাবার ঠিক মতোই খাই। পড়াশোনোর চাপ একটু বেশি।’

সুচিত্রাও তনুর কথায় সায় দিল, ‘তাই জন্যই তো ওকে এক সপ্তাহের ছুটি করিয়ে নিয়ে এসেছি। শরীরটা একটু সারিয়ে তারপর হস্টেলে পাঠাব।’

‘ভালোই করেছ , বলে অরুণাভ অন্য ঘরে চলে গেল।

স্বামীকে মিথ্যা বলতে সুচিত্রার খারাপই লাগল কিন্তু তনুর সম্মান আর মর্যাদা বাঁচাতে হলে হাজারো মিথ্যা বলার জন্য সুচিত্রা মনকে আগে থেকেই প্রস্তুত করে রেখেছে সুতরাং বাড়ি থেকে শুরু করতে অসুবিধা হল না ওর।

ফোন করে দিদিকে জানিয়ে দিল সুচিত্রা, তনুর শরীর পড়াশোনার চাপে সামান্য খারাপ হয়েছে ঠিকই কিন্তু চিন্তা করার মতো কিছু হয়নি।

রাতের খাওয়া শেষ হতেই তনুকে রুমনের ঘরে শুইয়ে দিল সুচিত্রা আর ছেলেকে নিজের সঙ্গে নিয়ে নিল। সারা রাত সুচিত্রা চোখের পাতা এক করতে পারল না। তনুর কথাই বারবার মনে হতে লাগল। আজকাল ইয়ং জেনারেশনের এতটা চেঞ্জ সুচিত্রা কিছুতেই সমর্থন করতে পারল না। কোনও বুদ্ধি-বিবেচনা করে এই প্রজন্ম কাজ করে না যেটা সত্যিই বিরক্তিকর।

সুচিত্রা খুব ভালো করেই জানে, চন্দনের সঙ্গে সঙ্গে তনুও এই ঘটনার জন্য সমান দোষী। তবুও এই ব্যাপারটা দিদিরই জানার কথা ছিল কিন্তু সুচিত্রা জানে, মায়েদেরও একটা বিশাল দোষ যে, তারা সন্তানের সঙ্গে বন্ধুর মতো আলোচনা করে না, অথচ সমস্যা কিছু একটা হলে শাসন করতে ছাড়ে না। ফলে সন্তানও মায়ের সঙ্গে শেয়ার করতে চায় না।

সকালবেলায় রুমন বায়না ধরল স্কুল যাবে না, তনুদিদির সঙ্গে সারাদিন কাটাবে। সুচিত্রা অনেক বুঝিয়ে ওকে স্কুল পাঠাল। সবাই কাজে চলে গেল। সুচিত্রা তনুকে বলল, ‘তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নে। তোকে নিয়ে একটু বেরোব, ডাক্তারের কাছে যাব।’

‘ডাক্তার… কেন মামি…?’ মনে হল তনু ওখানেই বসে পড়বে।

‘আমি তোকে কালকেই বলেছিলাম, তোকে নিয়ে একটা জায়গায় যাব। তোর জীবনটা নিয়ে কোনওরম রিস্ক আমি নিতে চাই না , সুচিত্রা তনুর মনে সাহস জোগাবার চেষ্টা করল।

ডাক্তার তনুর সবরকম পরীক্ষা করলেন। উনি সুচিত্রাকে আলাদা ডেকে জানালেন, ‘ঘাবড়াবার কিছু নেই। অনেক কারণেই ইয়ং বয়সে পিরিয়ডের সমস্যা হয়ে থাকে। আমি ওষুধ লিখে দিচ্ছি, কয়েকদিন খেলেই আবার এনার্জি ফিরে পাবে। ও সামান্য দুর্বল সুতরাং ওর খাওয়া-দাওয়াটার একটু খেয়াল রাখা দরকার। এমনি আর কোনও ওর প্রবলেম নেই।’

আনন্দে সুচিত্রা ডাক্তারকে ধন্যবাদ জানিয়ে বাইরে বেরিয়ে এল। মন থেকে মেঘ সরে যেতেই সুচিত্রা আবার রোদ ঝলমলে দিনের অগ্রিম আভাস টের পেল।

রাস্তায় বেরিয়ে তনুর জন্য শপিং করল সুচিত্রা। রেস্তোরাঁয় বসে দুজনে তনুর পছন্দের খাবার আর আইসক্রিম খেয়ে বেরিয়ে এল। দুঃস্বপ্নের দিনগুলো থেকে তনুকে বাইরে বার করে আনার চেষ্টার কোনও ত্রুটি রাখল না সুচিত্রা।

বাড়ি ফিরতেই তনু সুচিত্রার গলা জড়িয়ে ধরল, ‘থ্যাংক্স মামি। কালকে তোমার সঙ্গে কথা বলার পর থেকে আজ পর্যন্ত যা যা হয়েছে তাতে আমার মন অনেক হালকা লাগছে। সত্যিই তুমি যদি আমাকে জোর না করতে আমি হয়তো তোমাকে খুলে বলতেই পারতাম না ঘটনাটা। মনের মধ্যেই পুরোটা থেকে যেত এবং কিছু হয়তো একটা করেও বসতাম। তুমি যেভাবে ব্যাপারটা হ্যান্ডল করেছ আমি সত্যিই টেনশন ফ্রি হয়ে গেছি।

শুধু একটাই কথা খালি মনে হচ্ছে, ‘আমি কী করে এমন অবিবেচকের মতো কাজ করলাম? ঘটনাটায় আমার নিজের সবথেকে বেশি দোষ এটা স্বীকার না করা ছাড়া উপায় নেই , বলতে বলতে তনুর চোখ দিয়ে জল পড়তে লাগল।

‘অবশ্যই তুই এমন একটা ভুল করেছিস যার কোনও ক্ষমা নেই। কিন্তু এই যে তুই নিজের ভুল বুঝতে পেরেছিস, প্রায়শ্চিত্ত করেছিস এটাই সবথেকে বড়ো কথা। সম্পর্ক সবসময় প্রথম মন থেকে হয়। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক হোক অথবা প্রেমিকের সম্পর্কই হোক, প্রথম সম্পর্ক মনের গভীর থেকেই শুরু হয়। শরীর দিয়ে নয়।

চন্দনের সঙ্গে তোর মনের কোনও সম্পর্কই যেখানে ছিল না সেখানে ওকে নিয়ে এত চিন্তা করার দরকারটা কী? বরং ওকে মন থেকে সরিয়ে এবারে পড়াশোনায় মন দে আর আমার বিশ্বাস আর তুই এরকম ভুল করবি না’, বলে সুচিত্রা আলতো করে তনুর গালে সস্নেহে আদর করে। তনু যেন খানিকটা বিহ্বল হয়েই জড়িয়ে ধরে সুচিত্রাকে।

সেই মুহূর্তেই তনুর মোবাইল বেজে ওঠে, ‘মা আমি এখন একদম ভালো হয়ে গেছি। মামি আমার অসুখ সম্পূর্ণ সারিয়ে দিয়েছে…’ বলতে বলতে তনুর হাসির শব্দ সারা ঘরে প্রতিধবনিত হতে থাকে।

 

 

রোজদিনের রাস্তা

মানস বোস, কেউ বলে মানসা, কেউ বা আরও ভালোবেসে মা মনসা। পাঁচ ফুট দুই ইঞ্চির রোগা চেহারার লোকটি জেলা অফিসের একটি দফতরের বড়োবাবু।

বছর ছাপ্পান্নর ভদ্রলোকটি ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি মাস বাদ দিলে, বাকি সময় হাফশার্ট আর চটি পায়ে অফিসে আসেন। বাকি মাসে পাম শু, ফুল শার্ট আর হাফ সোয়েটার। মাথার বাঁ দিকে সিঁথে, চুল এক্কেবারে পেতে ছড়ানো।

আটটা একত্রিশের লোকাল ট্রেনের নির্দিষ্ট কামরাতে উঠলেই, সবাই যে-যার খুশিমতো ডেকে ঠাট্টা ইযার্কি আরম্ভ করে। মানস বোস রাগেন না, বা রাগলেও প্রকাশ করেন না। বেশির ভাগ দিনেই ট্রেনে বসার জায়গাটা রাখা থাকে, না পেলে দাঁড়িয়ে চলে যান। কারও-র সাথে কোনও রকম বিরোধে সচরাচর যান না। কম কথা বলেন, হাসেন কম, আসা-যাওয়ার মাঝে এই টুকটাক যা কথাবার্তা এই নিয়ে চলে মানস বোসের নিত্যযাত্রা।

শনি, রবি বা অন্যান্য ছুটির দিন বাদে মানসবাবুর প্রতিদিনের কাজকর্মও এক্কেবারে নিয়মমাফিক। ঘুম থেকে ওঠেন সাড়ে চারটে থেকে পৌনে পাঁচটার মধ্যে। নিজের হাতের তৈরি এক কাপ চা পান করে একটু হেঁটে যোগব্যায়াম করে বাড়ি ফেরা। তারপর ভাতের জল চাপিয়ে স্নান সেরে রান্নার কাজ আরম্ভ করেন।

মানসবাবু সকাল সাড়ে সাতটায় ভাত খেয়ে পৌনে আটটার বাস ধরেন। বাস থেকে নেমে ট্রেন, ট্রেন থেকে নেমে হেঁটে বা কোনও দিন অফিসের গাড়িতে অফিস পৌঁছন।

সকালে বউয়ের সাথে কথা বলা মানে আলু পটলের নাম গোত্র অথবা একমাত্র মেয়ে কলেজ বা টিউশন বা হাত খরচের টাকা নেওয়া সম্পর্কিত। কোনও দিন বউয়ের মনটা বাগান বাগান থাকলে বা সকালে ভালো ভাবে পেট পরিষ্কার হয়ে গেলে, আরও দু-একটা কথা বলেন তার মধ্যে বেশির ভাগটাই নিজের বাপের বাড়ি নিয়ে।

মানসবাবুর মেয়ে কলেজে পড়ে, গড়ন রোগা হলেও মায়ের মতো গায়ে রং-টা ফরসা। এখনকার চালচলন সম্পর্কে খুব বেশি সচেতন। নিয়মিত বিউটি পার্লার যায়, বন্ধু বান্ধবদের সাথে সিনেমা-টিনেমা তো আছেই। এখনও পর্যন্ত কোনও বিশেষ বন্ধু হয়েছে কিনা সে ব্যাপারে জানা না গেলেও, মায়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাবার গায়ে হুল ফোটাতে বেশ পটু হয়ে গেছে। মায়ের আশীর্বাদে এই দক্ষতা দিন দিন বেড়েই চলেছে। মাধ্যমিক পাশ করেই মোবাইলের জন্য তীব্র অসহযোগ আন্দোলনের মাধ্যমে মানসবাবুকে হারিয়ে নিজেকে মায়ের যোগ্য কন্যা হিসাবে প্রমাণও করে দিয়েছে।

মানসবাবুও কোনও আঠারো ইঞ্চির কপাল নিয়ে জন্মাননি। তাঁর বউও পৃথিবীর সেই একমাত্র ব্যতিক্রমী ভদ্রমহিলা হবেন, যিনি সব কিছু ছেড়ে শ্বশুরবাড়িতে এসে একমাত্র নিজের স্বামীর স্বার্থটাই দেখবেন। অন্তত মানসবাবু কোনও দিন স্বপ্নেও একথা ভাবেননি! বউএর পাশে দাঁড়ালে তাঁকে আরও নিরীহ অসহায় লাগে।

সন্ধে সাড়ে সাতটা থেকে আটটার মধ্যে মানসবাবু যখন বাড়ি ফেরেন, বউ তখন টিভির সাথে মধুর সহবাসে ব্যস্ত থাকেন। পেমেন্টের দিন বা অন্য কিছু বিশেষ দরকারের দিনে এক কাপ চায়ের সাথে কিছু খাবার মানসবাবুর মুখের সামনে পৌঁছে দেন। আর না হলে বলেন, চা করা আছে, গরম করে নাও, অথবা গিলে নাও।

এই বিশ বছরের বৈবাহিক জাঁতাযন্ত্রে বউএর রাগ, মন খারাপের রূপ, রং, গন্ধ, স্পর্শগুলো খুব ভালো ভাবে বুঝে গেছেন। যেমন যেদিন নিজে দরজা খুলে হাত থেকে বাজারের ব্যাগটা টেনে নেন, তার মানে আবহাওয়াটা বাগান বাগান। তা না হলে মেঘ জমেছে। সেদিন কোনও কথা না বলে চুপচাপ জামাকাপড় ছেড়ে, হাত পা ধুয়ে নিজের চা গরম করে নেন। মুড়ির কৌটো থেকে মুড়ি বের করে চায়ে চুমুকের সাথে মুড়ি চিবোতে চিবোতে ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করেন, রুটি হয়ে গেছে? উত্তরটাও সেদিনের আবহাওয়ার মতোই আসে।

সন্ধের থেকে রাতটা আরও ভয়ানক হয়ে ওঠে। একটা শীতল জড়বস্তুর পাশে শুয়ে নিজের অঙ্গ প্রত্যঙ্গ সব নিস্তেজ হয়ে পড়ে। অন্তত মানসবাবুর নিজের সেই রকমই মনে হয়। তবুও কোনও কোনও দিন শরীর হালুম হালুম করে ওঠে। পাশে শুয়ে থাকা শীতল যন্ত্রটাকে নিজের দিকে টেনে নিতে গেলে স্পিকার বেজে ওঠে, সেই কয়েকটা বুলি, লজ্জা লাগে না, মেয়ে বড়ো হয়ে গেছে। বা মরণ! কখনও আদিখ্যেতা!

মানসবাবুর জেগে ওঠা রঙে আলকাতরা মিশে যায়। জেগে যাওয়া শরীর নুয়ে পড়ে, জোর করে ঘুম পাড়িয়ে দেন। কোনও কোনও দিন শরীর বাগ মানে না। জেগে উঠে, বিছানা নড়ে। পাশের শীতল যন্ত্রের স্পিকারে শোনা যায, বাথরুমে যাও। তার পরেই ফুলস্টপ।

মানসবাবুর মেয়ে খুব ব্যস্ত। সকালে অফিস বেরিয়ে যাওয়ার পরেই ঘুম থেকে ওঠে। ফেরার সময় বেশির ভাগ দিনেই ব্যস্ত থাকে নিজের কাজে। কী কাজ, মানসবাবু জিজ্ঞেস করেন না। করলেও উত্তর আসে, তোমাকে বলে কী করব? কিছু বুঝবে কি? সেই তো সেকেলেই রয়ে গেলে। মায়ের সাথে পাল্লা দিয়ে হুল ফোটায়। মানসবাবুর ব্যথা লাগলেও কিছু বলা যায় না। বউ মেয়ে সাঁড়াশি আক্রমণে বেচারা বোসবাবুর যা অবস্থা, তা বর্ণনা করতে গেলে দক্ষতার প্রয়োজন হয় না।

মানসবাবুর অফিসটাও খুব অদ্ভুত। সকাল থেকে দুপুর হয়ে বিকাল শুধু কিছু ফাইল আর লেখা। না হয় পেপার পড়া। ডিপার্টমেন্টের না আছে কোনও ঘুসের ব্যবস্থা, না আছে কোনও মহিলা কর্মচারী। আগে দুএকজন যা ছিল ফাঁক-তোল, ভাঁজ-খাঁজ দেখা যেত। কিন্তু কয়েক বছর আগে অন্য জায়গায় বদলির পরে শুধু ফাঁকা মরুভূমি।

তবে খুব ভালো লাগার জায়গা হল ট্রেনের কামরা। যদিও তিনি খুব একটা সক্রিয় যাত্রী নন। এমনকী তাঁকে নিয়ে ইয়ার্কিতে ফাজলামিও বেশি হয়। তাও অন্য কেউ কিছু বললে শোনেন, অন্যের ইয়ার্কিতে মন পুলকিত হয়ে ওঠে। তাঁদের নজনের নিত্যযাত্রীর দলে কোনও মহিলা সঙ্গী নেই। বোসবাবু ছাড়া বাকি সবাই কম-বেশি নেশা করেন, খিস্তিখাস্তাও চলে। মহিলা নিত্যযাত্রী থাকলে অসুবিধা হয়।

এমনি যাত্রীদের সেরকম পাত্তা দেওয়া না হলেও, মহিলা যাত্রীদের আড় চোখে দেখে নেওয়া হয়। বোসবাবুও এই রস নেওয়া থেকে বাদ যান না। বিশুদা এলে খুব ভালো লাগে, তিনদিন আসেন বিশুদা। ওষুধ সাপ্লাই করেন, জামার বাঁ দিকের পকেট থেকে প্যাড বের করে ফোনে জিজ্ঞেস করেন, কপাতা? সঙ্গে একটা দামি মোবাইল থাকে। নিজের কাজ হয়ে যাওয়ার পরে মোবাইলটা বেশির ভাগ দিনেই বোসবাবুকে দিয়ে দিলে, তিনি ওটাকে আড়ালে নিয়ে চলে যান। একমনে দেখেন, আর শরীরের ঘুম ভাঙান। অনেকেই এই ব্যাপারটা দেখে টিপ্পনি কাটে, তবে তাতে বোসবাবুর কোনও কিছু এসে যায় না, হেসে উড়িয়ে দেন।

নজনের নিত্যযাত্রীদের প্রায় সবাই বযস্কদের জায়গা ছেড়ে বসতে দেন। আর জায়গা ছাড়েন ছেলে কোলে দাঁড়িয়ে থাকা মহিলা যাত্রীদের। শুধু কম বয়সী মহিলা, কলেজ পড়ুয়াদের বসতে জায়গা ছাড়েন না। তবে সেদিন এর ব্যতিক্রম ঘটল এবং ঘটালেন সেই মানস বোস।

লোকাল ট্রেনে সেদিন অস্বাভাবিক রকমের ভিড়। দেওঘরের কোনও এক আশ্রমের উৎসবের জন্য ট্রেনের সব কামরা তাদের দখলে। ট্রেনে ওঠার আগে এই খবরটা পেলেও কোনও এক্সপ্রেস ট্রেন না থাকার কারণে সবাইকে লোকালেই উঠতে হয়। উঠতেই পিছনের থেকে কেউ একজন বলে উঠল, কাকা, আজ মাছিও গলবে না। বোসবাবু তাকে কোনও উত্তর না দিয়ে আস্তে আস্তে ভিতরের দিকে এগিয়ে যান।

অন্যদিনে যে-সিটে তিনজন বসে থাকে আজ সেখানেই পাঁচজন। বোসবাবু কোনও রকমে একটা জায়গায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে চেনাজানা কাউকে দেখতে পাওয়া যায় কিনা দেখতে লাগলেন। মাথা নাড়িয়ে নিজের উপস্থিতি জানালেন। কেউ আবার তাঁকে দেখে বলে উঠল, বোসদা আমাদের এদিকে আসুন, গল্প করা যাবে।

না ভাই, আজ যে এখানে দাঁড়াবার জায়গা পেয়েছি এটাই অনেক।

কেউ আবার বলে উঠল, কি রে মানসা, কোনও এক্সপ্রেস পেলি না? ভিড়ে মরতে এলি, না মারাতে?

বোসবাবু এবারেও হেসে উত্তর দেন, উৎসব চলছে তো তাই এত ভিড়।

নিত্যযাত্রীদের অনেকেই সেদিন পেপার বা পলিথিন পেতে দরজার সামনে বসেছিল। বোসবাবুর একবার এভাবে বসতে গিয়ে প্যান্ট ফেটে গেছিল! সে এক যাচ্ছেতাই অবস্থা। সারাটা দিন ভগবানকে গালাগালের সাথে, জামা দিয়ে ফাটা জায়গা ঢাকতে হয়েছিল। তবে এইদিন মানসবাবুর ভাগ্যটা হয়তো একটু প্রসন্ন ছিল। পরের স্টেশনে একটা জায়গা পেয়ে গেলেন। গোটা সিট না হলেও এই বাজারে সেই সিটের যে কী মহিমা, তা আর বোঝাতে হবে না। অবশ্য সঙ্গে সঙ্গে শুনলেন, বোসদা আজ একটা লটারি কেটে নিন।

বোসবাবু কিছু না বলে হালকা হাসলেন। বুঝতে পারলেন নজর লেগে গেল, হলও তাই। এক স্টপেজ যেতে না যেতেই একটা মেয়ের গলা কানে এল, কাকু কাইন্ডলি আমাকে একটু বসতে দেবেন, পায়ে খুব ব্যথা করছে, আজ আমার পরীক্ষা আছে। বোসবাবু ঘাড় ঘুরিয়ে মেয়েটিকে দেখলেন। তাঁর মেয়ের মতোই বয়স, একটু বড়োও হতে পারে। জিন্স-এর প্যান্ট আর কুর্তি পরে আছে। গায়ে রং-টা চাপা হলেও মুখটা বেশ ভালো। কোনও ছেলে হলে এতক্ষণ জবাব না দিয়ে উলটো দিকে মুখ ঘুরিয়ে বসে থাকতেন। সেই জায়গায় উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, বোসো, তবে জায়গাটা খুব কম। মেয়েটি বোসবাবুর দিকে তাকিয়ে হালকা হেসে, থ্যাংক ইউ বলে বসেই হাতে থাকা একটা খাতাতে চোখ ডুবিয়ে দিল।

বোসবাবু আবার আগের জায়গায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে মাঝে মাঝে আড়চোখে মেয়েটিকে দেখতে লাগলেন। দুএকজন চেনা নিত্যযাত্রী দাঁড়ানোর কারণ জিজ্ঞেস করলে, তিনি চোখের ইশারাতে বোঝানোর চেষ্টা করলেন। কিছুক্ষণ পরেই মেয়েটি বলে উঠল, কাকু তোমার ব্যাগটা দাও, আমি ধরছি। বোসবাবু, না, ঠিক আছে বললেও মেয়েটি মানসবাবুর হাত থেকে ব্যাগটা প্রায় কেড়ে নিজের কোলে নিয়ে তার ওপর খাতা রেখে পড়তে আরম্ভ করল।

হাতের ভার কমলেও বোসবাবু আর মেয়েটির কুর্তির কোনও ভাঁজ দেখতে পেলেন না। তবে সারাদিন মনটা বেশ বাগান বাগান হয়ে থাকল। অলিগলি থেকে ট্রেনের মেয়েটার ভেসে ওঠা মুখটা শরীরটাকেও নাড়িয়ে দিচ্ছিল। কাজ করবার সময় গুনগুন গান আঙুলগুলোর মধ্যে একটা অনুঘটকের কাজ করছিল। এমনকী বাড়ি গিয়ে বউয়ের মুখ ঝামটা শুনেও সেরকম কোনও প্রতিক্রিযা হয়নি।

বাড়ি ফিরে বারান্দার অন্ধকারে দাঁড়িয়ে এক ভাবে আকাশের দিকে তাকিয়ে থেকে অথবা হাওয়ার সাথে মিশিয়ে নিজের গাওয়া দু-এক কলি গান গাওয়ার মধ্যেও মেয়েটি চলে আসে। রাতে শুয়ে ঘুম আসেনি। বন্ধ চোখের সামনে সেই মুখ মনে শরীরে এক অদ্ভুত তৃপ্তি এনে দিয়েছে। কিছুক্ষণ পরেই অবশ্য বউয়ের ভয়ে বাথরুম চলে যেতে হল।

তার পরের দিনও সেই একই রকমের ভিড় ঠেলে কিছুটা ট্রেনের ভিতরে গিয়ে ঘাড় ঘোরাতেই, আগের দিনের মেয়েটিকে বসে থাকতে দেখে একটু রাগই হল। নিশ্চয়ই আবার কারওর পি… মেরে জায়গা করে নিয়েছে। কিছু না বলে একটু ইতস্তত করে আরও ভেতরের দিকে যাওয়ার পরেই পিছনের দিক থেকে শুনলেন, ও কাকু, আমি এখানে, দেখতে পাওনি?

বোসবাবু আর না এগিয়ে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বললেন, না, মানে দেখতে পাইনি।

বুঝেছি, আর বলতে হবে না। না দেখার ভান করে চলে যাচ্ছিলে।

মানসবাবুর মাথাতে আর কোনও জলজ্যান্ত মিথ্যা কথা এল না। আমতা আমতা করে বললেন, তুমি পড়ছিলে তো তাই।

কই আজ তো আমি পড়িনি।

পরীক্ষা শেষ?

কাল একটা ডিপার্টমেন্টের পরীক্ষা ছিল।

তারপরে সিট ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, কাকু, আজ তুমি বোসো।

না না ঠিক আছে। আমরা তো প্রতিদিন জায়গা পাই না। দাঁড়িয়ে যাওয়ার অভ্যাস আছে।

পাশে বসে থাকা আর একজন যাত্রী বললেন, আপনি বসুন, আমি পরেরটাতেই নেমে যাব।

মেয়েটির পাশে কুঁকড়ে বসতেই মেয়েটি বলে উঠল, ও কাকু, তুমি ওরকম জড়ভূতের মতো বসে আছো কেন? বি কমফর্টেবল।

না না, আমি ঠিক আছি।

দূর কিছু ঠিক নেই।

মানসবাবু মেয়েটির দিকে আরও একটু সরে বসলেন।

আজও আগের দিনের মতোই জিন্স আর টপ পরেই এসেছে। ডান কাঁধের সাথে বোসবাবুর বাঁ কাঁধ লেগে আছে, কনুইটা বুকের কাছাকাছি।

পিছন থেকে নিত্যযাত্রী ভোম্বল বলে উঠল, বোসদা লটারি কিনেছিলেন? আজ মিলিয়ে নেবেন, ফার্স্ট প্রাইজ পেয়ে গেছেন। শুধু বউদিকে একটু সাইজে আনতে হবে।

ওষুধের বিশুদা বলে উঠল, নতুন ডাউনলোড করেছি দেখবেন নাকি? দেব ওখানে। বোসবাবু কিছু সময় মেয়েটির কাছে বসে উঠে দাঁড়িয়ে বলে উঠলেন, তুমি এখানে বোসো, আমি একটু বন্ধুদের কাছে যাই, ওরা আবার কী ভাববে।

ওরা তোমার লেগপুল করছে?

না না। আসলে প্রতিদিন একসাথে যাই তো, তাই একটু মজা করছে।

কথাগুলো শেষ করেই জায়গাটা ছেড়ে পিছনের দিকে চলে গেলেন। কিন্তু নিত্যযাত্রীদের কাছে রীতিমতো টোন টিটকিরি সহ্য করতে হল। সেটা অবশ্য প্রতিদিনই হয়। তবে সেদিন এতটাই মাত্রা ছাড়াল যে, বোসবাবু তাদের থেকে পাশে সরে দরজার সামনে একাই দাঁড়িয়ে থাকলেন। হাওয়া আসছিল, মনটাও ভেসে ভেসে যাচ্ছিল। কিন্তু সব কিছু কেমন যেন অস্থির। সব সময় ইয়ার্কিও ভালো লাগে না।

কাকু বসবে না তুমি? কথাটা শুনে ঘাড়টা ঘোরাতেই দেখলেন আবার সেই মেয়েটি, এক্কেবারে কাছে দাঁড়িয়ে আছে। বোসবাবু একটু কঠিন ভাবে বললেন, কী ব্যাপার তুমি উঠে এলে?

তুমি বসবে না?

তুমি বোসো।

মেয়েটি আর কথা না বাড়িয়ে আস্তে আস্তে নিজের জায়গাতে ফিরে গেল। কিছুক্ষণ পর মানসবাবুর মনটা হু হু করে উঠল। মেয়েটিকে এরকম ভাবে না বললেই হতো। বেচারি শুধুমাত্র বসতে বলবার জন্য এসেছিল।

মেয়েটির কাছে গিয়ে ওকে সরিয়ে নিজের বসবার ব্যবস্থা করলেন। কিছু সময় পরে মেয়েটি, বোসবাবু কোথায় কাজ করতে যান থেকে আরম্ভ করে, বাড়িতে কে কে আছে, সব জেনে নিল।

মানসবাবুও জানলেন ওর নাম অনুশ্রী। এবার নিত্যযাত্রীরা কেউ কিছু বললেও, বোসবাবু কাউকে কোনও পাত্তা দিলেন না। সারাটা রাস্তা অনুশ্রীর সাথে গল্প করে যেতে লাগলেন।

ট্রেন থেকে নেমেই অনুশ্রী বলে, কাকু তোমার অফিস তো কাছেই, পরের ট্রেনে তো আসতে পারো। দশটার মধ্যে ঢুকে যাবে।

ট্রেনের কামরাতে থাকবার সময় অনুশ্রীর কথাটা সেরকম ভাবে না শুনলেও, অফিসের রাস্তায় হাঁটবার সময় কথাগুলো কানের কাছে গুন গুন করতে আরম্ভ করল। সত্যিই তো পরের ট্রেনটাতেও আসা যায়! বাড়িতে আরও আধ ঘন্টা বেশি সময় পাওয়া যাবে। আর একটু বেশি সময় ঘুমানো যাবে। ট্রেনেও শুধুমাত্র অনুশ্রী। তাছাড়া অফিসে তাড়াতাড়ি এসেই বা কী করবেন, সেই তো বসে বসে পেপার পড়া। না হয়, এর ওর সাথে গল্প করা। মাঝে মাঝে বিরক্ত লাগে।

অনুশ্রীর মোবাইলে ফোন করতেই সঙ্গে সঙ্গে ওপার থেকে উত্তর আসে,

বলো কাকু…

ক্লাসে?

না, এই তো নামলাম।

শোনো কাল থেকে পরের ট্রেনেই আসব।

বেশ কাকু তাই হবে। পিছনের থেকে তিন নম্বর কামরাতে উঠবে, আমি জায়গা রাখব।

পরের দিন থেকেই মানসবাবু সব কিছু আধঘন্টা পরে করতে আরম্ভ করলেন। সেই ঘুম থেকে ওঠা থেকে আরম্ভ করে বাস ধরা পর্যন্ত সব কিছু আধ ঘন্টা পিছিয়ে গেল। বাকি সব কিছু একই ভাবে চললেও আরেকটা বড়ো পরিবর্তন বউয়ের চোখে পড়ল। অফিসে যাওয়ার সময় এই প্রথম জামা ইন করে পরতে আরম্ভ করলেন, সঙ্গে জুতো। এমনকী মেয়ের বডি স্প্রে-র গন্ধও জামার ঘামের গন্ধ থেকে বেরিয়ে আসতে লাগল। বউ সব কিছু দেখেও কিছু বললেন না। কিন্তু মাস দেড় পরে স্বামীর সাজ বেড়ে উঠতে দেখে, একদিন মানসবাবু বেরিয়ে গেলে, মেয়ের সাথে আলোচনা করলেন, হ্যাঁ রে তোর বাবার হল কী? এত চকচকে পোশাক, উড়ো উড়ো ভাব, বুড়ো বয়সে প্রেমে পড়ল নাকি?

মেয়ে সব কিছু দেখে শুনে, মাকে চিন্তা করতে বারণ করলেও নিজের কাছে অস্বস্তি গোপন থাকল না। ট্রেনে কিন্তু বোসবাবুর যাতাযাতের মজা আরও দ্বিগুন বেড়ে গেল। পরের ট্রেনটা তুলনামূলক ফাঁকা আসে। অনুশ্রীও প্রতিদিন বোসবাবুর জন্য জায়গা রেখে দেয়। সারাটা রাস্তা দুজনে গল্প করতে করতে চলে যান। শনি, রবি বা অন্যান্য ছুটির দিনে মন খারাপ লাগে। অনুশ্রীকে ফোন করেন।

বিশুদা কথা প্রসঙ্গে মোবাইলে আরও নতুন কিছু আনার খবর দেয়। মানসবাবু উত্তরে শুধু হাসেন। কিন্তু ট্রেন বা কার সঙ্গে কোন কামরাতে উঠলেন, সে সম্পর্কে কোনও কথাই বলেন না। রাতে ফিরে একা বসে প্রায়ই গুনগুন করে গান করেন। শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েন তাড়াতাড়ি। বউ ঘুমিয়ে থাকা বোসবাবুকে দেখে বোঝার চেষ্টা করেন। কিছু বুঝতে না পেরে পরের দিন বোসবাবু বেরিয়ে যাওয়ার পরে, আবার মেয়ের সাথে আলোচনা করতে বসেন।

 

সেদিন অফিস থেকে ফিরে মানসবাবু অবাক হয়ে যান। বেল বাজাতেই বউ তাড়াতাড়ি এসে হাত থেকে ব্যাগ নিয়ে চেযার টেনে বসতে দেন। হাত মুখ ধোওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হাতের কাছে চা তৈরি করে দেন। মেয়ে ডিম পাঁউরুটি তৈরি করে দাঁড়িয়ে থাকে। মানসবাবুর খাওয়ার আগে অবাক হয়ে সবার মুখের দিকে তাকাতে থাকেন।

বিবাহবার্ষিকী, দু-একটা পূজাপার্বণ আর মেয়ের জন্মদিন ছাড়া, অফিস থেকে ফিরে এরকম জলখাবার আর কোনও দিন হয় কিনা মনে করতে পারলেন না। তাই অত খাবার দেখে জিজ্ঞেস করলেন, আজ কি কোনও অনুষ্ঠান আছে? কোনও পুজো-টুজো!

না না, অনুষ্ঠান কেন থাকবে? রোজ ওই এক মুড়ি। তাই মাম্পি বলল, ডিম পাঁউরুটি করবে। এই টিফিনটা শুধুমাত্র একদিনের জন্যেই নয়। এরপর অফিস থেকে ফিরলেই বিভিন্ন রকমের টিফিন নিয়ে মা, মেয়ে হাজির থাকত।

এখন রাতে শুয়ে বউ নিজের থেকে নিজের দিকে টেনে, বিয়ের প্রথম কয়েক বছরের সেই সব দিনের কথা আলোচনা করে। তারপর মাঝে মাঝেই জানলাতে মুখ রেখে মাম্পি ঘুমিয়ে গেছে কিনা দেখে নিয়ে নিজেদের ঘরের দরজার ছিটকিনিটা তুলে দেয়। বোসবাবুর এখন ঘুম থেকে উঠতে একটু বেশি দেরি হয়। তবে অসুবিধা হয় না, হেঁটে এলেই হাতে রেডি চা পেয়ে যান।

এখন আর আনাজ কাটতে বসতে হয় না, ভাতের জলও চাপাতে হয় না। সব কাজ মা আর মেয়ে মিলেই সামলে দেয়। বোসবাবু ট্রেনে যাওয়ার সময় অনুশ্রীর সাথে সব কিছুর আলোচনা করেন, তবে পরিবর্তনের কারণ বুঝতে পারেন না। অনুশ্রীও কিছু বলে না।

একদিন প্ল্যাটফর্মের ওভারব্রিজে উঠতে উঠতে পুরোনো নিত্যযাত্রীদের দলের তপন ফোন করে, কী ব্যাপার বোসদা, আমাদের ছেড়ে নতুন বান্ধবী পাতিয়েছেন শুনলাম! বউদি সব জানে তো? গা পিত্তি জ্বলে উঠল। কাছে থাকলে টেনে দুথাপ্পড় কষাতেন।

বেশ জোর গলাতেই উত্তর দিলেন, সে খবরে তোমার কী দরকার? বলেই ফোনটা কেটে দিলেন।

ট্রেন আসতে মিনিট দশ দেরি হল। পিছনের দিক থেকে তিন নম্বর কামরাতে উঠলেন। অনুশ্রী বাঁ দিকটাতে বসে। বোসবাবু বাঁ দিক দেখলেন, ডান দিক দেখলেন, কই নেই তো! সামনে উঠল নাকি? চলন্ত ট্রেনের ভিতর হেঁটে সেই কামরার সামনের দিকে এলেন। না নেই। ভালো লাগছে না। মোবাইলের কন্ট্যাক্ট-এ গিয়ে অনুশ্রীকে ডায়াল করলেন। কী আশ্চর্য! ফোন বন্ধ! তাহলে? একটা জায়গাতে বসলেন বোসবাবু, কিন্তু অনুশ্রী কই? আসেনি, নাকি সামনের দিকে উঠল? এরপর কি পুরো ট্রেনটা দেখতে হবে? শরীরে একটা অস্বস্তি আরম্ভ হল। না আর বসা যাবে না।

অফিসেও সেদিন কোনও কাজ করা তো দূর, ভালো করে বসে থাকতেই পারলেন না। একটা চাপা কষ্ট তাড়িয়ে বেড়াচ্ছিল। বাড়িতে সেই এক অবস্থা। পরের দিন একটু আগে আগে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আগের ট্রেনে অনুশ্রীর কলেজে পৌঁছলেন। বহু কষ্ট করে ভিতরে গিয়ে ডিপার্টমেন্টও পৌঁছোলেন। কিন্তু নাম বলতে কেউই বুঝতে পারল না। একজন তো বলেই দিলেন, অনুশ্রী নামে এই ডিপার্টমেন্ট-এ কেউ নেই।

কলেজের রাস্তা ধরে অফিসের রাস্তায় আর যেতে ইচ্ছে করল না। কী রকম একটা লাগছে! তার মানে আগামীকাল থেকে সেই জীবন! সেই ট্রেন? সেই বউ মেয়ে?

কলেজের রাস্তার পাশে থাকা বেঞ্চে বসলেন। কত হাজার হাজার কমবয়সী ছেলে-মেয়ে কলেজে ঢুকছে। বোসবাবু তাদের দিকে এক ভাবে তাকিয়ে থাকলেন।

হঠাৎ দুকানে ও কাকু… ডাক শুনে একটু চমকে উঠলেন। ঘাড় ঘুরিয়ে এদিক ওদিক দেখতে আরম্ভ করলেন। না মানুষটা ধারে কাছে নেই!

 

 

পড়ার জন্য সীমাহীন গল্প-নিবন্ধসাবস্ক্রাইব