দেশভক্ত

স্কুল থেকে এসে ব্যাগটা খাটে ছুড়ে দিয়ে এনসিসি-র ড্রেসটা খুলতে থাকে উপল। মা পেছন থেকে এসে বলে, ওই ঘেমো জামাকাপড়গুলো বিছানায় তুলবি না, যত রাজ্যের নোংরা লেগে আছে।

উপল ঘেমো শরীরেই মাকে জড়িয়ে ধরে, জানে মা এতে আরও বেশি রেগে যায়। মা-র এই রাগটুকু উপল উপভোগ করে, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হয়ে নিলেই মা খুশি। গরিবের সংসারে পঞ্চব্যাঞ্জন না হোক, শাকপাতা দিয়ে মা যা রান্না করে, তাই উপলের অমৃত লাগে।

দেরি না করে কলপাড়ে হুড়োহুড়ি করে স্নানটা সেরে নেয় উপল। দুষ্টুমি করে চাতালে বসে থাকা কাকটাকে ভিজিয়ে দেয়। কা কা করে উড়ে কাকটা প্রতিবাদ করে যায়।

মা রান্নাঘরের দাওয়ায় বসে উপলের সুন্দর, সুঠাম চেহারা দেখে! ছেলেটা দেখতে দেখতে বড়ো হয়ে গেল। শরীরচর্চায় খুব উত্সাহ, পুলিশ বা মিলিটারিতে যাওয়ার ইচ্ছে আছে। সবসময় বলে, দেশের জন্য কিছু করর, লড়াইয়ে ময়দানে সামনের সারিতে থাকব। ছেলের এরকম ইচ্ছেতে মায়ের মন সায় দেয় না। তবে বড়ো হচ্ছে, ওর মতকেও তো গুরুত্ব দিতে হবে।

গত বছর, পাড়ার ক্লাবের পাশের ঝিলে একটা ছেলে ডুবে যাচ্ছে শুনে, এক ডাকে বেরিয়ে গেছিল, গিয়ে দ্যাখে আশেপাশের লোকেরা ঘিরে মজা দেখছে, কারুর নামার সাহস হচ্ছে না। উপল এক লাফে জলে নেমে, খাবি খেতে খেতেও ওকে উদ্ধার করে এনেছিল।

স্কুলের শারীরশিক্ষার শিক্ষক দীপেনবাবু উপলকে বিশেষ স্নেহ করেন। উপলের সততা, সুন্দর ব্যবহার আর টিম স্পিরিট সকলের নজর কাড়ে। বিবেকানন্দ মিশন স্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্র উপল, স্যারদের ডান হাত। কোনও কাজেই পিছপা হয় না। কারও বিপদ শুনলে ওইটুকু ছেলে ঝাঁপিয়ে পড়ে।

চন্দনা ওদের ক্লাসের ফার্স্ট গার্ল। উপল যা যা পারে, চন্দনা তা পারে না বলে উপলের ওপর ওর বাড়তি আগ্রহ। উপলের বোন আইরিন একই স্কুলে ক্লাস ফাইভে পড়ে। দাদা যে সকলের প্রিয়, এতে ওর প্রচ্ছন্ন গর্ব আছে। চন্দনা ক্লাসের অন্য ছেলেদের কাছে ঘেঁষতে দেয় না। কিন্তু উপল কিছু বলুক, একবার বললেই করে দেবে।

মাধ্যমিকে উপল টায়-টায় ফার্স্ট ডিভিশন পেল, চন্দনার সবেতেই লেটার মার্কস। আরও ভালো স্কুলে একাদশে ভর্তি হতে পারত। বেচারি, উপলের জন্য একই স্কুলে রয়ে গেল।

কৈশোর অতিক্রম করে উপলের ব্যাপারে চন্দনার আগ্রহ এখন নিখাদ ভালোবাসায় পরিণত হয়েে। কীসে উপলের ভালো হয়, পড়াশোনায় ওকে কতটা সাহায্য করা যায় এসবই চন্দনার ধ্যানজ্ঞান। উপল স্কুলের ফুটবল, ক্রিকেট দলের সদস্য, পাড়ার ক্লাবে জিমও করে, লক্ষ্য এখনও পর‌্যন্ত স্থির। চন্দনা চায় উপল পড়াশোনা করে শিক্ষকতা বা ব্যাংক-এ চাকরি করুক। তবু উপলের পছন্দের উপর প্রভাব খাটাতে পারে না। যাহোক দুটো বছর একসঙ্গে পড়াশোনা করবে, চন্দনার কাছে এই-ই অনেক।

চন্দনা বিজ্ঞান নিয়েে, উপল কমার্স। টিউশনির ব্যস্ততা চন্দনার অনেক বেশি, তাও নিয়ম করে উপলের খোঁজ নেয়। বাংলা, ইংরেজি তো ওদের দুজনেরই আছে। যত প্রশ্নোত্তর চন্দনা তৈরি করে, নোটস সব উপলকে দেয়। মনের আশা, ওগুলো পড়ে যদি উপল একটু ভালো রেজাল্ট করে।

এদিকে পাড়ায় ব্লাড ডোনেশন ক্যাম্প হোক কিংবা কোথাও রিলিফ দেওয়ার ব্যাপার সবার আগে হাজির উপল। মা মনে মনে ভাবে, তাদের মতো ছাপোষা সংসারে ছেলেটা যেন কেমন অন্যরকম। সারাদিনের খাটাখাটনির পর, ক্লান্ত শরীরে উপলের বাবার আর কিছু ভাবার ক্ষমতা থাকে না। এভাবেই দিন গড়িয়ে চলে।

উপলদের পাড়ায় এক বৃদ্ধ দম্পতি আছেন, উপল তাঁদের দাদু-ঠাকুমা বলে ডাকে। কদিন আগে ঠাকুমা পড়ে গিয়ে আর উঠতে পারেন না। কে তুলবে? কে নিয়ে যাবে? উপল হাজির ঠাকুমার সেবায়। প্লাস্টার করিয়ে আনা, রোজকার নিত্যকর্মে সাহায্য করা, এমনকী রান্না করে খাওয়ানো অবধি, উপল একাই করেছে।

মা-র মনে মনে শংকা হয়, এত উদার, এত ভালো ছেলে। কোনও স্বার্থপরতা ওকে স্পর্শ করেনি। যেন দেবতা, মানুষ নয়!

ঠাকুমা তো সুস্থ হয়ে সে কথা জনে জনে বলেন, আমার নিজের ছেলে-বউ,

নাতি-নাতনিরা খোঁজ নিল না। এই প্রাণটুকু কে বাঁচালে? ওই তো উপল।

দেখতে দেখতে দুবছর অতিক্রান্ত হল উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা সামনে। চন্দনার অভিভাবকরা চান ও ডাক্তারি পড়ুক, তাই এসময় তার চাপটা একটু বেশি। উপল যথা পূর্বং তথা পরং। সবকিছুর সঙ্গে মানিয়ে ওর পড়াশোনা।

পরীক্ষার রেজাল্ট বেরোনোর পর দেখা গেল, উপল টেনেটুনে ফার্স্ট ডিভিশন আর চন্দনা সবেতে লেটার পেয়েছে। উপল জানে চন্দনা ডাক্তারিতেও চান্স পাবে। ওর দিক থেকে চন্দনাকে দখল করে রাখার কোনও চেষ্টা নেই। সময় গড়িয়ে যা হবার হবে, আগে ওর লক্ষ্যপূরণ।

দেশের-দশের কাজ করার সুযোগ আছে, এমন একটা চাকরি পাওয়া খুব জরুরি। পুলিশ, মিলিটারি দুইয়েই প্র‌্যাক্টিক্যাল পরীক্ষা খুব কঠিন হয়, উপল জানে। শরীরকে তৈরি রাখতে হয়, কতজন দৌড়ানোর ট্র‌্যাকে অজ্ঞান হয়ে যায়। তবে, স্নাতক হয়ে পরীক্ষাগুলো দেবে, তাহলে সুযোগও বাড়বে।

চন্দনা এখন কলকাতা মেডিকেল কলেজের স্টুডেন্ট, মাঝে মাঝে উপল ওকে কলেজেও পেঁছে দেয়। চন্দনার বাবা-মা-ও উপলকে মেনে নিয়েেন, ওর সততা, সুন্দর ব্যবহারের জন্য। উপলের মায়ের অবশ্য আশংকা, অমন মেধাবী মেয়ে তার সাধারণ ছেলেকে শেষ অবধি বিয়ে করবে তো? মায়ের চিন্তা ছেলে যেন কোনও ভাবে দুঃখ না পায়। তবে সাদাসিধে চন্দনাকে ভালোও লাগে। মেযোর সরলতা সবাইকে মুগ্ধ করে। সবচেয়ে বড়ো কথা, এই পরিবারের ওপর ওর টান, যেন এটা ওর নিজেরই পরিবার।

উপল সিটি কলেজে যায়, কলেজ টিমের হয়ে ইন্টারকলেজ কম্পিটিশনে খেলে।

লং-জাম্প-এ ডিস্ট্রিক্ট চ্যাম্পিয়ন। কলেজ মিটে কলকাতা কমিশনিয়ারেট-এর কর্তাব্যক্তিরা উপলের শারীরিক সক্ষমতার প্রশংসা করে, ওকে চাকরির প্রস্তাবও দেয়।

উপল মেঘ না চাইতে জল পায়, খুশি হয়ে আইরিনের জন্য ফ্রক আর বাড়ির জন্য মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে ঘরে ঢোকে। মা মিষ্টি হাতে নিয়ে চোখের জলে ভাসেন। খুশি হবেন নাকি দুঃখ পাবেন, বুঝে উঠতে পারেন না। আইরিন নতুন ফ্রক পেয়ে তিড়িংবিড়িং করে লাফাতে থাকে। মায়ের পীড়াপীড়িতে চন্দনাকে কলেজ ফেরত আসতে বলে, একসঙ্গে খাওয়াদাওয়া করে সেলিব্রেট করবে বলে।

 

পার্ট-টু পরীক্ষার রেজাল্ট বেরোতে উপল কলকাতা পুলিশের ট্র‌্যাফিক গার্ডে সার্জেন্ট হিসেবে জয়ে করে। নিয়মমাফিক সব শারীরিক পরীক্ষা উপলকেও দিতে হয়। চন্দনা অবশ্য তেমন খুশি নয়। তারা যখন ঘরে আরাম করবে, উপলকে তখন রোদে গরমে ডিউটি করতে হবে। মনে মনে ভাবে আরও পড়তে পারত। মুখে কিছু বলে না। ওর আনন্দের সঙ্গে তার নিজের আনন্দকে মিলিয়ে নিতে হবে, এতেই তার সুখ।

চাকরিসূত্রে উপলকে কলকাতা চষে বেড়াতে হয়। শুধু ইন্টার অফিস মিট থাকলে খেলার জন্য ছাড় পায়। কখনও গার্ডেনরিচ তো কখনও বেহালার রাস্তায় ট্র‌্যাফিক সামলাতে দেখা যায় তাকে। বেনিয়ম করে গাড়ি দাঁড় করানো, কি ঘুস নেওয়া, এসবে দেখা যায় না উপলকে। চাকরি জগতেও তার বিরল স্বভাবের নিদর্শন চলতে থাকে। চন্দনা এমবিবিএস ফাইনাল দেবে এ বছর, হাজার ব্যস্ততাতেও উপলের খবর রাখে। ওর ক্ষমতায় যতটুকু কুলায় পরামর্শ দেয়।

সেদিন হেদুয়ার সামনে ডিউটি করছিল উপল। উলটো দিকে বেথুন থেকে কলেজ ফেরত মেযো বেরোচ্ছিল। রাস্তায় দাঁড়িয়ে তিন রোমিও ওদের দিকে বিশ্রী অঙ্গভঙ্গি করছিল। উপলের ব্যাপারটা নজরে আসে। ডিউটির পোশাকে সরাসরি মারধর তো করতে পারে না। গিয়ে ধমক দিয়ে এলাকা ছাড়া করেছিল ছেলেগুলোকে। তখনকার মতো চলে গেলেও,ওরা উপলকে পরে দেখে নেবে বলে শাসিয়ে ছিল।

উপলের কষ্ট হয় এই ভেবে, যে আইরিনও তো দুদিন পরেই কলেজ যাতায়াত করবে আর এইসব ইভটিজারদের খপ্পরে পড়বে। এরা মেয়েের নূ্যনতম সম্মানটুকু করে না, এরা কি আমাদের দেশের পরম্পরা, ঐতিহ্য জানে? কোন ধাতু দিয়ে গড়া, নরকের কীট সব!

চন্দনাকে ফোনে ওইদিনের অভিজ্ঞতা শেয়ার করায়, ওর ভয় দ্বিগুন হল। এমনিতেই উপলকে নিয়ে সবসময় ভয়ে ভয়ে থাকে। উপল চন্দনার মধ্যে ওর মায়ের ছায়া দ্যাখে। সকলের স্বাভাবিক চলাফেরা নিশ্চিন্ত করার জন্য, পুলিশের যে বিশেষ ভূমিকা আছে, ওকথা অস্বীকার করার উপায় নেই। চোখের সামনে অপরাধ দেখে যে চুপ করে বসে থাকা যায় না, তা চন্দনাকে বোঝাতে পেরেছিল।

উপল জোর করে বাবাকে ভিআরএস নেওয়া করিয়েছে। সংসারের পুরো দাযিত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েে। আইরিনকে অনেক দূর পড়ানোর স্বপ্ন দ্যাখে। পরদিন পুলিশ মিট উপলক্ষ্যে ধানবাদ যেতে হবে। আজকে নাইট ডিউটি কলেজ স্ট্রিটে। পরদিন রাতে ধানবাদ যাওয়ার ট্রেন। বিকেলে চন্দনার সঙ্গে দেখা করে নিতে হবে। দু-তিন দিনের জন্য বাইরে গেলে এটা উপলের আবশ্যিক কর্তব্যের মধ্যে পড়ে।

চন্দনাকে বাড়িতেই ডেকে নিল উপল। চন্দনার এ বাড়িতে যাতায়াত এখন স্বাভাবিক ব্যাপার। চন্দনা এল। একটা গোলাপি রঙের সালোয়ার কামিজ পরেছে। আজ কেন যেন উপলের দুচোখ ভরে চন্দনাকে দেখতে ইচ্ছে করছে। চন্দনা অবাক হয় উপলের এই আবেগ দেখে।

মায়ের বানানো লুচি তরকারি দিয়ে দুজনে বিকেলের জলখাবার সারে। দুজনেই হাক্লান্ত, ক্ষিদেও পেয়েছিল বেশ। খেয়ে নিযে উপলের চুলের গোছা নেড়ে দিয়ে চন্দনা বেরোল। বারবার পেছন ফিরে দেখছিল। বেরোনর আগে, ধানবাদ পৌঁছে খবর দেওয়ার কথা বলেছিল। চন্দনা চলে যেতে, আইরিনকে কটা অঙ্ক বুঝিয়ে রাতের ডিউটিতে যাওয়ার জন্য তৈরি হয়ে নিল উপল।

 

মা আজ পাড়ায় কীর্তন শুনতে যাবেন। তাও ছেলের কাচা পোশাক, সবকিছু গুছিয়ে দিলেন। কী মনে হতে উপল ঢিপ করে মাকে একটা প্রণাম করে নিল। সংসার চালানোয় মায়ের নিপুণতা উপলকে মুগ্ধ করে। চন্দনাকে ঘিরেও স্বপ্নের বীজ বোনে। বড়ো শ্রীমযী চন্দনা, অফুরন্ত ভালোবাসা দেয় তাকে।

আজ ডিউটিতে উপল ছাড়াও আরও দুজন সার্জেন্ট আছে। রাতের রাস্তা আস্তে আস্তে ফাঁকা হচ্ছে, ভারী গাড়ির আনাগোনা এসময় বেশি। দুজন সঙ্গী কাছের দোকানে চা খেতে গেল। উপল সতর্ক চোখে তাকিয়ে আছে। হঠাত্, ওকি!

বাইকের পেছনে একজন তরুণী, চালাচ্ছে এক যুবক। পাশে একটা গাড়ি থেকে বাইকটাকে ডিসটার্ব করা হচ্ছে। তরুণীর ওড়নাটাকেও টেনে ধরেছে।

গাড়িটাকে দাঁড় করাল উপল। ভেতর থেকে মদ্যপদের খিস্তি, খেউড় ভেসে আসছে। ওরা নেমে এসে উপলের ওপর চড়াও হল। চারজনে মিলে লাগাতার মেরে চলেছে ওকে। একা অভিমনু্য় যেন জগতের সব লাঞ্ছনা মুছে দিতে চাইছে। নাক দিয়ে রক্ত ঝরছে, পা ভেঙে গিয়েে, কেউ সাহায্য করতে এগিয়ে আসছে না। এমনকী, যে-বাইকআরোহীদের বাঁচাতে সে এগিয়েিল, তারাও না। উপলের দৃষ্টি ক্রমশ ঝাপসা হচ্ছে। চোখের সামনে ভাসছে চন্দনার মুখ, কানে বাজছে আইরিনের দাদা ডাক, মায়ের কাতরতা। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের অভিমনু্যর মতোই ক্ষতবিক্ষত, রক্তস্নাত হয়ে পথেই পড়ে রইল সে।

সঙ্গী দুজন ফিরে আসার আগেই শয়তানগুলো পালিয়েে। পুলিশের গাড়িতে চলেছে ভারতমাতার সাহসী সন্তান। নারী লাঞ্ছনার প্রতিবাদে যে নিজের প্রাণটাই বাজি রেখেছে। কাছাকাছি কলকাতা মেডিকেল কলেজে নিয়ে যাওয়া হল উপলকে। ডিউটি নার্স ওকে দেখেই চমকে উঠলেন। কারণ চন্দনার সঙ্গে উপলকে আগে দেখেছেন আর ও যে পুলিশে আছে সে কথাও জানেন।

ওয়ার্ডবয়ে সাহায্যে দ্রুত ট্রমা কেয়ারের আইসিইউতে নিয়ে চললেন। এক ফাঁকে ফোনে চন্দনাকে সব জানালেন। ডাক্তারি শপথ কি আর প্রিয়জনদের ক্ষেত্রে খাটে? আবেগ কি প্রশমিত করা যায়? চন্দনাও পারল না, শোকে মূর্ছিতাপ্রায় হয়ে বান্ধবীদের সঙ্গে এসে পৌঁছোল। ওর স্যারেরাও জান-প্রাণ লড়িয়ে দিলেন। প্রশাসনিক মহল থেকেও বিশেষ তত্পরতা দেখা গেল। ঘটনাস্থলে প্রচুর ব্লিডিং হয়েিল। তাই অরগ্যানস-এ, বিশেষ করে মাথায় অক্সিজেনের ঘাটতি এমন পর‌্যায় পৌঁছেছে যে, কোনও ওষুধই ঠিকমতো কাজ করছে না। উপল গভীর কোমায় চলে যাচ্ছে। উপলের আত্মীয়পরিজনেরাও এসেছেন ওর মাকে সামলানোর জন্য।

দৈনন্দিন জীবনে যে-যার সমস্যায় ব্যস্ত থাকে কিন্তু বিপদ এলে রক্তের সম্পর্ককে উপেক্ষা করা যায় না। ডাক্তারির অভিজ্ঞতায় চন্দনাও বুঝতে পারছে, শেষের সে ক্ষণ আসন্ন। আগামী চিরবিচ্ছেদের আশঙ্কার মধ্যেও ওর চোয়াল শক্ত হয়, রাস্তার গুন্ডাগুলোর কথা ভেবে। আইসিইউ-এর কাচের বাইরে উপলের দিকে স্থির চোখে তাকিয়ে আছে চন্দনা।

চোখের সামনে অদৃশ্য পর্দায় ভেসে উঠছে তাদের ছোটোবেলা, কৈশোর ও যৌবনে একসঙ্গে কাটানো মুহূর্তগুলো। ভেতরে নদীর পাড় ভাঙা টের পাচ্ছে, কেমন জীবন হবে তার উপলকে ছাড়া? মাসিমা, আইরিনকেই বা কীভাবে সামলাবে? ভাবনার ছন্দপতন হল বোস স্যার কাঁধে হাত রাখলেন, হি ইজ নো মোর মাই চাইল্ড, বলে মাথা নীচু করলেন।

ওরা উপলকে ঢেকে দিচ্ছে, এক ছুটে ঢুকল চন্দনা। শেষবারের মতো উপলের চুলে বিলি কেটে দিতে হবে না! ও তো সব দুঃখ, কষ্ট, যন্ত্রণা, অপমান থেকে বহুদূরে আরামে ঘুমোতে যাচ্ছে।

স্কুল জীবনের বন্ধুবান্ধবরাও অনেকে খবর পেয়ে এসেছে, চন্দনার সঙ্গে সঙ্গে থাকছে। শোকেরও তো সুযোগ নেই! পোস্টমর্টেম না হলে তো বডি দেবে না। চন্দনার বাবা-মাও আছেন, সবারই বাড়ি ফেরা স্থির হল। পরদিন আসতে হবে।

চোখের জলে ভেসে, বাবা-মার কাঁধে ভর দিয়ে চন্দনা বেরিয়ে আসে তার রোজকার ফেরার করিডর দিয়ে যে-করিডরে উপলও অনেক দিন তাকে সঙ্গ দিয়েে। মাসিমাকে দূর থেকে দেখতে পায়, উপলের মামাদের সঙ্গে। ওদের দাযিত্ব তো উপল তার ওপরে ছেড়েই অকালে বিদায় নিল।

পরদিন কাচের গাড়িতে উপল চলল সেইসব রাস্তা দিয়ে যে-রাস্তায় একনিষ্ঠতার সঙ্গে ডিউটি করেছে সে। পেরিয়ে যায় ওর কলেজ, থানায় গার্ড অফ অনার নিয়ে চলল পঞ্চভূতে লীন হতে।

চন্দনা মাসিমার সঙ্গে সেঁটে আছে, আইরিনই দাদার মুখাগ্নি করল। ইলেকট্রিক চুল্লির অন্ধকারে মিলিয়ে গেল, আলোকিত এক প্রাণ তার সমস্ত জাগতিক সম্ভাবনা নিয়ে চন্দনা চোখের জল মুছে শক্ত হল। তার এখন অনেক কাজ। প্রথম কাজ হল উপলের ওপর ঘটে যাওয়া জঘন্য অপরাধের প্রতিবিধান করা। প্রশাসন কী কী পদক্ষেপ করছে, তার ওপর কড়া নজর রাখবে সে। সঙ্গে উপলের চাকরির জায়গার পাওনা-গন্ডা পরিবার ঠিকমতো পাচ্ছে কিনা দেখা। ডিউটিরত অবস্থায় যখন ঘটনা ঘটেছে, তখন বিশেষ ক্ষতিপূরণও মাসিমা পাবেন।

খবর এল অপরাধী চারজন ধরা পড়েছে, তবে জেল-আদালতে চক্কর কাটা ছাড়া তো কোন সুরাহা হবে না। চন্দনা ওর এক বান্ধবীকে আইরিনকে পড়াবার দাযিত্ব দিয়েে। সবকিছুর মাঝে উপলের তার বোনকে ঘিরে দেখা স্বপ্নটা নষ্ট না হয়ে যায়। আদালতে সাক্ষ্য দেওয়ার লোকই তো পাওয়া যাচ্ছে না! এক চলমান শহরে, ছুটে চলে যাওয়া সাক্ষীদের কোথায় পাওয়া যাবে?

ওদিকে অপরাধী পক্ষ, সমাজে প্রভাবশালী হওয়ায়, টাকা ছড়িয়ে মিথ্যে সাক্ষী ধরে ধরে নিয়ে আসছে। চন্দনা ওর নেটওয়ার্ককে কাজে লাগিয়েে, ওই বাইকআরোহী আর মেযোকে খুঁজে বার করার জন্য। প্রাইভেট ডিটেক্টিভও লাগিয়েে। পুলিশ চেষ্টা করছে কিন্তু চন্দনা ভরসা রাখতে পারছে না। প্রভাবশালীদের হস্তক্ষেপে যদি খোঁজার আন্তরিকতা না থাকে। আদালতে সরকারি উকিল ছাড়াও ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় ভালো উকিল ঠিক করে রেখেছে।

নিজস্ব নেটওয়ার্কের মাধ্যমে ওই বাইকআরোহী আর মেযোর খোঁজ পেয়েে। একদিন লুকিয়ে দেখা করতে গেল। বুঝিয়ে বলল, উপলের মা, বোনের কথা। তার নিজের দুঃখের কথা। মেযো লজ্জা, অপমান, অনাগত আশংকায় কিছুতে রাজি হচ্ছে না সাক্ষ্য দিতে। চন্দনা অনেক চেষ্টা করল, ওর বিবেককে জাগ্রত করার। শেষে সব পরিস্থিতি চন্দনা সামলাবে, পুলিশও পাশে থাকবে এসব বলে যখন ফিরছে দূর থেকে দেখল ওই বাড়িতে কারা যেন ঢুকছে।

পরদিন অপরাধীদের সনাক্তকরণ প্যারেডে আনা হল, ম্যাজিস্ট্রেটের কক্ষে। গোপন জবানবন্দিতে মেযো জানাল, অপরাধী বলে যাদের আনা হয়েে তাদের সে চেনে না। কোনও দিন দেখেনি আর ঘটনার সময় ঘটনাস্থলে ভালো আলো ছিল না বলে, পরিষ্কার ভাবে সে কিছু বোঝেনি। তাকে যেন ভবিষ্যতে আর বিরক্ত করা না হয়।

শেষ আশাও বিফলে যাওয়ায় চন্দনা মাথা নীচু করে বসে আছে। এ সময় ওর কাঁধে কে হাত রাখল। আরে আইরিন! নিঃশব্দে কাঁদছে আইরিন। শক্ত করে ধরেছে চন্দনার হাত। সব আশ্বাস যেন ওই হাতেই আছে। আইরিনের মধ্যেই যেন উপলকে দেখতে পেল চন্দনা।

রোজদিনের রাস্তা

মানস বোস, কেউ বলে মানসা, কেউ বা আরও ভালোবেসে মা মনসা। পাঁচ ফুট দুই ইঞ্চির রোগা চেহারার লোকটি জেলা অফিসের একটি দফতরের বড়োবাবু।

বছর ছাপ্পান্নর ভদ্রলোকটি ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি মাস বাদ দিলে, বাকি সময় হাফশার্ট আর চটি পায়ে অফিসে আসেন। বাকি মাসে পাম শু, ফুল শার্ট আর হাফ সোয়েটার। মাথার বাঁ দিকে সিঁথে, চুল এক্কেবারে পেতে ছড়ানো।

আটটা একত্রিশের লোকাল ট্রেনের নির্দিষ্ট কামরাতে উঠলেই, সবাই যে-যার খুশিমতো ডেকে ঠাট্টা ইযার্কি আরম্ভ করে। মানস বোস রাগেন না, বা রাগলেও প্রকাশ করেন না। বেশির ভাগ দিনেই ট্রেনে বসার জায়গাটা রাখা থাকে, না পেলে দাঁড়িয়ে চলে যান। কারও-র সাথে কোনও রকম বিরোধে সচরাচর যান না। কম কথা বলেন, হাসেন কম, আসা-যাওয়ার মাঝে এই টুকটাক যা কথাবার্তা এই নিয়ে চলে মানস বোসের নিত্যযাত্রা।

শনি, রবি বা অন্যান্য ছুটির দিন বাদে মানসবাবুর প্রতিদিনের কাজকর্মও এক্কেবারে নিয়মমাফিক। ঘুম থেকে ওঠেন সাড়ে চারটে থেকে পৌনে পাঁচটার মধ্যে। নিজের হাতের তৈরি এক কাপ চা পান করে একটু হেঁটে যোগব্যায়াম করে বাড়ি ফেরা। তারপর ভাতের জল চাপিয়ে স্নান সেরে রান্নার কাজ আরম্ভ করেন।

মানসবাবু সকাল সাড়ে সাতটায় ভাত খেয়ে পৌনে আটটার বাস ধরেন। বাস থেকে নেমে ট্রেন, ট্রেন থেকে নেমে হেঁটে বা কোনও দিন অফিসের গাড়িতে অফিস পৌঁছন।

সকালে বউয়ের সাথে কথা বলা মানে আলু পটলের নাম গোত্র অথবা একমাত্র মেয়ে কলেজ বা টিউশন বা হাত খরচের টাকা নেওয়া সম্পর্কিত। কোনও দিন বউয়ের মনটা বাগান বাগান থাকলে বা সকালে ভালো ভাবে পেট পরিষ্কার হয়ে গেলে, আরও দু-একটা কথা বলেন তার মধ্যে বেশির ভাগটাই নিজের বাপের বাড়ি নিয়ে।

মানসবাবুর মেয়ে কলেজে পড়ে, গড়ন রোগা হলেও মায়ের মতো গায়ে রং-টা ফরসা। এখনকার চালচলন সম্পর্কে খুব বেশি সচেতন। নিয়মিত বিউটি পার্লার যায়, বন্ধু বান্ধবদের সাথে সিনেমা-টিনেমা তো আছেই। এখনও পর্যন্ত কোনও বিশেষ বন্ধু হয়েছে কিনা সে ব্যাপারে জানা না গেলেও, মায়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাবার গায়ে হুল ফোটাতে বেশ পটু হয়ে গেছে। মায়ের আশীর্বাদে এই দক্ষতা দিন দিন বেড়েই চলেছে। মাধ্যমিক পাশ করেই মোবাইলের জন্য তীব্র অসহযোগ আন্দোলনের মাধ্যমে মানসবাবুকে হারিয়ে নিজেকে মায়ের যোগ্য কন্যা হিসাবে প্রমাণও করে দিয়েছে।

মানসবাবুও কোনও আঠারো ইঞ্চির কপাল নিয়ে জন্মাননি। তাঁর বউও পৃথিবীর সেই একমাত্র ব্যতিক্রমী ভদ্রমহিলা হবেন, যিনি সব কিছু ছেড়ে শ্বশুরবাড়িতে এসে একমাত্র নিজের স্বামীর স্বার্থটাই দেখবেন। অন্তত মানসবাবু কোনও দিন স্বপ্নেও একথা ভাবেননি! বউএর পাশে দাঁড়ালে তাঁকে আরও নিরীহ অসহায় লাগে।

সন্ধে সাড়ে সাতটা থেকে আটটার মধ্যে মানসবাবু যখন বাড়ি ফেরেন, বউ তখন টিভির সাথে মধুর সহবাসে ব্যস্ত থাকেন। পেমেন্টের দিন বা অন্য কিছু বিশেষ দরকারের দিনে এক কাপ চায়ের সাথে কিছু খাবার মানসবাবুর মুখের সামনে পৌঁছে দেন। আর না হলে বলেন, চা করা আছে, গরম করে নাও, অথবা গিলে নাও।

এই বিশ বছরের বৈবাহিক জাঁতাযন্ত্রে বউএর রাগ, মন খারাপের রূপ, রং, গন্ধ, স্পর্শগুলো খুব ভালো ভাবে বুঝে গেছেন। যেমন যেদিন নিজে দরজা খুলে হাত থেকে বাজারের ব্যাগটা টেনে নেন, তার মানে আবহাওয়াটা বাগান বাগান। তা না হলে মেঘ জমেছে। সেদিন কোনও কথা না বলে চুপচাপ জামাকাপড় ছেড়ে, হাত পা ধুয়ে নিজের চা গরম করে নেন। মুড়ির কৌটো থেকে মুড়ি বের করে চায়ে চুমুকের সাথে মুড়ি চিবোতে চিবোতে ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করেন, রুটি হয়ে গেছে? উত্তরটাও সেদিনের আবহাওয়ার মতোই আসে।

সন্ধের থেকে রাতটা আরও ভয়ানক হয়ে ওঠে। একটা শীতল জড়বস্তুর পাশে শুয়ে নিজের অঙ্গ প্রত্যঙ্গ সব নিস্তেজ হয়ে পড়ে। অন্তত মানসবাবুর নিজের সেই রকমই মনে হয়। তবুও কোনও কোনও দিন শরীর হালুম হালুম করে ওঠে। পাশে শুয়ে থাকা শীতল যন্ত্রটাকে নিজের দিকে টেনে নিতে গেলে স্পিকার বেজে ওঠে, সেই কয়েকটা বুলি, লজ্জা লাগে না, মেয়ে বড়ো হয়ে গেছে। বা মরণ! কখনও আদিখ্যেতা!

মানসবাবুর জেগে ওঠা রঙে আলকাতরা মিশে যায়। জেগে যাওয়া শরীর নুয়ে পড়ে, জোর করে ঘুম পাড়িয়ে দেন। কোনও কোনও দিন শরীর বাগ মানে না। জেগে উঠে, বিছানা নড়ে। পাশের শীতল যন্ত্রের স্পিকারে শোনা যায, বাথরুমে যাও। তার পরেই ফুলস্টপ।

মানসবাবুর মেয়ে খুব ব্যস্ত। সকালে অফিস বেরিয়ে যাওয়ার পরেই ঘুম থেকে ওঠে। ফেরার সময় বেশির ভাগ দিনেই ব্যস্ত থাকে নিজের কাজে। কী কাজ, মানসবাবু জিজ্ঞেস করেন না। করলেও উত্তর আসে, তোমাকে বলে কী করব? কিছু বুঝবে কি? সেই তো সেকেলেই রয়ে গেলে। মায়ের সাথে পাল্লা দিয়ে হুল ফোটায়। মানসবাবুর ব্যথা লাগলেও কিছু বলা যায় না। বউ মেয়ে সাঁড়াশি আক্রমণে বেচারা বোসবাবুর যা অবস্থা, তা বর্ণনা করতে গেলে দক্ষতার প্রয়োজন হয় না।

মানসবাবুর অফিসটাও খুব অদ্ভুত। সকাল থেকে দুপুর হয়ে বিকাল শুধু কিছু ফাইল আর লেখা। না হয় পেপার পড়া। ডিপার্টমেন্টের না আছে কোনও ঘুসের ব্যবস্থা, না আছে কোনও মহিলা কর্মচারী। আগে দুএকজন যা ছিল ফাঁক-তোল, ভাঁজ-খাঁজ দেখা যেত। কিন্তু কয়েক বছর আগে অন্য জায়গায় বদলির পরে শুধু ফাঁকা মরুভূমি।

তবে খুব ভালো লাগার জায়গা হল ট্রেনের কামরা। যদিও তিনি খুব একটা সক্রিয় যাত্রী নন। এমনকী তাঁকে নিয়ে ইয়ার্কিতে ফাজলামিও বেশি হয়। তাও অন্য কেউ কিছু বললে শোনেন, অন্যের ইয়ার্কিতে মন পুলকিত হয়ে ওঠে। তাঁদের নজনের নিত্যযাত্রীর দলে কোনও মহিলা সঙ্গী নেই। বোসবাবু ছাড়া বাকি সবাই কম-বেশি নেশা করেন, খিস্তিখাস্তাও চলে। মহিলা নিত্যযাত্রী থাকলে অসুবিধা হয়।

এমনি যাত্রীদের সেরকম পাত্তা দেওয়া না হলেও, মহিলা যাত্রীদের আড় চোখে দেখে নেওয়া হয়। বোসবাবুও এই রস নেওয়া থেকে বাদ যান না। বিশুদা এলে খুব ভালো লাগে, তিনদিন আসেন বিশুদা। ওষুধ সাপ্লাই করেন, জামার বাঁ দিকের পকেট থেকে প্যাড বের করে ফোনে জিজ্ঞেস করেন, কপাতা? সঙ্গে একটা দামি মোবাইল থাকে। নিজের কাজ হয়ে যাওয়ার পরে মোবাইলটা বেশির ভাগ দিনেই বোসবাবুকে দিয়ে দিলে, তিনি ওটাকে আড়ালে নিয়ে চলে যান। একমনে দেখেন, আর শরীরের ঘুম ভাঙান। অনেকেই এই ব্যাপারটা দেখে টিপ্পনি কাটে, তবে তাতে বোসবাবুর কোনও কিছু এসে যায় না, হেসে উড়িয়ে দেন।

নজনের নিত্যযাত্রীদের প্রায় সবাই বযস্কদের জায়গা ছেড়ে বসতে দেন। আর জায়গা ছাড়েন ছেলে কোলে দাঁড়িয়ে থাকা মহিলা যাত্রীদের। শুধু কম বয়সী মহিলা, কলেজ পড়ুয়াদের বসতে জায়গা ছাড়েন না। তবে সেদিন এর ব্যতিক্রম ঘটল এবং ঘটালেন সেই মানস বোস।

লোকাল ট্রেনে সেদিন অস্বাভাবিক রকমের ভিড়। দেওঘরের কোনও এক আশ্রমের উৎসবের জন্য ট্রেনের সব কামরা তাদের দখলে। ট্রেনে ওঠার আগে এই খবরটা পেলেও কোনও এক্সপ্রেস ট্রেন না থাকার কারণে সবাইকে লোকালেই উঠতে হয়। উঠতেই পিছনের থেকে কেউ একজন বলে উঠল, কাকা, আজ মাছিও গলবে না। বোসবাবু তাকে কোনও উত্তর না দিয়ে আস্তে আস্তে ভিতরের দিকে এগিয়ে যান।

অন্যদিনে যে-সিটে তিনজন বসে থাকে আজ সেখানেই পাঁচজন। বোসবাবু কোনও রকমে একটা জায়গায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে চেনাজানা কাউকে দেখতে পাওয়া যায় কিনা দেখতে লাগলেন। মাথা নাড়িয়ে নিজের উপস্থিতি জানালেন। কেউ আবার তাঁকে দেখে বলে উঠল, বোসদা আমাদের এদিকে আসুন, গল্প করা যাবে।

না ভাই, আজ যে এখানে দাঁড়াবার জায়গা পেয়েছি এটাই অনেক।

কেউ আবার বলে উঠল, কি রে মানসা, কোনও এক্সপ্রেস পেলি না? ভিড়ে মরতে এলি, না মারাতে?

বোসবাবু এবারেও হেসে উত্তর দেন, উৎসব চলছে তো তাই এত ভিড়।

নিত্যযাত্রীদের অনেকেই সেদিন পেপার বা পলিথিন পেতে দরজার সামনে বসেছিল। বোসবাবুর একবার এভাবে বসতে গিয়ে প্যান্ট ফেটে গেছিল! সে এক যাচ্ছেতাই অবস্থা। সারাটা দিন ভগবানকে গালাগালের সাথে, জামা দিয়ে ফাটা জায়গা ঢাকতে হয়েছিল। তবে এইদিন মানসবাবুর ভাগ্যটা হয়তো একটু প্রসন্ন ছিল। পরের স্টেশনে একটা জায়গা পেয়ে গেলেন। গোটা সিট না হলেও এই বাজারে সেই সিটের যে কী মহিমা, তা আর বোঝাতে হবে না। অবশ্য সঙ্গে সঙ্গে শুনলেন, বোসদা আজ একটা লটারি কেটে নিন।

বোসবাবু কিছু না বলে হালকা হাসলেন। বুঝতে পারলেন নজর লেগে গেল, হলও তাই। এক স্টপেজ যেতে না যেতেই একটা মেয়ের গলা কানে এল, কাকু কাইন্ডলি আমাকে একটু বসতে দেবেন, পায়ে খুব ব্যথা করছে, আজ আমার পরীক্ষা আছে। বোসবাবু ঘাড় ঘুরিয়ে মেয়েটিকে দেখলেন। তাঁর মেয়ের মতোই বয়স, একটু বড়োও হতে পারে। জিন্স-এর প্যান্ট আর কুর্তি পরে আছে। গায়ে রং-টা চাপা হলেও মুখটা বেশ ভালো। কোনও ছেলে হলে এতক্ষণ জবাব না দিয়ে উলটো দিকে মুখ ঘুরিয়ে বসে থাকতেন। সেই জায়গায় উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, বোসো, তবে জায়গাটা খুব কম। মেয়েটি বোসবাবুর দিকে তাকিয়ে হালকা হেসে, থ্যাংক ইউ বলে বসেই হাতে থাকা একটা খাতাতে চোখ ডুবিয়ে দিল।

বোসবাবু আবার আগের জায়গায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে মাঝে মাঝে আড়চোখে মেয়েটিকে দেখতে লাগলেন। দুএকজন চেনা নিত্যযাত্রী দাঁড়ানোর কারণ জিজ্ঞেস করলে, তিনি চোখের ইশারাতে বোঝানোর চেষ্টা করলেন। কিছুক্ষণ পরেই মেয়েটি বলে উঠল, কাকু তোমার ব্যাগটা দাও, আমি ধরছি। বোসবাবু, না, ঠিক আছে বললেও মেয়েটি মানসবাবুর হাত থেকে ব্যাগটা প্রায় কেড়ে নিজের কোলে নিয়ে তার ওপর খাতা রেখে পড়তে আরম্ভ করল।

হাতের ভার কমলেও বোসবাবু আর মেয়েটির কুর্তির কোনও ভাঁজ দেখতে পেলেন না। তবে সারাদিন মনটা বেশ বাগান বাগান হয়ে থাকল। অলিগলি থেকে ট্রেনের মেয়েটার ভেসে ওঠা মুখটা শরীরটাকেও নাড়িয়ে দিচ্ছিল। কাজ করবার সময় গুনগুন গান আঙুলগুলোর মধ্যে একটা অনুঘটকের কাজ করছিল। এমনকী বাড়ি গিয়ে বউয়ের মুখ ঝামটা শুনেও সেরকম কোনও প্রতিক্রিযা হয়নি।

বাড়ি ফিরে বারান্দার অন্ধকারে দাঁড়িয়ে এক ভাবে আকাশের দিকে তাকিয়ে থেকে অথবা হাওয়ার সাথে মিশিয়ে নিজের গাওয়া দু-এক কলি গান গাওয়ার মধ্যেও মেয়েটি চলে আসে। রাতে শুয়ে ঘুম আসেনি। বন্ধ চোখের সামনে সেই মুখ মনে শরীরে এক অদ্ভুত তৃপ্তি এনে দিয়েছে। কিছুক্ষণ পরেই অবশ্য বউয়ের ভয়ে বাথরুম চলে যেতে হল।

তার পরের দিনও সেই একই রকমের ভিড় ঠেলে কিছুটা ট্রেনের ভিতরে গিয়ে ঘাড় ঘোরাতেই, আগের দিনের মেয়েটিকে বসে থাকতে দেখে একটু রাগই হল। নিশ্চয়ই আবার কারওর পি… মেরে জায়গা করে নিয়েছে। কিছু না বলে একটু ইতস্তত করে আরও ভেতরের দিকে যাওয়ার পরেই পিছনের দিক থেকে শুনলেন, ও কাকু, আমি এখানে, দেখতে পাওনি?

বোসবাবু আর না এগিয়ে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বললেন, না, মানে দেখতে পাইনি।

বুঝেছি, আর বলতে হবে না। না দেখার ভান করে চলে যাচ্ছিলে।

মানসবাবুর মাথাতে আর কোনও জলজ্যান্ত মিথ্যা কথা এল না। আমতা আমতা করে বললেন, তুমি পড়ছিলে তো তাই।

কই আজ তো আমি পড়িনি।

পরীক্ষা শেষ?

কাল একটা ডিপার্টমেন্টের পরীক্ষা ছিল।

তারপরে সিট ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, কাকু, আজ তুমি বোসো।

না না ঠিক আছে। আমরা তো প্রতিদিন জায়গা পাই না। দাঁড়িয়ে যাওয়ার অভ্যাস আছে।

পাশে বসে থাকা আর একজন যাত্রী বললেন, আপনি বসুন, আমি পরেরটাতেই নেমে যাব।

মেয়েটির পাশে কুঁকড়ে বসতেই মেয়েটি বলে উঠল, ও কাকু, তুমি ওরকম জড়ভূতের মতো বসে আছো কেন? বি কমফর্টেবল।

না না, আমি ঠিক আছি।

দূর কিছু ঠিক নেই।

মানসবাবু মেয়েটির দিকে আরও একটু সরে বসলেন।

আজও আগের দিনের মতোই জিন্স আর টপ পরেই এসেছে। ডান কাঁধের সাথে বোসবাবুর বাঁ কাঁধ লেগে আছে, কনুইটা বুকের কাছাকাছি।

পিছন থেকে নিত্যযাত্রী ভোম্বল বলে উঠল, বোসদা লটারি কিনেছিলেন? আজ মিলিয়ে নেবেন, ফার্স্ট প্রাইজ পেয়ে গেছেন। শুধু বউদিকে একটু সাইজে আনতে হবে।

ওষুধের বিশুদা বলে উঠল, নতুন ডাউনলোড করেছি দেখবেন নাকি? দেব ওখানে। বোসবাবু কিছু সময় মেয়েটির কাছে বসে উঠে দাঁড়িয়ে বলে উঠলেন, তুমি এখানে বোসো, আমি একটু বন্ধুদের কাছে যাই, ওরা আবার কী ভাববে।

ওরা তোমার লেগপুল করছে?

না না। আসলে প্রতিদিন একসাথে যাই তো, তাই একটু মজা করছে।

কথাগুলো শেষ করেই জায়গাটা ছেড়ে পিছনের দিকে চলে গেলেন। কিন্তু নিত্যযাত্রীদের কাছে রীতিমতো টোন টিটকিরি সহ্য করতে হল। সেটা অবশ্য প্রতিদিনই হয়। তবে সেদিন এতটাই মাত্রা ছাড়াল যে, বোসবাবু তাদের থেকে পাশে সরে দরজার সামনে একাই দাঁড়িয়ে থাকলেন। হাওয়া আসছিল, মনটাও ভেসে ভেসে যাচ্ছিল। কিন্তু সব কিছু কেমন যেন অস্থির। সব সময় ইয়ার্কিও ভালো লাগে না।

কাকু বসবে না তুমি? কথাটা শুনে ঘাড়টা ঘোরাতেই দেখলেন আবার সেই মেয়েটি, এক্কেবারে কাছে দাঁড়িয়ে আছে। বোসবাবু একটু কঠিন ভাবে বললেন, কী ব্যাপার তুমি উঠে এলে?

তুমি বসবে না?

তুমি বোসো।

মেয়েটি আর কথা না বাড়িয়ে আস্তে আস্তে নিজের জায়গাতে ফিরে গেল। কিছুক্ষণ পর মানসবাবুর মনটা হু হু করে উঠল। মেয়েটিকে এরকম ভাবে না বললেই হতো। বেচারি শুধুমাত্র বসতে বলবার জন্য এসেছিল।

মেয়েটির কাছে গিয়ে ওকে সরিয়ে নিজের বসবার ব্যবস্থা করলেন। কিছু সময় পরে মেয়েটি, বোসবাবু কোথায় কাজ করতে যান থেকে আরম্ভ করে, বাড়িতে কে কে আছে, সব জেনে নিল।

মানসবাবুও জানলেন ওর নাম অনুশ্রী। এবার নিত্যযাত্রীরা কেউ কিছু বললেও, বোসবাবু কাউকে কোনও পাত্তা দিলেন না। সারাটা রাস্তা অনুশ্রীর সাথে গল্প করে যেতে লাগলেন।

ট্রেন থেকে নেমেই অনুশ্রী বলে, কাকু তোমার অফিস তো কাছেই, পরের ট্রেনে তো আসতে পারো। দশটার মধ্যে ঢুকে যাবে।

ট্রেনের কামরাতে থাকবার সময় অনুশ্রীর কথাটা সেরকম ভাবে না শুনলেও, অফিসের রাস্তায় হাঁটবার সময় কথাগুলো কানের কাছে গুন গুন করতে আরম্ভ করল। সত্যিই তো পরের ট্রেনটাতেও আসা যায়! বাড়িতে আরও আধ ঘন্টা বেশি সময় পাওয়া যাবে। আর একটু বেশি সময় ঘুমানো যাবে। ট্রেনেও শুধুমাত্র অনুশ্রী। তাছাড়া অফিসে তাড়াতাড়ি এসেই বা কী করবেন, সেই তো বসে বসে পেপার পড়া। না হয়, এর ওর সাথে গল্প করা। মাঝে মাঝে বিরক্ত লাগে।

অনুশ্রীর মোবাইলে ফোন করতেই সঙ্গে সঙ্গে ওপার থেকে উত্তর আসে,

বলো কাকু…

ক্লাসে?

না, এই তো নামলাম।

শোনো কাল থেকে পরের ট্রেনেই আসব।

বেশ কাকু তাই হবে। পিছনের থেকে তিন নম্বর কামরাতে উঠবে, আমি জায়গা রাখব।

পরের দিন থেকেই মানসবাবু সব কিছু আধঘন্টা পরে করতে আরম্ভ করলেন। সেই ঘুম থেকে ওঠা থেকে আরম্ভ করে বাস ধরা পর্যন্ত সব কিছু আধ ঘন্টা পিছিয়ে গেল। বাকি সব কিছু একই ভাবে চললেও আরেকটা বড়ো পরিবর্তন বউয়ের চোখে পড়ল। অফিসে যাওয়ার সময় এই প্রথম জামা ইন করে পরতে আরম্ভ করলেন, সঙ্গে জুতো। এমনকী মেয়ের বডি স্প্রে-র গন্ধও জামার ঘামের গন্ধ থেকে বেরিয়ে আসতে লাগল। বউ সব কিছু দেখেও কিছু বললেন না। কিন্তু মাস দেড় পরে স্বামীর সাজ বেড়ে উঠতে দেখে, একদিন মানসবাবু বেরিয়ে গেলে, মেয়ের সাথে আলোচনা করলেন, হ্যাঁ রে তোর বাবার হল কী? এত চকচকে পোশাক, উড়ো উড়ো ভাব, বুড়ো বয়সে প্রেমে পড়ল নাকি?

মেয়ে সব কিছু দেখে শুনে, মাকে চিন্তা করতে বারণ করলেও নিজের কাছে অস্বস্তি গোপন থাকল না। ট্রেনে কিন্তু বোসবাবুর যাতাযাতের মজা আরও দ্বিগুন বেড়ে গেল। পরের ট্রেনটা তুলনামূলক ফাঁকা আসে। অনুশ্রীও প্রতিদিন বোসবাবুর জন্য জায়গা রেখে দেয়। সারাটা রাস্তা দুজনে গল্প করতে করতে চলে যান। শনি, রবি বা অন্যান্য ছুটির দিনে মন খারাপ লাগে। অনুশ্রীকে ফোন করেন।

বিশুদা কথা প্রসঙ্গে মোবাইলে আরও নতুন কিছু আনার খবর দেয়। মানসবাবু উত্তরে শুধু হাসেন। কিন্তু ট্রেন বা কার সঙ্গে কোন কামরাতে উঠলেন, সে সম্পর্কে কোনও কথাই বলেন না। রাতে ফিরে একা বসে প্রায়ই গুনগুন করে গান করেন। শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েন তাড়াতাড়ি। বউ ঘুমিয়ে থাকা বোসবাবুকে দেখে বোঝার চেষ্টা করেন। কিছু বুঝতে না পেরে পরের দিন বোসবাবু বেরিয়ে যাওয়ার পরে, আবার মেয়ের সাথে আলোচনা করতে বসেন।

 

সেদিন অফিস থেকে ফিরে মানসবাবু অবাক হয়ে যান। বেল বাজাতেই বউ তাড়াতাড়ি এসে হাত থেকে ব্যাগ নিয়ে চেযার টেনে বসতে দেন। হাত মুখ ধোওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হাতের কাছে চা তৈরি করে দেন। মেয়ে ডিম পাঁউরুটি তৈরি করে দাঁড়িয়ে থাকে। মানসবাবুর খাওয়ার আগে অবাক হয়ে সবার মুখের দিকে তাকাতে থাকেন।

বিবাহবার্ষিকী, দু-একটা পূজাপার্বণ আর মেয়ের জন্মদিন ছাড়া, অফিস থেকে ফিরে এরকম জলখাবার আর কোনও দিন হয় কিনা মনে করতে পারলেন না। তাই অত খাবার দেখে জিজ্ঞেস করলেন, আজ কি কোনও অনুষ্ঠান আছে? কোনও পুজো-টুজো!

না না, অনুষ্ঠান কেন থাকবে? রোজ ওই এক মুড়ি। তাই মাম্পি বলল, ডিম পাঁউরুটি করবে। এই টিফিনটা শুধুমাত্র একদিনের জন্যেই নয়। এরপর অফিস থেকে ফিরলেই বিভিন্ন রকমের টিফিন নিয়ে মা, মেয়ে হাজির থাকত।

এখন রাতে শুয়ে বউ নিজের থেকে নিজের দিকে টেনে, বিয়ের প্রথম কয়েক বছরের সেই সব দিনের কথা আলোচনা করে। তারপর মাঝে মাঝেই জানলাতে মুখ রেখে মাম্পি ঘুমিয়ে গেছে কিনা দেখে নিয়ে নিজেদের ঘরের দরজার ছিটকিনিটা তুলে দেয়। বোসবাবুর এখন ঘুম থেকে উঠতে একটু বেশি দেরি হয়। তবে অসুবিধা হয় না, হেঁটে এলেই হাতে রেডি চা পেয়ে যান।

এখন আর আনাজ কাটতে বসতে হয় না, ভাতের জলও চাপাতে হয় না। সব কাজ মা আর মেয়ে মিলেই সামলে দেয়। বোসবাবু ট্রেনে যাওয়ার সময় অনুশ্রীর সাথে সব কিছুর আলোচনা করেন, তবে পরিবর্তনের কারণ বুঝতে পারেন না। অনুশ্রীও কিছু বলে না।

একদিন প্ল্যাটফর্মের ওভারব্রিজে উঠতে উঠতে পুরোনো নিত্যযাত্রীদের দলের তপন ফোন করে, কী ব্যাপার বোসদা, আমাদের ছেড়ে নতুন বান্ধবী পাতিয়েছেন শুনলাম! বউদি সব জানে তো? গা পিত্তি জ্বলে উঠল। কাছে থাকলে টেনে দুথাপ্পড় কষাতেন।

বেশ জোর গলাতেই উত্তর দিলেন, সে খবরে তোমার কী দরকার? বলেই ফোনটা কেটে দিলেন।

ট্রেন আসতে মিনিট দশ দেরি হল। পিছনের দিক থেকে তিন নম্বর কামরাতে উঠলেন। অনুশ্রী বাঁ দিকটাতে বসে। বোসবাবু বাঁ দিক দেখলেন, ডান দিক দেখলেন, কই নেই তো! সামনে উঠল নাকি? চলন্ত ট্রেনের ভিতর হেঁটে সেই কামরার সামনের দিকে এলেন। না নেই। ভালো লাগছে না। মোবাইলের কন্ট্যাক্ট-এ গিয়ে অনুশ্রীকে ডায়াল করলেন। কী আশ্চর্য! ফোন বন্ধ! তাহলে? একটা জায়গাতে বসলেন বোসবাবু, কিন্তু অনুশ্রী কই? আসেনি, নাকি সামনের দিকে উঠল? এরপর কি পুরো ট্রেনটা দেখতে হবে? শরীরে একটা অস্বস্তি আরম্ভ হল। না আর বসা যাবে না।

অফিসেও সেদিন কোনও কাজ করা তো দূর, ভালো করে বসে থাকতেই পারলেন না। একটা চাপা কষ্ট তাড়িয়ে বেড়াচ্ছিল। বাড়িতে সেই এক অবস্থা। পরের দিন একটু আগে আগে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আগের ট্রেনে অনুশ্রীর কলেজে পৌঁছলেন। বহু কষ্ট করে ভিতরে গিয়ে ডিপার্টমেন্টও পৌঁছোলেন। কিন্তু নাম বলতে কেউই বুঝতে পারল না। একজন তো বলেই দিলেন, অনুশ্রী নামে এই ডিপার্টমেন্ট-এ কেউ নেই।

কলেজের রাস্তা ধরে অফিসের রাস্তায় আর যেতে ইচ্ছে করল না। কী রকম একটা লাগছে! তার মানে আগামীকাল থেকে সেই জীবন! সেই ট্রেন? সেই বউ মেয়ে?

কলেজের রাস্তার পাশে থাকা বেঞ্চে বসলেন। কত হাজার হাজার কমবয়সী ছেলে-মেয়ে কলেজে ঢুকছে। বোসবাবু তাদের দিকে এক ভাবে তাকিয়ে থাকলেন।

হঠাৎ দুকানে ও কাকু… ডাক শুনে একটু চমকে উঠলেন। ঘাড় ঘুরিয়ে এদিক ওদিক দেখতে আরম্ভ করলেন। না মানুষটা ধারে কাছে নেই!

 

 

হার-জিত

রাত প্রায় বারোটা বাজে। রোজকার মতো প্রিয়া বইখাতা খুলে পড়াশোনায় ব্যস্ত। প্রিয়ার বাবা, সোমনাথ দরজায় এসে দাঁড়ালেন। ঘরে উঁকি মেরে জিজ্ঞেস করলেন, এখনও পড়ছিস?

প্রিয়া না তাকিয়ে জবাব দিল, যা বলতে এসেছ বলে চলে যাও।

প্রিয়া জানত এত রাতে বাবা শুধু এখনও পড়ছিস, জিজ্ঞেস করতে ওর ঘরে আসেননি। অন্য কোনও কারণ আছে। কথা বলার আগে একটা ভূমিকা করা, প্রিয়ার একেবারে অপছন্দের। ভিতরে ভিতরে বিরক্ত হল সে।

সোমনাথ দরজা থেকে মুখ বাড়িয়ে মেয়ের উদ্দেশ্যে বললেন, এবার ওকে ক্ষমা করে দে প্রিয়া…এমনিতেই ও আমাদের ছেড়ে চলে যাবে।

ক্ষমা, কখনও না, আমি ওকে কোনও দিন ক্ষমা করতে পারব না, অনেক কষ্টে প্রিয়া নিজের রাগ সংযত করে।

কিন্তু প্রিয়া ও তোর মা…

সোমনাথের কথাগুলো প্রিয়ার ভিতরে ঢুকে সজোরে ওকে ধাক্কা মারে, চেঁচিয়ে ওঠে সে। বাবা ওই মহিলা তোমার বউ হতে পারে কিন্তু আমার মা নয়। আর তাছাড়া মায়ের জায়গায় ওকে আমি কোনও দিনই বসাতে পারব না। কোনও শক্তিই আমাকে দিয়ে এ কাজ করিয়ে নিতে পারবে না।

কিন্তু প্রিয়া…

কথা শেষ হবার আগেই প্রিয়া হাতের বইটা মাটিতে ছুড়ে ফেলে দিল, প্লিজ যাবে এখান থেকে? আমাকে একা ছেড়ে দাও।

মেয়ের রাগ দেখে সোমনাথ চলে গেলেন। প্রিয়া ভিতরে ভিতরে ফুঁসতে লাগল। পনেরোয় পড়েছে প্রিয়া কিন্তু পরিস্থিতি ওকে বয়সের তুলনায় অনেকটাই বড়ো করে তুলেছে। রাগেতে চোখে জল চলে এল তার। হঠাৎই বাবার কথাগুলো তার মনে হল… ও আমাদের ছেড়ে চলেই যাবে। সঙ্গে সঙ্গে মনটা খুশিতে ভরে উঠল তার।

বাবার কথার সহজ মানেটা করে ফেলল প্রিয়া। তার মানে বাবার সঙ্গে ওই মহিলার ডিভোর্স হয়ে যাচ্ছে। সেই জন্যই কি বাবার এত মন খারাপ? বাবার থেকে মনটা সরিয়ে নিজের মনের মধ্যে ডুব দিল প্রিয়া। এতটা খুশি সে অনেকদিন বোধ করেনি।

পরের দিন স্কুলে গিয়ে বন্ধুদের ক্যান্টিনে নিয়ে গেল প্রিয়া। আজ ট্রিট আমার তরফ থেকে।

কেন রে, হঠাৎ এত খুশির কী হল? বন্ধুদের মধ্যে একজন জিজ্ঞেস করল।

ফাইনালি… ফাইনালি অ্যান্ড ফাইনালি আমার বাবার আর মণিকার ডিভোর্স হচ্ছে। মণিকা আমাদের বাড়ি ছেড়ে কিছুদিনের মধ্যেই চলে যাবে, উৎফুল্ল দেখাচ্ছিল প্রিয়াকে।

সত্যি করেই মণিকাকে কখনও-ই প্রিয়া নিজের মায়ের আসনে বসাতে পারেনি। তাই মা বলা দূরে থাক বরাবরই নাম ধরেই ডেকে এসেছে। সোমনাথ মেয়েকে অনেক বোঝাবার চেষ্টা করেছেন কিন্তু বাবার একটা কথাও কানে তোলেনি প্রিয়া।

চিন্তা ভঙ্গ হল রিয়ার ডাকে, এই কী ভাবছিস বল তো? আচ্ছা, তোর বাবা আর সৎমায়ের মধ্যে খুব ঝগড়া হয়?

না তো!

বলতে বলতেই প্রিয়া আবার অতীতের দরজায় এসে দাঁড়াল। মনে পড়ে যখন ছোটো ছিল, মা আর বাবার মধ্যে খুব ঝগড়া হতো। ওদের ঝগড়া দেখে প্রিয়া কাঁদতে থাকত। প্রিয়াকে কাঁদতে দেখে ঝগড়া ক্ষণকালের জন্য থেমে গেলেও, আবার শুরু হতো। ওদের ঝগড়ায বারবার প্রিয়ার নামটাও উঠে আসত। দুজনের একই অভিযোগ, অপরজনের জন্য নাকি প্রিয়ার জীবনটা নষ্ট হতে চলেছে। প্রিয়া চুপ করে থাকত কারণ মা-বাবার মধ্যে কাউকেই আলাদা করে বেছে নেওয়া তার পক্ষে সম্ভব ছিল না।

কখনও ঘুম ভেঙে গেলেও মৃতের মতো বিছানায় পড়ে থাকত। সে খুব ভালো ভাবে জানত, তাকে কাঁদতে দেখলে মা আর বাবা একে অপরকে দোষারোপ শুরু করবে। ক্রমশ পরিস্থিতি এতটাই খারাপ হতে আরম্ভ করল যে, মা-বাবা প্রিয়াকে আলাদা ঘরে শোওয়ার ব্যবস্থা করে দিল।

দুর্ভাগ্যের বিষয, সেখানেও প্রিয়া স্বস্তি পেত না। ওদের ঝগড়ার আওয়াজ প্রিয়ার ঘর পর্যন্ত চলে আসত। বালিশ দিয়ে কান চেপে ধরলেও লাভ হতো না। মনে মনে কামনা করত, সব যেন ঠিক হয়ে যায়। কিন্তু তার মনের আশা কখনও পূরণ হয়নি।

আজও ওই দিনটা প্রিয়া ভুলতে পারে না। ছয় বছর বয়স হবে তখন তার। মা তাকে একটা গোলাপি রঙের ফ্রক পরিয়ে খুব আদর করছিলেন। চোখের জলে ভেসে যাচ্ছিল তাঁর চোখ-মুখ। কাঁদতে কাঁদতেই প্রিয়াকে কোলে বসিযে বললেন, প্রিয়া আমি কেস হেরে গেছি। তোমার বাবা তোমার কাস্টডি পেয়েছেন। আমাকে চলে যেতে হবে। বড়ো হও, আমি তখন যেমন করে হোক, আমার কাছে তোমাকে নিয়ে যাব।

ব্যস, ওর মা বাড়ি ছেড়ে চলে গেলেন। প্রিয়া বাবার সঙ্গে রয়ে গেল। প্রথম দুবছর বাবা মাসে একবার করে হলেও মায়ের সঙ্গে দেখা করাতে নিয়ে যেতেন। কিন্তু ধীরে ধীরে সেটাও বন্ধ হয়ে গেল। মা, অবশ্য মাঝেমধ্যে প্রিয়ার সঙ্গে ফোনে কথা বলতেন আর কাঁদতেন। মায়ের কান্না প্রিয়ার কোমল মনটাকে ভেঙে চুরমার করে দিত। ফলে ইমোশনাল সাপোর্ট পেতে প্রিয়া নিজের বাবার উপর বেশি করে নির্ভরশীল হয়ে পড়ল।

 

সেবার প্রিয়ার চতুর্থতম জন্মদিন পালিত হচ্ছিল। বাড়িতেই সোমনাথ সব ব্যবস্থা করেছিলেন ক্যাটেরার দিয়ে। অতিথিরা সকলেই প্রায় উপস্থিত ছিল। মণিকাকে প্রিয়া সেই প্রথম দ্যাখে। লক্ষ্য করে, বাবা একটু বেশিই হেসে হেসে কথা বলছেন মহিলাটির সঙ্গে। মহিলাটির সঙ্গে বাবাকে এতটা কথা বলতে দেখে, প্রথম দিনেই মণিকার প্রতি মনটা বিতৃষ্ণায় ভরে যায় প্রিয়ার। অথচ মণিকার ছেলে অয়নের সঙ্গে ভালো বন্ধুত্ব হয়ে যায় তার।

এর পর থেকে প্রায়দিনই মণিকা চলে আসত ওদের বাড়ি। যে সময়টা সোমনাথ মেয়ের সঙ্গে কাটাতেন, সেই সময়টার দখল নিল মণিকা। বাবাকে ওই মহিলার সঙ্গে দেখে প্রিয়ার মনের ভিতর আগুন জ্বলে উঠত। ওর খালি মনে হতো, বাবার পাশে বসার অধিকার শুধু তার আর মায়ের আছে। সেই অধিকার আর কেউ পেতে পারে না।

নানারকম ফন্দি আঁটত সে, কী করে মণিকাকে বাবার থেকে দূরে রাখা যায়। কিন্তু ওদের প্রেমের গভীরতা প্রিয়ার মতো ওইটুকু মেয়ে ফন্দিকে কোথায় ভাসিয়ে নিয়ে চলে যেত। কথাতেই আছে প্রেম অন্ধ। প্রিয়ার আজও মনে হয়, মণিকাকে বিয়ে করার সময় একবারের জন্যও বাবা তার কথা ভাবেননি।

বিয়ের পর মণিকার সঙ্গে ওর ছেলে অয়নও প্রিয়াদের বাড়িতেই থাকতে আরম্ভ করল। অয়নকে ছোটো ভাই হিসেবে স্বীকার করে নিলেও মণিকাকে সে মন থেকে ক্ষমা করতে পারল না। আর না তো মা হিসেবে মেনে নিল।

প্রিয়ার মনে পড়ল বিয়ের পর মণিকা যখন প্রথমবার ওদের বাড়িতে পা রাখল, প্রিয়া ঘরের এক কোণে চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিল, দুচোখে শুধু ঘৃণা নিয়ে ।মণিকা কিন্তু আদর করে ওকে কাছে টেনে নিয়েছিল। মাথায় হাত বুলোতে বুলোতে বলেছিল, প্রিয়া আমাদের জীবনটা একটা নদীর মতো। নদীর স্রোত কখনও পাথর ভেঙে নিজের রাস্তা তৈরি করে নেয় কখনও বা পাহাড় কেটে। আবার কখনও কাউকে আঘাত না করেই চুপচাপ নিজের গতিপথ বদলে নেয়। এর জন্য আমরা নদীকে দোষ দিতে পারি না। আমিও অনেকটা ওই নদীর মতোই। হঠাৎ তোমার জীবনে ঢুকে পড়েছি। আমি জানি তুমি আমাকে অপছন্দ করো। পারলে আমাকে ক্ষমা করে দিও। আমরা এখন একটাই পরিবার। আমি চেষ্টা করব পরিবারটাকে যেন ভালো রাখতে পারি।

 

প্রিয়া, এই প্রিয়া কী অতশত ভাবছিস? রিয়ার ডাকে সংবিৎ ফিরল প্রিয়ার। বন্ধুদের সঙ্গে গল্পে আবার মেতে উঠল সে।

পরের চার-পাঁচদিন খুব আনন্দে কাটল প্রিয়ার। গান শোনা, আড্ডা মারা, বন্ধুদের সঙ্গে হইহই করে কাটিয়ে দিল দিনগুলো। এই চার-পাঁচ দিনই মণিকা বা অয়ন কারওরই মুখোমুখি হতে হল না তাকে।

সপ্তাহ শেষে স্কুল ছুটি থাকায় বাড়িতে ছিল প্রিয়া। ঘুম থেকে উঠতে দেরিই হয়েছিল  উঠে বাইরের ঘরে আসতেই দেখল অয়ন তৈরি হয়ে বেরোচ্ছে। অয়নের কাছেই প্রিয়া জানতে পারল, মণিকা হাসপাতালে ভর্তি। জানার ইচ্ছা না থাকলেও সৌজন্য বজায় রাখতে জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে?

মায়ের লাং ক্যান্সার। টার্মিনাল স্টেজ।

হোয়াট? চেঁচিয়ে উঠল প্রিয়া। এখনই ধরা পড়ল আর এর মধ্যেই টার্মিনাল স্টেজ! কী করে সম্ভব?

প্রিয়ার চোখেমুখে অবিশ্বাসের ছাপ স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠল। তাই দেখে অয়ন বলল, শুরুতে লাং-এই ক্যান্সার ধরা পড়েছিল কিন্তু এখন ব্রেনেও ছড়িয়ে পড়েছে।

একটা শক খেল প্রিয়া। ঘটনার গতিপথ যে এরকম একটা মোড় নিতে পারে, স্বপ্নেও ভাবেনি সে। একটা ছোট্ট অপরাধবোধ গুঁড়ি মেরে যেন তার মনে জায়গা করে নিতে চাইছে। অয়নের একটা হাত নিজের হাতে তুলে নিয়ে প্রিয়া বলল, অয়ন চিন্তা কোরো না, সব ঠিক হয়ে যাবে। বলে নিজের ঘরে ফিরে এল প্রিয়া।

আজ বুঝতে পারছিল, কেন বাবা সেদিন বলেছিলেন মণিকার চলে যাওয়ার কথা। মণিকাকে দেখার জন্য অধীর হয়ে উঠল প্রিয়া। মনে পড়ল এক একদিন এমনও গেছে, মণিকা তার কাছে এসে কত অনুনয়বিনয় করেছে, ওকে ক্ষমা করে দেওয়ার জন্য। কিন্তু প্রিয়াই পাষাণ হয়ে থেকেছে। অবশ্য তাতেও মণিকার দিক থেকে তার যত্নের কোনও কমতি কোনও দিনই হয়নি। মায়ের কর্তব্য মণিকা একনিষ্ঠ ভাবে পালন করে গেছে।

 

আজ মনের সঙ্গে অনেক যুদ্ধ করে প্রিয়া বাবার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। বলল, আমি আজ তোমার সঙ্গে হাসপাতালে যাব মণিকাকে দেখতে। সন্ধেবেলায় হাসপাতালে গিয়ে মণিকার সঙ্গে দেখা হল না। মণিকাকে কাচের ঘরে রাখা হয়েছিল। সেখানে ভিজিটর যাওয়ার অনুমতি ছিল না।

মণিকাকে এভাবে কেন রাখা হয়েছে? প্রিয়া বাবাকে জিজ্ঞেস করল।

কেমো নেওয়ার পর মণিকার শরীর দুর্বল হয়ে পড়ায়, বুকে শুরুতেই সংক্রমণ হয়েছিল। তাই, ওকে আলাদা রাখা হয়েছে। কারণ যাতে আর কোনও রকম সংক্রমণ না হয়।

কাচের ওপারে দাঁড়িয়ে মণিকার শরীরের সঙ্গে লাগানো বিভিন্ন যন্ত্র ও নলগুলোর দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে দেখছিল প্রিয়া। মণিকা বাবার থেকে দূরে চলে যাবে এই স্বপ্নই দেখছিল এতদিন। কিন্তু এভাবে সেটা হোক, তা কখনওই চায়নি প্রিয়া। মণিকাকে মনে মনে সে ঘৃণা করত ঠিকই কিন্তু এতটাও ঘৃণা কখনও করেনি যে, মণিকাকে এই অবস্থায দেখে আনন্দে লাফিয়ে উঠবে।

আজ এইখানে মণিকার ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে থেকে প্রথমবার প্রিয়ার মনে হল একবার যদি সে মণিকার সামনে গিয়ে দাঁড়াবার সুযোগ পেত, তাহলে ওর হাতদুটো নিজের হাতে নিয়ে ওর চোখে চোখ রেখে বলত, মণিকা আমি তোমাকে ক্ষমা করে দিয়েছি। প্রিয়ার চোখের জল বাঁধ মানে না।

বারবার প্রিয়ার মনে হতে থাকে, আজ এত বছর জিতে আসার পর মণিকার কাছে আজ সে সম্পূর্ণ হেরে গেছে। মণিকাকে এত কষ্ট দেওয়ার জন্য অপরাধবোধে ডুবে যায় প্রিয়া। হঠাৎ করে বয়সের থেকে অনেকটাই বড়ো গেছে বলে মন হয় নিজেকে। উপলব্ধি করে, কোনও সম্পর্ক শেষ হওয়ার মূলে সবসময় যে অন্য কোনও নারীর হাত থাকে এই ধারণা ওর সম্পূর্ণ ভুল। ওর মা-বাবার মধ্যে সম্পর্কটা ভাঙারই ছিল। তাহলে কেন ওর সবসময় মনে হয়েছে মণিকাই দোষী? প্রিয়ার নিজের কাছেও এর উত্তর অজানাই।

মণিকাও তো জানত সে প্রিয়ার নিজের মা নয়। তবুও সুখী পরিবার তৈরি করার স্বপ্নে বিভোর হয়ে ছিল। সেই স্বপ্ন সত্যি করার লক্ষ্যে মণিকার দিক থেকে কোনও কমতি কোনও দিনও হয়নি। অথচ ওর সমস্ত চেষ্টা চালানোটাকে ষড়যন্ত্র বলেই মনে হয়েছে প্রিয়ার। আর সে ষড়যন্ত্রকে বানচাল করে দেওয়াকেই নিজের জয় বলে ধরে এসেছে প্রিয়া।

প্রতি বছরই একটু একটু করে বয়স বেড়েছে প্রিয়ার কিন্তু কেন জানি না এই সহজ সত্যটাকে দেখেও না দেখার ভান করে এসেছে। এখন মনে হচ্ছে আর একটু সময় যদি ও হাতে পায়, তাহলে অতীতের ভুলগুলো শুধরে নিতে পারে। কিন্তু জীবন কী তাকে সেই সুযোগ দেবে? মনে মনে অস্থির হয় প্রিয়া।

এক সপ্তাহ কেমো আর রেডিয়েশন চলার জন্য মণিকাকে কাচের ঘরেই রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। শুধু প্রিয়া কেন, কারুরই ওর সঙ্গে দেখা করার অনুমতি ছিল না।

এদিকে মণিকার অবস্থা শুধরোনোর বদলে আরও খারাপ হওয়া শুরু হল। ট্রিটমেন্ট কোনও কাজই করছিল না। রেডিয়েশনের জন্য সারা শরীরে জ্বলুনি অনুভব করছিল মণিকা। বাড়ির সকলে মণিকার জন্য উদ্বেগে দিন কাটাচ্ছিল। শুধু অপেক্ষা, কবে মণিকাকে দেখতে যাওয়ার অনুমতি পাওয়া যাবে। এছাড়া আর কোনও পথও খোলা ছিল না তাদের কাছে।

তাদের আশা অনুযায়ী মণিকাকে ওয়ার্ডে শিফ্ট করা হল না। অবস্থার অবণতি হওয়াতে এবং সোমনাথের বিশেষ চেনাশোনা থাকার কারণে হাসপাতালেই বিশেষ একটা কেবিনে আলাদা করে মণিকাকে রাখার ব্যবস্থা করা হল। চব্বিশ ঘন্টা ডাক্তার আর নার্সেরও ব্যবস্থা হল। সোমনাথ আর অয়ন হাসপাতালেই শিফট করে গেলেন যাতে পালা করে মণিকার দেখাশোনা করতে পারেন।

প্রিয়া কিছুতেই মণিকার সামনাসামনি হওয়ার সাহস জোটাতে পারল না। সে বাড়িতেই থেকে গেল। বাবার কাছ থেকে জানল, আর কিছু দিনের অতিথি মণিকা।

অনেক কষ্ট করে ভয় কাটিয়ে নিজের মনকে তৈরি করল প্রিয়া। হাসপাতালে পৌঁছে দেখল মণিকার দুর্বল শরীরটা বিছানার সঙ্গে মিশে গেছে। চোখ জলে ভরে এল। তার দিকে মণিকার চোখ পড়তেই হাত তুলে কোনও রকমে ওকে কাছে ডাকল মণিকা। মেয়ে আর স্ত্রীকে রেখে সোমনাথ আর অয়ন কেবিনের বাইরে বেরিয়ে এলেন। মণিকা প্রিয়াকে ইশারা করল, তাকে খাটে বসিয়ে দিতে।

প্রিয়া ধীরে ধীরে বেডের হাতল ঘুরিয়ে বসানোর অবস্থায় নিয়ে এল। হাত দিয়ে ধরে থাকল মণিকাকে। মণিকা তাকে জড়িয়ে ধরল। প্রিয়া আর নিজেকে সামলাতে পারল না। কান্নায় ভেঙে পড়ল।

মনের ভিতর চলতে থাকা প্রতিটা সংঘর্ষ প্রিয়া চাইছিল মণিকার সঙ্গে শেযার করতে। কিন্তু হঠাৎ-ই ওর মনে হল মণিকা ওকে খুব জোরে ধরে রয়েছে। একটু চেষ্টা করে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে প্রিয়ার খেযাল হল, মণিকা একদৃষ্টে তার দিকে তাকিয়ে আছে।

মৃত্যু জিনিসটা যে কী, তা এর আগে কোনও দিন প্রিয়া দেখেনি। কিন্তু খারাপ কিছু আশঙ্কা করে প্রিয়া চেঁচিয়ে উঠল, ডক্টর… ডক্টর! ততক্ষণে মণিকা সকলের থেকে বিদায় নিয়েছে।

মণিকার মৃত্যুর পর সারা বাড়িটা যেন প্রিয়াকে গিলতে আসত। মা চলে যাওয়ার পরেও, এতটা একাকিত্ব কখনও বোধ করেনি প্রিয়া। ধীরে ধীরে বুঝতে পারল, শুধু বাড়িটাই নয়, ওর নিজের মনের অনেকটা জুড়েও মণিকা জায়গা দখল করে নিয়েছিল।

আত্মগ্লানিতে পুড়তে লাগল প্রিয়া। ইশ যদি সুযোগ পেত তাহলে মনের কথাটা মণিকাকে বলতে পারত! যেটা শোনার জন্য মণিকা এতটা অধীর হয়ে ছিল। আদৌ কি সে শুনতে পেত? মৃত্যুপথযাত্রীর কাছে সত্যিই কি তার কথাটা কোনও গুরুত্ব পেত? প্রিয়া সবসময় শুনে এসেছে, সময় থেমে থাকে না। তাহলে কেন সে সময় থাকতে থাকতে নিজের মনের কথাটা খুলে বলতে পারল না?

নিজের উপরই ঘৃণা হল প্রিয়ার। অস্থির বোধ করল। নিঃশব্দে বারান্দায় এসে দাঁড়াল। নীল আকাশে সাদা মেঘগুলো ভেলার মতো ভেসে বেড়াচ্ছে। মাথাটা ঘুরছে মনে হল প্রিয়ার। ভিতর থেকে একটাই শব্দ ঠেলে বেরোতে চাইছে, মণিকা… মণিকা। চীৎকার করতে ইচ্ছে করছে কিন্তু কেউ যেন গলাটা চেপে ধরেছে। স্বর বেরোচ্ছে না কিছুতেই প্রিয়ার গলা দিয়ে।আকাশে মেঘের ঘূর্ণায়মান গতিপথের দিকে চেয়ে সমস্ত শক্তি একত্র করে চ্যাঁচাল প্রিয়া, মণিকা প্লিজ… প্লিজ আমাকে ক্ষমা করে দাও।

কিন্তু খুব ভালো করেই জানে প্রিয়া, আজ মণিকা আর কোনও কথাই শুনবে না। আজ যে মণিকারই জয় হয়েছে।

কে দেখেছে

শেষ পর্যন্ত সোনাগাছিতেই যাবে অলকানন্দা। তার তাড়না এখন বিপদসীমা ছাপিয়ে ফুঁসে ওঠা নদীর মতো ভয়ংকর। সেই জলের তোড় এখন অলকানন্দাকে ভাসিয়ে নিয়ে গিয়ে আছড়ে ফেলতে চাইছে সোনাগাছিতে। তারপর অলকানন্দা সেরে নেবে তার আসল কাজ। চকার সঙ্গে হবে তার শেষ বোঝাপড়া। একটা তুমুল হেস্তনেস্ত করে ছাড়বে সে। জামার কলার ধরে হিড়হিড় করে টানতে টানতে নিয়ে যাবে থানায়। সবাই দেখুক গোবরডাঙার চ্যাটার্জিপাড়ার, লালবাড়ির ছোটোবউয়ের আসল মূর্তি।

অফিসে গিয়ে কদিনই সুস্থির মতো কাজে মন দিতে পারছে না অলকানন্দা। ভেতরে ভেতরে একটা ছটফটানি ভাব লেগেই আছে। সেটা খেয়াল করেছে কস্তুরী। কস্তুরীর পাশের টেবিল অলকানন্দার।

কী হল তোর?

কাল সারারাত দুচোখের পাতা এক করতে পারিনি।

ঘুমোতে পারিসনি? কীসের অস্বস্তি? কী ব্যাপার রে তোর? কদিন ধরে লক্ষ্য করছি, কী হয়েছে?

অলকানন্দা এড়িয়ে যেতে গিয়ে, গেল না। বলল, তোকে বলে তো কোনও সুরাহা হবে না। খুবই বিশ্রী একটা কাণ্ড ঘটে গেছে। আমি কিছুতেই ব্যাপারটা বরদাস্ত করতে পারছি না। আবার মন থেকে ঝেড়েও ফেলতে পারছি না।

সব শুনে কস্তুরী একটা বড়ো করে নিঃশ্বাস ছাড়ল। জলের গেলাস হাতে তুলে বলল, তোর মাথাটা সত্যিই গেছে। এসব তো খুবই বস্তাপচা ঘটনা। তুই এতে ফালতু মাথা গলাচ্ছিস। চিরকালই তো এসব হচ্ছে। তুই ভেবেও বা করবিটা কী?

আমি সোনাগাছিতে যাব।

জলের গেলাসে সবে ঠোঁট ছুঁইয়েছিল কস্তুরী। বেমক্কা বিষম খেয়ে কাশতে লাগল। ধরা গলায় বলল, তুই কোনও সাইকায়াট্রিস্ট-কে দেখা অলোকা। আমার ধারণা, তোর মাথাটা হ্যাং মোডে চলে গেছে। ডোন্ট বি সিলি অলোকা। মাটিতে পা রেখে চল। বাস্তবটা বোঝার চেষ্টা কর। ডোন্ট টেক এনি হুইমজিক্যাল ডিসিশন লাইক দিস। এই ধরনের ছেলেমানুষি জেদের কথা তোর মুখে মানায় না। কোনও ভদ্রঘরের মেয়ে ও-পাড়ায় পা দেয় নাকি? তোর বাড়িতে ক’বছর রান্না করেছে, তো কী হয়েছে? এসব কথা কেউ স্বীকার করে নাকি? লজ্জায় চেপে গেছে।

সেই লজ্জাটাই তো ওকে দিতে চাই আমি। আবার ঠাটের কথার বহর কী! চাকরি পেয়েছি।

তোকে কি এই যুদ্ধে জিততেই হবে? একটা নোংরা ব্যাপার ঘাঁটতে গিয়ে তোকেও যে নর্দমায় নামতে হবে, তা ভেবে দেখেছিস?

ওসব আমি বুঝি না। আমি সোনাগাছিতে যাবই আর তুইও আমার সঙ্গে যাবি।

আমি যাব! তুই আমাকে নিয়ে যাওয়ার আর জায়গা পেলি না? শেষ পর্যন্ত ওই নরকে? কোনও লোচ্ছা তোর বা আমার হাত ধরে টান দিলে, আই মিন টু সে দ্যাট, তুই বা আমি ফিজিক্যালি হ্যরাসড হলে মুখ দেখাতে পারব?

ওসব ভয়  দেখিয়ে আমাকে দমিয়ে রাখতে পারবি না। আমি যাবই। আর তুইও আমার সঙ্গে যাবি। আমাকে যেতেই হবে।

সে নয় গেলি। আমিও সঙ্গে গেলাম। কিন্তু তুই তোর হাবিকে বলতে পারবি? সাহসে কুলোবে তোর?

ও জানে কেসটা। ও-ই বলেছে আমাকে।

কী বলেছে? বলেছে, ওহ, শিয়োর। ইউ মাস্ট গো টু সোনাগাছি? তাই বলেছে?

না, তা নয়। সোমা যে সোনাগাছিতে ঘর নিয়েছে, খবরটা সুজয়ই আমাকে দিয়েছে। কে নাকি সোমাকে সোনাগাছিতে দেখেছে, এই তো গত বৃহস্পতিবারেই।

রাতে অলকানন্দা শুতে যাওয়ার তোড়জোড় করছিল। সুজয় ওর স্টাডিরুমে ল্যাপটপে ঘাড় গুঁজে বসেছিল। সুজয়ের জন্য জলের গেলাস নিয়ে গজগজ করতে করতে ঢুকল অলকানন্দা। বলল, বেশি রাত কোরো না। আমাকে সাতসকালে উঠতে হবে। সোমা আমার সব সুখ কেড়ে নিয়েছে। কথা নেই বার্তা নেই দুম করে কাজ ছেড়ে দিল।

সুজয় তখনই বলল কথাটা। প্রথমটা তেমন খেয়াল করেনি অলকানন্দা। বলল, কী বললে?

সুজয় ল্যাপটপেই ঘাড় গুঁজে রেখে ফের বলল, তোমার সোমার প্রামোশন হয়েছে। সে সোনাগাছিতে ঘর নিয়েছে।

কী বলছ তুমি?

ঠিকই বলছি। ইটস ট্রু অ্যাজ ডে লাইট। নাও সোমা ইজ আ পার্মানেন্ট রেসিডেন্ট অফ সোনাগাছি।

সোমা সোনাগাছিতে…!

ইয়েস, ঘর নিয়েছে। নাও সি ইজ আ কনফার্মড হোর। ওহ, আই অ্যাম সরি। দিজ ভোকাবুলারিজ আর আনকনস্টিটিউশনাল নাউ-এ-ডেজ। আজকাল ওদের ডেজিগনেশন হয়েছে। দে আর কলড সেক্স ওয়ার্কার্স। আই মিন যৌনকর্মী। ডোন্ট সে হোর, প্রস্টিটিউট অ্যান্ড সো অন…

কী নিষ্ঠুরের মতো বলছ এসব? একটুও মুখে বাধছে না তোমার?

লিসন মাই ডিয়ার, ইন দিস কেস, আম সিম্পলি হেল্পলেস। আই ডোন্ট ওয়ান্ট টু বি আ পেটি সিমপ্যাথাইজার লাইক ইউ, ইউ নো। আই হেট অল দিস ডার্টি থিংগস। যাও, শুতে যাও। আমাকে কাজ করতে দাও।

অলকানন্দা আর দাঁড়ায়নি। সুজযের স্টাডিরুম থেকে বেরিয়ে নিজের ঘরে এসে সোফার ওপর গা ছেড়ে দিয়ে বসে পড়ে। অলকানন্দা মনে মনে দুয়ে দুয়ে চার করে নেয়। নিজের সঙ্গেই কথা বলে ওঠে সে, ও তাই সোমা আমার রান্নার কাজটা ছেড়ে দিল!

দোলের পরের দিনই সোমা এসেছিল। বলল, বউদি, খুব খারাপ খবর। তোমার বাড়ির কাজ আমি আর করতে পারব না গো। শুনে অলকানন্দার মাথাটা বাঁই করে ঘুরে গেল। বলল, ইযার্কি করিস না সোমা। তুই ছাড়া আমি অচল, তুই জানিস। আমার অফিস মাথায় উঠবে, তুই না এলে।

সে তো জানি বউদি। কিন্তু, কলকাতায় আমি একটা বড়ো কাজ পেয়েছি। অনেক টাকা মাইনে!

তুই কি আমাকে মাইনে বাড়াতে বলছিস? তা অত ঘুরিয়ে নাক ধরার কী আছে? সোজা কথা বল না। দেব বাড়িয়ে জানি তোর বরের চিকিত্সার খরচ অনেক। আমি তো সবাইকে বলি, সোমা ওর বরকে নিয়ে কী লড়াইটাই না লড়ছে! এমনিতেই তোকে আমি অনেক বেশিই টাকা দিই। আরও বাড়িয়ে দেব। তবু তোকে ছাড়া আমার চলবে না সোমা।

না বউদি, চাকরিটা আমি হাতছাড়া করতে চাই না। ওর ওষুধের পেছনে কত খরচ, তা তো জানো। তিনবাড়ির রান্নার কাজে যা পাই ফুটকড়াই হয়ে যায়। সংসার চলে না। এবার মনে হয় একটু সুখের মুখ দেখব।

কী চাকরি তোর?

উঁ

উঁ না টুঁ। বলছি কাজটা কী?

ওই একটা কাজ। সে বলার মতো কিছু নয়। লেখাপড়া জানি না। অফিসের কাজ আর কে দেবে আমায়?

তবে কী? টিভি সিরিয়ালে অ্যাকটিং করবি? ওই চকা তোর মাথায় এসব ভূত চাপিয়েেছে না? আমি তোকে বলেছি না, ওসব লাইন তোর মতো মেয়ের জন্য নয়। তোর রূপের চটক আছে। কিন্তু, খুঁটির জোর আছে কি? চিল-শকুনে ছিঁড়ে খাবে তোকে, তখন কেঁদে কূল পাবি না। ওই চকার পাল্লায পড়িস না। ওটা একটা আস্ত ক্রিমিনাল। মওকা পেলে ও তোকে আরব-এ চালান করে দেবে।

সোমা বলল, না বউদি, চকাকে ওপর থেকে দেখে আম্মো তাই ভাবতাম। ও আমাকে দিদি ডেকেছে।

অলকানন্দার আন্দাজে ঢিল ছোড়াটা তাহলে লাগসই হয়েছে। রিভলভিং স্টেজ-ড্রামার মতো বাঁই করে এক চক্করে ঘুরে গেল যেন মঞ্চটা। একটা ঘাগু উকিল আর ঝানু গোয়েন্দার মতো দ্বৈত চরিত্রে ঢুকে পড়ে অলকানন্দা। অদ্ভুত ভঙ্গিতে মাথাটা দোলাতে দোলাতে বলে, তাহলে চকাই তোর মাথাটা খেয়েছে। দ্যাখ সোমা, দুনিয়াটার কিছুই দেখিসনি তুই। জানিসও না কিছুই। চকার মতো ক্রিমিনালদের কাছে মা-বোন বলে কিছু নেই রে। ওটা একটা আস্ত তোলাবাজ। ওরা শুধু চেনে টাকা আর চেনে মদ আর মেয়েমানুষ। তোকে দিদি বলল, আর তুই অমনি গলে গেলি?

চকা আজ পোজ্জন্ত আমার সঙ্গে কোনও খারাপ ব্যাভার করেনি।

করেনি তোকে বাগে পায়নি, তাই করেনি। এবার পাবে।

কেন? এবার পাবে কেন?

ওই যে কৃতজ্ঞতা। তুই তো আর অকৃতজ্ঞ হতে পারবি না। তোকে অনেক টাকার কাজ জোগাড় করে দিল। তার প্রতিদান যখন চাইবে, তখন বুঝবি। যাই হোক, চাকরিটা কী? মানে কী কাজ?

সোমা বলতে গিয়ে থেমে গেল। কে যেন ওর গলা টিপে ধরল। তার চোখ, চিবুক শক্ত দেখাল। বলল, ওই একটা ছোটোখাটো কাজ আর কী। বলার মতো তেমন কিছু না। চলি। আর দাঁড়ায়নি সোমা।

 

বাড়ি ফিরে ঘরে ঢুকেই অলকানন্দা হাতব্যাগটাকে ছুঁড়ে দিল সোফায়। বাথরুমে ঢুকে গেল সোজা। অনেকক্ষণ ধরে শাওয়ারের নীচে দাঁড়িয়ে শরীর ও মনকে স্থির করার অনুশীলন চালাল। সোমার এই পরিণতির কথা ভাবতে ভাবতে গা গুলিয়ে ওঠে তার। বেসিনের কাছে ছুটে গিয়ে ওয়াক তুলতে থাকে। খানিক ধাতস্থ হওয়ার পর চোখে মুখে জলের ঝাপটা দেয়। ঘাড়ে ও পিঠে জল দেয়। হ্যাঙার থেকে তোয়ালেটাকে একটানে নামিয়ে এনে, বিছানায় শরীর গড়িয়ে দিয়ে চোখ বুঁজে পড়ে থাকে। যেন চোখ খুলতেও ভয়। ছেলেবেলায় রাক্ষস-খোক্ষসের স্বপ্ন দেখার পর ভয়ে আতঙ্কে যেমন চোখ খুলতে পারত না ঠিক তেমন। ঠিক সেই আতঙ্ক গিলে রেখেছে অলকানন্দাকে। যেন জেগে শুয়ে চোখ বুজে থাকলে মনে হবে, সে সোমাকে নিয়ে দুঃস্বপ্ন দেখছিল। গোটাটাই স্বপ্ন। চোখ খুলে বাস্তবে ফিরতে চায় না সে।

ওভাবে শুয়ে থাকতে থাকতে অলকানন্দা টের পায়, ওর ভেতরে স্মৃতির জলভরা বোতলটা কখন কাত হয়ে শুয়ে পড়েছে। তাই নীচের অচেতন স্তরের খড়িমাটির গুঁড়োর মতো থিতিয়ে পড়া স্মৃতিগুলো গড়িয়ে অবচেতন স্তর টপকে এল। এল একেবারে অলকানন্দার চেতন স্তরে। নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করতে থাকে সে। তার মন বলে ওঠে, ও, তাই! তাই সোনাগাছির প্রতি তার এমন দুর্বার আকর্ষণ? এই সেই সোনাগাছি। ওহ! এ তো সেই প্রত্যভিজ্ঞা! সেই প্রত্যভিজ্ঞাই এতকাল পরে ঘুরে ফিরে অলকানন্দার সামনে এসে হাজির।

অলকানন্দা কলেজে সাইকোলজি পড়েছে। জেনেছে প্রত্যভিজ্ঞার কথা। আগের দেখা ও শোনার সঙ্গে মিল খুঁজে পাওয়া। এই যে-সোনাগাছি তাকে মাতিয়ে তুলেছে, তার মূলে তো শুধু সোমা নয়! রয়েছে আরও একজন। সে অলকানন্দার মাসতুতো দিদি মান্তুদি। অনেক বছর আগে মান্তুদি গেছিল সোনাগাছিতে। মান্তুদির বর প্রায় রাতেই বাড়ি ফিরত না। পাড়ার অভিজিত্দাই গোয়েন্দাগিরি করে, সুমনদার সুলুক সন্ধান এনে দিল মান্তুদিকে। অভিজিত্দার সঙ্গে সোনাগাছিতে গিয়ে হানা দিল মান্তুদি। এক রূপসী মহিলার ঘর থেকে মান্তুদি ওর বরকে, জামার কলার ধরে হিড় হিড় করে টেনে রাস্তায় এনে, মুখে থুতু ছিটিয়ে দিয়ে চলে এসেছিল। আর ফেরেনি।

সে আজ থেকে বছর কুড়ি আগের কথা। তখন অলকানন্দার বয়স বড়োজোর বারো-তোরো হবে। তাই বাড়ির বড়োরা ছোটোদের কানকে আড়াল করে ফিসফাস, কানাঘুষো চালাত। তখনই সোনাগাছি শব্দটা ছিটকে এসেছিল অলকানন্দার কানে। পরে সব ঘটনাই শুনেছে, জেনেছে। প্রায় এক যুগ আগের সেই পারিবারিক বিপর্যয়, মান্তুদির সেই সোনাগাছি অভিযানের কথা স্রেফ কর্পূরের মতো উবে গিয়েছিল। আজ এতকাল পরে সোমার কদর্য পরিণতিতে অলকানন্দার অন্তরিন্দ্রিয়ে অচেতন স্তরে, মজে যাওয়া সেই স্মৃতি উঠে এল চেতনায়। আখেরে মান্তুদিই হল তার অ্যাকচুয়াল ইন্সপিরেশন। এই মুহূর্তে মান্তুদিই তার মনের জোর একশোগুন বাড়িয়ে দিল যেন।

রাতে ভালো করে ঘুমোতে পারল না অলকানন্দা। যত রাত বেড়েছে, ততই রোখ বেড়েছে তার। কেবলই মনে হতে থাকে, ওই লোচ্ছা চকা যেন ওকে হারিয়ে দিল শেষটায়। চকাকে উচিত শিক্ষা না দিতে পারলে স্বস্তি নেই। এত দূর স্পর্ধা! একটা মেয়ে দারিদ্রের সুযোগ নিয়ে তাকে ওই নরকে টেনে নিয়ে যায় কী করে? আগে সোমার গালে চড় কষিয়ে ওর দেমাক ভেঙে গুঁড়িয়ে দিতে হবে। তারপর সে একটা হেস্তনেস্ত করে তবেই ছাড়বে।

পার্টি-পলিটিক্স যতদূর যেতে হয় যাবে অলকানন্দা।

 

পরের দিন অফিস থেকে ফেরার পথে অলকানন্দা গেল চকাদের ঠেকে। একদল ছেলেছোকরা বসে গুলতানি করছিল একটা চা দোকানে। চকা এসে দাঁড়াল অলকানন্দার সামনে। মোবাইল ফোনে তর্জনী চালাতে চালাতেই বলল, আপনি এখানে? কী ব্যাপার বলুন তো?

অলকানন্দা বলল, সোমাকে তুমি এই পথে নামালে কেন?

কে সোমা?

তুমি ভালোই জানো কোন সোমা। ও আমাদের বাড়িতে রান্নার কাজ করত।

অ… সোমাদি। তাকে সোনাগাছিতে নিয়ে গেছি কেন? তাই তো? তা সে কি কারও কোলের মেয়ে আমি কি তাকে কারও কোল থেকে কেড়ে নিয়ে গেছি? এমন গিলাবিলা বলেন না, শুনলে শালা সাত পেগের নেশা ছুটে যায়। নিজের পায়ে হেঁটে হেঁটে হাটে গেল ঘোষ, সবাই বলে, হাই রোডেরই দোষ। সোমা তো নিজের ইচ্ছেতেই গেছে। সব জেনে তাপ্পর কথা বলুন। মাস খানেক ধরে সোমা আমার পেছনে এঁটুলির মতো লেগে পড়েছিল। শুধু বলেছে, ছেলেকে ইশকুলে ভত্তি করাবে। ওর অনেক টাকা দরকার। বলল, ও কারও দয়া নেবে না। বলল, চকা আমি রোজগার করতে চাই। যেমন করেই হোক, নিজের রোজগার। ওর স্বামীর তো প্যারলিসিস। শুনে আমার মায়া হল। তাই আমি ওকে…

চকার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে অলকানন্দা বলল, তাই তুমি ওকে সোনাগাছিতে নিয়ে গেলে? বাঃ চমত্কার সোমা যে-ছেলেকে স্কুলে ভর্তি করাবে, দুদিন বাদে ছেলে বড়ো হয়ে যখন মায়ের আসল পরিচয়টা জানবে, তখন?

চকা আঙুলের টোকায় সিগারেটটাকে ঘরের এক কোণে ছুড়ে দিয়ে বলল, দেখুন বউদি, ছোটোমুখে একটা বড়ো কথা বলি, মায়ের পরিচয় শুধুই মা। আপনারা পিথিবির কটা মাকে দেখেছেন?

তোমার কাছে জ্ঞানের কথা শুনতে চাই না। তুমি আমাকে সোমার সোনাগাছির ঠিকানাটা একটু বলবে?

কেন? আপনি যাবেন নাকি সেখানে?

নিশ্চয়ই যাব।

বিন্দাস বলেছেন মাইরি। আপনার কলিজায় কুলোবে?

আমি ভয় পাই না।

তাওলে যান, আপনি গেলে সিনটা জমে যাবে। অবোসসো আপনি একা গেলে ওর ঠেক খুঁজে পাবেন না। সে অনেক গোলমেলে গলতা। কিন্তু, আপনি কেন যাবেন সেখানে সেটা বলবেন? মানে আপনার আসলি কাহানি?

কাহিনি আবার কী? ও আমায় বলেছে চাকরি পেয়েছে নাকি। আমি গিয়ে ওই মিথ্যেবাদীর গালে একটা ঠাস করে চড় মারব। তারপর তোমার সঙ্গে হবে আমার আসল বোঝাপড়া।

চমকাচ্ছেন? আমাকে? আপনি মেয়েছেলে, তাই চেপে গেলাম। ঠিক আছে, কবে যেতে চান, চলুন আমি নিয়ে যাব।

আমি কালই যেতে চাই। কিন্তু তুমি আগে থেকে সোমাকে কিছু জানাতে পারবে না।

সে ঠিক আছে। একটা সবুজ পাত্তি ছাড়তে হবে। মাগনা হবে না।

মানে! কত পাঁচশো?

চকা মাথা ঝাঁকিয়ে তার সম্মতি বুঝিয়ে দেয়।

অলকানন্দা বলে, ঠিক আছে দেব।

 

রাতে তুলকালাম ঝড় উঠল। অলকানন্দার প্রস্তাব শুনে সুজয়, সিংহের গর্জন তুলে গোটা বাড়ি কাঁপিয়ে দিল। এমন বিশ্রী একগুঁয়েমি, জেদের কথা শুনে সুজয় ঝাঁঝিয়ে উঠে ঠাস করে একটা চড় কষিয়ে দিল অলকানন্দার গালে। ব্যস, আর কোনও পরোয়া নেই। কোনও বাধা নেই আর। সুজয়ের চড় অলকানন্দার সোনাগাছির পাসপোর্ট পাকা করে দিল। তার সোনাগাছি অভিযানের আসন্ন সাফল্যের রোমাঞ্চ, সুজয়ের চড়ের গ্লানি মুহূর্তে মুছে দিল। আর কথা বাড়তে দেয়নি অলকানন্দা। বালিশে মুখ গুঁজে পড়ে থাকে। সুজয় বারবার অনুতাপ, অনুকম্পা জানাতে এলেও, মুখ তোলেনি সে।

সারারাত এক ভাবে বিছানায় পড়ে থাকে অলকানন্দা। অনেক রাত পর‌্যন্ত সুজয় আত্মপক্ষ সমর্থনে গজগজ করতে থাকে। একসময় অলকানন্দা টের পায়, তার সিংহমার্কা স্বামী নাকের গর্জন তুলছে। অলকানন্দা টুঁ শব্দেরও টুঁটি টিপে নেমে আসে বিছানা থেকে। ওদের তিনতলার ঝুলবারান্দায় একটু একটু করে রাতের আয়ু ফুরিয়ে আসতে থাকে।

খুব ভোরে আচমকা ঘুম থেকে জেগে উঠে সুজয় দেখল অলকানন্দা নেই। ওর বালিশের এক কোণে একটা ভাঁজ করা এ ফোর পেপার। তাতে লেখা, আজ অফিস ছুটির পর সোনাগাছি যাচ্ছি। তার পরের গন্তব্য আমার জানা নেই।

 

অফিস ছুটির পর অলকানন্দা ভূত দেখে চমকে ওঠে। অফিসের গেটের মুখে সুজয় দাঁড়িয়ে অলকানন্দাকে দেখে এগিয়ে এল। বলল, চলো আমিও যাব। পেছন থেকে কস্তুরী বলল, অলকা, তাহলে আমি আর যাচ্ছি না। অলকানন্দা মাথা নেড়ে হাত তুলে গুডবাই বোঝাল।

ভিক্টোরিয়া হাউসের সামনে চকার দাঁড়ানোর কথা। দূর থেকে চকাকে দেখা গেল। ফর্সা লম্বা মেয়ে পটানো চেহারা। নীল জিন্স-এর ওপর একটা ডার্ক টি-শার্ট। বলিউডের হিরোর স্টাইলে কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

অলকানন্দা বলল, ওই যে ওই ছেলেটা। চকার গা ঘেঁষেই ট্যাক্সি দাঁড়াল। অলকানন্দা মুখ বাড়িয়ে বলল, উঠে এসো চকা, সামনে বসো। ট্যাক্সি ছুটছে সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ ধরে। চকা ড্রাইভারের কপালের কাছে ঝোলানো আয়নায় কেঁপে কেঁপে যাওয়া লোকটাকে দেখার চেষ্টা করছিল।

ট্যাক্সি থেকে নেমে চকা বলল, আপনারা আসুন আমার সঙ্গে। চকাকে অনুসরণ করে চলল অলকানন্দা আর সুজয়। বুক কাঁপছিল অলকানন্দার। এটাই তাহলে সোনাগাছি! আসলে পৃথিবীর এই আদিম পেশার ওপর অনেকদিনের চাপা কৌতূহল তার। সোমাই যেন হাত ধরে নিয়ে এল অলকানন্দাকে। তার অজানা ও অদেখাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল সোমাই। রাস্তার দুধারের বাড়ির সামনে সব অসভ্য সাজগোজ করা রোজগেরে মেয়ে। এরাই বেশ্যা, বারবনিতা, বারাঙ্গনা আরও কত নাম এদের। এখন শুধুই যৌনকর্মী।

একটা বাড়ির সামনে এসে দাঁড়িয়ে পেছন ফেরে চকা। বলে, এই বাড়িটাই, চলে আসুন। বাড়িটার একবারে গর্ভস্থলে ঢুকে পড়ল ওরা তিনজন।

অলকানন্দা বলল, বাব্বা, কত ভেতরে গো চকা।

চকা বলল, আসুন না। আরও একটু ভেতরে। সুজয় নাকে-মুখে সাদা রুমাল চেপে হাঁটছিল। অলকানন্দার বুকে ভূমিকম্পের ধকল। গলা শুকিয়ে আসছিল। অনেক কষ্টে বলল, চকা তুমি সোমাকে কিছু জানাওনি তো।

না কিছু বলিনি। আপনাদের দেখে ও বমকে যাবে।

অলকানন্দা চাপা গলায় বলল, লজ্জাও পাবে। অবশ্য এখনও যদি ওর লজ্জা বলে কিছু অবশিষ্ট থাকে।

চকা বলল, এখানে ওসব লজ্জাফজ্জা চলে না। বলতে বলতে একটা ঘরে ঢুকে গেল চকা। পেছন ফিরে বলল, আসুন ভেতরে চলে আসুন। ঘরের ভেতরে ঝলমল করছে আলো। ঘরে ঢুকেই একেবারে সোমার মুখোমুখি অলকানন্দা।

সোমা ছুটে এসে অলকানন্দার হাত চেপে ধরল। বলল, দাদা-বউদি, তোমরা এখানে! চকা নিয়ে এল বুঝি? খুব ভালো করেছ এসেছ। আমি যেন স্বপ্ন দেখছি।

অলকানন্দার কথা বলার শক্তি নেই। চকা বলল, এটা এই বাড়ির কিচেন। দুবেলা পনেরো-পনেরো তিরিশটার মতো পাত পড়ে এখানে। দুজন জোগাড়েকে নিয়ে সোমা একাই সামলায় এই কিচেন। মাস মাইনে পনেরো হাজার।

সোমা বলল, তোমরা বসো বউদি, আমি তোমাদের চা করে দিই।

 

অলকানন্দার পায়ের নীচ থেকে মাটি সরে যাচ্ছিল। কিচেন থেকে বেরিয়ে বাইরের ছোট্ট প্যাসেজে একটা চেয়ারে স্থবিরের মতো বসে পড়ল অলকানন্দা। সুজয় পাশে নাকে রুমাল চাপা দিয়ে দাঁড়াল।

চকা এসে বলল, এবার বলুন বউদি, আমার সঙ্গে কী বোঝাপড়া করবেন।

অলকানন্দার চোখ ঝাপসা হয়ে এল। হাতের রুমাল দিয়ে চোখের কোণা মুছে নিয়ে বলল, আমাকে আর লজ্জা দিও না।

ঠিক তখনই চকার মধ্যে জেগে উঠল মাস্তান চকা। মাস্তানির ঢঙেই সে বলল, বউদি, সোমাকে এই সোনাগাছিতে কে দেখেছে বলুন তো? মানে সেই ডবল ভদ্দলোকটি কে?

সুজয় এবার তাড়া লাগাল। বলল, ওসব কথা পরে হবে। আমরা এখন ফিরব।

অলকানন্দার বুকের ভেতরে ভূমিকম্পে ধস নামছিল। সুজয় বলল, চলো, একটু হেঁটে এসো। ওই মোড় থেকে ট্যাক্সি নেব।

অলকানন্দা হাঁটছিল সুজয়ের পেছন পেছন। দূরত্ব সামান্য হলেও ব্যবধান ছিল। একটা লোক সুজয়কে দেখে সালাম সাব বলল। প্রায় মাঝবয়সি লোকটার পরনে চেক লুঙ্গি, কালো স্যান্ডো গেঞ্জি, গলায় চৌকো তাবিজ। অলকানন্দাকে পাশ কাটিয়ে চলে গেল লোকটা।

অলকানন্দা এবার পা চালিয়ে সুজয়ের পাশে পাশে হাঁটতে লাগল। বলল, লোকটাকে তুমি চেনো নাকি?

কথাটা সুজয়ের কানে গেল কিনা বোঝা গেল না। অদূরে দাঁড়ানো একটা ট্যাক্সি দেখে সুজয়, ট্যাক্সি বলে চেঁচিয়ে উঠল।

ভাইরাল

বলছি আপনার প্রোফাইলটা একটু বলুন দিকি।

রায়বাবুর কথা শুনে অবাক চোখে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল লোকটা।

রায়বাবু তাড়া দিলেন, আচ্ছা লোক তো মশায় আপনি, প্রোফাইল বোঝেন না? মানে কী করেন? পলিটিকাল লিংক আছে কী না? মানে ধরুন মাঝামাঝি মানের নেতা হলেও চলবে। ভিআইপি-দের সাথে লিংক আছে? নিদেনপক্ষে ওনাদের সাথে কযেটা সেলফি, কিংবা কোনও এমএলএ বা মিনিস্টার রেকমেন্ডেশন?

লোকটা আবার চুপ।

রায়বাবু আর একটু ব্যাখ্যা করে বললেন, বলছি বিদেশ গেছেন কখনও? এনআরআই ছাপ আছে? বাড়ির কেউ বড়ো ডাক্তার বা নামকরা ইঞ্জিনিয়র আছেন? বা ধরুন কবি। মানে রিলেটিভে কি কোনও সেলিব্রিটি আছে?

লোকটা আবার চুপ। এবার রায়বাবু বিরক্ত।

আরে দূর মশাই আপনি কালা নাকি? আচ্ছা, ফেসবুক আইডি-টা বলুন, দেখি ভেরিফায়েড আইডি কিনা। লেখা শেযার করেন তো নাকি? তা ফ্যান ফলোয়ার কেমন আপনার? বলছি লাইক-টাইক পড়ে? শেযার হয় আপনার লেখা? কতগুলো পেজে লেখা বেরোয় আপনার? নিজের বন্ধু বান্ধবের ফলোয়ার আছে? কমেন্ট টমেন্ট পড়ে? ওই ম্যাগগুলোতে রেগুলার লেখেন তো না কী?

লোকটা আবার ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে চুপ।

রায়বাবু বিরক্ত হয়ে হাঁক পাড়েন, কী রে কেষ্ট, যাকে তাকে অফিসে ঢোকাস কেন? যতসব সময় নষ্ট। দাদা আপনি আসুন, অনেক কাজ বাকি। আসুন তো মশাই।

লোকটা এবার আমতা আমতা করে বলল, মানে কোনও ভাবেই কী লেখা বের করা যাবে না?

রায়বাবু তাচ্ছিল্য করে বললেন, দূর মশাই আপনার তো কোনও প্রোফাইলই নেই। অচেনা লোকের লেখা লোক পড়বে কেন? চোখ ছোটো করে বললেন ৩০ হাজার দিতে পারবেন, ভাইরাল করে দেব আপনাকে।

লোকটা আবার চুপ।

 

লোকটা মানে আকাশ মুখার্জি। ১০ ফুট বাই ৯ ফুট-এর খুপরিতে ছেলে বউ নিয়ে অশান্তির সংসার। অশান্তিরই বললাম, এত অশান্তি আগে ছিল না, ভালোবাসার বিয়ে উদ্দাম আঠারোর আবেগের দিনে, আকাশের প্রায় সব কিছু ভালোলাগা নিয়ে ওর হাত ধরেছিল কুর্চি। কুর্চি নামটাও আকাশেরই দেওয়া। ছেলে বিতান আসার সময় পর্যন্ত সম্পর্কটা বেশ ছিল। তারপর অভাবের কালো হাঁ সব সম্পর্কগুলোকে কেমন যেন গিলে খেল। আকাশ গুণী ছিল কিনা সেটা কোনও দিন ভেবে দেখেনি কুর্চি। কিন্তু আকাশের সততা আর সারল্য কাছে টেনেছিল তাকে। আজ বিয়ের এত বছর পর কুর্চির মনে হয় কোথাও হয়তো একটা ভুল হয়ে গেছে। লোকটার সততা বা সারল্য-টা ভন্ডামি। আসলে লোকটা অলস আর ভীতু টাইপের। পরিবর্তনের নামে লোকটার গায়ে জ্বর আসে। সারাক্ষণ বইয়ে মুখে গুঁজে বসে থাকলে সংসার চলে না, এটা লোকটা বোঝে না। বিতানের মুখ চেযে চুপ থাকে। অন্য কেউ হলে কবে সংসার ছেড়ে চলে যেত। এখন কুর্চির একটাই স্বপ্ন বিতানটার কিছু একটা হোক।

অভাব যখন চাওয়া পাওয়ার থেকে কম হয়, তখন ভিখারীও রাজা হয় এই প্রবাদটা আকাশের জীবনের এক অমোঘ সত্যি। ছোটো থেকে অভাবের সংসার আকাশকে অতটা আঘাত দেয়নি যতটা আঘাত করত ওর না-পারা নিয়ে সমাজের পরিহাস। না, আকাশ কিচ্ছু পারত না। মানে যেগুলো পারলে সমাজ ওকে মনে রাখবে সেগুলোর প্রায় কিছুই আকাশ কোনও দিন পারেনি। আকাশ কোনও হোমড়াচোমড়া ক্লাবের মেম্বার ছিল না, না ক্রিকেট বা ফুটবল টিমের ক্যাপ্টেন, না স্টেজ পারফর্মার। আর পড়াশোনা! টিউশন ছাড়া পাশ করে যেত কোনওরকমে। তবে আকাশ কবিতা লিখত, গল্প বুনত। যে-কবিতা কেউ পড়েনি, আকাশও কাউকে পড়ায়নি। সারাদিন ফ্যাক্টরির কালো ঘামে নিজেকে নিংড়ে যখন রাতের কালো হাতগুলো তাকে ভবিষ্যতের ভয় দেখাত, তখন আকাশ আর ওর লেখাগুলো, দিস্তাখাতায় জীবন্ত হয়ে জীবনের প্রতিটা বাস্তবকে কল্পনার চাদরে জড়িয়ে ওম দিত সুখের। কুর্চিকে নিয়ে লিখেছিল জীবনের প্রথম অনু কবিতা ইচ্ছে। ওর ব্যাগে চুপিচুপি ফেলেছিল চিরকুটটা,

ইচ্ছেটা ছিল সুযোগ হয়নি

এক থেকে মুহূর্তে একশো দেখার ইচ্ছে ছিল

এক থেকে দোকা হয়ে হারানোর ইচ্ছে ছিল

কাঁধে নির্ভরতা খোঁজার হাতকে উড়িয়ে নিয়ে যাবার ইচ্ছে ছিল

মেঠো ধুলোয় নিজেকে ঝাপসা দেখার ইচ্ছে ছিল

পাহাড়ি রাস্তায় চুপিসারে বৃষ্টি ভেজার ইচ্ছে ছিল

পেট্রল পোড়া গন্ধে নিকোটিনের গন্ধ মেলানোর ইচ্ছে ছিল

ইচ্ছে কী জানে?

উত্তরটা কুর্চি দিয়েছিল। জীবনসঙ্গী হয়ে কী মধুরই না ছিল দিনগুলো। এখন সাধ্যগুলো সব একই আছে, ইচ্ছেটাই শুধু নেই। কুর্চিকেও দোষ দেয় না আকাশ, ব্যর্থ স্বামী নিয়ে সংসার করা সহজ নয়! আকাশেরও চাওয়া-পাওয়া কোনও দিন ছিল না, আজও নেই। শুধু দিস্তাখাতায় স্বপ্নগুলো বেড়েই চলত, পাতার পর পাতা, দিস্তার পর দিস্তা।

 

প্রিন্টিং প্রেসের মালিক যেদিন প্রুফ রিডার রায়বাবুকে কোরাল ড্র বা অ্যাডোব ফটোশপের কাজ শিখতে বলেছিল, সেদিনই মাথায় আকাশ ভেঙেছিল। সারা জীবন হাতে কালি লাগিয়ে কাজ করা আর বানান ভুল ধরা প্রিন্টিং-এর মানুষ রায়বাবু। দুম করে কম্পিউটার শেখা, তাও আবার যেগুলো কখনও নাম শোনেনি, সেগুলো শেখা অসম্ভব, রায়বাবু তা জানত। মারওয়াড়ি মালিক বলত, বেওসা চেঞ্জ হচ্ছে রায়বাবু। সোব কম্পুটারিজ হবে, না শিখলে আর আগে বাড়বে কী করে?

চাকরিটা হারাবে এটা জেনে আর পোযাতি বউটার ভবিষ্যৎ-এর চিন্তায় যখন বাজারে ফলিডলের খোঁজে রায়বাবু ব্যস্ত, তখন কেষ্টর সাথে আলাপ। কেষ্টর আসল নাম কী, কেউ জানে না। সবাই কেষ্ট দাস নামেই চেনে। লেখালিখি বলে একটা অনলাইন ফেক পাবলিকেশন চালায় বেনামে। সোশ্যাল মিডিয়ায় মাতাল, প্রেমে ধোকা খাওয়া সাপ-ব্যাঙ-আগডুম-বাগডুম লেখাগুলোকে ফলস পাবলিসিটি দিয়ে লেখার রিচ বাড়ায়। তারপর শখের কবিদের লেখা বই করে ছাপাব বলে, হাজার হাজার টাকা ডোনেশন নেয়। ভালো ব্যাবসা। রায়বাবুকে পার্টনারশিপের কথা বলতেই, রায়বাবু রাজি। এখন দুজনের যৌথ ব্যাবসা। ইনভেস্টমেন্ট বলতে একটা অ্যান্ড্রোয়েড স্মার্ট ফোন, একটা কম্পিউটার, কয়েকশো ফেক সোশ্যাল অ্যাকাউন্ট।

ফ্রাস্ট্রু খাওয়া হযবরল লেখাগুলোকে নিপুণ হাতে রায়বাবু বেছে নেন। কেষ্ট হাজারখানেক লাইক আর শেযার করে সোশ্যাল মিডিয়ায়। তারপর দম দেখে একদিন ফোন করে লেখক বা লেখিকাকে, সেটাও পোর্টফোলিও দেখে ডিমান্ড। ওনাদের টার্গেট ক্ষেত্র একটু অন্যরকম, বেশিরভাগই গৃহবধূ। যেমন বড়ো সরকারি নেতার বউ, ডাক্তারদের বউ, ইঞ্জিনিয়রদের বেকার বউ, সরকারি অফিসারদের বউ কিংবা এনআরআই-দের বউ।

শুধু গৃহবধূই নয়, আছে ফাস্ট্রেটেড যুবসমাজ, বাউন্ডুলে বড়োলোক আর তাদের সুপুত্ররা। প্রথমে ওনাদের প্রতিভার মেকি প্রশংসা তারপর ডিমান্ড। আর ডিমান্ড পেলেই একটা ভুলভাল প্রিন্টিং সেন্টার থেকে একটা বই। আর বই বেরোলেই হাজারটা ফেক অ্যাকাউন্ট থেকে কয়েকশো শেয়ার। মালিক আর ক্লায়েনট দুজনেরই প্রফিট আর দুজনেই খুশ। মানে পুরো সোশ্যাল মিডিয়া নির্ভর লেখার মাফিয়া নেটওয়ার্ক, ফেলো কড়ি ছাপো লেখা, প্রতিভা কী আর দেখা যায়।

 

ডুবন্ত শিল্পরাজ্য পশ্চিমবঙ্গে ইউনিয়ন বাজিতে অনেকে ছাঁটাই হবার পরেও পুরোনো লোক হিসেবে আকাশকে রেখে দিয়েছিল কোম্পানি। শুধু ভালো কর্মীর জন্য নয়, এই ফ্যাক্টরির সব সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের লেখালেখির সব কাজ এতদিন আকাশই করে এসেছেন। সে ফ্যাক্টরির উদযাপন দিবস হোক বা শ্রমিকদের মে দিবস, লেবার ইউনিয়নের নেতা হোক বা কোম্পানির অবাঙালি ইঞ্জিনিয়র সবাই শুধু একবার বলে দিত আকাশদা কাল ভাষণ দিতে হবে, একটু লিখে দিও তো। ব্যস আকাশ নিজের ভঙ্গিতে সাবলীল ভাবে লিখে দিতেন। স্টেজে ওর লেখা অন্য কেউ পড়ে যখন হাততালিতে পুরো মঞ্চটা ভেসে যেত, তখন একবারও কেউ ওর নাম উচ্চারণ না করলেও আকাশ নিজের থেকেই খুশি হতো, এতদিন এটাই চলছিল।

এবারের রবীন্দ্র জয়ন্তীতে আকাশকে কেউ কিছু না বলায় খানিকটা অবাক হয়েছিল। অনুষ্ঠানের দিন শুনল ফ্যাক্টরির নতুন জয়েন করা এক ফিটার ওয়ার্কার, নাকি সব লেখালেখি করছে। প্রোডাকশনের জমাদারবাবুকে জিজ্ঞেস করাতে জানল, নতুন ছেলেটা নাকি সোশ্যাল মিডিয়ায় সেনসেশন। ইদানীং নাকি কী সব ব্যাপারে ভাইরাল হয়েছে। ফ্যান ফলোয়ারও নাকি অনেক। তাই এবার ম্যানেজারবাবু ওকে দাযিত্ব দিয়েছেন। এইসব অত্যাধুনিক ভাষাজ্ঞান বা উন্নত প্রযুক্তির কোনওটাই আকাশের কোনওদিন ছিল না। আর ইন্টারনেটটা এখনও গরিবের কাছে আলাদিনের প্রদীপ। আঘাতটা লেগেছিল। কুর্চিকে এগুলো বলেও লাভ নেই । বাড়ি ফিরে রাতের কালো অন্ধকারে চোখের জল লুকিয়ে বাঁধাই করা লেখাবোঝাই দিস্তাখাতাটা বুকে চেপেই শুয়ে পড়েছিল।

লেখালিখি পাবলিকেশন-এর খবরটা ফ্যাক্টরির নতুন ছেলেটাই আকাশকে দিয়েছিল। নিজে থেকেই এসে বলেছিল, কাকা তোমাদের ওই পুরোনো খাতা কলমে লেখা আর চলে না। আজকাল জো দিখতা হ্যায়, ওহি বিকতা হ্যায়। নতুন নতুন পেজে মিউজিক দিয়ে লেখা ইন্টারনেটে বেরোয় কাকা, পাবলিক ওটাই খায়। ঠিকানা নিয়ে বুকে সাহস করে কেষ্ট দাসের অফিসে এসে হাজির হয়েছিল আকাশ। যদি তার সারাজীবনের লেখাগুলো ইন্টারনেটে দেওয়া যায়। তারপর ওপরের ওই আলাপচারিতা। রায়বাবুর কাছ থেকে প্রশ্নগুলো শুনে বাড়ি ফেরার পথে কুর্চির জন্য প্রেশার-এর ওষুধটা একপাতা বেশি কিনল। সাথে একটা পঞ্চাশ টাকার স্ট্যাম্প পেপার। ওদের যাতে উইল নিয়ে কোনও অসুবিধা না হয়।

 

আজ বিতান জয়েন করল। বাবা সুইসাইড করার পর মাকে নিয়ে দাঁত চেপে লড়ে আজ বিতান বড়ো সরকারি আধিকারিক। পুরোনো ঘর ভেঙে নতুন ঘর হয়েছে। বাবার দিস্তামার্কা খাতাটা এ পর্যন্ত কয়েক হাজারবার ওর পড়া। প্রায় সব লেখাগুলোই ওর মুখস্থ।

এই দিনটার জন্য বিতান অনেক দিন অপেক্ষা করেছে। এখন গভীর রাত। ফেসবুক প্রোফাইলে বিতান জব প্রোফাইলটা আপডেট দিল। সাথে দফতরের মন্ত্রী আমলাদের সঙ্গে কয়েকটা সেলফি নেওয়া পোস্ট। তারপর দশ বছর ধরে অপেক্ষা করা দুটো ফ্রেন্ড রিকোয়েসট পাঠাল, একটা কেষ্ট দাস আর একটা রায়বাবুকে, সাথে লেখালিখি পেজে একটা মেসেজ,  অনেকগুলো লেখা ভাইরাল করতে চাই, যা লাগে দেব।

কেশকাঞ্চন

চুলের ব্যাবসা করবি?

প্রশ্ন শুনে বেটাকে আচ্ছা করে গাল পাড়ল তারাপদ। শ’কার, ব’কার, খ’কার, কিছুই বাদ গেল না।  হয়তো মেরেই দিত। চুলের আবার ব্যাবসা কী?  মশকরা করার জায়গা পায় না? আর পঙ্গু মানুষকে নিয়ে কেউ মশকরা করে? নেহাত পুরোনো বন্ধু তাই বেশি কিছু বলল না। বিড়ি ধরিয়ে রাস্তায় মন দিল।

বাসন্তী হাইওয়ে পিচঢালা, মসৃণ। পাশেই খাল। অবজ্ঞা, অবহেলা সয়েও একনিষ্ঠ। নিঃশব্দে বহন করে চলেছে কলকাতার নিকাশি। ওপারে ধাপা। আবর্জনার পাহাড়ে যেন বাঁকুড়া, পুরুলিয়া। সায়েন্সসিটি ব্রিজের নীচে পুবমুখী রাস্তাটাই বাসন্তী হাইওয়ে। সোজা চলে গিয়েছে বাসন্তী। সেখান থেকে মাতলা পেরিয়ে গোসাবা হয়ে সুন্দরবন, অথবা রাজারহাট-বসিরহাট-বনগাঁ হয়ে বাংলাদেশ। মাঝে বানতলা, বামনঘাটা, ভোজেরহাট, ঘটকপুকুর, ভাঙ্গড়, মালঞ্চ। রাজনৈতিক মানচিত্রে জায়গা করে নিয়েছে নিজগুণে। মারামারি, খুনোখুনি লেগেই আছে। অঞ্চলের বেশিরভাগটাই ভেড়ি। মিষ্টিতে যেমন পিঁপড়ে, মাছের ভেড়িতে তেমনি ক্রিমিনাল।

দুপুর সময়টা বড়োই গ্যাঁড়াকলের। নিষ্কর্মা মানুষকে উদোম করে দেয়। সকালটা কাটিয়ে দেওয়া যায় প্রাতঃকৃত্য, চুল-দাড়ি কাটা, স্নান, চায়ের দোকান, এটা-সেটা করে। খবরের কাগজ তো ত্রাতা মধুসূদন। ‘অনেক কাজ পড়ে আছে’ বা ‘যেতে হবে বহু দূর’ও মানানসই। কে আর সত্যান্বেষণ করছে! আঁধার তো খুবই সুবিধের। দিব্যি লোকচক্ষুর আড়াল হওয়া যায়। যা হোক দুটি পেটে ফেলে শুয়ে পড়লেই হল। ঘুম আসুক না আসুক, সুখনিদ্রার ভানে অসুবিধে নেই। ঘুম অবশ্য দুপুরেও দেওয়া যায়। তবে লাভ নেই। কর্মব্যস্ত ধরণীতে দ্বিপ্রাহরিক নিদ্রা একান্তই দৃষ্টিকটু। নিষ্কর্মার শ্রেষ্ঠ উদাহরণ। তা ছাড়া অত ঘুমও কি মানুষের আসে? কাঁহাতক ভালো লাগে মটকা মেরে শুয়ে থাকতে?

রোজ দুপুরে বানতলা বাজারে এসে বসতেই হয় তারাপদকে। গাছতলা, পুকুরপাড়, ভাঙা মন্দির, কোনওটাই তেমন জুতসই নয়। যেন আরও উদোম হওয়া। তার চেয়ে রাস্তার ধারই ভালো। গাড়িঘোড়া, মানুষজনের মাঝে দিব্যি মিশে থাকা যায়। চোখে লাগে না অতটা। ভরদুপুরে মানুষজন সামান্যই। গাড়িই ভরসা। গুনতি করে সময় মন্দ কাটে না। তবে মুশকিলও আছে। বেকার মানুষ পেলেই লোকের উপদেশ দেবার বাসনা উশখুশ করে। সেই কারণেই বটকেষ্টর, ‘চুলের ব্যাবসা করবি?’

কলকাতার এত কাছে, তবুও জীবন যেন এখানে থমকে আছে। হাইওয়ের উপর বিশাল চর্মনগরী, ছোটোখাটো কারখানা বা দু’একটা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল থাকলেও, গ্রামের ভিতরে প্রায় উলটো চিত্র। বিদ্যুৎ থাকলেও সব রাস্তা পাকা নয়! সর্বসাধারণের স্কুল মাধ্যমিক পর্যন্ত। কাছের হাসপাতাল বলতে পার্কসার্কাসের চিত্তরঞ্জন। মানুষের রোজগার মূলত ভেড়ি থেকে। এখনও হাট বসে। রাস্তার দু’ধারে সার দেওয়া ‘কাঁটা, ওজন করার যন্ত্র। আশপাশের ভেড়ি থেকে মাছ এসে কাঁটায় ওঠে। শুরু হয় ‘অকশন। যার ডাক বেশি সেই দাবিদার। মিষ্টি জলের রুই, কাতলা, ট্যাংরা, ভেটকি, পাড়ি দেয় গড়িয়াহাট, লেকমার্কেট, যদুবাবু বা মানিকতলা বাজারে। হইচই, হল্লাগুল্লায় হাট সরগরম। ঝগড়াঝাঁটি লাগলেও, বাজারে মাছ পৌঁছোনোর তাড়ায় আমল পায় না। মাছের সঙ্গে তরিতরকারিও থাকে। কলকাতার বাবুরা চলে আসে টাটকা মাছ-সবজির সন্ধানে। সস্তাও হয়! শপিং মল বা ফুডমার্টের চেয়ে তো বটেই। শুধু একটু চিনতে আর দরদাম করতে হয়। তাছাড়া গাড়ি হাঁকিয়ে হাটে আসার অ্যাডভেঞ্চার তো আছেই। সাইট সিয়িং ফাউ।

সার দেওয়া কাঁটাগুলো বিশ্রামে! জেগে উঠবে সকালে। নির্ধারণ করবে লাভ-লোকশান। দীর্ঘশ্বাস ফেলল তারাপদ। আবার বিড়ি ধরাল। বিড়িও অন্যতম অবলম্বন। ‘কিছু একটা করছি’বা ,শেষ করেই যাব অন্যখানে। দু’টান মেরেই ফেলে দিল। মুখটা তিতকুটে। মনও। এই হাটেই একসময় কোথা দিয়ে যে সময় কেটে যেত টেরও পেত না। মানিকতলা বাজারের বিধু সাহার মাছ সওদা করত। অগাধ আস্থা ছিল বিধুর। মাছ চেনার ব্যাপারে তারাপদরও জুড়ি ছিল না। কোন কাঁটায় কারচুপি আছে সেও ছিল নখদর্পণে। ফলে সেরা দামের সঠিক ওজনের মাছ চালান যেত বিধুর আড়তে। বিধুও গুণীর কদর করত। মাস গেলে প্রাপ্য মেটাতে কসুর করত না।

বিধু কদর করলেও, ভেড়িওয়ালারা তারাপদর গুণপনায় অতিষ্ঠ। বিধুর মতো বড়ো খরিদ্দারের কাছে মাছ গছাতে পারলে একসঙ্গে অনেকটা মাছেরই হিল্লে হয়। কিন্তু তারাপদর জ্বালায় সে উপায় নেই। সেরা মাছ ছাড়া তুলবে না। ওজনেও একচুল এদিক-ওদিক করবার জো নেই। ভগবানও বোধহয় ব্যাপারীদের সহায়। একসময় দুটো পা’ই অসাড় হতে লাগল তারাপদর। ডাক্তারবাবুরাও ধরতে পারল না অসুখটা। হেকিমি, কবিরাজিতেও লাভ হল না। ধীরে ধীরে দ্বিপদ থেকে চতুস্পদ বনে গেল তারাপদ।

কোনও যুক্তি না পেলে সহজতম গ্রাম্য সমাধান, ‘কেউ কিছু খাইয়ে দিয়েছে’ অথবা ‘বাণ মেরেছে’। এক্ষেত্রেও অন্যথা হল না। তবে কারওরই ‘কেউ’ বা ‘কিছু’ সম্বন্ধে সম্যক ধারণা নেই। বাণ জিনিসটাও ভজকট। তন্ত্রের সঙ্গে সম্বন্ধ থাকলেও, কেউই চাক্ষুষ করেনি কখনও। তাই পরিবার ভেড়িওয়ালাদের দিকে আঙুল তুললেও, প্রমাণ করতে পারল না কিছুই। বিধু অবশ্য বিকল্প ব্যবস্থা করেছিল। সহকারী রেখে তারাপদ তদারকি করবে। করলও কিছুদিন। তারপরে আস্তে আস্তে ভাটা পড়ল। কাঁহাতক আর ভালো লাগে অন্যের বোঝা হতে? তা ছাড়া গুরুত্বও কমছিল। সবার চোখেই দয়া, করুণা, অনুকম্পা। একদিন যেখানে দাপিয়ে বেড়িয়েছে, সেখানে এই দুর্দশা মেনে নিতে পারল না। লাইনই ছেড়ে দিল। তারপর কাঠ বেকার।

‘একবার ভেবে দেখলে পারতিস। লাইনটা খারাপ কিছু নয়। বসেই তো থাকিস…’

তেলেবেগুনে জ্বলে উঠল তারাপদ। শব্দ করে একদলা থুতু ছেটাল।

‘আমি বসে থাকি তো তোর বাপের কী রে? তুই কি খাওয়াস না পরাস?’, মনে মনে গজরাল। চৈত্রের গনগনে রোদে তর্ক জুড়তে ইচ্ছে হল না।

‘প্রথম প্রথম একটু অসুবিধে হবে। তারপর দেখবি সব ঠিক হয়ে গেছে। ইনকামও মন্দ নয়’, বটকেষ্ট নাছোড়বান্দা।

‘তা সে ইনকাম তুই কর না। আমার পেছনে পড়েছিস কেন?’, না বলে পারল না তারাপদ।

‘আমি তো চৌবাগা, ভিআইপি বাজার, পঞ্চান্নগ্রাম, এই এলাকাগুলো দেখছি। তুই এদিকটা দেখ না, বটকেষ্টর প্রস্তাব।

‘কেন রে শালা, আমি ছাড়া কি আর লোক নেই?’ পোঁদ ঘষটে আমাকেই গাঁয়ে গাঁয়ে ঘুরতে হবে?’, খিঁচিয়ে উঠল তারাপদ। হাঁটাচলা বলতে দু’হাতে ভর দিয়ে ঘষে ঘষে চলা। সব জেনেও বটা এইরকম প্রস্তাব দিচ্ছে? নাকি মজা করছে?

বটকেষ্ট পাকা ব্যাবসাদার। এ অঞ্চলে ব্যাবসা করা বিরাট ঝকমারি। লাইন দিয়ে টাকা নেবার লোক দাঁড়িয়ে। তোলা না দিয়ে এক পা-ও এগোনোর উপায় নেই। শালাগুলো কাজ-কম্ম কিছু করবে না, শুধু পরের ধনে পোদ্দারি মেরে মদ-মাংস খাবে। খাওয়া বেশি হলে পড়শির বউ-মেয়ের হাত ধরে টানবে। তবে তারাপদর কথা আলাদা। একে পঙ্গু তায় গ্রামের লোক। দয়া, করুণা, তাচ্ছিল্য যাই করুক না কেন, তোলা চাইবে না! ‘খোঁড়াটা আর কতই বা কামাবে’র যুক্তিতে ছাড়পত্র পাবে। এতসব না বলে হাসি মুখে বলল, ‘তুই আমার বন্ধু বলেই বলছি। তেমন হলে আমি নয় তোকে চাকা লাগানো গাড়ি বানিয়ে দিচ্ছি। ঠেলে ঠেলে ঘুরতে অসুবিধে হবে না।’

বিড়ি ধরাল তারাপদ। একটা হাতে চালানো সাইকেল গাড়ির জন্য কত তদবিরই না করেছে। নেতা থেকে এমএলএ পর্যন্ত। আশ্বাস ছাড়া জোটেনি কিছুই। অথচ ভোটটা কিন্তু ওই পার্টিকেই দিয়েছিল। কে জানে কেন, তালিকায় নাম আর উঠল না।।

তারাপদ চুপ করাতে বটকেষ্ট যেন ভরসা পেল। এদিককার গ্রামগুলো ছড়ানো-ছেটানো। দু’চারটে ঘুরতেই দিন কাবার। পড়তায় পোষায় না। লোক রেখেও সুবিধে হয় না। সকলেরই নজর ঘন বসতিপূর্ণ এলাকা, যেখানে গৃহস্থের সঙ্গে বিউটি পার্লারও আছে। একলন্ধে চুল মেলে অনেকটা। তাই তারাপদ যদি রাজি হয়, তা হলে গাড়ি দিয়েও লাভ। পাশ ঘেঁসে বসে মোলায়েম স্বরে বলল, ‘নিজের কথা নয় নাই ভাবলি তোরা। সংসারের কথা তো একটু ভাবতে হয়। দু’পয়সা রোজগার করলে সংসারটার কি একটু সুরাহা হবে না?’

‘দু’পয়সা রোজগার করলে সংসারটার কি একটু সুরাহা হবে না?’ বটার এই কথাটাই টলিয়ে দিল তারাপদকে! সংসার বলতে বউ মালতী আর মেয়ে ঝুমুর। জমিজমা না থাকলেও বাড়িটা নিজের। একতলা। ইটের গাঁথনি, অ্যাসবেস্টসের চাল। প্লাস্টার বা রং করা হয়ে ওঠেনি। জমির প্রতি মোহ কোনওদিনই ছিল না তারাপদর। রক্ষণাবেক্ষণ ভয়ানক ঝামেলার। ব্যাংকে যাবারও প্রয়োজন বোধ করেনি কখনও। ঈশ্বর যখন বিশেষ ক্ষমতার অধিকারী করেছেন, তখন চিন্তা কী? এক বিধু গেলে অন্য বিধু আসতে সময় লাগবে না।

খাটা-খাটনিও তেমন কিছু নয় যে শরীর ভেঙে পড়বে। সকালে খানিক দৌড়ঝাঁপ, খিস্তি-খেউড়, হম্বিতম্বি, তারপরেই অখণ্ড বিশ্রাম। ম্যাটাডোরে মাল চাপিয়ে বোতল খুলে বসা। নিখরচায়। দায় ভেড়িওয়ালাদের। তোয়াজ, তোষামোদে গদগদ। উদ্দেশ্য সিদ্ধ হোক না হোক, শনি দেবতাকে তুষ্ট রাখতেই হয়। আমোদ-আাদে তোফা কাটছিল দিনগুলো। যেন রাজা-বাদশা!

গোল বাধল পায়ের অসুখটার পর। আচমকাই রুঢ় বাস্তবের মুখোমুখি। টাকার জোগান থাকলে অনেক কিছুই চোখে পড়ে না। যেমন পড়েনি মালতীকে। দিব্যি হাসিখুশি গৃহকর্মনিপুণা! ভালো-মন্দ রান্না করা, ঘর-দোর গুছিয়ে রাখা, আত্মীয়-কুটুম্বিতা দরাজ হাতে। চারিদিকে ধন্য ধন্য, ‘বউ বটে তারাপদর!’ তারাপদও কোনও ফাঁক পায়নি। শরীর, মন দুইয়েরই চাহিদা মিটেছে অগাধ। বেসামাল অবস্থায় যত্ন-আত্তি তো দেখার মতো! জামা-জুতো খুলে, গা-হাত-পা মুছিয়ে, মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে ঘুম পাড়াত। পরম তৃপ্তিতে মনে হতো, ‘যাক, শেষ বয়সটায় কষ্ট পেতে হবে না!’

বোঝা যায়নি। হয়তো যায়ও না। সবুজে ভরা বনভূমি দেখে কি মরুভূমির আঁচ পাওয়া যায়? নাকি টলটলে নদীতে চরের পূর্বাভাস থাকে? সুউচ্চ মিনার আচমকা ভূমিকম্পে ধূলিসাৎ হবে, তা কী ভাবা যায়? না গেলেও, গেল একসময়। অভাব তাণ্ডব শুরু করতেই মালতী যেন ধূধূ মরুভূমি, রুক্ষ চর। প্রত্যাশার মিনার গুঁড়িয়ে চুরমার। শুরুতে মন দিয়েই চিকিৎসা করাচ্ছিল। আশা ছিল সুদিনের। যখন বুঝতে পারল দুর্দিন নিশ্চিত, তখনই ধৈর্যের বাঁধ ভাঙল। প্রথমে ভাগ্যকে দোষারোপ, তারপর মানুষকে। তারাপদর মতো অবিবেচক মানুষ নাকি জীবনে দেখেনি। অথচ প্রতি রাত-সোহাগেই তারাপদর দিলদরিয়া স্বভাবের গুনগুনানি ছিল অনিবার্য। অনেক ভাগ্য করলে নাকি এমন স্বামী পাওয়া যায়।

বউয়ের তাগাদা, খ্যাচখ্যাচ, মুখঝামটায় ঠোঙা বানানোর কাজে হাত লাগাল তারাপদ। কিন্তু সারাদিন ঘরে বসে ঠোঙা বানানো পোষায়? কাজটাও ঘ্যানঘ্যানে, ম্যাদামারা টাইপের। মাছের কারবারের ছিটেফোঁটা উত্তেজনাও নেই। আর বানিয়েই বা লাভ কী? সব রোজগারই তো ঢুকবে সংসার ‘গভ্ভে’। এক ছিপি মালও বরাদ্দ হবে না নিজের জন্য। সবদিক বিবেচনা করে ঝিম মারল তারাপদ। হাজার মুখ ঝামটাতেও রা নেই। যেন বোবা, বধির।

ঠোঙা বানানো ছিল ফ্যামিলি বিজনেস। প্রথমে মেয়ে তারপর বাপ-মেয়েই ছিল প্রধান কারিগর। মালতী ঘরের কাজ সেরে হাত লাগাত। তারাপদ গুটিয়ে যাবার পর মসৃণ অ্যাসেম্বলি লাইনে ছেদ পড়ল। মা মেয়ের পক্ষে সামাল দেওয়া মুশকিল। মেয়ে হোলটাইমার হলেও মাকে ব্যস্ত থাকতে হয় ‘গুষ্টির গেলার জোগাড়ে’! আলুটা মুলোটা চেয়ে, গেঁড়ি-গুগলি জোগাড় করে তবে রান্না। মাঝেমধ্যে মরা মাছ জুটলেও, ভাতের বড়োই আকাল। উপায় না দেখে একসময় মালতী রান্নার কাজ নিল। আনন্দপুরের দিকটায় বড়ো-বড়ো ফ্ল্যাটবাড়ি। পয়সার কমতি নেই কারও! সেরকমই তিনটে বাড়িতে কাজ জোটাল। সাত সকালে বেরিয়ে মাঝ দুপুরে ফেরা। একবেলা খাওয়ার সঙ্গে হাজার পাঁচেক মাইনে। কোনওরকমে দিন গুজরান।

টাকার চেয়ে বড়ো জোর আর কিছুই নেই। এতএব ‘জোর যার মুলুক তার’ – এই যুক্তিতেই সংসারের রাশ মালতীর হাতে। তারাপদ যেন কীটাণুকীট, অপাংতেয়। নেহাত তাড়িয়ে দেওয়া যায় না বলে সহ্য করা। তারাপদও মেনে নিল বউয়ের অহংকার, ঔদ্ধত্য। না মেনে উপায়ই বা কী? আত্মহত্যা? সম্ভব নয়! বড়ো ভয় জলে ডুবতে, গায়ে আগুন লাগাতে অথবা আচমকা গাড়ির সামনে পড়তে। দিনে দিনে আরও গুটিয়ে গেল। পারতপক্ষে রাতের আগে বাড়ি ফেরে না। ফিরেও চোরের মতো দুটো মুখে দিয়েই ঘুম। ঘুম মানে চোখ বুজে থাকা। মেয়েই খেতে দেয়। রাতে ঘুম না এলে পাশে এসে বসে কখনও-সখনও। মায়ের চোখে পড়লে মুখঝামটা, গালাগাল।

‘স্বামী তো নয়, শত্তুর।’

মেয়ে যেন আক্ষরিক অর্থেই গলার কাঁটা। রূপ না থাকলেও বেশিরভাগ মেয়েরই আলগা চটক বা লালিত্য থাকে। ঝুমুর যেন কুরুপার অধিক। চটক তো নেই-ই, লালিত্যের ছিটেফোঁটাও নেই। আলকাতরার মতো রং, খরখরে চামড়া, মুখের দিকে না তাকালেই স্বস্তি! গুণ বলতে নম্র, গৃহকর্মনিপুণা, সরলমতি। একেবারে খাদহীন। কাদার তাল যেন! ওইসবের কদর বাপ-মায়ের কাছে থাকলেও, বাইরের লোকের দায় পড়েনি নজর করবার।

পায়ের গোলমাল শুরু হতেই মনে কু ডেকেছিল তারাপদর। মেয়ের বিয়েটা এইবেলা না দিলেই নয়। পাত্রী পছন্দ হবার প্রশ্ন নেই, তাই প্রথম থেকেই টাকার চার ফেলেছিল। মাছও এল! ছেলের বাড়ি জয়নগর। রাজমিস্ত্রীর জোগাড়ে। দিল্লি, মুম্বাইতেও যায়। বাড়িতে বিধবা মা। জমিজমা না থাকলেও অভাব নেই। দেরি করল না তারাপদ। পঞ্চাশ হাজার টাকা বরপণে রাজি হয়ে গেল। সঙ্গে মোটরবাইক। দয়াপরবশ হয়ে হাজার তিরিশেক টাকা দিল বিধু সাহা। বোধহয় লাইফ টাইম অ্যাচিভমেন্ট। বাকিটা মহাজনের কাছে ধার! মোটরবাইকও ধারে। পড়শি নগেন পালের কাছে বিনা সুদে। আয়োজন তেমন কিছু ছিল না। কালীঘাটে বিয়ে আর বাড়িতে জনা পঞ্চাশের নিমন্ত্রণ। কাজ উতরাল নির্বিঘ্নে। ট্রেনে চড়ে মেয়ে চলে গেল শ্বশুরবাড়ি। দ্বিরাগমনেও এল। বর ছ’মাসের জন্য দিল্লি যাচ্ছে। ফিরে এসে নিয়ে যাবে। সেই যে জামাই গেল, তিন বছর পার হতে চলল ফিরল না এখনও। জয়নগরে খোঁজ নিয়ে লাভ হয়নি। শাশুড়ির কাছেও হদিশ নেই। মোবাইল সুইচড-অফ। শুরু হল শবরীর প্রতীক্ষা।

শ্বশুরবাড়ি থেকে ফিরে ঝুমুরও যেন পালটে গেল। যে-মেয়ে সাজগোজের ধারপাশ দিয়েও যেত না, সে নানারকম আবদার শুরু করল। ইচ্ছে থাকলেও সামর্থ্য আর নেই। চিকিৎসা, বিয়েতে সর্বস্বান্ত। মালতীকে টানতে হচ্ছে মোটরবাইক, মহাজনের ধার। ঝুমুরেরও যেন তাড়া নেই শ্বশুরবাড়ি ফেরার। রহস্য উদ্ঘাটন হল ছ’মাস পার হবার পর। বর নানারকম দাওয়াই বাতলে দিয়েছে ফরসা হবার। টিভিতে চাক্ষুষ করিয়েছে সিনেমার হিরো হিরোইনদের রূপ রহস্য। আশ্বাস দিয়েছে ফরসা হলেই ফেরত নিয়ে যাবে। নইলে সমাজে মান রাখাই দায়। ঝুমুরও বিশ্বাস করেছে সরল মনে! উপায় বাতলালেও, সংস্থানের কোনও ব্যবস্থা করেনি পতিদেবতা। অগত্যা পাড়ার মেয়েদের থেকে চেয়ে-চিন্তে ক্রিম, সাবান জোগাড় করে ঝুমুর। মনে দুর্বার আকাঙক্ষা। হবে সাধের উত্তরণ।

চোখে জল এসেছিল তারাপদর। তীব্র অভিমান হয়েছিল ঈশ্বরের উপর। মনটার মতো মেয়েটার চেহারাটা একটু সাদা করতে পারল না? কালো মনের সাদা মানুষ তো আকছার! বেশ বুঝতে পারল টোপ গিললেও মাছ বঁড়শিতে গাঁথেনি! মেয়ে আজও কুমারী। হয়তো আজীবনই থাকবে। টাকা, বাইকের সংস্থান হতেই পালিয়েছে জামাই বাবাজি। সেই থেকেই ঝুমুর একনিষ্ঠ রূপ সাধনায় ব্রতী। পাড়ার লোকে হাসে, ব্যঙ্গ করে, আবার কৗতূহলে খয়রাতিও করে। অপেক্ষা করে চূড়ান্ত ক্লাইম্যাক্সের। মিলনান্তক না বিয়োগান্তক? মিলনান্তক হলে, ‘আমিই তো…’, অন্যথায় মুখ বেঁকিয়ে ‘বোকার হদ্দ কোথাকার। সাধ্য নেই, সাধ আছে ষোলোআনা’। ঝুমুর অতশত বোঝে না। যে যা দেয় তাই নিয়েই খুশি। চালায় নিরলস প্রচেষ্টা। ডাক আসবে প্রিয়তমের।

নিরুত্তাপ, নিস্তরঙ্গ জীবনেও একসময় সিঁদুরে মেঘ দেখল তারাপদ। মালতীর শরীর ভেঙে পড়ছে। আজকাল প্রায়ই হাঁপ ধরে, বুক ধড়ফড় করে। অপুষ্টি, অধিক পরিশ্রমে শরীর কাহিল। মেজাজও তিরিক্ষি। স্বামীর উপর ক্ষোভ উগরেও শান্তি হয় না। মেয়েকেও জুড়ে নেয়। এমন বাপ-মেয়ের জন্যই নাকি জীবনটা দুর্বিষহ হল। বাপ-মেয়ে দুজনেই সর্বংসহা। এতএব মেজাজ আরও তিরিক্ষি! তবে ঠান্ডা হলে ঠোঙা বানানোয় হাত লাগায়। তারাপদ হাত উঠিয়ে নিলেও, মা-মেয়েতেই চালাচ্ছে ফ্যামিলি বিজনেস। মোটরবাইক, মহাজনের ধার এখনও চলছে। শুধু রান্নার কাজের মাইনেতে বাড়িতে রান্না চড়ানো মুশকিল। কিন্তু মালতী হঠাৎ অসুস্থ হলে? কেমন করে বাঁচাবে হাবাগোবা মেয়েটাকে?

‘ঘুম আসছে না বাবা?’

চমকে উঠল তারাপদ। সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে খেয়ালই করেনি কখন ঝুমুর শিয়রে এসে বসেছে। এদিক-ওদিক তাকিয়ে মালতীকে খুঁজল। চাপা স্বরে বলল, ‘এই ঘুমব… তুই এখন যা। মা দেখতে পেলে অযথা মুখঝামটা শুনবি!’

‘মা তো ঘুমিয়ে পড়েছে, ঝুমুর হাসি মুখে জানায়।

নিশ্চিন্ত হল তারাপদ। মেয়ের হাতে হাত রেখে বলল, ‘বুঝলি মা, এবার একটা নতুন কারবারে হাত দিচ্ছি।’

‘কীসের কারবার?’

‘চুলের।’

চুল নিয়ে যে কারবার হয়, তারাপদর ঘুণাক্ষরেও জানা ছিল না। খদ্দের দেখে তাজ্জব হয়ে গেল। বুঝল মহিলা মহলে এই ব্যাবসা খুবই জনপ্রিয়। নিজের মাথার ঝড়তি-পড়তি চুল বেচে যদি দুটো পয়সা মেলে, মন্দ কী? তাই ফেলে না দিয়ে কাচের শিশি বা প্লাস্টিকে জমায়। পরিমাণমতো হলে বেচে দেয়। দেড় থেকে তিন হাজার টাকা কিলো।

তারাপদকে পেয়ে মহিলা মহল যেন বর্তে গেল। খাপছাড়া গ্রামগুলোয় কোনও ক্রেতা না থাকায় বাড়ির পুরুষ মানুষদের শরণাপন্ন হতেই হতো। বিস্তর সাধাসাধি, তোষামোদ। তারপর নেহাতই দয়াপরবশ হয়ে দায়িত্ব গ্রহণ! তাও সব সময় যে সঠিক পয়সা ঘরে আসবে এমনটা নয়। ব্যস্ত পুরুষকুল উপকারের বিনিময়ে মাঝেমধ্যেই এক বান্ডিল বিড়ি বরাদ্দ করে নেয়। ঝরা চুল কিলোখানেক হবার প্রশ্ন নেই। সাকুল্যে হয়তো কয়েকগ্রাম। সেটুকুতেও যদি নজর পড়ে, সহ্য হয়! বলতে গেলে পালটা রাগ, দায়িত্ব অস্বীকারের হুমকি। সেদিক দিয়ে তারাপদ শ্রেষ্ঠ অবলম্বন। চোখের সামনে পুরো পয়সা মিলবে। তা ছাড়া চেনা লোক, ওজনে মারবে না ধরেই নেওয়া যায়। তবে কেউ কেউ নগদের বদলে বাসন প্রত্যাশী। কারও কারও নগদ নিয়েও অসন্তোষ। তারাপদ নাচার। ছোটো গাড়িতে বাসনের বোঝা বয়ে বেড়ানো দুঃসাধ্য। নগদ বাড়াবারও উপায় নেই। তা হলে নিজের বাড়া ভাতেই ছাই পড়ে। তা ছাড়া সবাইকে সমান নগদ দেওয়াও যায় না। দাম মেলে চুলের দৈর্ঘ্য অনুয়ায়ী। তবুও হাতের কাছে অন্য ক্রেতা না মেলায় তারাপদর কপালেই বরাত জোটে। নেই মামার চেয়ে কানা মামা ভালো।

সময় মন্দ কাটে না তারাপদর। বটকেষ্টর দেওয়া গাড়িটা বেশ মজবুত। কাঠের তক্তার উপর চাকা লাগানো। হাত দিয়ে ঠেলে দিব্যি গড়গড়িয়ে যাওয়া যায়। অন্যদের মতো ডুগডুগিও দিতে চেয়েছিল। এক কথায় নাকচ করেছে তারাপদ। চেনা লোকজনের মাঝে ডুগডুগি বাজিয়ে ফেরি করবে। এ কি ব্যাবসা নাকি বাঁদর নাচ দেখানো? জোর করেনি বটকেষ্ট। এলাকায় পরিচিতি এবং অন্য ক্রেতা না থাকার সুবাদে তেমন অসুবিধে হবে না তারাপদর। ‘চুল দেবেন গো’ হাঁক পাড়ারও দরকার পড়বে না। মেয়ে-বউরা এমনিই উজিয়ে আসবে। তাই গাড়ির সঙ্গে শুধু ওজন করবার সূক্ষ্ম যন্ত্রটা দিয়েছে, যাতে কয়েক গ্রামও অনায়াসে ওজন করা যায়। আর দিয়েছে ধার হিসেবে দশটাকার বান্ডিল। বেশিরভাগের প্রাপ্যই পঞ্চাশ, একশো ছাড়ায় না। খুচরো রাখতেই হয়। তারাপদ ঠকায় না কাউকেই। সেই কারণেই হয়তো বাড়তি খাতির মেলে। চাইলে জল পাওয়া যায়। সঙ্গে বাতাসাও আসে কখনও।

‘তুই করিস কী চুলগুলো দিয়ে?’

‘বেচে দি।’

‘কাকে?’

‘সে খোঁজে তোর দরকার কী? তুই কামাচ্ছিস কামা না’, বটকেষ্টর সাফ জবাব। এই হল মানুষের দোষ। নিজেরটুকু নিয়ে সন্তুষ্ট থাকবে না, অন্যের দিকে নজর । একেবারে নিশ্চিত, পরের প্রশ্ন দাম সম্বন্ধীয়।

‘তুই কী দাম পাস?’

হো-হো করে হেসে উঠল বটকেষ্ট! মানুষ ঘাঁটা সার্থক। তারাপদর পিঠে চাপড় মেরে বলল, ‘তোর তাতে দরকার কি রে শালা? তোকে একটা লাইন চেনালাম, গাড়ি বানিয়ে দিলাম, হাজার টাকা ধার দিলাম, এই নিয়েই সন্তুষ্ট থাক না। জাহাজের খবর জেনে তুই আদার ব্যাপারী কী করবি?’

চুপসে গেল তারাপদ। নেহাতই কৗতূহলী জিজ্ঞাসা। বটা যে কিছু মনে করবে ভাবেনি।

‘শোন, তোকে আর একটা রোজগারের উপায় বাতলাই’, পরিস্থিতি হালকা করতে চাইল বটকেষ্ট। চুলের জট ছাড়িয়ে, সাবান দিয়ে ধুয়ে সাইজ অনুযায়ী আলাদা আলাদা বান্ডিল করবি। এ বাবদও কিছু পাবি। বিড়ি খরচটা উঠে যাবে।’

বিড়ির কথা উঠতেই হাত পাতল তারাপদ। দুটো আয়েশি টান মেরে বলল, ‘চুলগুলো কী কাজে লাগে বলবি?’

‘পরচুলা বানায়। বিদেশেও নাকি যায়। আমি সব জানিও না।’

চুলের জট ছাড়ানোর কাজটা বেশ পছন্দ হল তারাপদর। রোজগারও আছে, সময়ও কাটবে। পরে অনেকবারই বিড়ি বা ঠোঙা বানানোয় হাত লাগাবার কথা ভেবেছে। কিন্তু মালতীর রণংদেহি মেজাজের সামনে পড়তে মন চায়নি। তা ছাড়া, আবার যদি ভালো না লাগে? এবার আর রেয়াত করবে না মালতী। হয়তো ঘাড় ধাক্বা দিয়ে বেরই করে দেবে। কী দরকার যেচে ঝামেলায় জড়ানোর! তার চেয়ে অনন্ত সময় ধরে জট ছাড়ানো ঢের ভালো। যেন মা-মেয়ের সঙ্গে অলিখিত প্রতিযোগিতা। নিজের অস্তিত্ব বজায় রাখার মরিয়া চেষ্টা। সামান্য হলেও কিছু টাকা তো দিচ্ছে সংসারে। তবে লাভ যৎসামান্যই। একবার কেনার পর বেশ কিছুদিন অপেক্ষা করতেই হয়। গ্রামগুলোও বেশি বড়ো নয়। গাড়ি ঠেলে দূরে যাওয়াও মুশকিল।

ইদানীং মালতীর আচরণ যেন অদ্ভুত! দূরছাইও করে আবার টাকাও নেয়। যেন ধার দিয়েছিল। টাকা অবশ্য মেয়ের হাতে দেয় তারাপদ! খামোখা সন্মুখ সমরে লাভ কী? তা হলেও, একটু সহানুভূতি পেতে মন চায়। শুনতে চায় সুবুদ্ধির প্রশংসা। আগেরই সেই মাখোমাখো ভাব না থাকলেও, প্রত্যাশা করে নরম সুর। মরুভূমি সবুজ না-ই হতে পারে, তা বলে কী মেঘের ছায়াটুকুও প্রাপ্য নয়? দু’ফোটা বৃষ্টিও কী বেশি চাওয়া হল? হাজার হলেও স্বামী তো! প্রত্যাশার ধারপাশও মাড়ায় না মালতী। মেজাজ রুক্ষতর। দিনগত পাপক্ষয়ে ক্লান্ত। তারাপদ হতাশ। নিজের কর্মকাণ্ডে অতিমনোযোগী। খেয়াল থাকে না, মরা নদীতে জোয়ার আসে না।

ঝুমুর যেন বৈশাখী বাতাস। খরা-মনে শান্তির প্রলেপ। মা ঘুমিয়ে পড়লে চুপিচুপি আসে। জট ছাড়াতে হাত লাগায়। ধুয়েও দেয়। তারাপদ বিশ্রাম নেয়। মেয়েলি হাতে কাজ এগোয় তরতরিয়ে। একদিন কাজ করতে করতেই বলল,

‘বাবা… আমাকে একটা জিনিস এনে দেবে?’

‘কী’? তারাপদর প্রশ্রয়। সারা জীবনে মেয়েকে দেওয়া হয়নি কিছুই। কাজ আর মদ খাওয়ার ব্যস্ততায় ফুরসতও মেলেনি! বিয়েটাও দিয়েছিল যত না মেয়ের জন্য, তার চেয়ে বেশি দায়মুক্ত হতে।

ভাঁজ করা একটা কাগজ এগিয়ে দিল ঝুমুর। তারাপদ দেখল পাতা জোড়া ক্রিমের বিজ্ঞাপন। সাত দিনেই বদলে যাবে ত্বকের রং! মেয়ে জুলজুল চোখে তাকিয়ে। মায়া হল তারাপদর। কত না স্বপ্ন মেয়েটার চোখে। ক্রিম লাগাবে, ফরসা হবে, বর নিয়ে যাবে শ্বশুরবাড়ি। গড়ে উঠবে সংসার, আসবে সন্তান, সার্থক হবে নারী জনম!

ভাবনার মাঝেই মাথা নীচু করে ঝুমুর বলল, ‘অনেক দাম জিনিসটার। পাড়ায় কারও কাছে নেই। তুমি…’

‘তুই ভাবিস না মা! আমি নিশ্চয়ই কিনে দেব।’

‘দুশো টাকা!’

দাম শুনে আঁতকে উঠল তারাপদ। এ সপ্তাহে দুশো টাকাই জুটেছে। মালতী নিশ্চয়ই প্রত্যাশা করবে। না পেলে কী কাণ্ড বাধাবে কে জানে! যা হয় হবে, মেয়ের শখপূরণ আজ করবেই। কত আশা করে রয়েছে মেয়েটা! জিনিসটা পেলেই হাসিতে ভরে উঠবে মুখ! মেয়ের হাসি মুখকে গুরুত্ব দিয়েই ক্রিমটা কিনে ফেলল তারাপদ। ঝড়-ঝাপটা যা আসে আসুক। ঠিক সামলে নেবে।

 

বাড়ির কাছাকাছি এসে কান্নার আওয়াজ পেল তারাপদ। তবে কি জামাই এল? মেয়ে চলে যাবে বলে মালতী কাঁদছে? নিশ্চয়ই তাই । ভগবান সবাইকেই একসময় সুখের মুখ দেখান। এবার নিশ্চয়ই মেয়ের কথা মনে পড়েছে! হয় জামাইয়ের মত বদল ঘটেছে অথবা মা অসুস্থ হবার কারণে বউয়ের প্রয়োজন পড়েছে। দুটোই মেয়ের পক্ষে মঙ্গল। শ্বশুরবাড়ি গেলে অনেকটাই নিশ্চিন্তি। একটা পেট কমলে মালতীর ভারও খানিকটা লাঘব হবে। অসুবিধে হবে তারাপদর। মেয়ের কল্যাণে যে দু’বেলা জুটত, সেটা হয়তো জুটবে না। চলতে হবে বউয়ের মর্জিমাফিক। সে হোক, মেয়ের সুখের জন্য এটুকু সওয়াই যায়। শুধু ক্রিমটার জন্য মন খচখচ করল। জামাই নিতে এসেছে মানে ওটার আর প্রয়োজন নেই। ফেরত না নিলে খামোখা গচ্চা।

বাড়ি পৌঁছে তারাপদ অবাক। সারা পাড়া ভেঙে পড়েছে উঠোনে। পড়শিদেরও নিশ্চয়ই মন খারাপ। দেখতে যেমনই হোক, সরল ব্যবহারে মেয়েটা সকলেরই মন টেনে নেয়। তাই চলে যাবার আগে সবাই দেখা করতে এসেছে। তারাপদরও দেখতে ইচ্ছে করল মেয়েকে। শ্বশুরবাড়ি যাবার আগে নিশ্চয়ই লজ্জা লজ্জা মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। অথবা কান্না জুড়েছে মায়ের সঙ্গে। কান্না বড়োই সংক্রামক। কিছুতেই বাঁধ দেওয়া যায় না। তবে শুভক্ষণে কাম্য নয় একেবারেই। খামোখা অমঙ্গলের আহ্বান। মা-মেয়েকে সামলাতে এগিয়ে গেল তারাপদ।

‘ও কে ওখানে!’

দোরগোড়ায় বসে মালতী কাঁদছে। সামনে শুয়ে ঝুমুর।

‘ও ওরকম ভাবে শুয়ে আছে কেন?’ মাথায় কিছুই ঢুকল না তারাপদর।

মালতীর কান্নার তোড় হঠাৎই বাড়ল।

সেই কান্নাই তারাপদকে জানিয়ে দিল, ঈশ্বরের বিধান সকলের জন্য সমান নয়। কাউকে কাউকে তিনি পৃথিবীতে পাঠান শুধুমাত্র দুঃখভোগের জন্যই। নইলে বাপ-মাকে সন্তানের মৃত্যু দেখতে হয়? আচমকাই তারাপদর পৃথিবী যেন থমকে গেল। বাতাস বইছে না, পাখি ডাকছে না, চোখের সামনে শুধুই অন্ধকার। হতভম্বের মতো বসে রইল কিছুক্ষণ। খানিক বাদে বুঝল, পৃথিবী চলছে আপন গতিতে, শুধু তার মেয়েটাই থেমে গিয়েছে।

‘আর সাতটা দিন, তারপরেই শাপমুক্তি।’

ঘুম থেকে উঠেই মাকে বলেছিল ঝুমুর! বাবা আনবে বিশল্যকরণী। দীর্ঘশ্বাস ফেলেছিল মালতী। সরল মেয়েটার জন্য বুক ফেটেছিল। গড়িয়ে পড়েছিল দু’ফোঁটা জল। সবাই শুধু বাইরেটাই দেখল, ভিতরটায় ভুলেও চোখ বোলাল না কেউ। দুঃখ চাপা দিতেই যে রাগ, বোঝাতেও পারল না কাউকে। সন্তানের ব্যর্থতার দায়ভার তো বাপ-মায়েরই। রাগ হয়, কষ্ট হয়, অনুশোচনায় জর্জরিত হয় মন। কিছু করার থাকলে সান্ত্বনা মেলে, নয়তো তীব্র আক্রোশ! একমাত্র মুক্তি আত্মপীড়নে। সেও বা কতক্ষণ? কাঁহাতক আর না খেয়ে অক্লান্ত পরিশ্রমে নিজেকে কষ্ট দেওয়া যায়? তাই রাগ গিয়ে পড়ে আপনজনদের উপর। অকারণেই রুঢ় ব্যবহার করে ফেলে মেয়েটার সঙ্গে। স্বামী যদি সহমর্মী হতো, তা হলে হয়তো মনের ভার কিছুটা কমত। কিন্তু সে মানুষটাও দুর্ভোগ, দুর্দশায় অনুভূতিহীন। দুর্বিপাকে কি মানুষ পড়ে না? পড়লে আবার কাটিয়েও তো ওঠে। কিন্তু মানুষটার কোনও চেষ্টাই নেই। সব কিছু ছেড়ে-ছুড়ে নির্বিকার, নির্লিপ্ত। ইদানীং চেষ্টা অবশ্য করছে। কতদিন স্থায়ী হয় কে জানে! আঁচলে ঠোঁট চেপে বিছানা ছেড়েছিল মালতী। তবে ভালো লেগেছিল মেয়ের প্রতি বাবার সামান্যতম দায়িত্ব পালন। কিছু তো করুক!

 

খবরটা দিয়েছিল বারুইবাড়ির ছোটো-বউ। বাপের বাড়ি জয়নগরে। নিজের চোখে দেখে এসেছে জামাইয়ের নতুন বউ। দিল্লি থেকে বিয়ে করে দিন সাতেক হল ফিরেছে। বিশ্বাস করেনি ঝুমুর। ছোটো বউ যেন প্রস্তুত হয়েই ছিল। অন্যের দুর্ভাগ্যে নিজেকে সৌভাগ্যবতী মনে করার সুযোগ ছাড়তে চায়নি। মোবাইলে ছবি তুলে এনেছিল। ঝুমুরের ছবিও তুলল। সতিন দেখার ফাস্ট রিয়েকশন। ছবি দেখে চুপ মারল ঝুমুর। তারপর দৌড়। মালতী, তারাপদ দুজনেই কাজে। ফাঁকা বাড়িতে গলায় দড়ি দিল।

মুখে কথা জোগাল না তারাপদর। হাতে তখনও বিশল্যকরণী। বুক ঠেলে কান্না উঠতে চাইলেও, কাঁদল না। কেনই বা কাঁদবে? তেমন করে আর মেয়েকে ভালোবাসল কই যে, হারাবার অনুতাপ করবে? ঝুমুরের মাথার কাছে ক্রিমের কৌটোটা রেখে দাওয়ায় বসল। পুলিশ এল খানিক বাদে। লাশ চলে গেল লাশকাটা ঘরে। প্রতিবেশিরা দু’একজন গেল সঙ্গে। বাকিরা নিজ নিজ কাজে। শূন্য উঠোনে সন্তানহারা বাপ-মা একাকী ।

ঝুমুর ফিরল পরদিন। খাটে শুয়ে, ফুলের মালা পরে। পাড়ার লোকেরাই ব্যবস্থা করেছে। শ্মশানে যাওয়ার ডাক পড়ল তারাপদর।

‘কোথায় যাচ্ছিস মুখপুড়ি? ধার শোধ না করে এক পা-ও নড়তে পারবি না তুই’ , হাউহাউ কান্নায় বলে উঠল মালতী। যদি আটকানো যায়!

রক্ত চলকে উঠল তারাপদর! ঘষটাতে ঘষটাতে ঘরে ঢুকল। বেরিয়ে এল হাঁসুয়া নিয়ে! সবাই হতবাক। মেয়ের শোকে পাগল হয়ে গেল নাকি বাপটা?

কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই তারাপদ পৌঁছে গেল মেয়ের শিয়রে। নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে। হাসি পেল ঈশ্বরের লীলায়। মেয়েটাকে সামান্যতম রূপ না দিলেও, দিয়েছেন এক মাথা চুল। কোমর ছাড়িয়ে প্রায় হাঁটু পর্যন্ত। ক্ষিপ্র হাতে হাঁসুয়া চালাল তারাপদ। প্রায় গোড়া শুদ্ধ উঠে এল এক ঢাল চুল।

সেই চুলের গোছা হাতে চিৎকার করে উঠল তারাপদ,

‘ধার শোধ…’

 

 

ছবি

অনেক মানুষ জীবনে ভুল করে থাকে, তা হয়তো পরে তার অনুতাপের কারণ হয়। রহমান সামান্য ফুর্তি আর আনন্দ পাওয়ার জন্য যে ভুল করেছিল তা যেন কেউ কোনও দিন না  করে।

হাসানপুরের রহমান আর দীপক ছোটোবেলা থেকেই অন্তরঙ্গ বন্ধু। একই বছরে গ্রামের স্কুল থেকে প্রথম বিভাগে হায়ার সেকেন্ডারি পাশ করে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে অনার্স-সহ একজন বিএ অন্যজন বিএসসি পাশ করে। পরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রহমান এমএ পাশ করে একটি গ্রামের স্কুলে মাস্টারি পায়, আর দীপক এমএসসি করে কলকাতার এক নামি কলেজে অধ্যাপনার কাজে নিযুক্ত হয়।

দীপকের মা শান্তাদেবী রহমানকে রমেন বলেই ডাকেন। মায়ের কথামতো দীপকও তাই। শান্তাদেবী রমেনকে নিজের ছেলের মতোই দেখেন। জাতপাতের বিচার তাঁর নেই।

দুই অন্তরঙ্গ বন্ধুতে বেশ কিছুদিন দেখা-সাক্ষাৎ নেই। মোবাইল থাকলেও পত্র লেখাতেই এদের বেশি আনন্দ। রহমানের প্রতি পত্রেই থাকে ওর ওখানে বেড়াতে যাওয়ার আমন্ত্রণ। দীপকেরও মাঝে মাঝে কলকাতার গণ্ডিবদ্ধ জীবনধারার বাইরে যেতে ইচ্ছে করে, কিন্তু কাজের চাপে যাওয়া হয়ে ওঠেনি।

এবার রহমান লিখেছে, ‘কলকাতার বাবু, বড়োদিনের ছুটিতে না এলে আর পত্র লিখব না। মোবাইলও বন্ধ করে রাখব।’ আগত্যা দীপককে যাওয়ার ব্যবস্থা করতে হয়।

স্টেশনে রহমান নিজে উপস্থিত ছিল। দু’বন্ধুতে দু’বছর পর দেখা। রাত ন’টা নাগাদ বাড়ি ফিরে খাওয়াদাওয়া শেষে একই বিছানায় আশ্রয় নেয়। সারারাত গল্পের পর ভোরের দিকে দুজনেই গভীর ঘুমে জড়িয়ে পড়ে।

– বাবু আপনার প্রাইভেটের ছাত্রছাত্রীরা এসে পড়েছে। সাতটা বাজে। চাকর রামু দরজায় ধাক্বা দিতে দিতে বলে।

রমেন তাড়াতাড়ি উঠে পড়ে, দীপক তখনও অঘোর ঘুমে আচ্ছন্ন।

প্রাইভেট পড়ানো প্রায় শেষ হওয়ার মুখে দীপক রমেনকে ডাক দেয়।

– বাবু পড়াতে বসেছে, আপনি মুখ হাত ধুয়ে নেন। চা-জলখাবার রেডি, বাবুরও ততক্ষণে পড়ানো শেষ হয়ে যাবে। রামু এসে জানায়।

– রমেন প্রাইভেট পড়ায় নাকি?

– হ্যাঁ, এখানের সব মাস্টারবাবুরাই তো পড়ায়।

এমন সময় রমেন এসে বলে, ‘দীপক উঠেছিস বুঝি? আমারও হয়ে এসেছে। চা খেয়ে তোকে আমাদের এখানকার বাজার দেখিয়ে আনব।’

রমেনের বাইরের ঘরে আঠারো-কুড়িটি ছেলেমেয়ে একমনে লেখাতে ব্যস্ত। সেদিকে তাকিয়ে একটি সুন্দরী মেয়েকে দেখে অবাক হয়ে যায় দীপক। পরনে দামি চুড়িদার, গায়ে রুচিসম্মত ওড়না জড়ানো, পিঠভর্তি কোঁকড়ানো চুলে দুটি বেনি, বেনি দুটিতে লাল ফিতে দিয়ে তৈরি দুটি গোলাপ ফুল আঁটা। কি অপূর্ব সৌন্দর্যে ঘেরা মুখশ্রী। এমন রূপসী মেয়ে দীপক জীবনে দেখেছে কি না সন্দেহ? এই বোধ হয় প্রথম।

আবাক বিস্ময়ে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে থাকে দীপক। হঠাৎ রমেনের ডাকে তার চেতনা ফেরে।

– কিরে আয়, জলখাবার খেতে হবে না?

খেয়েদেয়ে ওরা বেরিয়ে পড়ে বাজারের দিকে। গ্রামটি যেন পটে আঁকা ছবির মতো। বেশির ভাগই ধনী। রমেনের স্কুলটিও বেশ সুন্দর জায়গায়, গ্রামের একেবারে শেষ মাথায়। তার পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে একটি ছোট্ট নদী, রূপসী। এর চারপাশের সৗন্দর্য সত্যিই সকলকে মুগ্ধ করবে!

বাজার বেড়িয়ে ফেরার পথে হঠাৎ নারী কণ্ঠের ডাকে দুজনেই চমকে ওঠে। দীপক তাকিয়ে দেখে একটি বড়ো বাড়ির বাগানের সামনে দাঁড়িয়ে সেই মেয়েটি। কতরকমের ফুলে ভরা বাগানটির বেশিরভাগই গোলাপ, তাও লালই বেশি।

– মাস্টারমশাই, আমাদের বাড়িতে আসুন না। বাবা আছেন।

রমেন উত্তর দেয়, ‘আজ থাক্। পরে একদিন আসব।’

– বেশ প্রাইভেট টিউশন শুরু করেছিস রে ভাই, পথেঘাটে আমন্ত্রণ। শুধু পড়ানো, না আরও কিছু? হাসতে হাসতে টিপ্পনি কাটে দীপক।

–সে ভাই ইচ্ছে থাকলেও উপায় নাই। মেয়েটি যদিও আমাদের স্বজাতি, কিন্তু মস্ত বনেদি বাড়ির মেয়ে। কত যে ধনী তা তো দেখেছিস-ই। ওর নাম ফিরোজা। ওর বাবা এখানকার একজন নামকরা ডাক্তার। দুই দাদা, বড়ো ইঞ্জিনিয়ার, ছোটদাদা বিদেশে গবেষণা করছে। মেয়েটি পড়াশোনায় খুব ভালো। ভালো রেজাল্ট করে।

– আহা বড়ো বাড়ির মেয়ে তো কি হল? তোর ওকে ভালো লাগে না?

– না ভাই ও জিনিসে লোভ না করাই ভালো। বামন হয়ে চাঁদে হাত বাড়িয়ে কী লাভ বল? আমি হচ্ছি গরিব স্কুল মাস্টার। যেমন আছি ঠিক আছি। বুঝলি দীপক তোর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেব। মেয়েটির ব্যবহার খুব ভালো। কোনও অহংকার নেই।

দীপক বলে, ‘সত্যি রমেন এমন সুন্দরী মেয়ে সচরাচর দেখা যায় না।’

– কিরে তুই দেখছি ওর প্রেমে পড়ে যাচ্ছিস? বলে রমেন।

– তা পড়লে দোষ কি?

সারারাত গল্পের পর ভোরবেলায় দীপক ঘুমিয়ে পড়েছে। ঘুমোনোর ইচ্ছা তার মোটেও ছিল না। সকাল সাতটায় ফিরোজা আসবে। ওকে দেখার জন্য যে ওর প্রবল একটা ইচ্ছা মনের মধ্যে আছে, তা তো আর রমেনকে বলতে পারে না। ভোরের ঘুমটা সব বারোটা বাজিয়ে দিল।

দীপকের ঘুম ভাঙল রমেনের ডাকে। সব ছাত্র-ছাত্রী তখন চলে গেছে যে যার নিজের বাড়িতে।

– কিরে ওঠ। ন’টা বাজে যে।

– ন’টা, আমাকে তুলিসনি কেন?

– তোমার সুন্দরী নূরজাহান আজ আসেনি বন্ধু। উঠলেও কিছু লাভ হতো না।

– বাঃ নামটা বেশ দিয়েছিস তো? ওই নামেই ওকে ডাকা উচিত। কি বলিস রমেন?

সেদিন ওরা ঘুরতে ঘুরতে ফিরোজাদের বাড়ির দিকেই যাচ্ছিল। রমেন অবশ্য বারকতক গেছে এর আগে। কাছে যেতেই ফিরোজার মধুর আহ্বানে ফিরে তাকায় দুজনেই।

– একি, ফিরোজা তুমি! বলে রমেন।

পরনে জাফরানি রঙের চুড়িদার, নীল ওড়না, তার দুটি বেনিতে ওদেরই বাগানের দুটি রক্ত গোলাপ।

সত্যি এ মেয়ের তুলনা বুঝি কারও সাথেই চলে না। দীপক অবাক হয়ে ভাবতে থাকে।

এবার আর ফিরোজার অনুরোধ উপেক্ষা করতে পারে না ওরা। তবে দীপকের আর এক দফা অবাক হবার পালা। যেরকম সুরুচি সম্পন্ন আসবাবপত্র, সেরকম নিপুণ হাতে সাজানো সারা বাড়িটি! গৃহকর্তাকে ধন্যবাদ দিতে ইচ্ছা জাগে তার।

ফিরোজার বাবার সাথে আলাপের পর ফিরোজাকে জিজ্ঞাসা করে রমেন, ‘আজ পড়তে যাওনি কেন?’

‘উঠতে দেরি হয়ে গিয়েছিল স্যার।’ ছোট্ট উত্তর ফিরোজার।

এবার দীপকের দিকে তাকিয়ে একটু মুচকি হাসে রমেন। কথায় কথায় প্রায় ঘন্টাখানেক কেটে যায় ওদের। ফিরোজার মা আর বড়ো দাদার সাথেও পরিচয় হয় দীপকের। ফেরার সময় ফিরোজা ওদের মূল রাস্তা পর্যন্ত এগিয়ে দেয়। আবার আসার আনুরোধ করে।

পথে নেমে বাড়ির দিকে এগিয়ে চলে দুটি নির্বাক মন। মৌনতা ভেঙ্গে রমেন প্রশ্ন করে, ‘কিরে দীপক বাকশক্তি হারিয়ে ফেললি নাকি?’

– তা হারালে দোষের কি ভাই!

– তুই কী ভাবছিস বল তো?

– ভাবছি, ভগবানের কি নিখুঁত তুলির কাজ।

– কিন্তু একটু ওলট-পালট হয়ে গেছে বন্ধু। তবে এ ব্যাপারে মন খারাপ কোরো না, ঘটকালিটা না হয় আমিই করব!

পরদিন অবশ্য ঘুম থেকে উঠতে দীপকের দেরি হয় না। তখন রমেন পড়াতে বসে গেছে। দীপক একটু ঘোরাফেরা করে সামনের রাস্তায়। দূর থেকে ফিরোজার দিকে দৃষ্টি পড়তেই দেখে ফিরোজা ওরই দিকে তাকিয়ে আছে। সত্যি মেয়েটিকে যেন সবসময় দেখতে ইচ্ছা করে। চোখ ফেরাতে মন চায় না। কেন যে এমন হয়?

ফিরোজা এসেছে আজ দেরি করে। আগের দিন আসতে পারেনি তাই আজ সবার ছুটির পরেও ফিরোজা একাই কিছুক্ষণ পড়ছে। রমেন ওকে পড়াচ্ছে। বাড়ির থেকে গাড়ি এসে ওকে নিয়ে যাবে। ধীরে ধীরে দীপক আসে সেখানে। বলে,‘ রমেন এবেলা আর তোকে বাজারে যেতে হবে না, আমিই যাচ্ছি।’

– আরে বাবা বোস না একটু এখানে, দুজনেই যাব। ফিরোজার গাড়ি এল বলে। হ্যাঁ ফিরোজা, তোমার বই রেখে যেও।

দীপক বলে, ‘আমি ভেতরে যাচ্ছি। তুই আয়, তারপর দুজনে বেরোব।’

দুপুরে খাওয়াদাওয়ার পর ফিরোজার বইটি দাগ দিতে দিতে বইয়ের ভিতরে একখানা ছবি দেখে রমেন দীপককে ডাকে।

– শোনো শোনো দীপকবাবু, তোমার স্বপ্নসুন্দরী নিজেই ধরা দিয়েছে। একবার এসে দেখে যাও।

ফিরোজার একখানা ছবি। শাড়ি পরা, চুল একই ভাবে সামনের দিকে বেনি বাঁধা আর তাতে গোঁজা ফুটন্ত লাল গোলাপ। মেয়েটা সত্যিই খুব ফুল ভালোবাসে।

দীপক ছবিটা রেখে দেয় নিজের কাছে গোপনে।

সেদিন রবিবার। দুপুরের দিকে রমেন পড়াশোনা করছে।। বিকেলে রমেনের টিউশনি আছে। আজ আর ফিরোজাদের নয়, অন্যদের। দীপক আস্তে আস্তে হেঁটে নদীর কাছাকাছি চলে যায়। একটু ফাঁকা জায়গা দেখে চুপ করে বসে থাকে আকাশের দিকে তাকিয়ে। মনে হয়, এখানকার সবই সুন্দর। রমেনটা বেশ আছে।

– আপনি এখানে যে সাহেব?

হঠাৎ ফিরোজার ডাকে তাকায় দীপক।

– এমনি বসে আছি। রমেনের ব্যাচ আছে তাই। তা তুমি এদিকে কোথায়?

– আমি আমার বন্ধুর বাড়ি থেকে আসছি। চলুন না আমাদের বাড়ি। বলে ফিরোজা।

– না আজ থাক। তাছাড়া রমেনও সঙ্গে নেই। তুমি বুঝি মোটর সাইকেল চালাতে পারো?

– হ্যাঁ কিছুদিন হল শিখেছি। আপনি কলকাতায় থাকেন তাই না।

– হ্যাঁ ওখানে একটা কলেজে পড়াই।

– স্যার বলেছেন।

– তোমার নাম তো ফিরোজা?

– হ্যাঁ সাহেব।

দীপক বলে, ‘নূরজাহান তোমার উপযুক্ত নাম।’

– ধ্যাৎ কি যে বলেন। লজ্জায় মুখ নামায় ফিরোজা।

– আমি এখন যাই। যাবেন স্যারের সাথে আমাদের বাড়ি।

–আচ্ছা ফিরোজা তুমি আমাকে সাহেব বললে কেন?

– বাঃ রে আপনার গায়ের রং সাহেবকেও হার মানায়। সাহেব, এবার আমি আসি।

বলেই মুচকি হেসে ফিরোজা বাড়ির পথ ধরে।

ফিরোজার ফিরে যাওয়ার পথের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে দীপক। সত্যি এই বুঝি ভালোবাসার নিয়ম। এদিকে কখন যে রমেন এসে দাঁড়িয়েছে খেয়াল করেনি দীপক।

– কিরে তুই এখানে? আমি তোকে খুঁজে বেড়াচ্ছি। অমন করে কী দেখছিলিরে ভাই?

– তুই তো সবই দেখেছিস। আবার জিজ্ঞাসা করছিস কেন?

– দীপক তুই ভুল করছিস। এ হবার নয়।

– কেন নয়? ভালোবাসা কি মানুষ ইচ্ছা করে করে? ভালোবাসা কি চেষ্টা করে করতে হয়? ভালোবাসা হয়ে যায়। নিজের অজান্তেই হয়তো হয়ে যায়। যখন এমন ঘটে যায় তখন জাত-ধর্ম খড়কুটোর মতো উড়ে যায়।

– তা না হয় হল, কিন্তু ওর বাবাকে তুই চিনিস না। তাছাড়া তোর মা কি মেনে নেবেন? দ্যাখ ফিরোজাকে তুই ভুলে যা ভাই। বলিস তো সুন্দরী শিক্ষিতা তোর উপযুক্ত মেয়ে আমি দেখি।

দীপক নিরুত্তর থাকে।

দেখতে দেখতে দীপকের ছুটিও একদিন শেষ হয়ে যায়। বন্ধুর কাছে বিদায় নিয়ে চলে যায় কলকাতায়। ছবিটা রয়ে যায় দীপকের কাছে আর মনটা পড়ে থাকে ফিরোজার কাছে।

বন্ধুর চিঠিতে ফিরোজার খবরাখবর দীপক মাঝে মাঝে পায়। ফিরোজাকে দেখতেও মন চায় কিন্তু লজ্জায় এত তাড়াতাড়ি বন্ধুর ওখানে যেতে পারে না।

কেটে যায় একটা বছর।

যৌবনে নারী-পুরুষ দুজনে দুজনের প্রতি আকৃষ্ট হয়। এতে দোষের কিছু নেই। যদি জাত, ধর্ম, বয়স সব ক্ষেত্রে মিলে যায়, তাহলে তাদের প্রেম সঠিক পথে এগোয় আর যদি এগুলি না মেলে, তাদের প্রেমের পথে বাধা আসে প্রচুর। দীপকের বেলাতেও তাই হল। কোনও ব্যতিক্রম ঘটল না।

ছেলের বইয়ের আলমারি গোছাতে গিয়ে একটি সুন্দরী মেয়ের ছবি পান দীপকের মা শান্তা। ব্যস সেই শুরু! এ মেয়েকে তাঁরও খুব পছন্দ। কিন্তু যখন জানতে পারলেন এ মেয়ে ভিন্নধর্মের, আর এর সূত্রপাত রমেনের বাড়ি, তখন রমেনকে আসতে পত্র লিখলেন। সব জেনেও ছেলের বিয়ের জন্য অন্যত্র মেয়ে দেখা শুরু করলেন। ছেলের বন্ধুকে নিজের ছেলের মতো দেখা, সে যতই বিধর্মী হোক, তা দোষের নয়! তবে একটি মুসলমানের মেয়েকে পুত্রবধূ করে আনা সেটা বোধ হয় কোনও হিন্দু মা-ই পারে না। এতটা উদার মনের মানুষ দীপকের মা-ও নন এইক্ষেত্রে।

নানা জায়গা থেকে সম্বন্ধ আসতে লাগল। কয়েকটি মেয়ে সত্যিই সুন্দরী। অবশেষে একটি মেয়েকে পছন্দ করে তাদের বাড়িতে ওর মা কথা দিয়ে এলেন। দীপক কিছুতেই রাজি হল না।

এদিকে ফিরোজার অবস্থাও সঙ্গিন। প্রথম কয়েকবার চিঠি  আদান-প্রদানে বাড়ির কেউ তেমন জানতে বা বুঝতে পারেনি। পরে সব জানাজানি হয়ে যায়। পাছে রহমানের মাধ্যমে সূক্ষ্ম যোগাযোগ থেকে যায় এবং কোনওদিন ওরা লুকিয়ে চলে যেতে পারে এই ভয়ে, ফিরোজার বাবা উচ্চমাধ্যমিক পাশ করার পর মেয়েকে সৌদি আরবে ওর কাকার কাছে পাঠিয়ে দিলেন।

বছর দুই পরে ওখানেই ফিরোজার কাকা বিয়ের ঠিক করেন একটি উপযুক্ত ছেলের সঙ্গে! কোনও কিছুতেই কোনও শুভফল হল না! ছেলেটিকে সব কথা জানিয়ে দেয় ফিরোজা।

অবশেষে মেয়েকে ফিরিয়ে এনে প্রায় জোর করে রহমানের সাথেই বিয়ে দিয়ে দেন ফিরোজার বাবা ডাক্তারসাহেব। রহমানকে তিনি অনেকদিন ধরেই দেখছেন। পাত্র হিসাবে মোটেই খারাপ নয়। হয়তো ওদের মতো ধনী নয়, তবে ছেলেকে বাড়ি, গাড়ি, মূল্যবান জিনিসপত্র আর মেয়েকে সোনা দিয়ে মুড়ে দিলেন। সর্বতোভাবে মেয়েকে সুখী করার চেষ্টা করলেন!

এতেও ফল ভালো হল না। মেয়েকে চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছেন ঠিকই তবে ফিরোজা বা রহমান কেউই সুখী হল না জীবনে। প্রথম প্রেমিককে ফিরোজা কিছুতেই ভুলতে পারল না। ফিরোজার মন আর ভালোবাসা কোনওদিনই পেল না রহমান। নিত্য অশান্তি আর অসুখের সংসার করতে করতে দুজনেই জেরবার। ফিরোজার মনে আজও একটা সংশয়, দুদিক দিয়ে কথা চালাচালি রহমানই করেছে তাকে পাওয়ার জন্য। হয়তো এই জন্যই ওর বাবা এ বিয়ে দিয়েছেন।

এদিকে মায়ের চোখের জলের কাছে হার মেনে মায়ের কথা দেওয়া মেয়েটিকেই বিয়ে করতে বাধ্য হয় দীপক। মেয়েটি যথেষ্ট বুদ্ধিমতী। অপরূপা না হলেও বেশ সুন্দরী। তবে ফিরোজাকে শত চেষ্টা করেও সে ভুলতে পারেনি আজও। এ নিয়ে ওদের সুখের সংসারে অনেক ঝড় বয়ে গেছে। তবুও অনেক যন্ত্রণা, অনেক কষ্টের পর একটি পুত্র সন্তান এসেছে ওদের সংসারে।

এরপর কেটে গেছে অনেকগুলি বছর। ফিরোজার ছবিটি এখনও আছে দীপকের কাছে। সেই ছবিটি সে নিজের হাতে রং তুলি দিয়ে এঁকেছে। ছবিটি এতটাই জীবন্ত যেন এক্ষুনি কথা বলবে। সেটি সে রহমানকে পাঠিয়ে দিয়েছে উপহার হিসাবে।

শান্তি-অশান্তি নিয়ে কেটে গেল আরও বেশ কয়েকটা বছর। দেখতে দেখতে দীপকের ছোট্ট ছেলেটি ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে গেল। সে এখন অনেক বড়ো হয়েছে। বর্তমানে চেন্নাই-এ কর্মরত। কিছুদিনের মধ্যেই বিদেশ যাবে। দীপকের মা কিছুদিন আগে মারা গেছেন। ফিরোজার আর বেশি খবর সে রাখে না। হয়তো রহমানের সাথে ভালোই আছে!

ঘটনার চোরাস্রোতে এক বর্ণমুখর সন্ধ্যায় রহমানের সঙ্গে হঠাৎ দীপকের দেখা হয়ে যায়। প্রথমে না চেনার ভান করে রহমান। পরে অবশ্য সবই বলে সে দীপককে। চেহারারও অনেক পরিবর্তন হয়েছে রহমানের। ওর কাছেই জানতে পারে, ফিরোজা আর বেঁচে নেই। রমেন এখন ফিরোজাদের গ্রামে থাকেও না। তার একমাত্র মেয়েকে ওর মামা নিয়ে চলে গেছে, তার বয়স যখন মাত্র পাঁচ। তারপর থেকে সে তাকে আজও দেখেনি! ওখানকার স্কুলের চাকরি অনেকদিন আগেই ছেড়ে দিয়েছে।

শত অনুরোধ সত্ত্বেও রহমান সেদিন দীপকের বাড়িতে যায়নি। কোথায় থাকে, কীভাবে চলছে তার সেসব কিছু সে বলেনি। যেমন এসেছিল সেভাবেই চলে গেল।

বাড়ি ফিরে দীপক একটি মজার কথা শোনে ওর স্ত্রীর কাছে। তার ছেলে রোহন নাকি তহমিনা বলে একটি প্রবাসী মুসলমান মেয়েকে ভালোবাসে। তাকে সে বিয়ে করবে। এ বিয়ে যেন বাড়ি থেকে মেনে নেওয়া হয়।

মনে মনে হাসতে থাকে দীপক।

ফিরোজার বাবা ডাক্তার সাহেব বেঁচে আছেন। রহমান ফিরোজারা আজ না থাকলেও, ওদের বাড়িটি রং করানো চলছে, ঘরের সব অপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ফেলে দিয়ে। তবে বাড়ির দেখভাল করার লোকটি একটি ছবি সরিয়ে ফেলে, কলকাতায় বিক্রি করলে এসব ছবির ভালো দাম পাওয়া যাবে ভেবে। বিয়ের পর ডাক্তার সাহেবের নাতনি নাতজামাই এই প্রথম আসবে। তাই এই সাজ সাজ রব। এত আয়োজন। অবশ্য মা মরা তহমিনার বিয়ে দিয়েছে ওর ছোটো মামা।

এদিকে রোহন তার স্ত্রীকে নিয়ে কলকাতার বাড়িতে এসেছে। ওদের মেনে নিতে হয়েছে সবকিছু। কিন্তু বউমাকে দেখে দীপক অবাক। একি! এ যে ফিরোজার প্রতিমূর্তি। ঠিক যেন যৌবনের ফিরোজা। এ কী করে সম্ভব?

রোহন যে-মেয়েটিকে বিয়ে করেছে তার বাবা মা কেউ নেই। ধনী মামারাই তাকে মানুষ করেছে। পাঁচ বছর বয়স থেকেই সে প্যারিসে মানুষ। এখন চাকরি করে প্যারিসেই। রোহনকে তার কোম্পানি প্যারিসের একটি প্রোজেক্ট হ্যান্ডল করতে পাঠায়। সেখানেই তহমিনার সঙ্গে  তার আলাপ এবং প্রেম। মা-বাবা রাজি থাকায় রোহন আর দেরি করতে চায়নি। বিয়েটা সেরে ফেলে চটজলদি। এদিকে মা বাবা কাউকেই তহমিনার ভালো করে মনে নেই। ছোটোমামার কাছেই সে থাকত। তহমিনার মুখে তার মামার বাড়ির কথা শুনে স্তব্ধবাক্ হয়ে যায় দীপক। ডাক্তারসাহেবের সঙ্গে তার কি নতুন করে আত্মীয়তা তৈরি করা উচিত? নাকি পরিচয়টুকু গোপন-ই থাক– এই দোলাচলে মনটা বেশ অস্থির হয়ে ওঠে তার।

দীপক ভাবে তার মা যা পারেননি ওদের তা পারতে হল। রোহনদের এ বাড়িতে আসা বেশ কয়েকদিন হয়ে গেছে। রোজই বিকালের দিকে ওরা কোথাও না কোথাও বেড়িয়ে আসে। এই কদিনে অনেক জায়গা ঘুরে, দেখে এসেছে। আর কদিন পরে ওরা যাবে তহমিনাদের বাড়িতে। ওখান থেকেই চলে যাবে নিজেদের কাজের জায়গায়।

সেদিন রোহন-তহমিনা রাত্রে ফিরে একটি মজার ঘটনা শোনায়। আজ একটি ছবির দোকানে ওরা একখানি বাঁধানো ছবি দেখে অবাক হয়ে গেছে। ছবিটি অপরূপা এক নারীর। ছবির নীচের কোণে ডি কে স্বাক্ষর করা। আশ্চর্যের ব্যাপার ছবিটি যেন হুবহু তহমিনাকে দেখে আঁকা।

সবই বুঝতে পারে দীপক। ফিরোজাকে উপহার দেওয়া তারই নিজের হাতে আঁকা ছবি।

আজ সকালে মাকে নিয়ে রোহনরা দক্ষিণেশ্বরে গেছে। বিকালে ওরা ছবিটি কিনে নিয়ে আসবে বলে ঠিক করেছে। ভেবে কূলকিনারা পায় না দীপক কী করবে সে এখন। আজ বাড়িতে কেউ নেই, যা করার তাকে এবেলাতেই করতে হবে। আজ সে কলেজে যাবে না।

এগারোটা নাগাদ সে ছবির দোকানে যায়। বহু অর্থের বিনিময়ে দীপক ছবিটি কিনে নেয়। এক মুহূর্ত অপেক্ষা না করে খবরের কাগজে মোড়া ছবিটি গঙ্গায় বিসর্জন দেয়। সেই সঙ্গে ফিরোজার বই থেকে পাওয়া ছবিটিও।

যে অন্তরে আছে তাকে বাইরে রেখে লাভ কি? ডি কে নামের অনুসন্ধান করতে গিয়ে শেষে সব জানাজানি হওয়ারই বা দরকার কি!

 

মেঘলা আকাশ

মেঘলা, আকাশ মেঘা বলে ডাকে। নামটা বেশ রোমান্টিক। সূর্য হাপুচুপু খায়। ভিজে যায় শরীর। আবার কখনও ফুঁপিয়ে কাঁদে মন। আকাশ যখন মেঘা বলে ডাকে,মেঘার শরীরজুড়ে শীতল বাতাস ছুঁয়ে যায়। আকাশের চোখে মুখে মনে হয় পৃথিবীর সব সুখ লেপটে রয়েছে।

দীর্ঘ শীতাবকাশের পর আজ ছিল কলেজ খোলার দিন। কলেজ ফেরত আকাশ রোজকার মতো ফিরছে তার মেসে। কিন্তু মেঘার সঙ্গে দেখা হয়নি! এই পাহাড়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে শীতের ছুটি পড়ে ডিসেম্বর মাস থেকে। মেঘা আসেনি কেন বুঝতে পারছে না আকাশ। অথচ, ওর তো আসার কথা ছিল। কিংবা একটা তো খবর দেবে। এমন তো করে না মেঘা!

কলেজের শেষ পিরিয়ডটা করে বেশ কিছুক্ষণ ক্যান্টিনে দু’কাপ চায়ের ধূমায়িত পেয়ালায় চুমুক দিতে দিতে ভাবতে থাকে সেসব কথা। খুব দেরি হয়ে গিয়েছে মেসে ফিরতে হবে তাড়াতাড়ি। কিছুটা আলো থাকলেও সন্ধ্যা নামতে দেরি নেই। এমন সময় আকাশের মুখ ভার। মেঘের গর্জন। মেঘলা আকাশের বুক চিরে অবিশ্রান্ত বৃষ্টি কিংবা বিদ্যুতের ঝিলিক। ঝোড়ো পরিবেশ। কারেন্ট নেই। বিদ্যুতের ঝলকানির আলোতে ঝাপসা পথটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।

বেশ কয়েকটা চড়াই-উতরাই পার করে আকাশের ছাত্রাবাস। সবুজ চা-বাগিচায় মোড়া সুখি উপত্যকার ঢালে মেস। স্থানীয় একজনের বাড়িতে প্রায় চার বছর ভাড়া রয়েছে। কাঠের সারি সারি ঘর, খুব পরিচ্ছন্ন আর লম্বা সরু এক ফালি বারান্দা। এই বারান্দা থেকে দূর পাহাড়ের বসতি ও উপত্যকায় চা-বাগিচার সবুজ যেন চুঁইয়ে পড়ে। কিছুক্ষণের জন্য চোখের আরাম হয় বইকি।

এই পাহাড়ি শহরে অনার্স কমপ্লিট করে মাস্টার ডিগ্রি করছে আকাশ-মেঘলা। বিষয় ভূগোল। ফাইনাল ইয়ার। আর প্রথম যেদিন ভর্তি হতে আসে সেদিন মেঘলার সঙ্গে পরিচয়। মেঘলার মাস্টারমশাই মনোময়বাবু সজ্জন মানুষ। প্রথম দিনই আলাপ জমে যায় আকাশের সঙ্গে। মেঘলাকে ভর্তির পর ক্যান্টিনে মোমো খেতে খেতে সব কিছু মনের কথা উজাড় করে দিয়েছেন মনোময় স্যার। আকাশের সহযোগিতায় মেঘলার জন্য একটা ঘরে পেয়িং গেস্ট থাকবার ব্যবস্থা করেন মনোময়বাবু। কিছুটা গার্জেনের ভূমিকা পালন করেন।

আজ দুর্যোগের দিন। মনখারাপ করা বিকালে হাঁটতে থাকে একাকী আকাশ। সাতপাঁচ ভাবতে থাকে। ঝিরঝিরে বৃষ্টি কিছুটা কমেছে। সবুজ কচিপাতায় ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি বিকালের রোদে মুক্তোর মতো ঝলমল করছে। পাহাড়ের সামনের ঢালে বৌদ্ধ মন্দিরে সান্ধ্য আরাধনার প্রস্তুতি চলছে। ঘন ধুপিগাছের সরলবর্গীয় কাণ্ডের ফাঁক দিয়ে অস্তগামী সূর্যের রশ্মি ঠিকরে পড়ছে চোখে মুখে। আরও কিছুটা পাহাড়ি রাস্তা পার হলেই হেয়ার পিন বেন্ড পথ। তামাটে বিকালের রং চোখে মুখে।

দুর্যোগ কিছুটা কমল মনে হচ্ছে। বাঁকটার কাছে আসতেই কিছুক্ষণ থমকে দাঁড়াল আকাশ। এই পথ যা স্মৃতির সরণি বেয়ে উঠে গিয়েছে শর্বরী পার্কে। বেশ কিছুটা ছায়া-সুনিবিড়, সমতল সবুজ ঘাসের মখমলে ঢাকা। দেখা যায় তুষারধবল কাঞ্চনজঙঘার মোহনীয় রূপ। কিছুটা পরিচ্ছন্ন আবহাওয়া। রামধনু আকাশ ছুঁয়ে পাহাড়ের উপত্যকায় যেন জিরিয়ে নিচ্ছে। আকশের নীচে সবুজ উপত্যকা যেন সাতরঙের পেখম মেলেছে।

যেদিন শীতের ছুটি পড়ল সেদিন চুটিয়ে আড্ডা দিয়েছিল আকাশ মেঘলা এইখানে। সেইসব স্মৃতি উসকে দিচ্ছে। প্রায় দিন কলেজ শেষে এই পার্কে বসত। একটা ভিউ পয়েন্ট। পরিচ্ছন্ন আবহাওয়ায় মেঘেদের লুটোপুটি উপত্যকার বুকজুড়ে। দেখতে দেখতে কত সময় কেটে গেছে তাদের।

কখনও মেঘের দল এসে আকাশ-মেঘলাকে ঢেকে দিয়েছে। কিছুক্ষণের জন্য হারিয়ে গিয়েও খুঁজে পেয়েছে। হারিয়ে খুঁজে পাওয়ার একটা আনন্দ আছে বইকি! গভীর খাদটা যখন ভরে যেত মেঘে মেঘে তখন মনে হতো মেঘের সাগর। বিকালের ফুরফুরে হওয়ায় একটা ফুরফুরে মেজাজ। মেঘার এলোচুল কপালে চোখে মুখে উড়তে থাকত। আর ছোটো সাদা ধবধবে হাত দুটো দিয়ে নিমেষে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করত মেঘলা। একটা দূরত্ব রেখে বসত দুজনেই।

লাল টুকটুকে ঠোঁটের ওঠানামায় আর চোখে কী দারুণ একটা মাদকতা ছিল মেঘলার। দূর থেকে দেখত কীভাবে মেঘেরা ঘনিষ্ঠ হয়ে বৃষ্টি হয়ে ঝরছে। আবার পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে আকাশ। দেশলাই-বাক্সের মতো পাহাড়ি গাঁয়ের বসতি দেখা যায়। আর যে-পাথরটায় রোজ বসে গল্প করত সেই পাথরটাও খুব আপন হয়ে গিয়েছিল। দিনের শেষে বাগিচার শ্রমিকরা পিঠের ওপর দুধের শিশু নিয়ে ঘরে ফিরত। একটা সর্পিল পথ এই পাহাড়ের বাঁকটা ছুঁয়ে বেশ কিছুটা নীচে অন্য উপত্যকায় নেমে গিয়েছে। এই পথের নিয়মিত পথচারীরাও তাদের চিনে ফেলেছিল।

লেখাপড়ার গল্প আর বিভিন্ন সামাজিক সমস্যা নিয়ে বেশি আলোচনা চলত। চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে পারত না কেউই। ভাসা ভাসা কথার ভাঁজে লুকিয়ে থাকত নির্ভেজাল মনের গল্প। রাতের বিছানায় স্মৃতি রোমন্থনে দুটো মন সময়ের বয়সে ঘনিষ্ঠ হয়ে গিয়েছে।

খুব দারিদ্রের মধ্যে বেড়ে ওঠা মেঘলার। মনোময় স্যার না থাকলে এই নামি কলেজটায় আসতেই পারত না। আকাশ প্রথম দিন কিছু কথা শুনেছিল মনোময়বাবুর কাছে।

এই সেই পাহাড়ি বাঁক, যেখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গল্প করতে করতে জীবনের প্রায় সব কথাই বলেছিল মেঘলা। আকশের মনে পড়ছে এখন সে সব কথাকাহিনি। মেঘলা সেদিন বলেছিল, ছোটো বোন চন্দ্রিমার কথা। বাবার কথা মনে করতে পারি না। মেঘলার মা সীমা জ্যোৎস্না রাতে ফুটফুটে আকাশের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে শুনিয়েছে হারিয়ে যাওয়া পিতার গল্প। সেসব কথাও বলেছে মেঘলা আকাশকে একটু একটু করে। মায়ের কাছে শুনেছে, বাবা সইফুদ্দিন আকাশে তারা হয়ে জ্বলছে। পরে তারা দেখতে দেখতে যখন বড়ো হয়েছে সব বুঝেছে।

মেঘালয় রাজ্যের ডাউকি নদী সীমান্তঘেঁষা বাংলাদেশের সিলেট লাগোয়া অঞ্চলে বিক্ষিপ্ত কিছু খাসি জনজাতির বাস। আর পাহাড়ের কোলে ছবির মতো ছোটো গাঁয়ে বসবাস করত মেঘলাদের আদি খাসি পরিবার। সইফুদ্দিন সিলেটের বাসিন্দা। পুরুষানুক্রম থেকে চলে আসা ওদের মৎস্যশিকার আর জমিতে কৃষিকাজ-ই ছিল জীবিকা। পরিবহণ ব্যাবসার সঙ্গে যুক্ত ছিল সইফুদ্দিন।

নৌকা নিয়ে প্রায় দিন ডাউকি নদীর জল ভেঙে মাছ ধরত! কখনও পর্যটকদের মনোরঞ্জন করতে নৗকাবিহার করাত। কিছুটা পর্যটনের সঙ্গেই যুক্ত ছিল। ভালোই আয় হতো। আসা যাওয়ার পথে এই পাহাড়ি বসতির মানুষজন তার মুখচেনা হয়ে যায়। প্রথমে পরিচয়, মন দেওয়া নেওয়া তারপর বৈবাহিক সম্পর্কে আবদ্ধ হয়! সীমা সফি বলে ডাকত। সফির বাবা মা পরিবার তা মেনে নেয়নি। ঘর থেকে পালিয়ে সীমার বন্ধনে আবদ্ধ হয় সফি।

খাসি পাহাড়ের পাদদেশে সুখের সংসার পেতেছিল সীমা-সফি। সইফুদ্দিন চোস্ত খাসি ভাষায় কথা বলতে পারত। বিয়ের পর দায়িত্ব বেড়ে যায় সফির। পরবর্তীতে পর্যটকদের সঙ্গী করে নৌকাবিহার পর্যটন ব্যবসায় যুক্ত হয়। তার নৗকাটাও বেশ সাজানো। নৌকার গায়ে আঁকা থাকত নদী, বিভিন্ন মাছের ছবি। ডাউকি বাজারলাগোয়া ডাউকি নদীর ঘাট পর্যটন মরশুমে পর্যটকদের ভিড়ে ঠাসা থাকত। নিশ্বাস ফেলার সময় হতো না সফির। নদীর স্বচ্ছ জলে নৌকা বিহার এখানে খুব জনপ্রিয়। আবার অফসিজনে কখনও মালবাহী ছোটো গাড়ি নিয়ে শিলং চেরাপুঞ্জি রওনা দিত। প্রায় দিন পাহাড়ি পথে সন্ধ্যা নামার আগেই ঘরে ফিরত।

সীমা ভুট্টা খেতে ভালোবাসত। সারাদিন স্টিয়ারিং ধরে ক্লান্ত অবসন্ন শ্রান্ত শরীর এলিয়ে দিত সীমার কোলে। সন্ধ্যায় ওরা দুজনে ডাউকির তীরে ভুট্টা খেতে খেতে গল্প করত। ডাউকি নদী যেন সীমা সফির কাছে ভালোবাসার পূণ্যতোয়া। রামধনু রঙে মাখামাখি জলে হরেক রকমের মাছের ছোটাছুটি দেখতে দেখতে বাসায় ফিরে যেত। এ ছিল তাদের রোজকার রুটিন।

মেঘলার মা সীমা সেই স্মৃতিচারণ করতে করতে প্রিয় সফিকে খুঁজে পেত। স্মৃতির চাতালে আজও দপদপ করে সেইসব দিনের কথা। মায়ের কাছে শুনেছে মেঘলা– তখনও সন্ধ্যা নামেনি, হঠাৎ একটা ঝাঁকুনি। নিমেষে থরথর করে কেঁপে ওঠে পাহাড়, যেন নৃত্য করছে। ডাউকির মাছরাঙা জল, উথলে উঠছে আকাশ ছোঁবে বলে। এমন একটা ধবংসলীলার চলচ্চিত্র সেদিন স্বচক্ষে দেখেছিল মা।

বাবা গাড়ি নিয়ে চেরাপুঞ্জির রাস্তায় ছিল সেদিন। শুনেছি বহু মানুষ সেই ভূমিকম্পে মারা গিয়েছিল। তারপর চোখ ছলছল হয়ে আসে মেঘলার। কিছুটা সামলে আবার বলতে থাকে– সেই সন্ধ্যায় আর ফেরা হয়নি সফির। আসলে সেই সময়টায় কে কোন দিকে গিয়েছে জানা যায়নি। আত্মীয়স্বজন অনেকেই খবর নিয়েছে কিন্তু খোঁজ মেলেনি বাবার। মেঘলা বলে, মায়ের কাছে শুনেছে বীভৎস সেই রাতের কথা।

সবুজ শৈলশিরাটা যেখানে শিকলের মতো নদীর স্রোত ছুঁয়েছে সেই ঢালে বিক্ষিপ্ত জনবসতি সেখানেই দু-কামরার সীমা-সফির সাধের ছোটো সাংসার। কুটির বলাই ভালো। নদীর কাছে কিছুটা সমতল জায়গায় কয়েকজন মিলে তাড়াহুড়ো করে বার হয়ে আসে তাই বেঁচে যায়। বহু ছবির মতো পাহাড়ি বসতি এলোমেলো হয়ে গিয়েছিল। তারপর সরকারি ব্যবস্থাপনায় ত্রাণশিবিরে আশ্রয়।

তখন মা সন্তানসম্ভবা। একটি ত্রাণশিবিরে প্রথম প্রসব! সেদিন ছিল মেঘলা আকাশ। ঝিরঝিরে বৃষ্টি। যদিও বৃষ্টি-মেঘের খেলা নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। সীমা যমজ কন্যাসন্তানের জন্ম দেয়। ত্রাণশিবিরের সকলে নাম রেখেছিল মেঘলা, চন্দ্রিমা।

এরপর ডাউকি নদী দিয়ে বহু জল গড়িয়ে গিয়েছে। সীমান্তঘেঁষা উত্তর-পূর্বের মেঘালয় রাজ্যের পশ্চিম জয়ন্তিয়া পাহাড়ে অবস্থিত ডাউকি নদীর সীমান্তঘেঁষে মেঘার পাহাড়ি গ্রাম। ঢিলছোড়া দূরত্বে বাংলাদেশের সিলেট শহর। খাসি ভাষা একটি অস্ট্রো-এশীয় ভাষা যা মূলত ভারতের মেঘালয় রাজ্যে প্রচলিত।

ত্রাণ শিবিরের পর কোনওরকম একটা তাঁবুর মতো ছেঁড়া প্লাস্টিকের ছাউনিতে ঠাঁই হয়। কিংবা বর্ষার দিন প্রাইমারি স্কুলের বারান্দায় ঠাঁই নিত। মেঘালয়ের ব্যবচ্ছিন্ন মালভূমির মতো বিচ্ছিন্ন ছিন্নমূল দরিদ্র পরিবার। খাসি রমণী সীমা পরিশ্রমী। দুই কন্যাসন্তানকে শিক্ষায় আচার-আচরণে উন্নত করেছে সে। মায়ের স্থানীয় হোটেলে রান্নার কাজ নেওয়া, কখনও-বা ডাউকি নদীর ঘাটের কাছে ছোটো দোকান দিয়ে রোজগারের ব্যবস্থা করা। এসব জীবনযন্ত্রণার কথা দিনের পর দিন বলেছে মেঘলা আকাশকে।

ডাউকি নদীর বর্ডার প্রসিদ্ধ প্রাকৃতিক পর্যটন। নদীর মনোলোভা সৗন্দর্য চুম্বকের মতো আকর্ষণ করে পর্যটকদের। এরকম মনোরম পরিবেশে বেড়ে ওঠা মেঘলার।

ছোট্ট বয়সে বিয়ে হয়ে যায় চন্দ্রিমার। ভীষণ জেদ ছিল মেঘলার। বড়ো হবার জেদ। দেশ-বিদেশের বিভিন্ন পর্যটকদের খুব কাছ থেকে দেখেছে নদীতে নৗকা বিহার করতে। মায়ের সঙ্গে ডাউকি নদীর ধারে দোকানদারি করেছে সে। স্কুল পড়াশোনা, পাহাড়ের ঢালে জ্বালানি সংগ্রহ এই ছিল রোজকার রুটিন। শুকনো কাঠের জ্বালানি সংগ্রহ করতে গিয়ে কতবার কাঁটাঝোপে দুই বোনের আপেলের মতো গাল চিরে রক্ত ঝরেছে। সেই রক্ত রোদে জলে ধুয়ে গিয়েছে। খেয়ালই নেই মেঘলা, চন্দ্রিমার। ডাউকি নদীর আয়নার মতো জলে যখন সূর্যাস্ত হতো সিঁদুর মেঘের প্রতিচ্ছবি দেখা যেত, তারপর ক্রমশ ঘন রাত আঁকড়ে ধরত ডাউকির এই পাহাড়ি গ্রামকে।

ডাউকির জনপথলাগোয়া ফুটপাথেই ছিল সীমা-মেঘলা-চন্দ্রিমার বাস। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা। তারপর হাইস্কুল উচ্চমাধ্যমিক স্তর পার করেছে চরম দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে বুঁদ হয়ে থাকত মেঘলা। দূর পাহাড়ের চূড়া থেকে সমতলে সিলেট শহরের রূপ দেখতে কখন সে আনমনা হয়ে পড়ত।

খাসি ভাষার কবি সো সো থামের কবিতা পড়তে ভালোবাসত মেঘলা। খাসি ও জয়ন্তিয়া পাহাড়ে এই প্রাচীনতম জনজাতির বাস। প্রকৃতি, প্রেম, কল্পনা, মননশীলতায় ভরপুর সো সো থামের খাসি কবিতার পুস্তকটি ইতিমধ্যে পড়ে ফেলেছে মেঘলা। এমন সুন্দরী সবুজ উপত্যকায় বসে দেখেছে পাহাড়ি ঝরনা আর সূর্যমেঘের লুকোচুরি। পিতৃহারা মেঘলা-চন্দ্রিমা দেখেছে তাদের মায়ের কঠোর শ্রম।

কল্পনা, প্রকৃতি আর বাস্তবতা এসব নিয়ে তাদের ছোটো সংসার।নংক্রেম নৃত্যও অতি প্রসিদ্ধ খাসি উৎসব। লোক নাচে বেশ দক্ষ ছিল মেঘলা চন্দ্রিমা। পুরোনা অ্যালবাম ঘেঁটে কয়েকটা স্কুলজীবনের নাচগানের ছবিও দেখিয়েছে। চন্দ্রিমা ভালো গান গাইত। জয়ন্তিয়া পাহাড়ের উপজাতীয়দের পার্বণ বেহদিয়েংখ্লাম পালিত হয় প্রতি বছর জুলাই মাসে। গারোরা পালন করেন ওয়াংগালা উৎসব যা আদতে সূর্যের উপাসনা। এসব কথা শুনতে শুনতে সন্ধ্যা নেমেছে পাহাড়ের পাকদণ্ডি পথে। এক নিঃশ্বাসে অনেক কথা বলত মেঘলা। দার্জিলিং পাহাড়ের সিঙ্গালিলা শৈলশিরায় বসে কলেজপড়ুয়া আকাশ জয়ন্তিয়া পাহাড়ের মেঘলার কথা শুনেছে।

‘প্রাইমারি স্কুল, হাইস্কুল, মাধ্যামিক, উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে বেশ কিছুদিন বাড়িতেই বসেছিলাম। কয়েকজন প্রতিবেশীর বাচ্চাদের টিউশন পড়াতাম।’ আকাশকে তাদের পরিবারের অনেক কথাই বলেছে মেঘলা। ‘জানো, স্যার আসত প্রায় খোঁজখবর নিতে। বোনের খুব ছোটোতে বিয়ে হয়ে যায়। পরির মতো টুকটুকে সুন্দরী বোন। ঘটকের পাল্লায় পড়ে আমারও বিয়ের সম্বন্ধ এসেছিল বহুবার। কিন্তু রাজি হইনি। বাড়ির কোণে ফুঁপিয়ে কেঁদেছি। পরে একদিন স্যার কে সব কথা বললাম। আমি শুধু পড়তে চাই।

স্যার আমাদের ক্লাসে বলতেন, ‘মেয়েদের পড়তে হবে। নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে।’ সে অনেক কথা– বলতে বলতে চোখ ছলছল হয়ে আসে মেঘলার। মনোময় স্যার প্রবাসী বাঙালি। শিলং শহরে তাদের বাস। প্রাচীন বাঙালি পরিবার। অবিভক্ত দেশের এই পাহাড়ি স্কুলটা ডাউকি সীমান্তে অবস্থিত। মনোময় স্যার এই স্কুলের একজন শিক্ষক। তাঁর উদ্যোগে মেঘলার এতটা পথ আসা। মেঘলা বলেছিল, সে পড়তে চায়! বড়ো হতে চায়। এদিকে মনোময় স্যার অবসর নেন যে-বছর, সেই বছরই উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে মেঘলা।

মাধ্যমিক পাস করবার পর থেকে অভাবী ঘরের মেধাবী ছাত্রী সকলের নজর কাড়ে। মনোময় মেঘলাকে স্নেহ করতেন। তিনি দুঃস্থ অসহায় পরিবারকে সব রকম সহযোগিতা করতেন। মনোময়বাবুর সহযোগিতা নিয়ে দার্জিলিঙে ভূগোল পড়তে আসা মেঘলার। সব কথাই আকাশকে বলেছিল মেঘলা দার্জিলিঙের শর্বরী পার্কের নির্জনতাকে সাক্ষী রেখে। কোনওদিন সন্ধ্যা গড়িয়ে গাঢ় অন্ধকার নামত পাহাড়ে।

ভোঁ ভোঁ শব্দে মেঘের চাদর ফুঁড়ে ফিরতি জিপগাড়িগুলো পাকদণ্ডি পথে হর্ন বাজিয়ে চলছে। সার্চলাইটের মতো গাড়ির হেডলাইট মেঘার কখনওবা আকাশের চোখে মুখে পড়ছে। প্রায় ঘণ্টাখানেক আড্ডা দিয়ে ফিরে যেত আপন আপন মেসে। একদিন তো ফিরতে বেশ দেরি হয়ে গিয়েছিল। এসব থরেথরে সাজানো স্মৃতি কথাগুলো মনে করতে করতে আজ মেসে ফিরল একলা আকাশ। সঙ্গে মেঘলা নেই । কিন্তু মেঘলার স্মৃতি রোমন্থন করতে করতে কখনও পথে থমকে দাঁড়িয়েছে। আবার হাঁটা শুরু।

মূল সড়ক থেকে কিছুটা এবড়োখেবড়ো পথ নেমে গিয়েছে হ্যাপিভ্যালি চা বাগানের দিকে। এখন বৃষ্টি নেই। পরিচ্ছন্ন মেঘমুক্ত আকাশ। কয়েকটা ধাপ পা ফেলে ফেলে উঠলেই বারান্দা তার পর গভীর খাদ। ভেজানো দরজা খুলে লাইটের সুইচে হাত দিতেই আলোকিত হল ঘর। লাইট জ্বালিয়ে লেপটা বিছানায় বিছিয়ে দেয়। কারণ রাতের দিকে সব কিছু হিমশীতল হয়ে যায়।

সেই সকালে নীচের ঝরনা থেকে সংগৃহীত পানীয় জল বালতিতে কতটুকু রয়েছে দেখে নেয়। এর পর রান্নার তোড়জোড়। ডিম আলু ডাল একসঙ্গে সেদ্ধ করে নেওয়া। খিদে পেটে সব কিছুর স্বাদ অমৃত। রাত আটটার পর সব নিঝুম। তারার মতো দূর পাহাড়ের গায়ে গায়ে জ্বলজ্বল করে আলো। টগবগ করে ফুটছে ভাতের হাঁড়ির জল। কাঠের ছোটো ঘরের ফাঁকে খবরের কাগজ সাঁটানো।

শীতের রাতে গুনগুন করে গাইতে থাকে নেপালি গান, হিজো রাতি কিনো? কিনো? নিদ্রা লাগিনো, কসতো মায়া… কসতো মায়া… গানের কলি। ডেকচি উপচে ভাতের ফ্যানা পড়ছে।

ডালে-চালে আর আলু সেদ্ধ পেঁয়াজ লংকার তরিবতের খানা রেডি। কিছুক্ষণ সব ভুলে কলেজের পড়াসংক্রান্ত কাজ।

আকাশ রাতের খাওয়া-দাওয়া সেরে এখন ব্যালকনিতে। নিঝুম রাতের নিস্তব্ধতা ভাঙে পাহাড়ি কুকুরের ঘেউ ঘেউ ডাকে। এই সময়টা সে তার পড়া আর ভাবনাগুলোকে এক সূত্রে গাঁথে। আরও কয়েকটা মাস কাটাতে হবে পাহাড়ি শহরে। মনের মানুষের সান্নিধ্য বঞ্চিত হয়ে থাকতে হবে।

পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে নদী বিষয়ে গবেষণার বড়ো ইচ্ছা আকাশের। সব ইচ্ছা তো আর পূরণ হয় না। এসব এলোমেলো ইচ্ছের কথাও বলে ছিল আকাশ মেঘলাকে। বলেছিল, ডুয়ার্সের ছবির মতো তার গ্রামের কথাও! কখন যে মেঘালায়ের ডাউকি আর আকাশের রায়ডাক মিলেমিশে একাকার হয়েছে মনের মোহনায়, হয়তো টের পায়নি কেউ। বন্ধুত্ব থেকে ভালোলাগা ভালোবসায় রূপান্তরিত হয়েছে সময়ে সময়ে। দিনের পর দিন ভালোবাসা ঘন হয়েছে।

আসলে এই তো সেদিন ডুয়ার্সের ভূটান সীমান্ত গাঁ থেকে আকাশ এই পাহাড়ি শহরে এসেছিল অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে। পাহাড়ে খরচ বেশি। কিন্তু ভূগোল বিষয়ে সব কলেজে তখন পড়ার সুযোগ ছিল না। জমি বিক্রি করে টাকা জোগাড়! মাসে মাসে আবার খরচ আছে। আকাশদের একান্নবর্তী পরিবার। বাবা বিমল রায় একজন কৃষিজীবী।

আকাশের বাবারা ছিল তিন ভাই। বাকিরা সকলেই ব্যাবসাবাণিজ্য সরকারি চাকরি নিয়ে থাকত। ডুয়ার্সের কুমারগ্রাম ব্লকের খোঁয়াড়ডাঙা এলাকার নারারথলি গ্রামের এটাই সব চেয়ে বড়ো পরিবার। আকাশের বাবা খেতি কাজের পাশাপাশি ভেষজ চিকিৎসার মাধ্যমে ভাঙা হাড় জোড়া লাগানোর কাজও বেশ সফলতার সঙ্গে করেন।

স্থানীয় জঙ্গলের বিভিন্ন লতাগুল্ম দিয়ে হাড়গোড় জোড়া লাগাতেন আকাশের বাবা। ভোর থেকে লেগে থাকত ঘরময় রোগীর ভিড়। আকাশকে বড়ো মানুষ করে গড়ে তোলবার ইচ্ছা। সাত-পাঁচ করেই দার্জিলিং পাহাড়ের কলেজে ভর্তির বন্দোবস্ত করেছেন। আসলে, আকাশের দাদু হাড়ভাঙা ডাক্তার নামে এই সীমান্ত লাগায়ো আসাম-ভূটান স্ললাকায় বেশ পরিচিত ছিলেন।

কলেজ ছুটির ফাঁকে পাহাড় থেকে নেমে পড়ত আকাশ। জীবনের গতি এখানে যেন ধীর। আলিপুরদুয়ার ছুঁয়ে জাতীয় সড়কটা অসমের দিকে গিয়েছে। আর তেলিপাড়া থেকেই বাঁ দিকে পিচ ঢালা এক ফালি রাস্তা ছুটছে খোঁয়াড়ডাঙা অভিমুখে! যা ভূটানের গা-ছমছম গভীর জঙ্গলে ঢুকেছে। রাস্তার দু-ধারে ছায়াসুনিবিড় গাছ গাছালি। চরম গ্রীষ্মে যখন হাঁসফাঁস করে মানুষ তখন রোদের তীব্রতাকে এই পথছায়া গোগ্রাসে গিলে খায়। আর শরীরে এক মনোরম শীতল অনুভূতি জেগে উঠে। এমন একটা রূপকথার গাঁয়ে যাওয়ার প্রবল ইচ্ছে মনে মনে দানা বাঁধত মেঘলার।

আকাশের গ্রামের ঢিলছোঁড়া দূরত্বে ভূটান। জমজমাট গ্রামীণ বাজার। হাটের দিনগুলোতে উপচে পড়ে মানুষের ভিড়। শনি ও মঙ্গলবার হাট বসে। আকাশ যখন ছোটো ছিল বাবার সঙ্গে ঘরের মুরগি ও মরশুমের সবজি নিয়ে হাটে বসত। স্থানীয় নদ-নদীর তাজা নদীয়ালি মাছ যেমন পাওয়া যায় তেমনি ঘরের পোষা মুরগি হাঁস নিয়েও হাটুরেরা হাজির হয়। বিভিন্ন জনজাতীর মনপছন্দ খাদ্যতালিকা অনুযায়ী রকমারি সব কিছু হাটে মিলবে।

এখানকার গ্রামীণ হাটগুলো মেলার রূপ নেয়। এলাকাটি যেন মিনি ভারতবর্ষ। বিভিন্ন জাতি উপজাতি ধর্মের আর সংস্কৃতির মিলনক্ষেত্র। সহজসরল জীবনযাপন আর অফুরন্ত প্রাণ প্রাচুর্যে ভরপুর মানুষজন। ভাষা পোশাক ধর্ম আচার ভিন্ন হলেও কোথায় যেন একটা ঐক্যের সুর বাঁধা আছে। কৃষিপ্রধান এলাকা। রয়েছে বন বস্তি। আধুনিকতার ছোঁয়ায় ঘরবাড়ি পোশাকেও ছাপ পড়েছে। সব কথা মেঘলাকে শুনিয়েছে আকাশ। সকলকে আপন করে নেওয়ার কি অসাধারণ জাদু আছে আকাশের!

কলেজ জীবন শেষ করে এবার ঘরে ফেরা। তাঁর প্রিয় অধ্যাপকের পরামর্শ মতো নদী বিষয়ে গবেষণা শুরু করবে। ছোটো থেকেই নদীকে সঙ্গী করে জীবন। খুব কাছ থেকে দেখেছে কীভাবে ভূটান থেকে নেমে আসছে বিভিন্ন নদনদী! সংকোষ, রায়ডাকের মতো আন্তর্জাতিক নদী যেমন রয়েছে, তেমনি ঘোড়ামারা, জোড়াই, কুলকুলি প্রভৃতি নদী শিরা উপশিরার মতো ছড়িয়ে রয়েছে। অতি বর্ষণে বন্যা এই এলাকার স্থায়ী সঙ্গী। ভূটান পাহাড়ের অবৈজ্ঞানিকভাবে ডোলোমাইট উত্তোলন একটা কারণ। এই অঞ্চলের ঢাল দক্ষিণ-পূর্ব দিকে।

আকাশ দেখেছে নদীগুলোর পূর্ব দিকের পাড় ভাঙার প্রবণতা। হঠাৎ করে পাহাড় থেকে সমতলে নেমে আসায় নদীর গতিবেগ কমে যায়। নদী পাথরনুড়িতে বোঝাই হয়ে থাকে। ফলত বন্যার কবলে পড়ে এলাকা। এখান থেকে যেদিকে চোখ যায় শুধু সবুজ আর সবুজ। নদীমাতৃক বাংলার রূপসী রুপ যেন এখানে উপচে পড়ছে। এলোকেশী-নারী যেন ভরা বর্ষায় ফুঁপিয়ে কাঁদে। ভীষণ গর্জন করে ভাসিয়ে দেয় গ্রাম। শীতের মরশুমে শুধু শোনা যায় নদীর কুলুকুলু শব্দ আর নিস্তব্ধতা ভাঙে কোকিলের কুহু কুহু ডাকে।

বনবস্তির চরে বেড়ানো গরু-ছাগলের গলায় ঝুলানো টিনের তৈরি ঘণ্টা জানান দিচ্ছে তাদের অস্তিত্ব। নদী যেন একা নীরবে শুয়ে থাকে। এমন এক অনাবিল প্রাকৃতিক পরিবেশে বেড়ে ওঠা আকাশের। নদী পাহাড় তাকে আজও চুম্বকের মতো টানে।

শীতের ছুটির পর আর ফেরা হয়নি মেঘলার। ফিরবে কি করে! ফেরার দিন ঘটে গেল অঘটন। প্রতিদিন শিলং-গৗহাটি মেল নামে দুধসাদা বাসটা সাতসকালে হর্ন বাজিয়ে ডাউকি বাজার থেকে ছাড়ে। আর তখনই মেঘলাদের পুরোনো ঘড়িটা পেন্ডুলাম দোলাতে দোলাতে পাখির কিচিরমিচির আওয়াজ করে ঘড়ির কাঁটা মিলে যায় সাতের ঘরে।

সকাল সাতটা বাজে। এই সাত-পুরোনো ঘড়িটার একটা ইতিহাস আছে। মেঘলার বাবা সইফুদ্দিন বাংলাদেশ থেকে যখন চলে আসে তখন সীমাকে উপহার দিয়েছিল। সীমা দেওয়াল ঘড়িটা আগলে থাকে।

আজ মেঘলার দর্জিলিং ফেরার দিন। কিন্তু মা সীমার ঘুম ভাঙেনি। চলে গিয়েছে ঘুমের দেশে। হার্টের পেশেন্ট। শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছে। শোকের ছায়া ঘরজুড়ে! মাস্টারমশায় মনোময়বাবুর কাছে খবর যায়। মেঘলার বুকে তখন একটা নোনা বঙ্গোপসাগর তৈরি হয়েছে। ঘড়িটার দিকে নিঃষ্পলক তাকিয়ে থাকে মেঘলা।

কিছুদিন মনোময়বাবুর ঘরে থাকে। পরে একটি বেসরকারি স্কুলে শিক্ষকতার সঙ্গে যুক্ত হয়। আকাশকে সেসব কথা জানিয়ে চিঠিও লিখে রেখেছিল। কিন্তু চিঠিটা ফেলা হয়নি ডাকবক্সে! কচিকাঁচা ছাত্র-ছাত্রীদের সঙ্গে কেটে যাচ্ছে দিনগুলো। প্রতিদিন সাতসকালে রাস্তায় পথ চলতি গাড়ি ধরে স্কুলে যায় মেঘলা। দুষ্টু-মিষ্টি শিক্ষার্থীরা তার বেঁচে থাকার রসদ। মনে মনে ভাবে জীবনটা যেন একটা অসম্পূর্ণ সনদ।

এদিকে দার্জিলিঙের পাট চুকিয়ে অব্যক্ত যন্ত্রণা বুকে নিয়ে ঘরে ফিরেছে আকাশ। ফিরেই সংবাদ পেল আকাশ গবেষণার জন্য নির্বাচিত হয়েছে। কৃষকের ছেলের এমন সাফল্যে গোটা গ্রামে উৎসবের মেজাজ। উত্তর-পূর্ব ভারতের এক বিশ্ববিদ্যালয়ে লেকচারারশিপ ও নদী বিষয়ে গবেষণার জন্য নির্বাচিত হয়েছে। গবেষণার কাজ শুরু করতে রওনা দিল আকাশ।

ডুয়ার্সের গা ঘেঁষেই অসম। গুয়াহাটি হয়ে সেদিন শিলং পৌঁছোল আকাশ। আবার একটা মেসের মতো কোয়ার্টারে থাকবার ব্যবস্থা। উত্তর-পূর্ব ভারতের নদনদী চরিত্র ও নদী অধ্যুষিত অঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রা সম্পর্কিত টাটকা তথ্য সংগ্রহ করতে পাহাড়ি রাজ্য চষে ফেলেছে আকাশ। যখন কাজ শেষে রুমে ফেরে মেঘার কথা মনে পড়ে।

যাইহোক যদি পথে দেখা হয় কোনওদিন কি বলবে মেঘলাকে! কখনও রাগ অভিমানে গাল ফুলে যায়। আবার গবেষণার কাজে ডুবে যায় আকাশ। ভোলার চেষ্টা করে সব কথা। এবার ডাউকি নদী সীমান্তে যাবে। মেঘালয় মালভূমি থেকে আগত একটি পাহাড়ি নদী। ডাউকি চ্যুতির নাম অনুসারে নদীটির নাম ডাউকি। জল স্বচ্ছ কাচের মতো নান্দনিক সৗন্দর্যের যেন লীলাভূমি।

আকাশের গা ছমছম করে। সবে ডাউকি ব্রিজটা পার হয়ে গাড়িটা থামল। হকারের কাছে পায়ে পায়ে এগিয়ে একটু কফি কাপে চুমুক। শিলং থেকে যখন গাড়িটা ছাড়ে তখনই বৃষ্টি শুরু। আজ সকাল থেকে খুব মেঘলা। ডাউকি ঢোকার মুখে ব্রিজ। মনে পড়ছে মেঘলার কথা। ডাউকি মেঘলা মেঘালয় যেন অজান্তেই তার নিজের হয়ে গিয়েছে। শরীরটা যেন হিমশীতল হয়ে আসে!

গাড়িটা স্টার্ট দিতে আবার ঝমঝম শিলা বৃষ্টি। বৃষ্টির ফোঁটায় নদীর জলে বুদবুদ উঠছে। হু হু করে পাহাড়ি ঝরনা মূল সড়কে ধুয়ে খাদে পড়ছে বীভৎস গর্জন করতে করতে। অগত্যা গাড়ি থামাল চালক! মেইন রোডের পাশে একটা বেসরকারি স্কুল। নাম রিভার পয়েন্ট নার্সারি। এখানে কিছুক্ষণ বিরতি। মেঘে ঢাকা আকাশ। দিনের বেলায় যেন অন্ধকার নেমে আসছে।

গাড়ির জানলার কাচটা খুলতেই আকাশ দেখে বেশ চমকে গেল, পরির মতো অপ্সরা একজন মহিলা মেঘেঢাকা পাহাড়ের সর্পিল পথ বেয়ে নেমে আসছে। লুকস লাইক আ ফাউন্টেন, হয়তো মূল সড়কে উঠবে! হাত নেড়ে গাড়িটাকে ইশারায় অপেক্ষা করতে বলছে। যদিও আকাশদের গাড়িটা এমনি অতিবৃষ্টির দরুন দাঁড়িয়ে আছে। আকাশ কিছুটা হতোভম্ব হয়ে গাড়ির গেটটা খুলে দিল। সটান গেটে ছোটো হাতটা চেপে গাড়িতে উঠে পড়ল মহিলা।

খুব চেনা খুব জানা। কিন্তু দুজনেই নির্বাক। তখন আবার মেঘেঢাকা আকাশের বুক চিরে বিদ্যুতের রক্তিম আভায় টুকটুকে গাল দুটো স্মৃতির আলোর ঝরনাধারা। চোখের তারায় তারায় আনন্দ অশ্রুর প্লাবন।

জীবনের গাড়িটা হয়তো ছুটল পাহাড়ের পাকদণ্ডি পথ পেরিয়ে আলোর ঠিকানায়।

অলকানন্দার জলে

অলকানন্দা,

প্রথম দর্শনে মানুষ প্রেমিকার প্রেমে পড়ে। আমি প্রথম দর্শনে তোমাকে চরিত্রহীন ভেবে বসি। তাছাড়া তোমার শরীরটাও বেশ পুরুষ্ট। সালোয়ারের ভেতর থেকে দুটো পুষি বিড়াল সবসময় উঁকি দেয়। প্রতি মুহূর্তে মনে হতো হাত লেগে গেলে ম্যাও করে ডেকে উঠবে। পরে বুঝেছি হুলোই। এসব অবশ্য শাহিনকে বলিনি। তোমার স্তন দুটোর দুটো নাম দিয়ে ছিলাম তুমি জানো? দোয়েল আর কোয়েল। মনে রাখার সুবিধার জন্য। আসলে আমি মনে মনে দুটোকেই হুলো বেড়াল বলতাম। অত সেজে বাড়িতে কেউ থাকে! থাকে হয়তো। আমার জানা ছিল না। তোমাকেই প্রথম দেখেছিলাম বাড়িতে অত সেজে থাকতে। অবশ্য তোমার থেকে প্রথম দেখা প্রথম শেখা জিনিস আমার জীবনে অনেক। অথচ তুমি আমি কেউ কারও প্রথম প্রেমিক বা প্রেমিকা ছিলাম না।

তোমার খিদিরপুরের যে-অঞ্চলে বাড়ি, সেটা মারদাঙ্গা, খুনখারাপি, রাহাজানির জন্য এক সময়ে কুখ্যাত ছিল। তখন থেমে গিয়েছিল ঠিকই কিন্তু বদনামটা এখনও রয়ে গেছে। বিশেষ করে আমার মতো মফস্সলের ছেলের কাছে তো বটেই। অবশ্য পৃথিবীর যে-কোনও বন্দর শহরের সে বদনাম একটু আধটু থাকেই। তাই বলে কি সেখানে সুন্দরী থাকে না! জলপরিদেরও তো জল থেকে উঠে আসতে বন্দর লাগে। লাগে না? না লাগলে তুমি ওখানে গেলে কী করে?

বদনামটার ভয়ে সেদিন শাহিনকে সঙ্গে নিয়েছিলাম। ও বেচে গাড়ি আর আমি গাড়ির ইনসিওরেন্স। সেদিন ওর ওদিকে কোনও দরকারই ছিল না। ওকে বলেছিলাম তোমরা একটা নতুন প্রাইভেট কার নেবে। আমরা দুজনেই গুড্‌স ভেহিকেলস মানে মালবাহী বড়ো বড়ো লরির এক্সপার্ট। কিন্তু তোমরা তখন সবে চবিবশটা লরির ফ্লিট্ নিচ্ছ। শাহিন আপশোশ করছিল, লিডটা আগে পেলে ও ডিলটা ডান করতে পারত। মার্কেটে চাপা খবর ছিল, তাই ওকে কারের টোপটা দিই। মার্কেটিং লাইনে এসব টুকটাক মিথ্যে কথা চলতেই থাকে। শাহিনও হয়তো মিথ্যেটা বুঝেছিল, কিন্তু ও একবার তোমাদের সঙ্গে আলাপ করতে চাইছিল যদি পরে কখনও গাড়ি কেনার সময় ওকে ডাকো।

খিদিরপুর অঞ্চলে তোমাদের অনেকগুলো বাড়ি। গলি, তার ভেতরে গলি, কখনও কখনও কানা গলিতে ধাক্বা মেরেছি বাইক নিয়ে। তোমাদের ব্যাবসার তখনও অফিস ছিল না। সবে সবে ব্যাবসায় নেমেছ। বাড়ির ঠিকানা একটা ছিল। কিন্তু ঠিকানা থাকলেও কলকাতাতে বাড়ি খুঁজে পাওয়া যে এত কঠিন, সেদিন প্রথম বুঝেছিলাম। গলিগুলোর কত বাহারি নাম। হরিমঞ্চলেন, রামবাবু গুপ্তা রোড, এডেন ভিলা রোড! বললাম না তোমার থেকে কত কী প্রথম শিখেছি। অথচ সেল্সে কয়েক বছর কাজ করার সুবাদে কলকাতায় এ-মাথা ও-মাথা করেছি, কখনও কখনও বাড়ির নাম্বার, রাস্তার নাম না জেনে কিছু ল্যান্ডমার্ক জেনে নিয়েই ঠিক পৌঁছে গেছি।

অনেকটা গলির ভেতর তোমাদের প্রথম বাড়িতে পৌঁছে শুনলাম ঋষি রাজা লেনের বাড়িতে গেলে মালিককে এখন পাওয়া যাবে। গলির ভেতরে গাড়ি ঘোরানো কী যে কষ্টের তোমাকে বোঝানো যাবে না। ওই রকম সরু গলির ভেতর অত লোক যাতায়াত করে সব সময়, বাইক ঘোরাতে গেলেই বোঝা যায়। দু-দিক দিয়ে হইহট্টগোল। জলদি কিজিয়ে, জলদি কিজিয়ে! আরে বাবা জলদিই তো করছি। জলদিরও তো একটা সময় লাগে নাকি!

তবে তোমাদের প্রথম বাড়িটা গলির অনেক ভেতরে হলে কী হবে, ঢুকেই বুঝেছিলাম অর্থের বৈভব। একটা ছাবিবশ-সাতাশ বছর বয়সি ছেলে, পরে তুমি বলেছিলে তোমার ভাই, হিন্দিতে খুব রোয়াবে ঠিকানাটা বলেছিল। অর্ধেক বুঝিনি। শাহিন চট করে ধরে নিয়েছিল ঠিকানাটা। ওর মামার বাড়ি ওই অঞ্চলেই। ছোটো বেলায় খুব থাকত। পার্ক সার্কাস লোহাপুলের বাড়ি থেকে খিদিরপুর কার্ল মার্ক্স সরণিতে সাইকেল নিয়েই যাতায়াত করত তখন। এখন রয়েল এন্ডফিল্ড। যাকে তুমি বুলেট বলো। তোমার বরের তো বুলেট ছিল, বলেছিলে।

দ্বিতীয় বাড়িটায় পৌঁছোলাম চট করে। রাস্তাটা শাহিন চিনত। ওর বাল্যবন্ধুর বাড়ি। আর বাড়িটাও চওড়া রাস্তার ধারে। অথচ দেখো চওড়া রাস্তার নামে লেনের পদবি আর গলিগুলোর রোড, স্ট্রিট। পরে এই নিয়ে দুজনে খুব হাসাহাসি করেছিলাম তোমার মনে আছে? কিন্তু দ্বিতীয় বাড়িতে গিয়ে শুনলাম মালিকের শরীর খারাপ, তাই জিতেন সিং স্ট্রিটের বাড়িতে রেস্ট নিচ্ছেন। এ লোকটা তোমাদের ভাড়াটে। খুব বাবু বাবু করছিল।

দুপুর ঢিঢি করছে চারিদিকে। গরমকাল ছিল মনে আছে। সেল্স-এর লোকেদের অবশ্য এসব অভ্যাস আছে। আমরা মনে মনে নাছোড়বান্দা যে-কোনও সেল্স কলেই। বিশেষ করে এক সাথে চবিবশটা গাড়ির ইনসিওরেন্স মানে আমার বাঁধা ইনসেন্টিভ সে মাসে! অনেকদিন ধরে বউ একটা বালা চাইছিল। সেটা মাথায় ছিল। ফিরে যাওয়ার কোনও প্রশ্নই ছিল না। তবু একটা তো মানসিক ক্লান্তি আসে। দুই বন্ধুতে রাস্তার পাশের গুমটি থেকে দুটো দামি ব্র্যান্ডের মেন্থল সিগারেট কিনে ধরাই। আমাদের টিফিন বলো, রেস্ট বলো সবই ওই সাদা কাঠির সুখ টান আর ধোঁয়া ভর্তি গালের জাবর কাটা। অবশেষে তৃতীয় বাড়িতে তোমাদের পেলাম। না তোমাকে তো খুঁজতে যাইনি। চবিবশটা ফ্লিটের মালিকের সন্ধান পেলাম।

খিদিরপুর অঞ্চলের গলির ভেতর গলি, তার ভেতরে বাড়ি যে এত বৈভবের হতে পারে ধারণা ছিল না। তৃতীয় বাড়িটা ফ্ল্যাট টাইপের। প্রথম বাড়িটার থেকেও বেশি সাজানো। বাড়িগুলো বাইরে থেকে ইট বালির কঙ্কাল লাগে কিন্তু ভেতরের আসবাব, মেঝে, দেয়ালের কারুকাজ সব অন্যরকম। ওই ঘিঞ্জির মাঝেও যে ইটালিয়ান মার্বেলের মেঝে দেখব ভাবিনি। পুরো ফ্ল্যাটটাই সেন্ট্রালি এসি। গরম থেকে বাড়িতে ঢুকতেই এক রাশ স্বস্তি। যতটা না এসির কৃত্রিম ঠান্ডার জন্য, তার থেকেও বেশি অবশেষে চবিবশটা ফ্লিটের মালিকের কাছে পৌঁছোতে পারার জন্য। দুজনের দুটো ভালো পদ-নাম ছিল। আমি সেল্স ম্যানেজারের তকমা নিয়ে ঘুরি আর শাহিন ব্রাঞ্চ ডেভেলপমেন্ট ম্যানেজার। আসলে আমরা বেচুবাবু। মাল বেচাই কাজ। আমরা যা পাই বেচে দেবার সুযাগ খুঁজি।

অনেক বার বলেছি, তোমাদের ফ্ল্যাটটার নকশা ভালো নয়। কোনও প্রাইভেসি নেই। অতবড়ো ফ্ল্যাট অথচ উদোম। প্রথমে তোমাকে দেখার কথাটা বলি। চবিবশটা ফ্লিটের মালিকের নাম সতীশবাবু, টাইটেল জানি না। আধজানা ঠিকানায় পৌঁছে দেখলাম বড়ো ফ্ল্যাট। নিঃশব্দ। বয়স্ক কাজের মহিলা দরজা খুলে ড্রইংরুমে বসতে দিয়েছে। সোফাটা দামি। বসতেই ডুবে গেলাম। বসেছি ভেতরের দিকে মুখ করে। অপেক্ষা করছি। বেশ অনেকক্ষণ। মনে মনে সাজিয়ে নিচ্ছি বিমাকথা। যে-কোনও ভাবে তুলতেই হবে চেকটা। বউ যে নতুন ডিজাইনের বালা দেখেছে, এক জোড়া না একটাই বানাবে বলেছে। ইনসিওরেন্স ইজ আ সাবজেক্ট ম্যাটার অফ সলিসিটেশন। গুলি মার সলিসিটেশনের। যে করে হোক চেকটা আমার চাই।

আমি বা শাহিন কেউ কথা বলছি না। কাস্টমারের বাড়িতে আমরা একদম শান্ত ভদ্র। চোখে চোখে কথা হচ্ছে। ঠোঁটের অল্প নড়াচড়াতে দুজনে দুজনের ভাষা বুঝতে পারি। দু-একবার পর্দার আড়ালে তোমাকে দেখলাম। নিঃশব্দে নড়াচড়া করছ। আমি আর শাহিন চোখাচোখি করলাম। আবছা অবয়ব। শরীরের বর্ণনা দেব না। প্রেমিকার শরীর নিয়ে কথা বলা নোংরামি। কিন্তু দুজনে তোমাদের সোফায় বসে চোখ দিয়ে নোংরামিই করছিলাম। ওসব ছেলে ছেলেতে হয়ে থাকে। রাগ কোরো না। আর তখন কি জানতাম যে তোমার সাথে ওরকম দুনিয়া ভোলানো প্রেম হবে। আমি দেখতে শুনতে ভালো, লোকে স্মার্ট বলে। বেশ লম্বা চওড়া। ফর্মাল ড্রেসে সবাইকেই ভালো লাগার কথা। তাই বলে তোমার মত মারকাটারি সুন্দরী, সেক্সি বলব না। প্রেমিকাকে সেক্সি বলতে নেই, আমার সাথে প্রেম করবে ভাবতেই পারিনি।

মিনিট কুড়ি মানে অনেকক্ষণ। নতুন জায়গায় এসে বসে আছি অথচ কেউ কোনও কথা বলছে না। কোনও শব্দ নেই। নিঝুম। শুধু তুমি হেঁটেছ কয়েক বার খসখস করে। ফ্ল্যাটের দরজা বন্ধ হওয়ার পরেই বাইরের রোদ, তাপ, কোলাহল থেকে বহুদূরে চলে এসেছি। অন্য একটা শহর মনে হতে শুরু করেছে। ঘরের আসবাব সব অন্যরকম। একবার সদর স্ট্রিটের একটা অ্যাংলো ইন্ডিয়ানের বাড়িতে ঢুকে এরকম মনে হয়েছিল। যেন অন্য শহরের বাড়ি। সে বাড়িটা অবশ্য কেমন পড়ো শহর মনে হয়েছিল। আর এ বাড়িটা খুব উজ্জ্বল। মনে হচ্ছে কোনও অন্তরীপ শহরের আসবাব।

সেল্সম্যানদের ধৈর্য অকল্পনীয়। তবু অস্বস্তি হতে শুরু করেছে। বাইরে বাইকটা পড়ে আছে। এ অঞ্চলের বদনাম ভয় ধরাচ্ছে। চুরি গেলে ইনসিওরেন্সের ফুল ক্লেম পেলেও নতুন বাইক হবে না। আর ক্লেম পেতেও বেশ সময় লাগবে। ততদিন চলবে কী করে! তখনই তুমি বাইরে এলে, এক বৃদ্ধকে প্রায় জাপটে ধরে বাথরুমে নিয়ে যাচ্ছ। একজন পুরুষ আর নারীর প্রকাশ্যে জাপটে থাকা সব সময়ই অশোভন। আর তোমার সেজে থাকা! নেল পালিশ, লিপস্টিক, টিপ। সব কিছু গুলিয়ে দিচ্ছিল তোমার ফেটে পড়া শরীর। অনেক সুন্দরী দেখেছি কিন্তু তোমার মতো যৌবনবতী সুন্দরী আর দেখা হয়নি। তাছাড়া সতীশবাবু বৃদ্ধ হলেও বৃষস্কন্ধ, বয়সের তুলনায় সুঠাম। আমার দোষ কী বলো!

শাহিনও তো তোমাকে ভুল বুঝেছিল। আমি ও শাহিন তোমাকে নিয়ে কত কী ভেবেছি। তৃতীয় পক্ষের বউ, বউমা, নাতনি এমনকী রক্ষিতাও। সেই জন্যই তোমাকে বললাম না, প্রথম দর্শনেই তোমাকে চরিত্রহীন ভাবি। তোমাকে নিয়ে কত গবেষণা করেছি দুজনে। তবু বাপ-মেয়ে একবারও ভাবতে পারিনি। ওরকম জাপটে থাকলে কেউ ভাবতে পারে না। তুমি পরে বলেছিলে বাবা অসুস্থ ছিল। সরি অলকা। বাথরুম থেকে বেরিয়ে তুমি সতীশবাবুকে আমাদের কাছে সোফায় বসিয়ে দিয়ে গেলে। বসাতে গেলে ঝুঁকতেই হয়। আর ঝুঁকতেই তোমার সালোয়ারের ভেতর থেকে দুটো পুষি বিড়াল উঁকি দিয়ে গেল।

কাজের কথা বিশেষ কিছু হল না। তুমিও ওই যে সতীশবাবুকে বসিয়ে দিয়ে ঘরে ঢুকে গেলে আর বেরোলে না। সতীশবাবুর সামনে থেকে তো আর ঘরের পর্দার দিকে তাকিয়ে তোমাকে খোঁজা যায় না। তবু মনে মনে খুঁজছিলাম, যদি আর একবার দেখা যায় সুন্দরীকে। সতীশবাবু জাহাজে কাজ করতেন। আর জাহাজি মানুষের গল্পের শেষ নেই। সমুদ্র বৈচিত্র্যহীন কিন্তু বন্দরের তো গল্প অনেক। তখনই বুঝলাম তোমাদের বাড়ির অঙ্গসজ্জায় কেন বিদেশি সুবাস। বুঝলাম তোমার বাবা আর সমুদ্রে যেতে চায় না, এবার স্থলপথে আয় চায়। অনেক কষ্টে মুক্তি পেলাম। গল্প শুনতে ভালোই লাগছিল। কিন্তু কাজের তাড়া সেল্স-এর লোকেদের তাড়িয়ে বেড়ায়। এডেন বন্দর, তাহিতি, সুয়েজ ক্যানাল এসব গল্প কার না ভালো লাগে। আমার ভূগোলে জ্ঞান খারাপ, তবু ভালো লাগছিল। কানের মধ্যে একটা নতুন পৃথিবী তৈরি হয়ে পৌঁছে যাচ্ছিল হূদয়ে। শুধুমাত্র সতীশবাবুর মোবাইল নাম্বারটাই পেয়েছিলাম সেদিন। কবে আসব ইন্সিওরেন্সের জন্য জিজ্ঞাসা করতে নাম্বারটা দিয়ে বলেছিলেন, আসক্ মি ওভার টেলিফোন অ্যান্ড গিভ মি দ্য কোটেশন! তোমার বাবা ইংরেজি ছাড়া প্রায় কথাই বলতে পারে না।

চিঠিটা খুব বড়ো হয়ে যাচ্ছে জানি। আসলে আমারও তো বয়স বেড়েছে আরও দু-বছর, তোমারও। তোমার আমার গল্পও জমে গেছে অনেক। খুব স্মৃতি জমে গেলে রোমন্থন করেই আনন্দ। এসব কথা ফোনে হয় না। তুমি পড়লে আনন্দ পাবে ভেবেই লেখা। গতকাল আর আগামীকাল দুটোই আমাদের জীবনে দুটো গুরুত্বপূর্ণ দিন। তাই লিখছি আনন্দে আর বিষাদে।

শাহিনের কাছে সতীশবাবু নেগেটিভ কাস্টমার। আমার কাছে ইনসেন্টিভ, বউ-এর গয়না গড়িয়ে দেওয়া প্রত্যাশা। আমি ফলো আপ করব ঠিক করেই সতীশবাবুর থেকে বিদায় নিলাম। তোমাকে নিয়ে বেশি কথা ভাবার ছিল না। শাহিনের সাথে দেখা হলেই ও তোমার রূপ, রূপসজ্জা অথবা রূপটান নিয়ে বলে। তার বেশি কিছু না। আমিই শরীরের বেশি বর্ণনা দিতাম। শাহিন শুনত। তবে তোমাকে নিয়ে আমরা অন্য কোনও লোকের কাছে কথা বলতাম না। যেন আমাদের গোপন অভিযানে পাওয়া সম্পত্তি। জানাজানি হলে অংশীদারের ভয়।

তিনদিন পরে সতীশবাবুকে ফোন করলাম। তোমার বাবা কোটেশন চাইল। কোটেশন তো তৈরিই ছিল। আমি বললাম এখুনি দিয়ে আসছি। এবার আর শাহিনকে নিলাম না। চেনা হয়ে গেছে। সোজা চলে গেলাম জিতেন সিং স্ট্রিটের ফ্ল্যাটে। যে-ফ্ল্যাটে তোমাকে প্রথম তোমার বাবার সাথে দেখেছিলাম। একবারও ভাবিনি অন্য কোনও বাড়ির কথা।

তোমার একটা অমোঘ টান তো ছিলই। দরজা খুললে তুমি নিজেই। খুব অবাক হলাম তোমাকে দেখে। বিষণ্ণতার ঘন কুয়াশা তোমায় যেন মুড়ে রেখেছে। সেই প্রথম তোমার উপর মায়া হল। ধনীকে হঠাৎ গরিব দেখলে যেমন মায়া লাগে তার অস্বাচ্ছন্দ্যর কথা ভেবে, তেমনি। ভুল ভাঙল একটু পরেই। তুমি ভেতরে বসালে, যেন বাবাকে ডাকতে গেলে। বেশ কিছুক্ষণ আমি একাই সোফায়। খুব অস্বস্তিকর সময়। বাড়িতে একটাও বই নেই। টিভিও নেই যে চোখ মেলে সময় কাটাব। তোমার বাবা এল না। তুমিই এলে। আমার সামনের সোফায় বসলে। বসেই আমাকে সপাটে প্রশ্ন করলে, হ্যাংলার মতো আগের দিন তাকিয়ে ছিলেন কেন? আমি কী উত্তর দেব! লম্বায় ছয় ছুঁই ছুঁই কিন্তু লজ্জায় তখন জল ছুঁই ছুঁই। সেল্স লাইনে আমাকে সবাই ড্যাম স্মার্ট বলে। আমি বেচুবাবু হিসাবে যথেষ্ট কৃতি। গত তিনবছরে আমার মাইনে বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে, প্রোমোশন আর কোম্পানি পালটে। সেই আমি এসির ঠান্ডায় ঘামতে শুরু করি। এক গেলাস জল হলে ভালো হতো। ভাবি, একটা কমপ্লেন দিলেই চাকরিটা যাবে। আর এ-লাইনে চাকরি পাওয়া যাবে না। বউ বাচ্চা খাবে কী!

আমার অবস্থা দেখে তুমি নিজেই হেসে উঠলে। ছোটোবেলায় কুলগাছ নাড়িয়ে যেমন পাকা কুল পাড়তাম, কুল কুল করে তেমনি তুমি হেসে উঠলে। কোটেশন এনেছেন? দিন। বাবাকে দিয়ে দেব। এটা আমার বাড়ি। বাবার বাড়ি নয়। হাসতে হাসতে শুরু করে গম্ভীর হয়ে শেষ করলে কথাগুলো। পরে জেনেছি তুমি নাকি জানতে আমি আসব ওই ফ্ল্যাটেই। তুমি নাকি জানতে আমি ভালোবাসবই।

২৮ মার্চ, রবিবার ৮.১০ সকাল

জামদানীপুর।

রাজেন্দ্রনন্দিনী অলকানন্দা,

বাজার করতে গিয়েছিলাম। তুমি অবশ্য বাজার করা ব্যাপারটা বুঝবে না। নিজের হাতে বাজার করাটা খুব মজার ব্যাপার। টাটকা সবজি বেছে কেনা বা বড়ো হাঁসের ডিমটা খুঁজে নেওয়া। তোমরা ধনী। তোমাদের নিজস্ব বাজার সরকার আছে। সে-ই বাজার করে আনে। তিন বাড়িতে ভাগ করে দেয় বাজার। তুমি অবশ্য বেশির ভাগ দিন হোটেল থেকে খাবার কিনে আনাও বলেছ। তুমি ঝাল খেতে ভালোবাসো। লুকিয়ে দেখা করতে এসে দু-একবার তোমার বাড়িতে রান্না করা খাবার, টিফিন বাক্সে এনেছ। কী ঝাল, কী ঝাল! ঝালে আমি মরে যাই অবস্থা। আমি ভাবলাম তোমার জিভ থেকে ঠান্ডা নেব কিন্তু তোমার জিভও অত ঝাল কে জানত! তুমি ওই ঝাল চিলি চিকেন খেয়েই বেরিয়েছ বাড়ি থেকে। আমাকে বলোনি কেন? সেদিন তোমাকে বিষকন্যার মতো লাগছিল। সেদিন সেজেও ছিলে পাকা লংকা রঙের শাড়িতে।

প্রথম থেকেই তোমাদের ব্যাপারগুলো কেমন যেন তালগোল পাকিয়ে ছিল। তোমার বাবার ইংরেজি আর ভাইয়ের হিন্দি শুনে ভেবেছিলাম তোমরা অবাঙালি হবে। ‘সতীশ সিং’ তোমার বাবার নাম লিখেছিলাম ইন্সিওরেন্স কভার নোটে মনে আছে। পরে তুমি বললে, তোমরা মুঙ্গেরের প্রবাসী বাঙালি। সিনহা, সিংহ হয়ে সিং-এ পৌঁছেছে। বারুইপুরে তোমাদের আদি শিকড়। বারুইপুর থেকে কয়েক পুরুষ আগে ভাগ্য অন্বেষণে মুঙ্গের। আবার ফেরা কলকাতায়। তোমার সাথে না আলাপ হলে জানতাম না, বারুইপুরে তোমার বাবার বিশাল অট্টালিকার কথা। অবশ্য তোমার সাথে আমার যেটা হয়েছে সেটা আলাপ নয়, দুকূল ছাপানো প্রেম। বারুইপুরের উঁচু পাঁচিল দেওয়া বাগানবাড়িতে একটা যৌবনবতী মহিলা কী করে বালিকাবেলায় ফিরে যেতে পারে সেদিন দেখেছিলাম। সেই প্রথম তোমাকে অযৌনতায় দেখি। খালি পায়ে মেক্সিকান ঘাসের উপর দৌড়োতে দৌড়োতে ক্লান্ত হয়ে আমার কোলের উপর মাথা রেখে শুয়ে পড়েছিলে। আমি ঘাসে বসে তোমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলাম, যেমন বাড়িতে তিন বছরের মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিই।

আমার মেয়ে তিন্নি খুব আদর খেতে চায়। খুব বায়না। এটা আনবে ওটা আনবে। আজ ক্যাডবেরি তো কাল খেলনা গাড়ি। ওর বায়না মেটাই বলে আমার বউ খুব রাগ করে। মানসী স্কুল মাস্টারের মেয়ে। ওর কাছে আদর্শ ব্যাপারটা সহজাত। পয়সা একদমই নষ্ট করতে চায় না। নিজে দামি পরবে না, মেয়েকেও পরাতে দেবে না। আমার ওইটুকু মেয়ের সাজার খুব শখ। ঠিক তোমার মতো। মাঝে মাঝে মনে হয় তিন্নি তোমার মেয়ে। মানসীর সম্পূর্ণ বিপরীত চরিত্র তোমার ও তিন্নির। মানসী অপ্রয়োজনে সাজে না। বাড়িতে টিপ পরতে বললেও লজ্জা অথচ মানসী দেখতে ভালোই। মুখশ্রী সুন্দর। তোমাকে তো আমাদের বিয়ের ফটো দেখিয়েছি। বাড়ি থেকে লুকিয়ে অ্যালবাম নিয়ে গেছি আমাদের বিয়ের। তুমি বহুবার আমাকে বলেছ তুমি মানসীকে খুব পছন্দ করো। আর তিন্নিকে তোমার খুব ভালো লাগে বলে সেই পছন্দটা এসেছে। তিন্নিকে তুমি বহুবার দেখতে চেয়েছ কিন্তু তিন বছরের মেয়েকে কী করে দেখাই বলো? আরও একটু বড়ো হোক কলকাতায় তোমাকে দেখাতে নিয়ে যাব। এই মফস্সল থেকে এখনই নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। মানসী এখন তিন্নিকে আমার সাথে একা ছাড়বেও না।

আমার মেয়ের কথা, বউয়ের কথা সব বলেছি। আমার বাড়ির সব কথাও। বাবা ঠাকুরদার গরিব জীবনের কথা। বিয়ে করার কথা। অথচ তুমি নিজের কথা ছাড়া বিশেষ কিছু বলতে চাও না। তোমার বাবার কথা মায়ের কথা প্রায় কিছুই বলোনি। যেটুকু জেনেছি তাও আমার অনন্ত প্রশ্নের আগ্রহে শোনা। তোমার মা দুটো বলেছিলে। তারা দুজনেই বেঁচে আছে না মরে গেছে কোনওদিন বলোনি। তোমার ভাই যাকে আমি প্রথমদিনই শাহিনের সাথে প্রথম বাড়িতে দেখি, সে কি তোমার সৎ ভাই? জিজ্ঞাসা করলে তুমি এড়িয়ে যাও। এই সব ব্যক্তিগত প্রশ্ন করলেই তুমি শরীর দেখাও আর আমাকে জাগিয়ে দাও শরীরে। আমি রম্ভার শরীর দেখি, মাখি, ছানি, অসম্ভব সব বক্রতা থেকে আমার মনের মতো যৌনতা খুঁজি। আমাকে তুমি এত শরীরী-সুখ দিয়েছ মাঝে মাঝে মনে হয় তুমিই স্বর্গ অথবা চরম সত্য। অথচ তোমার সাথে যৌনসম্ভোগ তখনও হয়নি। চূড়ান্ত সম্ভোগের কোনও সম্ভাবনাও ছিল না। তুমি কিছুতেই রাজি ছিলে না। তুমি আমাকে শরীরে মাখতে কিন্তু শরীরে নিতে রাজি ছিলে না।

আজ রবিবার। বাজার করে এনে দিয়েছি। এখন খাবার সময় হয়ে এসেছে। মুড়িঘণ্ট ডাল আর খাসির মাংস। স্নান করতে হবে এবার। অথচ কিছুতেই স্নান করতে ইচ্ছা করছে না। গত দু-বছর আমাদের সম্পর্ক। দু-বছরে অনেক কথা হয়েছে। তুমি ভালোবাসবে না শুধু বন্ধুত্ব রাখতে চেয়েছ। সেখান থেকে অনেক কষ্টে তুমি স্বীকার করেছ ভালোবাসো। ভালোবাসা ছাড়া সম্পর্কটা টিকত না। ‘ভালোবাসি’ কথাটা তোমার মুখ থেকে শুনতে চেয়েছিলাম। একটা অন্য রকম স্বীকৃতি। তুমি বললে, সেই অমোঘ শব্দরাশি ভালোবাসি, ভালোবাসি। আমাকে বললে পৃথিবীর মধ্যে সব থেকে ভালোবাসো। আমি জিজ্ঞাসা করলাম বরের থেকেও? তুমি থমকে গেলে। তারপর আবার সময় চাইলে। তোমার বর কী করে, কোথায় থাকে জানি না। পরে বলেছ সেও বাবার মতো জাহাজি। বাবার দেখে দেওয়া পাত্র। সেও নীল সমুদ্রে ঘুরে বেড়ায়। নীল আকাশে সমুদ্র-পাখি খোঁজে। আমি বলেছিলাম নাবিকের সংসার তো বন্দরে বন্দরে। তুমি কোনও উত্তর দাওনি। আমার মুখের মধ্যে গুঁজে দিয়েছিলে অসম্ভব যৌনতা। আমি বাকরুদ্ধ হয়ে যাই তোমার কৌশলে। আমার সমস্ত প্রশ্ন হারিয়ে যায়। আমি তখন শিশুর মত পৃথিবী ভুলে মায়ের কোল খুঁজি নির্মল আনন্দে। আমার নিবাস, আবাস, পরবাস, সুবাস তখন তোমার মধ্যে। তুমি নিতেও পারো আমাকে অসম্ভব। যেন তুমিও আমার মধ্যে খুঁজতে অন্য পৃথিবী। একটা দুরন্ত বালকের মাতৃত্ব সামলানোর মতো আমায় তৃপ্ত করতে, দৃপ্ত করতে, দৃঢ় করতে।

আজ কিছুতেই স্নান করতে ইচ্ছা করছে না। গত দু-বছরে আমরা দুজনে দুজনকে কাল প্রথম সম্পূর্ণ পেলাম। তুমি স্বীকার করেছ আমাকেই সব থেকে বেশি ভালোবাসো। আমিই তোমাকে সব থেকে বেশি বুঝি অথবা তুমি আমার সঙ্গেই সময় কাটিয়ে সব থেকে বেশি সুখ পাও। তোমার কোনও সন্তান নেই। তবু তুমি আমার সাথে পালাতে পারবে না। আমার সংসার তুমি ভাঙতে চাও না। আর আমিও যতই তোমাকে ভালোবাসি, মানসীকে বা তিন্নিকে ছাড়তে চাই না। তোমার মতো উদ্ভিন্ন যৌবনা মেয়ে আমার মধ্যে কী দেখেছে জানি না কিন্তু কাল প্রথম যখন অনেক দূরের একটা হোটেলে আমাকে শরীরে নিলে, আমার মনে হয়েছিল তুমিও আমাতে তৃপ্ত। শুধু একবার চরম তৃপ্তির আগের মুহূর্তে দ্বিতীয় দিনে দেখা বিষণ্ণতা কয়েক পলের জন্য ফিরে এসেছিল। কাল আমাকে যেতেই হবে। কোম্পানি আমাকে সেল্স ম্যানেজার থেকে অসমের তিনসুকিয়ায় ব্রাঞ্চ ম্যানেজার করে পাঠাচ্ছে। এটাও সম্ভব হয়েছে তোমাদের চবিবশটা গাড়ির ইন্সিওরেন্স পাবার জন্য। তুমি আমার চলে যাওয়ার ব্যাপারে কোনও মতামত দাওনি। তুমি কি চাইছ আমি দূরে চলে যাই? না হলে একবারও কেন বললে না থেকে যেতে? কালই তোমাকে পুরোপুরি পেলাম আর আজ আমাকে চলে যেতে হবে ভাবলেই কষ্ট হচ্ছে। তুমি অবশ্য কথা দিয়েছ তিনসুকিয়ায় আসবে। থাকবে বেশ কিছুদিন। খুব মজা হবে পাহাড়ি ঝরনার নীচে জলপরিকে পেলে! এখন যাই। স্নান করি। না হলে মানসী রাগারাগি করবে। শরীরে তোমার সুবাস নিয়ে আবার আজ শাওয়ারের নীচে দাঁড়াব শুধু আজ পাশে তোমাকে, রতিক্লান্ত তোমাকে পাব না।

২৮ মার্চ, ১.৫৫ দুপুর,

জামদানীপুর।

অলকানন্দা,

চিঠিগুলো পোস্ট করা হয়নি। ভেবেছিলাম পরিষ্কার করে আবার লিখে তোমাকে তিনসুকিয়া থেকে পোস্ট করব। কিন্তু এখানে এসে চার্জ নিয়ে সব কাজকর্ম বুঝে নিতেই দিন দশেক হয়ে গেল। তোমাকে এখানের ফোন নাম্বার আগেই দিয়ে এসেছিলাম। আমি অফিসে এসেও তোমাকে ফোন করেছিলাম দু-দুবার। দুবারই তোমার মোবাইল বেজে বেজে বন্ধ হয়ে গেল। তুমি বলেছিলে কোনও বিপদ বা জানাজানি হয়ে গেলে চুপচাপ হয়ে যেতে। ছ-মাস পর সব ঠান্ডা হয়ে গেলে আবার যোগাযোগ করা হবে। আমি ভয় পেলাম বোধহয় জানাজানি হয়ে গেছে! তোমার কথা ভেবেই আমার কলকাতার মোবাইল নাম্বার চালু রেখেছি। কলকাতার কাস্টমাররা বিরক্ত করছে, ইনকামিং টাকা কাটছে, তবুও তোমার কথা ভেবে চালু আছে আজও। আমি ধীরে ধীরে কাজের মধ্যে ডুবে যাই। এখানে অনেক দায়িত্ব। তবু রোজ রাতে তোমাকে ফোন করতে চাইতাম। এখানে একা থাকি। ফোন করলে বউয়ের কাছে ধরা পড়ার ভয় নেই। ফোনটা বুকে চেপে ঘুমিয়ে পড়তাম। ভাবতাম এই বুঝি তুমি ফোন করবে। তবু তোমার বিপদের কথা ভেবে কোনও দিন ফোন করতাম না। তুমি বলেছিলে তোমার বাবা জানতে পারলে অনার কিলিং-এ তোমার নাম উঠবে। আমি স্রেফ ভয়ে ফোন করিনি। চিঠি পোস্ট করার প্রশ্নই ওঠে না।

গত কয়েকদিন থেকে মনে হচ্ছে ধনীর মেয়ে, বড়োলোকের বউ। বর বিদেশে থাকে! শরীরের চাহিদায় তুমি আমার কাছে এসেছিলে। শরীর যখন পেলে তখনই আমাকে বহুদূরে চলে আসতে হল। তাই আমার প্রতি আর কোনও টান নেই। হয়তো এরকমই করো তুমি। বা সব নাবিকের ঘরনিই এরকম ভাবে সময় কাটায়। আবার মনে হচ্ছিল তুমি বুঝি সত্যিই ভালো। যেমন দেখেছি তেমনই ভালো। শরীর চাইলে পাঁচতারা হোটেলে শরীর খেলাতে পারতে। সব রকমই ভাবছি। সন্ধে থেকে একা এবং অফুরান সময়। ভাবনারাও খেলে বেড়ায় বামদিক ডানদিক, দুদিক। ভাবছি চূড়ান্ত তৃপ্তির আগের মুহূর্তের বিষাদ ব্যাধ কী তির মারল যে, তুমি এক পলকের জন্য উদাস হয়ে গেলে! বরের কথা মনে পড়েছিল? অথবা ব্যভিচারের সূক্ষ্ম পাপবোধ?

সব ভাবনাই শুধু ভাবার জন্য। উত্তর পাওয়ার কোনও উপায় নেই। কেউ জানে না আমাদের গোপন সম্পর্ক। কেউ না। শুধু শাহিন হয়তো কিছুটা আন্দাজ করতে পারে। শাহিনকে জিজ্ঞাসা করব কিনা কয়েকদিন মরিয়া চিন্তায় আছি। হঠাৎ কাল অনেক রাতে শাহিন ফোন করে। আমি তোমার ব্যাপারে জানতে যাব, শাহিনই তুলল তোমার কথা। জানো বস্ খিদিরপুরের সতীশ সিং-এর বাড়ির সেই সুন্দরী মেয়েটা উত্তরাখণ্ডের একটা নদীতে ঝাঁপ দিয়ে সুইসাইড করেছে। নদীটার নাম নাকি মেয়েটার নামেই ছিল। মেয়েটাকে মনে পড়ে তোমার?

১২ এপ্রিল সকাল ৮টা

বক্স রোড তিনসুকিয়া, অসম।

 

পরকীয়া

 

অমিতের হাত দুটো শক্ত করে ধরল রত্না। ওর চোখেমুখে ভয় স্পষ্ট। এখন কী হবে অমিত?

কিচ্ছু হবে না, আমি আছি তো। তুমি চিন্তা কোরো না। খুব তাড়াতাড়ি তোমার পায়ে চোট সেরে যাবে। তুমি হাঁটতে পারবে। বলেই রত্নার মাথায় হাত বুলিয়ে দিল অমিত। কিন্তু অমিতের আশ্বাসেও ভয় কাটল না রত্নার। পরিস্থিতি বুঝে রত্নার কপালে ঠোঁট ছোঁয়াল অমিত। তারপর রত্নাকে পায়ে ব্যথা নিরাময়ে ওষুধ খাওয়াল।

ওষুধ খাওয়ার কিছুক্ষণ পর ঘুমিয়ে পড়ল রত্না। আর তার পাশে আধশোওয়া থেকে আনমনা হয়ে পড়ল অমিত। তার চোখের সামনে তখন ভেসে উঠল সপ্তাহখানেক আগের ঘটনাটা অফিসের কাজে যাচ্ছি এই অজুহাতে কলকাতা থেকে বোলপুর পেঁছেছিল অমিত এবং রত্না। স্বামী-স্ত্রী পরিচয়ে চেনাজানা একটি হোটেলে উঠেছিল দুজনে। দুদিনের জন্য বুকিং করে, বরাদ্দ ঘরে ঢুকেই দরজা বন্ধ করেছিল ওরা। যেন এই সময়টার অপেক্ষায় ছিল দুজনে। তাই, আলিঙ্গন, চুম্বনের পর চড়ান্ত শরীরী উষ্ণতা উপভোগ করতে অমিত এবং রত্না কেউই সময় নষ্ট করেনি। তবে এ ব্যাপারে রত্না একটু বেশি সক্রিয় ছিল। যেন ক্ষুধার্ত বাঘিনির মতো। দীর্ঘদিন অর্ধাহারে কিংবা অনাহারে থাকার পর যেন সে ক্ষুধা নিবারণ করল। তাই, অমিত তাকে বাইরে বেরোনোর প্রস্তাব দিলেও, প্রথমে সে রাজি হয়নি। কারণ, বন্ধ ঘরে আরও কিছুটা সময় সে অমিতকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে থাকতে চেয়েিল। কিন্তু একঘেয়েি কাটানোর জন্য অমিত-ই প্রায় জোরাজুরি করে বাইরে বের করেছিল রত্নাকে। আর তারপরই ঘটেছিল বিপত্তি। সোনাঝুরির জঙ্গলে অমিতের হাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে কখন যে গর্তে একটা পা পড়ে গিয়েিল, তা বুঝতে পারেনি রত্না।

হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে এক্স-রে করানোর পর চিকিত্সক জানিয়েিলেন, রত্নার ডান পায়ে হাড়ে হালকা চিড় ধরেছে, ক্রেপ ব্যান্ডেজের পর অন্তত পনেরো দিন বিশ্রামে থাকতে হবে।

পায়ে ক্রেপ ব্যান্ডেজ নিয়ে হোটলের বিছানায় এক সপ্তাহ কাটিয়ে ফেলেছে রত্না। দুদিনের হোটেল বুকিং বাড়িয়ে কুড়ি দিন করেছে অমিত। এখনও অনেক দিন থাকার পর বাড়ি ফিরতে পারবে দুজনে। অফিসের কাজ বেড়েছে বলে দুজনেই বাড়িতে বার্তা পাঠিয়েে। কিন্তু অমিতের স্ত্রী সেই বার্তা বিশ্বাস করে নিলেও, রত্নার হ্যাজব্যান্ড সুনীল যে সন্দেহের বাইরে রাখেনি, কথা বলে তা বেশ বুঝতে পেরেছে রত্না। যাইহোক, রত্নার পাশে শুয়ে এসব ভাবতে ভাবতেই অমিতের ঘোর কাটল ওর মোবাইল ফোনটা বেজে ওঠায়।

অমিত দেখল ওর বউ নীলিমার ফোন। ফোন কাটল অমিত। তারপর, বিজি অ্যাট প্রেজেন্ট, আই উইল কল ব্যাক লেটার লিখে পাঠিয়ে দিল। ওকে রিপ্লাই পাওয়ার পর শান্তিতে চোখ বন্ধ করল অমিত।

ঘুম ভাঙার পর রত্না দেখল অমিত ঘুমোচ্ছে। বিশ্রাম নিচ্ছে দেখে অমিতকে আর বিরক্ত করল না রত্না। বরং, চুপচাপ শুয়ে থেকে ভাবতে লাগল, অমিতের সঙ্গে পুনর্মিলনের সেই মুহূর্তটির কথা।

বছরখানেক আগের এক বিকেল। রত্না যে-এডুকেশনাল ইন্সটিটিউট-এর ফ্যাকাল্টি, সেই ইন্সটিটিউট-এর স্টুডেন্টস ওয়ার্কশপ ছিল ধর্মতলায় অবস্থিত একটি পাঁচতারা হোটেলে। ওয়ার্কশপ শেষ হওয়ার পর রত্না হল থেকে বেরিয়ে হাঁটছে লিফ্ট-এর দিকে। হঠাত্ একজনকে দেখে খুব চেনা মনে হল।

লিফট-এর একটু দূরে ঘুরে ফিরে কথা বলছিল অমিত। তাই, অমিত কিনা তা নিশ্চিত হতে রত্না দাঁড়িয়ে পড়ল।

এরই মধ্যে রত্নার মনে পড়ে গেল, বছর পাঁচেক আগের বিশ্ববিদ্যালয়ে দিনগুলির কথা। অমিত ওর মনের মানুষ ছিল। তাকে নিয়ে ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখত রত্না। কিন্তু ইউনির্ভাসিটির পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর, অমিত হঠাত্ কেন যে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করেছিল, তার কোনও যুক্তিগ্রাহ্য কারণ দর্শাতে পারেনি। অনেক অপেক্ষার পর তাই মা-বাবার পছন্দের পাত্র সুনীলকে বিয়ে করে রত্না। শুধু তাই নয়, বিয়ে পর রত্না সুনীলের সন্তানের মা-ও হয়েে নির্দিষ্ট সময়ে কিন্তু, সুনীলের বদমেজাজ আর অমিতের প্রতি সুপ্ত ভালোবাসার কারণে, রত্না ভালো স্ত্রী হতে পারেনি। যাইহোক, এসব ভাবতে ভাবতেই অমিতের মুখোমুখি হল রত্না। অমিত একবারেই রত্নাকে চিনতে পারল। ফোন ছেড়ে, এক মুখ হাসি নিয়ে রত্নাকে জিজ্ঞেস করল

আরে রত্না, তুমি এখানে!

আমার ইন্সটিটিউট-এর স্টুডেন্ট ওয়ার্কশপ ছিল। কিন্তু তুমি এখানে কী করছ?

আমার কোম্পানির প্রোডাক্ট লঞ্চ ছিল এখানে। বাই দ্য ওয়ে কেমন আছো রত্না?

আছি একপ্রকার, মণিহারা ফণির মতো।

কথাটা বলেই হাসতে হাসতে অমিতের চোখের দিকে তাকাল রত্না। যেন সে অমিতের মনের কথা বোঝার চেষ্টা করছে। এর ঠিক কয়ে সেকেন্ড পরে রত্না অমিতকে বলল, তুমি কেমন আছো?

ওই চলছে একপ্রকার।

ব্যস্ত মানুষ। তা এখন হাতে একটু সময় আছে? খুব বেশি সময় নষ্ট করব না। এতদিন বাদে দেখা, তাই একসঙ্গে বসে একটু কফি খাওয়ার লোভ সামলাতে পারছি না।

সেদিন রত্নার কফি খাওয়ার অনুরোধ রক্ষা করে, নিজেও খুশি হয়েিল অমিত। আড্ডা জমেছিল অনেক রাত পর্যন্ত। দুজনের বিবাহিত জীবন কেমন চলছে, একে অপরকে না পেয়ে কতটা দুখি, সবই সেদিন শেয়ার করেছিল পরস্পরকে। আর সেদিনের জন্য যখন একে অপরের থেকে বিদায় নিয়েিল, তখন দুটো শরীর যেন চুম্বক আর লোহার রূপ নিয়েিল। রাত বাড়ছে, বাড়ি ফিরতে হবে, ভেবেই হয়তো বাহুমুক্ত হতে বাধ্য হয়েিল তারা।

এরপর প্রতি মুহূর্তে দুজনে দুজনকে চোখে হারিয়েে। সময় পেলেই ফোন, হোয়াটসঅ্যাপ, কিংবা ম্যাসেঞ্জারে দীর্ঘ সময় ধরে মনের ঝাঁপি খুলে ধরেছে।

রত্না এবং অমিত অফিস আওয়ার্স-এ বেশি কথা বলত। কারণ দুজনে যেহেতু অন্যের সঙ্গে ঘর বেঁধেছে, তাই ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়ে বাড়ি থেকে খুব কম কথা বলত তারা। তবে সংসার এবং কর্মক্ষেত্রের জন্য ওই দিনের পর আর দেখা করতে না পারলেও, মনের টান বাড়তে লাগল উভয়ে। এ ব্যাপারে বেশি কাছে আসতে চাইত রত্না। একবার দূরভাষে রত্না অমিতকে জীবনসঙ্গী হিসাবে না-পাওয়ার জন্য এতটাই আক্ষেপ করতে শুরু করেছিল যে, অমিত জিজ্ঞেস করল বিয়ে করে তুমি কি খুশি নও?

অমিতের কথার উত্তরে রত্না সেদিন বলেছিল, আজ নয়, সময় এলে তোমার এই প্রশ্নের উত্তর আমি অন্য ভাবে দিতে চাই।

একটু থেমে রত্না আবার অমিতকে আবেগভরা গলায় বলল, আমরা যে পরস্পরকে আজও ভালোবাসি, এটা তো সত্যি।

ভালোবাসা ছিল, আছে, থাকবে। কিন্তু এর বেশি আর কীই-বা করতে পারি আমরা? আমরা তো এক বিছানা শেয়ার করতে পারব না। কেউ কি সমর্থন করবে আমাদের এই সম্পর্ককে? কেউ কি বুঝবে যে, আমরা বিয়ে করেছি একজনকে আর ভালোবাসি অন্য কাউকে?

অমিতের আবেগ দ্বিগুন হল। আবারও সে বলতে শুরু করল, তুমি-ই বলো রত্না, কী করা উচিত আমাদের?

উত্তরে রত্না সেদিন জানিয়েিল, বিয়ে এবং ভালোবাসা দুটি ভিন্ন বিষয় আমার কাছে। যাদের আমরা বিয়ে করেছি, তাদের জায়গায় রেখেও তো আমরা আমাদের দুজনের ভালোবাসাকে বাঁচিয়ে রাখতে পারি, নতুন করে আমাদের যা মন চায় তাই করতে পারি।

মানলাম আমরা দুজনে যা মন চাই তাই করলাম, কিন্তু আমাদের বাড়তি চাওয়ার ফলে তো সংসার থেকে মনও উঠে যাবে। আমাদের জীবনসঙ্গীরা তো কোনও অন্যায় করেনি, আমাদের সন্তানরা তো কোনও অন্যায় করেনি। তাহলে তারা অকারণে কেন শাস্তি পাবে?

অমিতের কথা কেড়ে নিয়ে রত্না বলেছিল, আমি কাউকে শাস্তি দিতে বলছি না, শুধু আমাদের চাহিদা পূরণের কথা বলছি। তাছাড়া আমরা তো ওদেরকে খুশি রেখেছি এতদিন। আজ যদি ভালোবাসার মানুষকে আমরা নতুন করে পেতে চাই, তাহলে অন্যায়টা কোথায় অমিত?

সেদিন আর কথা বাড়ায়নি অমিত। কিন্তু দূরভাষে এভাবেই মাঝেমধ্যে কাছে আসার জন্য উতলা করে তুলত রত্না। অমিতও রত্নাকে কাছে পাওয়ার একটা অদ্ভুত টান অনুভব করত। কিন্তু বউ-বাচ্চার কথা ভেবে আবার পিছিয়ে যেত। এভাবেই রত্নাকে এবং নিজের মনকে বহুবার সামাল দিয়ে এসেছিল অমিত। কিন্তু ওদের পুনর্মিলনের এক বছর যখন পূর্ণ হতে চলেছিল, তখন রত্না জানাল, অমিত, আমি আর পারছি না, অন্তত দুটো দিন তোমার সঙ্গে একান্তে কাটাতে চাই। আগামী মাসের চার তারিখ আমাদের দেখা হওয়ার এক বছর পূর্ণ হবে। ওই দিন আমরা বোলপুরে গিয়ে দুদিন কাটাব। ব্যস, এটুকুই আমার চাওয়া। ওই দুদিনের স্মৃতি নিয়ে আমি বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেব। তুমি রাজি হয়ে যাও প্লিজ।

রত্নার অনুরোধে দুদিন পর ভেবেচিন্তে বোলপুরে আসার সম্মতি জানিয়েিল অমিত। কিন্তু সেই সুখ কপালে সইল না। হোটেলের বিছানায় অমিতের পাশে শুয়ে রত্না তাই ভাবছিল, কী যে হয়ে গেল! বেশ ছিলাম হোটেলে, কেন যে মরতে বাইরে বেরোলাম, আরও এক সপ্তাহ পর কীভাবে যে সুনীলের মুখোমুখি হব বাড়ি গিয়ে এভাবেই ভাবনা আর অনুভবে পাশাপাশি থাকতে থাকতে অমিত ও রত্না কাটিয়ে দিয়েে আরও এক সপ্তাহ। এখন অমিতের কাঁধে ভর করে কিছুটা হাঁটতেও পারছে রত্না। ওর পায়ে ব্যান্ডেজ খুলে দিয়েেন ডক্টর। এবার ওদের বাড়ি ফেরার পালা।

হোটেল ছাড়ার আগে রত্না অমিতকে প্রাণপণে জড়িয়ে ধরে রয়েে। মিনিটখানেক ওভাবে থাকার পর রত্না অমিতের চোখে চোখ রেখে জানাল, আমার মনের দরজা সারা জীবন শুধু তোমার জন্য খোলা থাকবে। তুমি যখন খুশি আসতে পারো, আমি তোমার কাছে আত্মসমর্পন করে আনন্দ পাব।

রত্না এখনও সম্পূর্ণ সুস্থ হয়নি। স্বাভাবিক ভাবে হাঁটতে পারছিল না। তা দেখে অমিত কিছুতেই রত্নাকে একা বাড়ি ফিরতে দিল না। আরও কিছুটা সময় যাওয়ার পথে অমিতকে কাছে পাবে, তাই রত্নাও আর বাধা দেয়নি।

ফেরার পথে ওরা আর ট্রেন ধরল না। বোলপুর থেকে একটা গাড়ি ভাড়া করে রওনা দিল কলকাতার বালিগঞ্জের উদ্দেশে। ওখানেই রত্নার শ্বশুরবাড়ি। কিন্তু অমিত থাকে উত্তর চব্বিশ পরগণার ব্যারাকপুরে। তাই, রত্নাকে অমিত জানিয়েিল, ওর শ্বশুরবাড়ির কিছুটা আগে ওকে রিকশোতে তুলে দেবে। কিন্তু রত্না জানাল, না, তুমি আমাকে বাড়িতে পেঁছে দিয়ে আসবে। আমি সুনীলকে ম্যানেজ করব, আলাপ করিয়ে দেব তোমার সঙ্গে।

বাড়ি পেঁছোনোর আগে সুনীলকে ফোন করে তাকে রিসিভ করার কথা জানিয়েিল রত্না। সেইমতো রাস্তায় এসে ছেলেকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়েিল সুনীল।

গাড়ি থেকে নেমেই রত্না প্রথমে ছেলেকে কোলে তুলে নিল। কারণ, বিগত পনেরো দিন সে শুধু দূরভাষে ছেলের খবর নিয়েিল, টুকটাক কথা বলেছিল। ছেলের জন্য রত্নার বেশি চিন্তা ছিল না, কারণ রত্না জানত, ওর শাশুড়ি নাতিকে খুব ভালোবাসেন, তাই সামলে নেবেন।

সোনা বাবা, তুমি কেমন আছো? ঠাকুমা তোমায় আদর করেছিল তো? ছেলের গালে চুমু দিতে দিতে কথাগুলো বলতে থাকে রত্না।

ঠাকুমা আমায় অনেক গল্প শুনিয়েে। সদ্য কথা বলতে শেখা ছেলেটি তার মাকে জানায়।

রত্নাকে নামিয়ে অমিত গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে যেতে চেয়েিল, তখনই রত্না গাড়ির ড্রাইভারকে থামতে বলে এবং অমিতকে নামতে বলে ইশারায়।

সুনীল, এদিকে এসো, আলাপ করিয়ে দিই আমার বন্ধু অমিতের সঙ্গে। মনে কোনও দ্বিধা-সংশয় না রেখে, খুব স্বাভাবিক ভাবে অমিতের সঙ্গে সুনীলের আলাপ করিয়ে দেয় রত্না।

অমিতের সঙ্গে আলাপ পর্বে সুনীল কোনও বিরূপ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেনি ঠিকই, কিন্তু হতবাক হয়েিল হঠাত্ এমন একটি অভাবনীয় ঘটনার মুখোমুখি হয়ে তাই অমিত চলে যাওয়ার পর, একাধিক প্রশ্নবাণে বিদ্ধ করেছিল কিছুটা উত্তেজিত হয়ে কিন্তু রত্নাকে নিরুত্তাপ দেখে, সামযিক ভাবে ঘাবড়ে গিয়েিল সুনীল।

সময় এগিয়ে চলে তার নিজস্ব গতিতে। কাজের ব্যস্ততায় সুনীলের মাথা থেকেও বেরিয়ে যায় অমিতের বিষয়টা। পায়ে ব্যথা সেরে গিয়ে স্বাভাবিক হাঁটাচলা করতে পারার পর রত্নাও আবার কাজে যোগ দেয়। সময় পেলেই অমিতকে ফোনও করতে থাকে নিয়মিত। এভাবেই চলছিল সবকিছু, কিন্তু দিনের পর দিন বিছানায় রত্নাকে আর আগের মতো না পেয়ে নতুন করে আষাঢ়ের মেঘ ঘনীভত হতে শুরু করে সুনীলের মনে।

রাত দশটা। ডিনার সেরে নিয়েে রত্না। ছেলেকে খাইয়ে ওর ঠাকুমার ঘরে দিয়ে এসেছে। ঠাকুমার সঙ্গেই এখন ঘুমোনোর অভ্যাস ছেলের। রত্না তাই এখন একা। সুনীলের ফিরতে এখনও ঘন্টাখানেক বাকি। তাই এই ফাঁকা সময়ে অমিতের সঙ্গে কথা বলার ইচ্ছে হল রত্নার।

অমিত সেই রাতে অফিসের কাজে উত্তরবঙ্গে ছিল। কাজ সেরে হোটেলের ঘরে বসে টিভি দেখছিল। রত্নার ফোন রিসিভ করে টিভি বন্ধ করে দেয়। তারপর বেশ নিশ্চিন্তে কথোপকথন চালাতে থাকে অমিত এবং রত্না।

আবেগে চোখ বন্ধ রেখে কথা বলছিল রত্না। তাই, সুনীল কখন ঘরে ঢুকে চেয়ারে বসে ওর প্রেমালাপ শুনছিল, বুঝতেই পারেনি। হঠাত্ ঘরে কারওর উপস্থিতি টের পেয়ে চোখ খোলে রত্না। আচমকা সুনীলকে দেখে ঘাবড়ে গিয়ে ফোন কেটে দেয় সে।

ফোনের ওপারে কে ছিল? ওই লোকটা যে তোমাকে পেঁছোতে এসেছিল? কর্কশ ভাবে প্রশ্নগুলো রত্নার দিকে ছুড়ে দেয় সুনীল।

হ্যাঁ, আমিতই ছিল, তো কী হয়েে?

প্রেম তো বেশ জমে উঠেছে দেখছি। এইজন্যই ভাবছিলাম, রাতে এখন শরীরে তোমার প্রাণ থাকে না কেন?

বাজে কথা রাখো। রাত হয়েে, আমার ঘুম পাচ্ছে, ফালতু বকবক করতে পারব না।

তা পারবে কেন! সব এনার্জি তো ওই লোকটার সঙ্গে বকবক করে শেষ করে ফেলেছ। লজ্জা করে না। বাচ্চার মা তুমি। আমি কী অভাব রেখেছি তোমার?

তুমি আমার শরীরের খবর রেখেছ, মনের খবর রেখেছ কি?

বাহ্, ভালো বলেছ। এখন অনেক কথাই তুমি বলবে। ওই ইতরটার সান্নিধ্য পেয়ে না। এখন তো আমার সবই তোমার কাছে মূল্যহীন মনে হবে। যাইহোক, একটা কথা স্পষ্ট জানিয়ে রাখছি, আর যদি ওই লোকটার সঙ্গে যোগাযোগ রাখো, তাহলে তোমার সঙ্গে আমার ফাটাফাটি হবে বলে দিলাম। আমার সম্মান নষ্ট করলে আমি ছাড়ব না।

তোমার যা করার আছে তুমি করে নাও। অমিত আমার বন্ধু, আমি যোগাযোগ রাখবই।

ওহঃ তাই? দেখাচ্ছি মজা…

বলেই রত্নার হাত থেকে ওর মোবাইল ফোনটা কেড়ে নিয়ে মাটিতে আছাড় মারে সুনীল। ভেঙে ছড়িয়ে পড়ে ফোনের যন্ত্রাংশ। ভাঙা ফোনটা থেকে সিম কার্ডটা খুলে নিয়ে সুনীলের গালে সপাটে একটা চড় মেরে, অফিসের ব্যাগটা কাঁধে তুলে নেয় রত্না। ঘর থেকে বেরোনোর আগে সুনীলকে ধাক্কা মেরে ঠেলে ফেলে দেয় এবং বাইরে থেকে দরজা আটকে দিয়ে রাস্তায় আসে। তারপর একটা ট্যাক্সি ধরে সোজা হাতিবাগানে মায়ে বাড়িতে ওঠে।

অমিত সেদিন ওর মাকে ফোন করে দরজা খুলিয়ে উদ্ধার হয়েিল ঘর থেকে। রাগের মাথায় সুনীল সেদিন রত্নার বিরুদ্ধে কড়া পদক্ষেপ নিতে চেয়েিল কিন্তু ওর মা নিতে দেননি।

ওই ঘটনার পর কেটে গেছে এক সপ্তাহ। রত্নার কোনও খবর নেই। ছেলের খোঁজটুকুও নেয়নি। এদিকে ছোট্ট ছেলেটিকে ঠাকুমা আগলে রাখলেও, মাঝেমধ্যে মা-র জন্য কান্নাকাটি করতে থাকে। ওই দৃশ্য দেখে সুনীল আর নিজেকে ঠিক রাখতে পারে না। মনকে বুঝিয়ে রত্নার খোঁজ শুরু করে। রত্নার অফিস থেকে কোনও খবর পায় না। এক আত্মীয়ে মাধ্যমে জানতে পারে রত্না ওর মায়ে বাড়িতে আছে।

ছেলের ভবিষ্যতের কথা ভেবে আর পরিবারের সামাজিক সম্মান বাঁচানোর তাগিদে, শ্বশুরবাড়ি গিয়ে রত্নার মুখোমুখি হয় সুনীল। শাশুড়িকে বুঝিয়ে শুনিয়ে আর রত্নার হাত ধরে অনেক অনুনয়, বিনয়ে পর, রত্নাকে বাড়ি ফেরাতে সক্ষম হয় সে। কিন্তু সুনীলকে প্রতিশ্রুতি দিতে হয়, অমিত-রত্নার সম্পর্কের ব্যাপারে আর কখনও সে নাক গলাবে না।

পড়ার জন্য সীমাহীন গল্প-নিবন্ধসাবস্ক্রাইব