পৃথিবীর অদ্ভুত কিছু হোটেল পর্ব ৩

আমাদের অনেকেরই বিদেশে ঘুরে বেড়ানোর শখ আছে। অনেকেরই শখ আছে বরফের ঘরে রাত কাটানোর বা আরামদায়ক বিছানায় শুয়ে আকাশের তারা খসা বা তুষারপাত দেখা। এরকম ইচ্ছে থাকলে আপনাদের সে ইচ্ছেও পূরণ হয়ে যাবে। কারণ আমাদের এই পৃথিবীতে এমন কিছু হোটেল আছে যা আপনার মনের ইচ্ছে পূরণ করতে পারবে। সেরকম কয়েকটি হোটেলের সন্ধান রইল এখানে। আজ তৃতীয় পর্ব।

ডে সাল : লবণ বা নুনের তৈরি হোটেল শুনলে অনেকেই অবাক হবেন জানি। কিন্তু বলিভিয়াতে আছে এই নুনের তৈরি হোটেল। প্রথমে দেখলে আপাতদৃষ্টিতে এটিকে হোটেল মনে করতে কষ্ট হতে পারে! কারণ এখানকার আসবাব থেকে শুরু করে বেশির ভাগ উপকরণই লবণ দিয়ে তৈরি। দক্ষিণ আমেরিকার বলিভিয়ায় যে-সব পর্যটকেরা বেড়াতে যান, তারা সালার ডি ইযুনিতে ডে সাল নামের এই হোটেলটিতে ছুটি কাটিয়ে যেতে ভোলেন না। সালার ডি ইযুনি হল লবণের মরুভূমি। পুরো এলাকাজুড়ে ছড়িয়ে আছে লবণের চাঁই। এখানে লবণের হ্রদও দেখতে পাওয়া যায়। যেখানে আছে প্রচুর লিথিয়াম। মাত্র কয়েক বছর আগে এই লিথিয়ামের প্রাচুর্যতার  কথা জানতে পারা গেছে। আমাদের সমগ্র বিশ্বের মোট সরবরাহের প্রায় অর্ধেক লিথিয়াম এখানে মেলে।

তবে পুরো এলাকার কয়েক ফুট লবণের স্তরটি একেবারেই সমতল। সমুদ্রসীমা থেকে ৩৬৫০ মিটার উঁচুতে এই হোটেলটির অবস্থান। পর্যটকেরা এখানে এসে বিস্ময়ে মুগ্ধ হয়ে যান। যেদিকে তাকাবেন সেদিকেই খালি লবণের সাম্রাজ্য নজরে পড়বে। এই সাম্রাজ্য এতটাই বিস্তৃত যে, দূরে তাকালে বোঝার উপায় নেই আকাশ কোথায় গিয়ে মিশেছে। এরকম এক আজব জায়গাতেই গড়ে উঠেছে শুধুমাত্র নুন দিয়ে তৈরি হোটেলটি। এখানে দেওয়ালগুলো লবণ আর জল দিয়ে তৈরি ব্লক দিয়ে বানানো হয়েছে। বেডরুমের সংখ্যা ১৫টি। আশ্চর্য হবেন শুনে যে, হোটেলের আরামদায়ক বিছানাটিও কিন্তু লবণের তৈরি।

অনেক পর্যটকের বিশ্বাস করতে অসুবিধে হয় যে, এখানকার বেশিরভাগ আসবাবপত্র নুনের তৈরি। কেউ কেউ তখন জিভ দিয়ে চেটে সেগুলোর সত্যতা পরীক্ষা করেন বলেও শোনা যায়। শুধু তাই নয়, এই হোটেলটিতে আছে রেস্তোরাঁ, স্টাইল রুম, কনফারেন্স রুম, চিত্রকলা ও হস্তশিল্প কেন্দ্র এবং খেলাধূলার কক্ষ।

স্কাইওয়াকার হোটেল : বিশ্বে নানা ধরনের হোটেল আমরা দেখেছি কিন্তু মেঘফুঁড়ে আকাশের ওপরে হোটেল আছে একথা বিশ্বাস করতে খুবই অসুবিধে হয়। শুধু তাই নয় সে হোটেলে অন্যান্য হোটেলের মতো নাগরিক সুযোগ সুবিধার সবকিছুই আছে। অবাক হলেও সত্যি যে এরকম একটি হোটেল আছে এই বিশ্বে। মহাকাশে এই হোটেলটি বানিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। হোটেলটি তার নিজস্ব অরবিটালে ঘুরছে যুক্তরাষ্ট্রের লাস ভেগাসের ওপরে। পৃথিবীর সবচেয়ে কাছের অরবিটালে ঘূর্ণায়মান মানুষের তৈরি প্রথম হোটেল এটি। এই হোটেলের সব আয়োজনই দর্শক ও যাত্রীদের রোমাঞ্চিত করে। সেখানে যেতে হলে প্রত্যেক গ্রাহককে যেতে হয় নভোচারির প্রস্তুতি নিয়ে হোটেলের সাথে সাথে ঘুরতে হয় সব গ্রাহককেও। ঘন্টায় প্রায় ২৮ হাজার কিলোমিটার বেগে নিজের অরবিটের ওপর ঘূর্ণায়মান এই স্কাইওয়াকার হোটেল।

আমাদের পৃথিবী থেকে ৫১৫ কিলোমিটার উঁচুতে, মহাকাশে ছুটে চলেছে এই হোটেল। পৃথিবীর হোটেলগুলোতে যেসব আধুনিক সুযোগসুবিধে থাকে তার সবকিছুই আছে এখানে। তবে পার্থক্য হল যে, সেখানে সব বস্তুই বাতাসে ভেসে বেড়ায়। ঘুরপাক খায় শূন্যে। এই কারণে কম্পিউটার, টেলিভিশন, নিত্যপ্রযোজনীয় বস্তু নিজের নিজের জায়গায় আটকানো থাকে।

 

 

পৃথিবীর অদ্ভুত কিছু হোটেল পর্ব ২

আমাদের অনেকেরই বিদেশে ঘুরে বেড়ানোর শখ আছে। অনেকেরই শখ আছে বরফের ঘরে রাত কাটানোর বা আরামদায়ক বিছানায় শুয়ে আকাশের তারা খসা বা তুষারপাত দেখা। এরকম ইচ্ছে থাকলে আপনাদের সে ইচ্ছেও পূরণ হয়ে যাবে। কারণ আমাদের এই পৃথিবীতে এমন কিছু হোটেল আছে যা আপনার মনের ইচ্ছে পূরণ করতে পারবে। সেরকম কয়েকটি হোটেলের সন্ধান রইল এই লেখায়। আজ দ্বিতীয় পর্ব।

ম্যাজিক মাউন্টেন লজ : চিলির ম্যাজিক মাউন্টেন লজ গভীর জঙ্গলের মধ্যে তৈরি করা হয়েছে। এই হোটেলটিকে দেখে অনেকেরই মনে হবে রূপকথার একটি বাড়ি। আবার দূর থেকে দেখলে মনে হয় ছোটো একটি পাহাড়ি দুর্গ। অদ্ভুত ব্যাপার হল, হোটেলের মাথা থেকে নেমে আসছে ঝরনার স্রোত আর ভেতর থেকে মনে হবে যেন একটা বিশাল গাছের গুঁড়ি।

ম্যানড ক্লাউড হোটেল : ভাসমান হোটেলগুলোর কথা বলতে গেলে সবার আগেই বলতে হয় ম্যানড ক্লাউড হোটেলটির কথা। হোটেলটির নাম শুনলেই বোঝা যায় যে, মানুষকে মেঘের দেশে নিয়ে গিয়ে ভাসমান আনন্দ দেওয়ার জন্যই তৈরি করা হয়েছে এই হোটেলটি। ফ্রান্সের ম্যানড ক্লাউড বিশ্বের অন্যতম সেরা হোটেলগুলোর মধ্যে একটি। বৈচিত্র‌্যের দিক দিয়ে সবাইকে ছাড়িয়ে গেছে এটি। দেখলে মনে হবে, আকাশে ভেসে বেড়াচ্ছে কোনও নভোযান।

ব্ল্যাকহোলের মতো দেখতে হোটেলের বুকে বিশাল এক কালো গর্ত বসানো থাকবে, তাহলে দূর থেকে সেটা দেখতে অনেকটা ব্ল্যাক হোলের মতো মনে হবে। এমনই এক ভযংকর সৌন্দর্যের  কল্পনা নিয়ে দক্ষিণ কোরিয়ান স্থাপত্যবিদ এই নকশা এঁকেছেন ডেথস্টার হোটেলের জন্য।

রিজউড হোটেল অ্যান্ড স্যুট প্রাইভেট লিমিটেড : সম্প্রতি মালদ্বীপে এরকম আর একটি হোটেল নির্মাণের পরিকল্পনা চলছে। এ বিষয়ে পোলিশ আর্কিটেকচারাল এবং ডিপ্লসি ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি ডিপ ওশিয়ান টেকনোলজি সম্প্রতি চুক্তি করেছে রিজউড হোটেল অ্যান্ড স্যুট প্রাইভেট লিমিটেডের সঙ্গে। জলের নীচে অনেক হোটেল নির্মাণ করা হলেও, মালদ্বীপে নির্মিত এই হোটেলটি হবে সবচেয়ে বড়ো আন্ডারওয়াটার হোটেল বা জলের তলদেশে হোটেল।

হোটেলটির আকৃতি হবে স্পেসশিপের মতো। অনেকটা ফ্লাইং সসার বা ইউএফও আকৃতির। সায়েন্স ফিকশন মুভিগুলোতে আমরা যেমনটি দেখতে পাই। চাকতি আকৃতির এই হোটেলের ডিজাইন দেখলে সত্যই অবাক হতে হয়। উপরের ভাগে রেস্টুরেন্ট, স্পা করার ব্যবস্থা, হেলিকপ্টার ল্যান্ডিং প্যাড, বাগান রাখা হয়েছে। অতিথিরা উপর থেকে ভৌগোলিক আবহাওয়ার স্বাদ নিতে পারবেন আবার একই সঙ্গে জলের তলদেশের বিচিত্র অভিজ্ঞতাও উপভোগ করতে পারবেন।

পৃথিবীর অদ্ভুত কিছু হোটেল পর্ব ১

আমাদের অনেকেরই বিদেশে ঘুরে বেড়ানোর শখ আছে। অনেকেরই শখ আছে বরফের ঘরে রাত কাটানোর বা আরামদায়ক বিছানায় শুয়ে আকাশের তারা খসা বা তুষারপাত দেখা। এরকম ইচ্ছে থাকলে আপনাদের সে ইচ্ছেও পূরণ হয়ে যাবে। কারণ আমাদের এই পৃথিবীতে এমন কিছু হোটেল আছে যা আপনার মনের ইচ্ছে পূরণ করতে পারবে। সেরকম কয়েকটি হোটেলের সন্ধান রইল এই লেখায়।

কেভ রিসর্ট : ওয়েস্ট ইন্ডিজের জামাইকা-তে আছে কেভ রিসর্ট। এটি হল সমুদ্রের গায়ে প্রাকৃতিক চুনাপাথরের গুহায় তৈরি একটি হোটেল। সেখানে গেলে আপনি গুহায় বসে নীল সমুদ্র দেখার শখ অনায়াসেই পূরণ করতে পারবেন এবং সেই সাথে বিলাসিতারও অভাব হবে না। এখানে ডাইনিং হল, স্পা, রিসর্ট, অত্যাধুনিক সমস্ত ব্যবস্থাই আছে। আর সবচেয়ে সুন্দর হল গুহার ছাদে বসে সমুদ্র দেখতে দেখতে ক্যান্ডেল লাইট ডিনারও করা। একবার ভাবুন তো কি থ্রিলিং ব্যাপার হবে!

কক্সল্যাটিন্যান হোটেল : ফিনল্যান্ডের কক্সল্যাটিন্যান হোটেলটিতে ঘরের মধ্যে রয়েছে নরম বিছানা, ফায়ার প্লেসের উষ্ণতা ইত্যাদি। আপনি চাইলে এই হোটেলের বিছানায় নরম কম্বলের ভেতর শুয়ে বরফ ঢাকা প্রকৃতির সৌন্দর্য অনুভব করতে পারবেন। এর জন্য রয়েছে গ্লাস ইগলু-র ব্যবস্থা। তাই আসল ইগলুর-র অনুভব পাবেন। বাইরের উষ্ণতা ৪০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড হলেও ভয় পাবেন না, বরফের ঘরের তাপমাত্রা থাকবে ৩ ডিগ্রি। সাথে পাবেন নরম আর গরম কম্বল থেকে বিলাসের সমস্ত অত্যাধুনিক ব্যবস্থা। আর যদি নিজেকে কয়েকদিনের জন্য রাজপুত্র বা রাজকন্যা ভাবতে চান, তবে সে সুযোগও পাবেন। এখানে রাজকীয় ঘরের রাজকীয় শয্যাও আছে।

হোটেল দি গ্ল্যান্স : কানাডার হোটেল দি গ্ল্যান্স হোটেলটির নাম অনেকেরই জানা। এই হোটেলটি তৈরি করা হয়েছে বরফের পরতে পরতে কারুকার্য করে বরফকে কেটে কেটে। বহু শিল্পী এই কারুকার্য দেখে তারিফ না করে পারবেন না। বরফের প্যালেসে রাজকীয় শয্যা, খাবার ঘর, বাথরুম বিলাস ও বিনোদনের যাবতীয় ব্যবস্থাও সেখানে পাবেন। প্রত্যেক বছর শীতে নতুন করে খোলা হয় হোটেলটি। বরফের চোখ ধাঁধানো কারুকার্য বদলে যায়। এই সুবিধা শুধুমাত্র শীতকালেই পাওয়া যায়।

ময়ূরীগহন

ন-মাস-বচ্ছরকাল ধরে এখানে কলাপ মেলে দাঁড়িয়ে থাকে পথের বাঁকে বাঁকে। চলতে চলতে মনে হচ্ছিল এখানে কি বসন্ত ফুরোয় না? কী জানি? আমাদের ঘিরে উলটোদিকে ছুটতে থাকা সবুজের উজাড় করা আলিঙ্গন মাঝে মাঝেই বুনোফুলের রংমজলিসে ভরে উঠছে। গুচ্ছ গুচ্ছ ফুলের দল কখনও-সখনও ইনোভার উইন্ডস্ক্রিনে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। জনহীন পাকদণ্ডি। দ্বিতীয় কোনও গাড়ি তো দূরস্থান, পথের দুপাশে ঘন অরণ্যের বাহারি ঘেরাটোপ ছাড়া কিচ্ছু নেই। মনে সন্দেহ জাগছিল ভুল রাস্তায় চলে এলাম কি না!

গাড়ি এগিয়েই চলেছে। তবু কারও দেখা নেই। কাছে-দূরে পাহাড়ের তরঙ্গমালা। শরীরে তার সবুজ-ধূসর-মেটে কত রকমের রং। তারই খাঁজে খাঁজে খেলনা-বাড়ির মতো বসতির চিহ্ন। যেখানে যাচ্ছি তার নাম জানি, তবু যেন মনে হচ্ছে এ যাত্রা বুঝি দিকশূন্যপুরের। রাস্তার মানচিত্রে বিপুল প্যাঁচ। গাড়িটা এক মুহূর্তের জন্যেও সোজা চলছে না। ডাঁয়ে-বাঁয়ে হেলেদুলে পাড়ি দিচ্ছে পাহাড়ি বাঁকে। হরিয়ানার একমাত্র হিলস্টেশন।

অচিন ঠিকানা মোরনি পাহাড়। নামটা শোনামাত্রই মন আমার ময়ূরপঙ্খি নাও। নিজের কাছেই নিজে দাবি করে বসলাম, সেখানে গেলে নির্ঘাত অনেক ময়ূরীর দেখা মিলবে। নইলে এই শৈলগহনের এমন নামই বা কেন? এখনও পর্যন্ত তেমন একটা পর্যটকদের পায়ের চিহ্ন পড়েনি মোরনি পাহাড়ে। তবু শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা মায়াবিনী মোরনির সিংহদরজা খোলা থাকে অনাহুত পথিকের জন্য।

এখানেই আছে টিক্বর তাল। মোরনি হিলস থেকে প্রায় সাড়ে দশ কিলোমিটার। পঞ্চকুলা এখান থেকে কিছুটা দূরে। পঞ্চকুলা জেলাতেই এমন মৌনী মোরনির অবস্থান। চারিদিকে শান্তির স্তব্ধতা। নরম আলোয় ভেজা প্রকৃতির বুকে আত্মগোপন করে থাকা এমন একটি জায়গায়, একা একা পথ হাঁটতেও মন্দ লাগত না। বরং মনে হয়, এই বুঝি সেই জায়গা যেখানে নিজেকে হারিয়ে আবার খুঁজে পাওয়া যাবে।

হরিয়ানার নাডা সাহিব গুরুদ্বোয়ারার উলটোদিকের রাস্তায় ঢুকে খানিকটা যেতেই দু’দিকে রাস্তা ভাগ হয়েছে। বাঁ হাতের রাস্তাটি অসমান পাথুরে। গাঁয়ের মধ্যে দিয়ে গেছে। অন্যটি সোজা পিচ বাঁধানো সড়ক। এখান থেকে মোরনি পাহাড় কিছুটা দূরে। আঁকাবাঁকা রাস্তা বেয়ে পাহাড়ের অনেকটা উপরে ওঠার পরেই চোখে পড়ল অন্য একটি রাস্তা আমাদের চলার পথে এসে মিশেছে। ওটাই মোরনি আসার সেই দ্বিতীয় পথ যেটা গাঁয়ের মধ্যে দিয়ে এসেছে। ওপথে এলে দূরত্ব কিছু কমত ঠিকই কিন্তু এমন এঁকেবেঁকে উঠে আসা পাহাড়ি রাস্তা চলার দুরন্ত মজাটাই অধরা থেকে যেত। এপথে পুলিশের প্রতিপত্তি খুব। বেশ খানিক সময় ধরে চলল জব্বর চেকিং। যাই হোক, যতই মোরনির মৌবনে প্রবেশ করতে লাগলাম, ততই মনের নন্দনকানন অদ্ভূত পুলকে শিউরে উঠতে লাগল। অসাধারণ! অপূর্ব! না কি আরও বেশি কিছু?

হরিয়ানার হোটেলে ফোন পাওয়া বলা যায় ভাগ্যের ব্যাপার। অনেক কষ্ট করে তিনজনে মিলে হপ্তাখানেক গুঁতোতে গুঁতোতে একদিন পেলাম। যদি কেউ নাক সিটকে এ সময় বলে ওঠেন যে, ‘ধুর! হোটেল বুক করে বেড়াতে এলে বেড়ানোর রোমাঞ্চটাই তো মাটি’। তাঁদের জন্য বলি, এসে হোটেল বুক করার প্ল্যান থাকলে পাহাড়ি রাস্তাতে বাসররাত্রি কাটানো ছাড়া উপায় না-ও থাকতে পারে। বিড়ালের ভাগ্যে শিকে খুব কমই ছেঁড়ে। তাই ঘর গোছানো বাঙালির মতো আগেভাগেই হরিয়ানা পর্যটনের হোটেল ‘মাউন্টেন কোয়াইলস’ বুক করে রেখেছিলাম। পাহাড়ের মাথায় আদিগন্ত সবুজ আর নীল ক্যানভাসকে ব্যাকড্রপ করে দাঁড়িয়ে আছে মাউন্টেন কোয়াইলস। বারান্দায় দাঁড়ালে নীলাচল প্রকৃতির অবাধ হাট। কেয়ারিবাগানে হলুদ গাঁদা ফুলের দলে দোলা দিয়ে যাচ্ছে আলতো শীতল হাওয়া। সবজে রঙা দোলনাটি এখন চুপটি বসে, পড়ে-আসা সকালের ঘ্রাণ নিচ্ছে। ঘরগুলো খাসা।

পৌঁছোতে পৌঁছোতে বেলা গড়িয়ে গেল। তাই আর এক মুহূর্তও হোটেলে নয়। দ্বিপ্রাহরিক আহারের হুকুম ছুড়েই ক্যামেরা কাঁধে বেরিয়ে পড়া। লনের সবুজ কার্পেটের ওপর গাড়ি রইল পড়ে। এখন এগারো নম্বরই ভালো। পিচ বাঁধানো উতরাই পাহাড়ি পথ ধরে নেমে চললাম। পাহাড়ি পথে নামবার সময় শরীরের ভেতর অদ্ভুত এক নাচন লাগে। খালি মনে হয় এই বোধহয় গড়িয়ে গেলাম। আসলে সবই মাধ্যাকর্ষণের তাল। বেশ লাগে ব্যাপারটা। বেলা বাড়লে ছবি তুলে শান্তি নেই। তবু একটু পাহাড়, খাদ, স্থানীয় জনজীবনের ছবি বন্দি করেই ফিরে আসা। হিমাচলের ভয়ংকর বিরিয়ানি খেয়ে মুখের সাথে মনটাও ঘেঁটে গিয়েছিল। দুবেলা পেটপুরে খেয়েও মনটা আমাদের উপোসি ছিল গত পাঁচদিন ধরে। কিন্তু হরিয়ানায় এসে গরম গরম বাসমতী ভাত, চমৎকার ডাল, সুস্বাদু মটর পনির আর সঙ্গে গ্রিন স্যালাড মুখে পড়তেই উদরের অভ্যন্তরে ফুরফুরে দখিন হাওয়া।

কথাতেই বলে ভেতো বাঙালি। পেটে ভাত পড়লেই দুচোখে কালঘুম হাই তোলে। কিন্তু বেড়াতে এসে এই ঘুমকে প্রশ্রয় দিলেই সব পণ্ড। সূয্যিমামা শুয়ে পড়লে না ঘোরা না ছবি, কোনওটাই হবে না। তার ওপর মাত্র একটি দিনের জন্যে মোরনি আসা। তাই সময়ের স্রোতে নোঙর বেঁধে দলবেঁধে বেরিয়ে পড়া। হোটেলের ম্যানেজার বললেন, কাছেই একটা ফোর্ট আছে। হাঁটাপথ। দারুণ ব্যাপার! ভাবিনি এখানেও রাজারাজড়ার নিদর্শন পাব।

রাস্তাটা নেমে গিয়ে আবার উঠেছে। আকাশছোঁয়া চিরগাছের চালচিত্রে ছাওয়া রাজ্যে সেই দুর্গ। রাস্তাপাশে এলোমেলো সবুজে জড়ানো সরু পথ। সকলের চোখের সামনেই আছে। তবু খুঁজে নিতে হবে তাকে। সেটা ধরে দু’পা উঠতেই ঘন হয়ে জাপটে থাকা গাছগাছালির ফাঁক দিয়ে পোড়া ইট রঙের কিছু অংশ।

রাস্তা কই? ইতিউতি চেয়ে আমিও হতবাক। চোখের সামনে ধুমসো গতরখানা নিয়ে দিব্যি দাঁড়িয়ে আছে দুর্গ। কিন্তু দুর্গের অন্দরে ঢোকার কোনও পথই নেই। লম্ফঝম্প করে এদ্দূর এসে ফিরে যেতে হবে? পিচের রাস্তাটা তো অনেক নীচে নেমে গেছে। আর দুর্গের দিকে উঠে যাওয়া পথ দূর্গের গায়েই শেষ। তাহলে ভিতরে যাবার পথ? রাস্তায় একটি-দুটি গাড়ি আর মাঝেমধ্যে একটি করে বাস ছাড়া কারও দেখা নেই। দোকানের চৌহদ্দি কিছুটা আগেই ফেলে এসেছি। আবার হয়তো আমরা ভুল পথে চলে এসেছি। অগত্যা, পেছোনো ছাড়া আর পথ নেই।ঞ্জআরে, ওই তো দুটো স্থানীয় ছেলে আর একটা বউ আসছে। ওদের জিজ্ঞেস করতেই মোরনি দুর্গে পেৌঁছোনোর সঠিক পথটা বাতলে দিল। পুলিশ চৌকির গা ঘেঁষে রাস্তা উঠেছে। খানিকটা চড়াই উঠতেই বাঁ-হাতে লাল-হলুদ-সবুজের তুলিটানে শিবমন্দিরের অবস্থান। পাশেই দুর্গের বিরাট ফটক।

দুর্গের গায়ে প্রস্তরফলকে মোরনি ফোর্টের জন্মবৃত্তান্ত। এই দুর্গটি মিরজাফর আলির উত্তরসূরিদের। কিন্তু কোনও এক কারণে দুর্গটি হস্তচ্যুত হয়। হরিয়ানার ফরেস্টস টুরিজম, এনভায়রনমেন্ট, স্পোর্টস অ্যান্ড ইউথ অ্যাফেয়ার্সের মাননীয় মন্ত্রী শ্রীমতী কিরণ চৌধুরি এই দুর্গটিকে নতুন করে সাজিয়ে তোলেন।

বিশাল ফটকের গায়ের ছোট্ট পাল্লাটা খুলতেই শিশু-বুড়োর কলতানে মুখরিত এক অন্য জগৎ। কেয়ারি সবুজ, রঙিন চেয়ার, বাহারি সোয়েটার-জামা-টুপিতে মোড়া মানুষের এ এক আনন্দ উদ্যান। সত্যি বলতে কী, প্রথম চোটে একটু ধাক্বাই খেয়েছি। ‘দুর্গ’ শব্দটা শুনলেই মনের মধ্যে ছায়া ছায়া কিছু ঐতিহাসিক মুহূর্ত ভেসে ওঠে। সেসব দিন চোখে দেখিনি ঠিকই। ইতিহাসের পাতায় তো পড়েছি। আর তখনই মনের ক্যানভাসে সিপিয়া টোনে আঁকা হয়ে গেছে যুদ্ধ, ঢাল, তরোয়াল, বল্লম আর শত্রুর মোকাবিলা করার জন্য যোদ্ধা রাজাদের দুর্গে এসে লুকিয়ে থাকা। কিন্তু ময়ূরীমহলের এই দূর্গের বাইরের প্রাচীন পাথুরে শরীরটার সাথে ভিতরমহলের বিশেষ সাদৃশ্য নেই। হাতে হাতে বল, উড়ে চলেছে দুর্গের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত। পুরোনো ঘরগুলো হাল আমলের রংবাহারে কোনও সাজানো হোটেলকে মনে করিয়ে দেয়। কিন্তু ইতিহাস কই? বর্তমানের চাকচিক্যে কি সবই কালের কবলে? নাহ্! সবটা নয়। চোখ পড়ল একদিকে। কেউ যেন বলল, ‘এদিকে আয়, আমাকে পাবি’। ইতিহাসের ছাত্র বলেই কি না জানি না, প্রাচীন ভাঙা ইটের স্তূপ দেখলেই কেমন যেন অতীতের ছায়ামানুষের গন্ধ পাই। মূল ফটকের বাঁ-হাতের সোজাসুজি হেঁটে কিছুটা সিঁড়ি বেয়ে উঠে এক হাওদামহল।উঁকি দিতেই হারাদিনের ইতিকথারা ফিরে এল। মেটেরঙা দেয়ালে ছোটো ছোটো খোপ কাটা। সেইসময় ভিতর থেকে বন্দুক তাক করে শত্রুর সঙ্গে মোকাবিলা করা হতো। ইতিহাসের সুবাস গায়ে মেখে চৌকোমতো দোতলা মহলটা এখনও দাঁড়িয়ে। মাঝখানের সবুজ চাতালে ঝুরি নামা প্রাচীন বৃক্ষ। হাল আমলের জীবনযাপনের মাঝে সে যেন ধম্মের ষাঁড়ের মতোই তার অস্তিত্বকে টিকিয়ে রেখেছে। বিকেলের রোদ ছিটোনো নবীন-প্রবীণের মিলনচত্বরটায় ঘুরে বেড়ালে, ধীরে ধীরে মন শান্ত হয়। এখানে ইতিহাসের সাথে বর্তমানের কানাকানি চলে অবিরাম।

শিবমন্দিরের পাশে দাঁড়ালে পাখির চোখে দেখা হয়ে যায় মোরনি গ্রামটিকে। পাহাড়ের মাথা থেকে এক-দেড় কিলোমিটার। স্থানীয় মানুষের মুখের ভাষায় মোরনি ‘গাঁও’ হলেও, বাড়িঘর ইট-কাঠের তৈরি। রাস্তা আর খাদের সীমারেখা ধরে হাঁটতে থাকলে বেশ কয়েকটা হোটেল মিলবে। ঢলে পড়া বিকেলের কাঁচা হলদে আলোয় মাথায় কাঠবোঝাই করে মানুষজন এখন গাঁয়ের পথে। পশ্চিমের আকাশে আগুন গোধূলি। এখানে কয়েক দণ্ড দাঁড়িয়ে সূর্যাস্ত না দেখলে জীবনের রসাস্বাদনের অনেকটাই অধরা থেকে যাবে।

মাউন্টেন কোয়াইলসের চৌহদ্দি থেকে অস্তগামী কুসুমসূর্যটা এক্বেবারে আমাদের চোখের উপর চোখ রেখে যেন মেঘের সাগরে ডুব দিল। সন্ধে যত নামল, জংলি ঝিঁঝিঁ শব্দটাও দিকদিগন্তে চারিয়ে বসল। আকাশভরা তারার নীচে চলল আমাদের নিশ্চুপ আড্ডা। মাঝে মাঝে কয়েকটা কথার আলাপ। রাতের পাতে খোলা আকাশের নীচেই লাচ্চা পরোটা আর কড়াই চিকেনের আমেজ। সঙ্গে চিকেন তন্দুরির স্যাঁকা উষ্ণতায় জবুথবু ক্লান্তি নামল ঘুম হয়ে।

পুবদিগন্তে আলোর ঢেউ। ঘুম জড়ানো চোখের তারায় ভোর আকাশের মায়া। ঘরে কাচের জানলাটা হাট করতেই পাহাড়ের ঘুম ভাঙল। ধীরে ধীরে স্বর্গের আলো নেমে এল মোরনি পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে। মনে হল, স্বপ্নপুরীর রাজকন্যে সোনার কাঠি ছুঁইয়ে দিল। ফুটে উঠল ছোটো ছোটো বসতি। হঠাৎ খেয়াল হল, একটাও ছবি তুলিনি। অথচ এর জন্যেই এতো সক্বাল-সক্বাল উঠে আয়োজন। মোহিনী রূপের জাদু বুঝি একেই বলে!

লোটাকম্বল গুটিয়ে সাড়ে সাতটায় ইনোভার গদিতে হেলান। দিল্লি ফেরার পথে মোরনি পাহাড়ের টিক্বর তাল দেখব। সেখানেই কী ময়ূর-ময়ূরীর দল নেচে বেড়ায়? কে জানে? রায়পুরানির রাস্তাটা আগেই ডানহাতে বেঁকে যাবে। কিন্তু সে পথে গেলে টিক্বরের টিকিটিও ছোঁয়া যাবে না। তাই সাড়ে দশ কিলোমিটার পাহাড় নেমে পাশাপাশি দুটি তাল বা লেক। প্রথমটিতে মাছের চাষ। এটা ছোটা টিক্বর তাল। পাশেই প্রাচীর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে এক সবুজ টিলা। তাকে টপকালে বড়া টিক্বর তাল। পাহাড়মেশা দিগন্তজুড়ে তালের বিস্তার। কুয়াশায় আবছা ঘন সবুজের চাদর মোড়া লেক-পাড়ের তরঙ্গায়িত নাতিউচ্চ পাহাড়। পাড়ে হরিয়ানা টুরিজমের টিক্বর তাল টুরিস্ট রিসর্ট। সংলগ্ন অঞ্চলটায় জলখাবার খাওয়ার এক নিরিবিলি বসার জায়গা। ওখানেই ব্রেকফাস্টের অর্ডার দিয়ে সোজা তালের কাছে। জলের পাড়ে নাম-না-জানা পাখির চরাচর। বোটিংয়েরও সুব্যবস্থা আছে। হরেক রঙের হংসমুখী জলবিলাসী তরণিগুলো তালের তীরে থমকে আছে। ধূমায়িত চায়ের কাপে একটা আলতো চুমুক। ঠিক সেই মুহূর্তে ডানায় হাওয়া কেটে ভেসে যাবে হালকা শীতে উড়ে আসা পরিযায়ীর দল। দূরের জনপদ, সবুজের ঢেউ খেলানো পাহাড়ি টিলা, ভেসে চলা মেছো নৌকো আর সদ্যফোটা সকালের শিরিন আলো– তিরতিরিয়ে কাঁপতেই থাকবে টলটলে অতলে। মোরনির অথৈ রূপের ঢালা লাবণ্যে সত্যিই মনে হবে, ‘হূদয় আমার নাচে রে আজিকে…’। রঙে রূপে এই অচেনা ঠিকানা সত্যিই যেন বন্য মোরনি। বুঝলাম, মন আমার ভুল দাবি করেনি। লম্বা কোনও টুরের শেষে ভ্রমণক্লান্ত বেলা কিংবা কর্মসূত্রে দৌড়ে আসা রাজধানীর পাট চুকিয়ে গাড়ি নিয়ে চলে আসার। তারপর দুটো দিন, জল-জঙ্গল-পাহাড়ের মিলমিশে হরজাই হরিয়ানার মন ভোলানো এ নিরালা ময়ূরীগহন… এখন আপনার অপেক্ষায়।

হর্ষ-বিষাদের মেলা পরকুল

খাতড়া থেকে পরকুল দুই ক্রোশ পথ। নির্দিষ্ট কোনও ছক নেই যাওয়ার। ফলে অধিকটাই চাষ মাঠের আল ধরে হাঁটা। সেখানে কাঁসাই নদীর পাড়ে এই মকর সংক্রান্তির ভোর থেকেই টুসু মেলার আয়োজন শুরু হয়েছে। জানুয়ারির মাঝ বরাবর মুকুটমণির জলাধার থেকে ঠান্ডা বাতাস মারছে। সেই বাতাস উপেক্ষা করে গোড়াবাড়ি, অম্বিকানগরের মেয়ে-পুরুষের দল গাঁ উজাড় করে হাঁটা ধরেছে। লক্ষ্য পরকুল। এদিকের দূর গ্রাম ইস্তক পরকুলের টুসু মেলার খাতির। আর মেলা যাত্রীর মুখে মুখে লুটিয়ে বেড়ায় টুসু গান– ‘মেলা লাগেঁছে পরকুল য চালতা বনে শ্যাম ডাঁড়াঞ্চ য লুটতে চাহে জাত কুল য ও পিসিলো…।’ হরিজনের এই টুসু-মিছিলে পা জুড়েছি আমরাও। মকরের ভোর। মাঠ-ডহর ভিজে সারা রাতের শিশিরপাতে। হাড় হিম শীতের বাতাস। আর এই সর্পিল মিছিল চলেছে সরষে ফুলের কেয়ারি ভেঙে। মেয়েদের মাথায় টুসু ঠাকরুনের সুসজ্জিত চৌদল। নানা বর্ণের কাগজে বানানো সিংহাসনে উপবিষ্ট কন্যা। শ্রমজীবী সন্তানের ঘরে ক’টা দিন কাটিয়ে আজ কাঁসাইয়ের গর্ভে তার শ্বশুরঘরে প্রত্যাবর্তন। বেদনার্ত দিনটিকে দলিতজনের আনন্দের আবহে মুড়ে উদ্যাপন। টুসু পরব ঘিরে কুর্মি, মহালি, মেটে, বাগদি, বাউরি ঘরে দেশজ পিঠা, ব্যাঞ্জন, মাংস, মদের যথেচ্ছ ব্যবহার।

সেসব রাতের আয়োজন। এখন এই কবোষ্ণ রোদ ঝলমল সকালে সকলের পায়ে একটাই ঠিকানা– কাঁসাই চর। সেখানে মেলা-খেলা, নাচ-গান-দারু পান জুড়ে আনন্দ সওদার পাইকারি বাজার। চলতে চলতে চন্দ্রমোহনকে বাগে পেয়ে যাই। সাত সকালেই গলা জলে ভাসছে সে। মানুষটার ডেরা রানিবাঁধ। অনেকটা পথ। মকরের দিনে পথে যানবাহন নেই। মাঝে মাঝে মানুষের হল্লা-ট্রাক ছুটে যাচ্ছে পরকুল অথবা অম্বিকানগরে কুমারী নদীর ঘাটে। সেখানেও যে মেলা লেগেছে। সংক্রান্তির বড়ো মেলা পরকুলের কাঁসাই চরে। চন্দ্রমোহন খাতড়ার মোড়ে নেমে পরকুলে পা মিলিয়েছে। আর গলা মিলিয়েছে গানের কোরাসে– ‘হামার টুসু কাজ জানে নাই ননদ দিল্য গঞ্জনা য টুসু রানি মান করেছে শ্বশুরঘরকে যাবে না।’ গান ছেড়ে অবাধ্য পায়ে নাচ ধরল ক্ষ্যাপাটা। বগলের বোতল থেকে আরও খানিক দম-পানি গলায় ঢালল সে। তারপর কপট বিরক্তি নিয়ে বলে, ‘এ দ্রব্যে ধক্ লাগছে নাই। বাবু-পয়সায় ল্যাশা না খাঁলে দম চড়া লাগব্যে নাই। হঁ গ বাবু লঁকট, পার্বণী দিবে কি ন?’ পয়সা উশুলের এই এক ফিকির ওদের। বলি পরবের মেলায় পেৌঁছে তবে না পার্বণী।

মদ ফুর্তির ব্যবস্থা পাকা করে সে ভিড়ের দমকে ভেসে গেল। এই হরিজন মিছিলে এক হারালে আর-এক এসে ধরা দেয়। চন্দ্রমোহন গিয়ে সূরজ সিং-কে পেলাম। ভূমিজ সমাজের মানুষ। কালো পালিশ গায়ের রং। একেবারে জট পাকানো স্বাস্থ্য। গোঁফটি বেশ পুষ্ট। অযত্নে অনাদরে অনিয়মে এই গড়পড়তা শরীর-স্বাস্থ্য রাঢ় দেশের মানুষের। চলতে চলতে বলতে থাকে, তার জমি নাই। কাঁড়া (মোষ) বলদ নাই। নিজস্ব হাল নাই। বাবুর জমিতে চাষ দেয়। ‘একশো দিনের রোজগারে যাও না?’ ‘শরীর অত লিঁব্যেক নাই দাদা। হামি বাবু ঘরে খেতি করলাম, পরিবারটি গেল শতক দিনের রজগারে।’ এ ভাবেতে উপায়দারী।

চন্দ্রমোহন সরেন আর সূরজ সিং দু’জনার জীবনের মতলবে কতটা ফারাক। এই মানুষটা তার স্ব-উপার্জিত পয়সায় মেলার ফুর্তি কুড়োতে এসেছে, আর চন্দ্রমোহন মহাজন থেকে কর্জ নিয়ে পার্বণের তাপে তপ্ত হতে এসেছে। এভাবেই যত মানুষ, তত ভিন্ন স্রোতধারা এই মানব প্লাবনে। ভাবছিলাম আর হাঁটছিলাম। পাশের এক বৃদ্ধ সহযাত্রী সুধান, ‘পরকুল পরবেতে লুতন মুখ লাগছে যে?’ হ্যাঁ, আমরা নতুনই বটে। ‘মেলা যাত্রাটি কেমন লাগছে বলত?’ ‘দেদার লাগছে।’ বৃদ্ধ ওরফে হরিহর মাহাতো বলেন, ‘দেখ বাপু, অ্যাই রাঢ় দুনিয়ার হরিজন ঘরেতে অভাব, কষ্ঠ আমাদের নিত্য ভগবান। কিন্তুক পরব লাগলে কড়ি ফটকা মানুষগুলাকে দেখছ ত? উদমষাঁড়ি হয়ে ছুটছ্যেন। জীভনে দুখ্ তো থাকতেই লাগবে। ফুর্তি তামাশাটুকু তাঁড়্যে লিঁতে হবে। এইটুকু আমার পাওয়া।’ হরিহর বুড়োর বচনটুকু বহু যত্নে মনের ভল্টে জমা পড়ে গেল। পরকুলের ধারে এসে পড়েছি। এদিকে মাঠে ফুটেছে প্রবল সরষে ফুল। দূরের মাঠ থেকে অপস্রিয়মাণ কুয়াশা। বহুবর্ণ সাপের মিছিল এগিয়ে চলেছে টুসু গানের কোরাস গলায় ধরে। মেয়েদের মাথায় ধরা ঠাকরুনের চৌদল।

পরকুলের লাল মাটি ফুঁড়ে হঠাৎ যেন নদীটা কিলবিলিয়ে উঠেছে। নদী কংসাবতী। তার দু’পাড়েতে হলুদ ফুলের ঢেউ লেগেছে। নদীর পুলিনে বেশ খানিক জায়গা চৌরস করে মেলার প্রস্তুতি চলছে। দিন এখনও সাবালক হয়ে ওঠেনি। সবে দশটা। বাঁশ দড়ি ত্রিপল তাঁবুতে দোকান গড়ার প্রস্তুতি চলছে। তারই একটিতে গিয়ে উঠেছি চায়ের সন্ধানে। দোকানির নাম ঠাকুর কালিন্দী। পায়রাচালির এই ঠাকুর প্রতি পরকুলেই দোকান বসান। তিনি বলেন, ‘চা হবে, টুকু দম ধরথ্যে লাগবে।’ ‘সে-টি পারব না ভাই। এতটা পথ হেঁটে বে-দম হয়ে পড়েছি।’ ‘তাহলে্যঁ বসেন, চুলায় আগুন মারি। কিন্তু মেলার চেহারা তো ছরকট লাগছে ভাই। পরকুল জাগতে আর টুকু টেম লাগবে। ত্যাখন দমে ভিড়। অ্যাই দকানের টুঁইয়েতে (শিখরে) একট চির (পতাকা) উড়বে, বিবেচনায় লিঁবেন উয়াঁই ঠাকুর কালিন্দীর নিশান।’

কাঠের চুলাতে আগুন দাপিয়ে উঠেছে। কেটলির ঠোঁট দিয়ে গরম ধোঁয়ার কুণ্ডলী। ঠাকুর নিবিষ্ট মনে চা করেন আর কথা বলেন। তারপর কাচের গেলাসে খয়েরি তরল ঢেলে দেন এবং একটি টিনের পাত্রে নিজেও একপ্রস্থ নেন। রৌদ্রের মেজাজ চড়ছে। আমাদের গরম পোশাক ঠাকুরের হেফাজতে রেখে দেওয়ার ব্যবস্থা পাকা করে বেরিয়ে পড়ি।

ঠাকুর কালিন্দী কিছু মিছা বলেননি। বেলা চড়তেই বাঁধ ভাঙ্গা জল যেভাবে ঘর বসত ভাসিয়ে নিয়ে চলে, এ যেন তেমনই কতকটা। দূর প্রান্তরের শিরা-উপশিরা ধরে মানুষ ঢুকছে পরকুল মেলায়। নদীর মাথায় স্তম্ভিত দাঁড়িয়ে দেখি। কাঁসাই চরে ঠান্ডা বাতাস মারছে। মেয়েদের মুখে গানের বিরাম নাই। পায়েতে নাচের অন্ত নাই। মাথায় চৌদলে টুসু দেবী দেখেন বসে মানুষের পাগলামি। মেলার দোকানগুলি সেজে উঠেছে পণ্যে– কাঠের সরঞ্জাম, লোহার বস্তু, প্রসাধনী থেকে বস্ত্রবিপণি। ভাজা, মেঠাই, পোশাক, জুতো, খেলনা, পাঁচমুড়ার হাতি ঘোড়া থেকে বিষাণ শিল্প, সবংয়ের মাদুর, রাজগ্রামের গামছা, বিকনির ডোকরা শিল্পের সুনিপুণ বিজ্ঞাপন।

কতক গরম লবঙ্গলতা শালের পাতায় নিয়ে বসেছি মেলার মেঠাই শপে। সেই হলুদ লবঙ্গ ধুলোর চাদরে মোড়া। চায়ে কাঁসাইয়ের বালি। আর আছে মানুষের শ্রমের গন্ধ, প্রাণের আনন্দ। চারপাশে মেলা যাত্রীর ভিড়ের চাক। খুশির ফোয়ারা উড়ছে চারিদিকে। মাদল ধমসায় দল ঢুকল মিঠাআম গ্রামের। মানুষগুলি মদের পালিশে মদন-চড়া হয়ে আছে। মদাসক্ত মেয়েরাও। ওই যে মেয়েটি চৌদল মাথায় নিয়ে নাচে আর গায়, তার স্খলিত আঁচলটি ধুলাতে লুটায়। পায়ে পায়ে জড়িয়ে সে বহু দূরে যায়। নাচের উন্মাদনায় তার কোনও সম্ভ্রম বোধ নেই। তাকে জড়িয়ে ধরে ঝপকা চুল দাড়ির পুরুষটিও নাচে। আর রেগডা বাজছে। ফ্লুট, মীরকোষ। মানুষের পিন্ড জমা হয়েছে। নৃত্যরত নারীর শরীর থেকে বিচ্ছুরিত অগ্ন্যুৎপাত দেখি আর ভাবি, এই টুসু দেবীর নিরঞ্জন পর্ব! ওই কাঁসাইয়ের গর্ভে তার স্বামীগৃহ। আলো মরে এলে দেবী জলে পড়বেন। জল-ঘরে শুয়ে তাঁর শরীর থেকে ধুয়ে মুছে যাবে জীবন-যৌবনের চটক। তারপর শুধু খড়ের মৃতদেহ। মানুষের জীবন পর্বের অন্তিমও তো তাই। আগুনের নদীতে দহনে দহনে ভস্ম হয়ে যাওয়া।

মেলার একপাশে দাঁড়িয়ে ছুরি কাঁচি কোদাল কুড়ালে শান তুলছিল ঝামেলা সহিস। রোগাটে মানুষটার ভাঙা গালে বে-মানান গালপাট্টা, চুনট করা চুল, খর দৃষ্টির চোখ। ‘তোমার নাম ঝামেলা কেন ভাই?’ সে এক চটকা হেসে বলে, ‘আমার আসলি নাম ছিল লখন সহিস। কাঁসাই নদীর সে ধারে বেলবনি গাঁয়ে থাকা হয়। গাঁয়েতে ঝামেলি করতাম হামেশা। আমি ছিলম সিঁধল চোর দাদা, ‘মানুষটার অকপট স্বীকারোক্তি।’ দু’পাঁচ গাঁয়ের লঁক দিশাহারা হঁয়্যে পড়ল আমাকে লিঁয়ে। বুঝাঁল সুঝাঁল, কিছু হঁল্য নাই। ‘কেন করতে এই অপরাধ?’ ‘গন্ডগল ত সিখানেই। উয়াঁ যে উচিত কর্ম নহে বুঝথে লারছি। পেটে ভখ্ (ক্ষুধা) থাকলে ভাখ বাগাতে লাগবে। ঝামেলাকে কেহ কাজ-কাম দিবেক নাই তো রাইতে সিঁধ কাটতে লাগলম। ধরা পড়ে হাজত ভি হঁল্য। দু-পাঁচ দফা হাজত করার পর গাঁয়ের মন্ডল সালিশি বসাল। আমাকে ডাকা করে মুরুব্বি লঁক বুঝাল-ইয়াঁ অধর্ম কর্ম, ছাড়ান দে ঝামেলা। আমার ভি উলটা সওয়াল– তা হঁল্যে খাব কি? কাজকর্ম কে দিব্যে ঝামেলাকে? প্রধান গেরেন্টি দিল, আমি দেখব। তু চুরি ছাড়। সেই থাকতে এই পথ ধরলম।’ চুরি ছাড়লেও চুরির পথ ছাড়তে পারলে না ঝামেলা ভাই?’ সে হেসে বলে, ‘ওই দেখেন, ঝামেলি ছাড়লেও নাম ট ঝামেলাই রহে গেঁলি যে!’ ‘ওটা তোমার উপাধি হয়ে গেছে। তোমার সম্মান।’ কথাটা না বুঝে সে হাসতেই থাকল। আমি ভেসে পড়লাম মানব দরিয়ায়।

দুপুর টলে পড়েছে। ভিড়ের দাঁপ বেড়েছে হাজার গুন। ঠাকুর কালিন্দীর দোকানের নিশানাটা মানুষের মাথা ছাপিয়ে ফরফর উড়ছে। শর্ত মোতাবেক সঙ্গীরা সব শীত পোশাক ঠাকুরের দোকানে জমা করে নিজের মতো করে মেলায় ভেসে পড়েছি। ফের সামিল হব ভাঙা বেলায়। এখন ভরা কোটাল লেগেছে মেলায়। কাঁসাই নদীতে স্নান সেরে, নতুন বস্ত্র পরে খেটেল মানুষ নদীর চরে সপরিবারে আহারে বসেছে। নদীর জলে মুড়ি ভিজিয়ে, গুড় কদমা ফেনি বাতাসায় মেখে পার্বণের আহার। চেয়ে থাকি অপলক। পল্লী ঘরের অ্যানিমিক মানুষগুলির পরব-ভোজ কত যত্নবান গ্রাসে। আমাদের শহরের ফেস্টিভ ফিস্ট মনে পড়ে যায়। তাদের পান-ভোজনে কত অপচয়, মদ-মত্ততায় কদর্য প্রকাশ। এখানেও মত্ততা আছে। নাচ-গান-পানে তূরীয় আনন্দ আছে। সেই আনন্দের বাজে খরচ নেই। দলিত মুখগুলিতে খুশির ঝিলিকে যে দ্যুতি, শহরের ফেয়ার অ্যান্ড লাভলি ফেস-এ তার কণামাত্র নেই। একান্ত সেই ভাবনার মুখে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরল চন্দ্রমোহন সরেন, ‘চলেন দাদা!’ ‘কোথায় ভেগেছিলে হে?’ ‘ভাগব কুথা? আজ-দিন যে একটাই ঠেক্ পরকুল।’ মানুষটা আমাকে মহা প্লাবনের স্রোত দু’হাতে ঠেলে এগিয়ে নিয়ে চলল কোন জাহান্নামে জানি না! দাগি নেশাড়ুটা আমাকে টেনে এনে পৌঁছে দিল যেন মদন গঞ্জের ঘাটে। মেলার উত্তরপ্রান্তে জাঁকাল ভাবে পড়েছে মদ-মচ্ছবের আসর। ধাতব পাত্রে হাঁড়িয়া নিয়ে বসেছে গন্ডা পাঁচেক সঁড়ালে যুবতি। মদের সঙ্গে আছে অনুষঙ্গ। হরিজন মানুষ শালের দোনায় ভরে রস পানি খায় সঙ্গে কবুতর মাংস, চানা-বুট, কাঁচা মরিচ। সংসারের জ্বালা যন্ত্রণা হরক এ-ই ওদের পেইন কিলার। চন্দ্রমোহন বলে, ‘দাও দাদা পরব খর্চা। তুমি যত পার খাও, পয়সার কথা তো নয়।’ সে নিশ্চিন্ত হয়ে দাবড়ে বসে পড়ে মন ভুলাইয়া আসরে। এখন বেলা-ডোবা আলোয় মুখে মুখে ফিরছে একটাই গান– ‘হামার টুসু জলকে যাবে য আর ত ফিরে পাব না।’

সরষে ফুলে আগুন ঠুকে সূর্যটা টলে পড়েছে পশ্চিমের মাঠে। মেলা-যাত্রীর পায়ে এখন ভাটির টান। ওদিকে মাইকে লাগাতার ঘোষণা চলছে নিরুদ্দেশের– ধবনির লীলাবতী মাহাত, উমর রজ্জ যিখানে থাক…। হলুদকানালির কমলা হাঁসদা, চ্চ্ বছর, তুমার স্বামী মেলা অপিসে বসে…। লক্ষ্মীসাগরের সনামন…। চন্দ্রমোহন হঠাৎ ডুকরে ওঠে, ‘অই দেখ দাদা! আমার মাল্তিটাও দু’বছর আগেতে পরকুলে হাঁরায়েন গেঁলি। আর ফিরলিঁ নাই।’ ওকে বোঝাই, ‘এদের অনেকেই যে সংকল্প করেই হারায় চন্দ্রমোহন। তোমার কোনও কসুর নেই। ভালোবাসা নামক এই পাখি কার পিঞ্জিরা ভেঙে উড়ে বসে কার চালে কে বলে!’ পাতলা বোধের মানুষ অত শত বোঝে না। সে দোনা ভরে মদ খায়, আর বুক উজাড় করে কাঁদতে থাকে। তরল দ্রব্য গুনে মালতির অতীত ওর উপরে যত চেপে বসে, বিলাপ বাড়তে থাকে। মদের হিসেব চুকিয়ে আমি ফের ভেসে পড়ি মানব সাগরে।

ছায়ায় ঢেকেছে কাঁসাই চর। কাছে-দূরে দিনের রং মুছে গিয়ে সব সিল্যুট। মানুষগুলিও তাই। প্রকৃতির কালোয় ঢেকে প্রাকৃত জন এখন ঘরমুখো। সারাদিন ধরে এক মুঠো খুশি সওদা করে মানুষ ফিরে চলেছে তাদের চিরাচরিত তমশাচ্ছন্ন বিবরে। কাঁসাইয়ের বুকে ভাসছে ভগ্ন চৌদল। ঠান্ডা নামছে ঘন করে। মেলা প্রাঙ্গণ এখন যুদ্ধ শেষের রণক্ষেত্র। শুধু একপাশে মানুষের ভিড় এখনও। দ্রুত পায়ে এগিয়ে যাই। দেখি, ওখানে আবার কীসের তামাশা।

ঝান্ডির আসর পড়েছে এখানে। অর্থাৎ জুয়া কল। তাকে ঘিরে মানুষের চাক। তাদের কারও হাতে কাঁচা নোটের তাড়া, কারও খুঁটায় বাঁধা মহাজনি কর্জর টাকা, কেউ গাই-কাঁড়া বেচে দিয়ে সে টাকায় দান লাগাতে এসেছে। আমি জরিপ করি উৎকণ্ঠিত মানুষগুলির চোখ মুখ। বড়ো এক কাঠের ডাব্বায় নম্বর লেখা ছক্বা-পাঞ্জা ঘুঁটির মতো বড়োসড়ো এক ঘুঁটি ঝাঁকিয়ে ফেলা। যে নম্বর পড়ল, সেই নম্বরে যে আইটেম উঠবে, জুয়াড়ির ভাগ্যে সেটাই জুটবে। সেখানে সস্তা বিস্কুটের প্যাকেট থেকে ঘড়ি, ক্যামেরা, সাইকেল, টিভি, নানা প্রসাধনী সবই আছে। প্রতি পাঁচ টাকার দানে সকলেরই প্রায় জুটছে সস্তা আইটেম। কেউ বা ফিরছে শূন্য হাতে। বোঝা গেল কারসাজির চক্বরে পড়ে গেছে মানুষগুলি। দলিত মানুষ একটু সৌভাগ্যের আশায় তার সামান্য সঞ্চিত অর্থটুকু এই ঝান্ডির আগুনে ঢেলে দিয়ে নিঃস্ব হচ্ছে। তারপর ভেঙে পড়ছে অনুশোচনায়।

পাকড়াও করি মলিয়াড়ার ধনঞ্জয় মাহাতকে। ভাগ্যচক্রে পড়ে শ’তিনেক টাকা খুইয়ে সে বসে পড়েছে। ওইটুকু অর্থ শ্রম লগ্নি করে সে সঞ্চয় করেছিল। ভাগ্যদেবতা কেড়ে নিল। ওকে বলি, ‘ওই অর্থে সপরিবারে ক’দিনের মাংস-ভাত হতো। লোভ দমন করলে ওই খুশিটুকুন সকলে মিলে উদ্যাপন করতে পারতে। কি বলো ধনঞ্জয়?’ ‘কি বলব্য দাদা!’ তার গলায় হতাশা। ঝান্ডির টাকা মেটাতে না পেরে জগৎ খাটুয়ার সাইকেলটা জমা পড়ে গেল ঝান্ডিদারের হাতে। চোখের সামনে ঘটল ঘটনা। দুষ্টচক্রে পড়ে অভাবী জন কীভাবে নিঃস্ব হয় দেখি। জানতাম না আনন্দের নেপথ্যে টুসু ঠাকরুণ বিষাদের জাল বিছিয়ে রাখেন। সে জালে জড়িয়ে নিঃস্ব করে দেন হরিজন সমাজকে!

ভাঙা মেলার ফাঁকা মাঠে মানুষটা অনেকক্ষণ থেকেই ঘুরছিল। হঠাৎ কানে গেল তার কণ্ঠ, ‘আমাকে এট্টু পথ দেখাবে মশায়রা?’ তাকিয়ে দেখি গেরুয়াধারী এক উদাসী ফকির। পড়ন্ত বয়স। চুল দাড়ি অধিকটাই ধূসর। দিক্-হারা মানুষটার কাছে গিয়ে জানি, সে একটি চোখ হারিয়েছে। অপর চোখেও নজর কম। ‘এই জনহীন পথ ধরে তুমি যাবেটা কোথায়? কী পথ দেখাব তোমায়? আমরাই যেন নতুন বাবাজি!’ বাউলটির নাম জানলাম দীনদয়াল গোস্বামী, পাথরচাপুড়িতে তার আখড়া। ‘তা এখানে কীভাবে এলে?’ সে হেসে বলে, ‘পথের সন্ধানে বাবা! আমরা সদাই যাহাকে ধেয়ানি সে যে মানী লোক গো বাবু মশায়। তাহার স্বরূপটি জানতে দেখতে ছুটে চলাই সাধু সমাজের দস্তুর গো।’ দীনদয়ালকে সঙ্গে করে মাঠের পথে পা বাড়ালাম। সে পথ তমসাচ্ছন্ন। তাকে বলি, ‘এ পথের যে সিকি ভাগও চিনি না, কোন পথে এগোই বলত?’ ‘চলতে চলতেই পথ খোলে গো মশায়রা। শুধু এট্টুখানি ধরতাই পেতে লাগে। সেই ধরতাইটুকু যে দেয় সেই যে পরম সাঁই। তোমরা যে আমার সেই কাজটাই করে দিলে মশায়বাবুরা।’

মেলা যাত্রীরা অনেক আগেই চলে গেছে। শীতের কামড় অতটা আর গায়ে লাগছে না বাউল সঙ্গ করে। পাথরচাপুড়ির মহাজনটি আমাদের সঙ্গে। তার সাধু বচনে তপ্ত থাকি। আমাদের এক সঙ্গী প্রশ্ন করে বসে, ‘যে পথ চলছি সে-টি যে তোমার সঠিক গন্তব্য জানবে কেমন করে?’ সওয়ালের পিঠেই জবাব দীনদয়ালের, ‘দিগন্তহীন সাগরে জাহাজটি ঠিক দিশায় চলে কী প্রকারে? তারও তো এক গুরু আছে, যে সঠিক পথটি চিনিয়ে দেয়। আমাদের মনের কম্পাসটিও তেমনি, তেনার নির্দেশ মতো চলে। চলায় ফারাক ঘটলে যন্তর নির্দেশ দেবে। আমাদের বাউল বৈরেগীদের কানেতে শ্রবণ, পায়েতে দর্শন। পা পথটি দেখায় আর চলায়।’ আমার সঙ্গীটি এক লঘু তামাশ করে বসে। সে সুধায়, ‘যাকে ধেয়ানো তাকে চেনো গোঁসাই?’ দীনদয়াল শব্দ করে হেসে ওঠে এবারে। ‘এ কি বে-আন্দাজি তির মেরে বসলে মশায়বাবু। আলো-অাঁধারিকে চিনতে লাগে? সে যে আপনি এসে চেনায়। অন্তরের সাঁইটিও তাই। সে আপনি এসে চেনা দেয়। ভিতর দেউলে আপন গড়ন দেখায়। তাকে সাধন, পূজন, ভজনে ধরে রাখতে হয়। তাঁকে হূদ্মাঝারে রাখব ছেড়ে দেব না।’ ওই হল কথা।

কথায় কথায় মাঠ ছেড়ে সড়কে এসে পড়েছি। অদূরে খাতড়া বাজার। ওখানেই এক শিষ্যঘরে রাতটুকু গুজরান দিয়ে গোঁসাই ফিরে যাবে তার আখড়ায়। আমরাও রোডে উঠে একটা গাড়ির ব্যবস্থা করে ফেলেছি। গন্তব্য মুকুটমণিপুর। দীনদয়াল বলে, ‘দেখ্লে তো, পারঘাটায় একবার পহুঁছে গেলে ফেরির অভাব ঘটে না।’ তুমিও ওঠো। এই ঠান্ডায় হাঁটবে কেন? খাতড়া ইস্তক মাইলটাক পথ খাটো করে দিই।’ দীনদয়াল প্রস্তাব ফিরিয়ে দেয়। বলে, ‘না বাবুমশায়রা। মাথার উপরে বেলে চাঁদ ভাসছে ও-ই আমাকে উতরে দেবে। আমরা হলাম চলনদার লোক। তেনার চরণদাস। শরীর মনকে সর্বদা বিবিধ পরীক্ষায় রাখতে হয়। তোমরা উঠে পড়ো। কল্যাণ হোক। জয় রাধামাধব!’ এর পরে আর কথা বাড়িয়ে লাভ হবে না বুঝে উঠে বসি। গাড়ি ছেড়ে দেয়। এক সময় পিছন ফিরে দেখি কঠিন ঠান্ডায় চাঁদ-কুয়াশার গভীর নির্জন পথে হেঁটে চলেছে পাথরচাপুড়ির সহজিয়া গোঁসাই। এ তার কার কাছে কী পরীক্ষা, বুঝে উঠতে পারি না।

গঙ্গোত্রী থেকে অন্য পথে কেদার

সন্দেহ ছিল উত্তরকাশী আজ পৌঁছোতে পারব কিনা? হলও তাই। ঘটনাচক্রে পড়ে পৌঁছোতে পারলামও না। ফলে কেদারযাত্রার পথে পিছিয়ে গেলাম অনেকটাই। Gangotri  মন্দিরে লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে পুজো দিতেই লং-টাইম অতিক্রান্ত। হোটেল থেকে লাঞ্চ সেরে সকলকে ডেকেডুকে গাড়িতে তুলতেই, বিকালের ঘড়িতে ছ’টা ছুঁই ছুঁই। ভৈরবঘাঁটি, লংকা, হরশিল পেরিয়ে গাড়ি যখন গতি বাড়িয়ে ছুটছে, তখনও সব ঠিকঠাক। কিন্তু এরপরই পাহাড়ি রাস্তা হয়ে গেল অফিস টাইমের কলকাতা। দু’হাত যাচ্ছে তো মিনিট দশেক বেফালতু অপেক্ষা।

শেষমেশ গাড়ি ডেড স্টপ। কারণ যাই হোক, বনধ-রোকোর নোংরা রাজনীতি নেই শান্তির গাড়োয়ালে। শুনলাম একটা বড়ো গাড়ি বিগড়েছে ইউ-টার্ন পাহাড়ি বাঁকে। প্রমাদ গুনি। সঙ্গের অবাঙালি যাত্রীরা জোরে জোরে হনুমান চালিসা শুরু করল। অপেক্ষাকে প্রলম্বিত করতে কোরাস চালিসায় গলা মেলাচ্ছি, বসার মুদ্রা বদল করছি, মশা মারছি আওয়াজ করে। আর অন্ধকারের পর্দা টাঙানো আকাশে তারা ফ্যামিলিদের আইডেনটিফাই করছি। বজরংওয়ালির করুণায় কিনা জানি না, শেষমেশ গাড়ি ছাড়ল।

রাত বারোটার ঘর ছুঁয়ে। সকলেই যারপরনাই বিধ্বস্ত, পরিশ্রান্ত। শরীর-মন খাওয়ার চেয়ে পরিপাটি বিছানা খুঁজছে। কিছুটা চলার পরই আবার গতিরুদ্ধ গাড়ির। এবার মেষপালের চক্রব্যূহে। এই গভীর রাতে দুর্গম পাহাড়ি পথ ধরে মেষপালকরা মেষপালসহ স্থানান্তরিত হচ্ছে এক উপত্যকা থেকে অন্য পাহাড়ি উপত্যকায়। সভ্যতার ঊষালগ্নে খাদ্য সংগ্রাহকদের মতো এরা চলেছে চারণভূমির খোঁজে। ভাটোয়ারি নামক স্থানে অনেক চেষ্টায় অধিক অর্থের বিনিময়ে জুটল রাত-আস্তানা। আসলে সকল আটকে পড়া গাড়ির যাত্রীরাই হোটেলের অনুসন্ধানে নেমেছে। ফলে হোটেল রেট তো বাড়বেই। খাওয়ার কথা ভুলে রাত দুটো পনেরোয় গেলাম বিছানায়। বাইরে তখন আকাশ ভেঙে শুরু হয়েছে বৃষ্টি।

পরদিন ঘুমের কোটাপূরণে বেলা গড়াল। বৃষ্টি কিন্তু রাতের অন্ধকারের সঙ্গে আজও বিদায় নেয়নি। কর্পোরেশন জলের মতো ঝরাচ্ছে অল্পবিস্তর। থামলে তো চলবে না। তাই মনের প্রশ্রয়কে পাত্তা না দিয়ে, বৃষ্টি মাথায় ছুটল গাড়ি। সহযাত্রীদের ভক্তির ভাণ্ডার পরিপূর্ণ করতে চলতি রাস্তায় দাঁড়ালাম পাইলটবাবার আশ্রমে। ওপথে না গিয়ে ক্যামেরা বার করি আমি। ক্যামেরায় বৃষ্টির ছাঁট বাঁচিয়ে ছবি ধরি।

প্রকৃতির সাথে ল্যান্ডস্কেপে ধরা দেয় পাইলটবাবার আশ্রমও। আশ্রম-ব্রেক শেষে আবার ছুটে চলা। কাঙিক্ষত উত্তরকাশী পৌঁছে বিশ্বনাথ মন্দির দর্শন। বৃষ্টিকে বিদায় জানিয়ে উত্তরকাশীর আকাশ রোদ ঝলমলে। উত্তরকাশী থেকে এবার আমরা রংরুটে। প্রচলিত টেহরি রুদ্রপ্রয়াগের পথেই কেদারতীর্থ গমন করে গঙ্গোত্রী ফেরত যাত্রীরা। কিন্তু আমাদের ড্রাইভার ভগবতী পাহাড়তলির অপ্রচলিত পথকেই বেছে নেয়। কিছুটা দূরত্ব কমাতে। পরে জানলাম, এই এলাকার মানুষ বলেই ছোটোখাটো রাস্তাও ওর নখদর্পণে।

গাড়ি চলেছে এক পাহাড়ের পাকদণ্ডি শেষে অন্য পাহাড়ে। পাহাড়ি প্রকৃতির প্যাকেজে সংযুক্ত পাহাড়তলির ছোটো ছোটো জনপদও। ক্যালেন্ডারের ছবির মতো সেসব জনপদ পার হয়ে যাচ্ছি গতির নিয়মে। এবার চৌরঙ্গী খাল নামক ছোট্ট এক বাজারের কাছে গাড়ি ব্রেক নেয়। সামনেই ছোট্ট, অনাড়ম্বর চৌরঙ্গী বাবার মন্দির। মন্দিরে মানুষজনের আনাগোনা দেখে বোঝা যায় বেশ জাগ্রত। কয়েকটা ছড়ানো-ছিটানো পাহাড়ি ধাপে দোকানপাট নিয়ে বাজার বেশ জমজমাট। আশেপাশের পাহাড়তলির গ্রামের এটাই বোধহয় বড়োবাজার! টিফিনে গাড়োয়ালি ডিশ ‘আলু-কা-পরোটা’ আর দুধসর্বস্ব মিষ্টি মিষ্টি চা খেয়ে পুনরায় গাড়ি ছেড়ে দেয়। ঢেউ খেলানো পাহাড়শ্রেণী একাধিকবার ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে চোখ পড়তেই, মনে প্রশ্ন জাগে একই পাহাড়ে সারাদিন ঘুরছি না তো? অসমের গুয়াহাটি থেকে ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলা সড়ক পথে আসতে অষ্টমোড়া বলে একটা পাহাড় আছে। রাস্তাটা সেখানে আট-আটবার পাহাড়টাকে পেঁচিয়ে ধরেছে। আমরাও কি সেই অষ্ট বা বারোমোড়ার পাল্লায় পড়েছি? পাহাড়ি পথের ভুলভুলাইয়াতে ভুল করেনি তো ভগবতী? রুটের যাত্রী বোঝাই কিছু ট্রেকার আর মালবোঝাই ছোটো-বড়ো ট্রাক ছাড়া এপথে গাড়ির দেখা সেভাবে আর মেলেনি।

ঘানশালী আসতেই বুঝে গেলাম ঠিক পথেই চলেছি আমরা। ওখানকার এক হোটেলে মধ্যাহ্নভোজনের জন্য যখন উপস্থিত হলাম, দেখি খাবার-দাবার সব শেষ হয়ে গেছে। অনেক অনুরোধে দোকানি জিরা-আলুর সঙ্গে কটা লুচি ভেজে দিল। বাজার ছেড়ে আবার পাহাড়ি পরিমণ্ডলে। এবার চিরবাটিয়ার কাছে নির্জন পাহাড়ি বাঁকে গাড়ি থামাতে বাধ্য হলাম, একদল গাড়োয়ালি শিশুর সমবেত কলরবে। খুবানি নামক ছোটো-ছোটো মিষ্টি পাহাড়ি ফল বিক্রির জন্যই তাদের এই সমবেত হইচই। অনিচ্ছা সত্ত্বেও কয়েক প্যাকেট কিনলাম শিশুগুলোর কথা ভেবে। আর উপরি পাওনা হিসাবে ধাপচাষ জমির ব্যাকগ্রাউন্ডে তুললাম ছবি, সরল-নিষ্পাপ সেসব শিশুদের। অনবদ্য সেই ক্ষণ রয়ে গেল মনের ইনবক্সেও।

ময়ালি তিলওয়ারার পর বড়ো রাস্তায় পড়ে গাড়ি এবার ছুটছে তুফান বেগে। অগস্ত্যমুনি পেরিয়ে শিয়ালসোর ছুঁয়ে প্রকৃত গন্তব্য আমাদের গৌরকুণ্ড। কিন্তু এখনও ঢের রাস্তা পড়ে। এদিকে আলো ফুরিয়ে আসছে। সারাদিনের ধকলের ধারাবাহিকতায় না গিয়ে গতির আপাত ইতি টানতে চাইছে অনেকেই। অতএব শিয়ালসোরেই নোটিশ পড়ে গেল হোটেল খোঁজার। অবশ্য শিয়ালসোরের ক্ষেত্রে হোটেল খোঁজাখুঁজির দরকার নেই। মন্দাকিনীর ধার বরাবরই সব হোটেলের অবস্থান। যে হোটেল চুজ করে মালপত্র নামালাম এককথায় দুর্দান্ত। ভাড়া কিন্তু সে তুলনায় অনেকটাই কম।

মন্দাকিনী পাড়ে দাঁড়িয়ে প্রাক সন্ধ্যার মুখে দেখলাম, আকাশ আলো করা কেদারশৃঙ্গকে। এককথায় অনবদ্য। ঝকঝকে সেই রূপোলি শৃঙ্গের হাতছানি, ক্লান্তিকে ভুলিয়ে দিল নিমেষেই। এক কাপ চা নিয়ে বাগানছাতার নীচে বসে গেলাম। তার রূপের বিহ্বলতায় মোহচ্ছন্ন হয়ে পড়লাম কিছুক্ষণ। ডিনারের পর কমন ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ালাম। নিস্তব্ধ পাহাড়ি প্রকৃতি। জমাট অন্ধকারমাখা রাত। ম্যাজিক আলোয় দেখা সামনের পাহাড়শ্রেণী ডুব দিয়েছে সেই অন্ধকারের আড়ালে। নীচে সশব্দে বয়ে চলেছে হিমালয়-কন্যা মন্দাকিনী। তার জলতরঙ্গের উচ্ছলতার শব্দ অনুরণিত হচ্ছে কাছে-দূরের পাহাড়ে। রাত বাড়তেই হিমালয় থেকে নেমে আসছে ভলকে ভলকে ঠান্ডা বাতাস। হালকা পোশাকে আবৃত শরীরে অনুভূত হচ্ছে শিরশিরানিভাব। কাল যাব ঐ হিমতীর্থে। সেই স্বপ্নবিভোরেই ঘুমের রাজ্যে পাড়ি জমায়।

পরদিন সড়কপথের শেষ গন্তব্য গৌরীকুণ্ডের উদ্দেশ্যে যাত্রা। আজ আর কোনও সাইট সিয়িং হিসাবের মধ্যে নেই। সেই মতো দ্রুত এগিয়ে চলেছে গাড়ি। কিন্তু কুণ্ড, গুপ্তকাশী পেরিয়ে সোনপ্রয়াগ আসতেই আবার গঙ্গোত্রী পথের পুনরাবৃত্তি ঘটল। রাস্তা অবরুদ্ধ। রাস্তা জুড়ে গাড়ির সারিবদ্ধ লাইন। অপেক্ষায় অপেক্ষায় সময় বরবাদ। সিজনের হরিদ্বার, ঋষিকেশের সমস্ত গড়িই যেন এখানে এসে হাজির হয়েছে। ফলে সমস্যা হল স্থান সংকুলানের। অপেক্ষায় থাকা গাড়ি-জানালা থেকে কেদারশৃঙ্গের হাতছানি মনকে নাড়িয়ে দিল। গাড়ি থেকে নেমে পড়ি। ক্যামেরা তুলে নিই হাতে। ঐ পরিস্থিতিতে হকারদের জবরদস্তি মাল বিক্রির জন্য টানাহ্যাঁচড়াতে সকলেরই ধৈর্যের বাঁধ ভাঙে। জাফরান, মালা, পলা, মুক্তো, কস্তুরী, শিলাজিৎ শিকড়-বাকড় শাল-সালোয়ারের মতো হাজার রকমারি পসরা তাদের ঝোলায়। গাড়ি, যাত্রীদের পসরার প্রতি আকৃষ্ট করতে তারা যে বক্তব্য পেশ করছে, তা অধিকাংশই মিথ্যার বাঁধনে ঠাসা। একসময় কেটে যায় যানজট। নড়েচড়ে ওঠে জগদ্দল পাথরের মতো দাঁড়িয়ে থাকা সামনের গাড়িগুলো। গতির মুক্তি মেলে আমাদের গাড়িরও। গৌরীকুণ্ড আসতেই সড়কপথের ইতি পড়ে যায়। আমরাও চটজলদি নেমে পড়ি।

অধিকাংশ মালপত্তর গাড়িতে রেখে, প্রয়োজনীয় কিছু ব্যবহার্য জিনিস রুকস্যাকে ঢুকিয়ে গুটি গুটি পায়ে বাজার অভিমুখে এগিয়ে যাই। উষ্ণকুণ্ডের চড়াই সিঁড়ির মুখেই মিলে যায় বাঁকুড়াবাসীর এক বাঙালি হোটেল। মনের তৃপ্তিতে মধ্যাহ্নভোজন সেরে নেমে পড়ি পথে।

আমরা পদব্রজেই তীর্থপথে। অন্যান্যরা অন্যান্য উপায়েঃ ঘোড়া, ডান্ডি, কান্ডির দলে। কিন্তু ঘোড়া-খচ্চরদের আস্তাবল পার হতেই সশরীরে নরক দর্শন সারা হয়ে যায়। রাস্তা জুড়ে লোকে-লোকারণ্য। মোট চোদ্দো কিমি পথ কেদারের। খরিদ্দার ধরার জন্য সহিসরা পথের বাঁকে বাঁকে দাঁড়িয়ে। চড়াইটা প্রথমেই এত কষ্টদায়ক যে, শেষ ডেস্টিনেশনে পৌঁছোনোর ইচ্ছার মানসিকতায় অনেকখানি ঘাটতি এনে দেয়। সেটা ধর্মো-মাদক তীর্থযাত্রীই হোক বা আমাদের মতো ভ্রমণপিপাসুর দলবল। আমার ব্যক্তিগত মতামত, চোদ্দো কিমি কেদারের এই বন্ধুর দুর্গম রাস্তাটা অতি সহজেই ট্রেকার বা ছোটোগাড়ি চলতেই পারে। সান্দাকফু বা রিশপের রাস্তাটা তো এর চেয়েও শতগুণে খারাপ। সেখানে তো জিপ, ট্রেকার চলে দিব্যি। তবে মনে হয় এখানকার মানুষজনের রুটি-রুজির কথা ভেবেই এপথ দুর্গমই রাখা হয়েছে।

সবদিক বিবেচনা করে অন্তত রামওয়াড়া পর্যন্ত জিপ বা ট্রেকার চালিয়ে বাকি সাত কিমি পথ এই সিস্টেমই চালিয়ে রাখা যেতে পারে। সেক্ষেত্রে অনেকটাই সুরাহা হবে পায়ে চলা যাত্রীদের। মনের কোণে প্রশ্ন জাগে অদূর ভবিষ্যতে সত্যি সত্যি যদি রেলপথ চালু হয়? সেক্ষেত্রে সরকার কি রেজিষ্ট্রিকৃত ঘোড়া, ডান্ডি, কান্ডি, পিট্টু-বৃত্তিভোগীদের ভাতার ব্যবস্থা করবে? সিঙ্গুর বিতর্কের মতো প্রশ্নটা আপাতত ঝুলেই থাক।

জঙ্গল চটির কাছে এক ধাবায় বসে দেখছিলাম ফিরতি যাত্রীরা কতটা বিধবস্ত ও পরিশ্রান্ত হয়ে ফিরছে। আমাদের চলার পথ তো বারো-আনাই পড়ে। পারব তো এইপথ অতিক্রম করতে? রাস্তা প্রশস্ত হলেও, ঘোড়া-ডান্ডি-কান্ডিদের অনেকটা পথই ছাড়তে হচ্ছে। পথপ্রান্তে রেলিং যে সর্বত্র আছে তা নয়। ফলে গাইড দিতে হচ্ছে বুদ্ধি করে। লাঞ্চপেটে বেরিয়েছি বারবেলায়। ফলে পা চালাতে হচ্ছে দ্রুত। বোল্ডার সর্বস্ব রাস্তায় সেটা অসম্ভব। ক’বার শর্টকাট রাস্তা মারতে গিয়ে কামারের হাপরের মতো শ্বাস টেনেছি অনেকটা। ফলে ওপথে আর পা বাড়াইনি। জায়গায় জায়গায় পথ সিক্ত।

এপথে বৃষ্টি যখন-তখন। ফলে পাহাড়ের এ ঢালে শুষ্ক তো অন্য ঢালে টিপটাপ বা ঝমঝম। রাস্তার উপর শায়িত ঝোরাও শিঞ্চিত করছে পদযুগল। পাহাড়ি শরীর বেয়ে অপেক্ষাকৃত বড়ো যেসব অনামি ঝোরা, তারা নিজের পথ করে লোহাব্রিজের নীচে দিয়ে সশব্দে সফেন নেমে যাচ্ছে গভীর খাদে। রাস্তার ধারে জায়গায় জায়গায় ঘোড়াদের যে পানীয় জলের পাত্র, তারও উৎস এই সব ঝোরা। কেন জানি না সিকিমের ইয়ুমথাং-এর মতো পথের মিল পাচ্ছি অনেক জায়গায়। মন্দাকিনীর সঙ্গে দূরত্বটা কখনও বাড়ছে, কমছেও কখনওবা। তুষার পোশাকপরা পাহাড়গুলো সুস্পষ্ট হচ্ছে যত এগোচ্ছি। তবে ঘোড়া-খচ্চর পটির পটভূমিতে পাথর-সর্বস্ব পথের পরিস্থিতি পদে পদে দুর্বিসহ। গলা ভেজাতে মাঝে দু’তিনবার থেমেছি। আবার হাঁটা।

রামওয়াড়া পার হতেই দেহে বল পেলাম। অন্তত অর্ধরাস্তা তো অতিক্রম করেছি। ব্যাটম্যানের ব্যাট তুলে অর্ধ-সেঞ্চুরির ভঙ্গিতে আমরা দু’হাত তুলে আনন্দের বহিঃপ্রকাশ করলাম। আনন্দের আতিশয্যে দাঁড়িয়ে ছবিও নিই বেশ কয়েকটা। বলার অপেক্ষা রাখে না, যেদিকে তাকাই সমস্তটাই ছবির জগৎ। কিন্তু এবার পা জড়াচ্ছে। সে সাথে জিহ্বাও। সঙ্গে আনা লজেন্স মুখে ফেলি। সহিসদের হাতছানি মাঝেমধ্যেই মনের ইচ্ছাশক্তিকে অক্ষম করে দিচ্ছে। তবে অন্যান্য ব্যবস্থাপনায় যারা যাচ্ছেন, তারা যে খুব ভালো ভাবে যাত্রা করছেন তা বলা যাবে না। আমাদের সামনেই এক মাড়োয়ারি ফ্যামিলি তিনটে ঘোড়ায় চলেছেন। কিন্তু হঠাৎ করেই পাথরে স্লিপ কেটে সেই ভদ্রলোক ঘোড়াসমেত প্রপাত ধরণিতল। ক্রোধান্বিত ভদ্রলোক সঙ্গে সঙ্গেই টাকাপয়সা মিটিয়ে সহিসকে বিদায় জানালেন। আমাদের পদাতিকদের দলে আরও একটি ফ্যামিলি যুক্ত হল।

পথ যেন আর শেষ হয় না। একটা দমফাটা চড়াই এর পর বিশ্রাম নিই। সামান্য বিশ্রামের ফাঁকে পিছন ফিরে দেখি পিঁপড়ের সারির মতো অগণিত মানুষজন উঠে আসছে। যেন পুণ্যের টানে অর্ধেক ভারতবর্ষই কেদারমুখী। গরম চায়ে গলা ভিজিয়ে আবার চলা শুরু। ইচ্ছা ছিল পথে ব্রহ্মকমল দেখব। কিন্তু সন্ধান পাইনি। শুনলাম আগস্ট-সেপ্টেম্বরে ফুল ফোটে। তবে স্নেক লিলি দেখলাম। তীর্থ ফেরত বহু যাত্রীর হাতে। আকাশপথের সঙ্গেও কেদারতীর্থ যুক্ত। মন্দাকিনীর পথ ধরেই অনবরত যাতায়াত করছে হেলিকপ্টার। শুনলাম আছে দুটো রুট। এক ফাটা থেকে অন্যটা গুপ্তকাশী হয়ে। অতএব আকাশপথেও পুন্যার্জনের সুবর্ণসুযোগ।

সূর্য ডোবার পালা এসে গেল। তবে মেঘ-কুয়াশার পরিবেশে সূর্যাস্তটা দৃষ্টিগোচর হল না। কেবল অন্ধকারের অঘোষিত নোটিশ ফেলল যেন পাহাড়ি প্রকৃতি। পথের শেষে কী প্রাপ্তি লুকিয়ে আছে, সে ভাবনা ঘুরপাক খাচ্ছে বুকের মাঝে। ইতিমধ্যে বরফছোঁয়া ক্ষুরধার তীক্ষ্ন-হাওয়া বইতে শুরু করেছে। রাস্তার স্ট্রিট লাইট জ্বললেও জায়গায় জায়গায় তার চক্ষুদান ঘটেছে। দূরে দৃষ্টিগোচর হয় আলোর মালায় সজ্জিত কেদারধাম। আরও দু’দুটো বাঁক পার হলেই ওই আলোর রাজ্যে প্রবেশ করব। নেতিয়ে পড়া শরীরটা চাঙ্গা করতে অতি ক্ষীণ কণ্ঠে বলে উঠি ‘জয়বাবা কেদারনাথজি, শেষ পথটুকু পার করে দাও।’

সকালে ঘুম ভাঙতেই, হোটেলের প্রশস্ত করিডরে এসে দাঁড়াই। হাড় কাঁপানো ঠান্ডায় অসাধারণ দৃশ্যের মুখোমুখি হই। সামনে উদ্ভাসিত হিমালয়। যেদিকে তাকাই শুধু বরফ আর বরফের শৃঙ্গ। শৃঙ্গরাজি আবৃত খোদ কৈলাসেই যেন আমরা উপস্থিত। অ্যাপয়েন্টমেন্ট ভিত্তিক কল পড়বে শীঘ্রই শিব ঠাকুরের কাছে। তাঁকে জানাব দেশ ও রাজ্যের বর্তমান পরিবেশ পরিস্থিতির কথা। জানাব ভ্রমণের পথে বাধাসৃষ্টিকারি সমস্ত অশুভ শক্তির বিনাশের। চেয়ে নেব অমরত্ব ব্যতিরেকে অন্য দু-একটা বর।

কাল রাতে পথ হাতড়ে অনেক কষ্টে উঠে এসেছি। অন্ধকার পথে ঝোরার বরফজলে পা পড়ে মোজা জুতো সব ভিজেছে। মূল বাজারে খোঁজাখুঁজি করে শেষে অধিক অর্থে মিলেছে মাঝারিমানের এক হোটেল। ইচ্ছা ছিল সন্ধ্যারতি দেখব। কিন্তু সে সময় অতিক্রম করে রাত সাড়ে ৯টায় পা ফেলেছি। বরফঠান্ডা বিছানায় দুটো লেপ নিয়েও অনেক কষ্টে ঘুম এসেছিল। মন্দাকিনীর কুলুকুলু ধবনি ঘুম না আসা মুহূর্তকে ভরিয়ে দিয়েছিল।

হাতে গোনা হোটেল, ধর্মশালা আর অজস্র দোকানপাট নিয়ে ছোট্ট জনপদ কেদারনাথ। দ্বাদশ জ্যোতির্লিঙ্গের অন্যতম এই কেদারনাথ। মূলত মন্দিরকে ঘিরেই আবর্তিত এখানকার জীবনযাত্রা। হোটেল ছেড়ে রেলিং দেওয়া মন্দিরচত্বরে গিয়ে দাঁড়াই। কী অসাধারণ দৃশ্য চারদিকে। আকাশজুড়ে উড়ে চলা মেঘ-বালিকাদের ফাঁকে বরফচূড়ার দৃষ্টিনন্দন সৌন্দর্য এককথায় অবর্ণনীয়। ভোর থেকেই শুরু হয়েছে মন্দিরে পূজা-অর্চনা। ভক্তদের বাজিয়ে দেওয়া ঘণ্টার ধবনি নীরবতা ভেঙে চলেছে বারে বারেই। অন্ধকার মোছার আগেই আমজনতার লাইন পড়ে গেছে। লাইন সাপের মতো এঁকেবেঁকে টিনের শেড ছেড়ে পাহাড়তলির কাছে চলে গেছে। দেবতাকে দর্শনের জন্য  কতই না কৃচ্ছসাধন করা হয়, আর আমরা তো কেবল কয়েক ঘণ্টার জন্য লাইনে দাঁড়াব।

লাইনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে প্রকৃতিপ্রেমে বিভোর হয়ে যাই। চলন্ত লাইনে থাকতেই দেখেনি আদিগুরু শঙ্করাচার্যের সমাধিমন্দির। কেদারেই তিনি দেহত্যাগ করেছিলেন। সময়ের সাথে লাইনও এগোয়। ধৈর্যের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে শেষে পৌঁছে যাই মন্দির সম্মুখে। প্রবেশদ্বারের সামনেই মন্দিরের দিকে মুখ করে বসা পাথরের সুবিশাল নন্দিমূর্তি। পৌরাণিক মিথ অনুযায়ী পাণ্ডবরাই এই মন্দিরের স্থাপয়িতা। গ্রানাইট পাথরে নির্মিত অনিন্দ্যসুন্দর এই মন্দির বর্তমানে বহুবার সংস্কার করা হয়েছে।

কেদারমন্দিরের পাশ দিয়ে বয়ে চলা মন্দাকিনী আসলে কেদারপাহাড় থেকে নেমে আসা দুধগঙ্গা, মধুগঙ্গা, স্বর্গদ্বারী আর সরস্বতীরই মিলিত জলধারা। মন্দিরের গর্ভগৃহে দেখি দেয়াল জুড়ে পঞ্চ-পাণ্ডবদের ফ্যামিলি-ফোটাগ্রাফ খোদাই করা। এ ছাড়া আছেন লক্ষ্নী-নারায়ণ, পার্বতী ও সিদ্ধিদাতা গণেশ। ঘি, ফুল, বেলপাতা, ছোলা-ডাল, ধূপ, চন্দন মিশ্রিত এক গন্ধ মন্দির জুড়ে। মন্দিরের কেন্দ্রস্থলে মাটির মধ্যে ঢুকে থাকা একখণ্ড পাথরই মহাদেবের প্রতিভূ। একেই দেবতাজ্ঞানে পুজো করা হচ্ছে। চলছে লাগাতার স্তোত্রপাঠ। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ পরবর্তীকালে জ্ঞাতিহত্যার পাপস্খলনে পঞ্চ-পাণ্ডবরা শিব তপস্যায় রত হন। শিব সন্তুষ্ট হলেও সশরীরে দেখা দেন না, ফলে পাঁচভাই-এর সঙ্গে চলে লুকোচুরি খেলা। শেষে মহিষরূপী শিব ভীমের হাতে ধরা পড়ে পশ্চাৎ অংশ বাইরে রেখেই পাতালে প্রবেশ করেন। সেই মহিষের পশ্চাৎদেশ রূপী শিলাখণ্ডকেই স্পর্শ করে পুজো দিই। শুনলাম শীতের দিনে কেদারনাথের বাস, চুয়াল্লিশ কিমি নীচে উখিমঠের মন্দিরে। ফটোসেশন শেষে চললাম, কুণ্ড পরিদর্শনে। এখানে রেতম, উদাক, রুদ্র ও ঋষি মোট চারটি কুণ্ড। এর মধ্যে শুরু হয়ে গেল বৃষ্টি।

বৃষ্টি থামতেই এক চায়ের দোকনে ঢুকি। পরদিন আমাদের যাত্রা শুরু চোরাবালিতালের পথে।

জরুরি তথ্য

কীভাবে যাবেনঃ  হাওড়া থেকে ট্রেনে প্রথমে হরিদ্বার। হরিদ্বার থেকে হৃষীকেশ হয়ে গৌরীকুণ্ড। খুব সকালে গাড়ি নিয়ে বার হলে, দিনে দিনেই পৌঁছোনো সম্ভব। এপথে হৃষীকেশ থেকেই পর্যাপ্ত বাস মেলে। তবে মাঝে রুদ্রপ্রয়াগ, শিয়ালসোর বা চন্দ্রপুরীতে রাত্রিবাস করে পরদিন যাত্রা করলে শারীরিক ধকল কমে।গৌরীকুণ্ড থেকে কেদার হাঁটাপথ। অক্ষমে ঘোড়া, খচ্চর, ডান্ডি, কাণ্ডির ব্যবস্থা আছে।

কখন যাবেনঃ  কেদারের মন্দিরের দরজা অক্ষয় তৃতীয়া থেকে দীপান্বিতা অমাবস্যা পর্যন্ত খোলা থাকে। ফলে বর্ষাকালটা বাদ দিয়ে, মে থেকে অক্টোবরের যে-কোনও সময় গেলেই চলে।

কোথায় থাকবেনঃ  রাত্রিবাসের জন্য এখানে পাবেন ভারত সেবাশ্রম, আনন্দময়ী মায়ের আশ্রম, যোগমায়া আশ্রমের ধর্মশালা, বিড়লা মঙ্গল নিকেতন, মন্দির কমিটির রেস্ট হাউস, কালীকমলি ধর্মশালা ইত্যাদি। এ ছাড়া রয়েছে গাড়োয়াল মণ্ডল বিকাশ নিগম দ্বারা পরিচালিত আবাসস্থল।

কেনাকাটাঃ  মন্দিরের আশেপাশে দোকানগুলিতে পুজোর উপকরণসহ নানা দ্রব্যাদি মেলে। তবে স্মৃতি হিসাবে কিছু কিনতে চাইলে ফেরার পথে হরিদ্বারেই কিনুন। অর্থের সাশ্রয় হবে।

সঙ্গে নিনঃ  গৌরীকুণ্ড থেকে চড়াই পথে হাঁটার সময় জলের বোতল আর স্পাইকওয়ালা একটা লাঠি সঙ্গে নিন। মুখে দেওয়ার জন্য কাজু, খেজুর, কিশমিশ, লজেন্স নিলে ভালো।তবে রাস্তাজুড়ে দোকান অজস্র।

চলতে চলতে অরুণাচল

গুয়াহাটি বিমানবন্দরে যখন প্লেন-টা নামল তখন এক পশলা বৃষ্টি যেন প্রস্তুত হয়েই ছিল, আমাদের স্বাগত জানাবে বলে। গুয়াহাটি থেকে গাড়িতে আমরা যাব ভালুকপং। দূরত্ব ১৯০ কিলোমিটার। চা-বাগিচার মধ্যে দিয়ে পিচ রাস্তা পেরিয়ে, অসম-অরুণাচলের সীমান্ত শহরে এসে পড়লাম। তোরণদ্বার পেরোলেই ওপারে অরুণাচল। জিয়াভরালি নদীর ধারে এই ছোট্ট জনপদ ভালুকপং, অচিরেই মন কেড়ে নেয়। পরদিনের যাত্রাসূচি তৈরি করে নিই, রাতের আস্তানা অরুণাচল সরকারের ইন্সপেকশন বাংলোয় বসে।

পরদিন রওনা দিলাম দিরাং হয়ে বমডিলার উদ্দেশে। ভালুকপং থেকে দিরাং-এর বাসে চড়ে বসি। কামেং নদী পথের সঙ্গী। অপূর্ব গাছগাছালি ঘেরা পাহাড়ি নিসর্গ। রূপা আর টেঙ্গি উপত্যকা পেরিয়ে একসময় পৌঁছে গেলাম মেঘ-কুয়াশা ঘেরা বমডিলায়। চা-বিরতির পর পাড়ি দিলাম দিরাং-এর পথে।

দিরাং নদীর পাড়ে ছোট্ট জনপদ। চাষের জমি, নাসপাতি খেত, এই নিয়েই দিরাং। কাছাকাছি একটি উষ্ণ প্রস্রবণও আছে। পাইনের জঙ্গল পেরিয়ে এই জায়গাটিতে পৌঁছে এক আশ্চর্য মায়াময় পরিবেশের ঠিকানা মেলে। দিরাং নদীর কোলঘেঁষা বাংলোয় আমাদের থাকার ব্যবস্থা। প্রকৃতির রূপ-রস উপভোগ করে আমরা তাওয়াং যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিই গাড়িতে।

ইতিমধ্যেই ‘কোয়লা’ ছবির দৌলতে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে তাওয়াং। একটানা চড়াই পথে উঠে সেলা পাস পার হয়ে পৌঁছোতে হবে তাওয়াং-এ। পাহাড়ের উচ্চতা বাড়ায় সবুজ ফিকে হতে থাকে ক্রমশ। রাস্তায় চোখে পড়ে সেনা ছাউনি। একটু এগোতেই গ্লেসিয়ার পয়েন্ট—যার নাম সেলা লেক। প্রকৃতির রূপ পাগল করা। মন চায় না যেতে, তবু চলে যেতে হয়।

আবার গাড়িতে উঠে বসলাম। পৌঁছে গেলাম জং নামের একটি গ্রামে। এখানে এক বিশাল জলপ্রপাতের সঙ্গে দেখা। অদ্ভুত এই পরিবেশ, যেন রূপকথার দেশে এসে পড়েছি বলে ভ্রম হয়।

এবার রওনা হলাম আমাদের আসল গন্তব্য ৪০ কিমি দূরে তাওয়াং-এর উদ্দেশে। তাওয়াং-এর উচ্চতা প্রায় ১০,৮০০ ফুট। টুরিস্ট লজ-এ আগে থাকতেই ঘর সংরক্ষণ করা ছিল। অদূরেই তাওয়াং মনাস্ট্রি। ভারতের বৃহত্তম এই মনাস্ট্রি ৪০০ বছরের চেয়েও পুরোনো। এখানে রাখা ২৬ ফুট উঁচু বুদ্ধমূর্তি। তাওয়াং-এ আমাদের দ্রষ্টব্য এক অপূর্ব লেক, যার নাম পিতি সো। পারমিট দেখিয়ে সেনা প্রহরার নিয়মনির্দেশিকা পার হয়ে বরফ আর কুয়াশা মোড়া পিতি সো পৌঁছে, স্তব্ধবাক হয়ে যাই সেই সৌন্দর্যে। আর কিছুটা পথ পার হয়ে, আরও একটি লেক যার নাম সংগীতসর। ‘কোয়লার’ শুটিং-এর পর থেকে এটি ‘মাধুরী লেক’ নামেই পরিচিত। বরফশৃঙ্গ আর লেক-এর অপূর্ব নিসর্গ মন কেড়ে নেয়। অরুণাচল সফরে এটি অন্যতম প্রাপ্তি।

আমাদের সফরের শেষ দিকে এসে পড়েছি প্রায়। সেলা পাস পেরিয়ে এবার আমাদের বমডিলা যাত্রা। পাহাড়ের ঘেরাটোপে বমডিলা এক রূপসি পর্যটন ক্ষেত্র। বৌদ্ধ গুম্ফা, বাজার, ইত্যাদি নিয়ে বেশ জমজমাট। মেঘ-বৃষ্টি-কুয়াশার এক রূপকথার দেশ অরণাচল। পাহাড় আর প্রকৃতিকে ভালোবেসে এপথে পাড়ি না দিলে, হয়তো সারাজীবন আক্ষেপ থেকে যাবে।

 

 

নেপাল

আমাদের প্রতিবেশী ছোট্ট দেশ নেপাল কিছু বছর আগেও একমাত্র হিন্দু রাষ্ট্র ছিল, বর্তমানে গণতন্ত্র। যার বেশিরভাগ পাহাড় ও অরণ্য। আমাদের ভারতবর্ষের মতোই নেপালের সভ্যতাও প্রাচীন। নেপালের কোনও বন্দর নেই। পূর্ব, দক্ষিণ ও পশ্চিমে ভারত আর উত্তরে চীন দেশের ভূখন্ডে ঘেরা! হিমালয়ের কোলে অবস্থানের জন্য নেপালের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের ছড়াছড়ি। নেপালের পাহাড়ি পাকদন্ডি, চঞ্চলা নদনদী, নিবিড় অরণ্য, পাহাড়ি ঝরনা সবই আপনাকে মোহিত করবে।

কাঠমান্ডু

বাগমতি নদীর কিনারে কাঠমান্ডু নেপালের রাজধানী ও সবথেকে বড়ো শহর। মাল্লা রাজাদের আমলের রাজ্য কাঠমান্ডু, পাটন ও ভক্তপুর আজ মিলে হয়েছে কাঠমান্ডু। জনশ্রুতি বহু পূর্বে কাঠমান্ডু ভ্যালিতে ছিল বিশাল এক জলাশয়। বৌদ্ধ সন্ন্যাসী মঞ্জুশ্রীর তরবারির আঘাতে পাহাড়ে ছিদ্র সৃষ্টি হয় যেখান দিয়ে জলাশয়ের জল নেমে গিয়ে, শস্য-শ্যামলা উপত্যকা কাঠমান্ডুর সৃষ্টি। গোপাল, কিরাত, লিচ্ছবি ও মল্ল রাজাদের রাজত্বকালে কাঠমান্ডু বাণিজ্য, শিল্প ও স্থাপত্যে অগ্রগতি করে। কাঠমান্ডুতে পুরোনো দিনের স্থাপত্য ও শিল্পকলা ছড়িয়ে আছে।

বিদেশ হলেও ভারতীয়দের পাসপোর্ট বা ভিসার দরকার হয় না। অবশ্যই ভোটার কার্ড সঙ্গে রাখবেন। সমগ্র নেপালে খনিজ জলই পান করবেন ও সঙ্গে জলের বোতল রাখবেন। পাহাড়ের মানুষরা চায়েতে চিনি অনেক বেশি দিতে অভ্যস্ত, চা অর্ডার করার সময় আপনার চিনির মাত্রা বলে দেবেন। নেপালে ভারতের টাকা চলে কিন্তু ৫০০ বা ১০০০ টাকার নোট চলে না তাই ১০০ টাকার নোটই সঙ্গে নেবেন। আমাদের ভারতীয় ১০০ টাকা নেপালের ১৬০ টাকা।

কলকাতা থেকে ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্স-এর প্লেন ও দিল্লি থেকে প্রতিদিন ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্স ও বিভিন্ন প্রাইভেট এয়ারলাইন্স-এর প্লেন যাচ্ছে কাঠমান্ডু!

হাওড়া থেকে মিথিলা এক্সপ্রেস যাচ্ছে রক্সৌল। সেখান থেকে  দূরে সীমান্ত পার করে বীরগঞ্জ, তারপর জিপে ঘন্টা পাঁচেক গেলেই কাঠমান্ডু।

তবে কাঠমান্ডুতে না থেকে, অবশ্যই থামেল-এ থাকুন। যেমন প্রচুর হোটেল তেমনই আছে ফোন, ট্রাভেল এজেন্ট, গাড়ি, এয়ারলাইন্স টিকিট এজেন্ট, রেস্টুরেন্ট, সাইবার কাফে ইত্যাদির সুবিধা। সমগ্র নেপালে লোডশেডিং হতে পারে, আগেভাগে জেনে নেবেন হোটেলে জেনারেটর আছে কি না।

এবারে আসি কাঠমান্ডু শহরের ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটগুলোর কথায়।

পশুপতিনাথ মন্দির

কাঠমান্ডু শহরের পূর্ব দিকে গৌশালাতে পুরোনো দুতলা শিব মন্দির, ছাদ সোনার ও দরজা রুপোর পাতে মোড়া। হিন্দুদের অত্যন্ত পবিত্র ধর্মস্থান। মন্দিরের মধ্যে ক্যামেরা, জুতো, চামড়ার বেল্ট, ব্যাগ নিয়ে যাওয়া যায় না। মন্দির প্রাঙ্গণে আরও অনেক দেবদেবীর মন্দির রয়েছে। কাছেই ঘুহেস্বারি দেবীর মন্দির সতী পিঠ রূপে খ্যাত।

বৌদ্ধনাথ স্তুপ

পশুপতি মন্দির থেকে আরও পূর্বদিকে নেপালের সবথেকে বড়ো শ্বেতশুভ্র এই তিব্বতি বৌদ্ধ স্তুপ! সারাবছর বৌদ্ধ ভক্তদের ভিড় লেগেই থাকে এখানে।

ভক্তপুর

কাঠমান্ডু থেকে রচ্ কিমি পূর্বে অর্নিকো হাইওয়ে থেকে বামে, এখানে এলে মনে হবে পুরোনো দিনের নেপালে পেৌঁছে গেছেন। লাল ইটের বাড়ি, পাথর পাতা রাস্তা সবই আজও বর্তমান। দরবার স্কোয়ারে দেখবেন মল্ল রাজাদের আমলের অপূর্ব স্থাপত্য ও শিল্পকলা– রাজবাড়ি, মন্দির, নক্সা কাটা কাঠের দরজা জানালা, রাজাদের স্নানের পুকুর। বাতসালা দেবীর মন্দিরের প্রাঙ্গণে বিশাল ব্রোঞ্জের ঘণ্টা রঞ্জিত মল্ল দ্বারা নির্মিত।

এখান থেকে দূরে টিলার উপরে অপূর্ব কারুকার্য খচিত ছাঙ্গু নারায়ণ মন্দির, ইউনেস্কো হেরিটেজ সাইট। হিন্দু ও বৌদ্ধ দুই সম্প্রদায়ের মানুষের পুজো পেয়ে থাকেন এখানে বিষ্ণু।

পাটন দরবার স্কোয়ার

পূর্বের ললিতপুর আজ পাটন নামে খ্যাত, এখানেও মল্ল রাজাদের কারুকার্যময় রাজদরবার, প্যাগোডা স্টাইল-এর মন্দির দেখার মতো। কেশব নারায়ণ চক আজ মিউজিয়াম।  কৃষ্ণ মন্দির নেপালের প্রথম সম্পূর্ণ পাথরের শিখর স্টাইল-এর মন্দির। সমগ্র অঞ্চল খুবই ঘিঞ্জি, দরবারের ভিতরে যেতে টিকিট কাটতে হয়। কাছাকাছির মধ্যে রুদ্র বর্ণ ও হিরণ্য বর্ণ মহাবীর মন্দির দেখে নেওয়া যায়।

কাঠমান্ডুর দরবার স্কোয়ার

বসন্তপুর কাঠমান্ডুর প্রাণকেন্দ্রেই এই দরবার তার প্যালেস, অঙ্গন, মন্দির মল্ল রাজাদের স্থাপত্য ও শিল্পকলার নিদর্শন। এখানেই হনুমান ডোকা প্যালেস ও তালেজু মন্দির দর্শনীয়!

স্বয়ম্ভুনাথ স্তুপ

শহরের পশ্চিমে রিং রোড-এর ওপরে টিলার উপরে স্বয়ম্ভুনাথ স্তুপ। গাড়িতে অনেকটা ওপরে যাবার পরেও খাড়া সিঁড়ি চড়তে হয়। মঞ্জুশ্রীর তরবারির আঘাতে জলাশয় যখন সৃষ্টি হয় উপত্যকায় তখন থেকেই এই স্তুপেরও সৃষ্টি। এখান থেকে কাঠমান্ডু শহর ও হিমালয় দারুণ দেখতে লাগে।

পোখরা

পোখরার দরজা জনসমক্ষে খুলে যায় পৃথ্বী হাইওয়ে হবার পর। তার আগে তো পোখরা যাওয়া মানে অনেকটা হাঁটা পথ। রূপসি পোখরায় ভিড় উপচে পড়তে থাকে প্রকৃতিপ্রেমী পর্যটকদের, দেবতাও যেন তার অবসরে তুলির টানে এঁকেছেন পোখারাকে। উত্তরে তুষারশুভ্র হিমালয়ের শিখরশ্রেণি, সবুজ গালিচায় মোড়া ভূমিঃ তার মধ্যে তিনটি অপূর্ব প্রাকৃতিক লেক। ধৌলগিরি, অন্নপূর্ণা, মানাসলু ও মাচ্ছাপুছারে শৃঙ্গ দৃশ্যমান, প্রথম তিনটির উচ্চতা তো অনেক।

পোখরা গেছি ডজন বার বা তারও বেশি, বাস, প্লেন, ট্যাক্সি এমনকী মোটরবাইকেও। প্রত্যেকবারেই ভালো লেগেছে এই শহরকে, তা সে শীত, গ্রীষ্ম বা বর্ষা যে-কোনও ঋতু হোক না কেন। পোখরা যাবার সেরা সময় অক্টোবর-নভেম্বর থেকে মার্চ। দুর্গাপুজো বা ভাইফোঁটার সময় অবশ্যই যাবেন না। পোখরাতে বৃষ্টি অনেক বেশি হয় তাছাড়া পাহাড়ও ঢেকে থাকে মেঘের চাদরে।

ভারত থেকে পোখরা যাবার সোজা কোনও পথ নেই। কলকাতার হাওড়া থেকে মিথিলা এক্সপ্রেসে রক্সৌল হয়ে বীরগঞ্জে, সেখান থেকে বাসে পোখরা।

আপনি যদি কাঠমান্ডু হয়ে যান তাহলে তো অনেক ভাবেই যেতে পারেন। সকালে ও বিকালে প্লেন যাচ্ছে কাঠমান্ডু থেকে পোখরা। এই সব এয়ারলাইন্স-এর এজেন্ট রয়েছে কাঠমান্ডুতে সর্বত্র। ডিসকাউন্ট করে নেওয়া আপনার মুনশিয়ানা, এটা কেউ শিখিয়ে দিতে পারবে না।

বড়ো ও ছোটো (মাইক্রো) দু’রকমের বাস যায় কাঠমান্ডুর বালাজু থেকে কলঙ্কি হয়ে পোখরা। তবে এই সব বাসে বেশ ভিড় হয় সিটও আরামদায়ক নয়। থামেল-এর সামনে থেকে গ্রিন লাইন বাসে যান। এই বাসে বেশিরভাগ পশ্চিমের পর্যটক। কাঠমান্ডুর হোটেলে বললেই ওরা আপনার টিকিট বুক করে দেবে। এই বাসের ভাড়া একটু বেশি।

কাঠমান্ডু থেকে প্রাইভেট ট্যাক্সি নিয়েও যেতে পারেন। তবে তা হবে অত্যন্ত ব্যয়সাপেক্ষ। ট্যাক্সির কোনও ফিক্সড রেট নেই নেপালে।

উত্তরপ্রদেশের গোরখপুর বাস স্ট্যান্ড থেকেও রোডওয়েজ-এর বাস ও শেয়ার ট্যাক্সি যায় সুনাউলি, ভারত-নেপাল বর্ডার। এখান থেকে প্রাইভেট বাস ছাড়ে প্রতি রাতে, ভোরবেলায় পোখরা পৌঁছায়।

ফেওয়া লেক

পোখরার পর্যটন আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু নেপালের দ্বিতীয় বিশাল জলাশয়। লেকের পূর্ব পাড়ে যত হোটেল ও দোকান, লেকের জলে সদা ভাসমান নৌকোর সারি যেটাতে পারেন উঠে পড়ুন। আকাশ পরিষ্কার থাকলে লেকের জলে তুষার শৃঙ্গের প্রতিচ্ছবি অনবদ্য। মেঘলা থাকলেও ক্ষতি কি, লেকের জলের দিকে তাকিয়েও বহু সময় কেটে যায়। লেকের জল অবশ্য পরিশুদ্ধ নয় ঘোলাটে সবুজ রঙের।

লেকের মধ্যেখানে বরাহী দেবীর মন্দির, চাইলে নৌকো ভাড়া করে দেখে নিতে পারেন। ভক্তরা তাদের মনস্কামনা পূর্ণ হলে দেবীর মূর্তির সম্মুখে শনিবার পশুবলি দেন।

লেকের দক্ষিণে বিশ্ব শান্তি প্যাগোডা। যেতে চাইলে নৌকোয় লেক পাড়ি দিয়ে পায়ে হেঁটে পাহাড়ের মাথায় চড়তে হবে এই শ্বেতশুভ্র বিশাল প্যাগোডা দেখতে। এখান থেকে অন্নপূর্ণা শৃঙ্গ ও পোখরা শহর সুন্দর দৃশ্যমান।

লেকের পাশ বরাবর অসংখ্য কাফে, হোটেল। সকালে বা দুপুরে কফি-তে চুমুক দিতে দিতে হারিয়ে যান লেকের সৌন্দর্যে অথবা বোটিংও করতে পারেন লেকের জলে। যদি চান অলস ভাবে পায়ে পায়ে চলুন লেকের পাশ দিয়ে। সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের দৃশ্য অপূর্ব। সন্ধেবেলায় লেকের পাশ সেজে ওঠে নানা রঙের আলোর মেলায়। অনেক হোটেল বা রেস্তোরাঁয় চলে নেপালি সংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। আপনি চা পান করতে করতেও এর আনন্দ উপভোগ করতে পারেন। সঙ্গে বাচ্চারা থাকলে তারা যেন হইচই না করে সেইদিকে অবশ্যই খেয়াল রাখবেন। আর একটা কথা মনে রাখবেন অনেক শিল্পী এখানে টিপ্স-এর আশায় অনুষ্ঠান করে, হোটেল থেকে এদের কোনও মাইনে দেওয়া হয় না।

লেকের কাছে রয়েছে প্রচুর দোকানও তবে বেশিরভাগ, ভারত ও চিন-এর সস্তা সামগ্রী অনেক বেশি দামে বিক্রি করে। এখানে অনেক দোকানের মালিকই ভারতের কাশ্মীরিরা, টার্গেট কাস্টমার অবশ্যই ইউরোপ বা আমেরিকাবাসীরা, পণ্যের দাম শুনেই বুঝতে পারবেন। ভারতীয়দের এরা ঠকায় পশমিনা বিক্রি করে, কারণ একটাও দোকান পশমিনা রাখে না। অন্তত আমি কখনও দেখিনি। তাই অবশ্যই বুঝেশুনে জিনিস কিনবেন।

পোখরাতে অবশ্যই চেষ্টা করবেন লেকসাইড অর্থাৎ ফেওয়া লেকের কাছেই থাকতে, যদিও এখানকার হোটেল ভাড়া বেশি। সবসময় চেষ্টা করবেন ট্যাক্স সমেত রেট নিতে, পারলে হোটেল-এর কার্ডের পিছনে রেট লিখিয়ে নেবেন, ট্যাক্স সহ। হোটেল প্রচুর তাই আর নাম দিলাম না। আমি প্রত্যেকবার থেকেছি লেকের কাছে হোটেল মন্দাকিনীতে।

পোখরার পৃথ্বী চকের কাছে প্রচুর হোটেল রয়েছে। মাইক্রো ও সাধারণ বাস আড্ডাও এখানেই। এখানে টাকা বাঁচবে কিন্তু লেকের পাশে থাকার আনন্দ পাবেন না।

পোখরার মূল আকর্ষণ হিমালয়, যা দেখতে যেতে হবে ভোরবেলায়। এর জন্য আপনাকে ট্যাক্সি আগে থেকে বুক করতে হবে যা আপনার হোটেলই করে দেবে। আপনি যদি ফেওয়া লেকের কাছে থাকেন তবে এই লেক ছাড়া বাকি জায়গাগুলো ঘোরার জন্য গাড়ি ভাড়া করাই ভালো। পোখরাতে লোকাল বাস সার্ভিস না থাকার মতো। তাছাড়া আর এক অসুবিধা হল ভাষা। সবাই হিন্দি, ইংরেজি বুঝতে বা বলতে পারে না। পোখরা ঘুরে দেখবার জন্য আপনাকে দুটো দিন দিতে হবে।

বেগনাস ও রুপা লেক

পোখরা-কাঠমান্ডু পথে পৃথ্বী চকের থেকে প্রায় রপ্ত-রছ কিমি দূরে হাইওয়ে ছেড়ে উত্তরের পথে কিছুটা গেলেই এই লেক দুটি। দুটি লেকের মাঝে গহন অরণ্য ঘেরা টিলার নাম পঞ্চভাইয়াদণ্ড। অতি শান্ত এখানের পরিবেশ, লেকের জলে তুষার শৃঙ্গের প্রতিচ্ছবি। নৌকোয় চড়ে লেকের জলে মাছও ধরা যায়।

মহেন্দ্রপুল

পোখরার বুক চিরে বয়ে চলেছে তীব্র বেগে সেতি-গণ্ডকী যার জলের রং ঘোলাটে সাদা। কোথাও কোথাও সৃষ্টি হয়েছে গভীর গর্জ। পুরোনো মিশন হাসপাতালের কাছে মহেন্দ্রপুল থেকে দেখা যায় এই নদীর তীব্রতা।

ডেভিস ফল্স

নেপালিরা বলে পাতালে ছাঙ্গ, পাদ্রী খোলার জল প্রচণ্ড গর্জনে পাতালে প্রবেশ করছে। ডেভিস নামে কোনও এক বিদেশিনি এখানে স্নান করছিলেন, সেই সময় কাছের বাঁধের লকগেট খোলা হয়। পাদ্রী খোলার জল প্রচন্ড বেগে তাকে সমেত ভাসিয়ে নিয়ে প্রবেশ করে। তারপরে এটাকে ডেভিস ফল্স নাম দেওয়া হয়।

গুপ্তেশ্বর গুহা

ডেভিস ফল্স-এর উলটো দিকে বেশ কিছু ধাপ সিঁড়ি নামতে হয়। গুহাতে এক প্রাকৃতিক শিবলিঙ্গ পাওয়া যায় যা এখনও গুহাতেই আছে।কোথাও কোথাও জলে ভেজা ও পিচ্ছিল।

মহেন্দ্র গুহা

নেপালিতে ‘চামেরো ওধার’ মানে ‘বাদুড়ের ঘর’, লাইমস্টোন-এর গুহা। গুহার প্রাকৃতিক রূপ দেখতে গেলে সঙ্গে টর্চ নিয়ে আসতে হবে। খুব বেশি পর্যটক এই গুহা দেখতে আসে না।

পোখরা মিউজিয়াম

অবস্থান এয়ারপোর্ট ও মহেন্দ্রপুল-এর মাঝে। টিকিট আছে এবং ক্যামেরার চার্জ লাগবে। পশ্চিম নেপালের গুরুং, থাকলি ও তরু সম্প্রদায়দের ইতিহাস, বেশভুষা ও জীবনযাত্রা প্রদর্শিত হয়েছে এখানে।

বিন্দবাসিনী মন্দির

পুরোনো বাজারের কাছে জাগ্রত দেবী ভগবতীর মন্দির। জনশ্রুতি দেবীর কাছে মানত করলে তা বিফল হয় না। মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হলে পশুবলির প্রথা শনিবারে।

এছাড়া পোখরা থেকে শুরু হয়েছে নানা ট্রেক রুট যেমন ঘান্দ্রুক, জমসম, অন্নপূর্ণা সার্কিট ইত্যাদি।

গোর্খা

গোরক্ষনাথ (মহাদেব) ও গোরোক্ষকালী মন্দির থেকে জেলার নাম গোর্খা। শাহ বংশের প্রতিষ্ঠাতা দ্রব্য শাহ আমল থেকে ধীরে ধীরে শাহ রাজারা তাদের প্রতাপ নেপালে বিস্তার করতে থাকে। রাম শাহ ন্যায়বান রাজা।পৃথ্বী নারায়ণ শাহ কাঠমান্ডু আক্রমণ করে ওখানকার নেবারী রাজাকে তাড়িয়ে, নিজের দখলে নিয়ে আসে। রাজধানীও গোর্খা থেকে স্থানান্তরিত হয় কাঠমান্ডুতে। গোর্খা সৈন্যরা পৃথ্বী নারায়ণের নেতৃত্বে একে একে নেপালের শতাধিক ছোটো ছোটো রাজ্যগুলোকে জয় করে গড়ে তোলে আজকের নেপাল। গোর্খাদের সাহসী ও লড়াকু স্বভাবে অনুপ্রাণিত হয়ে ব্রিটিশরা গোর্খা রেজিমেন্ট গড়ে। আজও ভারতে ও ব্রিটেনে গোর্খা রেজিমেন্ট রয়েছে। যার উৎপত্তি এই গোর্খা জেলা। এই জেলার বহু সন্তান সৈনিক। আজকের নেপালি ভাষাও পূর্বের গোর্খালি ভাষা। নেপালের ইতিহাসে পৃথ্বী নারায়ণ শাহ এক উজ্জ্বল নাম, বহু জনশ্রুতি রয়েছে পৃথ্বী নারায়ণকে ঘিরে।

গোর্খা কাঠমান্ডু থেকে পোখরা যাওয়া যায়। গোর্খা অবশ্যই নেপালের সাধারণ টুরিস্ট ম্যাপেও তেমনভাবে অন্তর্গত নয়। তাই যাবার, থাকবার বা ঘোরার সুবিধা সীমিত। কাঠমান্ডুর বালাজু থেকে মাইক্রো বাস যাচ্ছে সোজা গোর্খা বাজার। এছাড়া পোখরা থেকে কাঠমান্ডু ফেরার পথে আবু খয়রানি নেমে পড়ুন। এখানে লোকাল বাস পাবেন গোর্খা বাজার যাবার জন্য।

গোর্খা বাজার থেকে র কিমি আগে হাতেগোনা কয়েকটা হোটেল, অতি সাধারণ মানের যার মধ্যে গোর্খা ইন আমার সবথেকে পছন্দের। আগে হোটেল ঘুরে নিজের ঘর পছন্দ করে নেবেন।

গোর্খা দরবার

ঐতিহাসিক এই দরবারের অবস্থান এক টিলার মাথায় গোর্খা বাজারের ওপরে। একই সাথে দুর্গ, রাজসভা ও মন্দির। পায়ে পায়ে খাড়া চড়াই ভেঙ্গে পৌঁছোতে হবে। হাঁটা পথ এঁকেবেঁকে উঠেছে পাহাড় বেয়ে। গোর্খাদের ছোটো ছোটো গ্রাম পথের পাশে। খেলা করছে শিশুর দল, বড়োরা রোদ পোয়াচ্ছে বা আড্ডায় ব্যস্ত। ওরাই দরবারের পথ দেখিয়ে দেবে। পাহাড়ের মাথায় পৌঁছোতে শেষের দিকে আছে অনেক ধাপ সিঁড়ি। পাহাড়িপথে হাঁটতে অভ্যস্ত হলে র ঘণ্টা, নচেৎ আরও বেশি সময় লাগতে পারে। এখানে আছে গোরক্ষনাথ ও গোরোক্ষকালী মন্দির। দুর্গাপূজার সময় পশুবলি দেওয়া হয়। এখান থেকে মানাসলু ও হিমলচুলির দৃশ্য অসাধারণ। পায়ে স্নিকার ও সঙ্গে খাবার জল নিতে ভুলবেন না।

মিউজিয়াম

দরবার দেখা শেষ হলে নেমে আসুন নীচে মিউজিয়াম দেখতে। টিকিট ও ক্যামেরার চার্জ লাগবে। এখানে সাজানো আছে শাহ আমলের বাসনপত্র, পেইন্টিং ও অস্ত্রশস্ত্র।

মনকামনা মন্দির

রোপওয়ে হবার আগে আবু খয়রানি থেকে পায়ে হেঁটে খাড়া পাহাড় পথে কয়েক ঘণ্টায় পৌঁছোনো যেত এই মন্দিরে। আজও অনেকেই পাহাড়ি গ্রাম ও নাসপাতি, কমলালেবুর বাগানের পাশ দিয়ে হেঁটে পৌঁছোয় এই মন্দিরে। জনশ্রুতি, দেবী সকলের মনের কামনা পূর্ণ করেন। কাঠমান্ডু পোখরা পথে হাইওয়ের ওপরেই রোপওয়ে পৌঁছে দেবে পাহাড় চূড়ার মন্দিরে। ছুটির দিনগুলোতে ভালোই ভিড় হয়। মন্দির থেকে হিমালয় শৃঙ্গ ও গোর্খা শহর সুন্দর দেখা যায়।

আমার দীর্ঘ নেপালের অভিজ্ঞতায় দেখেছি প্রচুর পর্যটক টাকা খরচা করে কম্বল কিনে নেপাল থেকে ফেরেন। নেপালে অল্প মুনাফায় কেউ ব্যাবসা করে না। ওই সব কম্বল চিনের তৈরি, চিন-নেপাল সীমান্তে এর দাম অনেক কম।

কাঠমান্ডুতে চিনের জ্যাকেট, সোয়েটার, মেয়েদের ব্যাগ নিউ রোড-এ দোকান ঘুরে দেখে বুঝে কিনবেন। দরদাম চলে। অনেক মলে বিদেশি চকোলেটও পাবেন।

মেলঘাট

দলবল মিলে বেরিয়ে পড়া গেল মহারাষ্ট্রের Melghat ব্যাঘ্র সংরক্ষণ-প্রকল্পের উদ্দেশ্যে। হাওড়া থেকে গীতাঞ্জলি এক্সপ্রেসে চড়ে চলে এলাম নাগপুর। আগেই গাড়ির বন্দোবস্ত করা ছিল, মালপত্র নিয়ে তাতে উঠে পড়া। আমাদের যাত্রা হল শুরু। শহর ছাড়াতেই পথের ধারে শুরু হল ঝরাপাতার খেলা অর্থাৎ পর্ণমোচী অরণ্যভূমি। পূর্ণতা যেমন সুন্দর তেমনি রিক্ততার সৌন্দর্যও কম নয়। ভারি সুন্দর লাগছে এই পাতা ঝরার মেলা। পথে মাঝে মাঝে অবশ্য বড়ো বড়ো শহরতলিও পড়ছে, দোকান বাজার, কোথাও কোথাও হাটও বসেছে।

কোটল নামে এক জায়গায় আমরা একটা দোকানে ব্রেকফাস্ট করলাম। আবার চলা। পথের ধারে নানা খেতখামার–ওলকপি, গম, যব, বাজরার খেত। সবুজ ও সোনায় মেশামেশি। কাপাসতুলোর খেতে বরফ সাদার ঝিলিক। মাঝে আবার গাঁদা ফুলের চাষ হচ্ছে, হলুদ আর গেরুয়ার মিতালি। পথ এগোয়, চোখে পড়ে কমলা রঙের কমলালেবু ঝুলছে। সৌন্দর্যের মোহময়ী নাগপাশে মন ধরা পড়ছে ক্ষণে ক্ষণে।

এসে পড়লাম পারাতোয়ারায়, বেশ বড়ো জনপদ। একটা দোকানে লাঞ্চ খাওয়া হল। এখানে হাট বসেছে। কমলালেবু, আঙুর, কলা কিনে আবার চলা। এবার ঢেউ খেলানো পাহাড়ি উপত্যকা দিয়ে। দু’ধারে পর্ণমোচী বৃক্ষের সারি। সেগুন গাছের প্রাবল্যই বেশি। প্রায় পাঁচটার পর সন্ধ্যা নাগাদ পেৌঁছোলাম সীমাডো গ্রামে, মেলঘাট ব্যাঘ্র সংরক্ষণ-প্রকল্পের দ্বারপ্রান্তে। গেট খুলে অন্দরে প্রবেশ। আগেই ঘর বুক করা ছিল। আমাদের দলের আটজনের জন্য চারটি বনকুটির। কুটিরে ঢুকে ভালো লাগল, সামনে বারান্দা। ঘর মোটামুটি প্রশস্ত, খাটবিছানা মোটামুটি পরিষ্কার, ঘর লাগোয়া সাজঘর এবং তার লাগোয়া বাথরুম, গিজারও আছে। কিন্তু মেন্টেনেন্স-এর কিছু গাফিলতি রয়েছে। বাংলোগুলি সিপলা নদীর একেবারে ধারেই।

অবশ্য নদী জলহীনই বলা চলে। তবু চেয়ে থাকতে ভালো লাগে। অন্যপারে খেত, চাষিদের ঘরবাড়ি, চাষিদের বাচ্চারা খেলছে, বেশ লাগে দেখতে। বাংলোগুলির চারিদিকে পত্রহীন গাছ। গাছের নীচে ঝরা পাতার স্তূপ। কানে আসছে পাখিদের কলতান।

ডাইনিং হলে গিয়ে চায়ের সঙ্গে জমে উঠল আড্ডা আর গান। গোধূলিলগন পার হয়ে আঁধার নামার আগেই পূর্বগগনে চাঁদের হাসির ঝিলিক। মন ভরে ওঠে। ক্রমে রাত বাড়ে, আমরা নদীর ধারে এসে বসি, রূপোলি জ্যোৎস্নার ঝরনাধারায় স্নান করে চারিদিক। চাঁদের নীল আলোর ইন্দ্রজাল আর সুরের মূর্ছনায় মন অনিকেত হয়ে ওঠে।

সাতপুরা পর্বতমালার দক্ষিণ ঢালে অবস্থিত মেলঘাটে বৃষ্টির আধিক্য বেশি হওয়ায় অরণ্যগভীর, মূলত পর্ণমোচী অরণ্যের প্রাচুর্য। টিক, মহুয়া, বহেড়া, পলাশ, তেন্ডু আর বাঁশে ছাওয়া অরণ্যভূমি। শোনা যায় এই বনভূমিতে অনেক বাঘের বাস। তাছাড়া রয়েছে গাউর, নীলগাই, শম্বর,

চিংকারা, চার শিঙের কৃষ্ণসার মৃগ ছাড়াও নানান জন্তু এবং শতাধিক নানা প্রজাতির পাখি মেলঘাটের বৃক্ষশাখায়। আর আছে এই অঞ্চলে ব্যাসোদে, গোণ্ডা, মাডিয়াস, কোলামস ও কোর্কু উপজাতিদের বসবাস। কোর্কু উপজাতির মানুষ খুব উৎসব প্রিয়। এদের বিয়ের নাচ বিশেষ বর্ণময়, স্থানীয়রা এই নাচকে বলে বিহাউ। আর গোন্দদের নাচের নাম ধেমসা।

পরের দিন ভোরবেলাতেই ঘুম ভাঙে, বাইরে এসে দেখি চাঁদ তখন পশ্চিমাকাশে জ্বলজ্বল করছে। চারিদিক জ্যোৎস্নায় মাখামাখি। ভোরের আলোয় আমাদের বাংলোর নাম চোখে পড়ল জারুল, বেশ মিষ্টি নাম। দেখলাম প্রত্যেক বাংলোতেই নাম লেখা আছে। চা খেয়ে গাড়ি চড়ে বেরিয়ে পড়া। আমাদের গন্তব্য কোলকাস বনবাংলো। চারিদিকের ঝরেপড়া সৌন্দর্যে চোখ ডুবিয়ে চলা। হরিশাল জনপদে থামা হল প্রাতরাশের জন্য। চিঁড়ের পোলাও (এখানে বলে পোহা), আলুর বড়া ও ক্ষীর দিয়ে জমিয়ে খাওয়া হল।

আবার চলা। সাতপুরা পাহাড়ের মেকলে রেঞ্জের উপর এই বনভূমি প্রাকৃতিক প্রাচুর্যে ভরা। কখনও পথ অনেক উঁচুতে উঠে যাচ্ছে আবার কখনও পথ গভীর নীচু উপত্যকায় নেমে যাচ্ছে। কোথাও অরণ্যের সজীব সবুজ, কোথাও পর্ণমোচী বৃক্ষের পত্রহীন রিক্ততা, কোথাও পাকা ফসলের সোনার বরণ। মাঝে মাঝে এঁকে বেঁকে নদী প্রবাহমানা। এখন অবশ্য নদীগুলিতে জল খুবই কম তবে বর্ষাকালে এদের রুপোলি জলধারা দেখার মতো। গাছে গাছে পক্ষীকূল, তাদের কূজন কানে ভেসে আসছে। উঁচু-নীচু ঢেউ খেলানো পথ ধরে পৌঁছোলাম কোলকাস বনবাংলোর দ্বারে। ভারি সুন্দর জায়গা। কোলকাস

বনবাংলো মেলঘাট অভয়ারণ্যের মধ্যে সব থেকে ভালো। এখানে থাকতে হলে বিশেষ পারমিশনের প্রয়োজন হয়। কোলকাসে কোরকু সম্প্রদায়ের বাস। বাংলোর সামনে দিয়ে দু’ধারের ঘন জঙ্গলকে সঙ্গী করে এঁকেবেঁকে বয়ে চলেছে সিপলা নদী। এখানে সিপলা নদীতে কিছু জল আছে আর অরণ্যভূমিও পাতাঝরা নয় সবুজ-সজীব। আশ্চর্য সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্য, এই বাংলো থেকে দৃশ্যমান। ইন্দিরা গান্ধির খুব প্রিয় ছিল এই বাংলো। সময় পেলেই এখানে এসে দু’একদিন কাটিয়ে যেতেন।

বাংলো দেখা শেষ করে আমাদের গাড়ি ছুটল তারুবান্দা বনবাংলোর পথে। এই বাংলোটিতে অরণ্যের নির্জনতা বোধহয় বেশি অনুভূত হয়। বাংলোর চারিদিকে ঝুরি নামা বটবৃক্ষ, জায়গাটিকে আরও নির্জন করে তুলেছে। বাংলোর সামনে ম্যাজেন্টা রঙের বোগোনভেলিয়ার উজ্জ্বল হাসি। বারান্দায় অনেক পাখির ছবি রয়েছে। কোলকাসের পথে একটি গাছের ডালে বসে থাকতে দেখেছি একটি ক্রাস্টেড সারপেন্ট ঈগল। আর কয়েকটি নীলকণ্ঠ। বাংলোর প্রাঙ্গণে দেখেছি ছাতারে, মুনিয়া, নানা প্রজাতির টিয়া, বুলবুলি, শালিখ, ফরেস্ট আউলেট, হাঁড়িচাচা, ঘুঘু, বেনেবউ প্রভৃতি।

এরপর যাওয়া হল ঢাকনা বনবাংলো দেখতে। গাড়গা নদীর ধারে ঢাকনা বনবাংলো। থাকার ঘর, বাংলোতে মনে হল একটি। ছোটো বাংলো খুব নির্জন নিরিবিলি। এই অরণ্যভূমির উপর দিয়ে পঞ্চনদী প্রবাহমান। সিপলা, গাড়গা, খাপরা, খাণ্ডু, ডোলার।

বিকেলে আবার গাড়ি করে বার হলাম পথে, গন্তব্য পিপলপাড়া অরণ্য। এটি অরণ্যভূমির কোর এরিয়া। বনভূমিতে ঢোকার মুখেই অদ্ভুত দর্শন একটি গাছ দেখতে পেলাম, নাম—- ক্রোকোডাইল বার্ক ট্রি, সত্যিই কুমিরের চামড়ার মতোই গাছটির ছাল। আর চোখ কাড়ল কুসুম বৃক্ষের নব পত্রাবলির রক্তিম শোভা। বেশ অনেকক্ষণ অরণ্য ভ্রমণের পর দেখা পাওয়া গেল একজোড়া ময়ূর-ময়ূরীর। হঠাৎ দেখা পাওয়া গেল এক দঙ্গল গাউরের (ইন্ডিয়ান বাইসন) পুরো পরিবার, কচিকাঁচাদের নিয়ে বৈকালিক ভ্রমণে বেরিয়েছে। বেশ ভদ্র আচরণ, পোজ দিয়ে ছবি তুলল, তারপর বনের মধ্যে অদৃশ্য। আমরাও ফেরার পথ ধরলাম। ফেরার পথে দেখা হল বনমের পিরখোদা প্রোটেকশন হাট। হঠাৎ বন্য জন্তুর সাক্ষাৎ মিললে এই হাটে ঢুকে আত্মরক্ষা করা যায়। ঘন করে ও বেশ উঁচু করে ঘেরা কিছুটা জায়গা। ফিরতে ফিরতে সূর্যদেব পশ্চিম আকাশে আগামী দিনের হোলির রং পূর্বাহ্নে ঢেলে বিদায় নিলেন। সন্ধ্যা পেরিয়ে সীমাডোতে পৌঁছোলাম।

কাকভোরে উঠে ঘরের বাইরে এসে পূর্ণচন্দ্রের সঙ্গে সাক্ষাৎ হল। অরণ্যভূমি মায়াআলোর পরশে মোহময়ী। ধীরে ধীরে বইছে ভোরবেলার বাতাস। রওনা হলাম অরণ্য ভ্রমণে। জাবিদার পথে যেতে পথে পড়ল মাখালা গ্রাম। বেশ বড়ো গ্রাম। অনেক লোকের বসবাস রয়েছে মনে হল। পথের ধারে মহুয়া গাছের বেশ আধিক্য, ডালে মহুয়া ফুলের কুঁড়ি ধরেছে। আম্রমুকুলের গন্ধ বাতাসে ভেসে আসছে। একটা জায়গায় গাড়ি থামিয়ে আমরা প্রকৃতির স্নেহচ্ছায়ায় বসে সকালের প্রাতরাশ করলাম।

পরেরদিন সকালে তৈরি হয়ে গাড়িতে মালপত্র তুলে রওনা হওয়া গেল মহারাষ্ট্রের একটি শৈলশহর চিকলদারার উদ্দেশে। ঘড়িতে তখন সাতটা বাজে। এখান থেকে চিকলদারা ঘণ্টা দেড়েকের পথ। আশ্চর্য সুন্দর পথের শোভা। আমরা যেন কোনও অমর্ত্যলোকের পথ ধরে চলেছি। মাঝে মাঝেই সবুজের হাতছানি চোখে পড়ছে। এ পথের সবুজায়নই বেশি দেখা যাচ্ছে। একটি বড়ো পাইন বাগানও দেখলাম। ক্রমে পেৌঁছে গেলাম চিকলদারায়। প্রথমেই একটা রেস্তোরাঁয় ব্রেকফাস্ট করা হল তারপর যাওয়া হল এসটিডিসি-র রিসর্টে। ভালোই ব্যবস্থা। ঘরে মালপত্র রেখে গাইডের সঙ্গে বেরিয়ে পড়া গেল এখানকার দ্রষ্টব্যের উদ্দেশে। আমাদের রিসর্টের কাছেই গোরাঘাট বা ঘোড়াঘাট পয়েন্ট। খানিকটা সোজা পথে গিয়েই সামনে বিশাল খাদ, যেন মেঘেদের খেলাঘর। এখানে একটা গল্প আছে, ইংরেজ আমলে দুটি ঘোড়ায় চড়া সাহেব খাদটির অস্তিত্ব বুঝতে না পেরে ঘোড়া সমেত এই খাদে পড়ে যান, তাই এই পয়েন্টের নাম গোরাঘাট।

এরপর প্রসপেক্ট পয়েন্ট, এই পয়েন্টে দাঁড়ালে তলায় ঘন জঙ্গল দেখা যায়। এখান থেকে অনেক সময় নাকি জন্তুজানোয়ার দেখা যায়। এবার গেলাম হারিকেন পয়েন্ট। এই পয়েন্টে দাঁড়ালে মনে হয় যেন ঝড় হচ্ছে, হাওয়ার বেগ এখানে এত প্রবল। এই পয়েন্টের নীচে শিবসাগর জলাশয়। এই হ্রদ থেকে চিকলদারা শহরে পানীয় জল সরবরাহ করা হয়। ইকোপয়েন্টের নাম হল পঞ্চবুল, পাঁচ পাহাড়ে ঘেরা জায়গাটি খুব সুন্দর। এই পয়েন্টে দাঁড়িয়ে চিৎকার করলে সারা উপত্যকায় প্রতিধবনিত হয় অর্থাৎ পাঁচ পাহাড়ের গায়ে আঘাত করে স্বর প্রত্যাবর্তন করে।

এরপর দেখতে যাওয়া হল ভীমকুণ্ড। কিংবদন্তি আছে, এখানে পঞ্চপাণ্ডবের মধ্যে পাণ্ডব ভীম অজ্ঞাতবাসকালে যখন বিদর্ভ রাজবাড়িতে থাকতেন তখন এখানে স্নান করতেন এবং এইখানেই নাকি রাজার শ্যালক লম্পট কীচককে বধ করেন। পূর্বে এখানকার নাম ছিল বিরাট নগর। কীচক বধের পর এখানকার নাম হয় কীচকদারা পরে চিকলদারা, মাঝে এখানকার নাম হয়েছিল গাভীলগড়। ভীমকুণ্ড, জলের একটি ছোটো কুণ্ড, তার সামনে পাহাড়ের অন্দরে বেশ বড়ো গুহা রয়েছে এবং গুহার মধ্যে দেবীর অবস্থান। দেবীর নাম অম্বাদেবী, সুন্দর মূর্তি। আর গুহার নাম পাণ্ডব গুহা। ওখান থেকে দেখতে পেলাম দূরে চন্দ্রভাগা ড্যামের সুনীল জলের ইশারা। এই জায়গাটির সামনে একটি ছোটো হ্রদ আছে তাতে নৌবিহার করা যায়। ফেরার পথে দেখা হল পূর্বের গভর্নর হাউস, এখন এটি সার্কিট হাউস হয়েছে। আমরা অন্মুতি নিয়ে ভিতরে প্রবেশ করে দেখে এলাম, সুন্দর সাজানো।

এবার দেখা হল এখনকার মতো শেষ দ্রষ্টব্য গাভীল গড় দুর্গ।  বিজয়নগরের (হাম্পি) রাজা কৃষ্ণদেব রায় নির্মাণ করেছিলেন। এক কালে বিশাল ছিল এই দুর্গ এখন কয়েকটি গেট অবশিষ্ট আছে তাও অর্ধভগ্ন, তাছাড়া সবই

ধবংসস্তূপ। জায়গাটি খুব সুন্দর এবং ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে বেশ রোমান্টিক। দুর্গের যেটুকু এখনও অবশিষ্ট আছে, ঘুরে ঘুরে দেখতে বেশ ভালো লাগে।

ফেরার পথে। আমাদের চোখে পড়ল কফি বাগান, এখানে ভালোই কফি চাষ হয় এবং এখানকার কফি বেশ উন্নতমানের। বাজার থেকে আমরা কিছু কফি কিনলাম। রিসর্টে ফিরে লাঞ্চ করা হল।

সামান্য বিশ্রামের পর আবার বেরিয়ে পড়া, এবার যাওয়া হল এখানকার ফরেস্ট গার্ডেনে। নানা পুষ্প সম্ভারে ও নানা জাতীয় বৃক্ষে সুন্দর এ বাগান। ঘুরে ঘুরে দেখা হল। তারপর গেলাম মাঝরি পয়েন্টে সূর্যাস্ত দেখতে। এখানকার ল্যান্ডস্কেপ-টি অপূর্ব। একটি বড়ো কুসুম গাছে রক্তরাঙা নবপত্রাবলি গোধূলির রাঙা রং মেখে মনোহরণ করছে। পশ্চিমাকাশে মহাজাগতিক রং ছড়িয়ে অস্তগামী হলেন অরুণদেব। গোধূলির বৈরাগ্যের রঙে মন উদাস হল। এবার ফেরার পথে।

পরের দিন খুব ভোরে উঠে বেরিয়ে পড়া গেল। চারিদিক কুয়াশা মাখা মায়াবী প্রকৃতি বেশ লাগছে হাঁটতে। আকাশে মেঘের খেলা দেখতে দেখতে রিসর্টে ফিরে এলাম। তখন আলো ফুটি ফুটি করছে। রিসর্টের বারান্দা থেকেই দেখতে পাওয়া গেল অপরূপ সূর্যোদয়। মন ভরে গেল। আজই আবার ফেরার পালা। কিছুটা দূরে নাগপুর স্টেশন। সন্ধ্যায় গীতাঞ্জলি এক্সপ্রেসে রওনা হলাম হাওড়ার পথে। চোখে তখনও মায়াবী সৌন্দর্যের পরশ লেগে আছে।

মেলঘাট ব্যাঘ্র-প্রকল্পের তালিকা

  •  মেলঘাট ব্যঘ্র সংরক্ষণ প্রকল্প অমরাবতী জেলায় অবস্থিত (মহারাষ্ট্র)। অমরাবতী চিকলদারা এবং ধারনি তহশিলে অবস্থিত। এখানে পাঁচটি ওয়াইল্ড লাইফ স্যাংচুয়ারি রয়েছে
  • ওয়ান ওয়াইল্ড লাইফ স্যাংচুয়ারি অমরাবতী। চিকলদারা এবং ধারনি তহশিল
  • নারনালা ওয়াইল্ড লাইফ স্যাংচুয়ারি অকট তহশিল (অকোলা জেলা)
  • আম বাবারওয়া ওয়াইল্ড লাইফ স্যাংচুয়ারি
  • সংগ্রামপুর তহশিল (বুল ধানা জেলা)
  • গুগামল ন্যাশনাল পার্ক।

হলিডে হট-স্পট

প্রতিদিনের একঘেয়ে জেটগতির জীবনযাপন থেকে মাঝেমধ্যে মুক্তি চায় মন। সেই জন্যই বাঙালি জীবনে হইহই করে ঢুকে পড়েছে গেট অ্যাওয়ের এক্সাইটমেন্ট। কিন্তু, কোথায় যাবেন সপরিবারে কিংবা শুধু সঙ্গীকে নিয়ে ছুটি কাটাতে?

কেউ ভালোবাসেন পাহাড়, কেউ সমুদ্র, কেউ আবার উপভোগ করতে চান জঙ্গলের রোমাঞ্চ। তবে যেখানেই যান না কেন, যাতায়াত, থাকা-খাওয়ার সুবিধে, সুন্দর প্রকৃতি এবং নিরালা– এসব দেখে নেওয়া জরুরি। অতএব, আপনাদের বেড়ানোর আনন্দকে পূর্ণতা দিতে, আমরা এবার বেছে নিলাম ভারতবর্ষের অন্যতম দুটি টুরিস্ট স্পট— কোদাইকানাল এবং কানহা। যারা এখনও এই দুটি স্পট-এ যাননি, তারা তাদের নেক্স টুর প্ল্যান-এ রাখতে পরেন এই দুটি জায়গার যে-কোনও একটি।

কান্হা ন্যাশনাল পার্ক

যারা আরণ্যক পরিবেশ ভালোবাসেন, তাদের জন্য আদর্শ গন্তব্য– মধ্যপ্রদেশের কান্হা ন্যাশনাল পার্ক। কান্হার গভীরে যাওয়া ভীষণ রোমাঞ্চকর! বনরাস্তায় চলে জিপ। রাস্তার দু’দিকে ভরে আছে থেমিডা ঘাস। দীর্ঘ ঘাসজমি পেরিয়ে ঢুকতে হয় অরণ্যে। যাওয়ার পথে চরে বেড়াতে দেখবেন নানারকম হরিণ। কৃষ্ণসার, চিতল এবং বারো-শিঙা হরিণ, কান্হার অলংকার। ঝাঁকে-ঝাঁকে ময়ূরও মুগ্ধ করবে আপনাকে। এছাড়া, নিরাপদ দূরত্বে থেকে বাঘ দর্শনেরও ব্যবস্থা করেছে কান্হার বনদফতর। কাঞ্জনা, বুলবুলি, দোয়েল, সোনাবউ, বসন্তবৌরি, পাপিয়া, হাঁড়িচাচা, কোকিল, তিতির প্রভৃতি প্রায় দুই শতাধিক প্রজাতির পাখির দেখা মিলবে কান্হার জঙ্গলে। আছে ঝুঁটিওয়ালা ঈগলও। ফুলে-ফুলে উড়ে বেড়ানো নানারঙের প্রজাপতিও, কান্হার বুনো সৌন্দর্যকে সম্পূর্ণতা দেয়।

এই কান্হা, বিন্ধ্যপর্বতের মাঝে মেখল পাহাড়ের অন্যতম অরণ্য। শাল, বাঁশ আর বহেরায় ঘেরা এই অরণ্যের আশপাশ দিয়ে বয়ে চলেছে বানজার, সুলকুম এবং হালোঁর নদী। আর আছে ‘তালাও’ বা বড়ো জলাশয়। কথিত আছে, এই তালাও থেকে জল নিতে এসে দশরথের তিরবিদ্ধ হন অন্ধমুনির পুত্র শ্রবণ বা সিন্ধু। তাই, এই তালাওর নাম হয়ে যায় ‘শ্রবণ তালাও’।

কান্হার দ্রষ্টব্য বলতে আর আছে একটি সানসেট পয়েন্ট। সূর্যাস্ত ছাড়াও, জঙ্গলের জীবজন্তু দেখা যায় এই সানসেট পয়েন্ট থেকে। তবে, সঙ্গে একটা বাইনোকুলার অবশ্যই রাখবেন। আর এই জঙ্গলভ্রমণ যেমন হুড খোলা জিপসিতে করতে পারেন, ঠিক তেমনই ভ্রমণকে আরও রোমাঞ্চকর করে তুলতে পারেন হাতির পিঠে চড়ে। কিন্তু সাবধান, শিকারের খোঁজে গাছের শাখায় ওত পেতে থাকে চিতা!

আর হ্যাঁ, কান্হা ভ্রমণের শেষ পর্বে, সাইড-টুর হিসাবে রাখুন খাজুরাহো মন্দিরকে। কান্হার মুক্বি থেকে কিছুটা পথ পাড়ি দিলেই পৌঁছে যাবেন ছত্তিশগড়ের ওই মন্দিরে। মধ্যপ্রদেশ টুরিজম কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করলে থাকা, খাওয়া এবং বেড়ানোর সুযোগসুবিধা পাবেন।

কীভাবে যাবেন

হাওড়া থেকে রেলপথে, হাওড়া-মুম্বই ভায়া এলাহাবাদ হয়ে পৌঁছোন জব্বলপুরে। ওখান থেকে বাসে করে কিসলি হয়ে কান্হা।

যোগাযোগ

দূরভাষঃ  (কান্হা সাফারি)

কোদাইকানাল

তামিলনাড়ুর এক অসাধারণ টুরিস্ট স্পট– কোদাইকানাল। নীল পাহাড় আর সবুজে ছাওয়া সুন্দর প্রকৃতি। কোদাই বিখ্যাত কমলালেবু, কলা, পাইন এবং ইউক্যালিপটাসের জন্য। এ অঞ্চল সূর্যালোকে আলোকিত হয় প্রায় বারো ঘণ্টা। কোদাইয়ের চাঁদের আলোয় স্নানও অপার্থিব। বিভিন্ন ধরনের (প্রায় শতাধিক) পাখির উপস্থিতিও চোখে পড়ার মতো। আর এই পাহাড়ি প্রকৃতির শোভা বাড়িয়েছে বেরিজাম লেক। এই লেক-এ রয়েছে তিনটি বোটিং পয়েন্ট। বোটহাউস-এ থাকার সুব্যবস্থাও রয়েছে। লেক-লাগোয়া অঞ্চলে রয়েছে ব্রায়ান্ট পার্ক। প্রায় সারা বছরই রংবেরং-এর ফুলে ভরে থাকে এই পাহাড়ি উদ্যান। নানা জাতের অর্কিড শোভিত করেছে কোদাইকানালকে। এই পাহাড়ি অঞ্চলে বাড়তি আনন্দ দেবে জলপ্রপাত। ক্যাসকেড, ফেয়ারি, বিয়ার শোলা, দ্য গ্রেন প্রভৃতি জলপ্রপাতগুলি পর্যটকদের মুগ্ধ করবেই। এককথায়, নিরালাযাপনের এ এক অতুলনীয় ঠাঁই।

কীভাবে যাবেন

হাওড়া থেকে কন্যাকুমারী এক্সপ্রেস-এ সরাসরি পৌঁছে যান কোদাই-এ। তবে ট্রেন ছাড়ে সপ্তাহে একদিন, শুধু সোমবার বিকেলে।

যোগাযোগঃ তামিলনাড়ু টুরিজম।

 

পড়ার জন্য সীমাহীন গল্প-নিবন্ধসাবস্ক্রাইব