মণিদা আমি এলাম (পর্ব ১)

মণি ঘোষাল। ইন্টেলেকচুয়াল। ছুঁচলো তার দাড়ি, অনেকটা আব্দুল মাঝির মতন। চোখে রিমলেস। ষাটোর্দ্ধ। টানটান আপাদমস্তক। ঠোঁট সতত একটা আলগা হাসির ক্লান্তিতে ঝুলন্ত। লম্বা চুলের মাথা সাহিত্যে খচাখচ। পায়ে কোলাপুরি। কাঁধে পত্রিকা ঠাঁসা শান্তিনিকেতনি ঝোলাব্যাগ। নীল জিনস-এর সাথে সাদা পাঞ্জাবি। সেই কোন বছর চল্লিশ আগে পথ চলা শুরু।

মণি তখন বছর কুড়ির উঠতি কবি সাহিত্যিক। দু’চারজন ঘনিষ্ঠকে সাথে নিয়ে প্রকাশ করল— ‘আসানসোলের দিনরাত্তির’ পত্রিকার প্রথম সংখ্যা। তখন তো তার বিশ্বজয়ের আনন্দ। দু’টো ছোটোগল্প আর খান চল্লিশেক কবিতার প্রশ্রয়কে সঙ্গী করে তার সদর্প আবির্ভাব আসানসোলের সাহিত্যজগৎকে আলোকময় করে তুলল।

তারপর তো দেখতে দেখতে বেশ কয়েকটা দশক কেটে গেছে। মণি ঘোষালের সোসিও—ইকনমিক ফান্ডাও নাকি বাড়তে বাড়তে এখন দারুণ শক্তিশালী! কিছুদিনের মধ্যেই বুঝে গেছিল পত্রিকা প্রকাশের সাথে সাথে বই প্রকাশনাটাও একান্ত জরুরি। পত্রিকা কুনকি হাতির কাজ করবে— যাতে করে বই প্রকাশনাটাও নিয়মিত থাকে৷ এইভাবেই মণি মূলত অর্থকরী দিকটা সামাল দেয়।

পত্রিকা নতুন নতুন কাব্য প্রতিভার সন্ধানের একটা ইন্সট্রুমেন্ট আর তারপর কিছু সময় অপেক্ষা এবং একদিন ঝপাং করে বই প্রকাশনার যাঁতাকলে পড়ে ছটপটাবে বেচারা কবি সাহিত্যিক কমপক্ষে হাজার পনেরোর ধাক্কায়! আর পায় কে? মণি তার মলাট উন্মোচনের জন্য পকেট কাটবে, তাকে সংবর্ধনা দেওয়ার জন্য পকেট কাটবে। পুশসেলের সব পয়সাই যে মণির পকেটস্থ হবে সেটা বলাই বাহুল্য। নামডাকে মণি কিন্তু বেশ তুখোড় পরিচিতির নিরিখে। নিন্দুকেরা সময় সময় তার সম্পর্কে মন্দভালো কিছু না কিছু বলেই থাকে। তাতে অবশ্য তার কিছু যায় আসে না। সে নাকি আদ্যোপান্ত নিবেদিত সুমহান এক সাহিত্য প্রাণ। অক্ষরকর্মী শব্দকর্মী এরকম নানা বিশেষণেই নাকি তার ঝুলি বিভূষিত।

লোকে পিছনে তাকে ‘মাল ঘোষাল’ বললে কী হবে, সামনে তো গদগদ ভাব দেখিয়ে দাঁত কেলিয়ে হে হে… করতে থাকে! মণি এটাও জানে লোকে ঈর্ষা থেকেই এইসব অপপ্রচার করে থাকে। যাইহোক, নেগেটিভ হলেও প্রচার তো একটা বটেই। লাদেনের নাম কে না জানে— সে যে- জন্যই হোক! জানে কি না? একশোবার হাজারবার অস্বীকার করে সাধ্যি কার? মণি তার প্রবল অস্তিত্বটার গোড়ায় নিয়মিত জল সার দিতে ভুল করে না কখনও। মাসে দু’তিনটে গল্প আলোচনা কবিতা পাঠের আসর জমাবেই জমাবে। দশ পনেরো জন তো এমনি এমনিই জুটে যায়। অবশ্য তাদের অধিকাংশই একদা চাকুরিজীবী বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত। সময় কাটাতে কবি সাহিত্যিক হতে গিয়ে মণির খপ্পরে।

কিংবা হয়তো একদা গৃহকর্মে নিপুণা এখন প্রৌঢ়ত্বে পা দিয়ে কবি কিংবা গল্পকার হয়ে ওঠার বাসনায় মণির ভেল্কিবাজি ধরতে না পেরে গল্পপাঠের আসরে দিস্তাখানেক কাগজ নিয়ে হাজির। মাঝবয়সিরা থাকে না এমন নয় তবে সংখ্যারলঘু পর্যায়ের। আর অবশ্যই অকর্মণ্য কিছু গ্র্যাজুয়েট, বাপের হোটেলে খেয়ে সাহিত্যের খোলনলচে পালটে তাকে উত্তর আধুনিকের পথ দেখানোর প্রতিজ্ঞায় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ কিছু দামড়া ছেলে। লিটল ম্যাগের মাহাত্ম্যে তার বিপ্লবী ইমেজ সম্পর্কে মাইক হাতে টানটান বক্তিমের জোরে হল ফাটানো হাততালি। ওরে বাপরে! শুনলে গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে শুধু নয়, সেই কাঁটা আবার ফুটেও যায়। সাথে মণির উস্কানির উত্তেজনা কামাল করে দেয় তাদের।

আঃ ভাবা যায়— ছোটোগল্পের কী দুর্দান্ত আলোচনাটাই না করলি রে অমরেশ। আর বোঝাতে গিয়ে তোর নিজের লেখা যে গল্পটা পড়ে শোনালি— তার জন্য কোনও তারিফই যথেষ্ট নয় রে! আয় আয় আমার বুকে আয়। একটা হামি দিইরে তোকে। আমার চাঁদের ছেলে আমার সোনার ছেলে। তারপরই গলাটা একপর্দা খাদে নামিয়ে বলে— বিমল করের মতো লেখকও তোর মতন এমন একটা লিখতে পারলে ধন্য হয়ে যেত রে। অমরেশ বিনয়ে মাটিতে মিশে যেতে বসেছে আর ভিতরে ভিতরে ফুলে ফেঁপে ঢোল— যে-কোনও সময় বিস্ফোরণের দিকে চলে যেতে পারে আপ খেতে খেতে। অমরেশ কিন্তু ফাটল না, যেহেতু আনকোরা নতুন নয়। তবে ফুলেফেঁপে থাকবেই এখন দিনকয়েক।

এবারের শারদসংখ্যায় তনু নাগরাজের গুচ্ছ কবিতা প্রকাশ করেছে মণি। তনু নাগরাজ বাড়িতে প্রায় সারাদিন একা। ছেলে বাইরে। বর একটা কোম্পানির ম্যানেজার। রান্নার লোক কাজের লোক বাগানের মালি ঠাকুর চাকর— কী নেই তার। নিজহাতে তাকে কুটোটি কেটে দু’টো করতে হয় না। বয়কাট চুল, তাও আবার আঁচড়ে দেওয়ার জন্য একটি মেয়ে আসে, তার পার্লারে যাওয়ার আগে ম্যামকে সাইজ করে দিয়ে যায়। তারপর সে তার লেডিস পার্লারের দোকান খোলে। আর সাহিত্যসভাতে গেলে তার তো আবার বিশেষ প্রস্তুতি থাকে, সেদিন সে মেয়ে তনু ম্যাডামকে একেবারে চিকনাই করে ছেড়ে দেয় ঘণ্টা দুয়েকের পরিচর্যায়।

মণির আদরের তনু কবিতাগুচ্ছ পাঠ করে শোনাল। মুগ্ধ হলঘর করতালি মুখরিত। মণি এবার তনুর একটা কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের কথা ভাবছে। পাঁচ ফর্মার করার প্ল্যান আছে। সত্তর বাহাত্তরটা কবিতা হলেই হবে। তা তনুর সংগ্রহে এখন ষাটটার মতন আছে। বলেছে সপ্তাহ দু’য়েক সময় পেলেই নাকি নামিয়ে ফেলবে। মণির আদেশ লেখা শেষ হলেই যেন তনু তাকে ফোন করে। কোনও কালক্ষেপ না, সাথে সাথেই ডিটিপি-র জন্য চলে যাবে যথাস্থানে।

মণি খরচখরচা বাবদ দু’টো ইনস্টলমেন্টে পঁচিশ পঁচিশ করে মোট পঞ্চাশ দিতে বলেছে। বাকিটা নাকি মণি বুঝে নেবে। নীচে কোথাও কোনও ফুটনোট নেই, কোনও শর্তাবলী নেই, এমনকী নেই কোনও হিডেন কস্ট-ও। ফার্স্ট অ্যান্ড ফাইনাল যাকে বলে। হাতি কা দাঁত মরদ কা বাত। এই হচ্ছে মণি ঘোষাল।

ক্রমশ…

মুখোশ (দ্বিতীয় পর্ব)

কয়েক ঘন্টা পর সমর এসে ওকে বাড়ি নিয়ে গেল। বাড়ি পৌঁছোবার পর সন্ধেবেলায় সমর সঞ্চিতাকে শুধু এটুকুই বলল যে, ও এখন বাচ্চার দায়িত্ব নিতে মানসিক ভাবে প্রস্তুত নয়। ওর এখন অনেক কাজ বাকি রয়েছে। ও যদি সঞ্চিতাকে গর্ভপাত করাবার কথা বলত, তাহলে হয়তো ও রাজি হতো না। তাই বাধ্য হয়ে সমরকে এই ব্যবস্থা নিতে হয়েছে।

সবকিছু শোনার পর নিজের মনে গুমরে মরা ছাড়া অন্য কোনও রাস্তা ওর কাছে খোলা নেই— সেটা খুব ভালো করেই বুঝে নিয়েছিল সঞ্চিতা। সমরের সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দিল। এতদিন সমরের প্রতি যে-সম্মান, ভালোবাসা সঞ্চিতার হৃদয়কে ঘিরে রেখেছিল— সেখানে জায়গা হল ঘৃণা, তিরস্কারের। কিন্তু বিদেশ-বিভুঁইয়ে থেকে সমরের বিরুদ্ধতা করা উচিত মনে করল না সঞ্চিতা। কারণ এখানে ও কাউকেই চেনে না, যে ওর পক্ষ নেবে। এখানে না কোনও বন্ধু, আত্মীয়স্বজন বা চেনা-পরিচিত— কার সঙ্গে ও মনের দুঃখ শেয়ার করবে?

একদিন দুপুরে বনানী পিসির ফোন এল সঞ্চিতার কাছে। পিসির কাছ থেকেই সঞ্চিতা জানতে পারল— গত পনেরো দিনে সমর বনানী পিসিকে তিনবার ফোন করেছে। প্রতিবারই নাকি পঁচিশ লক্ষ টাকা বনানীকে পাঠাতে বলেছে সমর ওর আমেরিকার অ্যাকাউন্টে। ও পিসিকে বলেছে, ও চাকরি ছেড়ে দিয়েছে এবং এই টাকা দিয়ে নিজের ব্যাবসা শুরু করবে। তাই টাকাটা ওর খুব প্রয়োজন।

সমরের হাবভাবে বনানীর সন্দেহ হওয়াতে সঞ্চিতাকে ফোন করে তিনি নিশ্চিত হতে চাইছিলেন। কিন্তু এ ব্যাপারে সঞ্চিতা কিছু জানতই না বরং মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে সঞ্চিতার গর্ভপাত ঘটানোর কথা সঞ্চিতা পিসিকে জানালে— বনানী সমরের ব্যবহারে মানসিক ভাবে খুবই মুষড়ে পড়লেন।

সঞ্চিতা সমরকে ভয় পেতে আরম্ভ করল। সমর সম্পর্কে সমস্ত সত্যটা ধীরে ধীরে সঞ্চিতার সামনে আসতে আরম্ভ করল। বিদেশে সমরের শত্রুতা করার সাহস ছিল না সঞ্চিতার— আর দেশে মা-বাবাকে জানিয়ে তাদের চিন্তিত করে তুলতে কিছুতেই মন চাইছিল না তার।

বাড়িতেও আর সময় কাটছিল না সঞ্চিতার। ভাগ্যের কাছে পরাজিত সঞ্চিতা একদিন বসে খবরের কাগজের পাতা ওলটাচ্ছিল। পত্রিকাটি আমেরিকার হলেও আমেরিকায় বসবাসকারী ভারতীয়দের জন্যই মূলতঃ পত্রিকাটি বার হতো। একটা খবরের দিকে দৃষ্টি পড়তে সঞ্চিতার চোখ সেখানে আটকে গেল।

প্রণতি নামের একজন ক্রাইম রিপোর্টার কীভাবে নিজের সাহস এবং বুদ্ধির জোরে একটি বড়ো সেক্স র‌্যাকেটের পর্দা ফাঁস করেছে। ভারত ও পাকিস্তানের বেশ কিছু প্রতিপত্তিশালী ব্যক্তি, যারা এর সঙ্গে জড়িত ছিল, প্রমাণ-সহ আইনের চোখে তাদের সে দোষী সাব্যস্ত করে ছেড়েছে— তার সম্পূর্ণ বিস্তারিত খবর ‘দ্য ট্রুথ’ পত্রিকায় ছাপা হয়েছে।

খবরটা তিন-চারবার পড়ল সঞ্চিতা। আশার একটা আলো দেখতে পেল সে। সঙ্গে সঙ্গে পত্রিকাটির দফতরে ফোন করে প্রণতির ঠিকানা এবং ফোন নম্বর সংগ্রহ করল সে। প্রণতিকে ফোন করে একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিল সঞ্চিতা। কথায় কথায় জানতে পারল প্রণতি ওর স্কুলেরই মেয়ে ওর থেকে দুবছরের সিনিয়র ছিল। তার বাবা চাকরি নিয়ে আমেরিকা চলে আসাতে ওদের পরিবার আমেরিকায় পাকাপাকি ভাবে থেকে গেছে।

প্রণতি নিজের বাড়িতেই আসতে বলল সঞ্চিতাকে। আমেরিকাতেও সঞ্চিতার নিজের বলতে কেউ আছে, এটা ভেবেই সঞ্চিতার মন অনেকটা হালকা বোধ হল। প্রণতির সঙ্গে দেখা করে ওর সঙ্গে যা যা ঘটেছে সব খুলে বলল। এমনকী পিসির কাছে পঁচিশ লক্ষ টাকা সমর চেয়েছে, এটা জানাতেও ভুলল না।

প্রণতিও মন দিয়ে সব শুনল। প্রায় দুঘন্টা ধরে ওদের কথাবার্তা চলল। প্রণতি কথা দিল, ও সমর সম্পর্কে সবকিছু অনুসন্ধান করে সঞ্চিতার সঙ্গে যোগাযোগ করবে। নিশ্চিন্ত মনে সঞ্চিতা বাড়ি ফিরে এল।

সেদিন সারারাত সমর বাড়ি ফিরল না। ওর জন্য অপেক্ষা করতে করতে, সঞ্চিতার কখন তন্দ্রা এসে গিয়েছিল ও নিজেই বুঝতে পারেনি। বহুবার ফোন করার পরেও কোনও রিপ্লাই না আসাতে, সঞ্চিতাও খোঁজ করা বৃথা চেষ্টা, ভেবে হাল ছেড়ে দিল। পরের দিন দুপুরে সমর বাড়ি ফিরল। ও কোথায় ছিল জিজ্ঞেস করাতে উত্তর দিল না। এক সপ্তাহর বেশি সময় পেরিয়ে গেল। রাতে বাড়ি না ফেরাটা প্রায়শই হতে লাগল সমরের। ফেরার কোনও ঠিক থাকত না। একবার টানা দুই রাত বাড়ি ফিরল না। জিজ্ঞেস করাও ছেড়ে দিল সঞ্চিতা।

পরের সপ্তাহের শেষের দিকে প্রণতির ফোন এল দেখা করার জন্য। তার আগের রাতেও সমর বাড়ি ফিরল না। সকালে উঠে চা খেয়ে সঞ্চিতা তৈরি হয়ে নিল। ওর অনুপস্থিতিতে সমর বাড়ি ফিরতে পারে, এই ভেবে একটা কাগজে মার্কেট যাচ্ছে লিখে খাবার টেবিলে চাপা দিয়ে রাখল।

প্রণতির বাড়ি পৌঁছোতেই প্রণতি ওকে বসার ঘরে আসার জন্য বলল। সঞ্চিতা সোফায় এসে বসলে প্রণতি বলতে শুরু করল, সঞ্চিতা তুমি আমাকে সমরের অফিস এবং ওর সম্পর্কে যা যা প্রয়োজনীয় তথ্য জানিয়েছিলে, সেই মতন আমি খোঁজখবর নেওয়া শুরু করে দিয়েছিলাম। ও একটা খুনের কেসে জড়িয়ে গেছে। গতকাল পুলিশ ওর ডেরায় পৌঁছে ওকে অ্যারেস্ট করেছে। এই কয়েকদিন ও পালিয়ে বেড়াচ্ছিল, তাই রাতে বাড়ি ফিরত না। ও এখন পুলিশের লক-আপে রয়েছে।

দ্বিতীয়ত ও চাকরি ছাড়েনি বরং কোম্পানি ওকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করেছে। ও অফিসে ভারতীয় মুদ্রায় পঁচিশ লক্ষ টাকা তছরুপ করেছে। বনানী পিসিকেও মিথ্যা বলেছিল। উনি সমরের অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠাতেই ওই টাকা তুলে ও কোম্পানিকে দিয়ে আইনি সাজা পাওয়ার হাত থেকে রেহাই পেয়েছে।

 

মুখোশ (প্রথম পর্ব)

বিয়ের পর ভারতীয় মেয়েদের দুরাবস্থার খবর আমাদের আশেপাশে, খবরের কাগজে প্রায়শই চোখে পড়ে, বিশেষ করে পাত্র যদি বিদেশে বসবাসকারী হয়। এর কারণ হচ্ছে মেয়ের পরিবারের লোকজন পাত্রের ঠিকমতো খোঁজখবর না নিয়েই মেয়ের বিয়ে দিতে রাজি হয়ে যান।

নির্মলা পুণাতে থাকে। ওর মা আর ওখানকার মহিলা সমিতির মেম্বার বনানী খুব ভালো বন্ধু, সেই সূত্রে নির্মলার সঙ্গেও বনানী আন্টির ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। একদিন কথায় কথায় নির্মলা নিজের মেয়ে সঞ্চিতার বিয়ের সম্বন্ধ দেখা শুরু করেছে জানাতে, বনানী আন্টি নিজের ভাইপো সমরের কথা বললেন। পাত্র বর্তমানে আমেরিকায় থাকে এবং ওখানে খুব ভালো চাকরি করে। বনানীর কথায় নির্মলা জানতে পারল— সমরের জন্যও পাত্রী সন্ধান করা হচ্ছে।

বাড়িতে স্বামী এবং মেয়েকে সমরের কথা জানাতে, নির্মলার স্বামী একটু ইতস্তত করলেও, সঞ্চিতা কিন্তু বিদেশে থাকা ছেলেকে বিয়ে করতে রাজি হয়ে গেল। ওদিকে বনানীও সমরকে ফোনে সঞ্চিতার ছবি-সহ ওর সম্পর্কে, সবকিছু জানাতে সমরও কথা দিল পাত্রীর সঙ্গে কথা বলে পিসিকে জানিয়ে দেবে। বনানী পাত্র-পাত্রী উভয়কে ভিডিও চ্যাটে যোগাযোগ করিয়ে দিলেন। বেশ কিছুদনি ওরা ফোনে নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা চালিয়ে সবকিছু ঠিক মনে হতে, নিজের নিজের পরিবারকে জানিয়ে দিল উভয়ে বিয়েতে রাজি আছে।

বিয়ের দিন স্থির হতে সমর এক মাসের ছুটি নিয়ে পুণা এসে পৌঁছোল। সবকিছু আগে থেকে ঠিক করাই ছিল। সমর ও সঞ্চিতার বিয়ে হয়ে গেল। সমরের কোনওরকম খোঁজখবর না নিয়ে সঞ্চিতার মা-বাবা বনানীর উপর ভরসা করে মেয়ের বিয়ে দিয়ে দিলেন।

ভরসা করার অবশ্য আরও একটা কারণ ছিল, শৈশবে এক দুর্ঘটনায় মা-বাবাকে হারিয়ে সমর তার বনানী পিসির কাছেই মানুষ হয়েছিল। অবশ্য টাকা-পয়সার জন্য বনানীকে চিন্তা করতে হয়নি। মা-বাবার অকালে মৃত্যু হওয়াতে ওই শিশু বয়সেই সমর বিপুল সম্পত্তির একমাত্র মালিক হয়ে উঠেছিল। বিধবা নিঃসন্তান বনানী, সমরকে দত্তক হিসেবে গ্রহণ করাতে সমরের বাবার তৈরি ট্রাস্ট থেকে পঞ্চাশ হাজার টাকা ভাতা হিসেবে বনানীকে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়।

অর্থের লোভে বনানী সমরকে দত্তক নিলেও ওকে মানুষ করতে কোনও কার্পণ্য করেননি। ভালো স্কুল থেকে পড়াশোনা করিয়ে সফ্টওয়্যার ইঞ্জিনিয়র হতে উদ্বুদ্ধ করেছেন সমরকে। একুশ বছর বয়সে সম্পত্তির অধিকার সমরের হাতে চলে আসায়, ধীরে ধীরে সমরের স্বভাব পালটাতে থাকে। সে ঠিক করে আমেরিকায় গিয়ে পাকাপাকি বসবাস করবে।

সফ্টওয়্যার ইঞ্জিনিয়র হিসেবে চাকরি নিয়ে সমর আমেরিকায় পাড়ি জমায় এবং ওখানেই থেকে যাওয়া মনস্থির করে। এত বছর বাদে বিয়ের জন্য দেশে ফিরেও বিয়ে মিটতে না মিটতেই সঞ্চিতাকে সঙ্গে নিয়ে আমেরিকায় ফিরে আসে ও।

কী করে দেখতে দেখতে দুটো বছর কেটে যায়, নতুন বিয়ের আনন্দে সঞ্চিতা বুঝতেই পারে না। রোজই মনে হতো সমরকে বিয়ে করে সারা বিশ্বের সুখ ওর মনের কোণায় জমা হয়েছে। একদিন হঠাৎ-ই সঞ্চিতা বুঝতে পারে যে, সে মা হতে চলেছে। এর পরেই ঠিক করে ডাক্তারের কাছে গিয়ে পরীক্ষা করিয়ে তবে সমরকে জানাবে। ডাক্তার সব রিপোর্ট পজিটিভ জানালে খুশিতে আত্মহারা হয়ে ওঠে সঞ্চিতা। অধীর আগ্রহে সমরের ফেরার অপেক্ষা করতে থাকে সবকিছু সমরকে বলার জন্য।

সন্ধেবেলায় সমর বাড়ি ফিরলে সবথেকে আগে সঞ্চিতা এই আনন্দ সংবাদ সমরকে জানায়। কিন্তু ওর মুখে আনন্দের বদলে অন্যকিছু চোখে পড়াতে সঞ্চিতা ভিতরে ভিতরে কেঁপে উঠল। সমরের মুখের এই ভাবান্তর আগে কখনও সঞ্চিতা দেখেনি। কিন্তু মুহূর্তের মধ্যে সমর নিজেকে সামলে নিল। সঞ্চিতাকে দুই হাতে নিজের কাছে টেনে নিতে নিতে বলল, আমি তো বিশ্বাস করতেই পারছি না যে আমি বাবা হতে চলেছি। খবরটা শুনে কিছু মুহূর্ত আমার ব্রেন কাজ করাই বন্ধ করে দিয়েছিল। তুমি এখন থেকে খুব সাবধানে থাকবে। আমার পরিচিত একজন ভালো গাইনিকোলজিস্ট আছেন, কাল আমি তোমাকে তার কাছে নিয়ে যাব সম্পূর্ণ চেক-আপের জন্য।

পরের দিন সঞ্চিতার যখন চোখ খুলল, দেখল অপরিচিত একটা বিছানায় ও শুয়ে আছে। কোমরের নীচের থেকে একটু ভারী ভারী মনে হচ্ছিল, পেটেও একটা সামান্য ব্যথা ছিল। চারপাশে চোখ বোলাতে মনে হল কোনও হাসপাতালের ঘরে ও শুয়ে আছে। উঠে বসার চেষ্টা করেও শক্তিতে কুলিয়ে উঠতে পারল না। সেই মুহূর্তে একজন নার্স দৌড়ে এসে বলল, আপনি আরও খানিক্ষণ বিশ্রাম করুন। তিন ঘন্টা পর আপনি উঠতে পারেন।

হাসপাতালের বিছানায় ও কীভাবে এল জানতে, কাউকে না পেয়ে নার্সকেই জিজ্ঞেস করাতে নার্স একটু অবাক হল। নার্স সঞ্চিতার দিকে একটা অবিশ্বাসের দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল, আপনি জানেন না আপনার কী হয়েছে? আপনার অ্যাবর্শন হয়েছে।

শুনেই সঞ্চিতার মাথা ঘুরে গেল। ওর মনে পড়ল সমরের সঙ্গে ও হাসপাতালে গাইনিকোলজিস্ট-এর কাছে এসেছিল চেক-আপ করাতে। ওখানে ওকে জল খেতে দেওয়া হয়েছিল তারপরেই ওর খুব ঘুম পাচ্ছিল। ব্যস আর কিছু ওর মনে নেই। এখন পুরো ঘটনাটাই সঞ্চিতার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল।

 

পিরামিড (শেষপর্ব)

মাস তিন আরও পেরিয়ে গেল। রূপার মায়ের গর্ভের সেই অপত্যস্নেহের প্রাণ এই তিনমাসে আরও তিনমাস বড়ো হয়ে গেছে। রূপার মাকে এখন দেখলে বোঝা যায়। সেদিনের ঘটনার পর রূপার ব্যবহার জটিল থেকে যৌগিক হয়ে উঠল।

রূপার বাবা-মা ডাক্তারের কাছে গিয়ে ওয়াশের ব্যাপারে আলোচনা করেছিল। রূপার কথাও বলেছিল। কিন্তু ডাক্তারবাবু সবকিছু পরীক্ষা করে বললেন, আপনাদের এইরকম পরিকল্পনা থাকলে আরও আগে ভাবতে হতো। এখন ব্যাপারটা রিস্কি হয়ে যাবে। এমনকী ম্যাডামের কিছু ভালো-মন্দ হয়ে যেতে পারে। তার থেকে মেয়ের সঙ্গে আবার কথা বলুন, বোঝান।

বাড়ি ফিরে রূপাকে কিছু বোঝানোর চেষ্টা করেও লাভ হয়নি। বরং দিন দিন রূপা তার নিজস্ব পৃথিবীর মধ্যে নিজেকে আরও বেশি করে পেঁচিয়ে রাখতে আরম্ভ করে। প্রযোজন ছাড়া বাবা মায়ের সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দেয়। লাঞ্চ তো একা খেতই, ডিনার নিয়ে নিজের ঘরে চলে যেতে আরম্ভ করল। বাবা-মায়ের প্রশ্নের কোনও উত্তর দিত না। স্কুল বা টিউশন থেকে দেরি করে বাড়ি ফিরতে আরম্ভ করল। কিছু জিজ্ঞেস করলেই বেশির ভাগ সময়ে এড়িয়ে চলে যেত, অথবা চিল্লিয়ে বলত, তোমাদের কী?

একটা ছেলের সঙ্গে ঘোরাঘুরির কথাও কানে এল। কিন্তু রূপাকে কিছু বলতে সাহস হয় না। একদিন রাত্রি নটার সময় বাবা বাড়ির সামনে একটা ছেলের বাইক থেকে রূপাকে নামতে দেখে। বাড়ি ফিরলে ছেলেটার ব্যাপারে প্রশ্ন করতে খুব বাজে ভাবে উত্তর দেয়, ইজ ইট ইযোর বিজনেস?

মা শুয়ে শুয়ে চেল্লাতে আরম্ভ করে, এর মানে! আমরা জিজ্ঞেস করব না তো কে করবে?

বাবা শান্ত করে বলে, ডাক্তার তোমায় উত্তেজিত হতে বারণ করেছে, শান্ত থাকো। আমি ওর সঙ্গে কথা বলছি। তারপর খুব শান্ত ভাবেই ছেলেটার কথা আবার জিজ্ঞেস করতে রূপা জবাব দেয়, ও চাঙ্কি, আমার টাইম পার্টনার, এনি প্রবলেম?

তবে ব্যাঙ্কের ব্যালান্স শূন্যের দিকে গেলে বাবার কাছে এসে গম্ভীর গলায় বলে, বাবা আমাকে কিছু ফান্ড ট্রান্সফার করে দেবে তো।

বাড়িতে টুকটাক কাজ করবার জন্যে আলপনা মাসি ছাড়াও রান্নার জন্যে আরকজন এসেছে। খিদে পেলে তাদের কাউকে বলে টিফিন থেকে আরম্ভ করে বাকি সব নিয়ে নেয়।

মা কিন্তু এখন এক্কেবারে শয্যাশাযী। ডাক্তার বলেছেন, বেশি বয়সের তো, বেশ কমপ্লিকেটেড প্রেগন্যান্সি। রেস্ট না নিলে রিস্ক হতে পারে।

রূপা কিন্তু কোনওদিন মায়ের ঘরে ঢুকে জিজ্ঞেস করে না, কেমন আছো? সাধের দিন পিসি আর দূর সম্পর্কের মাসি মামিরা এলেও রূপা স্কুল চলে যায়। এমনকী আগের রাতে মাকে শুনিয়ে শুনিয়ে ফোনে বলে, তাহলে কাল টিউশন থেকে ফেরার সময় পার্টি হবে।

আরও মাস দেড় পরে একরাতে দরজাতে বাবার জোরে জোরে ধাক্কা মারবার আওয়াজে রূপার ঘুম ভেঙে যায়। বাইরে বাবার গলার আওয়াজ পায়, মাম্পি তোর মায়ের শরীর খারাপ, তুই দরজা খোল।

একবার দুবার তিনবার। রূপা কিন্তু দরজা খোলে না। শুধু ভিতর থেকেই জোরে বলে ওঠে, শরীর খারাপ তো আমি কী করব? তোমাদের ব্যাপার, তোমরা বোঝো।

মিনিট পনেরো পরে একটা গাড়ির আওয়াজ পাওয়া যায়। ঘরের ভিতরে আরও কয়েকজন মানুষের উপস্থিতিও বোঝা যায়। আস্তে, একটু নামাও। এইসব কয়েকটা কথাও কানে আসে। আরও কিছু সময় পরে আবার বাবার গলা পায়।

—মাম্পি, তোর মাকে নিয়ে হাসপাতাল যাচ্ছি। আলপনা থাকল, পারলে সকালে আসবি।

রূপা কিন্তু তার পরের দিন হাসপাতালে যায়নি। সকালে উঠেই টিউশন চলে গেল। বাড়ি ফিরে তাকে আরও গুম হয়ে থাকতে হল। ঘরভর্তি লোকজন। ঢুকতেই প্রশ্ন, তোর মা কেমন আছে জানিস? সে কী রে?

তারপরেও হাজারটা অপ্রাসঙ্গিক কথাবার্তা। রূপা কোনওরকমে সবাইকে এড়িয়ে নিজের ঘরে ঢুকেই দরজা বন্ধ করে দেয়। কিছুসময় পরে দরজাতে টোকা দেওয়ার আওয়াজ শুনে দরজা খুললে, পিসি ঘরের ভিতরে এসেই বলে উঠল, পড়তে গেছিলি?

—হ্যাঁ।

—তোদের রান্নার মেয়েটা বলল সাড়ে আটটার মধ্যে চলে আসবে। তোর জন্যেই অপেক্ষা করছিলাম।

—কেন?

—তোর মাকে দেখতে যাবি না?

—তোমরা যাচ্ছ তো।

—তোর মায়ের এখনও জ্ঞান ফেরেনি।

—ও।

—ও মানে! ডাক্তার বলেছে ক্রিটিক্যাল স্টেজ।

কিছু সময় চুপ থেকে রূপার কাঁধে হাত রেখে বলল, কাল ওটিতে ঢোকানোর সময়ে ওই ব্যথার মধ্যেও তোর নাম ধরে ডাকছিল। দাদাকে বলে, তুমি বাড়ি যাও, মাম্পি একা আছে। কথাগুলো বলে বেরিয়ে যাবার সময় দরজাতে হাত রেখে বলে উঠল, তোর বোনটাও বাঁচেনি।

নিজের ঘরে এই প্রথম রূপা নিজে খুব একা হয়ে উঠল। খোলা জানলা দিয়ে বাইরের হাওয়া ঢুকলেও তার গরম লাগছিল। ব্যাগটা কিছুসময় আগেই বিছানাতে রেখেছিল। এবার নিজের শরীরটাকেও বিছানাতে জড় পদার্থের মতো ফেলে রাখল। মায়ের যদি কিছু হয়ে যায়…

মোবাইলে হিন্দি গান বেজে উঠল। একবার, দুইবার তিনবারের বার মোবাইলে চোখ রাখল। স্ক্রিনে চাঙ্কির ছবি দেখা যাচ্ছে।

—বল।

—বাড়িতে কেউ নেই তো, স্কুলে আসবি?

—কেন?

—আমারও বাড়ি ফাঁকা।

—একটু ব্যস্ত, পরে কল করব।

ফোনটা কেটে বিছানাতে মুখ নীচু করে কিছুসময় শুয়ে থাকল রূপা। পিসির কথাগুলো কানে বাজছে। কিছুসময় পরেই বিছানাতে উঠে বসল। বাইরে একটা আওয়াজ আসছে। সবাই বেরোচ্ছে। রূপা ফোনটা সাইলেন্ট করে জোরে বলে উঠল, পিসি… তোমরা কখন যাবে? আমি রেডি।

 

 

জীবন-নদী

অদিতি এভাবে চলে যাবে ভাবিনি। অদিতি এভাবে ফিরিয়ে দিয়ে যাবে তাও অকল্পনীয়। জীবনের বাঁকে বাঁকে এত রূপ রস, সব আমার জন্য!

‘আমি তোমার সাথে দেখা করব।’ অচেনা স্বর, কিন্তু আওয়াজে বোঝা যায় কিশোরী কণ্ঠ। দ্বিধাহীন ভাবে ‘তুমি’ সম্বোধনে সে কথা বলল।

‘কে কথা বলছ?’

‘নয়না।’

ভেবে পেলাম না এমন নামে আমি কাউকে চিনি কি না। গম্ভীর হয়ে তাই জবাব দিলাম, ‘আমার কোনও আগ্রহ নেই তোমার সাথে দেখা করায়।’ ওধার থেকে ধীরে জবাব এল, ‘আপনি আমায় মানে নয়নাকে চেনেন না কিন্তু আমার মাকে চেনেন।’ মেয়েটা হঠাৎ ‘তুমি’ থেকে ‘আপনি’তে উঠে এল। বোধহয় আমার বলাটা একটু বেশিই রুক্ষ হয়ে গিয়েছিল।

সকালবেলা একটা উটকো ফোন। চা খাওয়া হয়নি এখনও। বাসি মুখেই এমন ঝামেলা। দিনটা কেমন যাবে কে জানে। ‘আমি তোমার সঙ্গে দেখা করতে চাই না,’ বলেই রিসিভারটা নামিয়ে রাখলাম। চুপচাপ বসে অনেকক্ষণ ভাবলাম। কোনও দিশা খুঁজে পেলাম না। কার মেয়ে! আমার কাছে কী চায়? ‘মেয়ে’ শব্দটাই আমার কাছে অতীত মাত্র। সেই স্মৃতি– যা আমায় রুক্ষ, একা করে দিয়েছে। জীবনবোধে বিতৃষ্ণা এলেও জীবনকে ছাড়তে পারিনি। মেয়েটা কে? অদিতির চলে যাওয়া, আমার মাথার উপর ছাদ উড়ে যাওয়ার সমান। আমি ফিরে গেলাম চল্লিশ বছর আগের স্মৃতির পাতায়।

মফসসলের ছেলে আমি। উচ্চমাধ্যমিকে ভালো রেজাল্ট করায় বাবা পাঠিয়ে দিল কলকাতায়, কাকার বাড়ি। ভর্তি হলাম আশুতোষ কলেজে। কাকার বাড়ি থেকে কলেজ হাঁটা পথ। একদিন এমনই একা একা হেঁটে ফিরছি রবীন্দ্রসরোবর লেকের ভিতর দিয়ে হঠাৎ কেউ ডাকল ‘হাই অলোক।’ তাকিয়ে দেখি আমাদেরই সাইকোলজি ক্লাসের একটি মেয়ে। অনেকবার চোখাচোখি হয়েছে কিন্তু কথা হয়নি। বেশ ভালো লাগল কিন্তু ও আমার নাম জানল কী করে? ওই বয়েসে বেশ গর্ব-ও হল ক্লাসমেট আমার নাম জানে বলে। আমি হেসে দাঁড়িয়ে বললাম, ‘আমার নাম অলক, অলোক নয়।’ ও পরিচয় দিল, ‘আমি অদিতি। তুমি কোথায় থাকো? আমি কি তোমার সাথে একটু হাঁটতে পারি? আমার বাড়ি কাঁকুলিয়া রোড। বাড়িতে…।’ বেশ অনেকক্ষণ একা একাই বকবক করে গেল। হঠাৎ কী মনে হতে নিজেই চুপ করে হেসে জিজ্ঞাসা করল, ‘কই কথার জবাব দিলে না তো?’ আমি ওর দিকে সোজাসুজি তাকিয়ে বললাম– ‘সময় দিলে কোথায় কথা বলার?’ এইভাবেই আমাদের বন্ধুত্ব। অদিতি কবে যে আমার কাছে ‘দিতি’ হয়ে গেল তা নিজেই জানি না। এই আমার দিতি। অদিতি।

সামাজিকতার ধার আমি কোনওদিন ধারিনি। নিজের ইচ্ছেতেই চলেছি।

আমি এই বয়েসে নিজের কাজকর্ম নিয়ে বেশ আনন্দে আছি। জীবনে তেমন উচ্চাশা নেই, কেউকেটা হতেও চাইনি। তাই কলেজ জীবনে যখন, কলেজের মধ্যে সবথেকে সুন্দরী, মেধাবী মেয়েটি আমার দিকে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে ছিল, আমার সহপাঠীরা বেশ ঈর্ষান্বিতই হয়েছিল। আমার কিন্তু কোনও হেলদোল নেই, আমি স্বাভাবিক ভাবেই নিয়েছিলাম ব্যাপারটা। অদিতিও বেশ স্বাভাবিক। আমাদের মেলামেশা দিনের আলোর মতো সহজই ছিল কিন্তু অদিতি ধীরে ধীরে সেই সীমা ছাড়িয়ে অনেক এগিয়ে এল। আমি বারণ করেছিলাম, বুঝিয়েছিলাম ‘দিতি তোমার সমাজ আর আমার সমাজে অনেক তফাত। প্লিজ, তুমি এমন কোরো না, পরে কষ্ট পাবে।’ কিন্তু কাকস্য পরিবেদনা। অদিতি আমার কোনও কথাই শুনল না। ও দুর্দম, আমিও ভেসে গেলাম ওর সাথে। জানতাম অদিতির জীবনে আমি প্রথম পুরুষ নয়, তবু নিজের মধ্যে একটু দোটানা থাকলেও আমি নিজেকে আটকাতে পারিনি। আমরা স্বপ্নে ভেসে গেলাম– ছোট্ট সংসার, টলোমলো পা।

সত্যি আমরা ভেসে গেলাম। যেদিন দিতি জানাল তার শরীরের নতুন অনুভবের, সেদিন আমি আনন্দের পরিবর্তে বেশ ভীত হয়ে উঠলাম। মুখে হাসলেও দিতি ঠিক বুঝতে পারল, আমি ভয় পেয়েছি। দুজনের বাড়িতে কে কী বলবে? কীভাবে সামলাব? আমার শুকনো মুখ দেখে অদিতি কি বুঝল, কে জানে! বারবার একই কথা জোরের সঙ্গে পুনরাবৃত্তি করতে থাকল, ‘আমাদের ভালোবাসার ফসল, নতুন মানুষ আসবেই। আমাদের উত্তাপ ওর মধ্যেই। আমি পারবই।’ আমি অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম। খটকা লাগল ওর কথায় ‘আমি পারবই,’ তবে কী ‘আমরা’ নয়? হঠাৎ অনুভব করলাম আমি ঘেমে উঠেছি। এমনই হয়েছিল যেদিন প্রথম অদিতিকে আমি চুমু খেয়েছিলাম, ফাঁকা কলেজ করিডোর-এ। ভুল বললাম, আমি নয়, ও এগিয়ে এসে সপাটে জাপটে ধরে…। আমি ছটফট করে ওকে ঠেলে দিতেই ওর বাঁধভাঙা হাসি। ভয়, ভালোলাগা মিলেমিশে… এমনটাই হয়। হয়তো বা সকলের জীবন-সন্ধিক্ষণে। সেই শুরু। এতদিন পরে অদিতির সন্তানসম্ভাবনার কথা শুনে আবার তেমন ভয় আমায় চেপে ধরল।

সময় এগিয়ে চলে। অদিতির আড়ষ্টতাহীন চলাফেরা আমায় আবার স্বাভাবিক করে তুলল। আমি প্রায় ভুলেই গেলাম ওর শরীরের নতুন অঙ্কুরোগদ্মের কথা। আমি মেতে উঠলাম ওকে নিয়ে। ছুটির দিনে বেড়াতে যাওয়া, আইসক্রিম খাওয়া, হইচই করা, ঘুরে বেড়ানো সব আগের মতোই। ধীরে ধীরে আমি ধাতস্থ হয়ে গেলাম। দুজনের আনন্দের জীবনে শুধু নিস্তরঙ্গ জোয়ারের খেলা। অদিতি কিছু বুঝতে দেয়নি।

জোয়ারের পর ভাটা অনিবার্য। তা এল, কিন্তু এমনভাবে যা আমার কল্পনার অতীত। দিতি একদিন এসে খুব স্বাভাবিক ভাবে বলল, ‘আজ আমার লাঞ্চ আছে, স্পেশাল ব্যাপার।’ আমি শান্ত চোখ তুলে তাকালাম। কোনও প্রশ্ন নেই মুখে। শুধুই তাকিয়ে থাকলাম। ও আশা করেছিল আমি কিছু জিজ্ঞাসা করব। দিতিই নীরবতা ভাঙল, ‘আমার পুরোনো প্রেমিক। লন্ডন থেকে এসেই যোগাযোগ করেছে। সোহম সেন।’ আমি জানতাম, অদিতি বলেছিল, দুম করে সোহমের লন্ডন স্কুল অব ইকনমিক্স-এ চান্স পেয়ে যাওয়ার কথা। অদিতির খুব মন খারাপ হয়েছিল। তবে ওর মতন হুল্লোড়বাজ মেয়ের সব কিছু ভুলে যেতে সময় লাগেনি। মাঝে মধ্যে মনে হয় অদিতি খুবই ক্যাজুয়াল। জামাকাপড় বদলানোর মতো বয়ফ্রেন্ড বদল করে। ভাবতেও ভালো লাগে না এভাবে। আসলে ও তো ধনী পরিবারের দুলালি। আমারও কখনও কখনও সংশয় হয়। সত্যি ভালোবাসে তো মেয়েটা আমায়! আচ্ছা ও কি সত্যিই প্রেগন্যান্ট! তাই ওর সাথে দেখা করা। আমার মনের মধ্যে যাই-ই হোক, আমি ‘না’ বলতে পারিনি ওর মুখ দেখে।

সেদিন দিতি কলেজে এলেও ক্লাস করল না, তারপর দিনও এল না। পরপর চারদিন এল না। ওর ক্লাসমেটদের জিজ্ঞাসা করলাম, কেউ সদুত্তর দিতে পারল না। যেখানে যেখানে খোঁজ নেওয়া যায় নিলাম, কিন্তু কোথাও দিতির খোঁজ পেলাম না। হতাশা কেমন যেন আমায় গ্রাস করে নিল। আমি কলেজে আসতাম, শুধু আমার শরীরটাকেই বয়ে নিয়ে। মনটা সারাক্ষণ অদিতি-অদিতি করে ওকেই খুঁজে চলত।

গাছতলায় মাথা হেঁট করে বসে আনমনে ঘাস ছিঁড়ছি, মাটি খুঁটছি এমন সময় লক্ষ্য করলাম সামনে একটা ছায়া। মুখ তুলে দেখি অদিতি। অপূর্ব সুন্দর দেখাচ্ছে, ঝলমল করছে ও। আমি বুঝলাম না, কারণটা কী? আমি রাগে-দুঃখে ওকে দেখে চিৎকার করে উঠলাম ‘কী ব্যাপার তোমার? তুমি বোঝো না, তোমার সাথে একদিন দেখা না হলে আমি প্রায় পাগল হয়ে যাই। কোথায় ছিলে? এত দায়িত্বজ্ঞানের অভাব কেন?’ অন্য সময় আমি চিৎকার করলেই দিতিও সমানতালে ঝগড়া করত। সব সময় আমিই পরাজিত হতাম এবং হেসে সারেন্ডার করতাম। আজ এ কোন দিতি, আমার সামনে? আমি চিৎকার করছি, ও মাথা নিচু করে দাঁড়িয়েই থাকল। আমি হতভম্ব। দিতি চুপ করেই থাকল, তারপর যেন বহু কষ্টে নীরবতা ভেঙে অস্ফূটে বলল, ‘সরি অলক, এই ক’দিনের মধ্যেই বাড়ি থেকে আমার বিয়ের কথা পাকা হয়ে গেছে। আমার মতামত নিয়ে, সোহমের সাথে।’ অর্থাৎ অদিতির প্রাক্তন প্রেমিক, লন্ডন ফেরত, ভবিষ্যৎ সম্ভাবনাময় পূর্ণ সেই সোহম সেনই দিতির মনোনীত পাত্র। দিতির কথা শুনে আমি প্রায় হিংস্র বাঘের মতন হয়ে উঠেছিলাম। আমি হিস হিস করে বলে উঠলাম, ‘অসম্ভব, আমার দিতি অন্যের হতে পারে না। আমি তোমার বাড়িতে যাব, মা-বাবার সাথে কথা বলব, তুমি এভাবে আমায় ছেড়ে…।’

‘চুপ অলক’, আমার কথা শেষ হওয়ার আগেই দিতির শানিত স্বর আমায় থামিয়ে দিল। ‘কত উপার্জন তোমার? তোমার স্ট্যাটাস কী? কী খাওয়াবে? সবার আগে বলো, আজ বিয়ে করলে কোথায় রাখবে আমায়?’ আমি ঝড়ে ধাক্বা খাওয়া পাখির মতন যেন কিছুটা টাল খেয়ে গেলাম ওর কথায়, একটু সামলে নিজেকে প্রবোধ দিলাম। সত্যিই তো, অদিতির কথাগুলো বাস্তব-যুক্তিপূর্ণ। আমার কী আছে?

অদিতি সত্যিই চলে গেল আমায় ছেড়ে। আমার অনেক কিছু বলার ছিল, করার ছিল। কিন্তু আমি পারলাম না। নিজেকে গুটিয়ে নিলাম শামুকের মতন। দিতির শেষ কথাগুলো ‘তোমার স্ট্যাটাস কী? কোথায় রাখবে?…’ আমায় যেন এক নতুন আমি-তে রূপান্তরিত করল। আমি নিজেকে নিয়ে একটা ব্যূহ রচনা করে ফেললাম। নিজেরই অজান্তে। দিতি-সোহম, চলে গেল গোয়ায়। ও বিয়েতে নিমন্ত্রণও করে গিয়েছিল। কলেজ সহপাঠীরা জোরজবরদস্তি করে আমায় নিয়ে গিয়েছিল। ওরা সব কিছু জানত, তবুও। পরে শুনেছি অদিতি ওদের বারবার বলেছিল আমায় নিয়ে যাওয়ার জন্য। ওদের বাড়ি গিয়েও আমি অদিতির সামনে দাঁড়াতে চাইনি। ঢুকেই কোল্ড-ড্রিংকস নিয়ে অন্যদিকে চলে গিয়েছিলাম। অদিতি খুঁজে পেতে ঠিক আমার সামনে হাজির। অদিতি– না স্বর্গ থেকে নেমে আসা পরি! আমার চোখের পলক পড়ে না। আমি মূর্তির মতো নিথর। নিজের না পাওয়া আকাঙ্খাগুলো, ক্ষোভ-যন্ত্রণা আবার যেন সামনে এসে প্রাচীর হয়ে দাঁড়াল। অদিতি আমার। কেন অন্যের বিছানায় ও শোবে! কেন? কেন? একটা কথাও অদিতিকে বলতে পারলাম না। অথবা ওই অবস্থাতেও সে আমার হাতে মৃদু চাপ দিয়ে হাসতে হাসতে বলেছিল, ‘অলক আমি তোমারই থাকব।’

মেয়েদের প্রতি আমার এক অদ্ভুত বিতৃষ্ণা সেই থেকে। আমি নিজের লেখাপড়ার মধ্যেই পুরোপুরি ডুবে গেলাম। নিজের শরীর, খাওয়াদাওয়া, কোনও দিকে দৃষ্টি নেই। বাবা-মা এসেছিলেন, আমায় বাড়ি নিয়ে যাবার জন্য। কিন্তু আমি নারাজ। এভাবে মাস গড়াল, ফুরোল বছর।

স্মৃতির জালে যেন খাবি খাচ্ছিলাম, হঠাৎ দরজায় কলিংবেল শুনে আমার চমক ভাঙল। আমি স্খলিত পায়ে উঠে দাঁড়ালাম। আবার বেল, ভাবার চেষ্টা করলাম কে হতে পারে? মাথা কাজ করল না। প্রায় অবশ হাতে দরজা খুলতেই চমকে উঠলাম। একটা ঠান্ডা স্রোত শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে গেল। এ কে! প্রায় কুড়ি বছর আগের দিতি এতটুকুও বদলায়নি! এ কী করে সম্ভব! আমি স্থাণুবৎ দাঁড়িয়েই রইলাম। দিতি না, দিতির প্রতিচ্ছবি আমার দিকে তাকিয়ে একটু হেসে আমারই ঘরে বিনা অনুমতিতে গিয়ে বসে পড়ল চেয়ারে। বিছানায় ছড়ানো আমার পুজো সংখ্যার উপন্যাসের খসড়া। দিতি নয়, নয়না মেয়েটি আমার কোনও পরোয়া না করেই ঘরের মধ্যে এটা ওটা ঘুরে দেখতে শুরু করল। বইয়ের তাক, টেবিলে ছড়ানো বই, ঢাকনা না লাগানো পেন, পেনসিল, ফাইল-ক্লিপ সব এলোমেলো। ও শুধু দেখেই গেল। যেমন দিতিকে আমি কখনও বারণ করতে পারতাম না, নয়নাকেও আমি কিছুই বলতে পারলাম না। আমার চোখজোড়া ওকে অনুসরণ করে গেল। একসময় ও থামল, আবার চেয়ারে এসে বসল, ‘আপনার লেখা আমি পড়েছি।’ প্রসঙ্গে না গিয়ে আমি ওকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কেন এসেছ?’ নয়না তক্ষুণি কোনও প্রত্যুত্তর করল না। কয়েক সেকেন্ড সময় নিল, তারপর দৃঢ় স্বরে বলে উঠল, ‘আমি জানি, আপনি আর মা মেড ফর ইচ আদার ছিলেন। সমাজ, পরিবার আপনাদের এক হতে দেয়নি। আমার মা পারেনি নিজের পরিবারের বিরুদ্ধে যেতে। তাই আপনাদের দুজনের ভালোবাসার চিহ্ন নিয়ে সে চলে যেতে বাধ্য হয়েছিল। যে-বীজ বপন হয়েছিল তার শরীরে, তাকে সে বিনষ্ট হতে দেয়নি। ডালপালা মেলে তাকে পৃথিবীর আলো দেখতে সাহায্য করেছে। সোহম সেন সামাজিক দায়িত্ববোধে অবশ্যই আমার বাবা। কিন্তু আমার মা, মানে আপনার অদিতি, দিতি আমায় সব বলেছে অকপটে। আমার স্কুল-গণ্ডি পার হয়ে যাবার পরেই। আমি দিনটার অপেক্ষায় ছিলাম, কবে আপনার সাথে দেখা হবে।’

আমি স্থবির, নিশ্চল হয়ে বসে রইলাম। একি শুনছি। দিতি এখানেও তুমি আমায় হারিয়ে দিলে! তোমার প্রতি আমার যে ধারণা তা চুরচুর করে ভেঙে তুমি সোহমের সঙ্গে চলে গিয়েছিলে। সেটা যে তোমার অভিনয় ছিল তা বিন্দুমাত্র আমাকে বুঝতে দাওনি। আমার ভালোবাসাকে তুমি অপমানিত হতে দাওনি, দিতি। মেয়েদের প্রতি আমার যত বিষ সব আমি উগরে দিয়েছি, ঘৃণা, জ্বালা সব মিলিয়ে মেয়েরা যে বিশ্বাসঘাতকতার নজির তৈরি করেছিল আমার জীবনে, তা একমুহূর্তের জন্য ভুলিনি। আজ নয়না আমায় সম্পূর্ণরূপে এলোমেলো করে দিল। দিতি আমায় তুমি ক্ষমা করো। নিজেকে অবহেলা অযত্নে শেষ করে দিয়েছি। তুমি চলে যাওয়ার পর নেশা ধরলাম। কিছুদিন বাদে বুঝলাম আমি নেশা না করতে চাইলেও মদ আমার পিছু ছাড়ে না। আমার শরীর পুরোপুরি ভেঙে গেছে। এই মধ্যচল্লিশে আমায় দেখতে লাগে ষাট বছরের বুড়োর মতো। আজ আমার সামনে আমার আত্মজ– নয়না। আমি কি স্বপ্ন দেখছি!

মা জানত, বাড়িতে জানাজানি হলে দাদু আপনাকে খুন করিয়ে দিতেও দ্বিধা করবেন না। আপনিও জানেন আমার মামার বাড়ির অর্থনৈতিক ক্ষমতা-প্রতিপত্তির কথা। তাই মা নিজের ভালোবাসাকে বাঁচিয়ে রাখতে মুখ বুজে সব মেনে নিয়েছিল। মায়ের জেদ ছিল আমায় পৃথিবীতে আনার। সোহম সেনের প্রতি তার কর্তব্যে কোনও ত্রুটি ছিল না। শুধু এতগুলো বছর মা অপেক্ষায় ছিল, আপনাকে দেখানোর জন্য মা ও আপনার ভালোবাসায় ফাঁকি ছিল না।’

এ কোনও স্বপ্ন নয়, বড়ো নির্দয় কঠিন বাস্তব, নয়না, নয়নমণি।

 

হ্যালুসিনেশন

নাইলনের সুতোর শেষ প্রান্তে বঁড়শি গিলে আটকে আছে মাছটা। ধড়ে এখনও প্রাণও আছে অবশিষ্ট। মাঝেমধ্যে ঝটপট করে উঠে সেকথা জানানও দিচ্ছে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হল, এমন প্রজাতির মাছ অতুল কাঞ্জিলাল আগে কখনও দেখেননি, শুনেছেন বলেও তিনি মনে করতে পারলেন না। বিশ্বাসদের এই পুকুরে তিনি মাছ ধরছেন তা প্রায় সাত বছর হল।

বর্ষার ঋতুতে অন্তত দিন দশেক তাঁর মাছ ধরা বরাদ্দ। আজ সেই বাৎসরিক নিয়মেরই তৃতীয় দিন। এর আগে তাঁর ছিপে উঠেছে তেলাপিয়া, কই, চারাপোনার মতো সাধারণ মাছ। একবার একটা কেজি দুয়েকের রুইও উঠেছিল। ব্যস, ওই পর্যন্তই। এগুলি ছাড়া অন্য কোনও মাছ এই পুকুরে যে আদতেই থাকতে পারে, তা অন্তত অতুলবাবুর জানা ছিল না। আজ যে-মাছটা ধরা পড়েছে, তা অতুলবাবুর সমস্ত পূর্ব অভিজ্ঞতাকে ধূলিসাৎ করে দিয়েছে।

বঁড়শি থেকে মাছটা সাবধানে ছাড়িয়ে নিয়ে বেশ যত্ন করে উলটে পালটে দেখতে লাগলেন অতুলবাবু। মাছটার দৈর্ঘ্য আন্দাজ পাঁচ ইঞ্চি এবং ওজন একশো গ্রাম হলেও আশ্চর্যের কিছু নয়। রুপোলি শরীরের উপর মাথা থেকে লেজ পর্যন্ত উজ্জ্বল সোনালি বর্ণের উলম্ব রেখা মাছটাকে এক ঈর্ষণীয় সৌন্দর‌্যের অধিকারী করেছে। চোখ দুটি উজ্জ্বল হলুদ। প্রায় চল্লিশ মিনিট ছিপ ফেলে অপেক্ষা করার পর এই মাছটা উঠে এসেছে। এক কথায় যাকে বলে প্রাইজড পজেশন।

মাছ ধরা ব্যাপারটা যে সম্পূর্ণরূপে ধৈর্য এবং সংযমের উপর নির্ভরশীল তা অতুলবাবু বিলক্ষণ জানেন। কিন্তু এখন তাঁর মধ্যে এই দুটোর অভাব তীব্র হয়ে উঠেছে এবং তার কারণ যে ওই অদ্ভুত দর্শন মাছটা, সেটি বুঝতে অতুলবাবুর বাকি রইল না। অগত্যা তিনি উঠে পড়লেন। উদ্দেশ্য একটাই, মাছটাকে জীবিতবস্থায় বাড়ি নিয়ে ফিরতে হবে।

একটি ইটপাতা গলি পথে তিনটি বাঁক পেরিয়ে বাড়ি পৌঁছোতে অতুলবাবুর সময় লাগে ঠিক সাত মিনিট। আজ কিন্তু সময় লাগল আরও এক মিনিট কম। সদর দরজায় কলিং বেল চাপতেই পরিচারক পরিমল এসে দরজা খুলে দিয়ে অবাক সুরে প্রশ্ন করল, ‘বাবু, আজ এত তাড়াতাড়ি চলে এলেন যে? বড়ো কোনও মাছ পেয়েছেন বুঝি?’

অতুলবাবু উত্তর দেওয়ার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে প্রকাশ না করে ছিপটি তার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, ‘এটা জায়গামতন রাখ গিয়ে আর চটপট আমার জন্য এক কাপ চা করে আন তো।

পরিমল যেভাবে হতবাক ভঙ্গিতে ছিপটি নিয়ে অন্দরমহলে বিদায় নিল তাতে বোঝা গেল, সে মালিকের এই ধরনের প্রতিক্রিয়ায় অভ্যস্ত নয়।

সদর দরজা দিয়ে প্রবেশ করে বেশ কিছুটা খোলামেলা জায়গায় একটি টি-টেবিলকে ঘিরে চারটি চেয়ার পেতে বসার ব্যবস্থা করা আছে। উত্তর দিকের দেয়ালে একটি পুরোনো আমলের ঘড়ি এবং দুটি বাঁধানো অয়েল পেন্টিং ছাড়া আর কিছুই নেই। তবে এই ঘরে যে-জিনিসটি সবচেয়ে নজর কাড়ার মতো এবং যার সামনে এখন অতুলবাবু দণ্ডায়মান, তা হল একটি বড়ো মাপের অ্যাকোয়ারিয়াম।

অ্যাকোয়ারিয়ামটা বেশ পুরোনো। অন্তত বছর পনেরোর কম তো নয়ই। অ্যাকোয়ারিয়ামটি বিভিন্ন আকারের গোল্ড ফিশ, রেড হেড এবং পলির মতো শান্তিপূর্ণ সহবাসকারী বারোটি মাছের বিচরণক্ষেত্র। মাছ পোষা যে অতুলবাবুর শখ এইটুকু বললে বিষয়টি অসম্পূর্ণ থেকে যায়। তিনি মাছের চরিত্র, জীবনধারণ পদ্ধতি ইত্যাদি পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে স্টাডি করতেন। এটাও এক প্রকারের গবেষণা বলা যায়।

একসময় এই অ্যাকোয়ারিয়ামে দুটো পিরানহা, ক্রাউনটেল বিটা, পাফার ফিশ-এর মতো মাংসাশী মাছও তিনি মজুত করেছিলেন। তবে তাদের একটিও মাস খানেকের বেশি টেকেনি। এর জন্য অর্থ এবং পরিশ্রম দুই-ই বিস্তর খরচ করেছেন অতুলবাবু। তবে এ সবই পুরোনো কথা।

এখন তাঁর শরীর বয়সের ভারে ঝুঁকে পড়েছে। বলাইবাহুল্য শখটাও খানিকটা থিতিয়ে পড়েছে। গত জানুয়ারিতে তিনি আটষট্টিতে পা দিয়েছেন। অবিবাহিত জীবনে সরকারি দফতরের দায়িত্ব ছাড়া আর কোনও ঝক্কি তাঁকে সামলাতে হয়নি। অবসরের পর প্রথমদিকে কিছুটা একাকিত্বের ভ্রূকুটি সামলাতে হয়েছিল অবশ্য। কিন্তু এখন টুকটাক শখ আহ্লাদ মিটিয়ে দিন চলে যাচ্ছে বেশ। এই শখেরই একটি অন্যতম হল ভিন্ন প্রজাতির মাছ সংগ্রহ।

বেশ কয়েক বছর বিরতির পর অতুলবাবু যেন সেই পুরোনো রোমাঞ্চ আজ আর একবার অনুভব করছেন। অদ্ভুত দর্শন মাছটাকে তিনি ছেড়ে দিয়েছেন অ্যাকোয়ারিয়ামের জলে। স্বভাবতই নতুন পরিবেশ এবং প্রতিবেশীদের মাঝে সে কিছুটা নিস্তেজ এবং ভীত। একগোছা কৃত্রিম আগাছার আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে রেখেছে মাছটা।

পরিমল চা দিয়ে গেছে প্রায় মিনিট পনেরো, কিন্তু অতুলবাবু তাতে একবারও চুমুক দেওয়ার সময় পাননি। কারণ তাঁর দৃষ্টি ল্যাপটপের আয়তাকার স্ক্রিনের উপর স্থির। শুধু স্থির নয় বরং উত্তেজনায় উজ্জ্বল। সদ্য ধরে আনা মাছটার ব্যাপারে অনুসন্ধান করতে করতে একটি খবরের উপর নজর পড়তেই অতুলবাবু থমকে দাঁড়িয়েছেন।

মাছটার নাম সারপা সালপা। একটি রঙিন ছবিও জুড়ে দেওয়া আছে খবরটির সঙ্গে, যা দেখে অতুলবাবু একশো শতাংশ নিশ্চিত যে, ল্যাপটপের ছবিটি এবং তাঁর ধরে আনা মাছটা একই বংশদ্ভুত। এই প্রজাতির মাছ মূলত পাওয়া যায় আফ্রিকার দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূল এবং ভূমধ্যসাগরে। ভারতবর্ষের কোনও অঞ্চলে এর অস্তিত্ব কোনও কালেই আবিষ্কৃত হয়নি।

এই ধরনের মাছকে বিশেষজ্ঞরা একটি বিশেষ নামে ভূষিত করেছেন, হ্যালুসিনোজেনিক। অর্থাৎ যে-মাছ মানুষের মধ্যে হ্যালুসিনেশন বা কল্পিত দৃশ্যের জন্ম দিতে সক্ষম। এইসব তথ্য অতুলবাবু ইন্টারনেট থেকে জোগাড় করে একটি ডায়ারিতে লিখে নিচ্ছেন। প্রতিটি তথ্য তাঁকে বারেবারে যেমন চমকিত করে তুলছে, তেমনি অতিক্রম করে যাচ্ছে তাঁর বিশ্বাসের গণ্ডি।

সারপা সালপা যে প্রকৃত অর্থেই একটি নিষিদ্ধ মাছ এবং এটিকে খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করা যে রীতিমতো বিপজ্জনক তা বোঝাতে গবেষকরা বেশ কয়েকটি ঘটনারও উল্লেখ করেছেন। যেমন এই শতাব্দীর গোড়ার দিকে নব্বই বছরের এক বৃদ্ধ এই মাছ খেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন। তিনি প্রাণে মারা না পড়লেও দুদিন যাবৎ অদ্ভুত এবং ভযংকর দৃশ্য তাঁর চোখের সামনে ফুটে উঠতে থাকে। এক কথায় হ্যালুসিনেশন।

এমনই আর একটি ঘটনা ঘটে বছর চারেক পর। এইক্ষেত্রে রোগীর পরিস্থিতি আরও গুরুতর এবং দীর্ঘায়িত হয়। অতুলবাবু আর পড়তে পারলেন না। তাঁর দুই ভ্রূর মাঝে এক গভীর ভাঁজ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। প্রশ্ন এখন একটাই যে, এমন একটি দুর্লভ মাছ বিশ্বাসদের এই পুকুরে কী ভাবে এল?

এই প্রশ্নের উত্তর যে পুকুরের মালিক, প্রাণতোষ বিশ্বাসের থেকে পাওয়া যাবে না তা অতুলবাবু খুব ভালো করেই জানেন। ফলে মনের উদ্বেলিত আগ্রহকে সেই মুহূর্তের জন্য দমন করা ছাড়া আর উপায় রইল না।

রাত এগারোটা। খাওয়া দাওয়া সেরে অতুলবাবু বিছানায় উঠেছেন তা প্রায় আধঘন্টা। এটা তাঁর অভ্যাস। কিন্তু নিয়মের বাইরে আজ যা ঘটেছে তা হল, অতুলবাবুর দুচোখে ঘুমের লেশমাত্র নেই। চিন্তাটা ঠিক এইসময় অতুলবাবুর মনে উঁকি দিল। শুধু চিন্তা নয়, এক ভযংকর চিন্তা। বলা যেতে পারে এও একপ্রকার গবেষণার রসদ। গবেষণার ক্ষেত্রে গিনিপিগের ব্যবহার সর্বজনবিদিত।

অতুলবাবু এইমাত্র যে-পরিকল্পনার খসড়া মনে মনে এঁকেছেন তা হল, সারপা সালপা মাছটা কোনও এক মানুষের শরীরে প্রয়োগ করে তার প্রভাব তিনি নথিভুক্ত করবেন এবং এই গবেষণার গিনিপিগ হবে তাঁর পুরোনো ও বিশ্বস্ত পরিচারক, পরিমল। তবে এ কাজে যথেষ্ট ঝুঁকি আছে এবং সে কথা পরিমল জানতে পারলে এমন আত্মবলিদানে সে কিছুতেই রাজি হবে না। তবে এই গবেষণায় তিনি সফল হলে ভারতবর্ষের বিজ্ঞানমহলে যে একটা সাড়া পড়ে যাবে, সেকথা ভেবেই অতুলবাবু রোমাঞ্চিত হয়ে উঠলেন এবং সেই সঙ্গেই তার মনের দৃঢ়তা কয়েকগুন বেড়ে উঠল।

ভোরের আলো ফুটতেই অতুলবাবু ছুটে গেলেন অ্যাকোয়ারিয়ামটির কাছে। সুদর্শন মাছটা এখন অনেকটাই স্বাভাবিক ছন্দ ফিরে পেয়েছে। অ্যাকোয়ারিয়ামের কাচের দেয়াল ঘেঁষে সে নির্দ্বিধায় সাঁতরে বেড়াচ্ছে দেখে অতুলবাবু নিশ্চিন্ত হলেন।

অ্যাকোয়ারিয়ামে নতুন অতিথিটিকে লক্ষ্য করেছিল পরিমল। কিন্তু তখনও সে জানে না এই আপাতদৃষ্টিতে সুন্দর মাছটার মধ্যে কী ভয়ানক ক্ষমতা লুকিয়ে রয়েছে।

পরিমল, তুমি এমন মাছ আগে কখনও দেখেছ? অতুলবাবু অনিবার্য উত্তরটি জানা সত্ত্বেও প্রশ্নটি করলেন।

না, বাবু। আমি গাঁ-গঞ্জের মানুষ। ছোটোবেলা থেকে খালবিল চষে বেড়িয়েছি। দুহাতে কত মাছ ধরেছি। কিন্তু এমন মাছ সত্যিই কখনও দেখিনি। এর কী নাম, বাবু?

এর নাম, সারপা সালপা।

কী, কী বললেন? সাপলা… সার পলা

পরিমলের কাণ্ড দেখে অতুলবাবু হাসিতে ফেটে পড়লেন। প্রায় মিনিট খানেক পর নিজেকে সামলে নিয়ে তিনি বললেন, তুমি বরং এক কাজ করো পরিমল। মাছটাকে বার করে বেশ করে ভাজা করো দেখি।

এই মাছ আপনি খাবেন! কী সব নাম বলছেন বাপের জন্মেও শুনিনি। এটা কি খাওয়া ঠিক হবে? পরিমলের গলায় বিভ্রান্তি স্পষ্ট।

আলবাত খাব। এই মাছ এত সহজে মেলে না। দারুণ স্বাদ বুঝলে? নাও আর সময় নষ্ট না করে যা বললাম তাই করো। পরিমল বিনা বাক্যব্যয়ে মালিকের নির্দেশ পালন করল।

দুপুরে খাবার টেবিলে বসে অতুলবাবুকে একটা ছোটোখাটো অভিনয় করতে হল। খাবার পরিবেশিত হতেই অতুলবাবু বলে উঠলেন, আজ শরীরটা মোটেই ভালো ঠেকছে না। ভাত আর এবেলা খাব না। আমাকে বরং একটু ছাতু-মুড়ি দাও তো।

অতুলবাবুর কথা শুনে পরিমল ব্যস্ত হয়ে উঠে বলল, সেকি বাবু! সকালেও তো ভালোই ছিলেন। এইটুকু সময়ে মধ্যে আবার কী হল?

পেটটা বোধহয় ঠিক নেই।

তবে এক কাজ করি, মাছ ভাতটা বরং ফ্রিজে তুলে রাখি। রাতে না হয় গরম করে…

কথাটা সম্পূর্ণ করতে না দিয়ে অতুলবাবু বললেন, না না, ওসবের দরকার নেই। ডাক্তারের সাথে ফোনে কথা হয়েছে। মাছের কথাটা ওনাকে বলেছিলাম। উনি শ্রেফ মানা করে দিয়েছেন। আজ আর মাছটা আমার খাওয়া হবে না। তুমি মাছটা এবেলাই খেয়ে নাও।

পরিমল বেশ কিছুটা প্রতিবাদ করলেও তাতে ফল কিছুই হল না।

দুপুরের পর থেকেই অতুলবাবু তাঁর পরীক্ষার ফলাফল জানার জন্য উন্মুখ হয়ে উঠেছেন। ডায়ারিতে এখনও পর্যন্ত দুটো এন্ট্রি তুলেছেন অতুলবাবু।

প্রথমটা, দুপুর একটা সাতাশ মিনিটে। বয়ান এইরূপ পরিমল দাস আমার পনেরো বছরের পুরোনো বিশ্বস্ত পরিচারক। বয়স আটচল্লিশ। উচ্চতা, আনুমানিক পাঁচ ফুট ছয় ইঞ্চি, শীর্ণকায় এবং সামান্য হাঁপানির লক্ষণ আছে। পরিমল সারপা সালপা মাছটার আদ্যপান্ত আত্মসাৎ করেছে। কাঁটাগুলোকেও সে চিবোতে ছাড়েনি। জানিয়েছে, স্বাদ মোটের উপর ভালো লেগেছে।

দ্বিতীয় এন্ট্রিটি দুপুর আড়াইটের পরিমলের মধ্যে এখনও কোনও কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়নি।

এখন সন্ধে ছটা বেজে দশ মিনিট। প্রতিটি মিনিটের হিসেব রাখছেন অতুলবাবু। পরিমল রান্নাঘরে চা বানাতে ব্যস্ত। অতুলবাবু একটি চেয়ারে বসে। সামনের টেবিলের উপর রাখা তাঁর ডায়ারি ও একটি কলম। অতুলবাবুর দৃষ্টি যদিও হাতে ধরে রাখা খবরের কাগজের উপর স্থির, তথাপি তাঁর কানজোড়া সতর্ক।

হঠাৎ রান্নাঘর থেকে এক তীব্র চিত্কার। পরিমলের আর্তনাদ। অতুলবাবু ইতিমধ্যেই চমকে উঠেছেন। তিনি তড়িঘড়ি ছুটে গেলেন রান্নাঘরে উদ্দেশ্যে। সেখানে পৌঁছে দেখলেন, পরিমল বিস্ফারিত চোখে চেয়ে আছে পশ্চিম দেয়ালের খোলা জানলাটার দিকে।

কী হয়েছে, পরিমল? অমন করে চ্যাঁচামেচি করছ কেন?

পরিমল ধীরে ধীরে তার কম্পমান আঙুল তুলে জানলাটার দিকে দেখিয়ে বলল, বাবু, ওই প্যাঁএএএচাটা কেমন আমার দিকে চেএএএয়ে আছে!

পরিমলের উত্থিত আঙুল অনুসরণ করে অতুলবাবু জানলার দিকে চোখ ফেরালেন। নাহ, সেখানে কিচ্ছু নেই। ব্যাপারটা বুঝতেই এক প্রসন্নতার প্রচ্ছন্ন হাসি অতুলবাবুর ঠোঁটে খেলে গেল।

পরিমল, তুমি ভুল দেখেছ। জানলায় তো কিছুই নেই, অতুলবাবু বললেন।

ইতিমধ্যেই পরিমল কয়েক পা পিছনে সরে এসে অতুলবাবুর গা ঘেঁষে দাঁড়িয়েছে। সে কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, কী বলছেন বাবু, ওই তো জানলায় বসে প্যাঁচাটা,আপনি দেখতে পাচ্ছেন না? কী কুত্সিত দেখতে! এমন ভাবে আমার দিকে তাকিয়ে আছে যেন আমার চোখ দুটো খুবলে নেবে!

পরিমলকে চা করার দায়িত্ব থেকে মুক্তি দিয়ে বসার ঘরে নিয়ে এল অতুলবাবু। মাছটার প্রথম পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার সময় এবং ধরনটা ডায়ারিতে যত্ন করে তুলে রাখলেন অতুলবাবু। সেই দিন রাতে উল্লেখযোগ্য আর কিছুই ঘটল না। পরের দিন রাত দশটা পর‌্য়ন্তও পরিমলের মধ্যে কোনও অস্বাভাবিক পরিবর্তন লক্ষ্য করতে না পেরে অতুলবাবু একপ্রকার নিরাশ হয়ে পড়লেন।

ঘটনাটা ঘটল রাত বারোটা নাগাদ। অতুলবাবু বিছানায় শুয়ে মনের ভিতর ভিন্ন এবং বিপরীতমুখী চিন্তা কাটাকুটি খেলে চলেছে। হঠাৎ এক ক্ষীণ পায়ে শব্দে অতুলবাবুর চিন্তায় চিড় ধরল। তিনি সতর্ক হয়ে বিছানায় উঠে বসলেন। পায়ে আওয়াজটা ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠছে। খুব মনোযোগ দিয়ে অতুলবাবু বুঝলেন, পায়ে শব্দটি সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে আসছে।

চোর! কথাটা মনে হতেই একটা চাপা ভয়ে উদ্রেক হল অতুলবাবুর মধ্যে। তবে এই ভীতি অমূলক কিনা তা পরীক্ষা করতে বিছানা থেকে নামতে যাবেন এমন সময় ঘরের দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করল পরিমল। দুবছর আগে একটা মেজর হার্ট অ্যাটাকের পর দরজায় হুড়কো দেওয়া ছেড়ে দিয়েছেন অতুলবাবু। পরামর্শটা অবশ্য ডাক্তারবাবুরই ছিল। অতুলবাবু সে কথার যথার্থতা বুঝতে পেরে অক্ষরে অক্ষরে তা পালন করে চলেছেন মাত্র।

পরিমলকে ঘরের মধ্যে আবিষ্কার করে একটা স্বস্তির শ্বাস ফেললেন অতুলবাবু। বেড সুইচে চাপ দিয়ে ঘরের আলো জ্বেলে অতুলবাবু যা দেখলেন, তাতে তাঁর শরীরের রক্ত হিমশীতল হয়ে উঠল। তিনি দেখলেন, পরিমল তার বজ্র মুঠিতে ধরে আছে একটি বড়ো মাপের ছুরি। ছুরিটির ধারলো অংশে রক্তের ছাপ। এবার অতুলবাবুর দৃষ্টি পড়ল তার পরিচারকের পোশাকের উপর। পরিমলের জামার বিভিন্ন অংশে ছুরি চালানোর দাগ স্পষ্ট এবং সেই ছেঁড়া অংশ থেকে শরীরের যেটুকু অংশ দেখা যাচ্ছে, সেখান থেকে ঝরে পড়ছে রক্তের ধারা। আঁতকে উঠলেন অতুলবাবু।

অতুলবাবু কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন এমন সময় দেখলেন, পরিমল তার হাতে ধরে থাকা ছুরিটা হাওয়ায় বেপরোয়া ভাবে চালাতে শুরু করেছে। ঠিক যেন কোনও এক অদৃশ্য আততায়ীর থেকে বাঁচার আপ্রাণ চেষ্টা করছে সে।

যা… যা, চলে যা বলছি। কাছে আসবি না। পরিমল হাঁপাতে হাঁপাতে কথাগুলি বলল। ঘরে অতুলবাবুর উপস্থিতি যেন তার নজরেই পড়েনি। এক পা এক পা করে পিছোতে পিছোতে তার পিঠ এসে ঠেকল দেয়ালের গায়ে এবং সঙ্গে সঙ্গে পরিমলের এক তীব্র আর্তনাদে ঘরের শান্ত বাতাস আলোড়িত হয়ে উঠল।

না, আমার কাছে এলেই কিন্তু এই ছুরি দিয়ে.. বলেই পরিমল তার অস্ত্রটি নিজের শরীরের উপরেই চালাতে লাগল।

এমন একটি রক্তাক্ত দৃশ্য চোখের সামনে দেখে অতুলবাবু কিছু সময়ে জন্য কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়লেন। প্রাথমিক বিহ্বলতার ভাবটা কাটিয়ে উঠে তিনি বললেন, পরিমল, কী হয়েছে? কে তোমার কাছে আসছে? এখানে তো কেউ নেই!

ওই যে, একটা কুকুর। ওটা মনে হয় পাগল। আমাকে কতবার কামড়েছে। আর একটা সাপও ছিল। ওই প্যাঁচাটাও আবার এসেছে। ওই যে জানলায় বসে, ওই তো ওইখানে। ওরা আমায় মেরে ফেলবে। না, কাছে আসবিইইই না বলছি… কথাগুলি বলতে বলতে পরিমল নিজের বুকের উপর ছুরিটা আড়াআড়ি এমন ভাবে চালিয়ে দিল, যেন শরীরে জোঁকের মতো আঁকড়ে থাকা অদৃশ্য প্রাণীগুলিকে সে ছাড়িয়ে ফেলছে। এতে ফল হচ্ছে বিপরীত, তার শরীরে তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন ক্ষত।

ব্যাপারটা যে এতদূর গড়াবে তা কল্পনাও করতে পারেননি অতুলবাবু। শুধু যে গড়িয়েছে তা নয়, বরং অনেক অংশেই হাতের বাইরে চলে গেছে। অতুলবাবু যে-মারাত্মক খেলায় মেতে উঠেছিলেন, তার পরিণাম হিসেবে এখন পরিমলের প্রাণ সংশয় উপস্থিত।

অতুলবাবু দুহাত তুলে পরিমলকে শান্ত করার উদ্দেশ্যে এগিয়ে গেলেন। কিন্তু পরিমল তখন সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণের বাইরে। অতুলবাবুকে এগিয়ে আসতে দেখে পরিমল চেঁচিয়ে বলে উঠল, শেয়াল শেয়াল! খবরদার, আমি…আমি।

পরিমলের চোখে ফুটে উঠেছে মারাত্মক হিংস্রতা। তার হাতের ছুরিটা বুকের কাছে ঢালের মতো স্থির। অতুলবাবু আর এক পা এগোতেই, তুই আমাকে শেষ করার আগে আমি তোকে শেষ করব বলেই পরিমল ঝাঁপিয়ে পড়ল অতুলবাবুর বৃদ্ধ শরীরের উপর। কয়েক মূহুর্তের লড়াইয়ে পর পরিমলের হাতের ছুরিটি অতুলবাবুর বুকের বাঁ দিকের নরম চামড়া ভেদ করে অন্তত চার ইঞ্চি ভেতরে প্রবেশ করল। তত্ক্ষণাৎ ফিনকি দিয়ে বেরিয়ে এল লাল তরল।

অতুলবাবুর চোখ যেন কোটর থেকে ঠিকরে বেরিয়ে আসছে। তাঁর মুখমণ্ডল যন্ত্রণায় বিকৃত, আর্তনাদ গলায় এসে পথ হারিয়ে স্তব্ধ হয়ে গেছে। শুধু একটি চাপা গোঙানি চলল মিনিট খানেক, তারপর সব কিছু স্তব্ধ। পরিমলের বিজয়ের অট্টহাসি ঘরের চার দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে যেন অনুরণিত হতে লাগল।

মুক্তি

॥ ১ ॥

ভোরের কুয়াশা সরিয়ে স্পষ্ট হয়ে উঠছে নম্রতার পুরোনো শহর। বাসটা ক্রমশ পাহাড়পুরের দিকে এগিয়ে আসছে। চারপাশটা অনেক বদলে গেছে। এমনি বৃষ্টি ছিল সেদিন ভোরেও, যেদিন বিধ্বস্ত অবস্থায় তিন বছরের রাইকে নিয়ে বেরিয়ে এসেছিল নম্রতা। একরত্তি মেয়েটা কোল আঁকড়ে চুপ করে বসেছিল। এতটুকু কাঁদেনি। বরং যেন আগলে রেখেছিল নম্রতাকে। দেখতে দেখতে সতেরোটা বছর কেটে গেল।

এই তো দেবী চৌধুরানির মন্দির! যেদিন প্রথম টকটকে লাল সিঁদুর আর লাল বেনারসি পরে প্রথম পা রেখেছিল এই শহরটায়, সেদিনই এসেছিল এখানে প্রণাম করে নতুন জীবনের আশীর্বাদ নিতে। ভেজা ভেজা মায়া চোখে লেপটে যাওয়া কাজল আর একরাশ স্বপ্ন ছিল সেদিন। তারপর তো কত হেরে যাওয়া বিকেলে সে এসেছে!

সেই পাকুড় গাছটা! চার বছরে যতবার এদিকে এসেছে, ততবার খুঁজেছে গাছটাকে। রঙিন থেকে ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া জীবনের নীরব সাক্ষী তো এই গাছটাই!

বাসের হর্ন আর স্মৃতির মেদুরতায় কখন যে ব্যাগে মোবাইলটা বাজছে খেয়ালই করেনি নম্রতা। ফোনটা রিসিভ করে বলল, হ্যাঁ রে রাই এক্ষুনি ও বাড়ি পৌঁছোব। সন্ধের আগে ব্যাক করব কোচবিহারে দিদির কাছে। দিদান কে দে তো একটু…

—মা চিন্তা কোরো না যেটা আমার রাইয়ের প্রাপ্য সেটা আমি নেবই। কেউ বাধা দিতে পারবে না।

নেতাজি বাস টার্মিনাস থেকে কয়েক পা এগোলেই চৌমাথার মোড়টা। ডান পাশে সরু কানাগলিতে ঢুকতেই ওই তো দোতলা হলদে বাড়িটা। সামনের বেগনভেলিয়া গাছটা নেই বলে কেমন যেন ন্যাড়ান্যাড়া লাগছে। আশপাশের ছাদ থেকে দু-একটা উৎসুক, পরিচিত মুখ চোখে পড়ল নম্রতার। এই তো আর কপা এগোলেই বিশাল ফটক। কিন্তু পাগুলো কেন অসাড় হয়ে আসছে নম্রতার? অবশেষে সব দ্বিধা কাটিয়ে কলিংবেল বাজাতেই বেরিয়ে এল এ বাড়ির জামাই দেবেশ। কেস চলাকালীন দেখেছিল নম্রতা দুএকবার।

—আরে আসুন! একা কেন, রাই কোথায়?

—ওর ক্যাম্পাসিং আছে।

—তা বাপের ভিটে, ঠাকুমা এদের প্রতি অবশ্য আজকালকার ছেলেমেয়েদের তেমন সেন্টিমেন্ট নেই। কী বলে যে ডাকি! বউদিই বলি, কি বলেন? আপনি তো এখন কলকাতার ফ্ল্যাটে থাকেন। ইস্কুলটা কোথায়? আর পেপারে ফিচার টিচার তো লিখছেন খুব।

—ওই একটু আধটু!

—স্কুল ব্যান্ডেলের কাছে। থাকি উত্তরপাড়া, প্রপার কলকাতা নয়। ফ্ল্যাট না, দিদির ননদের বাড়ির নীচতলায় ভাড়া আছি।

—একাই তো থাকা হয় নাকি? বলেই ফিচেল হাসি হাসে দেবেশ।

—একা কেন? রাই আর মা থাকে। দৃঢ় ভাবে বলে নম্রতা।

ইতিমধ্যেই দোতলায় এসে পৌঁছেছে নম্রতা। বড়ো বৈঠকখানাটা এখন রোগিণীর শয্যা। বিছানার একপাশে পড়ে আছে এককালের দাপুটে বিভা দত্ত। চারদিকে চোখ বোলাতেই নজরে এল দেয়ালে ঝুল আর ধুলোর আস্তরণের মাঝে ঝুলছে শুকনো ফুলের মালা জড়ানো দীপকের ছবি।

ত্রস্তব্যস্ত হয়ে ছুটে এল সোনা। এখন বেশ গিন্নিবান্নি।

—ও তুমি? এসেছ? মা তো ঘুমোচ্ছে। একটু বসো, বলেই ইশারায় স্বামীকে ডেকে নিয়ে গেল। আয়া মাসি বলে চলে, তুমি বুঝি বাবুদার প্রথম বউ! বুড়ি খুব তোমার নাম করছে গো!

তার নাম করছে? আশ্চর্য! কয়েক মুহূর্তের জন্য নম্রতা পিছিয়ে গেল একুশ বছর আগে। তখন সে পাঁচ মাসের গর্ভবতী। রাত প্রায় বারোটা। সব কাজ সেরে ঘুমোনোর প্রস্তুতি নিচ্ছে। দীপক অফিসের কাগজপত্র নিয়ে একটু বিচলিত। ক্ষুদ্রাতি ক্ষুদ্র বিষয়ে বিচলিত আর উত্তেজিত হওয়াটাই প্রকৃতি ছিল দীপকের। নম্রতা বেশি ঘাঁটাত না। হঠাৎই রণংদেহী হয়ে ছেলের ঘরে কড়া নেড়ে উত্তেজিত হয়ে উপস্থিত হলেন বিভাদেবী।

—ও বাবু দেখ দেখ তোর বউ আজও হলুদের বয়মের মুখ আলগা রেখে এসেছে। আগে একদিন এভাবে চিনি নষ্ট করেছিল, আমি না দেখলে এখনি সব ছিটিয়ে চিত্তির হতো! বলি বিয়ে বাড়িতে দেখে কী মেয়ে পছন্দ করে আনলি? আমার সংসারটা তো গোল্লায় গেল!

—নম্রতা কী শুনছি এসব?

—আসলে মা বললেন শেষ পাতে সোনা বেগুন ভাজা খাবে, তাই তাড়াহুড়োয় খেয়াল করিনি।

—হলুদ কি তোমার বাবা জোগায় নাকি?

—বাবার নাম একদম তুলবে না। উনি নেই।

—একদম চুপ! মুখে মুখে কথা বললে জিভ টেনে ছিঁড়ে দেব।

—আহ লাগছে! চুলটা ছাড়ো!

—চল হারামজাদি! মা আর সোনার কাছে ক্ষমা চেয়ে বল, তোর মাস্টারবাবা তোকে শিক্ষা দেয়নি! বল!

—আহ লাগছে! ক্ষমা কেন চাইব? ভুল করে হয়ে গেছে। ইচ্ছে করে তো…

—একদম চুপ! আই! সোনা নিয়ে আয় ওর খাতাগুলো! দেখাচ্ছি মজা! লুকিয়ে লুকিয়ে কাগজে ফিচার পাঠানো? মন সবসময় উড়ু উড়ু! এক্ষুনি সব ছিঁড়ে দেব।

—হায় হায় গো! কী মেয়ে মানুষ! ক্ষ্যাপা ছেলেটাকে অসুস্থ করা! যা বাবা চোখে মুখে জল দে আমাদের ভদ্দর লোকের বাড়িতে চ্যাঁচামেচি! পাঁচজনে শুনলে বলবে কী?

॥ ২ ॥

—ও বউদি চা খাবে গো! ও বউদি! চারু মাসির ডাকে সম্বিত ফেরে নম্রতার। ধীরে ধীরে চশমাটা খুলে ব্যাগে রাখে। একবার শীর্ণ বিভাদেবীর দিকে তাকায়। এই মৃত্যুপথযাত্রীনির শেষইচ্ছে পূরণ করতেই তো আসা!

পাশের লাল সিমেন্টের ঘরটা ছিটকিনি দেওয়া। চারুর অনুমতি নিয়ে ঢুকল নম্রতা। এখানেই তার খাট, আলমারি ছিল এককালে! পরে হয়তো রুম্পাও এখানে থাকত! এখন বাতিল জিনিসের আখড়া হয়েছে। হয়তো বাতিল হওয়া সম্পর্কও? ঘর? না সেভাবে নম্রতা কোনও বরাদ্দ ঘর পায়নি এ বাড়িতে।

বিয়ের পরপরই উঠেছিল নীচতলার আলো, বাতাসহীন স্যাঁতসেঁতে ঘরে। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই রাই এল। বাচ্চার ঠান্ডার ধাত থাকায় উপরের লাল সিমেন্টের ঘর বরাদ্দ হল। কিন্তু সোনার পড়ার সমস্যা হওয়ায় শেষমেশ রাই আর নম্রতার ঠাঁই হল একদম ডাইনিং ঘরের এককোণে কাঠের চৌকিতে।

দরজাগুলোর একটাতেও কোনও পাল্লা ছিল না। শ্বশুরমশাই নগেন দত্ত তখন জীবিত ছিলেন। একে অ্যালজাইমার তার ওপর ডায়াবেটিস। যতবার তিনি ঘরের ওপর দিয়ে টয়লেটে যেতেন ততবার ছোট্ট রাইকে ফিডিং করাতে নম্রতাকে অস্বস্তিতে পড়তে হতো। হাজার বুঝিয়ে সুরাহা হয়নি। আসলে বিভাদেবী চাননি দীপক আর নম্রতার কোনও ব্যক্তিগত পরিসর থাকুক। জিনিসপত্র অবশ্যি নীচতলার ঘরেই থাকত।

একদিন এটাই তার সংসার ছিল! কই এতটুকু টান আসছে না তো? নম্রতার ঠাকুমা বলতেন দিনহাটার বাড়িটা ঠাকুমার স্বামীর ভিটে। পরপারে যাবার আগে তিনি ভিটে ছাড়বেন না! সেই ঠাকুমার সংস্কারেই তো বড়ো হয়েছে সে! স্বামীর ঘর, সিঁদুর, শাখা, পলা, নোয়া— এসব ভাবলেই ছোটোবেলায় প্রতিটা রোমকূপে যে-শিহরণ জাগত সেসব যে কোথায় উবে গেল কবে?

ধীরে ধীরে জানলার শিকগুলোতে হাত বোলায় নম্রতা। কত বুক ফাটা কান্নায় এই শিকগুলোর ফাঁক দিয়ে একফালি আকাশ খোঁজার চেষ্টা করেছে! কতদিন! ডানদিকের সরু দরজাটা খুলতেই চোখে পড়ে বাঁকানো সিঁড়িটা। ধীরে ধীরে খানিকটা ঘোরের মধ্যেই ছাদে চলে আসে নম্রতা। এই ছাদটার মধ্যেই মরূদ্যান খুঁজে পেত এক সময় সে! গাছগুলো সব শুকিয়ে মরে আছে। চারদিকে পরিত্যক্ত টব। ওই তো নম্রতার ফেব্রিক দিয়ে রং করা ছোট্ট টবটা রং চটে পড়ে আছে।

আজও মনে পড়ছে তখন সবে দুদিন বিয়ে হয়েছে, একদিন আপন মনে গাছে জল দিতে দিতেই পাশের বাড়ির ক্যাসেট থেকে ভেসে আসা শ্রাবণী সেনের আমার প্রাণের মাঝে সুধা আছে চাও কী-র সুরে গুনগুন করছিল হঠাৎ পেছন থেকে দীপকের ধুপধাপ চটির শব্দ এগিয়ে আসছিল। কাঁধে দীপকের স্পর্শে চোখ বুজে রোমান্টিকতার কাব্য লিখছিল নম্রতা। না কোনও আবেশেই আবিষ্ট হতে পারেনি সেদিন।

দীপক জানিয়ে দিল তাদের সবার বাটি, চামচ, থালা, গেলাস আলাদা। দেখে বুঝে নিতে হবে। গুলিয়ে যেন না যায়। আর সোনার ঘরে বিছানায় ভুলেও নম্রতা যেন না বসে। সোনার এসব পছন্দ নয়। মুহূর্তেই শ্রাবণী সেন এর গানটা কলেজের পি ডি স্যারের হ্যাকের থিওরির মতো লাগতে শুরু করেছিল!

আজও চোখে জল এসে গেল নম্রতার? এখনও জল বেরোয় চোখ দিয়ে দীপকের জন্য? ভালোবাসা না পাওয়ার জন্য? নাকি স্বামী নামক অদেখা ব্যক্তিটির জন্য আশৈশব তিল তিল করে জমানো এক বুক ভালোবাসার এক কণাও দিতে না পারার জন্য? সত্যি কোথায় গেল ভালোবাসাগুলো যার এক কণাও এই পরিবারের একটি মানুষকেও সে দিতে পারল না।

॥ ৩ ॥

—ও বউদি নীচে চলো গো সবাই ডাকছে!

—তুমি চারু? কতদিন আছ?

—আমি অনেকদিন বউদি। আগে ঠিকা কাজ করতাম। এখন বুড়ির ডিউটি। তোমার কথা শুনছি অনেকের মুখেই।

—কী? আমি খুব খারাপ?

—ধুর! মানুষ দেইখে চুল পাকল! রুম্পা বউদিও খারাপ না গো! একটু ইসস্টরং! বাবুন দাদা যে কী করল! বেরেনশর্টের অতগুলা ওষুধ! তুমি আসো শিগগির, আমি যাই। নাহলে ভাববে চুকলি কাটতেছি।

ধীরে ধীরে পা বাড়ায় নম্রতা। চিলেকোঠার কাছে এসে পুরোনো কাচের বই রাখার আলমারিটা চোখে পড়ে। এটা আগে তার ঘরেই ছিল। এখানেই হয়তো ছড়িয়ে আছে পুরোনো যাপনের কোনও চিহ্ন। ওই তো সেই ফটো স্ট্যান্ডটা! ধুলোয় ধূসরিত। ওর মধ্যেই অযত্নে অস্পষ্ট হয়ে গেছে ছোট্ট রাই আর দীপকের ছবি! ধীরে ধীরে ছবিটা বের করে নেয়। পুরো নষ্ট হয়নি এখনও। সেই লাল কভার ফাইলটা না? তাতে কোচবিহার থেকে নম্রতার লেখা প্রথম আর শেষ বোকা বোকা ইনল্যান্ড লেটারে চিঠি। ফাইলটা হাতে নিতেই আঠেরো বছর আগের সব স্মৃতি হুড়মুড় করে বেরিয়ে এল।

সেদিন দীপকের বন্ধুর বিয়ে ছিল। দীপক অবশ্য কোথাও তেমন যেত না। কথা ছিল নম্রতা সন্ধের আগেই রাইকে নিয়ে যাবে। হরিদার রিকশা বলে রেখেছিল। খুব একটা বেরোনোর ভাগ্য ছিল না বলেই ছোটো ছোটো জিনিসে সুখ খুঁজে নিত। দীপক অফিসে বেরিয়ে গেছে। আলমারি থেকে লাল সিল্কটা বের করে আয়রন করতে গিয়ে দেখে দীপকের কভার ফাইলটা ছিটিয়ে আছে। ধীরে ধীরে সব গুছিয়ে আলমারিতে তুলে রাখে নম্রতা। এমনিতে দীপকের সব জিনিস কখনওই ঘাঁটার অভ্যাস তার ছিল না।

বিকেলে সব কাজ এগিয়ে তৈরি হতে গিয়ে দেখে আলমারি থেকে সব বের করে স্তূপ হয়ে আছে। নম্রতার ভালো শাড়িগুলো সিগারেট দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া। দীপকের চোখগুলো টকটকে লাল আর ফর্সা গালগুলো লাল হয়ে আছে। নিজেকে সংযত রেখে কি ঘটেছে জানতে চাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঝাঁপিয়ে এসে চুলের মুঠি ধরে শুরু হয়ে গেল এলোপাতাড়ি কিল, চড়, লাথি। এক ধাক্কায় আছড়ে পড়ল লোহার রেলিংটায়।

অভ্যাসবশত চেষ্টা করেছিল শান্ত ভাবে অপরাধ জানতে আর পাঁচ কান না করে চার দেয়ালে মিটিয়ে নিতে! কিন্তু সেই সময় পাশবিকবলে বলীয়ান হয়ে দীপক এমন ধাক্কা দিল যে, সে আছড়ে পড়ল লোহার রেলিংয়ে ওপর! তারপর কতক্ষণ যে পড়েছিল নম্রতা সিঁড়ির নীচে আজ আর মনে করতে পারে না।

হাতটা ফ্র‌্যাকচার হয়েছিল। ওই অবস্থায় মেয়েটাকে খাইয়ে হাতব্যাগে বাবার দেওয়া গয়নাগুলো, ৫০০ টাকা আর রাই-এর দু একটা জিনিস ভরে, ভোর হবার আগেই উঠে বসেছিল কোচবিহারের বাসে। তারপর তো জামাইবাবু সব সামলাল। পুলিশ কেসের ভয়ে মিউচুয়াল ডিভোর্সটা হয়ে গেল।

এরাও ততদিনে ছেলের মানসিক সমস্যা দেখিয়ে গা বাঁচাল। তখনও দীপক দ্বিতীয় বিয়ে করেনি। ফোনে, চিঠিতে মেরে ফেলার হুমকি দিত। সেই জন্যই দিদি পাঠিয়ে দিল উত্তরপাড়া। সেখানে চাকরির পরীক্ষার প্রস্তুতি, টিউশনি, আর একের পর এক লড়াই।

আজও ভাবে সেদিন ফাইল থেকে একটা কাগজ খাটের নীচে পড়ে যাওয়ার মাশুল তাকে কীভাবে যে দিতে হয়েছে? সেটা কতটা দরকারি ছিল সেটাই তো আর জানা হল না।

॥ ৪ ॥

ইতিমধ্যে অনেকেই হাজির। বিভাদেবী বালিশে হেলান দিয়ে বসে। ছোটো কাকিমণি বললেন, কত দিন পর দেখলাম নম্রতা! জেল্লা বেড়েছে তো? একদম কোনও খোঁজখবর নেই। বাবুন চলে যাবার পরও এলে না? এলেম আছে তোমার, বর ছেড়ে, কলকাতায় গিয়ে চাকরি নিলে, ফিচার লেখালেখি! বলি এ বাড়ির ছেলেদের মেজাজ তো বরাবরই তিরিক্ষি। আমরা আর পারলাম কই?

—আপনারাও তো কাকিমা রাইয়ের বাবার খবর যতদিনে জানালেন তখন আসা না আসা এক। কী হয়েছিল সেটা স্পষ্ট করে বলেননি।

—কি আর জানাব বাছা! তুমি মাথা বিগড়িয়ে দিয়ে গেলে, ওষুধ ধরল। পরের বউ এসে কোথায় বুঝিয়ে ওষুধ খাওয়াবে তা না, আরও বাড়িয়ে দিল, শেষমেশ সেই ওষুধগুলো একবারে খেয়ে..

—ও সোনা কাঁদিস না মা!

—কী করব বলো কাকিমা! দাদাটা এত সৎ ছিল না! আমার মায়ের মতো। অন্যায় বরদাস্ত করত না। বউগুলো এমন জুটল…

নম্রতার হাসি পাচ্ছিল তবু সংযত হয়ে বলল, এতটাই সৎ যে না জানিয়ে মানসিক ভাবে অসুস্থ ছেলের দুবার বিয়ে দিলে!

হঠাৎই বিভাদেবী বলে ওঠেন, বউমা তুমি রাই দিদিকে আনলে না? ক্যান্সার রোগীটা ফোন করেছিল তাও রাখলে না কথাটা।

—পরে আসবে। এখন ক্যাম্পাসিং।

—আর পরে কি আমি থাকব?

—এই বালাটা রাখো। রাইদিদুর বিয়েতে দিও। আর এই শিবলিঙ্গটা রাখো মা। সে মেয়েকে আমি বলতে পারব না আর সোনা তো এসব পারবে না… তাই তুমি এর দায়িত্ব নাও। গভীর একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে নম্রতা।

দেবেশ ইতিমধ্যে দলিল আর জমি-বাড়ির ম্যাপ নিয়ে হাজির। উকিলি কেতায় বলে চলে,

—বউদি পুরো বাড়ি আর ফাঁকা জায়গা নিয়ে ৫ কাঠা ৩ ছটাক। শ্বশুরমশাই নগেন দত্তের নামে বাড়ি। ওয়ারিশ হচ্ছে, বিভা দত্ত, সোনালি রায়, রুম্পা দত্ত, ছেলে রাতুল দত্ত, আর আপনার মেয়ে রাই দত্ত। আপনি তো ডিভোর্সি। এবার আমি রুম্পা বউদিকে বুঝিয়েছি সরকারি রেটে আমাকে বিক্রি করতে, রাজি হচ্ছেন না। আমি অবশ্য এমন কেস ঠুকে দিয়েছি ও কাউকে বেচতেও পারবে না। এবার থাকে আপনার মেয়ে। আমরা ভদ্র ফ্যামিলি। রাইকে বঞ্চিত করব না। আপনি দানপত্রে কোনও দাবি নেই বলে সই করে দিন। রাই-এর বিয়েতে আমরা থোক অ্যামাউন্ট কিছু দেব। এখন হাতটা খালি!

মাঝখান থেকে সোনা বলে, তোমার ভাগ্য ভালো যে আমাদের ফ্যামিলিতে এসেছিলে!

আপন মনেই হেসে ওঠে নম্রতা। দেবেশের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে, এখন ডিভোর্সি মহিলারও প্রপার্টিতে লিগ্যালি অনেক দাবি আছে। আপনি বোধহয় আপ টু ডেট নন।

—মানে আপনি সহজে মেটাবেন না তাই তো? অত দুর থেকে সব পারবেন?

—থামুন! আমার কথা শেষ হয়নি। বিভাদেবীর দিকে তাকিয়ে বলেন, রাই এখন বড়ো হয়েছে। কিছু না কিছু করবেই। ওর বিয়ে নিয়ে আমার কোনও তাড়া নেই। আপনি বালাটা রাখুন। আর শিবঠাকুর আমায় দিচ্ছেন? ভরসা পাচ্ছেন? একদিন তো ঠাকুরঘরে ঢুকতে দিতেন না। যাইহোক ওটা দিতে চাইলে আমি নেব। এই চেকটা রাখুন সই করা। আপনার ছেলের একটা মাত্র পিএলআই-এর নমিনি ছিলাম আমি। বাদ বাকি তো আপনি আর সোনা। যখন সব বন্ধন ছেড়ে গেছি তখন এটার জন্য ঋণী থাকতে চাই না, আপনার কাছে রাখুন। ৫০ হাজার আছে।

সবাই একটু মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে দেখে নম্রতা বলে চলে, আশা করি বুঝেছেন সম্পত্তির প্রতি আমার আর রাই-এর কোনও আগ্রহ নেই। সম্পর্ক যখন ছিঁড়ে গেছে প্রপার্টি দিয়ে কি হবে? এ বাড়িতে চারবছরে একটাই সম্পদ পেয়েছি সেটা আমার রাই। যা যা সই সাবুদ একটু গিয়ে করিয়ে আনবেন আবার কবে আসব জানি না, ভালো থাকবেন।

অনেকদিন ধরেই ওই চেকটা গলার কাঁটার মতো বিঁধে ছিল। আজ ফেরত দিতে পেরে নিজেকে উদাত্ত আকাশের মতো মুক্ত মনে হচ্ছে। ভেবেছে রাইয়ের কথা। তার অধিকারের কথা। কিন্তু না, সে রাইকে যোগ্য করে গড়তে পেরেছে। সে নিজেই নিজের পায়ে দাঁড়াবে। আর যা পড়ে রইল তা তো আর্থিক লাভ আর ক্ষতি। পুরো জীবনটাই যার ক্ষতির খাতে চলে গেল এ টাকাগুলো তার আর কী সৌভাগ্য আনবে।

সোজা অসম মোড়ে না গিয়ে একটু ঘুর পথেই গৌড়িয় মঠের সামনে আসে নম্রতা। এখন সুন্দর ব্রিজ হয়েছে। শহরের মাঝ বরাবর তির তির করে বয়ে যাচ্ছে নিস্তরঙ্গ করলা নদী। ধীরে ধীরে ব্যাগ থেকে দীপককে লেখা নিজের চিঠিটা বের করে। তারপর টুকরো টুকরো করে ভাসিয়ে দেয় করলার জলে। ভেসে যাক সব অতীত, গ্লানি। আজ নিজেকে উদাত্ত আকাশের মতো মুক্ত মনে হচ্ছে। মাঝে মাঝে মনকেমন করা মুহূর্তে আসত সে।

এই শহরটা বড়ো মায়াবি। না তার জন্মভূমি নয়। স্বামীর ভিটের অনুভূতি নেই তার। তবে বড়ো আপন। অনেক মন কেমন করা মুহূর্তে এই জলশহরের রাস্তা, নদী, গাছ, মন্দির তাকে বলেছে তুমি কেঁদো না আমরা আছি! এগিয়ে যাও। বাঁচো। হেরো না। আজ শহরটা আরও ঝকঝকে হয়েছে। কিন্তু আনাচে কানাচে জুড়ে সেই আন্তরিকতার ছাপ আজও আছে! ভালো থেকো জলশহর! জানি না আবার আসব কিনা! কিন্তু আমি তোমাকে ভুলব না। এই তোমরা আমার কেউ না হয়ে যে অনেক কিছু!

 

আমি ও কোকিলা শেষ পর্ব

একটানা কথাগুলো বলে কোকিলা থামল। আমি ওর দিকে জলের বোতলটা এগিয়ে দিলাম। একটু চুপ করে বসে জল খেয়ে আবার বলতে শুরু করল, ‘ক্রমশ নেমে এল আমার জীবনে চরম অন্ধকার। জানতে পারলাম রাজীবের কোনও হাই-ফাই ব্যবসা নেই। বড়ো ব্যাবসাদারকে খুশি করে অর্ডার পাওয়াই তার কাজ। অল্প কিছু দিনের মধ্যে তার এই ব্যাবসাদার বন্ধুরা বাড়িতে যাতায়াত শুরু করল। রাজীব বাইরে থেকে খাবার নিয়ে আসত। হুইস্কি-সোডা-রাম, আরও কী যে আমি অত নামও জানি না। এসব নিয়ে আমায় যেতে হতো রাজীবের তথাকথিত বন্ধুদের সামনে। আমায় সময় দিতে হতো, হাস্যময়ী-লাস্যময়ী হয়ে সময় কাটাতে হতো গভীর রাত পর্যন্ত। রাজীব আরও এগিয়ে দিত আমাকে। অর্ডারটা যে পেতেই হবে। পরে আপত্তি জানালে রাজীবের হাতে উত্তম-মধ্যমই জুটত। কাকে জানাব? প্রতি মুহূর্তে মনে হয়, কেন গুরুজনদের কথা শুনিনি? মা-বাবার বারণ, বিশেষত মায়ের চোখের জল জীবনের চলার পথ কখনওই মসৃণ রাখে না। মা-তো। সন্তানের মঙ্গল কামনা কোন মা না চায়। আমি রাজীবের মা-বাবার সাথে আবার কথা বললাম। কিন্তু ওনাদের উদাসীনতা আমায় অবাক করল। নিজের বাবা-মাকে কী বলব! কুনাল, যে আমার সাথে রাজীবের আলাপ করিয়ে দিয়েছিল সে-ও হেসে উড়িয়ে দিল, রাজীব নাকি এমন হতেই পারে না। আমিই সবকিছু মানিয়ে নিতে পারছি না। ভেবেছিলাম রাজীবকে ছেড়ে চলে যাব কিন্তু সাহসে কুলোয়নি। কী খাব, কোথায় রাত কাটাব, আবার যদি অন্য রাজীবের খপ্পরে পড়ি! ভয়ে আমি রাজীবের বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার পরিকল্পনা ত্যাগ করলাম। এই রাজীবের জন্যই আমায় দু-দু’বার গর্ভপাত করাতে হয়েছে। আমি চাইনি কিন্তু ওর ভয়, আমার ফিগার খারাপ হয়ে যাবে তাই বাধ্য হয়েই আমি রাজি হই। কী কষ্ট যে হয়েছিল। কোন মেয়ে না মা হতে চায়! মনে হয়েছিল একটি শিশু বোধহয় দু’পক্ষের মা-বাবাকে হাসিখুশিতে ভরিয়ে তুলবে। আবার সব ঠিকঠাক হয়ে যাবে। শুধু একটা শিশু– আমার স্বপ্ন, আমার জীবন। কিন্তু সবই বৃথা, রাজীবের নির্দয় আচরণ, তার সিদ্ধান্ত, আমায় কোন অন্ধকারে ঠেলে দিল! আর রাজীবের হাত থেকে আমার মুক্তি নেই। আমি রাজীবের তুরুপের তাস। তাই তো আমার সাজসজ্জার দিকে ওর এত নজর। আমি শেষ হয়ে যাচ্ছি।’

আবার কোকিলা চুপচাপ। ফোঁপানির শব্দ। নিশ্চুপ আমি শুধু নির্বাক হয়ে শুনে গেলাম। আমার কিছু করার নেই। কোকিলার এ অবস্থার জন্য অনেকাংশে ও নিজেই দায়ী। আমি কিছুই করতে পারি না। কোকিলা হঠাৎ ঘুরে চলে গেল। আমি কোকিলাকে কোনওদিন কোনও পরামর্শও দিইনি। এ ঘটনার মাস চারেক পরেই আমি বদলি হলাম।

চাকরি সূত্রে বদলি হয়ে চলে এলাম আরব সাগরের তীরে, মুম্বাইতে। আসার সময় রাজীব-কোকিলা দুজনকে একসাথে গুডবাই জানিয়ে এসেছিলাম। বিশেষ করে রাজীবকে, নানা অসুবিধা সত্ত্বেও থাকতে দেওয়ার জন্য। কোকিলা একটা কথাও বলেনি আমার সাথে কিন্তু ওর চোখ বলে দিচ্ছিল অনেক অনেক কথা। হাসির আভাসমাত্র দিয়ে কোকিলা আমায় বিদায় জানিয়েছিল।

মুম্বাই এসে নিজেকে গুছিয়ে নিতে মাস দেড়েক কেটে গেল কোথা দিয়ে বুঝতেই পারিনি। নতুন পরিবেশে মানিয়ে নিতে একটু যেন বেশি সময় লেগে গেল। তবে মাঝেমধ্যেই কোকিলার বিবর্ণ মুখটা কেমন যেন আমায় উদাস করে দিত। সব জেনেও আমি নিরুপায়, হাত-পা বাঁধা, কিছুই করার নেই। দু’একবার কোকিলাকে ফোন করেছি, ওপ্রান্তে রাজীবের গলা। সাদামাটা কথার পর ফোন নামিয়ে রেখেছি। কোকিলার সাথে কথা বলতে চাইলে রাজীব যে ভাবেই হোক এড়িয়ে গেছে। কোকিলা যেন হারিয়ে গেল আমার জীবন থেকে। দিন তার নিজের ছন্দে চলে। অবসরে কখনও আরব সাগরের ধারে বসে দেখি অনন্তের রূপ। সমুদ্রেরও এক নিজস্ব ছন্দ আছে, ওঠানামা, ভাসানো, ফিরে যাওয়া। একা-একা কেমন যেন বিষণ্ণ হয়ে যাই মাঝেমধ্যে, আবার ঝাড়া দিয়ে বাস্তবে ফিরিয়ে নিয়ে আসি নিজেকে। একদিন অফিস গিয়ে নিজের নামে চিঠি দেখে বেশ চমকে গেলাম। এই মোবাইলের যুগে কেউ আর ব্যক্তিগত চিঠি লেখে না। খুলে দেখি চিঠির তলায় লেখা কোকিলা।

বিনা সম্বোধনেই সে লিখেছে – ‘জানি এতদিন বাদে আমার চিঠি পেয়ে তুমি চমকে যাবে। আমার কথা মনে আছে তো? নাকি সব ভুলে গেছ? মাত্র অল্প কয়েক মাস তুমি ছিলে আমাদের কাছে, তবু তোমায় আমি আমার ব্যক্তিগত অনেককিছু উজাড় করে দিয়েছিলাম। তুমি জানতে চাওনি তবুও। তোমার নীরবতাই আমায় টেনেছিল তোমার দিকে। সে যাইহোক, কুণালকে মনে আছে নিশ্চয়ই। আমার কলেজের বন্ধু যে রাজীবের সাথে আলাপ করিয়েছিল। আমি জানতাম কুণাল আমায় ভালোবাসে, তবু ওই বয়সে রাজীবের অত টাকাপয়সা, ব্যবসা, সব আমায় গুলিয়ে দিয়েছিল। আমি কুণালের ভালোবাসাকে প্রত্যাখ্যান করে রাজীবের হাত ধরেছিলাম। কুণাল বেশ ভেঙে পড়লেও আমায় কিছু বলেনি। জানি ও এখনও বিয়ে করেনি। এও জানি এখন ও চেম্বুরে কোনও এক ন্যাশনালাইজড ব্যাংকের অফিসার। প্লিজ ওর সাথে যোগাযোগ কোরো, বলো বিয়ে করতে। কেন বলছি জানি না, তবু একদিন আমি ওকে ভালোবাসতাম, ও হয়তো আজও বাসে। আমায় ভুলে যেতে বোলো। প্লিজ শুধুমাত্র একসময়ে বন্ধুত্বের দাবিতে তোমায় হয়তো বিরক্ত করলাম। ভালো থেকো। আমি কেমন আছি জানতে চেও না।’

অফিসে কাজ করা মাথায় উঠল। হাফ-ডে করে বেরিয়ে পড়লাম কুণালের খোঁজে। অফিস টেলিফোন ডাইরেক্টরি ঘেঁটেই কুণালের খোঁজ পাওয়া গেল। কিন্তু দুজনে মুখোমুখি হতে আরও চার-পাঁচদিন কেটে গেল। ফোনে আমি কোকিলার কথা সেভাবে কিছুই জানাইনি। শুধু বলেছিলাম, ওকে চিনি। কুণালকে কোকিলার চিঠির কথা বলতে কুণাল চুপচাপ শুনল, যখন চিঠিটা ওর হাতে দিতে গেলাম নিল না। অদ্ভুত স্থির হয়ে বলল ‘চিঠিটার কোনও মূল্য আর নেই বোধহয়, গতকাল রাতে কোকিলা সবকিছুর ঊর্দ্ধে চলে গেছে। আমি চমকে প্রায় চিৎকার করে উঠলাম ‘কি! তুমি কি করে জানলে? কে খবর দিল? কি হয়েছিল?’ কুণাল ধীর গলায় বলল, ‘বিজয় চেম্বুরে এসেছে, ওর মাসির বাড়ি এখানেই। কাকতালীয়ভাবে আমিও সেই বাড়িতে পেয়িংগেস্ট থাকি।’

কোনও কথা না বলে আমি ফিরে এলাম নিজের ঘরে। এক অদ্ভুত ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়লাম না খেয়েই। পরের দিন যথারীতি অফিস। পৌঁছোতেই আবার এক চমক। চিঠি। হাতের লেখা দেখেই বুঝলাম, কোকিলা। যে-মানুষটার চিঠি আমার হাতে, সে যে পৃথিবীতে নেই, ভাবতেই কেমন যেন এক বিদ্যুৎ খেলে গেল শরীরে। চিঠিটা হাতে নিয়ে নিজের টেবিলে এসে অনেকক্ষণ চুপ করে তাকিয়ে বসে রইলাম, সামনে কোকিলার চিঠি। চিঠিটা খুললাম, এক সুন্দর গন্ধের ছোঁওয়া চিঠির পাতায়। একইরকম ভাবে সম্বোধনহীন চিঠি।

‘কী হল, কুণালের সাথে দেখা হল? তোমার চিঠির অপেক্ষায়।’

—- কোকিলা

পুনশ্চঃ  তোমায় বলা হয়নি, আমি আর ভালো নেই। হাসপাতালে রয়েছি। এইচআইভি পজিটিভ। তাড়াতাড়ি যোগাযোগ কোরো। মনে হয় তুমি দেরি করে এলে, তোমারও মনে হবে বড়ো দেরি হয়ে গেলো।

আমি ও কোকিলা পর্ব ০১

কুনালের পক্ষে সম্ভবই নয় প্রভূত পরিমাণে টাকা কিংবা গাড়ির স্বপ্ন দেখা। আর রাজীব, দিল্লিতে নিজের বাড়ি-ব্যাবসা— সব মিলিয়ে সফল পুরুষ। এক মুহূর্ত সময় নেয়নি কোকিলা এতদিনের ভালোবাসাকে দূরে ঠেলে রাজীবের হাত ধরতে।

কোকিলার মৃত্যুসংবাদ আমায় বিচলিত করেনি। আমি জানতাম এমনটাই হবে— ধীরে ধীরে। জীবন যন্ত্রণা ওকে কুরে কুরে খাবে, এক পা এক পা করে ও এগোবেই মৃত্যুর দিকে। আমি হতবাক হয়ে ভাবছিলাম ওর সাথে পরিচয়, সুখস্মৃতির কথা।

কোকিলা আমার কেউ নয়, এমনকী বন্ধুও নয়। ওকে চিনেছি অন্যভাবে সৌজন্যবশতঃ। কাজের সূত্রে অল্প কিছুদিনের জন্য দিল্লি থাকতে হয়েছিল। সেখানেই আলাপ রাজীবের সাথে। রাজীব ধূত। পেশায় ব্যবসায়ী। ঘরের খোঁজ তার কাছেই পাই। তারই বাড়ির চিলেকোঠায়। এককামরা হলেও আমার অসুবিধা নেই। আমার অফিস এখান থেকে খুব বেশি দূর নয়। আর জায়গাটাও বেশ ভাল। বেশ ছিমছাম। রাজীব একা থাকে, স্ত্রী থাকলেও এক সপ্তাহেও তাকে দেখার সুযোগ আমার হয়নি।

সুযোগ এল, তা অন্যভাবে। একদিন অফিস থেকে বেরতে গিয়ে শুনি, ‘বন্ধ’। আরে হলটা কি? এই তো দুপুরে নীচে এসেছিলাম। গেটের সিকিউরিটি খবর দিল, ‘সাব দো আদমি মর গয়ে। দুকান সব বন্ধ হো গিয়া তিন বজে।’ বেশ দুশ্চিন্তা হল। বুঝলাম সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় হঠাৎ সব দোকানপাট বন্ধ। আমার তো মাথায় হাত। রোজ ভুজবল (ওড়িয়া ছেলে) আমার দিনের রাতের-খাবার দিয়ে যায়। শুনশান রাস্তা দিয়ে বেশ সন্ত্রস্তভাবে হেঁটে বাড়ি এলাম। একটু ঘুরে ভুজবলের দরজায় টোকা মারলে খানিকবাদে চিৎকার করে উত্তর এল, ‘খাবার পাওয়া যাবে না। দুপুর থেকে সব বন্ধ।’ আমি দরজা খোলার কথা বললেও কেউ খুলল না। অগত্যা বাড়ি এসে বিস্কুট-মুড়ি-চানাচুর, দারুণ ডিনার। ঢকঢক করে জল খেয়ে সটান বিছানায়। অন্যান্য দিন একটু টিভি দেখি আজ ভুজবলের উপর রাগে আমার সব গোলমাল হয়ে গেল।

ঘুম ভাঙল বেশ ভোরবেলায়। এত সকালে আমি উঠি না। গ্যাসে চা বানিয়ে লনে একটু বসেছি হঠাৎ রাজীব। ও যে প্রাতর্ভ্রমণ করে আমি জানতাম না। সুপ্রভাত জানিয়ে পাশে বসে পড়ল। ও বেশ অবাক হয়ে জানতে চাইল ‘এত সকাল সকাল কি ব্যাপার! আমি এড়িয়ে যেতে চাইলেও বলতে বাধ্য হলাম, ‘কার্ফিউয়ের জন্য ভুজবল ডুব মেরেছে।’ রাজীব মনে হল একটু লজ্জিত হল। একথা-সেকথার পর একটু ব্যায়াম করে চলে গেল। হঠাৎ কী মনে করে ঘুরে সিঁড়ির মুখে গিয়ে বলল, ‘আমাদের সাথে সকালের নাস্তাটা করে যেও।’ রাজীব মাঝেমধ্যে বাংলা বলার চেষ্টা করে। আজ ও পুরো বাংলায় কথা বলল।

আমি দ্বিরুক্তি না করে, রেডি হয়ে সকাল ন’টায় হাজির হলাম নীচে। রাজীবই দরজা খুলে দিল। খাবার টেবিলে আলাপ হল রাজীবের স্ত্রী কোকিলার সাথে। প্রথম দেখায় কেমন যেন ম্লান মনে হল, হাসলও ফ্যাকাসে ভাবে। দু’দিন আমায় ওদের সাথে জলখাবার খেতে হয়েছিল। কোকিলা খাবার টেবিলে বড়োই চুপচাপ। আমি আর রাজীবই যা কথা বলি। তবে রাজীব ঝড়ের মতো, খেয়েই বেরিয়ে যায় নতুবা বেশি সময় মোবাইলে কথা বলে। আমি মাঝেমধ্যে কোকিলার দিকে তাকাই। নীরব চোখে। মনে কত জিজ্ঞাসা কিন্তু রাজীব নিজের স্ত্রী-র ব্যাপারে উদাসীন না সতর্ক, তা বুঝতে পারিনি। কথা বলতেই দেয় না। ঠিক এড়িয়ে চলে, যাতে কোকিলা নাস্তার টেবিলে কথোপকথনে যোগ না দিতে পারে। তিনদিনের দিন থেকে দিল্লির রাস্তাঘাট স্বাভাবিক, ভুজবলও স্বাভাবিক।

দিন কাটছে নিজের ছন্দে। রাজীব বা কোকিলার কারুর সাথেই দেখা হয় না। একদিন বেশ সকালে দরজায় খুটখুট। ভাবলাম রাজীব। ঘুম চোখে দরজা খুলতেই চমকে ঘুম পালাল, কোকিলা। পাশ কাটিয়ে কোকিলা ঘরে ঢুকে পড়ল। বিছানায় বসেই বলে উঠল, ‘কানপুর থেকে আমার ভাই আসবে কাল সকালে, ও আপনার সাথেই থাকবে।’ একটু থেমে একটু নরম স্বরে আবার বলল, ‘আশা রাখি আপনার কোনও অসুবিধা হবে না।’ মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল, ‘কিন্তু কেন? আপনাদের নীচে তো ঘরের অভাব নেই। আমার একটা মাত্র ঘর সেখানে দু’জন!’

‘আপনার সঙ্গ আমার ভাইয়ের ভালো লাগবে।’

‘কিন্তু রাজীব যদি কিছু বলে বা মনে করে?’

‘রাজীবের কিছুই আসে যায় না আমার ভাইয়ের ব্যাপারে” অদ্ভুত ঠান্ডা নিরাশ স্বর ভেসে এল কোকিলার গলা থেকে।

একেবারে টিনএজার কোকিলার ভাই। মাত্র তিনদিনের সফরে দিদি-জামাইবাবুর কাছে এসেছে। অফিসের কাজ ম্যানেজ করে কোকিলার অনুরোধে ভাই বিজয়কে নিয়ে বের হতে হল দিল্লি ঘোরাতে। অবশ্য এজন্য কোকিলা রোজ পাঠিয়েছে ভালো-মন্দ খাবার। বেশ অবাক লেগেছিল যখন বিজয়ের খাবারও আমার ঘরে পাঠিয়ে দিচ্ছিল কোকিলা। প্রশ্ন মনে উঁকিঝুঁকি দিলেও আমি নীরব। রাজীবকে একদিনও আমার ঘরে আসতে দেখলাম না শালাবাবুর জন্য। বিজয় চলে যেতে বেশ ফাঁকা ফাঁকা লাগছিল। আবার ভুজবলের লম্বা কৌটোর খাবার, ঠিক যেন মুখে লাগছিল না। এ ব্যাপারে কোকিলার মুখটা বার বার ভেসে উঠছিল। দু’তিন দিন বাদে সব যখন ঠিকঠাক হয়ে গেল, রাজীব একদিন আমায় এসে ধন্যবাদ জানিয়ে গেল বিজয়ের জন্য। আমি এতটা সময় দিয়েছি বলে। আমি কেমন যেন বিস্মিত হলাম। হেসে চুপচাপ রইলাম। তবু মনের মধ্যে খচখচানি গেল না। বড়ো বাড়ি, এত ঘর তবু বিজয়কে থাকতে হল আমারই সাথে। এটা কোনওভাবে মেনে নিলেও, দিদির সাথে ভাইয়ের না খাওয়া আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলাম না। মনে পড়ে যাচ্ছিল আমার দিদির বাড়ি গেলে দিদির আদর। ভাগ্না-ভাগ্নিরাও দিদির সাথে তাল মেলায়, আর জামাইবাবু তো পারলে সেদিন ওকালতি করতে যান না।

আমার সব প্রশ্নের সমাধান হল সেদিনই রাত্রে। সিঁড়ির সামনে কোকিলার মুখোমুখি হলাম। আমি কিছু জিজ্ঞাসা করার আগেই বলে উঠল, ‘অনেক প্রশ্ন আপনার মনে, অনেক কৌতূহল, আমি জানি। আপনাকে ধন্যবাদ দিয়ে ছোটো করছি না। আমি চাইনি আমার ভাই দু’দিনের জন্য আমার কাছে বেড়াতে এসে দিদি-জামাইবাবুর রোজনামচা জেনে যাক। আজ সকালে ও দিল্লির বাইরে গেছে, ব্যাবসার জন্য। প্রতিমাসেই ওর যাওয়া থাকে। ওপরে আপনার ঘরে চলুন অনেক কথা আছে।’ তাকিয়ে দেখি কোকিলার চোখে জলঃ আমি নির্বাক। বুঝলাম মেয়েটি আরও কিছু বলতে চায়। সে নিজের মনেই বলে চলল, ‘আমি নিজেই নিজের পায়ে কুড়ুল মেরেছি। বাবা-মা কেউ চায়নি আমি রাজীবকে বিয়ে করি। আমারই এক কলেজ-বন্ধু রাজীবের সাথে আলাপ করিয়ে দেয়। রাজীব নাকি ব্যাবসা করে দিল্লিতে এবং রাজীবও আগ্রহী আমার প্রতি। ওকে দেখে আমি প্রায় পাগল। মা-বাবার অমতে, পড়াশোনা শেষ না করেই ওকে বিয়ে করি। কুনাল, আমার কলেজ-বন্ধু। সে ছিল রাজীবের সম্পর্কতুতো ভাই। সেও বলেছিল, ‘গ্রাজুয়েশনটা কমপ্লিট কর।’ আমি সবার বিপরীতে গিয়ে রাজীবকে বিয়ে করি। কেন জানি না আমার ছোটো থেকে স্বপ্ন ছিল, ধনী ঘরে আমার বিয়ে হবে। ছা-পোষা কেরানিকে বিয়ে করা আমার পোষাবে না। রাজীবের মা-বাবাকে জানানো হয়েছিল, ওনারা আসতে চাননি। আমার মা বাবা তখনই আপত্তি করেছিল কিন্তু আমার অন্ধ প্রেম সব ফুৎকারে উড়িয়ে দিল। রাজীবের অদ্ভুত তাকানো, কথা বলা, স্বপ্ন রচনা, ভালোবাসার খুঁটিনাটি সব… সব আমায় ভাসিয়ে নিয়ে গেল এক স্বর্গরাজ্যে। ও বলেছিল হনিমুনে যাবে সিঙ্গাপুরে। কিন্তু বিয়ের পর কাজের চাপের জন্য সব ক্যানসেল। মেনে নিয়েছিলাম স্বাভাবিক কারণেই। ব্যবসাদার মানুষজনদের কাজের ধারাটাই এরকম। সে যাইহোক, এও বলেছিল বিয়ের পর দিল্লিতে একটা গ্রান্ড পার্টি দেবে। কোথায় কি? রাজীবের বাড়ির লোকজন আমায় ভালো করে অভ্যর্থনাটুকুও জানায়নি। তিন চারদিন ওর মা-বাবার সাথে থাকার পরই চলে গেলাম ভাড়ার বাড়িতে।’

সন্দেহ

(১ )

এই শনিবার পঞ্চানন পুজো। রাঘবের মনে ছিল না। যথারীতি সকালে উঠে লাল চা আর বিস্কুট, তারপর গরুর দেখভাল। দুটো গাই গরু আছে। এবেলা ওবেলা ভালোই দুধ দেয়। কিন্তু রাঘবের আফশোস বাড়ির কেউ দুধ খায় না, আর রাঘব নিজে দুধ বিক্রির বিরুদ্ধে। রাঘব রাতে দুধভাত আর দিনে দইভাত পছন্দ করে।

বড়ো মেয়ে বিয়ে হয়ে গেছে, সুতরাং সংসারে সাকুল্যে তিনজন। ছোটো মেয়ে বউ আর সে। শুক্রবার রাত্রে ছোটো মেয়ে জন্মদিন ছিল। লুচি করেছিল কৃষ্ণা। পাশাপাশি খুড়তুতো, জ্যাঠতুতো ভাইয়ের ছেলেমেয়েরা আমন্ত্রিত। রাঘবের অফিসে আবার সেদিন ছিল ইয়ার এন্ডিং। দুপুরে মাংস ভাত সাঁটিয়ে রাতে আর লুচি খেতে ইচ্ছে হয়নি। কিন্তু লুচি রেখে দিয়েছে তার গিন্নি কৃষ্ণা।

ছোটো মেয়ে ইতু হঠাৎ বলে উঠল বাবা তুমি বাসি লুচি খাচ্ছ! আজ তো শনিবার। বটতলায় শিবের থানে যাবে না? দেড়খানা লুচি খেয়েছিল রাঘব, তিড়িং করে লাফিয়ে উঠে বলল ওরে বাবা কি পাপ করলাম…রে! অর্ধভুক্ত লুচি আর হাফ কাপ চা পড়ে রইল। আর সেদিনই দুর্ঘটনা ঘটল।

পুজো ছিল কদমগাছি রায়নাপুরে। বরাবর সে এটা করে। সবই নির্বিঘ্নে হল। কেবল ধ্যান করার সময় বাসি লুচির ঢেকুর। কেমন অম্বল অম্বল! মাথাটা চোঁ করে ঘুরে গেল রাঘবের। শুক্রবার মাংস, শনিবার বাসি লুচি। বটতলা থেকে রাঘব ফিরছিল, গায়ে নামাবলি।

দু-পাশে গাছ। পঞ্চায়ে লাগিয়েছে। পিচ ঢালা রাস্তা। মোরাম বদলে পিচ। সোনাঝুরি গাছের ছায়া। মনোরম লাগে রাঘবের। ছোটোবেলা থেকে বড়ো হয়েছে এই অঞ্চলে। আগে একটু নেশা করত রাঘব। এখন সেই সব বালাই নেই। ছেলেমেয়ে বড়ো হয়েছে। পুজোআচ্চা বেড়েছে। রাঘব নিজে এখন অভয়গিরি আশ্রমের ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য। হঠাৎ প্রস্রাবের বেগ। আজকাল মাঝে মাঝেই আকস্মিক বেগ চলে আসছে।

সোনাঝুরির গাছের পাশে চওড়া ড্রেন। সাইকেল থামিয়ে রাঘব বসে পড়ল। কানে পইতে। কিন্তু দু-এক ফোঁটা প্রস্রাব হওয়ার পরেই রাঘবের মাথা ঘুরে গেল। সটান ড্রেনে একেবারে মুখ গুঁজে পড়ল। কতক্ষণ যে সে ড্রেনে ছিল, তার নিজের খেয়াল নেই। অজ্ঞান রাঘব। যখন জ্ঞান ফিরল, সে তখন স্বাস্থ্য কেন্দ্রের বেডে। ডাক্তার বললেন সব গ্যাস থেকে হয়েছে। হাতে কোনও চোট নেই, মাথায় আঘাত নেই। কিন্তু সোজা হয়ে দাঁড়াতে গেলে কোমরে লাগছে।

চিত্তরঞ্জন থেকে বড়দা এসে উপস্থিত। বাড়ির বেশির ভাগ সদস্য ছড়িয়ে বড়ো বাড়ি, বেশিরভাগ ঘর তালা বন্ধ। একমাত্র দোল উত্সবে সবাই একসঙ্গে। তখন সাতদিন ধরে বাড়ি থাকে জমজমাট। রাধাকৃষ্ণের অষ্টমঙ্গলা পর্ব সমাপ্ত করে আবার সবাই কর্মস্থলে ফিরে যায়। অঢেল ভোগের এলাহি বন্দোবস্ত। লুচি ছোলার ডাল, তিন-চাররকম সবজি দিয়ে তরকারি, পায়ে। পাত পেতে সবাই মিলে ঘরে একসঙ্গে। বাড়ি ছেড়ে সবাই চলে যাবার পর রাঘব কদিন ঝিম হয়ে বসে থাকে। নীলাচল, রাঘবের বড়দা এসে এবারে খুব হম্বিতম্বি করল। তার ধারণা রাঘব নেশা করে, রাঘব যত বলে সে নেশা থেকে শত হস্ত দূরে, নীলাচলের বিশ্বাস হয় না। বাড়ির পেছনেই তাল গাছ।

—তুই নিশ্চয়ই তালের রস খাস! নীলাচল বলল।

—বিশ্বাস করো দাদা রাঘব গলায় মিনতির সুর।

—তাহলে তাল গাছের মাথায় হাঁড়ি কেন? দড়ির মই কেন?

পরদিনই হাঁড়ি নামানো হল। দড়ির মই কেটে ফেলা হল। নীলাচলও নিশ্চিন্ত হয়ে ফিরে গেল। ইচ্ছে করে রাঘবের মাঝে মাঝে তালের রস খেতে। কিন্তু গোপালপুরের চট্টোপাধ্যায় পরিবার কেউ নেশাভাং করে না।

কোমরের ব্যথা রাঘবের কিছুতেই নিরাময় হচ্ছে না। ডাক্তারের পরামর্শে কোমরে বেল্ট, প্রতিদিন ব্যায়াম। রাঘবের বড়ো মেয়ে রানীগঞ্জে থাকে। জামাই গৌতম থানার সেকেন্ড অফিসার। বাড়ি বৈদ্যবাটি। চতুর ছেলে। নিজেই রাঘবকে বলে, বাবা মাইনেতে হাত দিতে হয় না। পকেট ভর্তি টাকা গৌতমের। গৌতমই সন্ধান নিয়ে এল, নিয়ামত্পুরের অদূরে একজন সাধিকা আছেন, তিনি ওষুধ দেন।

রাঘবের এক বছর চাকরি আছে। ছোটো মেয়ে ইতু এবার মাধ্যমিকে বসেছে। মনে উদ্বেগ সবসময় কাজ করে রাঘবের। যদি তার কিছু হয়ে যায়। মেয়েটার কি হবে! ড্রেনের ভেতর মুখ থুবড়ে পড়ে থাকা অবস্থায় নাকে এসেছিল প্রস্রাবের গন্ধ। সেই গন্ধটা আর দূর হচ্ছে না। আর ওই গন্ধটা নাকে এলেই উদ্বেগ। বউ কৃষ্ণাকে বলেছে রাঘব। কৃষ্ণা খুব একটা পাত্তা দেয়নি। বলেছে ও তোমার মনের ভুল। এর জন্য রাঘবকে নিয়ামত্পুরের সাধিকার কাছে জোর করে নিয়ে এল জামাই গৌতম।

বাংলা বিহার সীমান্ত ঘেঁষা এক শ্মশানে সাধিকার আশ্রম দেখে রাঘবের চোখ ছানাবড়া। অত্যন্ত রূপসী। মাথায় জটা, একটি মধ্যত্রিশের মেয়ে গৌতমের সঙ্গে কী সব ইশারায় কথা হল। রাঘবের মোটেও পছন্দ হল না। গৌতম ও সাধিকা এমন ভাবে কথা বলছিল যেন দুজন প্রেমিক-প্রেমিকা। লোকজন বিশেষ নেই। বিশাল একটা অশ্বত্থ গাছ। অদূরে একটা মরা পুড়ছে। পাশে একটি সরু খাল। সামান্য জল। সেই জলে একটা লোক মুখ ধুচ্ছে। সন্ধে হয়ে আসছে। চারধারটা নির্জন।

জামাই গৌতমের স্কুটারে চেপে রাঘব এসেছে। তার আসার এতটুকু ইচ্ছে ছিল না। বড়ো মেয়ে জোর করে পাঠিয়েছে। বড়ো মেয়ে বিশ্বাস এই সাধিকার ওষুধ খেলে তার বাবা ভালো হয়ে যাবে। স্কুটারে ফেরার পথে রাঘব গৌতমের শরীর থেকে মদের গন্ধ পেল। রাঘবের কোমরে ব্যথাটা আজ যেন একটু বেশি। মাঝে মাঝে ভেতরে ভেতরে কেঁপে যাচ্ছিল রাঘব। ওষুধ খেতে হবে। রাঘবের মনে হচ্ছে স্রেফ বুজরুকি। সাধিকা ও গৌতমের নিভু আঁচে পারস্পরিক ইশারা ইঙ্গিত! ভাবতেই রাঘবের ব্যথা উঠে এল ঠিক শিরদাঁড়ার নীচে। কোমরের ডান দিকে।

রিতু, রাঘবের বড়ো মেয়ে বলল, বাবা কেমন বুঝলে? খুব ভালো সাধিকা তাই না!

রাঘব বিহ্বল। কেমন যেন ঘোর!

—ওষুধ দিয়েছে বাবা? নিয়ম করে কিন্তু খেতে হবে তোমাকে।

রাঘবের তখন বলতে ইচ্ছে হল রিতুকে, যেন গৌতম ওখানে আর না যায়! কিন্তু সবেমাত্র পেটে বাচ্চা এসেছে রিতুর। আগের বাচ্চাটা নষ্ট প্রসব। এই সময়ে এসব কথা বলা কি ঠিক!

রাঘবের চোখ বন্ধ। নাকে আসছে আশ্রমের ধূপের গন্ধ। রাঘবের কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। কাল ভোরেই চলে যেতে হবে। রাঘবের ফাটিকা গ্রাম। দেবখালের পাশে। দেবখাল বেশ বড়ো। খালের দুপাশে বাঁশের ঝাড়। খসেপড়া বাঁশের বাকল। হলদে ছায়া। নিরিবিলি। দুপুরের তাপ কেমন শান্ত! বাঁশ তলিতে গভীর ঘুঘু পাখির ডাক। নুয়ে পড়া বেতের লতা। একটা দুটো ফিঙ্গে পাখি। দেবখালের চারপাশে কৃষিজমি। বর্ষায় জল উপচে পড়ে। পচিয়ে দেয় জমির ধান। খালের জলের নীচে দলঘাসা শৈবাল। নলখাগড়া। দেবখালের সঙ্গে বিষহরি খাল মিশেছে।

( ২ )

বছর ঘুরে আবার পঞ্চানন পুজো। রাঘব নিবিষ্ট! কতক্ষণ বসে আছে রাঘব, কোনও খেয়াল নেই, চারদিকে প্রচুর মানুষ। রাঘবের স্পষ্ট মন্ত্র উচ্চারণ। রাঘবের কোমরের ব্যথা শিরশির করছে। ব্যথার অনুভতি মেরুদন্ড বেয়ে ক্রমশ উঠছে।

শেষদিকে রাঘবের চোখে সবকিছু ঝাপসা লাগছে। কেমন যেন ছায়া ছায়া একটা আচ্ছন্ন ভাব। কিন্তু অর্চনা তো শেষ করতে হবে! এটা চার-পাঁচটা গ্রামের খুব ধুমধাম উত্সব। চোখ বন্ধ রাঘবের। কোথায় যেন পড়েছিল শ্রীপঞ্চানন (শিব) পরস্ত্রীর প্রতি আসক্তি পছন্দ করে না। রাঘবের তো নেই। তবে হঠাৎ এ কথা কেন মনে হল!

বাড়ি ফিরছিল রাঘব। গত বছর যেখানে তার দুর্ঘটনা হয়েছিল সেখানে রাঘব সাইকেল দাঁড় করল। কেউ কোথাও নেই। দুপুরের রোদ ঢেকে গেছে মেঘের আড়ালে। হঠাৎ কী যে মনে হল রাঘবের, একটা গাছের আড়ালে বসে নিজের পোঁটলা খুলে ফেলল। কৌতূহল, খিদে, একই সঙ্গে তার এখন। পোঁটলার মধ্যে কতরকম জিনিস। দেখে তো রাঘবের চোখ ছানাবড়া।

এক কুইন্টাল চাল, পাঁঠার মুড়ি, পাঁঠার পেছনের ঠ্যাং, তিন হাজার টাকা (পাঁচশো টাকার ছখানা কড়কড়ে নোট) তিন হাজার টাকার কয়ে। ওরে ব্বাস অস্ফুট কণ্ঠস্বর রাঘবের। সত্যি তো এত সব দিয়েছে তাকে! গত বছরে দেয়নি, তার আগের বছরও…! কিছু মনে নেই রাঘবের। কালে কালে কত হল। এতসব জিনিসপত্র নিয়ে সে কী করবে? তার বউ কৃষ্ণা, মেয়ে ইতু মাছ মাংস ছোঁয় না। রাঘবের ইচ্ছে করে খেতে।

পোঁটলার ভেতরে পোঁটলা। মাখা সন্দেশ, শসা, কলা, আপেল, আর নাড়ু। গুড়ের নাড়ু। পটপট কয়েটা নাড়ু খেয়ে নিল রাঘব। সঙ্গে বোতলের জল। পাশে পড়ে আছে ছাতা, দক্ষিণায় পাওয়া নতুন ধুতি। ক্রমশ অন্ধকার করে আসছে। তুমুল হাওয়া ও টিপটিপে বৃষ্টি। সকালের দিকেও মেঘ ঘন ছিল। মেঘের রং এত কালো যে বোঝাই যাচ্ছে না সময় কত! বাড়ি ফিরতেই তুমুল বৃষ্টি এল। আর তখনই তরল ছায়ার মতো শরীর নিয়ে কৃষ্ণা পাশে এসে দাঁড়াল।

—রিতুকে কেমন দেখলে? কৃষ্ণার প্রশ্ন শুনে রাঘব বলল ভালো।

—আর গৌতম কেমন আছে? কৃষ্ণার পরের প্রশ্ন শুনে রাঘব বলল এসব প্রশ্ন করছ কেন হঠাৎ!

—কৃষ্ণা কেঁদে উঠল। বৃষ্টির শব্দ ও কান্নার হেঁচকি মিলেমিশে একাকার।

—কাঁদছ কেন? রাঘবের স্বরে বিস্ময়।

—ওরা গৌতমের মুখে অ্যাসিড ছুড়েছে। কান্নাভেজা গলায় কৃষ্ণা জানাল।

—কারা? রাঘব জিজ্ঞেস করল।

—মুখটা ঝলসে গেছে গৌতমের। সে এখন হাসপাতালে ভর্তি।

—কে মেরেছে অ্যাসিড রাঘব প্রশ্ন করল?

—আমাকে ফোন করেছিল হাসপাতাল থেকে কৃষ্ণা বলল।

ফ্যাকাশে হয়ে গেল রাঘবের মুখ। কৃষ্ণাকে ধরে ঝাঁকাচ্ছে কে ছুড়েছে অ্যাসিড?

ভোরবেলায় রওনা হল রাঘব। আসানসোল। বড়ো হাসপাতাল। বেডের কাছে কেউ নেই। চোখে মুখে ব্যান্ডেজ। বাইরে দাঁড়িয়ে গৌতমের বন্ধুরা। এদের মধ্যে অনেকেই পরিচিত রাঘবের। পলাশ গাছের নীচে রাঘবকে দেখে সবাই কেমন চুপ। রাঘব খুব নীচুস্বরে জিজ্ঞাসা করল, কে ছুড়েছে অ্যাসিড ওর মুখে? রাঘবের চোয়াল তখন শক্ত। কেউ বলতে চাইছে না। সবাই নিশ্চুপ।

বন্ধুদের মধ্যে একজন শুধু রাঘবকে ইশারায় পাশে ডেকে নিয়ে বলল, মেসোমশাই আমরা সামলে নিচ্ছি। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন, গৌতম প্রাণে বেঁচে যাবে। শুধু মুখটা একটু খারাপ হয়ে গেছে। এ সব ঘরের সমস্যা… সন্দেহ। চা খাবেন মেসোমশাই?

চায়ে দোকানে পাতা বেঞ্চিতে থপ করে বসে পড়ল রাঘব। কোমরের ব্যথাটা একেবারে মাথার পেছন বরাবর উঠে এসেছে। এভাবেও হয়! রিতু সন্দেহের বশে এই কাজটা করতে পারল? সন্দেহ তো তারও প্রথম থেকে হয়েছিল। তা বলে… বলে…!

পড়ার জন্য সীমাহীন গল্প-নিবন্ধসাবস্ক্রাইব