ডেমো (পর্ব ৫)

স্কুলে থাকতেই শ্বেতার সঙ্গে ভাব হয়েছিল নিলয়ের। নিলয়ের বাবা আর্মিতে ব্রিগেডিয়ার। ওনার চাকরিতে ট্রান্সফার লেগেই থাকত। কাজেই জম্মু, পাঠানকোট, ঝাঁসি, ইটানগর ঘুরে এসে দিল্লির দ্বারকাতে সেন্ট্রাল স্কুলে ভর্তি হয়েছিল নিলয় বারো ক্লাসের পরীক্ষাটা দিতে। নিলয়ের সায়েন্স, শ্বেতার আর্টস, তবু ওদের মধ্যে বন্ধুত্ব হয়ে গেল উচ্চ-মাধ্যমিক পরীক্ষায় বসার আগেই। কিন্তু শ্বেতার তো উইমেনস কলেজ, ছেলেরা ওখানে ভর্তি হতে পারে না। ওদিকে শ্বেতা কো-এডুকেশন কলেজে ভর্তি হতে গেলে প্রমিলা যে বদ্ধ উন্মাদ হয়ে যাবেন না তার নিশ্চয়তা কী?

প্রমিলা যখন ঠাকুরের আসনের সামনে জপ করতে বসেন শ্বেতা তখন ছাতে উঠে ফোনে কথা বলে নিলয়ের সঙ্গে। নিলয়কে বাড়িতে নিয়ে আসার সাহস হয়নি এখনও শ্বেতার কিন্তু মার জীবনের অন্ধকার অধ্যায়টি এবং ওঁর ওসিডি-সহ নানারকম খ্যাপামি সবিস্তারেই নিলয়কে জানিয়েছে শ্বেতা। কলেজ যাওয়া শুরু করার পর থেকেই ওর মা যে আবার রাতে মাথায় জল ঢালতে শুরু করেছেন সেটাও নিলয়কে জানিয়েছে শ্বেতা।

—তুমি রাজি থাকলে তোমার বাড়ি এসে তোমার মার সঙ্গে কথা বলতে পারি আমি, নিলয় বলল শ্বেতাকে ফোনে একদিন সন্ধের দিকে। -একদম নয়! মা তোমাকে রেপিস্ট ভেবে যে ঠ্যাঙাতে শুরু করবেন না বা গায়ে গরম জল ঢেলে দেবেন না তার কোনও সিওরিটি নেই। —কিন্তু ওনার তো ঠান্ডা লেগে আবার নিউমোনিয়া হয়ে যাবে!

—হাসপাতালে কয়েকদিন পড়ে থাকলে যদি এই পাগলামি বন্ধ হয়ে যায় তবে আমি বেঁচে যাই।

—না না, সেটা ঠিক হবে না। যে কারণে উনি এসব করছেন সেটা তো আমরা জানি। ওনার মনে তোমার সম্পর্কে যে ভয়টা সব সময় কাজ করে সেটাকে দূর করতে পারলে হয়তো….

—সেটা সহজ কাজ নয় নিলয়। ফর হার, এভরি মেল ইন দিল্লি ইজ আ পোটেনশিয়াল রেপিস্ট। এই মাইন্ডসেট কী করে পালটাবে তুমি? -তোমার হয়তো ক্যারাটে কিংবা বক্সিং শেখা উচিত ছিল।

—মার চাপে পড়ে সে চেষ্টা যে একেবারেই করিনি তা নয়। দু’বছর স্কুলের পর পাড়ার মাঠে একজন মহিলা ব্ল্যাকবেল্টের কোচিং-এ হাত পা ছুড়েছি আমি। কিন্তু আমাদের হাত পা ছোড়া দেখতে যখন পাড়ার ছেলেরা মাঠের পাশে ভিড় করতে লাগল, তখন মা আমাকে উইথড্র করে নিলেন। কলেজে বক্সিং বা রেসলিং শেখার সুযোগ নেই, নইলে মাকে আশ্বস্ত করার জন্য ওগুলোও ট্রাই করতাম।

ওরা দু’জনেই হাসল। সিঁড়িতে মা-র গলার আওয়াজ পেয়ে এখন ছাড়ছি, পরে কথা বলব বলে শ্বেতা মোবাইল সুইচ অফ করে সিঁড়ির দিকে এগোল।

সে রাতে শুতে যাবার আগে শ্বেতা মাকে বলল, “আমাকে তো তুমি ঘর থেকে বেরোতে দেবে না আর কলেজে পড়াশোনা না করলে আমি চাকরিও পাব না। এই মাঝরাতে চান করে করে নিউমোনিয়া বাঁধিয়ে মরবার আগে তুমি বরঞ্চ আমার বিয়েটা দিয়ে দাও মা।’ প্রমিলা অবাক হয়ে মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, “এ কী বলছিস তুই? তুই তো এখনও কুড়িতে পা দিসনি!”

—তাতে কী হয়েছে? শক্ত সমর্থ কোনও জোয়ান পুরুষের হাতে আমাকে তুলে দিতে পারলে তুমি নিশ্চিন্ত হয়ে মরতে পারবে। —না না তা হয় না। পড়াশোনা করে চাকরি করে তবে বিয়ে করবি তুই। আজকাল ছেলেদের কোনও ভরসা নেই, কথায় কথায় ডিভোর্স হয়ে যায়।

—তোমাদের সময়ই-বা ছেলেদের কী ভরসা ছিল মা? তোমার বরও তো তোমাকে ছেড়ে দিল মাঝ রাস্তায়।

—ওটা অন্য ব্যাপার। আমার কপালে যা ঘটল তারপর কোন ছেলে সাহস পেত আমাকে নিয়ে ঘর করতে বল? তবুও তো প্রতীক দূরে থেকেও স্বামীর কর্তব্য অনেকটাই পালন করে যাচ্ছে।

—ছাই করছে! মাঝখান থেকে আমার জীবনটা তোমরা দু’জনে মিলে নষ্ট করে দিলে। শ্বেতা মুখ গোমড়া করে পাশ ফিরে শুয়ে পড়ল। কিছুক্ষণ পর, ঘুমিয়ে পড়ার একটু আগে শ্বেতা অনুভব করল প্রমিলা ওর মাথায় পিঠে আস্তে আস্তে হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। শ্বেতার চোখে জল এসে গিয়েছিল কিন্তু ও চোখ মুছবার কোনও চেষ্টা করল না।

সে রাতে প্রমিলা মাঝরাতে উঠে স্নান করতে গেলেন না।

(চলবে)

ডেমো (পর্ব ৪)

মাঝরাতে উঠে মাকে বালতি বালতি জল ঢেলে প্রথমবার স্নান করতে দেখেছিল শ্বেতা পাঁচ বছর বয়সে। কখনও কখনও দিনে তিনবারও স্নান করতেন প্রমিলা। শ্বেতা জিজ্ঞেস করলে উনি বলতেন, “ওঁর গায়ে অনেক নোংরা লেগে আছে, ওঁর গা থেকে দুর্গন্ধ বেরুচ্ছে, তাই ওঁকে বারবার স্নান করতে হচ্ছে।’

শ্বেতা একবার ওর মার গা শুঁকে বলেছিল, ‘কই মা তোমার গায়ে তো কোনও খারাপ গন্ধ নেই।’ —আছে, তোর নাক এখনও তৈরি হয়নি, আরেকটু বড়ো হ তখন পাবি।

কিন্তু শ্বেতা বড়ো হয়েও মার গায়ে কোনওদিন দুর্গন্ধ পায়নি। শেষে দু’দুবার নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে হাসপাতাল ঘুরে এসে প্রমিলার নৈশ স্নানের বাতিকটা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। ক্লাস এইটে উঠে শ্বেতা রজস্বলা হলে প্রমিলা মেয়েকে একরাতে সংক্ষেপে প্রতীকের সঙ্গে কী কারণে ওর ছাড়াছাড়ি হল কিংবা পুরোপুরি ছাড়াছাড়ি হল না সেটা জানিয়ে দিয়েছিলেন।

ওর বাবা যে কাপুরুষ, লোকনিন্দার ভয়েই মাকে ত্যাগ করেছেন— এটা শ্বেতার মনে গভীর দাগ কেটে গিয়েছিল। যদিও প্রমিলা ব্যাপারটা একরকম মেনেই নিয়েছিলেন।

প্রমিলা শ্বশুরবাড়িতে থাকলে ওঁর ননদের বিয়ে দেওয়া সম্ভব হবে না— এই ছেঁদো যুক্তিটা যে প্রতীক মেনে নিয়েছিলেন, সেজন্য শ্বেতা ওর বাবাকে কোনওদিন ক্ষমা করতে পারবে না। তাই পুরো ব্যাপারটা মার কাছ থেকে শোনার পর প্রতীক ওর মার সঙ্গে দেখা করতে এলে শ্বেতা অন্য ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে চুপচাপ বসে থাকত। ওর বাবা অনেক ডাকাডাকি করলেও ও বাবার সামনে আসত না।

প্রমিলা ওকে বোঝাবার চেষ্টা করতেন যে প্রতীক ওকে ডিভোর্স দিলেও দ্বিতীয়বার যে উনি আর বিয়ে করেননি এবং ওদের খোরপোশ, এমনকী মেয়ের পড়াশোনার খরচ ঠিকভাবেই দিয়ে যাচ্ছেন এটাই বা কম কীসের?

এ নিয়ে মা-মেয়েতে কথা কাটাকাটি হয়েছে বেশ কয়েকবার কিন্তু শেষ পর্যন্ত প্রমিলা কান্নাকাটি শুরু করলে শ্বেতাকে চুপ করে যেতে হয়েছে। কিন্তু শ্বেতা কলেজে যাবে শোনার পর থেকেই প্রমিলা আবার তাঁর পুরোনো পাগলামি শুরু করলেন। কান্নাকাটি, চ্যাঁচামেচি এমনকী মেয়ের পায়ে পড়তে বাকি রাখলেন না প্রমিলা।

প্রতীক এসে ওকে এ ব্যাপারে বোঝাবার চেষ্টা করলেও প্রমিলা কিছুতেই মানতে রাজি হলেন না যে তার প্রাপ্তবয়স্ক এবং যথেষ্ট বুদ্ধিমতী মেয়ে শ্বেতা বাসে করে রোজ কলেজে যেতে আসতে পারে নিজেকে সুরক্ষিত রেখেই। তাই যেদিন থেকে শ্বেতা কলেজে যেতে শুরু করল সেদিন থেকেই প্রমিলার আবার নৈশ স্নান শুরু হয়ে গেল।

(চলবে)

ডেমো (পর্ব ৩)

গণধর্ষণের জন্য অভিযুক্ত গাড়ির ড্রাইভার কিষাণ লাল এবং ওই গাড়ির অন্য দুই আরোহী সুরেশ আর জ্ঞানচাঁদ তিন মাস পরে গ্রেফতার হয়েছিল। কিন্তু পুলিশ কোর্টে সাক্ষ্য প্রমাণ ঠিকমতো দাখিল করতে না পারায় ধর্ষণকারীরা মাত্র তিন বছর জেলে থাকার পর জামিন পেয়ে বেরিয়ে আসে।

ওদিকে কোর্টে কেস চলাকালীন বাবা-মা এবং আত্মীয় স্বজনের চাপে পড়ে লোকনিন্দার ভয়ে প্রতীক প্রমিলাকে ডিভোর্স দিতে একরকম বাধ্য হন। পশ্চিম দিল্লির বাঙালিপাড়া মহাবীর এনক্লেভে দু’কামরার ছোটো একটি ফ্ল্যাট কিনে সেখানে প্রমিলা এবং শ্বেতাকে স্থানান্তরিত করে দিয়ে স্বামীর দায়িত্ব পালন করেন প্রতীক। সেদিন থেকে মা-মেয়ের খোরপোশ বাবদ মাসে দশ হাজার টাকা প্রমিলার অ্যাকাউন্টে জমা করে যাচ্ছেন প্রতীক আর বাবা মাকে না জানিয়ে মাঝেমধ্যে এসে প্রাক্তন স্ত্রী এবং কন্যার সঙ্গে দেখা করে যান উনি। এই ঘটনার পর আগের স্কুলের চাকরি চলে গেলে প্রতীকের চেষ্টায় জনকপুরীর একটা প্রাইভেট স্কুলে জুনিয়র টিচারের চাকরি পেয়েছেন প্রমিলা।

শ্বেতাকে নিয়ে নতুন ভাবে যে-জীবন শুরু করলেন প্রমিলা তাতে কোনও আনন্দ ছিল না। পুরোনো বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়-স্বজন এবং পরিচিতরা এখন তাঁকে এড়িয়ে চলেন নয়তো এতটাই সমবেদনা দেখান যে প্রমিলা তা সহ্য করতে না পেরে ওদের থেকে দূরে সরে আসেন। যে-প্রমিলা একসময় কথা বলতে, আড্ডা মারতে ভালোবাসতেন তিনি এখন অপ্রয়োজনে মুখ খোলেন না। ওসিডি সনাক্ত হওয়ার পর প্রথমদিকে পুলিশের সহায়তায় কাউন্সেলরের শরণাপন্ন হয়েছিলেন প্রমিলা, পরে প্রতীকের অনুরোধে সাইকিয়াট্রিস্টের চেম্বারেও কয়েকবার ঘুরে এসেছেন উনি। ওঁরা সবাই প্রমিলাকে একই অ্যাডভাইস দিয়েছেন— ফরগেট ইওর পাস্ট অ্যান্ড স্টার্ট লাইফ অ্যাফ্রেশ। কিন্তু যে ঘটনা ওঁর পুরো জীবনটা তছনছ করে দিল প্রমিলা কী করে তাকে ভুলে যাবেন ?

ঘটনার পাঁচ বছর পরেও মাঝরাতে দুঃস্বপ্ন দেখে চিৎকার করে জেগে উঠেছেন। গা ঘিন ঘিন করা অসহ্য এক ক্লেদাক্ত অনুভূতি নিয়ে প্রমিলা ছুটে যেতেন বাথরুমে বালতি বালতি জল ঢেলে ওঁর অপবিত্র শরীরকে পবিত্র, নির্মল করবার দুরাশায়! কাউন্সেলিং-এর সময় ওর একবার মনে হয়েছিল সাইকিয়াট্রিস্টকে বলেন, ‘আপনাদের জীবনে এরকম ঘটনা কখনও ঘটেনি তাই আপনারা সবাই আমাকে অতীত ভুলে যাবার উপদেশ দিতে পারছেন।’

তবু শ্বেতা বড়ো হয়ে বাড়ির কাছের সরকারি স্কুলে যেতে শুরু করলে প্রমিলা মেয়ের কথা ভেবেই নিজের জীবনটা আবার গুছিয়ে নেবার চেষ্টা করেছিলেন। তবে মেয়েকে সন্ধ্যার আগে ঘরে ঢোকানোর ব্যাপারে উনি কোনও সমঝোতা করতে রাজি ছিলেন না। সন্ধের পরে বাইরে থাকার নিষেধ থাকায় স্কুলের বন্ধুদের জন্মদিনের নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে শ্বেতা মায়ের নির্দেশ মেনে দুপুরবেলাই গিফ্ট হাতে নিয়ে হাজির হয়ে যেত বন্ধুদের বাড়িতে। প্রথমদিকে অনেকে অবাক হলেও একসময় ওরা শ্বেতার মার সতর্ক, সন্দিগ্ধ ব্যবহারকে মেনে নিয়েছিল।

(চলবে)

ডেমো (পর্ব ২)

দুই

চোদ্দো বছর আগে, নভেম্বরের এক সন্ধ্যায় সরোজিনী নগর বাসস্টপে দাঁড়িয়ে পাঁচশো চুয়াল্লিশ নম্বর বাসের প্রতীক্ষা করছিলেন প্রমিলা। উনি তখন লোদি রোডে একটা প্রাইভেট স্কুলের প্রাইমারি সেকশনে পড়াতেন। শনিবার স্কুল ছুটির পরে এক সহকর্মী কৃত্তিকার সঙ্গে সরোজিনী নগরের খোলা বাজারে হেতার জন্য সস্তায় কিছু কাপড় জামা কিনতে গিয়েছিলেন প্রমিলা। বাজার সেরে বাবু মার্কেটে কৃত্তিকার সঙ্গে পাপড়ি চাট খেয়ে ওরা দুজন যখন বাসস্ট্যান্ডে এসে দাঁড়ালেন, তখন রাত প্রায় আটটা। কৃত্তিকার কপাল ভালো। মোতিবাগের বাসটা পাঁচ মিনিটের মধ্যে পেয়ে উনি বেরিয়ে গেলেন। কিন্তু প্রমিলা পাঁচশো চুয়াল্লিশের জন্য আধঘন্টা ঠায় দাঁড়িয়ে রইলেন।

রাতের দিকে একা অটোতে উঠতে তাঁকে নিষেধ করেছিলেন ওঁর স্বামী প্রতীক। না হলে খালি অটো তো বেশ কয়েকটা পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেল। বাজারে তখন সবে মোবাইল আসতে শুরু করেছে কিন্তু দামটা একটু উপরের দিকে থাকায় প্রমিলা তখনও মোবাইল কিনে উঠতে পারেননি। তাই বাসস্ট্যান্ডের পিছনে একটা পিসিওতে গিয়ে প্রতীককে ফোন করলেন প্রমিলা। সরোজিনী নগর বাসস্ট্যান্ডে আধঘন্টা দাঁড়িয়ে আছি, মনে হচ্ছে ট্যাক্সি ধরেই বাড়ি ফিরতে হবে আজ, প্রমিলা জানিয়েছিলেন ওঁর স্বামীকে। শ্বেতা এখন কী করছে?

—ও এখন ঠাম্মির ঘরে খেলা করছে, ওর জন্য চিন্তা করতে হবে না তোমাকে, প্রতীক ওকে আশ্বস্ত করলেন। প্রতীক কনট প্লেসে একটা বিদেশি ব্যাংকে চাকরি করেন, বাড়ি ফিরতে ওঁর রোজই রাত আটটা বেজে যায়। কাজেই প্রমিলার কোনওদিন ফিরতে দেরি হলে দুপুরে প্লে স্কুল থেকে ফিরে শ্বেতাকে ঠাম্মির কাছেই অনেকটা সময় কাটাতে হয়।

ট্যাক্সি স্ট্যান্ডের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন প্রমিলা আর ঠিক সেই সময়ই একটা সাদা প্রাইভেট গাড়ি দাঁড়িয়ে পড়ল ওঁর পাশে।

—কাঁহা জানা হ্যায় আপকো, ম্যাডাম?

—সিআর পার্ক।

—দোশো রুপেয়া লেঙ্গে, আইয়ে।

প্রমিলা তাকিয়ে দেখল গাড়িতে আরও দু’জন মোটামুটি ভদ্র চেহারার লোক বসে আছে। ‘ইনলোগ কালকাজি অউর গোবিন্দপুরী যা রহে হ্যায়’, ট্যাক্সি ড্রাইভার জানাল।

প্রমিলা অনুমান করলেন প্রাইভেট গাড়ির ড্রাইভার ওর মনিবকে এয়ারপোর্ট বা রেলওয়ে স্টেশনে ছেড়ে দিয়ে ফিরতি পথে গাড়িটাকে শেয়ারের ট্যাক্সি বানিয়ে কয়েকশো টাকা কামিয়ে নিচ্ছে। পিছন থেকে একজন যাত্রী নেমে সামনে ড্রাইভারের পাশের সিটে বসে ওকে পিছনে বসার জায়গা করে দিল।

সরোজিনী নগর থেকে চিত্তরঞ্জন পার্ক গাড়িতে ত্রিশ মিনিটের রাস্তা। কিন্তু প্রমিলা পুলিশের গাড়িতে যখন বাড়ি ফিরলেন তখন ভোর পাঁচটা। হাউজ খাস পেরোবার আগেই ওর ডানপাশে বসা সহযাত্রি পকেট থেকে রুমাল বের করে হঠাৎই তাঁর নাকে চেপে ধরে। দু’মিনিট ধ্বস্তাধস্তি করে ক্লোরোফর্মের তীব্র গন্ধে প্রমিলা বেহুঁশ হয়ে পড়লেন। ওঁর যখন জ্ঞান ফিরে এল উনি দেখলেন মেহেরলির কাছে একটা পার্কে অর্ধনগ্ন অবস্থায় পড়ে আছেন, ওঁর পা বেয়ে গড়িয়ে পড়া রক্ত ততক্ষণে শুকিয়ে জমাট বেঁধে গেছে। মর্নিং ওয়াক করতে বেরিয়ে এক ভদ্রলোক ওকে দেখতে পেয়ে পুলিশে খবর দেন।

(চলবে)

ডেমো (পর্ব ১)

মাঝরাতে মা-মেয়ের মধ্যে ঝগড়া শুরু হয়ে গেল। —তুমি আবার মাঝরাতে উঠে চান করতে শুরু করলে মা?

—আমার যা খুশি তাই করব, তুই আমায় বাধা দিতে আসিস না।

—কিন্তু তোমার যে ঠান্ডা লেগে আবার নিউমোনিয়া হয়ে যাবে, সেটা কেন বুঝতে পারছ না?

—আমি নিউমোনিয়া হয়ে মরলে তোর কী অসুবিধে? তুই তো স্বাধীন হয়ে যা খুশি করতে পারবি।

শ্বেতা বিরক্ত হয়ে একসময় নিজের বিছানায় ফিরে গেল। ও জানে মাঝরাতে এই স্নানপর্ব প্রমিলার এক অদ্ভুত প্রতিবাদ যা শুরু হয়েছিল শ্বেতার প্রথম কলেজে যাবার দিন থেকেই। প্রমিলা মেয়ের হাত-পা ধরে কান্নাকাটি করে ওকে নিষেধ করেছিলেন কলেজে ভর্তি না হতে। ওঁর ইচ্ছা শ্বেতা করেসপন্ডেন্স কোর্সেই বিএ-টা করে নিক। কিন্তু উচ্চ মাধ্যমিকে ভালো নম্বর পেয়ে শ্বেতা কেন ঘরে বসে ডাকযোগে শিক্ষা লাভ করবে? প্রমিলা মনে করেন ভিড়ের মধ্যে ডিটিসি বাসে চেপে রোজ লম্বা জার্নি করে কলেজে যাওয়া-আসা খুবই বিপজ্জনক। যা দিনকাল পড়েছে, যদি বাসের মধ্যে কখনও কিছু ঘটে যায়?

শ্বেতা মাকে বোঝাবার চেষ্টা করেছিল চোদ্দো বছর আগে একরাতে প্রমিলার জীবনে যে-অন্ধকার নেমে এসেছিল তার পুনরাবৃত্তি ঘটবে না ওর জীবনে। কেন-না আজকালকার মেয়েরা পথেঘাটে চলার সময় অনেক সতর্ক হয়ে গেছে! মাঝরাস্তায় অপরিচিত কেউ লিফ্‌ট দিতে চাইলে মেয়েরা নেয় না। তাছাড়া উইমেনস হেল্পলাইনে ফোন করলে দশ মিনিটের মধ্যে পুলিশের রোমিং স্কোয়াডের গাড়ি চলে আসে ঘটনাস্থলে। কিন্তু প্রমিলা ওর কথায় আশ্বস্ত হননি। এসবের পরেও তো দিল্লির রাস্তায় প্রায় প্রতি রাতেই রেপ হয়ে যাচ্ছে। দুনিয়ায় দিল্লি এখন রেপ সিটি নামেই পরিচিত! পুলিশ ধর্ষণ থামাতে পারছে কোথায়?

—ওগুলো অন্য ধরনের কেস মা, শ্বেতা মাকে বোঝাবার চেষ্টা করেছিল। রাত দশটার সময় সদ্য গ্রাম বা ছোটো শহর থেকে আসা কোনও মহিলা যদি বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে হাবার মতো এদিক ওদিক তাকায় আর কী করে পালামগাঁও কিংবা মদনগির যাবে— একে ওকে জিজ্ঞেস করে, তবে তার কপালে দুঃখ থাকবে না তো কী থাকবে? ওদের কাছে তো স্মার্ট ফোনও থাকে না। প্রমিলা এত সহজে দমে যাবার পাত্রী নন। তিনি দৈনিক পত্রিকাটি খুটিয়ে পড়েন। তাই মেয়ের সঙ্গে লড়ে গেলেন।

—তুই কী বলতে চাস যেসব মেয়েরা স্মার্ট ফোন নিয়ে ঘোরাফেরা করে তারা রেপড হয় না?

হয় বই কি। মাঝরাতে ফাইভ স্টার হোটেলে পার্টি অ্যাটেন্ড করে মদ খেয়ে বেহুঁশ অবস্থায় যে-মেয়েরা ক্যাব ডেকে বাড়ি আসে তাদের বিপদ তো হতেই পারে। কিন্তু আমি তো শুধু কলেজে যাব আসব, সন্ধ্যার মধ্যেই ঘরে ফিরে আসব। আমাকে নিয়ে তোমার এত চিন্তার কোনও মানে হয় না মা। আমি যখন ঠিক করেছি কলেজে পড়ব তো পড়ব।

জেদ করে শ্বেতা অনলাইনে অ্যাডমিশন ফর্ম ভরে, ইন্টারভিউ দিয়ে দক্ষিণ দিল্লির একটি কলেজে সাইকোলোজি অনার্স নিয়ে ভর্তি হয়ে গেল আর সেই থেকে ক্ষুব্ধ প্রমিলা মাঝরাত্রে উঠে বালতি বালতি জল ঢেলে স্নান করতে শুরু করে দিলেন।

(চলবে)

কুড়িয়ে পাওয়া স্বপ্ন (শেষ পর্ব)

সামন্তকের মুখের সবকটা বাতি নিভে গিয়েছিল অনেকক্ষণ। কোনও রকমে আমতা আমতা করে বলল, “বিশ্বাস করুন, আমি এসবের কিছুই জানতাম না।”

জানার কথাও নয়। আপনার কাকুর মতো ক্রিমিনালরা সকলকে অন্ধকারে রেখেই নিজেদের কাজ হাসিল করেন। রাগ-অভিমান এসবের অনেক ঊর্ধ্বে উঠে গিয়েছেন এখন মাসিমণি। তাই সবকিছু জেনেও আপনার কথায় কোনও প্রতিক্রিয়া জানালেন না আর। শুধু এই টাকাটা দিলেন, রোগশয্যায় থাকা গুরুর প্রতি একজন শিষ্যার দক্ষিণা হিসেবে।

তন্দ্রার এগিয়ে দেওয়া খামটা অনিচ্ছা সত্ত্বেও নিয়ে নিল স্যমন্তক। মুখে বলল, ‘আপনি না বললে এসব কথা হয়তো জানাই হতো না। নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে আমার।’

—মাসিমণি এই কথাগুলো কাউকে বলেন না। আপনাকেও হয়তো বলতেন না। কিন্তু আমি দিনের পর দিন একজন মানুষকে কষ্ট পেতে দেখতে দেখতে ক্লান্ত। তাই না পেরে বলে দিলাম। দয়া করে স্নেহাংশু সরকারকে এই বাড়ির ঠিকানা জানাবেন না।

আর আমি? আমাকেও কি আসতে বারণ করছেন আপনি? তন্দ্রার চোখে চোখ রেখে কথাটা বলল স্যমন্তক।

ঠোঁটের কোণে একটা দুর্বোধ্য হাসি লেগে আছে তার। গলার স্বরটাও কেমন যেন আবেগমাখা! নিরুত্তর তন্দ্রা তাকিয়ে আছে অপলক। দমকা হাওয়ায় মাথার ওপর বৃষ্টির মতো ঝরে পড়ছে অজস্র হলুদ রঙের ফুল।

প্রায় ছুটতে ছুটতে এসে লাস্ট বাসটা ধরল স্যমন্তক। ভাগ্যক্রমে একদম শেষের জানালার ধারের সিটটা পেয়ে গেল বসার জন্যে। ব্যাগটা কোলের ওপর রেখে বুক ভরে শ্বাস নিল একটা। বাসটা চলতে শুরু করেছে। জানলা দিয়ে ঢুকছে ঠান্ডা জোলো বাতাস। পকেট থেকে সাদা খামটা বের করে মুখটা সামান্য খুলল। একবার চোখ বুলিয়ে নিল কড়কড়ে পাঁচশ টাকার নোটগুলোর ওপর। হাজার দশেক আছে মনে হয়। আপাতত চলে যাবে। মনে মনে কৃতজ্ঞতা জানাল স্নেহাংশু সরকারকে। পরলোকে যাবার আগে একটা মোক্ষম পয়সা কামানোর উপায় বাতলে দিয়ে গিয়েছেন তিনি।

স্যমন্তককে মধুরিমার কাছে যাবার কথা বলেই চোখ বুজেছিলেন স্নেহাংশু। কী একটা ভেবে স্যমন্তকও লুফে নিয়েছিল কাকুর অন্তিম ইচ্ছেটা। ভগ্যিস নিয়েছিল। ব্যাবসাপাতির এই মন্দার বাজারে এখন মাঝে মাঝেই তাঁর নাম করে বেশ কিছু মালকড়ি হাতানো যাবে ভালো মানুষ মধুরিমার কাছ থেকে।

স্যমন্তকের জীবনে মেঘ না চাইতেই জল হিসেবে এসেছেন মধুরিমা, একসময়ের নামজাদা গায়িকা। অনেক টাকার মালিক। বছর বছর রয়্যালটি হিসেবেই ব্যাংক-এ জমে গাদা গাদা টাকা। স্নেহাংশুর সঙ্গে মধুরিমার আইনত বিচ্ছেদ হয়নি। তাই হিসেব মতো স্যমন্তকই এখন তাঁর একমাত্র রক্তের সম্পর্কের উত্তরাধিকারি।

এতদিন মৃত মেয়েকে শিখণ্ডী বানিয়ে টাকা নিয়ে এসেছেন স্নেহাংশু। এবার পালা স্যমন্তকের। ফুসফুসের জটিল রোগে ধুঁকে ধুঁকে ইহলোক ত্যাগ করা কাকুর মিথ্যে অসুখের ফিরিস্তি দিয়ে যতদিন পারা যায় টানবে আর এর মধ্যে যদি পটিয়ে ফেলতে পারে মধুরিমার পালিত কন্যা তন্দ্রাকে, তাহলে তো সোনায় সোহাগা। তন্দ্রার বিহ্বল চাহনি আশা জাগাচ্ছে স্যমন্তকের মনে। তার ফেলা টোপটা বোধহয় বৃথা যায়নি। আইসিইউতে চলে যাওয়া বাবার ব্যাবসাটাকে এবার একটু একটু করে সারিয়ে তুলবে সে। সাদা খামটায় আলতো করে চুমু খেয়ে ব্যাগে ঢুকিয়ে রাখল স্যমন্তক।

বাসের গতি বেড়ে গিয়েছে। হু হু হাওয়া এসে ঝাপটা মারছে মুখে। প্রসন্ন চিত্তে সিটের ব্যাকরেস্টে শরীর এলিয়ে দিয়েছে স্যমন্তক। মধুরিমার বিক্রি হওয়া বাংলোর দাম, বর্তমান বাড়ির ভ্যালুয়েশন, বছর বছর জমতে থাকা গানের রয়্যালটি এসবের একটা আনুমানিক হিসেব মনে মনে কষে চলেছে সে।

আধো ঘুম আধো চেতনার ঘোরেই চোখের সামনে একবার ভেসে উঠছে অনেক অনেক টাকা আর একবার তন্দ্রার মুখ। হঠাৎ পথ চলতে চলতে কোনও দামি জিনিস কুড়িয়ে পেলে যেমন আনন্দ হয় ঠিক তেমনই একটা খুশি চলকে উঠছে স্যমন্তকের মনে।

জীবনের এবড়োখেবড়ো পথে চলতে চলতে সেও যেন আচমকাই একটা স্বপ্ন কুড়িয়ে পেয়েছে। জোর করে চোখ বুজে থাকে স্যমন্তক ফিরে ফিরে দেখতে চায় স্বপ্নটাকে…।

কুড়িয়ে পাওয়া স্বপ্ন (পর্ব ৪)

পুরোনো কথা শোনার আগ্রহ স্যমন্তকের তেমন ছিল না। অস্থিরতা বাড়ছিল। সাড়ে চারটের বাসটা না ধরতে পারলে কেস খেতে হবে। তাই ব্যস্ত হয়ে বলল, “এবার আমায় উঠতে হবে ছোটোমা। সাড়ে চারটেতে লাস্ট বাস।’

—হ্যাঁ, তাই তো। গল্পে গল্পে সময়ের খেয়াল ছিল না। তোমাকে এ্যদ্দিন বাদে দেখে সমস্ত পুরোনো কথা মনে পড়ে গেল। তুমি আর একটু বসো, কেমন। তন্দ্রা একবারটি ভেতরে আয় তো।

যাবার আগে স্যমন্তকের মাথায় হাত রেখে মধুরিমা আরও একবার উচ্চারণ করলেন ওম শান্তি। স্যমন্তকও পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করল তার ছোটোমাকে। তন্দ্রা মধুরিমাকে অনুসরণ করে ঢুকে গেল ঘরের ভেতর আবার ফিরেও এল কয়েক মিনিটের মধ্যে। হাতে একটা সাদা খাম।

—চলুন আপনাকে একটু এগিয়ে দিই।

কথাটা বলেই চলে গেল দরজার দিকে। পায়ে গলিয়ে নিল চামড়ার জুতো। তারপর স্যমন্তককে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে এল বাড়ির সীমানা ছাড়িয়ে। কয়েক মিনিট চুপচাপ হাঁটার পর স্যমন্তক বলল, ‘আপনি যে আমার সঙ্গে এসেছেন সে কথা ছোটোমা জানেন?”

—নাহ। উনি এখন মেডিটেশনে বসেছেন। কোনও দিকে মন দেবেন না। তাই চলে এলাম আপনাকে কয়েকটা কথা বলতে। —যদি কিছু মনে না করেন তবে একটা প্রশ্ন করব?

—করুন।

—কাকু না হয় অন্যায় করেছেন ছোটোমার সঙ্গে। কিন্তু মিতিন? সে তো তাঁর সন্তান। তাহলে মিতিনের প্রতি এতটা উদাসীন কীভাবে হয়ে গেলেন ছোটোমা? বিষয়টা আমার কাছে খুবই অদ্ভুত ঠেকল।

ধীর গতিতে হাঁটছিল ওরা। এবার থেমে গেল তন্দ্রা। পথে লোকজন বিশেষ নেই। সকালে বেশ কিছুক্ষণ বৃষ্টি হয়েছিল। আকাশ এখনও মেঘলা। রাস্তার পাশের রাধাচূড়া গাছটার নীচে দাঁড়িয়ে বিষণ্ণ দৃষ্টিতে স্যমন্তকের দিকে তাকাল সে। বলল, “আপনি আপনার কাকু আর ছোটোমা সম্পর্কে কতটা জানেন স্যমন্তক?’

—না মানে তেমন কিছুই আমার পক্ষে জানা সম্ভব ছিল না। বললাম না আপনাকে কাকু সব যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছিলেন। কাকু ফিরে আসায় একটু আধটু জেনেছি। ইতস্তত করে উত্তর দিল স্যমন্তক।

—একটু আধটু নয়, আপনি আসলে কিছুই জানেন না। আপনার কাকু মানে স্নেহাংশু সরকার আপনাদের বাড়ি ছেড়ে আসার পর কলকাতায় বাড়ি ভাড়া করে থাকা শুরু করেছিলেন মিতিনকে নিয়ে। মাঝে মাঝেই তিনি হানা দিতেন মাসিমণির বাসায় আর নানা বাহানায় টাকা নিয়ে যেতেন। বেশিরভাগ সময় টাকা চাওয়ার কারণটা হতো মিতিন। মাসিমণি অনেক খোঁজখবর করে তার আস্তানার হদিশ বের করেছিল দু’একবার কিন্তু সেখানে গিয়ে দেখা পাওয়া যেত না কারওর। প্রত্যেকবার টাকা নিয়ে যাবার পর নিজের ঠিকানা বদলাতেন স্নেহাংশু। আত্মীয়স্বজনদের মুখে শুনেছি মেয়েকে একবার চোখের দেখা দেখার জন্যে পাগলের মতো করতেন মাসিমণি। কিন্তু আপনার কাকু কোনওদিনও সে সুযোগ দেননি মাসিমণিকে। শুধু দিনের পর দিন হাত পেতে টাকাই নিয়ে গিয়েছেন। ধীরে ধীরে নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছিলেন মাসিমণি। কমিয়ে দিয়েছিলেন গান গাওয়া।

—এসব কথা তো আমি…

—এখানেই শেষ নয় স্যমন্তক। গল্প আরও আছে। মাসিমণির সঙ্গে একবার গিয়েছিলাম হাওড়ায় এক কনসার্টে। সেখানে হঠাৎই দেখা হয়ে যায় পাপিয়ামাসির সঙ্গে। পাপিয়ামাসি মাসিমণির ছোটোবেলার সঙ্গী। একসঙ্গে গান শিখতেন স্নেহাংশু সরকারের কাছে। তিনি কলকাতার এক সরকারি হাসপাতালের নার্স। তাঁর মুখ থেকেই মাসিমণি শুনেছিলেন সেই চরম সত্যিটা যেটা দিনের পর দিন আপনার কাকু লুকিয়ে রেখেছিলেন মাসিমণির কাছ থেকে।

—চরম সত্যি? সেটা কী ?

ভ্রূ কুঁচকে তন্দ্রার দিকে তাকাল স্যমন্তক। বুজে আসা গলায় তন্দ্রা যে-কথাটা বলল সেটা শোনার জন্যে একটুও প্রস্তুত ছিল না স্যমন্তক।

—মিতিন আর বেঁচে নেই। বাড়ি ছেড়ে আসার পরপরই ম্যালিগন্যান্ট ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয় মিতিন। পাপিয়ামাসিদের হাসপাতালেই ভর্তি ছিল সে। আপনার কাকু বানিয়ে বানিয়ে মাসিমণির দায়িত্বজ্ঞানহীনতার প্রচুর গল্প বলেছিলেন পাপিয়ামাসিকে। তাঁর চোখের সামনেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে ছোট্ট মেয়েটা। অথচ স্নেহাংশু সরকার দিনের পর দিন সেই মৃত মেয়ের নাম করে টাকা নিয়ে আসছিলেন মাসিমণির কাছ থেকে। আজও আপনাকে পাঠিয়েছেন সেই একই কারণে। মিতিনের মৃত্যুর খবর শোনার পর থেকেই গান গাওয়া ছেড়ে দেন মাসিমণি। শান্তির খোঁজে পা বাড়ান আধ্যাত্মিকতার পথে। পুরোনো বাড়ি বিক্রি করে আশ্রয় নেন এই পাণ্ডববর্জিত জায়গায়। চলে যেতে চেয়েছিলেন। স্নেহাংশুর ধরাছোঁয়ার বাইরে। কিন্তু টাকার গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে সেখানেও পৌঁছে গিয়েছে ওই ঠগবাজ লোকটা। নিজে আসতে না পারলেও পাঠিয়ে দিয়েছে আপনাকে।

(চলবে)

কুড়িয়ে পাওয়া স্বপ্ন (পর্ব ৩)

দিঘির জলের মতো স্থির, শান্ত চাহনিতে বাঁধা পড়েছে স্যমন্তক। বলার আছে অনেক কথাই কিন্তু কোথা থেকে শুরু করবে, ঠিক ভেবে পাচ্ছে না। নীরবতা ভেঙে প্রথম কথা বললেন মধুরিমাই, ‘আমার এ বাড়ির ঠিকানা তোমায় কে দিল বুম্বা?’

গলাটা একটু পরিষ্কার করে নিয়ে স্যমন্তক বলল, “আমি আপনার কলকাতার বাড়িতে বার কয়েক গিয়েছি। কিন্তু জানতে পারলাম আপনি এখন আর সেখানে থাকেন না। বিক্রি করে দিয়েছেন বাড়িটা। তারাই আমাকে কয়েকটা সম্ভাব্য ঠিকানার কথা বলেছিল। সবগুলোতে খুঁজে খুঁজে শেষমেশ জানতে পারলাম আপনি এখানে আছেন।’

—তা এত বছর পর হঠাৎ ছোটোমাকে এমন খোঁজাখুঁজি ? কোনও বিশেষ কারণ আছে নিশ্চয়ই? ধীর কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন মধুরিমা।

সামন্তকের গলায় এখনও মৃদু উত্তেজনা, কারণ একটা আছে অবশ্য। কিন্তু বুম্বার কি তার ছোটোমাকে দেখতে ইচ্ছে করে না? “বিশ্বাস করুন ছোটোমা, আমি বহুবার আপনাদের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছি। কিন্তু কাকু নিজেই বন্ধ করে দিয়েছিলেন সব রাস্তা। তাই ইচ্ছে থাকলেও পৌঁছোতে পারিনি আপনাদের ধারে কাছে। যতদিন গায়িকা মধুরিমা সরকার প্রচারের আলোয় ছিলেন ততদিন তবুও আপনার খবরাখবর পেতাম। কিন্তু তারপর… ঠাকুমা জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত আপশোশ করে গিয়েছেন এই ছন্নছাড়া সংসারটার জন্যে। বাবা বরাবরই উদাসীন ছিল কাকুর প্রতি তাই ঠাকুমার হাজার বায়নাক্কার পরেও আগ বাড়িয়ে খোঁজ করতে যায়নি তাঁর। বারণ করে দিয়েছিল আমাকেও। কিন্তু সেদিন…..

—কেমন আছেন দাদামণি, দিদিভাই? স্যমন্তকের কথা মাঝ পথে থামিয়েই বলে উঠলেন মধুরিমা। —বাবা চলে গিয়েছে আজ দু’বছর হল। মা বাতের ব্যথায় কাবু। কোনওরকমে চলছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে।

—আর তুমি? বিয়ে থা করেছ? কাজ কারবার?

—বিয়ে এখনও করিনি ছোটোমা। বাবার ওষুধের ব্যাবসাটারই হাল ধরার চেষ্টা করছি।

ভেতর ঘরে যাবার দরজাটার দিকে এক পলক তাকিয়ে আলতো হেসে উত্তর দিল স্যমন্তক। আর ঠিক তখনই নড়ে উঠল পর্দাটা। হাতে জলখাবারের প্লেট নিয়ে ঘরে ঢুকল তন্দ্রা। টেবিলের ওপর রেখে নিঃশব্দে এসে দাঁড়াল মধুরিমার পাশে। বলল, “তুমি এখন চা খাবে মাসিমণি?”

—না রে বাবু, আজ আর চা খেতে মন চাইছে না। বুম্বা কে দে। তুইও খা।

—আমার জন্যে ব্যস্ত হবার দরকার নেই ছোটোমা। এতসব আয়োজন না করলেই হতো।

—সে কী? এতবছর পর তোমাকে দেখছি দু’চারটে মিষ্টি খাওয়াব না? আপত্তি কোরো না। এই গরমে এতটা পথ এসেছ, খিদে পেয়েছে নিশ্চয়ই?

খিদে তার জব্বরই পেয়েছিল তাই আর বেশি ভণিতা না করে দ্রুত তুলে নিল প্লেটটা। গোটা তিনেক মিষ্টি শেষ করে হাতে নিল বড়োসড়ো একটা শিঙাড়া। প্রসন্ন মুখে তার খাওয়া দেখছিলেন মধুরিমা। তন্দ্রা আড় চোখে নজর রাখছিল স্যমন্তকের ওপর।

—আর দুটো মিষ্টি দেবে?

—না না ছোটোমা, এই ঢের।

জল খেয়ে একটা মৃদু ঢেকুর তুলে জবাব দিল স্যমন্তক। খাওয়া দাওয়া সারা। এবার যত তাড়াতাড়ি কাজের কথায় আসা যায় ততই মঙ্গল। মধুরিমা বোধহয় পড়তে পেরেছিলেন স্যমন্তকের মনের কথাটা। তাই প্রায় সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলেন, “তোমার এখানে আসার পেছনে কী একটা কারণ আছে বলছিলে…।’

—হ্যাঁ ছোটো মা, আসলে যে কথাটা বলছিলাম। এতগুলো বছর আপনার, কাকুর, মিতিনের কোনও খবর না পেয়ে আমরা প্রায় ভুলতেই বসেছিলাম সবকিছু। কিন্তু হঠাৎই দিন দশেক আগে কাকুর লেখা একটা চিঠি আসে ডাকে। জানতে পারি তিনি অসুস্থ। আমাকে তাঁর ঠিকানায় যেতে লিখেছেন। রুমাল দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে কথাগুলো বলে স্যমন্তক, একবার দেখে নেয় মধুরিমাকে। ভাবলেশহীন দৃষ্টিতে তিনি চেয়ে আছেন সামন্তকের দিকে।

স্নেহাংশুর অসুস্থতার খবরে একটুও বিচলিত দেখাল না তাঁকে। রুমালটা পকেটে গুঁজে আবারও বলতে শুরু করে, অনেক খুঁজে পেতে অবশেষে উপস্থিত হই উত্তর কলকাতার এক ঘুপচি ঘরে। ওটাই কাকুর আস্তানা। হাঁপানির টানে দম নিতে পারছিলেন না তিনি। অনেক কষ্টে জানালেন আপনার কথা। বললেন, আপনাকে যেন খবরটা দিই আর বলেছেন মিতিনের হস্টেলের ফিজ বাকি পড়েছে অনেকদিন হল। উনি অসুস্থ তাই কোনও ভাবেই জোগাড় করতে পারছেন না টাকাটা। আমার হাতে আপনাকে টাকা দেওয়ার অনুরোধ করেছেন কাকু।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাথা নীচু করলেন মধুরিমা। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে অস্ফুটে বললেন, ‘এখন কোথায় আছেন তিনি?”

—হাসপাতালে ভর্তি করেছি। কিছুটা ভালো আছেন। আমি আসতে চাইনি কিন্তু কাকু বারবার জোর করতে থাকায়…

—ভালোই করেছ। এত বছর পর তোমার সঙ্গে দেখা তো হল। চেহারা অনেকটা বদলে গিয়েছে তোমার। কপালের ওই কাটা দাগটা না দেখলে চিনতেই পারতাম না হয়তো। সেবার মামা-ভাগ্নে পাহাড় দেখতে গিয়ে মাথা ফেটে সে এক কেলেঙ্কারি কাণ্ড! মনে আছে?

মধুরিমার কথা শেষ হতেই পাশে দাঁড়ানো তন্দ্রা ঝটিতি তাকাল সামন্তকের দিকে। তন্দ্রার সঙ্গে চোখাচোখি হতেই কাটা দাগটায় হাত বোলাল স্যমন্তক। একটা ইঙ্গিতপূর্ণ হাসি হেসে বলল, ‘সে আর বলতে?”

স্নেহাংশুর অসুস্থতা, মিতিনের হস্টেলের প্রসঙ্গ কোনও কিছু নিয়েই তেমন কৌতূহল দেখাচ্ছিলেন না মধুরিমা। বিষয়টা কেমন অদ্ভুত ঠেকছিল সামন্তকের কাছে। আঠারো বছর আগে দেখা মানুষটা অনেকটাই বদলে গিয়েছেন। এমনকী তাঁর একমাত্র মেয়েকে নিয়েও একটা শব্দ খরচ করছেন না তিনি। তাঁর প্রথম শ্বশুরবাড়ি যাওয়া, সামন্তকের সঙ্গে অন্তরঙ্গতা— এসব গল্পই তিনি শোনাচ্ছিলেন তন্দ্রা আর স্যমন্তককে।

(চলবে)

কুড়িয়ে পাওয়া স্বপ্ন (পর্ব ২)

স্যমন্তক খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিল ঘরের প্রতিটা জিনিস। বোঝার চেষ্টা করছিল ঠিক কোন গাঙে আজকাল তরী ভাসিয়েছেন মধুরিমা। একসময়ে খ্যাতির শীর্ষে থাকা গায়িকার এহেন স্বেচ্ছা নির্বাসন অনেকের কাছেই কৌতূহলের বিষয়। জনপ্রিয়তার মধ্যগগনে থাকতে থাকতেই কোনও এক অজ্ঞাত কারণে মঞ্চ সংগীতের জগৎ থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছিলেন তিনি। তারপর হঠাৎই একদিন উবে গেলেন কপূরের মতো। মানুষের মন থেকেও আস্তে আস্তে ফিকে হতে থাকলেন মধুরিমা সরকার নামের সুরেলা কণ্ঠের অধিকারিণী। তাঁর ফেলে যাওয়া আসন ভরাট করতে এগিয়ে এল একঝাঁক নতুন মুখ। এখনও কিছু রসিক শ্রোতার সংগ্রহ খুঁজলে মধুরিমার অনেক কালজয়ী গানের হদিশ পাওয়া যাবে।

মধুরিমা সরকারের নাগাল পেতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে স্যমন্তককেও। পুরোনো বাড়িতে ঢুঁ মেরেছে বার কতক। ফোন নম্বরও বদল হয়েছে। বহু চেষ্টার পর অবশেষে জানতে পেরেছে মধুরিমার বর্তমান ঠিকানার সন্ধান। ধরতে পেরেছে ফোনে। আর আজ বহুপ্রতীক্ষিত সেই সাক্ষাতের সময় উপস্থিত। স্যমন্তকের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যাচ্ছিল ক্রমশ। মনের ভেতরে জন্ম নিচ্ছিল অস্থিরতা। ঠিক তখনই ঘরে ঢুকলেন। সাদা পোশাক পরিহিতা মধুরিমা। মাথা ভর্তি কাঁচাপাকা চুল। মুখে আলতো বলিরেখার আভাস।

স্যমন্তকের দিকে প্রসন্ন মুখে চেয়ে বললেন, ‘কত বড়ো হয়ে গিয়েছ বুম্বা! বহু বছর বাদে তোমায় দেখলাম। ওম শান্তি!”

গভীর বিস্ময়ে স্যমন্তক দেখছে মধুরিমাকে। নিজের অজান্তেই মুখ থেকে বেরিয়ে এল, ‘ছোটোমা!”

স্যমন্তকের বয়স যখন নয় কী দশ বছর তখন তার কাকার সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল মধুরিমার। তাঁর গানের স্কুলের সবথেকে ভালো ছাত্রীটির প্রেমে পড়েছিলেন স্নেহাংশু। বিয়ে করেছিলেন সকলের অমতে বয়সে অনেক ছোটো মধুরিমাকে। স্নেহাংশুর বাড়ির লোকেরা অনিচ্ছা সত্ত্বেও মেনে নিয়েছিলেন সম্পর্কটা। কিন্তু বেঁকে বসলেন মধুরিমার পরিবারের লোকজন। বাপেরবাড়ির সঙ্গে সম্পর্ক তলানিতে ঠেকেছিল তাঁর।

প্রথম প্রথম সব কিছুই ঠিকঠাক চলছিল। নতুন কাকিমার ভীষণ ন্যাওটা ছিল স্যমন্তক। ডাকত ছোটোমা বলে। কিন্তু ধীরে ধীরে খারাপ হচ্ছিল পরিস্থিতি। গানের জগতে মধুরিমার পরিচিতি বেড়ে যাচ্ছিল দিন কে দিন। অপরদিকে হীনম্মন্যতা গ্রাস করছিল স্নেহাংশুকে। গুরুর কাছে ছাত্রীর উন্নতি সুখের হলেও একজন স্বামীর কাছে তাঁর স্ত্রীর বাড়তে থাকা উচ্চতা মেনে নেওয়া খুব কঠিন। যত দিন এগোতে লাগল তত গরিমা বাড়তে লাগল মধুরিমার।

মুগ্ধ শ্রোতার দল ঘিরে থাকত তাঁকে। রেগে যেতেন স্নেহাংশু। ভেবেছিলেন সন্তান এলে হয়তো ভাটা পড়বে মধুরিমার সংগীত চর্চায়। কিন্তু দেখা গেল মিতিনের জন্মের পর দ্বিগুন উৎসাহে গান গাইছেন তিনি। একের পর এক আসছে কনসার্ট, সিনেমায় প্লে-ব্যাকের প্রস্তাব। ঈর্ষার বশে স্নেহাংশু বন্ধ করলেন গান শেখানো। ঝাঁপ পড়ল স্কুলের।

নেশার প্রতি আসক্ত হচ্ছিলেন স্নেহাংশু। মধুরিমার ওপর বাড়তে থাকা ক্রোধ তাঁকে ঠেলে দিচ্ছিল অন্ধকারের দিকে। সে সময় স্যমন্তক নেহাতই শিশু। অতশত বুঝত না কিছু। তবুও বেশ মনে পড়ে, প্রায় রোজ রাতেই ঝামেলা করতেন স্নেহাংশু। কিন্তু কোনও দিন সে তার প্রত্যুত্তরে রা কাড়তে শোনেনি মধুরিমাকে। নিত্য অশান্তিতে বিরক্ত হয়ে একদিন বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন মধুরিমা।

স্যমন্তকের মনে আছে সেই দিনটার কথা। তার ছোটোমার মাথায় আঘাত করেছিলেন কাকু। রক্ত ঝরছিল সেখান থেকে। কাঁদতে কাঁদতে ব্যাগ গোছাচ্ছিলেন মধুরিমা। ছোট্ট মিতিনকে সঙ্গে নিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু স্নেহাংশুর তীব্র বিরোধিতায় একরত্তি মেয়েটাকে না নিয়েই বাড়ি ছেড়েছিলেন। পরিবারের সকলে হতভম্ব হয়ে দেখেছিল সব ঘটনা। মধুরিমা চলে যাবার মাস খানেক পর মিতিনকে নিয়ে গৃহত্যাগ করেন স্নেহাংশুও। ছিঁড়ে যায় মধুরিমার সঙ্গে স্যমন্তকের যোগাযোগের শেষ সুতোটাও। আজ আঠারো বছর পর আবার মুখোমুখি বুম্বা আর তার ছোটোমা।

(চলবে)

চোখ টেপা মেয়ে ( শেষ পর্ব )

হালকা গোলাপি রঙের শাড়ি পরে কাকলিকে খুব একটা খারাপ লাগল না অরিত্রর। ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের একটা চায়ের দোকানে বসে কাকলিই প্রথম কথা শুরু করল। বলল, “আপনাকে কষ্ট না দিয়ে আমার উপায় ছিল না, অরিত্রবাবু। আমার ব্যাপারে কোনও সিদ্ধান্ত নিয়ে বসেননি তো আপনারা?”

—না। আপনাকে খোলাখুলি বলি,আমরা কলকাতায় এসে আরও দুটি মেয়েকে দেখেছি। —পছন্দ হলে ওই দুটি মেয়ের একটিকে বেছে নিন। আমাকে বিয়ে করবেন না অরিত্রবাবু।

বিস্ময়ে অরিত্রের মুখ হাঁ হয়ে গেল। মা-বাবার কাছে অরি্ত্র শুনেছে ঈর্ষাবশত কুচুটে পাড়াপড়শিরা বেনামি চিঠি লিখে বা ফোন করে কোনও মেয়ের বিয়ে ভাঙিয়ে দিত আগের দিনে। কিন্তু নিজের বিয়ে ভাঙতে মেয়ে নিজেই এসে হাজির! নিশ্চয়ই ও অন্য কাউকে ভালোবাসে। হয়তো পাড়ার কোনও দাদা হবে। কিন্তু এটা তো ওকে ফোনেও বলা যেত।

—এ কথাটা বলার জন্যই কি আমাকে এতদূর ডেকে আনা জরুরি ছিল? একটু বিরক্ত হয়েই বলল অরিত্র।

—না, আমি আপনাকে চোখ মেরে দিয়েছিলাম তার জন্য আপনার কাছে ক্ষমা চাইতেই আপনাকে ডেকে আনলাম। কাকলি দুই হাত জোড় করে মাথা ঝুঁকিয়ে ক্ষমা চাইল ওর কাছে।

অরিত্র বুঝতে পারল না কাকলি নাটক করছে না সত্যিই দুঃখ প্রকাশ করছে ওর ফিচলেমির জন্য।

—তা আমাকে দেখে চোখ টিপলেন কেন বলুন তো?

—আপনাকে এক নজর দেখেই আমি বুঝতে পেরেছিলাম আপনি, আমরা যাকে সত্যিকার ‘ভালো ছেলে’ বলি তাই। হঠাৎ কীরকম বদবুদ্ধি মাথায় চেপে গেল, চোখ টিপে দিলাম। আপনারা চলে যাবার পরে মনে হল শেষ পর্যন্ত যদি আপনি আমাকে পছন্দ করে বসেন তবে তো কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে আর সেটা ঠেকাতেই এখানে ছুটে আসা।

—আপনি আমাকে ধন্দের মধ্যে ফেলে দিলেন। একদিকে আমাকে ভালো ছেলে বলছেন, অন্যদিকে আপনাকে বিয়ে করতে নিষেধ করছেন… আসল ব্যাপারটা কী খুলে বলুন দেখি?

চায়ে চুমুক দিয়ে কাকলি বলল, ‘আসলে আমি আপনার মতো ভালো ছেলের বউ হতে চাই না। আমার হিস্ট্রি জিওগ্রাফি কোনওটাই ভালো নয়। পাড়ার একটা ছেলের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল, সেটা এতদূর গড়িয়েছিল যে শেষে অ্যাবর্শন করাতে হল। ও আমাকে ডিচ্ করে আমারই এক কলেজের বান্ধবীকে পয়সার জন্য বিয়ে করল। আমার ইচ্ছের বিরুদ্ধে দাদা-বউদি ম্যাট্রিমনিয়াল সাইটে আমার ছবি আর বায়োডাটা দিয়ে দিয়েছিল। এই নিয়ে তিনবার নিজের বিয়ে ভাঙলাম আমি। অন্যকে ঠকাতে মন চায় না যে, কী করব বলুন?’

কাকলি মাথা নীচু করল, সম্ভবত চোখের জল লুকোতেই। অরিত্র কিছু না ভেবেই ওর মাথায় হাত রাখল, তারপর পকেট থেকে রুমালটা বের করে ওর হাতে দিয়ে বলল, ‘আপনার সততার জন্য ধন্যবাদ জানাই আপনাকে। সম্বন্ধ করা বিয়েতে চেস্টিটি একটা ফ্যাক্টর আমি স্বীকার করি, কিন্তু সেটার জন্য বিয়ে আটকে থাকে না। আপনি চাইলে আপনার নিশ্চয়ই ভালো জায়গায় বিয়ে হবে।”

কাকলি ভেজা চোখ তুলে বলল, “ওসব কথা এখন থাক। আমাকে ক্ষমা করেছেন তো?”

অরিত্র মাথা হেলাল, তারপর বলল, ‘আপনার সঙ্গে কথা বলে কেন জানি আমার খুব ভালো লাগল। যদি আবার কখনও ফোনে কথা বলি কিছু মনে করবেন না তো?

—সেটাতো আমার সৌভাগ্য হবে। আপনি আমার সঙ্গে যোগাযোগ রাখলে সত্যিই খুব খুশি হব আমি।

চায়ের দোকান থেকে বেরিয়ে দু’জন দুদিকে পা বাড়াল কিন্তু কিছুটা গিয়ে একই সময়ে দু’জন ফিরে তাকাল। আর কাকলি হেসে আবার চোখ টিপল অরিত্রকে তারপর হাত তুলে টাটা করল।

তিন মাস পরে অফিসের কাজে কলকাতা এসে কাকলিকে বিয়ে করল অরিত্র। এই তিন মাসে অন্তত পঞ্চাশ বার ফোনে কথা বলেছে ওরা। কখনও লাঞ্চের সময়, কখনও বা রাতের দিকে আর প্রত্যেকবারই কথা শেষ করে অরিত্রর মনে হয়েছে এই পাগলি মেয়েটাকে নিয়ে জীবনে অসুখী হবার কোনও সম্ভাবনা নেই ওর।

কাকলির ইচ্ছেতেই বিয়েটা ওরা করল কালীঘাটে গিয়ে, দাদা বউদির উপস্থিতিতে। লাল শাড়ি, শাঁখা, সিঁদুর পরে ভিড়ের মধ্য দিয়ে বেরোনোর সময় ওরা দু’জন ছিটকে দু’দিকে চলে গেল। অরিত্র এদিক ওদিক তাকাচ্ছিল ঠিক সেসময়ই জোরে সিটি বাজল। অরিত্র মাথা ঘুরিয়ে দেখল পাঁপড় হাতে কাকলি দাঁড়িয়ে আছে একটু দূরেই। চোখে চোখ পড়তেই ও চোখ টিপল, যেমনটা টিপেছিল সেই প্রথম দিন।

                                                                                                                                         সমাপ্ত৷

পড়ার জন্য সীমাহীন গল্প-নিবন্ধসাবস্ক্রাইব