মা (পর্ব- ৩)

সেই রবিবার ফোনে তুষার বাবাকে জানিয়ে রেখেছিল, বিকেলে আসবে। বিকেল গড়িয়ে সন্ধে হল। সন্ধে থেকে রাত্তির, তবু দু’জনের দেখা নেই। কোনও ফোনও নেই। খাবার সাজিয়ে অপেক্ষা করা ছাড়া আর কিছু করার নেই। এগারোটা বাজতে যায় দেখে পরিমলবাবু স্ত্রীকে বললেন, ‘আর বসে থেকে লাভ নেই, চলো আমরা দু’জন খেয়ে নিই। মনে হচ্ছে ওরা অন্য কোথাও হয়তো গেছে।’

অসীমাদেবীর চোখ জলে ভরে আসে, ‘হ্যাঁ গো, ওরা কি আমাদের কথা চিন্তাই করে না? রঞ্জনা না হয় পরের বাড়ির মেয়ে কিন্তু তুষার তো নিজের পেটের ছেলে। বাড়ি ছেড়ে তো আগেই গিয়েছে এখন এক-দুই ঘণ্টার জন্যে একবার চোখের দেখা দেখতে আসাটাও বন্ধ করে দিতে চাইছে। তুমি নিজে একবার ফোন করেও তো দেখতে পারো।’

পরিমলও প্রচণ্ড চিন্তা করছিলেন। একটু চড়া গলাতেই উত্তর করলেন, ‘তুমি কী ভাবো আমাকে? এতক্ষণ চুপচাপ বসে আছি? কখন থেকে সমানে চেষ্টা করছি। ফোন সুইচ অফ আসছে।’

‘তোমাদের কতবার বলেছি বাড়িতে ল্যান্ডলাইন ফোন করতে কিন্তু কেউই তোমরা শোনবার লোক নও। এই এমারজেন্সিতে…

রাতটা উৎকণ্ঠায় কোনওরকমে কাটিয়ে পরের দিন সকাল এগারোটাতে পরিমলবাবু, তুষারের অফিসে ফোন করলেন। ওখানে জানতে পারলেন স্ত্রীয়ের অসুস্থতার খবর জানিয়ে তুষার ছুটি নিয়েছে। অসীমাদেবীও বউমার অসুস্থতার খবরে বিচলিত হলেন। সামান্য রান্না করে স্বামীকে খাইয়ে তিনজনের খাবার টিফিনবক্সে ভরে তৈরি হয়ে নিলেন ছেলের কাছে যাবার জন্যে। ব্যস্ততার কারণে পরিমলবাবু যেতে না পারলেও ট্যাক্সি ডেকে স্ত্রীকে তুলে দিলেন এবং ড্রাইভারকে তুষারের ঠিকানা দিয়ে ভালো করে রাস্তা বুঝিয়ে দিলেন।

ড্রাইভার অসীমাদেবীকে তুষারের ফ্ল্যাটের নীচে নামিয়ে দিয়ে ভাড়া গুনে নিয়ে চলে গেল। দোতলায় তুষারের নাম লেখা ফ্ল্যাটের দরজায় অসীমাদেবী কলিংবেল বাজাতেই তুষার এসে দরজা খুলে মা- কে দেখে অবাক হল, ‘একী, মা তুমি!’

‘ভেতরে তো আসতে দে। বউমার শরীর খারাপ শুনলাম। ওকে ডাক্তার দেখিয়েছিস? এখন কেমন আছে? যা দূরে ফ্ল্যাট নিয়েছিস!’

ফ্ল্যাটে ঢুকেই অসীমার অভিজ্ঞ চোখে অনভিজ্ঞ সংসারের দুর্দশাগুলো পরিষ্কার হয়ে গেল। চারিদিকে জিনিসপত্র ছড়ানো, রান্নাঘরে এঁটো বাসন জড়ো করা। তিনদিন ধরে কাজের মেয়েটির অনুপস্থিতিতে বাড়ি যেন নরককুণ্ড। আর গৃহকর্ত্রী দু’দিন ধরে বিছানায় শয্যাশায়ী। প্রচণ্ড জ্বর আর পেটে ব্যথা। জিনিসপত্র গোছাতে গোছাতে অসীমাদেবা তুষারকে বললেন, ‘আমাকে একটা ফোন করতেও তো পারতিস। এরকম অসময়েই অপরের সাহায্যের দরকার পড়ে।

তুষারের হাজার মানা করা সত্ত্বেও অসীমা এঁটো বাসন ধুয়ে রান্নাঘরে সাজিয়ে রেখে সারা বাড়ি পরিষ্কার করলেন। কাচার জামাকাপড় একত্র করে ওয়াশিং মেশিনে ঢুকিয়ে তুষারকে ওটা চালিয়ে দিতে বললেন। রঞ্জনার জন্যে হালকা করে নিরামিষ ঝোল-ভাত বানিয়ে ওকে খাওয়ালেন। বাড়ি থেকে আনা খাবার নিজে এবং তুষারকে খেতে দিলেন। কাচা জামাকাপড়গুলো বারান্দায় মেলে দিয়ে এসে রঞ্জনার কাছে বসলেন। রঞ্জনার মুখ থেকেই শুনলেন দু’দিন সে স্নান করেনি। তৎক্ষণাৎ জল গরম করে এনে ওর চুল ধুয়ে, হাত-পা স্পঞ্জ করিয়ে বাড়ির পোশাকটা বদলে দিয়ে ফ্রেশ নাইটি পরিয়ে দিলেন। বিকেল হয়ে এসেছিল। হঠাৎই রঞ্জনা অসীমার হাতটা চেপে ধরে বলল, মা আজ তুমি কোথাও যাবে না। রাত্তিরে আমার কাছে থাকবে, বাবাকে জানিয়ে দাও।’

“আমিও তাই ভাবছিলাম।’ রঞ্জনার মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে অসীমা বললেন, ‘তোকে এই অবস্থায় ছেড়ে যেতে আমারও মন চাইছে না। তুষার, তুই বাবাকে ফোন কর। কাল উনি তোকে বহুবার ফোনে চেষ্টা করেছেন।’

‘মা, কাল রঞ্জনার বাড়াবাড়ি হওয়াতে আমি এত নার্ভাস হয়ে গিয়েছিলাম, ফোন করার কথা একদম মনে ছিল না। চার্জ শেষ হয়ে ফোনটা যে কখন অফ হয়ে গেছে, খেয়ালই করিনি। বাবা নিশ্চই খুব চিন্তা করছেন। তার ওপর তুমিও যদি না পৌঁছোও…

“উনি চিন্তা করছেন ঠিকই কিন্তু আমি না গেলে ওনার অসুবিধা হবে না বরং বাইরের খাবার খেতে পারবেন। পরিবেশটা খানিক হালকা করার চেষ্টা করলেন অসীমা।

‘রঞ্জনা, এখন একটু স্যুপ খাবি?’

“মা, বাড়িতে তো কিছুই নেই। স্যুপ বানাবে কী দিয়ে?’ ‘তোকে চিন্তা করতে হবে না। আমি সব নিয়ে এসেছি।

রঞ্জনা ওনাকে থেকে যেতে বলেছে এটা অসীমার খুব ভালো লেগেছিল। প্রথম বাড়িতে ঢুকে রঞ্জনার উপর খুব রাগ হয়েছিল। গৃহস্থ বাড়ি এত অগোছালো রাখতে আছে? চারিদিকে নোংরা, জামাকাপড়ের পাহাড় চেয়ারের ওপর জমানো। যে ছেলে নিজের বাড়িতে এক গেলাস জল গড়িয়ে খায়নি সে কিনা এখানে এসে স্ত্রীয়ের সেবা করছে, রান্না করে তাকে খাওয়াচ্ছে। কিন্তু তুষারের মুখ চেয়ে অসীমা একটা কটু কথাও মুখে আনেননি। ছেলের সুখে-দুঃখে তার পাশে দাঁড়ানোটাই তো মায়ের উচিত, এটাই মনে করে অসীমা চুপ করে থেকেছেন।

ক্রমশ…

 

 

মা (পর্ব – ১)

রোজকার মতোই তুষার চায়ের ট্রে হাতে করে বেডরুমে এসে ঢোকে। সাইড টেবিলে ট্রে-টা নামিয়ে রেখে জানলার পর্দাগুলো সামান্য সরিয়ে দেয় ঘরে আলো ঢোকার জন্যে। জানলা দিয়ে একফালি কমলালেবুরঙা স্নিগ্ধ আলো এসে পড়ে রঞ্জনার মুখের উপর। রঞ্জনা চোখ বুজেই খাটে পাশ ফিরে শোয়। হাত দিয়ে চোখটা ঢাকার চেষ্টা করে। তুষারের মুখে একটা পরিতৃপ্তির হাসি ফুটে ওঠে। বিছানায় বসে রঞ্জনার চুলে হাত রাখে তুষার, ‘ম্যাডাম, উঠুন। দাস আপনার চা নিয়ে হাজির।’

তুষারের গলা শুনেও রঞ্জনার চোখ খুলতে ইচ্ছা করে না। চোখ খুললেই তো কাজের পাহাড়। যদিও সকালটা তুষারই সামলে দেয়। দেরি করে ওঠাটা রঞ্জনার অভ্যাস। তুষারের ঘুম খুব সকালে ভেঙে যায়। উঠেই চোখে মুখে জল দিয়ে বেডরুমে রাখা মিউজিক সিস্টেম চালিয়ে দেয়। দু’জনেরই মিউজিক প্রিয়। হালকা করে চলতে থাকে আমজাদ আলি বা রবিশংকর। ঘরের জানলাও খুলে দেয় ভোর থাকতে যাতে কিছুটা ফ্রেশ হাওয়া এসে স্নেহের পরশ বুলিয়ে দিয়ে যেতে পারে তাদের শরীরে।

শুয়ে শুয়ে রঞ্জনা বুঝতে পারে তুষার পাশে বসে তার জেগে ওঠার অপেক্ষা করছে। চা এনেছে যখন না খাইয়ে ছাড়ছে না। এরই মধ্যে তুষারের কথা কানে আসে, ‘কী হল ম্যাডাম? বিছানার ওম ছেড়ে ওঠার কি ইচ্ছে নেই? সকাল সকাল তোমার সম্পাদক সাহেবের ফোন এসেছিল। কোনও একটা স্টোরির গন্ধ পেয়েছেন মনে হল, তাই তড়িঘড়ি তোমার খোঁজ পড়েছে।’

‘সম্পাদক’ শব্দটা বোধের উপর আঙুল ছোঁয়াতেই রঞ্জনা আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসে। ‘মিস্টার সেনের কি চোখে ঘুম আসে না যে সাতসকালে ফোন করেছেন?’

‘তোমার এডিটর সাহেবটি খুব ভালো করেই জানেন যে তুমি দেরি করে ঘুম থেকে ওঠো। তা সত্ত্বেও সাত সকালে ফোন করে আমার ঘুমটাও বরবাদ করেন। ‘

তুষার, রঞ্জনার হাতে চায়ের কাপটা তুলে দিয়ে নিজের কাপটাতে চুমুক মারে। হাতে আর বেশি সময় নেই। ঘরের টুকটাক কাজকর্ম মিটিয়ে অফিসের জন্য বেরোতে না পারলে নির্ঘাত দেরি হবেই। সুতরাং উঠে পড়ে তুষার। দুধ নিয়ে এসে গ্যাসে ফুটতে বসিয়ে টোস্ট তৈরি করাটা তুষারের রোজকার কাজ। বাকি রঞ্জনা উঠে যা করবার করবে।

মাত্র বছর দেড়েক হয়েছে দু’জনের বিয়ের। লভ ম্যারেজ। অবশ্য দুই পক্ষের পরিবারের সম্মতিতেই বিয়েটা হয়েছে। কিন্তু ওরা ভবিষ্যতের প্ল্যানিং ছাড়াই জীবনটা সুন্দর কাটিয়ে দিচ্ছে। সংসারের কাজটাকে দুজনে অলিখিত নিয়মে সুবিধামতো ভাগ করে নিয়েছে।

বিয়ের আগে অন্য ছেলেদের মতোই তুষার রান্নাঘরের কোনওদিন পা বাড়ায়নি। বাড়ির সব কাজ মা-ই করতেন। তুষার বড়ো হয়ে থেকে দেখে আসছে রান্নাঘরে মায়ের একাধিপত্য। আলস্য বস্তুটা মায়ের মধ্যে দেখেছে বলে তুষারের মনে পড়ে না। বাড়ির কেউ মা-কে সাহায্য করতে চাইলেও, মা সঙ্গে সঙ্গে তাকে না-করে নিতেন, বলতেন, ‘তোমরা নিজেদের কাজ করো। রান্নাঘরের কাজটা ভগবান মেয়েদের জন্যেই বেছে রেখেছেন।’

তুষারের বড়ো ভাই বিনয়, গ্রিন কার্ডহোল্ডার একটি মেয়েকে বিয়ে করে আমেরিকায় চলে যায় বেশ কয়েক বছর আগে। বড়ো ভাইয়ের চলে যাওয়াটা মা-বাবার মনে একটা গভীর ক্ষতের সৃষ্টি করে। তারপর থেকেই তুষারের মনে হতো মা তাকে আগলে আগলে রাখছেন। চাকরি নিয়ে বাইরে চলে যাওয়ার একেবারে বিপক্ষে ছিলেন মা। বাবাও চাইতেন পরিবারের ব্যাবসা-টা তুষারই দেখুক। কিন্তু তুষারের ভালো লাগত বই আর খবরের কাগজের পাতার কালো অক্ষরগুলো। রাত্তিরে বই নিয়ে শুলে, বাবা এসে পাশে বসে ব্যাবসার কথা বোঝাবার চেষ্টা করতেন। ছেলের বিরক্তি দেখে মা হেসে বাবাকে বোঝাবার চেষ্টা করতেন, ‘কেন শুধু শুধু ছেলেটাকে বিরক্ত করছ তুমি। পড়তে ভালোবাসে তাতে চিন্তার কী আছে? তোমারই তো রক্ত। একদিন দেখবে নিজেই ব্যাবসায় আগ্রহ দেখাচ্ছে।’

কিন্তু অসীমাদেবীর এই ভবিষ্যতবাণী মিথ্যাই প্রমাণিত হয়। পড়াশোনা শেষ করে তুষার চাকরির সন্ধানে ঘুরতে থাকে। পেয়েও যায়। একটি প্রতিষ্ঠিত খবরের কাগজের দফতরে সাব-এডিটরের চাকরি। কাজের প্রতি একাগ্রতা দেখে অসীমাদেবী এবং পরিমলবাবু বুঝে যান, পরিবারের ব্যাবসার ভার ছেলে কোনওদিনই কাঁধে তুলে নেবে না।

সেদিন বিকেলে স্বামী-স্ত্রী দুজনে বসার ঘরে বসে কোনও কিছু নিয়ে আলোচনায় ব্যস্ত, এমন সময় তুষার এসে ঘরে ঢোকে। ছুটির দিন। দুপুর থেকে তুষার বাড়িতেই রয়েছে। প্রথমটা অসীমাদেবী সামান্য আশ্চর্য হয়েছিলেন কারণ ইদানীং ছুটির দিনগুলোতেও তুষার বাড়িতে থাকত না। অফিসের কাজের অজুহাতে সারাদিন বেপাত্তা।

“যাক ভালোই হল। তোমরা দু’জনেই দেখছি এখানে রয়েছ। তোমাদের সঙ্গে আমার কিছু কথা রয়েছে। তুষারের গলা শুনে পরিমলবাবু এবং অসীমাদেবী তাকান ছেলের দিকে। কথা বলতে বলতে দুজনে কেউই খেয়াল করেননি ছেলে কখন এসে ঘরে ঢুকেছে।

“মা, কিছুদিন আগে রঞ্জনা নামে একটি মেয়ের সঙ্গে আমার আলাপ হয়। মেয়েটিও জার্নালিজম নিয়ে ডিপ্লোমা করেছে। ওর বাবা নামি একটি সংবাদপত্রে সিনিয়র জার্নালিস্ট, নাম দেবরঞ্জন রায়। তোমরা নিশ্চই ওনার নাম শুনে থাকবে। রঞ্জনার মা কলেজের প্রফেসর এবং ভাই ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার সঙ্গে যুক্ত। আমি রঞ্জনাকে বিয়ে করতে চাই।’

তুষারের মুখে হঠাৎ-ই সব শুনে পরিমলবাবু এবং অসীমাদেবী খানিক্ষণ চুপ করে থাকেন। কী বলবেন বুঝে পান না। তারা যে মানসিকতা নিয়ে সন্তানদের বড়ো করে তুলেছেন, তার সঙ্গে পুরো ঘটনাটার কোনও সাযুজ্য খুঁজে পান না। ছেলে যেখানে নিজেই মেয়ে দেখে বিয়ে স্থির করে ফেলেছে সেখানে তাদের ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ তে কিছুই যায় আসে না। পরিমলবাবু নিজের ভাবনার গতিবেগকে সংযত করেন, “বাঃ সে তো বেশ ভালো কথা। একটা দায়িত্ব থেকে তাহলে তুমি আমাদের নিষ্কৃতি দিলে। একটা দিন দেখে তাহলে দুটো পরিবারের মধ্যে প্রয়োজনীয় কথাবার্তাগুলোও সেরে ফেলা দরকার। তোমাদের যেদিন সুবিধা হবে মা-কে জানিয়ে দিও।’

ক্রমশ…

গর্ব (পর্ব ১)

বহুদিন পর নিজের জন্মস্থানের মাটিতে পা রাখলেন রমেন্দু সমাজপতি। মনে মনে হিসেব করে দেখলেন তা প্রায় কুড়ি বছর তো হল বটেই! বড়ো ছেলে রঞ্জন মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক দুটোতেই অসাধারণ রেজাল্ট করে আইআইটি-তে খুব সহজেই চান্স পেয়ে গিয়েছিল।

ছোটো ছেলে রাহুলও দাদার মতো দুর্দান্ত রেজাল্ট করে যাচ্ছিল। এইসময় রমেন্দুর ট্রান্সফার অর্ডার এল কলকাতায়। ওদের পড়াশোনোর কথা চিন্তা করে রমেন্দু কলকাতায় একটা ফ্ল্যাটও কিনে ফেললেন। এরপর হঠাৎ করেই পর পর দু’বছরের মধ্যে বাবা মা দু’জনেই গত হলেন।

সম্পত্তির ভাগ বাঁটোয়ারা নিয়ে অহেতুক কিছু বিবাদ তৈরি হল পরিবারে। রমেন্দু দেখলেন, কলকাতাতেই যখন তাঁর সবকিছু তখন দেশের বাড়ি ঘরদোর রেখে লাভ কী? ভাগের সম্পত্তি বিক্রি করে দিলেন। শিকড়টা ছিঁড়ে গেল চিরদিনের মতো।

সবকিছু বিক্রি করার যে খুব ইচ্ছে ছিল তা নয়, কিছুটা অভিমানেই অমনটা করেছিলেন রমেন্দু। বাবা মারা যেতেই ভাইয়েরা সম্পত্তির ভাগ নিয়ে এমন শুরু করে দিল যে, রমেন্দুর মন একদম ভেঙে গিয়েছিল। রাতারাতি ডিসিশন নিয়ে ফেললেন, আর এখানে কোনও দিন আসবেন না, ওদের মুখ দর্শনও করবেন না। যে-ব্যবহারটা ভাইয়েরা করেছিল তাতে ভবিষ্যতে ওদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখার ইচ্ছেটাই মরে গিয়েছিল। জ্যাঠতুতো ভাই তিনুর কাছে রমেন্দু প্রায় অর্ধেক দামে বিক্রি করে দিয়েছিলেন নিজের অংশ।

বাড়ির সামনের কৃষ্ণচূড়া গাছটি আর নেই। ওরা কেটে ফেলেছে, কিংবা একা একাই মরে গিয়েছে। তিনু তিনতলা বাড়ি হাঁকিয়েছে। নীচে ওপরে ভাড়া, মাঝের তলায় তারা থাকে। তিনু এখন বেশ বড়োলোক। অঢেল টাকার মালিক।

অভিমান ভুলে ছোটো ভাই রাখালের বাড়িতেই উঠেছেন রমেন্দু। সম্পত্তি নিয়ে সবচেয়ে বেশি গোলমাল পাকিয়েছিল রাখালই। এখন বিশেষ ভালো নেই রাখাল। একটা কিডনি ড্যামেজ। ছেলে মেয়ে দুটো একেবারেই মানুষ হয়নি। কোনওরকমে চলছে তার।

ভাইদের জন্য নয়, জন্মভূমি আর বাল্যবন্ধু শিবতোষের টানেই এসেছেন রমেন্দু। শিবতোষের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ আছে। শিবতোষ সুযোগ পেলেই বলে, একবার এসে ঘুরে যা। কাদের ওপর অভিমান করছিস? কত পালটে গেছে আমাদের জন্মভূমি, একবার দেখতে ইচ্ছে করে না তোর?

রিটায়ার করার পর রমেন্দুর মনে হয়েছে, জীবনের মেয়াদ ফুরিয়ে আসছে। সত্যি তো, কার ওপর অভিমান করছে সে! উপলব্ধির দরজা কখন যে খুলে যায়!

বুনিয়াদপুরের মাটিতে পা রেখেই মনে মনে হেসেছিলেন রমেন্দু। শিবতোষের কথাটা ডাহা ভুল। মায়ের শরীরের গন্ধটা কুড়ি বছর পরেও একইরকম অমলিন। মায়ের শরীরের গন্ধ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ পারফিউম এবং সেটা যে-কখনও মুছে যায় না, বুঝতেই পারেননি শিবতোষ।

—অবশেষে এলি তাহলে!

অনেকটা বুড়িয়ে গেলেও শিবতোষের হাসিটা একইরকম ঝকঝকে। কতকাল পরে সামনাসামনি দেখা! ক্র্যাচে ভর দিয়ে চলতে হয় শিবতোষকে। একটা অ্যাক্সিডেন্টে বাঁ-পা কাটা পড়েছে। রমেন্দু তখন চেন্নাই, খবরটা পেলেও আসা হয়নি। শিবতোষদের বাড়িটা একসময় টিনের ছিল। টিনের দেয়াল, টিনের চাল, মেঝেটা পাকা। বৃষ্টির সময় টিনের চালে অদ্ভুত সুন্দর একটা মিউজিক তৈরি হতো। এখন সবকিছু পাকা। তবে তেমন শৌখিনতার ছাপ নেই, নেহাতই আটপৌরে।

—ভালো আছিস তো সবাই? ভেলভেটের গদি আঁটা একটা কাঠের চেয়ারে বসতে বসতে বললেন রমেন্দু।

বছর বাইশ তেইশের ভারি মিষ্টি মুখের একটা মেয়ে জলের গেলাস হাতে নিয়ে সামনে এসে দাঁড়াল। হাতে শাঁখা-পলা, সিঁথিতে সিঁদুর।

শিবতোষ বললেন, “আমার ছোটো বউমা। গতবছর বিয়ে হয়েছে ওদের। তোকে কিন্তু চিঠি পাঠিয়েছিলাম।’

রমেন্দু সে কথার জবাব না দিয়ে বললেন, “তোর ছোটো ছেলে এখন কী করছে? কী যেন নাম ওর?’

—রাজা। ভালো নাম রণতোষ। বিএসসি পাশ করার পর কিছুদিন বসেছিল। চেষ্টা চরিত্র করে একটা প্রাইমারি স্কুলে ঢুকিয়ে দিয়েছি। চাকরি করে, সঙ্গে টিউশনিও করে, সব মিলিয়ে ভালোই আয় করে। বড়ো ছেলে শেখর বাজারে বইখাতার দোকান করেছে।

রমেন্দু, রাজার বউয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, “তোমার নাম কী মা?”

—রিনি।

রিনি পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করল। রমেন্দু মনে মনে ভাবলেন, আগে জানলে কিছু একটা উপহার আনতে পারতেন। কিন্তু সেটা যখন হয়নি তখন এখান থেকেই কিছু একটা কিনে দেবেন। প্রথম দেখাতেই মেয়েটাকে ভালো লেগে গিয়েছে তাঁর। কী সুন্দর প্রতিমা প্রতিমা গড়ন! টানা টানা চোখে অদ্ভুত এক মায়া মেশানো।

রিনি হেসে বলল, “বাবার মুখে আপনার কথা অনেক শুনেছি। বাবা তো আপনাদের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। আপনাদের কথা উঠলে আর থামতেই চায় না।’

—তাই? কী কী বলে তোমার শ্বশুর? হাসলেন রমেন্দু।

—সে অনেক কথা। আপনি কত্তবড়ো চাকরি করতেন। আপনার এক ছেলে ইঞ্জিনিয়র, এক ছেলে ডাক্তার— দু’জনেই বিদেশে থাকে। আরও কত্ত কী। একটা কথা জিজ্ঞেস করব কাকাবাবু? না মানে আমার কৌতূহল আর কি…।

রমেন্দু অবাক হয়ে বললেন, ‘কী?’

—শুনেছি আপনার বড়ো ছেলের বউ বিদেশিনি, মেমসাহেব। আপনারা ওর সঙ্গে কোন ভাষায় কথা বলেন? ইংরেজিতে? হো হো করে হেসে উঠলেন রমেন্দু। প্রাণখোলা হাসি। মনে হল বহুদিন পর যেন অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে একটা বিশুদ্ধ হাসি উঠে এল। রিনি কিছুটা অপ্রস্তুত, মুখে বোকা হাসি!

—না না মা, তোমার কৌতূহল যুক্তিসঙ্গত। আমার বিদেশিনি বউমা বাংলার ‘ব’ও বোঝে না। ইংরেজিতেই কথা হয়। তবে এবার দেখলাম দু’চারটে বাংলা শব্দ শিখেছে সে। সবমিলিয়ে ভাব বিনিময় ঠিক হয়ে যায়। ওরা যখন আসে ক’টাদিন খুব মজা হয়। মারিয়া মানে আমার পুত্রবধূটি বেশ মিশুকেও বটে।

শিবতোষের বড়ো বউমা প্লেট ভর্তি করে মিষ্টি নিয়ে এসেছে। প্রণাম পর্ব সে আগেই সেরে নিয়েছিল। টুল টেনে প্লেটটা রাখতে রাখতে বলল, “আপনার বউমার কথা শুনেই খুব দেখতে ইচ্ছে করছে কাকাবাবু। অবশ্য দেখা হলে আমরা দেখা ছাড়া আর কিছুই করতে পারব না। কী কথা বলব? আমাদের ইংরেজি শুনলে সে নিজের মাতৃভাষাই ভুলে যাবে, এটা নিশ্চিত করে বলতে পারি। তবুও দেখতে ইচ্ছে করছে।’

রিনি বলল, ‘আমারও। মেমবউ তো জীবনে কোনও দিন দেখিনি।’

—বেশ বেশ, সুযোগ পেলে একবার নিশ্চয়ই দেখাব তোমাদের। কিন্তু এত মিষ্টি কে খাবে? আমার যে সুগার।

শিবতোষের বড়ো বউমার নাম ইন্দ্রাণী। সবাই টুকি বলেই ডাকে। দেখতে শুনতে অতি সাদামাটা। পড়াশোনোর গণ্ডিও যৎসামান্য। তবে ভীষণ আন্তরিক আর দায়িত্বশীলা। রমেন্দু এসে অবধি দেখছেন, পরিবারের প্রতিটি সদস্যের প্রয়োজন- অপ্রয়োজনের খবর রাখে মেয়েটা। যথাসাধ্য সেসব পূরণও করার চেষ্টা করে। তার সঙ্গে সঙ্গে সংসারের কাজকর্ম করে চলেছে দিব্যি।

ক্রমশ…

পাথর-প্রতিমা (পর্ব- ২)

পর্ব – ২

অসতর্ক মুহূর্তের সব ফেলে আসা কথা। আমাকে আবির মাখিয়ে দাঁড়িয়েছিল সামনে। চোখের ইশারায় বোঝাতে চাইছিল আবির হাতে আমাকে, ওর শরীরের দখল নেওয়ার জন্য। তবে বিজলির সাথে আমার সম্পর্ক চরমে পৌঁছে ছিল সে বছর বড়োদিনের দিন। যখন ও আমায় মহুয়া খাবার পর জঙ্গলের পথ ধরে রাতেরবেলা বাড়ি পৌঁছে দিতে আসছিল।

খরস্রোতা কিশোরীর মতো পাহাড়ি ঝরনা দুকুল ছাপিয়ে উপচে পুরো পাহাড় ভিজিয়ে দিয়েছিল সেদিন। পাহাড়ের কোলে শিশিরে ভেজা ঘাসের ওপর আধখাওয়া চাঁদের দুধ গড়িয়ে পড়েছিল আমাদের দু’জনের গা বেয়ে। পাহাড়ি ঝরনার সাদা ফেনার মতো আমার ফরসা শরীরে কালো পাহাড়ের মতো বিজলি চেপে বসেছিল। পাহাড়ের বুক ফেটে ঝরনা নেমে এসেছিল আদিম গহ্বর থেকে শহুরে সভ্যতার বুকে। ব্যস! সেই শেষ রাত। তারপর আর বিজলির সাথে সেভাবে কোনওদিন যোগাযোগ হয়নি। কারণ দু’পক্ষেরই বাড়ির চাপে অবাধ মেলামেশার উপর কড়া নিষেধাজ্ঞা আরোপ হয়েছিল। তবে শেষ দেখা হয়েছিল, বাবা যেদিন বদলি হয়ে গেল। তখন আমি কলেজ শেষ করেছি সবে। ও দূরে দাঁড়িয়েছিল পাথরের মতো। যার বুকে অনেক হিমবাহ জমে আছে।

শুধু দু’চোখের কোণা বেয়ে তিরতির করে গড়িয়ে পড়ছে ঠিক কোয়েল নদীর মতো একটা ক্ষীণ ধারা। তারপর এই আবার এখানে এলাম বছর দুই পর। শীতের ছুটিতে। ছোটোবেলার শিকড়ের টানে। তবে তখন পাহাড় আর তার এই উপত্যকার ছবি এক থাকলেও রং পালটে গেছে অনেক। তবে এসে যা শুনলাম, তাতে বুঝলাম, তার জন্য দায়ী ওরা নয়। দায়ী আমরাই, শহুরে মানুষেরাই।

এবার বাঁক নিয়ে গল্পের শুরুর দিকে আবার ফিরে যেতে হবে। এ বছর আমি এসেছি বড়োদিনের ছুটিতে। এসে উঠেছি বাবারই এক বন্ধুর কোয়ার্টারে। ওনার ছেলে সিদ্ধার্থ আবার আমার স্কুলের বন্ধু। আমরা দু’জনেই গিয়েছিলাম বড়োদিনের সন্ধেবেলা আদিবাসীদের গ্রামে। ওখানে সব ছোটোবেলাকার খেলার সাথি এখনও কিছু আছে। তবে সিদ্ধার্থ প্রথমে যেতে চাইছিল না। তার কারণ ও যা বলল, আমি তো শুনে অবাক। ওর কথাটাই এখানে হুবহু তুলে ধরি।

—শোন শুভজিৎ, তোর এই অঞ্চলের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে কিছু জানা দরকার। তোরা এখান থেকে চলে যাওয়ার পর, অনেকেই কোয়ার্টার ছেড়ে চলে গেল। তুই আগের ধারণা নিয়ে এখানে এখন ঘোরাফেরা করলে বিপদ হতে পারে। তাই আগে থেকেই তোকে একটু সাবধান করে দিচ্ছি।

—বিপদ! আমাদের এই উপত্যকা তো স্বর্গরাজ্যের মতো সুন্দর ছিল। সেখানে আবার সমস্যা কী হল?

—না… আগে তো সত্যিই কোনও ঝামেলা ছিল না। কিন্তু এখন কারখানাগুলোর অবস্থাও তথৈবচ। নানারকম অশান্তিও শুরু হল একটার পর একটা। প্রথমে যেটা ঘটল, সেটা ভয়ংকর। তোরা চলে যাবার মাসখানেক পরেই। তুই তো জানতিস হাতিশালায় প্রতি হাতিপিছু দশ কেজি করে আটা দিনে বরাদ্দ ছিল। সেই আটা চুরি করত প্রভাকরদা, মানে প্রভাকর মাহাতো। চিনতে পারছিস তো?

—হ্যাঁ, চিনব না কেন? প্রভাকরদাই তো হাতিদের মাহুত ছিল। আমাকে কতবার হাতির পিঠে চড়িয়েছে।

—হ্যাঁ ঠিক। জানিস তো হাতিরা এমনিতেই খুব সংবেদনশীল আর বুদ্ধিমান। ওদের আধপেটা খেয়েই দিন কাটত। একদিন এক আদিবাসী সাফাইওয়ালা যেই না ঢুকেছে হাতিশালা পরিষ্কার করতে। আর ব্যস! তখনই একটা হাতি শুঁড়ে করে পেঁচিয়ে তাকে দেয়ালে ঠেসে পিষে মেরে দিল। সেই প্রথম খেপল আদিবাসীরা। আসলে প্রভাকরদার অসততায় বিনা দোষে একজন আদিবাসী মারা গেল।

—তারপর?

—তোর রমণীকাকুকে মনে আছে?

—হ্যাঁ রমণীমোহন কর। ডলোমাইট খনির ক্যাশিয়ার ছিল।

—তুই তো জানিস। রমণীকাকুর স্বভাব চরিত্র কোনও দিনই ভালো ছিল না। নিরক্ষর মজদুরদের হিসেব গুলিয়ে সবাইকে পয়সা কম দিত। ঠকাত। আর একটা রেজা (মহিলা কুলি) ছিল, একটু ধোঁড়ো গোছের, নাম লছমী এক্কা। তোর মনে আছে?

আমি হাসলাম। কারণ এই ‘ধোঁড়ো’ হল এই অঞ্চলের ভাষা। মানে শহুরে লোকেরা যাদের আর কী হস্তিনী নারী বলে। শ্রাবণের পুকুরের মতো টইটুম্বুর। হেসে বললাম, ‘ওই বয়সে লছমীকে কি ভোলা যায়?”

—সেই লছমীর সাথেই রমণীকাকুর লটরপটর, আদিবাসীরা একদিন হাতনাতে ধরে ফেলেছিল। তারপর সেটা নিয়ে বিরাট গণ্ডগোল হয়। মোটামুটি আদিবাসীদের সঙ্গে শহুরে মানুষদের একটা শ্রেণিশত্রুতার বীজ তখনই বোনা শুরু হয়ে গেল। আচ্ছা একটা কথা সত্যি করে বলতো, “তুই কি সত্যিই বিজলিকে ভালোবাসতিস?’

—ভাই আমাকে আবার এসবের মধ্যে জড়াচ্ছিস কেন? তবে একটা আগ্রহ চেপে রাখতে পারছি না, হ্যাঁরে সেই বিজলির কোনও খবর জানিস?

—এই তো গুরু, এবার পথে এসো। শোন, তোর আর বিজলির ব্যাপারটা নিয়েও পরবর্তীকালে আলোচনা হয়েছিল। আসলে এইসবের নাটের গুরু হল বুধিয়া। ও মনে মনে বিজলিকে খুব ভালোবাসত। যেটা আমি পরে বুঝতে পারি। যদিও বিজলি ওকে খুব একটা পাত্তা দিত না। তুই না চলে গেলে, ও হয়তো তোকে শেষই করে দিত।

—না না, বুধিয়া আমার ভালো বন্ধু ছিল।

—ভুল করছিস। প্রেম মানুষকে অন্ধ আর বুদ্ধিহীন করে দেয়। কারণ বিজলিও তোকে খুব ভালোবাসত।

—ওসব ছাড়! যে-সম্পর্কটা আমার বাবা-মা বা ওদের সম্প্রদায়, কেউই মেনে নেবে না, সেটা নিয়ে আর আলোচনা করে লাভ কি? তার চেয়ে বরং ওদের খবর বল।

—দ্যাখ, বুধিয়া আমাদের সাথে ওই পাহাড়ি আদিবাসীদের সম্পর্কের যাবতীয় ফাটলের জন্য একমাত্র দায়ী। বুধিয়া স্কুল পাশ করে রাউরকেল্লা কলেজে ভর্তি হল। ঠিক তারপর থেকেই ওর ভেতর একটা পরিবর্তন হতে শুরু করল। মনে হয় কলেজে কেউ ওর মগজ ধোলাই করেছিল। কোনও আদর্শবাদী দলের সব নীতিকথা ওর মস্তিষ্কে গুঁজে দেওয়া হয়েছিল। ও তলে তলে অনেক আদিবাসীকেই নিজের দলে টানতে শুরু করল। কিছু মেয়েও ওদের দলে ভিড়ল। তুই তো জানিস, ওর ছোটোবেলা থেকেই ধূর্ত শিকারির মতো প্রখর চোখ। বিজলিকেও হাত করে নিল মগজ ধোলাই করে। শুনেছি ওরা সবাই নাকি এক নিষিদ্ধ সংগঠনে যোগ দিয়েছে। এখন ওরা ওই পাহাড়ে জঙ্গলে লুকিয়ে থাকে। পুলিশ ওদের খুঁজছে। তাই ওপর থেকে তুই কিছুই বুঝবি না। ক’দিন থাকলেই সব টের পাবি, চারদিক থমথম করছে। সেই অনাবিল আনন্দ আর নেই রে…

আমি সব শুনে বাকরুদ্ধ। শুধু একটা ঢোঁক গিলে বললাম, ‘তার মানে আদিবাসীদের গ্রামে যাওয়া যাবে না?”

—তুই কলকাতা থেকে এত আশা করে এসেছিস। কী বলি বল! তবে গেলেও বেশি রাত করা যাবে না। সাবধানে তাড়াতাড়ি ফিরে আসতে হবে।

ক্রমশ…

 

বুদি

অনেকক্ষণ ধরে স্কুলের বড়ো গেটটার বাইরে, ভাই ও ঝুপড়ির কতগুলো ছোটো ছোটো ছেলেমেয়ের সাথে দাঁড়িয়েছিল চোদ্দ বছরের বুদি। বছর চোদ্দো হলেও বুদিকে যুবতি বলে ভুল হয়। অনেক ‘শিক্ষিত’, ‘সভ্য’ বাবুরাও মশকরা করে বলে— ‘ঝুপড়ি ঘরে এত সুন্দর একটা ‘মাল’ কীভাবে পয়দা হল মাইরি। মা-টা বোধহয় কোনও বাবুর ঘরে…’

এই সুবাদে স্কুলে মাঝেমধ্যেই কাজের সুযোগ পায় বুদি। মাস্টার, ক্লার্কদের চা-টা এনে দিয়ে দু’চার পয়সা বকশিস পায়। মাস্টারদের লোভাতুর চোখ বুদির উপর থাকলেও, পেশাগত অবস্থান চিন্তা করে তেমন কিছু একটা করে উঠতে পারে না তারা। তবে অশিক্ষক কর্মীরা মশকরা করতে ছাড়ে না। এইটুকু জীবনেই বুদি বুঝে গেছে, এইটুকু মশকরা মেনে না নিলে আয় বন্ধ, পিতৃহীন সংসার চলবে না। রুগ্ন মা ও ছোটো ভাইয়ের একমাত্র অবলম্বন সে।

আজ ২৬ জানুয়ারি। এই স্কুলের একটা আভিজাত্য আছে। স্কুলেরই প্রাক্তন মস্তান ছাত্র বর্তমানে এমএলএ হয়েছেন। তিনি নিজের স্কুলে পতাকা তুলে স্কুলকে গৌরবান্বিত করবেন। অন্যান্য বার পতাকা তোলার আগে একপ্রস্থ চা দিয়ে দু’একটা মিষ্টির প্যাকেট পায় বুদি। এবার এমএলএ আসবেন। ‘দেশপ্রাণ জননেতা’র সিকিউরিটির জন্য বুদিদের গেটের বাইরে আটকে দেওয়া হয়েছে। বুদি এতসব বোঝে না, প্যাকেটের লোভে দাঁড়িয়ে থাকে। ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েগুলোও চকোলেটের আশায় থাকে।

যথা সময়ের দু’ঘণ্টা পরে এমএলএ এসে পতাকা উত্তোলন করেন। শিশুদের মঙ্গল কামনায় দুর্দান্ত মানবতার ভাষণ দিয়ে অনুষ্ঠানের সমাপ্তি হয় ৷

শিক্ষকরা চলে গেছেন। টুকিটাকি কাজের জন্য অশিক্ষক কর্মী, ডেকোরেটাররা মাঠে ঘোরাফেরা করে। অশিক্ষক কর্মীরা বুদিকে ডাকে। বলা হয় মাঠ থেকে চায়ের কাপ, মিষ্টির প্যাকেটগুলো তুলে বাইরে ফেলে দিতে।

বুদি ক’টা টাকার লোভে চায়ের কাপ, প্যাকেট জড়ো করতে থাকে। কোনও যুবতির দেওয়া ঢিলেঢালা, মাপে বড়ো নাইটির ভেতর থেকে উঁকি দেয় বুদির প্রাকযৌবনের বিকশিত স্তন। লোলুপ দৃষ্টিতে দেখতে থাকে স্কুলের কর্মীরা। ‘সস্নেহে’ আদর করার অছিলায় বুদিকে কাছে টানে।

শীতের রৌদ্রোজ্জ্বল আকাশে উত্তুরে হাওয়ায় পতপত করে উড়ছে জাতীয় পতাকা। হঠাৎই জাতীয় পতাকাটি উড়ে এসে পড়ে বুদির গায়ে। জড়িয়ে যায় ওড়নার মতো। কেউ বুঝতে পারে না কীভাবে খুলে গেল জাতীয় পতাকা, উড়ে রক্ষা করল সরল বুদির সম্ভ্রম। শিক্ষিত অশিক্ষক কর্মীরা অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, দাঁড়িয়েই থাকে….।

মণিদা আমি এলাম (শেষ পর্ব)

শেষ পর্ব

অমরেশ অবশ্য থাকে সব সময়ই ওর হাতের নাগালে। ওকে কাল থেকেই কাজে শামিল করে নিতে হবে। এমনিতেই অমরেশ তিওয়ারি পত্রিকার কার্যনির্বাহী সহ-সম্পাদক৷ কাজেই কোনও সমস্যা নেই। কালই স্ক্রিপ্টগুলো ডিটিপি-র জন্য অমরেশকে দিয়ে বাবুলের কাছে পাঠিয়ে দেবে। বাবুল-ই ওদের সমস্ত ডিটিপি করে থাকে। ও জানে কীভাবে কী করতে হয় এবং মোটামুটি ঠিকঠাকই করে। এখন দেখা যাক সকালে অমরেশ কখন হাজির হয়।

বেলা দশটা নাগাদ অমরেশ এল। করিতকর্মা ছেলে। ব্যাটার খরচের হাতটা একটু বেশি, তবে নিজের পকেট বাদ দিয়ে। মণি ওটা দেখেও দেখে না। কারণ জানে কিছু কিছু জিনিস মেনে নিতে হয়। কাল ও বাবুলকে ভালো করে বুঝিয়ে দেবে। বাবুলকে কাজে লাগিয়ে তবেই ফিরবে। প্রায় সারাদিন ওখানেই কাটাবে। চা টিফিন দুপুরের খাবার সব মণির পকেট থেকে যাবে। কিন্তু কাজ দিয়ে নিশ্চিন্ত। ফেরার সময় কাজের কতটা কী হল জানিয়ে যাবে। সারাদিনের রাহা ও খাই খরচটুকুও চেয়ে নেবে। ভালো ছেলে। কথা শোনে। মোটামুটি মাসখানেক লাগবে বলেছে ডিটিপি হাতে পেতে। অবশ্য যেমন যেমন শেষ হবে এক এক করে কবি লেখকদের কাছে পৌঁছে যাবে প্রুফ দেখার জন্য। ফাইনাল হলে প্রেসে যাবে।

বাঁকুড়া আর সিউড়ির দু’টো প্রুফ ক্যুরিয়ারে পাঠাবে, ওরাও আবার প্রুফ দেখে রিটার্ন ক্যুরিয়ারে মণির কাছে পাঠিয়ে দেবে। কাছেপিঠের পাঁচজনের কাছে তো মণি নিজেই যাবে আবার নিয়েও আসবে, বলাই বাহুল্য। মানে দশদিনের জন্য চা টিফিন দুপুরের খাওয়া দাওয়া ফ্রি — ভাবা যায়! মণির মনে এখন যেন কোটি টাকার লটারি পাওয়ার আনন্দ, ডগমগ করে ফুটছে। এবার তো পোয়াবারো কারণ সাত সাতখানা বইয়ের প্রত্যেক কবি লেখকরা তাদের মণিদাকেই উৎসর্গ করছে। মণির আলতো অনিচ্ছা — এই এটা আবার আমাকে কেন আমাকে কেন…! ধোপে টেকেনি। কিন্তু মনে মনে ভীষণ খুশি।

সময় তো নয় যেন ভরা বর্ষার জলস্রোতের দামোদর। হু হু করে বয়ে যাচ্ছে। দেখতে দেখতে অমরেশ তিওয়ারির তাগাদার পাল্লায় পড়ে পঁচিশে বৈশাখের দিন পনেরো আগেই সব বই এখন মণির জিম্মায়। মণি দেখে নিয়েছে প্রোডাকশন লা জবাব! প্রত্যেক লেখক কবিকে একটা করে কপি পাঠিয়ে দিয়েছে। মলাট উন্মোচনের পর বাকি কপিগুলো হ্যান্ডওভার করবে। কিন্তু মণির কড়া শর্ত অন্তত ওই সাতজন কবি লেখকদের প্রত্যেককেই যুগলে উপস্থিত থাকতে হবে। কেউ না করেনি, সবাই সম্মতি জানিয়েছে একবাক্যে। মণির উত্তেজনা প্রত্যেক দিন একটু একটু তুঙ্গে উঠছে পঁচিশে বৈশাখ যত এগিয়ে আসছে। অবশ্য অমরেশ সব সময়ই আছে ওর ছায়াসঙ্গী হয়ে। এটাই যা রক্ষে। পেমেন্ট থেকে টাকা পয়সার হিসাব রাখা ব্যস্থাপনার সিংহভাগ অমরেশের নিয়ন্ত্রণে। যদিও মণির ডেরা থেকেই ঘটছে সবটাই এবং অবশ্যই তার সম্মতিক্রমে।

পঁচিশে বৈখাশ মঞ্চের উপরে সাজানো চেয়ার টেবিল। রবি ঠাকুরের একটা বড়ো বাঁধানো ছবি। ফুলমালা ধূপধুনো প্রদীপের সমারোহে। রবীন্দ্রগান দিয়েই সভার উদ্বোধন। তারপর রবীন্দ্র কবিতা আবৃত্তি ছোটো বড়ো সকলের জন্য। আজকের সভার প্রথম চমক ছিল মঞ্চের উপরে — যেখানে সব নতুন কবি লেখকরা সভা আলোকিত করলেন। না কোনও কেউকেটা নেই। মণি এখন তিতিবিরক্ত হয়ে গেছে কেউকেটাদেরকে সামাল দিতে দিতে। ব্যাটাদের হাজার বাহানা। তার ওপর পান থেকে চুন খসার যো নাই। এই মারে কি সেই মারে। বিরুদ্ধতায় নেমে পড়বে গালিগালাজ করতে করতে। পরিবর্তিত সময়ের প্রয়োজনে মণি এখন তাই নতুনদের উপরই ভরসা রাখছে। উপস্থিত সমবেতের অনেকেরই চোখে মুখে জিজ্ঞাসা উপচে পড়ছে — বইগুলোর মলাট উন্মোচন কারা করবেন? সে রকম কাউকেই তো চোখে পড়ছে না। মণি মুচকি হেসেছে। সময়ে জানতে পারবে। একটু সবুর করো না ভাই, আছো তো এখন! অত তাড়া কিসের?

এবার মলাট উন্মোচনের সময়। মণি মাইক হাতে একে একে মঞ্চে ডেকে নিলেন অজানা পাঁচজন পুরুষ ও দু’জন মহিলাকে৷ দর্শক তো অবাক। আরে এরা কারা? এদেরকে তো আগে কখনও কোনও সভায় দেখিনি, নাম শোনা তো দূরের কথা।

মণি আবেগপ্লুত গলায় বলতে শুরু করল— জানি আপনাদের এখন অনেক প্রশ্ন, মঞ্চে উপবিষ্ট এই সাতজন যারা আজ মলাট উন্মোচন করবেন। তবে শুনুন, এনারা সেই মানুষজন যাদের প্রতিদিনের যাপনের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে এক একজন কবি লেখকের উত্থানকথা। এদের সক্রিয় ও হার্দিক সহযোগিতা ছাড়া উদীয়মান এই সাতজন কবি সাহিত্যিকের চর্চার খবর আমরা কোনওদিনই জানতে পারতাম না। আজকের এই মঞ্চ যে আলোকিত, এ তাদেরই অমূল্য অবদান ধন্য। আহা, হাততালির কলরবে ফাটাফাটি সভাগৃহ! উপচে ওঠা উচ্ছ্বাস সভাস্থলের বাইরেও মুখরিত।

মণি প্রথমেই তনুকে ডেকে নিল মঞ্চে। তারপর সদর্পে ঘোষণা করল বইটির মলাট উন্মোচনের জন্য উপস্থিত, মাননীয় অনুপম নাগরাজ মহাশয় যিনি কবির হাজব্যান্ড, সাহিত্যপ্রেমী এবং সরকারি সংস্থার একজন উচ্চপদস্থ সফল আধিকারিক। আবার হাততালির রোল উঠল। মোবাইল ক্যামেরা ঝলসে উঠল, ভিডিও হল। বাপরে বাপ! অনুপম মনে মনে ভাবল — কে জানে শালা, সে যে এত কিছু সে কি নিজেই জানত নাকি কোনওদিন। মণি ঘোষাল মালটা তো খতরনাক আছে!

যাইহোক, তারপর একই ভাবে একে একে বাকি ছ’খানা বইয়েরও মলাট উন্মোচন হয়ে গেল। অমরেশ মঞ্চে উঠে উপস্থিত সকলকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে সভা সমাপ্তির ঘোষণা এবং একটু চা পান করে যাবার আমন্ত্রণ রাখল সবার কাছে।

মণি বাড়ি ফিরে এসে— আহা, লাখ দুয়েক টাকার ওমটা একটু স্পর্শ করে নেবার জন্যে তালা খুলে, বাক্সের ভিতর একদম ফাঁকা দেখে মাথায় হাত দিয়ে মাটিতে বসে পড়ল ধপাস করে।

কিছুক্ষণ পর একটু ধাতস্থ হলে ফোন করে অমরেশকে এক্ষুনি একবার জলদি আসতে বলল। কেন জিজ্ঞেস করাতে বিরক্ত হয়ে বলেছে— আসতে বলছি আয় না, অত কেন কিসের? আর এলেই তো জানতে পারবি। যত্তসব…

কয়েক মিনিটের মধ্যে অমরেশ হাজির। মণির দুঃখের কথা শুনে অমরেশের আর বলা কিংবা করারই বা কী আছে! নিশ্চুপ কয়েকটা সেকেন্ড কাটিয়ে, পিঁপড়েতে খেয়েছে বলে স্বগতোক্তি করতেই মণি বলল, “তুই কি কিছু বললি?”

—না না, পিছন ফিরে চলে যেতে যেতে অমরেশ বলল, মণিদা আমি এলাম। ভালো থেকো।

 

 

মণিদা আমি এলাম (পর্ব-৩)

পর্ব ৩

বাড়ি ফিরেই তনু ওর মণিদাকে ফোন করে জব্বর খরটা দিল। মণি তো আত্মহারা! লাফ দিয়ে বিছানা থেকে নামতে গিয়ে পা মচকে ফেলার জোগাড়। ভাবা যায় কড়কড়ে আড়াই লাখ জাস্ট আড়াই লাখ। খরচ খরচা বাদ দিয়ে আরামসে দেড় থেকে যাবে পকেটে। এত বড়ো দাঁও ওর জীবনে এই প্রথম।

—আরে মণিদা, কী হল শুনতে পাচ্ছ?

—হ্যাঁ হ্যাঁ বলো বলো….। হ্যাঁ নিশ্চয় নিয়ে আসবে সামনের রোববার। দেখবে ওদের যেন কোনও অসুবিধা না হয়। আর সঙ্গে করে ওরা যেন অবশ্যই নিজের নিজের লেখার স্ক্রিপ্টগুলো নিয়ে আসে। ওখান থেকেই ওরা কবিতা পাঠ করবে সাহিত্যবাসরে। আচ্ছা আচ্ছা ঠিক আছে রাখো। দেখা হবে। বাই।

কোমর থেকে আলগা হয়ে ঝুলে পড়া লুঙ্গিটার, অবস্থা মণি এতক্ষণ খেয়াল করেনি। ভাগ্যিস ঘরে একলা ছিল। একহাত জিভ কেটে মণি যথাস্থানে বেশ শক্ত করে লুঙ্গিটাকে বেঁধে নিল। অনেক দিন চিকেন খাওয়া হয়নি। মণি বাজারের থলি হাতে, গায়ে কোনওরকমে একটা ফতুয়া গলিয়ে হাওয়াই চটি ফটফট করতে করতে দ্রুত বেরিয়ে গেল।

রাতে অনেক দিন পর ভরপেট মুখরোচক খাবার খেয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তুলে সিগারেটে লম্বা একটা টান— আহা কী আনন্দ! সামনের সুখের দিনগুলোর কথা ভেবে মশগুল হয়ে রইল বেশ কিছুক্ষণ। তাহলে ভগবান এতদিনে মুখ তুলে চেয়েছেন। এখন শুধুই সুদিন আর সুদিন। সামনে শুধু আলো আর আলো। ‘তমসো মা জ্যোতির্গময়’– যাকে বলে! তবে আনন্দের আতিশয্যে সেই রাতটি তার নির্ঘুম গেল। তা যাক। এরকম নির্ঘুম এই রাত তার একটা অমূল্য অর্জন বলেই সে ভেবে নিল।

সারাজীবন এইরকম নির্ঘুম কেটে গেলেও তার আপত্তি নেই এখন। কত হেনস্থা, কত কটূক্তি, যাচ্ছেতাই অপমান— কত কিছুই যে তাকে হজম করতে হয়েছে। তার স্বপ্ন এই ‘আসানসোলের দিনরাত্তির’-র প্রকাশনা নিয়মিত রাখতে গিয়ে, তা তার চাইতে আর বেশি কে জানে!

বিজ্ঞাপন চাইতে গেলে দেবে তো না-ই উলটে আঁকাবাঁকা কত কথা শোনাবে। পত্রিকা কেউ কিনবে না। তার ওপর সৌজন্য সংখ্যা পাঠাতে হবে। ভালো লেখক কবিরা সাম্মানিক না দিলে লেখা দেবে না। আবার ভালো লেখা না থাকলে পত্রিকা বিক্রি হবে না। স্টলওয়ালারা বেশি কমিশন না পেলে বিক্রির জন্য স্টলেই রাখবে না। এত ‘না’ হলে কি আর পত্রিকা চালানো যায়! তবে এখন থেকে আর এই ক্রাইসিস থাকবে বলে মনে হয় না। জয় মা কালী দুগ্গা দুগ্গা।

পরের রোববার তনু-সহ পাঁচ বন্ধুই হাজির যথাসময়ে মণির সভা আলো করে। ওরা এক্কেবারে সামনের সারিতে। সাড়ে এগারোটা নাগাদ মণি হাতে মাইক তুলে নিয়ে সদর্প ঘোষণায় নতুন চার সদস্যের, মানে রূপা গোপা সীমা ও মণিকার উজ্জ্বল উপস্থিতি বরণ করে নিল। তারা প্রত্যেকেই মঞ্চে উঠে নিজের নিজের সংক্ষিপ্ত পরিচয় জ্ঞাপন করল।

মণি এরপর ভবিষ্যতের সাহিত্যের গতিপ্রকৃতির দিকনির্দেশ করার ক্ষেত্রে লিটল ম্যাগের অবদান সম্পর্কে একটা ভয়ানক জ্বালাময়ী বক্তিমে ঝাড়ল প্রায় আধঘণ্টার মতন। সভাস্থল ঘিরে তখন হুলুস্থুলু ভাবে হাততালির হুল্লোড়! কেউ কেউ আবার বলে উঠল, আহা, এই না হলে সম্পাদক! কী ভীষণ একখানা লেকচার দিল বটে!

তনু গোপা সীমা-রা তো অভিভূত। ওরা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করছিল যে মণিদার সাহিত্যসভায় ওদের অনেক আগেই জয়েন করা উচিত ছিল। যাক যা হবার তা হয়েছে। এখান থেকেই না হয় শুরু হল আজ। ওরা পাঁচজনের প্রত্যেকেই পাঁচটি করে স্বরচিত কবিতা পাঠ করে খুব খুশি। মণিদাও ওদের সকলের লেখার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছে। আনন্দে ডগমগ ওরা যেন হাতে এক একখানা করে আকাশের চাঁদ পেয়ে গেছে!

অনুষ্ঠান শেষে মণি ঘোষাল স্ক্রিপ্টগুলো চাইলে ওরা খুব কুণ্ঠিত হয়ে বলল— কয়েকটা দিন সময় চাই। লেখাগুলো একটু গুছিয়ে নিতে হবে। উলটো পালটা হয়ে আছে। কমপ্লিট হলেই আপনাকে খবর দেব। মণি বলল— আচ্ছা আচ্ছা ঠিক আছে। খবর পেলেই আমি নিজে গিয়ে নিয়ে আসব। তোমাদেরকে আসতে হবে না কেমন। চাপ নিও না তোমরা যতক্ষণ আমি আছি। আর আমি তো আছিই আছি।

মোটামুটি সপ্তাহ দু’য়েকের ভিতর মণি আলাদা আলাদা দিনে ওদের সবার বাড়ি বাড়ি গিয়ে স্ক্রিপ্ট সংগ্রহ করে গান্ডেপিন্ডে গেলাকোটা সেরে, তারপর সন্ধেনাগাদ ফিরে এসেছে। সাথে পঁচিশ পঁচিশ করে অগ্রিম নিতেও ভুল করেনি। মণি বাড়ি ফিরে অন্ধকার একটু গভীর হলে বিড়ি ফুঁকতে ফুঁকতে সোজা ছাদে। আকাশের তারাদের দিকে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে গুন গুন করে ‘ও আমার ময়না রে…’ গাইতে গিয়ে তালেগোলে গেয়ে উঠল— ‘ও আমার সোনার ডিম পাড়া হাঁস ৱে এএএ…..!’

যখন একটি দু’টি তারা খসে পড়ল ঠিক পায়ের পাশটিতে। তারার আলো যে এত তরল হয় সে আগে জানত না। পা-টা কেমন যেন একটু হালকা ভিজে মতন বোধ হতেই তার মোহাচ্ছন্ন ভাবের ঘোরটা যাকে বলে এক্কেবারে ঘেঁটে ‘ঘ’ হয়ে গেল।

সিউড়ি আর বাঁকুড়ার দু’টো নিয়ে মোট সাত সাতখানা বইয়ের ডিটিপি এবং প্রিন্টিং-এর কাজে নেমে পড়তে হবে কাল থেকেই। প্রেসের সঙ্গে কথা হয়ে গেছে। ডিটিপিও হয়ে যাবে, তারপর প্রুফ দেখা। প্রচ্ছদ সাতটা তো আগেই এসে গেছে। করেছেন প্রখ্যাত কিন্তু নিতান্ত প্রচারবিমুখ শিল্পী মণির অন্তরঙ্গ একদা শান্তিনিকেতনি আপাতত কলকাতাস্থিত ব্যাংক ম্যানেজার শুক্রাচার্য সান্যাল।

ক্রমশ…

 

মণিদা আমি এলাম (পর্ব-২)

পর্ব ২

মণি ঘোষাল গল্প কবিতার বাঘ-সিংহ-ভল্লুক সব একসাথে। কলম দিয়ে কলকল করে কাব্যি ছোটে ঝরনাধারার মতো। এককালে তার নাকি দুর্ধর্ষ এক গুরু সঙ্গ হয়েছিল। ওর মতো আর কেউ নাকি গুরুকে তেমন করে পায়নি। আর গুরুও মণি বলতে অজ্ঞান ছিল। তা সেই গুরুই একদিন সত্যি সত্যিই মণির একটা কবিতা পড়তে গিয়ে গোঁ গোঁ শব্দ করতে করতে মুখে লালা উঠে এই মরে কি, সেই মরে অবস্থা! অন্য যারা ছিল তারা গুরুকে হাসপাতালে গ্যারেজ করাতে কোনও মতে সে যাত্রা গুরুর পঞ্চত্বপ্রাপ্তি হয়নি।

তা মণি নাকি কবিতার কাটাছেঁড়ায় অদ্বিতীয়ম বলে মনে করে নিজেকে। এটাকে সে তার গুরুর দান বলেই ভাবে। কবিতার নাড়িভুঁড়ি ঘেঁটে সে তার পেটের কথা বার করে নিয়ে আসবে। হুঁ হুঁ বাবা কারওর নিস্তার নেই! বিটকেল হিংসুটে সতীর্থরা বলে— ও ব্যাটা নিজে কোনওদিন একটা সম্পূর্ণ কবিতা লিখতে পারেনি আজ পর্যন্ত। আর সে করে কিনা সমালোচনা! কালে কালে কতই হল, পুলি পিঠের ল্যাজ গজাল। যাইহোক, তা বলে সাহিত্যচর্চায় অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ সংবর্ধনা পাওয়াতে কোনও ঘাটতি ছিল না, আর এগুলো সে পেয়েছে ঠিক তারই মতন অন্যান্য সব সম্পাদকদের থেকে।

এখন নভেম্বর। হালকা শীতের আমেজ পোশাক চুঁইয়ে শরীর ছুঁয়ে দিচ্ছে শিরা উপশিরা ছাড়িয়ে অন্তরে অন্তরে। সামনের এপ্রিল আসতে হাতে আর মাস পাঁচেক মতন। সামনের পঁচিশে বৈশাখে এবার অন্তত পাঁচখানা বই প্রকাশ করতেই হবে। তবে মলাট উন্মোচনে এবার এমন সব আনকমন এক একজন থাকবে না, যা দেখে সবাই চমকে (পড়ুন ঘাবড়ে যাবে! মণি ওর ফিল্ডের পাকা মাথার লোক। টিকে থাকতে হলে যা যা করার দরকার, সবই করে সাধ্যমতো এবং পরিকল্পনা মাফিক।

একটা নেটওয়ার্ক ভালো মতন তৈরি করেছে আশেপাশের দু’তিনটে জেলা জুড়ে। সেখানের বিভিন্ন অঞ্চলে এক একজন কবি সাহিত্যিক রিপ্রেজেন্টেটিভের কাজ করে। তারা নতুন লেখক জোগাড় করে, প্রকাশিত বই পুশসেল করে। মণি অবশ্য পরিশ্রম করে যথেষ্ট। ফোনে যোগাযোগ তো থাকেই তাছাড়াও মাঝেমধ্যে ওইসব জায়গায় গিয়ে সাহিত্যবাসরও বসায়। দরকার হলে এক আধদিন থেকেও যায় সেখানে। দূরের কবি সাহিত্যিকরাও মণির আসানসোলে আসে। বিশেষ করে ফেব্রুয়ারি মার্চ নাগাদ দু’দিন ব্যাপী চলা আসানসোল লিটলম্যাগের মেলাতে তো আসবেই আসবে। আপাতত তিনটে বইয়ের মেটেরিয়াল প্রায় হাতের মুঠোয়। এখানকার বলতে তনুরটা আর বাকি দু’টোর একটা সিউড়ি আর একটা বাঁকুড়ার। এর মধ্যে একটা ছোটোগল্পের সংকলন, অন্য দু’টি কবিতার।

ফেসবুকে লেখার সূত্রে এখন অনায়াসে অনেকের সুপ্ত প্রতিভা ফেটে বেরোতে পারছে জনসমক্ষে। মন্দ না। যেমন সেদিন দেখলাম একজন লিখেছেন— বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর নদেয় এলো বান/ আমার বর দেখতে এমন যেমন জাম্বুবান। অথবা, সেদিন গোধূলিবেলা/ তোমার রাঙা ঠোঁটে আমার ওষ্ঠ চকাম চকাম করিছে খেলা। ইত্যাদি ইত্যাদি।

মণি মূলত ফেসবুক ঘেঁটে এই জাতীয় কবি লেখকদেরকে ট্যাপ করে। প্রথমে মেসেঞ্জারে প্রশংসা তারপরে ফোন, তারপর সোজা কবির বাড়িতে হানা। মহিলা কবি হলে তো সোনায় সোহাগা। বরের সামনে বউ-কবির কবিতার ফাটিয়ে প্রশংসা। দুপুরে গান্ডেপিন্ডে খাওয়াদাওয়া তারপর একটা জম্পেশ ঘুম। বিকেলে স্ন্যাক্স সহযোগে চা সাঁটিয়ে খানকতক কবিতা ব্যাগে পুরে নিয়ে চলল মদন। তনুকে মণি এভাবেই কবি বানিয়েছে। তনু বলেছে ওর কয়েকজন বন্ধুও লেখালেখি করছে ফিলহাল। মণি বলেছে— তা ওদেরকেও পরের কবিতা পাঠের আসরে নিয়ে এসো না। তনু রাজি হয়েছে বলেছে, দেখি যোগাযোগ করে। আপনাকে জানাব। তনু, ওর বন্ধু মানে রূপা গোপা সীমা আর মণিকার সাথে ফোনে কথা বলেছে। ওরা খুবই আগ্রহী।

একদিন রোববার বিকেলে বিগবাজারে, ওদের সবার সঙ্গে সপরিবারে হঠাৎই দেখা হয়ে গেল। আর যায় কোথা! ওরা সবাই যে যার বরকে কেটে পড়তে বলল। তারপর সোজা চারতলার ফাঁকা একটা খাবার দোকানের একটি টেবিল দখল করে পাঁচটা ঠান্ডা পানীয় নিয়ে গল্পে মেতে উঠল।

বেচারা বরসকল একটা চায়ের দোকানে মাটির ভাঁড়ে চা আর মুখে সিগারেট নিয়ে হোস্টেল জীবনের স্মৃতিচারণে মিনিট কুড়ি পঁচিশ কাটিয়ে যে-যার মতন যাবার তোড়জোড় করছে, ঠিক তখনই তনুর বর বলল, ‘জানিস তো তনু লেখালেখি করছে। কিছু টাকা গচ্চা যাচ্ছে বটে তবে শালা মুক্তি পেয়েছি বলতে পারিস একরকম। কাজকম্ম নেই শুধু ভুলভাল বকত আর আমার মাথা চেটে সাফ করে দিত। এখন মাঝে মধ্যে দু’একটা আগডুম বাগডুম লেখা শুনে বাঃ বাঃ বলে দিলেই ছুটি।’

বাকিরাও সবাই বলল— বাব্বা তুমি একা নও আমরাও তোমার মতনই ওই একই পথের পথিক। তবে এখন আছি বিন্দাস কিন্তু বস! বেঁচে থাকুক ওদের সাহিত্য সংস্কৃতির চর্চা— তাতে যদি হয় হোক আমাদের খরচা। তনুর বর অনুপম বলল— আরিব্বাস বস তুমিও তো দেখছি কাব্যি করে কথা বলছ, কী ব্যাপার রূপার ছোঁয়া লেগেছে মনে হচ্ছে।

বিরূপাক্ষ প্রবল প্রতিবাদ জানিয়ে বলে উঠেছে— আরে না না… ওটা বাইচান্স মিলে গেছে, এই আর কি!

—আমি? তাও আবার কাব্যি! বাংলায় প্রায় ফেল মারতে মারতে পাশ করে গেছিলাম হায়ার সেকেন্ডারিতে কোনওরকমে।

এদিকে তনুদের আড্ডা জমে উঠেছে। তনু বলল— হ্যাঁরে তোদের চারজনের লেখা কবিতা আমি ফেসবুকে পড়েছি। তোরা কী ভালো লিখিস রে৷ ফেসবুক না থাকলে তো কোনওদিন জানতেই পারতাম না। এই শোন তোদেরকে না বলা হয়নি, জানিস তো আমার না একটা কবিতার বই বের হচ্ছে।

—ওহ তাই নাকি তাই নাকি। তা কবে?

—মণিদাই সব করছে। এই সামনের পঁচিশে বৈশাখ। শোন না মলাট উন্মোচনের দিন কিন্তু আমি তোদের সবাইকে অনুষ্ঠানে চাই।

রূপা বলল— আচ্ছা, দিদি কমপক্ষে কতগুলো কবিতা হলে একটা বই করা যেতে পারে?

—অতটা তো জানি না। তবে আমারটা করতে মণিদা সত্তর থেকে বাহাত্তরটা দরকার বলেছে। তা’ তুই বের করবি নাকি একটা?

—হ্যাঁ দিদি হতে পারে। আমার স্টকে এখনই প্রায় সত্তর আশিটা হয়ে যাবে।

—বলিস কী রে? তাহলে করে ফেল। মণিদাকে বলি ?

—দাঁড়াও। দু’টো দিন ভেবে নিই। তা খরচ খরচা কেমন গো?

—তেমন কিছু না। ওই পঞ্চাশ মতো সাকুল্যে!

গোপা সীমা মণিকাও ততক্ষণে জেগে উঠেছে। তাহলে তো অতগুলো কবিতা আমারও আছে। আমারও আছে করে কলকল করে উঠল ওরা সকলে।

তনু বলল— থাম থাম। ধীরে। এক কাজ কর তোরা। সামনের সপ্তাহে একটা সাহিত্যবাসর হচ্ছে। চল না তোরা। মণিদা এমনিতেই বলেছে আগ্রহী বন্ধুদেরকে নিয়ে যেতে। রেডি থাকিস বেলা এগারোটা নাগাদ আমি তোদের প্রত্যেককে বাড়ি থেকে তুলে নেব আমার গাড়িতে। তোদের সবাইকে আর আলাদা করে গাড়িতে যেতে হবে না। তাহলে ওই কথাই রইল। ততক্ষণে তো ওদের সবার মনে ওই যাকে বলে লাড্ডু ফুটতে আরম্ভ করেছে।

ক্রমশ…

চোখ টেপা মেয়ে (পর্ব ২)

শনিবার বিকেলে ওদের শর্ট লিস্টের শেষ মেয়েটিকে দেখতে ক্যাবে করে ওঁরা এসে হাজির হলেন সিরিটিতে প্রফুল্ল সেন কলোনির দেড়তলা একটা বাড়িতে। যারা ওঁদের অভ্যর্থনা করে বাইরের ছোটো ঘরটিতে বসালেন, তাঁরা সম্পর্কে মেয়ের দাদা বউদি। মেয়ের বাবা মারা গিয়েছেন বছর খানেক আগে। মা একটু মোটার দিকে, জর্দা দিয়ে পান খাবার অভ্যেস। কেতকীকে উনি সাদর আমন্ত্রণ জানালেন পান সেবন করার জন্য কিন্তু কেতকী হাত জোড় করে জানালেন ও রসে তিনি বঞ্চিত।

প্রথম নজরেই কাকলিকে অপছন্দ করে বসলেন কেতকী। মুখটা একটু চ্যাপটা ধরনের, রং শ্যামলা বলা চলে আর চোখদুটো ছোটো। শাড়ি না পরে চিকনের কাজ করা সালোয়ার কুর্তা পরে ও কি নিজেকে স্মার্ট বলে জাহির করতে চায় ওর ভাবি শ্বশুড়- শাশুড়ি আর বরের সামনে? থার্ড ডিভিশানে যে-মেয়ে পাস কোর্সে বিএ পাশ করেছে তার চাকরি জুটবে কী করে? তাই ছাতের ঘরে দুই ব্যাচে গোটা দশেক পাড়ার বাচ্চাকে পড়িয়ে নিজের হাত খরচাটা উঠিয়ে নেয় কাকলি।

মেয়ের দাদা বিকাশ কুঁদঘাটার একটা শাড়ির দোকানে সেল্সম্যান। এই পরিবারের মাসিক আয় যে পনেরো হাজার টাকার উপরে হবে না— সেটা বুঝতে অবিনাশ এবং কেতকীর কোনও অসুবিধে হল না। এই পরিবারের যা আর্থিক অবস্থা তাতে এ ঘরে বিয়ে হলে মেয়ের হাতে, গলায়, কানে পরাবার মতো গয়নার ব্যবস্থা ওরা করতে পারবে কিনা তাতে সন্দেহ জাগতেই পারে কেতকীর মনে!

কাকলিকে শর্ট লিস্টে রাখার পেছনে অরিত্র আর আবিনাশবাবুর একটাই যুক্তি ছিল— চোখে মুখে বুদ্ধির ছাপ আছে মেয়েটার। শুধু ওদের দু’জনের সন্মান রক্ষা করতেই চায়ের কাপটা হাতে তুলে নিয়ে কেতকী জানতে চাইলেন ও রান্নাবান্না জানে কিনা৷ কাকলি সরাসরি কেতকীর মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, বিয়ের পর ও কাজটা তো সব মেয়েকেই করতে হয় মাসিমা। কিন্তু আমরা তো বাঙাল, আমার রান্না কি আপনাদের পছন্দ হবে?

কাকলির বউদি শম্পা আগ বাড়িয়ে বললেন, ‘কেন তুই তো ঘটিদের রান্নাও জানিস। বিউলির ডাল আর আলুপোস্ত করে খাওয়ালি সেদিন, খুব ভালো হয়েছিল।’

—সে আমাদের রান্না না হয় শিখিয়ে নেওয়া যাবে, বললেন কেতকী। আর বেশি সময় দিতে রাজি নন উনি এ দারিদ্র্যক্লিষ্ট পরিবারের সঙ্গে। ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন, “তোর কিছু জিজ্ঞেস করার থাকলে এই বেলা জিজ্ঞেস করে নে খোকা। আমাদের আবার শপিং করতে যেতে হবে তো।’

অরিত্র মাথা তুলে ওর দিকে তাকাতেই ওকে চোখ মারল কাকলি। অরিত্র প্রথমে ভাবল মেয়েটা হয়তো একটু ট্যারা তাই… কিন্তু মেয়েটা যেভাবে ওর দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসল তাতে বুঝল, ও ভুল দেখেনি। আশ্চর্যের ব্যাপার ওর বাবা-মা কেউই লক্ষ্য করেননি মেয়েটার এই শরারতি।

গেস্টহাউসে ফিরে খাওয়াদাওয়া সেরে মা-বাবা টিভির সামনে বসে গেলেন আর অরিত্র চলে গেল ব্যালকনিতে। পথে আসতে আসতেই মা জানিয়ে দিয়েছিলেন বেলেঘাটার মেয়ে শুভমিতাকেই ওঁর পছন্দ আর বিয়ের ব্যাপারে বাবার নয়, মার পছন্দটাই যে শেষ কথা, সেটা অরিত্রও ভালো ভাবেই জানে।

শুভমিতাকে অরিত্র-র খারাপ লাগেনি, খারাপ লাগেনি বাগুইআটির বর্ণালিকেও। ওদের দু’জনেরই কিছু গুণ এবং ক্ষমতা আছে যা হয়তো তার নেই। অরিত্রর মনে হয় বিয়ের জন্য মেয়ে দেখা ব্যাপারটাই একটা মধ্যযুগীয়, কুৎসিত সামাজিকপ্রথা কিন্তু একটি মেয়েকে ভালোবেসে বিয়ে করার জন্য যে সাহস, সময় এবং উদ্যোগের প্রয়োজন তা কোনওদিনই খুঁজে পায়নি অরিত্র। আর সেই জন্যই এই নোংরা প্রথাটাকে মেনে চলতে হচ্ছে ওকে।

কিন্তু কাকলি নামের মেয়েটি তাকে চোখ মেরে বসল কেন? ও কি তাকে ঠাট্টা করল মা বাবার সঙ্গে মেয়ে দেখতে এসেছে বলে? নাকি ওর অন্য কোনও মতলব আছে? অনেক রাত পর্যন্ত কাকলির চোখ টেপার পিছনে কী হেঁয়ালি আছে বুঝবার চেষ্টা করে ঘুমিয়ে পড়ল অরিত্র।

পরের দিন সকাল ন’টা নাগাদ ফোনটা এল অবিনাশবাবুর কাছে। কেতকী তখন বাথরুমে৷ ‘ও হ্যাঁ, ও কাছেই আছে, দিচ্ছি ওকে।” অবিনাশবাবু মুচকি হেসে মোবাইলটা এগিয়ে দিলেন অরিত্রর দিকে। ‘নাও কথা বলো কাকলির সঙ্গে’, অবিনাশবাবু বললেন গলা খাটো করে। ‘হ্যাঁ বা না বলার দরকার নেই এখন।’

অরিত্র ভাবতে পারেনি কাকলি ওকে সরাসরি ফোন করবে। ‘হ্যালো’ বলতেই কাকলি বলল, ‘অবাক হয়েছেন নিশ্চয়ই, বুঝতে পারছি। আপনার সঙ্গে আমি একটু কথা বলতে চাই— ফোনে নয়, সাক্ষাতে। কখন কোথায় আমার সঙ্গে দেখা করতে পারবেন যদি বলেন।’

—বিকেলে আমাদের ফ্লাইট, কাজেই দেখা করতে হলে এখনই দেখা করতে হয়, অরিত্র বলল। কিন্তু আপনি তো সিরিটিতে থাকেন আর আমি এখন সল্টলেকে।

—নো প্রবলেম। মাঝামাঝি কোনও জায়গায় দেখা করতে পারি আমরা। আমি যদি মেট্রোতে পার্ক স্ট্রিট এসে যাই?

—তাই করুন। পার্ক হোটেলের সামনেই দাঁড়াবেন। সাড়ে দশটা, ঠিক আছে?

—একদম। অনেক ধন্যবাদ।

                                                                                                                                        চলবে…

হনন (শেষ পর্ব)

শেষ পর্ব

শ্রীর সঙ্গে প্রতি পদে পদে ঝগড়া ও আপস করে করে ধুঁকতে ধুঁকতে জীবন কাটতে থাকে বিতানের। শ্রীর জন্য দামি দামি শাড়ি, গয়না, দামি কসমেটিক, পারফিউমের জোগান দিতে দিতে কখনও কখনও তার পকেটের অবস্থা শোচনীয় হয়ে যায়। সমতা রক্ষা করতে পারে না অনেক সময়। সহ্য করতে না পেরে একদিন ফোন করে ফেলল শ্বশুরমশাইকে।

—নিজের লুকস আর আমাকে ঘিরে শ্রীর অবসেশন যে রোগের পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। প্লিজ কিছু করুন, বাবা।

—না না, বাবা। মা মরা মেয়ে তো। আদরে আদরে মানুষ। একটু জেদি হয়ে গেছে। তুমি ওকে একটু সামলে রেখো। চিন্তা কোরো না সব ঠিক হয়ে যাবে একদিন।

ফোনের ও প্রান্তে কাঁদতে থাকেন পঁয়ষট্টি বছরের বৃদ্ধ। মুখে আর কোনও কথা সরে না বিতানের। বাড়িতে মাকে কিছু বললে মা-ও সেই একই কথা বলে, ‘ঠিক হয়ে যাবে।’ বন্ধু আবারও বলে, ‘এ যুগের মেয়ে। মানিয়ে নিতে হবে রে, ভাই। তোকে খুব ভালোবাসে। চোখে হারায়। ভালোই তো।’

ভালো আর কিছুতেই হয় না বিতানের জীবনে। এভাবেই চলতে থাকে প্রতিটা দিন। ভিতরে ভিতরে ক্ষয়ে যেতে থাকে সে। নিজেকে যেন শ্রীর ব্যক্তিগত সম্পত্তি ছাড়া আর কিছুই মনে হয় না। রাতে ঘুমের মধ্যেও শ্রীর এই ভয়ানক অবসেশন তাড়া করে ফেরে তাকে! নিজের জীবনটা যেন আঁজলা গলে বেরিয়ে যেতে থাকে ধীরে ধীরে।

এই করতে করতে প্রথম বিবাহবার্ষিকী এগিয়ে আসে বিতান আর শ্রীদর্শিনীর। খুব ধুমধাম করে উদযাপন করবার পরিকল্পনা নেয় তারা। আত্মীয়, বন্ধু-বান্ধবকে নিমন্ত্রণ করবার লিস্ট তৈরি হয়। কিন্তু লিস্ট দেখে প্রথমেই বাদ সাধে শ্রী, ‘তোমার মায়ের বান্ধবী রঞ্জনামাসিকে নিমন্ত্রণ করা যাবে না। ওঁর মেয়ে রনিতা খুব সুন্দরী, না? তোমার সঙ্গে তো ওর বিয়ের কথা হয়েছিল, অ্যাম আই রাইট? পুরোনো প্রেম চাগাড় দিক আর কি! আর তোমার অফিসের ওই দুই সুন্দরী মৃদুলা আর সেবন্তীও বাদ কিন্তু…’

—শোনো না, আমার কিন্তু অ্যানিভার্সারির গিফটে হিরের দুল চাই। হঠাৎ একেবারে প্রসঙ্গান্তরে গিয়ে আদুরে গলায় বলে ওঠে শ্রী। প্রথম অ্যানিভার্সারিতে শ্রীকে সোনার কোনও গয়না দেবে ভেবে রেখেছিল বিতান। হিরের গয়নার কথা ঠিক ভাবেনি। এটা তার বাজেটের বাইরে।

রঞ্জনামাসিকে নিমন্ত্রণ লিস্ট থেকে বাদ দেওয়ায় বিতান বোঝে মায়ের মনটা খারাপ হয়ে গেছে। কিন্তু বউমাকে খুশি করতে মুখ ফুটে মা কিছুই বলে না। বিতান শ্রীর মতের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গেলে সে না খেয়েদেয়ে কান্নাকাটি করে হত্যে দিয়ে পড়ে থাকে। সেই রাতেই ব্লেড দিয়ে হাত কেটে সে ভয়ানক এক হুলস্থুল কাণ্ড বাঁধাল। শেষপর্যন্ত শ্রীর সব কথাই তাদের মেনে নিতে বাধ্য হতে হল। ধুঁকতে ধুঁকতে বাঁচতে থাকে বিতান। মাঝে মাঝেই নিজেকে শেষ করে দেবার আগুনে-ইচ্ছে জেগে ওঠে তার মনে!

অনুষ্ঠানের দিন কয়েক আগে শ্রীর আবদারে অফিস থেকে ছুটি নেয় বিতান। শপিং-এ যাবে সে। দুপুরের ঠিক আগে আগে দু’জনে বেরিয়ে যায়। উদ্দেশ্য শপিং করে বাইরে কোথাও লাঞ্চ সেরে একেবারে বাড়িতে ফিরবে। পাঁচতলা বিখ্যাত বস্ত্রবিপনি সংস্থায় ঢোকে তারা। দোকানের মালিক বিতানের বাবার আমল থেকে পরিচিত। সাদরে অভ্যর্থনা জানায় তাদের। নিজের আর বিতানের পোশাক পছন্দ করতে শুরু করে শ্রী।

নিজের জন্য তুলে নেয় মটকা সিল্কের হাত বাটিক, র’তসরের ব্লক প্রিন্ট, স্ট্রাইপড কাতান, বিষ্ণুপুরী সিল্কের ওপর অ্যাসিড পেইন্টেড শাড়ি। এ কাউন্টার থেকে ও কাউন্টারে ছুটোছুটি করে যেন ছোঁ মেরে তুলে নিতে থাকে ব্যাঙ্গালোর সিল্কে কাঁথার কাজ, কোসাসিল্ক শাড়ি, কাঞ্জিভরম, ইক্কত, গাদোয়াল, নয়েল সিল্ক-কুর্তি, পালাজো, লং স্কার্ট, আনারকলি স্টাইলের লং কামিজ ও চুড়িদার কিছুই বাদ যায় না! তারপর নিতে থাকে বিতানের পাঞ্জাবি, জিন্স, শার্ট, শ্রী যেন হুঁশ হারিয়ে ফেলেছে। মুখে তার লেগে আছে অলৌকিক এক টুকরো হাসি। হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে একতলা থেকে পাঁচতলা গোটা দোকানময় ছুটে বেড়াচ্ছে সে। খিদে তৃষ্ণাও ভুলে গেছে যেন!

—মুর্শিদাবাদি সিল্কে বাঁধনি আর অজরখ প্রিন্টের কম্বিনেশনের এই শাড়িটা নিই, বিতান? দু’ধরনের প্রিন্টে একটা এক্সক্লুসিভ মাত্রা পেয়েছে শাড়িটা, দ্যাখো দ্যাখো! বিতানকে শাড়িটা দেখিয়ে আদুরে গলায় বলে ওঠে শ্রী। তার উজ্জ্বল চকচকে চোখদুটোর দিকে তাকিয়ে ধীরে ধীরে মাথা নেড়ে সম্মতি জানায় বিতান।

—আর বাঁদিকে কোণের ওই শাড়িটা দ্যাখো! অলিভ গ্রিন বাফতা সিল্কের উপর কলমকারি প্রিন্টে স্মার্ট লুক! শাড়িতে এইসব প্রিন্টের বৈচিত্র এখন ট্রেন্ডিং, জানো? এ শাড়িটাও নিয়ে নেব? ঘামতে থাকে বিতান। দমবন্ধ হয়ে আসতে থাকে তার।

—আমি একটু বাইরে থেকে আসছি শ্রী। তুমি কেনাকাটা করো…

সন্ধে হয়ে এসেছে। সময় যেন উড়ে উড়ে মিলিয়ে যাচ্ছে গোটা দোকানের আনাচকানাচে। হঠাৎ তার বাবার ফোনে হুঁশ ফেরে শ্রীদর্শিনীর।

—শিগগির বাড়িতে এসো। এক্ষুনি। রাইট নাও।

বাড়ি ফিরে শ্রী জানতে পারে একে একে প্রতিটি ধাপ। বিতান কাপড়ের দোকান থেকে বেরিয়ে বাড়ি এসে সোজা ঢুকে গিয়েছিল নিজের ঘরে। দরজা বন্ধ করে দিলেও জানালা দিয়ে বিতানকে সিলিং ফ্যান থেকে ঝুলন্ত অবস্থায় দেখেন তার মা। চিৎকার করে পড়শিদের ডাকেন তিনি। তারা এসে দরজা ভেঙে বিতানের দেহ নামিয়েছে। সবটা শোনার পর কেমন হতভম্ব হয়ে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে শ্রী। যেন বুঝতেই পারে না কোথায় বাঁধল গোলমালটা! বিড়বিড় করে অসংলগ্ন কথাবার্তা বলতে থাকে।

পুলিশ আসে অনেক রাতে। আর শ্রীকে তখনও দেখা যায় বারান্দার এক কোণে জামাকাপড়ের প্যাকেটগুলো খুব শক্ত করে বুকে জাপটে ধরে মুখ নামিয়ে বসে আছে।

দিন সাতেক পরে শ্রীর বাবা তাঁর সাইকিয়াট্রিস্ট বন্ধু ডা. বসুর চেম্বারে যান শ্রীকে নিয়ে। সমস্তটা শুনে ডাক্তারবাবু বলেন, ‘সময়মতো প্রপার মেডিকেশন আর সাইকোথেরাপি শ্রীদর্শিনীকে তার সুস্থ জীবন যাপনে ফিরিয়ে দিতে পারত। সেটা তো গেল শ্রীর কথা। উলটো দিকে শ্রীর অস্বাভাবিকতার জন্য একটা তাজা তরুণ প্রাণ এভাবে অকালে যে চলে গেল, সেটাও হয়তো আটকানো যেত। আগে কেন গুরুত্ব দিলে না, বন্ধু!’

 

পড়ার জন্য সীমাহীন গল্প-নিবন্ধসাবস্ক্রাইব