চোখ টেপা মেয়ে ( পর্ব ১)

প্রফুল্ল সেন কলোনি থেকে বেরিয়ে ক্যাবে বসে কেতকী ঘোষণা করে দিলেন, এই মেয়ে আমি ঘরে তুলব না। আমার মুখের দিকে যেভাবে ও সোজাসুজি তাকাল তাতে মনে হল ও আমাকে পারলে গিলে খায়।

অবিনাশবাবু হেসে বললেন, “কেন ও তো তোমাকে মাসিমা বলে ডাকল। তুমি ওকে আমাদের রান্নাবান্না শিখিয়ে দেবে বললে… আমার তো মনে হল খুব ইন্টেলিজেন্ট মেয়েটা আর সোজাসুজি কথা বলে।’

—অত স্পষ্ট বক্তা মেয়ের দরকার নেই বাপু আমার। চ্যাপটা মুখ, জোড়াভুরু, ছোটো ছোটো চোখ। দশ জনের সামনে দাঁড় করানো যাবে না ওকে। আমার শুভমিতাকেই পছন্দ, স্পষ্ট বলে দিলুম।

অবিনাশবাবু তাকালেন ছেলের দিকে। ‘কী রে খোকা, তুই কী ভাবছিস?”

অরিত্র যা ভাবছিল তা মা-বাবাকে কী করে বলবে ও? মেয়েটা যে ওকে চোখ টিপে দিয়েছে সেটা আর কেউ না দেখুক, ওতো দেখে নিয়েছে। বহুদিন আগে শোনা কুমার শানু আর কবিতা কৃষ্ণমূর্তির গাওয়া সেই হিন্দি ছবির গানের কলিটাই মনে মনে ভাঁজছিল অরিত্র – ‘আঁখ মারে, ও লেড়কি আঁখ মারে/ দিল ধড়কায়ে, বিচ সড়ক মে নখরে দিখায়ে উয়ো সারে/ হো করকে ইশারে ও লেড়কি আঁখ মারে’।

গাজিয়াবাদের বিজনেস ম্যানেজমেন্ট ইনস্টিটিউট-এ কর্পোরেট ফাইন্যান্সিং পড়ায় অরিত্র। আইআইটি, আইআইএম-এর প্রোডাক্ট অরিত্র দাশগুপ্ত লম্বা, সুদর্শন, মৃদুভাষী, কর্তব্যনিষ্ঠ, উনত্রিশ বছরের যুবক। বছরে আঠাশ লাখ টাকার প্যাকেজ, পাণিপ্রার্থী যুবক, তার বাড়ির সামনে তো মেয়েদের লাইন লেগে যাবারই কথা! কিন্তু অরিত্র আঠারো ঘণ্টা ল্যাপটপ নিয়ে কাজ করে এমন মেয়ে ঘরে আনতে চায় না। ও চায় এমন একটি ঘরোয়া মেয়ে যে নিজের শিক্ষার মর্যাদা দিতে দিনে কয়েক ঘন্টার জন্য ছোটোখাটো কোনও কাজ করুক ক্ষতি নেই কিন্তু ঘরেই বেশির ভাগ সময় থাকবে।

বড়ো কোম্পানিতে উচ্চ শিক্ষিতা যেসব মেয়েরা কাজ করে, তারা নিজের কেরিয়ার খারাপ করে হাউজওয়াইফ হতে রাজি নয়। কাজেই দিল্লি, মুম্বই, বেঙ্গালুরু, চেন্নাই-এ কর্মরতা হাজার হাজার উচ্চশিক্ষিতা বিবাহযোগ্যা মেয়েদের প্রলোভন এড়িয়ে দক্ষিণ কলকাতার গলি খুঁজিতে মেয়ে খুঁজতে বেরিয়েছে অরিত্র।

গুড ফ্রাইডের ছুটির সঙ্গে শনি আর রবিবারের ছুটি মিলিয়ে তিনটে দিন হাতে পেয়ে, প্লেনে করে বাবা-মাকে নিয়ে কলকাতা ছুটে এসেছে অরিত্র। যে-তিনটি মেয়েকে ম্যাট্রিমনিয়াল সাইট ঘেঁটে কেতকী আর অবিনাশ আগে থেকেই শর্ট লিস্ট করে রেখেছিলেন, তাদের মধ্যেই একটি মেয়েকে পছন্দ করে যাবেন ওঁরা। থাকার ব্যবস্থা সল্টলেক সেক্টর ফাইভে ওদের ইন্সটিটিউট-এর গেস্ট হাউসেই করে নিয়েছে অরিত্র।

শুক্রবার বিকেলে বেলেঘাটায় একটি মেয়ে দেখে শনিবার বাকি দুটো মেয়ে দেখার ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন অবিনাশ। বেলেঘাটার মেয়েটি দেখতে সুশ্রী, কম্পিউটার সায়েন্স নিয়ে এমএসসি করেছে, একটা প্রাইভেট স্কুলে পড়ায় সে। কেতকীর মেয়েটিকে একরকম পছন্দ হয়ে গিয়েছে। দিল্লিতে এলে ওকে কোনও স্কুলে ঢুকিয়ে দিতে পারবে অরিত্র। ওর নামটাও পছন্দ হয়েছে কেতকীর— শুভমিতা।

পরের দিন সকালে বাগুইআটির বর্ণালিকে দেখতে গেল ওরা। মেয়েটি বড্ড রোগা, চোখে চশমা, দমদম পার্কের কোনও এক উচ্চ মাধ্যমিক স্কুলে ইংরেজি পড়ায়। কথাবার্তা খুব গুছিয়ে বলতে পারে মেয়েটি যেটা ভালো শিক্ষিকা হবার জন্য প্রয়োজন। ওর ব্যাকগ্রাউন্ডও খুব ভালো, বাবা কাকা দাদারা সবাই স্কুল কলেজে পড়ান অথবা সরকারি চাকরি করেন। রংটাও বেশ ফরসা ছিল বর্ণালির, কিন্তু স্বাস্থ্যের কারণে ওকে ঘরে তুলতে ইচ্ছুক নন কেতকী। ছেলেপুলে যদি মায়ের মতো রোগা পটকা হয় তবে বাবা-মার আজীবন ভোগান্তি।

                                                                                                                                      চলবে….

রেহিইনের তিতলি (শেষ পর্ব)

রাইনের কাছে যেতেই ফটফটে সকালের আলো মরে গিয়ে এক সবজে জলছোপের মেঘলা আবহ তৈরি করেছে। আকাশে বৃষ্টির ছিটে ফোঁটাও নেই কিন্তু রাইনের জলোচ্ছ্বাস বৃষ্টি হয়ে ভিজিয়ে দিচ্ছে আমাদের। অনেক উচ্ছ্বাস চেপে রেখে একাকী সফর বৃষ্টি বিলাসী হয়ে উঠল। গোটা জীবনকাল ধরে যাজকের মতো আমার সমস্ত কনফেশন শুনেছে বৃষ্টি। রাইন নদীর মুখরতা প্রবল উচ্ছ্বলতা আবারও ভিজিয়ে দিল শ্রাবণে। ডানা ঝাপটানো সবজে জলে, এটাই কি আমার বৃষ্টি ভ্রমণ পরবাসে? ইহকাল পরকাল শরীরী জল্পনা খোলা পর্দার মতো উড়ে গেল। থেকে গেল মানব মানবীর দৃঢ় বন্ধুত্ব যা চিরকালের। যাতে কোনও ফ্যান্টাসির সেমিকোলন নেই।

স্পিড বোটের চরম দুলুনি আর জলের ঝাপটা খেয়ে ভাবুক মনকে ভিজিয়ে নিয়ে দেখলাম আমি ইষ্টিকুটুম পাখিটি হয়ে রাইনের পাথরে বসার চেষ্টা করছি। ডিলানের কথায় চমক ভাঙল, ভাঙা ইংরেজিতে আমায় দাঁড়াতে অনুরোধ করল। আমি তো পোজ মাস্টারনি আছিই! মিঠে হাসি দিয়ে হলুদ প্রজাপতি হয়ে দাঁড়ালাম এবং খিচিক। ডিলানেরও ছবি তুললাম। ডিলান আমার হাত শক্ত করে ধরে আছে বুঝতে পেরেছে যে, হাত ছাড়লে আমি ছিটকে জলেও পড়ে যেতে পারি। ডিলান কিন্তু কনফিডেন্সের সাথে বোটের দুলুনি উপেক্ষা করে ক্যামেরায় ছবি তুলে তাকে ওয়াটারপ্রুফ ব্যাগে বন্দি করে আমার হাত ধরে অপলক তাকিয়ে থাকল।

বোট এবার আস্তে করে ফলসের মধ্যিখানে ঢুকে গেল যেখানে বোটের ওপর দিয়ে জল ওভার ফ্লো করছে। অথচ আমরা ভিজলেও বোট জলে ভেসে যাচ্ছে না। হঠাৎ ডিলান বলে উঠল যার মানে এই দাঁড়ায়— ‘তোমায় জড়িয়ে ধরলে আমার কোনও ইচ্ছে জেগে উঠবে কি না আমার জানা নেই, কিন্তু আমি তোমার অবিশ্বাসের কারণ হতে চাই না!” বোটের এই প্রচণ্ড দুলুনিতে এইভাবে শুধু হাত ধরে ব্যালেন্স রাখা প্রায় অসম্ভব। মাঝের হাতখানেক গ্যাপ-কে কমিয়ে ডিলানের কাছে সরতেই বোটটা সহসা ডানদিকে হেলে গেল। সবাই হই হই চিৎকার করলেও ডিলান আমাকে সবলে জড়িয়ে ধরে নিল।

আমি যেন অজানা এক ভালোলাগায় ভেসে গেলাম। পাপপুণ্য নৈতিক অনৈতিক সহাবস্থান সব স্মৃতি থেকে ছিটকে ছিটকে খসে পড়ে গেল রাইনের জলে। ডিলানের পায়ের পাতার ওপর উঠে আমি আমার শরীরের ভার ছেড়ে দিতেই মাধ্যাকর্ষণ শক্তি যেন শূন্য হয়ে গেল। ডিলান আমার ঠোঁটের ওপর ওর ঠোঁট নামিয়ে এনে নিঃশেষে আমার নির্যাস শুষে নিল। ফিশফিশ করে কানে বলল, “ইউ আর আ ভেরি চার্মিং অ্যান্ড বিউটিফুল ইন্ডিয়ান লেডি উইথ দিস সসারি ড্রেস টিটাস!’ কথাগুলো শুনে একপলকের জন্য আমি পৃথিবীর দশটি দিকে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে ছড়িয়ে পড়লাম। সুদূর বাংলাদেশের নদী তিতাস যেন রাইনের জলে মিশে গেল। সম্বিৎ ফিরে পেতেই সজোরে ধাক্কা দিয়ে ডিলানের থেকে আলগা করতে চাইলাম নিজেকে। পারলাম না বোট তখন সবে রিস্ক জোন থেকে বেরোতে শুরু করেছে।

এতক্ষণে চারপাশে তাকিয়ে দেখি যারা কাপল হয়ে এসেছে, তারা এখনও প্রকৃতির সাথে এবং প্রিয়জনের সাথে প্রেমমগ্ন হয়ে আছে। আমার শিফন শাড়ি, ব্লাউজ, চুল ভিজে গিয়ে একটা ঠান্ডা ভাব ঘিরে ধরেছে। বেসামাল আমাকে হাতে ধরে ডিলান দুলুনি বোটের একটা সিটে বসিয়ে কপালের চুল সরিয়ে দিল। তারপর ভিডিওগ্রাফিতে ব্যস্ত হয়ে গেল। কিন্তু ছবিতেই কি সব ধরা পড়ে? অনুভবে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকে অনেক কিছু। জীবনে প্রথমবার আমার একান্ত দুই দিনের একলা বিদেশ সফর শেষ হল রোদেস্টাইনের হালকা আবছা দুপুরে।

চলে এলাম হ্রদের শহর লুজার্নে। আল্পস পবর্তমালার নেকলেস পিস দিয়ে সাজানো লুজার্ন যেন আরও মনোমহী দৃষ্টিনন্দন। হ্রদের জলে অপূর্ব রাজহাঁসের পাল পুটুস পাটুস ডুব দিয়ে একদম পাড়ে উঠে আসছে। আমরা হ্রদের ওপর দিয়ে অন্যতম পুরোনো কাঠের সেতু, চ্যাপেল ব্রিজের ওপর হাঁটা শুরু করলাম। ডিলান বেশ লম্বা তাই আমি পিছিয়ে পড়ছি বারবার আর ডিলান বলছে, ‘কাম অন কাম অন টিটাস।’ শেষে ডিলান আমার ডান হাতের আঙ্গুলগুলো ওর হাতে জড়িয়ে ভারসাম্য রেখে হাঁটতে শুরু করল। হেঁটে হেঁটেই আমরা শহরের ইতিকথা জানলাম। শহরের মধ্যে ঠিক খেলনার মতো এক রেলগাড়িতে চেপে সিটি টুর শেষ করলাম। একটা আস্তদিন নতুন শহর দেখতে দেখতে হালকা পায়ে দিনের ঢাল গড়িয়ে রাতের ঠিকানায় পৌঁছে গেল।

রাত্রিবাস করলাম আমার একার জন্য বুকিং করা নির্দিষ্ট রুমে। ডিলান ওই হোটেলেই অন্য ফ্লোরে অন্য রুমে। আমি সুভেনির শপ থেকে একটা গ্রিটিংস কার্ড কিনে তাতে ডিলানের তোলা আমার সেই হলুদ শাড়ি পরা ছবি এটাচ করে লিখে দিলাম— ‘লাভ অ্যান্ড সুইট মেমরি ইন রেহিইন ফলস — ফ্রম টিটাস রিভার।’

পরদিন সকালে ডিলান একটা খাম দিয়ে বলল, “প্লিজ ওপেন ইট টিটাস।’ খাম খুলেই চমকে গেলাম, —ওমা ডিলান আমার ওই হলুদ শাড়ি পড়া ছবিটাই হাতে এঁকে দিয়েছে অ্যাক্রিলিক কালারে। অপূর্ব, কী যে সুন্দর! আমি জীবনে প্রথমবার নিজেরই অবয়ব দেখে প্রচণ্ড খুশি, যেন সত্যি প্রজাপতি হয়ে গেছি। আমি হ্যান্ডশেকের জন্য হাত বাড়ালেও ডিলান সেই হাত ধরে আমাকে জড়িয়ে ইউরোপীয় কায়দায় একটু নীচু হয়ে আমার দু’গালে ঠোঁট ছোঁয়াল।

এক নতুন দেখা দেশে নতুন মানুষের স্পর্শ সারা জীবনের জন্য লেগে থাকল, মনের নিভৃত তাঁবুতে। জানি দেশে ফিরে কাজের চাপে ডিলানের সাথে ফেসবুকেও যোগাযোগ থাকবে কিনা সন্দেহ। তবে না থাকলেও ক্ষতি নেই। জীবনের বয়ে চলা তো এমনই। ডিলানকে আলবিদা জানিয়ে আমি সফরের অভিমুখ ঘোরালাম।

রেহিইনের তিতলি (পর্ব ২)

প্রাথমিক ধাক্কার আবেগে আমি তখন ভাঙছি। আমার ভারতীয়বোধ গুঁড়ো গুঁড়ো আবিরের মতো ছড়িয়ে পড়ছে গ্লোবালাইজেশনের নিরিখে। ডিলান আমাকে ধরে ক্রুজের ভেতর বিশাল লবির একটা জানলার পাশে নিয়ে বসাল। জানলাম ডিলানের বেশ কয়েকজন ভারতীয় আর্টিস্ট বন্ধু আছে, তাই ভারতমাতা শব্দটির সাথে সে বেশ পরিচিত। ডিলান ভাঙা ভাঙা ইংরেজি বলে বাকিটা ইটালিয়ান ভাষা।

আমি প্রমাদ গুনলাম সর্বনাশ কীভাবে কথা বলব! হঠাৎ ক্রুজের জানলা দিয়ে দেখি লেকের ঠিক মধ্যিখানে একটা বিশাল জলের ফোয়ারা আর সেটাকে ঘিরে কম বয়সি ছেলেমেয়েদের একটা গ্রুপ স্পিডবোট নিয়ে দারুণ সব রাইড করছে। ফার্স্ট ওয়ার্ল্ড কান্ট্রির ফ্লেভার সত্যিই অন্যরকম। একটু অন্যমনস্ক হয়েছি ব্যথার জন্য। কোঁকড়া চুল আর নীল চোখের ডিলান দু’হাতে দুটো সুইস আইসক্রিম নিয়ে এসে উপস্থিত। আমি ইংলিশে প্রাণপণে বোঝাতে চেষ্টা করলাম যে খাব না। তারপর খোঁড়াতে খোঁড়াতে কাউন্টারে গিয়ে জানলাম ক্রুজ অথরিটি স্পনসর করছে আজকের এই আইসক্রিম। সুইস আইক্রিমের অপার্থিব স্বাদ চিরকাল মনে থাকবে। আইসক্রিম, পেস্ট্রিতে আমি নির্লজ্জের মতো লোভী।

বাঁ হাতে টিস্যু পেপারে রক্ত মুছে ডান হাতে আইসক্রিম খাচ্ছি আর মনে মনে সুইজারল্যান্ডের দুধেলা গরুগুলোর তারিফ না করে পারছি না।

ক্রুজে উঠতে গিয়ে কলিশন বেশ ভালোই হয়েছে। ডান হাঁটুতে ছড়ে গিয়ে একটু ব্লিড করেছে। আমার পরিহিত ফাটা বয়ফ্রেন্ড জিন্স-এর ফাঁক দিয়ে বেশ ভালোই দেখা যাচ্ছে ক্ষত। সেটা দেখে ডিলান দৌড়ে গিয়ে বার কাউন্টার থেকে হ্যান্ড টাওয়েলে মুড়িয়ে আইস কিউব নিয়ে এসে পাশে বসে সোজা আমার হাঁটুতে চেপে ধরল। একটু থতমত খেলাম, প্রথমে প্রচণ্ড পেইন হলেও আস্তে আস্তে সয়ে গেল। আমি তো লজ্জায় একশেষ!

কী হচ্ছেটা কী আমার সঙ্গে যাচ্ছেতাই। বেশ কিছুক্ষণ পর ডিলান কে বললাম, “প্লিজ এনাফ ইজ এনাফ, লিভ মাই লেগ, প্লিজ।’ একটা অপরাধবোধের হাসি দিয়ে আস্তে করে আমার পা ছেড়ে দিয়ে টাওয়েল ফেরত দিয়ে এসে ডিলান আমার টেবিলের উলটো দিকে বসল। ততক্ষণে ক্রুজ চলতে শুরু করেছে। চারপাশের নয়নাভিরাম দৃশ্য, নীলপাহাড়, লেকের জলে অনবদ্য ল্যান্ডস্কেপের প্রতিবিম্ব এঁকেছে।

আমার চোখের নজরের ফুট দেড়েকের মধ্যেই এক অতীব সুন্দর লম্বা ইটালিয়ান পুরুষ বসে আইক্রিম খাচ্ছে। আমি দেখছি সেও দেখছে। মাঝেমধ্যে টুকটাক কথা চলছে সেই ভাঙা ইংরেজিতেই। ডিলান আমার নেক্সট ডে-র প্রোগ্রাম জানতে চাইলে আমি বললাম, রেহিইন রিভার ফলস। শুনে সে আবদার করে বসল আমি যদি কিছু মনে না করি তবে সেও যাবে আমার সাথে রেহিইন ফলস দেখতে। আমি ভাবলাম আমার এই একলা সফরে এ আবার কী গেরো! সায়ন, নীপা কী ভাববে? তারপর ভাবছি— কই আমার বেটার হাফ বাইরে গেলে তো কোনও সন্দেহের অবকাশ থাকে না। এই প্রোগ্রেশনের যুগে দাঁড়িয়ে এত সংকোচ, দ্বন্দ্ব নিয়ে আমার মাত্র দুই দিনের একলা সফরকে স্পয়েল করার কোনও মানেই হয় না।

নীপাকে একটা কল করে ব্যাপারটা বললাম কারণ আপাতত ওরাই গার্জেন। ‘নীপা, শোন পেশায় প্রোফেশনাল আর্টিস্ট অ্যান্ড ফোটোগ্রাফার ইটালির ছেলে ডিলানের সাথে আলাপ হয়েছে। বয়স বুঝতে পারছি না বাট ও আমার সাথে রেহিইন (রাইন) ফলস যেতে চাইছে। সো হোয়াট টু ডু?’

নীপা হা হা করে হেসে ফোনের ও প্রান্ত থেকে বলল, “একটা ভিডিও কল কর তো একটু দেখি ইটালিয়ান হিরোকে।” করলাম ভিডিও কল নীপা নিজেই কথা বলে ফাইনাল করে দিল কালকের প্রোগ্রাম। শুধু হাঁটুর ব্যাপারটা চেপে গেলাম। নীপার গলা শুনে মনে হল ও যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। আমার একদম একা একা রাইন ফলসে যাওয়া একটু চাপের ছিল। বললাম, ওকে ডিলান সো লেটস মুভ ফরওয়ার্ড ট্যুমরো।’

পরদিন সকালে সুন্দর হলুদ রঙের ফ্লোরাল প্রিন্টের শিফন জর্জেটের শাড়ি পরে নিলাম। নিজেকে বিদেশের মাটিতে স্বাধীন মহারানির মতো লাগছে। কারও ফুটকাটা নেই! বাবা কত্ত মাঞ্জা দিয়েছিস বলার কেউ নেই! পুরো বল্লে বল্লে।

ডিলান তো আমায় শাড়িতে দেখে এতটাই মুগ্ধ যে, চোখ সরাতে পারছে না। বলল ‘আই হ্যাভ নেভার সিন দিস টাইপ অফ ড্রেস ইন মাই লাইফ।’ বেচারা, ওর কাছে তো সবই ড্রেস! ভারতীয় শাড়ির আভিজাত্য যা পৃথিবীর আর কোথাও নেই বোঝাতে চেষ্টা করলাম ডিলান কে। প্রচুর ফোটো সেশান হল। একবার নবনীতা দেবসেনের লেখায় পড়েছিলাম তুন্দ্রার তৃণ অভিযানে, উলিকট ইনারের ওপর ফিনফিনে শিফন শাড়ি পরেই তিনি তুন্দ্রায় ঘুরে বেড়িয়েছেন। আমারও বাসনা ছিল, তুন্দ্রায় না পারি অন্তত সুইজারল্যান্ডেই পরে নিই শাড়ি। এখানকার লোকজনদের সাথে ভারতীয় শাড়ির একটু জানাশোনা হওয়া দরকার।

নির্দিষ্ট বাসে চেপে ডিলানের সাথে চলে এলাম স্যাফাউসেন-এ রাইন নদীর রেহিইন ফলস দেখতে। টিকিট কাটলাম তুমি না আমি? আমি না তুমির সংঘাতে না গিয়ে। দু’জনেই সমান ভাবে ভাগ করে দিলাম ডলার। একটা মিস্টি ওয়েদার আধা সবুজ জলরং ধরিয়েছে সবদিকে। তার মধ্যে বৃষ্টি বৃষ্টি ভাব চারপাশকে আরও রোমান্টিক করে তুলেছে। সাময়িক ভাবে ভাষা একটা সমস্যা হয়ে উঠেছিল চিন্তাতে, কিন্তু আজ তো কোনও অসুবিধা হচ্ছে না। দু’জনেই দিব্যি বুঝে যাচ্ছি কী বলতে বা করতে চাইছি।

টিকিট কাউন্টার থেকে দেখেছি বিশেষ লম্বা এক ধরনের মোটর বোটে করে ফলসের একদম কাছে টুরিস্টদের নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় আমি দ্বিতীয়বার ভাবলাম না। কাঁধের ব্যাগ জমা দিয়ে টিকিট কেটে লাইফ জ্যাকেট পরে নিলাম। শাড়ি পরায় সবাই আমায় ঘুরে ফিরে দেখছে, কয়েকজন তো ছবিও তুলল। সেফটি সিকিউরিটির বজ্র আঁটুনি থাকার পর ‘যোশ মে হোশ খো বৈঠে’। ছিটে ফোঁটা সাঁতার না জানা আমি, ডিলানের হাত শক্ত করে ধরে বোটে উঠে পড়লাম। কিন্তু পাদানিতে পা রাখার পর একটা হিমশীতল ভয় মেরুদণ্ড দিয়ে বয়ে গেল খরস্রোতা নদীটাকে দেখে।

ফিস ফিস করে ডিলানকে বললাম, ‘আই ডোন্ট নো সুইমিং অ্যাট অল।’ ডিলান কী বুঝল কে জানে এক টুসকিতে উড়িয়ে দিয়ে আধা ভাঙা ইংরেজিতে বলল, ‘ফরগেট অ্যাবাউট সুইমিং,ওয়্যার দ্যা জ্যাকেট অ্যান্ড এনজয় দ্য নেচার।’ মনের চোরাগোপ্তা ভয়কে অন্যত্র চালান করে সান্ত্বনা দিলাম— এমন সুযোগ বার বার আসে না। বোটে উঠে আনন্দে আটখানা হয়ে গেলাম। আসলে গানের সুর যেমন সারা পৃথিবীর মানুষকে বেঁধে রাখে, ভ্রমণেও বাঁধা থাকে এক মানবিকতার সুর যা আমরা সময় বিশেষে টের পাই।

রেহিইনের তিতলি (পর্ব ১ )

স্কুলে মেরি গো রাউন্ড খেলার সময় জোরে ঘুরতে ঘুরতে নীপা বলল, ‘জানিস তিতু বাড়িতে নীলুমামা আর মামি এসেছে সুইজারল্যান্ড থেকে।’

—ওমা তাই!

স্কুল ছুটির পর নীপা আমায় টানতে টানতে ওদের বাড়ি নিয়ে এসেছে। এসে দেখি পুরো চাঁদের হাট। ওদের ড্রইং রুমে কার্পেটের ওপর হাট করে বিশাল সুটকেস খুলে সুইস চকোলেট-সহ বিভিন্ন গিফট বিলি করছে মামি। নীপার প্রিয় বন্ধু আমি, আমাকেও আদর করে চকোলেট আর সুইস গ্রিটিংস কার্ড দিলেন মামি। আমার খুব লজ্জা করলেও নিলাম। সেই কার্ডখানা এখনও আছে।

পড়াশোনা শেষ করে পরীক্ষা দিয়ে নিজেদের জীবন তৈরিতে লেগেছি। নীপার বিয়ের ঘটকালি করতে গিয়ে নিজেও নীপার বর সায়নের ইঞ্জিনিয়র বন্ধু দেবদূতের প্রেমে ধপাস হলাম। প্রেম বিবাহ সবই হল। চাকরি সূত্রে এবং ভ্রামণিক হয়ে পৃথিবীর নানা প্রান্তরে ঘুরে বেড়ালেও, সুইজারল্যান্ড যাওয়া আর হয়ে ওঠেনি। অনেকদিন পরে মুম্বই থেকে হ্যালির ধুমকেতুর মতো নীপার ফোনকল— ‘হঠাৎ করে ডিসিশন হল রে, নিউ জবে জয়েন করে কয়েক বছরের কনট্র্যাক্টে সায়ন সুইজারল্যান্ড যাচ্ছে। বুঝতেই পারছিস এতটা বিরহ সহ্য হবে না, তাই আমিও তল্পি গুছিয়েছি। শোন তিতু এবার আর মিস করিস না। আমরা থাকতে থাকতেই দেবদূতকে তুলে নিয়ে চলে আসিস বেড়াতে।’

শুনে রিফ্লেক্সে চিৎকার করে বললাম, ‘নীপা তুই সুইজারল্যান্ড চলে যাচ্ছিস!’ ব্যস ততক্ষণে ফোন কাট।

এরপর বছর দেড়েকের মাথায় দেবদূতের কোম্পানির ইন্টারন্যাশানাল কনফারেন্সের ভেনু হল জেনেভাতে। আমি তো ওৎ পেতেই ছিলাম ছিপ ফেলে বঁড়শিখানা গেঁথে ফেললাম জেনেভা কনফারেন্সে —ওরফে সুইজারল্যান্ডের বুকে। শুরু হল জেরা। শুধু শ্বাশুড়ি মা কেন? আমার জন্মদায়িনীও তো কম যান না! পুরো ফ্যামিলি অ্যাটাক— ‘তিতু কী করে একা একা যাবি? দেব যাবে জেনেভা, তুই যাবি জুরিখ? ব্যাপারটা কি একটু খোলসা করে বলা যাবে ?*

—হোয়াট? এক প্লেন ভর্তি লোকের সাথে যাব আমি। সেন্ট্রাল গর্ভমেন্ট-এর সার্ভিলেন্সের একটা পাকাপোক্ত চাকরি করি মা। ছুটি ম্যানেজ করতে পারলেই ট্রেক করতে চলে যাই পাহাড়ে। বাইশ বছরের একমাথা সিঁদুর দেওয়া নতুন বউ নই যে কেউ ইলোপ করবে!

শ্বাশুড়ি চোখ কপালে তুলে বললেন, “তুমি তো সব সময় সাজুগুজুর আউটফিটে থাকো, অন্যের নজর লাগে।’ বিভিন্ন ধরনের হার্ডেলস আসলেও রাতের টুনি টুনি আঁধারে, দেবের সাথে মসৃণ স্লগ ওভারে ম্যাচ খেলে জিতে সোজা জুরিখের টিকিট কেটে তবে থামলাম। এই তো জীবন কালীদা। কার জন্য যে কী নৈবেদ্য সাজিয়ে রাখা, কেউ জানতি পারে না!

নীপা আর সায়নও লেগে পড়ল তাই দেবদূত বাবাজিকে রাজি হতেই হল। জেনেভা কনফারেন্স শেষ করে পুষ্পক রথে চড়েই না হয় দেবদূত আমাদের জুরিখ টিমে জয়েন করবে।

বন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে ভায়া দিল্লি হয়ে প্লেন যখন জুরিখের মাটি সত্যিই চুল, জানলা দিয়ে চোখ মেলে দেখি অদেখা স্বপ্নের দেশে কেবল নির্ঝরের স্বপ্নের ওড়াউড়ি।

একটু আউটস্কার্টে নীপাদের ছোট্ট কাঠের বাড়ি এবং পেছনদিকের অগোছালো বাগানটা অপূর্ব। বাগানের শেষ দিকে একটা ছোট্ট ক্রিক আছে। আমি প্রায়ই ওটার ওপর দাঁড়িয়ে চা খাই, রাত সাড়ে ন’টার সময় আবাক হয়ে সূর্যাস্ত দেখি। এখন সামার চলছে তাই সবদিকে বসন্ত বাহারের রাগমালা। নীপা, সায়ন আমায় নিয়ে ঘুরে দেখাল বেশ কিছু জায়গা। নীপা একটা ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানির ল্যাব অ্যাসিস্ট্যান্ট। এদেশে তো কেউ হাত পা নিয়ে বসে থাকে না, সবসময়টা কাজে লাগায়।

আমার ভ্রমণের ডায়ারিতে করে আসা হোমওয়ার্ক থেকে ক’টা জায়গা বাদ পড়ছে যেগুলো আমি চাইলে নিজেই ঘুরে আসতে পারি। নীপা আর সায়ন দুজনেই তো আমার জন্য লাগাতার ছুটি নিয়ে কেরিয়ার-কে বানপ্রস্থে পাঠিয়ে গাইড হয়ে যেতে পারে না! কারণ পরবর্তী পর্যায়ে দেব আসলে তার জন্য ছুটি মজুত রাখতে হবে।

আমি বাড়িতে বসে একা একা কী করি কী করি? তাই এখানেও সেই সেটিং করতে হল। বললাম— ‘সায়ন, নীপা ডোন্ট বি সিলি! আমার পঁয়ষট্টি বছরের মাসি একদম একা একা জার্মানির অর্ধেকটা নিজে ঘুরে তবে মেয়ে জামাইয়ের কাছে গেছেন গতবছর। আর মাত্র তিনটে দিন আমি এই কাছাকাছি জায়গাগুলো ঘুরে আসতে পারব না!”

সায়ন কাঁচুমাচু মুখে বলল, “পঁয়ষট্টি বছরের মাসি আর তুমি কি এক হলে? দেবদূত শুনলে কী বলবে তিতু? সর্বনাশ হয়ে যাবে।’

—দেব জানবে না সেই ব্যবস্থা করো না বাপু। মনে হচ্ছে আমি সুইজারল্যান্ড নয় উগান্ডা বেড়াতে এসেছি। চারিদিকে সিংহ, বন্য জন্তুর ভয়। তোমরা আমায় ভালো এজেন্সি দিয়ে হোটেল বুকিং, বাস বুকিং করে দাও ব্যস।

সুইজারল্যান্ড ভ্রমণ শুরু করেছি জুরিখ শহরের বনেদি পথ ধরে। খ্রিস্টপূর্ব পনেরো শতকে রোমানদের হাতে এই শহর গড়ে ওঠে। রাস্তাঘাট, মানুষের সভ্য ব্যস্ততা, লেকের জলের শহরের প্রতিবিম্ব দেখে মনে হচ্ছে স্বাধীনতার বর্ণময় পাখা সমগ্র শহরটিকে ছায়া দিয়ে রেখেছে।

জুরিখ সরোবরে বোটিং এবং লেক ক্রুজের ব্যবস্থা অনেকটা ফেলো কড়ি মাখো তেল গোছের। পকেটের রেস্ত অনুযায়ী শহরে বিচরণের জন্য হুডখোলা লাল ট্রামের টিকিট কাটলাম। আমি কলকাতার বাসিন্দা, নিত্যদিন রাস্তার ট্রাফিক জ্যামের লড়াইয়ের ধকল সামলেই যাতায়াত করতে হয়— তা সে সেডানেই হোক বা অটোতে। সেই রিফ্লেক্স আমার আজন্মের সহজাত। ক্ষিপ্রতার সাথে ট্রামে উঠে একপাশের প্রথম সিটের দখল নিলাম কিন্তু বসে মনে হল কেন করলাম এই অহেতুক আচরণ! একটু লজ্জা করল। বাকি সবাই কী সুন্দর ধীরেসুস্থে উঠে সিটে বসল। ঘন্টি বাজিয়ে লাল সাদা ট্রাম ছুটতে শুরু করল তার নির্দিষ্ট আউট লাইনে। মাইক্রোফোনে রাস্তার নাম এবং দ্রষ্টব্য স্থান বলা হতে লাগল। ছবির মতো সুন্দর জুরিখের ছায়া, তার মায়ার কাজল পরিয়ে দিচ্ছে চোখে। জুরিখ লেকের কোলে ফিরে এলাম একটা স্বপ্নের ট্রাম সফর শেষ করে।

নিয়ম মেনে লাইন দিয়ে টিকিট কেটে ক্রুজে উঠতে যাব হঠাৎই একটা ধাক্কায় হুমড়ি খেয়ে পড়ে আমার ডান হাঁটুটা ক্রুজে ওঠার কাঠের রেলিং-এ সজোরে ঠুকে গেল। আমার মুখ দিয়ে উফ শব্দের সঙ্গে সঙ্গে একটা মোলায়েম সুরের ‘সরি এক্সট্রিমলি সরি’ বলে আমার দিকে হাত বাড়িয়ে মাটিতে ছিটকে যাওয়া ব্যাগ ম্যাপ সব তুলে দিল একটি লম্বা ছেলে। উষ্ণ অভ্যর্থনায় হাত বাড়িয়ে বলল, ‘ডিলান ম্যাটিয়া ফ্রম ইটালি।’

আমিও হাত ঝাঁকিয়ে প্রত্যুত্তর দিলাম— ‘তিতাস রে ফ্রম টেগোরস কান্ট্রি ইন্ডিয়া।” আমাকে তস্য অবাক করে দিয়ে ডিলান হাতজোড় করে বলল, ‘নমস্তে, ভারত মাতাজি।’

উদয়ের অস্তাচল (শেষ পর্ব)

অমিয়র সুপুরুষ মুখে কে যেন এক দোয়াত কালি ঢেলে দিল। হাতের সিগারেটটা পুড়তে পুড়তে ছোটো হয়ে আঙুলে ছেঁকা লাগায়, সম্বিত ফিরে পেয়ে জানলার বাইরে ফেলে দিলেন ওটা। অনেকক্ষণ আর কোনও কথা বললেন না অমিয়। মনে হল যেন কোন সুদূর গ্রহে খুঁজে বেড়াচ্ছেন তাঁর এঞ্জেলকে।

—আইরিন, আমার স্ত্রী। বলতো তুমি এত বড়ো ডাক্তার। যমের মুখ থেকে মানুষকে ফিরিয়ে আনো! আর তুমি নিজের মেয়েকে, তোমার এঞ্জেল-কে বাঁচাতে পারলে না? নিজের মেয়ের জন্য সামান্য সময় করতে পারলে না? সত্যি বৈদ্যনাথবাবু আমি পারিনি। সেদিন একটা বড়ো সার্জারি ছিল। একনাগাড়ে ১৪ ঘণ্টা আমরা দশজন ডাক্তার, নার্স লেগেছিলাম ওই রোগীকে বাঁচাতে। তাকে বাঁচিয়েছিলাম কিন্তু পারলাম না আমার এঞ্জেলকে রক্ষা করতে। আমার কোলেই মাথা রেখে সে চলে গেল! আমিয়বাবু একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে চুপ করে গেলেন।

বৈদ্যনাথবাবু কোমল কণ্ঠে সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করলেন, ‘তাঁর ইচ্ছার বিরুদ্ধে কারও কোনও কথা চলে না ভাই।’

অমিয় ফুঁসে উঠলেন। “কিন্তু তাঁর ইচ্ছা কী ছিল? আমায় একেবারে রিক্ত, শূন্য করে দিতে? আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে চেয়ে রইলেন বৈদ্যনাথবাবু আরও কিছু সর্বনাশের খবরের জন্য।

—বৈদ্যনাথবাবু, আমাদের হিন্দু দর্শন বলেই খালাস— যার যাবার সময় হবে সে যাবেই। কিন্তু আমি যে সেই দর্শনে বিশ্বাসী নই। আমার শিক্ষা সেবা। আর রোগের সঙ্গে লড়াই করে রোগীকে বাঁচানোই আমার দীক্ষা। আমার শিক্ষা হার না মানার। কিন্তু তা সত্ত্বেও আমি হেরে গেলাম। আমি আমার স্ত্রী আইরিনের ক্যান্সারের জংধরা ফুসফুস কেটে বের করতে পারলাম কই? বললে বলতে আবেগে অমিয়র স্বর রুদ্ধ হয়ে গেল। চশমার আড়ালে জ্যোতির্ময় চোখ দুটি ঝাপসা হয়ে গেল। মুখ দিয়ে আর কথা বের হল না।

সান্ত্বনার ভাষা খুঁজে না পেয়ে বৈদ্যনাথবাবু এগিয়ে এসে তার পিঠে একটা হাত রাখলেন। অমিয় দু’হাতে ধরে চশমা নামিয়ে পকেট থেকে রুমাল বের করে কাচ পরিষ্কার করে, একবার চোখমুখেও বুলিয়ে নিলেন। পরে খানিকটা সামলে নিয়ে আবার বলতে শুরু করলেন— সেদিনও একটা বড়ো অপারেশন ছিল— সকাল ৮ টায় শুরু করে রাত ৯টায় শেষ করেছিলাম। আইরিনের শরীরটা ভালো ছিল না। আমার জুনিয়র একজন ডাক্তারকে সমস্ত নির্দেশ দিয়ে রেখেছিলাম আমার বাড়িতেই। অপারেশন শেষ করেই ছুটেছিলাম বাড়ি। পথেই টেলিফোন এল, শ্বাসকষ্ট শুরু হওয়াতে আইরিনকে নার্সিংহোমে ভর্তি করা হয়েছে। গাড়ি ঘুরিয়ে গেলাম নার্সিংহোমে। আইরিন তার বড়ো বড়ো নীলচে চোখ দিয়ে আমাকে দেখল। ঠোঁট নড়ল, কিন্তু কথা বলতে পারল না। আমি বারণ করলাম কথা বলতে। ওর কষ্ট হবে। আমি জানি ও কী বলতে চায়। সারারাত শ্বাসকষ্টে ঘুমাতে পারেনি ও। ভোররাতে আমার কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছিল। সে ঘুম আর ভাঙেনি! এবারে অমিয়নাথের স্বর কেঁপে কেঁপে একেবারে বন্ধ হয়ে গেল।

বৈদ্যনাথবাবু এগিয়ে গিয়ে অমিয়র মাথাটা নিজের কোলে টেনে নিয়ে খুব আলতো স্বরে বললেন, ‘অমিয়বাবু, আমাদের দেশের দর্শন, গীতার শিক্ষা হল— কাজেই তোমার অধিকার, ফলের অধিকার তোমার নেই। সে প্রত্যাশাও করতে নেই। তাহলেই এই দুঃখ থেকে মুক্তি পাবেন।”

অনেক পরে অমিয়, বৈদ্যনাথবাবুর আলিঙ্গন-মুক্ত হয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে বাথরুমে গিয়ে চোখমুখ ধুয়ে এসে চেয়ারে বসলেন। একটা সিগারেট জ্বালাতে জ্বালাতে, আসন্ন প্রভাতের কথা ভাবতে ভাবতে বলে উঠলেন, “বৈদ্যনাথবাবু, আইরিন শেষবারের মতো নীরবে কী বলতে চেয়েছিল জানেন?”

এই কথাটাই ভাবছিলেন বৈদ্যনাথবাবুও।

ওর ভাবনায় বাধা দিয়ে অমিয় নিজেই বলে উঠলেন, ‘আইরিন বলতে চেয়েছিল, ওয়াজ ইট রিয়েলি নিডেড? এতো টাকা, সম্মান, খ্যাতি, যশ, জগৎজোড়া নাম— এর কি কিছু কোনও কাজে লাগল?” এর উত্তরটা ওরা বেঁচে থাকতে পেলাম না। যখন পেলাম তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। তাই তো, সব ছেড়ে শুধু ওই ছোটো ব্যাগটি নিয়ে চলে এসেছি। ওতে আছে আমার টুথব্রাশ, একটা চিরুনি আর আইরিন আর এঞ্জেলের চিতাভস্ম।

বৈদ্যনাথবাবু তার আলমারি থেকে কাগজে মোড়া একটি বই দিয়ে বললেন, ‘এটাই আপনাকে ভবিষ্যতের পথ দেখাবে।”

অমিয় ধন্যবাদ জানিয়ে বইটা হাতে নিয়ে দেখলেন— একটা পকেট সংস্করণ গীতা।

ওদিকে ভোরের পাখি ডাকার সঙ্গে সঙ্গে বাসের হর্ন শোনা গেল। অমিয় নীরবে নমস্কার আর ধন্যবাদ জানিয়ে ছোটো ব্যাগটি তুলে নিয়ে স্টেশনের বাইরে বাসস্টপের দিকে এগিয়ে গেলেন।

ভোরের আলো-অন্ধকারের সন্ধিক্ষণে বৈদ্যনাথবাবু লক্ষ্য করলেন ছ’ফুট লম্বা মানুষটা যেন কীসের ভারে কুঁজো হয়ে চলেছেন। যেন দিনের দীপ্তিমান সূর্য অস্তাচলের পথে এগোচ্ছে।

উদয়ের অস্তাচল (পর্ব ২)

এবার হারান মণ্ডল প্রায় মেঝেতে শুয়ে প্রণাম জানাল অমিয়বাবুকে। বৈদ্যনাথবাবুও সসম্ভ্রমে আরও একবার হাতজোড় করে নমস্কার জানাল। অমিয় আর একটা সিগারেট জ্বালিয়ে ধোঁয়া ছাড়লেন।

—বাবা চেয়েছিলেন আমিও বাবা-ঠাকুরদার মতো প্রজাপালন আর তথাকথিত জমিদারির কাজকর্ম দেখে জীবনটা কাটিয়ে দিই। কিন্তু আমার লক্ষ্য ছিল অন্য। আমি চেয়েছিলাম বলরামপুরের গণ্ডি পেরিয়ে অনেক অনেক দূরের পৃথিবী দেখতে! নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে। সেই কুড়ি বছর বয়সে আমাকে পেয়ে বসেছিল বিশ্বজয়ের নেশা। এই নেশা আমাকে টেনে নিয়ে গেল অনেক অনেক দূরে। একটা স্কলারশিপ পেয়েছিলাম। এক লাফে আরব সাগর পেরিয়ে পৌঁছে গেলাম ইংল্যান্ড! সেই সময় আমাদের যুগের যুবকদের স্বপ্ন ছিল শিক্ষা-দীক্ষা আর উন্নতির শেষ সীমানা— ইংল্যান্ড-লন্ডন।

অমিয় থামলেন। অদ্ভুত একটা হাসিতে মুখ ছেয়ে গেল! বৈদ্যনাথবাবুর মনে হল— অমিয়বাবু বুঝি নিজেকেই ব্যঙ্গ করছেন। কিন্তু মুখ তুলে অমিয়বাবুর গল্প শোনার জন্য চেয়ে রইল। হারানও গাঙ্গুলিবাড়ির বড়ো কর্তার গল্প শুনছিল অবাক হয়ে। একবার শুধু রান্নাঘরে গিয়ে মাছের ঝোলটা নামিয়ে ভাত বসিয়ে এল।

রাতের হাওয়ার স্বরে আবার শুরু করলেন অমিয়নাথ — কুড়ি বছরের বিশ্বজয়ের নেশা আফিমের নেশার চেয়েও জোরালো। ওদেশে পৌঁছে মনে হয়েছিল আমার যোগ্য স্থানে পৌঁছে গেছি। ওই যে ইংরাজিতে বলে না ‘আই হ্যাভ অ্যারাইভড’, অনেকটা সেই রকম। আবার একবার সেই অদ্ভুত হাসিতে অনিন্দ্যসুন্দর মুখখানি ছেয়ে গেল।

অমিয়নাথ চেয়ার ছেড়ে জানলার দিকে এগিয়ে গেলেন। ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি হয়ে চলেছিল তখনও। মাঝে মাঝে দূরে নিঃশব্দ বিদ্যুৎ চমকের আলোয় ওর মুখটা কেমন যেন রহস্যময় দেখাচ্ছিল। মনে হল স্টেশনের কোয়ার্টারের জানালায় দাঁড়িয়ে বৃষ্টিভেজা আকাশ পানে চেয়ে যেন নিজের পুরোনো দিনের স্মৃতির গবাক্ষ উন্মুক্ত করে নিজেকেই দেখছেন অমিয়।

ফিরে এল হারানের ডাকে— ‘মাস্টারবাবু, ভাত হয়ে গেছে, আসুন।’ খাবার ডাকে সম্বিত ফিরে পেলেন বৈদ্যনাথবাবুও অনুভব করলেন চিনচিনে খিদে। ‘আসুন, গরম গরম ভাত আর তাজা রুই মাছের ঝোল’, বলে উঠে পড়লেন।

খেতে বসে বিশেষ কথা হল না। ঠাট্টার ছলেই বৈদ্যনাথবাবু বললেন, ‘আসলে আজ খিচুড়ি আর ইলিশ মাছ ভাজার রাত।”

—ইলিশ মাছ পাওয়া যায় এখন? খেতে খেতে প্রশ্ন করলেন আমিয়।

—পাওয়া যায়, তবে আগের মতো স্বাদ আর নেই। উত্তর দিলেন বৈদ্যনাথবাবু।

খাবার থালা থেকে মুখ তুলে অমিয় বললেন, “ওদেশে, মানে ইংল্যান্ড-এ কিন্তু আসল পদ্মার ইলিশ পাওয়া যায়। সে জিনিস বোধহয় আপনারাও এখানে পান না।’

বৈদ্যনাথবাবু মাথা নাড়লেন, ‘না অত দামি জিনিস খাবার সামর্থ্য কোথায় এখানের লোকের? তাই আসেও না, এখানে পাওয়া যায় কোলাঘাটের ইলিশ। আজকাল তো শুনি পুকুরেও ইলিশের চাষ হচ্ছে।’

—পুকুরে! অবাক হয়ে হাসলেন অমিয়।

ধীরে ধীরে মাথা নাড়লেন বৈদ্যনাথবাবু।

খাবার পরে দু’জনেই তক্তাপোষের উপর পা’তুলে আরাম করে বসলেন। অমিয় পা ছড়িয়ে দেয়ালে হেলান দিয়ে জানলার ধারে বসে একটা সিগারেট ধরালেন। হারান একটা ছোটো বাটি এগিয়ে দিল ছাইদানি হিসাবে।

বাইরে বৃষ্টিঝরা অন্ধকার রাত্রির স্তব্ধতা ভেঙে ভরাট গলায় বলে উঠলেন অমিয়, ‘বৈদ্যনাথবাবু, বলুন তো মানুষের অ্যাচিভমেন্ট কী?’

কী উত্তর দেবেন বৈদ্যনাথবাবু?

উত্তরের অপেক্ষা না করে অমিয়-ই বলে চলল, ‘মানুষের উচ্চাশা মানুষকে কোথা থেকে কোথায় নিয়ে যায়। মানুষকে চাঁদে নামিয়েও তো ফেরত এনেছে। তবুও তার উচ্চাশা থেমে আছে?”

বৈদ্যনাথবাবু সম্মতিসূচক ভাবে ঘাড় নাড়লেন না। উচ্চাশা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। এবার বলছে মঙ্গলে যাবে।

সম্মতিসূচক ঘাড় নেড়ে অমিয় বলল— এ এক অদ্ভুত মরীচিকা। আমি এর পিছনে ঘুরে বেড়িয়েছি ঘণ্টা, দিন, মাস, বছর। ডাক্তার হয়েছিলাম লন্ডনে গিয়ে। বিরাট সার্জেন-মানুষের অসুস্থ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ছুরি দিয়ে কেটে নতুন প্রত্যঙ্গ জুড়ে দিয়েছি। মৃত্যুপথযাত্রীকে মৃত্যু দেবতার হাত থেকে ছিনিয়ে এনে যমকে কাঁচকলা দেখিয়েছি। ইউরোপ, আমেরিকার বড়ো বড়ো হাসপাতালে কাজ করে প্রচুর

নাম-যশ আর অর্থ উপার্জন করেছি। একজন মানুষ পার্থিব সম্পদ বা সুনাম যা কিছু কামনা করতে পারে তার সবকিছু পেয়েছিলাম। এমনকী আমাদের দুনিয়ার সেরা পুরস্কারের জন্যও ‘নমিনেশন’ গেছে শুনে এসেছি।

বৈদ্যনাথবাবু সপ্রশংস দৃষ্টিতে আর একবার অমিয়নাথকে পা-থেকে মাথা পর্যন্ত জরিপ করে নিলেন।

—কিন্তু, এসবের কিছুই থাকে না বৈদ্যনাথবাবু! এমনকী, মনে হয়, কোনও দরকারও ছিল না। এ সত্যটা বুঝলাম অনেক দেরিতে! অমিয়র কণ্ঠে আন্তরিক আক্ষেপ প্রকাশ পেল। আমাদের একমাত্র মেয়ে ফুটফুটে ছোট্ট পরির মতো, পলিন। আমি তাই ওকে এঞ্জেল বলে ডাকতাম। মাত্র তিন দিনের জ্বরে সে আমাদের ছেড়ে চলে গেল!

উদয়ের অস্তাচল (পর্ব ১)

দিন-রাতের শেষ ট্রেনটা যখন চন্দনপুর স্টেশন ছেড়ে চলে গেল তখন একটা হাঁফ ছেড়ে বৈদ্যনাথবাবু দেয়াল ঘড়িটার দিকে তাকালেন— রাত ন’টা বেজে পাঁচ মিনিট। বহুদিন পরে ট্রেনটা প্রায় ঠিক সময়ে স্টেশন ছেড়ে গেল। বৃষ্টিটা কমেছে এখন। সারাদিন ধরে আজ ঝম ঝম করে বৃষ্টি হচ্ছিল।

পয়েন্টস ম্যান হারান মণ্ডল কেরোসিনের সিগনাল ল্যাম্প-টা হাতে নিয়ে ঢুকল। ‘বৃষ্টিটা একটু ধরেছে মাস্টারবাবু; চলুন এবার বন্ধ করুন দোকানপাট।’

—হ্যাঁ, চল, বলে খাতাপত্র বন্ধ করলেন বৈদ্যনাথবাবু। ম্লান হেসে চশমার কাচ পরিষ্কার করলেন শার্টের আস্তিনে। আজ মেল- টা লেট করেনি অনেকদিন পরে।

ঘাড় নেড়ে সামান্য হেসে হারান মণ্ডল বলল, ‘হ্যাঁ আজ ঠিক সময়ে চাট্টি গরম ভাত ভাগ্যে জুটবে।’

হারান ভিতর থেকে দরজা বন্ধ করল। পিছনের দরজা দিয়ে কোয়ার্টারে চলে যাবে। মাস্টারবাবুর কোয়ার্টারেরই একটা ঘরে থাকে হারান। বৈদ্যনাথবাবু লণ্ঠনটা হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়ালেন, ‘বাইরের লাইটটা জ্বলছে তো?”

ঘাড় নাড়ল হারান মণ্ডল৷

—চল, বলে এগিয়ে গেলেন বৈদ্যনাথবাবু। এমন সময় প্ল্যাটফর্মের দিকের দরজায় মৃদু টোকা পড়ল।

বিরক্ত হল হারান। এই অসময়ে আবার কে এল? অবাক হয়ে বাইরের দিকে তাকালেন বৈদ্যনাথবাবু।

হারান মণ্ডল দরজার দিকে এগিয়ে যেতেই বাইরে থেকে ভরাট গলায় আওয়াজ এল, ‘দয়া করে দরজাটা খুলুন।’ বৈদ্যনাথবাবু ইশারা করলেন।

দরজা খুলতেই দেখা গেল আগম্ভক মাঝবয়সি, প্রায় ছ’ফুট লম্বা সম্ভ্রান্ত সুপুরুষ। হালকা ফ্রেমের অন্তরালে উজ্জ্বল একজোড়া চোখে সাগরের গভীরতা।

—ভিতরে আসতে পারি? দরজায় ভারী গলার আওয়াজ।

বৈদ্যনাথবাবু দু’পা এগিয়ে এসে আমন্ত্রণ জানালেন, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ আসুন।’

আগন্তুক কোনও ভণিতা না করে ভিতরে ঢুকে বললেন, ‘আপনাদের অসুবিধায় ফেলার জন্য ভীষণ দুঃখিত! ঠিক জানা ছিল না, গাড়িতে এক ভদ্রলোক বললেন এখানে নামলে বলরামপুর কাছে পড়বে আর বাস বা অন্য গাড়ি পেয়ে যাব। কিন্তু এখন দেখছি এখানে কোনও গাড়ি-ঘোড়া পাওয়া যাবে না।’ বৈদ্যনাথবাবু আগন্তুককে বসতে ইঙ্গিত করলেন।

—এখান থেকে বলরামপুর কাছে বটে কিন্তু আগের জংশন স্টেশনে নামলে ওখান থেকে রাতের বাসটা বা হয়তো শেয়ারের ট্যাক্সিও পেয়ে যেতেন।

পকেট থেকে বিদেশি সিগারেটের প্যাকেট বের করে একটি সিগারেট নিজের ঠোঁটে লাগিয়ে, প্যাকেটটা বৈদ্যনাথবাবুর সামনে এগিয়ে ধরলেন। বৈদ্যনাথবাবু হাতজোড় করে স্মিত হেসে মাথা নাড়লেন, ‘আমার চলে না।’

আগন্তুক সিগারেটে অগ্নিসংযোগ করে একরাশ ধোঁয়া ছেড়ে হাত জোড় করলেন, ‘আমি অমিয়নাথ গাঙ্গুলি, যাব বলরামপুর। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে, তা নাহলে রাতটা প্ল্যাটফর্মের বেঞ্চিতেই কাটিয়ে দেওয়া যেত।’

বৈদ্যনাথবাবু লজ্জা পেয়ে জিভ বের করে বলে উঠলেন, “আরে না না, তাতে কী হয়েছে, পেছনেই আমার ডেরা। চলুন ওখানেই কষ্ট করে রাতটা না হয়…!’

—খুব খারাপ লাগছে। আপনাদের অযথা কষ্ট দিলাম। আন্তরিক বিনয়ের সঙ্গে বলে অমিয়নাথ কাঁধের ছোটো ব্যাগটা হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়ালেন।

—ছি ছি এমন করে বললে সত্যি সত্যিই নিজেকে অপরাধী বলে মনে হবে! বৈদ্যনাথবাবু জিভ কাটলেন।

গুঁড়ি গুড়ি বৃষ্টির মধ্যে কয়েক পা হেঁটেই স্টেশন মাস্টারের কোয়ার্টারে চলে এলেন, ‘আসুন স্যার’ বলে একটা নড়বড়ে হাতভাঙা চেয়ার এগিয়ে দিলেন বৈদ্যনাথবাবু। পরিচয় দিয়ে বললেন, ‘আমি বৈদ্যনাথ দে৷ এই পাণ্ডববর্জিত স্টেশনের চাকুরে, পরিবারের অন্যান্যরা কলকাতায় থাকে, তাই ওই হারান মণ্ডলই আমার সেবক, পাচক, মালি আবার স্টেশনের পয়েন্টসম্যান। তাই ও যেমন ‘অল ইন ওয়ান’ আমিও তেমনি ‘ওয়ান ইন অল।” নিজের রসিকতায় নিজেই হাসলেন বৈদ্যনাথ দে।

ছোটো কোয়ার্টারের ততোধিক ছোটো রান্নাঘর থেকে কেরোসিন স্টোভের সোঁ সোঁ আওয়াজ আসছিল। হারান রান্না চাপিয়েছে।

—পঁচিশ বছরে বিশেষ পরিবর্তন দেখছি না এখানের। জানালার বাইরে তাকিয়ে মন্তব্য করল অমিয়।

বৃষ্টিটা ততক্ষণে বেশ জোরে পড়তে আরম্ভ করেছিল, জ্বলন্ত সিগারেটের টুকরোটা বাইরে ছুড়তেই ছ্যাঁত করে আওয়াজ তুলল।

জানলা থেকে মুখ ফিরিয়ে খুব আলতো করে বলল অমিয়, ‘বলরামপুরের গাঙ্গুলিদের নাম শুনেছেন?

—না, মানে আমার তো এখানে বেশিদিন হয়নি। আমতা আমতা করতে লাগলেন বৈদ্যনাথবাবু।

হঠাৎ হারান রান্নাঘর থেকে প্রায় দৌড়ে এসে হাতজোড় করে প্রণাম জানিয়ে বলে উঠল, ‘অপরাধ মাফ করবেন! কত্তা কি জমিদার বাড়ির বড়ো ছেলে? যিনি …’ ইতস্তত করতে লাগল হারান।

ধীরে ধীরে ঘাড় নেড়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে অমিয়নাথ বলে উঠল, ‘হ্যাঁ, আমিই জমিদার শঙ্করনাথ গাঙ্গুলির বড়ো ছেলে অমিয়নাথ। বাবার সঙ্গে মতের অমিল হওয়াতে বাড়ি আর দেশ দুটোই ছেড়েছিলাম।’

আরও একটু বৃষ্টি নামুক ( শেষ পর্ব )

প্রায় কুড়ি মিনিট দূরত্বে একটা কফি শপে অনিন্দ্য দোয়েলকে নিয়ে এল। দোয়েল এমনিতেই স্মার্ট, সুন্দরী। কিন্তু আজ যেন দোয়েলকে সদ্য ফোটা গোলাপের মতো প্রাণবন্ত দেখাচ্ছিল।

অনিন্দ্য দোয়েলকে বসিয়ে রেখে বলল— ‘তুমি একটু বসো। আমি একটা ফোন কল করে আসছি। কিছুক্ষণ পর অনিন্দ্য ফিরে এসে বলল— ‘বোর ফিল হচ্ছে!’

একদম না। অনিন্দ্যদা, তুমি কী যেন বলবে বলছিলে!

বলব। তুমি ছাড়া আর কার সঙ্গে মনের কথা শেয়ার করব! সারপ্রাইজ তাড়াতাড়ি দিলে মজাটাই থাকে না। একটু ধৈর্য ধরো।

অনিন্দ্য কফি শপের ভিতর এদিক ওদিক বারবার চেয়ে দেখছিল। একটি ছেলে এসে অনিন্দ্যকে বলল— ‘স্যার, আপনাদের কী লাগবে?’

অনিন্দ্য বলল— ‘হুম, দুকাপ কফি।’

অনিন্দ্যর অনুসন্ধানী চোখের দিকে তাকিয়ে দোয়েল বলল— ‘অনিন্দ্যদা, তুমি কি কাউকে খুঁজছ?

অনিন্দ্য বলল— ‘না, না।’

কফি শপের ছেলেটি দুকাপ কফি দিয়ে গেল। দোয়েল কফির কাপে চুমুক দেবে এমন সময় একটি মেয়ে অনিন্দ্যর গলা পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে বলল— ‘অনিন্দ্য, আমি এসে গেছি। আজ সকালের ফ্ল্যাইটে কলকাতা ফিরলাম। হাউ আর ইউ ডারলিং?’

মেয়েটির বয়স পঁচিশের ঊর্ধ্বে নয়। গায়ে পেস্তা রঙের স্লিভলেস টপ, হাঁটু পর্যন্ত লম্বা কালো জিন্স। গায়ের রং খুব ফরসা বলা চলে না। বুদ্ধিদীপ্ত মুখ। নুডুলসের মতো কোঁকড়ানো চুল ঘাড় পর্যন্ত নেমে এসেছে। লম্বা প্রায় পাঁচ ফুট আট ইঞ্চি। কাঁধে লেদারের ভ্যানিটি ব্যাগ।

মেয়েটি ভ্যানিটি ব্যাগটা রেখে দোয়েলকে দেখে জিজ্ঞাসা করল, ‘হু ইজ শি অনিন্দ্য?’

অনিন্দ্য বলল— ‘কফি খেতে খেতে বলছি। বসো আগে। মেয়েটিকে বসিয়ে সে কফির অর্ডার দিল। দুমিনিটের মধ্যেই কফি চলে এল।’

দোয়েলের উদ্দেশ্যে অনিন্দ্য মেয়েটির দিকে হাত বাড়িয়ে বলল— ‘আলাপ করিয়ে দিই। ওর নাম শর্মিষ্ঠা বসু। বাড়ি কলকাতা। বর্তমানে সিঙ্গাপুরে পিএইচডি করছে। ফেসবুকে আমার সঙ্গে আলাপ হয়। আমরা একে অপরকে ভালোবাসি। সামনেই আমরা বিয়ে করতে চলেছি। আমার দোয়েল ছাড়া সাতকুলে কেউ নেই। দোয়েল সেন আমার অফিসের সহকর্মী এবং সহমর্মী।’

শর্মিষ্ঠা উচ্ছ্বসিত গলায় বলল— ‘তুমিই দোয়েল! অনিন্দ্যর মুখে কতবার যে তোমার নামটা শুনেছি কী বলব! নাইস টু মিট ইউ। আমাদের বিয়েতে তোমাকে থাকতেই হবে।’

দোয়েল এই পরিস্থিতিতে কী বলবে বা কী তার বলা উচিত হবে, ভেবে পেল না। বাইরের আকাশে ঘন কালো মেঘের মতো দোয়েলের মনের আকাশেও ঘন কালো মেঘে ছেয়ে গেছে। সে ঠোঁটের কোণে এক টুকরো হাসি এনে বলল— ‘দারুণ সারপ্রাইজ অনিন্দ্যদা। তুমি শর্মিষ্ঠার কাছে আমাকে এতটা গুরুত্ব দিয়ে। তোমাদের বিবাহিত জীবন সুখের হোক। অনেক দেরি হয়ে গেল। আমি আসি।’ অনিন্দ্য আর শর্মিষ্ঠার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে দোয়েল বাড়ি ফেরার বাসে উঠল।

সন্ধ্যা ছটা। বাসটা নিউ আলিপুরে স্টপেজ দিতেই দোয়েল নেমে পড়ল। অন্ধকারও চুপিসাড়ে রাস্তায় নেমেছে। হালকা বৃষ্টি শুরু হয়েছে। রাস্তাটা আজ বেশ ফাঁকা লাগছে দোয়েলের। তার মনের জমাটবাঁধা মেঘ অঝোরধারার শ্রাবণ হয়ে ঝরে পড়তে চাইছে। সে চলতে চলতে বারবার পিছন ফিরে তাকাচ্ছিল। দোয়েলের মনে সেই অনামি ছেলেটার মুখ ভেসে উঠল, যাকে আজ সকালে সে অপমান করেছে।

ফ্ল্যাটের কাছে এসে দোয়েল লক্ষ্য করল যে, ছেলেটি বারান্দা এবং জানলা কোথাও নেই। নেই কোনও গানের আওয়াজ। দোয়েলের কাছে ছেলেটি অপমানিত হয়ে আর হয়তো কোনও দুঃসাহসিক পদক্ষেপ নেবে না। দোয়েলের চোখের পাতা ভিজে আসছিল। তার চোখের জলকে ধুয়ে দিতে আকাশভাঙা বৃষ্টি নামল।

আরও একটু বৃষ্টি নামুক (পর্ব ২)

বিকালে কিছু জিনিসপত্র কিনতে দোয়েল বাইরে বেরোল। বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছেলেটি গান ধরেছে। সে কিছু বলবে ভেবেও বলতে পারে না ছেলেটাকে। ছেলেটার নাম-ধাম কিছুই সে জানে না। দোয়েলের ফ্ল্যাটের মুখোমুখি ফ্ল্যাটে অনামি ছেলেটির বাস। ছেলেটির বয়স বত্রিশের বেশি নয়। শ্যামবর্ণ লম্বা সুঠাম চেহারা। মুখভর্তি চাপ দাড়ি। মাথায় ঢেউখেলানো লালচে চুল। মুখটা বোকা বোকা। দোয়েলকে দেখার পর থেকেই ছেলেটির গান গাওয়া শুরু হয়। অফিসের বাস ধরার জন্য দোয়েল বাস স্টপেজে এলে ছেলেটিও প্রতিদিন তার পা অনুসরণ করে বাস স্টপেজে আসে। দোয়েল বাসে না ওঠা অবধি ছেলেটি সেখান থেকে নড়ে না। বেশ কয়েকদিন দোয়েল এসব লক্ষ্য করছে। রাস্তাঘাটে লোকজন থাকার ফলে ছেলেটাকে দোয়েল কিছু বলতে পারে না।

আজও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হল। দোয়েলের পিছনে অনামি ছেলেটিও চলল। একটু তফাতে থেকেই ছেলেটি দোয়েলের পা অনুসরণ করল। দোয়েল ফেরার পর দেখল ছেলেটিকেও নিজের ফ্ল্যাটে ঢুকতে।

সকালবেলা। স্নিগ্ধ আলোর দেখা নেই। আকাশের আজ মুখ ভার। অঝোরে বৃষ্টি নামতে পারে। কলকাতায় অবশ্য বৃষ্টিটা একটু বিলাসিতা করেই হয়। রমাও তাড়াহুড়ো করে কাজ সেরে চলে গেছে। বৃষ্টি নামার আগে দোয়েল অফিসে যাবার জন্য তৈরি হচ্ছিল। শ্রাবণের আকাশ যখন তখন জল ঢালবে এ আর নতুন কি!

দোয়েল ডার্ক ব্লু জিন্স, হোয়াইট টপ পরে অফিসের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ল। পাশের ফ্ল্যাটের সেই অনামি ছেলেটিও দোয়েলের পা অনুসরণ করে চলল। আকাশে মেঘের কারণে রাস্তায় লোকজন একটু কম। দোয়েল কিছুটা রাস্তা গিয়ে থেমে গেল। ছেলেটিও সঙ্গে সঙ্গে থেমে গিয়ে ঘাড়ে হাত দিয়ে পিছন ঘুরে দাঁড়াল। দোয়েল চলা শুরু করায়, সেও আবার চলতে শুরু করল। দোয়েল মনে মনে ঠিক করল আজ ছেলেটাকে মজা দেখাবে। বাস স্টপেজের কিছু আগে দোয়েল আবার কী মনে করে চারপাশটা দেখে ছেলেটির দিকে কয়েক পা পিছিয়ে এল।

দোয়েল ছেলেটির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে একটু গম্ভীর গলায় বলল— ‘পোশাক পরিচ্ছদ দেখে আপনাকে ভদ্র বাড়ির ছেলে মনে হয়। সবসময় আমাকে ফলো করেন কেন! মেয়ে দেখলেই বেসুরো গলায় সুর বেরোয় তাই না! ছেলেটির মুখটা আমচুরের মতো শুকিয়ে গেল।’

সে আমতা আমতা গলায় বলল— ‘দেখুন, আমার কোনও খারাপ উদ্দেশ্য নেই। আপনি যতটা আমাকে অভদ্র ভাবছেন ততটা অভদ্র আমি নই। আপনাকে দেখতে আমার কেন জানি না খুব ভালো লাগে। আপনাকে দেখতে তাই মন্ত্রমুগ্ধের মতো ছুটে চলি।’

দোয়েল বিরক্তির সুরে বলল— ‘যাক মানছেন যে আপনি আমাকে প্রতিদিন ফলো করেন। আপনাকে যদি দেখি ফারদার আমাকে ফলো করতে তাহলে অন্য স্টেপ নিতে আমি বাধ্য হব।’ হঠাৎ দোয়েল তার অফিসের সুদর্শন, সুপুরুষ অনিন্দ্য রায়ের কথা ভেবে ছেলেটিকে বলল— ‘একটা কথা আপনার জানা দরকার। আমি এনগেজড।’

ছেলেটি কেমন অবাক দৃষ্টিতে দোয়েলের দিকে তাকাল। সে মুখ নামিয়ে বলল— ‘সরি। ভুল হয়েছে।’ সে বাড়ির পথে পা বাড়াল। টুপটাপ বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে। দোয়েল হন্তদন্ত হয়ে বাসে উঠে পড়ল।

সারাদিন অফিসের কাজকর্মে দম ফেলার ফুরসত পায়নি দোয়েল। রবিবার অফিস বন্ধ থাকায় সোমবার কাজের চাপ একটু বেশিই হয়। ফাইলপত্র জমা দিয়ে দোয়েল অফিস থেকে বেরোবে এমন সময় অনিন্দ্য বলল— ‘দোয়েল, তোমার সঙ্গে আমার কিছু ব্যক্তিগত কথা আছে। ওয়েট ফর জাস্ট ফাইভ মিনিটস।’

দোয়েল মনে মনে বলল— ‘হয়তো অনিন্দ্যদা আজ তার কাছে ধরা দেবে। মুখ ফুটে বলবে ভালোবাসার কথা। লুকোচুরি শেষ হবে। এসব ভেবে ভোরের সূর‌্যের মতো লজ্জায় রাঙা হয়ে গেল তার মুখ।’

অনিন্দ্য এসে দোয়েলকে বলল— ‘চলো আমরা একটা কফি শপে যাই।’

আরও একটু বৃষ্টি নামুক (পর্ব ১ )

সকাল সাড়ে ছটা। বদ্ধ ঘরের নিস্তব্ধতাকে চুরমার করে মর্নিং অ্যালার্ম এবং কলিং বেল দুই-ই তারস্বরে বেজে উঠল। যৌথ শব্দে দোয়েলের ঘুমের বারোটা বেজে গেল। রাতের পোশাক পরিবর্তন না করেই মুখে একরাশ বিরক্তি এনে বলল— ‘রবিবার ছুটির দিনেও একটু শান্তিতে ঘুমাতে দেবে না রমা। ভালো লাগে না আর।’

রমা দোয়েলের ফ্ল্যাটের কাজের লোক। বছর পাঁচ হল সে দোয়েলের ফ্ল্যাটে কাজ করছে। দরজা খুলে দিয়ে দোয়েল বলল— ‘আসুন ম্যাডাম। আচ্ছা, তুই কি রাত্রে ঘুমোস না! আকাশে মেঘ মেঘ করেছে দেখে আমি ভাবলাম দেরিতে আসবি।’

দেরি করে এলে হবে নাকি! আরও দুবাড়ির কাজ আছে।

রমার কথায় দোয়েল আর কোনও প্রতিবাদ করল না। আজকাল খুব কাজের লোকের সমস্যা। রবিবার বলে দোয়েলের কোনও ব্যস্ততা নেই। অন্যদিন তো দশটার মধ্যে তাকে অফিস বেরোতে হয়।

রমা হাতের ব্যাগটা নামিয়ে দোয়েলকে বলল— ‘তুমি একটু ঘুমিয়ে নাও না। আমি ঘরের কাজ সেরে তোমাকে ডাকব।’

তোর জন্য ঘুম হবে না। আগে আমায় চা করে দে।

চা দিচ্ছি গো। তোমাকে দেখতে কিন্তু হেবি লাগছে পোশাকটাতে।

দোয়েল স্মিত হেসে টাওয়েল কাঁধে নিয়ে বাথরুমে চলে গেল।

রমারও চোখ আছে। দোয়েল সত্যিই সুন্দরী। শর্ট নাইট ড্রেসে তাকে বেশ দেখাচ্ছিল। দুধের মতো সাদা গায়ের রং। মুখশ্রী পানপাতার মতো। বয়স সাতাশ বছর। মেদহীন ছিপছিপে শরীর। বটগাছের ঝুরির মতো পিঠে নেমে এসেছে ঘন স্টেপ কাট চুল। টানা টানা জলভরা দুটি চোখ। নাইট ড্রেসের বাইরে অনাবৃত লোমহীন দুটি পা দেখলে যে-কারওর চোখ আটকাতে বাধ্য।

রমা কিছুক্ষণ পর চা করে বাথরুমের দরজায় ধাক্কা দিয়ে বলল— ‘দিদিমণি, চা তৈরি।’

দোয়েল বাথরুম থেকে বেরিয়ে এসে বলল— ‘আমার চা রেখে দে। তুই চা খেয়েছিস?’

রমা বলল— ‘খেয়েছি।’

স্নান সেরে নীল সালোয়ার কামিজে দোয়েলের সর্বাঙ্গে একটা অদ্ভুত স্নিগ্ধতা ছড়িয়ে পড়ছিল। দোয়েল একটু ধমক দিয়ে বলল— ‘পাকামি করিস না তো।’

দোয়েল চায়ের কাপ হাতে নিয়ে হোয়াটস অ্যাপে ফেসবুকে চোখ বুলিয়ে নিল। হোয়াটস অ্যাপে, অনিন্দ্য রায়ের মেসেজ চোখে পড়ল। অনিন্দ্য রায় দোয়েলের অফিসের বস। ভদ্রলোকটি চ্যাট করতে ওস্তাদ। অফিসে প্রায়ই দোয়েলকে শোনান, তিনি কাছের মানুষদের ছাড়া কাউকে ফোন অথবা এসএমএস করেন না। দোয়েলকে তিনি কাছের ভাবেন বলেই খোঁজখবর নেন।

অনিন্দ্যর অনেক আচরণই দোয়েল তিন বছর প্রশ্রয় দিয়ে আসছে। দোয়েল কোনওদিনই অনিন্দ্যর মুখের উপর কিছু বলতে পারে না। প্রথমত, দোয়েলের অফিসের বস অনিন্দ্য রায়। দ্বিতীয়ত, দোয়েলের প্রতি অনিন্দ্য রায়ের আচরণ অন্য সকল অফিস স্টাফদের থেকে আলাদা। এই আলাদা হওয়ার কারণেই অনিন্দ্যর প্রতি দোয়েলের মনে একটা সুপ্ত দুর্বলতা তৈরি হয়েছিল। দোয়েলের দৃঢ় বিশ্বাস গড়ে উঠেছে যে, অনিন্দ্য রায় তাকে ভালোবাসে।

দোয়েল এই যুগের মেয়ে হলেও মেয়ে তো। এখনও মুখ ফুটে সে অনিন্দ্যকে নিজে থেকে আগ বাড়িয়ে বলতে পারেনি তার মনের কথা। তাই দোয়েল অনিন্দ্যকে সম্বোধনের সময় অনিন্দ্যদা-এর দা-টা এখনও ছেঁটে ফেলতে পারেনি।

অনিন্দ্য কাল রাত্রে দোয়েলকে ফোনে বলেছে বলো তো দোয়েল রবিবার আমাদের জীবনে কেন আসে! আই মিস ইউ। এই মিস করার কারণ দোয়েল অনুসন্ধান করতে পারে না।

কিছুক্ষণ আগে রমা কাজ করে চলে গেছে। ব্রেকফাস্ট করে নিজের অগোছালো বেডরুম গোছাতে গিয়ে জানালার দিকে দৃষ্টি যেতেই দোয়েলের মেজাজ হঠাৎ পালটে গেল। সে বিরক্তিতে বিড়বিড় করে বলে উঠলজানলা খুললেই ফাটা রেকর্ডের মতো চার বছর হয়ে গেল এক লাইন মেরে সামনে ওয়ালি খিড়কি মে এক চাঁদ কা টুকরা রহতে হ্যায় শুনে যাচ্ছি। জাস্ট অসহ্য। ছেলেটিকে নেওয়া যাচ্ছে না। সে জানলা বন্ধ করে দিয়ে ল্যাপটপে অফিসের কাজ সারছিল। কাল অনিন্দ্যদাকে সব ফাইল ক্লিয়ার করে তার জমা দেওয়ার কথা। দোয়েল বলেই অনিন্দ্য বেশি সময় দিয়েছে।

পড়ার জন্য সীমাহীন গল্প-নিবন্ধসাবস্ক্রাইব