সমর্পিতা (পর্ব-১)

প্রথম সারির অভিনেতা সুবিমল রায়ের একমাত্র ছেলের বিয়েতে ফোটোগ্রাফির অর্ডার পাওয়াটা তো আর চাট্টিখানি কথা নয়। অহংকারে মাটিতে পা পড়ছিল না শুভজিতের। বদলে মুচকি হেসে বলেছিলাম, ‘তা ভাই বেশ তো, আশপাশের মানুষগুলো যদি উন্নতির শিখরে পৌঁছোতে পারে এবং সেটা যদি আবার বন্ধুবান্ধব হয়, শুনে ভালোই লাগে।’

তারপর কেটে গেছে তিনটে দিন। কাল থেকে গা-টা কেমন যেন ম্যাজম্যাজ করছে। সেদিন শুভজিৎদের বাড়ি থেকে ফেরার পথে বৃষ্টিতে ভিজেছিলাম বটে। তাই বুঝি, হালকা টেম্পারেচার এসেছে। তার উপর ইয়ার এন্ডিং এর কারণে অমানুষিক কাজের চাপ। শরীর আর দিচ্ছিল না। তাড়াতাড়ি ডিনার সেরে শুয়ে পড়েছিলাম। মাঝরাতে হঠাৎ-ই অন্বেষা, মানে শুভজিতের বউয়ের ফোন। উৎকণ্ঠিত গলায় খবর দিল শুভজিতের অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। সুবিমল রায়ের ছেলের বিয়েতে, ফোটোগ্রাফির কাজ সেরে ফেরার সময়, যে-গাড়িতে ফিরছিল সেটা লরির ধাক্কায় উলটে গেছে। জরুরি অবস্থায়, স্থানীয় লোকেরা পাশেই একটি সরকারি হাসপাতালে ভর্তি করেছে। এখন আইসিসিইউ-তে।

এরকম একটা খবর শুনে কি থাকা যায়? শরীরের কথা ভুলে অগত্যা ছুটে গেলাম হাসপাতালে। আমাকে দেখা মাত্রই অন্বেষার দু-চোখ দিয়ে জল গড়াতে লাগল। খানিক আশ্বস্ত করার জন্য এগোব, ঠিক তখনই অপারেশন থিয়েটার থেকে বেরিয়ে ডাক্তার জানালেন, পেশেন্টের অবস্থা যথেষ্ট সংকটজনক, ৭২ ঘন্টা না কাটলে কিছু বলা সম্ভব নয়।

অতএব অপেক্ষা ছাড়া আর কিছু করণীয় নেই আমাদের। সবকিছু এখন উপরওয়ালার হাতে। অপেক্ষমান মূর্তির মতো আইসিসিইউ-এর সামনের বেঞ্চে বসে রইলাম আমরা দুজনে। অন্বেষাকে ভীষণ বিধ্বস্ত লাগছিল।

একবার জিজ্ঞাসাও করলাম, ‘একটু চা খাবি? ভালো লাগবে।’ কোনওরকমে ঘাড় নাড়িয়ে না বলেই বেঞ্চে মাথাটা ঠেকিয়ে চোখ দুটো বুজল। সত্যিই মেয়েটাকে দেখলে ভারি কষ্ট হয়। বিয়ের পর থেকে একটা দিনও সুখ পেল না।

মনে পড়ে অতীতে শুভজিৎ আর অন্বেষার প্রথম সাক্ষাতের কথা। অন্বেষা তখন বিকম পাশ করে চাকরি খুঁজছে। এ-অফিস সে-অফিসে দরখাস্ত জমা দিয়ে বেড়াচ্ছে। আমাকেও বলেছিল, ‘ভানুদা তোমার তো অনেক চেনাজানা আছে, দেখো না কোথাও যদি কোনও সুযোগসুবিধা থাকে।’

ভানু আমার ডাকনাম। আমার ঠাকুমার দেওয়া বড়ো আদরের নাম। আমাদের বাড়ির পাশেই অন্বেষার মামারবাড়ি। ছোটোবেলায় মা মারা যাওয়ায় ও মামার বাড়িতে দিদার কাছেই বেশি থাকত। সেই থেকেই আমি ওর ভানুদা। আমার থেকে বছর সাতেকের ছোটো। কোনও অসুবিধা হলেই ভানুদা আছে।

সেই সময় আমাদের অফিসেই অ্যাকাউন্টস্ ডিপার্টমেন্টে একটা পদ খালি ছিল। মালিককে বলেকয়ে একটা চাকরির বন্দোবস্ত হয়েছিল। তার জন্য ধন্যবাদ জানাতে এসেছিল অন্বেষা। ঘটনাক্রমে ওইদিন শুভজিৎও হাজির। সেই প্রথম দেখা দুজনের।

অন্বেষা খুব সুন্দরী না হলেও বেশ একটা আলগা চটক রয়েছে। কথাবার্তায়ও পারদর্শী। কথার মারপ্যাচেই বিশ্বজয় করতে পারে সে। তার উপর অল্পবয়সি অমন চটপটে মেয়েকে ভালো লাগাই স্বাভাবিক।

জয়েনিং ডেট অনুযায়ী ৩ অক্টোবর অফিস জয়েন করল অন্বেষা। দায়িত্ব নিয়ে অন্যান্য স্টাফদের সঙ্গে পরিচয় করানো ছাড়াও ওর কাজও বুঝিয়ে দিলাম আমি। সপ্তাহ ঘুরতে না ঘুরতেই এক কর্মচারী রিপোর্ট দিয়ে গেল, ‘সাহেব, নতুন ম্যাডাম খুব ভালো। এত মিষ্টি কথা বলেন যে অন্যান্য সাহেবরাও খুব তারিফ করেন ওনার।’

শুভজিৎ মাঝেমধ্যে আমার অফিসেও আসত। খেয়াল করে দেখেছি, ও আমার সঙ্গে কথা বলত ঠিকই, কিন্তু ওর চোখ থাকত অন্বেষার দিকে। একদিন তো বলেই ফেলল, “আরে বস, এটা ওই মেয়েটা না, সেদিন যাকে তোদের বাড়িতে দেখেছিলাম?’

‘হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছিস। আসলে সেদিন ও বাড়ি ফেরার জন্য এত তাড়াহুড়ো করছিল, যে তোর সঙ্গে ওর পরিচয় করানোটাই সম্ভব হয়নি। তবে মনে হচ্ছে তোদের পরিচয়টা খুব শিগগিরি করাতে হবে।’

ঠিক সেই সময় দেখলাম অন্বেষা ফাইল হাতে অ্যাকাউন্টট্যান্ট রতনদার টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে। রতনদা অন্য কিছু কাজ নিয়ে ব্যস্ত। তাই সামনে দাঁড়িয়ে উশখুশ করছে অন্বেষা। এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। আমার দিকে তাকাতেই ইশারা করে ডাকলাম। দু’এক কথায় রতনদাকে মনে হয় কিছু বলল, হয়তো আপনি ফ্রি হলে আসছি’ এমন কিছু। তারপর সোজা আমার টেবিলে।

‘আরে দাঁড়িয়ে রইলি কেন? বস।’

একটু হেসে অন্বেষা জবাব দিল, ‘না না ঠিক আছে। কিছু বলবে?’

‘বলছি বলছি আগে বস। খানিক বসলে তোর কাজের এমন কিছু ক্ষতি হবে না।’

বসতেই হল অন্বেষাকে। এদিক-ওদিক টুকটাক কিছু কথা হওয়ার পর, সপ্রতিভ ভাবে বললাম ‘দেখেছিস তোদের আলাপটাই করানো হয়নি। অন্বেষা এ হল শুভজিৎ।’ একে-অপরের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হাসি বিনিময় হল দুজনের। বললাম, ‘আমার কলেজের বন্ধু, ‘আজকের বার্ত’-র ফোটোগ্রাফার। পাশাপাশি অবশ্য একটা স্টুডিয়োও চালায়। আর এই হল অন্বেষা। আমার কলিগ কাম বোন, আবার বন্ধুও বলতে পারিস। ভারি মিষ্টি মেয়ে।’

লজ্জায় লাল হয়ে ওঠে অন্বেষার মুখ। বলে, ‘সত্যি ভানুদা তুমিও না ।

ক্রমশ…

সিলেবাসের বাইরে (শেষ পর্ব)

শেষ পর্ব

অয়নের বাবা রিকশা চালাত। একদিন এক লরির ধাক্কায় কোমরের হাড় ভেঙে শয্যাশায়ী। অভীক বাড়িতে আর কাউকে দেখতে পেল না। পরিচয় দিতে অয়নের বাবা বসতে বললেন অভীককে পাশে রাখা মাদুরে। অয়নের বিরুদ্ধে কোনও নালিশ নিয়ে এসেছি কিনা জিজ্ঞাসা করলেন। কথা বলতে বলতেই অয়ন আর ওর মা বাড়িতে এল।

এদিকে অয়ন পাড়ায় খবর পেয়ে গেছে, স্যার এসেছেন বাড়িতে। খারাপ কিছু হতে পারে তাই মাকে কাজ থেকে ডেকে নিয়ে এসেছে। দু’জনের মুখের ঘাম বলে দিল দৌড়ে এসেছে ওরা। দু’জনের চোখেই একমুখ দুশ্চিন্তা। আশপাশের কিছু উৎসাহী মুখ উকি মারতে লাগল। অভীক ওদের স্বাভাবিক হতে বলে এক গেলাস জল চাইল অয়নের মায়ের কাছে।

অয়নের মা অয়নের মুখে আজকের স্কুলের ঘটনা শুনেছে। রাগে ঘেন্নায় আলোকদের বাড়ি আর কাজে যাবে না বলে এসেছে। অয়ন আগে কখনও জানায়নি আলোকের কোনও কথা ওর মাকে। কাজ চলে গেলে ওদের সংসার চলবে কী করে এই ভেবে!

অয়নের দিকে অভীক একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল। ওর চোখে এখন ও নিজের ছেলেবেলা দেখতে পাচ্ছে! অয়নকে কাছে ডেকে নিল। ওর মা বাবাও যেন একটু একটু করে শান্ত হতে থাকল। অভীক ওদের নিজের ছেলেবেলার গল্প বলতে লাগল। গরিব হলে এরকম ঘেন্না ও নোংরা আচরণ করাটা তথাকথিত পয়সাওয়ালারা যেন নিজেদের অধিকার ভেবে ফেলে। অভীকের কথা শুনতে শুনতে অয়নের পরিবারের সকলে যেন সমব্যথী হয়ে পড়ল। অভীক বুঝল, মাটি তৈরি হয়েছে। এবার বলা যায় ওর প্রস্তাবটা।

অভীক সরাসরি অয়নের মা বাবাকে বলল-কিছুদিন অয়নকে ওর কাছে রাখতে চায়। ওর পড়াশোনার সব দায়িত্ব সে নিতে চায়। সকলকে দেখিয়ে দিতে চায়, গরিবি কোনও অপরাধ নয়। বরং এটা জীবনে এগিয়ে চলার বড়ো একটা প্রেরণা হতে পারে। স্কুল থেকে অভীকের বাড়ি কুড়ি মিনিটের দূরত্বে। স্কুল ফেরত অয়ন প্রতিদিন অভীকের সাথে যাবে ওর বাড়ি। রাতে পড়াশোনা করে অভীকের বাড়িতে খেয়েদেয়ে ফিরবে ওর মা বাবার কাছে। দরকারে অভীক ওকে একটা সাইকেল কিনে দেবে। ওতে যাতায়াতের সুবিধা হবে। পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে আবার অভীকের কাছে পড়তে যাবে অয়ন। ওখানে চান খাওয়া করে ওরা একসাথেই স্কুলে চলে আসবে। শনিবার, রবিবার ও ছুটির দিন অয়ন বাড়িতে থাকবে ওর নিজের মা বাবার কাছে। কারণ ওই দিনগুলোয় অভীক যায় গবেষণার কাজে।

প্রস্তাব শুনে অয়নের বাবা-মার চোখ ভরে জল এল। হঠাৎ অয়নের মা বলে উঠলেন, ঠিকই বলেন মন্দিরের ঠাকুর মশায়! মন থেকে ডাকলে ঈশ্বরের দেখা পাওয়া যায়। উনি সাহায্য করতে মানুষের রূপ ধরে মাটিতে নেমে আসেন। বেশ জোরেই কেঁদে উঠল অয়নের মা। ওর বাবার চোখেও জল। অয়ন কেমন ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে। ওর এইমাত্র শোনা স্যারের কথাগুলো যেন বিশ্বাস হচ্ছে না।

অভীক আকাশে মুখ তুলে তাকিয়ে বাবাকে খুঁজতে লাগল। বাবা বলত, বড়ো হয়ে মানুষের পাশে দাঁড়ালে তবেই জানবি তোর শিক্ষা সার্থক। ও দেখল, চাঁদের আলোয় ভাসছে অয়নদের সারা উঠোন। ওদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে অভীক চলল মায়ের কাছে। সারা বুক জুড়ে একটা ভালোলাগার নদী বইছে, ছলাৎছল ছলাৎছল!

পরদিন থেকে শুরু হল অয়নের নতুন লড়াই। সহকর্মীরা অভীককে অনেক উৎসাহ দিল। মা অয়নকে যেন নিজের নাতি ভেবে বসে আছে। জোর করে খাওয়াবে সামনে বসিয়ে। চম্পা মাসিও খুব খুশি। যেখানে বুকের রক্ত দিয়ে মানুষ করা ছেলে মা-বাবাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেয় বৃদ্ধ বয়সে, সেখানে অভীকের মতো মানুষরা অপরের ছেলেকে সমাজের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েছে।

চম্পা মাসিও অয়নকে খুব ভালোবাসে। এক একদিন জোর করে অয়নের বাবা মার জন্য খাবার পাঠিয়ে দেয়। স্কুল ও স্কুলের বাইরে অভীকের এই কাজ যেন এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। শ্রদ্ধায় মাথা নত করে অহঙ্কারী মানুষগুলো ওর কাছে। সবচেয়ে পরিবর্তন হয়েছে অয়নের ক্লাসে। আলোক আর ওকে ‘ছোটোলোক’ বলে না। ওর কাছে ক্ষমা চেয়ে নিয়েছে সে। এখন অয়নের মনের মধ্যেও সে দুঃখ-কষ্ট আর নেই।

এদিকে অয়নের লেখাপড়ার উন্নতি, সত্যিই চোখে পড়ার মতো। অভীক মনপ্রাণ ঢেলে ওকে অর্জিত সব বিদ্যা যেন উজাড় করে দেয়। এটা অভীকেরও একটা লড়াই। অয়নের মাধ্যমে সমাজকে যেন ও একটা বার্তা দিতে চায়। একটু সহানুভূতি, একটু বাড়িয়ে দেওয়া হাত অসুবিধায় পড়া মানুষগুলোর জগৎ বদলে দিতে পারে।

সেদিন স্কুল জুড়ে সকলের চোখে মুখে আনন্দ! প্রধান শিক্ষক মহাশয় আনন্দে অভীককে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। সহকর্মীরা উচ্ছ্বসিত। অয়ন ষষ্ঠ শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষায় প্রথম হয়েছে! একটা লড়াইয়ের জয় হয়েছে। অভীক-অয়নের লড়াই ঘুণপোকায় আক্রান্ত নষ্ট হতে থাকা ছাত্র-শিক্ষকের সম্পর্কে যেন এক নতুন দিশা! শিক্ষক ও ছাত্রদের পবিত্র সম্পর্ক যেন আলোয় আলোয় ভরে যায় আগামীতে। অভিভাবক, শিক্ষক, ছাত্র, সাধারণ মানুষ- সকলের প্রার্থনা আজ এটাই।

এদিকে কামিনী ফুলের গাছটার নীচে অয়ন ওর মায়ের সাথে দাঁড়িয়ে শিরদাঁড়া সোজা করে। প্রতিবাদের এক নতুন ভাষা চেয়ে চেয়ে দেখছে স্কুলে উপস্থিত ছাত্র, অভিভাবক সকলে। অভীক ওর ছেলেবেলার শিক্ষকদের স্মরণ করল। এ যেন এক গুরুদক্ষিণা ওর। হঠাৎ চোখ পড়ল দেয়ালে আঁকা সেই দাড়িবুড়োর দিকে। মুচকি হেসে যেন বলছেন, কিছুই হারায় না। রাতের সব তারাই থাকে দিনের আলোর গভীরে!

 

সিলেবাসের বাইরে (পর্ব- ১)

অভীকের একমাত্র আশ্রয় মা, কিডনির সমস্যায় এখন শয্যাশায়ী। গবেষণার কাজ প্রায় থেমে। স্যারের “বিগ পুশ”-এও কোনও কাজ হচ্ছে না। মায়ের ডায়ালিসিস চলছে মাসে দুটো করে। অনেক টাকার ধাক্কা। একটা চাকরির নিতান্ত প্রয়োজন। তাই স্কুল সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে অর্থনীতির সহকারী শিক্ষক পদে যোগদান গ্রামেরই স্কুল আরামবাগ বিদ্যানিকেতনে। মেধা তালিকার ক্রমসংখ্যা একদম প্রথম দিকে থাকার ফল।

শনিবার বিকেল ও রবিবার গবেষণার কাজে বের হতে হয়। ও স্বনির্ভর গোষ্ঠী নিয়ে সামাজিক ও অর্থনৈতিক পালা বদলের যে-ইতিহাস তৈরি হতে শুরু করেছে তা সমাজ পরিবর্তনের হাওয়া মোরগ হয় কিনা তার ওপর চলছে ওর গবেষণা। স্বনির্ভর গোষ্ঠী গ্রামের প্রত্যন্ত পরিবারে একটা উন্নয়নের দিশা দেখাচ্ছে। কিছু মহিলা দল তৈরি করে কাজ করছে।

ব্যাংক থেকে ঋণ নিচ্ছে যৌথ ভাবে। তাতে দায়বদ্ধতা থাকছে সকলের। সেই ঋণের টাকা আয় উপার্জনকারী কোনও কাজে লাগিয়ে আয় করছে এবং ব্যাংকের ঋণ শোধ করছে। বাংলাদেশের অধ্যাপক মহম্মদ ইউনুসের দেখানো পথে চলছে এই ‘সেল্ফ হেল্প গ্রুপ’-এর কর্মধারা। উন্নয়নের একটা উদ্দীপনা সারা বিশ্বেই দেখা যাচ্ছে।

শিক্ষকতার কাজে অভীকের আগ্রহ নতুন নয়। সংসার চালাতে এর আগে ও প্রাইভেট টিউশনিও করেছে অনেক। বাবার মৃত্যুর পর জমানো টাকায় আর ক’দিন চলবে! ভালো ছাত্র হিসেবে নামডাক ওর টিউশনির পসার বাড়িয়ে ছিল খুব। চাকরিটা পেয়ে ও সব টিউশন ছেড়ে দিয়েছে। ওর বন্ধু প্রবালকে দিয়ে দিয়েছে। এখন শুধু মা, স্কুল, গবেষণা নিয়েই চলছে।

মায়ের কাছে সবসময় থাকার জন্য চম্পা মাসিকে রেখেছে। অসহায় বিধবা চম্পা মাসি ওদের বাড়িতেই থাকে। মায়ের দেখাশোনার সাথে বাড়ির সব কাজই করে। শনিবার স্কুল ছুটির পর, রবিবার ও ছুটির দিনগুলোয় গবেষণার কাজ জোর কদমে করে অভীক।

স্কুলের পরিবেশ বেশ ভালোই। সহকর্মীরা খুব তাড়াতাড়ি ওকে নিজেদেরই একজন করে নিয়েছে। স্কুলের শৃঙ্খলা বেশ ভালো। লেখাপড়ায় ছাত্রছাত্রীদের গুণগত মানও বেশ উঁচুতে। ভালোই চলছে ওর শিক্ষকতার দিনগুলো। বেশ মন দিয়ে কাজ করে ও। মা বলেন – যে অন্ন দেয় তাকে কখনও ঠকাবি না। অভীক স্কুলে ওর সেরাটা দেবার চেষ্টাই করে। সহকর্মীরা ও প্রধানশিক্ষকও খুশি ওর কাজে।

নীচু শ্রেণির ক্লাসে ও গ্রামারটা পড়ায়। ভিত শক্ত না হলে ইংরাজিটা শিখবে কী করে! সিক্স-এর ক্লাসে সেদিন ও সবে ক্রিয়ার কাল শুরু করেছে। হঠাৎ দেখে পিছনের বেঞ্চে একটি ছেলে মুখ নীচু করে বসে। মাঝে মাঝে ওর সারা দেহ কেঁপে কেঁপে উঠছে। ফুঁপিয়ে কাঁদছে যেন! কৌতূহলী হয়ে বিষয়টা জানার চেষ্টা করতেই ওর পাশের ছেলে যা বলল তা শুনে খুব কষ্ট হল অভীকের।

যে-ছেলেটি কাঁদছে তার নাম অয়ন। ক্লাশের মনোযোগী ছাত্র। ক্লাসে মাঝেমাঝে অভীকের প্রশ্নের উত্তরও দেয়। অন্য শিক্ষকদের কাছ থেকে খবর নিয়ে জেনেছে, অন্য বিষয়েও বেশ ভালো। ছেলেটির রোল পনেরো। পাশের ছেলে রমেন বলল, ওর কান্নার কারণটা।

অয়নরা খুব গরিব। ওর মা লোকের বাড়ি কাজ করে সংসার চালায়। ওর মা ক্লাসের চতুর্থ রোল নম্বর, আলোকদের বাড়িতে কাজ করে। আলোক ক্লাসের মনিটর। অয়নের মা লোকের বাড়ি কাজ করে বলে অয়নকে আলোক ‘ছোটোলোক’ বলে গালাগাল করে। ভীতু চেহারার অয়ন কিছু বলতে পারে না। শুধু কাঁদে। ক্লাসের অন্য ছেলেরা অয়নের হয়ে বলতে গেলে আলোক মনিটর বলে উলটোপালটা নাম তুলে স্যারেদের কাছে বকুনি খাওয়ায়।

অয়ন আজ আগে এসে প্রথম বেঞ্চে বসেছিল। আলোক পরে এসে ওর ব্যাগ শেষ বেঞ্চে রেখে ওর জায়গায় বসে। শুধু তাই নয়, আলোক অয়নকে সকলের সামনে বলে – ছোটোলোকের ছেলে সামনের বেঞ্চে বসবি কী! তুই রোজ শেষ বেঞ্চে বসবি। নাহলে তোর নামে উলটোপালটা নালিশ করব স্যারেদের কাছে। রীতিমতো হুমকি! চমকে উঠল অভীক। এইটুকু ছোটো ছেলেটার বুকে এতো ঘৃণা! অয়নের জন্য একটা কান্না যেন বুক ফেটে বেরিয়ে আসতে চাইছে। কোথায় যেন মিলে যাচ্ছে অভীকের ছেলেবেলা অয়নের সাথে।

অভীকের বাবার মৃত্যুর পর আশপাশের পরিচিত আত্মীয়দের ব্যবহার, ও ভোলেনি। কথায় কথায় গরিব বলে একটা ঘেন্না ছুড়ে দিত ওদের দিকে। মাকে জড়িয়ে ধরে শুধু কাঁদত সেই সময়। আগুন চোখে মা শুধু বলত, সুদিন আসবেই। মুখ বুজে অভীক সেই সুদিনের প্রতীক্ষা করে গেছে। ঈশ্বরের দূতের মতো কিছু শ্রদ্ধেয় শিক্ষককে তখন ও পাশে পেয়েছে। স্যারেরা অভীকের লেখাপড়ায় সব সমস্যা মিটিয়েছেন। তাঁদের, শুধু তাঁদেরই জন্যে অভীক অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেছে এবং আজ গবেষণায়। অয়নের কান্নাভেজা দু’চোখ ওর বুকে ঝড় তুলেছে আজ!

স্টাফরুমে ফিরে ও সহকর্মীদের বলল সব। প্রধানশিক্ষকও শুনলেন সব। পরের দিন আলোকের অভিভাবক-কে ডাকার ব্যবস্থা করলেন। অভীক বুঝল, অয়নের মাকে কালই অপমান করে কাজ থেকে ছাড়িয়ে দেবে ওরা। তাই যা করার আজই করতে হবে। স্কুল ছুটির পর অভীক ছাত্রদের জিজ্ঞেস করে করে অয়নের বাড়িতে গিয়ে পৌঁছোল। দেখল মাটির বারান্দায় অয়নের বাবা শুয়ে।

ক্রমশ…

 

 

কালো রাস্তার মানুষ (শেষ পর্ব)

শেষ পর্ব  

বিয়ের পর বছর চার কেটে গেলেও হারু ও ফুলমণির কোনও সন্তান জন্মায় না। ফুলমণির মাসের রক্তপাত বন্ধ হয়, পেটে সন্তানের উপস্থিতি বুঝতে পারে। কয়েকমাসের মধ্যে একদিন হঠাৎ রক্তপাত হতে শুরু করে। পরনের কাপড় ছেড়ে রক্ত গড়িয়ে আসে পায়ের দিকেও। এই রক্তপাত বড়োবাবুদের কাছে এটা খুব ভালো খবর হলেও ফুলমণির জন্যে খুবই দুঃখের।

হারু ফুলমণিকেই দোষ দেয়। ঝগড়া করে, খাবার উলটে দেয়, মদ খাবার পরিমাণ বাড়ায়। এমন ভাবেই চার বছর কেটে যায়। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে এই তিন মাস হল একটা মেয়ে জন্মালেও হারু কিন্তু তার আগের জায়গায় ফিরে আসেনি, বরং একটা গা’ছাড়া ভাব তাকে জাপটে ধরেছে। মুখে কিছু না বললেও ফুলমণি বেশ বুঝতে পারে।

পরের দিন খুব তাড়াতাড়িই ঘুম ভেঙে যায়। ফুলমণি ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে তাঁবুতে হারু নেই। মেয়েটা রাতে বেশ কয়েকবার কেঁদে উঠেছিল, কেমন যেন দম বন্ধ করা কান্না, গা পুড়ে যাচ্ছে জ্বরে। কাল সকালেও না কমলে বড়োবাবুর হাতে পায়ে ধরে একটা ডাক্তার দেখাতেই হবে। এদিকে সারা রাত বৃষ্টিও পড়েছে। রাতভর সে নিজেও ঘুমোতে পারেনি। ভোরের দিকে চোখদুটো বুজে আসে। ফুলমণি বাইরে বেরিয়ে দেখে বাকি সবাই উঠে গেলেও কাজের কোনও তোড়জোড় নাই।

বৃষ্টি থামলেও আকাশের মুখ ভার, এইরকম থাকলে আজ আর কাজ হবে না। চোখে মুখে জল দিয়ে হাঁড়ি থেকে পান্তা বের করে নিজে নেয়, হারুর জন্যেও ঢাকা দিয়ে রেখে দেয়। কিছু সময় পরেই দেখে দূরের চা-দোকানের ওই লোকটা তার দোকান ছেড়ে আরেকটু উপরের দিকে উঠে গেছে। জিনিসগুলো একটা একটা করে সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।

মেয়েটার শরীরের কথা ভেবে ফুলমণি ছেলেদের তাঁবুর কাছে এসে বাইরে থেকেই জিজ্ঞেস করে, “আমার লোকটা কোথায় গো?’

—পকুরের পানে গেইচে, উ আর সুবলা।

—আজ কাজ হবেক?

—দেখি বাবু যা বলবেক, ম্যাঘ করিছে, জল পড়লে আর কী করে কাজ বাগাব? রাজুয়ার গলা।

ফুলমণি একপা একপা করে দোকানের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘কি গো আজ রুটি দিবে না?’ দোকানি প্রথমে কোনও উত্তর দেয় না। ফুলমণি আবার জিজ্ঞেস করে। এবার দোকানি বিরক্ত হয়!

—দেখছ না, আজ কী অবস্থা, এক্ষুনি গাড়ি এসে সব ভেঙে দেবে, পিছিয়ে গেলাম। বৃষ্টি আরম্ভ হলে এই মানুষটাকে কোথায় রাখব কে’জানে?’

ফুলমণি তাকিয়ে দেখে দোকানির বউটা সেই একই ভাবে শুয়ে আছে। মাথার উপর খোলা আকাশ, ঝোড়ো হাওয়া বয়ে যাচ্ছে। ফুলমণি মাথা নীচু করে নিজের তাঁবুতে ফিরে মেয়েদের তাঁবুর কাছে এসে দাঁড়ায়, ‘কাঁদেনি তো?”

—না, শুনি নাই। রুবি উত্তর দেয়।

—আজ তো কাজ হবেক নাই, চল চানট করে আসি গা। একটু ভালো করে রান্না চাপাইতে হবেক।

–তুই উদিকে কুথাকে গিছিলি?

—উই যে, আজ উয়াদের দুকানটা ভেঙি দিবেক বলিছে, সেই…।

টিপ টিপ বৃষ্টি আরম্ভ হয়, ফুলমণি নিজের তাঁবুর ভেতর আসে। মেয়েটা এখনও উঠে নাই। ‘ভালো হল!’

পাশের তাঁবুতে গিয়ে মেয়েটাকে দেখবার জন্যে বলে ফুলমণি আরও কয়েকজনের সাথে স্নান করতে যায়। ফেরবার সময় একটু দেরি হয়ে যায়। বৃষ্টির জন্যে বেশ কয়েকবার দাঁড়াতে হয়েছিল। মাথায় গামছা ঢাকা দিয়ে তাঁবুতে ফিরতেই ভয় পেয়ে যায়। তাঁবুর ভেতর এক পাশে হারু কেমন ভাবে বসে আছে, তার মুখে কোনও কথা নেই।

ফুলমণি তার দিকে তাকিয়ে একরকম আঁৎকে উঠেই জিজ্ঞেস করে, ‘কী হল?’

হারু কাঁপা গলায় উত্তর দেয়, ‘গা-ট ঠান্ডা হয়ে… ‘

ফুলমণি তাড়াতাড়ি মেয়েটার পাশে বসে তার গায়ে হাত দিয়ে দ্যাখে, সেই তো এক্কেবারে বরফের মতো ঠান্ডা, নাকের নীচে হাত দেয়, না কোনও শ্বাস পড়ছে না।

ফুলমণি চিৎকার করে ওঠে। তার চিৎকার শুনে পাশের দুটো তাঁবু থেকে সবাই বেরিয়ে আসে। একজন ফুলমণিদের তাঁবুর ভেতর গিয়ে বাচ্চাটার শরীরে হাত দেয়।

—না আর প্রাণ নাই।

বেশ কয়েক ঘন্টা পেরিয়ে যায়। বাইরে তখন মুষল ধারায় বৃষ্টি পড়ছে। নিজেদের তাঁবুতে ফুলমণি কোলে মরা বাচ্চাটাকে নিয়ে বসে বৃষ্টি থামবার অপেক্ষা করে। কবর দেবে? কোথায় দেবে? বড়োবাবুকে একবার জানাবে?

ফুলমণির চোখ দুটো কেমন যেন শুকিয়ে গেছে। পাশে ছেলেদের তাঁবু, ওখান থেকেও কোনও গান বা হাসি-মজার আওয়াজ নেই. ওখানেই হারু বসে আছে। হঠাৎ ফুলমণির দূরের ওই চায়ের দোকানটার দিকে চোখ যায়। পাঁচরকমে খেয়াল করেনি, দোকানটা এক্কেবারে ভেঙে দিয়ে গেছে। ফুলমণির চোখ দুটো বন্ধ হয়ে যায়।

ভাঙা দোকানের পিছনে একটা খোলা ছাতা দেখতে পায়। ভিতরে দু’জন মানুষ খোলা আকাশের মাঝে একটা ছাতার নীচে বসে আছে। ফুলমণি এক ভাবে দেখে যায়, শুধু দেখে যায়। কোলে মরা মেয়ে, একটু দূরে একটা ছাতার নীচে বসে আছে সেই দোকানি আর তার অসুস্থ বউ। একদিকে তৈরি হওয়া রাস্তার উপর তখন শুধু মুষল ধারার বৃষ্টি পড়ছে।

 

কালো রাস্তার মানুষ (পর্ব-২)

পর্ব ২

বড়োবাবু বুঝতে পারলেই চিৎকার করে, ‘দূর হ, এখন আর কাজ হবে না, হয় সব খসিয়ে আয়, না হলে ভাগ।’ ফুলমণিদের সবেই জ্বালা। এমনিতেই মাসে মাসে আরেকটা জ্বালা আসে, কয়েকটা দিন পেটে ব্যথা হয়, মাথা ঘোরে, সারাটা শরীরে একটা দম বন্ধ করা পরিস্থিতি তৈরি হয়, সেই ম্যাদা মেরে যায়। তখন কাজ করতে হাঁপ ধরে, মাঝে মাঝেই আড়াল খুঁজতে হয়।

কথাগুলো তাঁবুতে প্রথম দিকে টুনটুনির মা বলেছিল, সেই সঙ্গে বড়োবাবুর থেকে সাবধানে থাকতে বলে। ফুলমণি নিজেও বড়োবাবুর চোখে সব সময়ের খিদে দেখছে। ফুলমণিরা শাড়ি বা সালোয়ার যাই পরুক তার উপর একটা জামাও পরে। তাও কাজ করবার ফাঁকে জামা সরে যায়, পোশাকের বাঁধন আলগা হয়, বড়োবাবু তখনই শকুন হয়ে ওঠে।

ফুলমণি নিজেও দেখেছে, গোবরার বউ কয়েকদিন আগে তার কোলের বাচ্চাটাকে দুধ খাওয়াচ্ছিল। বড়োবাবু মুখে একটা বিড়ি ভরে চোখ দিয়ে গিলে নিচ্ছিল মায়ের আদর, ভালোবাসা। গোবরার বউয়ের সেদিন কোনও উপায় ছিল না।

টুনটুনিও কাজ করত। কাজ করবার সময়েই বিয়ে হল, এখন কোনও নজর নাই। একবার টুনটুনি আর ফুলমণির একই সময়ে রক্তপাত আরম্ভ হল। টুনটুনি বয়সে অনেক ছোটো ছিল, তাও মেয়ে তো। কাজ করবার মাঝে বারবার আড়াল খুঁজতে গেলে বড়োবাবু ঝাঁঝি মেরে ওঠেন, ‘তুরা গেদে কামচোর, একটু ঝাঁট দিচ্ছিস আর পালাচ্ছিস।’

—উয়ারা এমনি পালাচ্ছে নাকি গো। তোমার ঘরে বিটিছিলা নাই! জানো না, কি বটে?

সেদিন অবশ্য বড়োবাবু সবার মাঝে হেসে উঠেছিল, ‘তুদের আবার লজ্জা?’

খেপে উঠেছিল টুনটুনির মা, ‘কেন গো বাবু, তুমার ঘরের মেয়েদের শরীর-ট শরীর, লাজলজ্জা সব তুমাদের, আমাদের নাই।’

—তুর কিন্তু খুব কথা হয়েছে। লাথ মেরে তাড়িয়ে দিলে বুঝবি।

আর কোনও কথা বলেনি টুনটুনির মা। সেদিনই রাতে রান্না করবার সময় ফুলমণিদের মাঝে বসে কথাগুলো বলে। ফুলমণি কোনও দিন তার মাকে কাঁদতে দেখেনি। চরম কষ্টের দিনেও শুকনো চোখে খেটে গেছে। গোবর কুড়িয়েছে, ঘুঁটে দিয়েছে, সেই ঘুঁটে মাথায় করে বিক্রি করেছে, রাতে বরের হাতে মার খেয়েছে, মারামারি করেছে, চিল্লিয়েছে। টুনটুনির মাকে কাঁদতে না দেখলেও চোখমুখে একটা চাপা ভয় দেখতে পেয়েছে।

ফুলমণি লম্ফের আলোটা একটু বাড়ায়। ভাতের মধ্যে কয়েকটা আলু আর দুটো ডিম ফেলে দেয়। আর বেশি কিছু করতে ভালো লাগছে না। লোকটার মুখে আবার খারাপ কিছু রোচে না, খিস্তি করে, মারতে যায়। আগে লোকটা এমন ছিল না। যে-রাতে বড়ো তাঁবুতে ফুলমণির পাশে মোটা বউয়ের বরটা ফুলমণির শরীর ছুঁয়ে নিজের আমিত্ব ফলাতে গেছিল তারপরের দিন সকালে উঠেই হারু লোকাটাকে খুব পেটায়। বড়োবাবুর কাছে খবর চলে যায়।

মোটাবউ ও তার বর দু’জনেই বড়োবাবুর পেয়ারের লোক ছিল। সবাই জানত নিজের শরীরের গন্ধ শুঁকিয়ে মোটা বউ বড়োবাবুর হকের মেয়েমানুষ হয়ে উঠেছে। সারাদিন কোনও কাজ না করে বসে থাকলেও তাকে কিছু বলে না, বরং ফুরসত পেলেই দু’জনে গল্প করে। বড়োবাবু একটা ক্লাব ভাড়া নিয়ে সেখানে থাকে। মোটাবউ সকালে রাতে সেখানে রান্না করতে যায়।

—রান্না করে হাতি, ও যায় ধান্দা করতে। কথাগুলো হাবুলের বউ একদিন বলে।

ফুলমণি তখন এই কাজে নতুন এসেছে। কথা বললেও খুব বেশি মাখামাখি করে না। পরের দিনের ঝামেলার জন্যে দু’জনেরই কাজ চলে যেত, পোঁটলা গুটিয়ে চলে যেতে হতো। কিন্তু বড়োবাবুর হাত পা ধরে সে যাত্রায় কোনওরকমে কাজটা বাঁচলেও অন্য জায়গায় পাঠিয়ে দেয়, বড়োবাবুও সেখানে যাবে। হারু ও ফুলমণিকে আবার নিজেদের খরচে পোঁটলা-পুঁটলি নিয়ে নতুন জায়গায় যেতে হয়।

হারুর বাবাও রাস্তা তৈরি করবার কাজ করত। ছোটো বয়সে মা মারা যাবার পর হারুও বাবার সাথে ছোটো থেকেই এই রাস্তা তৈরি করবার কাজে ঢুকে যায়। দু’জনের রোজগারে ভালোই চলছিল। বাবা ফুলমণির সাথে বিয়ের দেখাশোনাটাও করে গেছিল, তারপর হারুর বিয়ের আগেই একদিন রাস্তা তৈরি করবার সময় রোলার গাড়ির নীচে পড়ে এক্কেবারে মাটির সাথে মিশে যায়। কয়েক বছর সব চুপচাপ থাকবার পরেই ফুলমণির বাড়ি থেকে আবার হারুর সাথে যোগাযোগ করে, তাদের বিয়ে হয়। কন্ট্রাকটর কিছু টাকা দিয়েছিল, সেই টাকাতেই বিয়ের খরচ মেটে।

বিয়ে হলেও সমস্যা হয় অন্য জায়গায়। হারুর তো বিভিন্ন শহরে ঘুরে ঘুরে কাজ। গ্রামে বাবার একটা ঘর থাকলেও সেখানে আর কেউ থাকে না। হারুর জীবনও এই তাঁবুর ভেতরেই কাটতে আরম্ভ হয়ে গেছে। নতুন বিয়ে করা বউ তো আর সেভাবে থাকবে না। কথাগুলো তার তাঁবুর বাকি লোকদের সাথে আলোচনা করলে তারা বেশ মজা করেই বলে, “আরে বাবা, তুই বিয়ে করবি এটা তো ভালো কথা। এখানে অনেকেই বউ নিয়েই থাকে। তোরা যখন থাকবি আমরা না হয় চোখদুটো বন্ধ করে রাখব।”

হারু হেসে ওঠে। তাদের বিয়ে হয়, কন্ট্রাকটর কয়েকদিন ছুটিও দেয়, ফুলমণির বাড়িতেই তাদের ফুলশয্যা হয়। কয়েকদিন এদিক ওদিক ঘুরে বেড়ালেও বসে বসে কেউ আজীবন মুখে ভাত দেবে না। হারু ফুলমণি দু’জনই কাজে ঢুকে যায়। কাজ বলে কাজ— পিচ গরম, রাস্তা খোঁড়া, ধুলো বালি পরিষ্কার করা, পাথর বিছিয়ে সমান করা, দু’পায়ে চিকচিকি বেঁধে পিচ ফেলা, বালি দেওয়া, কাজের আর শেষ নাই।

ফুলমণির প্রথম প্রথম অসুবিধা হতো। বিয়ের কয়েকদিন পর হারু কোনও পিচের রাস্তার উপর দিয়ে যাবার সময় বলে উঠত, “এই দ্যাখ এই রাস্তাটা আমরা করেছি।’ তারপরেই রাস্তা তৈরি করবার গল্প করত। তখন ফুলমণি অবাক হয়ে শুনলেও কাজ করতে এসে বোঝে, সব গল্প গল্প হয় না!

ক্রমশ…

কালো রাস্তার মানুষ (পর্ব-১)

তাঁবুর বাইরে বেরিয়ে ফুলমণি আকাশের দিকে চোখ রেখে কিছু সময় দাঁড়িয়ে থাকে। এই দিকটাতে আলো নেই, চারদিকের অন্ধকার মেঘের জন্যে আরও গুমোট, তাঁবুর ভিতরেও হ্যারিকেন জ্বালিয়ে কাজ করতে হচ্ছে। পাশে মেয়েদের তাঁবুটাতেও রান্না চেপেছে, কারওর মোবাইলে গান বাজছে। ছেলেদের তাঁবুতে এই সময় এক-দু’জন বাদে কেউ থাকে না, ওরা রান্না করে না, মেয়েদের তাঁবুতেই রান্না করা হয় — সবাই তো বউ-বর বা মা-ছেলে।

মেয়েদের একটা তাঁবু, আর ছেলেদের আলাদা একটা। শুধু ফুলমণিরাই আলাদা থাকে। তাঁবুটা ওদের টাকাতেই তৈরি করা। ফুলমণি দেখে একটু দূরের চায়ের দোকানটা এখনও খোলা আছে। বেশ কয়েকবার ওই দোকানে পাউরুটি কিনতে গেছে। ঘরের মানুষটার মতিগতি সব সময় ভালো থাকে না। মাঝে মাঝে ফুলমণির মনে হয় সকাল আর রাতে দু’জন আলাদা লোকের সাথে ঘর করে! পেটে জল পড়লেই হয়ে গেল, কতদিন ভাতের হাঁড়ি উলটে দিয়েছে, তখনই দোকানে খাবার কিনতে যেতে হয়।

চায়ের দোকানটাতে গিয়ে অনেকবার কথাও বলেছে। দেখে খুব মায়া হয়! লোকটার বয়স হয়েছে, ছেলে মেয়ে কেউ দ্যাখে না। বউটাও অসুস্থ। দোকানের পিছনেই একটা ছোটো জায়গায় ওরা দু’জন থাকে। বউটা ওখানেই শুয়ে থাকে। ফুলমণি একবার দোকানের লোকটাকে, ‘কী হয়েছে?’ জিজ্ঞেস করেছিল।

লোকটা কেমন ভাবে বলে উঠেছিল, ‘আর কী হয়েছে! বেঁচে আছে এই…’

বউটা চোখ ঘুরিয়ে ফুলমণিকে দেখেছিল। তারপর থেকে ফুলমণি দোকানে গেলেই বউটাকে দেখে। বুঝতে পারে ভালো ঘরের মেয়ে, রোগে ভুগলেও গায়ের রং এখনও বেশ চকচকে। কয়েকদিন আগে দোকানিটা অন্য আরেকজন খদ্দেরকে বলছিল, “আর ক’দিন থাকতে দেবে কে জানে? শুনলাম সেন গুমটির কাছে সব দোকান ভেঙে দিয়েছে, আমাদের এদিকটাও ভাঙবে।” ফুলমণি কথাগুলো শুনে নিজের থেকেই জিজ্ঞেস করে, ‘তোমাদের দোকান ভেঙে দেবে, কেন?’

লোকটা ফুলমণির মুখের দিকে তাকিয়ে উত্তর দেয়, ‘এই যে তোমরা রাস্তা তৈরি করছ।’

মনটা খারাপ হয়ে যায়, কথাগুলো কাউকে বলতে পারে না! হারুকে বললেই এক্ষুনি খেঁকিয়ে উঠবে। সে নিজে এই কয়েক বছরে অনেক জায়গায় রাস্তা তৈরি করতে গেছে। দেখেওছে কীভাবে রাস্তা তৈরি করবার আগে কত জায়গার দু’দিকের ঘরবাড়ি দোকানঘর ভেঙে দেয়। এখানেও প্রথম দিকে কয়েকটা দোকানঘর ভেঙেছিল।

ফুলমণির এসব দেখে কষ্ট হয়, একবার ঝড়ে ওদের নিজেদের গোয়ালঘর ভেঙে গেছিল। দু’টো গরু সারাটা রাত ভিজেছিল। এদিকেও রাস্তা একদিকে তৈরি হয়, আরেক দিকে গাড়ি চলে। রাস্তা হয়ে গেলে এখন আবার পাথর বসায়, একটা কী যেন নাম আছে। ফুলমণিদের অবশ্য তখন ডাকে না।

একটু আগেই ও পুকুরে স্নান করে এসেছে। পুকুরটা একটু দূরে, তাও সন্ধেবেলাতেও সবাই মিলে স্নান করতে গেলে খুব একটা অসুবিধা হয় না। প্রতিদিন দু’বার করে স্নান করবার জন্যে প্রথম দিকে ঠান্ডা লাগত। এখন সবকিছু কেমন যেন সয়ে গেছে।

—কি রে ফুলু, আজ কী করবি, আটা খাবি, নাকি ভাত চাপাবি?

—আটা খেতে লারি, গলা দিয়ে নামতেই খুঁজে না, গেল হপ্তাতে কয়েকদিন আটা খেয়িছিলম, হাগা আর বাগাতে লারি, ক’টা ভাতই ভালো, তুমি কী করছ?

—আমার তো একার কথাতে কিছু হবেক নাই, সবাই রুটি সেঁকছে। ভাত কালকের লগে, পান্তা করবেক।

কথাগুলো বলে লোকটি এগিয়ে গেলেও পিছন থেকে ফুলমণি ডাকে, ‘ও, খুড়ো, বড়োবাবুর কী খবর, এখনও টাকা দিলেক নাই।’ খুড়ো একটা শ্বাস ছাড়ে। হাওয়ার শব্দ ফুলমণির কান দিয়ে মাথার ভেতরে পৌঁছে যায়।

—সেই তো, গেল হপ্তা থেকে পাঁয়তারা কষছে। হারু কই?

—সাঁঝের ব্যালা কুথাকে থাকে?

খুড়ো আর কথা না বলে একপা একপা করে নিজের তাঁবুর দিকে যায়। খুড়োর বয়স হয়েছে, এখন একটু বেশি কাজ করলেই হাঁপায়। কয়েকদিন আগেও মাটি কুপাত, মাথায় করে গরম পিচ মেশাত, পাথর ফেলত। এখন শুধু রোলার গাড়িটার সামনে ভিজে বস্তা ধরে আর বাকি টুকটাক কিছু কাজ করে।

ফুলমণি খুড়োর সাথে কথা শেষ করেই নিজের তাঁবুতে ঢোকে। মেয়েটা ঘুমোচ্ছে। এইবেলা ভাতটা করে নিলে অনেকটাই ফের কাটে। ফুলমণিরা আগে একটা তাঁবুতেই থাকত, তখন এই ব্যাটাছেলে মেয়েছেলে ছিল না। মরদগুলো সারাটা দিন জানোয়ারের মতো খাটত। কাজ শেষ হলে কয়েকজন পিচ গলানোর কাজ করলেও বাকিরা চলে যেত। রাত বাড়লে টলতে টলতে তাঁবুতে ফিরত। যারা পিচ গলাত তারাও যে গিলত না সেটা নয়, তাও ওদের সব কিছু বাঁচিয়ে করতে হতো।

এই দলে কম বয়সি মেয়েছেলেগুলোও মদ মারে। না হলে ওদের শরীর কেমন যেন ম্যাদামারা হয়ে যায়, তারা কেউ বাইরে যায় না। ফুলমণি প্রথম প্রথম অবাক হয়ে দেখত। টানা পাঁচদিন কাজের পর একদিন ছুটি থাকত, সেদিনের জন্যে তারা টাকা না পেলেও সবাই সন্ধেবেলা তাঁবুর ভেতরে বসে যেত, সামনের কোনও দোকানে ঝাল ঝাল করে চপ বা অন্যকিছু ভাজাত তারপর…

ফুলমণির লোকটার অবশ্য এইসব পোষাত না। দোকানে না গেলে তার নেশা জমত না। ফুলমণিরও খুব সাধ হতো, ছুটির বেলায় সবার সাথে বসে একটু মজা করবে। কিন্তু সেই সময় পেটে শত্রু চলে আসত। এটাই ফুলমণির সব থেকে অসুবিধার। শত্রু আসত, কয়েকটা মাস পেটেই বড়ো হতো, তারপর পেটের ভেতরেই মরে যেত। ফুলমণির সেই সময় খুব রক্তপাত হতো। কয়েকদিন তাঁবুর ভেতরেই শুয়ে থাকতে হতো। কাজ করতে পারত না। এটাই ঝামেলার, শত্রু এলে আর ভালো কাজ হয় না।

ক্রমশ…

 

 

চান (শেষ পর্ব)

শেষ পর্ব

পুরোহিতের নির্দেশের অপেক্ষায় আছে আদিবাসী ভক্তরা। তাদের ধামসা, রামসিঙা বেজে উঠবে। দুই থানের মাঝখানে দুটো মোষ বাঁধা আছে। পুরোহিত মঞ্চ থেকে তাদের গায়ে ফুল ছুড়লেই চারদিক থেকে টাঙি, বর্শা ছুঁড়ে মারতে থাকবে ভক্তরা। যতক্ষণ না ক্ষতবিক্ষত রক্তাক্ত হয়ে মাটিতে লুটিয়ে না পড়ে। তারপর বিশাল খাঁড়া দিয়ে তাদের মাথা কেটে দেবীর পায়ে দেয়া হবে। কুড়ানি সেই সময়ের প্রতীক্ষায় আছে। মোষের রক্ত কপালে ছুঁয়ে প্রার্থনা জানাবে, হে মা, একটা সন্তান দাও। অথচ ঝমঝম পা ফেলে সে নেমে আসে এসময়। রাগে চৌচির হতে থাকে। এই প্রতিক্ষিত সময়ে ডাকাডাকি! সন্ধ্যাদি কানে কানে বলল, দু’পা পেরোলেই শিলদারদের আটচালা শিবমন্দির, পাশে সামন্তদের বাড়িতেই মজুমদার মশায়ের ডাক। দ্রুত পা কুড়ানির। উৎকর্ণ কান ধামসা, সিঙার শব্দের দিকে। পাছে সে বাদ পড়ে যায়। মজুমদার মশাইকে কখনও দেখেনি কুড়ানি, তাঁর নামডাক শুনেছে শুধু। এই হতদরিদ্র অঞ্চলে যে সামান্য শ্রী এসেছে তাঁর নেপথ্যে তিনি। স্থানীয় রাজনীতিতেও তাঁর প্রবল প্রতাপ। ফলে তাঁকে কেউ অমান্য করে না। কিন্তু এই সময়ে ডাক! অবোধ মেয়ে মানুষ। পাঁচিলের পাশে বুড়ো শিরীষ গাছে একটা পেঁচা উড়ে এসে বসে। কুড়ানির চোখ যায়। ‘আর ভাল্লাগেনি মোর। বলতো কোন পানে আছেন উনি?’

বাগাল ছেলেটা গোয়ালে গরু তুলতে তুলতে মুখ না ফিরিয়েই আঙুল দেখিয়ে দেয়। সূর্য নেমে গেছে কিছুক্ষণ হল। কুয়াশার মতো একপোঁচ অন্ধকার নেমে এসেছে। কুড়ানির উৎকণ্ঠা আর ক্লান্তি তাতে রহস্য ছড়িয়েছে ঢের। একটা অস্থিরতা নিয়ে হুড়মুড় করে বনটগর গাছটার পাশে সামন্তদের বৈঠকখানা ঘরে ঢুকে পড়ে কুড়ানি।

সামনে জমাট অন্ধকার দেয়ালে বাধা পেয়ে ফিরে আসছে। কুড়ানির শরীরেও তা পিছলে যেতে থাকে। খোলা দরজা দিয়ে কিছু দূরের ভৈরব থানের অস্পষ্ট আলো দেখা যায়। কিন্তু ভিতরে গুমোট অন্ধকার। কোথাও কাউকে দেখা যাচ্ছে না। আর দেখা যাবে বা কাকে! আজ এ তল্লাটের সমস্ত মানুষের বউ-বাচ্চার ঝক্কি সামলাবে ওই রঙ্কিণী থান। চোখের নজর বাড়িয়েও কোথাও কাউকে দেখে না কুড়ানি ।

‘তবে মোর ভুল হইছে। কী শুনতি কী শুনছি!’

পিছনে ফেরে কুড়ানি, দরজার দিকে পা বাড়ায়। ‘ফিরতিছ ক্যান?’ একটা গলা ফ্যাসফ্যাস করে ওঠে আচমকা। কুড়ানি চমকায়। আবার চিঁচিঁ করে কথা বাজে, ‘তুমি আইছ, বসো, দুফরে খাওয়া হয় নাই?’

কুড়ানির মাথা ফাঁকা হয়ে যায়। কার কথা! নন্দীদের জোয়ান ছেলেটা শিরীষ গাছের ডালে ঝোলার পর অনেকবার ওইপথে সাঁঝবেলায় এরকম রক্তহীন আমন্ত্রণ শুনেছে। পড়িমরি দৌড়ে দাওয়ায় এসে উঠেছে অনেকদিন। ঘরে বসেও সেই বুক ধরফরানি থামেনি।

‘মায়ের ফুল আনছ, ধকল গিছে। এটটু বসো, জিরায় লও।’

“আলো নাই ক্যানে?’

শশব্যস্ত একটা ক্ষীণ আলো তক্ষুনি জ্বলে ওঠে। ঘরের কোণে একটা বসার জায়গা পরিপাটি দেখা যায়। অন্য প্রান্ত থেকে ডাক আসে, ‘আসো, বসো!’

কুড়ানির পায়ে জড়তা। মাথার ভিতর কাঁসাইয়ের ভটভটি। জোয়ারের টানে ভটভটি এগিয়ে যায় একপার থেকে অন্যপার। তক্তপোশে বসতেই কুড়ানির নাকে একটা বোটকা গন্ধ ধাক্কা মারে। এরকম গন্ধ তার চেনা। মাঝে মাঝে অনেক রাতে দিবা যখন বাড়ি ফেরে, এই গন্ধে সে ভীষণ রেগে যায়, চ্যাঁচামেচি করে। ততক্ষণে অন্য গন্ধ সমস্ত ঘরজুড়ে কুণ্ডলী পাকাতে থাকে। একটা অমঙ্গলের ঘূর্ণি ঘুরপাক খায়। কুড়ানির বুক ঢিপঢিপ করে ওঠে। অন্ধকার সয়ে এসেছে কুড়ানির, দূরে অস্পষ্ট আলোয় দেখে আরাম চেয়ারে শুয়ে এক বিশাল পুরুষ। এই আলোতে মুখ দেখা না গেলেও বোঝে সেইটা মজুমদারমশাই। ভয় ছেনে কুড়ানি কিছু সাহস সঞ্চয় করে। কথা বাড়ায়।

‘তা কি কইতেছেন? মোর একন কি করার আছে বলো দিকিন?’

‘করার তো আছেই। তুমি বুঝনি?’

শরীর রক্তহীন লাগে। কেমন ধোঁয়াটে বাতাস ঘরময় ঘোরাফেরা করে। এই রহস্যের খোলসের ভেতর থেকে একসময় সেই আধশোয়া পুরুষ উঠে আসে, কপাট লাগায়। ধোঁয়াশার চাদর সরে যায়। কুড়ানির সারাদিনের উপোসি শরীর এই আতঙ্ক সহ্য করতে পারে না। তার প্রায় বুজে আসা চোখের সামনে দেখে ভয়ংকর করাল মূর্তি। রক্তলোভী, লোলুপ তার জিভ, লকলক করছে। বহুদিনের পিপাসা তৃষ্ণা মেটাতে চায়। ভৈরব থান থেকে মাইকে মন্ত্র ভেসে আসে

মুণ্ডমালা গলে রক্তাংগীং শববাহনাম
সদাপূজম ধ্যায়েৎ সদা রঙ্কিণীম

সঙ্গে সঙ্গে ধামসা মাদল রামসিঙা ঢোল উৎকট শব্দে বেজে ওঠে। এই উচ্চকিত শব্দে তার সংজ্ঞা ফিরে আসতে দেখে, সেই বিশালাকায় মূর্তি তাকে গ্রাস করছে। মনে হচ্ছে যেন শত শত আদিবাসীদের টাঙি, বর্শা তার গায়ে এসে পড়ছে। ভীষণদর্শন পুরোহিত খাঁড়া নিয়ে এগিয়ে আসছে তার মুন্ডু কেটে নিতে। জ্ঞান হারায় কুড়ানি।

চেতন অচেতনে এই জল-জঙ্গল ধান-পানের দেশে এক ভটভটি জলের শান্ত শরীর দুমড়ে দিতে দিতে অন্য পারে চলে যায়। আর এক গাড্ডার ভিতর থেকে, হুজুগের ভিতর থেকে, পাগলামির ভিতর থেকে উঠে আসে কুড়ানি। বড়ো রাস্তায় উঠে চোখ যায় রঙ্কিণী থানের দিকে। মানতের কথা মনে হতেই পেটের ভিতর থেকে, বুকের ভেতর থেকে, গলার ভেতর থেকে ঘেন্নার থুতু তুলে আনে। থুক করে। থুথু হাওয়ায় ভেসে ছড়িয়ে পড়ে রঙ্কিণী থানে, দূরের বর্গভীমার মন্দিরে, বাবা পঞ্চানন্দের চোখে মুখে। তারপর আত্মবিশ্বাসে লৌকিক পায়ে হেঁটে যায় উলটো পথে, নেমে পড়ে পালদের পুকুরে। জমানো গ্লানি ধুয়ে ফেলে ঘরে ফিরতে হবে।

 

 

চান (পর্ব ৩)

ঘণ্টাধ্বনি বাজছে। এই ধ্বনির মধ্যে কী যেন আবেশ জড়িয়ে আছে। জড়ানো মোহ আছে, মন অন্য হয়ে যায়। এবছরই গরমে দিবার সাথে গিয়েছিল বর্গভীমা মন্দিরে। সেখানে এই ঘণ্টাধ্বনি, ধূপ-দীপ, আশ্চর্য গন্ধ তাকে স্থানু করে রেখেছিল প্রায় একবেলা। আসতেই ইচ্ছে করছিল না। সেই ধ্বনি।

দূর থেকে দেখা যাচ্ছে ঝামা পাথরের পঞ্চরথ পাঢ়া দেওল। চৌকো চৌকো পাথর বসিয়ে গাঁথনি। বহু যুগের শ্যাওলা জমা। ডাইনটিকরির লোকেরা বলে সাত আটশো বছরের পুরোনো তো হবেই। মন্দির কাছাকাছি হতে একটা ভয়ও কুড়ানির ভেতর, যদি কোনও কারণে কোনও ত্রুটি হয়। দূর থেকে সিঁদুরলিপ্ত পাথরে গুড়িসুড়ি মেরে ঢুকে পড়ছিল। অষ্টভুজা মা-র কাছে যাবে, যদি একটা আবছা অবয়ব দেখে। ক্রমে তা গাঢ় হয়। ওড়িয়া ব্রাহ্মণের দুর্বোধ্য মন্ত্রপাঠ কানে যায়। বোঝে না। পূর্বমুখী মন্দির। দরজায় দাঁড়াতেই ভেতরে ছায়া পড়ে। পুরোহিত ঘুরে দাঁড়িয়ে ফুলের থালি হাতে কুড়ানিকে দেখতে পান। ইশারায় বসতে বলেন।

স্থানীয় ভক্তদের মতো পূজারিও জানেন দেবী রঙ্কিণীর আসল বাসস্থান ছোটোনাগপুরের ঘাটশিলা। এই ভৈরবভূমিতে তিনি মাত্র কয়েকটা দিনের জন্য আসেন। আসেন ওড়গন্ডায়। তবে পথে এই ডাইনটিকরির মন্দিরেও কিছুক্ষণের জন্য দেবী প্রতিষ্ঠিত হন। এই প্রতিষ্ঠাকে স্বীকৃতি দেবার জন্যই যেন এই ফুল দেয়া নেয়া।

ফেরার পথটা প্রায় উড়ে পার হতে চায় কুড়ানি। চারদিকে অদ্ভুত একটা গন্ধ। দুরের বাঁশঝাড়, বেনাবুদা, লাটকে লাট ধানখেত— সব চেনা ছবিও নতুন লাগছে।

ধানওঠা রুখা জমিগুলো, মাঝেমাঝে কাঁকরভরা রুগড়ি পাথরের লাল পথ লাফিয়ে লাফিয়ে পার হয়ে যাচ্ছে। মকরসংক্রান্তির জন্য কাসাইয়ের তীরে মেলা বসেছিল। কুড়ানি এক বান্ডিল কাচের চুড়ি কিনেছে। চুড়িপরা হাত নাড়ালেই রিনরিন করে বাজছে। হাত তুলতেই নীল কাচের চুড়ি আলো ঠিকরোচ্ছে, খুশির।

একি আত্মপ্রকাশের আনন্দ? বুনো মকাই-এর খই-এর মতো ভেতরে ভেতরে ফুটছে। কৃতজ্ঞতায় আপ্লুত হয়ে যায়। দুহাত জড়ো হয়ে মাথায় ওঠে। রঙ্কিণী মা-র জন্য নয়। মজুমদার মশাইয়ের প্রতি। তিনিই তো এইসব ব্যবস্থা করেছেন। সামান্য কুড়ানি এই একমেলা মানুষের মধ্যে আলাদা আসন পাবে এতো তারই দান। এই মানুষটিকে কুড়ানি কখনও দেখেনি। শুধু তার দানই পেয়ে এসেছে। শিলদায় মজুমদার মশাই-এর বড়ো দোকান। খড়গপুর শহরেও তার ব্যাবসা। বাস আছে। শুনেছে কলকাতায় তার ঘর আছে। তিনি পঞ্চায়েতেরও মাথা।

দূরপাল্লার এই বাসটা সেমি-ডিলাক্স। বাসে গান বাজছে। বচ্চনের। ‘মেরে অঙ্গনেমে তুমারা ক্যায়া কাম হ্যায়।’ অন্য সময় হলে মন দিয়ে শুনত। মাথা নেড়ে হিন্দি উচ্চারণ করার অক্ষম চেষ্টা করত৷ দ্রুতগামী বাস। নির্দিষ্ট সময়ের অনেক আগেই পৌঁছে যায় কুড়ানি। বাস স্টপের গায়েই ভৈরব থান। বাস থেকে নেমেই দিবাকে দেখতে পায়। ভৈরব থানের পাশে দাঁড়ানো। সাড়ে চার ফুট উঁচু মাকড়াপাথরের বেদী। বেদী সাজানো হয়েছে। আলপনা আঁকা। নানা মাটির মূর্তি বেদীতে। হাতি ঘোড়াই বেশি। উলটোদিকে ভৈরবের শক্তি রঙ্কিণী দেবীর থান। কালো পাথরে লাল কাপড় জড়ানো দেবীর অধিষ্ঠান। মাথায় সিঁদুর মাখানো। সামনে পুজোর ঘট। স্থানীয় মান্যজনেরা এসে গিয়েছেন। কুড়ানি সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে এল ভীরু পায়ে। পুরোহিতের হাতে ফুলের থালি তুলে দিতেই মন্ত্র উচ্চারণ হল। ঢাকঢোল বেজে উঠল। এতক্ষণ খেয়াল করেনি, হরিতকী, বয়রা ঘেরা মাঠে, গাছের ফাঁকে ফাঁকে সাঁওতাল খেরোয়াল আদিবাসী ভক্তরা সেজেগুজে বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র আর বর্শা, টাঙি নিয়ে দাঁড়িয়ে। সামনের দিকে নাচের জন্য মেয়েরা। বাঁশ নাচে পারদর্শী ছেলেরাও। বেদীর পাশেই উঁচু মঞ্চে বসবার আয়োজন হয়েছে বিভিন্ন মান্যজনের। কুড়ানিরও ঠাই হল সেখানে।

কুড়ানি শুনেছে এই দেবীর মূর্তি আছে ঘাটশিলায়। কখনও সে দেখেনি। তাঁর মাথায় জটাজুট, আটহাত। উপরের দুটো হাত দিয়ে একটা হাতি ধরে আছেন। অন্যহাতে অস্ত্রশস্ত্র। শববাহন, রক্তমুখী, রক্তবর্ণা এই দেবী পশুরক্তে সন্তুষ্ট নন। তিনি নররক্ত চান। একসময় নরবলির রেওয়াজ ছিল। কিন্তু ব্রিটিশ শাসনকালে হেজ সাহেবের হস্তক্ষেপে সে বলি বন্ধ হয়ে যায়। নরবলি দেয়া বন্ধ হলেও কুড়ানির মা বলত দেবী নিজের হাতে নরহত্যা করে রক্তপিপাসা মেটাতেন। এখন মানুষের মূর্তি দেয়া হয় দেবীর কাছে।

ক্রমশ…

চান (পর্ব ২)

পর্ব ২

“শিল্‌দা শিল্‌দা আইছে। নামবে আস।’ বাসের হেল্পার কাম্ কন্ডাক্‌টর চেঁচিয়ে উঠল। হুড়মুড় করে একগাদা মানুষ হাঁড়িকুড়ি ছানাপোনা, পোঁটলা পুঁটলি নিয়ে নেমে যায়। আর একদল ওঠে। বাস ছেড়ে দেয়। বাঁদিকে বাঁক নিয়ে বীণপুরের উদ্দ্যেশে চলে ঝাড়গ্রামগামী বাস। বীণপুরে অনেকটা সময় দাঁড়ায় বাস। চা-জলখাবার খায় ড্রাইভার, যাত্রীরা।

সূর্য উঠে পড়েছে আলসেমি ছেড়ে। কাঁচারাস্তায় বাস হুহু করে এগিয়ে চলেছে। দুপাশে মহুয়া, শাল, বহেড়া গাছ রোদ মাখছে। শীত আর নেই। বেশ ভালো লাগে কুড়ানির। অন্যদিনের মতো সকালে পান্তা খায়নি। আজ উপোস। কিন্তু খিদের কথা মনেই আসছে না আজ। এমনিতে খিদে সইতে পারে না। ভারী শরীর। কাজও যেমন করে, খায়ও গবর গবর। শরীরও তাই বাঁধানো ঘাটের মতো। দিবা বাগ যখন তখন বাঘ হয়ে উঠেও কিছু জৌলুস কমাতে পারেনি। বরং কুড়ানিই শরীর পেতে আশ্রয় দেয়, যথেচ্ছ ব্যবহারের আনন্দ দেয় শান্তভাবে। দিবা উঠে গেলে পালদের পুকুরে একটা ডুব মেরে শরীর ঠান্ডা করে এসে ঘুমিয়ে পড়ে।

বাসের দুলুনিতে ঝিমুনি এসেছিল। দুটো গরু রাস্তার উপর হঠাৎ উঠে আসায় ড্রাইভার হাওয়া-ব্রেক মারে। বাসশুদ্ধ লোক হুড়মুড় করে এ ওর গায়ে। কুড়ানি পড়ে যাবার আগেই ডানহাত ইঞ্জিনের উপর উঁচু জায়গায় আটকে যায়। হাওয়াই চটি ছিটকে যায়। কুড়ানি লজ্জা পায়। মুখে লাজুক হাসি। এদিক ওদিক তাকায়। পা দিয়ে চটিটা টেনে নিয়ে কোনওক্রমে পায়ে গলিয়ে ফেলে। আসলে এত সকালে ঘুম থেকে ওঠার অভ্যাস নেই অনেকদিন। আর রাতেও ভালো ঘুম হয়নি। সকালে উঠতে হবে, ভোরের প্রথম বাস ধরতে হবে এই ভেবে।

ছেলেবেলায় মার সাথে খুব ভোরে উঠত। উঠে জলা-জায়গায় যেতে হতো খড়িকাঠি চুপিচুপি আনতে। মা-র মুখে শুনেছে বাবা পানু ঘোড়ই খুব বড়ো খড়িয়াল ছিল। বাবারা এখানে থাকত না। সবং-এ থাকত। সেখানে নদী ছিল, চণ্ডী নদী। কেলেঘাই-এর শাখানদী ওটা। বাবাদের গ্রামের নাম ছিল শ্যামসুন্দরপুর। মজা- নদীর চরে খুব সরু সরু খড়িগাছ হতো। গাছ কেটে শুকিয়ে ঝোড়া বুনত ওরা। দেখতে বেতের কাঠির মতো। খুব সুন্দর বুনোট। ঝোড়ার কানার দিকে অনেকটা মোটা বেষ্টনী থাকত, ধরার সুবিধার জন্য। স্থানীয় বাজারে শুধু নয়, বাইরেও চালান যেত সে সব। খুব কদর ছিল। বাবার খুব নামডাক ছিল একাজে। মা গেঁওখালির পাল্টি ঘর। কাজ জানত। বাবা মরে গেলে কেন যে সে কাজ উঠে গেল, কেনইবা এখানে এল ওরা, তা এক রহস্য।

বাসের গতি কমে এসেছে। বীণপুর এসে গেল বোধ হয়। ছেদো অনেকক্ষণ থেকে লটপটে মাথা নামিয়ে একটা আধুলি খুঁজছে। পায়নি। রুক্ষ গলায় আধবসা অবস্থায় চ্যাঁচাতে লাগল— ‘বীণপুর, বীণপুর।’

এখানে একটা বাস এলেই ভ্যানরিকশার তোড়জোড় শুরু হয়ে যায়। নানা সুরে ভেঁপু বাজতে থাকে। গম্ভব্য সবই কাসাইঘাট পর্যন্ত।

যত্ন-পায়ে নেমে এদিক ওদিক একবার দেখে কুড়ানি। তারপর কাছের ভ্যানরিকশার সামনের দিকে উঠে পড়ে। আরও অনেকটা পথ। তাছাড়া শুধু যাওয়া তো নয়, ফিরতেও হবে বেলায় বেলায়। ভেতরে ভেতরে একটা অস্থিরতা। শুধু মজুমদার মশাই-র কাজ নয়। একজোড়া কাপড় আর আলতা-সিঁদুর পাওয়া নয়। তার নিজেরও একটা কাজ আছে। একটু বাঁকা হাসে। ঠোঁট বাঁকে।

বড়ো জাগ্রত এই দেবী। রক্তমুখী, রক্তবর্ণা দেবীকে তুষ্ট করে বর চাইলে অভীষ্ট পূর্ণ হয়। কুড়ানিও চাইবে। আজ পুজোর পরম লগ্নে দেবীর থানে মাথা কুটে বলবে, ‘মহুল বৃক্ষের মতো একটা খোকা দাও ঠাকুর হে।’ ওতো জানেই সন্ধ্যা গায়েন, নন্দীগ্রাম থেকে বিয়ে হয়ে এল, দশ-বারো বছর পার করেও সন্তান নেই। শেষে রঙ্কিণীর থানে মানত করেইতো বছর ঘুরতে ছেলে। এখন নিত্যপুজোয় সে সাহায্য করে।

ভটভটি নৌকোয় ওঠার আগে হাতে জল তুলে কপালে ছোঁয়ায়, মাথায় নেয়, বিড়বিড় করে কুড়ানি। পুরুলিয়ার কপিলা পাহাড়ের বুক চিরে নেমেছে এ নদী। অঞ্চলের মানুষেরা ভক্তি করে খুব। গঙ্গার মতো।

নৌকোয় উঠতে যেয়েই বাধা। দুটো ছোকরা সাইকেল নিয়ে একেবারে মুখেই দাঁড়িয়ে। ওঠবার জায়গা নেই। কুড়ানি বিরক্তিতে ভ্রু কুঁচকে মুখ তুলতেই কিছুটা ভয়ে দুই কিশোর সাইকেলের হ্যান্ডেল ঘুরিয়ে ওঠার জায়গা করে দেয়। ভটভটি আড়া কাসাইয়ের বুকে ঢুকে পড়ে। পাশ থেকে হলেও কুড়ানি বুঝতে পারে দুই ছোকরাই তার দিকে ড্যাবডেবে চেয়ে আছে। তাকাবে না! কেন! আজ ব্লাউজের নীচে আরও একটা টাইট, ছোটো জামা পরেছে। এ নিয়ে দুবার পরল। বিয়ের পর দিবার সাথে রেলগাড়ি চড়ে দূরের কুটুমবাড়ি যাবার সময় একবার। আজ নিজেরই লজ্জা লাগছিল। কিছুটা গর্বও। মোষের সিং-এর মতো ফুঁসে আছে, বুক যেন বাঁধ দেয়া বর্ষার কাসাই।

ক্রমশ …

চান (পর্ব ১)

কুড়ানি প্রায় ঘুম চোখেই স্নানে যায় আজ। ভোরের উঠোন স্পষ্ট দেখতে পায় না, চেনা পায়েই পালদের পুকুরের দিকে ইটিতে থাকে। ঝুপ করে তিন চারটে ডুব মেরে দিতে হবে। পৌষ মাস। এ বছর ঝেপে ঠান্ডা পড়েছে। ভোরের কুয়াশাও আছে। বেশ কয়েক পা পথ। কুড়ানি শাড়ি চাপা দিয়ে কান ঢেকে কিছুটা উষ্ণতা পেতে চায়। বেশ বড়োসড়ো চেহারা তার। ফলে দশহাতি শাড়িতে টান ধরে। পিঠে পেটে ঠান্ডা বাতাস এসে ঝাঁ করে কামড় বসায়। কটা বাজে? আকাশে চোখ রাখে। ঠাহর করতে পারে না। সাদা তারারা তখনও ভাঁট ফুলের মতো ফুটে আছে। ফসল ওঠা মাটির গন্ধ নাকে। শব্দহীন এক আনন্দ শিরশির করে। ভক্তাদের বাছুর পায়ের শব্দে জেগে ওঠে, হাম্বা করে। বুকটা ছ্যাৎ করে ওঠে। একটু ভয় পায়। হঠাৎ মনে হয় সকাল হয়নি। মুখের কাঠকয়লার মাজন শব্দ করে ফেলে। ভয় কমে। মনে মনে মা রঙ্কিণীকে ডাকে।

দিবা এই সকালে ওঠার কথা ভাবতেই পারে না। তা শীত-গ্রীষ্ম যাই হোক। ওর আলসেমিটা যেন সকালেই পেয়ে বসে। খুব রাত করে জেগে থাকতে পারে। মজুমদারের ভাঁটিতে কাজ করে। অনেক রাতে ফিরতে হয়। শীতকালটাই কাজের সময়। টালির কাজ খুব বেশি। আজকাল খড়, শণের চাল আর কেউ রাখতে চায় না এখানে। দু-তিনটে বর্ষা যেতে না যেতেই জল পড়ে। সবাই তাই চেষ্টা চরিত্র করে টালির চালের জন্য। দিবাকে অবশ্য এখন আর পোণে আগুন দেয়া বা কাদা ছেনার কাজ করতে হয় না। মজুমদার মশাই ওকে বেশ ভালো চোখে দেখেন। তদারকি করেন। বছর চারেক হল বিয়ে করেছে কুড়ানিকে। শ্যামলা শরীর হলে কী হবে, একটা আলগা শ্রী আছে তার। দ্রুত চলনের মেয়েটিকে দেখলেই লাগসই একটা মন-পসন্দ চলে আসে। তো বাপ-মা মরা তিন কুলে কেউ নেই এমন নির্বান্ধব দিবার মনও যে মহুয়া ফুলের গন্ধে উড়ু- উড়ু করবে, তা বিচিত্র কি! কুড়ানিরও তিন কুলে কেউ ছিল না এক বিধবা মা ছাড়া। তা সে মা-ও বিয়ের ছ’মাসের মধ্যেই মরে গেল। এখন হাত-পা ঝাড়া দুটি প্রাণীর একান্ত বসবাস।

জলে পা রাখতেই ছ্যাঁৎ করে উঠল। কুড়ানি আস্তে আস্তে জল হাতে নিয়ে মুখে তুলল। একমুখ জল নিয়ে কুলকুচি করল। অনেকক্ষণ। চোখের কোনে জমা পিচুটি ধুলো। এভাবে জল সয়ে আসতে হাঁটুর ওপর কাপড় তুলে নেমে পড়ল। তারপর দুকানে আঙুল দিয়ে ঝুপ ঝুপ করে তিন চারটে ডুব মারল। হি হি করে কাঁপুনি আসছে। মোটা কাপড়ের আঁচল ঘুরিয়েই গলা মুখ বুক একবার ভালো করে মেজে নিয়ে একটা ডুব দিয়েই উঠে এল। পুব দিকের আকাশটা লাল লাল লাগছে। বুঝতে পারল ভোর হচ্ছে। ভেজা শাড়ি পরেই দ্রুত পা চালায় ঘরের দিকে। ভোরের প্রথম বাস ধরতে হবে।

বাঁকুড়া-ঝাড়গ্রামের প্রথম বাস ওড়গোঁদা আসে সকাল সাড়ে ছ’টায়। শিলদা হয়ে বীণপুর যেতে নিদেন দশটা বাজিয়ে দেবে। সেখান থেকে ভ্যান-রিকশায় চেপে যেতে হবে কাঁসাই-এর ঘাট। তারপর নদী পার হয়ে ডাইনটিকরি। এক বেলার হ্যাপা। কিন্তু কুড়ানির কাছে এসব আজ নেশার মতো, মিষ্টি স্বপ্নের মতো। বাপের কথা মনে নেই। সেই এটুবেলা থেকে এই পরব সে দেখে আসছে। মা-র কোলে উঠে এসেছে সে রঙ্কিণী থানে। মকরতিথিতে দেবী আসেন এখানে। তারপর তিন দিন ধরে পাতাবেদার মেলা। দূর থেকে ভয়ে বিস্ময়ে সে তাকিয়ে থাকত কতদিন, মেলা শেষ হবার পরও। ভৈরব চাতালের দিকে, রঙ্কিণী চাতালের দিকে। আজ সে এই পুজোয় সরাসরি অংশগ্রহণ করতে পারছে, একেবারে ছুঁয়ে দিতে পারবে দেবীকে, ভেবেই ভয়ে, আনন্দে একটা ঘোরের মধ্যে আছে।

কুয়াশামোড়া ভোরের একটা অন্য আমেজ আছে। সংসার এখনও ব্যক্ত হয়ে ওঠেনি। সূর্য সবে উকিঝুঁকি মারছে। ঠান্ডার সাথে একটা আবেগ জড়ো হয়ে কুড়ানিকে কাঁপাচ্ছিল। এখান থেকে তেমন কেউ ওঠার নেই, শুধু নামল কয়েকজন।

মজুমদার মশাই-এর দুটো বাস এই রুটে চলে। কথামতো ড্রাইভারের কেবিনে অহংকারী মুখে গ্যাট হয়ে বসল কুড়ানি। লালপাড়ের সাদা শাড়ি। চন্দ্রকোণা থেকে এসেছে। সাদা ব্লাউজ। মন্দিরের দেবীর পা ছুঁয়ে আবার ফিরে আসবে ভৈরবভূমিতে। হাতে রঙ্কিণীমা-র ফুল একটা সুন্দর পিতলের পাত্রে রাখা। রঙ্কিণী কুড়ানি আড়চোখে দেখছিল বাসের যাত্রীরা শুধু না, রাশভারী বিড়িও ফুঁকছে না। ড্রাইভার বলাই সামন্তও কেমন সম্ভ্রমের চোখে তাকাচ্ছে আজ, অন্যদিনের মতো নয় আজ। বীণপুর বাজারে এটা ওটা নিয়ে যাতায়াতের যত্ন আর কষ্টমাখা ব্যস্ততা নেই। পরিবর্তে অন্য এক ভালোলাগায় পেয়ে বসেছে। বাসের উইন্ডস্ক্রিন থেকে হু হু হাওয়া আসছে। গোছা গোছা ভারীচুল এলোমেলো করে দিচ্ছে। সে দিক। কপালে আজ বেশ বড়োসড়ো মেটে সিঁদুরের গোল সূর্য এঁকেছে। কুড়ানি আজ অন্যমূর্তি। কী মূর্তি? নিজেকে কি রঙ্কিণী মা মনে হচ্ছে। ইস! অমন ভাবাও পাপ। নিজের অজান্তেই একটা হাত মাথায় উঠে এল।

ক্রমশ…

 

পড়ার জন্য সীমাহীন গল্প-নিবন্ধসাবস্ক্রাইব