মা (শেষ পর্ব)

তুষারের ফ্ল্যাটে আসা থেকে অসীমা এক মুহূর্তের জন্যেও বিশ্রাম নেননি। সন্ধে হলে রঞ্জনাকে এসে জিজ্ঞেস করলেন, ‘রাত্তিরে তোর কী খেতে ইচ্ছে করছে বল, আমি বানিয়ে দিচ্ছি।’ রঞ্জনা শাশুড়ির হাত ধরে খাটে বসিয়ে কোলে মাথা রাখল, ‘তুমি যখন থেকে বাড়িতে এসেছ, এক মুহূর্তের জন্যেও বিশ্রাম নাওনি। রাত্তিরে তুমি কিচ্ছু করবে না, তুষার রেস্টুর‌্যান্ট থেকে খাবার নিয়ে আসবে।’

‘এই অবস্থায় হোটেলের খাবার? ওই খাবার খেলে তোকে হাসপাতাল যাওয়ার হাত থেকে কেউ আটকাতে পারবে না। আমাদের সকলের জন্যে চট করে কিছু একটা বানিয়ে নিচ্ছি যেটা খেলে তোর হজমের কোনও অসুবিধে হবে না। তার আগে তোর চুলে তেল লাগিয়ে চুলটা বেঁধে দিই চল। সন্ধে হয়ে গেছে চুল খোলা রাখতে নেই।’

তুষারও সঙ্গে সঙ্গে মায়ের সামনে উপস্থিত হল, ‘মা আমাকেও মাথায় একটু তেল মালিশ করে দাও। জানো রঞ্জনা, বাড়িতে এই তেল লাগানো নিয়ে আমাদের দুই ভাই আর বাবার মধ্যে লড়াই বেধে যেত, কে আগে মায়ের কাছে বসে মালিশ করাবে।’

তেল মালিশ করে চুল বেঁধে দিতেই রঞ্জনার ঘুমে চোখ ঢুলে আসে। কখন চোখ লেগে গিয়েছিল জানে না, চোখ খুলল যখন তখন দেখে তুষার মায়ের কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছে। অসীমার আঙুলগুলো খেলা করছে তুষারের চুলের মধ্যে। মা ছেলেকে বলছেন, “আমি বাড়ি ছেড়ে কতদিন আর তোদের কাছে থাকব? রঞ্জনা খুব ভালো মেয়ে। বাড়িতে কোনও জিনিস কিনিসনি তাও ও তো কোনওরকম অভিযোগ করেনি। ওর চাহিদা খুব কম। মেয়েটার মনে কোনও লোভ নেই। এই সামান্য জিনিসেই সংসার সামলাচ্ছে। আমাকেও বারবার থেকে যাওয়ার জন্যে জোর করছে। বউমা-কে নিয়ে বাড়ি ফিরে চল। ওখানে ওকে দেখাশোনা করার জন্যে আমরা থাকব। ওর যা শরীরের অবস্থা, খাওয়াদাওয়ার উপর বিশেষ যত্ন নেওয়া দরকার যেটা তোর একার পক্ষে সম্ভব নয়। আর তোরা এখানে থাকলে আমার আর তোর বাবারও চিন্তার শেষ থাকবে না। রঞ্জনাকে বাড়িতে পেলে তোর বাবাও খুব খুশি হবেন।’

তুষার মায়ের কোল থেকে উঠে বসে, মাকে জড়িয়ে ধরে বলে, “আমি তোমার কথা বুঝতে পারছি, কিন্তু রঞ্জনাকে জিজ্ঞেস না করে…’

অসীমা উঠে যান রান্নাঘরের কাজ শেষ করতে। কাজ শেষ করে যখন ঘরে ঢোকেন রঞ্জনা উঠে বসেছে খাটের উপর। শাশুড়িকে ঘরে ঢুকতে দেখে রঞ্জনা বলে, ‘মা, তুমি তেল লাগিয়ে দেওয়াতে এত আরাম হয়েছে যে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি বুঝতেই পারিনি। তুমি যদি রাগ না করো একটা কথা বলতে চাই।’

“হ্যা, বল না কী বলতে চাস।’

“মা, আমি আর তুষার তোমাদের কাছে গিয়ে থাকতে চাই। তোমাদের অসুবিধা হবে না তো? আমি জানি আমরা গেলে তোমার কাজ অনেক বেশি বেড়ে যাবে কিন্তু তোমাদের সঙ্গে থাকলে আমি জানি আমার খুব ভালো লাগবে। আমি আনন্দে থাকব আর তাছাড়াও আমি থাকলে বাবা খুশি হবেন তাই না?’

‘কী বলছিস কী তুই? ওটা তো তোরও বাড়ি। অসীমাদেবী গলার স্বরে খুশি চেপে রাখতে পারেন না। তুষারকে ডেকে সঙ্গে সঙ্গে বলেন, ‘যা, যা গোছাবার এক্ষুনি গুছিয়েনে। সকাল হলেই আমরা ওই বাড়িতে রওনা হবো। ওখানে গিয়েই জলখাবার খাওয়া হবে। বাবাকে একটা ফোন করে দে। রঞ্জনার জামাকাপড় যা দরকার এখন নিয়েনে, বাকি পরে এসে নিয়ে যাস। আর হ্যাঁ, রঞ্জনা, রঞ্জনার দিকে তাকান অসীমা, ‘মেয়ে বাপের বাড়ি যাচ্ছে। শাড়ি পরার দরকার নেই। তোকে অফিস যেতে হবে মনে রাখিস। সুতরাং যে-পোশাক পরে তোর সুবিধা হবে, তাই সঙ্গে নিবি। আমার বা তোর বাবার কোনও আপত্তি নেই।’

পরের দিন ভোরে উঠে তুষার আর অসীমা সবকিছু গোছানো জিনিসপত্র দরজার সামনে এনে রাখলেন। রঞ্জনাও উঠে পড়েছিল। অসীমা ওকে জামাকাপড় বদলাতে সাহায্য করলেন। জিনিসপত্র নিয়ে তুষার সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে গেলে, রঞ্জনার হাত ধরে অসীমাদেবী ফ্ল্যাটের বাইরে এসে দাঁড়ালেন। রঞ্জনা বাড়ির চাবি শাশুড়ির হাতে দিল তালা লাগাবার জন্য। তালা লাগিয়ে অসীমা চাবিটা বাড়িয়ে দেন রঞ্জনার দিকে, ‘এটা ব্যাগে রেখে দে।’

“মা, এটার আমার আর দরকার নেই। এটা এবার থেকে তোমার কাছেই থাকবে।’

অসীমা, রঞ্জনার হাত চেপে ধরে পা বাড়ান সিঁড়ির দিকে।

 

 

মা (পর্ব- ৩)

সেই রবিবার ফোনে তুষার বাবাকে জানিয়ে রেখেছিল, বিকেলে আসবে। বিকেল গড়িয়ে সন্ধে হল। সন্ধে থেকে রাত্তির, তবু দু’জনের দেখা নেই। কোনও ফোনও নেই। খাবার সাজিয়ে অপেক্ষা করা ছাড়া আর কিছু করার নেই। এগারোটা বাজতে যায় দেখে পরিমলবাবু স্ত্রীকে বললেন, ‘আর বসে থেকে লাভ নেই, চলো আমরা দু’জন খেয়ে নিই। মনে হচ্ছে ওরা অন্য কোথাও হয়তো গেছে।’

অসীমাদেবীর চোখ জলে ভরে আসে, ‘হ্যাঁ গো, ওরা কি আমাদের কথা চিন্তাই করে না? রঞ্জনা না হয় পরের বাড়ির মেয়ে কিন্তু তুষার তো নিজের পেটের ছেলে। বাড়ি ছেড়ে তো আগেই গিয়েছে এখন এক-দুই ঘণ্টার জন্যে একবার চোখের দেখা দেখতে আসাটাও বন্ধ করে দিতে চাইছে। তুমি নিজে একবার ফোন করেও তো দেখতে পারো।’

পরিমলও প্রচণ্ড চিন্তা করছিলেন। একটু চড়া গলাতেই উত্তর করলেন, ‘তুমি কী ভাবো আমাকে? এতক্ষণ চুপচাপ বসে আছি? কখন থেকে সমানে চেষ্টা করছি। ফোন সুইচ অফ আসছে।’

‘তোমাদের কতবার বলেছি বাড়িতে ল্যান্ডলাইন ফোন করতে কিন্তু কেউই তোমরা শোনবার লোক নও। এই এমারজেন্সিতে…

রাতটা উৎকণ্ঠায় কোনওরকমে কাটিয়ে পরের দিন সকাল এগারোটাতে পরিমলবাবু, তুষারের অফিসে ফোন করলেন। ওখানে জানতে পারলেন স্ত্রীয়ের অসুস্থতার খবর জানিয়ে তুষার ছুটি নিয়েছে। অসীমাদেবীও বউমার অসুস্থতার খবরে বিচলিত হলেন। সামান্য রান্না করে স্বামীকে খাইয়ে তিনজনের খাবার টিফিনবক্সে ভরে তৈরি হয়ে নিলেন ছেলের কাছে যাবার জন্যে। ব্যস্ততার কারণে পরিমলবাবু যেতে না পারলেও ট্যাক্সি ডেকে স্ত্রীকে তুলে দিলেন এবং ড্রাইভারকে তুষারের ঠিকানা দিয়ে ভালো করে রাস্তা বুঝিয়ে দিলেন।

ড্রাইভার অসীমাদেবীকে তুষারের ফ্ল্যাটের নীচে নামিয়ে দিয়ে ভাড়া গুনে নিয়ে চলে গেল। দোতলায় তুষারের নাম লেখা ফ্ল্যাটের দরজায় অসীমাদেবী কলিংবেল বাজাতেই তুষার এসে দরজা খুলে মা- কে দেখে অবাক হল, ‘একী, মা তুমি!’

‘ভেতরে তো আসতে দে। বউমার শরীর খারাপ শুনলাম। ওকে ডাক্তার দেখিয়েছিস? এখন কেমন আছে? যা দূরে ফ্ল্যাট নিয়েছিস!’

ফ্ল্যাটে ঢুকেই অসীমার অভিজ্ঞ চোখে অনভিজ্ঞ সংসারের দুর্দশাগুলো পরিষ্কার হয়ে গেল। চারিদিকে জিনিসপত্র ছড়ানো, রান্নাঘরে এঁটো বাসন জড়ো করা। তিনদিন ধরে কাজের মেয়েটির অনুপস্থিতিতে বাড়ি যেন নরককুণ্ড। আর গৃহকর্ত্রী দু’দিন ধরে বিছানায় শয্যাশায়ী। প্রচণ্ড জ্বর আর পেটে ব্যথা। জিনিসপত্র গোছাতে গোছাতে অসীমাদেবা তুষারকে বললেন, ‘আমাকে একটা ফোন করতেও তো পারতিস। এরকম অসময়েই অপরের সাহায্যের দরকার পড়ে।

তুষারের হাজার মানা করা সত্ত্বেও অসীমা এঁটো বাসন ধুয়ে রান্নাঘরে সাজিয়ে রেখে সারা বাড়ি পরিষ্কার করলেন। কাচার জামাকাপড় একত্র করে ওয়াশিং মেশিনে ঢুকিয়ে তুষারকে ওটা চালিয়ে দিতে বললেন। রঞ্জনার জন্যে হালকা করে নিরামিষ ঝোল-ভাত বানিয়ে ওকে খাওয়ালেন। বাড়ি থেকে আনা খাবার নিজে এবং তুষারকে খেতে দিলেন। কাচা জামাকাপড়গুলো বারান্দায় মেলে দিয়ে এসে রঞ্জনার কাছে বসলেন। রঞ্জনার মুখ থেকেই শুনলেন দু’দিন সে স্নান করেনি। তৎক্ষণাৎ জল গরম করে এনে ওর চুল ধুয়ে, হাত-পা স্পঞ্জ করিয়ে বাড়ির পোশাকটা বদলে দিয়ে ফ্রেশ নাইটি পরিয়ে দিলেন। বিকেল হয়ে এসেছিল। হঠাৎই রঞ্জনা অসীমার হাতটা চেপে ধরে বলল, মা আজ তুমি কোথাও যাবে না। রাত্তিরে আমার কাছে থাকবে, বাবাকে জানিয়ে দাও।’

“আমিও তাই ভাবছিলাম।’ রঞ্জনার মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে অসীমা বললেন, ‘তোকে এই অবস্থায় ছেড়ে যেতে আমারও মন চাইছে না। তুষার, তুই বাবাকে ফোন কর। কাল উনি তোকে বহুবার ফোনে চেষ্টা করেছেন।’

‘মা, কাল রঞ্জনার বাড়াবাড়ি হওয়াতে আমি এত নার্ভাস হয়ে গিয়েছিলাম, ফোন করার কথা একদম মনে ছিল না। চার্জ শেষ হয়ে ফোনটা যে কখন অফ হয়ে গেছে, খেয়ালই করিনি। বাবা নিশ্চই খুব চিন্তা করছেন। তার ওপর তুমিও যদি না পৌঁছোও…

“উনি চিন্তা করছেন ঠিকই কিন্তু আমি না গেলে ওনার অসুবিধা হবে না বরং বাইরের খাবার খেতে পারবেন। পরিবেশটা খানিক হালকা করার চেষ্টা করলেন অসীমা।

‘রঞ্জনা, এখন একটু স্যুপ খাবি?’

“মা, বাড়িতে তো কিছুই নেই। স্যুপ বানাবে কী দিয়ে?’ ‘তোকে চিন্তা করতে হবে না। আমি সব নিয়ে এসেছি।

রঞ্জনা ওনাকে থেকে যেতে বলেছে এটা অসীমার খুব ভালো লেগেছিল। প্রথম বাড়িতে ঢুকে রঞ্জনার উপর খুব রাগ হয়েছিল। গৃহস্থ বাড়ি এত অগোছালো রাখতে আছে? চারিদিকে নোংরা, জামাকাপড়ের পাহাড় চেয়ারের ওপর জমানো। যে ছেলে নিজের বাড়িতে এক গেলাস জল গড়িয়ে খায়নি সে কিনা এখানে এসে স্ত্রীয়ের সেবা করছে, রান্না করে তাকে খাওয়াচ্ছে। কিন্তু তুষারের মুখ চেয়ে অসীমা একটা কটু কথাও মুখে আনেননি। ছেলের সুখে-দুঃখে তার পাশে দাঁড়ানোটাই তো মায়ের উচিত, এটাই মনে করে অসীমা চুপ করে থেকেছেন।

ক্রমশ…

 

 

মা (পর্ব-২)

তুষার সম্মতি জানিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। পরিমল তাকান অসীমার দিকে। ফ্যাকাশে মুখ, রক্তশূন্য চেহারা। পরিমল উঠে আসেন চেয়ার ছেড়ে। যদিও স্বভাবসিদ্ধভাবে তিনি খুব প্র্যাকটিকাল তবু সেই মুহূর্তে স্ত্রীয়ের পাশে এসে বসেন। ‘মা’য়ের ব্যথাটাকে হৃদয় দিয়ে অনুভব করার চেষ্টা করেন। ‘অসীমা এভাবে ভেঙে পোড়ো না। আমাদের পছন্দ করা মেয়ে তুষারের পছন্দ না-ও হতে পারত। এটাই বরং ভালো হল। ও যা করতে চাইছে, করতে দাও। ও সুখী হলে আমাদের সঙ্গে সম্পর্কটাও অটুট থাকবে। এক ছেলে তো আগেই আমাদের ছেড়ে চলে গেছে। এখন ওর কথা মেনে নিলে এটুকুই আমাদের লাভ যে, ও আমাদের চোখের সামনে থাকবে।’

স্বামীর কথায় অসীমাদেবী খানিকটা আশ্বস্ত বোধ করেন। সত্যিই তো, ছেলেটাকে তো চোখের সামনেই রোজ দেখতে পাবেন। শুধু বউমাকে আপন করে নিতে পারলেই সংসারে শান্তি বজায় থাকবে। তবে রঞ্জনা যে-বাড়ির মেয়ে, তাতে যথেষ্ট আধুনিকা হওয়াটাই স্বাভাবিক। পোশাকে-আশাকে, মানসিকতায় তাদের মতো মধ্যবিত্ত পরিবারের সঙ্গে রঞ্জনা মানিয়ে উঠতে পারবে কিনা এমন সন্দেহও উঁকি মেরে যায় অসীমাদেবীর মনে।

বিয়ের কথা বলতে গিয়ে প্রথম দর্শনে দু’জনেরই রঞ্জনাকে পছন্দ হয়। বেশ স্মার্ট অথচ মিষ্টি স্বভাব মেয়েটির। তুষারের পছন্দ আছে। বেশ গর্ব অনুভব করেন তাঁরা। বিয়ের দিন স্থির করে বাড়ি ফেরেন।

এরপরেই অপেক্ষা করেছিল আসল ধাক্কাটা, যার আঁচ আগে একেবারেই পাননি পরিমলবাবুরা। একদিন হঠাৎই তুষার অসীমাদেবীকে এসে জিজ্ঞেস করল, ‘মা, তোমরা কি বিয়ের কেনাকাটা আরম্ভ করে দিয়েছ?’

‘না, কেন রে?’

আমি চাই না আমার বিয়েতে তোমরা আজেবাজে কিছু খরচ করো অথবা গয়নাগাটি কিছু কেনো। তোমরা আমার বিয়েতে যা টাকা খরচা করবে ভেবেছ সেটা আমার হাতে দিয়ে দাও। রঞ্জনাও একই কথা নিজের মা-বাবাকে জানিয়েছে। আমরা রাজারহাটে ছোটো একটা ফ্ল্যাট দেখেছি। তোমরা আমাদের জন্য যে-টাকা রেখেছ সেই টাকার সঙ্গে আরও কিছু টাকা দিয়ে আমরা ওই ফ্ল্যাটটা কিনব।’

ছেলের কথায় অসীমাদেবী পাথর হয়ে যান। কোথাও যেন একটা ভুল হয়ে যাচ্ছে তাঁর মনে হয়। ছেলেকে ঠিকমতো শিক্ষা দিতে পারেননি, নাকি যুগের পক্ষে তারাই বেমানান, ঠিক বুঝে উঠতে পারেন না অসীমা। ছেলের মুখের দিকে তাকান, চোখে শূন্যতা।

“তার মানে তুই আর আমাদের সঙ্গে থাকবি না?”

“তোমাদের ছেড়ে চলে যাওয়ার প্রশ্ন উঠছে কেন? তোমার আর বাবার সুবিধার জন্যেই আমরা এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমাদের এমনই চাকরি যে বাড়িতে আসা-যাওয়ার কোনও সঠিক সময় নেই। যখন- তখন আমরা তোমাদের বিরক্ত করতে চাই না।’

তুষারের সব কথাই ধীরে ধীরে অসীমার কাছে কাচের মতো পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল সব দিক দিয়ে এটাই বোধহয় ঠিক হল। চোখেও কিছু দেখতে হবে না তাই নতুন করে ব্যথা পাওয়ারও প্রশ্ন ওঠে না। আধুনিকা বউমা জিন্‌স, কুর্তি পরে তুষারের কোমর জড়িয়ে তাদের ‘বাই মম’ বলে অফিস বেরিয়ে যাবে। এমনটা হওয়ার থেকে এটাই ভালো, ওরা দূরে থাক। তুষারের ইচ্ছে, অসীমাদেবী পরিমলকে জানালেন। পরিমলবাবু মনে ব্যথা পেলেও স্ত্রীয়ের সামনে সেটা প্রকাশ করলেন না।

বিয়ের পর তুষার আর রঞ্জনা নিজেদের রাজারহাটের ফ্ল্যাটে আলাদা করে সংসার পাতল। নবদম্পতি হিসেবে সকালটাই একটু একসঙ্গে কাটাবার সময় পেত ওরা। একসঙ্গে জলখাবারের টেবিলে বসে দুজনে প্রয়োজনীয় কথাবার্তা সেরে ফেলত। এরপর তো দু’জন আলাদা আলাদা। দু’জনের আলাদা চাকরি। তুষার ইংরেজি দৈনিকে কাজ করত আর রঞ্জনার চাকরিটা ছিল বাংলা কাগজে। তুষারের কাজের সময়টা নির্ধারিত ছিল, সকাল এগারোটা থেকে সাতটা। আর রঞ্জনা বেরোত দুপুরে। ফিরতে প্রায়দিনই মধ্যরাত। সুতরাং সকালের পর থেকে দু’জনের যোগাযোগের মাধ্যমটা ছিল টেলিফোন।

রবিবার অথবা ছুটির দিনগুলোতে, তুষার আর রঞ্জনার ঘুম ভাঙতে দুপুর হয়ে যেত। সন্ধেবেলাটা দু’জনে কাটাত সিনেমা দেখে অথবা কারও একজনের মা-বাবার সঙ্গে দেখা করতে যেত। মুশকিল হতো রঞ্জনার যেদিন তুষারের বাড়ি যাওয়ার থাকত কারণ তুষারের মুখ থেকেই শুনেছিল শাশুড়িমা ওয়েস্টার্ন ড্রেস একেবারেই পছন্দ করেন না। তুষারের মা-বাবা দু’জনেই নাকি একটু পুরোনো ভাবধারায় বিশ্বাসী। অগত্যা শাড়ি পরেই রঞ্জনাকে শ্বশুরবাড়ি যেতে হতো।

তবে শ্বশুর, শাশুড়ির বিরুদ্ধে রঞ্জনার কোনও নালিশ ছিল না। ভয় তো একটা ছিলই কারণ শ্বশুরবাড়ির অত্যাচার নিয়ে রঞ্জনা অনেকবারই নিজের কাগজে স্টোরি করেছে। তাই নিজে যখন বউ হয়ে এল, মনের মধ্যে ভয়, সংশয় মিশ্রিত একটা দোনামনার মানসিকতা তৈরি হয়েছিল। কিন্তু অসীমাদেবীর এবং পরিমলবাবুর সৌম্য উপস্থিতি এবং অন্তরঙ্গ ব্যবহারে সেই ভয়টা রঞ্জনা কাটিয়ে উঠেছিল। একটাই অসুবিধে হতো রঞ্জনার। অসীমার অনুরোধে ও শাঁখা-পলা পরতে বাধ্য হয়েছিল।

যেদিন তুষার আর রঞ্জনার বাড়িতে আসার কথা থাকত, অসীমাদেবী স্বামীকে দিয়ে প্রচুর বাজার করিয়ে নিজের হাতে বিভিন্ন পদ রান্না করতেন। টেবিল ভর্তি এত রকমের খাবার দেখে রঞ্জনার খালি মনে হতো যে একটা মানুষ কীভাবে এত রান্না করে উঠতে পারে। অসীমাদেবী দু’জনকে বসিয়ে যত্ন করে খাওয়াতেন। শাশুড়ির সঙ্গে যদিও বা কথা হতো, শ্বশুরের সঙ্গে গল্প করার সুযোগ হতো না রঞ্জনার। উনি ছেলের সঙ্গে বসেই কথা বলে যেতেন, যতক্ষণ ওরা ওখানে থাকত। এতে রাগও হতো রঞ্জনার। ফেরার সময় তুষারের সঙ্গে ঝগড়া লেগে যেত, ‘দেখলে তো তুষার, তোমার ব্যাপারে ওনারা একটু বেশিই পজেসিভ। আমার সঙ্গে একটা-দুটো দায়সারা কথার পরেই ওনারা তোমার সঙ্গেই কথা বলতে থাকেন। আমি মধ্যিখানে বোকার মতো বসে থাকি। অথচ ওনাদের ভালো লাগবে বলে আমাকে পুতুলের মতো সাজিয়ে গুজিয়ে তুমি এখানে আমাকে নিয়ে আসো। আমার এখানে আসার কী মানে হয়?’ তুষার, রঞ্জনাকে বোঝাবার চেষ্টা করে, “তুমি এভাবে কেন ভাবছ? মা-বাবা আমাদের দু’জনকেই সমান ভালোবাসেন। কিন্তু ওনারা একটু সরল মানসিকতার, তোমাদের ভাষার সফিস্টিকেশনের অভাব রয়েছে ওনাদের মধ্যে। লোক দেখিয়ে ভালোবাসা জাহির করা ওনাদের আসে না।’

অন্যদিকে বউমারা চলে যাওয়ার পর অসীমাদেবী ক্ষোভ উগরে দিতেন স্বামীর কাছে। ‘দেখলে তো, এতক্ষণ ওরা রইল অথচ বউমা আমাদের সঙ্গে কথাই বলল না। তুষারই নিশ্চই ওকে জোর করে এখানে নিয়ে এসেছে। মুখ দেখে বোঝাই যায় না ও আমাদের সম্পর্কে কী ভাবছে। এত রকমের রান্না করে খাওয়ালাম অথচ মুখে একটা কথাও বলল না। কোন বাড়িতে শাশুড়ি, বউমার জন্যে এতটা করবে?”

পরিমলবাবু স্ত্রীকে চিনতেন। জানতেন অসীমার এই ক্ষোভ মুহূর্তের তাই চুপ করে থাকাটাই শ্রেয় মনে করতেন।

ক্রমশ…

মা (পর্ব – ১)

রোজকার মতোই তুষার চায়ের ট্রে হাতে করে বেডরুমে এসে ঢোকে। সাইড টেবিলে ট্রে-টা নামিয়ে রেখে জানলার পর্দাগুলো সামান্য সরিয়ে দেয় ঘরে আলো ঢোকার জন্যে। জানলা দিয়ে একফালি কমলালেবুরঙা স্নিগ্ধ আলো এসে পড়ে রঞ্জনার মুখের উপর। রঞ্জনা চোখ বুজেই খাটে পাশ ফিরে শোয়। হাত দিয়ে চোখটা ঢাকার চেষ্টা করে। তুষারের মুখে একটা পরিতৃপ্তির হাসি ফুটে ওঠে। বিছানায় বসে রঞ্জনার চুলে হাত রাখে তুষার, ‘ম্যাডাম, উঠুন। দাস আপনার চা নিয়ে হাজির।’

তুষারের গলা শুনেও রঞ্জনার চোখ খুলতে ইচ্ছা করে না। চোখ খুললেই তো কাজের পাহাড়। যদিও সকালটা তুষারই সামলে দেয়। দেরি করে ওঠাটা রঞ্জনার অভ্যাস। তুষারের ঘুম খুব সকালে ভেঙে যায়। উঠেই চোখে মুখে জল দিয়ে বেডরুমে রাখা মিউজিক সিস্টেম চালিয়ে দেয়। দু’জনেরই মিউজিক প্রিয়। হালকা করে চলতে থাকে আমজাদ আলি বা রবিশংকর। ঘরের জানলাও খুলে দেয় ভোর থাকতে যাতে কিছুটা ফ্রেশ হাওয়া এসে স্নেহের পরশ বুলিয়ে দিয়ে যেতে পারে তাদের শরীরে।

শুয়ে শুয়ে রঞ্জনা বুঝতে পারে তুষার পাশে বসে তার জেগে ওঠার অপেক্ষা করছে। চা এনেছে যখন না খাইয়ে ছাড়ছে না। এরই মধ্যে তুষারের কথা কানে আসে, ‘কী হল ম্যাডাম? বিছানার ওম ছেড়ে ওঠার কি ইচ্ছে নেই? সকাল সকাল তোমার সম্পাদক সাহেবের ফোন এসেছিল। কোনও একটা স্টোরির গন্ধ পেয়েছেন মনে হল, তাই তড়িঘড়ি তোমার খোঁজ পড়েছে।’

‘সম্পাদক’ শব্দটা বোধের উপর আঙুল ছোঁয়াতেই রঞ্জনা আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসে। ‘মিস্টার সেনের কি চোখে ঘুম আসে না যে সাতসকালে ফোন করেছেন?’

‘তোমার এডিটর সাহেবটি খুব ভালো করেই জানেন যে তুমি দেরি করে ঘুম থেকে ওঠো। তা সত্ত্বেও সাত সকালে ফোন করে আমার ঘুমটাও বরবাদ করেন। ‘

তুষার, রঞ্জনার হাতে চায়ের কাপটা তুলে দিয়ে নিজের কাপটাতে চুমুক মারে। হাতে আর বেশি সময় নেই। ঘরের টুকটাক কাজকর্ম মিটিয়ে অফিসের জন্য বেরোতে না পারলে নির্ঘাত দেরি হবেই। সুতরাং উঠে পড়ে তুষার। দুধ নিয়ে এসে গ্যাসে ফুটতে বসিয়ে টোস্ট তৈরি করাটা তুষারের রোজকার কাজ। বাকি রঞ্জনা উঠে যা করবার করবে।

মাত্র বছর দেড়েক হয়েছে দু’জনের বিয়ের। লভ ম্যারেজ। অবশ্য দুই পক্ষের পরিবারের সম্মতিতেই বিয়েটা হয়েছে। কিন্তু ওরা ভবিষ্যতের প্ল্যানিং ছাড়াই জীবনটা সুন্দর কাটিয়ে দিচ্ছে। সংসারের কাজটাকে দুজনে অলিখিত নিয়মে সুবিধামতো ভাগ করে নিয়েছে।

বিয়ের আগে অন্য ছেলেদের মতোই তুষার রান্নাঘরের কোনওদিন পা বাড়ায়নি। বাড়ির সব কাজ মা-ই করতেন। তুষার বড়ো হয়ে থেকে দেখে আসছে রান্নাঘরে মায়ের একাধিপত্য। আলস্য বস্তুটা মায়ের মধ্যে দেখেছে বলে তুষারের মনে পড়ে না। বাড়ির কেউ মা-কে সাহায্য করতে চাইলেও, মা সঙ্গে সঙ্গে তাকে না-করে নিতেন, বলতেন, ‘তোমরা নিজেদের কাজ করো। রান্নাঘরের কাজটা ভগবান মেয়েদের জন্যেই বেছে রেখেছেন।’

তুষারের বড়ো ভাই বিনয়, গ্রিন কার্ডহোল্ডার একটি মেয়েকে বিয়ে করে আমেরিকায় চলে যায় বেশ কয়েক বছর আগে। বড়ো ভাইয়ের চলে যাওয়াটা মা-বাবার মনে একটা গভীর ক্ষতের সৃষ্টি করে। তারপর থেকেই তুষারের মনে হতো মা তাকে আগলে আগলে রাখছেন। চাকরি নিয়ে বাইরে চলে যাওয়ার একেবারে বিপক্ষে ছিলেন মা। বাবাও চাইতেন পরিবারের ব্যাবসা-টা তুষারই দেখুক। কিন্তু তুষারের ভালো লাগত বই আর খবরের কাগজের পাতার কালো অক্ষরগুলো। রাত্তিরে বই নিয়ে শুলে, বাবা এসে পাশে বসে ব্যাবসার কথা বোঝাবার চেষ্টা করতেন। ছেলের বিরক্তি দেখে মা হেসে বাবাকে বোঝাবার চেষ্টা করতেন, ‘কেন শুধু শুধু ছেলেটাকে বিরক্ত করছ তুমি। পড়তে ভালোবাসে তাতে চিন্তার কী আছে? তোমারই তো রক্ত। একদিন দেখবে নিজেই ব্যাবসায় আগ্রহ দেখাচ্ছে।’

কিন্তু অসীমাদেবীর এই ভবিষ্যতবাণী মিথ্যাই প্রমাণিত হয়। পড়াশোনা শেষ করে তুষার চাকরির সন্ধানে ঘুরতে থাকে। পেয়েও যায়। একটি প্রতিষ্ঠিত খবরের কাগজের দফতরে সাব-এডিটরের চাকরি। কাজের প্রতি একাগ্রতা দেখে অসীমাদেবী এবং পরিমলবাবু বুঝে যান, পরিবারের ব্যাবসার ভার ছেলে কোনওদিনই কাঁধে তুলে নেবে না।

সেদিন বিকেলে স্বামী-স্ত্রী দুজনে বসার ঘরে বসে কোনও কিছু নিয়ে আলোচনায় ব্যস্ত, এমন সময় তুষার এসে ঘরে ঢোকে। ছুটির দিন। দুপুর থেকে তুষার বাড়িতেই রয়েছে। প্রথমটা অসীমাদেবী সামান্য আশ্চর্য হয়েছিলেন কারণ ইদানীং ছুটির দিনগুলোতেও তুষার বাড়িতে থাকত না। অফিসের কাজের অজুহাতে সারাদিন বেপাত্তা।

“যাক ভালোই হল। তোমরা দু’জনেই দেখছি এখানে রয়েছ। তোমাদের সঙ্গে আমার কিছু কথা রয়েছে। তুষারের গলা শুনে পরিমলবাবু এবং অসীমাদেবী তাকান ছেলের দিকে। কথা বলতে বলতে দুজনে কেউই খেয়াল করেননি ছেলে কখন এসে ঘরে ঢুকেছে।

“মা, কিছুদিন আগে রঞ্জনা নামে একটি মেয়ের সঙ্গে আমার আলাপ হয়। মেয়েটিও জার্নালিজম নিয়ে ডিপ্লোমা করেছে। ওর বাবা নামি একটি সংবাদপত্রে সিনিয়র জার্নালিস্ট, নাম দেবরঞ্জন রায়। তোমরা নিশ্চই ওনার নাম শুনে থাকবে। রঞ্জনার মা কলেজের প্রফেসর এবং ভাই ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার সঙ্গে যুক্ত। আমি রঞ্জনাকে বিয়ে করতে চাই।’

তুষারের মুখে হঠাৎ-ই সব শুনে পরিমলবাবু এবং অসীমাদেবী খানিক্ষণ চুপ করে থাকেন। কী বলবেন বুঝে পান না। তারা যে মানসিকতা নিয়ে সন্তানদের বড়ো করে তুলেছেন, তার সঙ্গে পুরো ঘটনাটার কোনও সাযুজ্য খুঁজে পান না। ছেলে যেখানে নিজেই মেয়ে দেখে বিয়ে স্থির করে ফেলেছে সেখানে তাদের ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ তে কিছুই যায় আসে না। পরিমলবাবু নিজের ভাবনার গতিবেগকে সংযত করেন, “বাঃ সে তো বেশ ভালো কথা। একটা দায়িত্ব থেকে তাহলে তুমি আমাদের নিষ্কৃতি দিলে। একটা দিন দেখে তাহলে দুটো পরিবারের মধ্যে প্রয়োজনীয় কথাবার্তাগুলোও সেরে ফেলা দরকার। তোমাদের যেদিন সুবিধা হবে মা-কে জানিয়ে দিও।’

ক্রমশ…

গর্ব (পর্ব ১)

বহুদিন পর নিজের জন্মস্থানের মাটিতে পা রাখলেন রমেন্দু সমাজপতি। মনে মনে হিসেব করে দেখলেন তা প্রায় কুড়ি বছর তো হল বটেই! বড়ো ছেলে রঞ্জন মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক দুটোতেই অসাধারণ রেজাল্ট করে আইআইটি-তে খুব সহজেই চান্স পেয়ে গিয়েছিল।

ছোটো ছেলে রাহুলও দাদার মতো দুর্দান্ত রেজাল্ট করে যাচ্ছিল। এইসময় রমেন্দুর ট্রান্সফার অর্ডার এল কলকাতায়। ওদের পড়াশোনোর কথা চিন্তা করে রমেন্দু কলকাতায় একটা ফ্ল্যাটও কিনে ফেললেন। এরপর হঠাৎ করেই পর পর দু’বছরের মধ্যে বাবা মা দু’জনেই গত হলেন।

সম্পত্তির ভাগ বাঁটোয়ারা নিয়ে অহেতুক কিছু বিবাদ তৈরি হল পরিবারে। রমেন্দু দেখলেন, কলকাতাতেই যখন তাঁর সবকিছু তখন দেশের বাড়ি ঘরদোর রেখে লাভ কী? ভাগের সম্পত্তি বিক্রি করে দিলেন। শিকড়টা ছিঁড়ে গেল চিরদিনের মতো।

সবকিছু বিক্রি করার যে খুব ইচ্ছে ছিল তা নয়, কিছুটা অভিমানেই অমনটা করেছিলেন রমেন্দু। বাবা মারা যেতেই ভাইয়েরা সম্পত্তির ভাগ নিয়ে এমন শুরু করে দিল যে, রমেন্দুর মন একদম ভেঙে গিয়েছিল। রাতারাতি ডিসিশন নিয়ে ফেললেন, আর এখানে কোনও দিন আসবেন না, ওদের মুখ দর্শনও করবেন না। যে-ব্যবহারটা ভাইয়েরা করেছিল তাতে ভবিষ্যতে ওদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখার ইচ্ছেটাই মরে গিয়েছিল। জ্যাঠতুতো ভাই তিনুর কাছে রমেন্দু প্রায় অর্ধেক দামে বিক্রি করে দিয়েছিলেন নিজের অংশ।

বাড়ির সামনের কৃষ্ণচূড়া গাছটি আর নেই। ওরা কেটে ফেলেছে, কিংবা একা একাই মরে গিয়েছে। তিনু তিনতলা বাড়ি হাঁকিয়েছে। নীচে ওপরে ভাড়া, মাঝের তলায় তারা থাকে। তিনু এখন বেশ বড়োলোক। অঢেল টাকার মালিক।

অভিমান ভুলে ছোটো ভাই রাখালের বাড়িতেই উঠেছেন রমেন্দু। সম্পত্তি নিয়ে সবচেয়ে বেশি গোলমাল পাকিয়েছিল রাখালই। এখন বিশেষ ভালো নেই রাখাল। একটা কিডনি ড্যামেজ। ছেলে মেয়ে দুটো একেবারেই মানুষ হয়নি। কোনওরকমে চলছে তার।

ভাইদের জন্য নয়, জন্মভূমি আর বাল্যবন্ধু শিবতোষের টানেই এসেছেন রমেন্দু। শিবতোষের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ আছে। শিবতোষ সুযোগ পেলেই বলে, একবার এসে ঘুরে যা। কাদের ওপর অভিমান করছিস? কত পালটে গেছে আমাদের জন্মভূমি, একবার দেখতে ইচ্ছে করে না তোর?

রিটায়ার করার পর রমেন্দুর মনে হয়েছে, জীবনের মেয়াদ ফুরিয়ে আসছে। সত্যি তো, কার ওপর অভিমান করছে সে! উপলব্ধির দরজা কখন যে খুলে যায়!

বুনিয়াদপুরের মাটিতে পা রেখেই মনে মনে হেসেছিলেন রমেন্দু। শিবতোষের কথাটা ডাহা ভুল। মায়ের শরীরের গন্ধটা কুড়ি বছর পরেও একইরকম অমলিন। মায়ের শরীরের গন্ধ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ পারফিউম এবং সেটা যে-কখনও মুছে যায় না, বুঝতেই পারেননি শিবতোষ।

—অবশেষে এলি তাহলে!

অনেকটা বুড়িয়ে গেলেও শিবতোষের হাসিটা একইরকম ঝকঝকে। কতকাল পরে সামনাসামনি দেখা! ক্র্যাচে ভর দিয়ে চলতে হয় শিবতোষকে। একটা অ্যাক্সিডেন্টে বাঁ-পা কাটা পড়েছে। রমেন্দু তখন চেন্নাই, খবরটা পেলেও আসা হয়নি। শিবতোষদের বাড়িটা একসময় টিনের ছিল। টিনের দেয়াল, টিনের চাল, মেঝেটা পাকা। বৃষ্টির সময় টিনের চালে অদ্ভুত সুন্দর একটা মিউজিক তৈরি হতো। এখন সবকিছু পাকা। তবে তেমন শৌখিনতার ছাপ নেই, নেহাতই আটপৌরে।

—ভালো আছিস তো সবাই? ভেলভেটের গদি আঁটা একটা কাঠের চেয়ারে বসতে বসতে বললেন রমেন্দু।

বছর বাইশ তেইশের ভারি মিষ্টি মুখের একটা মেয়ে জলের গেলাস হাতে নিয়ে সামনে এসে দাঁড়াল। হাতে শাঁখা-পলা, সিঁথিতে সিঁদুর।

শিবতোষ বললেন, “আমার ছোটো বউমা। গতবছর বিয়ে হয়েছে ওদের। তোকে কিন্তু চিঠি পাঠিয়েছিলাম।’

রমেন্দু সে কথার জবাব না দিয়ে বললেন, “তোর ছোটো ছেলে এখন কী করছে? কী যেন নাম ওর?’

—রাজা। ভালো নাম রণতোষ। বিএসসি পাশ করার পর কিছুদিন বসেছিল। চেষ্টা চরিত্র করে একটা প্রাইমারি স্কুলে ঢুকিয়ে দিয়েছি। চাকরি করে, সঙ্গে টিউশনিও করে, সব মিলিয়ে ভালোই আয় করে। বড়ো ছেলে শেখর বাজারে বইখাতার দোকান করেছে।

রমেন্দু, রাজার বউয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, “তোমার নাম কী মা?”

—রিনি।

রিনি পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করল। রমেন্দু মনে মনে ভাবলেন, আগে জানলে কিছু একটা উপহার আনতে পারতেন। কিন্তু সেটা যখন হয়নি তখন এখান থেকেই কিছু একটা কিনে দেবেন। প্রথম দেখাতেই মেয়েটাকে ভালো লেগে গিয়েছে তাঁর। কী সুন্দর প্রতিমা প্রতিমা গড়ন! টানা টানা চোখে অদ্ভুত এক মায়া মেশানো।

রিনি হেসে বলল, “বাবার মুখে আপনার কথা অনেক শুনেছি। বাবা তো আপনাদের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। আপনাদের কথা উঠলে আর থামতেই চায় না।’

—তাই? কী কী বলে তোমার শ্বশুর? হাসলেন রমেন্দু।

—সে অনেক কথা। আপনি কত্তবড়ো চাকরি করতেন। আপনার এক ছেলে ইঞ্জিনিয়র, এক ছেলে ডাক্তার— দু’জনেই বিদেশে থাকে। আরও কত্ত কী। একটা কথা জিজ্ঞেস করব কাকাবাবু? না মানে আমার কৌতূহল আর কি…।

রমেন্দু অবাক হয়ে বললেন, ‘কী?’

—শুনেছি আপনার বড়ো ছেলের বউ বিদেশিনি, মেমসাহেব। আপনারা ওর সঙ্গে কোন ভাষায় কথা বলেন? ইংরেজিতে? হো হো করে হেসে উঠলেন রমেন্দু। প্রাণখোলা হাসি। মনে হল বহুদিন পর যেন অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে একটা বিশুদ্ধ হাসি উঠে এল। রিনি কিছুটা অপ্রস্তুত, মুখে বোকা হাসি!

—না না মা, তোমার কৌতূহল যুক্তিসঙ্গত। আমার বিদেশিনি বউমা বাংলার ‘ব’ও বোঝে না। ইংরেজিতেই কথা হয়। তবে এবার দেখলাম দু’চারটে বাংলা শব্দ শিখেছে সে। সবমিলিয়ে ভাব বিনিময় ঠিক হয়ে যায়। ওরা যখন আসে ক’টাদিন খুব মজা হয়। মারিয়া মানে আমার পুত্রবধূটি বেশ মিশুকেও বটে।

শিবতোষের বড়ো বউমা প্লেট ভর্তি করে মিষ্টি নিয়ে এসেছে। প্রণাম পর্ব সে আগেই সেরে নিয়েছিল। টুল টেনে প্লেটটা রাখতে রাখতে বলল, “আপনার বউমার কথা শুনেই খুব দেখতে ইচ্ছে করছে কাকাবাবু। অবশ্য দেখা হলে আমরা দেখা ছাড়া আর কিছুই করতে পারব না। কী কথা বলব? আমাদের ইংরেজি শুনলে সে নিজের মাতৃভাষাই ভুলে যাবে, এটা নিশ্চিত করে বলতে পারি। তবুও দেখতে ইচ্ছে করছে।’

রিনি বলল, ‘আমারও। মেমবউ তো জীবনে কোনও দিন দেখিনি।’

—বেশ বেশ, সুযোগ পেলে একবার নিশ্চয়ই দেখাব তোমাদের। কিন্তু এত মিষ্টি কে খাবে? আমার যে সুগার।

শিবতোষের বড়ো বউমার নাম ইন্দ্রাণী। সবাই টুকি বলেই ডাকে। দেখতে শুনতে অতি সাদামাটা। পড়াশোনোর গণ্ডিও যৎসামান্য। তবে ভীষণ আন্তরিক আর দায়িত্বশীলা। রমেন্দু এসে অবধি দেখছেন, পরিবারের প্রতিটি সদস্যের প্রয়োজন- অপ্রয়োজনের খবর রাখে মেয়েটা। যথাসাধ্য সেসব পূরণও করার চেষ্টা করে। তার সঙ্গে সঙ্গে সংসারের কাজকর্ম করে চলেছে দিব্যি।

ক্রমশ…

পাথর-প্রতিমা (শেষ পর্ব)

শেষ পর্ব

একপ্রকার আমার জোরাজুরিতেই আমি আর সিদ্ধার্থ বড়োদিনের সন্ধেবেলা হাজির হলাম আদিবাসীদের গ্রামে। দূর থেকে দেখেই বিরজু ছুটে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরল। আরও অনেকে রয়েছে। আয়োজন ভালোই। মহুয়া আর মেঠো ইঁদুরের মাংস ধনেপাতা দিয়ে। সিদ্ধার্থ আমাকে চোখ দিয়ে ইশারা করল, না খাওয়ার জন্য। কিন্তু বয়ঃসন্ধিতে যে-নেশার বীজ শরীরের অলিতে গলিতে ছড়িয়েছে তাকে এড়ানো বড়ো মুশকিল। তার ওপর আবার যদি ছোটোবেলার স্যাঙাতদের অনুরোধ থাকে। বেশ কয়েক ভাঁড় মহুয়া মেরে দিলাম ইঁদুরের মাংস দিয়ে। আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখছি অনেকগুলো আধখাওয়া চাঁদ। তার মানে ভালোই নেশা হয়েছে।

সিদ্ধার্থ বলল, ‘চল এবার উঠি।’

আমার তখন ওঠার শক্তি নেই। হাতের ইশারায় আর একটু অপেক্ষা করতে বললাম। সিদ্ধার্থ তাড়া দিল। বিরজু ভরসা জোগাল, ‘সিধু তুই যা, আমি একটু পরে শুভকে এগিয়ে দেব।’ সিদ্ধার্থ আমার পিঠে হাত বুলিয়ে ভরসা দিয়ে চলে গেল।

আমি আর বিরজু আবার শুরু করলাম। উল্লাস! কিছুক্ষণ পর খেয়াল করলাম, বিরজুর-ই ওঠার ক্ষমতা নেই। ও আমাকে কীভাবে এগিয়ে দেবে! আমার শরীর ছেড়ে দিয়েছে। মনের জোরে উঠে দাঁড়ালাম। ভাবলাম, নদীর ধার দিয়ে কোয়ার্টারে ফিরতে অনেক সময় লাগবে। তার চেয়ে বরং পাহাড়ি জঙ্গলের মেঠো পথ দিয়ে শর্টকাট মারি।

ধীরে পাহাড়ের ঢাল ধরলাম। চারদিকে শুধু ঝিঁঝিঁপোকার শব্দ। থকথকে অন্ধকার। চারপাশের কালো পাহাড়গুলো যেন আমার বুকের ওপর চেপে বসছে। পা ক্রমশ ভারী হয়ে আসছে। আর চলতে চাইছে না। হঠাৎই পিঠে একটা শক্ত কিছু দিয়ে ধাক্কা মারা অনুভব করলাম। মুখ থুবড়ে সামনে পড়ে গেলাম। তারপরেই সেই গল্পের শুরুর ঘটনাটা।

আমার যখন হালকা জ্ঞান ফিরল, তখন দেখি আমি একটা পাহাড়ের গুহায় হাত বাঁধা অবস্থায় পড়ে আছি। দূরে আবছা দেখতে পেলাম একটা আগুন জ্বলছে। চারদিকে গোল হয়ে জলপাই রঙের পোশাক পরা কয়েকটি ছেলেমেয়ে। বসে খাওয়াদাওয়া করছে। একজনকে পিছন থেকে দেখে, যেন মনে হল বুধিয়া। আমার আর বুঝতে অসুবিধে হল না যে, আমি একটি জঙ্গি সংগঠন দ্বারা অপহৃত হয়েছি। কিন্তু এখন মুক্তির উপায় কী? আপাতত চুপ করে বসে থাকা ছাড়া আমার এই মুহূর্তে আর অন্য কোনও পথ নেই।

রাত ক্রমশ গড়াচ্ছে। আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখলাম চাঁদ দিক বদল করছে। ক্লান্তিতে আমার আবার চোখ জুড়ে আসতে লাগল। কখন ঘুমিয়ে পড়েছি জানি না। হঠাৎ ঘুম ভাঙল একটা উষ্ণ হাতের কোমল স্পর্শে। ভারী চোখের পাতা খুলে চমকে উঠলাম। চাঁদের আলোয় দেখি বিজলি। পরনে জংলা রঙের পোশাক। পিঠে একটা স্বয়ংক্রিয় রাইফেল। দূরে আগুনটা নিভু নিভু। ছড়িয়ে ছিটিয়ে কয়েকজন শুয়ে আছে।

পায়ের জুতোর ফাঁক থেকে ছোটো ছুরিটা বার করে বিজলি আমার হাতের বাঁধনটা কেটে দিল। তারপর ঠোঁটের ওপর আঙুল দিয়ে শব্দ করতে বারণ করল। হাতটা বাড়িয়ে দিল আমার দিকে। আমি বিজলির হাত ধরে উঠে দাঁড়ালাম। মাথা নীচু করে বেরিয়ে এলাম গুহা থেকে। অন্ধের মতো ওর হাত ধরে পাহাড়ি পথে জঙ্গল চিরে হাঁটতে লাগলাম। কোথায় যাচ্ছি, কেন যাচ্ছি জানি না।

কিছুক্ষণ পরে পিছনে শুনি শুকনো পাতার খসখস আওয়াজ। মনে হয় কেউ বা কারা যেন আমাদের অনুসরণ করছে। আমরা হাঁটার গতি বাড়ালাম। কতক্ষণ হাঁটছি খেয়াল নেই। শুধু মনে হচ্ছে মৃত্যুর মুখ থেকে জীবনের দিকে হাঁটছি। হঠাৎ আমরা একটা উঁচু টিলার ওপর এসে দাঁড়ালাম। দূরে দেখা যাচ্ছে নীচে আমাদের রাজগাঙপুর। টিপটিপ করে জ্বলছে কোয়ার্টারের কয়েকটা আলো। মুহূর্তের মধ্যে বিজলি আমাকে জড়িয়ে ধরল। আমার সারা শরীর অবশ হয়ে গেল। আমি পাহাড়ের বুকে আবার হারিয়ে যেতে লাগলাম। একটা আদিম চুম্বন আমার সংবিৎ ফেরাল। মনে হল খুব কাছেই কোনও মানুষের উপস্থিতি। ভারী বুটের আওয়াজ। বিজলি আমাকে ধাক্কা দিয়ে বলল, “পালা…ও। যত তাড়াতাড়ি পারো।’

আমি রুদ্ধশ্বাসে দৌড় শুরু করলাম। আচমকা পিছনে একটা গুলির আওয়াজ। একটা মেয়েলি গলার বিকট চিৎকার। চারদিকের পাহাড়ে প্রতিধ্বনিত হতে লাগল সেই গগনভেদী শব্দ। সে শব্দ কীসের! সে কি কোনও নারীর মৃত্যুর আর্তনাদ? নাকি তার দলের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতার বিচারহীন ভবিতব্য শাস্তির প্রতিবাদ? বা জাতপাতের অন্ধবিশ্বাসে এক নিষ্পাপ ভালোবাসার মৃত্যুর বিরুদ্ধে জেহাদ! জানি না৷

এক দৌড়ে এসে থামলাম একেবারে সিদ্ধার্থদের বাড়ির সামনে। দরজা খুলে আমার অবস্থা দেখে সিদ্ধার্থ অবাক। আমি নিশ্চুপ। আমার এক চোখে তখন বাঁচার আনন্দ, অন্য চোখে ভালোবাসার মরণের অশ্রু।

পরদিন কলকাতা ফেরার ট্রেন ধরলাম। সিদ্ধার্থ স্টেশনে ছাড়তে এল। ট্রেন ছাড়ার পর, আমি হাত নাড়তে থাকলাম। আমার পিছনে পড়ে রইল পাহাড়ঘেরা আমার জন্মস্থান, আমার ছোটোবেলার বেড়ে ওঠার স্মৃতিবিজড়িত পাহাড়ের পাদদেশের এক আদিবাসী গ্রাম আর আমার পবিত্র ভালোবাসার মৃত্যু উপত্যকা।

 

 

পাথর-প্রতিমা (পর্ব- ২)

পর্ব – ২

অসতর্ক মুহূর্তের সব ফেলে আসা কথা। আমাকে আবির মাখিয়ে দাঁড়িয়েছিল সামনে। চোখের ইশারায় বোঝাতে চাইছিল আবির হাতে আমাকে, ওর শরীরের দখল নেওয়ার জন্য। তবে বিজলির সাথে আমার সম্পর্ক চরমে পৌঁছে ছিল সে বছর বড়োদিনের দিন। যখন ও আমায় মহুয়া খাবার পর জঙ্গলের পথ ধরে রাতেরবেলা বাড়ি পৌঁছে দিতে আসছিল।

খরস্রোতা কিশোরীর মতো পাহাড়ি ঝরনা দুকুল ছাপিয়ে উপচে পুরো পাহাড় ভিজিয়ে দিয়েছিল সেদিন। পাহাড়ের কোলে শিশিরে ভেজা ঘাসের ওপর আধখাওয়া চাঁদের দুধ গড়িয়ে পড়েছিল আমাদের দু’জনের গা বেয়ে। পাহাড়ি ঝরনার সাদা ফেনার মতো আমার ফরসা শরীরে কালো পাহাড়ের মতো বিজলি চেপে বসেছিল। পাহাড়ের বুক ফেটে ঝরনা নেমে এসেছিল আদিম গহ্বর থেকে শহুরে সভ্যতার বুকে। ব্যস! সেই শেষ রাত। তারপর আর বিজলির সাথে সেভাবে কোনওদিন যোগাযোগ হয়নি। কারণ দু’পক্ষেরই বাড়ির চাপে অবাধ মেলামেশার উপর কড়া নিষেধাজ্ঞা আরোপ হয়েছিল। তবে শেষ দেখা হয়েছিল, বাবা যেদিন বদলি হয়ে গেল। তখন আমি কলেজ শেষ করেছি সবে। ও দূরে দাঁড়িয়েছিল পাথরের মতো। যার বুকে অনেক হিমবাহ জমে আছে।

শুধু দু’চোখের কোণা বেয়ে তিরতির করে গড়িয়ে পড়ছে ঠিক কোয়েল নদীর মতো একটা ক্ষীণ ধারা। তারপর এই আবার এখানে এলাম বছর দুই পর। শীতের ছুটিতে। ছোটোবেলার শিকড়ের টানে। তবে তখন পাহাড় আর তার এই উপত্যকার ছবি এক থাকলেও রং পালটে গেছে অনেক। তবে এসে যা শুনলাম, তাতে বুঝলাম, তার জন্য দায়ী ওরা নয়। দায়ী আমরাই, শহুরে মানুষেরাই।

এবার বাঁক নিয়ে গল্পের শুরুর দিকে আবার ফিরে যেতে হবে। এ বছর আমি এসেছি বড়োদিনের ছুটিতে। এসে উঠেছি বাবারই এক বন্ধুর কোয়ার্টারে। ওনার ছেলে সিদ্ধার্থ আবার আমার স্কুলের বন্ধু। আমরা দু’জনেই গিয়েছিলাম বড়োদিনের সন্ধেবেলা আদিবাসীদের গ্রামে। ওখানে সব ছোটোবেলাকার খেলার সাথি এখনও কিছু আছে। তবে সিদ্ধার্থ প্রথমে যেতে চাইছিল না। তার কারণ ও যা বলল, আমি তো শুনে অবাক। ওর কথাটাই এখানে হুবহু তুলে ধরি।

—শোন শুভজিৎ, তোর এই অঞ্চলের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে কিছু জানা দরকার। তোরা এখান থেকে চলে যাওয়ার পর, অনেকেই কোয়ার্টার ছেড়ে চলে গেল। তুই আগের ধারণা নিয়ে এখানে এখন ঘোরাফেরা করলে বিপদ হতে পারে। তাই আগে থেকেই তোকে একটু সাবধান করে দিচ্ছি।

—বিপদ! আমাদের এই উপত্যকা তো স্বর্গরাজ্যের মতো সুন্দর ছিল। সেখানে আবার সমস্যা কী হল?

—না… আগে তো সত্যিই কোনও ঝামেলা ছিল না। কিন্তু এখন কারখানাগুলোর অবস্থাও তথৈবচ। নানারকম অশান্তিও শুরু হল একটার পর একটা। প্রথমে যেটা ঘটল, সেটা ভয়ংকর। তোরা চলে যাবার মাসখানেক পরেই। তুই তো জানতিস হাতিশালায় প্রতি হাতিপিছু দশ কেজি করে আটা দিনে বরাদ্দ ছিল। সেই আটা চুরি করত প্রভাকরদা, মানে প্রভাকর মাহাতো। চিনতে পারছিস তো?

—হ্যাঁ, চিনব না কেন? প্রভাকরদাই তো হাতিদের মাহুত ছিল। আমাকে কতবার হাতির পিঠে চড়িয়েছে।

—হ্যাঁ ঠিক। জানিস তো হাতিরা এমনিতেই খুব সংবেদনশীল আর বুদ্ধিমান। ওদের আধপেটা খেয়েই দিন কাটত। একদিন এক আদিবাসী সাফাইওয়ালা যেই না ঢুকেছে হাতিশালা পরিষ্কার করতে। আর ব্যস! তখনই একটা হাতি শুঁড়ে করে পেঁচিয়ে তাকে দেয়ালে ঠেসে পিষে মেরে দিল। সেই প্রথম খেপল আদিবাসীরা। আসলে প্রভাকরদার অসততায় বিনা দোষে একজন আদিবাসী মারা গেল।

—তারপর?

—তোর রমণীকাকুকে মনে আছে?

—হ্যাঁ রমণীমোহন কর। ডলোমাইট খনির ক্যাশিয়ার ছিল।

—তুই তো জানিস। রমণীকাকুর স্বভাব চরিত্র কোনও দিনই ভালো ছিল না। নিরক্ষর মজদুরদের হিসেব গুলিয়ে সবাইকে পয়সা কম দিত। ঠকাত। আর একটা রেজা (মহিলা কুলি) ছিল, একটু ধোঁড়ো গোছের, নাম লছমী এক্কা। তোর মনে আছে?

আমি হাসলাম। কারণ এই ‘ধোঁড়ো’ হল এই অঞ্চলের ভাষা। মানে শহুরে লোকেরা যাদের আর কী হস্তিনী নারী বলে। শ্রাবণের পুকুরের মতো টইটুম্বুর। হেসে বললাম, ‘ওই বয়সে লছমীকে কি ভোলা যায়?”

—সেই লছমীর সাথেই রমণীকাকুর লটরপটর, আদিবাসীরা একদিন হাতনাতে ধরে ফেলেছিল। তারপর সেটা নিয়ে বিরাট গণ্ডগোল হয়। মোটামুটি আদিবাসীদের সঙ্গে শহুরে মানুষদের একটা শ্রেণিশত্রুতার বীজ তখনই বোনা শুরু হয়ে গেল। আচ্ছা একটা কথা সত্যি করে বলতো, “তুই কি সত্যিই বিজলিকে ভালোবাসতিস?’

—ভাই আমাকে আবার এসবের মধ্যে জড়াচ্ছিস কেন? তবে একটা আগ্রহ চেপে রাখতে পারছি না, হ্যাঁরে সেই বিজলির কোনও খবর জানিস?

—এই তো গুরু, এবার পথে এসো। শোন, তোর আর বিজলির ব্যাপারটা নিয়েও পরবর্তীকালে আলোচনা হয়েছিল। আসলে এইসবের নাটের গুরু হল বুধিয়া। ও মনে মনে বিজলিকে খুব ভালোবাসত। যেটা আমি পরে বুঝতে পারি। যদিও বিজলি ওকে খুব একটা পাত্তা দিত না। তুই না চলে গেলে, ও হয়তো তোকে শেষই করে দিত।

—না না, বুধিয়া আমার ভালো বন্ধু ছিল।

—ভুল করছিস। প্রেম মানুষকে অন্ধ আর বুদ্ধিহীন করে দেয়। কারণ বিজলিও তোকে খুব ভালোবাসত।

—ওসব ছাড়! যে-সম্পর্কটা আমার বাবা-মা বা ওদের সম্প্রদায়, কেউই মেনে নেবে না, সেটা নিয়ে আর আলোচনা করে লাভ কি? তার চেয়ে বরং ওদের খবর বল।

—দ্যাখ, বুধিয়া আমাদের সাথে ওই পাহাড়ি আদিবাসীদের সম্পর্কের যাবতীয় ফাটলের জন্য একমাত্র দায়ী। বুধিয়া স্কুল পাশ করে রাউরকেল্লা কলেজে ভর্তি হল। ঠিক তারপর থেকেই ওর ভেতর একটা পরিবর্তন হতে শুরু করল। মনে হয় কলেজে কেউ ওর মগজ ধোলাই করেছিল। কোনও আদর্শবাদী দলের সব নীতিকথা ওর মস্তিষ্কে গুঁজে দেওয়া হয়েছিল। ও তলে তলে অনেক আদিবাসীকেই নিজের দলে টানতে শুরু করল। কিছু মেয়েও ওদের দলে ভিড়ল। তুই তো জানিস, ওর ছোটোবেলা থেকেই ধূর্ত শিকারির মতো প্রখর চোখ। বিজলিকেও হাত করে নিল মগজ ধোলাই করে। শুনেছি ওরা সবাই নাকি এক নিষিদ্ধ সংগঠনে যোগ দিয়েছে। এখন ওরা ওই পাহাড়ে জঙ্গলে লুকিয়ে থাকে। পুলিশ ওদের খুঁজছে। তাই ওপর থেকে তুই কিছুই বুঝবি না। ক’দিন থাকলেই সব টের পাবি, চারদিক থমথম করছে। সেই অনাবিল আনন্দ আর নেই রে…

আমি সব শুনে বাকরুদ্ধ। শুধু একটা ঢোঁক গিলে বললাম, ‘তার মানে আদিবাসীদের গ্রামে যাওয়া যাবে না?”

—তুই কলকাতা থেকে এত আশা করে এসেছিস। কী বলি বল! তবে গেলেও বেশি রাত করা যাবে না। সাবধানে তাড়াতাড়ি ফিরে আসতে হবে।

ক্রমশ…

 

পাথর-প্রতিমা (পর্ব – ১)

হঠাৎ নাকে একটা অদ্ভুত সবুজ গন্ধ এসে লাগল। যদ্দুর মনে হয়, পাহাড়ের গায়ের ভিজে শ্যাওলার গন্ধ। মুখের ওপর ভারি টর্চের আলো। চোখ ধাঁধিয়ে গেছে। আলোর পিছনে আর কিছু দেখতে পাচ্ছি না। আলো আর আমার চোখের মাঝখানে একটা কুয়াশার টুকরো ঝুলে আছে। হঠাৎ দপ করে আলোটা নিভে গেল। আলকাতরার মতো একটা অন্ধকার কে যেন ঢেলে দিল আমার চোখে। তারপরই একটা হিমশীতল ধাতুর স্পর্শ লাগল আমার পিঠে। পরক্ষণেই গুরুগম্ভীর একটা প্রশ্ন কালো রাত ফুঁড়ে আমার দিকে ধেয়ে এল, ‘আপনি কে? কোত্থেকে আসছেন?”

আমার গলা তখন ভয়ে আর মহুয়ার নেশায় পুরো জড়িয়ে গেছে। বেশির ভাগটাই হাতের ইশারায় আর বাকিটা অস্ফুট শব্দে বলে উঠলাম, ‘বাড়ি রাজগাঙপুর। জঙ্গলে পথ হারিয়ে গেছি।’ আমার দুটো হাত দু’জনে ধরল। তারপর মাটিতে হেঁচড়েই ওরা পাহাড়ের চড়াই বেয়ে উঠতে লাগল। এরপর আমার আর কিছু মনে নেই।

এবার আমার কথা একটু বলে নেওয়া দরকার। আমার বেড়ে ওঠা উড়িষ্যার রাজগাঙপুরে। রাউরকেল্লা থেকে প্রায় চল্লিশ কিলোমিটার দূরে। চারপাশে পাহাড়ের পরিখা দিয়ে ঘেরা ছিল আমাদের এলাকা। পাহাড়ের গায়ে থোকা থোকা শালের জঙ্গল, আবার কোথাও রুক্ষ। তবে সেই শুষ্ক পাথরের বুক ফেটেই নেমে এসেছে একটা রুপোলি ফিতের মতো নদী। নামটি ভারি মিষ্টি, কোয়েল। সেই নদীর গা ঘেঁষেই আমাদের কোয়ার্টার। মাঝেমধ্যে চাঁদের আলোয় দেখতাম সেই পাহাড়ের গা বেয়ে ভাল্লুক নেমে আসতে।

খুব গরমের সময় ভুট্টা খেতে পাহাড়ি জঙ্গল থেকে হাতির পালও নেমে আসতে দেখেছি। ভুট্টা খেয়ে নদীতে দাপিয়ে চান করত তারা। তবে ওই অরণ্যে চিতাবাঘ আছে শুনলেও কোনও দিন দেখিনি। কিন্তু আছে এটা বিশ্বাস করতাম, কারণ মাঝেমধ্যে দু’একটা গরু ছাগল উধাও হয়ে যেত। তবে এখন সবচেয়ে ভয় মানুষের। কেন? সে কথায় একটু পরে আসছি।

গ্রামে মূলত দু’ধরনের মানুষের বাস। এখানকার বেশিরভাগ মানুষই হল আদিবাসী সম্প্রদায়ের। অনেকেই অভাবের তাড়নায় খ্রিস্টান। ব্রিটিশ সাহেবরা খাবার আর পোশাকের লোভ দেখিয়ে এদের খ্রিস্টান করেছিল। আর কিছু আশেপাশের কারখানায় কর্মজীবী শহুরে মানুষ। যেমন আমরা। আমার বাবা কাজ করতেন কাছেই উড়িষ্যা সিমেন্ট ফ্যাক্টরিতে। আমি পড়তাম ওখানকার ‘রাষ্ট্রীয় বিদ্যালয়’ স্কুলে। গ্রামের আদিবাসীরাও ওই স্কুলেই পড়ে।

বাবার কারখানার পাশেই ছিল আমাদের কোয়ার্টার। তার পাশেই বিরাট হাতিশালা। হাতিশালায় দশ বারোটা হাতি ছিল। গ্রাম থেকে এক কিলোমিটার দূরেই ডলোমাইট খনি। কারখানায় লাইমস্টোন আসত মালগাড়িতে। ইঞ্জিন মালগাড়ি রেখে দিয়ে চলে যেত। হাতি সেসব কামরা ঠেলে আনত। আমরা ছোটোবেলায় খুব মজা করে সেই সব দৃশ্য দেখতাম।

সবার ঘরেই হাঁস মুরগি ছিল। বিকেলে মাঠ থেকে খেলে ফিরে, বাড়ির হাঁস মুরগি চই চই করে ঘরে ঢোকানোর দায়িত্ব ছিল আমার। বিনিময়ে আমি ডিমের বেশি ভাগ পেতাম। সকালবেলা দুধ আনতে গেলে ঝগড়ু ভালোবেসে খেতে দিত পূর্ণ গর্ভবতী গরু মোষের সাঁজো দুধ। ধোঁয়া ওঠা গাঢ় হলুদ রঙের দুধ। ওটা বেচার নয়। এসব খেয়ে আদিবাসীদের মতোই বেশ তাগড়াই হয়েছিল চেহারাটা। তবে গায়ের রংটা শুধু ফরসা ছিল, এই যা! পাহাড়ি গ্রামের ছবি আঁকার ফাঁকে একটু স্কুলবেলার কথা বলে নিই।

আমার সাথে স্কুলে পড়ত যেমন আমাদের কোয়ার্টার-এর চাকুরিজীবীদের ছেলেরা, তেমনি আসত অ্যালেক্স ওঁরাও, জুয়েল মূর্খ, বিরজু মুণ্ডা, শিবু হেমব্রম, এইসব আদিবাসী ছেলেরা। ওদের গ্রাম ছিল পাহাড়ের কোলে মহুয়া গাছ দিয়ে ঘেরা। শীতকালে আদিবাসীরা এই মহুয়া জ্বাল দিয়ে ‘মাহুল’ বানাত। মহুয়ার গন্ধে সারা এলাকা ম-ম করত। সেই গন্ধে অনেক সময়েই পাহাড় থেকে ভাল্লুক নেমে আসত। তারপর দু’হাত দিয়ে মানুষের মতো মহুয়ার হাঁড়ি তুলে ‘মাহুল’ খেত। খাওয়ার পর সে কী হাঁটা! টলতে টলতে মাতাল পায়ে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে উঠে যেত।

এছাড়াও ওরা ভাত পচিয়ে হাঁড়িয়া বানাত। নেশা বেশি হওয়ার জন্য তাতে ‘বাখর’ বলে একরকম গাছের ফল মিশিয়ে দিত। তবে হাঁড়িয়া ফুটিয়ে ঠান্ডা হওয়ার সময়, হাঁড়ির গায়ে যে-বাষ্প জমা হতো, তার নাম ‘রাশি’। এর নেশা মারাত্মক। আদিবাসীরা খেত। আমি কোনও দিন খাইনি। পাকা নেশাড়ু ছাড়া অন্য কেউ সহ্য করতে পারবে না। বুধিয়া বারলা বলে আমার এক বন্ধু ছিল। পাখি মারায় ওস্তাদ। গুলতি দিয়ে কত নানা জাতের পাখি মেরে যে, তার মাংস আমায় খাইয়েছে, এখন ভাবলে প্রায়শ্চিত্ত করতে ইচ্ছে হয়।

আর একটা সাংঘাতিক কথা না বললে গল্প সম্পূর্ণ হবে না। ওরা ঠিক সন্ধে হওয়ার আগে ঘুড়ির সুতোয় বঁড়শি দিয়ে বাদুড় ধরত। বাদুড়ের ডানার চামড়ায় বঁড়শি গেঁথে যেত। তাই বলে আমি কোনও দিন বাদুড়ের মাংস খেয়ে দেখিনি। তবে বাদুড়ের হাড় ফোটানো তেল বাড়ি নিয়ে আসতাম। ব্যথায় বেশ কাজ দেয়। এই সবের ফাঁকেই কখন স্কুল পেরিয়ে গেলাম, বুঝতেই পারলাম না। এবার একটু অন্য কথায় যাব।

আমরা যখন মাঠে বিকেলে ফুটবল খেলতাম, তখন দূরে কবাডি খেলত মুনিয়া, নাচনী, বিজলি। এরা সব আদিবাসী গ্রামেরই মেয়ে। এই বিজলি আবার বিরজুর বোন। ওদের বাবা বীরসা মুণ্ডা হল আদিবাসীদের সর্দার। বিজলির শরীর ছিল কালো পাথরের মতো। যত বড়ো হতে লাগল, মনে হল যেন কোনও ভাস্কর ছেনি হাতুড়ি দিয়ে ওকে কেটে কেটে নির্মাণ করছে। কষ্টিপাথরের মূর্তির মতো। গোধূলির আবির মাখা আকাশে যখন সূর্যটা কপালের লাল টিপের মতো হয়ে যেত, পাহাড়ের কালো ছায়া এগিয়ে আসত ওদের গ্রামে। কিন্তু ভুট্টা খেতটা তখনও সোনালি বাগিচা। ঠিক যেন কানে মাকড়ি, নাকে নোলক আর হলুদ ফ্রক পরা বিজলি।

আমি এখনও যেন বিজলিকে দেখতে পাই বউবাজারের সোনার দোকানে। কাচের শো-কেসের ভেতর। কালো পাথরের গয়না পরা আবক্ষ মূর্তি, ঠিক যেন বিজলি! এখনও মনে হয় সেই দোলের দিনের আবির মাখানোর আবদার কাচ ভেঙে পূরণ করে দিই। সে এক আমার জীবনের উথালপাথাল ঘটনা। আজও মনে পড়ে সেই দোলের দিনের কথা। মানে ওরা যাকে বলত ‘ফাগুয়া’।

ক্রমশ…

 

মণিদা আমি এলাম (শেষ পর্ব)

শেষ পর্ব

অমরেশ অবশ্য থাকে সব সময়ই ওর হাতের নাগালে। ওকে কাল থেকেই কাজে শামিল করে নিতে হবে। এমনিতেই অমরেশ তিওয়ারি পত্রিকার কার্যনির্বাহী সহ-সম্পাদক৷ কাজেই কোনও সমস্যা নেই। কালই স্ক্রিপ্টগুলো ডিটিপি-র জন্য অমরেশকে দিয়ে বাবুলের কাছে পাঠিয়ে দেবে। বাবুল-ই ওদের সমস্ত ডিটিপি করে থাকে। ও জানে কীভাবে কী করতে হয় এবং মোটামুটি ঠিকঠাকই করে। এখন দেখা যাক সকালে অমরেশ কখন হাজির হয়।

বেলা দশটা নাগাদ অমরেশ এল। করিতকর্মা ছেলে। ব্যাটার খরচের হাতটা একটু বেশি, তবে নিজের পকেট বাদ দিয়ে। মণি ওটা দেখেও দেখে না। কারণ জানে কিছু কিছু জিনিস মেনে নিতে হয়। কাল ও বাবুলকে ভালো করে বুঝিয়ে দেবে। বাবুলকে কাজে লাগিয়ে তবেই ফিরবে। প্রায় সারাদিন ওখানেই কাটাবে। চা টিফিন দুপুরের খাবার সব মণির পকেট থেকে যাবে। কিন্তু কাজ দিয়ে নিশ্চিন্ত। ফেরার সময় কাজের কতটা কী হল জানিয়ে যাবে। সারাদিনের রাহা ও খাই খরচটুকুও চেয়ে নেবে। ভালো ছেলে। কথা শোনে। মোটামুটি মাসখানেক লাগবে বলেছে ডিটিপি হাতে পেতে। অবশ্য যেমন যেমন শেষ হবে এক এক করে কবি লেখকদের কাছে পৌঁছে যাবে প্রুফ দেখার জন্য। ফাইনাল হলে প্রেসে যাবে।

বাঁকুড়া আর সিউড়ির দু’টো প্রুফ ক্যুরিয়ারে পাঠাবে, ওরাও আবার প্রুফ দেখে রিটার্ন ক্যুরিয়ারে মণির কাছে পাঠিয়ে দেবে। কাছেপিঠের পাঁচজনের কাছে তো মণি নিজেই যাবে আবার নিয়েও আসবে, বলাই বাহুল্য। মানে দশদিনের জন্য চা টিফিন দুপুরের খাওয়া দাওয়া ফ্রি — ভাবা যায়! মণির মনে এখন যেন কোটি টাকার লটারি পাওয়ার আনন্দ, ডগমগ করে ফুটছে। এবার তো পোয়াবারো কারণ সাত সাতখানা বইয়ের প্রত্যেক কবি লেখকরা তাদের মণিদাকেই উৎসর্গ করছে। মণির আলতো অনিচ্ছা — এই এটা আবার আমাকে কেন আমাকে কেন…! ধোপে টেকেনি। কিন্তু মনে মনে ভীষণ খুশি।

সময় তো নয় যেন ভরা বর্ষার জলস্রোতের দামোদর। হু হু করে বয়ে যাচ্ছে। দেখতে দেখতে অমরেশ তিওয়ারির তাগাদার পাল্লায় পড়ে পঁচিশে বৈশাখের দিন পনেরো আগেই সব বই এখন মণির জিম্মায়। মণি দেখে নিয়েছে প্রোডাকশন লা জবাব! প্রত্যেক লেখক কবিকে একটা করে কপি পাঠিয়ে দিয়েছে। মলাট উন্মোচনের পর বাকি কপিগুলো হ্যান্ডওভার করবে। কিন্তু মণির কড়া শর্ত অন্তত ওই সাতজন কবি লেখকদের প্রত্যেককেই যুগলে উপস্থিত থাকতে হবে। কেউ না করেনি, সবাই সম্মতি জানিয়েছে একবাক্যে। মণির উত্তেজনা প্রত্যেক দিন একটু একটু তুঙ্গে উঠছে পঁচিশে বৈশাখ যত এগিয়ে আসছে। অবশ্য অমরেশ সব সময়ই আছে ওর ছায়াসঙ্গী হয়ে। এটাই যা রক্ষে। পেমেন্ট থেকে টাকা পয়সার হিসাব রাখা ব্যস্থাপনার সিংহভাগ অমরেশের নিয়ন্ত্রণে। যদিও মণির ডেরা থেকেই ঘটছে সবটাই এবং অবশ্যই তার সম্মতিক্রমে।

পঁচিশে বৈখাশ মঞ্চের উপরে সাজানো চেয়ার টেবিল। রবি ঠাকুরের একটা বড়ো বাঁধানো ছবি। ফুলমালা ধূপধুনো প্রদীপের সমারোহে। রবীন্দ্রগান দিয়েই সভার উদ্বোধন। তারপর রবীন্দ্র কবিতা আবৃত্তি ছোটো বড়ো সকলের জন্য। আজকের সভার প্রথম চমক ছিল মঞ্চের উপরে — যেখানে সব নতুন কবি লেখকরা সভা আলোকিত করলেন। না কোনও কেউকেটা নেই। মণি এখন তিতিবিরক্ত হয়ে গেছে কেউকেটাদেরকে সামাল দিতে দিতে। ব্যাটাদের হাজার বাহানা। তার ওপর পান থেকে চুন খসার যো নাই। এই মারে কি সেই মারে। বিরুদ্ধতায় নেমে পড়বে গালিগালাজ করতে করতে। পরিবর্তিত সময়ের প্রয়োজনে মণি এখন তাই নতুনদের উপরই ভরসা রাখছে। উপস্থিত সমবেতের অনেকেরই চোখে মুখে জিজ্ঞাসা উপচে পড়ছে — বইগুলোর মলাট উন্মোচন কারা করবেন? সে রকম কাউকেই তো চোখে পড়ছে না। মণি মুচকি হেসেছে। সময়ে জানতে পারবে। একটু সবুর করো না ভাই, আছো তো এখন! অত তাড়া কিসের?

এবার মলাট উন্মোচনের সময়। মণি মাইক হাতে একে একে মঞ্চে ডেকে নিলেন অজানা পাঁচজন পুরুষ ও দু’জন মহিলাকে৷ দর্শক তো অবাক। আরে এরা কারা? এদেরকে তো আগে কখনও কোনও সভায় দেখিনি, নাম শোনা তো দূরের কথা।

মণি আবেগপ্লুত গলায় বলতে শুরু করল— জানি আপনাদের এখন অনেক প্রশ্ন, মঞ্চে উপবিষ্ট এই সাতজন যারা আজ মলাট উন্মোচন করবেন। তবে শুনুন, এনারা সেই মানুষজন যাদের প্রতিদিনের যাপনের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে এক একজন কবি লেখকের উত্থানকথা। এদের সক্রিয় ও হার্দিক সহযোগিতা ছাড়া উদীয়মান এই সাতজন কবি সাহিত্যিকের চর্চার খবর আমরা কোনওদিনই জানতে পারতাম না। আজকের এই মঞ্চ যে আলোকিত, এ তাদেরই অমূল্য অবদান ধন্য। আহা, হাততালির কলরবে ফাটাফাটি সভাগৃহ! উপচে ওঠা উচ্ছ্বাস সভাস্থলের বাইরেও মুখরিত।

মণি প্রথমেই তনুকে ডেকে নিল মঞ্চে। তারপর সদর্পে ঘোষণা করল বইটির মলাট উন্মোচনের জন্য উপস্থিত, মাননীয় অনুপম নাগরাজ মহাশয় যিনি কবির হাজব্যান্ড, সাহিত্যপ্রেমী এবং সরকারি সংস্থার একজন উচ্চপদস্থ সফল আধিকারিক। আবার হাততালির রোল উঠল। মোবাইল ক্যামেরা ঝলসে উঠল, ভিডিও হল। বাপরে বাপ! অনুপম মনে মনে ভাবল — কে জানে শালা, সে যে এত কিছু সে কি নিজেই জানত নাকি কোনওদিন। মণি ঘোষাল মালটা তো খতরনাক আছে!

যাইহোক, তারপর একই ভাবে একে একে বাকি ছ’খানা বইয়েরও মলাট উন্মোচন হয়ে গেল। অমরেশ মঞ্চে উঠে উপস্থিত সকলকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে সভা সমাপ্তির ঘোষণা এবং একটু চা পান করে যাবার আমন্ত্রণ রাখল সবার কাছে।

মণি বাড়ি ফিরে এসে— আহা, লাখ দুয়েক টাকার ওমটা একটু স্পর্শ করে নেবার জন্যে তালা খুলে, বাক্সের ভিতর একদম ফাঁকা দেখে মাথায় হাত দিয়ে মাটিতে বসে পড়ল ধপাস করে।

কিছুক্ষণ পর একটু ধাতস্থ হলে ফোন করে অমরেশকে এক্ষুনি একবার জলদি আসতে বলল। কেন জিজ্ঞেস করাতে বিরক্ত হয়ে বলেছে— আসতে বলছি আয় না, অত কেন কিসের? আর এলেই তো জানতে পারবি। যত্তসব…

কয়েক মিনিটের মধ্যে অমরেশ হাজির। মণির দুঃখের কথা শুনে অমরেশের আর বলা কিংবা করারই বা কী আছে! নিশ্চুপ কয়েকটা সেকেন্ড কাটিয়ে, পিঁপড়েতে খেয়েছে বলে স্বগতোক্তি করতেই মণি বলল, “তুই কি কিছু বললি?”

—না না, পিছন ফিরে চলে যেতে যেতে অমরেশ বলল, মণিদা আমি এলাম। ভালো থেকো।

 

 

মণিদা আমি এলাম (পর্ব-৩)

পর্ব ৩

বাড়ি ফিরেই তনু ওর মণিদাকে ফোন করে জব্বর খরটা দিল। মণি তো আত্মহারা! লাফ দিয়ে বিছানা থেকে নামতে গিয়ে পা মচকে ফেলার জোগাড়। ভাবা যায় কড়কড়ে আড়াই লাখ জাস্ট আড়াই লাখ। খরচ খরচা বাদ দিয়ে আরামসে দেড় থেকে যাবে পকেটে। এত বড়ো দাঁও ওর জীবনে এই প্রথম।

—আরে মণিদা, কী হল শুনতে পাচ্ছ?

—হ্যাঁ হ্যাঁ বলো বলো….। হ্যাঁ নিশ্চয় নিয়ে আসবে সামনের রোববার। দেখবে ওদের যেন কোনও অসুবিধা না হয়। আর সঙ্গে করে ওরা যেন অবশ্যই নিজের নিজের লেখার স্ক্রিপ্টগুলো নিয়ে আসে। ওখান থেকেই ওরা কবিতা পাঠ করবে সাহিত্যবাসরে। আচ্ছা আচ্ছা ঠিক আছে রাখো। দেখা হবে। বাই।

কোমর থেকে আলগা হয়ে ঝুলে পড়া লুঙ্গিটার, অবস্থা মণি এতক্ষণ খেয়াল করেনি। ভাগ্যিস ঘরে একলা ছিল। একহাত জিভ কেটে মণি যথাস্থানে বেশ শক্ত করে লুঙ্গিটাকে বেঁধে নিল। অনেক দিন চিকেন খাওয়া হয়নি। মণি বাজারের থলি হাতে, গায়ে কোনওরকমে একটা ফতুয়া গলিয়ে হাওয়াই চটি ফটফট করতে করতে দ্রুত বেরিয়ে গেল।

রাতে অনেক দিন পর ভরপেট মুখরোচক খাবার খেয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তুলে সিগারেটে লম্বা একটা টান— আহা কী আনন্দ! সামনের সুখের দিনগুলোর কথা ভেবে মশগুল হয়ে রইল বেশ কিছুক্ষণ। তাহলে ভগবান এতদিনে মুখ তুলে চেয়েছেন। এখন শুধুই সুদিন আর সুদিন। সামনে শুধু আলো আর আলো। ‘তমসো মা জ্যোতির্গময়’– যাকে বলে! তবে আনন্দের আতিশয্যে সেই রাতটি তার নির্ঘুম গেল। তা যাক। এরকম নির্ঘুম এই রাত তার একটা অমূল্য অর্জন বলেই সে ভেবে নিল।

সারাজীবন এইরকম নির্ঘুম কেটে গেলেও তার আপত্তি নেই এখন। কত হেনস্থা, কত কটূক্তি, যাচ্ছেতাই অপমান— কত কিছুই যে তাকে হজম করতে হয়েছে। তার স্বপ্ন এই ‘আসানসোলের দিনরাত্তির’-র প্রকাশনা নিয়মিত রাখতে গিয়ে, তা তার চাইতে আর বেশি কে জানে!

বিজ্ঞাপন চাইতে গেলে দেবে তো না-ই উলটে আঁকাবাঁকা কত কথা শোনাবে। পত্রিকা কেউ কিনবে না। তার ওপর সৌজন্য সংখ্যা পাঠাতে হবে। ভালো লেখক কবিরা সাম্মানিক না দিলে লেখা দেবে না। আবার ভালো লেখা না থাকলে পত্রিকা বিক্রি হবে না। স্টলওয়ালারা বেশি কমিশন না পেলে বিক্রির জন্য স্টলেই রাখবে না। এত ‘না’ হলে কি আর পত্রিকা চালানো যায়! তবে এখন থেকে আর এই ক্রাইসিস থাকবে বলে মনে হয় না। জয় মা কালী দুগ্গা দুগ্গা।

পরের রোববার তনু-সহ পাঁচ বন্ধুই হাজির যথাসময়ে মণির সভা আলো করে। ওরা এক্কেবারে সামনের সারিতে। সাড়ে এগারোটা নাগাদ মণি হাতে মাইক তুলে নিয়ে সদর্প ঘোষণায় নতুন চার সদস্যের, মানে রূপা গোপা সীমা ও মণিকার উজ্জ্বল উপস্থিতি বরণ করে নিল। তারা প্রত্যেকেই মঞ্চে উঠে নিজের নিজের সংক্ষিপ্ত পরিচয় জ্ঞাপন করল।

মণি এরপর ভবিষ্যতের সাহিত্যের গতিপ্রকৃতির দিকনির্দেশ করার ক্ষেত্রে লিটল ম্যাগের অবদান সম্পর্কে একটা ভয়ানক জ্বালাময়ী বক্তিমে ঝাড়ল প্রায় আধঘণ্টার মতন। সভাস্থল ঘিরে তখন হুলুস্থুলু ভাবে হাততালির হুল্লোড়! কেউ কেউ আবার বলে উঠল, আহা, এই না হলে সম্পাদক! কী ভীষণ একখানা লেকচার দিল বটে!

তনু গোপা সীমা-রা তো অভিভূত। ওরা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করছিল যে মণিদার সাহিত্যসভায় ওদের অনেক আগেই জয়েন করা উচিত ছিল। যাক যা হবার তা হয়েছে। এখান থেকেই না হয় শুরু হল আজ। ওরা পাঁচজনের প্রত্যেকেই পাঁচটি করে স্বরচিত কবিতা পাঠ করে খুব খুশি। মণিদাও ওদের সকলের লেখার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছে। আনন্দে ডগমগ ওরা যেন হাতে এক একখানা করে আকাশের চাঁদ পেয়ে গেছে!

অনুষ্ঠান শেষে মণি ঘোষাল স্ক্রিপ্টগুলো চাইলে ওরা খুব কুণ্ঠিত হয়ে বলল— কয়েকটা দিন সময় চাই। লেখাগুলো একটু গুছিয়ে নিতে হবে। উলটো পালটা হয়ে আছে। কমপ্লিট হলেই আপনাকে খবর দেব। মণি বলল— আচ্ছা আচ্ছা ঠিক আছে। খবর পেলেই আমি নিজে গিয়ে নিয়ে আসব। তোমাদেরকে আসতে হবে না কেমন। চাপ নিও না তোমরা যতক্ষণ আমি আছি। আর আমি তো আছিই আছি।

মোটামুটি সপ্তাহ দু’য়েকের ভিতর মণি আলাদা আলাদা দিনে ওদের সবার বাড়ি বাড়ি গিয়ে স্ক্রিপ্ট সংগ্রহ করে গান্ডেপিন্ডে গেলাকোটা সেরে, তারপর সন্ধেনাগাদ ফিরে এসেছে। সাথে পঁচিশ পঁচিশ করে অগ্রিম নিতেও ভুল করেনি। মণি বাড়ি ফিরে অন্ধকার একটু গভীর হলে বিড়ি ফুঁকতে ফুঁকতে সোজা ছাদে। আকাশের তারাদের দিকে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে গুন গুন করে ‘ও আমার ময়না রে…’ গাইতে গিয়ে তালেগোলে গেয়ে উঠল— ‘ও আমার সোনার ডিম পাড়া হাঁস ৱে এএএ…..!’

যখন একটি দু’টি তারা খসে পড়ল ঠিক পায়ের পাশটিতে। তারার আলো যে এত তরল হয় সে আগে জানত না। পা-টা কেমন যেন একটু হালকা ভিজে মতন বোধ হতেই তার মোহাচ্ছন্ন ভাবের ঘোরটা যাকে বলে এক্কেবারে ঘেঁটে ‘ঘ’ হয়ে গেল।

সিউড়ি আর বাঁকুড়ার দু’টো নিয়ে মোট সাত সাতখানা বইয়ের ডিটিপি এবং প্রিন্টিং-এর কাজে নেমে পড়তে হবে কাল থেকেই। প্রেসের সঙ্গে কথা হয়ে গেছে। ডিটিপিও হয়ে যাবে, তারপর প্রুফ দেখা। প্রচ্ছদ সাতটা তো আগেই এসে গেছে। করেছেন প্রখ্যাত কিন্তু নিতান্ত প্রচারবিমুখ শিল্পী মণির অন্তরঙ্গ একদা শান্তিনিকেতনি আপাতত কলকাতাস্থিত ব্যাংক ম্যানেজার শুক্রাচার্য সান্যাল।

ক্রমশ…

 

পড়ার জন্য সীমাহীন গল্প-নিবন্ধসাবস্ক্রাইব