মণিদা আমি এলাম (শেষ পর্ব)

শেষ পর্ব

অমরেশ অবশ্য থাকে সব সময়ই ওর হাতের নাগালে। ওকে কাল থেকেই কাজে শামিল করে নিতে হবে। এমনিতেই অমরেশ তিওয়ারি পত্রিকার কার্যনির্বাহী সহ-সম্পাদক৷ কাজেই কোনও সমস্যা নেই। কালই স্ক্রিপ্টগুলো ডিটিপি-র জন্য অমরেশকে দিয়ে বাবুলের কাছে পাঠিয়ে দেবে। বাবুল-ই ওদের সমস্ত ডিটিপি করে থাকে। ও জানে কীভাবে কী করতে হয় এবং মোটামুটি ঠিকঠাকই করে। এখন দেখা যাক সকালে অমরেশ কখন হাজির হয়।

বেলা দশটা নাগাদ অমরেশ এল। করিতকর্মা ছেলে। ব্যাটার খরচের হাতটা একটু বেশি, তবে নিজের পকেট বাদ দিয়ে। মণি ওটা দেখেও দেখে না। কারণ জানে কিছু কিছু জিনিস মেনে নিতে হয়। কাল ও বাবুলকে ভালো করে বুঝিয়ে দেবে। বাবুলকে কাজে লাগিয়ে তবেই ফিরবে। প্রায় সারাদিন ওখানেই কাটাবে। চা টিফিন দুপুরের খাবার সব মণির পকেট থেকে যাবে। কিন্তু কাজ দিয়ে নিশ্চিন্ত। ফেরার সময় কাজের কতটা কী হল জানিয়ে যাবে। সারাদিনের রাহা ও খাই খরচটুকুও চেয়ে নেবে। ভালো ছেলে। কথা শোনে। মোটামুটি মাসখানেক লাগবে বলেছে ডিটিপি হাতে পেতে। অবশ্য যেমন যেমন শেষ হবে এক এক করে কবি লেখকদের কাছে পৌঁছে যাবে প্রুফ দেখার জন্য। ফাইনাল হলে প্রেসে যাবে।

বাঁকুড়া আর সিউড়ির দু’টো প্রুফ ক্যুরিয়ারে পাঠাবে, ওরাও আবার প্রুফ দেখে রিটার্ন ক্যুরিয়ারে মণির কাছে পাঠিয়ে দেবে। কাছেপিঠের পাঁচজনের কাছে তো মণি নিজেই যাবে আবার নিয়েও আসবে, বলাই বাহুল্য। মানে দশদিনের জন্য চা টিফিন দুপুরের খাওয়া দাওয়া ফ্রি — ভাবা যায়! মণির মনে এখন যেন কোটি টাকার লটারি পাওয়ার আনন্দ, ডগমগ করে ফুটছে। এবার তো পোয়াবারো কারণ সাত সাতখানা বইয়ের প্রত্যেক কবি লেখকরা তাদের মণিদাকেই উৎসর্গ করছে। মণির আলতো অনিচ্ছা — এই এটা আবার আমাকে কেন আমাকে কেন…! ধোপে টেকেনি। কিন্তু মনে মনে ভীষণ খুশি।

সময় তো নয় যেন ভরা বর্ষার জলস্রোতের দামোদর। হু হু করে বয়ে যাচ্ছে। দেখতে দেখতে অমরেশ তিওয়ারির তাগাদার পাল্লায় পড়ে পঁচিশে বৈশাখের দিন পনেরো আগেই সব বই এখন মণির জিম্মায়। মণি দেখে নিয়েছে প্রোডাকশন লা জবাব! প্রত্যেক লেখক কবিকে একটা করে কপি পাঠিয়ে দিয়েছে। মলাট উন্মোচনের পর বাকি কপিগুলো হ্যান্ডওভার করবে। কিন্তু মণির কড়া শর্ত অন্তত ওই সাতজন কবি লেখকদের প্রত্যেককেই যুগলে উপস্থিত থাকতে হবে। কেউ না করেনি, সবাই সম্মতি জানিয়েছে একবাক্যে। মণির উত্তেজনা প্রত্যেক দিন একটু একটু তুঙ্গে উঠছে পঁচিশে বৈশাখ যত এগিয়ে আসছে। অবশ্য অমরেশ সব সময়ই আছে ওর ছায়াসঙ্গী হয়ে। এটাই যা রক্ষে। পেমেন্ট থেকে টাকা পয়সার হিসাব রাখা ব্যস্থাপনার সিংহভাগ অমরেশের নিয়ন্ত্রণে। যদিও মণির ডেরা থেকেই ঘটছে সবটাই এবং অবশ্যই তার সম্মতিক্রমে।

পঁচিশে বৈখাশ মঞ্চের উপরে সাজানো চেয়ার টেবিল। রবি ঠাকুরের একটা বড়ো বাঁধানো ছবি। ফুলমালা ধূপধুনো প্রদীপের সমারোহে। রবীন্দ্রগান দিয়েই সভার উদ্বোধন। তারপর রবীন্দ্র কবিতা আবৃত্তি ছোটো বড়ো সকলের জন্য। আজকের সভার প্রথম চমক ছিল মঞ্চের উপরে — যেখানে সব নতুন কবি লেখকরা সভা আলোকিত করলেন। না কোনও কেউকেটা নেই। মণি এখন তিতিবিরক্ত হয়ে গেছে কেউকেটাদেরকে সামাল দিতে দিতে। ব্যাটাদের হাজার বাহানা। তার ওপর পান থেকে চুন খসার যো নাই। এই মারে কি সেই মারে। বিরুদ্ধতায় নেমে পড়বে গালিগালাজ করতে করতে। পরিবর্তিত সময়ের প্রয়োজনে মণি এখন তাই নতুনদের উপরই ভরসা রাখছে। উপস্থিত সমবেতের অনেকেরই চোখে মুখে জিজ্ঞাসা উপচে পড়ছে — বইগুলোর মলাট উন্মোচন কারা করবেন? সে রকম কাউকেই তো চোখে পড়ছে না। মণি মুচকি হেসেছে। সময়ে জানতে পারবে। একটু সবুর করো না ভাই, আছো তো এখন! অত তাড়া কিসের?

এবার মলাট উন্মোচনের সময়। মণি মাইক হাতে একে একে মঞ্চে ডেকে নিলেন অজানা পাঁচজন পুরুষ ও দু’জন মহিলাকে৷ দর্শক তো অবাক। আরে এরা কারা? এদেরকে তো আগে কখনও কোনও সভায় দেখিনি, নাম শোনা তো দূরের কথা।

মণি আবেগপ্লুত গলায় বলতে শুরু করল— জানি আপনাদের এখন অনেক প্রশ্ন, মঞ্চে উপবিষ্ট এই সাতজন যারা আজ মলাট উন্মোচন করবেন। তবে শুনুন, এনারা সেই মানুষজন যাদের প্রতিদিনের যাপনের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে এক একজন কবি লেখকের উত্থানকথা। এদের সক্রিয় ও হার্দিক সহযোগিতা ছাড়া উদীয়মান এই সাতজন কবি সাহিত্যিকের চর্চার খবর আমরা কোনওদিনই জানতে পারতাম না। আজকের এই মঞ্চ যে আলোকিত, এ তাদেরই অমূল্য অবদান ধন্য। আহা, হাততালির কলরবে ফাটাফাটি সভাগৃহ! উপচে ওঠা উচ্ছ্বাস সভাস্থলের বাইরেও মুখরিত।

মণি প্রথমেই তনুকে ডেকে নিল মঞ্চে। তারপর সদর্পে ঘোষণা করল বইটির মলাট উন্মোচনের জন্য উপস্থিত, মাননীয় অনুপম নাগরাজ মহাশয় যিনি কবির হাজব্যান্ড, সাহিত্যপ্রেমী এবং সরকারি সংস্থার একজন উচ্চপদস্থ সফল আধিকারিক। আবার হাততালির রোল উঠল। মোবাইল ক্যামেরা ঝলসে উঠল, ভিডিও হল। বাপরে বাপ! অনুপম মনে মনে ভাবল — কে জানে শালা, সে যে এত কিছু সে কি নিজেই জানত নাকি কোনওদিন। মণি ঘোষাল মালটা তো খতরনাক আছে!

যাইহোক, তারপর একই ভাবে একে একে বাকি ছ’খানা বইয়েরও মলাট উন্মোচন হয়ে গেল। অমরেশ মঞ্চে উঠে উপস্থিত সকলকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে সভা সমাপ্তির ঘোষণা এবং একটু চা পান করে যাবার আমন্ত্রণ রাখল সবার কাছে।

মণি বাড়ি ফিরে এসে— আহা, লাখ দুয়েক টাকার ওমটা একটু স্পর্শ করে নেবার জন্যে তালা খুলে, বাক্সের ভিতর একদম ফাঁকা দেখে মাথায় হাত দিয়ে মাটিতে বসে পড়ল ধপাস করে।

কিছুক্ষণ পর একটু ধাতস্থ হলে ফোন করে অমরেশকে এক্ষুনি একবার জলদি আসতে বলল। কেন জিজ্ঞেস করাতে বিরক্ত হয়ে বলেছে— আসতে বলছি আয় না, অত কেন কিসের? আর এলেই তো জানতে পারবি। যত্তসব…

কয়েক মিনিটের মধ্যে অমরেশ হাজির। মণির দুঃখের কথা শুনে অমরেশের আর বলা কিংবা করারই বা কী আছে! নিশ্চুপ কয়েকটা সেকেন্ড কাটিয়ে, পিঁপড়েতে খেয়েছে বলে স্বগতোক্তি করতেই মণি বলল, “তুই কি কিছু বললি?”

—না না, পিছন ফিরে চলে যেতে যেতে অমরেশ বলল, মণিদা আমি এলাম। ভালো থেকো।

 

 

মণিদা আমি এলাম (পর্ব-৩)

পর্ব ৩

বাড়ি ফিরেই তনু ওর মণিদাকে ফোন করে জব্বর খরটা দিল। মণি তো আত্মহারা! লাফ দিয়ে বিছানা থেকে নামতে গিয়ে পা মচকে ফেলার জোগাড়। ভাবা যায় কড়কড়ে আড়াই লাখ জাস্ট আড়াই লাখ। খরচ খরচা বাদ দিয়ে আরামসে দেড় থেকে যাবে পকেটে। এত বড়ো দাঁও ওর জীবনে এই প্রথম।

—আরে মণিদা, কী হল শুনতে পাচ্ছ?

—হ্যাঁ হ্যাঁ বলো বলো….। হ্যাঁ নিশ্চয় নিয়ে আসবে সামনের রোববার। দেখবে ওদের যেন কোনও অসুবিধা না হয়। আর সঙ্গে করে ওরা যেন অবশ্যই নিজের নিজের লেখার স্ক্রিপ্টগুলো নিয়ে আসে। ওখান থেকেই ওরা কবিতা পাঠ করবে সাহিত্যবাসরে। আচ্ছা আচ্ছা ঠিক আছে রাখো। দেখা হবে। বাই।

কোমর থেকে আলগা হয়ে ঝুলে পড়া লুঙ্গিটার, অবস্থা মণি এতক্ষণ খেয়াল করেনি। ভাগ্যিস ঘরে একলা ছিল। একহাত জিভ কেটে মণি যথাস্থানে বেশ শক্ত করে লুঙ্গিটাকে বেঁধে নিল। অনেক দিন চিকেন খাওয়া হয়নি। মণি বাজারের থলি হাতে, গায়ে কোনওরকমে একটা ফতুয়া গলিয়ে হাওয়াই চটি ফটফট করতে করতে দ্রুত বেরিয়ে গেল।

রাতে অনেক দিন পর ভরপেট মুখরোচক খাবার খেয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তুলে সিগারেটে লম্বা একটা টান— আহা কী আনন্দ! সামনের সুখের দিনগুলোর কথা ভেবে মশগুল হয়ে রইল বেশ কিছুক্ষণ। তাহলে ভগবান এতদিনে মুখ তুলে চেয়েছেন। এখন শুধুই সুদিন আর সুদিন। সামনে শুধু আলো আর আলো। ‘তমসো মা জ্যোতির্গময়’– যাকে বলে! তবে আনন্দের আতিশয্যে সেই রাতটি তার নির্ঘুম গেল। তা যাক। এরকম নির্ঘুম এই রাত তার একটা অমূল্য অর্জন বলেই সে ভেবে নিল।

সারাজীবন এইরকম নির্ঘুম কেটে গেলেও তার আপত্তি নেই এখন। কত হেনস্থা, কত কটূক্তি, যাচ্ছেতাই অপমান— কত কিছুই যে তাকে হজম করতে হয়েছে। তার স্বপ্ন এই ‘আসানসোলের দিনরাত্তির’-র প্রকাশনা নিয়মিত রাখতে গিয়ে, তা তার চাইতে আর বেশি কে জানে!

বিজ্ঞাপন চাইতে গেলে দেবে তো না-ই উলটে আঁকাবাঁকা কত কথা শোনাবে। পত্রিকা কেউ কিনবে না। তার ওপর সৌজন্য সংখ্যা পাঠাতে হবে। ভালো লেখক কবিরা সাম্মানিক না দিলে লেখা দেবে না। আবার ভালো লেখা না থাকলে পত্রিকা বিক্রি হবে না। স্টলওয়ালারা বেশি কমিশন না পেলে বিক্রির জন্য স্টলেই রাখবে না। এত ‘না’ হলে কি আর পত্রিকা চালানো যায়! তবে এখন থেকে আর এই ক্রাইসিস থাকবে বলে মনে হয় না। জয় মা কালী দুগ্গা দুগ্গা।

পরের রোববার তনু-সহ পাঁচ বন্ধুই হাজির যথাসময়ে মণির সভা আলো করে। ওরা এক্কেবারে সামনের সারিতে। সাড়ে এগারোটা নাগাদ মণি হাতে মাইক তুলে নিয়ে সদর্প ঘোষণায় নতুন চার সদস্যের, মানে রূপা গোপা সীমা ও মণিকার উজ্জ্বল উপস্থিতি বরণ করে নিল। তারা প্রত্যেকেই মঞ্চে উঠে নিজের নিজের সংক্ষিপ্ত পরিচয় জ্ঞাপন করল।

মণি এরপর ভবিষ্যতের সাহিত্যের গতিপ্রকৃতির দিকনির্দেশ করার ক্ষেত্রে লিটল ম্যাগের অবদান সম্পর্কে একটা ভয়ানক জ্বালাময়ী বক্তিমে ঝাড়ল প্রায় আধঘণ্টার মতন। সভাস্থল ঘিরে তখন হুলুস্থুলু ভাবে হাততালির হুল্লোড়! কেউ কেউ আবার বলে উঠল, আহা, এই না হলে সম্পাদক! কী ভীষণ একখানা লেকচার দিল বটে!

তনু গোপা সীমা-রা তো অভিভূত। ওরা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করছিল যে মণিদার সাহিত্যসভায় ওদের অনেক আগেই জয়েন করা উচিত ছিল। যাক যা হবার তা হয়েছে। এখান থেকেই না হয় শুরু হল আজ। ওরা পাঁচজনের প্রত্যেকেই পাঁচটি করে স্বরচিত কবিতা পাঠ করে খুব খুশি। মণিদাও ওদের সকলের লেখার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছে। আনন্দে ডগমগ ওরা যেন হাতে এক একখানা করে আকাশের চাঁদ পেয়ে গেছে!

অনুষ্ঠান শেষে মণি ঘোষাল স্ক্রিপ্টগুলো চাইলে ওরা খুব কুণ্ঠিত হয়ে বলল— কয়েকটা দিন সময় চাই। লেখাগুলো একটু গুছিয়ে নিতে হবে। উলটো পালটা হয়ে আছে। কমপ্লিট হলেই আপনাকে খবর দেব। মণি বলল— আচ্ছা আচ্ছা ঠিক আছে। খবর পেলেই আমি নিজে গিয়ে নিয়ে আসব। তোমাদেরকে আসতে হবে না কেমন। চাপ নিও না তোমরা যতক্ষণ আমি আছি। আর আমি তো আছিই আছি।

মোটামুটি সপ্তাহ দু’য়েকের ভিতর মণি আলাদা আলাদা দিনে ওদের সবার বাড়ি বাড়ি গিয়ে স্ক্রিপ্ট সংগ্রহ করে গান্ডেপিন্ডে গেলাকোটা সেরে, তারপর সন্ধেনাগাদ ফিরে এসেছে। সাথে পঁচিশ পঁচিশ করে অগ্রিম নিতেও ভুল করেনি। মণি বাড়ি ফিরে অন্ধকার একটু গভীর হলে বিড়ি ফুঁকতে ফুঁকতে সোজা ছাদে। আকাশের তারাদের দিকে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে গুন গুন করে ‘ও আমার ময়না রে…’ গাইতে গিয়ে তালেগোলে গেয়ে উঠল— ‘ও আমার সোনার ডিম পাড়া হাঁস ৱে এএএ…..!’

যখন একটি দু’টি তারা খসে পড়ল ঠিক পায়ের পাশটিতে। তারার আলো যে এত তরল হয় সে আগে জানত না। পা-টা কেমন যেন একটু হালকা ভিজে মতন বোধ হতেই তার মোহাচ্ছন্ন ভাবের ঘোরটা যাকে বলে এক্কেবারে ঘেঁটে ‘ঘ’ হয়ে গেল।

সিউড়ি আর বাঁকুড়ার দু’টো নিয়ে মোট সাত সাতখানা বইয়ের ডিটিপি এবং প্রিন্টিং-এর কাজে নেমে পড়তে হবে কাল থেকেই। প্রেসের সঙ্গে কথা হয়ে গেছে। ডিটিপিও হয়ে যাবে, তারপর প্রুফ দেখা। প্রচ্ছদ সাতটা তো আগেই এসে গেছে। করেছেন প্রখ্যাত কিন্তু নিতান্ত প্রচারবিমুখ শিল্পী মণির অন্তরঙ্গ একদা শান্তিনিকেতনি আপাতত কলকাতাস্থিত ব্যাংক ম্যানেজার শুক্রাচার্য সান্যাল।

ক্রমশ…

 

মণিদা আমি এলাম (পর্ব-২)

পর্ব ২

মণি ঘোষাল গল্প কবিতার বাঘ-সিংহ-ভল্লুক সব একসাথে। কলম দিয়ে কলকল করে কাব্যি ছোটে ঝরনাধারার মতো। এককালে তার নাকি দুর্ধর্ষ এক গুরু সঙ্গ হয়েছিল। ওর মতো আর কেউ নাকি গুরুকে তেমন করে পায়নি। আর গুরুও মণি বলতে অজ্ঞান ছিল। তা সেই গুরুই একদিন সত্যি সত্যিই মণির একটা কবিতা পড়তে গিয়ে গোঁ গোঁ শব্দ করতে করতে মুখে লালা উঠে এই মরে কি, সেই মরে অবস্থা! অন্য যারা ছিল তারা গুরুকে হাসপাতালে গ্যারেজ করাতে কোনও মতে সে যাত্রা গুরুর পঞ্চত্বপ্রাপ্তি হয়নি।

তা মণি নাকি কবিতার কাটাছেঁড়ায় অদ্বিতীয়ম বলে মনে করে নিজেকে। এটাকে সে তার গুরুর দান বলেই ভাবে। কবিতার নাড়িভুঁড়ি ঘেঁটে সে তার পেটের কথা বার করে নিয়ে আসবে। হুঁ হুঁ বাবা কারওর নিস্তার নেই! বিটকেল হিংসুটে সতীর্থরা বলে— ও ব্যাটা নিজে কোনওদিন একটা সম্পূর্ণ কবিতা লিখতে পারেনি আজ পর্যন্ত। আর সে করে কিনা সমালোচনা! কালে কালে কতই হল, পুলি পিঠের ল্যাজ গজাল। যাইহোক, তা বলে সাহিত্যচর্চায় অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ সংবর্ধনা পাওয়াতে কোনও ঘাটতি ছিল না, আর এগুলো সে পেয়েছে ঠিক তারই মতন অন্যান্য সব সম্পাদকদের থেকে।

এখন নভেম্বর। হালকা শীতের আমেজ পোশাক চুঁইয়ে শরীর ছুঁয়ে দিচ্ছে শিরা উপশিরা ছাড়িয়ে অন্তরে অন্তরে। সামনের এপ্রিল আসতে হাতে আর মাস পাঁচেক মতন। সামনের পঁচিশে বৈশাখে এবার অন্তত পাঁচখানা বই প্রকাশ করতেই হবে। তবে মলাট উন্মোচনে এবার এমন সব আনকমন এক একজন থাকবে না, যা দেখে সবাই চমকে (পড়ুন ঘাবড়ে যাবে! মণি ওর ফিল্ডের পাকা মাথার লোক। টিকে থাকতে হলে যা যা করার দরকার, সবই করে সাধ্যমতো এবং পরিকল্পনা মাফিক।

একটা নেটওয়ার্ক ভালো মতন তৈরি করেছে আশেপাশের দু’তিনটে জেলা জুড়ে। সেখানের বিভিন্ন অঞ্চলে এক একজন কবি সাহিত্যিক রিপ্রেজেন্টেটিভের কাজ করে। তারা নতুন লেখক জোগাড় করে, প্রকাশিত বই পুশসেল করে। মণি অবশ্য পরিশ্রম করে যথেষ্ট। ফোনে যোগাযোগ তো থাকেই তাছাড়াও মাঝেমধ্যে ওইসব জায়গায় গিয়ে সাহিত্যবাসরও বসায়। দরকার হলে এক আধদিন থেকেও যায় সেখানে। দূরের কবি সাহিত্যিকরাও মণির আসানসোলে আসে। বিশেষ করে ফেব্রুয়ারি মার্চ নাগাদ দু’দিন ব্যাপী চলা আসানসোল লিটলম্যাগের মেলাতে তো আসবেই আসবে। আপাতত তিনটে বইয়ের মেটেরিয়াল প্রায় হাতের মুঠোয়। এখানকার বলতে তনুরটা আর বাকি দু’টোর একটা সিউড়ি আর একটা বাঁকুড়ার। এর মধ্যে একটা ছোটোগল্পের সংকলন, অন্য দু’টি কবিতার।

ফেসবুকে লেখার সূত্রে এখন অনায়াসে অনেকের সুপ্ত প্রতিভা ফেটে বেরোতে পারছে জনসমক্ষে। মন্দ না। যেমন সেদিন দেখলাম একজন লিখেছেন— বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর নদেয় এলো বান/ আমার বর দেখতে এমন যেমন জাম্বুবান। অথবা, সেদিন গোধূলিবেলা/ তোমার রাঙা ঠোঁটে আমার ওষ্ঠ চকাম চকাম করিছে খেলা। ইত্যাদি ইত্যাদি।

মণি মূলত ফেসবুক ঘেঁটে এই জাতীয় কবি লেখকদেরকে ট্যাপ করে। প্রথমে মেসেঞ্জারে প্রশংসা তারপরে ফোন, তারপর সোজা কবির বাড়িতে হানা। মহিলা কবি হলে তো সোনায় সোহাগা। বরের সামনে বউ-কবির কবিতার ফাটিয়ে প্রশংসা। দুপুরে গান্ডেপিন্ডে খাওয়াদাওয়া তারপর একটা জম্পেশ ঘুম। বিকেলে স্ন্যাক্স সহযোগে চা সাঁটিয়ে খানকতক কবিতা ব্যাগে পুরে নিয়ে চলল মদন। তনুকে মণি এভাবেই কবি বানিয়েছে। তনু বলেছে ওর কয়েকজন বন্ধুও লেখালেখি করছে ফিলহাল। মণি বলেছে— তা ওদেরকেও পরের কবিতা পাঠের আসরে নিয়ে এসো না। তনু রাজি হয়েছে বলেছে, দেখি যোগাযোগ করে। আপনাকে জানাব। তনু, ওর বন্ধু মানে রূপা গোপা সীমা আর মণিকার সাথে ফোনে কথা বলেছে। ওরা খুবই আগ্রহী।

একদিন রোববার বিকেলে বিগবাজারে, ওদের সবার সঙ্গে সপরিবারে হঠাৎই দেখা হয়ে গেল। আর যায় কোথা! ওরা সবাই যে যার বরকে কেটে পড়তে বলল। তারপর সোজা চারতলার ফাঁকা একটা খাবার দোকানের একটি টেবিল দখল করে পাঁচটা ঠান্ডা পানীয় নিয়ে গল্পে মেতে উঠল।

বেচারা বরসকল একটা চায়ের দোকানে মাটির ভাঁড়ে চা আর মুখে সিগারেট নিয়ে হোস্টেল জীবনের স্মৃতিচারণে মিনিট কুড়ি পঁচিশ কাটিয়ে যে-যার মতন যাবার তোড়জোড় করছে, ঠিক তখনই তনুর বর বলল, ‘জানিস তো তনু লেখালেখি করছে। কিছু টাকা গচ্চা যাচ্ছে বটে তবে শালা মুক্তি পেয়েছি বলতে পারিস একরকম। কাজকম্ম নেই শুধু ভুলভাল বকত আর আমার মাথা চেটে সাফ করে দিত। এখন মাঝে মধ্যে দু’একটা আগডুম বাগডুম লেখা শুনে বাঃ বাঃ বলে দিলেই ছুটি।’

বাকিরাও সবাই বলল— বাব্বা তুমি একা নও আমরাও তোমার মতনই ওই একই পথের পথিক। তবে এখন আছি বিন্দাস কিন্তু বস! বেঁচে থাকুক ওদের সাহিত্য সংস্কৃতির চর্চা— তাতে যদি হয় হোক আমাদের খরচা। তনুর বর অনুপম বলল— আরিব্বাস বস তুমিও তো দেখছি কাব্যি করে কথা বলছ, কী ব্যাপার রূপার ছোঁয়া লেগেছে মনে হচ্ছে।

বিরূপাক্ষ প্রবল প্রতিবাদ জানিয়ে বলে উঠেছে— আরে না না… ওটা বাইচান্স মিলে গেছে, এই আর কি!

—আমি? তাও আবার কাব্যি! বাংলায় প্রায় ফেল মারতে মারতে পাশ করে গেছিলাম হায়ার সেকেন্ডারিতে কোনওরকমে।

এদিকে তনুদের আড্ডা জমে উঠেছে। তনু বলল— হ্যাঁরে তোদের চারজনের লেখা কবিতা আমি ফেসবুকে পড়েছি। তোরা কী ভালো লিখিস রে৷ ফেসবুক না থাকলে তো কোনওদিন জানতেই পারতাম না। এই শোন তোদেরকে না বলা হয়নি, জানিস তো আমার না একটা কবিতার বই বের হচ্ছে।

—ওহ তাই নাকি তাই নাকি। তা কবে?

—মণিদাই সব করছে। এই সামনের পঁচিশে বৈশাখ। শোন না মলাট উন্মোচনের দিন কিন্তু আমি তোদের সবাইকে অনুষ্ঠানে চাই।

রূপা বলল— আচ্ছা, দিদি কমপক্ষে কতগুলো কবিতা হলে একটা বই করা যেতে পারে?

—অতটা তো জানি না। তবে আমারটা করতে মণিদা সত্তর থেকে বাহাত্তরটা দরকার বলেছে। তা’ তুই বের করবি নাকি একটা?

—হ্যাঁ দিদি হতে পারে। আমার স্টকে এখনই প্রায় সত্তর আশিটা হয়ে যাবে।

—বলিস কী রে? তাহলে করে ফেল। মণিদাকে বলি ?

—দাঁড়াও। দু’টো দিন ভেবে নিই। তা খরচ খরচা কেমন গো?

—তেমন কিছু না। ওই পঞ্চাশ মতো সাকুল্যে!

গোপা সীমা মণিকাও ততক্ষণে জেগে উঠেছে। তাহলে তো অতগুলো কবিতা আমারও আছে। আমারও আছে করে কলকল করে উঠল ওরা সকলে।

তনু বলল— থাম থাম। ধীরে। এক কাজ কর তোরা। সামনের সপ্তাহে একটা সাহিত্যবাসর হচ্ছে। চল না তোরা। মণিদা এমনিতেই বলেছে আগ্রহী বন্ধুদেরকে নিয়ে যেতে। রেডি থাকিস বেলা এগারোটা নাগাদ আমি তোদের প্রত্যেককে বাড়ি থেকে তুলে নেব আমার গাড়িতে। তোদের সবাইকে আর আলাদা করে গাড়িতে যেতে হবে না। তাহলে ওই কথাই রইল। ততক্ষণে তো ওদের সবার মনে ওই যাকে বলে লাড্ডু ফুটতে আরম্ভ করেছে।

ক্রমশ…

মণিদা আমি এলাম (পর্ব ১)

মণি ঘোষাল। ইন্টেলেকচুয়াল। ছুঁচলো তার দাড়ি, অনেকটা আব্দুল মাঝির মতন। চোখে রিমলেস। ষাটোর্দ্ধ। টানটান আপাদমস্তক। ঠোঁট সতত একটা আলগা হাসির ক্লান্তিতে ঝুলন্ত। লম্বা চুলের মাথা সাহিত্যে খচাখচ। পায়ে কোলাপুরি। কাঁধে পত্রিকা ঠাঁসা শান্তিনিকেতনি ঝোলাব্যাগ। নীল জিনস-এর সাথে সাদা পাঞ্জাবি। সেই কোন বছর চল্লিশ আগে পথ চলা শুরু।

মণি তখন বছর কুড়ির উঠতি কবি সাহিত্যিক। দু’চারজন ঘনিষ্ঠকে সাথে নিয়ে প্রকাশ করল— ‘আসানসোলের দিনরাত্তির’ পত্রিকার প্রথম সংখ্যা। তখন তো তার বিশ্বজয়ের আনন্দ। দু’টো ছোটোগল্প আর খান চল্লিশেক কবিতার প্রশ্রয়কে সঙ্গী করে তার সদর্প আবির্ভাব আসানসোলের সাহিত্যজগৎকে আলোকময় করে তুলল।

তারপর তো দেখতে দেখতে বেশ কয়েকটা দশক কেটে গেছে। মণি ঘোষালের সোসিও—ইকনমিক ফান্ডাও নাকি বাড়তে বাড়তে এখন দারুণ শক্তিশালী! কিছুদিনের মধ্যেই বুঝে গেছিল পত্রিকা প্রকাশের সাথে সাথে বই প্রকাশনাটাও একান্ত জরুরি। পত্রিকা কুনকি হাতির কাজ করবে— যাতে করে বই প্রকাশনাটাও নিয়মিত থাকে৷ এইভাবেই মণি মূলত অর্থকরী দিকটা সামাল দেয়।

পত্রিকা নতুন নতুন কাব্য প্রতিভার সন্ধানের একটা ইন্সট্রুমেন্ট আর তারপর কিছু সময় অপেক্ষা এবং একদিন ঝপাং করে বই প্রকাশনার যাঁতাকলে পড়ে ছটপটাবে বেচারা কবি সাহিত্যিক কমপক্ষে হাজার পনেরোর ধাক্কায়! আর পায় কে? মণি তার মলাট উন্মোচনের জন্য পকেট কাটবে, তাকে সংবর্ধনা দেওয়ার জন্য পকেট কাটবে। পুশসেলের সব পয়সাই যে মণির পকেটস্থ হবে সেটা বলাই বাহুল্য। নামডাকে মণি কিন্তু বেশ তুখোড় পরিচিতির নিরিখে। নিন্দুকেরা সময় সময় তার সম্পর্কে মন্দভালো কিছু না কিছু বলেই থাকে। তাতে অবশ্য তার কিছু যায় আসে না। সে নাকি আদ্যোপান্ত নিবেদিত সুমহান এক সাহিত্য প্রাণ। অক্ষরকর্মী শব্দকর্মী এরকম নানা বিশেষণেই নাকি তার ঝুলি বিভূষিত।

লোকে পিছনে তাকে ‘মাল ঘোষাল’ বললে কী হবে, সামনে তো গদগদ ভাব দেখিয়ে দাঁত কেলিয়ে হে হে… করতে থাকে! মণি এটাও জানে লোকে ঈর্ষা থেকেই এইসব অপপ্রচার করে থাকে। যাইহোক, নেগেটিভ হলেও প্রচার তো একটা বটেই। লাদেনের নাম কে না জানে— সে যে- জন্যই হোক! জানে কি না? একশোবার হাজারবার অস্বীকার করে সাধ্যি কার? মণি তার প্রবল অস্তিত্বটার গোড়ায় নিয়মিত জল সার দিতে ভুল করে না কখনও। মাসে দু’তিনটে গল্প আলোচনা কবিতা পাঠের আসর জমাবেই জমাবে। দশ পনেরো জন তো এমনি এমনিই জুটে যায়। অবশ্য তাদের অধিকাংশই একদা চাকুরিজীবী বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত। সময় কাটাতে কবি সাহিত্যিক হতে গিয়ে মণির খপ্পরে।

কিংবা হয়তো একদা গৃহকর্মে নিপুণা এখন প্রৌঢ়ত্বে পা দিয়ে কবি কিংবা গল্পকার হয়ে ওঠার বাসনায় মণির ভেল্কিবাজি ধরতে না পেরে গল্পপাঠের আসরে দিস্তাখানেক কাগজ নিয়ে হাজির। মাঝবয়সিরা থাকে না এমন নয় তবে সংখ্যারলঘু পর্যায়ের। আর অবশ্যই অকর্মণ্য কিছু গ্র্যাজুয়েট, বাপের হোটেলে খেয়ে সাহিত্যের খোলনলচে পালটে তাকে উত্তর আধুনিকের পথ দেখানোর প্রতিজ্ঞায় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ কিছু দামড়া ছেলে। লিটল ম্যাগের মাহাত্ম্যে তার বিপ্লবী ইমেজ সম্পর্কে মাইক হাতে টানটান বক্তিমের জোরে হল ফাটানো হাততালি। ওরে বাপরে! শুনলে গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে শুধু নয়, সেই কাঁটা আবার ফুটেও যায়। সাথে মণির উস্কানির উত্তেজনা কামাল করে দেয় তাদের।

আঃ ভাবা যায়— ছোটোগল্পের কী দুর্দান্ত আলোচনাটাই না করলি রে অমরেশ। আর বোঝাতে গিয়ে তোর নিজের লেখা যে গল্পটা পড়ে শোনালি— তার জন্য কোনও তারিফই যথেষ্ট নয় রে! আয় আয় আমার বুকে আয়। একটা হামি দিইরে তোকে। আমার চাঁদের ছেলে আমার সোনার ছেলে। তারপরই গলাটা একপর্দা খাদে নামিয়ে বলে— বিমল করের মতো লেখকও তোর মতন এমন একটা লিখতে পারলে ধন্য হয়ে যেত রে। অমরেশ বিনয়ে মাটিতে মিশে যেতে বসেছে আর ভিতরে ভিতরে ফুলে ফেঁপে ঢোল— যে-কোনও সময় বিস্ফোরণের দিকে চলে যেতে পারে আপ খেতে খেতে। অমরেশ কিন্তু ফাটল না, যেহেতু আনকোরা নতুন নয়। তবে ফুলেফেঁপে থাকবেই এখন দিনকয়েক।

এবারের শারদসংখ্যায় তনু নাগরাজের গুচ্ছ কবিতা প্রকাশ করেছে মণি। তনু নাগরাজ বাড়িতে প্রায় সারাদিন একা। ছেলে বাইরে। বর একটা কোম্পানির ম্যানেজার। রান্নার লোক কাজের লোক বাগানের মালি ঠাকুর চাকর— কী নেই তার। নিজহাতে তাকে কুটোটি কেটে দু’টো করতে হয় না। বয়কাট চুল, তাও আবার আঁচড়ে দেওয়ার জন্য একটি মেয়ে আসে, তার পার্লারে যাওয়ার আগে ম্যামকে সাইজ করে দিয়ে যায়। তারপর সে তার লেডিস পার্লারের দোকান খোলে। আর সাহিত্যসভাতে গেলে তার তো আবার বিশেষ প্রস্তুতি থাকে, সেদিন সে মেয়ে তনু ম্যাডামকে একেবারে চিকনাই করে ছেড়ে দেয় ঘণ্টা দুয়েকের পরিচর্যায়।

মণির আদরের তনু কবিতাগুচ্ছ পাঠ করে শোনাল। মুগ্ধ হলঘর করতালি মুখরিত। মণি এবার তনুর একটা কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের কথা ভাবছে। পাঁচ ফর্মার করার প্ল্যান আছে। সত্তর বাহাত্তরটা কবিতা হলেই হবে। তা তনুর সংগ্রহে এখন ষাটটার মতন আছে। বলেছে সপ্তাহ দু’য়েক সময় পেলেই নাকি নামিয়ে ফেলবে। মণির আদেশ লেখা শেষ হলেই যেন তনু তাকে ফোন করে। কোনও কালক্ষেপ না, সাথে সাথেই ডিটিপি-র জন্য চলে যাবে যথাস্থানে।

মণি খরচখরচা বাবদ দু’টো ইনস্টলমেন্টে পঁচিশ পঁচিশ করে মোট পঞ্চাশ দিতে বলেছে। বাকিটা নাকি মণি বুঝে নেবে। নীচে কোথাও কোনও ফুটনোট নেই, কোনও শর্তাবলী নেই, এমনকী নেই কোনও হিডেন কস্ট-ও। ফার্স্ট অ্যান্ড ফাইনাল যাকে বলে। হাতি কা দাঁত মরদ কা বাত। এই হচ্ছে মণি ঘোষাল।

ক্রমশ…

বলিদান (শেষ পর্ব)

সার্থক আর অনন্যার সম্পর্কের কথা অফিসে কারওরই অজানা ছিল না এবং সকলেই চাইত ওরা দু’জনে বিয়ে করে নিক। ওদের দু’জনেরই বডি ল্যাঙ্গুয়েজ প্রমাণ করত দু’জনের মধ্যের ভালোবাসাটা কতটা গভীর।

—সার্থক, কবে বিয়ে করছ অনন্যাকে? অফিসের সহকর্মী আশিস অফিস ফাঁকা দেখে সার্থককে জিজ্ঞাসা করল। সার্থক আর আশিসের বন্ধুত্ব প্রায় নয়-দশ বছর গড়াতে চলল। অফিসেরই এক কলিগের মেয়ের বিয়েতে গেছে অফিসের বেশির ভাগ লোকজন। অফিস মোটামুটি ফাঁকা দেখেই আশিস প্রশ্নটা করেছিল।

অনন্যা বেরোবার সময় নিজের পার্সটা নিতে ভুলে গিয়েছিল, সেটাই নিতে অফিসে ফিরে এসেছিল। না চাইতেও আশিস আর সার্থকের কথোপকথন ওর কানে গেল। আশিসের মুখে নিজের নাম শুনে কৌতূহলবশত অনন্যা দাঁড়িয়ে গেল।

—অনন্যাকে আমি পছন্দ করি আশিস, ও খুব ভালো মেয়ে। কুশলও ওকে ভালোবাসে। কিন্তু অনন্যা এখন কুশলকে পছন্দ করলেও যখন ওর নিজের সন্তান হবে তখন কুশলকে ওর ভালো না-ও লাগতে পারে। আমি আমার ছেলের জন্য জীবনে কোনওরকম রিস্ক নিতে রাজি নই। আশিসের প্রশ্নের স্পষ্ট জবাব দেয় সার্থক৷

এই কথা শোনার পর অনন্যার আর দাঁড়িয়ে কিছু শোনার ক্ষমতা ছিল না। পার্সটা নিয়ে অফিস থেকে ও বেরিয়ে গেল।

তিন-চারদিন অনন্যা অফিস এল না। মোবাইলও বন্ধ ছিল ওর। সার্থক কোনওরকম খবর না পেয়ে শঙ্কিত হয়ে উঠল। দুই বছরে এই প্রথমবার অনন্যার অনুপস্থিতি ওকে ভিতরে ভিতরে চিন্তায় পাগল করে তুলল। ও বুঝতে পারছিল না কী করে অনন্যাকে ছাড়া ওর জীবন চলবে? অফিসের প্রত্যেকে, সার্থকের এই মানসিক অস্থিরতা উপলব্ধি করতে পারছিল এবং বুঝতেও পারছিল ওর ব্যবহারে এই অসংলগ্নতার কারণ।

পাঁচদিন কেটে যাওয়ার পর সন্ধের দিকে একটা ট্যাক্সি এসে দাঁড়াল সার্থকের বাড়ির সামনে। ট্যাক্সি থেকে নেমে অনন্যা সার্থকের দরজায় কলিংবেল বাজাল। দরজা খুলে অনন্যাকে সামনে দেখে সার্থক হতবাক হয়ে গেল।

অনন্যাকে খুব দুর্বল লাগছিল দেখতে। দেখে মনে হচ্ছিল কোনও শক্ত অসুখ থেকে সবেমাত্র সুস্থ হয়ে উঠেছে। দুশ্চিন্তা চেপে রেখেই সার্থক জিজ্ঞেস করল, ‘কী ব্যাপার অনন্যা, পাঁচদিন কোথায় ছিলে তুমি?’

ততক্ষণে কুশলও এসে দাঁড়িয়েছে অনন্যার কোল ঘেঁসে। ব্যাগের থেকে দুটো চকোলেট বার করে কুশলের হাতে দিল অনন্যা। সস্নেহে ওর নরম গালে হাত বুলিয়ে কাছে টেনে নিয়ে ওর চুলের মধ্যে ঠোঁট ঠেকাল অনন্যা।

প্রতিবারের মতোই ‘থ্যাংক ইউ’ বলে কুশল অনন্যার কোলে মুখ লুকাল।

—কী হল অনন্যা, বললে না তো তোমার কী হয়েছে। পাঁচদিন কোথায় ছিলে? অনন্যার উত্তরের অপেক্ষায় অধীর হয়ে উঠছিল সার্থক।

অনন্যা একটা গভীর নিশ্বাস নিল। হাতের ফাইলটা থেকে একটা কাগজ এগিয়ে দিল সার্থকের হাতে।

—এটা কী? সার্থক চোখ রাখল কাগজটিতে। বিস্ময়ে এবং হতচকিত হয়ে তাকিয়ে রইল কাগজটির দিকে। অস্ফুট একটা আওয়াজ বেরোল সার্থকের মুখ দিয়ে, ‘অনন্যা এটা তুমি কী করেছ?”

অনন্যাকে চুপ করে বসে থাকতে দেখে সার্থক বলে উঠল, “তুমি নিজেকে এভাবে মাতৃত্ব থেকে বঞ্চিত করলে? কেন তুমি নিজের অপারেশন করালে?’ হাতের মেডিকেল সার্টিফিকেটটা নিয়ে সার্থক পাথরের মতো বসে রইল। এবার অনন্যা মুখ খুলল।

—সার্থক তুমি আমাকে বিয়ে করতে এই জন্যই রাজি ছিলে না বা ভয় পাচ্ছিলে যে, আমাদের সন্তান হলে আমি কুশলকে আর ভালোবাসব না। ওর খেয়াল রাখা বন্ধ করে দেব। এই ভাবনাই তোমাকে ভিতরে ভিতরে শেষ করে দিচ্ছিল। কিন্তু আমি চেয়েছি যে, কুশলই আমার একমাত্র সন্তান হয়ে থাকুক। তাই ভবিষ্যতে যাতে কোনওদিন নিজে মা হতে না পারি সেজন্য সকলের আশঙ্কাই শেষ করে দিতে আমি নিজের অপারেশন করালাম। সার্থক আমি তোমাকে কোনওভাবে হারাতে চাই না। অনন্যার কন্ঠস্বর রুদ্ধ হয়ে আসে।

—অনন্যা, আমাদের সকলের জন্য তুমি এই নিয়ে তিন তিনবার চরম স্যাক্রিফাইস করলে। তোমার হৃদয়ের এই বিশালতার কাছে আমার কিছু বলা অতি তুচ্ছ! আমি তোমাকে দেখে কিছু বলার ভাষাও হারিয়ে ফেলেছি, বলে সার্থক অনন্যাকে নিজের বুকে টেনে নিল। অনন্যা অবাক হয়ে দেখল সার্থকের দু’গাল বেয়ে নামছে অশ্রুধারা!

বলিদান (পর্ব ২)

অনেকদিন পর অনন্যা যখন সার্থকের এরকম আচরণের কারণটা জানতে পারল, ও মনে মনে খুব দুঃখিত বোধ করল। সার্থকের জন্য মনের কোণায় সহানুভূতি জন্ম নিল। দু’বছর আগে ক্যান্সারের মতো মারণ রোগে সার্থক স্ত্রীকে হারিয়েছে। পাঁচ বছরের ওদের একটি সন্তান আছে। দ্বিতীয়বার সার্থক আর বিয়ে করেনি কারণ সৎমা সম্পর্কে খুব একটা ভালো ধারণা সার্থকের নেই। ছেলের ভবিষ্যৎ নিয়েই সবসময় দুশ্চিন্তায় থাকে সার্থক।

এতটা শারীরিক এবং মানসিক সমস্যা থাকতেও সার্থক যে নিজের সন্তানের ভবিষ্যৎকে অগ্রাধিকার দেয়, এটা ভেবেও ভালো লাগল অনন্যার।

একদিন লাঞ্চ টাইমে অনন্যাকে ক্যান্টিনে বসে খেতে দেখে সার্থক মনের মধ্যে ওঠা একটা প্রশ্ন না করে পারল না, “আচ্ছা অনন্যা, নিজের বাড়ি-ঘর ছেড়ে পুণার মতো একেবারে অচেনা একটা শহরে বদলি নিলে কেন?”

—কারণ, ওটা শুধু চারটে দেয়ালযুক্ত একটা বাড়িই, আর হ্যাঁ মাথায় একটা ছাদ আছে এইপর্যন্ত! আনমনা হয়ে উত্তর দিল অনন্যা।

—মানে? সার্থক অনন্যার উত্তরের মানেটা ঠিক বোধগম্য করতে পারল না।

—বাড়িতে ভাই বোনেদের মধ্যে আমি সবথেকে বড়ো। বাবার হঠাৎ মৃত্যুর পর বাড়িতে রোজগার করার মতো কেউ ছিল না। ভাই বোনেরা পড়াশোনা করছিল। বাবার জায়গায় আমাকে কোম্পানি বহাল করে কারণ বাবার বস বাবাকে খুব শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসতেন। সংসারে অবশ্য আর্থিক অনটন কিছু ছিল না।

আমার মাইনেতে ভালো ভাবেই সংসারটা চলছিল। ভাই বোনের পড়াশুনোও বন্ধ হয়নি। কিন্তু বিয়ে করা সম্ভব ছিল না। বিয়ে করে নিলে বাড়ির অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ হয়ে যেত আর ভাই বোনের কেরিয়ারটাও নষ্ট হয়ে যেত। উলটে অন্য আর একটা বিপদের সম্মুখীন হতে হতো।

একবার একটা ভালো সম্বন্ধ এসেছিল। পাত্রপক্ষকে খুব সাহস করে একটা শর্ত দিয়েছিলাম — বিয়ের পর আমার মাসমাইনের অর্ধেক আমি নিজের বাড়িতে দেব। ব্যস, ওদের আগ্রহ ওখানেই শেষ। এরপর আর ওই শর্ত কারও সামনে রাখার সাহস হয়নি। আমার কাছে আমার ভাই বোন বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল। আমিই ওদের আশা-ভরসা ছিলাম। নিজের জীবন নিয়ে আমি খুব খুশি ছিলাম। ওদের পড়াশোনা শেষ হলে, নিজেদের কেরিয়ারে ওরা প্রতিষ্ঠিত হলে যতটা সম্ভব ধূমধাম করে ওদের বিয়ে দিই। মা-ও বোধহয় ওটার জন্যই বেঁচে ছিলেন। এরপর মা-ও মারা যান।

ভাইয়ের বিয়ের পরেই সমস্যা শুরু হয়। ভাইয়ের বউয়ের আমার মোটা মাইনের অঙ্কটা খুব পছন্দ ছিল কিন্তু আমি ওই একই বাড়িতে থাকি ওটা ওর পছন্দ ছিল না। আমাকে নিয়ে আমার ভাইয়ের সঙ্গেও কথা কাটাকাটি করত। ফলে ভাই-ভাইয়ের বউয়ের মধ্যে যেমন দূরত্ব বাড়ছিল, আমার আর ভাইয়ের মধ্যেও একটা দুর্ভেদ্য দেয়াল উঠতে আরম্ভ করল। বেশ বুঝতে পারছিলাম ওদের জীবনে আমার প্রয়োজন ফুরিয়েছে। এবার সম্মানের সঙ্গে সরে আসাটাই সবার জন্য মঙ্গল। অফিসেও বদলির জন্য দরখাস্ত করি এবং কারণটাও ওদের খুলে বলি। প্রথম বদলি হয় হায়দরাবাদে। এখন কোন শহরে আমার বদলি হল তাতে আমার কিছু যায় আসে না। সব শহরই আমার কাছে সমান।

এখানে পুণাতে এসে আমি মানসিক শান্তিতে রয়েছি। তারপর তোমার সঙ্গে দেখা হয়ে এখন তো আরও ভালো লাগছে। সার্থক, আমি যেন আবার সেই কলেজের দিনগুলোতে ফিরে গেছি।

—অনন্যা, তোমার আত্মত্যাগের কোনও তুলনা হয় না। নিজের পরিবারের ভালোর জন্য এভাবে নিজের সুখ স্যাক্রিফাইস করা খুব সহজ কাজ নয়। তাও প্রথমবার নয়। পরিবারের জন্য নিজে বিয়ে করলে না আবার দ্বিতীয়বার সকলের ভালো চেয়ে নিজের বাড়ি ছেড়েই চলে এলে, যেটা কিনা মেয়েদের কাছে সবথেকে প্রিয় জায়গা। বলতে বলতে সার্থকের গলা অবরুদ্ধ হয়ে এল।

সার্থক অনন্যার জন্য গর্ববোধ করল। ওর মনের মধ্যে অনন্যার প্রতি শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসা অনেকটাই বেড়ে গেল।

—তুমি কখনও কাউকে ভালোবেসেছ? ইতস্তত করে জিজ্ঞেস করল সার্থক।

—জানি না, আমার কাছে দায়িত্ববোধ-টাই এত প্রবল ছিল, ভালোবাসাটা কোনওদিন উপলব্ধিই করতে পারিনি। অনন্যার উত্তর শুনে সার্থকের মনে হল আজও অনন্যা সত্যিকারের ভালোবাসার অপেক্ষায় রয়েছে।

—এখন আর তো কোনও দায়িত্ব নেই, তাহলে কেন বিয়ে করছ না? আপন মনে করেই সার্থক অনন্যাকে প্রশ্নটা করল।

—সত্যি বলব, এক তো বয়স হয়ে গেছে আর দ্বিতীয়ত খোঁজার মতোও তো কাউকে দরকার। হতাশা ভরা ফ্যাকাশে হাসি হাসল অনন্যা!

—৩৪-৩৫ বছর এখনকার দিনে কোনও বয়স নয়।

—দেখি, আমার ভাগ্য আমাকে কোথায় নিয়ে যায়। অনন্যা এই আলোচনা বন্ধ করতে চাইছিল।

—তুমিও তো আমার থেকে মাত্র দু’বছরের সিনিয়র ছিলে, তাহলে তুমিই বা বিয়ে করছ না কেন? অনন্যা পালটা প্রশ্ন করল।

—শুধু ছেলের জন্য। মায়ের ভালোবাসা থেকে ও বঞ্চিত হয়েছে বলে বাবা হয়ে আমি ওকে ভালোবাসা দেব না? বাড়িতে ওর সৎমা নিয়ে এলে সে কেমন মা হবে কে জানে? তার উপর তার নিজের সন্তান হলে, আমার ছেলের খেয়াল সে কি রাখবে? এই প্রশ্নগুলোই আমার মনে ভয়ের উদ্রেক করে, স্পষ্ট উত্তর সার্থকের।

—ছেলে যেদিন কলেজ যাবে তখন না হয় দ্বিতীয় বিয়েটা করা যাবে, বলে সার্থক হেসে ফেলল। দেখাদেখি অনন্যাও হেসে ফেলল।

দেখতে দেখতে অনন্যা দু’টো বছর পুণায় কাটিয়ে ফেলল। সার্থক আর ও এখন খুব ভালো বন্ধু। একসঙ্গে দু’জনে বাইরে ঘুরতে যায় এমনকী সার্থকের সাত বছরের ছেলে কুশলও বেশিরভাগ সময় ওদের সঙ্গে থাকে। অনন্যাকে কুশলও খুব পছন্দ করে। ওকে অ্যান্টি সম্বোধন করে কুশল।

ক্রমশঃ

বলিদান (পর্ব ১)

চিন্তায় ডুবে গিয়েছিল অনন্যা। এতগুলো বছর পার করে ফেলল। কমদিন হল না ওর চাকরির। বাবার অবর্তমানে ছোটো ভাই বোনের দায়িত্ব ওর উপরেই এসে পড়েছিল, এক অজানা নিয়তির হাত ধরে। ভাই বোনকে উচ্চশিক্ষা দিতে গিয়ে নিজের দিকে আর তাকাবার সময় পায়নি ও। এই করেই বিয়ের বয়স পেরিয়ে গেছে। অথচ শান্তি জোটেনি ওর কপালে।

ভাইয়ের বউয়ের গঞ্জনায় মাথার উপরের ছাদটুকুও ওকে ছেড়ে আসতে হয়েছে। অবিবাহিত ননদের সঙ্গে এক বাড়িতে থাকা ভাইয়ের বউয়ের পছন্দ হয়নি। সেখানের পরিস্থিতি ক্রমশ জটিল হতে দেখে অনন্যা নিজেই বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছে। ভরসা তার চাকরিটুকুই। একটি বিদেশি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে ভালো পদে সে কর্মরত।

দু’বছর হল হায়দরাবাদ থেকে পুণায় বদলি হয়েছে। পুণায় এসে জানতে পেরেছে তার কলেজের সিনিয়র সার্থকও এই একই কোম্পানিতে রয়েছে গত দশ বছর। কলেজে থাকতে কলেজের যে-কোনও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানগুলো পরিচালনার দায়িত্বে অনন্যা এবং সার্থক দু’জনেই থাকত আরও অনেকের সঙ্গে। এই ভাবেই বন্ধুত্ব দু’জনের। অবশ্য সম্পর্কটা বন্ধুত্বেই থেকে গিয়েছিল, গভীরতা পায়নি।

পুণায় এসে অফিস জয়েন করার প্রায় তিন-চারদিন পর লাঞ্চ টাইমে হঠাৎ সার্থককে দেখতে পেয়ে খুশিতে উচ্ছল হয়ে উঠল অনন্যা।

অনন্যা, “আরে সার্থক না? তুমি এখানে?”

—হ্যাঁ, আমি এই অফিসেই কাজ করি কিন্তু আপনাকে ঠিক…’, সার্থক আশ্চর্যান্বিত হয়ে তাকাল অনন্যার দিকে! কারণ এখানে “তুমি’ সম্বোধন করার মতো এমন আপনজন কে হতে পারে। অবশ্য সার্থককেও দোষ দেওয়া যায় না। অনন্যার সৌন্দর্য এতটুকু কমে না গেলেও ছিপছিপে চেহারা আগের থেকে ভারী হয়েছে। চুল ছেঁটে কাঁধ অবধি এসেছে।

অফিসের তিন-চারজন কর্মচারীও অবাক হয়ে ওদের লক্ষ্য করছিল। ওরা নিশ্চিত ছিল অনন্যাই কোনওরকম ভুল করছে।

—সার্থক, আমি অনন্যা। জয়পুরে আমরা একই কলেজে পড়তাম। অনন্যা একটু আশ্চর্য হল, সার্থক ওকে চিনতে পারেনি দেখে! ও একটু লজ্জিত হল কারণ আশেপাশে সকলেই ওর দিকে এমন করে তাকাচ্ছিল যে ওদের চাহনি বলছিল অনন্যাই মস্ত ভুল করে বসেছে।

—সরি অনন্যা, আমি সত্যি তোমাকে চিনতে পারিনি। কলেজ ছেড়েছি প্রায় বারো-তেরো বছর হতে চলল। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে স্মৃতিশক্তিও কমছে। যদিও পঁয়ত্রিশ বছর এখনকার দিনে কোনও বয়সই নয় তবুও সার্থক কথোপকথন চালাবার চেষ্টা করল।

অনন্যার দিকে ভালো করে তাকাল সার্থক। মনে পড়ল কলেজে থাকতে লম্বা বিনুনি করে আসত। এখন কাঁধ পর্যন্ত চুল খোলা রয়েছে। চোখেও পাওয়ারের চশমা উঠেছে। কিন্তু এত কথা সাৰ্থক সকলের সামনে বলাটা সমীচীন মনে করল না।

—তুমি কবে জয়েন করলে অফিস? আসলে আমিও পাঁচদিন ছুটিতে ছিলাম। আমার বাচ্চাটা অসুস্থ ছিল, সার্থক বলল।

—আমি চারদিন হল, অফিস জয়েন করেছি। অনন্যা সার্থকের ব্যবহারে কিছুটা অস্বস্তি বোধ করছিল। ওর খালি মনে হচ্ছিল শুধুমাত্র ভদ্রতার খাতিরে সার্থক ওর সঙ্গে দাঁড়িয়ে কথা বলছে। নয় তো ওর সঙ্গে কথা বলার সার্থকের বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই। যদিও কলেজেও বন্ধুত্ব কোনওদিন খুব গভীর ছিল না দু’জনের মধ্যে। কাজ নিয়েই যা দু’জনের কথাবার্তা হতো। কিন্তু একে অপরের অপরিচিত তো ছিল না।

এতবছর বাদে একটা অচেনা শহরে এসে পুরোনো বন্ধুর সঙ্গে দেখা হওয়াতে অনন্যা খুব উৎসাহিত হয়ে পড়েছিল, সার্থকের ব্যবহার অনন্যার সেই উৎসাহে একেবারে জল ঢেলে দিল। সার্থকের চেহারায় যে, কোনও পরিবর্তন হয়নি এমন তো নয়। আগের থেকে ওর শরীরেও মেদ জমেছে, গোঁফ রেখেছে। তাও ওকে চিনতে বিন্দুমাত্র দেরি হয়নি অনন্যার। অফিসের সহকর্মীরাও ধরেই নিয়েছিল, ওদের দু’জনের সম্পর্কটা নিশ্চয়ই পুরোনো কলেজ প্রেমের বর্তমান রূপরেখা।

পরের দিন অনন্যার মুড খারাপ দেখে সার্থকের বুঝতে অসুবিধা হল না, ওর কথা বলার স্টাইলেই অনন্যা মনে মনে আহত হয়েছে। নিজেকে খুব দোষী মনে হল সার্থকের। লাঞ্চের সময় নিজেই এগিয়ে এসে অনন্যা-কে বলল, “খুব সরি অনন্যা, আমি তোমাকে একেবারেই চিনতে পারিনি।’ হাত দিয়ে কান ধরে কলেজের দিনের মতো বন্ধুত্বের ভাষা সার্থকের মুখে শুনে অনন্যা না হেসে পারল না।

—সার্থক আমার ছোটো চুল দেখে অনেকেই আমাকে চট করে চিনতে পারে না। তোমাকে আমি দোষ দিচ্ছি না। বুঝতে পেরেছি তুমি আমাকে চিনতে পারোনি।

—হ্যাঁ, কলেজে তুমি লম্বা বিনুনির জন্যই খ্যাত ছিলে আর সেই কারণেই ‘মিস কলেজ’-এর খেতাবও তোমার ঝুলিতে জুটেছিল। সার্থকের চোখের সামনে ভেসে উঠল অনন্যার চুলের সৌন্দর্যে কেমন ছেলেরা ওর জন্য পাগল ছিল।

—কী করি? অফিস জয়েন করার পর সকালের দৌড়াদৌড়িতে বিনুনি করার সময় কোথায়? তাই জন্য চুল কেটে ফেলতে বাধ্য হয়েছি। অনন্যার কথায় আফশোশ স্পষ্ট ফুটে উঠছিল কারণ ভারতীয় নারীর কাছে নিজের চুলের সৌন্দর্য অত্যন্ত গর্বের বিষয়।

অনেক সময় যখন আমরা একই শহরে বা একই কলেজে পড়ি এবং সেখানে রোজই প্রায় দেখা সাক্ষাৎ হতে থাকে তখন সেখানে বন্ধুত্ব গড়ে উঠলেও ঘনিষ্ঠতা বাড়বেই এমনটা হলফ করে বলা যায় না। অথচ অন্য শহরে গিয়ে হঠাৎ যদি সেই দু’জনের দেখা হয়ে যায়, তাহলে মনে হয় দু’জন খুব কাছের মানুষ বহু বছর বিচ্ছেদ কাটিয়ে আবার একত্রিত হয়েছে। সার্থক এবং অনন্যার মনের অবস্থাটাও ঠিক এমনই ছিল।

কিছুদিন কাজ করতে করতেই অনন্যা লক্ষ্য করল অফিসের মহিলা সহকর্মীদের সঙ্গে সার্থকের কাজ ছাড়া কোনও কথা হয় না তাও বেশিরভাগই হ্যাঁ কিংবা হুঁ— শুধু এটুকুই। অথচ পুরুষ সহকর্মীদের সঙ্গে সার্থক খুব সহজ ভাবে মেশে এবং সবসময় তাদের সাহায্য করতে এগিয়েও আসে। এছাড়াও ঠিক ছ’টায় অফিস ছুটির সঙ্গে সঙ্গে সার্থক এক মুহূর্ত কারও অপেক্ষা না করেই একাই অফিস থেকে বেরিয়ে যায়।

ক্রমশঃ

হনন (পর্ব ২)

২য় পর্ব

—এ কি! তুমি এত সাজগোজ করে জামা-কাপড় পরে বসে আছ কেন? কোনও অনুষ্ঠানে যাবে বুঝি?

কথার উত্তর না দিয়ে শ্রী বিতানকে জাপটে ধরে খাটে বসিয়ে দেয়। তারপর বলে, ‘কেন আমাকে দেখতে যথেষ্ট সুন্দর লাগছে না বুঝি? দ্যাখো… দ্যাখো… দ্যাখো ভালো করে। তোমার জন্যই তো সাজলাম। এগুলো কেরালার গয়না, জানো? বাবা কেরালার কান্নুরে পোস্টেড ছিলেন। তখন কিনে দিয়েছিলেন এগুলো।’ বিরক্ত হয়ে নিজেকে ছাড়িয়ে নেয় বিতান।

—আঃ শ্রী! কী যে ছেলেমানুষি করো না! তোমাকে তো রোজই দেখছি। আমার জন্য এত সাজগোজ করবার তো কিছু নেই! বিতানের আরও কাছে এগিয়ে এসে তার বুকে মুখ গুঁজে শ্রী বলে ওঠে, ‘উঁহু, অনেকক্ষণ দ্যাখোনি তো আমায়। সারাটা দিন। মানে ঠিক আট ঘন্টা, ত্রিশ মিনিট, দশ সেকেন্ড।’ শ্রীর আলিঙ্গনে বিরক্তি যেন জাপটে ধরে বিতানকে।

—আঃ ছাড়ো এখন! সারাদিন পর অফিস থেকে ফিরেছি। এখন বড্ড ক্লান্ত, শ্রী। কোথায় চা, জলখাবার দেবে তা নয়… কী যে করো না এসব!

ফ্রেশ হতে বাথরুমের দিকে চলে যায় বিতান। পিছনে শ্রীদর্শিনীর মাথায় যে নীরবে ভিসুভিয়াস ফুটছে, তা বেশ বুঝতে পারে সে। বাথরুম থেকে বেরিয়ে সোজা মায়ের ঘরে ঢোকে বিতান। দেখে মা শরৎকাহিনিতে মগ্ন। দেখেই মাথায় রক্ত উঠে গেল। এতক্ষণ মনে যে-ক্ষোভ, বিরক্তি জমেছিল পুরোটা উগরে দিল মায়ের উপর।

—বেশ ভালোই আছো তোমরা। একজন সাজগোজে বিভোর, আর একজন কাব্য-কাহিনি পড়তে ব্যস্ত। বাহ্! আমি যে সারাদিন পর অফিস থেকে ফিরে এসেছি সে দিকে কারও নজর নেই। বিতান দেখল ছায়া ঘনিয়ে এল মায়ের মুখে। লজ্জিত মুখে মা বলল,

—এইমাত্র সব সেরে এসে একটু বসলুম রে, বাবা। ওবেলার রান্নাটাও সেরে নিলুম। রাতে শুধু গরম গরম ভাত নামিয়ে খেতে দেব তোদের। তা এখন জলখাবারে কী দেব, বল?

গজগজ করতে করতে বিতান বলে, ‘কেন? একা সব কাজ করো কেন? তোমার আদরের বউমাটিকে একটু শিখিয়ে পড়িয়ে নিলেও তো পারো! শেখালে কি সে শিখবে না?’ মায়ের মুখটা যেন আরও কালো হয়ে যায়। মৃদু কণ্ঠে বলে উঠল, ‘আসলে সে তো এ সংসারের নতুন মানুষ। এখন একটু সাজগোজ-আমোদ-আহ্লাদ করুক না মেয়েটা। ক’দিন পরে তো সংসারের জোয়ার  কাঁধে নিতেই হবে। যাক গে, তোকে একটু মুড়ি মেখে দিই, শসা-পেঁয়াজ দিয়ে?’

—নাঃ, শুধু চা আর বিস্কুট দাও। বলেই গট গট করে ড্রয়িংরুমের দিকে হেঁটে যায় বিতান। যেতে গিয়ে আড় চোখে শোবার ঘরের দিকে তাকায়। সেখানে যেন কঠিন নীরবতা বিরাজ করছে! আসন্ন ঝড়ের পূর্বাভাষ! টিভিটা চালিয়ে অস্থির ভাবে চ্যানেল ঘোরাতে থাকে বিতান।

মা কিছু না বললেও বিতান জানে সারাদিন রূপচর্চায় মত্ত থাকতে চায় শ্রীদর্শিনী। নানারকম রূপটান বা ফেসপ্যাক, হেয়ার প্যাক তৈরির উপকরণ বিতানই তো কিনে আনে শ্রীর ফরমায়েশ অনুসারে।

সকালে উঠে এক কাপ ঈষদুষ্ণ জলে একটা পাতিলেবু আর এক চামচ মধু মিশিয়ে খায় শ্রী। তারপর মুসুরডাল বাটা আর হলুদ দিয়ে একটা প্যাক তৈরি করে মুখে লাগায়। শেষে ঈষদুষ্ণ নারকেল তেলে এক চামচ লবঙ্গ তেল মিশিয়ে ভালো করে স্ক্যাল্পে মাসাজ করে। প্রায় দিনই বিতান দেখে বাড়িতে লবঙ্গ তেল তৈরি করে শ্রী।

লবঙ্গ, মিক্সার গ্রাইন্ডারে গুঁড়ো করে নারকেল তেলে মিশিয়ে একটা কাচের বোতলে ঢেলে খাটের নীচের অন্ধকারে রেখে দেয় এক সপ্তাহ। এক সপ্তাহ পর মসলিন কাপড়ে ছেঁকে নিয়ে সেই তেল মাথায় লাগায়। বিতান লক্ষ্য করে শ্রীর এইসব রূপচর্চা ও তার উপকরণ তৈরি করা শেষ হতে হতে মায়ের একটা ভাজা, মাছের ঝোল, ডাল নেমে যায়। বিষয়টা খুবই দৃষ্টিকটু ও বিরক্তিকর লাগলেও নতুন বউকে কড়া ভাবে কিছু বলতে পারে না সে।

কিছুক্ষণ পরে শোবার ঘরে ঢুকে মনটা ভারী হয়ে ওঠে বিতানের। দেখে ঘরের সারা মেঝে জুড়ে গয়নাগাটি, মেক-আপের জিনিস ছড়ানো। লিপস্টিক, আইলাইনারগুলো ভেঙে কুটিকুটি করে ফেলেছে। আর বিছানায় শুয়ে ফুলে ফুলে ফুঁপিয়ে কাঁদছে শ্রী। কাছে গিয়ে তার পিঠে হাত রাখে বিতান। শ্রীর কান্নার তোড় আরও বাড়তে থাকে। মনে মনে অনুশোচনা হতে থাকে বিতানের। এতটা আঘাত না দিলেও হতো মেয়েটাকে। না হয় একটু সেজে তাকে দেখাতেই এসেছিল। একটু অবুঝ মা মরা মেয়েটা, বাবার আদরের। বুঝিয়েসুজিয়ে বললে নিশ্চয়ই একদিন ঠিক হয়ে যাবে সব। আদর করে শ্রীকে কাছে টেনে নেয় বিতান। শ্রীকে যে সত্যিই সে ভীষণ ভালোবাসে।

কিন্তু কিছুই ঠিক হল না। নিজের রূপচর্চা-সাজগোজ আর বিতানকে ঘিরে শ্রীর ভয়ংকর অবসেশন দিনের পর দিন বাড়তেই লাগল। সবসময় শ্রীর এক অমূলক ভয় যে, সে দেখতে খারাপ হয়ে যাচ্ছে আর বিতান অন্য মেয়েদের দিকে ঝুঁকে পড়ছে…

—পুজোর দিনগুলোতে নিজের সাজপোশাকে সেরাটা দেওয়া মাস্ট। ভিড়ের মাঝে, বিশেষ করে তোমার অফিসের বিশ্বকর্মা পুজোর দিনের ওই গেট টুগেদারে নজর কাড়তে গেলে পোশাকের কালার, কাট, ফ্যাব্রিক সব হতে হবে একদম এক্সক্লুসিভ। জানো? কীভাবে সাজতে হবে ও ঘরোয়া রূপচর্চার নানা গাইড লাইন দিচ্ছে বহু প্রিন্টেড ও অন-লাইন ফ্যাশান ম্যাগাজিনগুলো। নেইলপলিশ পরতে পরতে এক নাগাড়ে বলে চলে শ্রী।

—সেবার তুমি অফিসের কম্পিউটার সেকশানের মৃদুলার দিকে ড্যাবড্যাব করে চেয়ে দেখছিলে। সেবন্তীর সঙ্গে তোমার সে কী হাহা হিহি! এবার আমি আর কোনও রিস্ক নেব না বাবা। এবার আমার ড্রেস হবে এক্কেবারে হটকে! আর জানো তো আজকাল পুরো মুখের সাজে একই রঙের আধিক্য। এই মনোক্রোম মেক-আপ এখন রীতিমতো ভাইরাল।

শ্রীর স্বরে যেন একেবারে কোনও ক্লান্তি নেই! শুনতে শুনতে মাথা ধরে যায় বিভানের।

—জীবনটা শুধু সাজগোজ আর গয়নাগাটি নয়, শ্রী। প্লিজ বোঝার চেষ্টা করো লক্ষ্মীটি! এ তো মানসিক অসুখ! চলো তোমাকে নিয়ে কোনও সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে যাই। তিনি হয়তো তোমাকে কোনও ভাবে হেল্প করতে পারবেন।

—কী বললে? আমি পাগল? আমি পাগলের ডাক্তারের কাছে যাব? হাউ ডেয়ার ইউ! রাগে হাতের কাছে যা থাকে বিতানের দিকে ছুড়তে থাকে শ্রী!

 

 

হনন (পর্ব ১)

বিতানদের বাড়িটা সাবেকি আমলের। বাবার তৈরি বাংলো প্যাটার্নের কাঠের বাড়ি। বাড়ির সামনে ছোট্ট একখানি বাগানের বুক চিরে হাঁটাচলা করার সরু একটা মোরামের পথ। বাবা চলে যাবার পর একবার ভেবেছিল বাড়িটাকে রি-মডেলিং করবে। কিন্তু মা একদম রাজি হয়নি। আর ছোটোবেলার গন্ধমাখা এই বাড়িটা বিতানেরও খুব প্রিয়।

আজ অফিস থেকে ফিরে সামনের গেট দিয়ে ঢুকে বাগান পেরোতে পেরোতে নানান ফুলের একটা ককটেল সুবাস যেমন বিতানের নাকে এসে লাগে, সেই সঙ্গে কান ছুঁয়ে দেয় শ্রীদর্শিনীর গান— সাজনা হ্যায় মুঝে সজনা কে লিয়ে…। ভারি সুরেলা গলা তার।

শ্রীদর্শিনী বিতানের স্ত্রী। মাত্র তিনমাস আগে এক মাঘীপূর্ণিমার সন্ধেতে শ্রীর সঙ্গে তার বিয়ে হয়েছে। বিতান আর শ্রীদর্শিনীর পরিচয় হয়েছিল এক বছর আগে একটি সোশ্যাল ম্যাট্রিমোনি সাইটে। তিন মাস তারা একে অপরের সঙ্গে কথাবার্তা বলার পর, মেলামেশা করবার পর দু’জনে বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। তারপর চলেছিল ছ’মাসের কোর্টশিপ।

শ্রীদর্শিনী তার বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান। বিতানের চেয়ে অনেক বেশি বৈভবে মানুষ সে। শ্রীর বাবা রিটায়ার্ড আর্মি অফিসার। এছাড়াও তাদের পারিবারিক ব্যাবসা আছে। ভারতের নানা প্রান্তের সংস্কৃতি, সাজগোজ সম্পর্কে শ্রী বেশ ওয়াকিবহাল। এছাড়া গণিতে স্নাতকোত্তর শ্রীদর্শিনী পড়াশোনাতেও বেশ মেধাবী। অন্যদিকে, বিতান নিতান্তই সাধারণ। অ্যালুমিনিয়াম প্রস্তুতকারক সংস্থায় কোয়ালিটি কনট্রোল ইঞ্জিনিয়র সে।

বাবা ছিলেন ন্যাশনালাইজড ব্যাংকের ক্লার্ক। ছোটোবেলা থেকে তেমন কোনও বিলাসবহুল জীবনযাপন তাদের ছিল না। জীবনটা ছিল আর দশটা মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলের মতো অত্যন্ত সাদামাটা। তাই মাঝে মাঝে বিতানের বেশ আশ্চর্য লাগে এটা ভেবে যে, তার মতো একজন সাধারণ ছেলেকে কীভাবে মনে ধরল অত উচ্চবিত্ত পরিবারের মেয়ে শ্রীদর্শিনীর!

বাগান পেরিয়ে এসে নিজেদের শোবার ঘরে ঢুকতেই ভীষণ চমকে উঠল বিতান। দেখল গা ভর্তি নানারকম সোনার গয়না পরে সেজেগুজে বসে আছে শ্রী। পরনে দামি শাড়ি, গলায় সীতাহার, কানে বড়ো ঝোলাদুল, হাতে মোটা সোনার চুড়ি, খোঁপায় বেলকুঁড়ির মালা। সামনে খোলা মেক-আপ বক্স, লিপস্টিক, আইলাইনার, আই-শ্যাডো — আয়নার সামনে বসে গভীর ভাবে নিজেকে দেখতে দেখতে মিটি মিটি হাসছে শ্রী। দেখেই চলেছে নিজেকে। যেন নিজের প্রেমে নিজেই বিভোর। চারপাশের কোনওকিছু সম্পর্কে তার যেন কোনও চেতনাই নেই।

বিয়ের আগে থেকেই বিতান জানত ভীষণ সাজতে ভালোবাসে শ্রীদর্শিনী। শ্রী সুন্দরী কিন্তু তার সাজগোজের জন্য অপরূপা হয়ে ওঠে সে। বিতানের সঙ্গে যখন দেখা করতে আসত তখন বরাবরই তার রুচিসম্মত সাজগোজ তাকে মুগ্ধ করত। শ্রীর দৌলতেই বিতান জেনেছে মেক-আপের খুঁটিনাটি, বিভিন্ন বিউটি প্রোডাক্টের কার্যকারিতা, ঘরোয়া রূপটানের উপকারিতা ইত্যাদি নানা বিষয়। তখন থেকেই বিতান লক্ষ্য করত তাদের কথোপকথনের বেশ অনেকটা অংশ জুড়েই যেন থাকছে সাজগোজ, রূপচর্চা বিষয়ক আলোচনা।

বিতান ছোটোখাটো সোনার গয়না বা জাংক জুয়েলারি, কিংবা লিপস্টিক, নেলপলিশ এসব উপহার দিলে ভীষণই খুশি হতো শ্রী। তাকে দেখতে খুব সুন্দর লাগছে বিতানের কাছ থেকে এমন কমপ্লিমেন্ট পেলে শিশুর মতো আনন্দে উদ্বেল হয়ে উঠত। এমন কি পথ চলতি কোনও সুন্দরী মেয়ের দিকে বিতানের চোখ গেলে, ভারি অভিমানী গলায় শ্রী জিজ্ঞেস করত, ‘ওকে কি আমার চেয়েও বেশি সুন্দর লাগছে দেখতে, বিতান? আমি কি তেমন সুন্দরী নই?’

বিতান খুব আনন্দিত হতো। মেতে উঠত খুনশুটিতে। ভাবত শ্রী তাকে এত ভালোবাসে যে সবসময় তার মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকতে চায়। ভাবলেই বুক ভরে উঠত তার। কিন্তু কথায় আছে একজনের সঙ্গে এক ছাদের নীচে চাল-ডাল-তেল- হলুদের আটপৌরে জীবন শুরু না হলে তাকে সম্পূর্ণ চেনাই যায় না। বিতানের ক্ষেত্রে ঠিক সেটাই ঘটেছিল।

 

অচেনা নারী (শেষ পর্ব)

সুচরিতার কথা

অতনু গাড়ি চালিয়ে চলে গেল। ওকে শেষবারের মতো ফ্লাইং কিস দিলাম। এখন আমার অনেক কাজ। ঘরে গিয়ে ল্যাপটপে দেখতে হবে কত কম খরচে ফিউনারাল করা যায়। কোথায় দেখেছিলাম — এমনি খরচ ২,৫০০ ডলার, ভিউইং যোগ করলে ৪,০০০ ডলার। তাড়াতাড়ি দেখতে হবে। এরপর লোকজন আসতে শুরু করলে তো শোকে পাথর হয়ে যাবার অভিনয় করতে হবে।

সত্যি গুগুল-এর জবাব নেই। কাল মাত্র দশ মিনিটে বার করে ফেললাম একটা স্ক্রু ড্রাইভার দিয়ে কী করে গাড়ির ফ্রন্ট ব্রেক নষ্ট করে দেওয়া যায়। আবার ওরা বারবার মনে করিয়ে দিয়েছে, গাড়ি স্টার্ট দিয়ে যেন রিভার্স না করতে হয়। তাই তো কাল আগে গাড়ি রাস্তার দিকে মুখ করে রেখেছিলাম। সকালে উঠে গিয়েছিলাম, ও কিছু সন্দেহ করে কিনা দেখতে। অতনু কিছু বোঝেইনি। আমাকে খুব বোকা ভেবেছে। ভুলে গেছে যে, রীতেশের জুনিয়র যে সাউথ ইন্ডিয়ান মেয়েটা কাজ করে, লতা, ও ছোটোবেলায় আমার বোনের ক্লাসমেট ছিল দিল্লিতে। তাই তো আমাকে কাল দুপুরে ফোন করে জানাল, ‘সুচরিতাদি, সামথিং ইজ ফিশি। ইওর হাজব্যান্ড কেম টু রীতেশ উইথ টু বেঙ্গলি ফ্রেন্ডস। দে ওয়ার টকিং ইন বেঙ্গলি বাট ইট সিম্স লাইক এ কন্সপিরেসি টু সেন্ড ইউ টু অ্যান অ্যাসাইলাম সুন। বি কেয়ারফুল।”

অতনু আমাকে পাগলা গারদে পাঠিয়ে তারপর কী ডিভোর্স নিত? নিয়ে কাকে বিয়ে করত? ওই মুটকি বনানীকে? যার বাড়ি গেলে দহিবড়া নিয়ে এসে ‘অতনুদা, আরেকটা নাও, আরেকটা নাও’ করে অতনুর গায়ে ঢলে পড়ে?

এই রাস্তাটা আমার বাড়ির সামনে থেকে সোজা গিয়ে একটা টি জংশনে পড়েছে। সেখানে স্টপ সাইন। ক্রস স্ট্রিট দিয়ে এ সময় প্রচুর গাড়ি যায়। স্টপ সাইনে ব্রেক কষবে, গাড়ি সোজা রাস্তার মধ্যে গিয়ে পড়বে ট্রাফিকের মাঝে। শুক্রবার রীতেশের কাছে আমায় নিয়ে যেতে চেয়েছিলে না? সরি, তার বদলে রীতেশই আসবে তোমায় দেখতে, কাসকেটে শোয়া অবস্থায়।

অতনু, তুমি কেন আমার কিসটা লুফতে গেলে সেই অনেকদিন আগের মতো? তখন রাকা বোধহয় বছর দুই। সামারে গাড়ি নিয়ে চলে যেতাম কোনও পাহাড়ে। রাকার পিছনে দাঁড়িয়ে আমি ফ্লাইং কিস ছুড়ে দিতাম। তুমি ডান হাত বাড়িয়ে লুফে নিতে। রাকা বুঝতে না পেরে তোমায় জিজ্ঞেস করত, ‘বাবা কী লুফলে?” তুমি হেসে বলতে ‘একটা প্রজাপতি’। তারপর মুঠো খুলে বলতে, ‘যা, উড়ে গেল।’

রাকার সঙ্গে লুকোচুরি খেলতে খেলতে গাছের আড়ালে লুকিয়ে পড়তে। রাকা খুঁজে না পেয়ে কাঁদতে কাঁদতে এসে বলত, ‘বাবা কোথায়? দেখতে পাচ্ছি না।’ আমি হেসে গাছটা দেখিয়ে দিতাম। এখন কী হবে?

আজ যখন রাকা এসে কাঁদতে কাঁদতে বলবে ‘বাবা কোথায়? দেখতে পাচ্ছি না’ আমি কী উত্তর দেব? এটা আমি কী করলাম! এটা আমি কী করলাম! এটা আমি কী করলাম…! আমি কি সত্যিই পাগল হয়ে গেছি? ওই যে ফোন বাজছে! ওদিকে কি অতনু?

‘সু, আজ ভীষণ জোর বেঁচে গিয়েছি। ব্রেক কাজ করছিল না, স্টপ সাইনে না থেমে গাড়ি সোজা রাস্তার ওপারে ফুটপাথে। ভাগ্যিস কোনও গাড়ি ছিল না।’

নাকি পুলিশ? “ইস দিস অটনু রে’স রেসিডেন্স? সরি ম্যাম, অটনু ইজ নো মোর, স্পট ডেড ইন আ কার অ্যাক্সিডেন্ট।’ ফোনটা বেজেই চলেছে। আমি কেন উঠতে পারছি না সোফা থেকে? মনে হচ্ছে পা দুটো যেন কার্পেটের সঙ্গে পেরেক দিয়ে জুড়ে দিয়েছে কেউ। অতনু না পুলিশ। পুলিশ না অতনু? ভগবান যেন অতনু হয়, অতনু, অতনু, অতনু।

* এই গল্পের সব চরিত্র কাল্পনিক।

 

পড়ার জন্য সীমাহীন গল্প-নিবন্ধসাবস্ক্রাইব