প্রতি বাঁকে ‘তুমি’

 

হাতছানি

তখন তেড়ে বর্ষা, জুনের শেষের দিক… বেড়াবার জায়গা খুঁজছি নেটে। আলগোছে এটা-সেটা দেখতে দেখতে চোখে পড়ল বরফঢাকা পাহাড়ের কোলে পান্না সবুজ শেষনাগ। পাহাড়ি ঢালে ভেড়া চরছে আর রুক্ষ প্রকৃতির মাঝখান দিয়ে সুতোর মতো এক চিলতে পথের পরতে-পরতে এঁকেবেঁকে মানুষের সারি। লোভ উসকে দেবার একশো আয়োজন নিয়ে কভার পিকচার হাতছানিতে রেডি। পেজটি আসলে অমরনাথ যাত্রার ও যাত্রার ফর্ম এখান থেকেই জমা নিচ্ছে। ব্যস, নেটসার্ফিং-এর ক্যাজুয়াল ভাব গোল্লায় গিয়ে লাফিয়ে উঠল মন ‘যাব’ বলে। কিন্তু কীভাবে? বাকি প্রয়োজন মিটলে তবে না! মিডিল অফ জুনে যাত্রা শুরু হয়েছে যা বন্ধ হতে জুলাইয়ের শেষ। তার মানে হাতে পাচ্ছি বিশ-বাইশটা দিন। এর মধ্যেই ফর্ম ফিলআপ, রিজার্ভেশন, পোশাক-আশাক, ফিট সার্টিফিকেট… কঠিন জায়গার কঠিন প্রস্তুতি।

খ্যাপামি

জানি, ঝাঁকায় করে টিকিট নিয়ে রেল দফতর বসে নেই যে চাইলেই দু’খিলি পান খাইয়ে হাত বাড়াবেন ‘নিন গো দিদি’ বলে। তবু… চোখের ওপর উড়ছে অমরাবতীর আকাশ- বরফঠান্ডা বাতাস। পিছু হটার ভাবনা আমলই পাচ্ছে না। এ পথ মোটে দেড়-দু’মাসের জন্য খুলেই ফের তুষার গ্রাসের কবলে চলে যায়। সুতরাং মিস মানে সেই পরের বছর। সঙ্গে-সঙ্গে নেট-এ যেতে হল ট্রেন টিকিটের সাইটে। কিন্তু সবাই যে খেয়ালি নন তার ছাপ ছড়িয়ে আছে অ্যাভেলেবিলিটির পাতায়। ‘নো রুম’ পড়তে-পড়তে চোখে চালশে। ওরই মধ্যে হিমগিরি এক্সপ্রেসে ক’টা বাঁচাখোঁচা তখনও। এবার সঙ্গী হিসেবে যাদের পেতে চাই, জিজ্ঞাসা না করেই টিকিট কাটলাম তাদেরও।

বেড়ানোর ইচ্ছে একটা খ্যাপামির মতো। আমি ফড়িং হয়ে ছোট্ট পাখায় উড়ি তো মন দৌড়োয় ফিঙের ডানায়। অথচ ক-ত-কি-ছু। আছে ফর্ম ফিলআপ, সঙ্গীদের অনুমোদন… তবু ডেফিনিট পা ফেলেছি যেই, মন ‘পিসুটপ’-এর চড়াই ভাঙছে। ‘পেতে চাই’-টা জোরদার ছিল বলে এগোনো যাচ্ছে আর ইচ্ছেকে মান দিতে গেলে যেতেও হয়। আগ্রাসী আমি আদ্যান্ত এগিয়েও ঝকমারি চলছেই। বাকিদের যে বলাই হয়নি। কিন্তু কে জানত ঘাপটি মেরে আছে বিপুল বিস্ময়। ‘অমরনাথ’ শোনামাত্র তাদের উৎসাহের বাঁধ ভাঙল, বুঝিয়ে দিল ভুল।

‘দহ’ থেকে দয়া-য়

এবার নড়ে চড়ে বসতে হল। টিকিটের খোঁজে ঘোরাঘুরি শুরু হতেই দিল্লি অবধি ‘দুরন্ত এক্সপ্রেস’ ও ‘রাজধানী-জম্মু’র ই-টিকিট হয়ে গেল। পরের পর্যায়ে শুধু পহেলগাঁ অবধি পৌঁছোনো চাই। পড়লাম এবার হেলিকপ্টার নিয়ে। অমরনাথ শ্রাইন বোর্ডের যে সাইট দেখে অ্যাদ্দুর এগোলাম, এবার সেখান থেকে চাই রেজিস্ট্রেশন। ফর্মের সাধাসিধে প্রশ্নাবলী নিয়ে দিব্যি চলেছি, আটকালাম ‘হেল্থ’এ এসে। ডক্টরের নো অবজেকশন সার্টিফিকেট চাই। আরও চাই বললেই তো পাই না। ব্লাডগ্রুপ টেস্ট করানো, দুরারোগ্য রোগী নই জানিয়ে ডা.-এর মুচলেকা দেওয়া… অবশেষে দিন পাঁচেকে সব জুটিয়ে নিয়ে বসা গেল। কিন্তু সাইট এবার দাঁত ছরকুটে চেত্তা খাওয়া ঘুড়ি। ‘যাব’-‘যাব’ পাগলামি আর ঘাঁটাঘাঁটিতে তিনি একজস্টেড, খুললই না। প্রায় কাঁচা ঘুঁটি পাকা করে ফেলে শেষে কিনা দহ? ভাবা ছিল পহেলগাঁও থেকে চন্দনবাড়ি হয়ে ঘোড়ায় যাব ও ফিরব বালতাল দিয়ে হেলিকপ্টারে। হেঁটে হবে না, কেন না রাস্তা বিপদসংকুল। ঘনঘন ল্যান্ডস্লাইড, স্টিফ চড়াই-উতরাই ও খাদ পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে কখনও ফুট দু-একের রাস্তা। এ সবও পরে, আগে রেজিস্ট্রেশন দরকার।

অতঃপর মেল-এ হেলিকপ্টার সার্ভিসেস-এর টেক্সট- ‘উড়ান অ্যাভেল করতে চাইলে টিকিট কাটুন- না হলে প্রেফারেন্স ডেটে পাবেন না।’ ফের সাইটে গিয়ে রেজিস্ট্রেশন করলাম এবং পঞ্চতরণী-বালতাল হেলিকপ্টর-এর টিকিট কেটে ফেললাম।

যাত্রা হল শুরু

যেই সব মিটে গেল, শুরু হল হাজারো প্রস্তুতি। ব্যাপারটা ইউজ্যুয়াল বেড়ানোর মতন যে নয় তা বুঝে গেছি। এরই মধ্যে দূরের এক যাত্রা-সাথির ফোন, কি কিনবে, কতটা প্রিপারেশন, স্লিপিংব্যাগ, সোয়েটার, জ্যাকেট… উত্তর দিতে-দিতে ও সবটার সঙ্গে জুড়তে জুড়তে ফের ছন্দে ফিরলাম। জুলাইয়ের তৃতীয় সপ্তাহ। ভোর সবে প্ল্যাটফর্মের কারশেড ছুঁয়ে নামছে, আমরা পৗঁছে গেলাম জম্মু। জানতাম যে জম্মু থেকে পহেলগাঁও শেয়ার জিপে যাওয়াই শ্রেয়। ওদিকে ট্যাক্সির পর ট্যাক্সি ছাড়লেও সবাই ‘শ্রীনগর শ্রীনগর’ চ্যাঁচায়। ক্রমশ যাত্রীশূন্য স্ট্যান্ডে ‘পহেলগাঁও’ শোনার অপেক্ষায় শুধু আমরাই দাঁড়িয়ে। অমরনাথের যাত্রী প্রায় নেই বললেই হয়। যদিও এই শেষ দিকে যাওয়ায় অসুবিধের চেয়ে সুবিধে পেয়েছি বেশি। আসছি তা’তে পরে। আগে বেসক্যাম্পে পৌঁছোই।

উড়াল

প্রায় ঘন্টাখানেক বাদে এক ড্রাইভার এল বোলেরো চালিয়ে। বাড়ি তার পহেলগাঁও, পথে পাবলিক পেলে রথ দেখা কলা বেচা সেরে নেবে। ভাগ্যিস! মুক্তচিত্তে এবার সুস্থির হয়ে বসা গেল। গাড়ি ছাড়তেই মনে ফূর্তির রোদ। একে অজানাকে জানার ইচ্ছেয় ভিতরটা লাফাচ্ছে তায় কাছে দূরের পাহাড়ে অফুরন্ত সবুজ। সময়টা ঠিকঠাক। জুলাই, মানে কাশ্মীরের গ্রীষ্মকাল। পরিপাটি রাস্তা, ভোরবেলাকার পবিত্রতা দিয়ে ধুয়ে যাচ্ছে সকাল। গাড়ি ছেড়েছে তখন আটটা। বেলা বাড়তে রেস্টুরেন্টে লাঞ্চ সেরে ফের উঠলাম ড্রাইভারের পাশের সিটে। সারাদিনে কখনও নদী, কখনও আপেল খেত, কখনও ড্রাইভারের বাড়ির উঠোন পেরিয়ে একসময় পৌঁছে গেলাম পহেলগাঁও। তখন সন্ধ্যার মুখ, কোথাও উঠতে হবে। তিনটে দেখাদেখির পরে সটান উঠলাম সেই হোটেলটায় যেটা বাসআড্ডা থেকে দেখা যাচ্ছিল দূরে– জঙ্গলের কপালে টিপের মতো। একেবারেই নতুন, সবুজ বনানীর ফাঁকে জ্বলজ্বল করছিল লাল-হলুদ বাহার নিয়ে একলা। খানিকটা উঁচুতে। এখন ‘নেব-নেব না’-র দোনামনা দেখে মালিক আশ্বস্ত করল, ‘নেচারমে রহনে কে লিয়ে আয়ে হো, রহে যাও। আনে যানে কা দিক্বত নেহি, মেন চৗকমে হোটেল কা গাড়ি ছোড় দেগা।’ আর কি চাই, চোখের সামনে লিডার নদী, নদীর পাশে ঘোড়ার সারি আর সাতশো কিসিমের ফুলের বিছানা বিছিয়ে পহেলগাঁও আনমনে শুয়ে। তার সবুজ এলোচুলের মাঝখানে কুয়াশার সাতকাহন। যেন সম্ভাবনার স্বপ্নে মজে টুকরো-টুকরো সুখের মুখ।

পূর্তি দিয়ে পূণ্যি

আমাদের যাত্রা পরদিনই, সুতরাং সরেজমিন তদারকিতে বেরোতে হল। শ্রাইন বোর্ড অফিসের খোঁজ, কিছু জানা, নিজেদেরটা জানানো, সেই বুঝে ব্যবস্থা নেওয়া, কাজ অঢেল। খোঁজখবর নিতে, গিয়ে পড়লাম এক বিস্তৃত প্রাঙ্গণে। সাজগোজ করা অফিস, নানা ধর্মের পতাকা ওড়ানো ভক্তবৃন্দ, মোবাইল রিচার্জ ও সিম বদলের দোকান, তাগাড় দেওয়া সোয়েটার-কম্বল, তাঁবু, ফুডস্টল। ঠিক মনঃপূত  হল না পরিবেশ। কেমন যেন খাবি খাওয়া বিধবস্ত দশা। অফিস আছে, লোক নেই। তাঁবু অনেক, মানুষ নেই। শুধু ফুডস্টলগুলো মুখর। অমরনাথ শ্রাইন বোর্ড এখান থেকেই যাত্রা শুরুর ব্যবস্থা রেখেছে। এটাই বেসক্যাম্প, কিন্তু প্রকৃতিগত ভাবে ভাঙা হাট। ইতিমধ্যে অফিসে লোক এল, কাজকর্ম মিটিয়ে গুটি গুটি এগোলাম স্টলের দিকে।

এই একটা ব্যাপার সারা অমরনাথের মুখ্য জায়গাগুলো জুড়ে। কী খাবার এখানে আছে আর কী যে নেই তা গবেষণার বিষয়। ভারতের সমস্ত রাজ্যের সেরা খাবারের দেদার আয়োজন। সবটা এ-ক্লাস শুধু নয়, পরিষেবাও বিনামূল্যে। চা থেকে চানা-বাটোরা থেকে সবজি, পায়েস, রোস্টেড পেস্তা-আখরোট-কাজু, ফল, ফুচকা, লাড্ডু, লো-ফ্যাট কার্ড, ব্রেড-রোটি, উপমা, জিরা রাইস, পোলাও মায় ফ্রুট জুস, হার্বাল টি, জোয়ান, বলে শেষ হবে না মেনু। বিভিন্ন ভাণ্ডারায় ২০ থেকে শুরু করে প্রায় ৫৬ রকম আইটেম। সেবা কার্যে নিয়োজিত কত যে মানুষ, আর সমস্ত কাজটা ভাণ্ডারা অর্গানাইজেশন করে চলেছে অমরনাথ সাইনবোর্ডের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে। সেবকদল কোনও কোনও ভাণ্ডারায় পরিচয়জ্ঞাপক ড্রেসে আছে তো কেউ-কেউ ক্যাজুয়াল ড্রেসে। লক্ষ্য সেই এক– সেবাদান। পূর্ণার্থীকে তৃিঀ৫ দিয়ে পূণ্যির দান জমানো। ওই উচ্চতা, এত মানুষ, আবহাওয়ার বৈপরিত্য সামলে যে কি করে তা অর্গানাইজড ওয়েতে চলেছে, না দেখলে বোঝা যাবে না। কোথাও জমে থাকা জঞ্জাল নেই, খাবারের প্রতিটি ট্রে বার্নারের ওপর তীব্র ঠান্ডাতেও ছ্যাঁকা লাগা উত্তাপে উষ্ণ। গ্যাস সিলিন্ডার, কাঁচা বাজার, চাল-চিনি-মশলাপাতি, কত যে স্টক, বিপুল যজ্ঞ। নিজেরাই হেঁটে উঠতে পারছি না ওদিকে এতসব মজুত প্রতি পাঁচ-সাত কিলোমিটার অন্তর। বরফে বরফ চারিধার, পিসুটপের চড়াই, তারপরেও, বিস্ময় অতল।

জয় জওয়ান

চন্দনবাড়ি থেকে মোট ৩২ কিলোমিটার পথে যতই উত্তর দিতে দিতে যাই না কেন, শেষ হয় না প্রশ্ন। ১৬ কিমি পর্যন্ত শেষনাগের রাস্তা ঝিম ধরানো সৌন্দর্যের খনি যেমন, তেমনি কঠিনতম। যদিও এ পথের সর্বোচ্চ পয়েন্ট মহাগুনাস পাস, যে পাস শেষনাগ ও পঞ্চতরণীর পিককে দোলনার মতো ধরে আছে। শেষনাগ থেকে ১৪ কিমি দূরে পঞ্চতরণী, রূপ ও মহিমায় সেরার সেরা। কী নেই সেখানে, জল, জঙ্গল, বরফিলা চূড়া, ঝরণা, সাঁকো, সোঁতা, মৗনতা। মাধুরী অশেষ। এরপর ৩ কিমি এগোতেই সংগম পয়েন্টে বালতালের রাস্তার সঙ্গে দেখা। বাকি ৩ কিমি উতরাই ও গ্লেসিয়ার। পেরোতে পারলেই বিপুল বিস্তার নিয়ে অমরনাথ গুহা।

এই সারা পথ জুড়ে ভারতীয় সেনাবাহিনীর অবদান বিবরণের বাইরে। কে কোথায় হাঁটতে পারছে না, দেবদূতের মতো হাজির জওয়ান। কেউ অন্ধকারে হা-ক্লান্ত হয়ে আসছে, তাঁকে টর্চের আলো দেখিয়ে এনে গরম পানীয়ে চাঙ্গা করছে জওয়ান, কারুর শারীরিক অসুবিধেয় কোলে করে এনে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা, সব কিছু সামলাচ্ছে হাসিমুখে। স্লঁরা মনপ্রাণ সঁপে নিয়োজিত বলেই যাত্রা নিরুদ্বিগ্ন। যদি কর্তব্য ও মহানুভবতার দিক এটা হয় তো বাকি খাটনি অন্যত্র। সেখানে দেশের দায়, দশের দায়। যেমন কথায় কথায় রাস্তায় ল্যান্ডস্লাইড, সে সমস্ত পরিষ্কার করে পূর্বাবস্থায় ফেরানো, যাত্রা পরিচালনা করা… একদম তুখোড় কুশলতা।

আজকের দিনে অমরনাথ যাত্রা আর হানাদারীর বার্তা একটা সমাপাতনের মতো। একের উচ্চারণে অন্যটি আপনি এসে দাঁড়ায়। এ জায়গার এফিসিয়েন্সি প্রশ্নাতীত। এক হাতে রিলিফ অন্য হাতে আর্মস নিয়ে সেনাদল কর্তব্যকর্মে নিবিড়। ছেয়ে আছে সর্বত্র… ভর্তি যাত্রীসহ বাস আসছে সেখানে, অস্থায়ী টেন্টে, ভাণ্ডারায়। যদিও সিকিউরিটি ফোর্সের কাছে নাইট ভিশন ক্যাপাবিলিটির সহযোগ ভরপুর, আছে বুলেট প্রুফ বাঙ্কার, তবু চ্যালেঞ্জ বইকি। সজাগ, সতর্ক, নিবেদিত প্রাণ জওয়ান-মনোযোগ পথের প্রতি ইঞ্চিতে।

প্রস্তুতি

ঘোড়া ঠিক করতে গিয়ে পড়েছি বিপুল সমস্যায়। এখন প্রায় ফাঁকা মাঠ, গোল দিলেই বল জড়াবে জালে। মানে ওপরে ওঠার যাত্রী নেই অথচ ঘোড়াওয়ালা ঢের। শেষের দিকে আসার ফল ফলতে শুরু করেছে। যতদূর দৃষ্টি যায়, দেদার ফাঁকা। সবুজ পাহাড়, গায়ে তার ঘাস চিবুনি একটি-দুটি ভেড়া আর মাঝে মধ্যেই তিরতিরিয়ে নেমে আসা সোঁতা। পা ভিজিয়ে গা ভিজিয়ে গান শুনিয়ে চলল। ছবিতে যেমন অহরহ দেখে থাকি, তেমন সারি সারি পিলপিলানো মানুষ নেই। শুরুতেই তাই দারুণ ভালো লাগা।

কিন্তু বেশিক্ষণ মুগ্ধতায় থাকা গেল না, ঘোড়া চড়াই ভাঙছে। সাংঘাতিক খাড়াই রাস্তায় টালমাটাল শরীর ক্লান্ত হচ্ছে ঘোড়ায় বসেও। যে সে নয়, এ পিসুটপের চড়াই, যাত্রা শুরু হল শক্ত প্রশ্ন দিয়ে। এন্তার এলোপাতাড়ি আপ-ডাউন, কাদা আর ঘোড়ার পটিতে থকথকে পথে ঘোড়াবাবাজির চার ঠ্যাং-এর কোনও এক ঠ্যাং ছেতরে চলেছে। গেল গেল ভাব সারাক্ষণ। বুঝতে পারছি, বরফ গলছে। খাতা বন্ধ করতে চলেছে পাহাড়, মাটি-জলে পথ বিপৎসংকুল। হেঁটে না উঠেও দম পুরো ফুস।

বাঁচাখোঁচা দমটুকু হাতড়ে নিয়ে চলেছি। মহাগুনাস পাস পেরোলাম, পেরোলাম পোষপাতরী। এখানে পাহাড়ের চূড়া যেন কেকের ওপরের আইসিং। ভারি যত্ন দিয়ে সাজানো। কুয়াশার চাদর সরিয়ে সূর্য কখনও দ্যুতি ছড়াচ্ছে, কখনও মুখ ঢাকছে। যেতে-যেতে বারবার মনের মধ্যে প্রণিপাত, তিনি চেয়েছেন বলেই আসতে পেরেছি, তিনি চাইলে তবেই ফিরতে পারব। এ এমন এক বন্যতা, যা চেতনাকে কিনারায় নিয়ে রাখে। যে-কোনও মুহূর্তে যা কিছু ঘটতে পারে। বেঁচে থাকতে পারি নাও পারি, এ’কথা রিংরিং করে মনের মধ্যে অনর্গল। এই রূপশালী প্রকৃতির কী ছেড়ে কী দেখি, কাকে যে দেখি। দুরূহ রাস্তা পেরোবার কিছু কানুন আছে, যা জানা ছিল না, অবস্থার ফেরে পড়ে বুঝলাম। যেমন এতটাই বেয়াড়া বাঁক কোথাও, যে সওয়ারিসমেত ঘোড়া নিয়ে এগোনোর প্রশ্ন ওঠে না, নামতেই হয়। তারপর সহিস ঘোড়া সামলে এগিয়ে যায়, গিয়ে দাঁড়ায় অপেক্ষাকৃত সুবিধেজনক জায়গায় আর মোক্ষম চ্যালেঞ্জে পড়ে যাত্রী। আসলে সরু যে পথে হেঁটে এগোচ্ছি, উলটোদিক থেকে সে পথেই আসছে ঘোড়া। হাজারো হাজারো ঘোড়ার বর্জ্য, বরফ গলা জল, ঝিরঝিরে ঝরনার উড়তি কণা, খাদ, কখনও পায়ের গোছ অবধি ডুবে যাওয়া তুষারপথ সামলে এগোনো। এই মাপের দুরূহ অবস্থা ভাবতে পারিনি বলেই ফেলে মারার শাস্তি জুটেছে মনে হয়। ছাড়ান নেই। পেরোতে হবে মানে হবেই।

স্বপ্নের নানারূপ

কেঁদে ককিয়ে, আধো বেঁচে আধো মরে একসময় পৌঁছে গেলাম শেষনাগ। ওটুকু অপারগতা বাদ দিলে সহিসকে পাই যে-কোনও অবস্থানে, যে-কোনও অবস্থায়। এখানে জীবন-মৃত্যুর চুল পরিমাণ ফাঁকের মধ্যে ঘোড়াওয়ালার ছড়ি-লাগামই ভরসা। ঘোড়া নিশ্চিন্তে পিছলোচ্ছে আর সওয়ারি সহিস-ভরসায় বিন্দাস। সে দায় তার, সওয়ার ও সওয়ারি দু’জনের। কীভাবে সে পারছে জানি না তবে অমরনাথের পথে এ আর এক দর্শন ‘অমরাথের’। নিজেকে শতধায় তিনি ছড়িয়ে রেখেছেন সর্বত্র!

এগিয়ে যাচ্ছি এগোতে হবে বলেই। ভাণ্ডারায় ঢোকার অবকাশ নেই, থাকব পঞ্চতরণীতে। উষ্ণ খাবার সেধে সেধে দিচ্ছে তারা সারাক্ষণ। এমনকী ঘোড়ায় চড়ে যখন এগোচ্ছি, দৗড়ে এসে কেউ ফ্রুটজুস ধরিয়ে গেল তো পাশের ভাণ্ডারার মানুষ দিয়ে গেল লাঠি, কেউ রুদ্রাক্ষ। পূণ্যের এই সেবাদানী ব্যাখ্যায় ও পার্থিব প্রাপ্তিবিহীন উদ্যোগে আপ্লুত মন আর্দ্র হয়েছে শতবার।

রূপের খনি

বেলা গেছে, বিকেলও ফুরোতে চলল। এসে গেছি শুদ্ধি-লোভে সবুজ জলের কোলে। এ কোল পাতা আছে অমরনাথ গুহার ৬ কিমি আগে। তুষারলিঙ্গের কাছে পৌঁছোনো যদি একটা লক্ষ্য হয়, তবে পৌঁছোতে যতগুলি উপলক্ষ্য, অমরনাথ তার সবটা জুড়ে আছেন নিজেকে একশো ভাগে ভেঙে। এমনই এক ছোট্ট ভাগের নাম- পঞ্চতরণী। সৌন্দর্যে, বন্যতায়, আবহাওয়ার আনপ্রেডিক্টেবল ধাঁচধরণ নিয়ে তার উপস্থিতি তীব্র, স্বনিয়ন্ত্রিত।  গা থেকে বচ্ছরকার বরফ খসিয়ে ফেলে এই ফুটে ওঠার মাঝে দেড়মাস কেটে গেছে, তবু আদিম ভাব তার এখনও সোচ্চার। এখানে রাত কাটাতে হবে ভেবেই ভিতরে ধুকুরপুকুর ভয়। চারিদিকে প্রচুর তাঁবু, তবু মাথায় ছাউনি তাদের কোনওটা নীল, কোনওটা সবুজ, কমলা, লাল। পাহাড় জুড়ে বরফ, পাদদেশে তার সবে জন্মানো কাঁচাসবুজ গুল্ম, তিরতিরে সোঁতার ওপর কাঠের সাঁকো আর রাজকীয় গরিমায় পঞ্চতরণীর শ্রেষ্ঠ মহিমা হয়ে টলটলাচ্ছে স্বপ্নসবুজ জল। এই ঐশ্বরিক সৌন্দর্য শুধু উপলব্ধির। কীসের টানে আমি এখানে তার উত্তর প্রতি পরতে সাজিয়ে বসে আছে চরাচর। না এলে অপূর্ণ জীবন।

বেছেবুছে তাঁবুতে

পৌঁছে গেছি। এবার বেছেবুছে একটা তাঁবুতে উঠলাম। হ্যাঁ, ঠিকই, বেছেবুছে। এই যে বললাম, শেষের দিকে আসার সুফল ফলতেঞ্জশুরু করেছে।ঞ্জএক-একটা তাঁবুতে কম করে বারো থেকে ষোলোটি শোবার জায়গা, অথচ কোথাওই দু’তিন জনের বেশি নেই। আমরা খুঁজেপেতে পুরো খালি একটাই চাইলাম, হয়েও গেল ব্যবস্থা। আহা, তারপর থেকে শুধু শীতে জবুথুবু কাঁপা, আর প্রকৃতিতে তাকিয়ে তাকিয়ে আনমনা হওয়া। ব্যস। এরই মধ্যে শরীরে ঠান্ডা আর অন্তরে রূপময় প্রকৃতির দাপট সইয়ে নিয়ে অন্দরে ফিরে চাইলাম। এক কোণায় একটা ব্যাটারি-হারিকেন আর পায়ের তলায় বিছানো খড়ের ওপর সারসার খাটিয়া। তবু যাহোক ঠিকঠাক এখানটা। কিন্তু পঞ্চতরণী থেকে অমরনাথ যেতে যেসব তাঁবু, তা সোজাসুজি বরফের ওপর পাতা। ভাবতেই পারলাম না মানুষ থাকল কী করে- তা সে যতই খড় বিছানো ঘর আর স্লিপিং ব্যাগের ওম হোক।

ভেতরে এসেও মন বসছে না। সূর্য ঢলছে, দিন পালাচ্ছে। মোটে একটা রাতের থাকায় কী জানি কী মিস করছি, অপার্থিব কিছু কি হারাচ্ছি? বাইরে বেরোলাম। সরু, পাথুরে পথে পাহাড়ি ঝরনা খেলছে, পা ফেলছি সতর্ক হয়ে। আচমকা কোনও বাঁকে সবুজরঙা জল দেখা দিয়েই মেলাচ্ছে, তারপর হঠাৎই একসময় টন টন বরফের মাঝে পান্নারঙা আলো, পৗঁছে গেছি স্বপ্ননদীর কাছে। হূদকোরকে কাঁপন, বুঝতে পারছি- ফুল ফুটছে। পাহাড় পাহাড় বেয়ে ধারা। স্রোতস্বিনী নামতে নামতে তুষার সোঁতায় বদলে গিয়ে মিশছে জলে, চুড়োর খাঁজে-ভাঁজে আটকে যাচ্ছে চারু মেঘের দল। জল আয়নায় পাহাড়ের প্রতিচ্ছবি আর বাস্তব চোখের আঙিনায় সিধেসাদা পরমেশ। কাকে দেখি! ছায়ামায়ার মুখ না বাউলিনি বিউটি এই ভাবতেই বেলা গেল। হু-হু ঠান্ডা হাওয়া যে কোথা থেকে আসছে ধেয়ে কে জানে।

আকাশ-পাহাড়-লেক ছাপিয়ে নজর গেল নীচের সাঁকোয়, সে একলা ভিজছে, ওপর দিয়ে ছোটো ছোটো ঢেউয়ের তিরতিরে জল অনর্গল।

দেখব ভিতরপুরে

ঘোড়াওলা ভোর পাঁচটায় আসবে বলে গেল, তাড়াতাড়ি বেরোতে চায়। অমরনাথ ঘুরে পঞ্চতরণীতে আমাদের রেখে ওরা সেদিনই ফিরবে। ফিরব আমরাও। হেলিকপ্টারে বালতালের পথে। এবার ঘুমোবার আপ্রাণ চেষ্টায় কাটল সারারাত। কী যে অস্বস্তি, কেন যে চারটে কম্বলের নীচেও কাঁপছি কে জানে। ‘চলো বহেনজি’ শুনে ধড়মড়িয়ে বাইরে এলাম। ঝকঝকে আকাশে তখনও তকতকে তারার মেলা। জমে যাচ্ছি ঠান্ডায়। টর্চের আলোয় দেখি কাঁধের কাছ থেকে ছিঁড়ে পরা লতপতানো সোয়াটারের তরুণ সহিসটি হাস্যমুখের আহ্বানে। প্রসন্ন হয়ে উঠল মন। বেরোলাম গায়ে শীত-তাড়ুনি একশো জগঝম্প চাপিয়ে।

এখন সবাই ফিরতি পথের যাত্রী- দর্শন শেষে নামছে আর আমি যাচ্ছি উজানে, ফাঁকার মজা নেব বলে। অনেকে বলেছিল এত দেরিতে গিয়ে কী পাবে? তুষারলিঙ্গ গলে যাবে, মিথ্যে কষ্ট করা। কিন্তু কেন? লেক-পাহাড়ের কিনারায় গজিয়েছে সবুজ ঘাস, একই ছাঁটে বেড়েছে তার মাপসই রেখা। বছরভরের বরফ-ঢাকা পাহাড় মোটে দেড় মাসের রোদ-সোহাগে যে সবুজের জন্ম দিল, সে দৃশ্য কিছু না? সাঁকোর জলখেলার দিকে চেয়ে-চেয়ে আমার যে চোখ ঝাপসা হচ্ছে, এটা কিছু না? দোকান-বিক্রেতার থেকে ফুল-নৈবিদ্য কিনে পুজো দিচ্ছে অমরনাথের। এটা উদ্দীপনার না? কেন ছোটো করে নেব আমার পাওনা-গণ্ডার হিসেব? হয়তো তুষারলিঙ্গের কাছে এমনই কোনও বৈভব লুকিয়ে আছে অপেক্ষায়, সেটাই দেখব… যা সবার নজরে এল না। এই ছড়িয়ে থাকা একশো ‘অমরনাথ’-এর টানই আমায় অমরনাথ-এ এনেছে।

গান্ডিকোটা ও বেলাম

যারা আপশোশ করছেন আরিজোনার গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন যেতে পারছেন না বলে– তাদের দুঃখ ঘোচাবে, ভারতেরই একটি অপূর্ব জায়গা, যা সৌন্দর্যে পাল্লা দিতে পারে গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের সঙ্গে। অন্ধ্রপ্রদেশের কাডাপা জেলার অন্তর্গত গান্ডিকোটা, প্রকৃতির এক অপরূপ সৃষ্টি।

তবে শুরুতেই বলে নেওয়া ভালো যে, গান্ডিকোটা পৌঁছোনো একটু কঠিন, কারণ এর যোগাযোগ ব্যবস্থা একেবারেই অনুন্নত। একমাত্র বেঙ্গালুরু, চেন্নাই বা হায়দরাবাদ থেকে গাড়িতে পৌঁছোনো যাবে গান্ডিকোটা। এই সফরের অন্যতম পাওনা, বেলাম গুহা, গান্ডিকোটা ফোর্ট ও গুটি ফোর্ট দর্শন।

যারা ট্রেনে আসতে চান তারা তাডিপাট্রি, গুটি বা গুনটাকাল-এ নামতে পারেন। তবে তাডিপাট্রি বা

গুনটাকাল-এ কোনও হোটেল নেই। সেক্ষেত্রে গুটি নামাটাই বুদ্ধিমানের। গুটি থেকে গাড়িতে গান্ডিকোটা ফোর্টের সামনে অন্ধ্রপ্রদেশ ট্যুরিজম ‘হারিথা’-এ থাকার ব্যবস্থা করতে পারেন।

আমরা গুটি থেকে সকাল সকাল রওনা হলাম গাড়িতে। মোট তিনটি জেলা ছুঁয়ে শুরু হল যাত্রা। গুটি অনন্তপুরের অন্তর্গত, বেলাম, কুর্নুলের মধ্যে আর গান্ডিকোটা কাডাপা জেলায়। এটি অন্ধ্রপ্রদেশের শুষ্কতম অঞ্চল।

গান্ডিকোটার নদীখাতের অদূরেই গান্ডিকোটা ফোর্ট, এই জেলাকে সুরক্ষিত করতেই এমন কূটনৈতিক ভাবে এটি নদীখাতের পাশে তৈরি করা হয়েছিল। ত্রয়োদশ শতাব্দীতে তৈরি এই কেল্লার বেশিরভাগটা ধবংশের কবলে। ভেতরে একটি মসজিদ ও ভিউপয়েন্ট রয়েছে।

‘গান্ডি’ অর্থাৎ নদীখাত এবং ‘কোটা’ মানে দুর্গ। চাণক্যদের রাজত্বকালে এর নির্মাণ। গান্ডিকোটাকে হাম্পির সঙ্গে তুলনা করা হয়ে থাকে। এর কারণ এর মধ্যে পাথরে নির্মিত মন্দির ভাস্কর্যগুলির সঙ্গে হাম্পির মিল পাওয়া যায়। একটি প্রবেশদ্বারে অবশ্য ইসলামিক শৈলীর সুস্পষ্ট ইঙ্গিত রয়েছে। গেটের দুধারে লোহার শলাকা, যাতে বহিরাগত শত্রুর হাতি না প্রবেশ করতে পারে। কেল্লার চারপাশে একাধিক ওয়াচ টাওয়ার।

ভিতরে এখনও অটুট রয়েছে একটি চারমিনার। পায়রা রাখার জন্য ব্যবহূত হতো এই ধরনের স্থাপত্যগুলি। এখন এখানে বহু পায়রার ভরাভর্তি সংসার। আর রয়েছে একটি বন্দিশালা। এর উঁচু প্রাচীর ও ছোটো ছোটো ভেন্টিলেটর দেখেই বোঝা যায়, সমস্ত রাজ্যের বন্দিদের এখানেই রাখা হতো। চৌহদ্দির ভিতরে স্থিত মাধবরায় স্বামী মন্দিরের অদূরেই বিশাল জলাধার। এখন এখানেই গ্রামবাসীরা পাম্প বসিয়ে সেচকার্য চালায়। বহু গ্রামবাসীর বসবাস এই কেল্লার মধ্যে। তাদের জলও যোগান দেয় এই জলাধার।

দুর্গের মধ্যে সবচেয়ে বর্ণাঢ্যপূর্ণ মাধবরায় স্বামী মন্দির। গোপুরম সমৃদ্ধ চারতলা বিশিষ্ট মন্দির। পিলারে ও সিলিঙে খোদাই করা কারুকাজ। ১৫ -১৬ শতকে রাজা কৃষ্ণদেব রায়ের সৃষ্টি। আরও আগে তৈরি জুমা মসজিদ। তিনটি আর্চ ও দুটি মিনার বিশিষ্ট কেল্লার অন্তর্গত এই মসজিদে, এখনও কিছু নকশা করা দেয়াল রয়ে গেছে। একটি শস্য ভাণ্ডার রয়েছে। কালের কবল থেকে কীভাবে এগুলি অক্ষত রয়ে গেল কে জানে, তবে কেল্লার অভ্যন্তর দেখে বোঝাই যায় এগুলি কতটা প্ল্যানিং করে করা হয়েছিল। রঘুনাথ মন্দিরেরও কিছু দেয়াল-ভাস্কর্য এখনও অটুট।

এসব দেখে ভিউপয়েন্টে যাবার জন্য পিচ্ছিল পাথরে পা রেখে যেতে হবে। বেশ কিছুটা ক্লাইম্ব করে ভিউ পয়েন্টে পৌঁছোলে নদীখাতের নিসর্গ চোখে ভেসে উঠবে। পাথুরে ল্যান্ডস্কেপের মাঝখানে এক অপরূপ পিকচার পোস্টকার্ড। যেন, নীচে পেন্না নদী। যারা গনগনি দেখেছেন, তারাও মানবেন গনগনি এর তুলনায় কিছুই নয়। একমাত্র গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের সঙ্গেই এর তুলনা চলে। চারপাশের সৌন্দর্য যেন জায়গাটাকে আরও রহস্যময় করে তুলেছে।

পরের দিন গাড়িভাড়া করে আমরা পৌঁছোলাম বেলাম গুহা। ভারতের দ্বিতীয় বৃহত্তম এই গুহা প্রায় ৩চ্চ্৯ মিটার দৈর্ঘ্যের। দেড় ঘন্টা লাগে ঘুরে দেখতে। গুহার প্রথম অংশে একটি বড়ো হল, সেখানে একসময় বৌদ্ধ ভিক্ষুরা প্রার্থনা করতেন। তারপর একটি প্রবেশদ্বার। স্ট্যাল্যাকটাইট পাথরে যেন তিনটি সিংহের মুখ তৈরি হয়েছে। আরও ভেতরে শিবলিঙ্গের মতো কিছু আকৃতি। এরপর একটি অংশে পৌঁছোলে স্ট্যালাকটাইট পাথরের কিছু স্ট্রাকচার যার দ্বারা সৃষ্টি হয়েছে সপ্তসুর। কাঠ দিয়ে বাজালে শোনা যায়। এ এক প্রাকৃতিক বিস্ময়।

কিছু কিছু অংশে হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকতে হয়। পাথুরে সিলিং-এর একটি অংশে যেন সহস্র ফণাবিশিষ্ট একটি গোখরো সাপ। কোথাও আবার অজস্র ঝুরি সমেত একটি পাথুরে বটবৃক্ষ। প্রাকৃতিক ভাবে তৈরি এসব ভাস্কর্য সত্যি অবাক করে। গুহার গভীরতম স্থানে একটি জলস্রোত, যার নাম পাতালগঙ্গা। এই অপূর্ব ভ্রমণ মুখে বর্ণনা করার নয়, দেখে বিস্ময়ে মুগ্ধ হবার।

সিংহলের প্রাচীন রাজধানী

ছোটোবেলায় শুনেছিলাম রামেশ্বরমের সমুদ্রপাড় থেকে ধনুষ্কোটির সেতুর ওপর দিয়ে হেঁটে পাকপ্রণালী পার হয়ে এককালে যাওয়া যেত ভারত থেকে সিংহলে। সেই রাস্তার পুনর্নির্মাণ হয়নি, সড়কপথে দুই দেশের মধ্যে যোগাযোগ আর বাস্তাবায়িত হয়নি। তাই আকাশপথেই কলকাতা থেকে পৌঁছেছি কলম্বোর বন্দরনায়েকে বিমানবন্দরে। তারপর একদিন কলম্বো সফর করে চলেছি অনুরাধাপুরের পথে। দূরত্ব প্রায় ২০৬ কিমি। প্যাকেজ ট্যুর হলেও আমরা পাঁচজন নিজস্ব একটা গাড়ি ভাড়া করে নিয়েছি। লম্বা পথ, একবার শুধু কার্তিক মন্দিরে নেমে দর্শন করে আবার এগিয়ে চলেছি। পথে সে রকম দর্শনীয় কিছু নেই– ফাঁকা মাঠ, মাঝে মাঝে চাষের খেত, গাছপালা, গ্রাম, আধাশহর। সঙ্গে আনা শ্রীলংকা সম্পর্কিত তথ্য পুস্তকগুলিতে মনোযোগ দিই।

শ্রীলংকার ইতিহাসে খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতক খুবই গুরুত্বপূর্ণ কারণ এই সময় দেশে ভগবান বুদ্ধের পদার্পণ ঘটে আর এই ঘটনাই দেশের সভ্যতা প্রসারের ভিত্তি। কথিত আছে আরও আগে খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে ভারত থেকে বিতাড়িত হয়ে রাজকুমার বিজয়, শ্রীলংকায় আসেন আর এই দ্বীপের প্রথম রাজা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হন। সেইসঙ্গে প্রতিষ্ঠা করেন সিংহলী জাতিকে। প্রথম সিংহলী রাজত্ব খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতকে এই অনুরাধাপুরের কাছেই প্রতিষ্ঠিত হয়। অনুরাধাপুরের ধবংসাবশেষ দক্ষিণ এশিয়ার এক এমনই আকর্ষণ যা স্মৃতিকে অনেক প্রাচীন সভ্যতার কথা মনে করিয়ে দেয়।

অনুরাধাপুরের এই বিশাল চত্বর জুড়ে পুরাতাত্ত্বিক ও স্থাপত্যশিল্পের অতুলনীয় সমষ্টি। কখনও দেখা যাবে স্তূপ (দাগোবা), বিশাল আকৃতির ইটের স্থাপত্য, প্রাচীন পুষ্করিণী বা ভগ্ন মন্দির যা কয়েক হাজার বছর আগে অনুরাধাপুরে শ্রীলংকার রাজাদের শাসনের সময় নির্মিত। আজকের দিনেও তার অনেকগুলি যেন জীবন্ত! কখনও পবিত্র বা ধার্মিক স্থান হিসাবে মানুষের সমাগম হচ্ছে। মন্দিরে পূজা বা নানা উৎসবে মানুষের মনে স্পন্দন জাগাচ্ছে।

পান্ডুকাভায়ার রাজত্বকালে অনুরাধাপুর, সিংহলের প্রথম রাজধানী হয়। সেটা ৩০০ খ্রিষ্টপূর্ব। কিন্তু দেবনামপিয়া টিসার রাজত্বকালে  বৌদ্ধ ধর্মের প্রচার সিংহলে শুরু এবং সামাজিক জীবনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ স্থান ধারণ করে। কয়েক বছরের মধ্যেই অনুরাধাপুর সমৃদ্ধির পীঠস্থান হয়ে ওঠে। কিন্তু দক্ষিণ ভারতীয় রাজাদের হাতে তার পতন হয়। এই ঘটনা হাজার বছরের মধ্যে বার বার ঘটেছে। কিন্তু ডুটুগেমুনু তার গুপ্ত আশ্রয়স্থল থেকে একদল সৈন্য জোগাড় করে তাদের সাহায্যে আবার অনুরাধাপুর পুনরুদ্ধার করেন। ডুটুগেমুনু তার রাজত্বকালে অনেক গুরুত্বপূর্ণ স্থাপত্য নির্মাণ করেন, যা আজকের দিনেও বর্তমান। এর পরবর্তীকালের গুরুত্বপূর্ণ রাজাদের মধ্যে রয়েছেন ভালাগাম্বা যিনি দক্ষিণ ভারতীয় রাজাদের আক্রমণে সিংহাসন হারান কিন্তু আবার তা পুনরুদ্ধার করেন। অনুরাধাপুরে শেষ মহান রাজা ছিলেন মহাসেনা যার আমলে জিতবনরামা দাগোবা বা স্তূপ নির্মিত হয়। এছাড়া পুষ্করিণী ও একটি ক্যানেল কাটানোর তিনি ব্যবস্থা করেন। কিন্তু ক্রমাগত দক্ষিণ ভারতীয় আক্রমণের ফলে রাজধানী, দেশের আরও অভ্যন্তরে পোলোনারুয়ায় স্থানান্তরিত হয় এবং অবশেষে ক্যান্ডিতে স্থাপিত হয়। এই অনুরাধাপুর, পোলোনারুয়া, ক্যান্ডি স্থানগুলি পরস্পরের সঙ্গে সরলরেখায় যুক্ত করলে যে ত্রিভুজ তৈরি হবে তাকে সাংস্কৃতিক ত্রিভুজ বলে আখ্যা দিয়েছে ইউনেস্কো। শ্রীলংকা ছোটো দেশ হলেও এখানে রয়েছে সাত-সাতটি ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট।

এই সব হেরিটেজ সাইটে যেমন জীবন্ত মানুষ তথা বৌদ্ধ ভিক্ষুদের অস্ফুট ধর্মীয় উচ্চারণ ধবনি শোনা যায় তেমনই প্রাচীন ইটের মন্দির, পাথরের মূর্তি, বিশাল স্তূপগুলির স্থাপত্য ও ভাস্কর্য আধুনিক মানুষকে মুগ্ধ করে, মনে স্পন্দন জাগায়। এই হেরিটেজ সাইটগুলির মাধ্যমে ফিরে যাই সেই প্রাচীন যুগে যেখানে পরপর ছায়াছবির মতো ফুটে ওঠে কালক্রমে একের পর এক দৃশ্যাবলী– বৌদ্ধ ধর্মের শুভ সূচনা, যার অনুপ্রেরণায় রাজাদের নির্মিত নানা বিস্ময়কর নির্মাণকল্প, রাজসভায় নানা চক্রান্ত, বারবার বিদেশি শত্রুর আক্রমণ এবং অবশেষে ইউরোপীয়দের হাত থেকে স্বাধীনতা অর্জন।

ইতিমধ্যে আমরা অনেকটা পথ চলে এসেছি। রাস্তার ধারে এক মহিলা ডাব বিক্রেতাকে দেখে তৃষ্ণাটা আরও বেড়ে গেল। গাড়ি থামিয়ে অনেকেই ডাবের জল পানে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। ডাবের দাম অবশ্য কম নয়, ডাব প্রতি সত্তর রুপি।

অবশেষে পৌঁছোলাম অনুরাধাপুরে। বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে ছড়িয়ে আছে প্রাচীন অনুরাধাপুরের সমৃদ্ধির ঐতিহাসিক নিদর্শন। ভারতের বাইরে এই সিংহলেই মৌর্যসম্রাট অশোক বৌদ্ধধর্ম প্রচার শুরু করেন।  তবে আংশিক দেখার টিকিট আলাদা মূল্যেও পাওয়া যায়। এছাড়া এ ধরনের ঐতিহাসিক স্থান ভ্রমণে একজন অভিজ্ঞ গাইডেরও প্রয়োজন। আমাদের গাড়ির ড্রাইভার ও টুর গাইড হেমন্ত অবশ্য তৎপরতার সঙ্গে জোগাড় করে আনল ফিল্মস্টার মার্কা চেহারার এক গাইড নাম তার জগৎ। গেট দিয়ে ঢুকে বিশাল চত্বরের মধ্যে দিয়ে আমরা এগিয়ে চলি বোধিবৃক্ষের দিকে। যেতে যেতে নজরে আসে জাপানি অর্থ সাহায্যে নির্মিত এক লাইব্রেরি ও মিউজিয়াম। সালে উদ্ঘাটিত এই মিউজিয়ামের দরজা কিন্তু বন্ধ ছিল।

আর একটু এগিয়েই ফুল বিক্রেতারা বসে আছে। সবাই পথ্বফুল বিক্রি করছে। বোধিবৃক্ষের তলায় এই পথ্বফুল উৎসর্গ করার জন্যই বোধহয় অনেকে কেনাকাটা করছে। আমাদের গাইড জগৎ বলতে শুরু করে– দর্শনার্থীরা যেদিকে যাচ্ছে ওই বৃক্ষটিই হল বোধিবৃক্ষ বা শ্রীমহাবোধি। গৌতম বুদ্ধ যে-গাছের নীচে ধ্যানমগ্ন হয়ে মহানির্বাণ লাভ করেন, পিতার নির্দেশে সেই ‘বো’ বৃক্ষের একটি চারা সংগ্রহ করে সিংহলে নিয়ে এসেছিলেন সম্রাট অশোকের কন্যা সংঘমিত্রা। অশোকের পুত্র মহেন্দ্র অনুরাধাপুরের রাজা দেবানামপিয়াতি সসাকে বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষিত করে এই চারাটি উপহার দেন। তারপর এই পবিত্র বৃক্ষটি মহাসমারোহে রোপন করা হয়। তারপর অনুরাধাপুর একাধারে হয়ে ওঠে রাজধানী-শহর ও বৌদ্ধধর্মের পীঠস্থান। অনেক বৌদ্ধস্তূপ, মনাস্ট্রি, জল সরবরাহের জন্য পুষ্করিণী ইত্যাদি নিয়ে সমৃদ্ধ হয় এই শহর।

এরপর বারবার বহিঃশত্রুর আক্রমণে অনুরাধাপুরের পতন হয়। পেলোনারুয়ায় নতুন রাজধানী স্থাপন হয় আর অনুরাধাপুর ঢেকে যায় গভীর জঙ্গলে। ঊনিশ শতকে ইংরেজ আমলে জঙ্গল পরিষ্কার করে অনুরাধাপুরে ঐতিহাসিক শহরের সন্ধান মেলে। এটি এখন বিশ্ব ঐতিহ্যশালী স্থানের মর্যাদা পেয়েছে।

 

আমরা বোধিবৃক্ষের কাছে পৌঁছে গেছি। এবার এগোতে হলে জুতো খুলতে হবে। গাইড মহাশয় অনুরোধ করলেন যে যারা জুতো দেখভাল করছে তাদের যেন অন্তত ২০ টাকা মাথাপিছু টিপ্স দেওয়া হয়। বোধিবৃক্ষ বেশ বড়ো একদিকে হেলে পড়েছে। এই গাছের ডালগুলি এখন সোনার পাতে মোড়া ঠেকার সাহায্যে রক্ষা করা হচ্ছে। গাছের চারদিক ঘিরে রাখা হয়েছে, একেবারে কাছে কাউকে যেতে দেওয়া হয় না। এই বোধিবৃক্ষই এখন বিশ্বের সব চেয়ে প্রাচীন বৃক্ষ বলে পরিগণিত হয়।

গাছের পাটাতনে উঠতে সিঁড়ি রয়েছে তা খুবই প্রাচীন তবে গাছকে ঘিরে যে সোনালি রেলিং রয়েছে তা আধুনিক কালের। এই রেলিংগুলি পুণ্যার্থীরা রঙিন কাপড় ও প্রার্থনা পতাকা দিয়ে সাজিয়ে দেয়। তারপর বোধিবৃক্ষের নীচে পূজা নিবেদন করে। এখানে এপ্রিল ও ডিসেম্বর মাসের পূর্ণিমাতে পুণ্যার্থীদের সবচেয়ে বেশি ভিড় হয়। বৃক্ষের পাদমূলে ছোটো মন্দির, সেখানে রয়েছে ছোটো ছোটো বুদ্ধমূর্তি। বোধিবৃক্ষের পিছনে একটি সাদা রং-এর মন্দির সদৃশ স্থাপত্য তার ভিতরে নানা রং-এ রঞ্জিত কয়েকটি বুদ্ধমূর্তি। মার্বেল পাথরের মেঝেতে বসে ভক্তরা বুদ্ধকে অন্তরের ভক্তি প্রণাম নিবেদন করছেন। সামনে নানা রং-এর পথ্বফুল বুদ্ধের চরণে নিবেদন করা হচ্ছে।

মন্দিরের দেয়াল বুদ্ধের নানা ভঙ্গিমার ছবিতে সজ্জিত। বোধিবৃক্ষ ও সংলগ্ন অঞ্চলটি অনুরাধাপুরের হূদয় বলা চলে। এখানে নানা ধর্মীয় অনুষ্ঠান হয়। দলে দলে মানুষ সুন্দর পোশাকে সজ্জিত হয়ে এখানে প্রণাম নিবেদনের জন্য একত্রিত হয়। নানা ধরনের পশরা নিয়ে বিক্রেতারা হাজির। বিক্রি হচ্ছে ফল-ফুল, হালকা খাবার, খেলনা ঠিক যেন মেলার পরিবেশ।

 

বোধিবৃক্ষ অঞ্চল ছেড়ে পাদুকা উদ্ধার পর্ব (অর্থাৎ টিপ্স দিয়ে জুতো নিয়ে) শেষ করে ঘাসজমির মধ্যে দিয়ে হাঁটতে থাকি। কয়েকটি একই প্রজাতির সুন্দর দেখতে পাখি ঘাসের মধ্যে থেকে পোকা খুঁটে খাচ্ছে। ছবি তুলতে কোনও অসুবিধাই হল না। গাইড পাখির নামটা জানালেও পরে ভুলে গেছি। একটু এগিয়ে দেখতে পেলাম সারি সারি পাথর নির্মিত বড়ো বড়ো স্তম্ভ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। জগৎ জানাল এটাই ব্রাজেন প্যালেস। এখানে ১ছঙ্মঙ্মটি পাথরের স্তম্ভ আছে। এর মাথায় ব্রোঞ্জের ছাদ ছিল বলেই নামকরণ ব্রাজেন প্যালেস। এই স্তম্ভগুলি ছাড়া সেকালের প্রসিদ্ধ নয়তলা বিশিষ্ট অট্টালিকার আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। এখানেই বাসস্থান ছিল এক হাজার বৌদ্ধ ভিক্ষু ও তাদের সহচরদের। সম্রাট অশোকের পুত্র মহেন্দ্র তার সিংহল সফরে এই রাজপ্রাসাদেই বসবাস করতেন। এই রাজপ্রসাদটি প্রথমে নির্মাণ করেন রাজা ডুটুজেমুনু দু-হাজার বছরেরও আগে। কালের গ্রাসে তা বার বার ধবংসের দিকে এগিয়ে গেলেও পুনর্নির্মাণ হয়েছে। কিন্তু আস্তে আস্তে কমেছে তার জাঁকজমক। বর্তমানে তারের বেড়া দিয়ে ঘেরা এই প্রাসাদ।

এবার গাড়িতে করে এগোতে থাকি গাইডের নির্দেশে। বাঁদিকে পড়ল একটি বিরাট প্রাকৃতিক জলাশয়– নাম তার অনুরাধাপুর লেক। লেকের ধারে গাছপালা বিক্ষিপ্ত ভাবে বেড়ে উঠেছে সৗন্দর্যায়নের প্রচেষ্টা সেরকম ভাবে চোখে পড়ল না। কয়েকটি ছবি তুলে আবার এগিয়ে চলি। গাড়ি থামে থুপারামা স্তূপের সামনে। চারপাশে গাছপালা ঘেরা সাদা রং-এর এক অতি সুন্দর স্তূপ। চারধারে চারটি গেট, স্তূপ ঘিরে রয়েছে সবুজ লন ও ফুলের বাগান। থুপারামা স্তূপটি (দাগোবা) শ্রীলংকার তো বটেই পৃথিবীর মধ্যে অন্যতম প্রাচীন স্তূপ বলে স্বীকৃত।

আরও তথ্য জোগাল জগৎ– খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতকে রাজা দেবনামপিয়া এটি নির্মাণ করেন। অনেকের মতে বুদ্ধের দেহের একটি অস্থি এখানে সংরক্ষিত আছে। বর্তমানে ঘন্টার আকৃতির এই স্তূপ তার এই বর্তমান আকৃতি লাভ করে। তার আগে এটি ধানের গোলার আকৃতি ছিল। স্তূপটি এক কেন্দ্র বিশিষ্ট চারটি বৃত্তে পিলার দিয়ে ঘেরা। ঐতিহাসিকরা পিলারের উপস্থিতি নির্ধারণ করলেও বর্তমানে মাত্র ৪রটি উপস্থিত আছে। ঐতিহাসিকরা এই স্তূপের মাথায় কাঠের কৌণিক একটি ছাদও কল্পনা করেন কিন্তু কোনও পুরাতাত্ত্বিক প্রমাণ তার স্বপক্ষে পাওয়া যায়নি।

যুপারামা স্তূপের পরই অভয়গিরি স্তূপ। অভয়গিরির অর্থ হল গিরির অভয় অর্থাৎ পাহাড়ের সুরক্ষা। তাঁর লেখনী থেকে অনেক তথ্যই সংগ্রহ করা যায়। বার বার এই স্তূপ নির্মিত হয় এবং সবশেষে তার উচ্চতা দাঁড়ায় ৭৫ মিটার। পশ্চিম দ্বারপ্রান্তে রয়েছে একটি হাতি গাছ টেনে আনার মূর্তি। উত্তর দিকের দ্বারপ্রান্তে যে পদচিহ্ন রয়েছে, সেটি বুদ্ধের পদচিহ্ন বলে কথিত। পূর্ব দিকের দ্বারপ্রান্তে রয়েছে মুনস্টোন। রাজা ওয়ালাগাম্বারা নির্মিত এই স্তূপের নাম অনেক, অভয়গিরি ছাড়াও উত্তরা মহাচেতা, অপহাইয়াগরা, ভাগিরিনাকা, বায়াগির্যা প্রভৃতি।

সেই প্রাচীন কাল থেকে এই স্তূপের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পালন করেছেন সেখানকার শাসকেরা যেমন গজবাহু, মিত্তসেনা, কাসাপা ৪, পরাক্রমবাহু প্রভৃতি। বর্তমান কালের এই স্তূপের রূপ ও পূর্বের রূপের বিশাল ছবি স্তূপের কাছেই শোভা পাচ্ছে।

অভয়গিরি স্তূপের উত্তর পশ্চিম দিকে নবম শতকের আমলের বৌদ্ধ ভিক্ষুদের জন্য নির্মিত বাসস্থানের ভগ্নস্তূপের সামনে আমরা উপস্থিত হয়েছি। এর খ্যাতি এখানে মুনস্টোনের উপস্থিতির কারণে। চারদিকে সবুজ প্রকৃতির মধ্যে এই ভগ্নস্তূপ। প্রবেশ পথের কাছে রাস্তার ধারে স্থানীয় হস্তশিল্পের দোকান রয়েছে কয়েকটি। দু-চারজন টুরিস্টের দেখা পাওয়া গেল তবে সবাই বিদেশি। ভিক্ষুদের এই আশ্রম পিবিভেনা প্রাসাদ অথবা আরামা নামেও পরিচিত। সামনে একটি প্রধান বাসগৃহ। চারকোণে ছোটো আকারের বাসস্থান। এখানে জলের ও স্নানঘরের ব্যবস্থাও ছিল। সিঁড়ির মুখেই এক আশ্চর্য সুন্দর মুনস্টোন। মুনস্টোন হল অর্ধচন্দ্রাকৃতি পাথরের টুকরো যার গায়ে অর্ধবৃত্তাকারে কারুকার্য করা রয়েছে। সেকালের ভাস্কর্যশিল্পের গৗরবের স্বাক্ষর বহন করছে এই নিদর্শন অর্ধচন্দ্রাকৃতি চন্দ্রকান্ত মণি। এক একটি সারিতে এক এক রকমের নকশা– অধিকাংশই ফুল লতা-পাতা ও জীবজন্তুর। এই পাথরটির ব্যাস প্রায় ৯ ফুট এবং সমালোচকদের মতে এই সব কারুকার্যের জীবনযাত্রার পরিপ্রেক্ষিতে এক অন্তর্নিহিত অর্থও রয়েছে। অভয়গিরি স্তূপের ঠিক দক্ষিণে অভয়গিরি মিউজিয়াম। খোলা থাকে সকাল ১০ থেকে  বিকেল ৫টা পর্যন্ত। চিন দেশের অর্থানুকুল্যে নির্মিত এই মিউজিয়াম।

পঞ্চম শতাব্দীতে চৈনিক পরিব্রাজক ফা-হিউয়েন-এর ভ্রমণের স্মারক হিসাবে এই নির্মাণ। ফা-হিয়েন তাঁর ভ্রমণকালে এই অভয়গিরি মনাস্ট্রিতে কিছুদিন বসবাস করেন এবং কিছু পুঁথির অনুবাদের কাজও করেন যা তিনি কাজের শেষে চিন দেশে নিয়ে যান। এই মিউজিয়ামে রাখা আছে বিভিন্ন সাইটে প্রাপ্ত ঐতিহাসিক প্লেট, অলংকার, বাসনপত্র, ভাস্কর্যের নমুনা। অনেকক্ষণ ঘোরাঘুরি করে ও লম্বা সফরের ধকলে আমরা একটু ক্লান্ত হয়ে পড়েছি সেটা বোধহয় বুঝতে পেরে গাইড উৎসাহ দেয়, আরও অনেক কিছু দেখার আছে। অনুরাধাপুর দর্শন এত তাড়াতাড়ি ফুরিয়ে যাবে না। মুনস্টোন তো দেখলেন এবার দেখুন গার্ডস্টোন। একটি প্রাঙ্গণে অনেকগুলি খাড়া খাড়া পাথরের স্তম্ভ দেখিয়ে বললেন, ‘এ গুলো হল গার্ডস্টোন মন্দিরের চারধারে সব সময় নির্মাণ করা হয়। মন্দির রক্ষার জন্য এগুলি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।’ এরপর দেখা হল ‘রত্নপ্রাসাদ’। নামেই রত্নপ্রাসাদ এখন এই গার্ডস্টোন ছাড়া কিছুই অবশিষ্ট নেই।

মুনস্টোন, গার্ডস্টোন দর্শন শেষে অভয়গিরি স্তূপের পূর্বদিকে খোলা মাঠের মধ্যে দিয়ে হাঁটতে থাকি গাইডের নির্দেশে। জগৎ জানাল, আমরা শ্রীলংকার শ্রেষ্ঠ বুদ্ধমূর্তি দেখতে যাচ্ছি। খুবই আড়ম্বরপূর্ণ একটি মূর্তি দেখব বলে আশা করেছিলাম। কিন্তু খুবই সাধারণ পরিবেশে এক অসাধারণ মূর্তি দেখলাম। চতুর্থ শতকে নির্মিত ধ্যানরত বুদ্ধের এই পাথরের মূর্তি সত্যিই অনন্য। ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু ব্রিটিশ আমলে যখন কারাগারে অন্তরিন থাকতেন, তখন এই বুদ্ধমূর্তির ছবি সামনে রেখে মনের শান্তি ফিরে পেতেন।

 

আবার গাড়িতে ওঠা, তবে এবারও বেশি পথ নয়, তিন চার মিনিটের মধ্যে পৌঁছে গেলাম পরবর্তী গন্তব্যের সামনে। নাম তার কুট্টাম পাকুনা যার অর্থ জমজ পুষ্করিণী এই পুকুর দুটি অসাধারণ স্থাপত্য শৈলীতে সমৃদ্ধ। এখানে যেন সুকুমার শিল্পকলা ও বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তির মেলবন্ধন, সপ্তম থেকে অষ্টম শতাব্দীতে নির্মিত এই জোড়া পুষ্করিণী সম্ভবত অভয়গিরির বৗদ্ধ ভিক্ষুদের স্নানের জন্য নির্মিত হয়েছিল। নামে জমজ হলেও দক্ষিণ দিকের পুষ্করিণীটি অপেক্ষাকৃত বড়ো (র্ব২ ফুট দৈর্ঘ্য)। আর অন্যটি ৯১ ফুট লম্বা। আয়তক্ষেত্রকার পুষ্করিণী দুটির ঘাট সুন্দর ভাবে বাঁধানো এখনও প্রায় অটুট রয়েছে। বড়ো পুকুরটিতে জলের প্রবেশপথ একটি মকরমুখী গহ্বর দিয়ে তারপর মাটির তলার পাইপের মাধ্যমে ছোটো পুকুরে প্রবেশ করেছে। বর্তমানে পুকুরে সঞ্চিত জলের রং সবুজ। পুকুরের ঘাটে অল্পক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে আবার পরের গন্তব্যের দিকে রওনা হলাম।

পাশেই যেটা দর্শনীয় সেটা হল পাথরে নির্মিত ৩ মিটার লম্বা এক পাত্রবিশেষ। এই পাত্রে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের জন্য ভাত রান্না করে রাখা হতো। প্রায় ৫০০ ভিক্ষুর খাদ্য সংস্থানের ব্যবস্থা। ফিরে আসি আবার পুরাতত্ত্ব স্থলের কাছেই যেখানে রয়েছে ইটের বিশাল স্তূপ জেতবন বিহার। এই স্তূপ বর্তমানে ৭০ মিটার উঁচু। তবে নির্মাণকালে এটি ১০০ মিটার উচ্চতা ছুঁয়ে যায়। তখন এটি ছিল পৃথিবীর তৃতীয় উচ্চতম সৌধ, ইজিপ্টের পিরামিডের পরেই ছিল এর স্থান। জেতবন বিহার থেকে গাড়িতে ফিরে এলাম পার্কিং লটে তারপর সামান্য হেঁটে রুবানওয়ালি স্তূপের সামনে। এই স্তূপ নির্মিত হয়েছিল দুশো খ্রিষ্টপূর্বে। অর্ধগোলাকৃতি শুভ্র এই স্তূপের অন্দরে মার্বেল পাথরের মেঝে, সামনে তিনটি বুদ্ধমূর্তি। দীর্ঘকাল পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে থাকার পর ভগ্নদশায় পরিণত হয়। ইংরেজ আমলে এই স্তূপ পুনর্নির্মিত হয়। রাজা ডুটুজেমুনুর রাজত্বকালে এই স্তূপ নির্মিত হয়, যদিও জীবনকালে এই স্থাপত্য সম্পূর্ণ করে যেতে পারেননি। শত্রুর আক্রমণে বিধবস্ত হলেও বর্তমানে এই স্তূপের উচ্চতা ৫৫ মিটার। স্তূপটির পূর্বের চেহারা ছিল জলের বুদ্বুদের মতো। কিন্তু বর্তমানে পরিমার্জনের পরে সে রূপ আর নেই। এই রুবানওয়ালি স্তূপের চারপাশে সবুজ মাঠ, মাঝে মাঝে ধবংসস্তূপের চিহ্ন পাথরের ভাঙা পিলার, আর পুকুর বা জলাশয়ের চিহ্নও রয়েছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে।

এবার আমরা আজকের শেষ দ্রষ্টব্য অনুরাধাপুর পুরাতাত্ত্বিক সংগ্রহশালার সামনে। ব্রিটিশ যুগের প্রশাসনিক ভবনকে এখন সংগ্রহশালা হিসাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। তবে এই মিউজিয়াম দর্শনের সময় সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৫টা। ঘড়ির কাঁটা এখন ৫টা ছাড়িয়ে গেছে তাই আমাদের আর মিউজিয়াম দেখার সুযোগ হল না। তবে জগতের মুখে তার বিবরণ শুনে দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানো হল। এই মিউজিয়ামে আছে অনুরাধাপুর ও শ্রীলংকার নানা ঐতিহাসিক স্থানে প্রাপ্ত বিভিন্ন ধরনের শিল্পবস্তু, খোদাই করা নানা ভাস্কর্য এবং সেকালের দৈনন্দিন ব্যবহার্য বস্তুর সমাহার। অনুরাধাপুর দর্শন এখানেই শেষ।

গাইড জগৎকে ধন্যবাদ জানিয়ে তার প্রাপ্য মিটিয়ে দিয়ে জানালাম, আমরা মুগ্ধ। জগৎ গ্রামের ছেলে হলেও নিজের চেষ্টায় ইংরেজি শিখেছে। বই পড়ে ঐতিহাসিক তথ্যগুলিতে সমৃদ্ধ হয়েছে। তাই বিদেশি ভ্রমণার্থীদের তার সুন্দর উচ্চারণ ও বাচনভঙ্গি দিয়ে মুগ্ধ করে দিচ্ছে। জগৎ বিদায় নিলে আমাদের গাড়ি ছেড়ে দিল। আমাদের আজকের রাত্রিবাস অনুরাধাপুরের এক হোটেলে– ‘মেরিডিয়া লেক’।

যাত্রাপথে আমাদের ড্রাইভার হেমন্ত আর একবার গাড়ি থামাল। রাস্তার ধারেই বিশাল লেক, নাম নুয়ারাওয়া। এবারে হেমন্তই আমাদের গাইড। সে জানাল, এই লেকটি অনুরাধাপুরে পুর্ব দিকে অবস্থিত প্রায় ১২ বর্গ কিমি এলাকা জুড়ে রয়েছে। এই লেকের আর এক নাম নাকারা ভাপি। প্রস্তরলিপি থেকে জানা যায় যে এই লেক রাজা পান্ডুকাভারা খনন করেয়েছিলেন, খ্রিস্টপূর্ব ২০ সময়কালে। এর পরিমার্জিত রূপ বর্তমানে আমরা দেখছি। লেকের ধারের গাছ-গাছালির ফাঁক দিয়ে লেকের রূপ ধরে রাখলাম ক্যামেরায়।

হোটেল ‘মিরিডিয়া লেক’ মন্দ নয়। ঘরগুলি বেশ বড়ো ও সুসজ্জিত। আমাদের টুর প্যাকেজের শর্ত অনুযায়ী ডিনার এই হোটেলই ব্যবস্থা করবে। খাবার বেশ ভালো কন্টিনেন্টাল, চাইনিজ, শ্রীলংকার স্থানীয় মেনুও রয়েছে। আমরা বুফে সিস্টেমে ডিনার সেরে যে যার নিজের নিজের ঘরে চলে গেলাম। সারাদিন অনেক পরিশ্রম হয়েছে, কাল সকালেই আবার যাত্রা, ডামবুলা হয়ে ক্যান্ডির পথে।

প্রয়োজনীয় তথ্য

  •  প্যাকেজ টুরে বিদেশ ভ্রমণ করতে চাইলে শুধুই পাসপোর্ট লাগবে বাকি সব দায়িত্ব ভ্রমণ সংস্থার।
  •  শ্রীলংকার প্যাকেজ টুর করায় বিভিন্ন ভ্রমণ সংস্থা। সময় সীমা ৬ দিন-র০ দিন। সেই অনুযায়ী ভ্রমণসূচী ও আর্থিকমূল্য পরিবর্তিত হয়।
  •  শ্রীলংকা ভ্রমণে কলম্বো দিয়েই ভ্রমণ শুরু করতে হবে কারণ প্রধান বিমানবন্দর কলম্বো।
  •  প্যাকেজ টুরে হোটেল, গাড়ি, খাওয়া-দাওয়ার সব ব্যবস্থা ভ্রমণ সংস্থা করবে।
  • শ্রীলংকা থেকে কেনাকাটা করা যেতে পারে চা-পাতা, মূল্যবান পাথর, মশলা।

সবুজ দ্বীপের সফরনামা

একসময় কালাপানি-তে দ্বীপান্তর হবে শুনলেই বুকের ভেতর রক্তস্রোত যেন জমাট বেঁধে যেত। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সেই রক্তাক্ত ইতিহাস বুকে করে আজও আন্দামান তার আপন মহিমায় উজ্জ্বল হয়ে রয়েছে ভারতীয় মানচিত্রে। তবে আন্দামান প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর অতুলনীয় বৈচিত্র্যময়তার জন্যও বিখ্যাত। বায়ুপথে পোর্ট ব্লেয়ার পৌঁছে সেই সৌন্দর্যের সাক্ষী হতেই এবারের সফর। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সবুজদ্বীপের রাজার স্মৃতিমেদুরতা বুকে নিয়ে যাত্রা। বহু দ্বীপের সমন্বয়ে তৈরি আন্দামানের, মাত্র কয়েকটি দ্বীপে মানুষের বাস।

আমাদের নির্দিষ্ট রিসর্টে পৌঁছে আশপাশের দৃশ্য দেখে মন ভরে গেল। সামনেই নীল জলের সমুদ্র। বারান্দায় বসেই বেশ সময় কেটে যায়। লাঞ্চ সেরে ঘুরে নিলাম কাছেই কর্বিনস্ কোভ বিচ। যাওয়ার পথেই চোখে পড়ে রস আইল্যান্ড। বিকেলে পৌঁছোলাম সেলুলার জেল। মনটা অচিরেই ভারী হয়ে আসে বহু স্বাধীনতা সংগ্রামীর ফাঁসির মঞ্চটি দেখে। এই জেলেই একসময় বন্দী ছিলেন বিপ্লবী বীর সাভারকর।

পরদিন প্রাতরাশ সেরে আমাদের গন্তব্য রস আইল্যান্ডের উদ্দেশে রওনা দিলাম। জেটি থেকে ১০ মিনিটের বোটযাত্রা। একসময় এই দ্বীপ রাজধানী ছিল আন্দামানের। এখনও কিছু পুরোনো স্থাপত্য রয়ে গেছে ওই দ্বীপে।

এরপরের গন্তব্য চিড়িয়াটাপু। একটা অটোয় চড়ে রওনা দিলাম অরণ্যে ঘেরা পথ দিয়ে। এই জঙ্গলে প্রচুর পাখির বাস। তাই হয়তো জায়গাটার নাম চিড়িয়াটাপু। সামনেই আদিগন্ত সমুদ্র ও এক ফালি মায়াময় বিচ। এক অপূর্ব সূর্যাস্তের সাক্ষী হলাম চিড়িয়াটাপুতে। ফিরে এসে সি-ফুড সমৃদ্ধ ডিনার খেয়ে মন ভরে গেল।

পরদিন ভোর ভোর উঠে আমরা তৈরি হলাম জলিবয় দ্বীপের উদ্দেশে রওনা দেব বলে। এর জন্য ওয়ানডুর থেকে বোট-এ উঠতে হয়। ওয়ানডুর পোর্ট ব্লেয়ার থেকে ৩০ কিমি দূরে। টিকিট নিয়ে আমরা বোটে উঠলাম সকাল ৯টায়। ওই বোট দ্বীপ ঘুরে দেখার জন্য আমাদের ঘন্টা তিনেক সময় বরাদ্দ করেছে। দ্বীপটি মহাত্মা গান্ধি মেরিন ন্যাশনাল পার্কের অন্তর্গত। এখানে সংরক্ষিত কোরাল ও নানা জলজ উদ্ভিদ দেখে মন ভরে গেল। বোটে করে নিয়ে যায় এই কোরাল রিফ দেখতে। বোটের তলদেশ কাচের তৈরি। ফলে জলজীবন স্বচ্ছ ভাবে দেখা যায় এই বোটযাত্রায়। কোরাল ছাড়াও দেখতে পেলাম ক্রাউন, প্যারট, জেব্রা, স্টারফিশ প্রভৃতি নানা মাছ। ২টো অক্টোপাসও দেখা গেল কাচের গা ঘেঁষে যেতে। ওখানে স্নরকেলিং-এর ব্যবস্থা থাকায় আমরা গাইডের সাহায্যে আরও একটু গভীর সমদ্রে ডুব সাঁতার দিলাম, আরও কিছু জলচর দেখব বলে। সাঁতার শেষে বেশ ক্লান্ত হয়ে হোটেলে ফিরলাম লাঞ্চ সারতে। সেদিন বিকেলে হাঁটাপথে অ্যানথ্রোপোলজিকাল মিউজিয়াম ঘুরে এলাম।

পরদিনটা নির্দিষ্ট ছিল জাহাজে করে হ্যাভলক ও রাধানগর দ্বীপ দেখার জন্য। ফিনিক্স বে জেটি থেকে জাহাজ ছাড়ল। নীল জলরাশি পেরিয়ে ২ ঘণ্টা পর পৌঁছোলাম হ্যাভলক। নির্জন দ্বীপটিতে খুব স্বল্প জনবসতি। একটা সুন্দর রিসর্ট-এ পৌঁছোলাম। তার নাম সি-শেল। নারকেল গাছের ছায়া ঘেরা সুন্দর লনে ছিল মধ্যাহ্নভোজের আয়োজন। কাছেই বিচ। খানিক বিশ্রাম নিয়ে আমরা রাধানগর বিচের উদ্দেশে রওনা হলাম। সিলভার স্যান্ড-এর জন্য বিখ্যাত এক রোমান্টিক বিচ এটি। এশিয়ার দ্বিতীয়তম সুন্দর বিচ বলে খ্যাত।

হ্যাভলকের দ্বিতীয় দিনের সকালটা বহু প্রতীক্ষিত ছিল। আমাদের প্ল্যান স্কুবা ডাইভিং-এর। গো-ডাইভ ইন্ডিয়া সেন্টারের ইন্সট্রাক্টর আমাদের বুঝিয়ে দিলেন কী করতে হবে। ৬-৮ ফিট জলের নীচে ডাইভ দিয়ে এর পর জলের নীচের পৃথিবীটাকে আরও কাছ থেকে দেখার সুযোগ মিলল। প্রায় এক ঘন্টা জলের নীচে সাঁতার কাটার এই অভিজ্ঞতা, সারা জীবনেও ভোলার নয়।

পরদিন আবারও জাহাজে উঠে আমরা পোর্টব্লেয়ার ফিরলাম। এবার ঘরে ফেরার পালা। চোখে লেগে রইল প্রবাল দ্বীপের অতলের ওই রহস্যময়তা, ভাষায় যার বর্ণনা হয় না।

পবিত্র মনোরম হরিদ্বার

সন্ধ্যায় হাওড়া থেকে দুন এক্সপ্রেস ধরলাম হরিদ্বার ভ্রমণের জন্য। টাইম-টেবিল মেনে দ্বিতীয় ভোরে আমরা পৌঁছোলাম হরিদ্বারে।

স্টেশন চত্বর থেকেই একটা অটো ভাড়া করে রাস্তাঘাট দেখতে দেখতে আমাদের বুকিং করা নির্দিষ্ট হোটেলের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা হোটেলে পেঁছে রুম-এ ঢুকে ফ্রেশ হয়ে নিলাম। ভারি সুন্দর দৃশ্য দেখা যাচ্ছিল দোতলার ঘর থেকে। সামনেই উন্মুক্ত গঙ্গা। দেখেই মনপ্রাণ জুড়িয়ে যায়। সূর্য  দেখি ঘুম ঘুম চোখে উঁকি দিচ্ছে আকাশের ক্যানভাস জুড়ে।

সিগারেট ধরিয়ে বারান্দায় এসে বেতের চেয়ারে আরাম করে হেলান দিয়ে বসলাম। একটু সময় বসে থাকতেই চারিদিকের সুশোভন প্রকৃতি আমার ক্লান্তি যেন কোথায় উড়িয়ে নিয়ে গেল। পেটের মধ্যে কেমন যেন চোঁ চোঁ শব্দ হতেই বুঝলাম খিদে পেয়েে। আগের রাতে তিনটে রুটি আর একটু ফুলকপির তরকারি, খিদে পাওয়ারই কথা! যথা ভাবা সেইমতো কাজ। ঠিক করলাম একটু এগিয়ে পাঞ্জাবি হোটেল থেকে কিছু হরিদ্বারী খাবার খেয়ে আসব। সকলেই রাজি হল, চললাম খেতে। আমি আগে থেকেই নেট সার্চ করে এখানকার দোকানপাঠ, রাস্তাঘাটের বিবরণ জেনে নিয়েছি, যাতে স্বাচ্ছন্দ্য বজায় থাকে।

ভারতের সকল ভ্রমণ স্থলগুলির মধ্যে হরিদ্বার অন্যতম একটি আকর্ষণীয় স্থান। এখানকার প্রাকৃতিক পটভমি ও মনোরম দৃশ্য আমাদের হৃদয়ে পরম আনন্দের সঞ্চার করে। এখানে প্রবাহিত গঙ্গা সকলের মনপ্রাণ প্রসন্ন করে। গঙ্গার নির্মল পবিত্র রূপ ও ধারা যেন জায়গাটিকে বিশ্বের প্রথম সারির ভ্রমণস্থলে পরিণত করেছে। ঋষি, মুনি, সিদ্ধ পুরুষদের আনাগোনায় এই তপস্যাভমি সবসময় সরগরম থাকে। শুধু প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কারণেই নয়, হরিদ্বারে একটি ধর্মীয় পটভূমিও রয়েছে।

প্রাচীন ঐতিহ্য ও মাহাত্ম্যে এই জায়গাটি খুবই সমাদৃত। দেশের এবং বিদেশের ভ্রমণযাত্রী ও পর‌্যটকরা এখানে আসেন বহু দূর থেকে। গঙ্গার ধারে শান্ত সমাহিত পরিবেশে সময় কাটানোর জন্য হরিদ্বার, পর্যটক ও তীর্থযাত্রীদের কাছে খুবই আকর্ষণীয়। যেমন নামেতে ধর্মীয় মাহাত্ম্য জড়িয়ে আছে, তেমনই এখানকার পর্যটন মাহাত্ম্যও কম নয়। এখানে অগণিত মন্দির, আশ্রম, শিবালয়, বন-উপবন, বাটিকা, পাহাড়, পর্বতীয় দেবালয় এবং তীর্থকেন্দ্র অবস্থিত। এখানে গঙ্গা, পর্বত প্রদেশ হতে কলকল শব্দ করতে করতে সর্বপ্রথম সমতলভমিতে প্রবাহিত হয়েে। এজন্যই এ-স্থলের নামকরণ হয় গঙ্গাদ্বার।

এখানে বেড়াতে এসে জানলাম হর-কি-পৌড়ি হরিদ্বারের প্রধান ঘাট। আর আছে বিষ্ণু ঘাট, রাম ঘাট, গো-ঘাট। দুজন সাধুকে দেখলাম ছাইভস্ম মেখে আখড়ায় বসার তোড়জোড় করছেন। স্বচ্ছ ভারত অভিযানে এখানে অনেকগুলি শৌচালয় ও জামা-কাপড় বদলানোর জায়গাও হয়েে সরকারি উদ্যোগে। তাছাড়া ঘাটগুলিও সত্যিই পরিষ্কার।

খুব জানতে ইচ্ছে হল হরিদ্বার নামকরণ হল কেন? স্কন্ধপুরাণে এইস্থল মায়াপুরী নামে বর্ণিত আছে। কালক্রমে হরিদ্বারের এক সামান্য অংশে পরিণত হয়েে। বর্তমানে উক্ত স্থানকে কঙ্খল বলে অভিহিত করা হয়ে থাকে।

শত সহস্র বছরের প্রাচীন গঙ্গার দক্ষিণ তটে অবস্থিত এই ভ্রমণক্ষেত্র বা তীর্থক্ষেত্র। বিশাল পর্বতরাশি কেটেই গঙ্গা এখান থেকে সমতলে অবতীর্ণ হয়েে। হরিদ্বারে গঙ্গা প্রায় এক কিলোমিটার চওড়া। সেজন্যই নানা শাখা-প্রশাখায় বিভক্ত। হাজার হাজার যাত্রী এখানে সকাল সন্ধ্যায় গঙ্গাস্নান এবং গঙ্গা আরতি দর্শনে বিপুল আনন্দ ও পুণ্য লাভ করে থাকেন।

হরিদ্বারে প্রতি বছর কোটি কোটি যাত্রীর আগমন ঘটে চন্দ্রগ্রহণ, সূর্যগ্রহণ, অমাবস্যা, বৈশাখী, মকরসংক্রান্তি ও মাঘীস্নানে। ১২ বছর পরে পরে কুম্ভ ইত্যাদি স্নান উপলক্ষ্যে এখানে অত্যন্ত ভিড় হয়। পূণ্যস্নান ও মেলায় লক্ষ লক্ষ যাত্রী সমাবেশ হওয়ার ফলে হরিদ্বার আলাদা মাহাত্ম্য লাভ করে। দুই মাসব্যাপী কুম্ভপর্ব উপলক্ষ্যে এখানে বয় আনন্দের বন্যা। কোথাও কীর্তনীয়ারা ভজন কীর্তন করছেন, কোথাও চলছে যজ্ঞানুষ্ঠান। আবার কোথাও মহাত্মাগণ সদুপদেশ দান করছেন এবং কোথাও বিরাট দানপুণ্য চলছে।

travel
Haridwar

এবারে জেনে নেওয়া যায় হরিদ্বারের প্রাচীন ইতিহাস পৌড়ির রাজপুতদের পর হরিদ্বার কয়েকবার মুঘলরা আক্রমণ করে। আক্রমণের ক্ষতচিহ্ন হিসাবে ভেখজির প্রতিমা (ভেখ অর্থাত্ আখড়া), নবগ্রহের মূর্তিগুলি (কাংড়া মন্দির) এবং হর কি পৌড়ির ভগবান বিষ্ণুর মন্দির দেখা যেতে পারে।

হরিদ্বারের আবহাওয়া খুবই মনমুগ্ধকর। গ্রীষ্মকালে সূর‌্যদেব এখানে তার নিজ আধিপত্য বিস্তার করতে পারেন না। সন্ধ্যাবেলায় গঙ্গার তীরে বসে থাকলে মন শান্ত ও পুলকিত হয়। কিন্তু শীতকালে আবার প্রচন্ড ঠান্ডা।

আমরা খানিক বিশ্রামের পর শহর দেখতে বেরোলাম। অনেকেই খেয়াল করে থাকবেন, রেলওয়ে স্টেশন থেকে বাইরে বেরিয়ে এলেই সন্মুখে প্রাপ্তি ফোয়ারা। ফোয়ারা থেকে তিনধারে রাস্তা বেরিয়ে গেছে। এক রাস্তা সোজাসুজি হরিদ্বারের উপর দিয়ে হর কি পৌড়ির দিকে, দ্বিতীয়টি কঙ্খলের দিকে, আর তৃতীয়টি স্টেশনের আগে বের হয়ে পেছন দিকে দক্ষিণ দিশার জ্বালাপুরে চলে গেছে। ঋষিকুল, কুরুকুল এবং ভারত হেভি ইলেক্ট্রিক্যালস উক্ত রাস্তায় পড়ে। বাণীপুর মোড় থেকে এই রাস্তা মোড় ঘুরে যুক্ত হয়েে।

হরিদ্বারের অভিমুখী রাস্তায় চলতে চলতে ফুহারেনুমা প্রতিমা দর্শন করবেন। এর নিকটেই হাতের ডানদিকে চিত্রা সিনেমা হল। সিনেমা হলের সোজাসুজি অন্য একটি ছোট্ট রাস্তা গঙ্গার কিনারা পর্যন্ত চলে গিয়েে, যা আজ কালের গর্ভে সমাহিত। ওই রাস্তার দুধারে চোখে পড়ে বড়ো বড়ো আশ্রম ও সুন্দর সুন্দর অট্টালিকা। সন্মুখে চলতে চলতে রাস্তার বাম দিকে স্টেশনের সীমানা পার হয়ে গেলে পঞ্চায়েি মারওয়াড়ি এবং ডানদিকে কলকত্তাওয়ালি মুরলীমল ও বাসন্তীদেবীর ধর্মশালা। এগুলি পার হয়ে এলে কিছু দূরে অবস্থিত লালতারো পাকা পুল।

উক্ত পুল থেকে কিছু দূর এগিয়ে গেলে বামদিকে রাস্তার ধার ঘেঁষে অপর একটি রাস্তা সোজা বিশ্বকেশ্বর মন্দির পর‌্যন্ত চলে গেছে। এই রাস্তার ওপরে শ্রীগুরু সিংহ সভা গুরুদ্বারা নামে একটি বিশাল গুরুদ্বারা আছে। যাত্রীদের অবস্থানের জন্য উক্ত গুরুদ্বারে যথোপযুক্ত সুব্যবস্থা রয়েে।

ভোলাগিরি রোড গঙ্গাতীর ধরে চলে গেলে মোতি বাজার। এটি হর কি পৌড়ি পর‌্যন্ত বিস্তৃত। উক্ত রোডে গীতা ভবন, ভোলাগিরি আশ্রম এবং শেঠ কেশব দেব ধর্মশালা, বিড়লা ভবন, কর্ণাটক ধর্মশালা ইত্যাদি আছে। সবজিমন্ডি থেকে রাস্তা নীচের বাজার পর‌্যন্ত বিস্তৃত। ওই বাজারে প্রচুর দোকানপাঠ আছে। হর কি পৌড়ি থেকে পাহাড়ের নীচ দিয়ে একটা রাস্তা ভীমগোডা, সপ্তধারা, ঋষিকেশ ইত্যাদি অঞ্চলে চলে গেছে।

প্রধান দর্শনীয় স্থলগুলির মধ্যে মনসাদেবী মন্দির, বিল্বকেশ্বর মহাদেব মন্দির (মনসাদেবী মন্দির যাওয়ার উড়ান খোটলা যেখান থেকে শুরু হয়, ঠিক তার নীচে দিয়ে একটি রাস্তা, বাইপাশ রোড হয়ে চলে গেছে এই মন্দিরে), পার্বতী মায়ে মন্দির, শান্তিকুঞ্জ, পতঞ্জলী যোগপীঠ, চণ্ডীদেবী মন্দির, ভীমগোডা মন্দির, বিশ্বকেশ্বর মন্দির, মায়াদেবী মন্দির, স্বামী বিবেকানন্দ পার্ক, গীতা ভবন, পারদ শিবলিঙ্গ, রাঘবেন্দ্র মন্দির, ভপতওয়ালা, ভারতমাতা মন্দির, বৈষ্ণোদেবী মন্দির, সপ্ত সরোবর, ভমা নিকেতন, গৌরীশংকর মহাদেব মন্দির, নীলধারা পক্ষীবিহার, জয়রাম আশ্রম, কুশাবর্ত ঘাট, সুরেশ্বরী দেবী মন্দির, প্রেমনগর আশ্রম, ভারতসেবাশ্রম সংঘ, রামকৃষ্ণ মিশন (হাসপাতাল, কঙ্খল), প্রভতি অনেক কিছু দেখার আছে এখানে।

 

অন্যান্য দর্শনীয় স্থান

২৬ কিলোমিটার দূরত্বে চিল্লা ওয়াইল্ড লাইফ সাংচুয়ারি। হৃষিকেশ, যা হরিদ্বার থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে উত্তর-পূর্ব দিকে গঙ্গার কিনারায় অবস্থিত। এখান থেকেই উত্তরাখন্ডের বদ্রিনাথ, কেদারনাথ, গঙ্গোত্রী, যমুনোত্রী আদি পবিত্র তীর্থস্থানগুলির উদ্দেশে বাসযাত্রা আরম্ভ হয়। এখানে শুধুমাত্র একটিই বাজার রয়েে। অধিকাংশ যাত্রীই পাঞ্জাব সিন্ধক্ষেত্র এবং বাবা কালী কমলিওয়ালে ধর্মশালাতে অবস্থান করেন। এছাড়া স্বর্গাশ্রম, গীতাভবন, শিবানন্দ আশ্রম, হেমকুন্ড ও গুরুদ্বারা ট্রাস্ট নির্মিত গুরুদ্বারাতে বহু যাত্রী রাত্রিযাপন করেন। ত্রিবেণী ঘাট, ভরত মন্দির, লছমন ঝুলা, রাম ঝুলা, পরমার্থ নিকেতন, নীলকণ্ঠ মহাদেব, সবই প্রাকৃতিক সৌন্দর‌্য ও মাহাত্ম্যে ষোলোআনা পরিপূর্ণ।

হরিদ্বার থেকে তিন কিলোমিটার দূরে অবস্থিত অতি প্রাচীন এক দর্শনীয় স্থান কঙ্খল। হরিদ্বার স্টেশনে নামার পর রাস্তায় যেতে যেতে মৃতু্যঞ্জয় মহাদেবের মূর্তি নজরে আসে। সেখান থেকে ডানদিকে এক রাস্তা চলে গেছে। ওই রাস্তাই মায়াপুরী হয়ে কঙ্খল পর‌্যন্ত বিস্তৃত। দক্ষমন্দির, সতীকুন্ড, সতীঘাট, অবধূত মন্ডল, আনন্দমযী মা-র আশ্রম, গুরুদ্বারা গুরু অমর দাস, হরিহর আশ্রম, গঙ্গা ইত্যাদি বেশ কিছু দর্শনীয় স্থান রয়েে।

হরিদ্বারে যারা আসেন তারা জানেন যে, এখানে শুদ্ধ নিরামিষ ভোজনই পাওয়া যায়। ভাত, রুটি ছাড়াও দেশি ঘি-এর তৈরি অন্যান্য উপাদেয় খাবারও এখানে পাওয়া যায়। কোনও রকম আমিষ খাবার না থাকার জন্য দুঃখ হবার কথা নয়। কিছু বাঙালি হোটেলও রয়েে। তবে প্রায় সব হোটেলেই থালি সিস্টেম। বাঙালি হোটেলের মেনুতে থাকে দেরাদুন চালের ভাত, ঘি, বেগুনি, ঝুরোঝুরো আলুভাজা, ডাল, পোস্ত, অন্য সবজির দুটো তরকারি, চাটনি, পাঁপড়।

ইচ্ছে করলে লাইন হোটেল থেকে গরম তাজা দুধ কিনে খেতে পারেন। খাঁটি দুধের তৈরি রাবড়িও খুব ভালো। রসনার তপ্তির জন্য একটু পরখ করে দেখতেই পারেন। এখানে বেশকিছু মিষ্টির দোকান রয়েে, যেখানে হরিদ্বারের বিখ্যাত প্যাঁড়া পাওয়া যায়। আসার সময় বাড়ির জন্য কিনে আনতে পারেন। এখানকার লস্যির স্বাদ একেবারেই অন্যরকম। এক গেলাস লস্যি পান করলে সমস্ত ক্লান্তি দূর হয়ে যাবে।

কীভাবে যাবেন : প্রতিদিন হাওড়া থেকে উপাসনা এক্সপ্রেস দুপুরে এবং দুন এক্সপ্রেস রাতে হরিদ্বারের উদ্দেশে রওনা দেয়।

কোথায় থাকবেন : এখানে থাকার জায়গার কোনও অভাব নেই। বিভিন্ন বাজেটের সরকারি, বেসরকারি হোটেলে রয়েে। রয়েে বিলাসবহুল রিসর্ট। এছাড়া অগুনতি ধর্মশালা রয়েে, যেখানে অল্প রেট বা অনুদানের ভিত্তিতে থাকা যায়।

গন্তব্য ভেড়াঘাট

মধ্যপ্রদেশের জব্বলপুরের একটি অত্যন্ত জনপ্রিয় ডেস্টিনেশন ভেড়াঘাট। তবে সবাই এর খোঁজ রাখেন না, প্রকৃত অর্থে যারা প্রকৃতি প্রেমিক, তাদের ট্রাভেল ডায়ারির এ এক আবশ্যক সংযোজন। জব্বলপুর এয়ারপোর্ট থেকে ৪৫ মিনিটের গাড়ি-পথে পৌঁছে গেছি ভেড়াঘাট। অক্টোবরের শুরু কিন্তু বেশ গরম। সদ্য বর্ষাস্নাত পাহাড়তলিতে যেন সবুজের রায়ট।

নর্মদার বহতা স্রোত ধরে জব্বলপুর থেকে ২০ কিমি দূরত্বে ভেড়াঘাটের অবস্থান। ছোট্ট এই জনপদ তেমন জনবহুল নয়। কিন্তু সৌন্দর্যের খনি। অতিকায় মার্বেল পাথরের ল্যান্ডস্কেপ ও নদী, যেন এক পিকচার পোস্টকার্ড-এর সাক্ষী করল।

বর্ষা পেরোনোর পর নর্মদা যেন তার স্বরূপে উদ্ভাসিত। একটি বোট-এর সঙ্গে দরদাম করে আমরা চড়ে বসলাম। মিনিট পনেরো জলে ভেসে বেড়ানোর পর যেন এক অন্য পৃথিবীতে গিয়ে পড়লাম। এ বড়ো প্রাচীন এক ল্যান্ডস্কেপ, যার বিশালত্বে ভয় করে। মার্বেলের ওই প্রাচীর যেন কোন প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে অমনই অগম্য অবস্থায় রয়ে গেছে।

ভেড়াঘাটে ক্রুজ শেষ করে আমরা চললাম পরের গন্তব্য ধুঁয়াধার ফল্স দেখতে। এ এক অসাধারণ জলপ্রপাত যাকে ইন্ডিয়ান নায়াগ্রার আখ্যা দেওয়া হয়। কেবল কার-এ চড়ে এর দর্শন করা একটা লাইফটাইম এক্সপিরিয়েন্স। শাহরুখ খান ও করিনা অভিনীত ছবি ‘অশোকা’ এই অঞ্চলে শুট হওয়ায়, অনেকেই পর্দায় এর সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হয়েছেন। এই অপরূপ জলপ্রপাত সত্যিই মন্ত্রমুগ্ধ করে দেয়।

travelogue
Destination Bheraghat

আমাদের থাকার ব্যবস্থা হয়েছে মধ্যপ্রদেশ ট্যুরিজমের-এর নিজস্ব রিসর্টে। ভেড়াঘাটের খুব কাছেই এই রিসর্ট এক কথায় অসাধারণ। লাঞ্চ করে আমরা বেরিয়ে পড়লাম চৗষট্টি যোগিনী মন্দিরের উদ্দেশে। জব্বলপুরের ঐতিহাসিক তাৎপর্যটি জেনে নিই এক লোকাল গাইডের সাহায্যে। মৌর্য ও সতবাহন সাম্রাজ্যের ইতিহাস বহন করে জব্বলপুর। পরবর্তীকালে গু৫ ও কালাচুরি বংশের শাসকরা এখানে রাজ্যপাট চালান। এই কালাচুরি রাজত্বের এক অমাত্যই চৌষট্টি যোগিনী মন্দিরের প্রতিষ্ঠা করেন। ভেড়াঘাটের অনতিদূরে পাহাড়ের উপরে অবস্থিত এই মন্দির, ভারতের সবক’টি যোগিনী মন্দিরের মধ্যে সর্ববৃহৎ।

চৌষট্টি যোগিনী মন্দির ভারতের প্রচীনতম মন্দির স্থাপত্যগুলির অন্যতম। বস্তুত এটা দুর্গামন্দির। যোগিনীরা দেবীর সহচরী। প্রতিটি যোগিনী মূর্তি দেয়ালে খোদাই করা এবং এক গোলাকার প্রাচীরের উপর এগুলির অবস্থান। তবে প্রাচীরে রয়েছে মোট ৮৪টি কম্পার্টমেন্ট। তার মধ্যে ৬৪টি যোগিনী মূর্তি, অন্যগুলো অন্যান্য দেব-দেবীর। এই মন্দিরে পৌঁছোতে গেলে ১০০টি সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠতে হয়। একবার পৌঁছে গেলে কিন্তু মুগ্ধ করার মতো এক সৌন্দর্যের সাক্ষী থাকবেন সারাজীবন।

Travelogue
Destination Bheraghat

অনেকগুলি মূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায়, বর্তমানে আর্কিওলজিক্যাল সার্ভের তত্ত্ববধানে এর সংরক্ষণের চেষ্টা হচ্ছে। গোলাকার ওই প্রাচীরের মাঝখানে গৌরী-শঙ্কর মন্দির। উপর থেকে নর্মদাকে দেখাও এক অনন্য সুন্দর অভিজ্ঞতা। সেই প্রাচীন কাল থেকে মানুষ কেন প্রকৃতির উপাসক হয়ে এসেছে, পাহাড়ের উপরে এই অনির্বচনীয় দৃশ্য দেখতে দেখতে সেটাই উপলব্ধি করছিলাম।

বেলা জুড়ে বেলপাহাড়ি

বাতাসে আর বারুদের গন্ধ নেই। হাতে নেই অত্যাধুনিক অস্ত্র। চিড় ধরা অবিশ্বাসী মনে উন্নয়নের অনুকূল প্রলেপ। সবুজ হয়েছে আরও সবুজ। লাল ভাঙাচোরা পথে অজগর সদৃশ পিচ সড়ক। বাধা কাটিয়ে সেই সবুজ সমুদ্রে গা ভাসতে চলে যান জঙ্গল মহল। হয়তো ঝাড়া হাত পায়ে দুদিনের ছুটিতে ঝাড়গ্রাম গেছেন। রাজবাড়ি, চিড়িয়াখানা আর চিলকিগড় গিয়ে চিলতে ভ্রমণের ইতি টানতে চান। কিন্তু দিন বাড়িয়ে যদি পা বাড়ান বেলপাহাড়ি, তাহলে কেমন হয়?

দহিজুড়ি, বিনপুর, শিলদা হয়ে ৩৮ কিলোমিটার দূরে বেলপাহাড়ি। এখানে শাল, মহুয়া, সোনাঝুরি, পিয়াল, ইউক্যালিপটাস ও কেন্দুগাছের নিবিড় সমাবেশ। আদিবাসী অধু্যষিত এই অঞ্চলকে সাজাতে ঈশ্বর এতটুকু কার্পণ্য করেননি। যেখানে প্রকৃতির কোলে এক অদ্ভুত মাদকতা মিশে রয়েছে। লাল কাঁকুড়ে পথঘাটের সঙ্গে মিশে রয়েছে মহুয়ার মৌতাত।

travelogue
Belpahari

বেলপাহাড়ি বাজারে আসতেই দেখবেন, রাস্তা বেঁকেছে নানাদিকে। জিপিএস থমকে গেলে, বাজারের মুখটায় বোর্ডটা দেখে নিন। স্থানীয়দের সহযোগিতা পাবেন একশো শতাংশ।

প্রথমে গ্রাম্য পথ দিয়ে গাড়ি ছুটবে কানাইশোল। লাল কাঁকুড়ে পথ এখন পিচমোড়া। আদিম জঙ্গলে মোড়া পাহাড়তলির কানাইশোল-এর সৌন্দর্য বর্ণনাতীত। তবে পাহাড় ঘেরা ছোট্ট লেক দেখতে হলে চড়াই রাস্তায় উঠতে হবে অনেকটা। রাজ্য বিভাজনের পাহাড়ও বলা চলে কানাইশোলকে। এই পাহাড়ের উলটো দিকেই ঝাড়খণ্ড রাজ্য। উদার আকাশ আর নয়নাভিরাম সবুজের সৌন্দর্য আগত পর‌্যটকদের বিমুগ্ধ করবে। ভিন্ন রাস্তায়, ভিন্ন গ্রাম্য পরিবেশকে দুচোখে দেখতে দেখতে, আবার বেলপাহাড়ি বাজার।

এবার গাড়ি ঘুরবে ঘাঘরা-র দিকে। বাজার থেকে ৬ কিলোমিটার দূরে ঘাঘরা। ঘাঘরা পাথুরে রূপকথার চঞ্চলমতি এক ঝরনা। তাকে পাহারা দিচ্ছে শাল, পিয়াল, অমলতাস, ইউক্যালিপটাস-এর ছড়ানো প্রকৃতি। শীতে তার জলধারা ক্ষীণ। সবুজ দিগন্তের মাঝে বিস্তীর্ণ ব্ল্যাকস্টোনের কোলে সবুজ নীলাভ স্বচ্ছ জল। জলের আঘাতে পাহাড়গুলোর আকৃতি স্থানীয় ভাষায় গাগরি, অর্থাত্ কলশির মতো।

travelogue
Belpahari

এখানকার নির্জন পথে দেখবেন মাথায় জ্বালানি কাঠের বোঝা নিয়ে চলেছে স্থানীয় মহিলারা। রোজ সকালে এরা কাঠ কুড়োতে জঙ্গলে যায়। কাঠ বিক্রি করেই এদের সংসার চলে। অতীতে ১৮৭০ সালে বেলপাহাড়ির ব্রিটিশশাসক, ঘোড়ায় চড়ে ঘুরতে ঘুরতে ঘাঘরা-য় উপস্থিত হয়েিলেন। সেখানে দলবল নিয়ে বনভোজনও করেছিলেন। ক্রমেই এখানকার সৌন্দর্য মানুষের মুখে মুখে ফিরতে থাকে।

ঘাগরা থেকে কিছুটা দূরেই রয়েছে তারাফেনি ব্যারেজ। কংসাবতী নদীকে জলবন্দি করা হয়েছে এখানে। ১০ লকের বাঁধ নীল সাদা রঙে আবদ্ধ। ব্যারেজের পাশেই পুলিশ ক্যাম্প। উলটো দিকের প্রকৃতি জুড়ে খেজুর গাছের ব্যাপ্তি। শীতে এখানে ভালো খেজুরগুড় মেলে। এখান থেকে জল শোধিত হয়ে বেলপাহাড়ি যাচ্ছে। তবে এর আর-একটা পরিচয়ও আছে। ঘাগরা সংলগ্ন তারাফেনি অববাহিকা অঞ্চলে, প্রাচীন জীবাশ্ম ও প্রস্তর যুগের কিছু চিহ্ন মিলেছে।

এবার মধ্যাহ্ন ভোজনের পালা। তার জন্য বেলপাহাড়ি বাজারে কাঁচালংকা রেস্টুরেন্টকে চুজ করতে পারেন। আবার গাড়ি ছুটবে ১২ কিলোমিটার দূরে গাড়রাসিনির দিকে। ঝিলিমিলি-র দিকে কয়ে কিলোমিটার দৌড়ানোর পরই বাম দিকের পথ ধরুন। সর্পিল পাহাড়ি পথ ধরে গাড়রাসিনির আঙিনায়। পাহাড় পাদদেশে অরণ্য মাঝে এক ধর্মীয় আশ্রম। তার চূড়ায় মন্দির। সেখানেই সিদ্ধি লাভ করেছিলেন সন্ন্যাসী সত্যানন্দ মহারাজ। এই গাড়রাসিনি পাহাড়ের পূর্বদিকে পড়বে খাঁদারানি ড্যাম। এই বাঁধের পান্না সবুজ জল আর পারিপার্শ্বিক সবুজ অরণ্যের নৈসর্গিক দৃশ্য দেখে মুগ্ধ হবেন।

হাতে সময় থাকলে চলে যেতে পারেন ২২ কিলোমিটার দূরে কাঁকড়াঝোড়। পাহাড়ঘেরা ঝরনা ঝংকৃত সবচেয়ে সুন্দর বনাঞ্চল এই কাঁকড়াঝোড়। এখনও পড়ে রইল লালজল গুহা, মযূর ঝরনা, তালবেড়িয়া ড্যাম। এসব দেখতে আরও একটা দিন অন্তত হাতে সময় রাখুন। এবার ঝাড়গ্রাম ফিরবেন, না ঝিলিমিলি, রানিবাঁধ, মুকুটমণিপুর-এর দিকে গাড়ি ছোটাবেন সেটা আপনার মর্জি।

কীভাবে যাবেন : হাওড়া থেকে ঝাড়গ্রাম পৌঁছোতে দক্ষিণ পূর্ব রেলপথের ট্রেন ধরুন। তালিকায় রয়েছে ইস্পাত, স্টিল, লালমাটি, হাতিয়া, জনশতাব্দীর মতো ট্রেন। ঝাড়গ্রাম থেকে ৩৮ কিলোমিটার দূরে বেলপাহাড়ি ঘুরতে নিজস্ব গাড়ি রাখলেই ভালো হয়।

কোথায় থাকবেন : সরকারি গেস্ট হাউসের মধ্যে ঝাড়গ্রাম টুরিস্ট কমপ্লেক্স (০৩৩-২২৩৩৪০), ঝাড়গ্রাম টু্যরিজম ডেভলপমেন্ট কমিটি (৯৪৩৪৫০৮০২৮), ঝাড়গ্রাম প্রকৃতি পর্য‌্যটন কেন্দ্র (০৩৩-২২২৮৫৪৯)। ভাড়া ২০০০ টাকার মধ্যে। এছাড়াও বিভিন্ন মানের বিভিন্ন দামের অনেক বেসরকারি হোটেল রয়েছে। ভাড়া মোটামুটি ৬০০ টাকা থেকে ১৫০০ টাকার মধ্যে।

প্রযোজনীয় তথ্য : এই রুটে বাস চললেও ঝাড়গ্রাম থেকে ভাড়া গাড়ি করে নেওয়াই সুবিধা। বেলপাহাড়ি ঘুরতে ১৫০০ টাকা থেকে ২০০০ টাকার মধ্যে গাড়ি ভাড়া পড়বে।

ঝাড়গ্রামে সরকারি রুম বুকিং-এর জন্য কলকাতায় যোগাযোগের ঠিকানা : ৩/২ বিবিডি বাগ, কলকাতা-৭০০ ০০১ এবং ৬৫, রাজা সুবোধ মল্লিক স্কোয়ার, ৭ম ফ্লোর, কলকাতা-৭০০ ০১৩।

রাজি থাকলে চলুন রাজিম

এনএইচ৬ ধরে ছুটে চলেছে গাড়ি। ল্যান্ডস্কেপে বন্ধুর প্রকৃতি। ধুলোওড়া রুখু-শুখু পরিবেশ। সামনে ছোট্ট এক জনপদ। কুশলপুর। হাত নেড়ে জানায় যেন সে কুশলবার্তা। আসলে লম্বা দৌড়ের কাউন্টডাউন শুরু রায়পুর থেকে। চলেছি মন্দিরতীর্থ রাজিম। সন্তোষী চক থেকে গাড়ি ছেড়ে দিল, উঠল জাতীয় সড়কে। এবার লিঙ্ক রোড। মিনিট সাতেক পরই দেবপুরী। আবার জাতীয় সড়ক। তবে এবার এনএইচ৩০। এই রাস্তাটা চলে গেছে বস্তারের জগদলপুর। এক ফসলি চাষজমি রাস্তার দুদিকে। শীতে ফসলহীন জমি খাঁ খাঁ করছে। যেন তেপান্তরের মাঠ! ভেজলিন না লাগানো পা-ঠোঁটের মতো ভমিরূপ। ফাটা-চটা। এপথে বলার মতো বড়োসড়ো গাছ বাবলা আর খেজুর। বাদবাকি ছোটো-খাটো ঝোপ-ঝাড়। যেন কমা, পূর্ণচ্ছেদ।

সেই তেপান্তরের মাঠ ছুঁয়ে চলে গেছে রেলপথ। মিটার গেজ। গতি মন্থর। যেন হাওড়া-শিয়াখালা মার্টিন রেলের প্রত্ননিদর্শন। দৌড় তার রায়পুর থেকে বাঘবেহেড়া। ওয়াই আকৃতির বামহাতি বাঁক ঢুকেছে চম্পারনে। এখান থেকে দৌড়টা পাক্কা সাতাশ কিমি। অন্যপথ ধরে একটু এগোলেই আমনপুর। বাজার আমনপুরের পরই আবার বামহাতি পথ। আর পড়ে মেরে-কেটে মাত্র ১৪ কিমি। রাজ্য-জয়ের হাসি নিয়ে শেষ পর্যন্ত রাজিম রাজ্যে প্রবেশ। মহানদীর মহাব্রিজের এপারটাই নবাপাড়া। ওপারে কাঙ্ক্ষিত রাজিম। রাজিম স্টেশন-ও নদীর এপারে। মিটার গেজের ছোট্ট স্টেশন। ৪৯ কিলোমিটার দৌড়ঝাঁপের পর এবার গাড়ি দৌড়ের ইতি। পার্কিং তার তেঁতুলবটের নিঝুম ছায়ায়।

Travelogue Rajim

মহানদী, পৈরি এবং সেন্দুর এই ত্রিবেণী নদী সঙ্গম পাড়েই রাজিম নগরী। যা আসলে ছত্তিশগড়ের প্রয়াগ তীর্থ। ফিবছরই চলে এখানে পূণ্যার্থীদের জনসমাবেশ। সময়টা মাঘি পূর্ণিমা থেকে মহাশিবরাত্রি। এক পক্ষকাল ধরে চলে এখানে উত্সবের আমেজ। চলে তর্পণ ও পূণ্যস্নান। সমবেত হয় দূর-দূরান্ত থেকে অসংখ্য পূণ্যার্থী। প্রতি বারো বছর অন্তর এখানে অনুষ্ঠিত হয় রাজিম মহাকুম্ভ। পুরী বার বার গেলেও ক্ষতি নেই। কিন্তু  পুরো কোটা পূরণে রাজিম অন্তত একবার আসতেই হবে। তাই পুরীর জগন্নাথ দর্শনের  পূর্ণতার জন্য রাজিমলোচন মন্দির দর্শন একান্তই পালনীয়। তাই তো রাজিমের আর এক নাম কমলাক্ষেত্র পদ্মাবতী পুরী।

চলে এলাম অষ্টম শতাব্দীতে তৈরি রাজিবলোচন মন্দির কমপ্লেক্সে। সিংহভাগ মন্দিরের অবস্থানই এই ঘেরাটোপের অন্দরে। তবে সঙ্গম ঘাট ও নদীর অন্য পারেও বেশ কযেটি মন্দির। জুতো খুলে চলে আসি মন্দির চত্বরে। এখানকার মধ্যমণি রাজিবলোচন মন্দির। ইটশৈলীর এই মন্দির উঁচু প্ল্যাটফর্মের উপর সুগঠিত। গঠনশৈলীতে সম্পূর্ণ আঞ্চলিকতার ছাপ। শ্বেতশুভ্র দেবগৃহের মাথায় উড়ছে লাল ধ্বজা। ধাপ সিঁড়ি উঠেছে মন্দির প্রকোষ্ঠে। মন্দিরের তিনটি ধাপ গর্ভগৃহ, অন্তরাল ও মণ্ডপ। গর্ভগৃহে অবস্থান করছেন রাজিবলোচন। অর্থাত্ ভগবান শ্রীবিষ্ণু। কালো কষ্টি পাথরের মূর্তি। চতুর্ভুজে তাঁর শঙ্খ, চক্র, গদা পদ্ম। এইরূপ মোটেই রুদ্র নয়। বরং শান্ত, সৌম্য, তথাগত টাইপের। মনে করা হয় যুদ্ধ পরবর্তী শান্ত রূপই এই রাজিবলোচন।

গর্ভগৃহের দ্বার সম্মুখের দেওয়া ভাস্কর‌্য অসাধারণ। যে-শিল্প নিপুণতা সহজেই চোখ টানে। দেওয়ালজুড়ে পৌরাণিক গল্পকথার পুঙ্খানুপুঙ্খ চিত্রায়ণ অনবদ্য। মণ্ডপ অংশের স্তম্ভস্থাপত্য শৈলীও এককথায় অসাধারণ। যা খাজুরাহো শিল্পরীতির সঙ্গে অনায়াসেই তুলনা করা যায়। স্তম্ভস্থাপত্য পৌরাণিক চরিত্র চিত্রণের সঙ্গে মিথুন চিত্রের মেলবন্ধন ঘটেছে। তাই নরসিংহ, বরাহ,

রাম-লক্ষণ, গঙ্গা-যমুনার সঙ্গে সহাবস্থান করছে অপরূপ অপ্সরাবৃন্দের অনবদ্য ভঙ্গিমামূর্তি। একটু লক্ষ্য করলেই অনুমেয় যে, এখানে ভাস্কর‌্য শিল্প তিনটি পর‌্যাযে। যার প্রথমভাগে আছে কল্পলতার চারুচিত্র। দ্বিতীয়তে বিভিন্ন মুদ্রা ও ভঙ্গিমায় মিথুন মূর্তি। আর শেষভাগে মেলে অর্ধমানবী রূপ ও নাগনাগিনী মূর্তি।

মণ্ডপ অংশের সম্মুখ ভাগেই চোখেপড়ে এক গরুড়মূর্তি। ললাট বিম্বের উপর এই শিলামূর্তির অবস্থান। মনে করা হয় গরুড় অপ্রতিম শক্তি ও শৌর‌্যের প্রতীক। মন্দিরের নিয়মনিষ্ঠা সম্পর্কে জানছিলাম মন্দিরের পুরোহিত বিজয়শর্মার কাছে। মন্দির খোলা হয় ভোর সাড়ে চারটায়। ভোগ পর্বের পর বেলা বারোটায় মন্দির বন্ধ হয়। বেলা তিনটায় খুলে রাত পর‌্যন্ত চলে ভক্তদের পূর্জার্চনা। মন্দিরের ইতিহাস সম্পর্কে  শুনছিলাম শর্মাবাবুর কাছে, মন্দির চাতালে বসে।

এক দরিদ্র তেলিনী ভোজ্য তেল বিক্রি করে সংসার প্রতিপালন করতেন। অন্যদিনের মতো সে দিনও তিনি রাস্তায় বার হয়েছেন। কিন্তু সেদিন ঘটলো এক অঘটন। এক প্রশস্ত পাথরখণ্ডে তিনি আঘাতপ্রাপ্ত হন। ফলে তাঁর পাত্রের সমস্ত তেলই মাটিতে পড়ে নষ্ট হয়। সেই পাথরের উপরই খালি পাত্রটি রেখে তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন। অগত্যা সেদিনের মতো গৃহে ফিরে যাবেন মনস্থির করেন। কথা মতো খালিপাত্র তুলতেই আশ্চর‌্য এক ঘটনা ঘটে যায়। দেখেন আগের মতোই, তেলে পরিপূর্ণ রয়েছে পাত্রটি! মহানন্দে তেল বিক্রি করে তিনি গৃহে ফিরলেন।

রাতে স্বামীকে বললেন, এই অত্যাশ্চর্য ঘটনা প্রবাহের কথা।

স্বামী-স্ত্রী মিলে শেষে এক সিদ্ধান্ত নিলেন ওই শিলাখণ্ডকে লোকচক্ষুর অন্তরালে বাড়িতে আনবেন। আর যাদুশিলার স্পর্শে পাত্র ভর্তি তেল বিক্রয় করে দরিদ্রতা মোচন করবেন। কথা মতো সেই শিলাখণ্ড মাটি থেকে সরাতেই ঘটল আরও একটা অত্যাশ্চর‌্য ঘটনা! তার তলদেশেই বিরাজ করছে কষ্টি পাথরের এক বিষ্ণু মূর্তি। মূর্তি ও শিলাখণ্ড নিজবাটিতে নিয়ে গেলেন রাজিম তেলিন পরিবার। কিন্তু নিম্ন সম্প্রদায়ভক্ত বলে মন্দির প্রতিষ্ঠায় দ্বিধান্বিত হলেন।

সেই সময় কালচুরি বংশের সামন্ত রাজা ছিলেন জগত্ পাল। তিনি এক নতুন বিষ্ণু মন্দির তৈরি করেন। বিষ্ণুমূর্তি নিয়ে তিনি বিড়ম্বনায় পড়েন। নানান বাধা আসে মূর্তি তৈরিতে। এই সময় জগত্ পাল স্বপ্নে এক বিষ্ণু মূর্তির দর্শন পান। ইতিমধ্যে রাজিম তেলিনের মূর্তিপ্রাপ্তি লোকমুখে রাষ্ট্র হয়েছে। একদিন স্বযং রাজা রাজিম তেলিনের বাটিতে উপস্থিত হন। আর আশ্চর‌্য হয়ে যান বিষ্ণুমূর্তি দেখে। স্বপ্নের সঙ্গে অবিকল মিলে যাচ্ছে। রাজা এই মূর্তিটি তাঁকে দান করার কথা বললে, রাজিম অরাজি হন। এই অমূল্য সম্পদ তিনি হারাতে চান না। পরে অবশ্য শর্তসাপেক্ষে রাজাকে মূর্তিটি দান করেন। শর্তানুয়াযী বিষ্ণুমূর্তির নাম হয় রাবিজলোচন। রাজার প্রতিশ্রুতি অনুযাযী সস্ত্রীক রাজিম তেলিনের প্রস্তর মূর্তি আর এক মন্দিরে প্রতিস্থাপিত হয়।

চলে এলাম সেই রাজিম তেলিন মন্দিরে। রাজিবলোচন মন্দিরের সামনে ও মহাদেব মন্দিরের পিছনে এই মন্দির। মন্দিরের অভ্যন্তরে এক পুরুষ ও এক নারীর মূর্তি। করজোড়ে ধ্যানরত। এই মূর্তিই সস্ত্রীক রাজিম তেলিনের বলে মনে করা হয়। মূর্তির দুই দিকে রয়েছে দুই পরিচারিকাও। মন্দির কমিটির অফিস ঘুরে চলে এলাম এবার জগন্নাথ মন্দিরে। মন্দিরটি আবার আর এক আয়তকার ঘেরা জায়গার মধ্যে। সে চত্বরে যাওয়ার দ্বার চতুর্পার্শ্বের দেওয়া ভাস্কর‌্য থেকে চোখ ফেরানো অসম্ভব। জগন্নাথ মন্দিরের চত্বরে আবার সাধু-সন্তদের আখড়া। ফালি জমিতে সবজি চাষ। ছড়িযে ছিটিয়ে গৃহস্থালির টুকিটাকি।

ওখান থেকে ঘুরে এবার রামচন্দ্র মন্দির। এই মন্দিরের মণ্ডপ অংশের স্তম্ভ ভাস্কর‌্যেও পৌরাণিক কাহিনীর চরিত্র চিত্রায়ণের নৈপুণ্যতা অনবদ্য। এছাড়া দেখে নিলাম রাজেশ্বর মন্দির, দানেশ্বর মন্দির, বরাহ মন্দির, নরসিংহ মন্দির, বদ্রিনাথ মন্দির, বামন মন্দির ইত্যাদি। জগত্ পাল দেবের পৃষ্ঠপোষকতায় এই সকল মন্দির শ্রেণি তৈরি হয়েিল বলে মনে করা হয়। এর সত্যতা মেলে রাজিবলোচন মন্দিরের মহামণ্ডপের পাশে রাখা এক শিলাখণ্ডে। সেখানে উল্লেখ আছে রতনপুরের কলচুরি রাজার অধীনস্থ সামন্ত রাজা ছিলেন জগত্ পাল। প্রতিষ্ঠাকাল হিসাবে ১১৪৫ খ্রিষ্টাব্দের উল্লেখ আছে।

চলে এলাম সঙ্গম ঘাটে। ঘাট পথের ডানহাতি উঁচু ঢিপিতে ভতেশ্বরনাথ মন্দির। নাম লেখা পুরাতত্ত্ব বিভাগের বোর্ড ঝুলছে। তবে মন্দির সংস্কারের কাজে হাত পড়েনি আদৌ। ভাঙাচোরা মন্দির। দেয়াল ও স্তম্ভ জুড়ে সর্পের ছবি অাঁকা। তবে মন্দিরের আশপাশ খুঁজলে, মহাদেবের জ্যান্ত বাহনদের দুএকটা দেখা মেলা অস্বাভাবিক নয়। তার পাশেই পঞ্চেশ্বর মহাদেব মন্দির। সে মন্দিরের পঞ্চত্ব প্রাপ্তি ঘটেছে অনেকদিন আগেই। ইট শৈলীর মন্দির এখন সম্পূর্ণ পরিত্যক্ত। ঘাটপাড়ে অবশ্য অজস্র মন্দির। যেন মন্দিরমালা। আছে মহাদেব মন্দির,

দত্তাত্রেয়-মন্দির, মহামায়া মন্দির, লক্ষ্মী-নারায়ণ মন্দির, শীতলা মন্দির, ভৈরব মন্দির, বিশ্বকর্মা মন্দির, গরিবনাথ মন্দির, ইত্যাদি। এর মধ্যে মহাদেব মন্দির অভ্যন্তরে শেষনাগের মূর্তিটি বিশেষ উল্লেখের দাবি রাখে।

নেমে গেলাম নদীবক্ষে, ত্রিবেণী সঙ্গমে। ফল্গুর মতো করুণ অবস্থা মহানদীরও। নদীবক্ষে শুধু বালি আর বালি। পৈরি, সেন্দুরের বিভাজনও চোখে ধরা পড়ে না। ক্ষীণ বিভাজিত কযেটি জলধারায় নদী অস্তিত্ব বজায় রেখেছে। সেই জলধারাতে স্থানীয় মানুষজন কাপজ-চোপড় কাচছে। অতি কষ্টে করছে স্নান। এই বিস্তৃত বালু সমুদ্র ও হাঁটু জল পেরিযে দলে-দলে চলেছে ভক্তের দল। কুলেশ্বর মহাদেব মন্দিরে। যে মন্দির নদীর অপরপাড়া। আনুমানিক অষ্টম থেকে নবম শতকের। নির্মাতা সামন্ত রাজা জগত্পাল।

এই মন্দিরের আর এক নাম উত্পলেশ্বর মহাদেব মন্দির। রাম-সীতা ও লক্ষণ বনবাসকালে এই স্থানেই বিশ্রাম নিয়েিলেন বলে জনশ্রুতি আছে। শোনা যায় সীতা নিজহাতে সঙ্গমের বালি দিয়ে শিবালিঙ্গ বানিয়েিলেন। এবং নিষ্ঠাসহ পুজোপাঠ করছিলেন। এই পৌরাণিক প্রেক্ষাপটেই এই মন্দির। ভাবা হয় শৃঙ্খলা ও মহত্বের প্রতীক এই মন্দির। লোমশ ঋষির আশ্রম ছিল এরই সন্নিকটে। এখানকার এক শিলালেখে তা উল্লেখ আছে।

গাড়ি ছুটছে। ফেলে আসা পথ ধরে রুদ্ধশ্বাসে। পিছনে পড়ে মহানদী। আর নদী তীরে সমৃদ্ধ নগরীর অতীত কথা। না-ছোড় মন কিন্তু পড়ে আছে অতীতে। সঙ্গম ঘাটে। অথবা পোড়া মন্দিরের প্রকোষ্ঠে। চুন-সুরকির গন্ধমাখা মন্দিরগাত্রের অবাক ছবিতে। হাতে গাছশুদ্ধ কাঁচা ছোলা। রাজিম বাজার থেকে কেনা। এক-একটা ছিঁড়ে খাচ্ছি। যেন ভাবনায় ভর করে আরও চাইছি পিছুতে। মাত্র দশ কিলোমিটার গাড়ি দৌড় শেষে গন্তব্য। বৈষ্ণবতীর্থ চম্পারণে। চম্পারন ঢুকতেই রাস্তার ধারে ধর্মশালা। তাতে গুজরাতি মানুষজনেরই আনা-গোনা। এখানে সাধক বল্লভাচার‌্যের জন্মস্থান। চোখে পড়া

উত্সাহ-উদ্দিপনার নজির মেলে শ্রীচৈতন্যদেবকে নিয়ে নবদ্বীপ ধামে। তার চেযে কম উন্মাদনার নজির মিলল না, বল্লভাচার‌্যকে নিয়ে এখানকার শিষ্যদের। পার্কিং জোনে গাড়ি রেখে এগিযে যাই।

চম্পারনের প্রাচীন নাম ছিল চম্পাকার। শোনা যায় এক তেলুগু ব্রাহ্মণ সস্ত্রীক দাক্ষিণাত্য থেকে যাত্রা শুরু করেন। পদব্রজে তাঁরা চলেছেন গুজরাত। পথ মধ্যে পরে চম্পাকার নগরী সেই সময় এই অঞ্চল ছিল জঙ্গলে পরিপূর্ণ। ব্রাহ্মণ সেই সময় এক সমস্যার সম্মুখিন হন। অন্তঃস্বত্তা ব্রাহ্মণীর প্রসব বেদনা ওঠে। লোকালয় না মেলায় ব্রাহ্মণী এই জঙ্গল মাঝেই প্রসব করেন, এক পুত্র সন্তান। সেই পুত্রই বল্লভাচার‌্য। পরবর্তীতে জঙ্গল কেটে জনপদ গড়ে ওঠে, এই এলাকায়।

বল্লভাচার‌্য-পন্থীরা নির্মাণ করেন বিশাল এক মন্দির। নাম তার সুদামাপুরি।

পাযে পাযে চলে আসি সুদামাপুরিতে। সাধক বল্লভাচার‌্যের নামে উত্সীর্গীকৃত মন্দির প্রাঙ্গণে। দুদিকে একাধিক সুদৃশ্য কালারফুল অট্টালিকা। সবই ধর্মশালা, অথবা ওই সংক্রান্ত কার‌্যালয়। জুতো খুলে এগিযে যাই বাঁধানো মোজাযেের অলিন্দ ধরে। যেন দক্ষিণের রামেশ্বরম মন্দিরের প্রশস্ত অলিন্দপথ। অন্তরালে ঘেরাটোপে সুদামাধাম। মূল গর্ভগৃহের দ্বার রুদ্ধ। নিয়ম মেনে বিকাল পাঁচটার আগে খুলবে না। শুনলাম এর ভিতরে আছে বল্লভাচার‌্যের ব্যবহৃত খড়ম, বস্ত্র, উত্তরীয়, পুজোর সামগ্রী ইত্যাদি। এখন বেলা তিনটে। দুঘন্টা অপেক্ষা করা সম্ভব নয়। তাই ফেরার পথ ধরি।

শুনলাম বৈশাখ মাসে বল্লভাচার‌্যের জন্মতিথি উপলক্ষ্যে ফি-বছর বিশাল ভক্ত সমাবেশ হয়। জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতেও হয় উত্সব। এই সময় মেলা বসে মন্দিরকে কেন্দ্র করে। পার্কিং জোনের কাছে দেখি আবার হনুমানের দৌরাত্ম। হোল ফ্যামিলি রাস্তায় নেমে ফলাহার করছে। আসলে ভক্তদের উত্সর্গীকৃত দানেই কপিকুলের উদরপূর্তি। গাড়ির চাকা গড়ায়। চম্পকেশ্বর মহাদেব মন্দির দেখে এবার রায়পুরের পথে ছুটব। আজকের রাতের ট্রেনেই যে কলকাতা ফিরতে হবে।

ছবিঃ লেখক

কীভাবে যাবেন : কলকাতা থেকে ৮৩১ কিলোমিটার দূরে রায়পুর। ট্রেন পথে যেতে কম-বেশি ১২-১৩ ঘন্টার পথ। ট্রেন যাচ্ছে ১২৮৩৪ হাওড়া-আমেদাবাদ এক্সপ্রেস, ১২৮১০ হাওড়া-মুম্বই মেল, ১২১৩০ হাওড়া-পুণে আজাদ হিন্দ এক্সপ্রেস, ১২১৫২ হাওড়া-লোকমান্য তিলক এক্সপ্রেস, ইত্যাদি। আকাশ পথে গেলে নামতে হবে রায়পুর বিমানবন্দরে। রায়পুর থেকে গাড়ি নিয়ে রাজিম ও চম্পারন দিনে দিনে দেখে নেওয়া যায়।

কোথায় থাকবেন : রেলস্টেশন বা বাস টার্মিনাসের কাছাকাছি বেশকিছু হোটেল মিলবে। এর মধ্যে থেকেই একটু দেখে-শুনে বেছে নিন একটি। রয়েছে ছত্তিশগড় টু্য়রিজম বোর্ড পরিচালিত হোটেল – ছত্তিশগড় (ফোন : ৪২২৪৩৩৩, ০৯৩০০৬-৫২৫৪৮) ২০০০ থেকে ৩০০০ হাজার টাকার মধ্যে। রায়পুরের এসটিডি কোড : ০৭৭১।

অতিরিক্ত : এই সম্বন্ধে আরও জানতে ও রুম বুকিং-এর জন্য যোগাযোগ করুন : ছত্তিশগড় টুরিজম বোর্ড, ২৩০এ, এজেসি বোস রোড, রুম নম্বর-২৫, চিত্রকোট বিল্ডিং, কলকাতা-৭০০ ০২০।ফোন : (০৩৩) ৪০৬৬-২০৮১ / ৯৪৩৩৩-৭০০১১।ওয়েবসাইট : www.chhattisgarhtourism.net

রুদ্রনাথ দর্শন

এই যাত্রাতেও কুম্ভ এক্সপ্রেস সময় মেনে দুপুর ঠিক ১টায় স্টেশন ছাড়ল। মানকড় স্টেশনে ট্রেন এসে পৌঁছোল ২টো ৩৫ মিনিটে। মনে পড়ল, কয়েক বছর আগে এখান থেকেই গিয়েছিলাম যমুনাদিঘি ও ভালকি মাচান বেড়াতে। জানলার বাইরে শরতের আবহাওয়া! হাওয়ায় দুলছে কাশফুল। উজ্জ্বল সূর্যলোকে ঝলমল করছে সবুজ মাঠ। ট্রেনের কামরায় বাংলা গান পুজোর গন্ধকে ছড়িয়ে দিয়েছে সবার মাঝে। বেশ ভালো লাগছে কাচের জানলায় চোখ রাখতে –পুকুরে ফুটে রয়েছে অজস্র পদ্মফুল, আর বকগুলো সাদা পাখা মেলে উড়ে চলেছে আকাশের দিকে। গাড়ি আসানসোল, যোশিডি হয়ে পৌঁছোল ঝাঝা স্টেশনে। স্লখান থেকেই আমাদের ৩ এসি কামরা আপামর জনসাধারণের এক্তিয়ারে চলে এসেছে। আমরাই এখন সংখ্যালঘু! রাত সাড়ে ৯টায় বাড়ি থেকে আনা খাবারে ডিনার সেরে শুয়ে পড়লাম।

সকাল ৭টায় উঠে চায়ে চুমুক দিতেই ট্রেন এসে পৌঁছোল লখনউ স্টেশনে। বেরিলি আসতে পৗনে ১টা। হরিদ্বারে গাড়ি পৌঁছোল ঠিক সময়েই। লাগেজ পিঠে নিয়ে প্লাটফর্মের বাইরে আসতেই দেখি ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়ছে। এসবিআই এটিএম-এ কাজ সেরেই চলে এলাম এক চা-দোকানে। হরিদ্বারে মামুলি কিছু কাজ ছিল। কিন্তু বিরামহীন বৃষ্টিতে পরিকল্পনা পালটে নিয়ে সোজা বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছোলাম এবং ঋষিকেশগামী বাসে চড়ে বসলাম। বাস ছাড়ল সাড়ে ৫টায়, গন্তব্যে পৌঁছোলাম সন্ধে ৭টায়। মদমহেশ্বর যাত্রার সময় যে প্ল্যান করেছিলাম, এবারেও তাই। বাসস্ট্যান্ডের কাছেই স্লক গেস্ট হাউস-এর দোতলায় একটি ঘরে এসে উঠলাম লাগেজ সহ। সেবার অবশ্য ছিলাম বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন অন্য স্লক লজ-এ। এবারের ব্যবস্থাটা কৌলীন্যে একটু উঁচুতে। উদ্দেশ্য একটাই, ভোরে গোপেশ্বরগামী প্রথম বাসটা ধরা। ডিনার সেরে শুয়ে পড়লাম রাত ১টায়।

গোপেশ্বর যাবার প্রথম বাস ভোর ৪টেয়। লাগেজ বাসের ডিকিতে ঢুকিয়ে অপেক্ষা করতে থাকি। ইতিমধ্যে, প্রাতঃকালীন চা-বিস্কুট খাওয়া হয়ে গেছে। আধঘণ্টা পরে বাসের কনডাক্টর জানায়, যাত্রী সংখ্যা কম বলে এই বাস ছাড়বে না। পরবর্তী বাস ভোর সাড়ে ৫টায়। রুদ্রপ্রয়াগগামী বাসটাই যাবে গোপেশ্বর পর্যন্ত। বড়ো ব্যাগ ডিকিতে রেখে ছোটো ব্যাগ সঙ্গে নিয়ে বসেছি। পতিতপাবনী গঙ্গাকে পিছনে ফেলে, সূর্যের নরম আলো গায়ে মেখে বাস চলতে লাগল পাহাড়ি পথে। ঘণ্টা দুই পরে আমরা দেবপ্রয়াগ এসে পৌঁছোলাম। এখানে যাত্রা বিরতি ২০ মিনিটের। বাস থেকে নেমে এক দোকানে বসে গরম গরম আলুপরোটা ও চায়ে প্রাতরাশ সারলাম। সকাল সাড়ে ৮টা নাগাদ ভাগিরথী-অলকনন্দার সঙ্গমস্থল ছেড়ে বাস আবার চলতে শুরু করল। বেলা ১টায় বাস এসে পৌঁছোল রুদ্রপ্রয়াগ। দুই বছর আগের যাত্রার স্মৃতি ভেসে আসে মনে– সেবারে এখান থেকেই বাস পরিবর্তন করতে হয়েছিল। এখানেও যাত্রাবিরতি, তাই বাস থেকে নেমে কিছুদূর এগিয়ে মন্দাকিনী ও অলকনন্দার সঙ্গমের ছবি নিলাম। গোচর ছাড়িয়ে বাস কর্ণপ্রয়াগ-এ পৌঁছোল দুপুর সোয়া ১টায়। রুদ্রপ্রয়াগ-এর মতো কর্ণপ্রয়াগও আজ চামোলী জেলার এক ব্যস্ত, বড়ো শহর। এখানে অলকনন্দার মিলন ঘটেছে পিণ্ডারী নদীর সঙ্গে। এই জায়গা মহাভারতের মহাবীর কর্ণের তপস্যাস্থল। আমার সবচেয়ে প্রিয় এই প্রয়াগে অনেকটা সময় কাটিয়েছিলাম।

নন্দপ্রয়াগ এসে পৌঁছোলাম দুপুর দেড়টা নাগাদ– এই স্থানে মন্দাকিনী মিলিত হয়েছে অলকনন্দার সঙ্গে। পরিচিত পথে চামোলী শহর পেরিয়ে গোপেশ্বর এসে পৌঁছোলাম দুপুর ৩টেয়। লাগেজ নামাতেই নজরে এল অপেক্ষারত এক জিপের। মাথা পিছু ২০ টাকা ভাড়া দিয়ে পৌঁছোলাম ৫ কিলোমিটার দূরে সাগর গ্রামে, আমাদের প্রথম গন্তব্যস্থল। গাড়ি থেকে মালপত্র নামিয়ে চেক-ইন করলাম হোটেলে। ঘড়িতে তখন বিকেল ৩টে বেজে ৫মিনিট।

অ্যাটাচ্ড বাথরুম সহ ঘর বেশ পরিষ্কার।নিজেদের মোবাইল ও পাওয়ার ব্যাংক চার্জ করতে দিয়ে সামনের ডাইনিং হলে এসে বসলাম। এরপর চায়ের গেলাস হাতে নিয়ে বাইরে এলাম। কিছু দূরেই সগরেশ্বর মহাদেব মন্দির দেখা যাচ্ছে। একটু পরে হোটেল থেকে কিছুটা এগিয়ে পথের ধারে এক জায়গায় এলাম। সেখান থেকে সিঁড়ি নেমে গেছে নীচে ঘুরে ঘুরে। দেখছি, ধাপে ধাপে ফসলের চাষ– ধান, গম, মনুয়া, কলাই ও তিল। মন্দিরের পিছনে পাহাড়, সামনে ও দুই পাশে চাষজমি। উপরের পাহাড় থেকে আগত কয়েকটি ঝরনাধারা প্রতিটি ধাপের চাষজমিকে ভিজিয়ে দিয়ে নীচে নেমে আসছে  এবং সেই জমা জলকে পুনরায় চাষের কাজে লাগানো হচ্ছে। এক অনুপম প্রাকৃতিক জলসেচ ব্যবস্থা! ধীরে ধীরে পৌঁছোলাম প্রাচীন সকলেশ্বর (সগরেশ্বর) মন্দিরে। কয়েক বছর আগেই সংস্কার করা হয়েছে সকলেশ্বর মহাদেব মন্দির এবং পাশেই অবস্থিত মা চণ্ডিকা দেবী ও লক্ষ্মীনারায়ণ মন্দিরে। জানলাম, সূর্যবংশীয় রাজা বাহু-র পুত্র মহারাজ সগর-এর জন্মভূমি, ক্রীড়াভূমি, শিক্ষাস্থল ও উপাসনাস্থল এই সাগর গ্রাম। সগর রাজা শিব ও শক্তি (মা চণ্ডিকা)-র উপাসনা করে পুনরায় অযোধ্যা রাজ্য জয় করেন। তাঁর উপাসনাস্থলেই রয়েছে ওই প্রাচীন তিন মন্দির। মন্দিরের শান্ত পরিবেশ সহজেই মন কেড়ে নেয়। মন্দির থেকে ফেরার পথে আমরা আলাপ করলাম চাষের কাজে ব্যস্ত রমণীদের সঙ্গে। তারাই দেখাল, কোন জমিতে কোন ফসলের চাষ হচ্ছে।

হোটেলে ফিরে আর এক দফা চা খেয়ে লাগেজ গুছোতে শুরু করলাম। ঠিক হল, একটা রুকস্যাকে আমাদের দুজনের প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে গাইড রুদ্রনাথের পথে এগোবে। বাকি জিনিস সমেত অন্য রুকস্যাকটা থাকবে এই হোটেলেই। ট্রেকিং শেষে আমাদের ফোন পেলেই স্লই হোটেল থেকে লাগেজ পাঠিয়ে দেওয়া হবে মণ্ডলে ঠিক করা হোটেল-স্ল। রাতে গরম রুটি, ডাল ও সবজিতে ডিনার সেরে নিয়ে শুয়ে পড়লাম। কাল ভোর সাড়ে ৪টেয় উঠতে হবে।

আমাদের গাইড প্রদীপ সিং রানা ভোর হতেই চলে এসেছে হোটেলে। আমরাও গরম জলে স্নান সেরে, চা-বিস্কুট খেয়ে তৈরি হয়ে নিয়েছি ৬টার মধ্যে। হোটেল মালিক-এর সামনেই ঠিক হল, গাইডকে  পারিশ্রমিক এবং থাকা-খাওয়ার খরচ দেওয়া হবে। প্রদীপ স্থানীয় গাড়োয়ালি যুবক। সে রুকস্যাক পিঠে তুলে নিল,  আমাদের পিঠে ন্যাপস্যাক ও হাতে লাঠি। ঠিক সকাল সোয়া ৬টায় হোটেল ছেড়ে বের হলাম। একটু এগিয়েই এক দোকান থেকে

২ প্যাকেট ধূপ কিনে নিলাম, কারণ মন্দির চত্বরে কিছুই পাওয়া যাবে না। সাড়ে ৬টায় রুদ্রনাথ যাত্রার প্রবেশদ্বারে পৌঁছোলাম এবং চতুর্থ কেদারের উদ্দেশ্যে প্রণাম জানিয়ে যাত্রা শুরু করলাম।

গ্রাম পেরিয়ে, ঘাস জমিকে নীচে রেখে, পাহাড়ি পথে উপরে উঠতে লাগলাম। সকাল ৭টা ৪০ মিনিটে, পৌঁছোলাম চন্দ্রকোঠি। সেখানে গজেন্দ্র সিং-এর ধাবায় বসে চা খাওয়ার সময় জানলাম, দোকানে প্রায় ৩ঙ্মজন যাত্রীর রাত কাটানোর ব্যবস্থা রয়েছে। ১৫ মিনিটের বিরতি নিয়ে আবার চলা শুরু করলাম। এবার পাথুরে পথ এগিয়েছে হালকা জঙ্গলের মধ্য দিয়ে। গাছের পাতা চুঁইয়ে সূর্যের নরম আলো শরীর ছুঁয়ে যাচ্ছে। নিস্তব্ধ বনপথ, চড়াই ক্রমশ বেড়ে চলেছে।

গত রাতে বৃষ্টি না হলেও আগের ২-৩ দিন প্রচুর বৃষ্টি হয়েছিল। ফলে পথ বেশ পিছল। দু’পাশেই ফার্ন-এর জঙ্গল, ভিজে পাথরের ওপর মসের আস্তরণ। ক্বচিৎ কখনও পাখির ডাক। বাঁ-দিকে সবুজ পাহাড় রোদে উজ্জ্বল। বনে বিশাল সব ওক, মাঝারি সাইজের ব্রাস এবং নাম না জানা অজস্র বুনো গাছ। শুনে চলেছি ঝিঁঝি পোকার একটানা কলতান।

পুঙ বুগিয়ালে এসে পৌঁছোলাম ৯টা নাগাদ। প্রায় ৩প্তঙ্ম০ ফুট উঁচুতে অবস্থিত ছোট্ট বুগিয়ালটি ভারি সুন্দর, তিন দিকে পাহাড় দিয়ে ঘেরা। সাগর থেকে ৩ কিলোমিটার দূরে এই বুগিয়ালে এক রঙিন ছাতার নীচে বসার ব্যবস্থা। তাঁবু খাটানো ধাবার মালিক দেবেন্দ্র সিং এগিয়ে এসে আমাদের আমন্ত্রণ জানালেন। শিশিরভেজা ঘাসের ওপর বড়ো পলিথিনের চাদর পেতে দিলেন। আমরা সেখানে লাগেজ রেখে হাত-পা ছড়িয়ে বসলাম। সঙ্গে আনা কিছু শুকনো খাবার খেয়ে আরাম করে চা পান করলাম। ছবি নিলাম বুগিয়ালের, দেবেন্দ্র সিংকে সঙ্গে নিয়ে। উল্লেখ্য, পুঙ বুগিয়ালে বন বিভাগের তৈরি একটি শৗচালয়ও আছে।

এবার চড়াই আরও কঠিন। ধীরে ধীরে হাঁটছি। প্রথম বার দেখলাম গাছের ডালে হনুমানের সতর্ক উপস্থিতি। খরস্রোতা ঝরনার ওপর নির্মিত পুল পার হ’লাম। অসাধারণ সুন্দর জায়গা। বেলা বেড়েছে, গাছের ফাঁক দিয়ে সূর্যের আলো এসে চলার পথকে আলোকিত করেছে। পথের ধারে সাদা বুনো ফুল, মাথার ওপরে গাছে হলুদ ফুল। স্যাঁতসেঁতে গাছের গায়েও মসের আস্তরণ। দ্স্তুর চড়াই অতিক্রম করে বেলা ১রটা ১প্তমিনিটে চক্রগনি-তে এসে পৌঁছোলাম। এখানে ১৫ মিনিটের চা-বিরতি।

আবার হাঁটা শুরু করলাম ধীর লয়ে। পরবর্তী গন্তব্য মৗলি খড়ক, প্রায় ২ কিলোমিটার দূরে। জঙ্গলে উড়ে বেড়াচ্ছে নানা রং-এর প্রজাপতি। পাহাড়ের চূড়ায় নেমে এসেছে সাদা মেঘ। চারিদিক একেবারে নিশ্চুপ। শুধু দূর থেকে ভেসে আসছে ঝরনার জলের একটানা শব্দ। পথের দু’পাশেই বহু রডোডেনড্রন, যদিও ফুল আসেনি গাছে। ভয়ংকর চড়াই ভেঙে দুপুরে পৌঁছোলাম মৗলি খড়ক-এ। এখানে থাকার কোনও জায়গা নেই। তাই একটু থেমেই আবার হাঁটতে শুরু করলাম। চড়াই ক্রমশই বাড়ছে। তাই আমাদের হাঁটার গতি আরও মন্থর হয়েছে। জঙ্গলের ঘনত্ব কমেনি একটুও। আকাশে হঠাৎই মেঘের উপস্থিতি। বহু কষ্টের পর লিউটি বুগিয়াল-এ এসে পৌঁছোলাম।

কিষাণ সিং বিস্ত-এর ধাবায় লাগেজ নামিয়ে রাখতেই বৃষ্টি শুরু হল। পুঙ বুগিয়াল থেকে কম করেও ৫ কিলোমিটার হেঁটে এসেছি এখানে। শরীর আর চলছিল না। তাই জুতো খুলে বসে পড়লাম কম্বলের ওপরে। গরম চায়ের সঙ্গে মশলা-মুড়ি খেতে খেতে অপেক্ষা করছি যদি বৃষ্টি থেমে যায় তাড়াতাড়ি। ইতিমধ্যে কয়েকটি মিশমিশে কালো কাক চলে এসেছে ধাবার উঠোনে। আবহাওয়া আরও খারাপ হল, সঙ্গে আরও বৃষ্টি। আমাদের লক্ষ্য ছিল, সন্ধের আগে পানার বুগিয়ালে পৗঁছোনো। বিকেল সাড়ে ৪টে বেজে গেল, কিন্তু বৃষ্টি থামল না। দিনের আলোয় পানার-এ পৗঁছোনোর সময় হাতে আর রইল না। গাইড প্রদীপও চাইছিল না আর এগোতে। মনকে শান্ত করলাম, লিউটি বুগিয়ালেই রাত কাটাব।

বিকেল ৫টা নাগাদ বৃষ্টি থেমে গেল। বাইরে এসে দাঁড়ালাম। পাহাড়ের ঠিক নীচেই এই ছোট্ট বুগিয়াল। দেখছি আকাশে মেঘের খেলা। সন্ধে ঘনিয়ে আসছে। কিষাণ সিং-এর বউ তাদের গরুগুলোকে সামনের গোশালায় ঢুকিয়ে দিয়ে এল। ঠিক তখনই বিশাল, পোষা পাহাড়ি কুকুরটা চলে এল ধাবার উঠোনে, রাতে পাহারা দেবার জন্য। সন্ধেবেলায় পুজো সেরে রান্নার কাজে বসলেন কিষাণ সিং। তিনি কাজের ফাঁকে গল্প করতে লাগলেন আমাদের সঙ্গে। জানালেন, সকাল ৬টায় আলো ফোটার আগে আমাদের বুগিয়াল ছেড়ে যাওয়া ঠিক হবে না। তাছাড়া লিউটি থেকে পানার বুগিয়ালের দূরত্ব প্রায় ৪ কিলোমিটার, দুই ঘণ্টার বেশি সময় লাগবে না। রাত ৮টায় সয়াবিন-এর বড়ি সহযোগে মিক্সড ভেজিটেবল্স ও রুটি দিয়ে ডিনার সেরে নিলাম। ক্লান্ত আমরা, ৯ টার আগেই শুয়ে পড়লাম।

ভোর সাড়ে ৫টায় বিছানা ছেড়ে উঠে পড়েছি। হাত-মুখ ধুয়ে, পরিষ্কার হয়ে, ব্যাগ গুছিয়ে নিলাম। গরম চা পান করে সকাল সাড়ে ৬টার মধ্যে লিউটি বুগিয়াল ছেড়ে বেরিয়ে পড়লাম। আমাদের গন্তব্য পানার বুগিয়াল। এই পথের সবচেয়ে বড়ো ও সুন্দর বুগিয়াল। গত রাতের বিশ্রাম আমাদের হাঁটার গতিকে বাড়িয়ে দিয়েছে। প্রথম সকালে হিমালয়ের স্নিগ্ধ রূপ দেখব না দ্রুত হেঁটে লক্ষ্যে পৌঁছোব, ঠিক করতে পারছি না। প্রায় ৪৫ মিনিট ধরে চড়াই ভাঙার পর জঙ্গল হালকা হল। আমরা দ্রুত এগিয়ে চললাম। আরও আধ ঘণ্টা হাঁটার পর কিছু দূরে দেখা পাওয়া গেল এক সবুজ বুগিয়ালের। বুঝলাম, গন্তব্য আর বেশি দূরে নয়। আরও কিছুদূর হেঁটে ঠিক পৗনে ৮টায় পৌঁছে গেলাম এক বিশাল বুগিয়ালে। চোখের সামনে পানার বুগিয়াল। গিরিরাজ হিমালয়ের কোলে এ যেন এক স্বর্গরাজ্য! বহুদিন মনে পোষণ করার পর আজ সে ধরা দিয়েছে তার অনিন্দ্য সুন্দর রূপকে সম্পূর্ণ উন্মোচন করে। সুবিস্তৃত, ঢালু, সবুজ প্রান্তরের পিছনে বিভিন্ন উচ্চতায় বিশাল সব প্রস্তরখণ্ড মাটি ফুঁড়ে বেরিয়ে পড়েছে। তারও পিছনে তুষার শুভ্র হিমালয়ের বিখ্যাত সব শৃঙ্গরাজি। মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে কিছুক্ষণ বুগিয়ালের রূপ উপভোগ করে এগিয়ে গেলাম দিলওয়ার সিং-এর ধাবায়। এখানে ট্রেকারদের থাকা-খাওয়ার জন্য ভালো ব্যবস্থা আছে। ধাবার পিছনে বনবিভাগের তৈরি একটি শৌচালয়ও আছে। অর্জুন সিং জানাল, ধাবায় থাকা-খাওয়া-শোওয়া-র ভালো ব্যবস্থা আছে। বেশ খিদে পেয়েছিল। চেয়ারে বসে আরাম করে খেলাম গরম ম্যাগি ও চা।এরপর পানার বুগিয়ালের ছবি নিলাম বিভিন্ন স্থান থেকে।

আধ ঘণ্টা বিশ্রামের পর আবার হাঁটা শুরু করলাম। এবার গন্তব্য ৩ কিলোমিটার দূরে পিত্রাধর টপ্। অনেকটা পথ হাঁটলাম হালকা চড়াইয়ে। সামনে তাকালে দেখা যাচ্ছে সুউচ্চ শৃঙ্গগুলি– ত্রিশূল, দ্রোণাগিরি, হাতি, ঘোড়ি, নন্দাদেবী ও নন্দাঘুণ্টি। যত এগোচ্ছি, যত চড়াই ভাঙছি, হিমালয়ের শৃঙ্গগুলি ততই যেন বিভিন্ন আঙ্গিকে ধরা দিচ্ছে চোখের সামনে! ওপর থেকে দেখছি, সবুজ পাহাড়ি ঢাল ক্রমশ মিশে গিয়েছে বুগিয়ালে।

এইবার খাড়া চড়াই শুরু হল। সে চড়াই-এর যেন শেষ নেই। ঘণ্টা দেড়েক পরে, অনেকটা উঁচুতে দেখতে পেলাম পিত্রাধর-এর

লাল-হলুদ পতাকা। আবার উজ্জীবিত হয়ে হাঁটতে লাগলাম। ভয়ংকর চড়াই শেষে সকাল স্লগারোটা নাগাদ পৌঁছে গেলাম পিত্রাধর টপ্-এ। কয়েক মিনিট সেখানে দাঁড়িয়ে আবার হাঁটা শুরু করলাম। হঠাৎই কোথা থেকে একখণ্ড মেঘ এসে আমাদের ছুঁয়ে গেল। পঞ্চগঙ্গার পথে চড়াই কম, বেশিটাই উতরাই। মোটামুটি দ্রুত হাঁটছি আমরা। এখান থেকে পথের দু’পাশেই রডোডেনড্রনের জঙ্গল। ঘড়িতে ১টা ৪৫ মিনিট। আমরা এসে পড়েছি ২ কিলোমিটার দূরে পরের গন্তব্যে। দেখছি পথের ধারে ছোটো-বড়ো পাথরে বাঁধানো এক জায়গা থেকে নলের মাধ্যমে জল পড়ছে, সেখানে লেখা ‘পঞ্চ গঙ্গা’। সামনে এগোলেই একটি ধাবা। তার উলটো দিকে পাথরে তৈরি সুন্দর এক বসার জায়গা। আমরা সেখানেই লাগেজ নামিয়ে বসলাম।

চা-বিরতি প্রায় ২০ মিনিটের। ফটো তোলার সুযোগও পাওয়া গেল।

পঞ্চগঙ্গা থেকে রুদ্রনাথ-এর দূরত্ব প্রায় ৩ কিলোমিটার। এবার অনেকটা পথ উতরাইয়ে। দু’পাশে শুধু রডোডেনড্রনের বন। মাসখানেক পরে ফুলে ফুলে ভরে যাবে এই জায়গা। বাঁদিকে পাহাড়ের গায়ে ঘাস বন– সেখানে বেগুনি, হলুদ ও সাদা ফুলের ছড়াছড়ি। রুদ্রনাথ মন্দিরের আধ কিলোমিটার আগেই থাকা-খাওয়ার জায়গা ‘যাত্রী নিবাস’। সেখানে পৌঁছোলাম দুপুর ২টো নাগাদ। লাগেজ নামিয়েই মন্দির দর্শন করলাম।

মন্দিরের দরজা তখন বন্ধ, খুলবে বিকেল সাড়ে ৪টেয়। মন্দিরের কাছাকাছি কয়েকটি  পবিত্র কুণ্ডের অবস্থান– সূর্য কুণ্ড, চন্দ্র কুণ্ড, তারা কুণ্ড, মানা কুণ্ড, যোধা কুণ্ড ইত্যাদি। মন্দিরের কিছুটা নীচে বয়ে চলেছে বৈতরণী নদী যাকে রুদ্রগঙ্গাও বলা হয়। আকাশ পরিষ্কার। দেখতে পাচ্ছি ত্রিশূল, নন্দাদেবী, দেবস্থান, হাতি পর্বত, নন্দাঘুণ্টি এবং আরও কয়েকটি অজানা শৃঙ্গ।

রুদ্রনাথে প্রচণ্ড ঠান্ডা এই সময়ে। সাড়ে ৩টে নাগাদ গরম ম্যাগি ও চায়ে খিদে ও তৃপ্তি মেটালাম। তখনই আলাপ হ’ল মালয়েশিয়া থেকে আগত দু’জন তামিল যুবকের সঙ্গে। তারা দুজনেই ধর্মপ্রাণ এবং একই সঙ্গে পঞ্চকেদার পরিক্রমা করছে। আরও আলাপ হ’ল দিল্লিবাসী রাজেন্দ্র সিং রাওয়াত ও তাঁর পত্নীর সঙ্গে। পরে জেনেছিলাম, রাজেন্দ্রজি দেশের প্রায় সব শিবতীর্থই দর্শন করে ফেলেছেন। সকলেই সন্ধে সাড়ে ৬টার মধ্যে পৌঁছে গেলাম রুদ্রনাথের গুহামন্দিরে আরতি দর্শনের জন্য।

অসাধারণ পরিবেশ মন্দিরে। ভক্তগণ সমবেত হয়েছেন নীরবে। ঠিক সন্ধে ৬টা ৪৫ মিনিটে আরতি শুরু হ’ল। গুহামন্দিরের সঙ্গে যুক্ত ঘরের ছাদ থেকে ঝুলছে বিভিন্ন আকারের ১ঙ্ম-রচ্টি ঘণ্টা। আরতি শুরু হতেই ভক্তজনেরা ঘণ্টা বাজিয়ে যোগদান করলেন। বর্তমান পূজারি সৗম্যদর্শন হরিশ ভাট, গাড়োয়ালেরই বাসিন্দা। প্রথমে তিনি ধুনুচি নিয়ে এবং তারপর পঞ্চপ্রদীপ-এ আরতি করতে লাগলেন। এবার চামর দুলিয়ে এবং শেষে ডুগডুগি বাজিয়ে আরতি সম্পন্ন করলেন শুদ্ধ মন্ত্রোচ্চারণের সঙ্গে। মহাদেবের বাঁ পাশে পিতলের সাপ, ডান পাশে পিতলের কমণ্ডলু ও ত্রিশূল। আরতি শেষে আমরা সকলেই দীপশিখার ওম্ স্পর্শ করলাম।

আরতির পরে এবার মন্ত্রোচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে পূজারিজি মুখরূপী, স্বয়ম্ভূ শিবলিঙ্গ থেকে ধীরে ধীরে, এক এক করে খুলে নিলেন মালা ও রাজ (রুদ্র) বেশ। আমার অনন্ত প্রতীক্ষার অবসান ঘটল। চোখের সামনে উন্মোচিত হলেন চতুর্থ কেদার, তাঁর শান্ত ক্ষমাশীল, সমাহিত রূপে। আমি অপলক দৃষ্টিতে সেই অনুপম রূপ অবলোকন করে ধন্য হলাম। ধীরে ধীরে মন্দিরের বাইরে এলাম এবং ফিরে চললাম পুষ্পিন্দর সিং-এর ধাবায়। রাতে আমাদের ইচ্ছে অনুযায়ী গরম খিচুড়ি পরিবেশন করা হল আলুভাজা ও পাঁপড় ভাজা সহ। আজ রাতে যাত্রীনিবাস বিভিন্ন বয়সের তীর্থযাত্রীতে ভর্তি। দুই পোর্টার-এর সঙ্গে কিছুক্ষণ গল্প করে শুয়ে পড়লাম।

সকাল ৬টায় উঠে পড়লাম। মুখ ধুয়ে প্রথমে গরম চা খেয়ে নিলাম। এবার পোশাক পরিবর্তন করে ৭টার মধ্যেই মন্দিরে পৗঁছে গেলাম। রুদ্রনাথের অভিষেক ক্রিয়া শুরু হল সকাল সাড়ে ৭টায়। পূজারিজি শিবলিঙ্গ শোধন করে পরম যত্নে এক এক করে সমস্ত অলংকার পরাতে লাগলেন– পিছন থেকে তাঁর সহকারীর মন্ত্রোচ্চারণ চলতে লাগল। মহাদেব ধারণ করলেন রুদ্ররূপ। অভিষেক ক্রিয়া সম্পূর্ণ হল দুই ঘণ্টা পরে। বেলা ১ঙ্মটায় আমরা পুজো দিলাম। আমাদের সঙ্গে আনা রুপোর বিল্বপত্র শোভিত হল মহাদেবের মস্তকে। এরপর হোম চলল প্রায় এক ঘণ্টা ধরে। ফুল ও প্রসাদ নিয়ে আমরা যখন ধাবায় ফিরলাম, তখন ঘড়িতে বেলা সোয়া ১টা। বুঝলাম, অনেক দেরি হয়ে গেছে। আজ আর কোনওভাবেই মণ্ডল পৌঁছোনো যাবে না। লাগেজ গুছিয়ে নিয়ে দ্রুত রুটি-সবজি ও চা খেয়ে নিলাম। ধাবার বিল মিটিয়ে পিঠে স্যাক ও হাতে লাঠি নিয়ে আমরা ফিরতি যাত্রা শুরু করলাম ঠিক দুপুর ১টায়।

শীতকালে মহাদেবের প্রতীকী অবয়ব গোপেশ্বরে নিয়ে এসে পূজা করা হয়। ডোলিযাত্রা গোপেশ্বর থেকে শুরু হয়ে সাগর, লিউটি, পানার পেরিয়ে পিত্রাধর এসে পৌঁছোয়। সেখানে পূর্বপুরুষদের পুজো করা হয়। ধালাবনি ময়দান পেরিয়ে ডোলি রুদ্রনাথ এসে পৗঁছোয়। সেখানে প্রথমে বনদেবী-র পুজো করা হয়, যাঁকে অঞ্চলের রক্ষাকর্ত্রী বলে মানা হয়। শ্রাবণ মাসে রাখী পূর্ণিমার দিন বার্ষিক মেলা উদ্যাপিত হয় রুদ্রনাথ মন্দিরে।

যাত্রীনিবাস থেকে পঞ্চগঙ্গা পর্যন্ত প্রায় পুরোটাই চড়াই পথ। দু’পাশে রডোডেনড্রনের বন ও ঘাস জমি। আমরা এগোচ্ছি ধীর পায়ে। পঞ্চগঙ্গা পৌঁছোতে দুপুর সোয়া ১টা বেজে গেল। সেখানে ১০ মিনিট বিশ্রাম করে, একেবারে খাড়া চড়াই ভেঙে পাহাড়ের শীর্ষদেশে পৌঁছোলাম আধ ঘণ্টায়। হঠাৎই আবহাওয়া খারাপ হয়ে গেল। আকাশ জুড়ে শুধু মেঘ আর মেঘ। গাইড প্রদীপের পিছু পিছু বিপজ্জনক শৈলশিরা ধরে বাঁদিকে এগিয়ে গেলাম, কোনও ভাবে ঘাসের গোছা আঁকড়ে ধরে। হঠাৎ গাইডের খেয়াল হয়, সে ভুল পথে চলে এসেছে। বহু কষ্টে সেই শৈলশিরা ধরে ফিরে আসি পূর্বস্থানে। বৃষ্টিতে দেখা যাচ্ছে না পথ। ভাগ্যক্রমে, নীচে এক জায়গা থেকে স্থানীয় এক ব্যক্তি আমাদের গাইডকে সঠিক রাস্তা দেখিয়ে দিল। ভুলের জন্য আধ ঘণ্টা অমূল্য সময় নষ্ট হল। এবার ডান দিক ধরে চলতে শুরু করলাম অনসূয়ার উদ্দেশ্যে। মিনিট দশেক হাঁটার পরেই শিলাবৃষ্টি শুরু হল। ছোটো বড়ো শিলা পড়তে শুরু করল মাথায়। তাড়াতাড়ি মাথা ও লাগেজ ঢেকে নিলাম পলিথিনের চাদরে। কখনও জঙ্গল পথে, কখনও ঘাসবনের মধ্য দিয়ে ভয়ানক বিপজ্জনক পথে নামতে লাগলাম আমরা। নীচে তাকালে রক্ত হিম হয়ে যায়! অন্তত তিন-চার হাজার ফুটের ভয়ংকর উতরাই। অবিরাম শিলাবৃষ্টি হয়ে চলেছে। গত কয়েকদিনের বৃষ্টিতে ঘাসঝোপের অস্বাভাবিক বাড়-বাড়ন্ত! পথ খুঁজে পাওয়াই মুশকিল হয়ে পড়ছে। প্রত্যেকেরই গলা শুকিয়ে কাঠ, নিজেদের দুর্বল মনে হচ্ছে। এবার একটু সুরক্ষিত স্থানে এসে পাহাড়ের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়ালাম। প্রত্যেকেই কিছুটা করে শুকনো ফল খেয়ে জলে গলা ভেজালাম।

এবার আবার শুরু হল জঙ্গল পথ। পিছল পথে ক্রমশ নীচে নেমে চলেছি। প্রায় দেড় ঘণ্টা ধরে নীচে নেমে আসার পর আরও কিছুটা নীচে নজরে এল ছোট্ট এক বুগিয়াল। আমরা অনেকটা নীচে নেমে এসেছি। মনে আশা, কোনওরকমে ওই বুগিয়ালে পৌঁছোতে হবে যেখানে দেখা যাচ্ছে দুটি পাতা ছাওয়া ঘর। হয়তো কোনও একটাতে মিলে যাবে রাতে থাকার আশ্রয়। গাইড দ্রুত নেমে গেল খোঁজ নিতে। আমরা টলতে টলতে বুগিয়ালের কাছে এসে পৌঁছোলে গাইড জানায়, ঘর দুটি মেষপালকদের, যেখানে ট্রেকারদের জন্য থাকা-খাওয়ার কোনও ব্যবস্থা নেই। আশাহত হ’লাম ভীষণ ভাবে। আমরা সেখানে গিয়ে বসলে একজন মেষপালক পাঁচ মিনিটের মধ্যে গরম চা নিয়ে চলে এল। বেশি মিষ্টি চা আমাদের শরীরে জোগাল প্রয়োজনীয় শর্করা। আমরা জোর করে তাকে কিছু টাকা দিয়ে আবার হাঁটা শুরু করলাম। বুগিয়ালের লোকেরা জানাল, নিকটবর্তী কাণ্ডাই বুগিয়াল আরও ৩ কিলোমিটার দূরে। আরও জানাল, পিত্রাধর থেকে নাওলা পাস হয়ে এলে আমরা পৌঁছোতাম হানসা বুগিয়ালে।

ঘড়িতে সন্ধে পৗনে ৬টা। তাই, আরও ঘণ্টাখানেক আলো থাকবে পথে। কিন্তু মেঘলা আবহাওয়ায় আধ ঘণ্টার মধ্যেই অন্ধকার ঘনিয়ে এল। জঙ্গলপথে আর কিছুই দেখা যাচ্ছে না। বৃষ্টিতে আলগা, পিছল মাটি। এর মাঝে আমরা প্রত্যেকেই এক-দুই বার করে পিছলে পড়েছি মাটিতে। যেখানে সেখানে বড়ো গাছ উলটে পড়ে হাঁটা পথ আটকে দিয়েছে। টর্চ-এর আলোই একমাত্র ভরসা। কখনও হামাগুড়ি দিয়ে, কখনও বুকে হেঁটে, কখনও বা উলটে পড়া গাছের ওপর চড়ে আমরা এগোচ্ছি। পথ যেন আর শেষ হয় না। এখনও পর্যন্ত আনুমানিক ৯০ কিলোমিটার হেঁটেছি চরম প্রতিকূল অবস্থায়। গাইড যদিও বলে চলেছে, আমরা ঠিক পথেই চলেছি, তবু আমাদের মনে বেশ

সংশয়। বহু চেষ্টার পরে গাইড মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করতে সমর্থ হয় কাণ্ডাই বুগিয়ালে ধাবার মালিকের সঙ্গে। তার কথা মতো আমাদের অবস্থান বোঝাতে বার বার গাছের মাথায় টর্চের আলো ফেলতে লাগলাম। প্রায় আধ ঘণ্টা পর কাণ্ডাই ধাবা থেকে ছুটে এল নন্দন সিং বিস্ত। এবার তাকে অনুসরণ করে আরও প্রায় ৪৫ মিনিট পরে রাত ৮টা নাগাদ আমরা এসে পৌঁছোলাম কাণ্ডাই বুগিয়ালে, পঞ্চগঙ্গা থেকে যার দূরত্ব ১১ কিলোমিটার। মনে হল, আমরা যেন নতুন জীবন ফিরে পেলাম!

ছোট্ট ধাবায় আমাদের স্বাগত জানালেন রাওয়াতজি। আমরা খুশি হ’লাম পরিচিত ব্যক্তিকে দেখে। হাত-পা ধুয়ে প্রথমেই গরম চায়ে একটু চাঙ্গা হবার চেষ্টা করলাম। আধভেজা পোশাক পরিবর্তন করে ডিনারে বসলাম। তার পরেই ক্লান্ত শরীরকে বিছানায় এলিয়ে দিলাম।

সকালে উঠে ধাবা থেকে বাইরে এলাম। মন ভরে গেল প্রকৃতির অপার সৗন্দর্যে। ধ্যান মগ্ন হিমালয়ের মাঝে নিজেকে ধন্য মনে করলাম। দূরে, অনেকটা নীচে দেখতে পাচ্ছি অনসূয়া মন্দির ও সংলগ্ন ঘরবাড়ি। ঠিক সকাল সাড়ে ৭টায় দুই গাইডের সঙ্গে আমরা ৭জন যাত্রা শুরু করলাম গহন জঙ্গলের মাঝ দিয়ে।

রাতের বিশ্রাম চলার শক্তি দিয়েছে আবার। আজ ভারি ভালো লাগছে জঙ্গলের শান্ত রূপ! ক্বচিৎ শুনছি পাখির ডাক, নয়তো দূরে বয়ে চলা ঝরনার কলতান। সামনে চলেছে দুই গাইড, পেছনে আমরা চারজন। এবার পার হ’লাম খরস্রোতা এক ঝরনার ওপরে বানানো একটি সেতু। আরও ১৫ মিনিট হাঁটার পর পৌঁছোলাম অত্রিমুনির আশ্রমে যাওয়ার পথে। প্রদীপ সকলের লাগেজ নিয়ে উপরে থেকে গেল। আমরা অন্য গাইডকে অনুসরণ করে সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে চলে এলাম অত্রিগঙ্গার কাছে। কাছেই একটি গুহায় বিশালদেহী এক মৗনীবাবার বাস। নদীতে প্রচণ্ড স্রোত। গাইডের সাহায্যে বিশাল পাথরগুলোর ওপর সতর্ক পা ফেলে একে একে নদী পার হ’লাম। ঘড়িতে তখন বেলা ১রটা। ধীরে ধীরে আশ্রমের ঠিক নীচে গিয়ে পৌঁছোলাম। উপরে তাকিয়ে দেখি, অত্রিগঙ্গা বিপুল জলধারায় পাহাড় থেকে নীচে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। উপরে গুহা আশ্রমে পৌঁছোনোর পথ এই বর্ষায় অত্যন্ত বিপজ্জনক। তাই, নীচে দাঁড়িয়েই মহর্ষির উদ্দেশ্যে প্রণাম জানালাম এবং একই পথে সাবধানে ফিরে গেলাম নদীর অপর পাড়ে।

আবার হাঁটা লাগালাম বনপথে। প্রায় ঘণ্টাখানেক হেঁটে দুপুর সোয়া ১টায়। পৌঁছোলাম ছবির মতো সুন্দর গ্রাম অনসূয়াতে। প্রথমেই চলে এলাম হোটেলে। গত দিনের বর্ষাতে ভিজে যাওয়া পোশাক ও জুতো রোদে শুকোতে দিলাম। তারপর সবাই মিলে গল্প করতে করতে চা খেলাম। লাঞ্চের অর্ডার দিয়ে চললাম অনসূয়া দেবী মন্দিরে। সেখানেও থাকা-খাওয়ার জন্য মন্দির কমিটির ধর্মশালা রয়েছে। আমাদের দেখে পুরোহিত মশাই এসে মন্দিরের দরজা খুলে দিলেন। দর্শন করলাম অনসূয়া দেবীর অপূর্ব সুন্দর মূর্তি।

এরপর গেলাম দত্তাত্রেয় মন্দিরে। ঋষি দত্তাত্রেয়-র মূর্তিটিও অতি সুন্দর। ছোট্ট গ্রামটিতে যেন এক অপার শান্তি! ফিরে এলাম লজে। পিছনে স্নানের জায়গায় গিয়ে সাবান দিয়ে হাত-পা-মুখ ধুয়ে পরিষ্কার হ’লাম। সকলে মিলে লাঞ্চ সারলাম ভাত, কারি ও শাকভাজায়।

৬ কিলোমিটার দূরে মণ্ডলের পথে যাত্রা শুরু করলাম আড়াইটে নাগাদ।

শুরুতে অনেকটা পথ পাথরে বাঁধানো, হাঁটলে পায়ে লাগে। এরপর আবার শুরু হল জঙ্গল, সঙ্গে বৃষ্টি। প্রায় ২ কিলোমিটার হাঁটার পর এএসআই দ্বারা রক্ষিত এক প্রাচীন শিলালিপি দেখতে  পেলাম পথের পাশেই। অনুমান করা হয়, এই শিলালিপি ষষ্ঠ শতকের, যখন সেখানে (সির্কা) রাজত্ব করতেন মৌখান রাজ সরবর্মন । শিলালিপির ছবি তুলে আবার এগিয়ে চললাম।

কিছুক্ষণ হাঁটার পর এক চা-দোকান দেখে সকলে বসে পড়লাম সেখানে। চা খাওয়ার সময় লক্ষ্য করলাম, পাহাড়ের গায়ে অনেক উঁচুতে দাঁড়িয়ে আছে হরিণ প্রজাতির দুই প্রতিভু। বিকেল সাড়ে ৪টের সময় পৌঁছোলাম বর্ধিষ্ণু গ্রাম মণ্ডল-এ এবং আরও ১৫ মিনিট পরে বাস রাস্তার পাশে আমাদের রাতের আশ্রয় ভগৎ সিং বিস্ত-এর হোটেলে। দোতলায় একটি ঘরে আমাদের থাকার ব্যবস্থা। ঘরটা ভালোই, সবরকম সুবিধে যুক্ত। ব্যালকনিতে দাঁড়ালে রাস্তা সহ মণ্ডল গ্রামের অনেকটা দেখা যায়। হালকা গরম জলে স্নান করে নীচে চলে এলাম এবং গরম চায়ে ক্লান্তি দূর করলাম। একটু আগেই জেনেছি, প্রায় সমগ্র গাড়োয়াল অঞ্চলে ছোটো গাড়ি (জিপ, ট্যাক্সি)-র ধর্মঘট চলছে গত তিন দিন ধরে। বুঝলাম, পরদিন সকালে আমাদের জন্যও দুর্ভোগ থাকতে পারে। ইতিমধ্যে, সন্ধেবেলার লোকাল বাসে আমাদের

‘লেফ্ট-লাগেজ’ চলে এল হোটেলে।

ঘরে ফিরে আমরা নিজের নিজের রুকস্যাক গুছিয়ে নিলাম। মোবাইল ও পাওয়ার ব্যাংক-এও যতটা সম্ভব চার্জ দিয়ে নিলাম। রাত সাড়ে ৮টায় ডিনার করতে নীচে নামলাম। মেনুতে ছিল মনুয়া ও গমের রুটি, ভাত, ডাল, আলু, কপির তরকারি। অন্যান্য তীর্থযাত্রীদের সঙ্গে গল্প করতে করতে ডিনার সারলাম। এখনও আমার মন জুড়ে শুধুই রুদ্রনাথ! সত্যিই তো, চতুর্থ কেদার একমাত্র স্বয়ম্ভু লিঙ্গ যার মাধ্যমে দেবাদিদেব-এর অনুপম, ক্ষমাশীল মুখমণ্ডলের প্রকাশ। আমি প্রকৃতই ভাগ্যবান সেই রূপ দর্শন করে। পরদিন মণ্ডল থেকেই যাত্রা শুরু করব কেদারনাথ অভিমুখে।

কীভাবে যাবেন ছ হরিদ্বার বা ঋষিকেশ থেকে গোপেশ্বর আসুন। সেখান থেকে আরও ৫ কিলোমিটার দূরে সাগর গ্রামে অথবা

১৩ কিলোমিটার দূরে মণ্ডল গ্রামে চলে আসুন। সাগর অথবা মণ্ডল থেকে ট্রেকিং শুরু করুন। সাগর থেকে যাত্রা শুরু করে একই পথে নির্বিঘ্নে ফিরে আসুন ২০ কিলোমিটার দূরত্ব। মণ্ডল থেকে ট্রেক করলে চড়াই অতি ভয়ানক, উতরাই আরও বিপজ্জনক, প্রায় ২৪ কিলোমিটারের পথ।

কোথায় থাকবেনঃ সাগর থেকে ট্রেক শুরু করলে থাকুন ‘হোটেল রুদ্র’-তে। পাশেই ‘হোটেল হরি ওম’।

মণ্ডল থেকে ট্রেক শুরু করলে থাকুন ‘হোটেল অনুসূয়া’তে।

কখন যাবেনঃ মে থেকে অক্টোবর পর্যন্ত। বর্ষায় যাত্রা কিছুটা বিপজ্জনক।

ভরতপুর ন্যাশনাল পার্ক

পাখপাখালির স্বর্গ ভরতপুরঃ দিল্লি থেকে খুব দূরে নয়। সেইমতো পথনির্দেশ মেনে গাড়িতে ফরিদাবাদের জনবসতি ছাড়িয়ে মথুরা-ভরতপুরগামী পথ ধরেছি। সঙ্গে রয়েছে জোরালো বাইনোকুলার, ক্যামেরা, চার্জার, টর্চ প্রভৃতি জরুরি অ্যাক্সেসরি।

ভরতপুর স্যাংচুয়ারির গেটে পেৌঁছোতেই মনটা চনমনে হয়ে উঠল। এন্ট্রি টিকিট সংগ্রহ করে সোজা আমাদের আস্তানা, হোটেল ভরতপুর অশোক-এর দিকে এগোলাম।

ভরতপুর ন্যাশনাল পার্ক-এর ডাক নাম কেওলাদেও ন্যাশনাল পার্ক। উদ্যানের ভিতরে প্যাডেল রিকশায় চড়ে জঙ্গলের নির্জনতা উপভোগ করা ও বার্ড ওয়াচিং দুই-ই সারতে পারেন। সামান্য বিশ্রামের পর আমরা এই জঙ্গুলে সফর শুরু করলাম। বনজ গন্ধ নাকে এসে ঝাপটা মারছে ঠান্ডা হাওয়ার সঙ্গে। নানা অচেনা গাছ গুল্মে ভরা জঙ্গলে, এখানে ওখানে স্যাঁতসেঁতে জলাভূমি।

মার্শি ল্যান্ড বলতে যা বোঝায় পাতায় ছাওয়া সেই বনভূমির পথ চিরে চলেছে রিকশা প্রজাতির পাখির বাস এই ভরতপুর। জলের মধ্যে ইতস্তত পড়ে থাকা শুকনো গাছের গুঁড়ির কোথাও মাছরাঙা, কোথাও সারসের ঝাঁক। শুকনো পাতায় সরসর আওয়াজ তুলে একেবেঁকে চলে যায় সরীসৃপ। গাছে গাছে অজস্র গিরগিটি, বাঁদর এমনকী বনবিড়ালেরও দেখা মেলে কদাচিৎ। তপস্বীর মতো বসে থাকতে দেখলাম একটি প্যাঁচাকে। কে বলবে এই প্রাণীটিই রাতে কী ভয়ানক হয়ে ওঠে!

অনর্গল ঝিঁঝিঁর ডাকে কেমন যেন ঝিম ধরে যায়। সেই সঙ্গে চেনা-অচেনা পাখির কলকাকলী। কথা না বলে সেই বন্য সৌন্দর্যের সবটুকু রূপসুধা পান করে চলেছি আমরা। কখনও ক্যামেরায়, কখনও বাইনোকুলারে ধরা দিচ্ছে কপারস্মিথ বারবেট, গ্রিন বি ইটার, ইউরেনিয়ান কুট বা লাফিং ডাভ।

চলতে চলতে এসে পড়লাম এক প্রশস্ত ঝিলের ধারে। একটি মরা গাছকে আঁকড়ে সেখানে বাসা বেঁধেছে অজস্র পরিযায়ী পাখির ঝাঁক। ঝিলের ধার ঘেঁষে পেন্টেড স্টর্ক-এর দল সংসার পেতেছে। চোখে পড়ল কিছু হুইসলিং ডাক-ও। চোখ ভরে দেখছি পাখির স্বর্গভূমি।

গায়ের খুব কাছ দিয়ে সামনের ডালে উড়ে গিয়ে বসল একটি অতিকায় ময়ূর। তার কেকা রবে জঙ্গল চনমনে হয়ে উঠল। অজস্র রঙের পালক। অদ্ভূত কম্বিনেশনে সেজে ওঠা পাখির দল ধরা দিতে লাগল ক্যামেরার ভিউ ফাইন্ডারে।

স্যাংচুয়ারির শেষ মাথায় একটি শিব মন্দির। এই কেওলাদেও শিবের নামেই জঙ্গলের নামকরণ। এখানেই রয়েছে একটি ওয়াচ টাওয়ার। উপরে উঠে পাখির চোখে ধরা দিল গোটা বনস্থলি। একটি নীলকণ্ঠ উড়ে গেল হঠাৎ চমকে দিয়ে। সূর্য ডোবার মুখে যেন কলকাকলিতে মুখরিত হয়ে উঠল গোটা জঙ্গল। রাতের আস্তানায় ফিরল পাখির দল। আমরাও ফিরলাম হোটেলে।

ভোরবেলায় আরও একবার জঙ্গল ভ্রমণের লোভ সামলাতে পারলাম না। নানা রঙের প্রজাপতি এবং কয়েকটি সরীসৃপ চোখে পড়ল। একটি ফেউ ত্রস্ত পায়ে ঢুকে গেল ঝোপের আড়ালে, কয়েকটি সাইবেরিয়ান ক্রেন দাঁড়িয়েছিল আমাদের অভ্যর্থনার জন্য। এই জঙ্গলমহলে আমাদের নীরব উপস্থিতিতে যেন খুশি হল তারাও।

পড়ার জন্য সীমাহীন গল্প-নিবন্ধসাবস্ক্রাইব