আনপ্ল্যান্ড সেক্স

অনুকূল আবহে শরীরে যৌবনের স্রোত তীব্র হয়। আর সেই স্রোতে ভেঙে যায় লজ্জা কিংবা ভয়ের বাঁধ। বিয়ের আগেই সম্ভোগের Unplanned Sex – এর অভিজ্ঞতা হয় অনেকেরই। আর এই আনপ্ল্যান্ড সেক্স নিয়ে আলোচনা এবং পরামর্শ রইল এই লেখায়।

বিষয়ের গভীরে

কেউ-কেউ বিয়ের আগেই দেখাতে পারেন শারীরিক ঘনিষ্ঠতার সাহস। তাই ফুলশয্যার আগেই অনেকে সঞ্চয় করেন সম্ভোগের Unplanned Sex অভিজ্ঞতা। ‘আরাধনা’ ছবির রূপ তেরা মস্তানা গানটির কথাই ভাবুন না! এ প্রসঙ্গে সুজিত সরকার পরিচালিত ‘ভিকি ডোনার’ ছবিটির একটি দৃশ্যও চোখের সামনে ভাসছে। অসীমার প্রেমিক ভিকি খুব স্মার্ট ছেলে। একদিন হঠাৎ অসীমার বাড়িতে ভিকি এসে দেখে, বাড়ি পুরো ফাঁকা। অসীমা ছাড়া বাড়িতে আর কেউ নেই। ব্যস! পেয়ে গেল শারীরিক ঘনিষ্ঠতার অনুকূল পরিবেশ। ‘ঘরমে কোই নেহি হ্যায়! থোড়িই না লুডো খেলেঙ্গে’। হয়তো অসীমাও মনে-মনে ঠিক এমনটাই চেয়েছিল, তাই সে ভিকিকে বাধা দেয়নি।

আসলে যৌবন-ঢেউ যখন শরীরকে উত্তাল করে, তখনই ঘটে অঘটন। নিয়ম কিংবা অনুশাসনের সব বেড়া ভেঙে যায়। মন তখন পাপ-পুণ্যের বিচার করে না। যৌবনের স্বাদ আস্বাদনই তখন মুখ্য হয়ে ওঠে। তখনই অঘটন ঘটে যায় অনেকের জীবনে। আর যদি না-ও ঘটে থাকে, তাহলে ঘটতে কতক্ষণ? সমীক্ষা করলে হয়তো দেখা যাবে, আজকের যুগে সিংহভাগ ছেলে-মেয়েরই আচমকা সম্ভোগের অভিজ্ঞতা রয়েছে কিংবা বিয়ের আগেই সম্ভোগের স্বাদ নেওয়ার ইচ্ছে রয়েছে।

একটা সময় ছিল যখন শুধু পুরুষরাই যৌন স্বাধীনতা ভোগ করার অধিকারী ছিল। নারী তার শরীর ও মনকে তুলে রাখত শুধু স্বামীর জন্য। বিয়ের আগে অন্য কারওর সঙ্গে মেয়েদের শারীরিক মিলনকে ‘পাপ কাজ’ বলে মনে করা হতো। কিন্তু সত্যিই কি এই সামাজিক অনুশাসন মানা সম্ভব হতো? হয়তো অনেককিছুই ঘটত কিন্তু সামাজিক চাপের কথা ভেবে কেউ স্বীকার করত না কিংবা প্রকাশ্যে আসত না ওইসব ঘটনা।

যাইহোক, এখন সময় বদলেছে। এখন মোবাইল, ইন্টারনেট-এর যুগ। যে-কোনও পর্নসাইট-এ ঢুকলেই যৌনতার দুনিয়ায় অবাধ প্রবেশ। তাছাড়া নারী-স্বাধীনতা, প্রি-ম্যারিটাল সেক্স প্রভৃতি বিষয় নিয়ে আজকাল প্রচুর কাহিনিচিত্রও তৈরি হচ্ছে এবং তারই প্রতিফলন ঘটছে সমাজে। অনেকেই সেইসব ছবি দেখে উদ্বুদ্ধও হচ্ছে। অতএব, যখন খুশি সম্ভোগের অভিজ্ঞতা সঞ্চয় কিংবা স্বাদ আস্বাদনের ঘটনা ঘটছে, ঘটবেও।

পরামর্শ

মেয়েরা এখন একাই পথ চলেন, একাই সিদ্ধান্ত নেন। পেশাগত কারণে ঘুরে বেড়াতে হয় দেশ-বিদেশে। কাজ করতে হয় নাইট শিফ্টেও। তাই জড়তাহীন মনোভাব থাকলে সঞ্চয় হতে পারে সম্ভোগের অভিজ্ঞতা। হতে পারে তা কোনও ইমোশনাল মুহূর্তে কিংবা ঘটনাচক্রে। অতএব, ‘জলে নামব অথচ গা ভেজাব না’– এমন সনাতন মানসিকতাকে ঝেড়ে ফেলুন মন থেকে। বরং তৈরি করুন সেক্স সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা। মনে রাখবেন, পুরুষের মতো নারী শরীরেও যৌনচাহিদা তৈরি হয় খুব স্বাভাবিক ভাবে। তাই, রপ্ত করুন সঠিক গর্ভনিরোধক কৌশল। হ্যান্ডব্যাগে রাখুন গর্ভনিরোধক সামগ্রী। যাতে হঠাৎ কারও সঙ্গে শারীরিক মিলন ঘটে গেলেও, ‘ভুল করেছি’ বলে আক্ষেপ করতে না হয়। কিংবা, যার সঙ্গে শারীরিক মিলন ঘটেছিল, অনিবার্য কারণে যদি তার সঙ্গে সম্পর্ক ভেঙেও যায়, তাহলে ‘জীবন বৃথা’ বলে যাতে গিল্টি ফিল না করতে হয়।

কুমারীত্ব বা সতীচ্ছদ (স্ত্রী যোনিতে পাতলা পর্দাবিশেষ) নিয়ে এখন ভাবনার কিছু নেই। কারণ, ছেলেরাও এখন অনেক উদার হয়েছে। ফুলশয্যার রাতে স্ত্রীর সতীচ্ছদ আগেই ছিন্ন হয়েছে (সম্ভোগ, সাইক্লিং কিংবা আঘাতজনিত কারণে ছেঁড়ে) বুঝতে পারলেও আধুনিক মনস্করা এ নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করে না। আর ফুলশয্যা রাতে যদি ‘অজ্ঞ’ স্বামীর মুখ থেকে ‘ইউজ্ড’ শব্দটি শোনার আশঙ্কা থাকে, তাহলে নিজেকে ‘কুমারী’ প্রমাণ করার জন্য সার্জারি করিয়ে নিতে পারেন। মেডিকেল সায়েন্স এখন সেই পথও খোলা রেখেছে। কয়েক হাজার টাকার (দশ থেকে কুড়ি হাজার) বিনিময়ে একটা ছোট্ট সার্জারির মাধ্যমে (হাইমেনোপ্লাস্টি) যৌনাঙ্গে কৃত্রিম সতীচ্ছদ তৈরি করা সম্ভব।

সতর্কতা

নিজের ইচ্ছে মতো সুরক্ষিত যৌনতার জন্য মেডিকেল প্রিকশন সর্বদা সঙ্গে রাখুন। আর যদি প্রিকশন ছাড়া কারও সঙ্গে হঠাৎ ইমোশনালি দৈহিক সম্পর্ক হয়ে যায়, তাহলে ব্যবহার করুন ইমার্জেন্সি কন্ট্রাসেপটিভ পিল। তবে চাপমুক্ত থাকতে পুরুষ বন্ধুটি যৌনরোগমুক্ত আছে, এ ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে তবেই কন্ডোম কিংবা কপার্টি ছাড়া Unplanned Sex করুন।

রোমান্স ইন রেইন

আকাশে মেঘ জমেছে। সূর্য এখন আর তেমন চোখ রাঙাবার সুযোগ পাচ্ছে না। মেঘেরা ম্লান করে দিচ্ছে সূর্যের দাপট। খানিক পরে শুরু হল মেঘের গর্জন আর বিদ্যুতের ঝলকানি। হঠাৎই ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামল। থামল কলরব। থমকে গেল ব্যস্ততা। ঘরমুখোরা ব্যস্ত হয়ে পড়ল বাড়ি ফেরার জন্য। এমনই এক বৃষ্টির আবহে বনান্ত আর বনানী রয়েছে ভিক্টোরিয়া উদ্যানে। মুখোমুখি বসেছিল ওরা। ফেসবুক-এর মাধ্যমে যোগাযোগের পর এই প্রথম ওরা মুখোমুখি হয়েছিল পরস্পরের। বন্ধুত্বের উষ্ণতা Romance উপভোগ করতে করতে কখন যে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নেমেছে, তা টের পায়নি।

শেষপর্যন্ত যখন ওরা ভিক্টোরিয়ার পূর্বদিকের গেট দিয়ে আকাদেমি অফ ফাইন আর্টস-এর ছাদের তলায় এসে দাঁড়াল, তখন ওদের শরীর বেয়ে নেমে আসছে বৃষ্টির আনন্দধারা। এমন সময় বেজে উঠল বনানীর মুঠোফোন। আর্জেন্ট কাজ আছে, এক্ষুনি বাড়ি ফিরতে হবে। বৃষ্টি তখন কিছুটা কমেছে। বনানী আরও কিছুটা সময় বনান্তর সঙ্গে কাটাতে চাইলেও, ভেজা জামাকাপড় আর আর্জেন্ট কাজের জন্য বিদায় নিতেই হল বনান্তর কাছ থেকে। বনানীকে ট্যাক্সিতে তুলে দেওয়ার পর বনান্ত বলেছিল, যদি ‘জ্বর’ আসে তাহলে ফোন করবে।

সত্যিই ‘জ্বর’ এসেছিল বনানীর। Romance – এর জ্বর। তাই পরের দিন দূরভাষে কাঁপা গলায় থেমে থেমে বনানী বলেছিল বনান্তকে, ‘আমি তোমায় ভালোবেসে ফেলেছি।’ এভাবেই বনান্ত-বনানীর ভালোবাসার সাক্ষী হয়ে রয়েছে এক বৃষ্টিমুখর দিন। এ কোনও গল্প-কথা নয়, এক ঘরোয়া আড্ডায় বনান্ত-বনানী শেয়ার করেছিল তাদের প্রেমের স্মৃতি।

তবে শুধু বনান্ত-বনানীর সম্পর্ক গড়তে বৃষ্টি অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিল এমন নয়, বৃষ্টি সবারই মনে কমবেশি প্রভাব ফেলে। আষাঢ়-শ্রাবণে তাই মন বশে থাকে না রোমান্টিক মানুষ মাত্রেরই। এই সময় বৃষ্টির আনন্দধারা ভিজিয়ে নরম করে দেয় মনকে। গরমের অস্বস্তি কাটিয়ে শরীর জুড়ে তাই নেমে আসে প্রশান্তির পরশ। কোনও দিন যে কবিতার ‘ক’ লেখেনি, সেও বৃষ্টির আবহে হয়ে ওঠে প্রেমিক-কবি। যেমন হয়েছিল বনানী। ফেসবুক-এর প্রাইভেট মেসেজ বক্স-এ বনান্তকে নিয়ে লিখেছিল একটি দারুণ কবিতা। ‘তুমি নও অনন্ত, নও দিগন্ত, তুমি বনের শেষের সবুজ বলয়– বনানীর বনান্ত। একটু আদর পাওয়ার আশায় বসেই থাকো আমার পাশে, তুমি আমি উড়ব এবার বৃষ্টিঝরা এক আকাশে।’

যুগে-যুগে বৃষ্টির আবহে গড়ে ওঠে এমন অনেক প্রেম কাহিনি। কেউ-কেউ বন্ধুবান্ধবদের কাছে তা শেয়ার করে, অনেকে হয়তো করে না।

তবে সুখী দম্পতি প্রণয়-শ্রাবণী অকপটে জানিয়েছে তাদের বিবাহপূর্ব প্রেম-পর্বের ঘটনা। কিছুদিন প্রেম করার পর কোনও এক কারণে প্রণয়ের সঙ্গে মনোমালিন্য হয়েছিল শ্রাবণীর। বলা যায়, অনেকটা দূরত্ব তৈরি হয়ে গিয়েছিল দু’জনের মধ্যে কিন্তু হঠাৎই শ্রাবণের ধারা এসে ধুয়েমুছে দিয়েছিল ওদের মনোমালিন্য এবং দূরত্ব সরিয়ে একাত্ম করেছিল ওদের মন ও শরীরকে। ঝড়বৃষ্টির এক সন্ধেবেলা, অফিস থেকে ফেরার পথে বাস-ট্রাম না পেয়ে শ্রাবণী বিপর্যস্ত অবস্থায় দাঁড়িয়েছিল বাসস্ট্যান্ড-এ। ওই পথেই অফিস থেকে গাড়ি করে ফিরছিল প্রণয়। শ্রাবণীকে ওইভাবে একা দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে গাড়ি থামিয়ে প্রণয় ওর গাড়িতে ওঠার অনুরোধ করে শ্রাবণীকে। শ্রাবণী প্রথমে অভিমানে ‘না’ করলেও, কী ভেবে যেন উঠে পড়েছিল প্রণয়ের গাড়িতে। বসেছিল প্রণয়ের পাশে। শুধু তাই নয়, প্রণয়ের বাড়িতে গিয়ে ভেজা শাড়ি চেঞ্জ করে প্রণয়ের কেনা নতুন সালোয়ার পরে বাড়ি ফিরতে চেয়েছিল শ্রাবণী কিন্তু অবিরাম বৃষ্টি আর অনিচ্ছার কারণে সে রাতে আর বাড়ি ফেরা হয়নি। মান-অভিমান ভুলে, প্রণয়ের ফাঁকা বাড়িতে প্রণয়কে একান্তভাবে পাওয়া উদ্বেল করে তুলেছিল শ্রাবণীকে। ওদের মন আর শরীরের এতটাই উন্মাদনা ছিল যে, পরের দিনই ওরা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিল আইনি বিয়ের (ম্যারেজ রেজেস্ট্রি)। আর সেই থেকে আজও ওদের রোমান্স-এ এতটুকুও ভাটা পড়েনি। সুযোগ পেলে আজও ওরা বৃষ্টিতে ভেজে, শরীরে-মনে গভীরভাবে অনুভব করতে চায় সেই বৃষ্টিমুখর নিরালা রাতের প্রতিটি মুহূর্তকে।

এভাবেই বৃষ্টির হাত ধরে প্রেম আসে চুপি-চুপি। প্রভাবিত করে শরীর, মন আর জীবনকে। বৃষ্টিকে পাথেয় করে লেখা হয় কতশত কবিতা, গল্প, গান। তৈরি হয় সিনেমা। মাটির সোঁদা গন্ধ, আলো-আঁধারি পরিবেশ কিংবা বর্ষার রাতে ব্যাঙ আর ঝিঁঝিঁপোকার ডাক– সব মিলে তৈরি হয় অদ্ভুত এক প্রেমময় পরিবেশ। প্রেমিক-প্রেমিকার হৃদয় ব্যাকুল হয়। কেউ চান ভালোবাসার মানুষের হাত ধরাধরি করে বৃষ্টিতে ভিজতে, কেউ চান উদ্যানের নিরালা পরিবেশে এক ছাতার তলায় বসে ঘনিষ্ট হতে। কেউ আবার বৃষ্টি উপভোগ করতে মনের মানুষের হাত ধরে অবসর যাপন করেন পাহাড়, জঙ্গল কিংবা সামুদ্রিক পরিবেশে।

আসলে বর্ষার আবহে এ সবই প্রেমের মহিমা। তবে বৃষ্টি মানেই যে মধুর প্রেম এমন নয় নিশ্চয়ই, বৃষ্টির আবহে বিরহ-বিচ্ছেদের স্মৃতিও নীরবে ঝরায় অশ্রু। যেমন ঘটেছিল খরাজ-স্মৃতিকার জীবনে। একই অফিসের কর্মী ছিল ওরা। রূপে নয়, খরাজের গুণে মুগ্ধ ছিল স্মৃতিকা কিন্তু মুখ ফুটে বলতে পারেনি। এক বৃষ্টিমুখর সন্ধে, মনের ইচ্ছেপূরণ করে দিয়েছিল স্মৃতিকার। প্রচণ্ড বৃষ্টিতে ট্রেন ধরতে স্টেশনে যাওয়ার অসুবিধার অজুহাত দেখিয়ে খরাজকে একসঙ্গে ট্যাক্সিতে বাড়ি ফেরার অনুরোধ করেছিল স্মৃতিকা। একই পাড়ায় থাকার কারণে, খরাজও স্মৃতিকার সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছিল। তারপর ঝড়বৃষ্টির ওই সন্ধেতে ট্যাক্সিতে টানা একঘন্টার যাত্রাপথে স্মৃতিকা অকপটে তার ভালোবাসা ব্যক্ত করেছিল খরাজকে। খরাজও সম্মান-সম্মতি না জানিয়ে পারেনি। এরপর খরাজ-স্মৃতিকার উষ্ণ প্রেমের মুহূর্তগুলোর সাক্ষী হয়ে আছে কলকাতার বহু উদ্যান, রেস্তোরাঁ আর প্রেক্ষাগৃহ। কিন্তু খরাজের জীবনে সেসব এখন ধূসর স্মৃতি। কারণ দুরারোগ্য ব্যাধি ছিনিয়ে নিয়েছে স্মৃতিকার জীবন। খরাজ তবুও আঁকড়ে আছে স্মৃতিকার স্মৃতি। কিন্তু যখন ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামে, খরাজ তখন দুঃখ-স্মৃতি ভুলে গিয়ে আলিঙ্গন করার চেষ্টা করে সুখ-স্মৃতিকে। তখন তার শুধু মনে হয়, স্মৃতিকাকে হারানোর বেদনা ধুয়েমুছে দিতেই যেন এই বৃষ্টিপাত।

অতএব, Romance – এর আনন্দ কিংবা বিরহ-বিচ্ছেদের স্মৃতি রোমন্থন– সবই বৃষ্টির আবহে হৃদয় আলোড়িত করে। তাই-তো সংবেদনশীল মানুষমাত্রেই স্বীকার করবেন, প্রেমের বর্ষসেরা ঋতু– ‘বর্ষা’।

সেক্স আফটার চাইল্ডবার্থ

এই আধুনিক যুগ থেকে কয়েক দশক পিছনে তাকালেই, সদ্য মা হওয়া মহিলাদের জীবনযাপনের এক ‘অন্যরকম’ ছবি দেখতে পাবাে। তখন সিংহভাগই নর্মাল ডেলিভারি হতো।। বাচ্চার জন্ম দেওয়ার পর চল্লিশদিন আঁতুরঘরে অর্থাৎ আলাদা থাকতে হতো মাকে। সেই আঁতুর ঘরে স্বামীর প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল। আসলে, এই সংস্কারের পিছনে যে উদ্দেশ্য ছিল তা হল— ওই সময়ের মধ্যে (৪০ দিন) স্বামীর সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন না করতে দেওয়া। কারণ, সদ্য মায়ের সঙ্গে স্বামীর শারীরিক মিলন ঘটলে, মায়ের নানারকম শারীরিক সমস্যা এবং জটিলতা তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু সময় বদলেছে। এখন নর্মাল ডেলিভারির পরিবর্তে সিজারিয়ান ডেলিভারিরই সংখ্যাধিক্য। কাজেই, সদ্য মা হওয়া মহিলাদের নতুন ভাবে সেক্সলাইফ শুরু করার রীতিনীতিও বদলেছে।।

একটা সময় ছিল যখন ভিন্ন সামাজিক আবহে সদ্য মা হওয়া যুবতিরা তাদের মনের গােপন ইচ্ছে প্রকাশ করতে পারতেন না। কিন্তু এখন পরিবর্তিত সামাজিক পরিস্থিতি এবং উন্নত চিকিৎসা পরিষেবা পাওয়ার সুবাদে, বদলে গেছে নারীদের সেক্সলাইফ। এখন মা হওয়ার কয়েকদিন পর থেকেই আবার নতুন করে সেক্সলাইফ শুরু করা যায় অনায়াসেই। তবে, এই সেক্সলাইফ শুরু করার আগে, কিছু শরীরবিজ্ঞান, সতর্কতা এবং রীতিপদ্ধতির বিষয়ে জ্ঞান অর্জন আবশ্যক।

ডেলিভারি সিস্টেম এবং সেক্স

নর্মাল এবং সিজার এই দু’রকম ডেলিভারি পদ্ধতিতে শিশুর জন্ম হচ্ছে সারা পৃথিবীতে। দুটো পদ্ধতির-ই সুবিধে-অসুবিধে দুই-ই আছে। সৌন্দর্য সচেতন সেলিব্রিটি কিংবা সাধারণ নারীরা অনেকেই নর্মাল ডেলিভারির পথ ধরেন। কারণ, সিজার করলে পেটে যেহেতু স্টিচের দাগ থেকে যায়, তাই কেউ কেউ নর্মাল ডেলিভারি চান। তবে বেশিরভাগ মহিলা এখন নর্মাল ডেলিভারির পথ ছেড়ে সিজার-এর দিকেই ঝুঁকছেন। আর এই ঝোঁকের পিছনে দুটো গুরুত্বপূর্ণ কারণ আছে। প্রথমত, সিজার করলে কষ্ট কম, ঝুঁকি কম। দ্বিতীয়ত, নর্মাল ডেলিভারির ক্ষেত্রে যােনিপথ অনেকটা প্রশস্ত বা আলগা হয়ে যাওয়ার কারণে সঙ্গমে পরিপূর্ণ তৃপ্তি পাওয়া যায় না। তাই, সিজার-এর পথ বেছে নেন আধুনিক মহিলারা। তাছাড়া, সিজার করলে যেহেতু ভ্যাজাইনা স্বাভাবিক থাকে, তাই বাচ্চা প্রসবের পরে দ্রুত নতুন ভাবে যৌনজীবন শুরু করা যায়।

ব্রেস্টফিডিং অ্যান্ড সেক্স

বক্ষসৌন্দর্য নষ্ট হয়ে যাবে এমন নানারকম ভুল ধারণার শিকার হয়ে, অনেক মহিলাই ব্রেস্টফিডিং করাতে চান না। কিন্তু এ প্রসঙ্গে জেনে রাখা ভালো যে, বাচ্চার জন্ম দেওয়ার পরই, মায়ের শরীরে অক্সিটোসিন হরমোনের মাত্রা বেড়ে যায়। আর এই অক্সিটোসিন হরমোন বুকে দুধ সরবরাহ করতে যেমন সাহায্য করে, তেমনই পরোক্ষ ভাবে সেক্সলাইফকেও কন্ট্রোল করে। এখন প্রশ্ন জাগতে পারে— কীভাবে? আসলে, বাচ্চা যত মাতৃদুগ্ধ পান করবে, মায়ের শরীরে অক্সিটোসিন হরমোনের মাত্রা ততই বাড়বে এবং মায়ের শরীরে ধীরে-ধীরে যৌন উত্তেজনা তৈরি করবে। যারা এই বিষয়টি জানেন, সেইসব দম্পতি এই পদ্ধতির সুবিধে নিয়ে নতুন ভাবে আনন্দদায়ক সেক্সলাইফ শুরু করেন।

বিশ্রাম এবং সেক্স

মা হওয়ার পর কে কতদিন পর আবার সেক্সলাইফ শুরু করতে পারবেন, তা অনেকটাই নির্ভর করে বিশ্রামের উপর। আর সব মায়েরা যেহেতু সমান বিশ্রাম পান না, তাই প্রত্যেকের ক্ষেত্রে ভিন্ন সেক্স সিচুয়েশন তৈরি হয়। অতএব, বাচ্চার জন্মদানের পর মাকে যতটা সম্ভব বিশ্রাম নিতে হবে। বাচ্চার ন্যাপি বদলানাে, খাওয়ানাে, সেবাযত্ন করা প্রভৃতি কাজগুলি পার্টনার-এর সঙ্গে ভাগ করে নিতে হবে। সময়সুযােগ করে ঘুমোতেও হবে পর্যাপ্ত। তবেই মা হওয়ার পর দ্রুত নতুন করে স্বাভাবিক যৌনজীবন শুরু করা সম্ভব হবে।

স্বাস্থ্য এবং সেক্স

বাচ্চার জন্ম দেওয়ার পর, মানসিক এবং শারীরিক পরিবর্তন ঘটে মায়ের। এইসময় মায়ের শরীরে যেমন নানারকম ভিটামিনের ঘাটতি এবং রক্তাল্পতা দেখা দিতে পারে, তেমনই তিনি অতিরিক্ত আবেগপ্রবণ এবং স্পর্শকাতরও হয়ে উঠতে পারেন। আর এই সময়ের ওইরকম মানসিক এবং শারীরিক পরিস্থিতি নতুন ভাবে সেক্সলাইফ শুরু করার ক্ষেত্রে পরিপন্থী হয়ে উঠতে পারে। তাই, বাচ্চার জন্মদানের পর মায়ের শারীরিক এবং মানসিক সমস্যা ও ঘাটতি দূর করার জন্য উপযুক্ত ওষুধ-পথ্য, চিকিৎসা এবং মানসিক সহযােগিতা-সহানুভূতির প্রয়োজন। অতএব এইসময় স্বামীকে আন্তরিক সহযােগিতা করতে হবে মানবিক কারণে এবং নতুন ভাবে যৌনজীবন শুরু করার জন্য।

স্লো বাট স্টেডি ফরম্যাট

মা হওয়ার সপ্তাহ তিনেক পর যদি সঙ্গমে লিপ্ত হওয়ার মতো শারীরিক পরিস্থিতি তৈরি হয় বা যদি কমফর্ট ফিল করেন তাহলে সেক্সলাইফ স্বাভাবিক করতে পারেন, তবে স্লো বাট স্টেডি ফরম্যাট-এ। কারণ, ওইসময় ভ্যাজাইনাল ট্রাক ড্রাই থাকে, তাই প্রথম কয়েকদিন পুরোপুরি যৌনসঙ্গমে লিপ্ত না হওয়াই উচিত। ভ্যাজাইনাল ট্র্যাককে আর্দ্র, অর্থাৎ সঙ্গমের অনুকূল করে তোলার জন্য পার্টনার-এর সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে সেক্স শুরু করুন ধীরে-ধীরে। এরজন্য প্রথমে অন্তত দু’দিন ওরাল সেক্স বা মিউচুয়াল মাস্টারবেশন করুন এবং তারপর থেকে পূর্ণ যৌনসঙ্গমে লিপ্ত হন।

টিপস

  • রাতে বাচ্চাকে বুকের দুধ পান করিয়ে ঘুম পাড়িয়ে সেক্স শুরু করুন নিশ্চিন্তে।
  • পার্টনারকে আপনার মনের ইচ্ছে-অনিচ্ছের কথা জানিয়ে সেইমতো নতুন ভাবে সেক্সলাইফ স্টার্ট করুন।
  • নিজের শরীর বুঝে সেক্স করুন। কমফর্ট ফিল না করলে, অর্থাৎ মা হওয়ার পর নিজের শরীর সেক্স-এর জন্য প্রস্তুত মনে না হলে, সেক্স এড়িয়ে যাওয়াই ভালো।
  • মা হওয়ার পর দীর্ঘদিন যদি ভ্যাজাইনাল ট্র্যাক শুষ্ক থাকে তাহলে ভালো গাইনিকোলজিস্টকে জানিয়ে ওষুধ খেয়ে সমস্যামুক্ত হন।
  • এইসময় সঙ্গমকালে ক্ষিপ্রতা একেবারেই বারণ। কারণ, মা হওয়ার পর ভ্যাজাইনা স্বাভাবিক হতে সময় লাগে।

মা হওয়ার পর সেক্স-এর সময়ে হাইজিন অবলম্বন করুন। কারণ, ওইসময় ইনফেকশন-এর সম্ভাবনাও বেড়ে যায়।

দাম্পত্যের অটুট বন্ধন

কবিতা আর অনুরাগের বিয়ের পর কেটে গেছে ১২ বছর। যথেষ্ট সুখের সংসার কবিতার। অন্তত তাই মনে হয় তার। কিন্তু অনুরাগ কবিতার মতো ভাবে না। তার মনে কোথাও একটা অসন্তুষ্টি রয়ে গেছে। নয়তো কেন তার বারবার মনে হয় কবিতাকে বিয়ে না-করে অন্য কাউকে বিয়ে করলে আরও ভালো হতো তার জীবনটা। কই, অনুরাগের মনে চারবছর আগে অবধিও এই ভাবনাটা আসেনি তাহলে হঠাৎ আজ কেন? কবিতা যথেষ্ট স্মার্ট, সুন্দরী এবং আধুনিকা। গুছিয়ে সংসার করে। ওর বিরুদ্ধে কিন্তু অনুরাগের কোনও অভিযোগ নেই। অনুরাগ ও কবিতার সংসারের মতো অবস্থা আজ বহু দম্পতির।

বিয়ের কয়েক বছর পর থেকেই স্ত্রীয়ের ভালো গুণগুলি আর চোখে পড়ে না। বহু স্বামীই তখন স্ত্রীর বদগুণগুলোই বেশি করে খেয়াল করেন। অথচ স্বামী এবং পরিবারের প্রতি স্ত্রীয়ের আচরণে কিন্তু কোনও পরিবর্তন আসে না। তৎসত্ত্বেও অর্ধাঙ্গিনীর উপর থেকে স্বামীর অনুরাগ কম হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে স্ত্রীয়েরা সম্মুখীন হন স্বামীর অবহেলার এবং প্রতারণার। দাম্পত্যের ভিত আলগা হওয়া শুরু হয়। এর মূল কারণ খুঁজতে গেলে দেখা যায় পুরুষের অহংকারই বিচ্ছেদের শিকড়।

অধিকাংশ পুরুষের মনে স্ত্রী-কে নিজস্ব সম্পত্তি মনে করার মানসিকতা তৈরি হয়। নিজেরা দায়িত্ব থেকে দূরে থেকে, স্ত্রীয়েদের থেকে এক্সপেকটেশনের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। কথায় কথায় স্ত্রীকে ছোটো করা, তার সমস্ত ইচ্ছায় দমবন্ধ করে দেওয়ার মানসিকতায় পুরুষদের জন্মসিদ্ধ অধিকার।

স্ত্রী গৃহিণী হোক অথবা চাকুরিরতা, কোনও কারণে যদি স্বামীর মনে হয়, তার থেকে স্ত্রীয়ের কার্যক্ষমতা বেশি, তাহলেই স্ত্রীকে সে সবথেকে বড়ো প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে ধরে নেয়। কর্মক্ষেত্রে যেটা তাকে পদোন্নতির দিকে নিয়ে যেতে সাহায্য করবে, দাম্পত্যজীবনে সেটাই ভাঙনের সৃষ্টি করে।

স্ত্রীকে দমিয়ে রাখার মানসিকতা বেশিরভাগ পুরুষের মধ্যেই রয়েছে। স্ত্রী চাকুরিরতাই হোক বা হোমমেকার, স্বামী সবসময়ই চায় বাড়ি এবং বাইরের সব দায়িত্ব স্ত্রী একাই সামলাবে এবং তাও খুবই সুনিপুণ ভাবে। ভুলচুক হওয়া চলবে না। স্ত্রীয়ের দায়িত্ব নিজের উপর না-নিতে পারলেও, বিশ্ব-সংসারের বোঝা স্ত্রীয়ের ঘাড়ে চাপিয়ে দিতে বহু স্বামীরই কোনও দ্বিধা বোধ হয় না। স্ত্রী-র, মুখ বন্ধ করে রাখাও যেমন স্বামীদের পছন্দ নয় তেমনি মুখের উপর তর্ক-বিতর্কও তাদের অপছন্দ। বহু পুরুষ এমনও আছে যাদের স্ত্রীকে বাইরে কাজে পাঠাতে কোনও অসুবিধে নেই কিন্তু কাজের জায়গায় স্ত্রীয়ের সহকর্মীদের সঙ্গে বন্ধুত্ব হলেই আকাশ ভেঙে পড়ে স্বামীর মাথার উপর। এক্ষেত্রে স্ত্রীয়ের পোশাক নিয়েও, স্বামীদের হাজারো উপদেশ স্ত্রীয়ের উপর বর্ষিত হয়। স্ত্রী যদি শুধুমাত্র গৃহিণী হয়, তাহলেও স্বামীর শব্দবাণের ঠেলায় তারও জীবন ওষ্ঠাগত হয়। বাড়িতে বসে থেকে স্ত্রী নাকি আন্দাজই করতে পারে না যে, স্বামী কত পরিশ্রমে অর্থ উপার্জন করে নিয়ে আসছে আর স্ত্রী বাড়িতে বসে বসে সেই কষ্টের সঞ্চয় ধবংস করছে।

এই পরিবেশে স্ত্রীয়ের উচিত

১০-১২ বছর একসঙ্গে থাকার পরেও স্ত্রী যদি স্বামীকে কোনওভাবেই সুখী করে তুলতে না-পারে, যদি সে তার প্রাপ্য সম্মান, ভালোবাসা স্বামীর কাছে না-পায়, তাহলে স্বভাবতই তার মন আত্মহত্যাপ্রবণ হয়ে উঠতে পারে অথবা বিবাহবিচ্ছেদের ভাবনাও তার মনে জাগতে পারে। কিন্তু এই ধরনের চিন্তা করা ভুল। জীবনটাকে পজিটিভ ভঙ্গিতে দেখার চেষ্টা করা উচিত।

স্বামীর ব্যবহারে ভেঙে পড়ে শরীরকে অবহেলা করা চলবে না। শরীর এবং মনের বিশ্রামের জন্যে বাড়ির বাইরে বেরোনো একান্ত দরকার। পুষ্টিকর খাবারের সঙ্গে ৭-৮ ঘণ্টার ঘুমও শরীর ভালো রাখার জন্যে প্রয়োজন। স্বামীর কাছ থেকে সাহায্য না পেলেও, মন শক্ত করে সঠিক জীবনযাপনে নিজেকে ব্যস্ত রাখার চেষ্টা করতে হবে। সবাইকে ছেড়ে নিজেকে বাঁচতে হবে নিজের জন্যে।

স্বামীর সঙ্গে তর্ক-বিতর্ক বিবাদ নয় এমনকী স্বামীর আচরণ বারবার মনে করে দুঃখ পাওয়াও যুক্তিসঙ্গত নয়। কারণ এগুলোর কোনওটাই সমস্যার সমাধান নয়। আনন্দে থাকার সুযোগ খুঁজে নিতে হবে নিজেকেই। যে-কোনও হবি, মন ও শরীর ভালো রাখতে সাহায্য করবে। সন্তান যদি থাকে তাহলে তাদের সঙ্গে অধিক সময় কাটাবার প্রয়াস করলে মানসিক আনন্দ লাভ করা যেতে পারে।

প্রচণ্ড দুঃসময়ের মধ্যেও হতাশা মনকে যেন গ্রাস না করে। অবসাদ যদি একবার মনের মধ্যে বাসা বাঁধে তাহলে অঘটন যে-কোনও মুহূর্তে ঘটতে পারে। সেজন্যে সবথেকে আগে দরকার নিজেকে ভালোবাসা এবং তাহলেই শারীরিক এবং মানসিকভাবে নিজের সন্তান, স্বামী-সহ পুরো পরিবারকেই সুখী রাখা সম্ভব হবে।

কী করবেন, কেন করবেন

স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক স্নেহ, ভালোবাসা এবং পারষ্পরিক সম্মানের ভিতের উপর দাঁড়িয়ে থাকলে আজন্ম সম্পর্কে দৃঢ়তা এবং মাধুর্য্য বজায় থাকে। অথচ যদি দাম্পত্যে একজনেরও অহংকার অথবা মানসিক তিক্ততা অন্য সবকিছুকে ছাপিয়ে যায় তাহলে যে-কোনও মুহূর্তেই এত দিনকার সম্পর্ক ভেঙে গুঁড়িয়ে ধুলোয় মিশে যেতে পারে। তাই সম্পর্ক মজবুত রাখতে স্বামী-স্ত্রী উভয়েরই সমানভাবে চেষ্টা চালানো উচিত।

স্বামীর উচিত

১ পুরুষের অহংকার ত্যাগ করে স্ত্রীর প্রতি উদার মনোভাব রাখা উচিত

২ স্ত্রীকে পরিচারিকা না-ভেবে, ভালো জীবনসঙ্গিনী ভাবুন

৩ কর্মরতা স্ত্রীকে প্রতিদ্বন্দ্বী না-ভেবে, তাকে কাজে উৎসাহ দিন

৪ স্ত্রীয়ের ইচ্ছাকে দমাবার চেষ্টা না করে তাকে আরও উৎসাহিত করে তুলুন

৫ অনাবশ্যক বাইরের বন্ধুদের অপেক্ষা করাবেন না। যে-কোনও নেশার বস্তুকে দূরে রাখার চেষ্টা করবেন

৬ স্ত্রীকে প্রতি কথায় দোষারোপ করবেন না বরং দোষ করলেও স্নেহের সঙ্গে বুঝিয়ে দোষটা ধরিয়ে দেবেন

স্ত্রীয়ের উচিত

১ প্রতি ক্ষেত্রে স্বামীর দিকে আঙুল না-তুলে তাকে স্পেস দিন

২ অনাবশ্যক তর্ক-বিতর্ক করবেন না কারণ সমস্যার সমাধান ঝগড়া নয়

৩ স্বামীর বিচার, বিবেচনাকেও সম্মান দিন

৪ স্বামীর পরিবারের সকলকেও সম্মান দিন। স্বামী কিছু বললে হাসিমুখে সেটা মানার চেষ্টা করুন

৫ অপরের সামনে স্বামীকে অপমান বা ছোটো করবেন না। অন্যের স্বামীর সঙ্গে তুলনা করবেন না

৬ স্বামী কোনও ভালো কাজ করলে মন খুলে কাজের প্রশংসা করুন

সম্পর্ক ভালো করুন ১০টি উপায়ে

সমাজে থাকতে হলে, ইচ্ছেমতন যেমন খুশি ব্যবহার করা সমীচীন নয়। এতে সামাজিক এবং পারিবারিক সম্পর্কগুলির মধ্যে ব্যবধান তৈরি হতেই পারে, কারণ পরিবার কিন্তু সমাজের বাইরে নয়। সুতরাং সম্পর্কের মিষ্টতা বজায় রেখে জীবনের প্রতিটা মুহূর্ত সুন্দর করে তোলাটাই কাম্য।

পারিবারিক সম্পর্ক

বংশপরম্পরায় পারিবারিক সম্পর্কগুলিকে টিকিয়ে রাখা খুব জরুরি। পাঁচটি এমনই উপায় জেনে রাখুন যাতে সম্পর্কের বুনিয়াদ আরও শক্ত হতে পারবে।

১)  বিদ্রুপ করে কথা বলবেন না – পরিবারের কারও মনে আঘাত দিয়ে কথা বলবেন না অথবা কারও চরিত্রের দুর্বলতা অপরের সামনে প্রকাশ করে তাকে নীচু করার চেষ্টা করবেন না। দৃষ্টান্তস্বরূপ ধরুন বাড়ির বউয়ের ভাই ইন্টারকাস্ট বিয়ে করার ফলে, বউয়ের শ্বশুর বাড়িতে থাকাই মুশকিল হয়ে পড়ল। শ্বশুরবাড়ির লোকেরা উঠতে বসতে ভাইয়ের বিয়ের জন্যে বাড়ির বউকে খোঁটা দেওয়া শুরু করল। কিন্তু কেন এমনটা হবে? ইন্টারকাস্ট ম্যারেজ কোনও দোষের নয়, হতে পারে পুরোনো ধারণায় বিশ্বাসী, বয়স্ক মানুষজন। তাঁদের সংস্কৃতি এটাকে দোষের বলে মনে করে। কিন্তু বউ তো নিজের বাড়ির লোক, তার সুখ দুঃখ ভাগ করে নেওয়ার দায়িত্বও তাই শ্বশুরবাড়ির সকলেরই। অপরকে ছোটো করে লাভ কী, হয়তো নিজেকে সকলের কাছে মহান প্রতিপন্ন করা। কিন্তু ফল উলটোই হয়, অপরকে সকলের সামনে খাটো করে তুলতে গিয়ে সে নিজেই সকলের হাসির পাত্র হয়ে ওঠে। সুতরাং এই রোগ থেকে নিজেকে মুক্ত রাখাই শ্রেয়।

২)  নিজের দায়িত্ব বুঝুন – নিজের সন্তানের সঙ্গে সঙ্গে মা-বাবার দায়িত্ব নেওয়াটাও পারিবারিক দায়িত্ববোধের মধ্যেই পড়ে। বৃদ্ধ বাবা-মা, শ্বশুর-শাশুড়ির দেখাশোনা করাটাও যেমন দায়িত্বর মধ্যে পড়ে, তেমনি সন্তানকে ভালো ভাবে যত্ন নিয়ে বড়ো করে তোলাটাও মা-বাবার দায়িত্ব। কিন্তু আধুনিক সভ্যতার চাদরে যারা গা-মুড়ে রাখতে ভালোবাসেন, তারা সন্তানের জন্ম দেওয়া এবং সবরকম সুখসুবিধা দেওয়াটাকেই খালি দায়িত্ব বলে মনে করেন। অথচ মা-বাবার সঙ্গ এবং তাদের মূল্যবান সময়ের অংশ কিছুটা হলেও সন্তানের ভালো ভাবে বড় হয়ে ওঠার জন্যে প্রয়োজন হয়। সুতরাং সন্তানকে সময় দেওয়াটাও দায়িত্বের অংশ বলেই মনে করা উচিত।

৩)  মিথ্যার আশ্রয় নেবেন না – নিজের দায়িত্ব থেকে বাঁচতে, নিজেকে জনপ্রিয় করে তুলতে অথবা নিজের ভুল লোকাবার জন্যে মানুষ মিথ্যার আশ্রয় নেয়। জয়েন্ট ফ্যামিলিতে মিথ্যা বলার প্রবণতা বেশি দেখা যায়। সেখানে বহু মানুষের মধ্যে একে অপরের থেকে নিজের সুপিরিয়রিটি প্রমাণ করার জন্যে মিথ্যার আশ্রয় যেমন কেউ কেউ নিয়ে থাকে, তেমনি ভুলও করে ফেলে অনেক বেশি। তাই অপরের প্রতি কোনওরকম দ্বন্দ্ব যদি মনের মধ্যে পোষণ না করেন তাহলে সম্পর্কটাও অনেক সহজ হবে এবং মিথ্যার আশ্রয়ও নিতে হবে না। সুতরাং মনে সাকারাত্মক ভাবনা রাখুন, দেখবেন সম্পর্কে চিড় ধরবে না এবং নিজের ব্যক্তিত্বও উন্নত হবে।

৪)  অর্থের প্রাচুর্য দেখাবার দরকার নেই – আপনি যে ধনী, সেটা পরিবারে জনে জনে সকলকে বলে বেড়াবার প্রয়োজন হয় না। অনেকেই অনুষ্ঠান, রীতি রেওয়াজের নাম করে টাকার বন্যা বইয়ে দেন যাতে আত্মীয়স্বজনের মধ্যে নিজেকে উঁচু আসনে বসানো যায়। বিয়ে, পৈতে, অন্নপ্রাশন ইত্যাদি অনুষ্ঠানে অপ্রয়োজনে অনেক বেশি খরচ করার ট্রেন্ড এখন হামেশাই চোখে পড়ে। এগুলো অবিলম্বে বন্ধ করা বাঞ্ছনীয়।

৫)  অভিব্যক্তির স্বতন্ত্রতা – আমাদের সংবিধানেও অভিব্যক্তির স্বতন্ত্রতার উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু পরিবারে কয়েকজনই নিজেদের স্বতন্ত্র অভিব্যক্তি প্রকাশ করার সুযোগ পায়। সরল, সাদাসিধে মানুষরা নিজেদের ইচ্ছে অনেক সময় খুলে বলে উঠতে পারেন না কারণ পরিবারের প্রতাপশালী ব্যক্তিটি অন্যদের দাবিয়ে রাখাই পছন্দ করেন। সরল মানুষটির কথায় হয়তো প্রতাপশালী ব্যক্তিটি উপকৃতই হতে পারেন কিন্তু তাকে দাবিয়ে দিয়ে ক্ষতিটা কার হয়? সুতরাং সকলের কথা শোনার পরেই আপনি ভালো-মন্দের বিবেচনায় আসতে পারেন। বাড়ির স্ত্রী পুরুষ, ছোটো-বড়ো সকলেরই মনের ইচ্ছে খুলে বলার স্বতন্ত্রতা থাকা উচিত।

সামাজিক সম্পর্ক

জীবনে সুখ পেতে হলে পারিবারিক সম্পর্কগুলির সঙ্গে সামাজিক সম্পর্কগুলোও মজবুত করা দরকার।

১)  ইগো, অহংকার ত্যাগ করতে হবে – অহংকারে মানুষ অন্ধ হয়ে যায়। তখন অপরকে মানুষ বলে জ্ঞান করে না, তাকে দুঃখ দিতে চেষ্টা করে অথবা পরের আত্মবিশ্বাস কমাবার ইচ্ছা মনের মধ্যে জেগে ওঠে। অফিসের মধ্যে এরকম ইগোর লড়াই সকলেরই চোখে পড়ে। ইগো, অহংকারে অনেক সময় মানুষ এমন পদক্ষেপ নিয়ে ফেলে যেটা তার ব্যক্তিত্বকে কলঙ্কিত করে তোলে আবার কখনও অপর মানুষটির সাংঘাতিক ক্ষতিও করে ফেলে। অহংকার কখনওই কাউকে উচ্চতার শিখরে নিয়ে যেতে পারে না বরং সকলের চোখে নীচ প্রতিপন্ন করে। যাতে লাভের থেকে লোকসানই হয় বেশি। সুতরাং ইগো ত্যাগ করে নিজের ব্যক্তিত্ব বাড়িয়ে তুলুন।

২)  সাহায্যের হাত বাড়ান – সমাজে থাকতে হলে কেউ পরিচিত অথবা কেউ কেউ অপরিচতই থেকে যায়। অপরকে সাহায্য করার প্রক্রিয়াটি এমনই যা মানুষকে একে অপরের সঙ্গে জোড়ে। দু’টি মানুষকে মনের দিক থেকে কাছাকাছি এনে দেয়। কারও বিপদে পাশে থাকা এবং যথাসম্ভব তাকে সাহায্য করার নামই মনুষ্যত্ব।

৩)  অপরের জন্য যখন ভাববেন, মনের মধ্যে নীচতা রাখবেন না – নিজের চিন্তাভাবনার বিস্তার ঘটান দেখবেন আপনি সম্পূর্ণ চিন্তামুক্ত এবং সন্তুষ্ট থাকবেন। অনেক সময় এরকম মানুষেরও সংস্পর্শে আমরা আসি যারা নিজেদের সময় অপরের হিতার্থ চিন্তায় কাটিয়ে দেয়। আবার অনেকে এমনও আছেন যারা অপরের চিন্তা করেন ঠিকই কিন্তু ভাবেন তারা সবাই বুঝি আপনার অনিষ্ট চাইছে। দুশ্চিন্তা, সন্দেহ মন থেকে হটান। কারও অনিষ্ট না করে নিজের লাভ কীসে হবে সেটা ভাবুন।

৪)  পুণ্যলাভের আশায় নয়, কর্তব্য ভাবুন – মানুষ অপরকে সাহায্য করে পূণ্যলাভের আশায়। কিন্তু যেখানে পুণ্য হওয়ার কোনও আশাই নেই সেখানে ক’জন এগিয়ে যান? শাস্ত্রে আছে ক্ষুধার্ত এবং পিপাসাতুর মানুষের সাহায্য করলে স্বর্গপ্রাপ্তি হয়। বহু লোক এমন আছে প্রচারের আশায় বহু অর্থ খরচ করে রীতিমতো আয়োজন অনুষ্ঠান করে কাঙালি ভোজন করায়। অথচ রাস্তায় বসে থাকা কোনও গরিব বাচ্চার মুখে এগিয়ে গিয়ে দুটো রুটি তুলে দিতে চায় না। ক্ষুধার্ত মানুষের মুখে অন্ন তুলে দেওয়াতে পুণ্য হয় না, এটা মানুষের কর্তব্য। ধর্মের দোহাই দিয়ে বিশেষ একটি দিনের জন্যে অপেক্ষা না করে বরং যার সত্যিই প্রয়োজন তাকে সাহায্য করাটাই নিজের কর্তব্য মনে করুন।

৫)  অপরকে সম্মান করুন পরিবর্তে সম্মান পান – উঁচুতে উঠে গেলে মানুষ নীচু স্তরের মানুষকে অবজ্ঞার চোখে দেখে। মানুষের স্বভাবই তাই। অফিসে হামেশাই অনেকেই সিনিয়র লেভেলে উঠে গেলে অধস্তন কর্মচারীদের উপর নিজের কতৃত্ব ফলাবার জন্যে শোষণ এবং অপমানের মাত্রা বাড়িয়ে তোলে। কিন্তু কাদাতে ঢিল ছুড়লে আমরা জানি কাদা নিজের গায়ে এসেও লাগবে। সুতরাং অপরকে অপমান করা মানেই অপরের অপমানও অপনাকে সহ্য করতে হবে। তাই অপরকে সম্মান করুন এবং পরিবর্তে অপরের সম্মান লাভ করুন।

 

দূরত্ব নয়, সম্পর্কে আনুন মাধুর্য

হালসময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে লাইফ স্টাইল বজায় রাখতে গিয়ে সবাই এত কেরিয়ারিস্ট হয়ে পড়ছেন যে, জীবনের অন্যান্য আবেগ ও রসায়নের দিকে আর সেভাবে নজর দিয়ে উঠতে পারছেন না। সাংসারিক জীবনে যার সরাসরি প্রভাব মারাত্মক বিপদ ডেকে আনছে। একে-অপরকে সময় দিতে না পারার ক্ষতটা অঘোষিত ভাবে একটা দূরত্ব তৈরি করছে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে।

দুজন অচেনা-অপরিচিত মানুষ অনেক আশা নিয়ে একে-অপরের সাথে গাঁটছড়া বাঁধেন সুখ-দুঃখ ভাগ করে নেওয়ার দায়বদ্ধতা থেকে। তবে কখনও কখনও নতুন সম্পর্ককে ঘিরে তৈরি হয় হতাশা আর অবসাদ। আর এর থেকে বাঁচতে অনেকেই সেপারেশন-এর পথ বেছে নিচ্ছেন। এর একটা বড়োসড়ো কারণ হল অ্যাডজাস্টমেন্ট-এর অভাব, একে-অপরকে খাটো করে দেখা। বিশেষ করে স্বামী-স্ত্রী উভয়েই যদি চাকরি করেন এবং কমবেশি মোটা অঙ্কের বেতন পেয়ে থাকেন, সেক্ষেত্রে সমস্যা আরও প্রকট হয়ে দাঁড়ায়।

এমনটা কেন হয়?

বিয়ের পর উভয়েরই একে-অপরের প্রতি প্রত্যাশা অনেক বেড়ে যায়। কর্মব্যস্ততার কারণে যখন সেই প্রত্যাশা পূরণ হয় না, তখনই সম্পর্কে তিক্ততা নেমে আসে। পাওয়া না পাওয়ার ক্ষোভ থেকেই সৃষ্টি হয় অশান্তির। দীর্ঘদিনের এই লড়াইয়ে অনেকেই মানসিক অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়েন। কেউ কেউ আবার আশ্রয় নেন অ্যালকোহলের। ফলে স্বাভাবিক কারণেই তৈরি হয় দূরত্ব।

বিবাহ হল দুটি মানুষের শরীর-মনের মেলবন্ধন। তবে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া মানে এই নয় যে দুটি মানুষের চিন্তাভাবনা এক হবে। সেটা কখনওই সম্ভব নয়। চরিত্রগতভাবেও দুটো মানুষ ভিন্ন। কেউ হয়তো অতিমাত্রায় অন্তর্মুখী কেউ আবার কথা বলতে ভালোবাসেন। কারওর খরচের হাত বেশ লম্বা, কেউ বা আবার একটু সংযমী। সেক্ষেত্রে সঙ্গী যদি তার উলটোদিকের মানুষটাকে একটু সংযমী হতে শেখান, তাহলে ক্ষতিটা কোথায়? ঠিক সেইরকম হতেই পারে, পার্টনারের কেউ একজন অতিমাত্রায় সংবেদনশীল, আবার উলটোদিকের মানুষটি একটু রুক্ষ প্রকৃতির। তাতে কী! সংসারে ওঠা-পড়া, খুনশুটি একটু রাগারাগি তো থাকবেই। সেগুলিকে কাটিয়ে উঠে ভালো থাকার নামই তো হল সংসার। না হয় ভালো থাকার জন্য একটু কমপ্রোমাইজ করলেন-ই।

কোনও সম্পর্কে যদি অ্যাডজাস্টমেন্ট শব্দটার গ্রহণযোগ্যতা না থাকে সে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখা মুশকিল। আর সেখানে যদি ইগো মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে তাহলে তো কথাই নেই। বলাই বাহুল্য, এরকম সম্পর্ক ভাঙার জন্যই গড়ে ওঠে। শহরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এমন অনেক ঘটনার সাক্ষী আমরা নিজেরাও। উদাহরণস্বরূপ একটি ঘটনা তুলে ধরা হল আপনাদের সামনে।

রিয়া আর অনীশের সম্পর্ক দীর্ঘদিনের। প্রায় সাত বছরের সম্পর্ক। একই কোম্পানিতে চাকরি করতে করতে প্রেম গড়ে ওঠে তাদের মধ্যে। দীর্ঘ ছয় বছর প্রণয়ের পর তারা বিয়ের সিদ্ধান্ত নেয়। সেইমতো বিয়েও হয় তাদের। কিন্তু বিয়ের মাস চারেক যেতে না যেতেই, লাঠালাঠি কাটাকাটি। অথচ বিয়ের আগে পর্যন্ত তাদের সম্পর্ক ছিল চোখে পড়ার মতো। তাদের ভালোবাসা দেখে অনেকেই ঈর্ষান্বিত হতো। কিন্তু বিয়ের পরে পরেই সম্পর্কটা কেমন যেন তিক্ততার পর্যায়ে চলে যায়। এক্ষেত্রে অনীশের এক্সপেক্টেশন ছিল অনেক বেশি। বিয়ের পরে সংসারের সমস্ত দায়িত্ব নাকি মেয়েদেরই বহন করতে হয়। সে যেহেতু পুরুষ, তাই কখনওই বাসন মাজা বা রান্নার কাজ সে করতে পারে না, এতে নাকি তার পৌরুষত্বে বাধে। স্বাভাবিক কারণেই সারাদিন অফিস করে ফেরার পর সংসার সামলাতে রীতিমতো হিমশিম খেতে হয় রিয়াকে। মাসের পর মাস এভাবে আপোষহীন ভাবে চলতে থাকার ফলে হাঁপিয়ে ওঠে রিয়া। অবশেষে একদিন সংসারে ইতি টানা। কোর্টের দ্বারস্থ হওয়া।

আবার এমনও দেখা গেছে। মেয়েটির আয় ছেলেটির তুলনায় অনেক বেশি। বিয়ের আগে এই ব্যাপারটিই খুব সহজ ভাবে নেওয়া ছেলেটি, হঠাৎ করেই কেমন যেন ইগোতে নিতে শুরু করেছে। ছোটোখাটো কথাকেই গায়ে মাখতে শুরু করেছে সে। নিজের অজান্তেই কখন স্ত্রীকে নিজের প্রতিদ্বন্ধী ভাবতে শুরু করেছে। মেয়েটি বহু চেষ্টা সত্ত্বেও এই ইগো থেকে বার করে আনতে পারেনি স্বামীকে। একটা সময় পর ক্লান্ত হয়ে মেয়েটিও কেমন যেন গুটিয়ে নিতে থাকে নিজেকে। এভাবেই একটু একটু করে চোখের সামনে সম্পর্কটা শেষ হয়ে যায়। প্রথমে আলাদা থাকা। তারপর পাকাপাকি ব্যবস্থা করা। যেন এই সম্পর্কটা থেকে বেরিয়ে আসতে পারলে দুজনেই স্বস্তির নিঃশ্বাস নিতে পারবে।

ভাবলে অবাক হতে হয়, এই সম্পর্ককে নিয়ে বিয়ের আগে তারা কতই না স্বপ্ন দেখেছে। কতকিছু প্ল্যান করেছে আগে থেকে। এমনকী বহুক্ষেত্রে দেখা গেছে, নিজের ভালোবাসার সম্পর্ক বাঁচাতে গিয়ে বাড়ির লোকেদের সঙ্গে সম্পর্ক পর্যন্ত ছেদ করেছে তারা। অথচ সেই সম্পর্কের কী পরিণতি! শুধুমাত্র অ্যাডজাস্টমেন্ট-এর অভাবে সম্পর্কগুলো কেমন যেন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে।

সমস্যা যে শুধু পুরুষদের তরফ থেকেই হচ্ছে এমনটা কিন্তু নয়। এর জন্য সমানভাবে দায়ী মেয়েরাও। অতিরিক্ত উচ্চাশা, নতি স্বীকার না করা, পরিবার থেকে সরে গিয়ে আলাদা থাকার প্রবণতা– এগুলো ভীষণ ভাবে সংসারের উপর নেতিবাচক ছাপ ফেলে। পুরুষ-মহিলা নির্বিশেষে সকলকেই সংসারের দায়ভার বহন করতে হবে। তাহলে বোধহয় অনেকাংশে সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।

সমীক্ষায় দেখা গেছে, অ্যারেঞ্জড্ ম্যারেজের তুলনায় লভ ম্যারেজে বিবাহ-বিচ্ছেদ হওয়ার সংখ্যাটা অনেক বেশি। কারণ সেখানে অ্যাডজাস্টমেন্ট-এর জায়গাটা অনেক বেশি। তারা জানেন সারাজীবন একসাথে থাকতে গেলে, সম্পর্ক মধুর করতে হলে একে-অপরকে বুঝতে হবে, নতুন করে জানতে হবে, অজানা পরিবেশে, অপরিচিত মানুষের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে হবে। সুতরাং তাদের এই মানসিক পূর্বপ্রস্তুতিই তাদের অনেকটা এগিয়ে রাখে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে।

বলাই বাহুল্য, যে-সমস্ত পুরুষ এখনও সেই প্রাচীন চিন্তাভাবনা নিয়ে বসে আছেন, যে অর্থ উপার্জন করলেই সংসারের প্রতি তার সমস্ত দায়ভার শেষ– তারা অবিলম্বে নিজেকে বদলে ফেলুন। নিজের জায়গা থেকে সরে এসে স্ত্রী-য়ের সঙ্গে মিলেমিশে সংসারে হাত লাগান। দেখবেন সম্পর্কের ইক্যুয়েশনটাই চেঞ্জ হয়ে গেছে। সঞ্জীব কপূরের কথা ভেবে দেখুন, আজ তিনি ওয়ার্ল্ড ফেমাস শেফ। তিনিও একজন পুরুষ, এটা যদি নিতান্তই মহিলাদের-ই কাজ হতো, তাহলে তিনি কেন এটাকে প্রফেশন হিসাবে বেছে নিলেন। একটু অ্যাডজাস্ট করতে শিখুন, দেখবেন ভালো থাকবেন।

কী করবেন

১)  কেরিয়ারের কথা অবশ্যই ভাববেন, কারণ ভালোভাবে বাঁচতে গেলে, লাইফস্টাইল মেনটেইন করতে গেলে টাকাটা ভীষণ প্রয়োজন। তবে তার মানে এই নয় যে সংসার, স্বামী সবকিছু ভুলে টাকার পিছনে ছুটবেন। এমন অনেক মহিলাই আছেন যারা অফিস সামলেও সুন্দর ভাবে সংসার করছেন। আপনিও পারবেন। অযথা রাগারাগি না করে স্বামীকে বোঝান, দেখবেন ঠিক বুঝবেন। আপনাকে হেল্পও করবেন।

২)  স্বামী বা স্ত্রী যখন কোনও বিষয়ে কমেন্ট করে, শুরুতেই রিঅ্যাক্ট করবেন না। আগে বুঝুন কেনও কথাগুলো বলছেন। অনৈতিক মনে হলে বিতর্কে না গিয়ে বোঝান।

৩)  সংসার থাকলে টুকটাক অশান্তি লেগে থাকবে। এসব নিয়ে ডিপ্রেসড্ হয়ে যাওয়ার কোনও কারণ নেই। বরং জানবেন যেখানে যত বেশি প্রেম, ভালোবাসা, এক্সপেক্টেশন, সেখানে তত বেশি অশান্তি। তাই বলব অ্যাডজাস্ট করতে শিখুন।

৪)  কাজ ভাগ করে নিন।

৫)  সুযোগ পেলেই কাছে-দূরে বেড়িয়ে আসুন।

৬)  চেষ্টা করুন সপ্তাহে অন্তত একদিন রেস্টুরেন্টে খেতে যেতে।

৭)  আপনার কাছের মানুষটিকে মাঝেমধ্যে তার পছন্দমতো গিফ্ট দিয়ে তাকে অবাক করে দিন। আপনার পার্টনারের ভালো লাগবে।

৮)  মন খুলে তারিফ করুন।

৯)  মহিলা বলে নিজে থেকে এগিয়ে গিয়ে স্বামীকে আদর করবেন না বা কাছে টানবেন না, এরকম ধারণা থাকলে বদলে ফেলুন। সঙ্গীকে কাছে টেনে নিন।

১০)  অনেকে বাচ্চা সামলাতে গিয়ে স্বামীর কথা বেমালুম ভুলে যান। এটা একেবারেই উচিত নয়, স্বামীকে সময় দিন।

 

কো-ডিপেনডেন্ট পেরেন্টিং-এ ক্ষতি

মা-বাবা মাত্রেই স্বপ্ন দেখেন, সন্তানকে সুশিক্ষা এবং অনুশাসন দিয়ে মানুষ করবেন। আর সেটা করতে গিয়ে অনেক সময় নিজেদের অজান্তেই কিছু ভুল করে বসেন, যার কুপ্রভাব বাচ্চাদের উপরে গিয়ে পড়ে। যার ফলে বাচ্চা মানসিক ভাবে অভিভাবকদের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। এই নির্ভরশীলতাই হল কো-ডিপেনডেন্ট পেরেন্টিং।

হেলিকপ্টার পেরেন্টিং-এর মতোই কো-ডিপেনডেন্ট পেরেন্টিং-এর ক্ষতিকারক এফেক্ট রয়েছে। এই ধরনের সম্পর্কে মা-বাবা এবং বাচ্চার মধ্যে নির্ভরতা, অস্বাস্থ্যকর আকর্ষণ, নেশার অভ্যাস গড়ে ওঠে যা কিনা মা-বাবা এবং বাচ্চা, উভয়েরই সম্পর্কের উপর প্রভাব ফেলে।

অনেক সময় কোনও ব্যক্তি অভিভাবক হয়ে যাওয়ার পর, নিজের সন্তানের সঙ্গে এমন সম্পর্ক তৈরি করেন, যেরকম সম্পর্ক তার নিজের মা-বাবার সঙ্গে ছিল অথবা নিজের মা-বাবার কাছেই শিখেছেন। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে সেই ব্যক্তি শিশু বয়স থেকে যখনই নিজস্ব কোনও সিদ্ধান্ত নিতে পা বাড়িয়েছেন, তাঁর অভিভাবকেরা সবসময় তাতে হস্তক্ষেপ করেছেন। যার ফলে অভিভাবকদের সঙ্গে তার সম্পর্ক ক্রমশ দুর্বল হয়েছে এবং সম্পর্কে দূরত্ব বেড়েছে।

বাচ্চার উপর প্রভাব

আপনার কাছে কো-ডিপেনডেন্সির সম্পর্ক হয়তো খুবই পছন্দের, ভালোলাগার কিন্তু আপনার সন্তানের জন্য কতটা ক্ষতিকারক সেটা কি আপনি বুঝতে পারছেন? আসলে এই ধরনের সম্পর্কে বাচ্চা নিজের ভাবনাচিন্তা বা সিদ্ধান্তকে গুরুত্ব দিতে পারে না। সব সময় চেষ্টা করে মা-বাবার ইচ্ছের সঙ্গে নিজের ভাবনাচিন্তাকে জুড়ে রাখতে। সেই কারণেই তারা নিজের খুশি, নিজের লক্ষ্যের উপর ফোকাস করা ছেড়ে দেয়। পরে এরাই যখন পেরেন্ট হয়ে ওঠে, নিজের সন্তানের কাছেও এই একই প্রত্যাশা থাকে।

সন্তানকে কী করে বুঝবেন?

বাচ্চা হয়তো কোথাও বাইরে বেরোচ্ছে, সেই মুহূর্তে তার মা-বাবা তাকে দেখে তার পোশাক বদলাতে বললেন। কারণ হিসেবে তারা বললেন, পোশাকটি তাকে মানাচ্ছে না। এটি খুবই সাধারণ, স্বাস্থ্যকর কথোপকথন। কিন্তু এটা নিয়ে যদি তারা জোর করতে থাকেন বাচ্চাটিকে পোশাক বদলাবার জন্য এবং শেষমেশ তারা পোশাক বদলাতে বাধ্য করেন, তাহলে বুঝতে হবে এটা কো-ডিপেনডেন্ট টেন্ডেন্সির উদাহরণ।

এক্সপার্টদের মতে কো-ডিপেনডেন্ট অবিভাবকেরা প্রায়শই সন্তান মানুষ করার ক্ষেত্রে ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন এবং অনুচিত ভাবে নিজের সন্তানের মাধ্যমে নিজেদের মানসিক, সামাজিক এবং ব্যক্তিগত প্রয়োজনকে চরিতার্থ করার জেদ প্রকাশ করে থাকেন। এর ফলে শিশুর মানসিক বিকাশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

আমি সঠিক, তুমি নও

বেশির ভাগ অভিভাবকদেরই এটা মনের কথা, যেটা তারা নিজেদের সন্তানদের প্রায়শই বলতে থাকেন। বাচ্চার সিদ্ধান্ত ভুল এবং তারা যেটা বলছেন সেটাই সঠিক, এই মানসিকতা প্রায় সব অভিভাবকদের মধ্যেই কাজ করে। একই সঙ্গে তারা এটাও প্রমাণ করার চেষ্টা করেন যে, তারা যা কিছু করছেন সবই সন্তানের ভালোর কথা ভেবে। এই ক্ষেত্রে বাচ্চা যদি অভিভাবকের সঙ্গে সহমত না হয়, তার মানে মা-বাবার অধিকারকে চ্যালেঞ্জ জানানো। তাদের বিরুদ্ধাচরণ করা।

ইমোশনাল অত্যাচার

অভিভাবকদের যখনই মনে হয় পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে অথবা বাচ্চা বেশি তর্ক করছে, তখনই পরিস্থিতির উপর নিয়ন্ত্রণ হারাবার ভয়ে কোনও রকম তর্কের মাঝেই কান্নাকাটি করা শুরু করে দেন অথবা বাচ্চার সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দিয়ে বাচ্চাকে রাজি করাবার জন্য প্রেশার ক্রিয়েট করেন। কো-ডিপেনডেন্সির এটি একটি উদাহরণ মাত্র, যেটার সাহায্য নিয়ে একজন অভিভাবক নিজের সন্তানকে তার মত অনুযায়ী রাজী করাতে চেষ্টা করেন।

ব্ল্যাকমেলিং

কো-ডিপেনডেন্ট রিলেশনশিপে মা-বাবার মুখ্য উদ্দেশ্য হয় বাচ্চাকে নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখা। তারা আশা করেন, বাচ্চা তাদের কথা শুনেই চলবে। কোনও ব্যাপারে সন্তানের যদি তাদের সঙ্গে মতের অমিল হয়, তাহলে আক্রমণাত্মক হয়ে উঠতেও তারা দ্বিধা করেন না। প্রথমে ইমোশনালি ব্ল্যাকমেলিং করা শুরু করেন। তাতেও যদি বাচ্চাকে নিজের মতামত মানতে বাধ্য না করতে পারেন, তাহলে অনেক সময় তাদের ভায়োলেন্ট ব্যবহারের মুখোমুখি হতে হয় বাচ্চাকে।

 

আনন্দ নিন মাতৃত্বের পূর্ণতার

মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে সীমা বরাবরই প্রচণ্ড স্টুডিয়াস। পরিবারে পড়াশোনার পরিবেশের মধ্যে সবসময় থাকার ফলে, নিজে পড়াশোনা এবং কেরিয়ার ছাড়া কোনও কিছু নিয়েই সীমা কখনও চিন্তা করেনি। গ্র্যাজুয়েশন শেষ করার পর এমবিএ পড়া শেষ করে একটি প্রাইভেট সেক্টর ব্যাংকে সীমা অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজারের পদে বহাল হয়। বাড়ি থেকেও শুরু হয় বিয়ের জন্য জোরাজুরি। কিন্তু সীমার কাছে চাকরি, পদ, কেরিয়ার ছাড়া অন্য কিছু ভাবার সময় কোথায়? তার ওপর বিয়ে মানেই সংসার, বাচ্চা সামলানো এসব তো সীমা স্বপ্নেও ভাবতে পারে না। সুতরাং তার মা-বাবার, মেয়ের বিয়ে নিয়ে চিন্তার সেখানেই বিরতি।

বছর পেরিয়েছে। আর্থিক স্বাধীনতা লাভের মোহ সীমাকে আরও পেঁচিয়ে ধরেছে। তা সত্ত্বেও সীমা বিয়ে করেছে। নিজের পছন্দেই করেছে। কিন্তু চাকরি ছাড়েনি এবং সন্তানের চিন্তাভাবনা তার মনে উঁকিও মারেনি। নিজের পছন্দমতো চাকরি পেয়েছে সীমা। মোটা মাইনে, সীমার জীবনকে উপভোগ্য করে তুলেছিল। হঠাৎ করে কেরিয়ার গ্রাফ যখন প্রগতির মুখে, তখনই এই ছেদ, সীমার জীবনে আনল আশ্চর্য পরিবর্তন।

সীমা সন্তানসম্ভবা হল এবং একটি শিশুপুত্রেরও জন্ম দিল। বাড়িতে দেখাশোনা করার কেউ নেই এবং বাইরের আয়ার ভরসায় বাড়িতে ওইটুকু বাচ্চাকে একা ছাড়া অসম্ভব। সুতরাং বাধ্য হয়েই সীমাকে চাকরি ছাড়তে হল।

সংসারের কাজকর্ম, সন্তানের যত্ন নেওয়া, তার ওপর মনের মতো বড়ো মাপের চাকরি ছাড়ার ব্যথা– সব মিলিয়ে নৈরাশ্যে ডুবে যেতে থাকে সীমা। সবসময় তার মনে হতে থাকে, সে নিজের জীবন, কেরিয়ার নিয়ে ছিনিমিনি খেলেছে এবং তারই ফলস্বরূপ কেরিয়ারে উন্নতির রাস্তা আজ তার কাছে সম্পূর্ণ বন্ধ।

ধীরে ধীরে তার মন এই পরিস্থিতির সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিল। সীমা নিজের মনকে বোঝাল। সন্তানকে বড়ো করা মায়ের দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে সুতরাং তাকে এই দায়িত্ব পালন করতেই হবে। তবে মনে মনে প্রার্থনা করতে থাকল, দিন তাড়াতাড়ি কেটে যাওয়ার জন্য এবং সন্তানও যাতে তাড়াতাড়ি বড়ো হয়ে ওঠে। সীমাও যাতে তাড়াতাড়ি চাকরিতে ফিরে যেতে পারে।

স্নেহের ছোঁয়ায় মাতৃত্বের বিকাশ

 দেখতে দেখতে তিন মাস কেটে যায়। ছোট্ট শিশুটির সঙ্গে গল্প করতে করতে সীমার সময় কাটে, যেন দুধের শিশুটি মায়ের সব কথা বুঝতে পারছে। বাচ্চাকে খাওয়ানো, তোল মাসাজ করানো, স্নান করানো, কোলে দোল দিয়ে ঘুম পাড়ানো। পরিবর্তে শিশুর নিষ্পাপ মুখে হাসির ঝিলিক খেলে যাওয়া, নরম হাতে মায়ের আঙুল আঁকড়ে ধরা। এসবই ধীরে ধীরে সীমাকে অনেক বেশি আনন্দ দিতে আরম্ভ করল যার স্বাদ চাকরি জীবনে সীমা কোনওদিন অনুভব করতে পারেনি। ছেলের মুখের এক ঝলক হাসি সীমার জীবন থেকে নৈরাশ্য মুছে দিয়ে সূর্যের রাঙা আলোয় জীবনকে রাঙিয়ে তুলল। হঠাৎই সীমা উপলব্ধি করতে পারল, শুধুমাত্র কর্তব্যের খাতিরেই সে সন্তানের পুরো দায়িত্ব নিজের কাঁধে নিয়ে নেয়নি। নিজের হাতে বাচ্চার প্রত্যেকটা কাজ করতে তার আনন্দ হচ্ছে এবং এর পিছনে একটাই কারণ কাজ করছে সেটা হল মাতৃত্বের উপলব্ধি এবং সন্তানের প্রতি গভীর স্নেহ ও ভালোবাসা।

দেখতে দেখতে কেটে যায় আরও কয়েকটা মাস। সীমার ছেলের বয়স এখন দেড়। গানের তালে নাচতে নাচতে মায়ের হাত ধরে টানে। ছেলেকে পাশে শুইয়ে ছড়া, গল্প বলা সীমার এখন নেশার মতো হয়ে গেছে। সীমার গানের গলা খুব সুন্দর। মায়ের গান শুনে শুনে ছেলেও গান গাইতে শিখেছে। বাড়ির আশেপাশে পাড়া প্রতিবেশী সক্বলে ঈশানকে প্রচণ্ড ভালোবাসে।

পাড়ার সকলে এই পুরো কৃতিত্বটাই দেয় সীমাকে। সীমার জন্যই ঈশান এত ভালো ভাবে মানুষ হচ্ছে। বাচ্চার জন্য সীমা নিজের চাকরি, কেরিয়ার সব স্যাক্রিফাইস করেছে কিন্তু এর ভালো ফল আজ ও হাতেনাতে পাচ্ছে। সীমার মনে পড়ে, অফিসের ঊর্ধ্বতন বস-ও তার কাজের সাফল্যে এইভাবেই প্রশংসায় মুখর হতেন।

পাঁচ বছর পরে যখন সীমা পিছনে ফিরে তাকায় তখন একটা জিনিস ওর কাছে খুব পরিষ্কার হয়ে যায় চোখের সামনে। কোনও পরিমাণ অর্থ, কেরিয়ারের সাফল্য, ছোট্ট শিশুর মাতৃত্বের স্পর্শে বড়ো হয়ে ওঠার মুহূর্তগুলির আনন্দকে ম্লান করতে পারে না। দুটোর মধ্যে কোনও তুলনা করাই চলে না। সীমার মনে হয় এই কটা বছরে সত্যিই কি ও জীবন থেকে কিছু হারিয়েছে? চাকরি ছেড়ে ও কি খুব বড়ো ভুল করে ফেলেছে? উত্তরটাও আজ ওর কাছে খুব স্পষ্ট ও উজ্জ্বল। সেটা হল ‘না’। সে তো রীতিমতো লাইফ এনজয় করেছে।

ঈশান এখন বেশ কিছুটা বড়ো হয়েছে। সীমা এবার তার নিজের কেরিয়ারে ফিরতে চায়। একটা অধ্যায়ে ছেদ পড়েছে ঠিকই– কিন্তু কোনও কিছুই পুরোপুরি শেষ হয়ে যায় না। মাতৃত্বের দায়িত্ব ও পোশাদার জগৎ দুই-ই এবার সীমা নিশ্চিন্তে সামলাতে পারবে।

 

দাম্পত্য অশান্তির প্রভাব শিশুর জীবনে

সম্প্রতি বলিউডের একটি ছবি ‘সিক্রেট সুপারস্টার’-এ আমরা দেখেছি, বাড়িতে স্বামী-স্ত্রীয়ের মধ্যে ঝগড়ার জন্য তাদের ছেলে-মেয়েরা কতটা সাফার করছে। অবশ্য ছবির শেষে দাম্পত্য সম্পর্কের ইতি দেখানো হলেও, ওই দম্পতিরই কন্যাসন্তানটি স্বতন্ত্র পরিচয় তৈরি করে নিতে সফল হয়।

কিন্তু সকলের ভাগ্যই এমন সুপ্রসন্ন হয় না। শহরের এক নামি স্কুলের শিক্ষিকা মনীষা গোস্বামীর অস্বাভাবিক মৃত্যুর পর পুলিশ, পারিবারিক কলহের সন্দেহবশত মনীষার স্বামী সুখেন্দুকে গ্রেফতার করে। কিন্তু সুখেন্দুর মা-বাবা সুখেন্দুর দুই মেয়েকে নিয়ে কোনও আত্মীয়ের বাড়ি আত্মগোপন করে।

মনীষার ভাই, সুখেন্দুর বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ জমা করে যে সুখেন্দু তার স্ত্রীকে নানাভাবে অত্যাচার করত।মণীষার ভাই জানিয়েছিল, তিনতলা থেকে ধাক্বা দিয়ে নীচে ফেলে দিয়েছিল সুখেন্দু ওর দিদিকে এবং তাতেই দিদির মৃত্যু হয়। কিন্তু সুখেন্দু বয়ান দিয়েছিল, বাপের বাড়িতে যাওয়া নিয়ে দুজনের মধ্যে কথা কাটাকাটি হয় এবং তাতেই মণীষা হঠাৎ করে উপর থেকে লাফ দেয়।

মণীষা মারা যায়। সুখেন্দুর লক-আপে স্থান হয়। পুলিশ নিজের মতো করে কেস গুছোতে আরম্ভ করে। এই কেস কতদিন চলবে ঠিক নেই। হয়তো আদালতে তারিখ বদলাতেই থাকবে। কিন্তু মণীষা আর সুখেন্দুর বাচ্চাদের কী হবে এটা কি কারও মনে হয়েছে? এই ক্ষেত্রে আইনও নিশ্চুপ। বাচ্চাদের একজনের বয়স দু’বছর আর ছোটোটার বয়স দশ মাস। ঠাকুমা, ঠাকুরদা কতদিন ওদের দেখাশোনা করতে পারবে? পড়াশোনারই বা কী হবে? এই ধরনের অনেক প্রশ্নই রয়েছে, যার উত্তর না সমাজের কাছে আছে, আর না আইনের মোটা মোটা বইতে লেখা আছে।

মনোবৈজ্ঞানিক ডা. সরকারের কাছে প্রশ্ন রাখা হলে তিনি জানালেন এই সমস্যা এখন প্রায় এপিডেমিকের পর্যায় চলে গেছে। কোর্টে এই ধরনের কত যে কেস চলছে তার ঠিক মতো পরিসংখ্যান কারও কাছেই নেই। তাঁর নিজের কাছেও এরকম বহু দম্পতি আসেন নিজেদের এবং বাচ্চাদের কাউন্সেলিং করাতে।

একটি উদাহরণ দিলেন। স্বামী-স্ত্রী তাদের দুই সন্তানকে নিয়ে এসেছিলেন কাউন্সেলিং-এর প্রয়োজনে। বড়ো দুজনের সঙ্গে কথা বলার পর বাচ্চাদের জিজ্ঞেস করা হয় মা-বাবার মধ্যে কে বেশি ঝগড়া করে? দুজনেই উত্তর না দিয়ে শুধু মা-বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে চুপচাপ বসে থাকে।

দুজনকে আলাদা অন্য একটা ঘরে নিয়ে যাওয়া হলে, ৬ বছরের বাচ্চাটি জানায়, মা-বাবা সবসময় অশান্তি করতে থাকে। বিবাদের পর দুজনেই আলাদা করে বাচ্চাদের জিজ্ঞেস করে কে বেশি ঝগড়া করে, মা না বাবা? ঝগড়া কে শুরু করেছিল ইত্যাদি ইত্যাদি। এই প্রশ্নের কোনও উত্তর বাচ্চারা দিতে পারে না। ঝগড়া করার পর দুজনেই গিয়ে শুয়ে পড়ে। দুটি বাচ্চাকেই ব্রেড বা বিস্কুট খেয়ে রাত্রে শুয়ে পড়তে হয়। কখনও কখনও ৬-৭ দিন পর্যন্ত মা-বাবার মধ্যে কথাবার্তা হয় না। ওই সময় বাচ্চাদের স্কুলেও পাঠানো হয় না এমনকী ওদের মা ঠিক করে রান্নাবান্নাও করে না তখন।

মনোবিদদের মতে মা-বাবাকেই আইডিয়াল মনে করে প্রত্যেক সন্তান। সুতরাং মা-বাবার মধ্যে ঝগড়া হলে বাচ্চাদের মনের সিংহাসন থেকে মা-বাবার স্থান অনেক নীচে নেমে আসে। এতে বাচ্চারা মানসিক আঘাত পায়। বাচ্চা কষ্টটার কথা কাউকে বলতে পারে না, মনে মনে গুমরোতে থাকে। ফলে বাচ্চার মানসিক এবং শারীরিক বিকাশ বাধাপ্রাপ্ত হয়। যে বাড়িতে অভিভাবকেরা নিজেদের মধ্যে ঝগড়া বেশি করে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সেই বাড়ির বাচ্চারা মানসিক বিকারের অথবা ডিপ্রেশনের শিকার হয়। কখনও আবার বাচ্চাদের মধ্যে অসম্ভব রাগ দেখা যায় আবার কেউ কেউ অপরাধ জগতেও পা রাখে।

বাচ্চার মনে কনফিউশন জন্মায় মা-বাবার ঝগড়ার ফলে

মা-বাবার মধ্যে ঝগড়া হলে, তার সরাসরি প্রভাব পড়ে বাচ্চার উপর। ক্ষতি হয় বাচ্চারই বেশি। স্বামী-স্ত্রী নিজেদের মধ্যে ঝগড়া করে বাচ্চার চোখে নিজেকে ঠিক প্রমাণ করার জন্য, একে অপরের বিরুদ্ধে বাচ্চার মনে বিষ ঢালতে শুরু করে। লড়াই করার পর মা বাচ্চাকে বোঝায়, বাবাই আসলে দোষী, সবসময় ঝগড়া করে। বাবার সঙ্গে খবরদার যেন সে কথা না বলে, তাহলে বাবা রাগের মাথায় তাকেও মারধর করতে পারে। বাবা আবার সন্তানকে বোঝায় পুরো ঝগড়াটার জন্য বাচ্চার মা প্রথম থেকেই দায়ী। ‘মা’ মানুষটা খুব খারাপ। দুই পক্ষের কথা শুনে বাচ্চার মনে কনফিউশন তৈরি হয়। যাদের সে এতদিন পৃথিবীর সবথেকে ভালো মা-বাবা জেনে এসেছে, সেই দুজন মানুষই কী করে একে অপরের নিন্দে করছে সেটা শিশুমন ভেবে পায় না।

মা-বাবার ডিভোর্সের পর কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন

ডিভোর্সের পর ওই দম্পতির সন্তানরাই সবথেকে বেশি কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন হয়। ডিভোর্সের কেস চলাকালীন মা-বাবা সন্তানদের নিজের নিজের কাছে রাখার জেদ ধরে বসেন। সম্প্রতি এমনই ঘটনা খবরের কাগজেও চোখে পড়েছে। মা-বাবা দুজনেই ডাক্তার। তাদের একমাত্র শিশুকন্যা হাসপাতালে ভর্তি অথচ তাদের নিজস্ব সমস্যা এবং ইগোর কারণে বাচ্চার চিকিৎসার পদ্ধতি নিয়ে টানাপোড়েনের ঘটনায় শেষমেশ বাচ্চাটির মৃত্যু হয়। আদালতে এমনই বহু কেস চলাকালীন মা-বাবা দুজনেই দাবি করেন বাচ্চা তাদের কাছে থাকলে বেশি ভালো থাকবে অপরজন বাচ্চাকে ভালোভাবে রাখতে পারবে না। কখনও আদালত, নির্ধারিত মেয়াদ ঠিক করে দেয় বাচ্চাকে রাখার। যেমন মায়ের কাছে একমাস থাকবে আবার বাবার কাছেও একমাস থাকবে বাচ্চা। এর ফলে মা-বাবার সঙ্গে দেখা তো হয় শিশুটির কিন্তু মা-বাবার সত্যিকারের স্নেহ কি সে আদৌ পায়? মা নিজেকে ভালো প্রমাণ করতে গিয়ে বাচ্চাকে নতুন নতুন খেলনা, কাপড়জামা হয়তো কিনে দেয়। এদিকে বাবা তার থেকেও দামি জিনিসপত্র কিনে দিয়ে প্রমাণ করতে চায়, তার থেকে ভালো বাবা আর হয় না। ইগো-র বশবর্তী হয়ে দুজনেই বুঝতে পারে না যে বাচ্চার আসল আনন্দ হল দু’জনকে একসঙ্গে পাওয়া। মা-বাবা একসঙ্গে থাকলেই বাচ্চা খুশি। আলাদা আলাদা ভাবে মা-বাবার সঙ্গে দেখা করে, দামি উপহার পেয়েও বাচ্চার সরল মন কিছুতেই আনন্দ লাভ করতে পারে না।

পারিবারিক বিবাদের মুখে অসহায় শিশুরা

শুধু মা-বাবার ঝগড়াই নয়, বাড়িতে বড়োদের মধ্যে ঝগড়া হওয়ার কারণেও বাচ্চারাই সব থেকে বেশি কষ্ট পায়। বাড়িতে বাবা-কাকা-জেঠুর মধ্যে হঠাৎ কেন ঝগড়া হচ্ছে, বাড়িতে পুলিশ আসছে, সকলে কোর্ট-কাছারি ছুটছে এইসব দেখে বাচ্চাও বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে। অথচ এদেরকেই হয়তো একসঙ্গে উঠতে বসতে দেখেছে বাড়ির বাচ্চারা। বাচ্চার শিশুমন বুঝে উঠতে পারে না কী কারণে হঠাৎ বাড়ির সকলে একে অপরের শত্রু হয়ে উঠেছে।

শহরের এক নামকরা উকিল বিষয়টি বিশ্লেষণ করতে গিয়ে উদাহরণ হিসেবে নিজের একটি কেসের কথা জানালেন। একটি পরিবারের চার ভাইয়ের মধ্যে শুরু হয় সম্পত্তি নিয়ে ঝগড়া ঝামেলা। ব্যাপারটা পুলিশ অবধি গড়ায়। চারজনের মধ্যে এক ভাই অপর ভাইদের বিরুদ্ধে, তাদের বউদের বিরুদ্ধে এমনকী সেই ভাইদের বাচ্চাদের বিরদ্ধেও থানায় এফআইআর লজ করে। বাচ্চাদের মধ্যে একটি দশ বছরের ছেলেও ছিল যার বিরুদ্ধে মারধর করার আরোপ দেওয়া হয়। কেসটি আদালতে ৮ বছর পর্যন্ত চলেছিল। সেই ১০ বছরের বাচ্চা আজ ২৪ বছরের যুবক। কিন্তু ছেলেটির মনে আজও কাকার উপর বিদ্বেষ এতটুকুও কমেনি।

এই কেসটি থেকে পরিষ্কার হয়ে যায় কেসকাছারি ঝগড়া করে বড়োরা পরে নিজের নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে কিন্তু শিশুদের মনে এই ঝগড়া-বিবাদ, ক্ষতিকর ছাপ ফেলে যায়। যার ফলে মনের মধ্যে রাগ পুষে রেখেই এরা বড়ো হয়ে ওঠে।

শিশুমনে জেল আদালত ইত্যাদির ছায়া

মা-বাবার ডিভোর্স চলাকালীন অথবা কোনও অপরাধের দরুন যদি হাজতবাস হয় কোনও অভিভাবকের, তাহলে তাদের সন্তানই ক্ষতিগ্রস্ত বেশি হয়। মা-বাবার হাত ধরে যদি আদালত চত্বরে যেতে হয় বাচ্চাকে, সেখানে কাঠগড়ায় মা-বাবাকে উঠতে দেখলে শিশুমনে সাংঘাতিক প্রভাব পড়ে। এছাড়াও হাতকড়া পরিয়ে যদি মা কিংবা বাবাকে পুলিশের সঙ্গে যেতে দেখে কোনও শিশু, তাহলেও সারা জীবনের মতো ওই দৃশ্য সে মন থেকে মুছে ফেলতে পারে না। মনে প্রশ্ন তার থেকেই যায় যে, কী দোষে তার প্রিয় মানুষটাকে হাতকড়া পরিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে? সে বাড়িতে কবে ফিরবে? জেলে কেন তাকে রাখা হচ্ছে?

বাচ্চাদের উপর কুপ্রভাব

১)  বাচ্চারা চুপচাপ হয়ে যায়। কারও সঙ্গে মেলামেশা করতে চায় না

২)  ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে। স্বপ্নে মা-বাবার ঝগড়ার দৃশ্যই বারবার উঠে আসে

৩)  অনেক বাচ্চা ড্রাগের শিকার হয়ে পড়ে

৪)  ঝগড়াটে, বদমেজাজি এবং খিটখিটে হয়ে পড়ে

৫)  অপরাধের জগতেও ঢুকে পড়ার প্রবণতা দেখা যায়

৬)  পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়

৭)  ডিপ্রেশনের শিকার হতে পারে বাচ্চা

৮)  বাচ্চার মানসিক এবং শারীরিক বৃদ্ধি রোধ হতে পারে

 

শিশুর দায়িত্বে সুপারমম

সুপারমম মানেই ‘সুপারম্যান’ ধরনের একটা চরিত্র হবে এমন ধারণা ভুল। তবে আজকাল বেশিরভাগ মায়েদের মুখে একটা কথা প্রায়ই শোনা যায়, ‘আমার ছেলের (অথবা মেয়ের) সব থেকে ভালো বন্ধু হচ্ছি আমি। আমার সঙ্গে ও সবকিছু শেয়ার করে।’ স্কুলের টিচার অথবা পেডিয়াট্রিশিয়ানরা অভিভাবকদের বলেন বাচ্চাদের সবরকম অ্যাকটিভিটিতে সঙ্গ দেওয়ার জন্যে। কিন্তু সন্তানের সমস্ত কাজে ইন্টারেস্ট নিতে নিতে একসময় দেখা যায় শিশুর ইচ্ছেকে ছাপিয়ে মায়ের ইচ্ছেই প্রাধান্য পাচ্ছে বেশি। অভিভাবকদের মধ্যে মায়ের ক্ষেত্রেই এটা বেশি হয়ে থাকে।

মেট্রো শহরের শিক্ষিত মায়েদের মধ্যে এই ধরনের প্রবণতা চোখে পড়ে। অনেকে তো ভালো চাকরি ছেড়ে বাড়িতে থাকাটা উচিত মনে করেন, সন্তানকে আরও ভালোভাবে মানুষ করার জন্যে। কেউ কেউ অফিসের কাজ করার ডিসিপ্লিন বাড়িতেও বাচ্চার ঘাড়ে চাপাতে চান। এই ধরনের অভিভাবকরা সর্বক্ষণ বাচ্চার প্রত্যেকটা কাজ নিজের নখদর্পনে রাখতে চান।

কলকাতার নামি স্কুলের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র সায়ন্তন মায়ের প্রেজেন্স-এ কুন্ঠিত হয়ে ওঠে। ওর মনে হয় মায়ের এই আচরণে তার ভালো কিছু হচ্ছে না, এটা শুধু টর্চার-এর নামান্তর মাত্র। সকাল থেকে উঠে ক্যালোরি মেপে খাওয়া এবং সারাদিনে তার আর কতটা ক্যালোরি গ্রহণ করা উচিত, তার উপরেও মায়ের একটা ডেলি লেকচার। স্কুলে আসার সময়ও সঙ্গে মা। যাওয়ার পথে, সন্ধেয় পড়ে নেওয়া আগের হোমওয়ার্কগুলো ঝালিয়ে নেওয়া। একটুকু যা বাঁচোয়া, অন্যান্য অনেক বন্ধুদের মায়েদের মতো মা সারাদিন স্কুলের গেটের বাইরে বসে থাকে না। বাড়ি ফিরে যায়। ডট সাড়ে তিনটেয় মা আবার হাজির স্কুলের গেটে। ফেরার পথে সারাদিনের স্কুলের ডিটেলড রিপোর্ট ছেলের মুখ থেকে কীভাবে বার করতে হয়, তা সায়ন্তনের মা ভালোই জানেন।

স্কুলের খাতায় প্রত্যেকটা ভুলের চুলচেরা বিশ্লেষণ মায়েদের– এই সমস্যার মুখোমুখি অনেক বাচ্চাকেই পড়তে হয় বাড়িতে। অনেক মায়েদের নিজেদের মতামত এতটাই প্রধান হয়ে ওঠে যে, সামান্যতম কোয়্যারি নিয়ে প্রিন্সিপালের অফিসে পৌঁছে যেতেও কোনও দ্বিধা হয় না। অনেক মায়েরা টিচারদের সঙ্গে মিটিং-এ লম্বা অভিযোগের লিস্ট নিয়ে উপস্থিত হন, যতই সেটা স্কুল পলিসির বিরুদ্ধেই হোক না কেন।

মায়েদের এই ধরনের আচরণ শিশুর মানসিক বিকাশে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। শিশুর যে-কোনও অ্যাকটিভিটি-তে মায়ের অংশগ্রহণ, বাড়িতে পড়াশোনা, হোমওয়ার্ক সবকিছুতে অংশ নেওয়ার ইচ্ছে এবং সাহায্যের হাত বাড়ানো ভুল পদক্ষেপ নয়। কিন্তু সবকিছু অতিরিক্ত মাত্রায় হলে, তা খারাপ প্রভাব ফেলতে বাধ্য।

আচরণে পরিবর্তন

সন্তানের সব ব্যাপারে অতিরিক্ত নাক গলানো হয়ে যাচ্ছে, এটা বোঝা যাবে কী করে? সন্তানের ছোটো-খাটো ভুলেও অতিমাত্রায় চিন্তা নিষ্প্রোয়োজন। রাত জেগে অথবা ভোরে উঠে ভালো অভিভাবক হয়ে ওঠার উপায়ের উপর বই পড়া, নেট সার্ফ করা ইত্যাদি ইত্যাদি। এছাড়াও বাচ্চার প্রত্যেকটা ব্যাপারের মধ্যে থাকা, সারাদিন নিজেকে এবং বাচ্চাকে ব্যস্ত রাখা, ডান্স, স্পোর্টস, অভিনয়, আঁকা, গান ইত্যাদি শেখাতে বিভিন্ন জায়গায় নিয়ে যাওয়া– কোনওরকম চেষ্টাই তারা ছাড়তে চান না কারণ সবকিছুতেই বাচ্চাকে করে তুলতে হবে পারদর্শী। তাদের মতে সবকিছু শেখাতে পারলে তবেই তো বাচ্চা বুঝতে পারবে কোনটাতে সে সবথেকে ভালো। বই পড়ে আর নেট সার্চ করে এই শিক্ষাগুলিই অভিভাবকেরা পেয়ে থাকেন। এভাবেই হয়ে উঠতে চান আইডিয়াল পেরেন্ট।

এইসব মায়েরা নিজের সন্তানের ক্ষেত্রে একটু বেশি প্রোটেক্টিভ হয়ে ওঠেন। ছোট্ট থেকেই বাচ্চাকে হাঁটতে চলতে, যেখানে-সেখানে যেতে বাধা দেন, যাতে শিশু কোনওভাবে আহত না হয়। একটু বড়ো হলে স্কুলের পড়াশোনা, হোমওয়ার্ক নিয়ে চলে কন্সট্যান্ট রিমাইন্ডার। তারপর বিভিন্ন হবি জোরজবরদস্তি বাচ্চার উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়। এর বেশিরভাগ ইচ্ছেটাই মায়ের, বাচ্চার তাতে মত আছে কিনা জানার চেষ্টা করা হয় না। নিজেদের ইচ্ছা ও আকাঙক্ষা যা অপূর্ণ থেকে গেছে, সেগুলো বাচ্চার মধ্যে দিয়ে পূর্ণ করার আপ্রাণ চেষ্টা চলতে থাকে। বাসে-ট্রামে যাতায়াতে অনেক সময়ই কানে আসে, ‘আমার ছেলের পরীক্ষা না-তো, আমারই পরীক্ষা। পড়াতে পড়াতে ওর প্রশ্ন-উত্তর আমারই মুখস্থ হয়ে গেছে।’ সুতরাং ক্ষতিটা হচ্ছে কার? সন্তান যে তার কনফিডেন্স হারিয়ে ফেলছে সে ব্যাপারটা কি মায়েদের কাছে অজানা থেকে যাচ্ছে? তাই প্রথম থেকেই সাবধান হয়ে যান, কখন অতিরিক্ত অভিভাবকের বোঝা ঘাড়ে তুলে দায়িত্বের অপব্যবহার করে ফেলছেন।

সজাগ থাকুন

১) আপনি কি আপনার সন্তানের অনিচ্ছা সত্ত্বেও তার অ্যাক্টিভিটির মধ্যে অতিরিক্ত ইনভল্ভ হয়ে পড়ছেন?

২) সন্তানের হয়ে যুদ্ধজয় করার আকাঙক্ষা রাখেন এবং বাচ্চার স্কুলের প্রোজেক্ট নিজেই করে দেন?

৩) আপনি কি বাচ্চার অ্যাক্টিভিটি, পড়াশোনা, বন্ধু, খাবার অভ্যাস, সবকিছুই কনট্রোল করছেন?

৪) প্রত্যেকটা ছোটো ছোটো বিষয়ে (দোষ অথবা অন্যায়) আপনি কি সন্তানকে ব্ল্যাকমেল করেন?

৫) আপনি কি আপনার সন্তানের যে-কোনও ফেলিওর-এ লজ্জিত হন?

৬) কোনও সময়ই সন্তানকে একা ছেড়ে না দিয়ে, খেলা অথবা পড়ার জন্যে সর্বক্ষণ জোর করতে থাকেন কি?

উপরের প্রশ্নগুলির উত্তর যদি হ্যাঁ হয় তাহলে জানবেন বাচ্চার প্রতি অন্যায় করছেন আপনি।

 

পড়ার জন্য সীমাহীন গল্প-নিবন্ধসাবস্ক্রাইব