সমাজে থাকতে হলে, ইচ্ছেমতন যেমন খুশি ব্যবহার করা সমীচীন নয়। এতে সামাজিক এবং পারিবারিক সম্পর্কগুলির মধ্যে ব্যবধান তৈরি হতেই পারে, কারণ পরিবার কিন্তু সমাজের বাইরে নয়। সুতরাং সম্পর্কের মিষ্টতা বজায় রেখে জীবনের প্রতিটা মুহূর্ত সুন্দর করে তোলাটাই কাম্য।

পারিবারিক সম্পর্ক

বংশপরম্পরায় পারিবারিক সম্পর্কগুলিকে টিকিয়ে রাখা খুব জরুরি। পাঁচটি এমনই উপায় জেনে রাখুন যাতে সম্পর্কের বুনিয়াদ আরও শক্ত হতে পারবে।

১)  বিদ্রুপ করে কথা বলবেন না – পরিবারের কারও মনে আঘাত দিয়ে কথা বলবেন না অথবা কারও চরিত্রের দুর্বলতা অপরের সামনে প্রকাশ করে তাকে নীচু করার চেষ্টা করবেন না। দৃষ্টান্তস্বরূপ ধরুন বাড়ির বউয়ের ভাই ইন্টারকাস্ট বিয়ে করার ফলে, বউয়ের শ্বশুর বাড়িতে থাকাই মুশকিল হয়ে পড়ল। শ্বশুরবাড়ির লোকেরা উঠতে বসতে ভাইয়ের বিয়ের জন্যে বাড়ির বউকে খোঁটা দেওয়া শুরু করল। কিন্তু কেন এমনটা হবে? ইন্টারকাস্ট ম্যারেজ কোনও দোষের নয়, হতে পারে পুরোনো ধারণায় বিশ্বাসী, বয়স্ক মানুষজন। তাঁদের সংস্কৃতি এটাকে দোষের বলে মনে করে। কিন্তু বউ তো নিজের বাড়ির লোক, তার সুখ দুঃখ ভাগ করে নেওয়ার দায়িত্বও তাই শ্বশুরবাড়ির সকলেরই। অপরকে ছোটো করে লাভ কী, হয়তো নিজেকে সকলের কাছে মহান প্রতিপন্ন করা। কিন্তু ফল উলটোই হয়, অপরকে সকলের সামনে খাটো করে তুলতে গিয়ে সে নিজেই সকলের হাসির পাত্র হয়ে ওঠে। সুতরাং এই রোগ থেকে নিজেকে মুক্ত রাখাই শ্রেয়।

২)  নিজের দায়িত্ব বুঝুন – নিজের সন্তানের সঙ্গে সঙ্গে মা-বাবার দায়িত্ব নেওয়াটাও পারিবারিক দায়িত্ববোধের মধ্যেই পড়ে। বৃদ্ধ বাবা-মা, শ্বশুর-শাশুড়ির দেখাশোনা করাটাও যেমন দায়িত্বর মধ্যে পড়ে, তেমনি সন্তানকে ভালো ভাবে যত্ন নিয়ে বড়ো করে তোলাটাও মা-বাবার দায়িত্ব। কিন্তু আধুনিক সভ্যতার চাদরে যারা গা-মুড়ে রাখতে ভালোবাসেন, তারা সন্তানের জন্ম দেওয়া এবং সবরকম সুখসুবিধা দেওয়াটাকেই খালি দায়িত্ব বলে মনে করেন। অথচ মা-বাবার সঙ্গ এবং তাদের মূল্যবান সময়ের অংশ কিছুটা হলেও সন্তানের ভালো ভাবে বড় হয়ে ওঠার জন্যে প্রয়োজন হয়। সুতরাং সন্তানকে সময় দেওয়াটাও দায়িত্বের অংশ বলেই মনে করা উচিত।

৩)  মিথ্যার আশ্রয় নেবেন না – নিজের দায়িত্ব থেকে বাঁচতে, নিজেকে জনপ্রিয় করে তুলতে অথবা নিজের ভুল লোকাবার জন্যে মানুষ মিথ্যার আশ্রয় নেয়। জয়েন্ট ফ্যামিলিতে মিথ্যা বলার প্রবণতা বেশি দেখা যায়। সেখানে বহু মানুষের মধ্যে একে অপরের থেকে নিজের সুপিরিয়রিটি প্রমাণ করার জন্যে মিথ্যার আশ্রয় যেমন কেউ কেউ নিয়ে থাকে, তেমনি ভুলও করে ফেলে অনেক বেশি। তাই অপরের প্রতি কোনওরকম দ্বন্দ্ব যদি মনের মধ্যে পোষণ না করেন তাহলে সম্পর্কটাও অনেক সহজ হবে এবং মিথ্যার আশ্রয়ও নিতে হবে না। সুতরাং মনে সাকারাত্মক ভাবনা রাখুন, দেখবেন সম্পর্কে চিড় ধরবে না এবং নিজের ব্যক্তিত্বও উন্নত হবে।

৪)  অর্থের প্রাচুর্য দেখাবার দরকার নেই – আপনি যে ধনী, সেটা পরিবারে জনে জনে সকলকে বলে বেড়াবার প্রয়োজন হয় না। অনেকেই অনুষ্ঠান, রীতি রেওয়াজের নাম করে টাকার বন্যা বইয়ে দেন যাতে আত্মীয়স্বজনের মধ্যে নিজেকে উঁচু আসনে বসানো যায়। বিয়ে, পৈতে, অন্নপ্রাশন ইত্যাদি অনুষ্ঠানে অপ্রয়োজনে অনেক বেশি খরচ করার ট্রেন্ড এখন হামেশাই চোখে পড়ে। এগুলো অবিলম্বে বন্ধ করা বাঞ্ছনীয়।

৫)  অভিব্যক্তির স্বতন্ত্রতা – আমাদের সংবিধানেও অভিব্যক্তির স্বতন্ত্রতার উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু পরিবারে কয়েকজনই নিজেদের স্বতন্ত্র অভিব্যক্তি প্রকাশ করার সুযোগ পায়। সরল, সাদাসিধে মানুষরা নিজেদের ইচ্ছে অনেক সময় খুলে বলে উঠতে পারেন না কারণ পরিবারের প্রতাপশালী ব্যক্তিটি অন্যদের দাবিয়ে রাখাই পছন্দ করেন। সরল মানুষটির কথায় হয়তো প্রতাপশালী ব্যক্তিটি উপকৃতই হতে পারেন কিন্তু তাকে দাবিয়ে দিয়ে ক্ষতিটা কার হয়? সুতরাং সকলের কথা শোনার পরেই আপনি ভালো-মন্দের বিবেচনায় আসতে পারেন। বাড়ির স্ত্রী পুরুষ, ছোটো-বড়ো সকলেরই মনের ইচ্ছে খুলে বলার স্বতন্ত্রতা থাকা উচিত।

সামাজিক সম্পর্ক

জীবনে সুখ পেতে হলে পারিবারিক সম্পর্কগুলির সঙ্গে সামাজিক সম্পর্কগুলোও মজবুত করা দরকার।

১)  ইগো, অহংকার ত্যাগ করতে হবে – অহংকারে মানুষ অন্ধ হয়ে যায়। তখন অপরকে মানুষ বলে জ্ঞান করে না, তাকে দুঃখ দিতে চেষ্টা করে অথবা পরের আত্মবিশ্বাস কমাবার ইচ্ছা মনের মধ্যে জেগে ওঠে। অফিসের মধ্যে এরকম ইগোর লড়াই সকলেরই চোখে পড়ে। ইগো, অহংকারে অনেক সময় মানুষ এমন পদক্ষেপ নিয়ে ফেলে যেটা তার ব্যক্তিত্বকে কলঙ্কিত করে তোলে আবার কখনও অপর মানুষটির সাংঘাতিক ক্ষতিও করে ফেলে। অহংকার কখনওই কাউকে উচ্চতার শিখরে নিয়ে যেতে পারে না বরং সকলের চোখে নীচ প্রতিপন্ন করে। যাতে লাভের থেকে লোকসানই হয় বেশি। সুতরাং ইগো ত্যাগ করে নিজের ব্যক্তিত্ব বাড়িয়ে তুলুন।

২)  সাহায্যের হাত বাড়ান – সমাজে থাকতে হলে কেউ পরিচিত অথবা কেউ কেউ অপরিচতই থেকে যায়। অপরকে সাহায্য করার প্রক্রিয়াটি এমনই যা মানুষকে একে অপরের সঙ্গে জোড়ে। দু’টি মানুষকে মনের দিক থেকে কাছাকাছি এনে দেয়। কারও বিপদে পাশে থাকা এবং যথাসম্ভব তাকে সাহায্য করার নামই মনুষ্যত্ব।

৩)  অপরের জন্য যখন ভাববেন, মনের মধ্যে নীচতা রাখবেন না – নিজের চিন্তাভাবনার বিস্তার ঘটান দেখবেন আপনি সম্পূর্ণ চিন্তামুক্ত এবং সন্তুষ্ট থাকবেন। অনেক সময় এরকম মানুষেরও সংস্পর্শে আমরা আসি যারা নিজেদের সময় অপরের হিতার্থ চিন্তায় কাটিয়ে দেয়। আবার অনেকে এমনও আছেন যারা অপরের চিন্তা করেন ঠিকই কিন্তু ভাবেন তারা সবাই বুঝি আপনার অনিষ্ট চাইছে। দুশ্চিন্তা, সন্দেহ মন থেকে হটান। কারও অনিষ্ট না করে নিজের লাভ কীসে হবে সেটা ভাবুন।

৪)  পুণ্যলাভের আশায় নয়, কর্তব্য ভাবুন – মানুষ অপরকে সাহায্য করে পূণ্যলাভের আশায়। কিন্তু যেখানে পুণ্য হওয়ার কোনও আশাই নেই সেখানে ক’জন এগিয়ে যান? শাস্ত্রে আছে ক্ষুধার্ত এবং পিপাসাতুর মানুষের সাহায্য করলে স্বর্গপ্রাপ্তি হয়। বহু লোক এমন আছে প্রচারের আশায় বহু অর্থ খরচ করে রীতিমতো আয়োজন অনুষ্ঠান করে কাঙালি ভোজন করায়। অথচ রাস্তায় বসে থাকা কোনও গরিব বাচ্চার মুখে এগিয়ে গিয়ে দুটো রুটি তুলে দিতে চায় না। ক্ষুধার্ত মানুষের মুখে অন্ন তুলে দেওয়াতে পুণ্য হয় না, এটা মানুষের কর্তব্য। ধর্মের দোহাই দিয়ে বিশেষ একটি দিনের জন্যে অপেক্ষা না করে বরং যার সত্যিই প্রয়োজন তাকে সাহায্য করাটাই নিজের কর্তব্য মনে করুন।

৫)  অপরকে সম্মান করুন পরিবর্তে সম্মান পান – উঁচুতে উঠে গেলে মানুষ নীচু স্তরের মানুষকে অবজ্ঞার চোখে দেখে। মানুষের স্বভাবই তাই। অফিসে হামেশাই অনেকেই সিনিয়র লেভেলে উঠে গেলে অধস্তন কর্মচারীদের উপর নিজের কতৃত্ব ফলাবার জন্যে শোষণ এবং অপমানের মাত্রা বাড়িয়ে তোলে। কিন্তু কাদাতে ঢিল ছুড়লে আমরা জানি কাদা নিজের গায়ে এসেও লাগবে। সুতরাং অপরকে অপমান করা মানেই অপরের অপমানও অপনাকে সহ্য করতে হবে। তাই অপরকে সম্মান করুন এবং পরিবর্তে অপরের সম্মান লাভ করুন।

 

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...