অপত্য

অফিস ফেরত রোজই একবার করে থানায় ঘুরে আসে দেবেশ। আজ তিন মাস যাবৎ এই চলে আসছে। এই কয়েকদিনের ধকলেই আদ্যোপান্ত বুড়ো হয়ে গেছে মানুষটা। মাথায় এখন কাঁচার তুলনায় পাকারই আধিক্য। চোয়াল ভেঙে গালদুটো ভিতর দিকে ঢুকে গেছে। চোখের নীচে একরাশ কালি। দেখলেই বোঝা যায় বেশ কয়েকরাত ঠিক করে ঘুমোয়নি।

আজও রুটিনের বড়ো একটা হেরফের হয়নি। অফিস চলাকালীন ইন্সপেক্টর তপন সিকদারের ফোন পেয়ে কয়েকঘন্টা আগেই থানায় ছুটে গিয়েছিল দেবেশ। বড়োবাবু অসীম জোয়ারদারের ঘরের বাইরে বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর, যে-খবরটা নিয়ে ফিরেছিল দেবেশ, তাতে তাকে আরও বিমর্ষ দেখাচ্ছিল।

স্বামীর অপেক্ষাতেই বারান্দায় পায়চারি করছিল কাবেরী। তার নজর আটকে ছিল বাইরের মূল ফটকের দিকে। দেবেশকে ঢুকতে দেখেই তাড়াহুড়ো করে দরজাটা খুলে দেয় সে। এক মিনিটও ব্যয় না করে প্রশ্ন করে বসে, ‘কোনও খবর পেলে?’ স্ত্রী-র কথার কোনও সদুত্তর দিতে পারে না দেবেশ। কেবল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। চুপচাপ জুতোটা খুলে ঘরের ভিতর ঢুকে যায়। সামনে থাকা সোফাটার উপরে ব্যাগটা রেখে মাথা নীচু করে বসে পড়ে। সেই প্রশ্নটা আবার তিরের মতো কানে এসে বেঁধে। ‘বললে না তো, কোনও খবর পেলে?’

উত্তরটা হয়তো কাবেরীরও অজানা নয়, তবু মন যে মানে না। দেবেশের কাছেও যে কোনও উত্তর নেই। কী জবাব দেবে দেবেশ, স্ত্রী-র চোখের দিকে তাকাতে পারে না সে। কোনওমতে নিজেকে সামলে নিয়ে ধীর কণ্ঠে বলে, ‘না’। একটা অস্ফুট স্বর কানে আসে কাবেরীর। পাথরের মূর্তির মতো স্থির হয়ে থাকে সে। দীর্ঘ তিনমাস যাবৎ একই কথা শুনতে শুনতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে সে। পুলিশের অক্ষমতা নিয়ে বারবার প্রশ্নও তুলেছে। ক্রমশ নিরাশা যেন গ্রাস করে ফেলছে তাদের। তাদের যে আর কিছুই করার নেই। সাধ্য অনুযায়ী সবরকম চেষ্টা তো করল এতদিন। দিনরাত থানায় পড়ে থেকেছে। এদিক-সেদিক ছুটেছে। আত্মীয়, বন্ধুবান্ধব কম করেনি। খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন পর্যন্ত দিয়েছে। এখন সবই উপরওয়ালার হাতে।

সোফার পাশে কাবেরীকে ওভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কষ্ট যেন দ্বিগুণ বেড়ে যায় দেবেশের। গলা শুকিয়ে আসে তার। খানিক স্বস্তি পেতে সামনের টি-টেবিলে ঢেকে রাখা জল ঢক ঢক করে খেয়ে নেয় সে। তারপর কাবেরীকে কাছে ডেকে বসিয়ে বলে, ‘আজকে অসীমবাবু আবার একটা নতুন খবর দিলেন।’

‘নতুন খবর!’ মুখে যেন একশো ওয়াটের বাল্ব জলে ওঠে কাবেরীর। কিন্তু সেই আলো আবার নিভেও যায়। মনের মধ্যে আশঙ্কার মেঘ জমতে শুরু করে। ভাবে, যে-কথাটা তারা কিছুতেই মন থেকে স্বীকার করতে পারছে না, তাহলে কী অবশেষে সেটাই সত্যি হয়ে দাঁড়াল। মনটা কেমন যেন কু-গাইতে থাকে। সবকিছু এলোমেলো হয়ে যায়। উদ্বিগ্ন ভাবে স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।

‘ঋকের বন্ধুরা পুলিশের মারের চাপে স্বীকার করেছে যে, তারা আমাদের ঋককে এ-পৃথিবী থেকে সরিয়ে ফেলেছে।’ বলতে বলতে গলা কেঁপে ওঠে দেবেশের। জল চিকচিক করে ওঠে চোখের কোণায়।

কথাটা শোনামাত্রই হাউহাউ করে কেঁদে ওঠে কাবেরী। থামানোর চেষ্টাও করে না দেবেশ। যদিও সান্ত্বনা দেওয়ার মতো ভাষা তার কাছে নেই। মেয়েরা তো কেঁদে-কেটে খানিক হালকা হতে পারে, কিন্তু পুরুষরা তো সেটাও পারে না। মিনিট কয়েক এভাবেই কেটে যায়। মাথা নীচু করে কপালে হাত দিয়ে বসে থাকে দেবেশ। সম্বিৎ ফেরে কাবেরীর গোঙানির শব্দে। তাড়াতাড়ি উঠে একগ্লাস জল বাড়িয়ে দেয়। তারপর আবার বলতে শুরু করে, ‘বডি পাওয়া যায়নি, তবে কিছু হাড়গোড় উদ্ধার করেছে। ওটা দেখে তো সনাক্ত করা সম্ভব নয়।’

কাতরস্বরে কাবেরী বলে ওঠে, ‘তাহলে কী করে ওরা এত নিশ্চিত হচ্ছে যে, ও-ই আমাদের ঋক। এমনও তো হতে পারে ওটা অন্য কেউ। ওরা ভুল ভাবছে।’ শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখের জল মোছে কাবেরী।

‘হ্যাঁ, ওদের ধারণা ভুল প্রমাণিত হতেই পারে। সেই কারণেই তো ওরা ডিএনএ টেস্ট করে দেখতে চাইছে। কাল একবার থানায় গিয়ে ব্লাড স্যাম্পেল দিয়ে আসতে বলেছে।’

‘ব্লাড স্যাম্পল?’ কেমন যেন চমকে ওঠে কাবেরী। একমুহূর্তেই আতঙ্কের কালো মেঘ ছেয়ে যায় কাবেরীর চোখেমুখে।

‘ভয় পাচ্ছ কেন, এমনও তো হতে পারে তোমার ধারণাই ঠিক। ও আমাদের ঋক নয়।’

দেবেশের সান্ত্বনা কাজে আসে না। ছটফট করতে থাকে কাবেরী। দেবেশ ভাবে ছেলে হারানোর শোক একজন মা-কে অস্থির করে তুলেছে। কোনওরকমে শান্ত করে ওষুধ খাইয়ে শুইয়ে দেয় কাবেরীকে। তারপর নিজে ড্রইং রুমে আরাম কেদারায় গা এলিয়ে দিতেই বহু পুরোনো কথা মনের মধ্যে ভিড় করে আসে।

দেবেশের পারিবারিক ব্যাকগ্রাউন্ড বেশ ভালো। সম্ভ্রান্ত পরিবার। বাবা রিজার্ভ ব্যাংক-এ চাকরি করতেন। মা হাউজওয়াইফ হলেও যথেষ্ট কোয়ালিফায়েড। তখনকার দিনে এমএ পাশ করাটা চাট্টিখানি কথা নয়। শুধুমাত্র সংসার আর বাচ্চাকে ভালোবেসে কেরিয়ারের কথা ভাবেননি। সংসার আর ছেলেকে নিয়েই স্বাচ্ছন্দ্যে কাটিয়েছেন। প্রভাব প্রতিপত্তি, বৈভবের মাঝে কখনও হারিয়ে ফেলেননি নিজেকে। ছেলেকেও ঠিক নিজের মনের মতো করে মানুষ করেছেন। দেবেশ যখন বছর আঠাশের তখনই মারা যান দেবেশের বাবা। তখন সবে সবে রেলে-র চাকরিতে জয়েন করেছে দেবেশ। পড়াশোনায় বরাবরই ভালো ছাত্র হিসাবে কলেজে নামডাক ছিল। চাকরিটাও পেয়ে যায় জীবনের প্রথম পরীক্ষাতে বসেই। সংসার বলতে মা আর ছেলে। ছেলে অফিস বেরিয়ে যাওয়ার পর বড়ো একাকী বোধ করতেন দেবেশের মা। তাই যুদ্ধকালীন তৎপরতায় পছন্দ করা পাত্রীর সঙ্গে ছেলের বিয়ে দিয়েছিলেন। দেবেশের বাবা তাঁর ছোটোবেলার বন্ধুর একমাত্র মেয়ের সাথে ছেলের বিয়ে একরকম পাকা করেই রেখেছিলেন। বাবার পছন্দ করা পাত্রী কাবেরী-র সাথেই বিয়ে হয়েছিল দেবেশের। অবশ্য দেবেশও যে বিয়ের আগে কাবেরীকে দেখেনি এমন নয়। একই কলেজে পড়াশোনা করেছে, বেশ কয়েকবার আলাদা করে কথাও বলেছে। বিয়ের আগে বার দুয়েক কলেজের বাইরে দেখাও করেছে তারা।

দেবেশের মা উমাদেবী ভেবেছিলেন বউমাকে একেবারে মেয়ের মতো করে রাখবেন। ঘুরবেন, ফিরবেন, গল্প করবেন। নাতি-নাতনি নিয়ে সুখে সংসার করবেন। কিন্তু ভাবনা তো ভাবনাই। বাস্তবের সঙ্গে এর তফাত অনেকটা। প্রথম প্রথম সব ঠিক থাকলেও দিনকতক পর উমাদেবী বুঝতে পারেন তাঁর আধুনিক মনস্ক বউমার মন সংসারের তুলনায় বাইরের দিকেই বেশি। সবসময় বন্ধুবান্ধব, পার্টি। সমাজসেবার নামে এখানে সেখানে বেরিয়ে পড়া।

উমাদেবী বউমার এই যখন-তখন বেরিয়ে পড়া, রাত করে বাড়ি ফেরা নিয়ে মাঝেমধ্যেই আপত্তি তুলতেন। এই নিয়ে শাশুড়ি-বউমার টুকটাক অশান্তিও লেগে থাকত। তবে এসব ব্যাপারে বড়ো একটা মাথা ঘামাত না দেবেশ। বরং তার ধারণা ছিল সংসারের চাপ পড়লে কাবেরী নিজে থেকেই ক্লাব, পার্টি এসমস্ত ছেড়ে দেবে। তখন বাচ্চার টানে নিজেই সংসারের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেবে। কাজেই শুধু শুধু অশান্তি করে লাভ কী। এরকম তো অনেক মেয়েই ভাবে বাচ্চা নিলে তার ফিগার নষ্ট হয়ে যাবে। আগের মতো আর আকর্ষণীয় থাকবে না। কিন্তু ক’টা মেয়ে এই ভাবনা-চিন্তায় অনড় থাকতে পারে। একবার মা হলে এসমস্ত তাদের আর খেয়ালই থাকে না।

কিন্তু কাবেরীর ক্ষেত্রে এমনটা হয় না। বিয়ের পাঁচ বছর পরে পুত্রসন্তানের জন্ম দেওয়ার পরেও কাবেরীর স্বভাবে কিছুমাত্র রদবদল ঘটে না।

মাস তিনেক বাড়িতে থাকার পর শাশুড়ি আর আয়ার ভরসায় আবার আগের মতো ক্লাব, পার্টি করতে শুরু করে সে। বয়সের ভারে আয়ার সাহায্য নিতে হয়েছে ঠিকই তবে যতদিন উমাদেবী বেঁচেছিলেন ততদিন ঋক-কে উনিই সামলেছেন। কিন্তু মানুষের মৃত্যুর কথা কে বলতে পারে, যখন ঋকের বছর দশ বয়স তখনই একদিন হঠাৎ করে বুকে ব্যথা। আধ ঘন্টাও সময় দেননি। ডাক্তার নিয়ে আসতে আসতেই সব শেষ। তার পর থেকেই ঋক বড়ো একা। কারও সাথে তেমনভাবে কথা বলে না। সারাক্ষণ হয় টিভি দেখে নয়তো বাচ্চাদের পত্রিকা হাতে বসে থাকে। সে যেন নিজের একটা আলাদা পৃথিবী বানিয়ে ফেলেছে, সেখানে কারওর অবাধ প্রবেশ নিষেধ। দেবেশ আপ্রাণ চেষ্টা করে ছেলেকে খুশি করার, যার জন্যই ছেলের পছন্দের এটা-ওটা-সেটা নিয়ে আসে। সন্ধেবেলা অফিস থেকে ফিরে ছেলের হোমওয়ার্ক করানো, তাকে খাওয়ানো, খেলা করা সবশেষে ঘুম পাড়ানো, সমস্তটাই নিজে হাতে করার চেষ্টা করত দেবেশ। কিন্তু তবু কোথাও যেন একটা ফাঁক থেকেই যেত। রাত দশটার পরে কখনও বা তারও পরে কিটি পার্টি সেরে ফিরত কাবেরী। তখন তার এমন হুঁশ থাকত না যে একমাত্র ছেলের ঘরে গিয়ে তার সাথে দুটো কথা বলে বা মমত্ব উজাড় করে দেয়। কখনও তো ঠিক করে এটা জানার চেষ্টা করেনি যে, তার নাড়ি ছেঁড়া সন্তান কীভাবে বড়ো হচ্ছে, তার কোনও অসুবিধা হচ্ছে কিনা, মায়ের জন্য তার মন কাঁদে কিনা। কোনওদিন কাছে ডেকে সুখ-দুঃখের কথাও যেমন বলেনি তেমনি আদর করে ছেলের পাশে বসে তাকে খাওয়ায়ওনি। মা-ছেলের মধ্যে সেই বন্ডিং-টাই কোনওদিন তৈরি হয়নি। হওয়ার কথাও নয়। বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে ঘুরতে গিয়ে মল থেকে চারটে দামিদামি জামাকাপড় এনে দিয়েই কর্তব্য শেষ হয়ে যায় না, কাজেই দূরত্ব তৈরি হওয়াটাও অস্বাভাবিক নয়।

বছরের পর বছর চলে যায়। কিন্তু কাবেরীর মধ্যে কোনও পরিবর্তন আসে না। ঋকও এখন বছর সতেরোর। বারো ক্লাসের ছাত্র। তারও লাইফস্টাইলে আমূল পরিবর্তন ঘটেছে। সে ও রাত করে বাড়ি ফিরতে শিখেছে। নজর এড়ায়নি দেবেশেরও। খেয়াল করে দেখেছে বাড়ি ফিরেই সে, সোজা নিজেকে ঘরের মধ্যে বন্দি করে নেয়। হাজার ডাকাডাকি করলেও দরজা খোলে না। বিভিন্ন রকম টালবাহানা করে এড়িয়ে যায়। কখনও বলে শরীর ভালো নয়, কখনও খেতে ইচ্ছে করছে না বলে ডিনার টেবিলে একসঙ্গে বসে রাতের খাবার খাওয়ার ব্যাপারটা কাটিয়ে দেয়। ব্যাপারটা ভাবিয়ে তোলে তাকে। মনস্থির করে, এই নিয়ে ছেলের সাথে কথা বলবে।

সেইমতো পরদিন সকালবেলা খাবার টেবিলে ছেলেকে পাকড়াও করে দেবেশ। ‘তুই রোজ রোজ দেরি করে বাড়ি ফিরছিস। অর্ধেক দিন বাড়িতে খাচ্ছিস না। ব্যাপারটা কী বলতো? অত রাত পর্যন্ত থাকিস কোথায়? পড়াশোনাটাই বা কেমন চলছে সেটাও তো বুঝতে পারছি না। সামনের বছর বোর্ড দিবি, মাথায় আছে সেটা?’

‘আমাকে নিয়ে একদম চিন্তা কোরো না। স্কুলের পর পাপানদের বাড়িতে আমরা সবাই একসাথে পড়াশোনা করি। সেইজন্যই ফিরতে দেরি হয়।’

‘পাপান-টা কে? এর নাম তো আগে কখনও শুনিনি। থাকে কোথায়?’

‘তুমি কী সবাইকে চেনো নাকি। ও বাপ্পাদের বাড়ির কাছে থাকে।’

ঋকের কথা পুরোপুরি বিশ্বাস না করলেও আর কথা বাড়ায় না দেবেশ। কিন্তু ছেলের গতিবিধির ওপর নজর রাখতে শুরু করে। কয়েকদিনের মধ্যে দেবেশ বুঝে গিয়েছিল ছেলে কোনও অসৎ সঙ্গের পাল্লায় পড়েছে। মাঝে দু-দিন তো ঠিকভাবে হেঁটে চলে বাড়ি ফিরতে পারেনি। কোনও রকমে এদিক-ওদিক করতে করতে সোজা নিজের ঘরে। দেবেশের বারবার ডাকা সত্ত্বেও উত্তর করেনি ঋক। পরদিন সকাল পার হয়ে দুপুর গড়াতে তবে তার ঘুম ভেঙেছে।

চিন্তায় দেবেশের ঘুম উড়ে গিয়েছিল। একমাত্র ছেলে। এইভাবে চলতে থাকলে কেরিয়ার, ভবিষ্যৎ সব শেষ হয়ে যাবে। একেবারে অন্ধকারের মধ্যে ডুবে যাবে ছেলেটা। এই প্রসঙ্গে কাবেরীর সঙ্গেও কথা বলেছে দেবেশ। হালকা হওয়ার বদলে আশ্চর্যই হয়েছে। ‘এখন এনজয় করবে না তো কবে করবে, এই তো বয়স। তাছাড়া রোজ তো আর এমনটা করছে না। মাঝেমধ্যে এক-আধটা দিন হতেই পারে। এগুলো ধরলে কী চলে। খেলনা নিয়ে খেলার বয়স তো আর নেই। কাজেই এই বয়সে একটু অন্যরকম কিছু করার ইচ্ছে জাগবে সেটাই স্বাভাবিক। এই নিয়ে অযথা টেনশন নিও না।’

সত্যিই একেবারে অন্যরকম কিছুই করে দেখাল ঋক। দেবেশ তো দূর, কাবেরীও বোধহয় এরকমটা কখনও কল্পনা করেনি।

কোনওরকমে এইচএস পাশ করেছে ঋক, কিন্তু নাম্বার এতটাই কম পেয়েছে যে ভালো কোনও কলেজে ভর্তি করানোটাই বড়োরকমের সমস্যা হয়ে দাঁড়াল। এখন তো বাচ্চারা কম্পিটিশনের কারণে বিভিন্ন কোচিং ক্লাস নিয়ে আটানব্বই শতাংশ পর্যন্ত মার্কস তুলছে। নব্বই শতাংশ পেয়েও ভালো কলেজে অ্যাডমিশন পেতে রীতিমতো হিমশিম খেতে হচ্ছে তাদের। সেখানে ঋকের নম্বর তো একেবারে চল্লিশ

শতাংশের কোটায়। দেবেশ নিজের সোর্স লাগিয়ে কোনওমতে একটা কলেজে অ্যাডমিশনের ব্যবস্থা করিয়েছিল ঠিকই, কিন্তু ভর্তি করলেই তো হবে না, পড়াশোনাটাও তো জরুরি। জোর করে তো কারওর উপর কোনও কিছু চাপিয়ে দেওয়া সম্ভব নয়। ছেলে বড়ো হয়ে গেলে তার গায়ে হাত তোলাও সম্ভব নয়। তাতে হিতে বিপরীত হতে পারে। কত বুঝিয়েছে। ততদিনে ড্রাগস, মদে নিজেকে ডুবিয়ে ফেলেছে ঋক।

বাবা-মা যতরকম ভাবে ছেলেকে শোধরানোর চেষ্টা করে দেবেশ, কাবেরীও ঠিক ততটাই করেছিল। ঋক-এর নেশায় আসক্ত হওয়ার পর থেকে কাবেরীর মধ্যে অনেক চেঞ্জ এসেছে। এখন ক্লাব, পার্টির নামও মুখে আনে না। কোথাও একটা অপরাধবোধ কাজ করতে থাকে তার মধ্যে। মুখে না বললেও মনে মনে নিজেকে দূষতে থাকে সে। ভাবে সে যদি সোশ্যালাইজ না করে আর পাঁচটা মায়ের মতো আদর-স্নেহে লালনপালন করত ছেলেকে, সবসময় তার পাশেপাশে থাকত– তাহলে বোধহয় ছেলেটা এভাবে নষ্ট হয়ে যেত না।

একাধিক ডাক্তারের পরামর্শ নিয়েছে। এমনকী প্রয়োজনে রি-হ্যাব সেন্টারের কথাও ভেবেছে তারা। এতে ফল আরও উলটোই হয়েছে। রি-হ্যাবের নাম শুনে বাড়ি ফেরা বন্ধ করে দিয়েছে ঋক। রাতের পর রাত বন্ধুদের সঙ্গে তাদের ভাড়া করা বাসায় পড়ে থেকেছে। তারাও ঋকের মতো ড্রাগ অ্যাডিকটেড। পড়াশোনার নামে বাড়ির থেকে দূরে থাকে। আর এই সমস্ত করে বেড়ায়। অথচ বাবা-মায়েরা এই ভেবে বুকের উপর পাথর চেপে রাখে যে, তাদের বাচ্চারা পড়াশোনা করে নিজেদের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল করছে।

দেবেশের হাতে আর কিছুই ছিল না। কাবেরীর অবস্থা তো আরও করুণ। আপশোশ করা ছাড়া আর কোনও পথ দেখছিল না সেও। কতদিন এমন হয়েছে ছেলেকে খুঁজতে, এই ক্লাব, সেই ক্লাব, এই বন্ধুর বাড়ি, সেই বন্ধুর বাড়ি করে বেড়িয়েছে। কখনও ছেলেকে বেহুঁশ অবস্থায় নিয়ে ফিরেছে। আবার কখনও নিরাশ হয়ে ফিরেছে খালি হাতে। এমনও দিন গেছে খাটের মধ্যে বেহুঁশ ছেলেকে পড়ে থাকতে দেখে, ঘরের কোণায় বসে রাতের পর রাত কাটিয়েছে দুজনে। চোখের জল ফেলেছে। ঋকের এই বিপথে যাওয়ার আসল কারণটা কী, সেটা বিলক্ষণ জানত দেবেশ। সেই নিয়ে যে ক্ষোভও রয়েছে যথেষ্ট। কিন্তু এখন আর সেই বিতর্কেও গিয়ে লাভ নেই। কোনও কিছুই আর কাজে আসবে না।

শেষমেশ ঠিক হল ঋককে জোর করেই রি-হ্যাব-এ পাঠানো হবে। সেইমতো সমস্ত কথাবার্তা পাকা করা হল। এর মাঝেই ঘটল এক বিপত্তি। হঠাৎ একদিন একটা নিউজ চ্যানেলে বারবার ঋকের সঙ্গে তার কয়েকজন বন্ধুকে আপত্তিকর অবস্থায় একটা ঘরে পড়ে থাকতে দেখাল। বেশ কয়েকজন একেবারে বিবস্ত্র। খবর করা হচ্ছে, শহরের স্বচ্ছল পরিবারের বেশ কয়েকটি বখে যাওয়া ড্রাগ অ্যাডিকটেড সমকামী ছেলেদের কুকীর্তি নিয়ে। একের পর এক ফোন। হাজারো প্রশ্ন। কী জবাব দেবে দেবেশ। লজ্জায় মাথা কাটা যাবার উপক্রম হয়েছিল তাদের। কী করবে সে। ড্রাগ, মদের নেশা না হয় ছাড়াতে পারবে। কিন্তু তাই বলে সমকামীতা! এটা একজন বাবা-মায়ের কাছে মারাত্মক লজ্জার। এর আগেও নেশার কারণে ঋক যখন মায়ের বালা চুরি করে বিক্রি করে দিয়েছিল, তখনও বোধহয় এতটা শক্ড হয়নি তারা, যতটা এখন। পরিস্থিতি যে কখন কাকে কোথায় নিয়ে ফেলে। তবু ছেলে তো। হাল তো ছেড়ে দেওয়া যায় না। ঘটনাস্থল থেকেই পুলিশ তুলে নিয়ে গিয়েছিল ঋকদের। সেখান থেকে ছাড়িয়ে এনে সোজা রি-হ্যাব। তারপর দীর্ঘদিন কাউন্সেলিং।

মাস ছয়েক পরে ঋক যখন বাড়ি ফিরে আসে, তখন একেবারে স্বাভাবিক। দেবেশ – কাবেরী কল্পনাই করতে পারেনি যে ঋক আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারবে। টাইমে খাওয়াদাওয়া, পড়াশোনা, বেড়ানো। ছেলেকে নিয়ে বেশ ভালোই ছিল তারা। মাস দেড়েক এভাবেই কেটে গেল।

একদিন সকালে সকলে মিলে ব্রেকফাস্ট করতে বসেছে, ঠিক সেই সময়ে ঋকের ফোনটা বেজে উঠল। সেই দিন বিকেলে ‘ঘন্টাখানেকের মধ্যে ফিরে আসব’ বলে সেই যে বাড়ির বাইরে বেরোল আর বাড়িমুখো হয়নি ছেলেটা। বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়পরিজন, ক্লাব– কোনও হদিশ মেলেনি তার। নিরুপায় হয়ে থানায় গিয়ে মিসিং ডায়েরি করে এসেছিল দেবেশ। তারপর কেটে গেছে আরও তিনটে মাস। নিরন্তর মনের সাথে যুদ্ধ করতে করতে এখন খানিকটা ধাতস্থ হয়ে গেছে তারা।

প্রথমদিকে তো পুলিশ সেভাবে গুরুত্ব দেয়নি। তারা ভেবেছিল ছোটো ছেলে রাগ করে বাড়ি থেকে পালিয়ে গেছে। টাকা-পয়সা ফুরিয়ে গেলেই আবার বাড়ি ফিরে আসবে। কিন্তু ঋক-এর পাস্ট লাইফের ঘটনা শুনে দেবেশের সঙ্গে সঙ্গে তাদেরও মনে হয়েছে এটা নিছক কোনও সাধারণ ঘটনা হতে পারে না, অন্য রহস্যের গন্ধ পায় তারাও। সেইমতো তারা তদন্ত করতে থাকে। ঋক-এর সমস্ত বন্ধুবান্ধবদের থানায় ডেকে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।

তারপর থেকে দেবেশ রোজই একবার করে থানায় গিয়ে খোঁজখবর নিয়ে আসে। বড়োবাবু অসীম জোয়ারদার কতবার বলেছেন এভাবে রোজ-রোজ থানায় না যেতে। কোনও খবর হলে উনি নিজেই ফোন করে ডেকে নেবেন। কিন্তু একজন বাবার মন কী আর সে-সব মানে। আশায় বুক বেঁধে রোজই ছুটে যায়।

আর আজ তো একেবারে ছেলের মৃত্যুর সম্ভাবনা প্রায় নিশ্চিত করে দিলেন জোয়ারদার সাহেব। ঋকের বন্ধুদের কথা অনুযায়ী দুর্ঘটনাস্থল থেকে পুলিশ কিছু অস্থি পেয়েছে। যেহেতু ঋকের বডি পাওয়া যায়নি, সেই কারণেই ডিএনএ টেস্ট জরুরি হয়ে পড়েছে। তাই তাকে আর কাবেরীকে থানায় যেতে হবে, সেখান থেকে হাসপাতালে। পুরোনো স্মৃতি রোমন্থন করতে করতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছে দেবেশ। ঘুম ভাঙে সকালবেলা বংশী দুধওয়ালার বেলের আওয়াজে। কথামতো সকাল সকাল থানার উদ্দেশে বেরিয়ে পড়ে দেবেশ আর কাবেরী।

এর প্রায় একমাস পরে বেলা এগারোটা নাগাদ থানা থেকে বড়োবাবুর ফোন আসে। দেবেশ তখন অফিসের ফাইলে মুখ গুঁজে আছে। ‘ডিএনএ টেস্ট-এর রিপোর্টটা চলে এসেছে। একবার থানায় চলে আসুন।’

‘রিপোর্টে কী আছে?’ উদ্বেগজনক ভাবে প্রশ্ন করে দেবেশ।

‘আপনি থানায় এলে তো সবই জানতে পারবেন।’ বেশ গম্ভীর শোনায় জোয়ারদারের গলা।

জোয়ারদারের ফোন পাওয়ামাত্রই ফাইল-টাইল ভুলে বাড়ির পথে রওনা দিয়েছিল দেবেশ। অফিস থেকে বেরোনোর আগেই কাবেরীকে সমস্তটা জানিয়ে রেডি হয়ে থাকতে বলেছিল সে। সেই মতো দুজনে হাজির হয়েছিল থানায়। কাবেরীর মধ্যে একটা অস্বস্তির ছাপ দেখা গেলেও আজ দেবেশ অনেক স্থিতধী। যেন সবকিছুর জন্যই সে প্রস্তুত।

থানার আর এক ইন্সপেক্টর দেবেশকে সঙ্গে করে নিয়ে যায়। আর কাবেরীকে সেইখানেই অপেক্ষা করতে বলে। দেবেশকে ভিতরের একটি ঘরে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে বড়োবাবু অসীম জোয়ারদারও উপস্থিত রয়েছেন। একটু অবাক হয় দেবেশ। তারপর ধীর কণ্ঠে বড়োবাবুকে জিজ্ঞেস করে, ‘তাহলে কী…?’ বলেই ধপ করে বসে পড়ে চেয়ারে।

দেবেশবাবুর মনের অবস্থা আঁচ করতে পারেন অসীম জোয়ারদার। তারপর বলতে শুরু করেন, ‘দেখুন দেবেশবাবু, আমাদেরও বলতে খারাপ লাগছে, কিন্তু সত্যিটা তো সামনে আনতেই হবে। ব্যাপারটা সত্যিই খুব সিরিয়াস, তাই আপনাকে জানানোটা জরুরি। ডিএনএ টেস্ট-এর রিপোর্ট অনুযায়ী যে ব্যক্তির অস্থি পেয়েছিলাম, সেটা ঋকেরই।’

ক্ষণিকের একটা ঝটকা লাগলেও, বুকের উপর পাথর রেখে প্রশ্ন করেছিল বড়োবাবুকে, ‘কিন্তু ওর হত্যার পিছনে কোনও সঠিক কারণ তো থাকবে। সেগুলো আমি জানতে চাই অসীমবাবু। কেন এত

নৃশংসভাবে মারা হল আমার ওই একরত্তি ছেলেটাকে?’

‘আপনি তো জানতেন-ই যে আপনার ছেলে, আর-পাঁচটা ছেলের মতো স্বাভাবিক নয়। একাধিক ছেলের সঙ্গে তার সমকামী সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। যাই হোক, যে ছেলেগুলো ধরা পড়েছে এরা তাদেরই একটা গ্রুপ। একটা সময় ঋকের এদের সঙ্গেই সম্পর্ক ছিল। সারাদিন হেরোইনের নেশায় বুঁদ হয়ে থাকত ছেলেগুলো। ওদেরই মধ্যে ম্যাক বলে একটি ছেলে, শহরের নামি উকিল অভিষেক জালানের একমাত্র বখাটে ছেলে। সে নিজেও নেশায় বুঁদ হয়ে থাকে আর অন্যদের নেশা করার জন্য টাকা ধার দেয়। নতুন নতুন পার্টনারের ব্যাপারেও তার প্রবল আগ্রহ। ঋক-কে খুব মনে ধরেছিল তার। তাই কখনও টাকা চাইত না ঋকের কাছ থেকে। রি-হ্যাব থেকে ফেরার পর ঋকের নেশা ছেড়ে দেওয়া, তার সঙ্গ ছেড়ে দেওয়াটা মেনে নিতে পারেনি সে। রি-হ্যাব থেকে ফেরার পর ঋককে বারবার ফোন করেছে তার কাছে ফিরে যাওয়ার জন্য। ঋক রাজি না হওয়াতেই এই বিপত্তি। সে শর্ত দিয়েছিল, হয় তাকে টাকা ফেরত দিতে হবে, নয়তো আগের মতো সঙ্গ দিতে হবে। টাকা ফেরতের ব্যাপারটা তো অজুহাত মাত্র, তার উদ্দেশ্যই ছিল ঋককে পাওয়া। কল লিস্ট দেখে আমরা জানতে পেরেছি, সেদিনের ওই ফোনটা ম্যাক-এরই ছিল। সে-ই ডেকেছিল তাকে। টাকাপয়সা নিয়ে ব্ল্যাকমেল করতে শুরু করেছিল ঋক-কে। একপ্রকার বাধ্য হয়েই ঋক সেদিন জানাতে গিয়েছিল, টাকা সে ধীরে ধীরে শোধ করে দেবে। ঋক-কে না পেয়ে সেদিন জোশের মাথায় গুলি চালিয়ে দিয়েছিল ছেলেটি। তারপর বাকি বন্ধুদের সহায়তায় লাশ গায়েব করে দিয়েছিল।’ অসীমবাবুর কথাগুলো শেলের মতো বুকে এসে বিঁধছিল দেবেশের। চোখ দিয়ে টপটপ করে জল পড়ে জামার উপরের দিকে বেশ খানিকটা অংশ ভিজে গিয়েছে। সহানুভূতি দেখাতে, অসীমবাবু দেবেশের কাঁধে হাত রাখেন। দেবেশের দিকে একগ্লাস জল এগিয়ে দিয়ে আবার বলতে শুরু করেন, ‘দেবেশবাবু আর একটা কথা জানানোর ছিল। জানি না, কথাটা বলার এটাই উপযুক্ত সময় কিনা, তবুও ডিউটির খাতিরে আমাকে বলতেই হবে। নয়তো আদালতে জেরার সময়ে আপনি জানতেই পারবেন।’

নিজেকে খানিক শক্ত করার চেষ্টা করে দেবেশ। ‘কী ব্যাপার বলুন না। এই কষ্টটা যখন সহ্য করতে পেরেছি, তখন আর কোনও কিছুই আমাকে ছুঁতে পারবে না। আপনি বলুন।’

‘দেবেশবাবু, ঋক কাবেরীদেবীর ছেলে এটা যেমন সত্যি, তেমনি রিপোর্ট অনুযায়ী এটাও সামনে এসেছে যে, ঋক আপনার ঔরসজাত সন্তান নয়।’

একমুহূর্তেই চোখের সামনে অন্ধকার নেমে আসে দেবেশের। মাথাটা ঘুরে যায় তার। যেন কেউ সপাটে তার গালে একটা চড় কষিষে দিয়েছে।

কিছুক্ষণ ওইভাবেই ঘোরের মধ্যে বসে থাকে দেবেশ। ইন্সপেক্টরও তার মনের কথা বুঝে চুপ করে যান।

খানিক পরে কাবেরীর চিৎকারে সম্বিৎ ফেরে দেবেশের। ‘আমাকে কেন ভিতরে যেতে দেওয়া হচ্ছে না।’

কী যেন ভাবে দেবেশ। তারপর হাতজোড় করে বড়োবাবু অসীম জোয়ারদারকে বলে, ‘অসীমবাবু, যা হওয়ার হয়ে গেছে। আমাদের ঋক আর কোনওদিন আমাদের কাছে ফিরে আসবে না। কিন্তু আপনার কাছে আমার রিকোয়েস্ট, আমি এতদিন যে-মিথ্যেটাকে সত্যি ভেবে বেঁচে এসেছি, বাকি জীবনটাও সেটা নিয়েই কাটাতে চাই। এটা আমার আর কাবেরীর দাম্পত্যের জন্যও জরুরি।’

‘ঠিক বুঝলাম না দেবেশবাবু।’

‘প্লিজ অসীমবাবু, আপনি আমার স্ত্রীকে এটা কখনওই জানতে দেবেন না যে আমি জেনে গেছি যে ঋক আমার আপন সন্তান নয়।’

কী যেন ভেবে মাথা চুলকে নেন অসীম জেয়ারদার। দেবেশকে আশ্বস্ত করে বলেন, ‘ঠিক আছে। কথা দিচ্ছি, আমি আমার সাধ্যমতো চেষ্টা করব। চেষ্টা করব আপনার স্ত্রীকে সাক্ষী না বানাবার।’

‘অশেষ ধন্যবাদ অসীমবাবু। আপনার ঋণ আমি কোনওদিনও শোধ করতে পারব না।’ কৃতজ্ঞতা জানাতে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা বড়োবাবুর হাতদুটো চেপে ধরে দেবেশ।

কিছুক্ষণ পর একেবারে বিধবস্ত অবস্থায় থানা থেকে কাবেরীকে নিয়ে বের হয় দেবেশ। কাবেরী পাগলের মতো করতে থাকে। বারবার জিজ্ঞাসা করতে থাকে, ‘কী হল? বড়োবাবু কী বলছেন? ডিএনএ রিপোর্ট-এ কী এল। ওটাই আমাদের ঋক?’

গাড়িতে উঠে কাবেরীর মাথা নিজের কাঁধের উপর টেনে নেয় দেবেশ। তারপর খুব ধীর কণ্ঠে বলে, ‘কাবেরী নিজের মনকে শক্ত করো। যা হওয়ার হয়ে গেছে। তোমার ঋক যে পথে এগিয়ে গিয়েছিল তাতে ভগবান বোধহয় এটাই সঠিক মনে করেছেন।’

হাউহাউ করে কেঁদে ফেলে কাবেরী। বাধা দেয় না দেবেশ। শুধু শক্ত করে ধরে রাখে তাকে।

 

শেষবারের মতো

সকাল সকাল উঠে পড়া গীতার বরাবরের অভ্যাস। আজকের দিনটাও তার ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু ঘুম ভাঙার পরেও বিছানা ছাড়তে আজকে কিছুতেই ইচ্ছে করছে না গীতার। কীরকম যেন আলসেমি লাগছে। এপাশ ওপাশ করতে করতে অজয়ের দিকে পাশ ফিরল।

অঘোরে ঘুমোচ্ছে অজয়। গীতার স্বামী। অজয়ের উপর চোখ পড়তেই গীতার মনটা আশ্চর্য রকমের দ্রব হয়ে উঠল।

অজয়ের কপালে তপ্ত ঠোঁটের চুম্বন এঁকে দিয়ে বিছানা থেকে নামবার জন্য পা বাড়াতেই অজয়ের বলিষ্ঠ বাহু এক ঝটকায় গীতাকে নিজের শরীরের উপরে এনে ফেলল। অজয়ের শরীরের উষ্ণতা গীতার স্বাভাবিক বোধবুদ্ধিকে গ্রাস করে নেওয়ার উপক্রম করল। তাও নিজেকে সংযত করার চেষ্টা করল গীতা। অজয়ের বলিষ্ঠ বাহুর বন্ধন থেকে গীতা নিজেকে আপ্রাণ ছাড়াবার চেষ্টা চালাতে চালাতে কপট রাগ দেখাল।

‘আঃ কী করছ কী? সকাল হয়ে গেছে খেয়াল নেই?’

‘তো কী হয়েছে? আমি নিজের বউয়ের সঙ্গে প্রেম করছি সেটাও দোষের?’ অজয়ের চোখে দুষ্টুমির হাসি চিকচিক করে ওঠে।

‘না, ছাড়ো আমাকে। আজকে থেকে আমাকে মর্নিং ওয়াকে যেতেই হবে। বুঝতে পারছি অসম্ভব ওয়েট পুট অন করছি।’

‘তাই জন্যই তো তোমার শরীরের এ টু জেড আমাকে মেপে রাখতে হবে নয়তো বুঝব কী করে যে সত্যি সত্যি হাঁটতে যাচ্ছ নাকি বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা মেরে বাড়ি ফিরে চলে আসছ।’

‘তাহলে সঙ্গে যাচ্ছ না কেন আমার উপর নজর রাখতে?’

‘এক বছর আগে যখন এই বাড়িতে তুমি নতুন বউ হয়ে এসেছিলে, তখনই কোনওদিন তোমাকে সন্দেহ করিনি তাহলে আজকে নতুন করে কেন শুরু করব?’

‘হ্যাপি ম্যারেজ অ্যানিভার্সারি’, গীতা নিজের আনন্দ চেপে রাখতে না পেরে অজয়ের বুকে মুখ লুকোয়।

‘গীতা, আমি প্রমিস করছি আমাদের বিবাহিত জীবনের সুখ, আনন্দ আমি কোনওদিন এতটুকুও ফিকে হয়ে যেতে দেব না। সারাজীবন আমি তোমাকে সুখে রাখবার চেষ্টা করে যাব।’

আনন্দে গীতার চোখে জল চলে আসে। পাছে অজয় এই আনন্দাশ্রু দেখে ফেলে, লজ্জায় গীতা অজয়ের বুকে মুখ গুঁজে রাখে।

গীতা হাতের ঘড়ির দিকে তাকায়। একঘণ্টা কেটে গেছে। ঘামে শরীর চপচপ করছে। বাড়ি থেকে যখন বেরিয়েছিল তখন আকাশ সবে ফরসা হতে শুরু করেছে। এখন ভালো রোদ উঠে গেছে। গীতা বাড়ির দিকে পা বাড়ায়।

বাড়ি পেৌঁছোতেই অজয় লেবু মধুর জল এগিয়ে দেয় গীতার দিকে। অজয়ের এই ছোটো ছোটো জিনিসের খেয়াল রাখার স্বভাবটা গীতার বড়ো ভালো লাগে। গীতা চেয়ারে বসে লেবু মধুর জলের গেলাসে ঠোঁট লাগায়।

অজয় চোখ দিয়ে গীতাকে খানিকটা মেপে নেয়, ‘বাঃ, একদিনেই তো তোমাকে বেশ খানিকটা রোগা লাগছে।’

‘মিথ্যা কথা বোলো না তো। একদিনে কেউ আবার রোগা হয় নাকি?’

‘কথাটা আজকে তোমার মিথ্যা মনে হলেও, এক মাস বাদে কিন্তু আমার কথা যে সত্যি হবেই এটা আমি এখনই বুঝতে পারছি।’

‘না গো, তোমার চোখে নিজেকে সুন্দর রাখার জন্য তো বটেই, নিজের শরীর স্বাস্থ্যের কথা ভেবেও আমাকে যেমন করে হোক রোগা হতেই হবে।’

‘গুড। আচ্ছা এখন বলুন তো ম্যাডাম, তৈরি হয়ে বেরোতে আপনার কতটা সময় লাগবে?’

‘তার মানে তুমি বলতে চাও, আজকের এই বিশেষ দিনে আমার সাজতে-গুজতে কতটা সময় লাগবে?’

‘ঠিক ধরেছ, বিশেষ দিনের বিশেষ সাজ তো।’

‘তুমি সবসময় অভিযোগ করো সাজতে আমি একটু বেশি সময় নিই। দেখো আজ তুমি অভিযোগ করার সুযোগই পাবে না।’

তৈরি হয়ে দুজনে দোতলা থেকে একতলায় নেমে আসে। সত্যি ওদের দুজনের দিক থেকে চোখ ঘোরানো যাচ্ছিল না। ভগবান যেন দুজনকে বানিয়েছেন একে অপরের জন্যে। একতলায় গীতার শ্বশুর শাশুড়ি, ভাসুর-জা আর এক ননদ থাকে।

প্রথমেই গীতার জা অলকা দুজনকে ‘হ্যাপি ম্যারেজ অ্যানিভার্সারি’ উইশ করে। গীতা নিজের পার্স থেকে জা-য়ের পছন্দের একটা চকোলেট বার করে ওর হাতে ধরিয়ে দেয়।

কয়েক সপ্তাহ ধরেই গীতার ননদ শিখা ওদের সঙ্গে কথাবার্তা বলছিল না। সামান্য কারণে ও, অজয় আর গীতার উপর রেগেছিল। কারণ কী ঘটেছিল গীতার জানা নেই কিন্তু এক-দুবার চেষ্টা করেছিল দিদির রাগ ভাঙানোর, কিন্তু শিখা যেন প্রতিজ্ঞা করে নিয়েছিল কথা না বলার।

আজ যখন ওরা দুজন একসাথে বসার ঘরে এসে ঢুকল দেখল শিখা সোফায় বসে টিভি-তে খবর দেখছে। ওদেরকে দেখে শিখা সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে দরজার দিকে পা বাড়াতেই, গীতা এসে শিখার পথ আগলে দাঁড়াল।

ঘটনার আকস্মিকতায় শিখা খানিকটা হকচকিয়ে গিয়েছিল। গীতার দিকে দৃষ্টি দিতেই গীতা বলল, ‘দিদি, তুমি আজ আমাদের আশীর্বাদ করবে না? আজ আমাদের বিয়ের একবছর পূর্ণ হল।’ এই বলে গীতা শিখার পা ছুঁয়ে প্রণাম করল। অজয়ও এগিয়ে এসে দিদির পা ছুঁয়ে প্রণাম করল।

গীতা দিদির হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলল, ‘দিদি, আমরা যা অন্যায় করেছি সেটা ভুলে গিয়ে আমাদের ক্ষমা করে দাও প্লিজ। আজকের দিনে মুখ ঘুরিয়ে থেকো না।’ হঠাৎ-ই কান্নায় গলা রুদ্ধ হয়ে আসার ফলে গীতার গলা দিয়ে আর একটা শব্দও বেরোয় না।

গীতার হঠাৎ করে ক্ষমা চাওয়ায় দুজনের মধ্যে গড়ে ওঠা দেয়ালটা এক ঝটকায় ভেঙে যায়। শিখা একটা কথাও মুখ ফুটে বলতে পারে না। শুধু নিজের ভাইয়ের বউকে দুই হাত বাড়িয়ে কাছে টেনে নেয়। দুজনের মনের যত অভিমান সব চোখের জলে ধুয়ে মুছে পরিষ্কার হয়ে যায়। শিখা দুজনকে বিবাহবার্ষিকীর শুভেচ্ছা জানিয়ে বাথরুমের দিকে পা বাড়ায়।

শিখা বেরিয়ে যেতেই অজয়ের মা-বাবা ঘরে এসে ঢোকেন। গীতার কান্নাভেজা চোখ দেখে ভুল ধারণা করে বসেন। অজয়ের মা নির্মলা বউমার দিকে তীক্ষ্ন দৃষ্টি নিক্ষেপ করেন, ‘কী বউমা, আজকের দিনেও তোমরা ঝগড়াঝাঁটি করছ? একটা দিন তো অন্তত আমার ছেলেটাকে শান্তিতে থাকতে দাও। কী পাও বলো তো এইসব করে?’

গীতার চোখে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ মুহূর্তের জন্য দেখা দিয়ে আবার মিলিয়ে যায়। অজয়ের মুখে হাসি দেখে নিজেকে সামলে নেয় গীতা।

‘আমাদের মধ্যে তো কোনও ঝগড়া হয়নি, মা। তুমি ভুল বুঝেছ,’ অজয় ঝুঁকে মা আর বাবার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে।

অজয়ের দেখাদেখি গীতাও শ্বশুর-শাশুড়িকে প্রণাম করে। ওর শ্বশুরমশাই প্রকাশবাবু চুপ করে থাকেন। শাশুড়ি নির্মলা আশীর্বাদ করেন ঠিকই কিন্তু মেশিনের মতো হাতটা বাড়িয়ে শুধু গীতার মাথাটা একবার ছুঁয়ে নেন। এর পরেও উনি নিজের বিরক্তি চাপতে পারেন না, ‘আজ সকাল সকাল দুজনে সেজেগুজে কোথায় চললে? একটা দিনও কি বাড়িতে থাকা যায় না? তোমাদের জন্য লুচি, তরকারি আর পায়েসের ব্যবস্থা করছিলাম। এখন ওগুলো কে খাবে বলো তো?’ নির্মলার প্রশ্নবান যে গীতাকে উদ্দেশ্য করেই নিক্ষেপ করা সেটা কারও বুঝতে অসুবিধা হয় না।

‘আঃ নির্মলা, বলতে শুরু করলে তুমি যে আর থামতেই চাও না। কী হবে এসব বলে? এরপর দেখবে বউমা রাগ করে দুই-তিন মাসের জন্য বাপের বাড়ি চলে গেছে।’ প্রকাশবাবুর কথার তীর্যক ভঙ্গী গীতাকে আঘাত করে।

অজয়ের মৃদ্যু হাতের স্পর্শ নিজের কাঁধে অনুভব করে গীতা মনে খানিকটা বল পায়। ধীর মৃদু স্বরে উত্তর করে, ‘না বাবা, ভবিষ্যতে এরকম ভুল আর কখনও করব না।’

‘আমিও আজ একটা প্রতিজ্ঞা করেছি বাবা।’ অজয়ের গলা শুনে সকলের চোখ গিয়ে পড়ে অজয়ের উপর।

প্রকাশবাবু জিজ্ঞেস করেন, ‘কী প্রতিজ্ঞা করেছ তুমি?

‘এই যে তুমি সবসময় আমাদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে বলো, আমি আর গীতা ঠিক করেছি সিরিয়াসলি ব্যাপারটা নিয়ে নিজেদের মুড আর খারাপ করব না।’

‘অজয়, এই বাড়িতে থাকতে হলে এখানকার নিয়মকানুন তো তোমাকে মেনে চলতেই হবে।’

‘বাবা প্লিজ, আজকের দিনে এইসব কথা কি তোমার না বললেই নয়? আজ এসব ভালো লাগছে না,’ এই বলে অজয় বাবাকে জড়িয়ে ধরে। ‘আজ আমরা ঠিক করেছি বাইরে কোথাও ঘুরেফিরে একটা ফিল্ম দেখব, তারপর বাইরেই কোথাও খেয়ে নেব। সন্ধেবেলায় সিদ্ধার্থর ওখানে পার্টি রয়েছে। বন্ধুরা সবাই মিলে আমাদের পার্টি দিচ্ছে। ওরা তোমাদেরও নেমন্তন্ন করতে আসবে। প্লিজ তোমরা ঠিক সময় পেৌঁছে যেও আর আমাদের গিফট্-টা আনতে ভুলো না কিন্তু।’

এইবলে অজয় গীতার হাতটা চেপে ধরে সদর দরজার দিকে পা বাড়ায়।

‘সকাল সকাল ছেলেটা কোনও নেশা-টেশা করেছে নাকি? দেখলে ছেলের ব্যবহারটা?’ নির্মলার কথার মধ্যেই ফুটে উঠল অজয়ের প্রতি বিরিক্তির মনোভাব।

পনেরো কুড়ি মিনিট বাদে অজয়ের মোটরবাইকটা যেখানে এসে দাঁড়াল সেটা একটা দশতলা ফ্ল্যাটবাড়ি। অজয়ের সঙ্গে গীতাও বাইক থেকে নেমে লিফটের দিকে এগোল। ‘তুমি দশ মিনিট বাদে উপরে এসো। আমি আগে গিয়ে পরিস্থিতিটা সামলাই নয়তো শুধুশুধু তোমাকে আবার অপমানিত হতে হবে,’ এই বলে গীতার গালে একটা আলতো টোকা মেরে অজয় লিফটের ভিতরে ঢুকে গেল।

আটতলায় উঠে যে-ফ্ল্যাটটার সামনে গিয়ে অজয় কলিংবেল বাজাল, তার দরজাটা একটু পরেই খুলে সামনে এসে দাঁড়াল অর্চনা। অর্চনা অজয়ের অফিসেই কাজ করে। সকলেই জানে টানা তিনবছর অজয়ের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক ছিল অর্চনার। অনেক বছর আগেই স্বামীর সঙ্গে অর্চনার ডিভোর্স হয়ে গেছে। অজয়ের থেকে বয়সেও দুবছরের বড়ো অর্চনা।

‘আরে তুমি। আজ তোমাকে এখানে দেখব আশা করিনি। যাক তোমাকে দেখে অসম্ভব আনন্দ হচ্ছে’, এই বলে অজয়ের হাত ধরে টেনে নিয়ে গিয়ে সোফাতে বসিয়ে দিল অর্চনা।

অর্চনার হাত ছাড়িয়ে নিয়ে অজয় সোফাতে গুছিয়ে বসল, ‘কী করছিলে?’

‘এই ঘরদোর পরিষ্কার করছিলাম। কেন কোথাও বেড়াতে যাবার কথা ভাবছ? তাহলে বলো তৈরি হয়ে আসি।’

‘আগে এক কাপ কফি তো খাওয়াও, তারপর দেখছি।’ অজয়কে দেখে মনে হচ্ছিল আজ ওর কাছে অফুরন্ত সময় রয়েছে।

‘গীতা কি এখনও বাপের বাড়িতেই রয়েছে?’

‘না, গতকাল সকালেই বাড়ি ফিরে এসেছে।’

‘বাবা, শেষমেশ মাথা নীচু করতে রাজী হয়েছে?’

‘সময়, অনেক মানুষকেই বদলে দেয় অর্চনা।’

‘গীতার পক্ষে বদলানো অসম্ভব। তোমাদের দুজনের এতদিনে ডিভোর্স নিয়ে নেওয়া উচিত ছিল। না তোমরা একে অপরকে ভালোবাসো আর না তোমাদের চরিত্রগত কোনও মিল রয়েছে। স্বভাবেও তোমরা একদম আলাদা।’

‘ধরো ডিভোর্স হয়েও গেল, কিন্তু আমার একাকিত্ব কীভাবে কাটবে?’

‘কেন আমি তো আছি।’ অর্চনা সোফায় বসে অজয়ের গলাটা জড়িয়ে ধরে নিজের দিকে ওকে টানার চেষ্টা করে।

‘কিন্তু তুমি তো দ্বিতীয়বার বিয়ের রাস্তা মাড়াবে না বলে প্রতিজ্ঞা করেছ।’

‘প্রথম বিয়ের পরে যা বাজে অভিজ্ঞতা হয়েছে, এখন বিয়ের নাম শুনলেই ভয় লাগে। তাই বলে তুমি চিন্তা কোরো না। প্রেমিকার ভূমিকা যে আমি ভালো ভাবেই পালন করতে পারব সে বিশ্বাস আমার নিজের ওপর আছে। কী বলো অজয়?’

‘উত্তরটা কফি খাওয়ার পরেই দেব।’

অজয়ের গাছাড়া ভাবটা ইচ্ছে করেই উপেক্ষা করে অর্চনা রান্নাঘরের দিকে প্রস্থান করে।

কফি বানিয়ে আনতে আনতে ফ্ল্যাটের কলিংবেলটা আর একবার বেজে ওঠে। কফির কাপটা অজয়ের সামনে নামিয়ে রেখে অর্চনা সদর দরজাটা খুলে দেয়।

সামনে গীতাকে দেখেই অর্চনার মেজাজটা চড়াক করে গরম হয়ে ওঠে। কিছু বলার জন্য মুখ খোলার আগেই পিছন থেকে অজয়ের গলা ভেসে আসে, ‘ওঃ তুমি এসে গেছো। ভেতরে চলে এসো।’

অর্চনা সামান্য সরে দাঁড়িয়ে গীতাকে ফ্ল্যাটের ভিতরে ঢুকতে দেয়। ফ্ল্যাটে ঢেকার দরজাটা বন্ধ করে অর্চনা অজয়ের শরীর ঘেঁসে সোফার উপর বসে পড়ে।

‘অজয়, ওকে বলে দাও লাস্ট টাইমের মতো অশান্তি করে একটা সিন না ক্রিয়েট করে। সেদিন ওরকম চ্যাঁচামেচির পর প্রতিবেশীদের সামনে চোখ তুলে দাঁড়াতে পর্যন্ত লজ্জা করছিল।’ অর্চনার কথায় শুধু রাগ নয় একটা ভীতিও ফুটে উঠছিল।

‘আমি অশান্তি করতে এখানে আসিনি। কিন্তু সেদিনও আমার যা প্রশ্ন ছিল আজও সেই প্রশ্নই আমি তোমাকে করতে চাই। অজয় বিবাহিত জেনেও কেন তুমি ওকে পেতে চাইছ?’ গীতা নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ না হারিয়েই অর্চনাকে প্রশ্নটা করে।

‘তোমাকে তো সেদিনই অজয় এর পরিষ্কার উত্তর দিয়েছিল। আমরা দুজন পরস্পরকে ভালোবাসি। তোমাদের দুজনের সম্পর্কটা যে ক্রমশ খারাপের দিকে যাচ্ছে, তার জন্য আমি নই, তুমিই পুরোপুরি দায়ী।’

অজয় এতক্ষণ চুপচাপ ওদের কথা শুনছিল, এবার মুখ খোলে, ‘অর্চনা সত্যিটা গীতার কাছে লুকোবার চেষ্টা কোরো না। স্বীকার করো যে গত তিনবছর ধরে আমাদের মধ্যে গভীর সম্পর্ক গড়ে উঠেছে।’

অর্চনা চমকে অজয়ের দিকে তাকায়। চোখে মুখে ওর স্পষ্ট ফুটে ওঠে রাগ।

‘অর্চনা, বিবাহিত পুরুষের সঙ্গে সম্পর্ক রাখাটা অনুচিত। সমাজের নিয়মের বাইরে এটা। এছাড়াও তোমার এই জেদের জন্য আমাদেরও বিবাহিত জীবনের সুখশান্তি নষ্ট হতে বসেছে। তুমি প্লিজ অজয়ের জীবন থেকে সরে দাঁড়াও।’ গীতার ধীর কণ্ঠস্বরে শুধু অর্চনা নয়, অজয়ও বেশ আশ্চর্য হয়। ভোররাত্রে বাহুবন্ধনে আবদ্ধ গীতার সঙ্গে এখন সামনে দাঁড়িয়ে থাকা গীতার কোনও মিল খুঁজে পায় না অজয়।

‘আমাকে অজয় ভালোবাসে। ওর জীবনে আমার প্রয়োজন আছে। সেই জন্যই আজও আমাদের সম্পর্ক অটুট রয়েছে। তোমাদের অসফল বিয়ের জন্য আমাকে দোষী ঠাওর করার কোনও অর্থ হয় না।’ রুক্ষভাবে অর্চনা উত্তর করে।

‘তাহলে তো অজয়কেই ঠিক করে নিতে হবে আমাদের দু’জনের মধ্যে থেকে ও কাকে জীবনসঙ্গী হিসেবে বেছে নিতে চায়। ও যদি তোমাকে বেছে নেয়, তাহলে আমি কথা দিচ্ছি চিরজীবনের মতো তোমাদের দু’জনের জীবন থেকে আমি সরে দাঁড়াব।’

‘আগের বারও অজয় নিজের ইচ্ছে তোমাকে জানিয়ে দিয়েছিল। তুমিই জেদ করে একলাই এখান থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল। আজকের দিনটা অজয়ের আমার কাছে আসা এটাই প্রমাণ করে যে, ও আমাকে ছাড়া থাকতে পারবে না।’

‘ঠিক আছে। আমি না হয় এখনই অজয়ের কাছ থেকে জেনে নিই এখন ও কী চায়।’

‘জিজ্ঞেস করো।’

‘আর ও যদি জীবনসঙ্গী হিসেবে আমাকে বাছে তাহলে তোমাকে কথা দিতে হবে তুমি ওর জীবন থেকে সরে দাঁড়াবে।’

‘এটা কখনওই হবে না।’ আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে অর্চনা উত্তর দেয়।’

‘আর যদি এরকমই হয়, তাহলে?’

সম্মুখ সমরে আহ্বান করার গীতার এই ভঙ্গিমা অর্চনা-কে মনে মনে দুর্বল করে তোলে।

দু’জনেই অজয়ের দিকে ঘোরে। অজয়ের মুখে লেগে থাকা হাসি কাউকেই বুঝতে দেয় না কাকে ও জীবনসঙ্গী হিসেবে বেছে নিয়েছে।

খানিকক্ষণ চুপ থেকে অজয় অর্চনার পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। সঙ্গে সঙ্গে অর্চনার চোখেমুখে ফুটে ওঠে বিজয়ীর অভিব্যক্তি।

‘গতবার তোমাদের দু’জনের ঝগড়ায় আমি তোমাকে সাপোর্ট করেছিলাম কিন্তু আজ আর সেটা সম্ভব নয় অর্চনা। আমি যদি দ্বিতীয়বার আবার এই একই ভুল করি তাহলে সারা জীবনের জন্য গীতাকে হারিয়ে ফেলব। তোমার সঙ্গে আমার পথ চলা এতদূর পর্যন্তই ছিল। গীতার সঙ্গে নতুন জীবন শুরু করতে হলে তোমার থেকে তো আমাকে দূরে যেতেই হবে।’ অর্চনার হাতে সামান্য চাপ দিয়ে অজয় নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে গীতার দিকে ফেরে।

‘আমার মনে হয় তোমার জীবন থেকে অজয়ের সরে যাওয়াই ভালো। আর সেটা তোমার মঙ্গলের জন্যই। অর্চনা, অতীতের সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগ করতে না পারলে নতুনকে কীভাবে আমন্ত্রণ জানানো যাবে?  মনে রেখো, এটাই ভালো হল তোমাদের জন্য’, এই বলে গীতা অজয়ের হাত ধরে অর্চনার ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে আসে। অজয়কে আটকাবার সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয় অর্চনার।

দোকানে বসে দু’জনেরই পছন্দের ঢাকাই পরোটা, আলুর তরকারি আর মিষ্টি খেয়ে বেরিয়ে এসে সোজা ওরা পা বাড়ায় গীতার বাপের বাড়ির দিকে। বাপের বাড়ির সামনে বাইক থেকে নেমে দাঁড়াতেই গীতা যেন আবেগে ভেসে যেতে থাকে।

‘কী হল, দাঁড়িয়ে পড়লে যে। ভেতরে যাবে না?’

‘এই এক সপ্তাহ আগে যখন মায়ের কাছে এসেছিলাম তখন কেমন একটা নিঃসঙ্গ একাকিত্বে ভুগছিলাম। সবসময় মনে হচ্ছিল সবাই যেন আমার মনের ভিতরটা স্পষ্ট পড়তে পারছে। আমার ব্যথার জায়গাটা সকলের যেন জানা হয়ে গেছে। আজ মনটা খুব ভালো লাগছে জানো। আমি এই আনন্দের মুহূর্তগুলো আর হারাতে চাই না।’

‘আমরা আবার নতুন করে জীবন শুরু করতে চলেছি গীতা। কথা দিচ্ছি, আনন্দ খুশিতে তোমার জীবন ভরিয়ে দেব।’ অজয় গীতার কাঁধটা জড়িয়ে ধরে শ্বশুরবাড়ির দরজায় গিয়ে দাঁড়ায়।

গীতার মা-বাবা, দাদা-বউদি এসে ওদের দু’জনকে প্রথম বিবাহবার্ষিকীর শুভেচ্ছা জানিয়ে বাড়ির ভিতরে নিয়ে যায়। এতদিন পরে জামাই বাড়ি এসেছে অথচ কীভাবে ওদের দু’জনকে স্বাগত জানাবে, গীতার বাড়ির লোকেরা বুঝে পায় না। এক সপ্তাহ আগে পর্যন্ত ওদের জানা ছিল জামাই আর মেয়ের মধ্যে সম্পর্কের টানাপোড়েন চলছে। এর মধ্যে যে সব ঠিক হয়ে গেছে তা ওদের ধারণাও ছিল না।

সবাই একসঙ্গে বসবার ঘরে বসে গল্পগুজব করতে করতে গীতার মা বন্দনা মেয়েকে নিয়ে ভিতরের ঘরে চলে যান। গীতার বউদিও রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ায়। অজয় শ্বশুর এবং শ্যালকের সঙ্গে বসেই গল্প করতে থাকে।

প্রায় কুড়ি মিনিট পর গীতা মায়ের সঙ্গে বসবার ঘরে এসে ঢোকে। গীতা মাকে চেয়ারে বসিয়ে অজয়ের পাশে এসে বসে।

‘শুনছ, মা না আমায় নিয়ে খুব চিন্তায় রয়েছে। আমি কীরকম আছি, সুখে আছি কিনা এই নিয়ে নানা দুশ্চিন্তা আর কী! আমি তো বুঝিয়েছি, এখন তুমিই পারো মায়ের চিন্তা দূর করতে।’ বন্দনা মেয়ের কথা শুনে জামাইয়ের সামনে লজ্জায় পড়ে যান।

‘মা, গীতাকে নিয়ে কী এত চিন্তা করছেন?’ অজয় খুব সিরিয়াস হয়েই শাশুড়িকে প্রশ্নটা করে।

‘না-না বাবা, সেরকম কিছু নয়। একটাই মেয়ে। চিন্তা তো হয়ই।’

এরই মধ্যে গীতা বলে ওঠে, ‘মা, শুধু তো চিন্তা নয়, আমি কীভাবে ভালো থাকতে পারি সেই পরামর্শগুলোও আমার সঙ্গে সঙ্গে অজয়কেও দাও। দ্যাখো না ও কী বলে।’

মেয়ের কথা শুনে বন্দনা যেন একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়েন। মেয়েকে থামাবার প্রয়াস বিফল হলে মুখের হাসি বজায় রেখেই অজয়কে বলেন, ‘গীতা বরাবরই একটু বোকা, মনের কথা গুছিয়ে বলতে পারে না। তোমাদের দু’জনেরই জীবনে যাতে খুশি বজায় থাকে তাই আমি গীতাকে বলেছিলাম, সংযুক্ত পরিবারে থেকে যখন তোমাদের দুজনের মধ্যে ব্যবধান বাড়ছে তখন উচিত হচ্ছে ওই বাড়ি ছেড়ে অন্য কোথাও দু’জনের আলাদা করে সংসার পাতা উচিত। এক বছর ধরে তোমাদের সম্পর্কের টানাপোড়েনের ঘটনা তো সকলেরই জানা। মা হয়ে এটুকু চাওয়াটা কি অন্যায়?’

‘না মা, অন্যায়টা আসলে আমার,’ গম্ভীর ভাবে অজয় শাশুড়ির কথার উত্তর দেয়। ‘তবে বিবাহিত জীবনের দ্বিতীয় ধাপের শুরুতে আমরা দুজনেই অতীতকে ভুলে নতুন করে জীবন শুরু করার প্রতিজ্ঞা করেছি। আপনাদের আশীর্বাদটুকুই এখন শুধু দরকার।’

‘মা তোমাকেও একটা প্রমিস করতে হবে। এবার থেকে কিছু বোঝাবার হলে আমাকে একলা নয়, অজয় সঙ্গে থাকলে তবেই বলবে।’ গীতাও কিছুটা সিরিয়াস হয় কারণ মায়ের স্বভাব তার অজানা নয়।

‘আর একটা কথা’, অজয় বলে, ‘এটাও আমরা ঠিক করেছি সকলের কথাই আমরা শুনব। কিন্তু আমরা দু’জন মিলে যা ডিসিশন নেব সেটাই মেনে চলব। এটাতে কেউ ব্যথা পেলেও আমাদের কিছু করার নেই।’

‘আমি তো গীতাকে যা বলেছি, সবই ওর ভালোর জন্যই। ও যদি সেটা না মানে তাহলে সেখানে আমার কিছু বলার নেই।’

‘মা প্লিজ। এখন থেকে আমার জন্য নয়, আমাদের ভালো কীসে হবে ভাবতে শুরু করো।’

বন্দনা কথা না বাড়িয়ে, মেয়ের দিকে তীর্যক দৃষ্টি নিক্ষেপ করে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ান।

এতক্ষণ গীতার বাবা সুব্রতবাবু এবং দাদা সৌম্য দু’জনেই মুখ বন্ধ করে বসে সব শুনছিলেন। বাড়ির গৃহিনী ভিতরে যেতেই দুজনে উঠে এসে অজয়কে জড়িয়ে ধরেন। দুজনের চোখেই আনন্দ যেন উপচে পড়ছিল।

‘অজয়, আমার মনের বোঝা আজ তোমরা দুজনে মিলে হালকা করে দিলে। আশীর্বাদ করি তোমাদের এই সদ্বুদ্ধি আজীবন বজায় থাকুক।’ সুব্রতবাবুর গলা রুদ্ধ হয়ে আসে।

হাসিঠাট্টার মধ্যে দিয়ে ওদের চারজনের আড্ডা জমে ওঠে। দুপুরে সকলে একসঙ্গে খেতে বসলে গল্পগুজবের মধ্যে দিয়ে সকালের টেনশন অনেকটা সহজ হয়ে আসে। বিশ্রামের পর অজয়, বন্ধু সিদ্ধার্থর বাড়ির পার্টিতে সকলকে নিমন্ত্রণ জানিয়ে গীতাকে নিয়ে শ্বশুরবাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে।

অজয়ের চারজন বন্ধু মিলে সিদ্ধার্থর বাড়িতে গীতা আর অজয়ের বিবাহবার্ষিকীর পার্টিটার আয়োজন করেছিল। সিদ্ধার্থর বউ সুচেতা গীতাকে সাজানোর দায়িত্ব নিয়েছিল। গীতাকে সাজিয়েগুজিয়ে যখন বার করল সত্যিই ওর দিক থেকে চোখ ফেরানো যাচ্ছিল না।

অজয় আর গীতারই পার্টিটা দেওয়া উচিত ছিল কিন্তু প্রায় ভেঙে যাওয়া দু’জনের বিবাহিত জীবন নতুন করে জোড়া লাগার আনন্দে বন্ধুরাই পার্টিটার আয়োজন করেছিল। নিমন্ত্রিত সকলেই প্রায় উপস্থিত ছিল পার্টিতে। হাসি, আড্ডা আর সকলের শুভেচ্ছায় পার্টি জমে ওঠে। হইচই মিটতে মিটতে রাত প্রায় বারোটা। অতিথিরা সকলেই তখন চলে গেছেন। শুধু পাঁচ বন্ধু আর তাদের ফ্যামিলি তখনও গল্পে মশগুল।

হাতঘড়ির দিকে চোখ পড়তেই অজয় উঠে দাঁড়ায়, ‘আর না, এইবার বাড়ি যাওয়া দরকার। অনেক রাত্তির হল। তোদের সকলকে অনেক ধন্যবাদ এত ভালো একটা পার্টি আয়োজন করার জন্য। চলো গীতা, এর পরে গেলে বাড়িতেও আর ঢুকতে পারব না।’

সকলকে শুভরাত্রি জানিয়ে অজয় আর গীতা যখন বাড়ি ঢুকল তখন রটা বেজে গিয়েছে। শোবার ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করতেই গীতা অজয়ের কাছে নিজেকে সঁপে দেয়। হাতের বেষ্টনী এতটুকুও আলগা না করে অজয় জিজ্ঞেস করে, ‘কেমন কাটল আজকের দিনটা?’

‘অসম্ভব ভালো। এই দিনটার কথা কোনওদিনও ভুলতে পারব না।’

‘আমিও না। আমি প্রমিস করছি কোনওদিন তোমাকে আর দুঃখ দেব না। অতীতটা আজ আমার কাছে স্বপ্ন। আমার বাস্তব এখন তুমি। ভুল করেছি আর ভুল ভেঙেও গেছে। আমি ধীরে ধীরে বুঝতে পারছিলাম, অর্চনা আর আমার সম্পর্ক আসলে কোনও পরিণতিতে পেৌঁছোবে না। কারণ ও কখনও চায় না আমার বউ হয়ে সংসার করতে। ক্ষণিক সুখের চাহিদা মিটে গেলেই ও খুশি। দাম্পত্য মানে যে আগলে রাখা, আঁকড়ে থাকা, এই আবেগটা ওর মধ্যে দেখিনি। দেখেছি শুধু তোমার কাছ থেকে কেড়ে নেওয়ার, যেন কোনও বাজি জেতার আনন্দ। আমার ভুল আমি বুঝতে পেরেছি। আমি শুধু প্রায়শ্চিত্ত-ই করতে চাই না গীতা, তোমার জীবনটাও ভালোবাসায় ভরিয়ে তুলতে চাই। আমাকে সেই সুযোগটুকু দেবে তো গীতা?’

উত্তর না দিয়ে গীতা অজয়ের বুকের কাছে আরও ঘন হয়ে আসে। টের পায় অজয়ের উষ্ণ নিঃশ্বাস নিজের ঠোঁটে এসে লাগছে। ঘরের আলোটা কখন নেভানো হয়েছে গীতা টের পায় না। শুধু ওদের উষ্ণ ভালোবাসার সাক্ষী হয়ে থাকে ঘরের নাইট বাল্বটা।

চেতন-অচেতন

দোতলার ঝুল বারান্দা থেকে দৃশ্যটা দেখে মামির চক্ষু ছানাবড়া!

– এই হাঁদারাম, কী করছিস, কী করছিস– বলতে বলতে দ্রুত সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে আসেন। তারপর কান ধরে হিড়হিড় করে টানতে টানতে ঋজুকে ড্রয়িংরুমে মামার কাছে নিয়ে গিয়ে ঝাঁঝের সঙ্গে বলেন– এই শুনছ, দ্যাখো, একে নিয়ে তো আর পারা যায় না।

– কী, করেছে কী গর্দভটা?

– আর করেছে! শোনো, পুজোর নতুন শার্ট প্যান্টটা একটা ভিখিরি ছেলেকে… সঙ্গে আবার ফ্রিজ খুলে মিষ্টির প্যাকেটটাও!

মামা গর্জে ওঠেন– সে কী! এভাবে দানছত্র করতে কে বলেছে?

ঋজুর কাঁদো কাঁদো স্বর– ও যে চাইল মামা!

গালে এক চড় বসিয়ে চিৎকার করে বলেন– চাইলেই দিতে হবে, অপদার্থ কোথাকার! ক্ষমতা কতটুকু বুঝতে হবে না! এখন যদি কেউ কেঁদে কেটে আমার কাছে বাড়িটা চায়, আমি কি দিতে পারব?

তোতলাতে তোতলাতে ঋজু বলে– না মানে… আমার তো পুরোনো দুটো আছে কিন্তু ওর তো একটাও নেই!

চোখ পাকিয়ে মামা বলেন– খবরদার! আর যেন এরকম না শুনি! ওর কাছে নেই, তুই কি দেখে এসেছিস? এক্বেবারে রাম বোকা! ছোটো ভাইটাকে দেখেও শেখে না! ভাগ এখান থেকে। মনে রাখবি নিজে যখন উপার্জন করবি, তখন যতখুশি দানছত্র করবি। কিন্তু এখন নয়।

আপনমনে গজগজ করেন মামা– হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে, মাথার ঘাম পায়ে ফেলে সংসার ঠেলতে হচ্ছে। তার ওপর আবার দানছত্র করে পুণ্য অর্জন করা! যত্তসব…!

মামি পিঠে দুটো কিল দিয়ে বলেন– আর যদি কোনওদিন এরকম কিছু দেখি, তবে ওদের সঙ্গে তোকেও বাইরে পাঠিয়ে দেব। ঋজু দু’হাতে চোখ মুছতে মুছতে নিজের ঘরের দিকে চলে যায়।

জন্মলগ্নে মাকে হারিয়েছে ঋজু। তার বছর খানেক ঘুরতে না ঘুরতে এক দুর্ঘটনায় বাবাকেও। এই মামা ছাড়া সাতকুলে আর কেউ নেই। মামা নিজে এক ছোটো কারখানায় ছোটো কর্মী মাত্র। বাড়িটা পৈত্রিক সূত্রে। তিনজনের সংসার মামা মামি আর তাদের একমাত্র সন্তান সানু। ভালো নাম সান্নিধ্য। ঋজুর চেয়ে বছর দুইয়ের ছোটো। সব্বার স্নেহ ভালোবাসার সান্নিধ্যে তিলতিল করে বড়ো হয়ে ওঠা বুদ্ধিমান মেধাবী সান্নিধ্য। ঋজু এ’বাড়িতে পরগাছা। পান থেকে চুন খসলে কপালে জোটে কিল চড় ঘুসি। পোশাকি নাম সমৃদ্ধ। অনেক শখ করে বাবা তাঁদের ছোট্ট সংসারের নতুন অতিথির নাম রেখেছিলেন সমৃদ্ধ। আজ কপালগুণে সেই সমৃদ্ধ সব খুইয়ে এ বাড়ির একটা বাড়তি বোঝা।

কালের নিয়মে একসময় বড়ো হয়ে ওঠে সমৃদ্ধ। তবুও খুব সাদাসিধে। আলাভোলা। পরীক্ষার রেজাল্ট বরাবর-ই কোনওক্রমে, টেনেটুনে। এদিকে প্রায় প্রতি ক্লাসে প্রথম দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে সান্নিধ্য এখন ভালো নামজাদা কলেজে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে। আর দু’বেলা সানুর সঙ্গে তুলনার খোঁচা খেতে খেতে একসময় নিজের পায়ে দাঁড়াবার চেষ্টায় ব্যস্ত ঋজু। যদিও মামা-মামি একটা ব্যাপারে একমত যে, এই ছেলে কোনওদিন ভালো কিছু করতে পারবে না। এত ভুলো মনের, হাবাগোবা ছেলের দ্বারা বড়ো কিছু অসম্ভব। এব্যাপারে হয়তো শত্রু মিত্র সব্বাই একমত। মামা মাঝে মাঝে দুঃখ করে বলেন– হঠাৎ যদি আমার মৃত্যু হয়, ঋজুটাকে কে দেখবে?

মামি সায় দেন– আমিও তাই ভাবি, ভবিষ্যতে এই ছেলের কী হবে? আমাদের মৃত্যুর পর এটা সানুর বোঝা হয়ে থাকবে না তো?

মামার গম্ভীর স্বর– মস্তিষ্কের বিশেষ কোনও কোশ বা অনুকোশ অকেজো হয়ে পড়লে, এরকম হয় হয়তো। মামি বলে ওঠেন– কাজ তো করে একটা প্লাস্টিক কারখানায় কিন্তু সেখানেও ক’দিন করতে পারবে কে জানে! মাধ্যমিকের যা রেজাল্ট! উচ্চমাধ্যমিকে পি ডিভিশন ছিল বলে রক্ষে, নইলে…। পাস কোর্সে বি.এ। তা-ও কোনওক্রমে। মামা একটা ছোট্ট স্বস্তির নিশ্বাস ছেড়ে বলেন– যাক তবু তো গ্র্যাজুয়েট।

মামি আবার গজগজ করে ওঠেন– জানো আজও কারখানায় বেরোবার মুখে টিফিন কৌটো নিতে ভুলে গেল! সব গুছিয়ে এলাম, তবুও…! কী যে হবে এর!

মামাও সুর মিলিয়ে বলে ওঠেন– হ্যাঁ, আমিও লক্ষ্য করেছি, দিন দিন যেন এটা বেড়ে যাচ্ছে। এই তো রোববার সকালে দোকানে পাঠালাম একটা ব্লেড আনতে, আর ছেলে কিনা একটা পাউরুটি নিয়ে হাজির। সত্যি ভাবনার বিষয়! মামি আবার বলেন– আর বলো কেন, গত পরশু সানুটার জন্মদিন ছিল, তাই ঋজুকে বললাম, একটু তাড়াতাড়ি কারখানা থেকে ফিরতে, বলেও গেল তাড়াতাড়ি ফিরবে অথচ বেমালুম ভুলে ফিরল সেই রাত দশটায়। এমন ছেলে দেখিনি বাবা! না লাগে হোমে, না লাগে যজ্ঞে।

কারখানায় ক’দিন ধরেই ঝামেলা চলছে। একটা জরুরি ফাইল খুঁজে পাচ্ছে না ঋজু। অথচ গত তিনদিন আগেই দত্ত সাহেব ফাইলটা ওর হাতে দিয়ে বলেছিল– এটা খুব জরুরি। নেক্সট ফ্রাইডে ফ্যাক্টরির বোর্ড মিটিং। অর্ডারটা বড়ো সাহেবকে দিয়ে তখন স্যাংশন করিয়ে নিতে হবে। এটা রাখুন। কাল আমাকে দিয়ে দেবেন। এর আগেও দত্ত সাহেব অনেক জরুরি ফাইল ঋজুর হাতে তুলে দিয়েছেন। ঋজুও সততার সঙ্গে দায়িত্ব নিয়ে, সেই দায়িত্ব যথাযথ পালন করেছে। কোথাও কোনওরকম ভুল হয়নি। বরং ওর সততা আর দায়িত্ববোধকে সব্বাই বেশ তারিফ করেছেন।

অথচ পরশু দিনের ফাইলটা ওর কাছ থেকে বেমালুম লোপাট হয়ে গেল! এটা কী ওর মনের ভুল না কাজের গাফিলতি? নিজেকে নিজে সান্ত্বনা দেয়– নাহ্, এটা মোটেই ওর গাফিলতি নয়। কারখানায় এসে কাজে কখনও ফাঁকি দেয় না সে। ফাইলটা নিয়ে, সেটা যত্ন করেই রেখেছিল, তবুও…! চারদিক তন্নতন্ন করে খোঁজা হ’ল। কোথাও নেই…! সেই থেকে কারখানার দত্তসাহেবের কাছে দু’চক্ষের বিষ হয়ে উঠল। এদিকে ওর এক সহকর্মী কমল, নিজের দুঃখ দুর্দশার কথা ওর কাছে সাতকাহন করে ফেনিয়ে ফেনিয়ে বলে ওর মাইনের পুরো টাকাটা নিয়ে কারখানা ছেড়ে কেটে পড়ল। বাড়িতে মামা মামির কাছে কী কৈফিয়ত দেবে ভেবে পায় না ঋজু। মামির বাক্যবাণে প্রাণ ওষ্ঠাগত। ঘরে বাইরে কেমন যেন কোণঠাসা অবস্থা। আপন মনে বিড়বিড় করে ঋজু– ধ্যুস, কিচ্ছু ভাল্লাগে না। কী যে করি! কোথায় যে যাই!

মামি মুখ ঝামটা দিয়ে বলেন– এত বোকা, পৃথিবীতে দু’টো নেই। মামা শুধরে দিয়ে বলেন– না না বোকা নয় ঋজু। তবে খুব নরম মনের ছেলে। কারও দুঃখ কষ্ট সহ্য করতে পারে না। মামি আবার চড়া গলায় বলেন– ওই একই হ’ল। নির্বোধ যারা তাদেরই মন নরম হয়, ওসব নরম-ই বলো আর সরল-ই বলো সব এক-ই। নইলে এই তো দু’দিন আগে, পল্টু নামে কারখানার এক ছেলেকে নিজের টিফিন খাইয়ে নিজে সারাদিন ঢোক ঢোক করে জল গিলে রাতে বাড়ি ফিরল। সে নাকি টিফিন আনেনি, খিদেতে ছটফট করছিল তাই…। এমন বোকা কেউ দেখেছে!

মনে মনে ভাবে ঋজু– আর আজ? আজও ভুল হয়ে গেল আবার। মুহূর্তের অন্যমনস্কতায় ফেরার পথে, চেনা ট্রেন ছেড়ে অচেনা ট্রেনে উঠে পড়ল। প্রায় প্রতি রোববার-ই এদিক-ওদিক বেরোয় সমৃদ্ধ। বাড়িতে মন বসে না। মামা-মামির তির্যক কথার চোটে এদিক-ওদিক ছুটে বেড়ায়। তাছাড়া সান্নিধ্যটাও হয়েছে সে’রকম। কেবল পড়ার বই-এ মুখ গুঁজে বসে থাকা, আর কেরিয়ার তৈরি করা– এর বাইরে দুনিয়াটা যেন নিরস গদ্যময়।

ধ্যুস কিস্যু ভাল্লাগে না। যেদিকে চোখ যায়, চলে যেতে ইচ্ছে করে সমৃদ্ধের। তাই ফেরার তেমন তাগিদও ছিল না। যাবে শিয়ালদা চলে গেল সোদপুর। ভিড় ঠেলে স্টেশনে নামতেই টনক নড়ল। কোথা থেকে এক সুন্দরী মেয়ে সামনে এসে, একমুখ হাসি নিয়ে বলল– এই তো শান্তনু কোথায় ছিলে এতদিন! চলো চলো আমার সঙ্গে এসো, যেতে যেতে সব শুনব।

ঋজুকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে হাত ধরে টানতে টানতে সামনের দিকে নিয়ে চলে। ঋজু যখন দিশেহারা, আমতা আমতা করে কিছু বলতে যাচ্ছে, মেয়েটি তখন হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে, ওকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরে, ঠেলে নিয়ে চলল। কিছুটা গিয়ে একটু থেমে মেয়েটা বলে– হাঁদারামের মতো অমন করে কী দেখছ? আমাকে চিনতে পারছ না, মনে হচ্ছে? আর অভিনয় কোরো না। ধরা পড়ে গেছ। এবার লক্ষ্মী ছেলের মতো চলো তো।

দিশেহারা মন নিয়েও, স্মৃতি হাতড়াবার চেষ্টা করল সমৃদ্ধ। কিন্তু না। চিনতে পারল না। ফলে মনে উঠল দ্বিধা আর সংশয়ের দোলাচল। আপনমনেই প্রশ্নের ঝড় উঠল একসময়– খারাপ মেয়ে নয়তো? রাত তো বেশ হয়েছে। শীতের রাত। চারদিক সুনশান। ঋজু ক্রমশ মেয়েটিকে এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করল। কিন্তু ততক্ষণে মেয়েটি রিকশা ডেকে, নিজে আগে উঠে, হাত ধরে সমৃদ্ধকেও রিকশায় ওঠার জন্য টানাটানি শুরু করে। আশেপাশের কয়েকজন রিকশাওয়ালা, অটোওয়ালা এসে ভিড় জমায়। অগত্যা একসময় সিন-ক্রিয়েটের ভয়ে রিকশায় উঠে বসে ঋজু। কিন্তু মেয়েটিকে সত্যি সত্যি চিনতে পারে না। অথচ আসতে বাধ্য হল। মেয়েটি যেভাবে জড়িয়ে ধরেছে, হাত ধরে টানছে, তাতে গভীর অন্তরঙ্গতা ফুটে ওঠে। প্রতিবাদের ভাষা থাকে না। তাছাড়া প্রতিবাদ করতে গেলে হয়তো মেয়েটি তর্কাতর্কি শুরু করবে, পরে হয়তো কান্নাকাটিও জুড়ে দেবে। লোক জড়ো হবে– এই ভয়েও ঋজু শেষ পর্যন্ত বেশি কথা বলে না।

সমৃদ্ধ তবুও একসময় প্রতিবাদের গলায় মিনমিনিয়ে বলে– দেখুন আপনি বোধহয় কোথাও ভুল করছেন।

– ভুল! না না আমি কোনও ভুল করছি না। তবে মাত্র সাত বছরে তুমি আমাকে ভুলে গেলে? এ-ও কি সম্ভব? আমাদের এত বছরের সম্পর্ক! তবে চিরদিন-ই তুমি ভুলো মনের, হাঁদারাম। এখন-ও সেরকম-ই আছো। কোনও পরিবর্তন নেই। কথা না বলে, মুখ বুজে চলো তো!

এই মুহূর্তে সমৃদ্ধের মনে হল কে যেন তাকে মাদক খাইয়ে বেহুঁশ করে দিয়েছে। হাত পা কেমন যেন আলগা আলগা লাগছে। শরীরটা অবশ। মামা-মামি, ঘরবাড়ি, সব যেন ক্রমশ ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। শরীরে শরীর ছুঁয়ে ওরা যখন রিকশায় পাশাপাশি বসল, সমৃদ্ধের মন তখন আরও বেশি অসাড়। এই প্রথম একজন অল্পবয়সি মেয়ের ছোঁয়া। মনে ওঠে সাত সমুদ্রের ঢেউ। অনেকটা পথ যাবার পর আমতা আমতা করে বলে সমৃদ্ধ– আচ্ছা আমরা কোথায় চলেছি…?

মেয়েটি হেসে ওঠে ওর প্রশ্ন শুনে। এই হাসির মধ্যে আর যাই হোক, কিন্তু ছলনা নেই। এ যেন বিশ্বজয়ের আনন্দে গর্বিত হাসি। হাসতে হাসতেই বলল– আর পারি না। সত্যি সত্যি তুমি একটা ক্যাবলাকান্ত। কোথায় আর যাব এত রাতে? বাড়ি যাচ্ছি। তুমি আমাদের বাড়ি চেন না? তুমি না আমার বাবার প্রিয় ছাত্র ছিলে? সব ভুলে গেলে? সত্যি তোমার হলটা কী বলো তো? মগজ ধোলাই হয়েছে নাকি? গঙ্গার ধারে আমাদের বাড়ি। তুমি রোজ সে বাড়িতে যেতে, সব ভুলে গেছ? পরীক্ষার পরও নানান ছুতো করে আমাদের বাড়ি আসতে, শুধু একবার আমাকে দেখার জন্য। তবে এতটাই হাঁদা ছিলে বাড়ির সবার সঙ্গে কত কথা, শুধু আমার সঙ্গে কথা বলতে গেলেই তোতলাতে, মনে আছে?

সমৃদ্ধের মুখে কোনও ভাষা নেই। ভাষা যেন কোথায় হারিয়ে গেছে। তেরছা চোখে বারবার মেয়েটিকে দেখার চেষ্টা করছে। আর মনের অতল গহ্বরে, স্মৃতির ঘেরাটোপ থেকে ওর মুখটা তুলে আনার চেষ্টা করছে। কিন্তু যতবার চেষ্টা করছে, ততবার-ই ব্যর্থ হচ্ছে। অগত্যা অসহায় ভাবে ভ্যাবলার মতো চারদিকে তাকাচ্ছে। স্মৃতিকে উস্কে দেবার জন্য প্রকৃতি যদি সামান্যতম সাহায্য করে, এই আশায়। কিন্তু শীতের রাত। বেশিরভাগ বাড়ির দরজা জানালা বন্ধ। অন্ধকার যেন অন্ধকারকে ছুঁয়ে ঘন হয়ে আছে। কিছু ঠাহর করা অসম্ভব। মনে মনে ভাবে সমৃদ্ধ, মেয়েটি ভালো-ই নাটক জানে। এমনকী ওর বাচনভঙ্গিতে কোনও জড়তা নেই। অভিনয়ে এতটুকু আড়ষ্টতা নেই। কখন কী বলতে হবে, সব মুখস্ত। মুহূর্তে আবার মনে ঝড় ওঠে, সবটাই কি অভিনয়? এই যে শীতের রাতে গঙ্গার ধার দিয়ে রিকশায় যাচ্ছে, তাতে ওর একটু আগে শীত করছিল। মেয়েটি যেহেতু ওর গা ঘেঁষে বসেছিল তাই ওর ঠক ঠক করে কাঁপা বুঝতে পেরে, তক্ষুনি নিজের গায়ের শালটা খুলে, ওর গায়ে জড়িয়ে দিল। বারণ করেও সে আটকাতে পারল না। এটাও কি অভিনয়! ওর চোখ দুটো ছলছল করে উঠেছিল। ভাগ্যিস অন্ধকার ছিল!

সমৃদ্ধ স্মৃতি হাতড়ে সমানে মেয়েটিকে খোঁজার চেষ্টা করে। কিন্তু স্মৃতির ঘরে শুধুই ধোঁয়াশা। গাঢ় অন্ধকার। মেয়েটিকে কখনও দেখেছে কিনা সন্দেহ। প্রেম তো বহু দূরের কথা! মেয়েটি কিন্তু তার সবরকমের সুযোগ-সুবিধার প্রতি খেয়াল রাখছে। ব্যাগের চেন খুলে দুটো লজেন্স ওর হাতে দিল। গায়ের শালটা দিল! বারবার জল তেষ্টা পেয়েছে কিনা জানতে চাইছে। এই মুহূর্তে সমৃদ্ধের নরম মনটা একটু একটু করে নিজের বশ হারিয়ে দুর্বল হয়ে পড়ছে। ওর এত বয়সের জীবনে এভাবে কেউ কোনওদিন ওর প্রতি নজর দেয়নি। মামা-মামির সংসারে, জ্ঞান বয়স থেকেই ও একটা পরগাছা, আপদ বিশেষ। সেও যে কারও প্রিয় পাত্র হতে পারে, এটা এই প্রথম সমৃদ্ধ অনুভব করল। তবে কী ইদানীং ওর সব স্মৃতি ক্রমশ বিস্মৃতির গহ্বরে চলে যাচ্ছে! হলটা কি তার! একজন মানসিক ডাক্তারের সঙ্গে পরামর্শ করা প্রয়োজন।

এসব সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতেই তারা গঙ্গার ধারে একটা পুরোনো বাড়ির সামনে দাঁড়াল। সমৃদ্ধ তাড়াতাড়ি রিকশাভাড়া মিটিয়ে দিল। রিকশাওয়ালা তক্ষুনি উলটোদিকে চলা শুরু করল। মেয়েটি দ্রুত পায়ে এগিয়ে সদরের কড়া নাড়ে। মুহূর্তের মধ্যে বেরিয়ে এলেন বনেদি চেহারার এক প্রৌঢ়া। মুখে চোখে উৎকণ্ঠা। মেয়েটির দিকে এক ঝলক তাকিয়েই বলে ওঠেন– কোথায় গিয়েছিলি সুমি? এত দেরি হ’ল যে!

তারপর পাশে দাঁড়ানো সমৃদ্ধকে দেখে উদ্বেগে দিশাহারা ভাবে ব্যাকুল স্বরে বলে ওঠেন– আবার একজনকে…! সুমি মাথা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলে– এবার ভুল করিনি মা। দ্যাখো ভালো করে দ্যাখো ও শান্তনু। পরক্ষণে একটু চড়া সুরে ডাকে, এই শান্তনু এদিকে এসো। আলোর দিকে মুখ করে দাঁড়াও। এবার দেখে বলো তো মা, আমি ভুল করেছি কি না?

মা জোরে জোরে ঘাড় নেড়ে কান্নায় ভেঙে পড়তে পড়তে প্রতিবাদের গলায় বললেন– ওরে সুমি ও শান্তনু নয়। তোকে কতবার বলেছি শান্তনু মারা গেছে। তবুও তুই বিশ্বাস করবি না! তবু এই বার বার ভুল করে…!

ভয়ংকর ক্ষেপে ওঠে সুমি। যে-মেয়েকে কিছুক্ষণ আগেও হাসি খুশি দেখাচ্ছিল, উচ্ছল উজ্জ্বল লাগছিল, মুহূর্তে কে যেন তার মুখে কালি লেপে দিল! মাথা ঝাঁকিয়ে কড়া চোখে মায়ের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে ওঠে– বিশ্বাস করো মা এবার আমি ভুল করিনি। ভুল করিনি মা। ও শান্তনু… শান্তনু।

এই সময় ভেতর ঘর থেকে এক যুবক বেরিয়ে এল। সমৃদ্ধের-ই সমবয়সি। বেশ ভালো চেহারা। কাছে এসে উৎকণ্ঠা নিয়ে বলল– আবারও এক-ই ভুল করলি সুমি?

– না রে দাদা আমি তো কোনও ভুল করিনি। তারপর সমৃদ্ধের দিকে ঘুরে বলে ওঠে, তুমি ওকে চিনবে না শান্তনু। ও আমার মাসতুতো দাদা সুব্রত।

মা বলে ওঠেন– ওকে ঘরে নিয়ে যা সুব্রত।

– না না আমি শান্তনুকে না নিয়ে ঘরে ঢুকবই না। সমৃদ্ধ-র হাতটা শক্ত করে ধরে রেখেছে সুমি। কেমন যেন বেপরোয়া ভঙ্গি, উন্মত্ত ক্ষিপ্ত চেহারা। মেয়ের হাত মা কিছুতেই ছাড়াতে পারছেন না। অগত্যা সুব্রত ওর পেশিবহুল শরীরের সব শক্তি প্রয়োগ করে। গর্জে উঠে বলে– শোন সুমি ও সত্যিই শান্তনুর মতো দেখতে, কিন্তু ও শান্তনু নয়। বোঝার চেষ্টা কর। শান্তনু আর নেই।

কিন্তু কে কার কথা শোনে! সুমি তখন-ও চ্যাঁচাচ্ছে– আমি যাব না। শান্তনুকে ছেড়ে আমি কিছুতেই যাব না। নাছোড়বান্দা সুমিকে একসময় জোর করেই টানতে টানতে ভেতরের ঘরে ঢুকিয়ে বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে দেয় সুব্রত। ভেতরে তখন প্রলয় কাণ্ড চলছে। হাতের কাছে যা যা ছিল সব ছুড়ে ছুড়ে ভাঙছে সুমি। কোনও কাণ্ডজ্ঞান নেই। বৃদ্ধ বাবা-মা, দাদা, কত বোঝাবার চেষ্টা করছে বাইরে থেকে। যত শান্ত করার চেষ্টা চলছে তত-ই হিংস্র নেকড়ের মতো জিনিসপত্রগুলো তছনছ করছে। ভেতরের ঝড়ের তাণ্ডবে বাইরের সবাই চমকে উঠছে। বেকুবের মতো এককোণে দাঁড়িয়ে আছে সমৃদ্ধ। যেন কিংকর্তব্যবিমূঢ় এক জড়পিণ্ড।

মা একটু এগিয়ে ওর কাছে এসে ফিস ফিস করে বলেন– এভাবেই চলছে বাবা। এরপরই ও জ্ঞান হারাবে। দেখা ছাড়া কিচ্ছু করার নেই আমাদের। ওরা দু’জনে দু’জনকে খুব ভালোবাসত। বিয়ের দিন-ও ঠিক হয়ে গিয়েছিল। অনেক চিকিৎসা করেছি। কিন্তু…! মনোরোগ! তেমন কোনও তাৎক্ষণিক মেডিসিন নেই। অনেক ধৈর্য ধরে দীর্ঘদিন চিকিৎসা করাতে হবে। কিন্তু আমাদের বয়স হয়েছে। দুজনেই অসুস্থ। সুব্রত চলে যাবে। তখন আমাদের পক্ষে…! কী জানি কী হবে! ডাক্তারের মতে এভাবে চলতে থাকলে একসময় ও সম্পূর্ণ উন্মাদ হয়ে যাবে, বলেই কান্নায় ভেঙে পড়লেন মা। ভেতরে তখন হুলুস্থুলু কাণ্ড! দরজার খিল দিয়ে বাড়ি দিচ্ছে আলমারি, ড্রেসিং টেবিলের উপর। ঝনঝন করে কাচ ভাঙ্গার আওয়াজ। সুব্রত তাড়াতাড়ি দরজাটা খুলতেই দরজার ডাসাটা ছুড়ে মারল ওকে লক্ষ্য করে। তারপর দাঁত কিড়মিড় করে ছুটে এল ওর দিকে। চোখ দিয়ে যেন আগুন বেরোচ্ছে।

সমৃদ্ধ যাবার জন্য পেছন ঘুরেছে। হঠাৎ শুনতে পায় গোঁ গোঁ আওয়াজ। মুখ দিয়ে গ্যাঁজলা বেরোচ্ছে। চোখ উলটে ধড়াস করে মেঝেতে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যায় মেয়েটি। ছুটে আসে সব্বাই। সমৃদ্ধও দ্রুত ঘরে এসে ওর মুখে চোখে জল ছেটায়। পাখার হাওয়া করে জ্ঞান ফেরায়। প্রথমে সুমি কারোকে চিনতে পারে না। চারদিকে চোখ বোলায়। হঠাৎ একসময় সমৃদ্ধের দিকে দৃষ্টি স্থির হয়। শার্টটা দুহাতে চেপে ধরে, টেনে টেনে বলে– আর পালাতে পারবে না। এইতো আমি ধরে রেখেছি। সুমির মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে শান্ত স্বরে সমৃদ্ধ বলে– না সুমি আর ভয় নেই। আমি আর কোথাও যাব না। মামা-মামি সান্নিধ্য-র মুখটা এক ঝলক ভেবে নিয়ে ধীরে ধীরে আবার বলে– উঠে পড়ো, তোমার শান্তনু তোমার কাছেই ফিরে এসেছে। সব্বাই একসঙ্গে অপলক দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকায়। সুমি ফ্যাল ফ্যাল করে অসহায় দৃষ্টি মেলে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে।

তবু মনে রেখো…

পাবলিশারের দফতর থেকে এক কপি একটুকরো আকাশ সবেমাত্র হাতে পেল আঁচল। বইটা নাড়াচাড়া করতে করতে নতুন বইয়ের ঘ্রাণ নিল। কবি তোর্সা বসু নামটা ছাপার অক্ষরে দেখে চোখটা ঝাপসা হয়ে আসছে। নিউ সার্কুলার রোডের নতুন সাজানো ফ্ল্যাটটা যতই আপন হোক, সে আর সুতীর্থ বিয়ের পর প্রথম সংসার পেতেছিল মালিনী নিবাস-এই। ভাড়া বাড়ি হলেও আজও কেন জানি বড্ড নিজের!

মালিনী রায়চৌধুরী বছর ষাটের ডাকসাইটে সুন্দরী। স্বামী বেণুলাল রায়চৌধুরী অবসরপ্রাপ্ত উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মী। ইজিচেয়ারে গা এলিয়ে হাতে খবরের কাগজ নিয়ে তাঁর দিন কাটে। এক গেলাস জল গড়িয়ে খাবার অভ্যাস কোনও কালেই নেই। সারাজীবনে, যা কিছু সঞ্চয় করেছেন, তার রক্ষনাবেক্ষণের দাযিত্ব স্ত্রী মালিনীদেবীর হাতে ন্যস্ত করে তিনি নিশ্চিন্ত। এসব মাথায় রাখা মানেই তো উর্বর মস্তিষ্ককে কষ্ট দেওয়া। অতএব, জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ সবই সামলাতে হয় মালিনীদেবীকেই। নিন্দুকেরা বলে, মালিনীদেবীর শ্যেন দৃষ্টি এড়িয়ে একটি পিঁপড়েরও প্রবেশাধিকার নেই মালিনী নিবাস-এ। যদি বা আচমকা প্রবেশ করে ফেলে, তত্ক্ষণাৎই মালিনীদেবীর সম্মার্জনী আঘাতে তার ভবলীলা সাঙ্গ হয়।

বেশ মনে পড়ে আঁচলের, যারা মালিনী নিবাস-এ বাসন সাফাই আর কাপড় ধোয়ার দাযিত্বে বহাল হতো, তাদের মুখগুলো দিন কুড়ি পর পর বদলাতে থাকত। কারও তেল চিটচিটে বাসন ধোয়া তো কেউ কাপড় নিংড়ানোর কোনও ছিরি জানত না। মাঝে একবার মালিনীদেবীর তীব্র হাঁটু ব্যথার দরুন, একমাসের জন্য যে-কজন রন্ধনশিল্পী বহাল হয়েছিল তাদের কারওরই মালিনীদেবীর মাপ করা তেল-মশলায় রান্নার পারদর্শিতা ছিল না।

 

মালিনী নিবাস-এ দুটি প্রাণী। কর্তা ও গিন্নী। অনেক যত্ন নিয়ে বড়ো করেছেন একমাত্র ছেলে অবিনাশকে। সে-ও বদলি নিয়ে ভিনরাজ্যের বাসিন্দা। তার স্ত্রী তিতির সাফ জানিয়েছে, মালিনী নিবাস-কে ধুলোমুক্ত করার জন্য সে পৃথিবীতে জন্মায়নি। তার করার মতো অনেক কাজ রয়েছে।

মাঝে মাঝে ছুটিছাটায় একবেলার জন্য অবিনাশ আসত। কিন্তু স্ত্রী, পুত্র শ্বশুরালয়ে থাকায় অবিনাশের বিশেষ থাকা হতো না। এতে মালিনীদেবীর বিশেষ ভ্রুক্ষেপ নেই।

তেল-নুন-লকড়ি নিয়ে তিনি দিব্যি আছেন। বরং এ যেন একদিকে ভালোই। অন্যের আজেবাজে কাজ তার বরাবরই না-পসন্দ। খালি মাঝে মাঝে এক মাত্র নাতি তাতানের জন্য ভেতরটা হু হু করে এই যা! সাধ করে জিভেগজা, খুরমা, আচার বয়ম ধরে বানিয়ে রোদে দেন। সংরক্ষণ করেন, যদি কখনও তার দাদুভাই আসে! কিন্তু কালের নিয়মে একসময় তাতে ছাতা ধরে। তবু মালিনীদেবী প্রাণে ধরে কাউকে দিতে পারেন না।

মালিনী নিবাস-এর একমাত্র ভাড়াটে সুতীর্থ বসু আর তার ছোট্ট ছেলে বাবিনের প্রতি মালিনীদেবী বরাবরই স্নেহশীলা। কিন্তু সুতীর্থর বাউন্ডুলে লেখিকা বউ, আঁচলের উড়নচণ্ডী স্বভাব দেখে রেগে গজগজ করে বলতেন, মেযোনুষের অত সংসার ফেলে বাউন্ডুলেপনা ভালো লাগে না বাপু! বলি পাতাকে পাতা হিজিবিজি লিখলে সংসারের কোনও উপকার হয়? তার চেয়ে ঝুলগুলো তো একটু ঝাড়তে পারে? নেহাৎ পড়েছিল অমন ভালো ছেলেটার হাতে! আহা গো, বাচ্চাটা কেমন শুকনো মুখে ঘুরে বেড়ায়!

প্রতিদিনের মতোই একদিন মালিনী নিবাস-কে ধুলোমুক্ত করতে করতে, সেরিব্রাল অ্যাটাকের শিকার হয়ে শয্যাশাযী হলেন মালিনীদেবী। বাঁ দিকটা কোনও জোর নেই। ভাগ্যিস আঁচল এসে ধরেছিল, নইলে সে যাত্রা ফিরতেন না। সবই অদৃষ্ট নইলে কে ভেবেছিল, তার মতো দাপুটে মহিলাকেও কাজের মাসি আর আয়াদের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হবে।

এদিকে পিঁপড়ে, আরশোলা, ছুঁচো মনের সুখে বাসা বেঁধেছে মালিনী নিবাস-এ। বেণুলাল খুব একটা এদিকে আসেন না। রোগীর ঘরে আসতে তাঁর গা ঘিনঘিন করে। পরিচিত কেউ যদি জিজ্ঞেস করত, মাঝে মাঝে ভুলেই যান, ডান না বাঁ কোন দিকে অসাড় মালিনীদেবীর। না এসব করলেও বেণুবাবু যথেষ্ট কর্তব্যবান। কারণ চিকিৎসা ও পরিচর্যার যাবতীয় আর্থিক ভার তো তাঁরই। শুধু শুধু খোঁজ নিতে গিয়ে নিজের সুস্থ শরীরকে অসুস্থ করে বিপদ বাড়ানো বই-তো নয়!

বিশেষ কেউ আসে না মালিনীদেবীর ঘরে। এভাবে বেঁচে থাকার চেয়ে মৃত্যু তাঁর কাছে অনেক স্বস্তির। অবিনাশ একবেলার জন্য এসেছিল। চোখ ফেটে জল আসে মালিনীদেবীর। সামনে আলমারীর ওপরে তাঁদের বিয়ে ছবি। আজ পঁয়ত্রিশ বছর ধরে বেঢপ বেণুলালের সঙ্গে নিজের জুটিটাকে মানানসই করতে, নিজেকে ভেঙেচুরে ফেলেছেন সেই কবেই! এই পুতুল খেলার নেশার মতো সংসারের নেশায় বুঁদ হয়ে সব কষ্ট ভুলেছেন। নয়তো এই স্বার্থপর, বাতিকগ্রস্ত, বদমেজাজি লোকটার সঙ্গে থাকতেন কীভাবে? মাঝে মাঝে বিভিন্ন মহিলা কলিগের সঙ্গে মাখোমাখো গল্প কানে এসেছে। শুনেও শোনেননি, বুঝেও বোঝেননি। সব কষ্ট থেকে পালানোর একটাই জায়গা ছিল। আজ আর সেটাও রইল না।

ও মাসি আমি কিন্তু ফল, হরলিক্স আনিনি, এই দ্যাখো বকুল ফুল। খুশি? বলেই হেসে ওঠে আঁচল। আঁচলের চুলের শ্যাম্পু আর পারফিউমের গন্ধে সতেজ লাগে মালিনীর। পর্দা সরাতেই ঘরে একরাশ রোদ্দুর হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পড়ল।

এই দ্যাখো মাসি আমার মোবাইলে, একি! মাসি তুমি কাঁদছ?

চাঁপা কলির মতো আঙুল দিয়ে চোখ মুছিয়ে দিয়ে আঁচল স্বভাবসুলভ ভাবে বলে চলে, এটা ওয়ে ম্যাগাজিন। আমি এডিটর। সেদিন কাগজওয়ালার পুরোনো খবরের কাগজের স্তূপে, তোমার কবিতার খাতাগুলো পাই। মেসো মনে হয় বোঝেননি। আমি কিন্তু আরও ছাপব মাসি! আসলে তুমি যতই খিটখিট করো, আলমারী ঠাসা রবীন্দ্র রচনাবলীর সম্পূর্ণ সেট আর ঝাড়ু দিতে দিতে রবিবাসরীয় পড়া দেখেই বুঝেছিলাম।

ফ্যালফ্যাল করে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকেন মালিনীদেবী। আঁচল বলে চলে, বারীন সেনের মতো লেখক তোমার বন্ধু? উনি পড়ে নিজে আমায় ফোন করেছেন। ভাবতেই পারছি না! কত বেস্টসেলার লিখেছেন উনি।

 

ঈষৎ বেঁকে যাওয়া, বলিরেখায় ভরা মুখটায় কে যেন আবির ছড়িয়ে দিল। লাজুক হেসে একটু জড়ানো স্বরে বলে চলেন, এক কালে বারীনদার সাথে কত চিঠি, কবিতা দেওয়া-নেওয়া হয়েছে। মামার সংসারে মানুষ তো! বারীনদা তখনও প্রতিষ্ঠা পায়নি। তোর মেসোর ভালো চাকরি। (একটু থেমে) আচ্ছা আঁচল আমি কি আর আগের মতো জোর ফিরে পাব না রে? শুয়ে বসে খুব কষ্ট হয়। আমাকে একটু তোর মতো ফোন দিয়ে টাইপ শিখিয়ে দে না। নতুন করে লিখি।

খুব কষ্ট হয় আঁচলের। জোর করে হেসে বলে, একটু ভালো হও তারপর। এখনও তো অসুস্থ তুমি।

ধুর! আর ভালো হব নাকি! শোন না, আমার এই সোনার চুড়ি দুটো রাখ।

এ মা! কেন?

আরে সে লোক এখন টাকা পয়সা নিজের হাতে করে নিয়েছে। সময় থাকতে সরিয়ে রাখিনি আমিও যেমন! শোন না, কবিতাগুলোর একটা বই করে দিবি মা! এটা দিয়ে হবে তো? আর একটা কথা, কবির নাম দিবি তোর্সা বসু। আমার বাপের দেওয়া ডাকনাম। বাপের পদবী।

তুমি ওটা রাখো মাসি, আমি নিজে করে দেব। চাকরি করি তো না কি! একটু সময় দাও।

শোন না যাবার আগে বাবিন সোনার জন্য আমের আচার নিয়ে যাস কিন্তু।

চোখটা মুছে মোবাইলের গ্যালারি থেকে মালিনী মাসিমার ছবিটা বের করে আঁচল আপন মনেই বলে, আজ বইমেলার ৪ নম্বর স্টলে তোমার এক টুকরো আকাশ থাকবে। তোমার কথা ভুলিনি মাসি, একটু দেরি হয়ে গেল! গুছিয়ে নিতে সময় লেগে গেল।

ঘূর্ণাবর্ত

ভালো ছাত্রছাত্রীরা গোলাপবাগ আর তারাবাগের মায়া কাটাতে না পেরে একটার পর একটা কোর্সের জন্য পরীক্ষায় বসে, আর কোনওটা না কোনওটা উৎরে গিয়ে ফের অ্যাডমিশন পেয়ে যায়, আর সবান্ধবে হোস্টেল জীবন দীর্ঘায়িত করে চলে। তাছাড়া ছাত্র সংসদের নেতা হওয়ার একাধিক সুবিধার মধ্যে একটি হল বছরের পর বছর সাংগাঠনিক কাজের উদ্দেশ্যে ছাত্রাবাস দখল করে থাকা যায়।

কৃষাণু রায়ের দুটো খুঁটিই মজবুত। এমকম করার পর এমবিএ-তে ভর্তি হয়েছে। এমবিএ-তে সুযোগ পাওয়াটা কঠিন, কিন্তু পেলে প্রথম শ্রেণিতে পাস না করাটাই বিরলতমের মধ্যে বিরলতম ঘটনা– এই আপ্তবাক্য স্মরণে রেখে ক্যাম্পাস কাঁপিয়ে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে আছে। দ্বিতীয় প্রাপ্তি হোস্টেলের প্রাথমিক লিস্ট বেরোনোতেও সংসদের দাদা-দিদিদের ভূমিকা অগ্রণী। মেয়েদের ছাত্রীনিবাস ছাত্রী সংখ্যার অনুপাতে নিতান্ত অপ্রতুল। তাই নতুন ভর্তির সঙ্গে সঙ্গে কৃষাণুদের পেছনে নতুন নতুন মেয়েরা ঘুরে বেড়ায় যাতে আবাসন তাড়াতাড়ি জোটে।

সুতরাং প্রথমটায় সিক্তাই কৃষাণুর সাক্ষাত ও সহযোগিতা প্রার্থী ছিল। পরবর্তীকালে দেখা গেল নিজের বিভাগের নতুন ছাত্রীটির আবাসনিক সুবন্দোবস্তের জন্য কৃষাণুর তৎপরতাই বেশি। কারণ প্রতিদান প্রাপ্তির ব্যাপারে তার আত্মবিশ্বাস চিড় খায়নি। কৃষাণুর টানেই সিক্তা ইংরেজির ছাত্রী হয়েও সাহস করে ফাইনান্সে স্পেশালাইজেশন নেবে স্থির করে, কাছাকাছি এক জায়গায় ম্যানেজারিয়াল অ্যাকাউন্টেন্সির টিউশনি নিচ্ছে। টিউশনি ছাড়াও তারাবাগের গাছের তলায়, ঝিলের পাড়ে, কৃষ্ণসায়র পার্কে ও মাঝেমধ্যে কৃষাণুর হোস্টেলেও ডেবিট, ক্রেডিট, ফান্ড ফ্লো, ব্রেক ইভেনের কোচিং চলে। ছাত্রীর গাফিলতি থাকলেও শিক্ষক শিক্ষাদানে ও গুরুদক্ষিণা আদায়ে যথেষ্ট দায়িত্বশীল।

‘জানিস নাইনটি এইটের পর আমাদের ডিপার্টমেন্ট আর একাঙ্ক নাটক প্রতিযোগিতায় পার্টিসিপেট করেনি। যতসব ডেঁপোর দল। আমাদের বিরাট পড়াশোনো, প্রজেক্ট, সেমিনার, ক্যাম্পাসের চাপ– তাই নাকি নাটকের সময় নেই। আমরা এবার এই প্রোডাকশনটা নামাবই। এই নিয়ে এসকে স্যারের সঙ্গে হেডুর লেগে গিয়েছিল। এসকে হেড থাকার সময় নাটক হয়েছিল তো।’

‘কিন্তু নাটকের ক’দিন পরেই ফার্স্ট সেমেস্টার। তোর কাছে সাবজেক্টগুলো খুব অপরিচিত না হলেও আমার কাছে একেবারে নতুন। অ্যাকাউন্টেন্সির এ জানি না। ম্যানেজারিয়াল ইকোনোমিক্সে এত অঙ্ক জানলে আমি অ্যাডমিশন টেস্টই দিতাম না।’

‘আরে সবাই পাস করবে। তুই ঘাবড়াচ্ছিস কেন? নাটকটা যেন না ধ্যাড়ায়, এমজি আর তার চামচাদের উচিত জবাব দিতে হবে।’

নাটকের মহড়া চলে তারাবাগেই, বিশ্ববিদ্যালয়ের অতিথিনিবাসে। শনি রবিবার স্বর্গ দর্শনের লোভ দেখালেও সিক্তা হোস্টেলে থাকতে চায় না। সপ্তাহের শেষে বাড়ি না ফিরলে তারাবাগের বৃন্দাবনকে আন্দামানের দ্বীপান্তর মনে হয়। কৃষাণুর মাসে একবার বাড়ি গেলেই চলে। আগে একজনের সঙ্গে ব্যান্ডেল পর্যন্ত একসাথে যেত বলে গন্তব্য হাওড়া হলেও মেইন লাইনের লোকাল বা মেইল ধরত। এখন সে মুখপুস্তিকার বন্ধুতালিকায় কোনওক্রমে টিকে আছে। বড্ড কেঁদেছিল মেয়েটা সেদিন। ভাবতেই পারছিল না এত কিছুর পর এত সহজে কেউ সব শেষ করে দিতে পারে। ভগবান মেয়েদের চোখে কত জল ভরে পাঠান কে জানে? সিক্তাও তো– দুদিন দেখা না হলে কি ফোন না ধরলেই চোখ ছলছল, আবার একটু বেশি দেখতে চাইলেও প্রবল বাধা, জোর করে কেঁদে ফেলে যেন কী না কী অনাসৃষ্টি হয়ে গেল!

‘আজ হোস্টেলে রাতের মিল অফ রাখিস। অতনুদার বাড়িতে রাত জেগে রিহার্সাল হবে।’

‘কালকেই তো স্টেজ রিহার্সাল, তাহলে আজ আবার… ওকে, গেটপাস করিয়ে রাখি।’

‘ধুর! কাল ওই মশার আড়তে কখন আমাদের পালা আসবে বসে থাকতে হবে। আজ একেবারে ফুল এনার্জি দিয়ে, বুঝলি? গেটপাসের কী দরকার? তুই তো এমনিতেই শনি রবি থাকিস না। বোধহয় এই প্রথম শনিবার বাড়ি ছুটছিস না। চল না। সবাই মিলে জমিয়ে আড্ডা দেব।’

পরিচালক অতনু সান্যালের বাড়িতে সন্ধে ছটা নাগাদ বাণিজ্য প্রশাসন বিভাগের নাট্যশিল্পীর দল পেৌঁছে গেল। মহড়া চলল রাত সাড়ে দশটা পর্যন্ত। অতনুদার মা বেশ সমারোহ করে সবাইকে সান্ধ্য জলখাবার থেকে রাতের মাংস ভাত খাওয়ালেন। সোমা, দিলীপ, সমরেন্দ্রর বাড়ি বর্ধমান শহরেই। ওরা খেয়েদেয়ে চলে গেল। সিক্তা একটু অবাক হল শুনে ওদের কারোরই নাকি অতনুর বাড়ি থেকে যাওয়ার কথা হয়নি। কারণ বিশাল সিলেবাস, টার্ম পেপার, সামনে পরীক্ষা। বাকিরা বিদায় নিতে সিক্তার মুখখানা আরও ভাবিত হয়ে উঠল।

‘কী ভাবছ? এখন নাটকে কনসেনট্রেট করো সিক্তা। আরে কৃষাণু রায়ের বান্ধবীর চিন্তা কীসের? এই তোরা বেশি রাত করিস না। সিক্তা, রেবতীর ঘরে একা শুতে ভয় করবে না তো? বোনটা আজই মাসির বাড়ি গেল।’ কথাগুলো বলে অতনু স্নানঘরে ঢুকে গেল ব্রাশ মুখে।

কৃষাণু কী চমৎকার বিন্দাস থাকতে পারে! পাশের ঘরে অতনুদার সঙ্গে তার হাসিমশকরার শব্দ একটু পরেই স্তিমিত হয়ে এল। অতনুদার নাক ডাকছে। সিক্তার ঘুম আসছিল না। বান্ধবের কথায় নেচে এসব নাটক ফাটক নিয়ে মাতা কি উচিত হল? বাড়ি না গেলে কিছুতেই হোস্টেলে পড়াশুনো করতে পারে না সিক্তা। অনেককেই দেখেছে নিরুপদ্রবে দল বেঁধে পড়বে বলে টানা ছুটির দিনগুলোতেও হোস্টেলে থেকে যায়। এপাশ ওপাশ করতে করতে চোখে তন্দ্রা লেগে গিয়েছিল কখন– গায়ে একটা স্পর্শে চমকে জেগে উঠল।

‘ঘুমোসনি?’ কৃষাণুর মৃদু গলার প্রশ্ন।

‘আসছে না। নিজের জায়গা ছাড়া অস্বস্তি হয়। তুই মশারি খুলে মাথা অর্ধেকটা ঢুকিয়েছিস? মশা কামড়াবে যে আমায়। কী করছিস? ওই ঘরে যা, কেউ দেখে ফেললে উলটোপালটা ভাববে।’

‘কে দেখবে? শুনছিস না, অতনুদার নাসিকা গর্জন। ওই আওয়াজে কারও ঘুম হয়? তাই তো এ ঘরে এলাম দেখতে ম্যাডাম নিদ্রিত না জাগ্রত।’

‘আমার অনেক পড়া বাকি। নাটকটা মঞ্চস্থ হওয়ার আগে সেদিকে মন দিতে পারব না। জিএম স্যার এমনিতেই আমাদের ওপর খচা। তার ওপর রেজাল্ট খারাপ হলে…। এসকে-র সঙ্গে টাএ, আর তার রিপার্কেশন পড়বে আমাদের ওপর। এই মশা ঢুকবে কিন্তু। ও ঘরে যা না।’

‘বাবা! এমন করে তাড়িয়ে দিচ্ছিস? এবার মশা ঢোকার রাস্তা বন্ধ।’ কৃষাণু পুরোপুরি খাটে উঠে মশারি গুঁজে দিল।

‘ও কী?’ সিক্তা আঁতকে উঠল। ‘এই বিছানায় ঢুকলি কেন? প্লিজ…। এ ঘরে কেউ দেখে ফেললে খুব খারাপ হবে। আমারও তো ঘুম আসছে না। আমি কি অন্য ঘরে হানা দিয়েছি?’

‘অতনুদার মা বাবা দোতলায়। অতনুদার ঘুম বিউগল বাজালেও ভাঙবে না। এক কাজ করি চ। দালানের সিঁড়িতে বসি। উঠোনে চমৎকার জোছনা।’

অগত্যা। সিঁড়িতে বসে সিক্তার হাত ধরে ইকিড়মিকিড় খেলছে কৃষাণু। হাতের আঙুল কখনও কখনও ম্যাও মারতে গেলাম ভঙ্গিতে ওপর নীচ করছে। অস্বস্তি আর ভালোলাগা নিয়ে একটু আড়ষ্ট হয়েও নিজেকে ছেড়ে রেখেছে সিক্তা। বাধ সাধল মশা। ‘বাপরে! এখানে বসা যায় নাকি? ম্যালেরিয়া ডেঙ্গু চিকুনগুনিয়া সব একসাথে ধরবে। আমি ঘরে যাচ্ছি।’

হাত ধরে টেনে নিজের কাছে বসাতে গেল কৃষাণু। সিক্তা প্রায় হুমড়ি খেয়ে ওর কোলের ওপর পড়ল। গালে মুখ চেপে কৃষাণু বলল, ‘বাড়িতে জানিয়েছিস?’

‘কী জানাব?’ কথাটায় একটু নাড়া খেল সিক্তা। সঙ্গে শিরশিরানি।

‘যার জন্য কিছুদিন মেলামেশার পরেই মেয়েরা প্যানপ্যান করতে থাকে। সারাজীবন কি এভাবে খোলা বারান্দায় মশার কামড় খাব নাকি? মশারিতে ঢোকার পারমিশনটা চাই তো? লিগাল পারমিশন।’

কৃষাণুর মধ্যে বামপন্থী রাজনৈতিক বিশ্বাসের পাশাপাশি একটা প্রতিষ্ঠান বিরোধী প্রবণতাও ফুটে ওঠে প্রায়ই। যেন প্রচলিত সব কিছু বোগাস, প্রথা ভাঙাই বীরত্ব। সংস্কারকে গুঁড়িয়ে ফেলার নামই প্রগতি। সংস্কারটা ভালো না মন্দ জানার দরকার নেই। আধুনিক এক মহিলা কবির একটা কবিতা প্রায়ই শোনায়– ‘বেশ করি নিশিক্লাবে যাই বেশ করি আমি মাল খাই বেশ করি রাত করে ফিরি এসব ছাড়পত্র বুঝি তোর? মনে ক্লেদ পেশি ভরা জোর যখন তখন পশুগিরি? পাঁচ বছরের কচি মেয়ে কাঁদে মাকে দেখতে না পেয়ে বিক্ষত কেন তার শ্রোণী? সেও কি পেশায় মেতে আছে? ইশারায় ডেকেছিল কাছে? অস্ত্রে শান পড়ল যখনই?’ শেষ অনুচ্ছেদের প্রশ্নটার চাইতে প্রথম লাইনকটার দৃপ্ত ঘোষণা কৃষাণুকে বেশি আকর্ষণ করে বোঝা যায়। ওই সোচ্চার ঘোষণার মধ্যে যে ক্ষোভ লুকিয়ে আছে বিনা প্ররোচনাতেও লালসার শিকার হওয়ার প্রতি, সেটা কি বোঝে না? যেন সিক্তার মদে প্রবল বিরাগ, সিগারেটের গন্ধে এলার্জি– মানে সে যথেষ্ট সাহসি নয়।

এক সময় এই দলের দাদা-দিদিরাই ছাত্রীদের জন্য শালীনতার নানা সীমানা বেঁধে দিয়েছিল। ক্যাম্পাসের বক্তৃতায় প্রায়ই শোনা যেত ‘অপসংস্কৃতি’ শব্দটা। তখন ‘চোলিকে পিছে’ও ছিল অপসংস্কৃতি, ‘দূরদর্শনের পাঁচটি নতুন চ্যানেল যেন চেতনার বুকে ছুরিকাঘাত’। আজ তো ‘ছত্রাক’ ও সংস্কৃতির অঙ্গ কারণ কেবল আর ইন্টারনেটে ব্যাক্টিরিয়া, ভাইরাস, প্রোটোজোয়া’দের অবাধ বিস্তার। যে-ছেলেটা বান্ধবীকে কথায় কথায় শোনায়, ‘তুই যথেষ্ট বোহেমিয়ান নোস। আমার সাথে তাল মেলাতে গেলে কিন্তু প্রথা ভেঙে ছুটতে হবে। টিভি সিরিয়ালের ঘোমটা টানা বহুরানি, শাঁখা নোয়া চুড়ির জবরজং আমার পোষাবে না। বুক ফুলিয়ে বলতে পারা চাই আমি একে ভালোবাসি, এর সঙ্গে থাকব, কার বাপের কী?’– তার সাথে সম্পর্ক চাইলেও, মুখ ফুটে সমাজ স্বীকৃত চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের কথা তাই কোনওদিন বলতে পারেনি সিক্তা, পাছে বন্ধুত্বটাও হাতছাড়া হয়। আড়ালে আবডালে কৃষাণুর খাইখাই আদরটায় উত্যক্ত হয়েছে যত, উত্তপ্ত হয়েছে তার চেয়ে ঢের বেশি। কিন্তু সীমা ছাড়ানোটার ব্যাপারটা যেন বৈধতার শর্তেই আটকে থেকেছে। যার ফলে শুনেছে ‘তুই টিপিক্যাল মিডলক্লাস গাঁইয়া, এই, ওই, সেই’। সেই ছেলের মুখে আজ এ কী কথা? ভেতরটা অদ্ভুত ভালোলাগায় কেঁপে উঠল।

আর একটু নিশ্চিত হওয়ার জন্য প্রশ্ন করল, ‘লিগাল পারমিশন মানে? কাগজে কলমে সাক্ষী রেখে পরস্পরকে পার্টনার হিসাবে গ্রহণ?’

‘শুধু কাগজ কলম কেন, তোর আমার বাড়িতে চাইলে প্যাঁপ্যাঁপ্যাঁপ্যাঁ– প্যাঁপ্যাঁপ্যাঁ– প্যাঁ– ’

এই চিরকালীন বহু ঘটিত ব্যাপারটা, পৃথিবীর কত স্ত্রী পুরুষই তো করেছে, কেউ নিজের পছন্দে কেউ অন্যের কথায়। কেউ স্বেচ্ছায়, কেউ বাধ্য হয়ে। কিন্তু কৃষাণুর সঙ্গে মিশে সিক্তাও দায়বন্ধনহীন সহবাস কিংবা বিচ্ছেদকে নিজের প্রেমের নিয়তি হিসাবে ধরে নিয়ে অহরহ একটা অস্বস্তিতেই থাকে। বাড়িতে কী বলবে? মা, ‘আমি একজনের সঙ্গে লিভ টুগেদার করতে চাই!’ কীভাবে বলবে? আর বাবাকে? সেই প্রতিষ্ঠান বিরোধী মানুষের মুখে এই সেকেলে ব্যপারটার উল্লেখই এক অদ্ভুত শিহরণ সৃষ্টি করছে।

‘কী বললে? আবার বলো?’

কৃষাণু সিক্তাকে গাঢ়ভাবে আলিঙ্গন করে ঠোঁটদুটোকে যেন শুষে নিতে লাগল। আধ মিনিট পর বাঁধন আলগা করে বলল, ‘মশার কামড়ে আপাতত এই টুকুই। বাকিটা লাইসেন্স পেলে উসুল করে নেব। ভেবে দেখলাম, তোকে ছাড়া থাকা সম্ভব নয়। পুরোপুরি এবং পাকাপাকি ভাবে পেতে যদি রেজিস্ট্রারের সামনে শপথ নিতে হয় নেব, যদি মাথায় টোপরও পরতে হয় তো তাই সই। কিন্তু তোকেই চাই। এবার যা, বর কনের কারও ডেঙ্গু হলে সব ফুটুস। আপাতত নাটকটাও নামানো দরকার। আমি অতনুদার নাকডাকা শুনি। তুই একটু ঘুমোনোর চেষ্টা কর।’

আর ঘুম? দু চোখে অত স্বপ্ন জড়ো হলে কি ঘুম আসে? নিজের কানকে বিশ্বাস হচ্ছিল না। অথচ অবিশ্বাসের কিছু নেই। পৃথিবীতে ওরাই প্রথম ভালোবেসে বিয়ে করতে চলছে না। লাইসেন্স পেলে উসুল করার কথাটা মনে পড়লে শিরদাঁড়া দিয়ে একটা শিরশিরে স্রোত বয়ে যাচ্ছে। গালে ঘাড়ে ঠোঁটে কৃষাণুর আদর, শরীরের আনাচ-কানাচ অভিমুখী হাতের স্পর্শ হঠাৎ একটা অনুচ্চারিত শব্দে অমৃত হয়ে গেল– বিয়ে। কারণ কৃষাণু ওকেই চায়। কিন্তু সত্যিই শেষ রক্ষা হবে তো?

নাটক পর্ব অতিক্রান্ত। কুশীলবদের অভিনয় সহ গোটা প্রযোজনাটাই বেশ প্রশংসিত হল। কদিন কিছু ক্লাস কামাই হলেও অনুমতিক্রমে উপস্থিতির খাতায় ওদের হাজিরার রেকর্ড আছে। কিন্তু অনেকদিন না পড়ায় অনেক কিছু বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে। বাণিজ্য অর্থনীতির ছদ্মবেশে গাদা গাদা ক্যালকুলাস খাঁড়ার মতো ডিফারেন্সিয়েশন, ইন্টিগ্রেশন, লিমিট, ডট ডট ইত্যাদি বাগিয়ে ঘাপটি মেরে আছে কে জানত? এইসব আঙ্কিক দংশন থেকে মুক্তি পেতেই তো বিজ্ঞান নিয়ে উচ্চমাধ্যমিক পাস করার পর ইংরিজিতে অনার্স নিয়েছিল সিক্তা। আবার ওই কিম্ভূত চিহ্নগুলোর খপ্পরে পড়তে হল? পড়ায় ক্ষতিপূরণের জন্য এখন এর তার শরণাপন্ন হতে হচ্ছে। কৃষাণুর কাছে কাজের চেয়ে অকাজ হয় বেশি, যার জেরে রাত জেগে পড়া আর রাতের ঘুম দুটোই ভোগে যায়।

এরই মধ্যে কেন্দ্রীয় সরকারের সন্ত্রাস দমন নীতির বিরুদ্ধে ভারতের কোণে কোণে ছাত্রদের বিক্ষোভ। কৃষাণু ব্যস্ত হয়ে পড়ল মিটিং মিছিল পরিচালনায়। সিক্তাকেও যখন তখন ক্লাস কামাই করিয়ে নিয়ে যায়। উত্তপ্ত বক্তৃতা পড়ে মতামত চায়। সিক্তা বলল, ‘আর সময় নেই। সামনেই শীতের ছুটি, মোটে সাত দিনের। এখনই বন্ধুদের কাছ থেকে যা কালেক্ট করার করে নিতে হবে। ছুটিতে কাউকে পাব না। ছুটির পরেই পরীক্ষা। আমি অত ব্রেইনি নই। অলরেডি নাটকের জন্য পিছিয়ে গেছি। আর মিছিলে পথনাটিকায় পার্টিসিপেট করতে পারব না।’

‘এত সেলফিশ কেন তুই? শুধু নিজের কথা ভাবছিস? যাদের দেশদ্রোহী স্ট্যাম্প দিয়ে অ্যারেস্ট করা হল, যারা নিজভূমে পরবাসী হয়ে ইন্ডিয়ান আর্মির হাতে শহিদ হচ্ছে তাদের কথা ভাববি না?’

‘একটা কথা বলে রাখি। তোর সঙ্গে সারা জীবন কাটাতে চাই বলে তোর বিচিত্র রাজনৈতিক স্ট্যান্ডকেও অ্যাকসেপ্ট করে নেব ভাবিস না। ইডিওলজিকালি আমি এই আজাদির আন্দোলন, অ্যান্টি ইন্ডিয়ান স্লোগান শাউটিং কোনওটাই সমর্থন করছি না। আমাদের দেশের সরকার যারা চালায় তাদের হয়তো অনেক দোষ আছে, অনেক ভুল নীতিও আছে আমাদের সংবিধানে। নর্থ-ইস্টে সেনা যা করে তার নিশ্চই প্রতিকার হওয়া দরকার। কিন্তু সেগুলো রেকটিফাই করার পদ্ধতি শত্রু দেশগুলোর ষড়যন্ত্রে কি সন্ত্রাসে মদত দেওয়া নয়? দ্যাখ বলতে গেলে অনেক তর্ক হবে। আমি শুধু বলতে চাই, যে মিশনটা আমি সাপোর্টই করি না, তার জন্য নিজের শ্রম, সময়, পড়াশোনা নষ্ট করব কেন? তুই এই নিয়ে স্টুডেন্টদের খ্যাপাচ্ছিস খ্যাপা, আমার পছন্দ না হলেও তোকে তো বাধা দিচ্ছি না। আমাকেও জোর করিস না।’

‘পথনাটিকায় অভিনয় না করিস, অ্যাটলিস্ট প্রসেশনে চল।’

‘কেন ভিড় বাড়াতে? স্যরি।’

‘ভুলে যাস না, তুই কিন্তু এখনও ফিফ্থ ইয়ার। আমি এখন তোর ক্লাসমেট হলেও তোর চেয়ে সিনিয়র, তিন বছর গোলাপবাগে আছি। তোকে সারদা হোস্টেলে পার্মানেন্ট বোর্ডার করেছি কিন্তু আমিই।’

‘ভয় দেখাচ্ছিস? তোদের জুলুমবাজিতে এসে অবধি প্রায় দিন মিটিং, মিছিলে হাজির থাকতে হয়েছে। আমাদের হোস্টেলের মেস কমিটি কিন্তু বলেছে যাদের ছুটির পরেই পরীক্ষা তাদের মিছিলে যাওয়া বাধ্যতামূলক নয়।’

‘শেষবারের মতো জানতে চাইছি। যাবি কিনা?’

‘আমায় ছেড়ে দে কৃষাণু। আমি পারব না। শরীরটাও ভালো নেই। গলায় কষ্ট হচ্ছে। গা ম্যাজম্যাজ করছে।’

‘গা ম্যাজম্যাজানির টনিক আমি জানি। একটু ফিজিওথেরাপিতে ফ্রেশ হয়ে যাবি।’

‘প্লিজ আমায় জোর করিস না।’

‘তোর ওপর আমার এটুকু জোর নেই? তাহলে আজ এখানেই বাইবাই বলি?’

প্রথমে কথাটা বুঝতে পারেনি সিক্তা। বোঝার পরও ভাবল রাগের মাথায় বলছে। পালটা রাগ দেখিয়ে বলল, ‘তোর খুশি’। কিন্তু মনে খচখচানি নিয়ে হোস্টেলে ফিরল।

পরেরদিন শনিবার। সিক্তা ব্যাগপত্তর নিয়ে ক্লাসে। শেষ ক্লাসটা শেষ হতেই স্টেশন ছুটবে। কতদিন পরে বাড়ি যাচ্ছে! সাত দিনের ছুটি, আর বিরাট পাঠ্যসূচি। গতকালের খচখচানি নিয়ে কৃষাণুকে খুঁজল। রিডিং রুমে অয়নদের সঙ্গে হেসে হেসে গল্প করছে। একবার চোখাচোখি হল। আবার তাকিয়ে দেখে কৃষাণু নেই। ক্লাসে ঢুকেও কথা নেই। সিক্তার কথার জবাব দিল না। ছুটির আমেজে বেশিরভাগ ক্লাস হল না। কৃষাণুও বিকেলে ছুটি পর্যন্ত সিক্তাকে যেন দেখতেই পেল না।

গোলাপবাগ থেকে যখন স্টেশনগামী বাসে চড়ল, তখন চোখ ছাপিয়ে জল আসছে। মাত্র দু’দিন আগে যে পাকাপাকি গাঁটছড়ার কথা বাড়িতে জানানোর প্রস্তাব দেয়, প্রেয়সীকে পাওয়ার জন্য ছটফট করে, এতটাই ছটফটানি যে এখনও সিক্তার শরীরে কৃষাণুর নিশ্বাসের উত্তাপ লেগে আছে, আজ সেই মানুষটার চাওনি মরা মাছের মতো অভিব্যক্তিহীন হয়ে গেল? ব্যক্তিগত সম্পর্কের চেয়ে রাজনৈতিক অবস্থানটাই বড়ো হয়ে গেল? বিয়ে সংসার বন্ধন সবই সাময়িক আবেগ, আজাদিটাই সত্যি?

পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য যেখানে মনে হচ্ছিল সাত দিনের বদলে মাস খানেক ছুটি পেলে ভালো হতো, সেখানে বই হাতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অন্যমনস্ক কেটে যাচ্ছে, রাত জেগে যত না পড়া হচ্ছে বালিশ ভিজছে তার দশগুন। কৃষাণু ফোন করা তো দূর, ধরেওনি, মিস্ড কল দেখে ফিরতি কল করেনি। এমনকী ফেসবুক কি হোয়াটস্অ্যাপে জাগ্রত থাকলেও নীরব থেকেছে। সিক্তার সেই প্রথম মনে হল কবে ছুটি শেষ হবে। একবার মনে হয়, এই যে মান খুইয়ে একতরফা যোগাযোগের চেষ্টা করে প্রত্যাখ্যাত হল, মুখোমুখি হলে পালটা উপেক্ষা দেখিয়ে প্রতিশোধ তো নিতে হবে। আবার কখনও সেই অসম্পূর্ণ উষ্ণ মুহূর্তগুলো হ্যাংলার মতো আবার ফিরে পেতে ইচ্ছে করে। হে ঈশ্বর! কী ভাবে সময় নষ্ট করছে মেয়েটা? প্রথম সেমেস্টার উৎরোবে তো?

পরীক্ষার পর সবাই হইহই করে সিনেমা দেখতে গেল। সঙঘমিত্রা, ভাস্বতী, মৃণালরা বলল সঙ্গে যেতে। কিন্তু সিক্তা যার সঙ্গের অপেক্ষায়, সে অন্য বন্ধুদের সাথে সিনেমা দেখে এসেছে শুনে পা থেকে মাথা টলে গেল। শরীর ভালো লাগছে না বলে হোস্টেলে ফিরে বিছানায় শুয়ে রইল। রুমমেট রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মৃন্ময়ী সন্ধে থেকে লক্ষ্য করে রাতে মাথায় হাত বুলিয়ে গালে গাল রেখে বলল, ‘জানি ভুলে যা বললেই ভোলা সম্ভব নয়, তবু মনে হয় তোর সেটাই করা উচিত। কৃষাণুদার জীবনে তুই প্রথম নোস, দ্বিতীয়ও নোস। ওই মারকাটারি চেহারা আর পারসোনালিটি নিয়ে গত তিন বছরে এ রকম অনেককেই কাঁদিয়েছে। কলেজে পড়তেও। আমিও তো সিটি কলেজেই পড়তাম না।’

‘আগে বলিসনি কেন?’

‘বললেই কি তুই শুনতিস? তাছাড়া ওকে যারা চেনে আমাদের সিনিয়রদের কেউ কেউ বলছিল, কৃষাণুর নৌকা তাহলে এই ঘাটে পাকাপাকি নোঙর করল। ওদের মনে হয়েছিল তুইই শেষতম। আমারও তাই মনে হতো, আর তোকেও বেশ খুশি খুশি দেখাত।’

‘একটু আধটু আমিও শুনেছিলাম। ও তো দুঃখ করত ওর কোনও রিলেশন টেকেনি। তাই আমাকে ভীষণ ভাবে আঁকড়ে ধরেছিল। এমনকী বিয়েতে বিশ্বাস না করলেও নাটকের ঠিক আগেটায় আমায় বিয়ের প্রস্তাবও দেয়। দু দিনের মধ্যে একটা তুচ্ছ ব্যাপারকে অজুহাত করে…। নিজে না ঠকলে, মনের ভেতর থেকে চাড় না এলে অন্যের কাউন্সেলিং-এ মোহ থেকে সরে আসা মুশকিল রে!’ আবার গলা ধরে এল। ‘আই স্টিল বিলিভ ও জেদের বশে নিজেকেও শাস্তি দিচ্ছে। ইফ নট মি, ইটস্ নান।’

‘কেঁদে নে, কেঁদে হালকা হ।’

মাস ছয়েক ধরে তারা রুমমেট। কিন্তু আজ প্রথম মৃন্ময়ীকে ভীষণ ভালো বন্ধু মনে হল। একটা বিছানা খালি পড়ে রইল। শীতের রাতে একই কম্বলের তলায় পরস্পরের শরীরের ওম্ ভাগাভাগি করে দুই বন্ধু ঘুমিয়ে পড়ল।

ফেব্রুয়ারির গোড়ায় সেমিনার। বিজ্ঞাপন যোগাড়, ডেলিগেট আহ্বান, অতিথি আমন্ত্রণের প্রস্তুতি পুজোর পর থেকেই শুরু হয়ে গিয়েছিল। সিক্তাও কোনও একটি কমিটির সদস্য, তবে তার বিশেষ কাজ নেই। থাকলে এই একঘেয়ে ছিঁচকাদুনে জ্বালা ভুলে থাকা যেত। বদলে, বিভাগের অনেক ছাত্র, সহপাঠী থেকে সিনিয়র তার হাফ-সোল খাওয়া নিয়ে টিটকিরি দিচ্ছে, ‘বিরহিণী রাধার কোনও কাজে মন নেই।’ কৃষাণু দারুণ ব্যস্ত, সদা হাস্যময়। সম্পর্ক ব্যাপারটাই ছেলেদের কাছে ছেলেখেলা। গভীর ভাবে জড়িয়ে পড়া, তাই নিয়ে কষ্ট পাওয়া এইসব মেয়েলি ন্যাকামি। ‘স্টে কু-ল’ হল এই যুগের মন্ত্র, জীবন যেভাবে আসবে তাকে সেইভাবে নাও। যতদিন ভালো লাগবে ততদিন থাকো, তারপর গা ঝাড়া দাও। আবার কিছু প্রত্যাখ্যাত প্রার্থী আনন্দে ফুটছে ভেতর ভেতর। বস কেটে গেছে এবার বুঝি তাদের পালা। কার কপালে সিকে ছেঁড়ে, সেটাই দেখার। এসএমএস থেকে ফেসবুক, হোয়াটস্অ্যাপে বার্তার ছড়াছড়ি। কেউ বা নতুন বান্ধবী জুটিয়ে হিংস্র আনন্দে– বেশ হয়েছে!

সেমিনারের দ্বিতীয় দিন রাতের খাওয়ার পর সিক্তা একা একা খোলা আকাশের নীচে দাঁড়িয়েছিল। ভেতরের হইচই আর মশকরা ভালো লাগছিল না। হঠাৎ পেছন থেকে একটা গরম কোট কে চাপিয়ে দিল। চমকে ফিরে তাকাতেই দেখে কৃষাণু! ‘তোর না ঠান্ডা লাগার ধাত। শিশির পড়ছে, এভাবে বাইরে দাঁড়িয়ে আছিস যে? ভাস্বতীদের হলে হোস্টেলে চলে যাস। ততক্ষণ ভেতরে বোস।’

বিহ্বলতা কাটিয়ে বলতে গেল, ‘তাতে তোর কী?’– কিন্তু গলা বুঁজে এল। নাটকের মহড়ার সময় সিক্তা গলা আর নাক নিয়ে বেশ নাকাল থাকত। মশার ধূপ, ঠান্ডা, সিগারেটের ধোঁয়া সবেতেই অ্যালার্জি। বেশি কথা বললেও কষ্ট। তাই নিয়ে কৃষাণু পেছনে লাগত, আর উপদেশ দিত, ‘সব তোর ম্যানিয়া, মুক্ত হয়ে বাঁচ, দেখবি সব রোগ পালিয়েছে।’ ওর মনে আছে? মানে মনে রেখেছে? তার আর মনে হচ্ছে না ঠান্ডার ভয়টা সিক্তার বাতিক? উলটে নিজের ব্লেজার সিক্তার গায়ে চালিয়ে দিল! আর সবার মধ্যে থেকেও লক্ষ্য করেছে সিক্তা ম্যারাপ বা ডিপার্টমেন্ট কোথাও নেই, বাইরে অন্ধকারে একা?

এই চোখের জল মস্ত বিড়ম্বনার বস্তু। এই অবস্থায় সবার মাঝে গিয়ে বসে কী করে? চুপচাপ কৃষাণুকে অনুসরণ করে ভেতরে ঢুকেও নির্জনতার খোঁজ। কৃষাণু ওকে রেখে আবার হইহুল্লোড়ের মধ্যে ফিরে গেল। একান্তে পেয়েও সিক্তার কাছে থাকল না, কথাও বলল না আর। ও শুধু দয়া দেখাতে এসেছিল? ব্লেজারটা খুলে তনয়ের হাতে দিয়ে বলল, ‘কৃষাণুকে দিয়ে দিস।’ তারপর সোজা জ্যোৎস্নার আলোয় গাছগাছালির আলো-আঁধারির ভেতর দিয়ে, দু বছর আগে যেখানে এক ছাত্রীর অচৈতন্য ক্ষত-বিক্ষত দেহ পাওয়া গিয়েছিল, তারাবাগ গোলাপবাগের মধ্যেকার সেই কাঠের সেতু পেরিয়ে একাই হোস্টেলে পৌঁছে গেল।

গেটপাস ভাস্বতীদের কাছে। দারোয়ান ভূত দেখার মতো অবাক হলেও সিক্তার উদ্ভ্রান্ত রূপ দেখে দরজা খুলে দিল। সিক্তা তিনতলায় ওর ঘরে ছুটল। ওর এখন অনেক অনেক কান্না বাকি আছে। আজ মৃন্ময়ী নেই। ভালোই হয়েছে। যে যন্ত্রণার সান্ত্বনা হয় না, সে একাকিত্বই খোঁজে।

পরের দিন রাজবাটী থেকে হেঁটে ফেরার পথে একটা রিক্শার দিকে চোখ পড়তে থমকে যেতে হল। বুকে ছুরি মারলেও বুঝি কম যন্ত্রণা হতো। কৃষাণুর পাশে মৃন্ময়ী। দুজনের তন্ময়তা একটাই সম্পর্ক সূচিত করে। আগুন সর্বভুক, আর পিঁপড়ের পাখা গজানোই নিয়তি।

সোনা মামিমার গল্প

স্বর্ণলতা সোনা মামিমার ভালো নাম। ডাকনাম সোনা। উনি আমার মামার প্রথম পক্ষের স্ত্রী। কেউ বলে, স্বর্ণলতা থেকে ছোটো করে সোনা হয়েছে। আবার কেউ বলে, কাঁচা সোনার মতো গায়ের রঙের জন্য এই নাম শ্বশুরবাড়ির লোকেরা দিয়েছে। মামিমা মানুষ হিসেবে খুব ভালো। আমাদের খুব ভালোবাসতেন। বছরে অন্তত একবার আমাদের বাড়ি আসতেনই। আর সেই দিনগুলো ছিল, বিশেষ করে আমার কাছে খুব মজার– মহা আনন্দের।

মামিমার বাপের বাড়ি কলকাতার শোভাবাজারে। আমার মায়ের বাড়ি কিন্তু অজপাড়াগাঁ। বাস থেকে নেমে হয় গরুর গাড়ি, নয়তো পালকিতে চেপে যেতে হতো প্রায় পাঁচ মাইল। মাঝে পড়ে নদী। নদীর ওপারে বনের প্রান্ত ঘেঁষা গ্রাম। নাম মধুবন। বন-প্রকৃতির কোলে আদরের দুলালির মতো গ্রামটি। মনকাড়া এখানের প্রাকৃতিক শোভা।

তবে প্রকৃতিপ্রেমিক বা কবি-সাহিত্যিকদের মন কেড়ে নিলেও, কলকাতার মানুষের পক্ষে এই বিভুঁইয়ে এসে মানিয়ে নেওয়া প্রায় অসম্ভব। আমারই মাঝে মাঝে ভালো লাগত না। মায়ের সাথে গেলেও বাড়ি ফেরার জন্য মন কাঁদত। মায়ের তো বাপের বাড়ি, জন্মভূমি। তার ভালো লাগলেও আমার কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগত। থাকতে মন চাইত না।

সোনা মামিমার ক্ষেত্রে ঘটে ছিল তাই। মামিমা কলকাতার মানুষ। শৈশব-কৈশোর কাটিয়ে ষোলোয় পা দিয়েই এসে পড়েন মামা বাড়ির কুলবধূ রূপে মধুবনে। সে এক ইতিহাস। মায়ের মুখে শোনা ওই চমকপ্রদ ঘটনা।

গ্রামের মধ্যে সবচেয়ে ধনীর বাড়ি। ছেলে শিক্ষিত। চাকুরে। এসব দেখেই মামিমার বাবা গণ্ডগ্রাম হওয়া সত্ত্বেও এখানে মেয়ের বিয়ে দিয়েছিলেন। প্রথমবার যখন বধূবেশে মামিমা এবাড়িতে পা দেন তখন তো হইচই, লোকজনে ভরা শ্বশুরবাড়ি তাঁর মন্দ লাগেনি। কিন্তু অষ্টমঙ্গলার পর বিপরীত ছবি। সব ফাঁকা ফাঁকা লাগে তাঁর। মন বসে না কোনওকিছুতেই। বাড়ির একমাত্র বউ মামিমা। শ্বশুর, শাশুড়ি আর স্বামী নিয়ে তাঁর ছোট্ট সংসার। তার উপর স্বামী সারাদিন থাকে বাইরে। মধুবন থেকে অনেকখানি দূরে তার চাকরিস্থল। ফিরতে ফিরতে হয় সন্ধে।

পাড়াপড়শির বাড়িতে বেড়াতে যাবার চল তেমন ছিল না। সিনেমা দেখতে গেলেও অনেক কাঠ খড় পোড়াতে হতো। সারা দিন শাশুড়ি আর বউ। এছাড়া জনা কতক মুনিশ-মানদার। আর বাড়ির পুরোনো ঝি মানদা। তবে আমার মা যখন বাপের বাড়ি যেত, সে সব দিনগুলো মামিমার খুব আনন্দে কাটত। কিন্তু তা তো বছরে মাত্র একবার কি দু’বার।

দিনের বেলা যদিও বা হইচই হাসি আনন্দে কেটে যেত, সন্ধের পর থেকে মামিমার একা একা খুব কষ্ট হতো। বাড়ির পিছনের পুকুর পাড়ের বাঁশ-ঝাড় থেকে মাঝে মাঝে শিয়াল ডেকে উঠত। তার সঙ্গে প্যাঁচা আর ঝিঁঝির ডাক। ফলে মামিমার শ্বশুরবাড়িতে মন টিকত না। বাপের বাড়ি গেলে আর আসতে চাইতেন না।

মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে তেমন মন নেই তার একটাই কারণ, মেয়ে ভয় পায়। এমন অজপাড়াগাঁয়ে থাকা তার পক্ষে দুরূহ। মামা আনতে গেলে, এবার থাক না, আর ক’টা দিন যাক তারপরে যাবে বলে মামিমার বাবা মামাকে দু’একবার ঘুরিয়েও দেন। দাদুর রাগ হয়। কড়া ভাষায় বেয়াইকে পত্র দেন।

– যদি আপনার মেয়েকে না পাঠান তাহলে আবার ছেলের বিয়ে দেবার কথা ভাবব।

পত্র পেয়েই মামিমার বাবা তখন নিজে এসে দাদুকে অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে অনুরোধ করেন– আপনি যদি মাসে একবার অন্তত মেয়েকে দিন দুয়ের জন্যও বাপের বাড়ি যাবার অনুমতি দেন তাহলে আমাদের পাঠাতে কোনও বাধা নেই। আসলে শহরে মানুষ তো, তাই একটু অসুবিধে হচ্ছে। বিশেষ করে সন্ধ্যার দিকে ভয় পায়। পরে পরে অবশ্য সব ঠিক হয়ে যাবে।

– ঠিক আছে। আমি বউমার কাছে দিন-রাতের জন্য একজন কাজের মেয়ে রাখার ব্যবস্থা করে দেব। আপনারা মেয়ে পাঠিয়ে দিন। নচেৎ ছেলের বিয়ে দিতে বাধ্য হব।

কতকটা মনমরা হয়েই মামিমা আসেন শ্বশুরবাড়িতে। দাদু কিন্তু তার কথার খেলাপ করেননি। একজন দাসীর বন্দোবস্ত করে দিয়েছিলেন। তবে সেই মেয়ের সঙ্গে কি গল্পই বা করবে মামিমা? গ্রামের মানুষের গল্প বলতে তো চোর-ডাকাত, নয়তো ভূত-পেত্নি। এতে মামিমার ভয় আরও বেড়ে যেতে থাকে।

সেবার দু’দুটি ঘটনা মামিমার শ্বশুরবাড়িতে থাকার বাধা হয়ে দাঁড়ায়। বলতে দ্বিধা নেই, মামিমার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়।

দিদিমা, মামিমাকে খুব ভালোবাসতেন। তবে বেশিক্ষণ সময় দিতে পারতেন না। মাঝে মাঝে সন্ধ্যার পর মামিমাকে নিয়ে ছাদে উঠে হাঁটতেন। কখনও কখনও মাদুর পেতে বসে গল্প করতেন। পাশের বাড়ির রাঙা দিদিমাও এই আসরে কোনও কোনওদিন যোগ দিত। এতে মামিমারও খুব ভালো লাগত।

এরকম একদিন মামার আসতে দেরি দেখে দিদিমা মামিমাকে নিয়ে ছাদ থেকে মামা আসছেন কিনা দেখছিলেন। কিন্তু নীচের থেকে কারও ডাকে দিদিমা নেমে গেলে মামিমা দূরে বয়ে যাওয়া নদীর দিকে উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন। কারণ ওই পথেই তো মামা বাড়ি ফিরবেন।

নদীর ওই পাড়ে দিগন্তবিস্তৃত ধানখেত। আর এপারে মামাদের বিশাল আম বাগান। মামিমা জীবনে এত বড়ো আম বাগান দেখেননি। যখন আম ঝরানো হতো তখন ঝাঁকা ঝাঁকা আম আসত মামাদের বাড়িতে।

নদীর থেকে হঠাৎ সোনা মামিমার দৃষ্টি পড়ে আম বাগানে। পাশে দাঁড়িয়ে কাজের মেয়ে নন্দা। শুক্লপক্ষ চলছিল। তাই ছাদ থেকেও বাগানটিকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। সেই আলোতে মামিমা হঠাৎ দেখতে পান, একটি মেয়ে সাদা কাপড়ে সারা গা ঢেকে বাগানের ভিতরের দিকে দৌড়োচ্ছে। ওই দৃশ্য নন্দাকে দেখালে সে ভূত ভূত বলে চিৎকার করে মূর্ছা যায়। মামিমাও চোখ ঢেকে বসে পড়েন। কিন্তু দিদিমা এসে কোনও কিছুই দেখতে পাননি।

ঠিক এর দিন দুই পরে আরও একটি ঘটনা ঘটে মামিমার চোখের সামনে। এক বিরাট ডাকাতি হয় মামাদের পাশের বাড়িতে। দলটি নাকি চল্লিশ জনের। হাতে মশাল নিয়ে রণপা চেপে এসেছিল। প্রায় দু’ঘন্টা ধরে ডাকাতি করে সেই সাথে গৃহস্থকে মারধোর দিয়ে সর্বস্বান্ত করে দলটি চলে যায়।

এসব দেখে মামিমা কান্নাকাটি শুরু করেন। ফলে কয়েক দিনের জন্য মামিমাকে বাপের বাড়িতে রেখে আসতে হয়। তারপর থেকে মামিমা আর মধুবনে আসেননি। বাপের বাড়ির লোকেরাও আর পাঠাতে চায়নি। বিশেষ করে মামিমার বাবা তো মেয়ের নামে বেশ কিছু টাকা ও বসতবাড়ি সংলগ্ন একটি বাড়িও কিনে দিয়েছিলেন। তাই মামা আনতে গেলে উনি বলেন– মেয়ে যখন ওখানে থাকতেই পারবে না তখন আর জোর করে ওখানে পাঠাই কি করে বাবা? এখানেই থাক। নইলে কবে দেখব মেয়েটা ভয়ে মারাই গেছে।

সব জানার পর দাদু প্রায় জেদ নিয়ে সেই মাসেই মামার বিয়ে দেন। এ বিয়েতে নাকি মামার মত ছিল না। কিন্তু বাপের মুখের ওপর কথা বলার সাহস তখনকার ছেলেদের ছিল না। তাই বিয়েটিও হয়ে যায়। এরপর থেকে মামাবাড়ির সাথে যোগাযোগ উঠে যায় সোনা মামিমার। তবে দিদিমা যতদিন বেঁচে ছিলেন ততদিন নাকি সোনা বউয়ের জন্য কাঁদতেন। সে বউ এখনকার বউয়ের চেয়ে রূপেগুণে সব দিকেই সেরা ছিল তাঁর কাছে। মামাও বোধ হয় মামিমাকে একেবারে ভুলতে পারেননি।

নতুন মামিমার তিন ছেলের পর, একমাত্র মেয়ে পুষ্পদি। বড়ো ছেলে যে-বছর এম.এ. পড়ার জন্য কলকাতার কলেজে ভর্তি হয় সেবছরই মামা মারা যান। এরপর ওই ছেলেই সোনা মামিমার সাথে যোগাযোগ করে মামিমাকে জোর করে মাঝে মধ্যে বাড়িতে নিয়েও আসে। এখন বয়সের জন্যই হোক আর নিঃসন্তান বলেই হোক ছেলেদের কাছে থেকেও যেতেন কিছুদিন করে। সৎ ছেলেমেয়েদের ভালোবাসতেন খুব। ছেলেমেয়েরাও সোনামা বলতে অজ্ঞান। মা তো কাজ-যোগের বাড়ি হলে মামিমাকে আমাদের বাড়ি আনতে পাঠাতেন। উনি নিজেও বছরে একবার অন্তত আসতেন।

আমরা ছোটোরা যখন মামিমাকে দেখলাম তখন তিনি বিগত যৌবনা একজন বিধবা। তবে দুধে আলতা গায়ের রং তখনও মামিমাকে অন্যের থেকে আলাদা করে রেখেছে। পিঠ ভর্তি কালো চুল। মুখে একটা কমনীয় মাধুর্য।

শ্বশুরবাড়ি মামিমার এখন ভালো লাগে। তাছাড়া মধুবনের এখন অনেক উন্নতি হয়েছে।  গ্রামের পাশ দিয়ে পাকা রাস্তা। দিনে তিন চারটি বাস যাতায়াত করে। ঘরে ঘরে বিজলি বাতি। ল্যান্ড ফোনও এসেছে চার-পাঁচটি ঘরে।

মামার বড়ো ছেলের বিয়ে। কিছুদিন আগে একমাত্র মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে ধুমধাম করে, বড়ো ঘরে। সেবারও মামিমা এসেছিলেন। বেশ কয়েকভরি গয়না দিয়ে মেয়েকে আশীর্বাদ করেছিলেন। এবার এসেছেন মামার ছোটো ছেলের সাথে। বিয়েটা বেশ জাঁকজমক করেই হচ্ছে। আত্মীয় কুটুম্ব এসেছে প্রচুর। কেউ বাদ যায়নি। মায়ের বয়স হলেও মাকে নিয়ে আমরা গিয়েছি।

বিয়ের দিন বরযাত্রী সহ দাদা যখন যাত্রা করল রাত তখন প্রায় আটটা। বরযাত্রীরা বাসে আর দাদা ট্যাক্সিতে। পুষ্পদি-সহ আমরা মেয়েরা যাওয়ার জন্য বায়না ধরলেও, বড়োরা তা বাতিল করে দেয়। কারণ মেয়ের বাড়ি যাওয়ার পথে ভীষণ জয়পুরের জঙ্গল। অতএব রিস্ক নেওয়া উচিত নয়। বিফল মনোরথ হয়ে আমরা রয়ে গেলাম।

খাওয়াদাওয়ার পর রাতে পুষ্পদি সহ আমরা কয়েকজন সোনা মামিমার সাথে বৈঠকখানায় শুয়েছি। বাড়িতে পুরুষ বলতে কয়েকজন বুড়ো। মা-মামিরা সব ওপর ঘরে শুয়েছে। পুরুষের চেয়ে মেয়েরা সংখ্যায় বেশি। সারাদিন খাটাখাটনির জন্য অনেকেই ঘুমিয়ে পড়েছে। আমরা দু’চারজন তখনও জেগে। মামিমার মুখে গল্প শুনছি। আসলে মামিমা খুব জমিয়ে গল্প বলতে পারতেন। রাত বাড়ার সাথে সাথে গল্পও বেশ জমে উঠেছে। গল্প শোনার মাঝেই আমার একটু তন্দ্রা মতো এসেছিল, সেই সময়ই কানে এল ত্রাহি ত্রাহি চিৎকার।

– বাবা গো, মেরে ফেললে গো। কে আছো বাঁচাও।

জেগে উঠে বিছানায় বসলাম। বুঝতে অসুবিধা হল না যে আমাদের বাড়িতেই ডাকাত পড়েছে। ভয়ে কাঁপতে থাকি। কি হবে এবার? দেখি পুষ্পদি ভয়ে সোনা মামিমার কোলে মাথা গুঁজে বসে। বিয়ে বাড়ি বলে কথা। মেয়েদের সবারই গায়ে কিছু না কিছু গয়নাগাটি রয়েছে। বিশেষ করে পুষ্পদির গায়ে। ওর তো আবার নতুন বিয়ে হয়েছে। মামিমা মুহূর্তের মধ্যে সকলের গয়নাপত্তর খুলিয়ে নিয়ে কাপড়ে জড়িয়ে বৈঠকখানার দরজা একটু ফাঁক করে চারদিকে দেখেই ছুটে বেরিয়ে গেলেন। পুষ্পদি সাথে সাথে মামিমার নির্দেশমতো দরজা বন্ধ করে দিল। আসলে বৈঠকখানাটা ছিল বাড়ির একেবারে বাইরের দিকে। তাই হয়তো এই দুঃসাহসিক কাজটা করতে পারলেন মামিমা।

আমাদের তারস্বরে চিৎকার চ্যাঁচামেচির ফলে ডাকাত দলটি আর বৈঠকখানার দিকে এল না। তার উপর সারা পাড়া জেগে উঠেছে। ধরা পড়ার ভয়ে দলটি চম্পট দিল। কিন্তু যাবার সময় আশা মতো গয়নাগাটি আর টাকাকড়ি না পেয়ে অনেক আসবাবপত্র ভাঙচুর করে গেল। তবু নগদ টাকা, গয়নাপত্তর খুব কমও তো পায়নি। কেবল সোনা মামিমার সাহসিকতা আর বুদ্ধিমত্তার জন্য আমাদের, বিশেষ করে পুষ্পদির গায়ের বহুমূল্য অলংকারগুলি রক্ষা পেল।

পরের দিন সকালে সব ঘটনা জানাজানি হলে শুধু মামাবাড়িতে নয়, গোটা পাড়ায় আলোড়ন পড়ে গেল। ওই অন্ধকার রাতে পুকুর পাড়ে বাঁশবনের ঝোপে সোনা মামিমা একাকী রাত কাটালেন কী করে? ভাবতে আমারও দেহে শিহরণ জাগে। অথচ ওই বাঁশবনের পুকুরের ভয়ে মামিমা একদিন সংসার ছেড়ে ছিলেন। কেমন যেন রহস্যময়। তাইতো অনেকে প্রশংসা করলেও নিন্দুকেরা কটূক্তি করতে ছাড়ল না।

– এই সাহসের সিকিভাগ যদি দেখাত সেদিন, তাহলে তো আর এ বাড়ি ছাড়তে হতো না। মেয়ে কিনা ভয় পায়। নাকি বাপির বাড়িতে অন্য কিছু ছিল?

নিন্দুকেরা যাই বলুক, সেদিন আর এদিন যে অনেক তফাত, অনেকটা সময়, তা তারা বোঝে না।

তবে মামিমা এই নিন্দা বা প্রশংসার কোনওটিতেই কর্ণপাত করেননি। তিনি যা করেছেন ওই মুহূর্তে তাঁর যা মনে হয়েছে। ভালো মন্দ বিবেচনার সময় কোথায়?

– এ সব কথা তোমরা আর আমায় জিজ্ঞাসা কোরো না। ভগবানই আমাকে বুদ্ধি ও সাহস জুগিয়েছেন। নইলে কি পারতাম। সবই তাঁর ইচ্ছা।

এরপর আর কেউ কোনও কথা বলার সাহস পায়নি।

অষ্টমঙ্গলা শেষ। আমরা বাড়ি ফেরার জন্য তৈরি হচ্ছি। মামিমাও পরের দিন কলকাতায় বাপের বাড়ি ফিরে যাবেন। কিন্তু দুই মামিমা, পুষ্পদি আর নতুন বউদি সেদিনটা থেকে যাবার জন্য এমন ভাবে অনুরোধ করতে থাকলেন যে, মা সিদ্ধান্ত বদলাতে বাধ্য হলেন। বিশেষ করে আবার কবে একসাথে দেখা হবে কে জানে? আমারও ভালো লাগল এই সিদ্ধান্ত।

সন্ধ্যাবেলা আমরা ছোটদার ঘরে নতুন বউদির গান শুনছি। মা আর দু’মামিমা ছাদে গল্প করছেন। হঠাৎ কাকতালীয় ভাবে সোনা মামিমার চোখে পড়ে পঁয়ত্রিশ বছর আগেকার সেই একই রকম ঘটনা। শাড়ি পরা একটি মেয়ে আম বাগানের ভিতর দিয়ে একাকী দৌড়োচ্ছে। তবে এর শাড়িটা রঙিন। এটা দেখেই তিনি, মা ও ছোটো মামিমাকে দেখালেন। এবার আর সোনা মামিমা ভয় পেলেন না। বরং বিয়েবাড়ির অন্যান্যদের জানালেন। তখনও বাড়িতে লোক কম ছিল না। ঘটনা শুনে সবাই ছুটল বাগানের দিকে। পাড়ার লোকেরাও ওদের সঙ্গ নিল।

প্রায় আধ ঘন্টা পরে সকলে ফিরল, সঙ্গে নিয়ে একটি রঙিন শাড়ি পরা অল্পবয়সি মেয়েকে। মেয়েটি পাড়ারই সম্ভ্রান্ত বোসবাবুর ছোটো মেয়ে। সে তার প্রেমিকের সাথে ঘর বাঁধার উদ্দেশ্যে এই রাত্রিতে একাকী বেরিয়েছিল বাড়ি ছেড়ে। ভালোবাসে তাকে সে। অথচ বাবা-মায়ের ইচ্ছে তার বিপরীত। তাই তার এই সিদ্ধান্ত।

এরপর যা হয় তাই। মেয়েটিকে সকলে মিলে বুঝিয়ে সুঝিয়ে বাবা-মায়ের কাছে রেখে আসে। ঘটনাটা যাই হোক, সোনা মামিমার ভাবনা কিন্তু দানা বাঁধল পঁয়ত্রিশ বছর আগের ঘটনায়। সেই মেয়েটিও নিশ্চয় ভূত বা পেত্নি ছিল না। হয়তো এরকমই একটি সাধারণ মেয়ে। নিজের ভালোবাসার জনকে পেতে রাতের বেলা বেরিয়েছিল অভিসারে। আর সেটিকে অন্যভাবে ভেবেই তার জীবন আজ রিক্ত, শূন্য। ভাবতে ভাবতেই তার চোখে জল এসে যায়।

এই ঘটনার পর সোনা মামিকে আর শত অনুরোধেও এখানে রাখা যায়নি। অনুতাপে দগ্ধ মামিমার হয়তো মনে হয়েছিল একটি ভুল সিদ্ধান্ত কীভাবে তার জীবনের সব কিছু কেড়ে নিয়েছে। ওই ভুলের জন্যই তার এত ভালো স্বামীর ঘর করা হয়নি। সব কিছু পেয়েও সে আজ নিঃস্ব। এই ভাবনার মাঝেই বাঁধভাঙা কান্নায় ভেঙে পড়েন সোনা মামিমা।

রজনি বৃত্তান্ত

কথা হচ্ছিল ঘুঘুডাঙার দিঘির পাড়ে প্রাচীন বটগাছের সিমেন্ট বাঁধানো চত্বরে বসে গুটি পাঁচেক মাতব্বরের মধ্যে। ঘুঘুডাঙা গাঁয়ে সনাতন হাজরা হ’ল গিয়ে লায়েক। গলা খাঁকারি দিয়ে সে-ই কথাটা পেড়েছিল। ওহে মেয়েমানুষ তো লয় চামার। দজ্জাল মেয়েছেলে। ধম্মকম্ম বলে কিস্যু নাই। গলা তুলে গাল পাড়া মন্দ কথা বলা, এর বাইরে…। বাকি কথাটা লুফে নিল ভজন সামন্ত, কিস্যু নাই কিস্যু নাই। দিনকাল বদল হইচে গো, নইলে এমন মেয়েছেলেকে গাঁয়ে রাখাও কাজের কথা নয়। অমনি বাকি তিনজন তালে তাল মেলাল। হরিহর সামন্ত, শুধু এক কদম এগিয়ে বলল, বাপটা আর সোয়ামিটা কী অমনি অমনি ধেনো খেয়ে নেশায় বুঁদ হয়ে থাকে। সনাতন ঘুরে বলল, ওই ঘরজামাইটার কথা বলতিছ? ও তো ক্লীব, শ্বশুরের সম্পত্তির লোভে বউ-এর লাথিঝ্যাঁটা খায়। আর ওকে তাল দেয় বিষ্ণু হাজরা মানে শ্বশুরটা। হরিহর অমনি গলা তুলে বলল, সে গুড়ে বালি। ওই খান্ডারনি বউয়ের হাত থেকে সম্পত্তি গ’লে ওর হাতে যেতে যেতে মাধব মানে মেধো এমনিই অক্বা পেয়ে যাবে।

শীতের দুপুরে রোদ্দুর যেন পালাব পালাব করে। দিঘির ও’পারে তালবনে সুয্যি ঠাকুর জাল গুটোচ্ছে। সেদিক পানে চেয়ে থাকতে থাকতে সনাতন বলল, চল হে একটু পরেই হিম পড়বে। এই বুড়োবেলায় সব সইতে পারি হিম সইতে পারব না।

যাকে নিয়ে এত কথা সেই রজনি তখন সাঁঝের আকাশের দিকে চেয়ে গাল পাড়ছে, একবার ঘর এসো, মুখে নুড়ো জ্বেলে দেব। হাটে যাবার নাম করে সেই সকালে দুটিতে বেইরেছে, এতখানি বেলা পার হয়ে সুয্যি পাটে বসল, ফেরার নাম নেই। হেঁসেলের উনুনে দুটোকেই পুড়িয়ে মারব। গঙ্গাজলে ভাইস্যে দেব ওই বুড়োটাকে আর পোড়ামুখো জামাইটাকে। খিড়কির চৌকাঠে একটা ছায়া চুপিসারে ঢুকতে গিয়ে কেমন থমকে দাঁড়াল। রজনি আকাশমুখো, ভাগ্যিস। কে জানি রজনিকে বলেছিল, আকাশমুখো সব কথা বহু দূর তক্ শোনা যায়। ছায়া আরও এক পা রাখতেই খড়ের গাদার ওপর রাখা কাটারিটা টিউবওয়েলের বাঁধানো শানে পড়ে ঠনঝন শব্দ করে উঠল। সেদিক পানে চেয়ে রজনি তিরিক্ষি চেঁচিয়ে বলে উঠল, এসো ওই কাটারিতে তোমাদের টুকরো টুকরো করব।

ছায়া এবার ফুটফুটে চাঁদের আলোয় দাঁড়াল। বিষ্ণু হাজরা। একটু টাল খেয়েছিল। ধেনোটা বুকের ভেতর থেকে তখনও পেট অবধি নামেনি। এইসময় মেয়েটা এমন তেড়ে উঠল যে চমকে আবার পিছু হঠতে গিয়ে প্রায় কাটারিতে পা দিয়ে ফেলেছিল। সামলাতে গিয়ে টিউবওয়েল-এর হাতলটা ধরে ফেলল। রজনি খানিক থমকে গিয়ে আবার সুর তুলল, বলি ল্যাজটা কোথায়?

বিষ্ণু হাজরা অমনি যেন খানিক ফুরসত পেয়ে একরকম নীচু গলায় বলল, মেধো সেই কোন দুপুরে আমার সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়ে কোথায় যে গেল, বলল তো হাটে যাচ্ছি…।

কোথায় গড়াগড়ি দিচ্ছে? তুলে আনতে পাল্লে না? এবার তুমি এসো, তোমায় দেখি খানিক। মেয়ের রণচণ্ডী মূর্তি দেখে নেশা ছুটে গেছে বিষ্ণু হাজরার। মনে খানিকটা বল সঞ্চয় করে বলল, একটু ঠান্ডা হ মা। হাট তো এখনও পুরোপুরি শেষ হয়নি। ঠিক ফিরে আসবে। তুই বরং উনুনে আঁচ দে। বিষ্ণু হাজরা মনে মনে আওড়াল, আঁচ দেবে কী, মেয়েটা তো নিজেই আঁচ হয়ে আছে।

তারপরেই মনে হ’ল, তাই তো ছোঁড়়াটা গেল কোথা! সে কী সত্যি-ই হাটে গেছে! ধেনোর ঠেকেও তো যায়নি। তাহ’লে!

মেধো তখন অনেক দূরে। আশমান গাঁ আর চাঁপাডাঙা ছাড়িয়ে ফুলটুসি গাঁয়ের মখমল বাজারের থেকে পোয়া মাইল দূরে এক সাধু আসন গেড়েছে। তাতেই লোক হামলে পড়েছে। সাধুর নাকি মোক্ষম দিব্যদৃষ্টি। অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ– সব গড়গড়িয়ে বলতে পারে। এত ভিড়ের মধ্যে সাধুর নাগাল পাওয়া কঠিন। বেশ খানিক পিছনে দুটো থান ইটের ওপর দাঁড়িয়ে মেধো ঠাওর করতে চাইছে। এই সাধুর খবর সে পেয়েছিল তার ছেলেবেলার বন্ধু পঙ্কার কাছ থেকে। পঙ্কা বলেছিল, একবার গেলেই টের পাবি। স্বয়ং বিশ্বনাথের চ্যালা।

তোর যা দুঃখ, যা গিয়ে বল। কিছু একটা তো হবেই। ধেনো খেয়ে তো আর সাধুর কাছে আসা যায় না, তাই ধেনোর ঠেকে যাবার আগেই বাবা শ্বশুরকে বলেছে, হাটে যাচ্ছে। তবে ভেবেছিল সাধুর সঙ্গে দেখা করে বাজার থেকে আনাজপত্র কিনে ফিরবে। কিন্তু এত ভিড় ভাবনার বাইরে ছিল। ইতিউতি দাঁড়িয়ে কোনওভাবেই যেন তার দর্শন মেলে না। তেমন একটা গাছও নেই যার ওপর চড়ে সাধুর দর্শন পাওয়া যায়। অনেকে দূর দূর থেকে এসেছে। কারও মানত ফলেনি, কারও ব্যাবসা মন্দগতিক– হাজারও সমস্যা। পঙ্কা বলেছিল, সব তুড়ি মেরে সমাধান করে দেবে সাধুবাবা। অগত্যা বেশ খানিক দূরে মোটা গুঁড়ির একটা তেঁতুল গাছের আড়ালে বসে থাকে ঠায়। তাছাড়া সব কথা তো সবার মাঝে বলাও যায় না। কথাগুলো পেরাইভেট কিনা।

সন্ধের পর একটু একটু করে ফাঁকা হচ্ছে। ইয়াব্বড়ো একটা চাঁদ ফুলকো লুচির মতো আকাশে ফুটে উঠল। শাল্লা মশার ভনভন, পোকামাকড়, সাপও থাকতে পারে। তারমধ্যেই একটু ঘুম ঘুম পাচ্ছে। চোখদুটো রাবারের মতো চিপসে যাচ্ছে। তন্দ্রা তন্দ্রা ভাবটা একটু কাটতেই হঠাৎ কেউ কোথাও নেই। সাধু একলা বসে। বুক পর্যন্ত সাদা কাশফুলের মতো দাড়ি, কাঁধ থেকে বুক পিঠ পর্যন্ত নেমে এসেছে সাদা জটা। সাধু মহারাজ একটা কল্কেতে সুখটান দিতে দিতে চোখ বুজে আছে। ধুনির আলো আর চাঁদের আলোতে সাধুর পদ্মাসন থেকে পা দুটো খুলে ছড়িয়ে বসে থাকার কায়দাটা খুব চেনা ঠেকল। আরে ভুতোদা না! এই বসার ধরনটা এই গাঁ ছাড়িয়ে আরও দশ গাঁয়ের পর মেধোর জন্মভিটে হরিশপুরে কে না চেনে! আর ওই দাড়ি গোঁফের আড়ালে মুখটাও তো…! এইরকম আয়েশ করে বসতে আর কাউকেই জানে না মেধো। শুধু সে নয়, গাঁয়ের সব্বাই…।

হামাগুড়ি দিয়ে খানিকটা এগোতেই জলের মতো পরিষ্কার হয়ে গেল। ভুতোদা-ই তো। ভুতোদা বলে ফসকা গলায় প্রায় চেঁচিয়ে উঠেছিল। কোনওরকমে নিজেকে সামলে নিল। শুধু শুধু বেমক্বা সব কেঁচিয়ে দিলে হয় না। এখনও বাজারের লোক হয়তো সব ঘরমুখো হয়নি। কিন্তু ফসকে যাওয়া ওইটুকুতেই ভুতোদা এদিক-ওদিক চাইতে চাইতে চাপা গলায় বলল, কে কে বটে?

বুনো গাছগাছালির ওপর হামাগুড়ি দিতে গিয়ে হাঁটু দুটোর নুনছাল উঠে গিয়েছিল। জ্বালা করছে। তবু শেষবার চেষ্টার মতো করে শরীরটা একরকম ছুড়ে দিল মেধো।

আমি গো আমি। চিনতে পাচ্ছো ভুতোদা? আমি হলেম গে হরিশপুরের মাধব হুই। বাপের নাম কেষ্টচরণ হুই। মায়ের নাম…।

বলতে হবে না। তো এ তল্লাটে কি কচ্ছিস?

আমি হলেম গ্যে ঘুঘুডাঙা গাঁয়ে বিষ্ণু হাজরার ঘরজামাই গো।

ছ্যাঃ ঘরজামাই। পুরুষ মানুষের কলঙ্ক।

মেধো এবার গুছিয়ে বসে ঘনিষ্ট গলায় শুধাল, তুমি সাধু হলে কবে থেকে? বে থা করনি এ’কথা জানি। কিন্তু তাই বলে সাধু!

কল্কেতে টান দিয়ে খানিক ধোঁয়া উগরে দিয়ে ভুতো বলল, আমি হলেম ভূতানন্দ স্বামী। গৃহীর নাম সাধুর হয় না। তো বল তোর সমিস্যি কী।

সমিস্যি তো একটাই। বউটা বড়ো দজ্জাল। উঠতে বসতে গাল পাড়ে। আগে অমনটি ছেল না। ছেলেপুলে হ’লনি তো। তাতেই এমন তিরিক্ষি হয়ে গেল।

শুধু তোরেই গাল দেয়?

না গো ওর বাপটারেও দেয়। দোষের মধ্যি আমরা পুরুষ মানুষ তো বটে, একটু আধটু…।

কথা শেষ হবার আগেই ভুতো বলে, মেয়েছেলের দোষ আছে? মানে খারাপ বাড়িতে যাস নাকি? তা হ’লে তো…।

ছিঃ কী যে বলো। তুমি না সাধু। এই যেমন ধরো গিয়ে তুমি কল্কেতে টান দাও আর আমরা সারাদিন পরে একটু ধেনো খাই। সেটা কি খুউব দোষের?

দোষ? দোষ গুণের বিচার করার আমি কে রে। সবই ওই ওনার– বলে একটা হাত তুলে আকাশের দিকে তর্জনী তুলে দেখাল ভুতো। তোর ছেলেপুলে?

হয়নি। আর তার জন্যই তো এত গোল। হাকিম বদ্যিও কম হয়নি। তো ওই যে বললে না সবই তেনার ইচ্ছে। এবার গলাটা খাদে নামিয়ে বলল, দাও না।

কী? ছেলেপুলে?

না গো। ওতেও শান্তি হবে না। তোমার পায়ে ঠাঁই দাও। কথাটা বলে ভুতোর ছড়ানো পা দুটো ধরতে যাবে অমনি দ্রুত পা সরিয়ে নিয়ে ভুতো বলল, অত সোজা। সাধু হব বললেই সাধু হওয়া যায় নাকি? মেধো দ্বিতীয়বার শরীরটা ছুড়ে দিয়ে ভুতোর দুটো পা-ই ধরে ফেলল।

আঃ ছাড় ছাড়, সাধু হলে শ্বশুরের ভিটে জমি পুকুর এ’সব যে হাতছাড়া হয়ে যাবে রে।

হাতছাড়া হয়েই আছে ধরে রাখো। অমন দজ্জাল বউ না-মরা ইস্তক কিচ্ছুটি পাবার যো নেই। সংসারে ঘেন্না ধরে গেছে। তারপর আর একটু এগিয়ে ভুতোর পায়ের পাতা থেকে হাঁটু অবধি দলাই মলাই করতে করতে মেধো কেমন যেন আবেশ বিভোর গলায় বলল, তোমার সেবা করব। আমারে দীক্ষে দাও।

সেবা করবি? তা হ’লে কর। কল্কেটা একটু সাজিয়ে দে। বাবা বিশ্বেশ্বর কী বলেন দেখি। মেধো অমনি হাত বাড়িয়ে কল্কেটা নিল।

দু’টান মারতেই ভুতোর কেমন ফুরফুরে উদার হয়ে গেল মনটা। তোকে আমার চ্যালা করে দিলাম যাঃ। ক’দিন এ’ধার ও’ধার আমার সঙ্গে ঘুরে দেখ, তারপর না হয় দেখা যাবে। সংসারের এঁটেল মাটি গা থেকে আগে খসুক, দীক্ষা হবে।

মেধো গদগদ গলায় বলল, হবে বইলছ। তাইলে এট্টু পেসাদ…। ভুতো কল্কেটা বাড়িয়ে দিল। মেধো চোখ বুজে এক দমে খানিক টেনে বুকের মধ্যে ধরে রেখে তারপর ধোঁয়া ছাড়ল। ব্যাস হয়ে গেল, পাপ তাপ সব ছাড়িয়ে ভেতরটা কেমন যেন উদাস বাউল পারা। কোথায় পড়ে রইল রজনি, জমি জমা ভিটে– সব কেমন শূন্যে মিলিয়ে গেল। শুধু ধোঁয়ার কুন্ডলীর ভেতর যেটুকু দেখা যায়, ভূতানন্দ স্বামী।

দুই

রাতে ঘুম হয় না বিষ্ণু হাজরার। ঘোলাটে চোখ দুটো পেঁয়াজের পাতলা খোসার মতো যেন ভাসছে। ছেলেটা যে কর্পূরের মতো উবে গেল। আকাশপটে বাসি কদমফুলের মতো তখন শুকতারাটা ফুটেছে। আপন মনে বিড়বিড় করে বিষ্ণু হাজরা, তোমায় বইলছি তো সব তোমার নামে নেকাপড়া করি দিব, তা বুঝি বিশ্বাস হ’লনি। তোমার হলি তো মেয়েটারও হ’ল নাকি! তারপরেই মনে হ’ল বেবাক কোথাও নেশার ঘোরে পড়ে নেই তো! তবে নেশার ঠেকগুলো তো এ’কদিন ঘুরে দেখে নিয়েছে। তো সে কোথায়! তাহ’লে কী…! বুকটা ছ্যাঁৎ করে ওঠে।

পাশের ঘরে শুয়ে অমনি এ’পাশ ও’পাশ করে জেগে আছে রজনি। মানুষটা গেল কোথা! যা গাঁয়ের ছিরি ফুঁসলিয়ে নিয়ে গেল না তো! কথাটা মনে হতেই ধড়মড় করে উঠে কপাট খুলে দাঁড়ায়। আকাশে চাঁদ ফ্যাক ফ্যাক করে হাসছে। জ্যোৎস্না গলে গলে পড়ছে উঠোনের মাটিতে। রাগে জ্বলে ওঠে রজনি, রঙ্গ হচ্ছে! তামাশা! তারপরেই কেমন যেন ভেঙে পড়ল, কোথায় খুঁজবে মানুষটাকে। বাপটা কি ঘুমে নিঃসাড়, না তারই মতো…! ভেতরের কপাট আবজানই ছিল।

পড়ে পড়ে ঘুমুচ্ছ? ভাবো কি আমি তোমায় ছাড়ি দিব? মানুষটাকে কোথায় রাখি এয়েচ? দিনরাত মদ গিলেও শান্তি হয়নি? শেষে বেচি দিলে মানুষটারে! বিষ্ণু হাজরা হাতের মুদ্রায় জানান দেয়, সে জানে না। এমন কাণ্ড কোনও বাপে করতি পারে!

তারপরেও সব যেমন চলছিল তেমনি সব ঠিকঠাক। সকালের প্রথম রোদ্দুর উঠোনে চুঁয়ে পড়েছে। রজনি তখন কোমরে আঁচল গুঁজে অন্য মূর্তি। পারলে রাঙা রোদ্দুর ঝাঁটা দিয়ে উপড়ে ফেলে। বিষ্ণু হাজরা এক পা দু’পা করে খানিকটা এগোতেই রজনি রণং দেহী ভঙ্গিতে সামনে এসে দাঁড়াল, ভেবেছ কী? ওই আবাগির ব্যাটার সঙ্গে খালাস হই যাতি পাল্লে না। হাড় জুড়োত।

আঃ, আমি কী তার জানি! আমায় কি বলেকয়ে গেছে?

এমনি এমনি হাওয়ায় গায়েব হয়ে গেল? কেমন করে ভূত ছাড়াতি হয় তোমাদের আমার জানা আছে।

তারে খুঁজতি গেলেও তো যাতি হয়।

তো যাও। সঙের মতো দাঁইড়ে না থেকে খুঁজি আনো। মানুষটারে না নিয়ে ফিরলি তোমার একদিন কি আমার একদিন।

চিন্তায় বিষ্ণু হাজরার ভ্রূ কুঁচকে ওঠে, বাগদিপাড়া, দুলেপাড়া, মালাপাড়া কোনওটাতেই তো বাদ দেয়নি। তাহ’লে! মাথা নাড়তে নাড়তে বিষ্ণু হাজরা বেরিয়ে যেতেই ভজন সামন্তের ছোটো ছেলে পটলা হাঁফাতে হাঁফাতে হাজির। সববনাশ হই গ্যাছে। গাঁয়ের কে যেন দেখেছে, মানুষটা এক সাধুবাবার সঙ্গে বাঁকা নদী পার হয়ে কোথায় যেন…!

তা কেউ বারণ করলে না?

বারণ করবে কিগো। সাধুবাবা যে তখন বাণ মারিছে। সব বেবাক দাঁইড়্যে…!

রজনির মুখ থেকে কথা সরে না। কোথা গেল মানুষটা! কতদূর!

বিষ্ণু হাজরা ফিরল বেশ খানিক রাতে। সারাদিন খুঁজে বেরিয়েছে। একে তাকে জিগ্যেস করেছে। ফুলটুসি গাঁয়ের কয়েকজন অবশ্য সাধুর কথা বলেছে। কিন্তু তাতে কি হদিস মেলে! দু’একজন হেসে তামাশা করে বলেছে, তা তোমরা বাপ-বেটি মিলি মানুষটারে খেদানোর ভালো কল ঠাউরেছ তো! এখন হাপিত্যেস করার যাত্রা নাই বা করলে। বিষ্ণু হাজরা কোনও উত্তর দেয়নি। কী-ই বা উত্তর দেবে!

ঘরে ফিরতেই রজনির সামনাসামনি। পাল্লে না সাধুটারে পুঁতি রাখতি? ভণ্ড আমার সংসারটারে তুক করিছে, আর তুমি বেবাক ঘরে ফিরলে? যাও না কেনে বাঁকা নদী পার হই তারে খুঁজে আনতি।

বিষ্ণু হাজরা চুপচাপ দাওয়ায় মাদুর পেতে শুয়ে পড়ল। মেয়েটার জন্য কষ্ট হচ্ছে। এত শোক কি ও সইতে পারে! বাইরের কপাট ধরে তখনও রজনি দাঁড়িয়ে।

পরের দিন পুলিশ চৌকিতে হাজির বাপ-বেটি। সব শুনে বড়োবাবু হাসল, তো আমি কী করব। জামাই পালিয়েছে নিজের ইচ্ছেয়। নিজের ইচ্ছেয় সংসার ত্যাগ করেছে, তো আমি কী করব? এতক্ষণ চুপ করে শুনছিল, হঠাৎ জ্বলে উঠল রজনি, তাই তো পুলিশ তো হাবাগোবা, শুধু ঘুষ নিবে, সাধুকে জেলে পুরবে আর চোরকে ছেড়ে দিবে। বড়োবাবু হুঙ্কার দিয়ে বলল, খবরদার মুখ সামলে।

চোপ, বিষ নেই তো কুলোপানা চক্বর। ঝাঁটা মারি অমন আবাগির ব্যাটাকে।

হনহন করে বেরিয়ে এল রজনি, বাপটা পেছু পেছু একরকম ছুটতে ছুটতে পাঞ্চেত বিডিও আপিস ঘুরেও কোথাও কোনও হদিস পেল না।

ঘরে ফিরে রজনি কেমন যেন থিতিয়ে গেল। চুপ করে দাওয়ায় খুঁটি ধরে বসে রইল।

তিন

এতসব কাণ্ড যখন তখন হর-কী পাউরির ঘাটে বসে কল্ কল্ জল দেখছে মেধো। পাশে বসে গুরু ভূতানন্দ স্বামী। দীক্ষান্তে মেধো এখন তার চ্যালা।

কেমন লাগছে তোর?

ভালোই, তবে…।

কী তবে?

নিরামিষ এত ভাল্লাগে না।

এ তো দেবস্থান। এ’সব কথা বলাও পাপ। এরপর তো তোর গেরুয়া বসন হবে।

ও যখন হবে, হবে। তাই বলে…।

চুপ করে থাকে ভূতানন্দ। চোখ বুজে মনে মনে বলে, সংসারের গন্ধ গা থেকে খসতে তো সময় লাগবেই। মুখে বলল, তাঁর ভজনা কর। তিনিই পথ দেখাবেন।

শাল্লা ঠিক সেইসময়-ই দজ্জাল বউটার কথা মনে হ’ল। বউটার জন্য কেমন যেন দুঃখ হচ্ছে। কেন হচ্ছে এমনটা! এমনটা কি সবার হয়! সংসার কি এমনিই পেছন থেকে টানে! কথাগুলো শুধোতে গিয়েও শুধোল না। শুধোলে তো সেই ওপরের ওনাকেই দেখিয়ে দেবে ভুতোদা, থুরি ভূতানন্দ।

তারপর কংখল। মা আনন্দময়ীর আশ্রম। ভজন, গীত, স্তোত্র, খাওয়া বলতে মালসায় খিচুড়ি ভোগ। বাকি সময়টা মাধুকরী– ভিক্ষে চেয়ে পেট ভরা। শাল্লা পেট চটকে ঠাকুর ঠাকুর। নিকুচি করেছে ঠাকুরের। একবার মনে হয়েছিল ফিরে যায় গাঁয়ে। অমনি মনে হ’ল রজনির কথা। যা খান্ডারনি হাত-পা ভেঙে নুলো করে দেবে। শাল্লা জলে কুমির তো ডাঙায় বাঘ। মাঝেমধ্যে কোনও গাঁয়ে গিয়ে আসন পাতলেও তো হয়। কলাটা মুলোটা ফলটা কম তো হয় না।

চাঁদ দেখছিল ভূতানন্দ। মেধো শুধিয়েই ফেলল, কবে যাবে?

কোথায়?

এই কোনও গাঁয়ে।

বোশেখের আগে নয়। তার আগে এলাহাবাদ। মাঘী স্নান।

মাঘী স্নান!

সারা মাঘ মাস স্নান চলবে আর ঠাকুরের নাম সংকীর্তন সঙ্গে মাধুকরী।

এই হয়েছে এক গেরো। দুটো কথা সহ্য করে গাঁয়ে থাকলে ভালো হতো। ভূতানন্দ ওর দিকে ফিরে চাইল। তারপর গুনগুন করে গেয়ে উঠল, পাগলা মনটারে তুই বাঁধ…। ঝুলি থেকে একটা কল্কে বের করে বলল, নে সাজ তো।

দুটো টান দিতেই গুরু খুশ্ তো চ্যালা খুশ্।

চার

সময় যেন ডাকহরকরা। নিদানের চিঠি তার হাতে ধরা। কখনও বা সে গাঁয়ের চপলা শ্যামলাবরণ মেয়ে। ঘণ্টা বাজে দ্বিতীয় প্রহর থেকে তৃতীয় প্রহর।

শূন্য ঘরে রজনি একা। তার শরীরেও সময় কখন গুটিগুটি প্রবেশ করেছে। গত বিশ বছরের জোয়াল এখন তার কাঁধে। বিষ্ণু হাজরা দেহ রেখেছে তা-ও দশ বছর পার। আনমনা বসে থাকতে থাকতে শোনে কোথায় যেন কোনও বৈরাগী গান ধরেছে, এ জীবন নদীর পারা যতই ভাবো যায় না ধরা। হবে হয় তো। শূন্য ঝাঁপি শূন্যই থেকে যায়, কেউ তো এক আনিও দিল না।

রাত্রে মোহন এল। মোহন রজনির জ্যাঠতুতো ভাইয়ের ছেলে। বলল, পিসি হয় না।

কী হয় না?

খড়ের গাদায় সূচ খোঁজা যায়? যায় না। সব ধম্মস্থানই তো খুঁজলে, পেলে?

রজনি মোহনের দিকে এক ঝলক দেখে নিয়ে বলল, হয় কী না হয় সে আমি বুঝব। তোকে যেতে হবে না।

আমি কি তা-ই বলেছি?

গেলে যাবি না গেলে যাবি না। কারও জন্য কিছু…। এই যে একটা গোটা মানুষ হারিয়ে গেল তার জন্য…! রজনি থেমে গেল।

তারপর শুধু চলা আর চলা। কখনও হূষিকেশ কখনও এলাহাবাদ আবার কখনও মথুরা। কোথাও নেই। রুদ্রপ্রয়াগ। মন্দিরে গান হচ্ছে, হ্যায় জীবন কি নৈয়া তুমহারে হাওয়ালে, জিধার চাহো হম কো উধর লে চলো তুম। গানের সুর, নদীর আবিরগোলা জল– সব একাকার।

মোহন পিছন থেকে ডাকল, পিসি। রজনি সাড়া দিল না। ও তখন অনেক দূরে। মানুষ হারিয়ে যাবার সুলুক সন্ধান যেন এখন ও জানে। মোহন বলল, যাবে পিসি?

কোথায়?

সাধুভান্ডারা। ভক্তের ভোগ দান সাধু বিলিয়ে দেবে সবার মধ্যে। যাবে? রজনি অস্ফুটে বলল, যাব।

সার বেধে ভক্তের দল। ডিমের কুসুমের মতো সূর্য তখন পুব আকাশে। পিসি-ভাইপো সেই সারে দাঁড়িয়ে। একজন একজন করে এগিয়ে যাচ্ছে। ধীর পায়ে রজনি এগিয়ে এসেছে। এক ব্রহ্মচারী। শ্বেত শুভ্র বসনের সঙ্গে পক্ব কেশ শুভ্র শ্মশ্রুমণ্ডিত মুখমন্ডলী একাকার। চোখদুটো যেন দূর পারের কান্ডারি। তন্ময় হয়ে দেখছে রজনি। চেনা মুখটা কত যেন অচেনা। মনে মনেই বলল, কে তুমি?

একেবারে সামনে এসে দাঁড়াল রজনি। করজোড়ে আঁচলের কাপড় গলায় জড়িয়ে প্রণতভঙ্গিতে রজনি মাথা নীচু করল। ব্রহ্মচারী কেঁপে উঠল। অস্থির এক ভাব। হাত তুলতে গিয়েও যেন থমকে গেল।

দেব দর্শন। রজনি মনে মনেই বলল, তোমায় মুক্তি দিলাম ঠাকুর। মোহন কিছুই টের পায়নি।

বিহান তখনও ফুটেছে কী ফোটেনি। ব্রহ্মচারী এসে দাঁড়িয়েছেন মন্দির লাগোয়া ধরমশালার দোরগোড়ায়। কেয়ারটেকার বাবুটি আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে সব শুনে বলল, উ লোগ তো চলা গিয়া।

অস্পষ্ট অন্ধকারে ব্রহ্মচারী দাঁড়ালেন নদীর সঙ্গমস্থলে। পুব পাড়ে তখন সূর্য ওঠার প্রস্ততিপর্ব। দু’হাত বুকের ওপর প্রণামের ভঙ্গিতে রেখে তিনি মন্ত্র উচ্চারণের মতো বললেন, এবার গেরুয়া বসনের অধিকার দাও হে প্রভু।

অন্তরালে স্বামী ভূতানন্দ হয়তো হাসলেন।

পানিবাই

ঘটকপুকুরে যেতে চাইলে দুটো স্টপেজে নামা যায়। এক, ডাক্তারখানা স্টপেজ। এক কামরার একটা মাটির চালা, সামনে ছোট্ট বারান্দা। একসময় রুগির ভিড় উপচে পড়ত সেই বারান্দায়, ভেতরঘরে নড়বড়ে চেয়ার-টেবিল পেতে বসে থাকত প্রতাপ ডাক্তার। প্রতাপ কাঁড়ার, হোমিওপ্যাথ। এক শিশি সুগার অব মিল্কে এক ফোঁটা ওষুধ ফেলে সাত গাঁয়ের লোককে খাওয়াত, লোকে কপালে হাত ঠেকিয়ে বলত, ‘সাক্ষাৎ ধন্বন্তরি’। সেই ধন্বন্তরি প্রতাপ ডাক্তারকে হঠাৎ একদিন সকালে কেউ দেখতে পেল না। চেয়ার, টেবিল আছে, খোপ-খোপ ওষুধের বাক্স আছে, তক্তাপোশে তেলচিটে বিছানা, নীচে স্টোভ. কালি-লাগা হাঁড়িকুড়ি, দড়িতে ধুতি-গামছা, সব যেমনকার তেমন আছে। শুধু মানুষটা নেই। কেউ বলল, স্বপ্নে আদেশ পেয়ে হিমালয়ে চলে গেছে ডাক্তার, কেউ বলে বাড়ি থেকে খারাপ খবর পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে দৌড়েছে। প্রতাপ ডাক্তার চলে যেতে সাত গাঁয়ের লোক কিছুদিন হা-হুতাশ করল, তারপর নতুন ডাক্তার খুঁজে নিল। কিন্তু ডাক্তারের ঘরটা তেমনই পড়ে রইল, থাকতে থাকতে জরাজীর্ণ হয়ে গেলেও ঠিক দাঁড়িয়ে রইল মাটির ওপর। আর বাস স্টপেজের নাম হয়ে গেল ডাক্তারখানা।

দ্বিতীয় স্টপেজের নাম ঘটকপুকুর স্ট্যান্ড। এখান থেকে রাস্তা একদিকে রায়দিঘি অন্যদিকে কাকদ্বীপের দিকে চলে গেছে। জায়গাটা সবসময়ই সরগরম। তিন-চারটে মিষ্টির দোকান, চপ-ফুলুরিও বেশ কয়েকটা, সারের দোকান, টেলারিং, ইদানীং একটা টিভি মেরামতের দোকানও খুলেছে পঞ্চায়েত প্রধানের ভাইপো নাড়ু। বিকেলে একটা রোল-চাওমিনের চলমান দোকানও বসে। তার গায়ে বড়ো বড়ো করে লেখা ‘ঘটকপুকুর রোল কর্নার’।

ঘটকপুকুর গ্রামে যেতে গেলে এই স্ট্যান্ড থেকে একটু পিছিয়ে আসতে হয়। ডাক্তারখানা স্টপেজে নেমে অবশ্য সোজা ঢুকে গেলেই হল। গাছগাছালির ছায়ায় ছায়ায়, পুকুরে হাঁসের সাঁতার দেখতে দেখতে গ্রামীণ ব্যাংকের পাশ দিয়ে সোজা ঘটকপুকুর হাটতলায় ঢুকে পড়া যাবে। এই হাটতলাটাই গ্রামের প্রাণকেন্দ্র। গ্রামটা তাকে ঘিরে পদ্মের পাপড়ির মতো ফুটে আছে।

ডাক্তারখানা আর স্ট্যান্ড– এই দুই স্টপেজের মাঝে গ্রামে ঢোকার আর একটা তৃতীয় রাস্তা আছে। বাস ওখানে দাঁড়ায় না। যদি দাঁড়ায়, তবে হয়তো স্টপেজটার নাম হতো, কাওরাপাড়া স্টপেজ। ঘটকপুকুরের কোনও মান্যগণ্য লোককে প্রকাশ্যে এ রাস্তায় যাতায়াত করতে দেখা যায় না। আগেকার দিনে বাড়িতে যেমন মেথর ঢোকার আলাদা পথ থাকত, এই রাস্তাটাও তেমনি। ভদ্রসমাজের অস্পৃশ্য, অব্যবহূত। আসলে এই পাড়ার বাসিন্দারাও তাই। পন্ডিতেরা বলেন এরা আগে ছিল জমিদারের পালকিবাহক, কাহার সম্প্রদায়। কাহার থেকে কাওরা। যারা পালকি না বইলে ভদ্রলোকের সভ্যতার গতিরুদ্ধ হয়ে যেত, অফিস-কাছারি, পালা-পার্বণে যাতায়াত বন্ধ হয়ে যেত, এমনকী পালকি শুদ্ধু গঙ্গায় ডুবিয়ে পুণ্যের থলিটা বোঝাই করা যাদের দাক্ষিণ্যে, তারা নাকি এত নীচু জাত যে গ্রামের ভেতরে তাদের বাস চলে না, তাদের রাস্তাটাও বিপদে না পড়লে কেউ ব্যবহার করে না। তো সেই কাওরাপাড়ায় লকলক করে লাউডগার মতো বেড়ে উঠছে ফুল্লরা কাওরা। তাকে নিয়েই এই গল্প।

ফুল্লরা একরাশ গোবর কুড়িয়ে ঘরে ফিরে দেখল তার মা সনকা দাওয়ায় বসে চুল খুলছে। সে প্রায়ই দড়ি দিয়ে চুল বাঁধতে গিয়ে গিঁট ফেলে দেয়, তাই দড়ির বদলে অনেকসময় শাড়ির পাড় ছিঁড়ে নেয়। আজ মার কাঁচাপাকা চুলে লালরঙের শাড়ির পাড় কেমন বেখাপ্পা লাগল ফুল্লরার। মার সিঁথির জায়গাটা ফটফটে ফাঁকা। তার বাপ দুখে মারা গেছে দু-মাসও হয়নি। স্বাভাবিক মৃত্যু নয়, দুখেকে খুন করা হয়েছে।

দুখে কাওরার স্থায়ী কোনও পেশা ছিল না। মাঝে মাঝে সে নিত্য শাহ-র সিমেন্টের দোকানে মাল বওয়ার কাজ করত বটে, কিন্তু বেশিরভাগ দিনই তাকে কাজ করবার মতো সুস্থ অবস্থায় পাওয়া যেত না। সে পড়ে থাকত পঞ্চার তাড়ির ঠেকে কিংবা মণিকা-কণিকার বাড়ি। সেখানে মদের আসর বসত, তবে সেটা মুখ্য নয়। দুখে খুব ভালো গান গাইত। তার গলায় গোষ্ঠগোপাল দাসের ‘গুরু না ভজি মুই সন্ধ্যা সকালে মন প্রাণ দিয়া’ শুনে মহাপাতকের চোখেও জল আসত। তার গানের সঙ্গে নাল বাজাত সাগর। আর মণিকা-কণিকা, যাদের নামে গ্রামের সবাই বলে, তারা গ্রামের বুকেই, ভদ্রপাড়ায় লাইন খুলে বসেছে, তারা গানের মাঝে মাঝে মদ, চাট এবং হাসি পরিবেশন করত আর পরিবেশনের ফাঁকে ফাঁকে তাদের আঁচল বার-বার খসে পড়ত।

এরকম অবস্থায় তাবড়-তাবড় ঋষিদেরই ধ্যানভঙ্গ হয়, দুখে তো কোন ছার! সে শুধু মনস্থির করতে পারছিল না, মণিকা না কণিকা– কে তার মন বেশি টেনেছে। নিজের এই সংশয়ে সে এতই নিবিষ্ট ছিল যে খেয়ালই করেনি, যে তার বাজনদার সাগর, তাকে তার প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবতে শুরু করেছে। এ বাড়িতে সাগরের যাতায়াত দুখের অনেক আগে থেকে, দুটি বোনকেই সে তার হাতের বাজনার মতোই ভালো বাজাতে পারে। তারাই যখন, দুখের গানে মজে, নতুন হাতে বাজতে চাইল, সে মেনে নিল না।

দুখে আর সাগর মাঝে মাঝেই দূর দূর গ্রামে মাচা প্রোগ্রাম করতে যেত। সেবার তারা গেল কাঁটাগাছি, কাঁটাগাছি ব্যবসায়ী সমিতির ডাক পেয়ে। ফেরার সময় সাগর একাই ফিরল, দুখে নাকি ওখান থেকে কোথায় চলে গেছে, কাউকে কিছু না বলে। কয়েকদিন পর দুখের বডি ভেসে উঠল খালের জলে। সনকা থানায় রিপোর্ট লেখাতে গিয়ে ফিরে এল। একে তো সাগর উঁচুজাত, তার ওপর সে পঞ্চায়েত প্রধানের লতায়পাতায় আত্মীয় হয়। সনকা চোখের জল মুছে বাড়ি ফিরে এল।

সনকার ফটফটে সাদা সিঁথিটা দেখে ফুল্লরার মনে আবার সেই ভয়ংকর দিনগুলো ফিরে আসে। সেই জল থেকে তোলা ফুলে ঢোল বডি, বাবা বলে চেনাই যায় না। পোস্টমর্টেম রিপোর্টও হাওয়া হয়ে গেল। কিন্তু ফুল্লরা জানে তার বাবাকে ছুরি মেরে খুন করেছে সাগর। পুলিশের মুখ বন্ধ করলেও লোকের মুখ অত সহজে বন্ধ করা যায় না। ইস্কুলের টিউকলে জল নিতে গিয়ে শুনে এসেছে সে, গাঁয়ের বউ-ঝিরা সেখানে খাবার জল নিতে ভিড় করে সকালে-বিকেলে।

যত আগে গিয়েই লাইন দিক, ফুল্লরা জানে যে, সে জল পাবে সবার পরে। ছোটোবেলা থেকেই এমন দেখে আসছে। তখন বুঝত না। জেদ করে ওদের লাইনে দাঁড়াতে গিয়েছিল একবার। ওরা ঠেলে ফেলে দিয়েছিল। খোয়ার ওপর পড়ে কপাল একটুর জন্যে ফাটেনি, কিন্তু মাটির কলসি ভেঙে গিয়েছিল। ছোট্ট ফুল্লরার কপালে গাঁদা পাতার রস লাগাতে লাগাতে তার মা বুঝিয়েছিল উঁচুজাতের জলের লাইন আলাদা, ওদের ছোঁয়া লাগলে যে জল ওরা খেতে পারবে না। ফুল্লরা বুঝতে পারেনি, সরকারি কলের জল ওদের ছোঁয়ায় কী করে অশুদ্ধ হতে পারে। তখনও ইস্কুল ছাড়েনি। খিচুড়ি ইস্কুল। সেখানে খুব করে প্রার্থনা গাইতে হতো, ‘আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে।’ গাইতে গাইতে ওর বুকে কীরকম একটা কষ্ট হতো। ওর মনে হতো, এখানে যে আগুনের কথা বলা হয়েছে, সেই আগুন তো বইয়ের অক্ষরের মধ্যে লুকোনো আছে। সেই আগুন যে ছুঁয়েছে, সে-ই শুদ্ধ। তার আবার জল-অচল কী? ইস্কুলে বেশিদিন যেতে পারেনি ফুল্লরা, কিন্তু গানটা ভোলেনি।

সবার পরে জল নিতে এখন আর কষ্ট হয় না। ও জেনে গেছে এটাই নিয়ম। কাওরাপাড়ায় দুখে কাওরার ঘরে জন্মালে এরকমই হয়। সেই জন্মদাতা বাবাও যদি ওরকম বেঘোরে চলে যায়। শ্যাওলা-জড়ানো, ফুলে ঢোল দুখের লাশ মনে পড়ে যায় বারবার ফুল্লরার।

সনকার চুল খোলা হয়ে গেছিল। সে কেমন চোখে ফুল্লরাকে দেখতে দেখতে বলল, ‘ঘরে শ্যাম্পুর পাতা আছে, মাথা ঘষে চান কর। বিকেলে, তোর মামি গেলবার যে শাড়িটা দিয়েছিল, নীল করে, ওটা পরবি।’

ফুল্লরা অবাক হয়ে গেল। মার ভালো শাড়ি বলতে ওই একটাই। কোনওদিন চাইলেও পরতে দেয় না। বলে ছিঁড়ে যাবে। হরিসভায় মোচ্ছবের সময় তাদের পাড়ার মেয়েরা কত সেজেগুজে যায়। সেসময় কতবার শাড়িটা পরতে চেয়েছে ফুল্লরা, মা দেয়নি। আজ কী হল তার! সে তবু কিছু জিজ্ঞেস করে না মাকে। বাবা চলে যাবার পর মা কেমন খিটখিটে হয়ে গেছে। দশবাড়ি খেটে খেটে সারাক্ষণ তেতেপুড়ে থাকে, কিছু জিজ্ঞেস করলেই ঝাঁঝিয়ে ওঠে।

সে গোবরটা উঠোনে রেখে হাত ধুয়ে কোমরে বাঁধা ওড়নায় মুছে নিল। তারপর ঘরে এল। শ্যাম্পুর পাতাটা নেবে। নীচু ঘর, দিনের বেলাতেও আলো ঢোকে না। দেয়ালে একটা আয়না ঝোলানো আছে। তার ঘষা কাচে ফুল্লরা নিজেকে দেখার চেষ্টা করে।

এ গাঁয়ের অনেক মেয়েরই সকাল সকাল বিয়ে হয়ে যায়। বিয়ের সরকারি বয়সে পৌছনোর অনেক আগেই। শুধু গরিব ঘরে বা নীচু জাতের মধ্যে নয়, বড়ো বড়ো ঘরেও এটাই স্বাভাবিক। ভালো ছেলে পেয়ে গেলে সবাই হাঁকপাঁক করে মেয়ের বিয়ে দিয়ে দেয়। সে সামনে মাধ্যমিক থাকলেও। আর ফুল্লরা তো স্কুলেই যায় না। তারওপর বাবাও নেই। তাই তার এই বয়সে বিয়ে ঠিক হওয়ায় কেউ অবাক হল না। কিন্তু ছেলের বাড়ি কোথায় জেনে সবার চোখ কপালে উঠে গেল। কথায় বলে, ‘কোনও কালে নেই ষষ্ঠীপুজো। একেবারে দশভুজো।’ একেবারে বম্বে। বম্বে তো একেবারে কল্পলোক। সেখানে ক্যাটরিনা কইফ, সলমন খান, শাহরুখ খান রাস্তাঘাটে ঘুরে বেড়ায়। ভোরে সমুদ্র ধরে হাঁটলে বিগ বি-র সঙ্গে ধাক্বা লাগতে পারে। সেখানে শ্বশুরঘর করতে যাবে কাওরাপাড়ার ফুল্লরা কাওরা!

ফুল্লরার বন্ধুরা শুনে বলল, ‘তোর নাকি শাহরুখ খানের সঙ্গে বিয়ে!’

যদিও ঠাট্টা, তবু ফুল্লরার বুক তিরতির করে কেঁপে উঠল। সত্যি তার বিয়ে, তাও আবার বম্বেতে! মাঠে গোবর কুড়োনো, সেফটিপিন দিয়ে ফ্রক আঁটা, সবার শেষে জল নেওয়া– এই ছেঁড়াফাটা, তালিমারা জীবন শেষ হয়ে যাচ্ছে তার? শাহরুখ খান না হোক, তার বরের নাকি মেলা জমি-জিরেত, এখনকার মতো ভাতের ভাবনা থাকবে না বিয়ের পর। কিন্তু তাদের গাঁয়ের লোকগুলো কি হিংসুটে, কেউ একবেলা ভাত দেবে না, কিন্তু কু গাইতে ওস্তাদ। তাদের কাওরা পাড়ার বউ-ঝি থেকে শুরু করে, যে-বাবুদের বাড়ি মা কাজ করে, তারাও বলছে, ‘হুট করে কোথায় বিদেশ বিভুঁইয়ে বিয়ে ঠিক করে ফেললে, জানো তো, বিয়ের নাম করে মেয়ে পাচার চক্র চলছে রমরমিয়ে, মেয়েগুলোকে দিয়ে কী যে করাবে–’

তার ধলাদাদু তাকে পাচার করে দেবে! ভাবলেও হাসি পায়। বাবা মারা যাবার পর এই দাদুই তো তাদের টেনেছে সাধ্যমতো। ধলাদাদু, মার কীরকম কাকা হয়, বম্বের একটা ফ্ল্যাটে পাহারাদারের কাজ করে। সেই এনেছে সম্বন্ধটা। ছেলের বাড়ি বম্বে শহর থেকে একটু দূরে। বিট্টলপুরা বলে একটা গাঁয়ে। ছেলের বয়স নাকি একটু বেশি। ছেলের এক মেসো কলকাতায় থাকে, সেই এসে দেখে গেছে ফুল্লরাকে। মা যেদিন তাকে নীল শাড়ি পরে সেজেগুজে থাকতে বলেছিল, সেইদিনই। মেসোর নাম ভগবান দাস। পাকানো গোঁফে মোচড় দিতে দিতে সেই ভগবান দাস ফুল্লরাকে একটা প্রশ্নই করেছিল–

‘পিনে কা পানি আনতে কতদূর যেতে হয় বেটি?’

প্রশ্ন শুনে অবাক হয়েছিল, কিন্তু ঠিকঠাক উত্তরই দিয়েছিল। খুশি হয়েছিল ভগবান দাস। কে জানে, এক ঘণ্টা-দু ঘণ্টা লাইনে দাঁড়ানোর কথা তাকে এত মুগ্ধ করেছিল কেন। হয়তো সে পরখ করে দেখতে চাইছিল ফুল্লরার ধৈর্য, সহ্যক্ষমতা। তারপর ফুল্লরাকে সুপুরি, রুপোর টাকা ও জরিন শাড়ি দিয়ে আশীর্বাদ করে চলে গেছিল ভগবান দাস।

কয়েকদিনের মধ্যেই নিত্য শাহ-র বাড়ি কাজ করতে করতে ফোনে শুভ খবর পেয়েছিল সনকা। ফুল্লরাকে ওদের পছন্দ হয়েছে। কিন্তু জমি-জিরেত ছেড়ে ছেলে বিয়ে করতে আসতে পারবে না। ফুল্লরাকেই যেতে হবে। তাকে নিয়ে যাবে ভগবান দাস।

এতদিন গাঁয়ের লোকের নানান কথাতেও সনকার মন টলেনি। কিন্তু এখন বিয়ে হবে শুনে সে কেমন কেঁপে উঠল। বিদেশ-বিভুঁই জায়গা, ভাষাও অন্য, মেয়েটাকে সে অনিশ্চয়তার মুখে ঠেলে দিচ্ছে, সব সে জানে, আর কী-ই বা করার আছে তার? কিন্তু সাতপাকটা অন্তত যদি তার সামনে হয়ে যেত, বুকটা আঁটা থাকত। এই ভগবান দাস, যাকে সে একদিন মাত্র দেখেছে, তার হাতে একটা উঠতি বয়সের মেয়েকে সঁপে দেবে? ফোনের মধ্যে তার আশঙ্কা টের পেয়েছিল ভগবান দাস, সে আশ্বস্ত করেছিল সনকাকে। ‘আরে বেটি, ঘাবড়াও মৎ। তোর মেয়েকে আমি কোনও কোঠিতে বেচতে যাচ্ছি না। সোজা শাদির মন্ডপে নিয়ে গিয়ে তুলব। আর তোর চাচা তো আছেই ওখানে।’

নির্দিষ্ট দিনে ভগবান দাস তাকে নিতে এসেছিল। নিত্য শাহ-র বউয়ের দেওয়া একটা পুরোনো কাপড়ের ব্যাগে টুকিটাকি জিনিস গুছিয়ে নিতে নিতে ফুল্লরা আবিষ্কার করেছিল মা কখন যেন নীল শাড়িটা তার ব্যাগে ঢুকিয়ে দিয়েছে। এতদিন ঘোরের মধ্যে থেকে সে ভাবেইনি বিয়ে মানে মাকে ছেড়ে অনেক দূরে চলে যাওয়া। নীল শাড়িটা তার সেই ভুলে থাকা ব্যথাটা খুঁচিয়ে দিয়েছিল। বিছানায় উপুড় হয়ে কেঁদেছিল ফুল্লরা।

নতুন জায়গায় ঘুম আসতে দেরি হয়। কিন্তু বিট্টলপুরায় এসে বিছানায় পিঠ ঠেকাতেই ঘুম এসে গেল ফুল্লরার। কারণ দুদিনের ট্রেন জার্নিতে সে প্রায় ঘুমোয়নি বললেই চলে। মাকে ছেড়ে এতদূর চলে আসার কষ্ট একটা ফোড়ার মতো টাটিয়ে ছিল বুকের মধ্যে, তার ওপর অচেনা একটা লোকের সঙ্গে আসা, প্রতি মুহূর্তেই মনে হচ্ছিল হিংস্র নেকড়ে তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে।

স্টেশনে নেমে ধলাদাদুকে দেখে ওর মন অনেক হালকা হয়ে গেল। ধলাদাদু আজ যেতে পারছে না, তবে বিয়ের দিন অবশ্যই যাবে। তারপর দুবার বাস পালটে সন্ধে নাগাদ বিট্টলপুরায় এসে পৌঁছলো।

বাস থেকে নেমে সে দেখল পুরো গ্রামটা অন্ধকারে ডুবে আছে। মাঝে মাঝে টিমটিমে লণ্ঠনের আলো। গ্রামে এখনও বিদ্যুৎ আসেনি। বাস থেকে নেমে কাঁচা সড়ক দিয়ে অল্প একটু হেঁটে ওর শ্বশুরবাড়ি। একটা লোক আলো নিয়ে এগোতে গেছিল। উঠোন ঘিরে ছড়ানো ছিটোনো ঘর। লণ্ঠনের আলোয় ও বুঝতে পারল না ভালো। ওরা ঢুকতেই একদল বাচ্চা ছুটে এল। ওদের চিৎকার থেকে একটাই শব্দ বুঝতে পারল ফুল্লরা।

‘পানিবাই! পানিবাই!’

কাকে বলছে কথাটা? নতুন বউকে এরা পানিবাই বলে নাকি? ওকে হাত-পা ধোবার জায়গা দেখিয়ে দিতে গেল এক মহিলা। খুব শক্ত, হাড়-হাড় চেহারা, রাগি মুখ। সে দাঁতে দাঁত চেপে যা বলল, তা থেকে মোদ্দা কথা বুঝে নিল ফুল্লরা। মহিলা ওকে বলছে, এটা শুখা দেশ, বাংলার মতো হরা-ভরা নয়, তাই পানি কম খরচ করতে হবে।

তাদের ঘটকপুকুরে তাকে খাবার জল পাবার জন্যে সবার পেছনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়াতে হয়েছে সত্যি, কিন্তু সে তো অন্য কারণে। সেখানে জলের ছড়াছড়ি। বাড়ির পেছনে হাঁসপুকুরে তারা ঝাঁপাঝাঁপি করে চান করত। আর এখানে দু-এক ঘটিতে তো পুরো গা-ও ভিজবে না। রাতের খাবারে মোটা মোটা রুটি আর বিচ্ছিরি স্বাদের একটা সবজি খেতেও ওর তত কষ্ট হচ্ছিল না, যতটা জলের জন্য হচ্ছিল।

রাতে ওকে শুতে দেওয়া হল একটা বুড়ির সঙ্গে। তাদের দেশে বয়স হলে সাদা বা হালকা খোলের শাড়ি পরে, এ বুড়ি পরে আছে ক্যাটকেটে সবুজ রঙের শাড়ি। তবে মানুষটা এমনি খারাপ না। শুয়ে শুয়ে ওর পিঠে হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল আর বিড়বিড় করে কীসব বলছিল। একসময় বুড়ির হাত ওর কোমরে এসে থামল। কোমর টিপে টিপে বুড়ি যেন কী পরখ করার চেষ্টা করছে। হাতটা সরিয়ে দেবার চেষ্টা করতে করতে ফুল্লরা কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিল, সে নিজেও জানে না। মাঝরাতে হঠাৎ কান্নার শব্দে ঘুম ভাঙল। বিছানা হাতড়ে দেখল বুড়িটা নেই। ঘরের বাইরে থেকে মেয়েগুলোর কান্না আর পুরুষের চিৎকার ভেসে আসছে। শুনতে শুনতে ফুল্লরা আবার ঘুমিয়ে গেল।

পরদিন ঘুম ভাঙল শক্ত এক হাতের ধাক্বায়। সেই রাগি রাগি বউটা ওকে ঠেলা দিচ্ছে।

‘এত বেলা অবদি ঘুমোলে পানি মিলবে?’

কে যেন পাশ থেকে বলল, ‘আহা, সে তো আজই নয়, আগে তো শাদি হোক।’

‘আরে রাখো তোমার শাদি, আজ যদি ঝুঁটি ধরে না তুলি, তবে আদত পড়ে যাবে বিছানায় শুয়ে থাকার।’

আরেকটি বউ অমনি ঝনঝন করে হেসে উঠল, ‘আহা কোন সুখে বিছানা আঁকড়ে থাকবে বলো, সে তো তুমিই দখল করে আছ!’

এই কথা শুনে রাগি বউটি দপদপ করে চলে গেল। অন্য বউগুলো, যারা ফুল্লরার বিছানার চারদিক ঘিরে ছিল, তারা বলল, ‘জলদি জলদি উঠে পড়, আজ না তোর শাদি?’

তাদের গাঁয়ে ‘ওঠ ছুঁড়ি তোর বিয়ে’ বলে একটা কথা আছে। কিন্তু ফুল্লরার বুক কেমন ধক্ করে উঠল শুনে। ‘আজই শাদি! ধলাদাদু যে বলল তিনদিন পরে?’

‘আহা, এই তিনদিন পানি আনার জন্য অন্য বাই রাখবে নাকি?’

আসা থেকেই ‘পানি’ শব্দটা কতবার শুনেছে ফুল্লরা। মাথায় এখন যেন সেই জল টলটল করে উঠল। বিছানা থেকে উঠতে গিয়ে পড়ে যাচ্ছিল ও। বউগুলো চেঁচিয়ে উঠে বলল, ‘হায় হায়! এই দুবলি পাতলি লেড়কি কী করে পানিবাই হবে? ভগবানচাচা কেমন মেয়ে ঢুঁড়ে আনল!’

পাশ থেকে কে যেন বলল, ‘আশপাশের গাঁয়ে তো কেউ রাজি হল না। ভগবানচাচা তাই বলল, বাঙালি লেড়কিরা কথা শোনে, তার ওপর বাপও নেই।’

বিয়ের মন্ডপে বসেও ফুল্লরার মাথায় টলমলানি যাচ্ছিল না। পানিবাই! পানিবাই মানে কী! নতুন বউকে এদেশে পানিবাই বলে নাকি? ভগবানচাচাকে ও কোথাও দেখতে পাচ্ছিল না। পেলে বলত মাকে ফোনে ধরে দিতে। মা এখন নিত্য শাহ-র বাড়ি ঘর মুছতে মুছতে জানতেও পারছে না তার মেয়ের বিয়ে হয়ে যাচ্ছে।

নিজের চিন্তায় এতখানি ডুবে ছিল ফুল্লরা, যে সে বুঝতেও পারেনি বিবাহমন্ডপে কখন বর এসে হাজির হয়েছে। বাচ্চাদের ‘দুলহা আ গয়া, দুলহা আ গয়া’ চিৎকারে সে সচকিত হয়ে দেখল তার সামনে এক দীর্ঘদেহ, প্রশস্ত বক্ষ মানুষ, এদেশের রীতি অনুযায়ী মুখ ঢেকে এসে দাঁড়িয়েছে। ফুল্লরার বুক দুরদুর করে উঠল, সমস্ত ভয়, সন্দেহ, অপমান, ক্ষুধা দূর হয়ে যাবে এইবার। তার কল্পলোকের শাহরুখ খান এসে দাঁড়িয়েছে তার সামনে বরমাল্য হাতে। কে যেন চেঁচিয়ে বলল, ‘মুখ খোলো কিষণলাল।’ দুলহা মুখের ওপর থেকে চাঁদমালার মতো ঢাকা সরিয়ে নিল। অমনি ফুল্লরার নাকে এসে লাগল একটা পচা গন্ধ। বাবাকে জল থেকে তোলার পর যেমন গন্ধ বেরোচ্ছিল। কিন্তু সত্যি সত্যি তো এমন গন্ধ কোথাও নেই। চারদিকে ঘিরে থাকা বউ-মেয়েরা সুগন্ধি ফুল ছুঁড়ছিল, কিষণলাল কড়া সেন্ট মেখে আছে, তবে? আসলে বুড়ো মানুষদের শরীর থেকে একধরনের পচা গন্ধ বেরোয়, শিথিল চামড়া, নড়া দাঁতের গন্ধ, বহু বছর দুনিয়া দেখে ভেতরটা পচে যাবার গন্ধ। সামনে দুলহা সেজে যে লোকটা দাঁড়িয়ে আছে, তার বয়স সত্তরের কম নয়। লোকটা ভাবলেশহীন চোখে ফুল্লরাকে দেখছিল, আর ফুল্লরার ষোলো বছরের সবুজ লাউডগা শরীর গুলিয়ে উঠছিল। এই তার শাহরুখ খান! সে মাথা ঘুরে মাটিতে পড়ে গেল।

জ্ঞান ফিরতে দেখল, সেই বুড়ি মহিলা তার চোখমুখে অল্প অল্প জলের ছিটে দিচ্ছে। জলের স্পর্শে আরাম হচ্ছিল ফুল্লরার। আবার মায়ের কথাও মনে পড়ছিল। সে ডুকরে কেঁদে উঠতেই বুড়ি তাকে প্রবোধ দিয়ে বলল, ‘দুলহার বয়স আর রূপ দেখে ফালতু কষ্ট পাচ্ছিস। যেমন নাম-কা-ওয়াস্তে শাদি, তেমনি নাম-কা-ওয়াস্তে পতি। তোর আসলি মরদ তো ওইটা।’ বলে কী যেন একটা আঙুল দিয়ে দেখায় বুড়িটা। তার আঙুল অনুসরণ করে ফুল্লরা দেখে ঘরের কোণে একটা পিতলের বিশাল কলশি। গড়নটা তাদের দেশের তুলনায় খানিকটা আলাদা, কিন্তু দেখেই বোঝা যাচ্ছে অনেক বেশি ভারী। এতে করে জল আনতে গেলে মোষের শক্তি দরকার। আচমকা তার মাথায় পর-পর কিছু দৃশ্য-শব্দ খেলে যায়, গত রাতে বুড়ির তার কোমর পরখ করা, দুবলি-পাতলি বাঙালি, পানিবাই! সে-ই পানিবাই নয়তো?

কান্নায় তার শরীর ফুলে ফুলে ওঠে। বুড়ি তার গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, ‘পাগলি কাঁহিকা! এখনও বরের বয়স ভাবছিস বসে বসে। আরে, ও তোকে কোনওদিনই বিছানায় নেবে না। সে তো আছেই আশাবাই। ধরমপত্নী। তবে কি না, পুরুষের কাম, কখন কাকে দেখে জেগে ওঠে। কুছ সাল পহলে, এক বরসাতের রাতে, আশাবাই বাচ্চা বিয়োতে মাইকে গেছে, আমাকে ডাকল। তা কী করে না বলি বল, পানিবাই হলেও বউ তো বটে। শরীরের স্বাদ পেয়েছিল তো, তাই আমায় তাড়ায়নি। এখন তো আর পানি আনতে পারি না, তাও রেখে দিয়েছে। অথচ কত পানিবাই এল আর গেল।’

কান্না থামিয়ে বিষ্ময়ে হতবাক ফুল্লরা বুড়ির দিকে তাকায়। এই বুড়ি কিষণলালের বউ!

বুড়ি বলে চলে, ‘আসলি বাত কী জানিস? এ হল শুখা দেশ। সহজে পানি মেলে না। পানি দু-তিন গাঁও ভেঙে আনতে যেতে হয়। সকালে গেলে ফিরতে ফিরতে বিকেল তিনটে-চারটে। তা ঘরের বউ যদি পানি আনতে যায়, তবে ঘরের কাম-কাজ কী করে চলবে, খানাপাকানো, বালবাচ্চাদের পালপোষ কে করবে? তাই পানিবাইদের দরকার। শাদি তো একটা হচ্ছে, তাই মাইনে দিতে হয় না, ডাল-রুটি তো মিলবে দুবেলা। তা, কিষণলালের খুব বদনাম, বউটাও রাগি, তাই এখানকার কেউ আর পানিবাই হয়ে আসতে চায় না। একজনকে তো পিটিয়েই…’ বুড়ি কী যেন বলতে গিয়ে চুপ করে যায়। ফুল্লরা হাঁটুর ওপর মুখ রেখে সেই নৈঃশব্দ্য থেকে কিছু খুঁড়ে বার করার চেষ্টা করে, জলের মতো। শুখা দেশে চোখের জলও যে শুকিয়ে যায়, কে জানত!

দূরে দূরে ছোটো কয়েকটা টিলা। পশ্চিমের টিলার পেছন থেকে কমলা আলোর বলটাকে আস্তে আস্তে নেমে যেতে দেখল ফুল্লরা। সূর্য ডুবছে। আজ তার বড্ড দেরি হয়ে গেছে। এখানকার বউরা মাথায় কলশি নিয়ে চলতে পারে। সেটা তার এখনও অভ্যাস হয়নি। সে কলশি নেয় কাঁখে। প্রথম প্রথম এত ভারী কলশি বইতে পারত না, একবার তো জলভরা কলশি দরজার কাছে পর্যন্ত এনে ফেলে দিয়েছিল। সেজন্য আশাবাই খুব মেরেছিল তাকে। রাতে খেতেও দেয়নি। গায়ের ব্যথায় সে পরেরদিন উঠতে পারেনি, জল আনাও হয়নি। সেই থেকে আশাবাই তাকে মারে না, কিন্তু বোলি বড়ো তীক্ষ্ণ তার। চাবুকের মতো সপাং করে গায়ে বেঁধে।

কিষণলাল বলে যে-লোকটা তার স্বামী, সে অবশ্য কিছু বলে না। উঠোনে পাতা চৌপাইতে বসে শুধু চোখ দিয়ে অনুসরণ করে তাকে। সে দৃষ্টি দেখলেই গা ছমছম করে ফুল্লরার। কারণ কিষণলাল তাকে যে দেখছে, সেটা আবার আশাবাই-এর নজর এড়ায় না। একসঙ্গে দুজোড়া চোখের ভার বহন করা কঠিন।

অন্যদিন ঠাঁ ঠাঁ দুপুর রোদে সে ফেরে। আজ রোদ পড়ে গেছে। অত কষ্ট হচ্ছে না তার। কিন্তু মাসিক শুরু হওয়ায় কোমরে সে আর কলশি রাখত পারছে না। এবার থেকে এদেশের বউ-ঝিদের মতো মাথায় কলশি বওয়া অভ্যাস করতে হবে তাকে।

রোদ নেই। তবু কলশি নামিয়ে একটু জিরিয়ে নেওয়ার জন্য একটা গাছের ছায়া খুঁজল ফুল্লরা। গাছ, গাছের ছায়া তাকে বাংলার কথা, নদীর কথা, মায়ের কথা মনে পড়িয়ে দেয়। সেই বিয়ের দিন মাকে একবার ফোন করেছিল ভগবান চাচাকে ধরে করে। তারপর কত দিন, কত মাস হয়ে গেল কোনও খোঁজ খবর নেই। কিষণলালের একটা মোবাইল আছে, সারাক্ষণ সে সেটা গলায় ঝুলিয়ে ঘুরে বেড়ায়। কোনও বরসাতের রাতে সে যদি ফুল্লরার শরীর চায়, তাহলে, কিষণলালের মোবাইল নাগালে পেয়েও, মাকে ফোন করা হবে না ফুল্লরার। মার তো ফোন নেই। মাকে ফোন করতে হবে দিনের বেলা, মা যখন কারও বাড়ি কাজ করে। জল আনতে আসা-যাওয়ার পথে কোনও বাজার পড়ে না, যে সেখানে একটা ফোনের বুথ খুঁজে ফোন করতে পারে। তার কাছে অবশ্য পয়সা নেই, পানিবাইরা তো পেটখোরাকি, হাতে পয়সা পায় না। কিন্তু তার নাকে এককুচি রুপোর নাকফুল আছে, বাবার শেষ স্মৃতি। ফোনের বুথ পেলে ওই ফুল দিয়ে সে মাকে ফোন করবে। মা যেন ধলাদাদুকে পাঠিয়ে তাকে এখান থেকে নিয়ে যায়।

খুঁজতে খুঁজতে ফুল্লরা দেখল দূরে একটা শিমুল গাছ। মাংসল লাল ফুলে ছেয়ে আছে। শিমুল ফুল ফুটেছে! তার মানে এটা বসন্তকাল! আর কদিন পরেই বৈশাখ মাস পড়বে, তাদের হরিসভায় মোচ্ছব হবে, তাদের পাড়ার মেয়েরা সেজেগুজে গিয়ে কত মজা করবে, শুধু সে-ই থাকবে না। সবাই জানবে যে শাহরুখ খানের…

হঠাৎ শিমুলফুলের রং দেখে বুক ধক্ করে ওঠে ফুল্লরার। বসন্ত এসে গেছে! তার মানে একদিন বর্ষাও আসবে। আশাবাই-এর আবার গর্ভ হয়েছে, বুড়ি, যার নাম যশোমতী জানিয়েছে তাকে। বর্ষাকালেই হয়তো সে মাইকে যাবে। সেইসময়, অন্ধকার রাতে, কিষণলালের বুকে তৃষ্ণা জেগে ওঠে যদি? বাংলার শ্যামল-সবুজ জল-ছলছল শরীর পান করার সাধ জাগে তার? যশোমতী বলেছে তাতে অন্যায় কিছু নেই । কিষণলাল তো তার শাদি করা মরদ, সে তার শরীর নিতেই পারে। কিন্তু আশাবাই-এর মতো ঘর বা বিছানা সে পাবে না কোনওদিন। কিন্তু কিষণলালের ইচ্ছেয় সায় দিলে আখেরে তারই ভালো। যখন ফুল্লরা একদিন বুড়ি হয়ে যাবে যশোমতীর মতো, আর পানি আনতে পারবে না দূর গাঁও থেকে, তখন, কিষণলালের মনে জাগরুক থাকতে পারে তার শরীরের স্মৃতি, সে হয়তো তাড়াবে না ফুল্লরাকে। তা না হলে রাস্তায় রাস্তায় ভিখ মেগে বেড়াতে হবে তাকে।

ফুল্লরা কি তাহলে সারাজীবন জল বয়ে আনবে একটা সংসারের জন্য, যে-সংসারটা তার নয়। তার নিজের আনা জলে দু-ঢোঁকের বেশি অধিকার থাকবে না তার? জল আনতে আনতে যশোমতীর মতো বুড়ি হয়ে যাবে সে? তখন তাকে রাস্তায় রাস্তায় ভিক্ষে করে বেড়াতে হবে, যদি না কোনও বরসাতের রাতে কিষণলালের ইচ্ছেয় সে সাড়া দেয়?

ভাবতেই ভেতরটা কেঁপে ওঠে। শিমুল ফুলের টকটকে লাল রং যেন বিপদ সংকেতের মতো তার চোখের সামনে নাচতে থাকে। বসন্ত থেকে বর্ষা আর কতই বা দূর। তাকে পালাতে হবে। তাকে এখনি পালাতে হবে। দৌড় শুরু করার আগে সে নিজের আনা জল, কলশি কাত করে আঁজলা ভরে আশ মিটিয়ে খেয়ে নেয়। তারপর ধাক্বা মেরে উলটে দেয় কলশিটা। জল মাটিতে গড়িয়ে যায়, শুখা মাটি তা শুষে নেয় মুহূর্তে।

অনেকক্ষণ থেকে মেয়েটাকে লক্ষ্য করছিলেন ইনস্পেকটর ঘোসলে। মেয়েটার সাজপোশাক মারাঠি গাঁয়ের বউয়ের মতো, কিন্তু ওর সবুজ পানপাতার মতো মুখ, নরম চাউনি বলে দিচ্ছে ও বাঙালি। কিছুক্ষণ আগে তিনি এক দল বাঙালি মেয়েকে উদ্ধার করেছেন মুম্বইয়ের এক কুখ্যাত কোঠি থেকে। এদের কলকাতা নিয়ে যাওয়ার জন্য পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের দুজন প্রতিনিধি এসেছে কলকাতা থেকে। তিনি নীচুগলায় তাদের সঙ্গে কীসব বলেন…

হাওড়া স্টেশনে ট্রেনটা থামার পর টিভি ক্যামেরা ঝাঁপিয়ে পড়ল মেয়েগুলোর ওপর। সবাই ওড়না বা শাড়ির আঁচলে মুখ ঢেকে ফেলল অমনি। শুধু একটা মেয়ে উদাসীন মুখে বসেছিল। সাংবাদিকদের হাজার প্রশ্নের উত্তরে যে শুধু একটাই কথা বলল, ‘পানিবাই’।

আবার ইস্কুলের সামনের টিউকল থেকে জল নিতে এসেছে ফুল্লরা। আগে যেমন আসত। কিন্তু ঠিক আগের মতো যে আর সবকিছু নেই তা সে বুঝতে পারছে। আগের মতো জলের জন্য সবার পেছনে দাঁড়াতে হচ্ছে বটে, কিন্তু আগে তাকে দেখে বউদের এরকম কানাকানি, গা-টেপাটেপি ছিল না। সেদিন হাওড়া স্টেশনের ছবি অনেকেই দেখেছে টিভিতে। ওকে মুম্বইয়ের কোঠি থেকে উদ্ধার করা হয়েছে, এরকম একটা খবর রটে গেছে চারদিকে। তাতে নতুন করে কিছু ক্ষতি হয়নি, আগেও ওরা একটেরে কাওরাপাড়ায় আধপেটা খেয়ে থাকত, এখনও তাই। মায়ের কাজগুলোও যায়নি, বরঞ্চ তার মেয়ের মুখ টিভিতে দেখা গেছে বলে খানিকটা সমীহ তৈরি হয়েছে। তবে সবাই সনকাকে বলছে, ‘আগেই তোমাকে বলেছিলাম, শুনলে না।’

তবে লাভ একটা হয়েছে, কলকাতা থেকে ভালো শাড়ি-জামা পরা, চশমা চোখে একদল মহিলা দামি গাড়ি চেপে এসেছিল শুধু ওর সঙ্গে কথা বলতে। তারা ওকে শহরের মহিলা স্বনির্ভর কেন্দ্রে ভর্তির ব্যবস্থা করেছে। কাজ শেখার পাশাপাশি কিছু রোজগারও হবে।

সবার জল নেওয়া হয়ে গেছে ভেবে ফুল্লরা তাড়াতাড়ি তার প্লাস্টিকের বোতল কলের মুখে বসাতে গেল। ঘোষেদের মেজোবউয়ের যে আর একটা বোতল বাকি আছে সে দেখতে পায়নি। মেজোবউ অমনি খরখরে গলায় বলে ওঠে, ‘আরে ছুঁড়ি, মর মর। তোকে ছুঁয়ে আবার অবেলায় চান করব নাকি? একে কাওরা-হাঁড়ি, তারওপর দিল্লি বোম্বে সৃষ্টি জজিয়ে এসেছিস!’

শুনে শুনে অভ্যস্ত, তবু খামোখা চোখে জল এল ফুল্লরার। কয়েক মাস আগেও তার আনা জলের জন্য হাঁ করে থাকত আশাবাই আর তার ছেলেমেয়েরা। কিষণলাল লোটা ভরে পানি খেয়ে তৃপ্তিতে  বলত ‘আঃ’। ফুল্লরা বাড়ির জন্য কান্নাকাটি করলে যশোমতী তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলত, ‘লোককে পানি পিলানা বড়ো পুণ্যের কাজ রে। পানিবাই কি যে সে হতে পারে?’ কয়েক মাসের তফাতে, সেই একই জল, তার ছোঁয়ায় অশুদ্ধ হয়ে গেল!

ভালো বাসা

সক্রোধে তখনও চেঁচিয়ে চলেছেন মৃণালিনী। ‘না আর এক মহূর্তও এই বাড়িতে থাকব না আমি। এ বাড়ির জলও আমার জন্য বিষ। আমার কি মান-সম্মান বলে কিচ্ছু নেই! সামান্য একটা কাজের লোক কিনা আমার মুখের উপর জবাব দেবে। এতবড়ো দুঃসাহস। এ অনাচার মেনে নেওয়া যায় না। আজই আমরা এ-বাড়ি ছেড়ে গ্রামের বাড়িতে চলে যাব।’

উৎপলেন্দুবাবু সামনের চেয়ারে বসে চায়ে চুমুক দিতে দিতে খবরের কাগজের পাতা উলটে-পালটে দেখছিলেন। আর মাঝে মাঝে আড়চোখে চশমার ফাঁক দিয়ে গিন্নির পারদ মাপবার চেষ্টা করছিলেন। প্রথম প্রথম পাত্তা দেননি, কিন্তু বেগতিক দেখে বলে বসলেন, ‘বনমালি তোমাকে কী এমন বলেছে যে, সক্বাল সক্বাল বাড়ি একেবারে মাথায় তুলে ফেললে। বলার মধ্যে এই তো বলেছে, বাগান থেকে ফুল না তুলতে। ও তো দ্যাখে ওই গাছগুলোর পিছনে ওর বউদিমণি কতটা সময় ব্যয় করে। বরাবর বউমার তো একটাই স্বপ্ন, বাড়ির সামনে একটা ছোট্ট সুন্দর ফুলবাগান থাকবে। সেখানে তুমি যদি ওর সাজানো বাগান নষ্ট করতে যাও, তাহলে কথা তো উঠবেই। আজ ও বলছে, কাল কেয়া, বউমা কিংবা রক্তিম বলবে।’

স্বামীর কথা শুনে ঝাঁঝিয়ে ওঠেন মৃণালিনী, ‘তুমি তো কখনওই অন্য কারওর দোষ দেখতে পাও না। ঘরে সাজিয়ে রাখব বলে সামান্য কয়েকটা গোলাপের কুঁড়ি-ই তো তুলেছিলাম! অমনি ওই বউদি-সোহাগি এসে বলে কিনা ফুল তুলবে না। বউদিমণি রাগ করবেন। কোথায় তোর বউদিমণি ডাক, আমিও দেখছি।’ কাকে ডাকবে সে, তার বউদিমণি, দাদাবাবু তো ততক্ষণে অফিসে পৌঁছে গেছে।

বনমালি এবাড়িতে বাগান দেখাশোনার কাজ করে। শুধুমাত্র বাগানের শখ মেটাবার জন্য বাড়ির-ই নীচের তলায় একটা ঘরে থাকতে দিয়েছে কেয়া আর রক্তিম। দু-বেলা খাওয়াদাওয়া, থাকা আর মাস গেলে কিছু টাকা পায় সে। তাতেই সে খুশি। চারকূলে তার যে আর কেউ নেই। কেয়ার বাগানের শখ দেখে এক প্রতিবেশী কাকিমাই বিশ্বস্ত এই বনমালিকে ঠিক করে দিয়েছেন। গাছ দেখাশোনা ছাড়াও ঘরের দোকান-বাজার করে দেয় ওই বনমালি-ই। কেয়ারটেকার বললেও খুব একটা ভুল বলা হয় না। খুব সাধাসিধে মানুষ। সংসারের এত মারপ্যাঁচ সে বোঝে না। আগে চাকদা গ্রামে থাকত। মাটির পাত্র বানাত। তাতে দুবেলা ঠিক করে খেতেও পেত না। এই কাজ পেয়ে সে খুব খুশি।

অন্যদিন ছেলে-বউমার সাথেই বেরিয়ে যান উৎপলেন্দুবাবু। আজ হাঁটুর ব্যথায় কাবু হয়ে পড়েছেন, তাই আর বেরোতে পারেননি। একটু বেলা করে উঠে সামনে পার্কে কিছুক্ষণের জন্য পা-টা ছাড়াতে গিয়েছিলেন। তখনই খানিক আভাস পেয়েছিলেন। কিন্তু সেটা যে এতদূর গড়াবে বুঝতে পারেননি।

বাড়ি ফিরে দেখেন তখনও তর্জা চলছে। গিন্নি অনর্গল অকথা-কুকথা বলেই চলেছেন, আর সামনে দাঁড়িয়ে বনমালি মালি থরথর করে কাঁপছে। বারবার বোঝানোর চেষ্টা করছে ওভাবে সে বলতে চায়নি, কিন্তু কে-কার কথা শোনে। ভেবেছিলেন আশ মিটিয়ে বলার পর গিন্নি খানিক শান্ত হবে, তাই কিছু না দেখার ভান করে লক্ষ্মীকে চা দিতে বলে খবরের কাগজটা নিয়ে বসে পড়েছিলেন। মাঝে লক্ষ্মী এসে চুপিসাড়ে চা-ও দিয়ে গেছে। একটুও দাঁড়ায়নি সে-ও কী কম ডরায় গিন্নিমাকে। সব ওই মুখে মুখে চোপার কারণে।

বনমালির অনুনয়-বিনয় কাজে আসছে না দেখে নিজেই মাঠে নেমে পড়লেন উৎপলেন্দুবাবু। পরিবেশ হালকা করতে চেষ্টা চালালেন বটে, কিন্তু কাজে দিল না। ‘মাথা ঠান্ডা করো, মাথা ঠান্ডা করো। রক্তের চাপ বেড়ে যাবে।’ বলেই হাঁক দিলেন, ‘লক্ষ্মী তোর গিন্নিমাকে ফ্রিজ থেকে এক বোতল জল দিয়ে যাতো। মাথায় ঢালুক।’ আর সঙ্গে সঙ্গে বনমালিকেও ইশারা করলেন ওখান থেকে সরে পড়ার জন্য। বড়োবাবুর কথামতো সেও সুড়সুড় করে সরে পড়ল।

স্বামীর রসিকতা আর ইশারার বহর দেখে মেজাজ আরও সপ্তমে চড়ে যায় মৃণালিনীর। ‘তোলো তোলো, আরও মাথায় তোলো। তোমাদের সংসার তোমরা যা খুশি করো। মৃণালিনী কারওর গলগ্রহ হয়ে বেঁচে থাকবে না। কালই চলে যাব এখান থেকে। মৃণালিনী শেষ হয়ে যাবে তবু কথার নড়চড় করবে না।’

মৃণালিনীর কথায় কথায় হুমকি দেওয়াটা নতুন কিছু নয়। বাড়ির সকলেই কমবেশি ওনার এই অভ্যাস সম্পর্কে অবগত। কথায় কথায় শপথ নেওয়া, দিব্যি দেওয়া, তিলকে তাল করা, সুযোগ পেলেই সকলকে নীচু দেখানো এটা ওনার বরাবরের অভ্যাস। আগে নিজের সংসারে হুকুম চালাতেন এখন ছেলে-বউয়ের সংসারে। তফাতটা এই যা!

মৃণালিনী বরাবরই বদমেজাজি। সংসারে চ্যাঁচামেচি, টুকটাক ঝামেলা তো হয়ই, তবে বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি এর আগে কোনওদিন তৈরি হয়নি। রাগ করেছেন আবার নিজে নিজেই শান্ত হয়ে গেছেন। তার মালকিন হওয়ার অহংবোধ তাকে কোনওদিন একথা ভাবায়নি।

কিন্তু আজ ছবিটা একটু আলাদা। এটা তার ছেলে বউয়ের বাড়ি। ছেলে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক-এর ম্যানেজার। বউমা একটা কর্পোরেট অফিসে আছে। শহরের সম্ভ্রান্ত এলাকায় দেখার মতো একটা বাংলো। ছেলেও মায়ের ব্যাপারে বেশ যত্নশীল। তৎসত্ত্বেও কিছু কিছু মহিলা এমন থাকেন, যারা ছেলের বিয়ে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ভাবতে শুরু করেন ছেলে পর হয়ে গেছে।

অথচ বিয়ের আগে এই ছেলেকেই চোখে হারাতেন মৃণালিনী। ছেলের সাথে মন-কষাকষি শুরু হয় কেয়ার সাথে বিয়ের অনুমতি চাওয়ার সময় থেকেই। এক তো নিজেদের পছন্দের মেয়ে নয় তার উপর জাত আলাদা। কিছুতেই মন থেকে মানতে পারছিলেন না মৃণালিনী। এই নিয়ে কম কথাকাটাকাটি হয়নি। শেষে উৎপলেন্দুবাবুর মধ্যস্থতায় মৃণালিনীর অমতেই রক্তিম আর কেয়ার বিয়েটা সম্পন্ন হয়েছিল। ছেলের খুশির কথা মাথায় রেখে মত দিয়েছিলেন উৎপলেন্দুবাবু। সঙ্গে মৃণালিনীকেও বুঝিয়েছিলেন, ‘অসুবিধেটা কোথায়? কেয়া যথেষ্ট সুন্দরী। শিক্ষিত। ভালো পরিবারের মেয়ে। তাছাড়া যেখানে রক্তিম নিজে থেকে পছন্দ করেছে, সেখানে আমাদের রাজি হওয়া না হওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। ভালো বলতে হবে রক্তিমকে যে ও তোমাকে সম্মান দিতে তোমার মতামত জানতে চেয়েছে।’

কিন্তু মৃণালিনী নিজের সিদ্ধান্তে অনড়। না-জানি কেন ওনার বারবার মনে হয়েছে ওনার সাধাসিধে ছেলের মাথাটা এমবিএ করা কেয়া একেবারে চিবিয়ে খেয়েছে। আসলে উনি ব্যাংক ম্যানেজার ছেলের জন্য কোনও উচ্চশিক্ষিত মেয়ে চাননি বরং এমন মেয়ে আনতে চেয়েছিলেন, যে দিবারাত তার সেবা করবে, তার কথা মতোই চলবে।

উৎপলেন্দুবাবু কম বোঝাননি, যে সংসারটা শেষমেশ তাদেরকেই করতে হবে, মৃণালিনীকে নয়, তার থেকেও বড়ো কথা ওরা একে-অপরকে ভালোবাসে, জানে বোঝে, সুতরাং ওরা একে-অপরের সঙ্গে ভালো থাকবে। কিন্তু ছেলের পছন্দ করার কাঁটাটা মৃণালিনী কোনওদিন তুলে ফেলতে পারেননি। তবুও একরকম চলে যাচ্ছিল।

উৎপলেন্দুবাবুর বদলির চাকরি। মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার। ভালো পোস্টে আছেন। কর্মসূত্রে বিভিন্ন জায়গাতেই থাকতে হয়েছে। শেষে চাকরির আর বছর তিনেক বাকি থাকতে কলকাতায় ট্রান্সফার হয়ে এসেছেন। প্রথমে ভেবেছিলেন গ্রামের বাড়ি থেকেই যাতায়াত করবেন। কিন্তু এই বয়সে তিন-তিন ছয় ঘন্টা জার্নি করা খুব কষ্টের। শরীর দেবে কেন! তাই ঠিক করে ছিলেন ছেলের বাড়িতেই থাকবেন। কিন্তু মৃণালিনী আপত্তি জানিয়েছিলেন। তাই গিন্নির কথামতো ঠিক করেছিলেন অফিসের কাছাকাছি বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকবেন। সেইমতো ব্যবস্থাও পাকা করে ফেলেছিলেন, কিন্তু ছেলে রাজি হয়নি। একপ্রকার জোর করেই মা-বাবাকে বাড়িতে নিয়ে এসেছিল। ‘এই বয়সে তোমাদের একা থাকাটাও তো ঠিক নয়। শরীরের কথা তো বলা যায় না। কখন কি হয়। সবসময় কি এতটা পথ ঠেঙিয়ে আসাটা সম্ভব। তাছাড়া অদ্রিজা বড়ো হচ্ছে, সব কিছু সামলে সম্ভব হলে তো? তাছাড়া তোমরা ভাড়া থাকতেই বা যাবে কেন।’

একপ্রকার বাধ্য হয়ে মৃণালিনী এবাড়িতে আসতে রাজি হয়েছিলেন। কিন্তু কিছুতেই নতুন পরিবেশে মানিয়ে নিতে পারছিলেন না। ছেলে-বউমা ওনার সবরকম সুবিধা-অসুবিধার খেয়াল রাখত। অভিযোগ করার কোনওরকম সুযোগ দিত না। তবু সুযোগ পেলেই উৎপলেন্দুবাবুকে বলতে ছাড়তেন না, ‘নিজেদের বাড়ির আলাদা একটা ব্যাপার। সেখানে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে সব কিছু করা যায়, কোনও কিছুতে কিন্তু কিন্তু করতে লাগে না। কত করে বললাম– একটা বাড়ির ব্যবস্থা করতে, তা নয় অন্যের সংসারে জোয়াল টেনে মরছি।’

‘জোয়াল টানার কথা কেন বলছ মৃণাল, কেয়া তো কোনওদিন তোমাকে এক গ্লাস জলও গড়িয়ে খেতে বলেনি। তুমি নিজের ইচ্ছেয় করো। লক্ষ্মীকেও রান্নায় হাত লাগাতে দিতে চাও না। তাহলে কেন শুধু শুধু…। তাছাড়া অন্যের তো নয়, করছ তো নিজের সংসারেই। ছেলে-বউ-নাতনি তো আর পর নয়।’ মিষ্টি হেসে জবাব দেন উৎপলেন্দুবাবু।

কথাগুলো মৃণালিনীর মনোমতো হয় না, ‘এসব তোমরা ছেলেরা বুঝতে পারবে না। আর নাতনির কথা বলছ তাকেও তো প্রশ্রয় দিয়ে দিয়ে একেবারে মাথায় তুলে রেখেছে তোমার বউমা। এখন থেকেই মুখে মুখে জবাব দিতে শিখে গেছে। কেউ বলবে ক্লাস সিক্স-এ পড়ে। পোশাক-আশাক দেখেছ। ওই ছোটো ছোটো স্কার্টগুলো– সব মায়ের দোষ। নিজেও যেমন ছেলেদের জামাকাপড় পড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে, তেমনি মেয়েটাকেও উচ্ছন্নে পাঠাচ্ছে। সারাদিন তো বাইরে পড়ে রয়েছে। মেয়ে, মানুষ হবে কী করে। চাকরি করছে চাকরি! বলি চাকরি করে হবেটা কী? এমন তো নয় যে ও উপায় করে আনলে তবে হাঁড়ি চড়বে। রক্তিমের আয় তো কম নয়। আসলে তা নয় ঘরে মন টেকে না।’

বিরক্ত হয়ে উঠে দাঁড়িয়ে পড়েন উৎপলেন্দুবাবু। একটু কর্কশ ভাবেই বলেন, ‘পড়াশোনা শিখেছে কি ঘরে বসে থাকবে বলে। এখন আর কেউ বাড়িতে বসে থাকে না। তোমার এই খিটখিটে মেজাজের জন্য অদ্রিজাটা পর্যন্ত তোমার কাছে ঘেঁষতে চায় না। সব সময় টিক-টিক, এই করিস না ওই করিস না। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সবকিছু বদলায়। তোমার কালে একরকম ছিল এখন আর এক রকম। এতবছর বাইরে থেকেও একটু বদলালে না তুমি। সেই পুরোনো চিন্তাভাবনা নিয়ে বসে আছ। কিছু বলার থাকলে ভালোবেসে বোঝাও। কেয়াকে দ্যাখো তো সারাদিন অক্লান্ত পরিশ্রমের পরেও মেয়েটা কীভাবে হাসি মুখে বাড়ির প্রতি তার দায়িত্ব-কর্তব্য পালন করে। মেয়েকে পড়ানো, তোমাদের সকলের ফরমায়েশ পূরণ করা।’ স্বামীর কথা শুনে মুখ বাঁকায় মৃণালিনী। স্ত্রীর আচরণে একটুও অবাক হন না উৎপলেন্দুবাবু। এই বদ্ধ পরিবেশ থেকে বাঁচতে দরজা খুলে বেরিয়ে যান তিনি।

এদিক থেকে উৎপলেন্দুবাবু অনেক উদার মনের মানুষ। খুব সহজেই সকলের সাথে মিশে যেতে পারেন। সকলকে আপন করে নিতে পারেন। তাই এত কম সময়ের মধ্যেই সকলের কাছে খুব প্রিয় হয়ে উঠেছিলেন। নাতনি তো একেবারে দাদুঅন্ত প্রাণ। কার্টুন দেখতে বসলেও দাদু। অঙ্ক করতে বসে কোনও সমস্যা হলেও দাদু আবার কোনও বায়না মেটাতে হলেও দাদু।

বউমা কেয়ার সাথেও উৎপলেন্দুবাবুর বেশ ভালো সম্পর্ক। পাকাপাকিভাবে উনি আসাতে কেয়াও অনেকটা নিশ্চিন্ত হতে পেরেছে। নাতনির পড়াশোনার পুরো দায়ভারটাই উনি নিজের ইচ্ছেয় কাঁধে তুলে নিয়েছেন। কেয়াকে সেভাবে আর দায়িত্বও নিতে হয় না। এমনকী প্রোজেক্ট ওয়ার্ক-টা পর্যন্ত উনি নিজের হাতে করেন। লক্ষ্মী-র ভরসায় তো আর পড়াশোনাটা ছাড়লে চলে না। সারাদিনের দেখভালের জন্য ও ঠিক আছে। বন্ধুদের জোরাজুরিতে বেড়াতে গিয়েছিল রক্তিম আর কেয়া। অদ্রিজার ক্লাস টেস্টের কারণে ওকে নিয়ে যেতে পারেনি। প্রথমে না-ই করে দিয়েছিল কেয়া, উৎপলেন্দুবাবুই জোর করে পাঠিয়েছিলেন তাদের। সেই নিয়েও মুখ ভার করতে ছাড়েননি মৃণালিনী।

‘কই আমার বেলায় তো এসব ভাবেনি কেউ। সব মনে আছে আমার, গ্রামের বাড়ি থেকে যখন মা আসতেন তখন আমরা দুজনে বেড়ানো তো দূর ঠিক করে কথা বলতে পর্যন্ত পারতাম না। মাথা থেকে ঘোমটা সরে যাওয়া নিয়ে কম গঞ্জনা শুনতে হয়নি আমাকে। মানুষ তো সবাই সমান তাহলে এত ভেদাভেদ কেন?’

‘ভুল করছ কোনও ভেদাভেদ নয়। নিজেরা যে দিনগুলো পেরিয়ে এসেছি, যাতে ওরা এই সমস্ত কষ্টের মুখোমুখি না হয়, তার জন্যই এই ব্যবস্থা। তাছাড়া এখন যাবে না তো কবে যাবে। ওরা তো আমাদের সমস্ত রকম ব্যবস্থা পাকা করে তবেই যায় বলো। অসুবিধা করে তো কোথাও যাচ্ছে না।’

‘সমস্যাটা তো তোমার নয় আমার। তুমি তো অফিসে চলে যাবে। এই বুড়ো বয়সে সংসারের সমস্ত ঝক্বি সামলাতে হবে আমাকে।’

‘একটু ভেবে দেখো তো ও তোমাকে বিশ্বাস করে বলেই না তোমার উপর সংসারের দায়িত্ব দিয়ে নিশিন্তে থাকতে পারে।’ কোনও জবাব দিতে পারে না মৃণালিনী।

মৃণালিনী যে খুব খারাপ মনের মানুষ, তা কিন্তু নয়। তবে সংসারে তিনিই যে সর্বেসর্বা একথা প্রমাণ করতে নিরন্তর লড়াই চালাতে চালাতে কেমন যেন গাম্ভীর্যের খোলসে মুড়ে ফেলেছেন নিজেকে। এতদিন যেখানে ওনার ইচ্ছের বিরুদ্ধে বাড়ির একটা পর্দা পর্যন্ত বদলানো হয়নি, সেখানে এই বাড়িতে যে-যার দুনিয়ায় মগ্ন, শত ব্যস্ততা। এখানে যেন তার কোনও অস্তিত্ব-ই নেই। এতদিনে তার বানানো ভিতটা যেন নড়বড়ে মনে হতে থাকে তার, সবসময় একটা ইনসিক্যুরিটি  কাজ করতে থাকে। নতুন এই পরিবেশে হাঁপিয়ে উঠছিলেন মৃণালিনী। কোনও মতেই নিজেকে এই আলো-আঁধারি থেকে টেনে বার করতে পারছিলেন না। ক্রমশ ঘনান্ধকারে ডুবে যাচ্ছিলেন তিনি।

তার উপর গত সপ্তাহে অদ্রিজার ব্যাগ থেকে পাওয়া প্রেমপত্র নিয়ে তিনি বেশ চিন্তিত ছিলেন। চিঠি আবিষ্কারের পর সকলের উপস্থিতিতে নাতনিকে জিজ্ঞেস করাতে নাতনি চিঠিটা ওনার হাত থেকে কেড়ে নিয়ে ঝাঁঝিয়ে ওঠে, ‘না বলে কারওর জিনিসে হাত দেওয়া উচিত নয়। কৃষাণু দাদা ওটা বিপাশা দিদিকে দিতে দিয়েছিল। আর তুমি না বলে পড়ে ফেললে। জানো না কারওর জিনিসে হাত দেওয়া উচিত নয়।’

নাতনির কথাতে একেবারে আকাশ থেকে মাটিতে নেমে এসেছিলেন মৃণালিনী। সব থেকে বেশি রাগ হয়েছিল ছেলে-বউয়ের উপর। এসব দেখেও তারা দু-ঠোঁট এক করল না। শাসন করার বদলে মেয়ের মুখে পাকাপাকা কথা শুনে হাসছিল তারা। তার উপর আজ বনমালির ফুল তুলতে মানা করার ঘটনাটা একেবারে আগুনের মধ্যে ঘি ঢালার কাজ করে দিয়েছে। সবমিলিয়েই আজকের ওনার এই বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার ঘোষণা।

বনমালি আজ আর এমুখো হয়নি। লক্ষ্মীকে দিয়ে ঘরেই খাবার আনিয়ে নিয়েছেন মৃণালিনী। বনমালির ক’টা মাথা যে আবার গিন্নিমার সামনে এসে দাঁড়ায়।

দুপুরে উৎপলেন্দুবাবুই বুঝিয়েসুঝিয়ে গিন্নিকে খাওয়াতে রাজি করিয়েছিলেন। খাওয়াদাওয়ার যখন প্রায় একেবারে শেষ ঠিক তখনই কলিংবেলের আওয়াজ। লক্ষ্মী দরজা খুলতেই কেয়া-কে দেখে উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে। ‘আরে বউদি আজ তাড়াতাড়ি ছুটি হয়ে গেল? ভালোই হয়েছে, সবার এখন খাওয়া শেষ হয়নি, হাত-পা ধুয়ে এসে বসে পড়ো। আমি খাবার বাড়ছি।’ বউমাকে দেখে উৎপলেন্দুবাবুও একগাল হেসে বলে ওঠেন, ‘যা-মা যা, ফ্রেশ হয়ে এসে বসে পড়।’ সামনের টেবিলে ব্যাগটা রেখে ফ্যানের নীচে বসে পড়ে কেয়া।

‘না বাবা, এখন আর কিছু খাব না।’ বলে লক্ষ্মীর দিকে তাকিয়ে, ‘তুই বরং আমাকে একটু লেবুর শরবত বানিয়ে দে, তাহলেই হবে।’

‘কিছু খাবে না?’

‘না রে, এই গরমে আর ভালো লাগছে না।’

‘হ্যাঁরে বনমালিদা, কই রে? ফেরার পথে নার্সারি থেকে এই চারাগুলো আনলাম। বসাতে হবে তো। খেতে আসেনি?’

‘হ্যাঁ খেয়েছে। তুমি রাখো, তোমাকে শরবতটা করে দিয়ে তারপর চারাগুলো দিয়ে আসছি।’ কিন্তু কিন্তু করে জবাব দেয় লক্ষ্মী। বনমালির প্রসঙ্গ ওঠাতে উৎপলেন্দুবাবুও চুপ করে যান। শাশুড়ির মুখটাও কেমন যেন ভার ভার লাগে কেয়ার।

লক্ষ্মীর কথাবার্তাতেই কেয়া খানিক আঁচ করতে পারে যে কিছু একটা ঘটেছে। সন্দেহ আরও বাড়িয়ে দেয়, খাবার সময়ে বনমালিদার অনুপস্থিতিটা। কেয়াও আর খুঁচিয়ে ঘা করতে চায়নি, পরে তো সব জানতেই পারবে।

‘ওহ্ বাবা ভাবছি বিকেলে একটু মার্কেটে যাব। তোমাদের কিছু লাগলে বোলো। ফেরার পথে নিয়ে আসব।’

মৃণালিনী যেন মুখিয়েই ছিলেন, উৎপলেন্দুবাবু কিছু বলার আগেই তাচ্ছিল্যের সুরে বলতে শুরু করলেন, ‘হ্যাঁ, এবাড়িতে শুধু উনিই আছেন। ওনার খিদমত খাটতে সবাই হাজির। শুধু আমিই সংসারের অতিরিক্ত বোঝা। আমার প্রয়োজনের কথা আর কে মাথায় রাখে। করার মধ্যে তো ওই রক্তিম-ই একটু…’ কথা শেষ করতে পারে না মৃণালিনী। তার আগেই কেয়া রাগত স্বরে বলে ওঠে, ‘আপনি হয়তো ঠিক করে শোনেননি, আমি আপনাদের দুজনের কথাই বলেছিলাম। আপনার প্রয়োজনের যথেষ্ট খেয়াল রাখি আমরা। ওইভাবে না বলে সোজাভাবেই বলতে তো পারেন কী লাগবে না লাগবে। এই সামান্য কথাতে রক্তিমকে টানার তো দরকার নেই।’ কথাগুলো বলে আর এক মুহূর্ত দাঁড়ায় না কেয়া। পায়ের শব্দ করতে করতে সিঁড়ি বেয়ে নিজের ঘরের দিকে চলে যায় সে।

উৎপলেন্দুবাবু সহজে রাগেন না। তবে সকাল থেকে বাড়ির পরিবেশে মেজাজটা এমনিতেই বিগড়ে ছিল। ‘এবার শান্তি হয়েছে। এটাই তো চাইছিলে। কতবার বলেছি মানিয়ে নিতে শেখো। গতবার যখন মুম্বইতে গিয়েছিলে তখনও তোমার জন্য মেয়ে জামাইয়ের মধ্যে অশান্তি লেগে গিয়েছিল। তোমার আর জামাইয়ের মাঝে পিষে মেয়েটা শেষ হতে বসেছিল। যেখানেই যাবে সেখানেই কিছু না কিছু ঘটাবে তুমি। বয়স তো হল। এবার তো শোধরাও।’ রাগ সামলাতে না পেরে খাবার থালা ঠেলে উঠে যান তিনি।

মেয়ে জামাইয়ের কথা বলতে বোধকরি খানিক অনুশোচনায় ভুগছিলেন মৃণালিনী। মনে মনে ভাবছিলেন সত্যিই তো তার জন্য মেয়ের সংসারটাই ভাঙতে বসেছিল। কিন্তু সেটা তো সম্পূর্ণ ভিন্ন ঘটনা। আজ অন্তত কেয়ার ওইভাবে বলা উচিত হয়নি। তাকে সঙ্গে করে নিয়ে গিয়ে তার প্রয়োজনীয় কিছু জিনিস কিনে দিতেই পারত সে।

উৎপলেন্দু তো সে সবের ধার দিয়েও হাঁটে না। আজ পর্যন্ত কোনওদিন একটা শাড়িও হাতে করে আনেনি তার জন্য। শুধু টাকা দিয়েই খালাস। কেয়া তো তো তবু মাঝে মধ্যেই এটা-ওটা-সেটা নিয়ে আসে তার জন্য। কী যে ভীমরতি ধরেছিল আজ, কেন যে কেয়াকে ওভাবে বলতে গেল। আর কেনই বা ঘর ছাড়ার কথাটা তুলতে গেল। এই বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাবেটা কোথায়? গ্রামের বাড়িতে! আজ পর্যন্ত গ্রামের বাড়িতে এক সপ্তাহের বেশি থেকেছে কখনও! সারাজীবন তো বরের সাথে এপ্রান্ত-ওপ্রান্ত করে বেড়িয়েছ। আর এই বুড়ো বয়সে গ্রামের বাড়িতে কাটাবে কীভাবে? শরীরেও তো নিত্যদিন কিছু না কিছু লেগেই রয়েছে। আগাগোড়াই চাকর-বাকর দিয়ে

সংসারের কাজ করিয়ে এসেছে। আর ছেলে-বউয়ের বাড়িতে এসে কাজ না করে করে তো বোধহয় হাত-পায়ে জং ধরে গেছে।

খেতে খেতে টিভি দেখাটা এবাড়ির সকলের বরাবরের অভ্যাস। ডাইনিং টেবিলে বসে সকলের চোখ আটকে থাকে টিভির পর্দায়। অবশ্য সকলে বলতে উৎপলেন্দুবাবু আর অদ্রিজার। রক্তিম তো আজ কয়েকদিন যাবৎ তাড়াতাড়িই ডিনার সেরে শুয়ে পড়ছে। ইয়ারএন্ডিং চলছে। কাজের প্রচণ্ড প্রেশার। সেই কাকভোরে বেরিয়ে যাচ্ছে আর ফিরতে ফিরতে রাত ন-টা দশটা। কেয়া আর লক্ষ্মী রান্নাঘরে সম্ভবত পরোটা ভাজছিল। ঠিক সেই সময়ে উৎপলেন্দুবাবুর চেয়ারের সামনে এসে দাঁড়ায় মৃণালিনী।

‘খাওয়া হয়ে গেলে তাড়াতাড়ি উপরে এসে ব্যাগ গুছিয়ে নিও।’

‘শুধু শুধু ব্যাগ গোছাতে যাব কেন?’ খুব সহজ ভাবে মৃণালিনীর দিকে না তাকিয়েই উত্তর দেন উৎপলেন্দুবাবু।

‘কেন আবার, কাল সকালের ট্রেনেই আমরা বেরিয়ে যাব।’

এইবার টিভির দিক থেকে চোখ সরিয়ে মৃণালিনীর দিকে তাকায় উৎপলেন্দুবাবু। বলেন, ‘যাচ্ছ তো তুমি, আমি ব্যাগ প্যাক করব কেন?’

কথাটা শুনে আঁতকে ওঠেন মৃণালিনী। কোনওমতে নিজেকে সামলে নেন। ‘মানে। মানে তুমি যাবে না তাই তো?’

‘ঠিক তাই।’ উৎপলেন্দুবাবুর সোজাসাপটা জবাব শুনে চমকে ওঠেন মৃণালিনী। স্বামীর কাছ থেকে কখনও এরকম উত্তর পাবেন আশা করেননি। প্রকাশ না করলেও একধাক্বায় মনের জোর কমে যায় মৃণালিনীর। এতদিনের বন্ধ ঘর খোলা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা, জ্বালানির ব্যবস্থা করা, দোকানপাট সমস্ত একহাতে করার কথা ভেবেই যেন অসুস্থ বোধ করতে থাকেন তিনি। মনে হতে থাকে এভারেস্ট-এ ওঠার থেকেও এগুলো বোধকরি অনেক কঠিন কাজ। কিন্তু আর করারও তো কিছু নেই, মুখ ফসকে বাড়ি ছাড়ার কথাটা তো বলে বসেছেন। যদি উৎপলেন্দুর হূদয় পরিবর্তনের একটুও আভাস পেতেন তাহলে ভুল করেও এমন শপথ বাক্য পাঠ করতেন না।

অগত্যা মনোবল বাড়িয়ে জিনিসপত্র গোছাতে শুরু করেছিলেন মৃণালিনী। কথামতো পরদিন সকালবেলা রক্তিম বেরিয়ে যাওয়ার পর ড্রাইভারকে গাড়ি বার করতে বলে ব্যাগ নিয়ে নীচে নেমে আসেন মৃণালিনী। গাড়িতে বসে দেখেন চালকের আসনে তার একমাত্র ছেলের বউ কেয়া। বেশ আশ্চর্য লেগেছিল মৃণালিনীর। কিন্তু পালটা কোনও প্রশ্ন করেননি। কোথায় ভেবেছিলেন যাবার সময় উৎপলেন্দু কিংবা বউমা আটকাবে। তা নয় এ যে একেবারে উলটো স্রোত। শাশুড়িকে বাড়ি থেকে তাড়াতে পারলে যেন হাড়ে বাতাস লাগবে। তাই এই ঔদ্ধত্য। ছেলে বাড়িতে থাকলে ব্যাপারটা হয়তো উলটো হতো। হয়তো…!

কেয়াদের বাড়ি থেকে স্টেশন চার কিলোমিটার। এতখানি পথ একটিও বাক্য ব্যয় করেনি কেউই। সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে কখন যে স্টেশনে পৌঁছে গেছেন বুঝতেই পারেননি মৃণালিনী। সম্বিৎ ফেরে এক কুলির কথাতে। ‘সামান দিয়ে আসব মাইজি?’ কুলির কথায় কর্ণপাত করেন না মৃণালিনী, ব্যাগটা নিজের হাতে নিয়েই পড়িমরি করে দরজাটা খুলে রাস্তাটা পার করতে যাবেন অমনি আচমকা সামনে একটা গাড়ি… তারপরে কিছুক্ষণের জন্য সব অন্ধকার। মাঝে একবার মনে হয়েছে, কে যেন তার হাতটা ধরে জোরে টান মেরেছে। তারপর আর কিছু মনে নেই।

সম্বিৎ যখন ফেরে তখন হাসপাতালের বেডে। মাথার সামনে বসে আছেন উৎপলেন্দুবাবু। আর কেয়া পুলিশের সামনেই সাতাশ-আঠাশ বছর বয়সি এক যুবককে ধমক দিয়েই চলেছে।

‘এইভাবে কেউ গাড়ি চালায়। যে-কোনও মুহূর্তে একটা বড়োসড়ো বিপদ ঘটে যেতে পারত। আজ আমি না থাকলে মানুষটা মারা পর্যন্ত যেতে পারত। কিছু হয়ে গেলে ফিরিয়ে দিতে পারতে। এই তোমাদের মতো বেপরোয়া ছেলেদের সাজা পাওয়াই উচিত। নইলে তোমরা শোধরাবে না। ইন্সপেক্টর সাহেব একদম ছাড়বেন না। কয়েকদিন জেলের হাওয়া খেলেই মজা টের পাবে।’

বিছানায় শুয়ে থাকা মৃণালিনীর আর বুঝতে বাকি থাকে না যে, অন্য কেউ নয়, তার বউমা কেয়াই তাকে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরিয়ে এনেছে। বউমার জন্যই যে প্রাণ ফিরে পেয়েছেন। এখন তার চোখের সামনে তার জন্যই লড়াই করছে কেয়া। যাকে তিনি চিরকাল তার প্রতিদ্বন্ধী ভেবে এসেছেন, সে-ই আজ তার পরিত্রাতা হয়ে সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।

মৃণালিনীর শরীরে কিছু কাটা-ছড়া ছাড়াও বড়ো ক্ষতি বলতে, ডান পা-টা ভেঙেছিল। প্লাস্টার করার পর তাই বাড়ি ফেরার অনুমতি দিয়েছিলেন ডাক্তার। ততক্ষণে খবর পেয়ে রক্তিম হাসপাতালে পৌঁছে ছুটে যায় মায়ের কাছে। মায়ের সাথে কথা বলার পর খানিক স্বস্তি পায় সে। তারপর বাড়ি ফেরার ব্যবস্থা করে।

বাড়ি ফেরার পরেই কেয়া লেগে পড়ে শাশুড়ির যত্নে। রক্তিমকে ইয়ারএন্ডিং-এর কারণে ফিরে যেতে হয় ব্যাংকে।

শাশুড়ির পায়ের উপর যাতে কোনওরকম চাপ না পড়ে সেজন্য সমরকম ব্যবস্থা করেছিল কেয়া। অ্যাটাচ বাথরুম থাকার জন্য নিজেদের বেডরুমটা পর্যন্ত ছেড়ে দিয়েছিল ওনাকে। সামনের টি-টেবিলে ওষুধ, জল, বিস্কুট থেকে শুরু করে প্রয়োজনীয় সমস্তরকম জিনিস রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। এমনকী ইলেকট্রিশিয়ানকে ডেকে বেডের নীচে একটা সুইচেরও বন্দোবস্ত করা হয়েছিল, যাতে বেলের আওয়াজে কেউ না কেউ ওনার সেবায় নিয়োজিত হতে পারে। মৃণালিনী সবিস্ময়ে তাকিয়ে থাকেন বউমার দিকে। লজ্জায় পাতাল প্রবেশ করার মতো অবস্থা হয় তার।

নিজের অজান্তেই চোখে জল চলে আসে মৃণালিনীর। লুকোবার আপ্রাণ চেষ্টা করে কিন্তু কেয়ার চোখকে ফাঁকি দিতে পারে না। শাশুড়ির চোখে জল দেখে খানিক মুচকি হেসে শাশুড়িমায়ের উদ্দেশ্যে বলে, ‘কাঁদছেন যে বড়ো। কাঁদলে চলবে। মনকে শক্ত করুন। তাড়াতাড়ি সুস্থ হতে হবে তো। নাহলে গ্রামের বাড়ি যাবেন কী করে।’ চোখ মুছে বউমার দিকে বিস্ময়ভরা নজরে তাকিয়ে থাকে মৃণালিনী। মনে মনে ভাবতে থাকে তাহলে কী…

ভাবনায় বাধ সাধে কেয়া, ‘গ্রামের বাড়ি যাবেন, তবে একা নয় আমরা সকলে দু-দিনের জন্য বেড়িয়ে আসব বুঝেছেন। এবার সবকিছু ভুলে গিয়ে সংসার, নাতনি সামলান তো। শুধু পালাই পালাই। আপনি থাকতে আমি সংসার সামলাতে যাব কেন।’ বলেই চাবির গোছাটা শাশুড়ির হাতে ধরিয়ে দেয় কেয়া।

বউমার হাত ধরে কিছু বলার চেষ্টা করছিলেন মৃণালিনী। ‘থাক আর কিছু বলতে হবে না। বাসন একসাথে থাকলে একটু ঠোকাঠুকি লাগবেই। তাছাড়া বুড়ো মা-বাবারা একটু খিটখিটেই হয়। কী বলো মা?’ এর মাঝে কখন যে উৎপলেন্দুবাবু ঘরে ঢুকে দাঁড়িয়েছিল কেউ-ই খেয়াল করেনি। কেয়ার কথায় হঠাৎ করে তাদের সাথে সাথে উৎপলেন্দুবাবুও হেসে ওঠেন। আর মৃণালিনী কাঁদতে কাঁদতে বউমাকে জড়িয়ে ধরেন।

মৃণালিনীর, উৎপলেন্দুবাবুর কথাগুলো মনে পড়ে যায়। ‘সম্পর্কগুলোকে এভাবে জটিল করে ফেলো না মৃণাল। এটা কেন হল না, ও-কেন ওটা করল এটা বিচার করতে না বসে বরং মিলেমিশে থাকো। দেখবে শান্তি পাবে।’

সত্যিই আজ শান্তি বিরাজ করছে মৃণালিনীর মনে।

বাঘবনে বেড়াতে

তাহলে মিরিক? নাকি কালিঝোরা? আরও দূরে যেতে চাইলে বলে ফেলুন। দেখুন অয়নদা, এখনই ডিসিশন নিন। আর কোনও জায়গা মনে হলে বলে ফেলুন। কলি কফির কাপ এগিয়ে দিল।

অয়ন চিন্তিতভাবে কলির দিকে তাকিয়ে আছে। চোখ এখানে, মন দৃষ্টিটুকু নিয়ে অনেক দূরে। যেন মংপং, কালিঝোরা ছাড়িয়ে অন্যান্য পিকনিক স্পটগুলো দেখতে বেরিয়ে পড়েছে।

– এ কি? তুই যে ব্যোম মেরে রইলি! বলে ফেল বাবা। নাহলে কলি আমাকে পঞ্চাশবার পাঠাবে তোর কাছে। যশ হাসে।

– সত্যি? আহা, সে যে আমার পরম আকাঙিক্ষত। কলি আমাকে বার বার স্মরণ করছে, একথা ভাবতেই আমার হার্ট বিট বেড়ে গেছে।

– ইয়ার্কি নয়, ঠিকঠাক বলুন তো। কলি বুকের ওপর ওড়না ছড়িয়ে দিল– কী ভাবছেন? মিরিক?

– ভাবছি, বাঘবনে আজ ভিড় করেছে দত্যিদানো, বাক বন্দি বর্গিরা সব পালিয়ে কেন? বাঘবনে যাব। অনেক হল মংপং কালিঝোরা। এবার স্বাদ পালটাই চলো। বেতলার জঙ্গলে যাবে?

– বেতলা আমার দেখা। যশ মুচকি হাসে– বিয়ের আগে অবশ্য। তারপর আর বাঘ হওয়া হয়নি, মানে বাঘ দেখা হয়নি। কুছ পরোয়া নেই, পেঞ্চ-এ চল। পেঞ্চ রে বাবা! মধ্যপ্রদেশে। মুখ দেখে মনে হচ্ছে জায়গাটার নাম শোননি? পড়াশোনার ব্যাকগ্রাউন্ড সবার ভালো হবে তার মানে নেই!

কলি অবাক– তুমি কোথায় পেলে নামটা?

অয়ন হাসি চেপে যশের চোখে চোখ রাখে– তুই কোথায় শুনলি?

যশ হেসে ফেলে– এটা কিন্তু বউয়ের সামনে আমাকে আন্ডার এস্টিমেট করা হচ্ছে। কলির মাথায় গ্রে ম্যাটার কম, সেটা মানবি? ও বুঝবে না, তুই একজন ওয়াইল্ড লাইফ ফোটোগ্রাফার, আমাদের সামনে আছিস, স্বাভাবিক ভাবে তোর কাছেই শুনব নামটা? গণ্ডারের গায়ে সুড়সুড়ি দেওয়া, আর কি! একদিন বুঝবে ঠিক।

কলি রেগে যাচ্ছে বুঝে হাত তুলে দাঁড়ায় যশ– ক্ষম দেবী এ দাসের অপরাধ যত! ভাবো, পিকনিক করতে নিয়ে যাচ্ছি বাঘের সামনে ঘোঘ কে। তোমার পাঁচ কোটি বার দেখা মংপং, কালিঝোরা নয়। মধ্যপ্রদেশে! বুইলে গিন্নি?

কলি অবাক হতে হতে খুশির চটক লাগাল চোখে মুখে– সত্যি অয়ন? কবে যাচ্ছি? মঞ্জিরা যাবে তো?

যশ থমকে গেল– কেন? কেন যাবে না? তোমার যত ডিপ্রেসড চিন্তা। বোগাস।

কলি থতমত খেয়ে গেল– আসলে লাস্ট ইয়ারে যাবে বলেও গেল না।

– সেটা তো লাস্ট মোমেন্টে কী একটা প্রবে ফেঁসে গেল বলে, না রে অয়ন?

যশ সিগারেটে আগুন ছোঁয়াতে চেষ্টা করছিল, থেমে হাসল– অয়ন যাচ্ছে, মঞ্জিরা যাবে না? তাহলে অয়ন, ডেট ঠিক করে ফেল।

অয়ন আড় চোখে কলিকে দেখল– ডেট ঠিক করব, কিন্তু দুজন সুন্দরী সঙ্গে থাকছে, বিউটি কনটেস্ট করলে কেমন হয়? তবে শিরোপা কে পাবে?

– যে যার বউকে দেবে। গৃহশান্তি বলে একটা কথা আছে। গুরুর নিষেধ, সেটা নষ্ট না করতে। হাওয়ার হাত থেকে বাঁচিয়ে অবশেষে আগুন ধরাতে পেরেছে যশ।

কলি অল্প হাসে, – বউ কেন? বান্ধবীকে দেবে বলো।

– বান্ধবী? সে আবার কে?

– আসবে! নো টেনশন। ফুশিয়া বর্ডারের লাইট পিংক শাড়ির ময়ূরগুলো দোল খেতে খেতে হাসে। অয়নের চোখের দৃষ্টি দেখে কলি বাধ্য হল চোখ পাকাতে। নিবিষ্ট চোখে খোলা জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ছিল যশ। কলি সেদিকে তাকিয়ে বুঝল সন্ধে হয়ে এসেছে। ঠান্ডা বাতাস আসছে। জানালা বন্ধ করে না দিলে পন পন করে মশা ঢুকে যাবে। জানালা বন্ধ করতে গিয়ে দেখতে পেল বুবলিকে। এদিকেই আসছে। কলি ঘাড় ঘুরিয়ে যশের দিকে তাকাল– এই, যাও না, দরজাটা খুলে দাও না! বুবলি আসছে। যশও দেখেছিল। উঠে যেতে যেতে বলল– সন্ধে হয়ে যায়। এখন ক’দিন বাইরে যেতে দিও না। ঠান্ডা পড়ছে।

কলি সম্মতিসূচক মাথা নাড়ে– আমিও তাই ভেবেছিলাম।

ওদের কথাবার্তার মধ্যে ঢুকে পড়ে অয়ন– আরে, এদিকে দ্যাখো। জিন্দা লাশ হয়ে বসে আছি। আমি তাহলে ব্যবস্থা করে ফেলছি? মধ্যপ্রদেশের পেঞ্চ রিজার্ভ ফরেস্টে যাচ্ছি?

নেক্সট উইকে ডেট ঠিক হয়েছে। তুমুল গোছগাছ চলছে। অয়নের বউ মঞ্জিরা প্রায় রোজই আসছে। আলোচনা চলছে। সাংঘাতিক এক্সাইটেড কলি আর যশ। বাইরে যাওয়া হয় না ওদের অনেকদিন। দিনক্ষণ ঠিক হওয়া মাত্র অয়ন টিকিট কেটে ফেলেছে।

রাতে নেট সার্ফিং করে যশ। তখনই কলি পেছনে এসে দাঁড়াল। যশ মনিটরে চোখ রেখে বলল– কী? কিছু বলবে? কলি কথা বলছে না দেখে যশ তাকাল– কলি? কী হল? বলেই কলির হাতের দিকে চোখ পড়ল। বুবলির পুতুলের বাক্স। এলোমেলো ছোটো ছোটো পুতুল, রঙিন কাপড়ের টুকরো, ছোটো ছোটো সোফাসেট খাট…। রান্নাবাড়ির ক্ষুদ্র সংস্করণগুলোর নীচে মঞ্জিরার পারফিউমের শিশিটা! এটা সেদিন খুঁজে পাচ্ছিল না মঞ্জিরা।

তুলে হাতে নেওয়ার কথাটা মনে ছিল না। দুজনে স্থির হয়ে থাকে। কলির শাড়ির কুচিগুলো একবারও কেঁপে উঠল না কলির বুকের মতো। লজ্জা করছিল। কেউ কারও দিকে তাকাল না। চকচকে সুন্দর শিশি ভরা তরল পদার্থ। গতকালই মঞ্জিরা এটা বের করে সুগন্ধ ছড়িয়ে দিয়েছিল বাতাসে। কলির ঘাড়ে এসে পড়েছিল সুগন্ধি। অয়ন চোখ বুজে সজোরে শ্বাস নিয়েছিল– এত সুগন্ধি তুমি! অয়নের শ্বাস কলির ঘাড়ে, কানে… আবিষ্ট হয়ে যাচ্ছিল কলি। যশ মঞ্জিরাকে ওর বাগান দেখাতে নিয়ে গেছিল বাড়ির পেছনে। তখন বুবলি…! বুক জুড়ে উথাল পাথাল কান্নাকে গিলে ফেলতে ফেলতে উঠে দাঁড়ায় কলি। যশ অন্ধকার বারান্দায় চলে গেছে নিজেকে লুকোতে। কলি দেখতে পেল ছায়াশরীরকে।

– কী হল? ফিসফিস করে কলি।

– খুব ভুল হয়েছে আমাদের। সাবধান হওয়া উচিত ছিল। অথচ কোনও অভাব তো রাখিনি! কোথা থেকে এই জঘন্য স্বভাব পেল মেয়েটা। এর আগেও এই ধরনের ঘটনা ঘটেছে। ঠিক বলেছে যশ। সহেলির পেনসিল দিয়ে শুরু। মাসতুতো বোন দিয়ার নেইলপালিশ, রুপুদির মেয়ের ক্লিপ, দোতলার ভানুবাবুর গোঁফ কাটার কাঁচি, প্রাঞ্জলের স্কেচ পেন…!

– তোমার রাঙা পিসির সোনার চিরুনি? মনে আছে? জোরে কথা বলতে ভয় পাচ্ছে কলি। কথার শব্দে সভ্যতার মুখোশ ভেঙে চুরমার হয়ে যাবে যেন।

যশ কলির হাত ধরে– এখনও সময় আছে। বকাবকি কোরো না। শুধরে নেওয়া যাবে।

– কিছু বলব না? মেরে ফেলব। কলি হাঁপায়।

এনজেপি থেকে শিয়ালদা। তারপর বিকেলের ফ্লাইটে কলকাতা থেকে নাগপুরের বিআর আম্বেদকর এয়ারপোর্ট পৌঁছোতে সন্ধে হয়ে গেল। গাড়ির ব্যবস্থা করে রেখেছিল অয়ন। বিরানব্বই কিমি পথ পাড়ি দিয়ে মধ্যপ্রদেশের চেকপোস্টে পৌঁছে হাঁফ ছাড়ে ওরা। কলি অয়নের দিকে তাকায়– আর কদ্দূর অয়নদা?

অয়ন হাসে– আর একটু। এসেই গিয়েছি ধরে নাও। লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে প্রচুর গাড়ি। এখান থেকেই গাড়ির পারমিট নিতে হবে। অয়ন আগেই মধ্যপ্রদেশ ট্যুরিজমের একটি রিসর্টে থাকার ব্যবস্থা করে রেখেছিল। সুন্দর প্রাকৃতিক পরিবেশ। মন ভালো হয়ে গেল সবারই। অয়ন হেঁকে বলল– কি? কারও মুখে কথা নেই কেন? কলি সমুদ্রনীল ও লালের কম্বিনেশনের সালোয়ার কামিজে মোড়া শরীরটা দুলিয়ে হেসে উঠল– ওই অয়নদা, দারুণ সারপ্রাইজ দিলেন কিন্তু!

যশ মুগ্ধ গলায় বলে– তুমি জান না কলি, ওয়াইল্ড লাইফ ফোটোগ্রাফাররা খুবই অরগ্যানাইজড হয়। চোখ বুজে বিশ্বাস করা যায়।

পাশাপাশি দুটো কটেজ। পেছন দিকে এক্সট্রা ব্যালকনি। রাতে নাকি বাঘের গর্জন শোনা যায়। ঘরে ঢুকে অয়ন-মঞ্জিরা বাদে বাকি দুজনে থ মেরে গেল। বেডকভারে, ব্লাঙ্কেটে সব জায়গায় বাঘের গায়ের ছাপ বা পাগ মার্কের প্রিন্ট। যশ সোফায় বসে পড়ল– এতক্ষণে মনে হচ্ছে বাঘবনে এসেছি। নিজেকে বাঘ বাঘ মনে হচ্ছে, বলেই শব্দ করে মুখে– হালুম। কলি স্নানের তোড়জোড় করছে। একঘন্টা পরে ডিনার। এখন চা, কফি, স্ন্যাক্স এসেছে। ব্যালকনিতে বসে অয়ন কফির কাপে চুমুক দিয়ে কলিকে দেখল এক পলক– কি কলি? কেমন লাগছে? পালাজোর সঙ্গে লং কামিজ, জিওমেট্রিক শেপের কানের দুল, চুল গুছিয়ে তুলে ট্রেন্ডি ক্লিপে আটকে রাখা কলির চেহারায় ক্লাসি লুক এসেছে। পেছনের ব্যালকনিতে যশ মঞ্জিরার ঠোঁট চুষে চুষে ফুলিয়ে দিল। মঞ্জিরা হাঁপিয়ে উঠে নিজেকে ছাড়াতে চেষ্টা করে– ছাড়ো বাঘ। যশ মত্ত হয়ে উঠেছে। মঞ্জিরার বুকে মুখ ঘষছে। মঞ্জিরা কেঁপে উঠল– এখন না। পরে, পরে…। কলি অয়নের কানে আলতো কামড় দেয়– আজ তোমার কাছে থাকব সারারাত। এখানে। বাঘের ডাক শুনব, বাঘ ঝাঁপিয়ে পড়বে আমার শরীরের ওপর… কামড়ে খাবে আমাকে, খামচে খাবে…। অয়ন কলির কানে মুখ নিয়ে আসে– আজ রাতে এখানে… ঠিক?

পাঁচটায় বেড টি দিয়েছে। হুডখোলা গাড়িতে ছটা নাগাদ বেরিয়ে পড়ল ওরা। সঙ্গে ড্রাইভার ও একজন গাইড। চারপাশে জঙ্গল। জঙ্গলের রং শুকনো শুকনো। কিছুটা যাওয়ার পর বাঘের মল দেখা গেল। গাইড বলল কাছাকাছি বাঘ আছে। একটু পরেই পাগ মার্ক দেখা গেল। মঞ্জিরা চাপা গলায় বলল এবারে ফেরা যাক। লাঞ্চ সেরে ফের আসা যাবে। অয়ন হাসল– তুমি বাঘের অস্তিত্ব টের পেয়ে ভয় পেয়েছ। তোমাকে শেয়াল দেখাব। যশ কোনও কথা না বলে মন দিয়ে দেখে যাচ্ছে। কলি উশখুশ করে– মঞ্জিরা ঠিকই বলেছে। বুবলি ঘুমিয়ে পড়েছে। পরে আসা যাবে অয়নদা।

লাঞ্চ সেরে ব্যালকনি থেকে ক্যামেরা বের করে দাঁড়িয়েছে অয়ন। ভিউফাইন্ডারে চোখ রেখে কী তাক করছে কে জানে। যশকে দেখেছে কলি পেছন ব্যালকনি থেকে আসতে। ও ডাকল– রেডি? যশ আড়মোড়া ভাঙল– এত খেয়েছি। ঘুম পাচ্ছে। অয়ন ঘাড় ঘুরিয়ে যশের চোখে লেন্স তাক করল। চারদিকে পাখিদের কিচিরমিচিরের মধ্যে শাটারের শব্দ হল। অয়ন বলল– যশের চোখ দুটো শ্বাপদের মতো। পেছনের ব্যালকনি থেকে নিজেকে গুছিয়ে নিতে নিতে মঞ্জিরা অয়নের কথা শুনেছে। অলস গলায় ও বলল– কে গো? বাঘের মতো কে? কলি হেসে উঠেছে– শ্বাপদের মতো। মঞ্জিরা আরাম করে বসেছে– আমি একটু ঘুমোব। কোন ভোরে উঠেছি! তোমরা যাও। আমি কাল যাব, সিওর।

শেষে যশ আর মঞ্জিরা রয়ে গেল। কলি অয়নের সঙ্গে বেরিয়ে পড়ল। বুবলি ঘুমিয়েছে। যশের পাশে আছে ও।

– আজ সূর্যাস্ত পর্যন্ত জঙ্গলে ঘুরে বেড়াব। আপত্তি? অয়ন কলির হাতে অল্প চাপ দেয়। কলি গহিন চোখে তাকাল– ফিরতেই হবে?

সাদা বোগেনভিলিয়ার পাশ কাটিয়ে গাড়িতে উঠতে উঠতে অয়ন একটু দাঁড়াতে বলে কলির পরপর কয়েকটা স্ন্যাপ নিল। জিন্সের উপর ফেব্রিকের কাজ করা টপ। খোলা চুলে, ম্যাট টেক্সচারে ব্রাইট শেডের ঠোঁটে সিমপ্লি গ্ল্যামারাস হয়ে উঠেছে কলি। গাড়িতে উঠে বসেও ক্যামেরা কলির দিকে তাক করে রেখেছে অয়ন– এখন ড্রাইভার আর গাইড ছাড়া কেউ নেই। প্লিজ, টপের বোতাম খুলে দাও। নর্মাল থাকো…।

– স্যার, দেখুন, গাইড আঙুল তুলে দেখাচ্ছে। একপাল হরিণ ছুটে পালাচ্ছে। অয়ন লেন্সে চোখ রেখে উঠে দাঁড়াল। কিছু দূরে কয়েকটা ওয়াইল্ড ডগ চুপ করে দাঁড়িয়ে। ওদের দেখে দৌড় লাগাল। একটা ধবধবে সাদা গাছ দেখিয়ে গাইড জানাল এর নাম ঘোস্ট ট্রি। তাড়াতাড়ি করে বোতাম আটকে নিচ্ছিল কলি। লোকগুলো আবার পেছনে না তাকায়। কি ঝামেলা রে বাবা। গাড়ি চলতে চলতে একটা বাঁক নিতেই মুখোমুখি হয়ে গেল ওরা বাঘের। কি বিশাল চেহারা। মাত্র বিশ ফুট মতো তফাতে দাঁড়িয়ে তিনি। সোজা গাড়ির দিকে এগিয়ে আসছেন। ড্রাইভার ব্যাক গিয়ার দিয়ে পিছোতে শুরু করেছে। বাঘ এগিয়ে আসতে আসতে এখন প্রায় দশ ফিটের মধ্যে বনেটের সামনে। কলি শ্বাস বন্ধ করে গোঙাতে শুরু করেছে– তুমি আমাকে মেরে ফেললে অয়ন। আমি ফিরে যাব। আমাকে ফিরিয়ে নিয়ে চলো। তোমার জন্য হল এসব। এখানে আমরা আসতে চাইনি। তুমি! তুমি দায়ী।

বাঘটা হুংকার দিল। অয়নের চোখ ফিউফাইন্ডারে। শাটারে আঙুল রেখে অপেক্ষা করছে ও। কলি চেঁচিয়ে উঠল– আমি বাঁচতে চাই… বাঁচাও…। আর তখনই শাটার পড়ল। চমকে গেল ফ্ল্যাশ। বাঘ থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। শরীরটা গুটিয়ে নিল। ধীরে এগোতে লাগল একটা হরিণের দিকে। হরিণ সম্মোহিত হয়ে গেছে। গাইড বলল– আজ কিলিং ডে। কিছু মারবেই আজ।

গাড়ি ফিরিয়ে নিতে বলেছে অয়ন। ওদের দেখে মঞ্জিরা ব্যালকনি থেকে চেঁচাল– কি? কিছু দেখতে পেলে? অয়ন হেসে জলের বোতল বের করে অনেকটা জল খেল। কলির দিকে এগিয়ে দিল বোতল– জল খাও। কলি মুখ চুন করে দাঁড়িয়ে। হাত বাড়িয়ে বোতল নিল– সরি।

ওদের আওয়াজ পেয়ে যশ দ্রুত মঞ্জিরার ঘর থেকে ওর ঘড়িটা নিয়ে এল। এত তাড়াতাড়ি ফিরে এল ওরা! মঞ্জিরা ইচ্ছে করে জোরে কথা বলছে, যাতে যশ সামলে নিতে পারে। বুঝে মনে মনে হাসে যশ। একটু সুখ চুরি করাকে কি ক্লেপ্টোম্যানিয়া বলা যায়? অয়ন কি কলিকে সঙ্গী করে কীর্তন গেয়ে এল?

গুছিয়ে বসে বাঘ দেখার গল্প করছিল অয়ন। কলির ভয়ে কেঁদে ফেলাটাও বাদ দেয়নি। সব ফের স্বাভাবিক।

ডিনার সেরে ব্যালকনিতে বসেছে সবাই। কলির আসতে দেরি দেখে যশ উঠে গেল। নিশ্চয়ই সাজুগুজু করছে কলি। সবসময়ে মঞ্জিরার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলার অভ্যাসটা যে কবে ত্যাগ করবে ও! ঘরে ঢুকে অবশ্য থ হয়ে গেল। কলি শুয়ে আছে ঘুমন্ত বুবলির পাশে। সারাদিন ধকল গেছে। ঘুমুচ্ছে। যশ শব্দ না করে ফিরে গেল। তখন অয়নের কাছ ঘেঁষে বাঘের গল্প শুনছে মঞ্জিরা।

– আমাকে বাদ দিয়ে সব বলা হয়ে গেল নাকি? যশ হাসতে হাসতে বসে পড়ে– বাঘ কমে যাচ্ছে? সত্যি?

অয়ন ঘাড় নাড়ে– ঠিক। কাস্পিয়ান বাঘ, বালি বাঘ, জাভান বাঘ লুপ্ত। এখন যা আছে, সবই লুপ্তের দিকে। সাড়ে চারশো গ্রাম বাঘের হাড় পাঁচশো ডলারে পাওয়া যায় ভিয়েতনামে। বাঘের হাড়, মাংস দিয়ে বানানো মদের খুব চাহিদা। শুনেছি এক বাটি ব্যাঘ্র লিঙ্গের সুপ তাইওয়ানের কোনও এক রেস্তোরাঁয় মেলে। প্রচুর দাম। তাহলে বাঘ থাকবে কী করে?

মঞ্জিরা সুন্দর মুখটা তুলে বলে– বাঘ বাঁচাও প্রকল্প হচ্ছে শুনেছি!

– হচ্ছে। হাই তোলে অয়ন– কলি আজ ভয় কাকে বলে বুঝেছে। আর কখনও বাঘবনে আসবে বলে মনে হয় না। বাঘের ছবি না তুলে কলির ছবি তোলা উচিত ছিল। তাহলে বুঝতে তোমরা ঘোঘরা আসলে ছুঁচো। হেসে ওঠে অয়ন– বাঘ বাঁচাও প্রকল্প! আগে মানুষ বাঁচাও প্রকল্প হোক।

যশ অবাক প্রায়– মানে, মানুষের গড় আয়ু বেড়ে গেছে জানিস?

অয়ন অদ্ভুত ভাবে তাকায়– তাই? মানুষ আছে বলছিস? ও-ও তো লুপ্তের পথে! দিন এলে মানুষ বনে বেড়াতে যাব।

মঞ্জিরা জোরে হেসে ওঠে– এইরে, তুমি আজ বাঘ দেখে নিজেকেই বাঘ ভাবতে শুরু করেছ নাকি? জবাব না দিয়ে চলে গেল অয়ন। যশকে ইশারা করে মঞ্জিরাও চলে গেল। সবাই টায়ার্ড। কেউ বাঘ দেখে, কেউ না দেখে, কেউ বাঘ হয়ে, কেউ বাঘ হতে না পেরে। পেছনের ব্যালকনিতে অয়নকে জড়িয়ে গুটিসুটি কলি। বন ছমছম করছে। জঙ্গল, জীবজন্তুর মধ্যে থেকে রাতটাকে উপভোগ করছিল ওরা। অয়নের ভেতরে আজ বাঘ দেখে আপ্লুত কলি। নাক ভরে বাঘের গন্ধ নিতে নিতে কলি ভাবে, ডাক্তার বলেছে বুবলির ক্লেপ্টোম্যানিয়া আছে। পরের জিনিসের দিকে আকর্ষণ। তবে সেরে যাবে একটু যত্ন নিলে…। বুবলি সেরে যাবে। কিন্তু ক্লেপ্টোম্যানিয়া কি সবসময় সারে? সেরে যাওয়াটা কি সুখের হয়?

পড়ার জন্য সীমাহীন গল্প-নিবন্ধসাবস্ক্রাইব