প্রথমে দোষারোপ, তারপর তিক্ততা, শেষে একটি সম্পর্কের মৃত্যু। সন্দেহ বা doubt-এর বীজ যে-কোনও সম্পর্কের মধ্যে এসে পড়লে— পরিণাম এর চেয়ে ভিন্ন গতি পায় না। তা সে দাম্পত্য সম্পর্কই হোক, বা প্রাক বৈবাহিক প্রেমজ সম্পর্ক কিংবা যে-কোনও সূত্রে আবদ্ধ দুটি মানুষের একাত্ম বন্ধন। সম্পর্ক ধ্বংসের মূলে বারুদ ওই একটিই জিনিস, সন্দেহ।
সন্দেহ বা doubt-এর সবচেয়ে বড়ো কারণ হল পজেসিভনেস বা অধিকারবোধ। দাম্পত্য সম্পর্কে প্রায়শই এই অধিকারবোধ এমনই বাড়াবাড়ি স্তরে পেৌঁছোয়, যে তা গলায় ফাঁসের মতো আটকে যায়। এই ফাঁসে ভালোবাসা যত না থাকে, তার চেয়েও বেশি থাকে অন্যকে নিজের ইচ্ছেয় চালিত করার জেদ, আমিত্বের অহংকার আর অধিকার আরোপ করার অসংযত আবেগ। যেভাবে মানুষ তার সম্পত্তি সংরক্ষণ করার ব্যাপারে মরীয়া হয়ে ওঠে, এক্ষেত্রে সেভাবেই কোনও ব্যক্তিকে সম্পূর্ণরূপে জয় করার একটা অভীপ্সা থেকে যায়। এই অধিকার বোধের অনুভূতি যদি নেহাতই প্রেমের বহিঃপ্রকাশ স্বরূপ হালকা চালে বিকশিত হয়, তাহলে তা তেমন ক্ষতিকারক হয় না। কিন্তু এটাই যখন ফাঁস হয়ে অন্য ব্যক্তিটির গলায় চেপে বসে, তখন সম্পর্কের ভাঙন অবশ্যম্ভাবী।
সন্দেহের সূত্রপাত
মনোবিদদের মতে, সন্দেহ এমনই একটি রসায়ন যার অন্য পিঠে রয়েছে অনিয়ন্ত্রিত প্রেম। দাম্পত্যে এই সন্দেহের সূত্রপাত হয় তখনই, যখন স্বামী বা স্ত্রী’র মধ্যে কোনও একজন, অন্যজনকে ডমিনেট করতে শুরু করে।
বিয়ের শুরুর দিনগুলোতে এই পজেসিভনেস মধুর লাগলেও, কিছুদিন পর যখন সংসারের চাপে দুজনেরই প্রাথমিক রোমান্স প্রায় অপসৃত— সেই পর্যায়ে একটা অনুভূতি হতে থাকে যে, সঙ্গিটি বোধহয় যথাযথ মনোযোগ দিচ্ছে না অন্যজনের উপর। স্বামীরা প্রায়শই বাইরের কাজ-কর্মে ব্যস্ত থাকেন, মহিলাদের মতো তারা সংসারের ব্যাপারে ততটা ইনভল্ভড হন না। এই পর্যায়েই একজন স্ত্রী, স্বামীর মনোযোগী না হওয়ার ব্যাপারে কিছু মনগড়া কারণ তৈরি করতে থাকেন। নিজের যুক্তির স্বপক্ষে তারা অনেক সময়ই কোনও কল্পিত তৃতীয় ব্যক্তিকে দুষতে শুরু করেন। সন্দেহ গাঢ় হয়। স্বামীর পরিচিত মহিলাকর্মী বা বান্ধবীরাই প্রথমে সন্দেহের তালিকায় স্থান পেতে থাকে। স্ত্রী তার ভাবনাকে সঠিক প্রমাণ করার অভিপ্রায়ে কলহপ্রিয় হয়ে ওঠেন। এভাবে চিড় ধরতে শুরু করে তার বিশ্বাসে। স্বামীও বীতশ্রদ্ধ হয়ে ওঠেন এই অমূলক অশান্তিতে।
ঘটনাটি একইভাবে স্বামীর দিক থেকেও ঘটতে পারে। বিশেষত স্বামীটি যদি হীনন্ম্যতার শিকার হয়ে থাকেন, তবে তো কথাই নেই। স্ত্রী সুন্দরী হলে স্বামীটি অধিকাংশ সময়ই একধরনের কমপ্লেক্স সাফার করেন এবং স্ত্রী যতই তার অনুরক্ত হোক, সে কিছুতেই স্বামীর চোখে বিশ্বস্ত হয়ে উঠতে পারে না। তার কেবলই আশঙ্কা হয় যে, স্ত্রী বুঝি অন্য কোনও পুরুষের সঙ্গে সম্পর্কে লিপ্ত।
সন্দেহভাজন স্বামী বা স্ত্রী যে-ই হোন, সম্পর্ক ক্রমশ তিক্ততার দিকেই যেতে থাকে এবং মৌখিক ঝগড়ার স্তর পেরিয়ে কখনও কখনও তা ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স-এর স্তরেও উন্নীত হয়। সম্পর্কের এই ক্রমাবনতি প্রথমে দুটি মানুষের মধ্যে গোপনীয়তার খামে মোড়া থাকলেও, শেষ পর্যন্ত তা দাম্পত্যের দেয়াল ভেঙে বাইরে চলে আসে। চূড়ান্ত অবস্থায় বিবাহবিচ্ছেদেই সম্পর্কের পরিসমাপ্তি ঘটেছে, এমনও দেখা গেছে।
সন্দেহের অন্যতম কারণ হল উপেক্ষা। স্বামী বা স্ত্রী কেউ একজন উপেক্ষিত হলেও অনেক সময় সন্দেহ দানা বাঁধতে শুরু করে। উপেক্ষিত ব্যক্তিটি ভাবতে শুরু করে যে তার প্রয়োজন ফুরিয়েছে। এই পর্যায়ে যদি তার সঙ্গিটি তৃতীয় কোনও ব্যক্তির সঙ্গে অতিরিক্ত অন্তরঙ্গতার সঙ্গে কথাও বলে, তাহলে সন্দেহ ক্রমশ প্রগাঢ় হতে থাকে। কর্মরতা স্ত্রী দেরি করে বাড়ি ফিরলেও স্বামীর মনে হতে থাকে, স্ত্রী অন্য কোনও সম্পর্কে জড়িত। স্ত্রীর সমস্ত কাজে-কর্মে তার সন্দেহের স্বপক্ষে সে যুক্তি খুঁজতে থাকে।
অনেক সময় স্ত্রী’র উচ্চপদ বা বেশি আয় এক ধরনের কমপ্লেক্স তৈরি করে স্বামীর মনে। সন্দেহের বীজ রোপিত হওয়ার অন্যতম কারণ হল এই কমপ্লেক্স। এই সন্দেহের বহিঃপ্রকাশ স্বরূপ স্ত্রী’র উদ্দেশ্যে অপমানকর তীর্যক উক্তি করতে থাকে স্বামী। স্ত্রীর কর্মক্ষেত্রকে ঘিরে নানা অপ্রিয় কথা, তার সহকর্মীদের সম্পর্কে অপ্রীতিকর মন্তব্য— এসব চলতেই থাকে।
সম্পর্কের প্রতি আত্মবিশ্বাসের অভাবও পরোক্ষভাবে এই সন্দেহের বীজ বপনে অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করে। পরস্পরের প্রতি সত্যিকারের ভালোবাসা ও একনিষ্ঠতা থাকলে, ছোটোখাটো অশান্তি, ঝগড়াঝাঁটির নিষ্পত্তি বাড়িতেই হয়ে যায়। কিন্তু প্রেমহীন অধিকারবোধের লড়াই, শেষপর্যন্ত সন্দেহের ভিতকেই মজবুত করে।
ঈর্ষা প্রবণতাও সন্দেহের একটি কারণ হতে পারে। স্ত্রী বা স্বামীর কোনও গুণ যদি আত্মীয়-বন্ধুদের প্রশংসার বিষয় হয়ে ওঠে, তখন ঈর্ষাপ্রবণ স্ত্রী বা স্বামীর এই নঞ্চর্থক অনুভূতির প্রকাশ ঘটে সন্দেহের মধ্যে দিয়ে। সঙ্গীটিকে আঘাত করতেই তখন অন্যজন সন্দেহের কল্পিত কারণ তৈরি করে নেয় এবং অন্য ব্যক্তিটিকে যন্ত্রণাবিদ্ধ করতে থাকে।
বিশেষজ্ঞদের রায়
দাম্পত্য সম্পর্কে সন্দেহজনিত কারণে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কলহ-বিবাদের বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, খোলা মনে পরস্পরের সঙ্গে কথা বলে এই সমস্যা মেটানো সম্ভব। সন্দেহের কেন্দ্রে সঠিক কারণটা চিহ্নিত করা দরকার। তা যদি যৌনতা, প্রেম, অর্থ বা সময়াভাবে মনোযোগ না দেওয়া হয়— তাহলে প্রত্যেকটিই সমাধান করতে পারেন, নিজেদের মধ্যে আলোচনার মধ্য দিয়ে।
কিন্তু সেই সমস্ত সন্দেহপ্রবণ ব্যক্তি যারা সমস্ত সময় সঙ্গীর দোষ বের করতেই ব্যস্ত, নিজের মতামত তার উপর ন্যস্ত করতে উদ্যত, বাইরের লোকের কাছে সঙ্গীর বিষয়ে নিন্দারত— তাদের সমস্যার সমাধান হওয়া কঠিন। তাই সমস্যা শুরু হওয়া মাত্র তার কারণ চিহ্নিত করুন এবং সমাধান করতে চেষ্টা করুন। প্রয়োজনে কাউন্সেলর-এর সাহায্য নিন। দেখবেন দূরত্ব যেন এতটা না বেড়ে যায়, যাতে স্বামী-স্ত্রীর পক্ষে চিরদিনের মতো আর পরস্পরের মনের নাগাল পাওয়াই কঠিন হয়।
সমাধানের টিপ্স
- সঙ্গীর সন্দেহের doubt কারণ চিহ্নিত করুন ও তা দূর করতে সচেষ্ট হোন। এ ক্ষেত্রে সঙ্গীটিকে সহানুভূতির চোখে দেখুন ও তার ব্যপারে সহনশীল হোন।
- সন্দেহের অবসান ঘটাতে গিয়ে অতিরিক্ত মাত্রায় প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে পড়বেন না। নিজের বুদ্ধি-বিবেচনার উপর আস্থা রাখুন।
- আলোচনার মধ্য দিয়ে সমাধান সূত্র খুঁজতে বসে কখনও নেতিবাচক ভাবনাকে প্রশ্রয় দেবেন না। সদর্থক ও গঠনমূলক বিষয়গুলিকেই গুরুত্ব দিন।
- যদি আলোচনা চলাকালীন ভুল বোঝাবুঝি বৃদ্ধি পেতে থাকে, তাহলে আলোচনা ওখানেই থামিয়ে দিন ও তৃতীয় ব্যক্তির (কাউন্সেলর) সাহায্য নিন।
- আপনার সঙ্গীটিকেও সময় দিন যাতে সে তার বিচার ও বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে সমাধান সূত্রে পৌঁছোতে পারে। ধৈর্য হারিয়ে তার উপর আপনার মতামত আরোপ করতে যাবেন না বা তাকে কোনও সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করবেন না।