অভিভাবকেরা সকলেই চান একটা ধরাবাঁধা রুট ম্যাপ, যেটা ফলো করতে পারলেই সন্তান ভবিষ্যতে সাফল্যের চূড়ায় বসে রাজত্ব চালাতে পারবে। সৎ এবং ভদ্র হিসেবেও সন্তানকে প্রতিষ্ঠিত হতে দেখতে চান অভিভাবকেরা। এই সব কিছু ইচ্ছা সফল করে তোলার ডেফিনিট ফর্মুলা হয়তো কিছুই নেই কিন্তু বিজ্ঞানভিত্তিক বহু প্রমাণ আছে যার উপর ভিত্তি করে বলা চলে যে অভিভাবকেরা কীভাবে সন্তানকে বড়ো করছেন তার উপরে সন্তানের সাফল্য অনেকটাই নির্ভর করে।
বেশিরভাগ মা-বাবাই বিশ্বাস করেন তাদের সন্তানের ভবিষ্যৎ সাফল্য, নির্ভর করে তাদের অ্যাকাডেমিক এক্সিলেন্স-এর উপর। আজকের কমপিটিটিভ ওয়ার্ল্ডে ভালো রেজাল্ট-ই একমাত্র বাচ্চাকে অন্যান্যদের তুলনায় এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে এই ধারণা অনেকেরই আছে। কিন্তু এটা জেনে আশ্চর্য হবেন, পড়াশোনা ছাড়াও আরও অনেক বিষয় আছে যেগুলোর উপর বাচ্চার সাফল্য নির্ভর করছে। বহু রিসার্চ এবং পরীক্ষা চালাবার পর একটাই সিদ্ধান্তে পৌঁছোনো গেছে যে, সব বিষয়ে জোর খাটিয়ে বাচ্চাকে কিছুতেই সঠিক রাস্তায় আনা যায় না উলটে তার প্রতি অবিচারই করা হয়। সুতরাং জানতে হবে অভিভাবক হিসেবে সন্তানের জন্য কী করা উচিত এবং কী নয়।
গৃহকর্মে সহযোগিতা
সেদিন আর নেই যখন বাচ্চারাও বাড়ির কাজে মা-বাবাকে সাহায্য করত যেমন, ময়লা ফেলা, বাগানে জল দেওয়া, এক ছুট্টে দোকান থেকে প্রয়োজনীয় কোনও জিনিস এনে দেওয়া ইত্যাদি। বাচ্চাদের উপর অলরেডি অ্যাকাডেমিক প্রেশার ছাড়াও, টিউশন, এক্সট্রা কারিকুলার অ্যাকটিভিটি ইত্যাদির চাপ তো আছেই সুতরাং বাড়ির কাজে মা-বাবাকে সাহায্য করাটা তার সময়ের অপচয় বলেই ধরে নেওয়া হয়।
কয়েকদিন আগেই স্কুলে মেয়েকে আনতে গিয়ে কয়েকজন অভিভাবকের মধ্যে কিছু কথাবার্তা কানে এল। একজন মা, অপর আর একজনকে বলছিলেন, ‘আমি মেয়েকে বাড়ির কোনও কাজ করতে দিই না। জল ভরা বা আমাদের বাড়ির কুুকুরটাকে একটু বাইরে ঘুরিয়ে নিয়ে আসা মানে সময় নষ্ট করা আর পড়াশোনার ক্ষতি।’
ওনাদের মধ্যে আর এক মহিলার উত্তর কানে এল, ‘ঠিকই বলেছেন, আর মাত্র একমাসই বাকি পরীক্ষার। ছেলে যখন চাকরির জন্য ইন্টারভিউ দিতে যাবে তখন রান্না করতে পারে কিনা বা বিছানা ঠিকমতো করতে পারে কিনা এই নিয়ে কেউ কি মাথা ঘামাবে? আমি তো পড়াশোনার সময় ছেলেকে এক গেলাস জলও নিজেকে নিতে দিই না। আমিই সবকিছু এগিয়ে দিই।’
আজকের দিনে মা-বাবা, সন্তানকে বাড়ির কাজ করতে দেন না এই ভেবে যে, সে পুরো সময়টা পড়াশোনায় দেবে যেটা একমাত্র পারে তাকে সাফল্য এনে দিতে। অথচ বহু প্রমাণ আছে, যেখানে বাড়িতে করা কাজেরও একটা অবদান রয়েছে, ভবিষ্যতে সাক্সেসফুল হয়ে ওঠার পিছনে। মনে রাখতে হবে বাড়ির দৈনন্দিন কর্মসূচি বাচ্চার মধ্যে দায়িত্ববোধের বিকাশ ঘটায় এবং এই শিক্ষাও দেয় যে বাড়ির কাজটাও অন্যান্য প্রয়োজনের মতোই আমাদের জীবনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী ভাবে যুক্ত।
সামাজিক যোগ্যতা
অভিভাবক হিসেবে অনেক সময়েই আমরা বাচ্চার সামাজিক এবং মানসিক দক্ষতার বিকাশ ঘটাবার প্রয়োজনীয়তাকে গুরুত্ব দিই না।
যে-কোনও সংবেদনশীল বাচ্চা, যে অন্যান্য বাচ্চাদের সঙ্গে মানিয়ে চলতে পারে, নিজের সমস্যা সমাধান করার ক্ষমতা রাখে– তাদেরকেই মনে করা হয় সামাজিক যোগ্যতার অধিকারী। এই সব বাচ্চার অভিভাবকেরা চেষ্টা করেন এই গুণগুলিকেই আরও বিকশিত করার এবং বহু অধ্যয়ন করে প্রমাণিত হয়েছে ভবিষ্যতে সাফল্য অর্জন করতে হলে এই গুণগুলিও মস্ত সহায়ক। যে বাচ্চার মধ্যে এই গুণগুলির অভাব থাকে তারা বেশিরভাগই বদ অভ্যাসের শিকার হয়ে পড়ে এবং সময় ও সুযোগের অপব্যবহার করে ফেলে। সুতরাং এক্ষেত্রে অভিভাবকের দায়িত্ব হয়ে দাঁড়ায়, সন্তানকে সঠিক পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার। এছাড়াও বাচ্চা নিজে থেকে অগ্রসর হয়ে কোনও সোশ্যাল কাজ করতে চাইলে অথবা কোনও দলগত অ্যাকটিভিটি-তে অংশগ্রহণ করতে চাইলে তাকে বাধা দেওয়া যুক্তিসঙ্গত নয়।
ঘুমের প্রয়োজনীয়তা
রাত্রে দেরি অবধি জোর করে বাচ্চাকে পড়ানো অথবা ভোরবেলায় ঘুমন্ত বাচ্চাকে জোর করে ঘুম ভাঙিয়ে পড়তে বসানো কখনওই উচিত কাজ নয়। ঘুম পর্যাপ্ত না হলে বাচ্চারা অমনোযোগী হয়ে পড়ে, কোনও কিছু শিখতে দেরি করে এবং লক্ষ্য স্থির করতে পারে না। ঘুমটাকে সময়ের অপচয় ভাবা ঠিক নয়। বরং টাইম ম্যানেজমেন্ট ঠিক মতো করতে পারলে, বাচ্চা নিজে থেকে যতটা সময় জেগে থাকবে তার পুরোপুরি সদ্ব্যবহার করতে তাকে সাহায্য করুন। বাচ্চার ব্রেন এবং শরীর যতটা আরাম চায় তাকে ততটা দেওয়া একান্ত দরকার।
অত্যধিক প্রেশার দেওয়ার অভ্যাস
অভিভাবকেরা অনেক সময় ভয়ে থাকেন, স্কুলে সহপাঠীদের কতটা চাপ তাদের সন্তানকে সহ্য করতে হচ্ছে এবং এটার কোনও খারাপ প্রভাব তাদের সন্তানের ভবিষ্যতের উপর পড়বে না তো, এই চিন্তাও ক্রমাগত তাদের মনের শান্তি ব্যহত করে। এটা জানেন কি, অভিভাবক হিসেবে আপনার প্রভাবও নেগেটিভ ইমপ্যাক্ট ফেলতে পারে আপনার সন্তানের ভবিষ্যতের উপর। যেমন সন্তানকে ছোটোখাটো সিদ্ধান্ত নিতে বাধা দেওয়া, কী করলে তাদের জীবন আরামদায়ক হবে সেটা সব সময় পয়েন্ট আউট করা ইত্যাদি।
যে-মুহূর্তে সন্তানকে স্ট্রাগল করতে দেখেন মা-বাবা, তাকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসেন তারা। এর ফলে বাচ্চা নিজে সিদ্ধান্ত নেওয়া শিখতে পারে না এবং বড়ো হয়ে সর্বগুণসম্পন্ন হয়ে উঠতে পারে না।
স্বাভাবিক ভাবেই মা-বাবা চাইবেন, সন্তানকে অসাফল্যের বিপদ থেকে সবসময় গার্ড করতে। কিন্তু মা-বাবার আসল দায়িত্ব হল সন্তানকে ডানা মেলে উড়তে সাহায্য করা, তাদের ডানা দুটো কেটে দেওয়া নয়। নিজেদের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করার শিক্ষা দিতে হবে যেমন, ছোটোদের তেমনি তাদের স্বাধীনতাও দিতে হবে নিজে নিজে সিদ্ধান্ত নেওয়ার। ওভারবিয়ারিং পেরেন্টদের বাচ্চার উপর প্রতিনিয়ত নিয়ন্ত্রণ, বাচ্চার জীবনভরের জন্য মানসিক ক্ষতি করে দিতে পারে। ফলে বাচ্চার মধ্যে আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি থেকে যায় এবং বড়ো হয়েও তার মধ্যে এই অভাব রয়েই যায়। পেরেন্ট হিসেবে বাচ্চাকে শুধুমাত্র গাইড করা উচিত। কীসে বিপদ হতে পারে তার একটা পরিষ্কার ছবি বাচ্চার সামনে তুলে ধরা দরকার এবং সে যেটা করবে তার কী কী পরিণতি এবং প্রভাব পড়বে সেটাও বুঝিয়ে বলা উচিত।
অভিভাবকদের অত্যধিক চাপ
মাঝেমধ্যেই বড়োদের বলতে শোনা যায় ‘আমি চাই আমার সন্তান এই করবে’। কিন্তু তারা যেটা চান তাদের সন্তানও কি ওই একই জিনিস করতে আগ্রহী? মা-বাবা চান, তাদের সন্তানের মাধ্যমে নিজেদের স্বপ্ন সাকার করতে। নিজেরা জীবনে যেটা করতে পারেননি, সেটাকেই সাকার করে তোলার ইচ্ছেটা তারা বাচ্চার ঘাড়ে তুলে দিতে চেষ্টা করেন। এতেই বোঝা যায় কেন অনেক সময় বাচ্চারা, মা-বাবার বেছে দেওয়া রাস্তায় চলতে বাধ্য হয়, নিজেদের আগ্রহ না থাকা সত্ত্বেও।
সেল্ফ ডিসিপ্লিন
সুশৃঙ্খল জীবনযাত্রা নানাভাবে সাহায্য করে মানুষের জীবনে সাফল্য এনে দিতে। সেল্ফ ডিসিপ্লিনড বাচ্চা জীবনে একটা লক্ষ্য স্থির করে নেয় এবং সেটাকেই সাকার করার চেষ্টা করতে থাকে। এরা নিজেদের রাগ কন্ট্রোল করার ক্ষমতা রাখে, পথের দিশা সঠিক রাখে, ভুল ধরিয়ে দিলে নিজেকে ঠিক করে নিতে লজ্জা বোধ করে না। এই ধরনের মানুষ নিজের পরিবারের সংস্কারও মেনে চলে। এদের এই মানসিকতার জন্য এদের মা-বাবাও জীবনের কিছু মূল্যবান শিক্ষা এদের প্রথমেই শিখিয়ে রাখেন সুতরাং এরাই যখন প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে ওঠে তখন জীবনের যে-কোনও চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে এরা ভয় পায় না।
অভিভাবকদের নিজেদের মধ্যে সম্পর্ক
আমরা সকলেই ভালো করে জানি মা-বাবার মধ্যে সম্পর্ক অনেকটাই বাচ্চাকে প্রভাবিত করে। মা-বাবার সুখী দাম্পত্য ইমোশনালি সাউন্ড রাখে বাচ্চাকে। মা-বাবার মধ্যে ভালো সম্পর্ক এবং তাদের নিজস্ব শৈশবের স্মৃতি বাচ্চাকে যেমন সুস্থ ভবিষ্যৎ প্রদান করে তেমনি ইমোশনালি, অ্যাকাডেমিকালি ও সোশ্যালি তাকে হেলদি এবং স্ট্রং হতেও সাহায্য করে। বাড়ির পরিবেশে বাচ্চার প্রথম শিক্ষার হাতেখড়ি সুতরাং সেটাই সবথেকে হেলদি হওয়া আগে প্রয়োজন যাতে বাচ্চা সম্পর্কের গুরুত্ব বুঝতে শেখে। ভবিষ্যতে প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পরেও যাতে বিভিন্ন সম্পর্কের আনাগোনার মধ্যেও সে সম্পর্ককে সম্মান দিতে পারে।
অভিভাবক হিসেবে বাচ্চাদের রোল মডেল মা-বাবাকেই হতে হবে। কারণ, অনুপ্রেরণার প্রয়োজন পড়লে বাচ্চা, মা-বাবার দিকেই প্রথম দৃষ্টিপাত করবে, সাপোর্টের প্রয়োজন হলে তাদের পাশে পাবে এবং সাফল্যে খুশি হলে মা-বাবার সঙ্গেই আগে শেয়ার করবে।