আজকাল সবচেয়ে দ্রুতগতির বার্তা-বাহক বা প্রেরণ-মাধ্যম হিসাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে সোশ্যাল মিডিয়া। ফেসবুক, হোয়াট্স অ্যাপ, টুইটার, লিংক্ডইন্ প্রভৃতি সোশ্যাল সাইটস-এ এত দ্রুত সবকিছু ছড়িয়ে পড়ছে যে, ইলেক্ট্রনিক মিডিয়াও হার মেনেছে। এখন বাচ্চা থেকে শুরু করে বয়স্ক মানুষ, সবার হাতেই রয়েছে স্মার্ট ফোন। মহিলারা তো কাজকর্ম ভুলে গিয়ে সারাদিন শুধু চ্যাট-এ ব্যস্ত থাকছেন। কোনও মেসেজ মোবাইল-এ ঢুকতে না ঢুকতেই তা গ্রুপ-এ ফরওয়ার্ড হয়ে যাচ্ছে।
জোক্স, রাশিফল, ছবি, ধর্মীয় খবর, স্বাস্থ্যরক্ষার উপদেশ, রেসিপিজ প্রভৃতি হরেক কিসিমের বার্তা শেয়ার হয়ে যাচ্ছে মুহূর্তের মধ্যে। এমনকি ছড়িয়ে পড়ছে কোনও না কোনও বিখ্যাত ব্যক্তির মিথ্যা মৃত্যু সংবাদও। এখন কারও হাতে অবসর সময় বলে কিছু নেই। ২৫০ মিলিয়ন ইউজার্স এখন হোয়াট্স অ্যাপ-এ সক্রিয়। বলতে গেলে জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠেছে হোয়াট্স অ্যাপ।
বন্ধু, আত্মীয় এবং পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার জন্যও এখন মাধ্যম করা হচ্ছে সোশ্যাল নেটওয়ার্ক-কে। আবার এই সোশ্যাল নেটওয়ার্ক-এরই অপপ্রয়োগ করা হচ্ছে ফেক নিউজ, ছবি ইত্যাদি ছড়িয়ে। কে, কী পোস্ট করছে, কেন করছে, কী উদ্দেশ্যে করছে, এসবের ভালোমন্দ বিচার না করে, সবকিছু ফরওয়ার্ড করার প্রবণতা বাড়ছে।
অনেকসময় দেখা যায় যে, কোনও মিথ্যে বা গুজব ছড়িয়ে নিরপরাধ কাউকে ফাঁসিয়ে দেওয়া হচ্ছে। অথচ মজার কথা হল, যে-ব্যক্তি কৗশলে প্রথম গুজবটা ছড়াল, সে ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে গেল।
এখন পরিত্রাণ নেই
সাবধান! উচ্চ আদালত কড়া পদক্ষেপ নিতে পারে। যদি কেউ কোনও পোস্ট-এর ভালোমন্দ বিচার না করে তা ফরওয়ার্ড কিংবা শেয়ার করে, তাহলে সেই ব্যক্তি কিংবা ব্যক্তিবর্গ দোষী সাব্যস্ত হতে পারেন। দক্ষিণ ভারতের এক অভিনেতা এবং ভাজপা নেতা এস ভি শেখর-কে সম্প্রতি উচ্চ আদালত দোষী সাব্যস্ত করেছে এবং তার আগাম জামিনের আবেদনও খারিজ করেছে। কারণ, এই ব্যক্তি মহিলাদের উদ্দেশ্যে অপমানজনক মেসেজ তার ফেসবুক অ্যাকাউন্ট-এ শেয়ার এবং ফরওয়ার্ড করেছেন।
গত এপ্রিল মাসে, মহিলা মিডিয়াকর্মীদের উদ্দেশ্যে অপমানজনক উক্তি নিজের ফেসবুক অ্যাকাউন্ট-এ শেয়ার এবং মেসেঞ্জার-এ ফরওয়ার্ড করেছিলেন দক্ষিণ ভারতের অভিনেতা এবং গণ্যমান্য এই ভাজপা নেতা এস ভি শেখর। তিনি নিজে না লিখলেও, যেহেতু উনি কুরুচিকর মন্তব্য ভাইরাল করেছেন, তাই তিনি অপরাধী সাব্যস্ত হয়েছেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে তিনি গ্রেফতার এড়াতে চেন্নাই হাইকোর্ট-এর দ্বারস্থ হন কিন্তু তার জামিনের আবেদন খারিজ হয়ে যায়। এরপর তিনি উচ্চ আদালতে গেলে ওখানেও তাকে রেহাই দেওয়া হয়নি, জামিনের আবেদন বাতিল করা হয়েছে।
এস ভি শেখর-এর কুুরুচিকর উক্তি ছড়ানোর প্রেক্ষিতে চেন্নাই হাইকোর্ট-এর মন্তব্য, কোনও খারাপ উক্তি শেয়ার কিংবা ফরওয়ার্ড করার অর্থ, ওই উক্তিকে স্বীকার এবং সমর্থন করে নেওয়া।
যদি কোনও বিশিষ্ট ব্যক্তি কিছু শেয়ার কিংবা ফরওয়ার্ড করেন, তখন তা সাধারণ মানুষ আরও বেশি বিশ্বাস করেন এবং ভেবে নেন, সত্যিই হয়তো তাই ঘটেছে। তাই বিশিষ্ট ব্যক্তিদের আরও বেশি সতর্ক থাকা উচিত। এস ভি শেখর-এর ফরওয়ার্ড করা পোস্ট-এ কুরুচিকর মন্তব্য পরোক্ষ নয়, প্রত্যক্ষ ছিল। তাই তাকে কঠিন আইনি জটিলতায় পড়তে হয়েছে।
আদালত স্পষ্ট জানিয়েছে যে, একজন গণ্যমান্য ব্যক্তির উচিত সমাজের জন্য ভালো কিছু করা কিন্তু তার পরিবর্তে তিনি আদর্শচ্যুত হয়ে ভুল এবং আপত্তিকর মন্তব্য ছড়িয়েছেন। অবশ্য শুধু এস ভি শেখর-ই নন, এইরকম ভুল করে অনেকেই গ্রেফতার হয়েছেন ইতিমধ্যে।
ফেক মেসেজ এক কঠিন সমস্যা
ফেক নিউজ, মেসেজ ইত্যাদি সোশ্যাল মিডিয়াতে ভাইরাল হওয়া এত বেড়ে গেছে যে, এই সমস্যার সমাধান করার বিষয়টি সরকারের কাছে এখন সবচেয়ে বড়ো চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর এই সমস্যা যত বাড়ছে, কিছু মানুষকে এর কুফল ভোগ করতে হচ্ছে। কখনও আবার প্রাণ হারাতে হচ্ছে এর পরিণামস্বরূপ।
মহারাষ্ট্রে বাচ্চা-চোর সন্দেহে পাঁচজনকে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়েছে। তাও আবার এই একটা ঘটনাই নয়, সোশ্যাল মিডিয়ায় গুজব ছড়িয়ে পড়ার কারণে, নিরীহ মানুষের প্রাণ কেড়ে নেওয়া হয়েছে বহুবার। সবচেয়ে বড়ো সমস্যা হল, খবর সত্যি নাকি মিথ্যে, তা যাচাই না করে, অবিবেচকরা মাঝেমধ্যে কিছু মানুষের প্রাণহানি পর্যন্ত করছেন অমানবিক ভাবে।
দেশের মধ্যে প্রায় কুড়ি কোটি হোয়াট্স অ্যাপ ইউজার্স, ভুল খবর ভাইরাল করে চলেছেন প্রতিদিন। বিবেচনা না করে, যাচাই না করে কীভাবে কিছু সংখ্যক মানুষ গুজব ছড়াচ্ছেন, তা ভাবলেই অবাক হতে হচ্ছে। যারা কোনওকিছু শেয়ার কিংবা ফরওয়ার্ড করছেন, তাঁরা একবারও ভাবছেন না যে, গুজব ছড়ানোর পরিণাম কী হতে পারে!
ভয়ংকর পরিণাম
না ভেবেচিন্তে হোয়াট্স অ্যাপ-এ মেসেজ ফরওয়ার্ড করলে কী পরিণাম হতে পারে, তারও প্রমাণ পাওয়া গেছে বহুবার। চার বছর আগের এক পুরোনো মেসেজ ফরওয়ার্ড করতে করতে যখন সত্যটা সামনে এল, ততক্ষণে যা ঘটার ঘটে গেছে।
বেঙ্গালুরুর বানশংকরী অঞ্চলের বাসিন্দা এক ব্যবসায়ীর হোয়াট্স অ্যাপ-এ মেসেজ এল– ‘কেম্পাগৗড়া ইন্সটিটিউট অফ মেডিকেল সায়েন্সেজ হস্পিটাল-এ এক অচেনা বাচ্চা মাথায় চোট পেয়ে ভর্তি আছে। মেসেজ ছড়িয়ে দ্রুত ওই বাচ্চার মা-বাবার কাছে খবর ছড়িয়ে দিন।’ এই মেসেজ এবং বাচ্চার ছবি দেখে ওই ব্যবসায়ী বিচলিত হয়ে পড়েন, কারণ তার বোনের ছেলের সঙ্গে ওই বাচ্চার ছবির মিল আছে। তিনি তখনই তার বোনকে ফোন করে খবর দেন। বোন ঘাবড়ে গিয়ে বাচ্চার স্কুলে যান, কিন্তু দেখেন যে, বাচ্চাটি ঠিক আছে।
এই ঘটনার পর ওই ব্যবসায়ী খোঁজ খবর নেন। জানতে পারেন, তারই এক পরিচিত লোক নতুন স্মার্ট ফোন কিনে, পুরোনো ফোন থেকে ব্যাক-আপ নেওয়ার পর, নতুন ফোন-এ হোয়াট্স অ্যাপ ঠিক মতো কাজ করছে কিনা দেখার জন্য ওই মেসেজ ফরওয়ার্ড করেছিলেন। তিনি ভেবে দেখেননি, এর পরিণাম কী হতে পারে। এভাবেই অনেকে অবিবেচকের মতো কাজ করে চলেছেন।
সাবধান হওয়া জরুরি
সত্যি-মিথ্যে যাচাই না করে, আপনারও যদি কোনও কিছু ফরওয়ার্ড করার অভ্যাস থাকে, তাহলে সাবধান হয়ে যান। কারণ, আদালত এখন এইরকম গুবজ ছড়ানোর ঘটনায় কড়া পদক্ষেপ নিতে শুরু করেছে। পুলিশও যদি এইরকম অভিযোগ পায়, তাহলে দ্রুত মামলা শুরু করে অভিযুক্তের বিরুদ্ধে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেবে।
সম্প্রতি লখনউ নিবাসী এক ব্যক্তি গ্রেফতার হয়েছেন অন্যের হোয়াট্স অ্যাপ-এ আপত্তিজনক কার্টুন পাঠিয়ে।
গুজব ছড়াবেন না
রোগব্যধির চিকিৎসা থেকে শুরু করে ভক্তিলাভের উপায় তুলে ধরা হচ্ছে ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ এবং মেসেঞ্জার-এ। আয়ুর্বেদ-এ টিবি কিংবা ক্যানসার নিরাময় হয়ে যাবে, এমন বার্তাও দেওয়া হচ্ছে সোশ্যাল সাইট-এ। দেবদেবীর ছবি এবং বাণী দশজনকে ফরওয়ার্ড করলে ইচ্ছেপূরণ হবে, এমন মেসেজও ভাইরাল করা হচ্ছে। ‘এটা খাবেন না, ওটা খাবেন না, অমুক অসুখ হবে, অমুক জায়গায় বাচ্চা চুরি হচ্ছে’ –এমন হাজারও গুজব ছড়ানো হচ্ছে প্রতিদিন। আর এরফলে ক্ষতি হচ্ছে বৃহত্তর সমাজের। তাই, গুজব ছড়ানো বন্ধ করুন। আপনার এবং আপনার আত্মীয়স্বজনেরও ক্ষতি হতে পারে এই রকম গুজবে, কিংবা গুজব ছড়ানোর কারণে আপনি গ্রেফতারও হতে পারেন, একথা ভেবে অন্তত গুজব ছড়ানো বন্ধ করুন।
উড়ো খবরের ছড়াছড়ি
নোটবন্দির পর তো এমন খবরও ছড়িয়েছিল যে নোট অর্থাৎ টাকার মধ্যে ‘চিপ’ বসানো রয়েছে। কখনও আবার এমন খবরও ছড়িয়েছিল যে, নুন-এর ঘাটতি দেখা দিতে পারে। এই খবর ছড়িয়ে পড়ার পর, রাতারাতি বাজার থেকে নুন উধাও হয়ে গিয়ে কালোবাজারি শুরু হয়ে গিয়েছিল। কুড়ি টাকা কিলোগ্রাম নুন প্রায় ২ঙ্ম০ টাকা দামেও বিক্রি হয়েছে কিছু জায়গায়।
‘আর কিছুদিন পর পৃথিবী ধবংস হয়ে যাবে’– এমন খবরও ছড়িয়েছে সোশ্যাল সাইট-এ। শুধু তাই নয়, গুজবের ফলে সাম্প্রদায়িক সম্প্রতি নষ্ট হয়ে কোথাও হয়তো দাঙ্গার পরিস্থিতিও তৈরি হয়েছে কখনও।
আসলে, কিছু কুমতলবী মানুষ মাঝেমধ্যে এইরকম গুজব ছড়িয়ে আনন্দ পায়। তারা বেশ ভালো মতো বুঝে গেছে যে, অনেক অবিবেচক মানুষ আছেন, যাদের মগজধোলাই করে গুজব ছড়িয়ে অশান্তি বাঁধানো সম্ভব। সভ্য সমাজের কাছে এটা খুব-ই লজ্জার! অতএব, সতর্ক থাকুন। কুমতলবীদের উড়ো খবরে বিভ্রান্ত না হয়ে, আসল সত্য উদ্ঘাটন করুন। বাঁচান নিজেকে এবং সমাজ তথা দেশকে।