খবরটা শুনে চমকে গিয়েছিল স্পন্দনা। ওর হৃদস্পন্দন থেমে যাওয়ার মতো অবস্থা হয়েছিল।
চমকে যাওয়াটাই স্বাভাবিক ছিল। কারণ চমকপ্রদ খবরটা ছিল স্পন্দনার পরিচিত পটেল পরিবার-কে নিয়ে।
মিস্টার পটেল নাকি খুব নেশা করতেন। সাইকোট্রোপিক ড্রাগসও নিতেন তিনি। তাঁর মেয়ে প্রেমিকের সঙ্গে পালিয়েছে বলে যা রটেছিল, তাও নাকি সত্যি নয়। আসলে খুব সহজে অর্থ উপার্জনের জন্যই নাকি পটেল তাঁর মেয়েকে বিক্রি করে দিয়েছিলেন। তবে, এখানেই শেষ নয়। এরপর নিজের বাড়িও বিক্রি করে দিয়েছিলেন পটেল এবং অবসাদগ্রস্ত হয়ে শেষপর্যন্ত আত্মহত্যা করেছিলেন। আর স্বামীর এই অপকর্মের বিষয়ে সবকিছু জেনেও, ভয়ে পুলিশের কাছে মুখ খুলতে পারেননি শ্রীমতি পটেল।– অবশ্য এই ঘটনা শুধু উদাহরণ-মাত্র। খবরে প্রকাশিত হোক কিংবা না-হোক, এমন ঘটনা বহু ঘটে এবং উপযুক্ত ব্যবস্থা না নিলে অদূর ভবিষ্যতেও অনেক মেয়েই বিকোবে পণ্যের মতো।
গুজরাতের পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের ডিআইজি, গান্ধিনগরের ডা. মীরা রাম নিবাস এবং পরিত্রান নাম্বিয়ারের লেখা ‘ট্র্যাফিকিং ইন গার্ল চাইল্ড আ গুজরাত সিনারিয়ো’ শীর্ষক বইটি প্রকাশিত হয়েছে। আর ওই বইটির গুরুত্বপূর্ণ তথ্য নিয়েই এই নিবন্ধ।
কন্যাসন্তান নিখোঁজ হওয়া কিংবা বিক্রি হয়ে যাওয়ার নানা কারণ খুঁজে পাওয়া যায়। কোনও ক্ষেত্রে আর্থিক মন্দা অবস্থার জন্য কিংবা নেশাতাড়িত হয়ে বাবা-মা বিক্রি করে দেন সন্তানকে, আবার কারও দ্বারা প্রতারিত হওয়ার ফলেও এই ধরনের ঘটনা ঘটে।
কিছুদিন আগে পশ্চিমবঙ্গের এক প্রান্তিক জেলায়, শ্রীদেবী নামের এক মেয়ের ক্ষেত্রেও এমনই এক মর্মান্তিক ঘটনা ঘটেছিল। তার বাবা হঠাৎই দ্বিতীয়বার বিয়ে করে। তখন মায়ের সঙ্গে অসহায়ভাবে দিনযাপন করতে হয় শ্রীদেবীকে। এমন পরিস্থিতিতে ওকে গুজরাতের এক বিউটি পার্লারে কাজ দেওয়ার জন্য এক দম্পতি নিয়ে যায়। তার মায়ের হাতে অগ্রিম চার হাজার টাকাও দিয়ে যায় ওই দম্পতি। কিন্তু দুঃখের বিষয় হল এই যে, বিউটি পার্লারে কাজ দেওয়ার কথা বলে গুজরাত নিয়ে গিয়ে শ্রীদেবীকে যৌণকর্মী হতে বাধ্য করা হয়। পরে অবশ্য সুযোগ বুঝে পালিয়ে আসে শ্রীদেবী এবং এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার মাধ্যমে পুলিশ তাকে উদ্ধার করার পর দোষীদের গ্রেপ্তার করা হয়।
ওড়িশার শান্তি ও পাম্মিকেও কাজ পাইয়ে দেওয়ার কথা বলে ওদের মায়ের এক বান্ধবী আহমেদাবাদে বিক্রি করে দেয়। অবশ্য তিনদিনের মধ্যেই পাম্মি ওখান থেকে পালিয়ে আসে এবং পুলিশের মাধ্যমে ওর বোনকেও উদ্ধার করে।
আরও একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটেছিল আহমেদাবাদে। বছর বয়সি দিয়া এবং কাজল শাহিবাগে একটি মন্দিরের সামনে দাঁড়িয়েছিল। হঠাৎ এক মহিলা এসে ওদের পুজোর প্রসাদ খেতে দেবে বলে লোভ দেখিয়ে একটি গাড়িতে তোলে। এই ঘটনাটি একটু দূরে দাঁড়িয়ে থাকা মোবাইল ভ্যানের পুলিশের নজরে আসে এবং ওদের সন্দেহ হয়। এরপর পুলিশ ওই গাড়িটিকে অনুসরণ করে এবং অপরাধীকে ধরে। পরে জানা যায়, স্থানীয় ধান্দাবাজ লোকেদের সাহায্যেই ওইরকম গার্লস ট্র্যাফিকিং চলছে ওই অঞ্চলে।
গার্লস ট্র্যাফিকিং সারা বিশ্বে সত্যিই এখন এক ভয়ানক সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভারতবর্ষের কেন্দ্রীয় সরকার এবং বিভিন্ন রাজ্য সরকার এই বিষয়টির উপর গুরুত্ব আরোপ করে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা চালালেও, অপরাধ দমনে এখনও পুরোপুরি সাফল্য আসেনি। তবে সমস্ত রেলস্টেশন এবং বাসস্ট্যান্ডগুলিতে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে বলে জানা গেছে। মেয়েপাচার রোধে স্পেশাল পুলিশ বাহিনীও নিয়োগ করার চেষ্টা চলছে সমস্ত রাজ্যে। গার্লস ট্র্যাফিকিং সংক্রান্ত বেশ কিছু প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন ডিআইজি মীরা বর্মা।
সাধারণের সুবিধার্থে গার্লস ট্র্যাফিকিং–এর বিষয়ে বিশদে জানাবেন?
ওয়েল, অফকোর্স, বিষয়টি নিয়ে স্বচ্ছ ধারণা গড়ে তোলা দরকার। যখন কোনও মেয়েকে তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে নিয়ে গিয়ে কল-কারখানায়, বাড়ির কাজে কিংবা সেক্স ওয়ার্কার হতে বাধ্য করা হয়, তখন সেই বিষয়টিকে গার্লস ট্র্যাফিকিং বলে ধরা হয়। অবশ্যই এটা চরম ঘৃণ্য অপরাধ এবং ধরা পড়লে এর জন্য আইনমাফিক কঠিন শাস্তিও পেতে হবে অপরাধীকে।
এই ধরনের অপরাধ কি বাড়ছে?
আন্তর্জাতির বিভিন্ন সংগঠনের সমীক্ষা অনুযায়ী জানা যায়, গার্লস ট্র্যাফিকিং বেড়েছে। তবে এই ধরনের অপরাধ দমনের ব্যাপক চেষ্টা চলছে।
ট্র্যাফিকিং হওয়া মেয়েদের বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেহব্যাবসায় নামতে বাধ্য করা হয় কেন?
শুধু ভারতবর্ষেই নয়, সারা বিশ্বে দেহব্যাবসা চলছে পরম্পরাগতভাবে। দক্ষিণ ভারত এবং মহারাষ্ট্রে চালু আছে দেবদাসী প্রথা। আসলে দেহব্যাবসায় যুক্ত থাকা মেয়েদের ব্যাপক চাহিদা এবং আয় আছে বলেই এর বাজার রমরমা। তাই এই পেশায় মেয়েদের জোর করে নামানো হচ্ছে এবং পকেট ভরছে অপরাধীরা।
গার্লস ট্র্যাফিকিং আটকাতে সচেতনতা বেড়েছে কি?
কিছুদিন আগে মুম্বইয়ে এক চমকপ্রদ ঘটনা ঘটেছিল। জোট বেঁধে ন্যাড়া হয়ে দেবদাসীরা তাদের বাধ্য হয়ে জড়িয়ে পড়া এই পেশার বিষয়ে যন্ত্রণাদায়ক অভিজ্ঞতা শোনান সাধারণ মানুষকে। বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের পক্ষ থেকেও গার্লস ট্র্যাফিকিং আটকানোর জন্য জন-সচেতনতা বাড়ানোর চেষ্টা করা হয়। ‘চাঁদনি বার’ এবং ‘পেজ থ্রি’ ছবিতে ‘কিড পর্নো’র বিষয়টিকে তুলে ধরা হয়েছে সচেতনতা বাড়ানোর উদ্দেশ্য নিয়েই। এ ছাড়া প্রশাসনিকভাবেও গার্লস ট্র্যাফিকিংয়ের বিষয়ে সচেতনতা বাড়ানোর চেষ্টা জারি আছে।
ভারতবর্ষে সেক্স–ওয়ার্কারদের মধ্যে চাইল্ড সেক্স–ওয়ার্কার কত শতাংশ?
এর সঠিক হিসাব পাওয়া শক্ত, তবে মোটামুটিভাবে বলা যায়, সেক্স ওয়ার্কার-দের মধ্যে প্রায় কুড়ি শতাংশ চাইল্ড সেক্স ওয়ার্কার রয়েছে ভারতবর্ষে।
সতর্কতা
- ট্র্যাফিকিং থেকে উদ্ধার হওয়া বাচ্চাদের ফিরিয়ে আনতে হবে স্বাভাবিক জীবনে। ওদের মনে যাতে নিজের প্রতি ঘৃণা কিংবা বিদ্বেষ না জাগে, সে ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে
- বাস-স্ট্যান্ড, রেলওয়ে স্টেশন, বন্দর ও বিমানবন্দর এবং সীমান্ত অঞ্চলে পুলিশ-প্রশাসনের কড়া নজরদারির প্রয়োজন
- ট্র্যাফিকিং আটকাতে পুলিশ-প্রশাসনে এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে নেটওয়ার্ক থাকা দরকার
- গার্লস ট্র্যাফিকিং-এর অপরাধীরা ধরা পড়লে তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া উচিত। যাতে এই ধরনের জঘন্য অপরাধ করতে কেউ সাহস না পায়
- কেউ নিখোঁজ হলে সময় নষ্ট না করে থানায় গিয়ে অভিযোগ নথিভুক্ত করুন এবং সবার সাহায্যে উপযুক্ত ব্যবস্থা নিন।