পলাশ মিত্র ছোটোবেলা থেকে কলকাতাতেই মানুষ হয়েছে। যখন স্কুলে পড়ত তখন বাবাকে হারিয়েছে। এরপর রেলের চাকরিতে জয়েন্ট করার পর মাকে-ও হারিয়েছে। তাই এখন একদম একা। বর্তমান জীবনটা বড়ো শুষ্ক, কঠিন, মরুভমির মতো লাগে। মা মারা যাওয়ার পর বেশ কয়েকটা বছর কেটে গেছে কিন্তু কিছুতেই মা-কে ভুলতে পারেনি। বাবা মারা যাওয়ার পর মা-ই ছিল তার অনুপ্রেরণা।
মা একটা স্কুলের শিক্ষিকা ছিলেন তাই ছেলেকে যথাযথ শিক্ষা দিতে পেরেছিলেন। কিন্তু আজও মায়ের মৃত্যুটা পলাশ কিছুতেই মেনে নিতে পারে না। কারণ মা স্কুল থেকে ফেরার পথে একদিন গাড়ির ধাক্কায় মারা যান। আজও পলাশের জীবনে একটা নিঃসঙ্গতা তাড়া করে বেড়ায়। কী করলে যে জীবনে একটু শান্তি ফিরে পাবে তা বুঝে উঠতে পারে না। তাই তো নিজের ইচ্ছেয় দূরবর্তী একটা স্টেশনে চাকরি নিয়ে চলে এসেছে।
বর্তমানে পলাশ মিত্র হাতিয়া স্টেশনের স্টেশন মাস্টার। স্টেশনের পাশেই কোয়ার্টারে থাকে। রেলওয়ে সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষা দিয়ে চাকরি পেয়েছিল। তারপর বদলি হতে হতে এখানে এসে পৌঁছেছে। সকাল থেকে সন্ধে পর্যন্ত স্টেশনেই থাকে। মা, বাবা দুজনেই গত হয়েছেন, তাই পিছুটান বলে কিছু নেই। পলাশ কাজের মধ্যেই আনন্দ খুঁজে নেয়। ওই স্টেশনের অ্যাসিস্ট্যান্ট স্টেশন মাস্টার বীরেন্দর অবস্তি অনেকবার বলেছে পলাশবাবু আপনি এবার বিয়েটা করে নিন। কিন্তু পলাশকে কিছুতেই রাজি করাতে পারেননি। পলাশ যখন একা একা বসে থাকে নিজের কেবিনে, তখন মাঝে মাঝে উদাস হয়ে নানা কথা ভাবতে থাকে। এটা বীরেন্দরের চোখ এড়ায়নি।
পলাশের মনে অতীতের কথাগুলো তাকে আরও উদাস করে দেয়। পশ্চিমবঙ্গে চাকরি না পেয়ে দিল্লি চলে যায়। সেখানে গিয়ে একটা ফুড ডেলিভারি সার্ভিসের ডেলিভারি বয়-এর চাকরিও সে করেছে। তাই এখানকার খেটে খাওয়া মানুষগুলোকে দেখলেই তার মনটা কেমন নরম হয়ে যায়। তাদের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। তাই রেলের ছোটো-বড়ো সব কর্মচারীই পলাশকে খুব ভালোবাসে।
দিল্লিতে ফুড ডেলিভারি বয়-এর চাকরি করতে করতে যখন প্রায় ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল সে, তখন একদিন মা-র ফোন এল। মা জানালেন যে, ওর রেলের চাকরিটা হয়ে গেছে। দিল্লি যাওয়ার আগে যে-ইন্টারভিউ দিয়ে গিয়েছিল তাতে সে পাশ করেছে। চাকরির জয়েনিং লেটার এসেছে। খবরটা পেয়ে দিল্লির সব পাট চুকিয়ে বাড়ি ফিরে এসেছিল পলাশ।
প্রতিদিনই সারাদিনের ডিউটি সেরে সন্ধ্যায় কোয়ার্টারে গিয়ে একটু বিশ্রাম নিয়ে রাতের ডিনার সেরে আবার ফিরে আসে স্টেশনে। বিশেষ করে হাওড়া-রাঁচি এক্সপ্রেসটাকে পাস করাতে। এটা একটা বেশ নামকরা ট্রেন এই লাইনের। কোয়ার্টারটা স্টেশনের সঙ্গে একেবারে লাগোয়া তাই খুব একটা অসুবিধে হয় না।
অন্যদিনের মতো সেদিনও রাঁচি এক্সপ্রেসটাকে পাস করাতে স্টেশনে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে, বীরেন্দর অবস্তির সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। বীরেন্দর বলল আমি আপনাকেই খবর দেওয়ার জন্য পোর্টারকে বলতে যাচ্ছিলাম। যাক আপনি যখন এসে গেছেন তাহলে আপনি রাঁচি এক্সপ্রেসটা পাস করিয়ে দেবেন। আমি খাবারটা খেয়ে আসছি ততক্ষণে। আর হ্যাঁ, আপনার সঙ্গে এক মহিলা দেখা করতে এসেছেন। আমি তাকে আপনার কেবিনে বসিয়ে রেখে এসেছি।
—এত রাতে আবার কে এল দেখা করতে! ঠিক আছে আপনি যান। আমি দেখে নেব।
কেবিনে ঢুকেই পলাশ চমকে উঠল। দেখল একটা চেয়ারে মৌ বসে আছে। উচ্ছ্বাস চেপে রাখতে না পেরে সে বলে উঠল আরে তুমি, এখানে। আর আমি তোমাকে তন্ন তন্ন করে কোথায় না খুঁজেছি। কোথাও তোমার খোঁজ পাইনি। কী খাবে বলো। তোমার মুখটা দেখে কেমন শুকনো শুকনো লাগছে, নিশ্চয়ই খুব খিদে পেয়েছে তোমার। কী হল কোনও কথা বলছ না কেন?
এমন সময় পোর্টার এসে খবর দিল বাবু, রাঁচি এক্সপ্রেস স্টেশনে ঢুকছে। এদিকে একটা ডেডবডি এসেছে দূরের এক গ্রাম থেকে। রাঁচি হাসপাতালে পাঠানো হচ্ছে পোস্টমর্টেমের জন্য। আপনার সই চাই।
—তুমি যাও আমি আসছি বলেই পলাশ মিত্র, মৌ-কে উদ্দেশ্য করে বলল, তুমি একটু বসো, আমি যাব আর আসব। আমার কাজটাই এরকম বুঝলে, বলেই কেবিন থেকে বেরিয়ে প্ল্যাটফর্মে বেরিয়ে গেল।
যে-কামরায় বডিটা তোলা হবে তার সামনে বডিটা রাখা আছে। পলাশ সেখানে পৌঁছে কাগজে সই করতে করতে বলল মুখের কাপড়টা খুলে মুখটা একটু দেখাও। এটা নিত্যনৈমিত্তিক কাজ। একবার দেখে কনফার্ম করে নেওয়া আর কী।
ডেডবডির মুখ থেকে কাপড়টা সরাতেই পলাশের মাথাটা কেমন যেন ঝিম-ঝিম করে উঠল। এ কী করে সম্ভব। এ তো মৌ-এর ডেডবডি। এইমাত্র যাকে ওর কেবিনে বসিয়ে রেখে এসেছে। ইতিমধ্যেই ডেডবডিটা হাতিয়া এক্সপ্রেসে কামরায় তোলার সময় দেখল, মৌ কামরার দরজায় দাঁড়িয়ে পলাশের দিকে তাকিয়ে হাসছে। যেন কিছু বলতে চাইছে।
পলাশের মুখ দিয়ে কোনও কথা বেরোল না। পাগলের মতো নিজের কেবিনের দিকে দৌড়ে গেল। কেবিনে ঢুকে দেখল সেখানে মৌ নেই। ওর মাথাটা যেন ঘুরছে মনে হচ্ছে। চোখে অন্ধকার দেখছে। একি স্বপ্ন না সত্যি? মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ল নিজের চেয়ারে।
পলাশ ভূত-প্রেত ইত্যাদিতে কোনও দিনই বিশ্বাস করে না। রাতের পর রাত অনেক ছোটো ছোটো রেলওয়ে স্টেশনে ডিউটি দিয়েছে। ট্রেনের তলায় কাটা-পড়া বহু ডেডবডি তাকে দেখতে হয়েছে কিন্তু এমন পরিস্থিতিতে পড়তে হবে, তা এর আগে কখনও ভাবেনি। এ কী করে সম্ভব তা কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছিল না!
চোখের সামনে পুরোনো দিনের স্মৃতিগুলো ভেসে উঠল একে একে। দিল্লিতে চাকরি করতে গিয়ে তার পরিচয় হয়েছিল মৌ-এর সঙ্গে। পরিচয়টাও খুব অদ্ভুত ভাবে হয়েছিল। একদিন ফুড ডেলিভারি করতে গিয়ে পলাশের আলাপ হয়েছিল মৌ-এর বাবার সঙ্গে। মৌ-এর বাবা কথায় কথায় পলাশের সঙ্গে গল্প জমিয়ে দেন এবং জানতে পারেন যে, পলাশ একজন শিক্ষিত যুবক। কিন্তু অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এই ডেলিভারির কাজ করতে দিল্লিতে এসেছে।
এরপর আরও জানতে পারেন যে, পলাশ একাই থাকে এখানে তাই রাতে ফিরে গিয়ে কোনও কোনও দিন খাওয়াও জোটে না কপালে। এরপর একদিন পলাশ যখন দুটো খাবারের প্যাকেট নিয়ে মৌ-দের বাড়িতে ডেলিভারি দিতে যায়, সে সময় মৌ এসে একটি প্যাকেট নেয় এবং অন্যটি পলাশের হাতে দিয়ে বলে, বাবা আজ বাড়িতে নেই। বলেছেন এটা আপনার জন্য। আর আগামী রবিবার আমাদের বাড়িতে আপনার নিমন্ত্রণ।
পলাশ এরকম একটা পরিস্থিতির জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিল না। তাই অনেক আপত্তি সত্ত্বেও মৌ-এর অনুরোধে প্যাকেটটি নিতে রাজি হয় এবং রবিবার নিমন্ত্রণ রক্ষা করবে বলে জানিয়ে আসে।