এটাই লাস্ট সেমিস্টার। সিদ্ধার্থ কিছুটা অধৈর্য হয়ে উঠছিল ধীরে ধীরে। বিবিএ পাশ করে ইচ্ছে ছিল এমবিএ-টা করে নেবে কিন্তু টাকা কোথায়? বাবা চাকরি থেকে রিটায়ার করেছেন। চাকরি থাকতেই বড়ো দুই দিদির বিয়ে শুধু বাবা দিতে পেরেছিলেন, তাও পিপিএফ থেকে বড়ো একটা অঙ্কের টাকা বার করে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন। ছোড়দির বিয়ে দুমাস পরেই মা-ও হঠাৎই মারা যান।

বাবার পেনশনের টাকায় ওদের দুজনের ভালোমতোই চলে যায় সেটা সিদ্ধার্থ জানে। বাবার কথাতেই বিবিএ পড়তে ও রাজি হয়ে গিয়েছিল। সিদ্ধার্থ ভেবেছিল বিবিএ করে ব্যাবসার কিছু কিছু ও জেনে যাবে। সুতরাং চাকরি না পেলেও ক্ষতি নেই, কিছু একটা ব্যাবসা শুরু করবে। টাকা রোজগার করতে আরম্ভ করলে এমবিএ-টাও করে নেবে। বাবা অবশ্য সিদ্ধার্থকে বলে রেখেছেন, ওর প্রয়োজন পড়লে পড়াশোনার জন্য বাড়িটা বন্ধক রাখতেও রাজি আছেন। ওদের এই একটাই সম্বল, ঠাকুরদার বাবা এই বাড়িটা তৈরি করে গিয়েছিলেন।

এইসব নানা কথা ভাবতে ভাবতেই সিদ্ধার্থ বাড়ি থেকে বেরিয়ে রাস্তা দিয়ে হাঁটছিল। হঠাৎ-ই তার চোখে মুখে, কিছুটা জলের ছিটে এসে স্বপ্নভঙ্গ করল। বর্ষাকাল নয়, আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিটেফোঁটা মেঘও সে দেখতে পেল না। আবার একটু জলের ছিটে তার মাথায় আর মুখে এসে লাগল। উপরের দিকে তাকাতে গিয়ে নজর পড়ল যেখানে ও দাঁড়িয়ে ঠিক তার পাশের বাড়ির দোতলায় দাঁড়িয়ে একটি মেয়ে বারান্দায় তোয়ালে দিয়ে নিজের ভিজে চুল ঝাড়ছে।

চোখাচোখি হতেই মেয়েটির মুখে লজ্জিত হাসি ফুটে উঠল। ধীর স্বরে কিছু একটা বলল, যেটা সিদ্ধার্থর কানে এসে পেঁছোল না। তবে ওর মনে হল মেয়েটি সরি বলছে। সিদ্ধার্থর মাথায় একটু দুষ্টু বুদ্ধি খেলে গেল। সে হাত তুলে মেয়েটিকে আশ্বস্ত করার ভঙ্গিতে বলল, না না ঠিক আছে তবে আপনার হাসিটা কিন্তু বড়ো অমায়িক। আর একবার প্লিজ হেসে দিন।

সিদ্ধার্থের কথা শুনে মেয়েটি জোরে হেসে উঠল। তারপর হঠাৎই নিজের ব্যবহারে লজ্জিত হয়ে ভিতরে চলে গেল। সিদ্ধার্থও নিজের মুগ্ধতা কাটিয়ে আবার হাঁটা শুরু করল।

এই ঘটনার দুদিন পর ওই একই রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে নিজের অজান্তেই সিদ্ধার্থর চোখ চলে গেল আগের দিনের মেয়েটি যে-বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছিল, সেই বারান্দার দিকে। দেখল মেয়েটি দাঁড়িয়ে আছে রাস্তার দিকে তাকিয়ে আজ চুল বাঁধা আছে বলেই মনে হল সিদ্ধার্থর। হঠাৎই মেয়েটির চোখ পড়ল সিদ্ধার্থর উপর আর সঙ্গে সঙ্গে ওর সুন্দর মুখশ্রী মৃদু হাসিতে ঝলমল করে উঠল। অদ্ভুত এক ভালোলাগায় সিদ্ধার্থর বুক ভরে উঠল। এই অনুভূতি আগে কোনওদিন সিদ্ধার্থ অনুভব করেনি। এরপর প্রায় দুই সপ্তাহ মেয়েটিকে দেখতে পেল না সে।

হঠাৎই একদিন বাজারে গিয়ে আবার মেয়েটির মুখোমুখি হল। মেয়েটি সবজি কিনতে ব্যস্ত ছিল, ফলে সিদ্ধার্থকে দেখতে পায়নি। সিদ্ধার্থ-ই সাহস করে এগিয়ে গিয়ে প্রথম কথা বলল, কযেদিন আপনাকে দেখতে পাইনি, কোথাও গিয়েছিলেন বুঝি?

চমকে তাকাতেই সিদ্ধার্থর দিকে চোখ পড়ল মেয়েটির। সঙ্গে সঙ্গে একমুখ হাসি নিয়ে সে জবাব দিল,হ্যাঁ , ছুটি ছিল। দিদির কাছে বেড়াতে গিয়েছিলাম। গতকালই ফিরেছি।

সিদ্ধার্থ ভাবতেই পারেনি মেয়েটি ওর প্রশ্নের উত্তর এত সাবলীল ভঙ্গিতে দেবে। মেয়েটির হাতে দুটো ব্যাগ-ভর্তি সবজিপাতি ছিল। মেয়েটি দুই হাতে ব্যাগদুটো ভাগ করে নিয়ে সিদ্ধার্থের সঙ্গে হাঁটতে শুরু করল। সিদ্ধার্থ ওর হাত থেকে ব্যাগ নেওয়ার চেষ্টা করল কিন্তু মেয়েটি কিছুতেই রাজি হল না, না না আপনাকে কষ্ট করতে হবে না। আমার দুটো ব্যাগ নিতে কোনও অসুবিধা হচ্ছে না। বাড়ি তো কাছেই আর অসুবিধা বোধ করলে একটা রিকশা নিয়ে নেব।

মেয়েটির কথায় সিদ্ধার্থ আমল না দিয়ে ওর হাত থেকে একটা ব্যাগ একপ্রকার ছিনিয়ে নিয়ে নিজের হাতে নিল, আরে এতে কষ্টের কী আছে? আর রিক্শার পয়সা বাঁচিযে রাখুন, চা খাওয়া যাবে।

বলতে বলতেই সামনে চায়ের দোকান দেখে সিদ্ধার্থ বেঞ্চের উপর সবজির ব্যাগ নামিয়ে রেখে দুটো স্পেশাল চায়ের অর্ডার দিল। চা খেতে খেতে দুজনে নিজেদের মধ্যে পরিচয় আদান-প্রদান করে নিল। মেয়েটি জানাল তার নাম সুলগ্না। মায়ের সঙ্গে থাকে। বাবা অনেকদিন হল মারা গেছেন। কম্পিউটার নিয়ে পড়াশোনা করে একটি প্রাইভেট স্কুলে কর্মরতা। সিদ্ধার্থও নিজের পড়াশোনা আর ভবিষ্যতের ইচ্ছের কথা মন খুলে মেয়েটিকে জানাল। চায়ের পয়সা দেওয়ার জন্য পার্স বের করতেই মেয়েটি সিদ্ধার্থের হাত চেপে ধরল, রিকশার টাকা বেঁচে গেছে সুতরাং চায়ের টাকা আমি দেব।

সুলগ্নার চায়ের টাকা দিয়ে দেওয়াটা সিদ্ধার্থর ভালো লাগল না। তবুও সে আর কিছু বলল না। দাম মিটিয়ে বাড়ির পথ ধরল ওরা। প্রথমে সুলগ্নার বাড়ি। বাড়ির দরজায় এসে সিদ্ধার্থর হাত থেকে ব্যাগটা নিয়ে ওকে থ্যাংকস জানিয়ে সুলগ্না বাড়ির ভিতর ঢুকে গেল। সিদ্ধার্থ নিজের বাড়ির দিকে পা চালাল।

এরপর প্রায়শই সুলগ্না আর সিদ্ধার্থ বাড়ির বাইরে দেখা করতে শুরু করল। সুলগ্নার ভালো চাকরি ছিল ঠিকই কিন্তু সিদ্ধার্থ কিছুতেই মনের মতো চাকরি পাচ্ছিল না। বিবিএ-র রেজাল্ট তার ভালো হওয়া সত্ত্বেও যে-চাকরিগুলো পাচ্ছিল সেগুলো কম মাইনের। ব্যাবসা শুরু করার কথাও মাথাতে ছিল সিদ্ধার্থর। সুলগ্নাও সবসময় ওকে উৎসাহ জোগাতে থাকত, নানা লোকের উদাহরণ দিত, যারা জীবনের প্রথমে কঠিন সংঘর্ষ করলেও পরে তারা সকলেই জীবনে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে।

সিদ্ধার্থ দিনের অনেকটা সময় ল্যাপটপে কাটিয়ে দিত চাকরি খুঁজতে আর নয়তো বিকল্প কোনও ব্যাবসার সন্ধানে। মাঝেমধ্যে সুলগ্নার সঙ্গে ওর বাড়িতেও যেত সিদ্ধার্থ। সুলগ্নার মা ওকে খুবই স্নেহ করতেন। একদিন সুলগ্না এসে জানাল যে, ওদের স্কুলে প্রাইভেটে কম্পিউটার ক্লাস খোলার কথা চলছে, যার জন্য অনেক কম্পিউটার একসঙ্গে স্কুল কিনবে। এই সংক্রান্ত একটা প্রোজেক্ট রিপোর্ট আর টেন্ডার তৈরি করতে বলে, সুলগ্না।

সিদ্ধার্থর কম্পিউটার অ্যাপ্লিকেশনের কোর্স করাই ছিল এবং পড়ার সময় টেন্ডার, মার্কেটিং বিষয়ে অনেক কিছু শিখেও ছিল। সিদ্ধার্থর বাবা ছেলেকে এই সুযোগ না ছাড়ার পরামর্শ দিলেন।

সিদ্ধার্থ টেন্ডার ভরল। ভাগ্যও ওর সহায় ছিল। জীবনে প্রথম সুযোগ পেল ভালো কিছু করে দেখানোর। সিদ্ধার্থর টেন্ডার পাস হয়ে গেল। সুলগ্নাদের স্কুলের অনেকগুলো ব্রাঞ্চ ছিল সারা রাজ্যজুড়ে এবং এই কম্পিউটার প্রোজেক্টটার প্রধান ইনচার্জ ছিলেন সুলগ্নার স্কুলের প্রিন্সিপাল। প্রিন্সিপাল সিদ্ধার্থ-কে ডেকে জানালেন, তিনি সিদ্ধার্থর কাজে খুশি হলে রাজ্যের বাইরে তাঁদের যতগুলি স্কুল আছে সেখানেও সিদ্ধার্থর নাম রেকমেন্ড করবেন। যখন তাদের স্কুলেও একই প্রোজেক্ট নিয়ে কাজ শুরু হবে, তখন সিদ্ধার্থর কাজের আরও সম্ভাবনা বাড়বে।

সুলগ্নার সঙ্গে দেখা হলে সিদ্ধার্থ ওকে জানাল, সুলগ্না, আমি কিন্তু টিচার হতে চাই না। আমি একটা কাজ করে দিতে পারি, সেটা হচ্ছে কম্পিউটারগুলো ইন্সটল করে নেটওয়ার্কিং ইত্যাদি। এরপর বেসিক-টা না হয় একজন টিচার এবং কযেজন স্টুডেন্টকে শিখিয়ে দেব। তারপর তোমরা কী করে এগোবে সেটা কিন্তু সম্পূর্ণ তোমাদের দায়িত্ব। এই নিয়ে তোমার স্কুলের সঙ্গে কোনও কথা হয়নি।

ঠিক আছে, তুমি আমাকে পুরোটা শিখিয়ে দিও। আমারও কম্পিউটার নিয়ে অল্প পড়াশোনা আছে সেটা তুমি ভালো করেই জানো।

এই প্রথম কাজটাতেই সিদ্ধার্থ আশাতীত সাফল্য পেল। সিদ্ধার্থর কাজে প্রিন্সিপাল এতটাই খুশি হলেন, তিনি সিদ্ধার্থকে বাকি বারোটা স্কুলের টেন্ডার জমা দিতে বললেন। সুযোগটা পেয়ে সিদ্ধার্থর আনন্দের সীমা থাকল না। খবরটাতে সিদ্ধার্থর বাবাও অত্যন্ত খুশি হলেন। তিনি ছেলেকে ডেকে বললেন, মেয়েটি তোর জন্য অত্যন্ত শুভ। ওর সঙ্গে আলাপ হতে না হতেই এত বড়ো কাজটা হাতে পেলি। আমার মনে হয় সিদ্ধার্থ তোরা দুজনে একসঙ্গে মিলে কাজটা কর। একটু চুপ করে থেকে আবার বললেন, সিদ্ধার্থ, এটা আমার মনের কথা, মেয়েটাকে বড়ো পছন্দ আমার। তোর সঙ্গে ওকে মানাবে ভালো।

সুলগ্নার মায়েরও মনে এই ইচ্ছেটাই শাখা-প্রশাখা বিস্তার করছিল। সিদ্ধার্থ, সুলগ্নাকে নিজের করে পাওয়ার ইচ্ছে অনেকদিন ধরেই মনের মধ্যে সুপ্ত রেখেছিল, কাউকেই বুঝতে দেয়নি। সে জানত আগে তাকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে, তবেই চাঁদের দিকে হাত বাড়ানোর যোগ্য হয়ে উঠবে।

বাবার আশীর্বাদ আর ব্যাবসায় সাফল্য পেযে সিদ্ধার্থ নিজের বাড়ি থেকেই, নতুন কোম্পানির উদ্বোধন করল, সিদ্ধার্থ ডট কম। বাকি স্কুলের টেন্ডারগুলো আগেই সিদ্ধার্থ ভরে জমা দিয়ে দিয়েছিল। ওই কাজগুলোও সে পেল। ছেলেকে ব্যাবসায় প্রতিষ্ঠিত হতে দেখে তার বাবা সুলগ্নার মায়ের সঙ্গে দেখা করে, ওদের দুজনের বিয়ের কথা পাকা করে ফেললেন। শুভদিন দেখে ওদের বিয়ের ভালোমতো ব্যবস্থা করলেন। ধুমধাম করে বিয়ে দিয়ে সুলগ্নাকে বাড়ির বউ করে বাড়িতে নিয়ে এলেন।

বিয়ের পর দিনগুলো ভালোই কাটতে লাগল সিদ্ধার্থর। প্রচুর কাজও পেতে আরম্ভ করল সে। কাজের চাপ এতটাই বেড়ে গেল, একা আর সবদিক দেখা তাদের পক্ষে সম্ভবপর হল না। দুজন লোক রাখতে সিদ্ধার্থ বাধ্য হল। বাড়ি থেকে অফিস শিফট করে একটু বড়ো জায়গা নিল ভাড়ায়। বাইরের ঘরটায় দুজন স্টাফের বসার বন্দোবস্ত করল আর ভিতরের ঘরটায় নিজের বসার। প্রয়োজনমতো অফিসটাকে কাজের জন্য গুছিয়ে সাজাল। সুলগ্নাও সময় করতে পারলে মাঝেমধ্যেই সিদ্ধার্থর অফিসে চলে আসত তার কাজে সাহায্য করতে। বেশ সুখেই কাটতে লাগল তদের দাম্পত্য জীবন।

দুবছর এ ভাবেই কাটার পর সুলগ্না সন্তানসম্ভবা হল। সিদ্ধার্থর জীবনে নতুন করে আনন্দর জোয়ার সব বাধা অতিক্রম করে গেল। কাজের চাপে বাড়িতে আগে বেশি সময দিতে পারত না সে। এখন সেই সিদ্ধার্থই কাজ ফেলে সুলগ্নার কাছাকাছি সবসময় থাকার চেষ্টা করতে লাগল, যাতে সুলগ্নার যত্নের কোনও ত্রুটি না হয়। বরং সুলগ্নাই বকাবকি করত সিদ্ধার্থর এই অবুঝ ব্যবহারের জন্য, আমি কি পালিযে যাচ্ছি নাকি আমি নিজের যত্ন ঠিক করে নিতে পারব না? তুমি কাজ ফেলে বাড়িতে সময বেশি দিচ্ছ, এটা ঠিক হচ্ছে না। এতে তোমার কাজের ক্ষতি হবে।

সিদ্ধার্থও বুঝত এতে কাজের ক্ষতি হচ্ছে। বাজারে একবার বদনাম হয়ে গেলে কেউ তাকে আর কাজ দেবে না। কিন্তু তাও নিজেকে শোধরাবার চেষ্টা করল না সে। এরই মধ্যে সুলগ্নার মা হঠাৎই মারা গেলেন। সুলগ্না শোকে যেন পাথর হয়ে গেল। দুর্ভাগ্যবশত গর্ভাবস্থা চারমাসে পড়তেই সুলগ্নার মিসক্যারেজ হয়ে গেল। এই ঘটনার পর সে পুরোপুরি ডিপ্রেশনে ডুবে যেতে থাকল।

এমন দুঃসময়ে সিদ্ধার্থ আরও বেশি করে সুলগ্নার কাছে থাকতে শুরু করল। সুলগ্না চেষ্টা করত নিজে থেকেই ডিপ্রেশন কাটিয়ে উঠতে। সিদ্ধার্থকেও বোঝাবার চেষ্টা করত কাজে যাওয়ার জন্য। কিন্তু সিদ্ধার্থর সেই এক গোঁ, তুমি সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে যাও, তারপরেই আমি কাজে যাব।

সিদ্ধার্থ কারও কথা শুনল না। এই করে তার প্রোজেক্টগুলোও ডেডলাইন মিস করতে লাগল। নতুন কাজ আসা প্রায় বন্ধ হয়ে গেল। পুরোনো ক্লায়েন্টরাও আর তার উপর ভরসা রাখতে পারল না। সুলগ্নার শরীর ধীরে ধীরে ঠিক হতে আরম্ভ করলেও সিদ্ধার্থর ব্যাবসার ভরাডুবি ঘটল।

দুজন স্টাফকে ছাঁটাই করতে বাধ্য হল সিদ্ধার্থ। ভাড়ার অফিস ছেড়ে দিয়ে আবার বাড়ি থেকেই কাজ করা আরম্ভ করল সে। তবে কাজ বলতে, এখন নতুন কাজের অনুসন্ধান। কারণ সিদ্ধার্থর হাতে কোনও কাজই ছিল না। সুলগ্নাও তাকে নতুন কাজ খোঁজার জন্য চাপ দিতে শুরু করল। এটা সিদ্ধার্থর কিছুতেই সহ্য হতো না, সম্মানে বাধত। এতদিন সে সবাইকে কাজ দিয়ে এসেছে, এখন লোকের দরজায় কড়া নেড়ে কাজ খুঁজতে যাওয়াটায় তার অপমান বোধ হতো। মনে হতো এটা নিয়ে সুলগ্নার সঙ্গে ওদের যত দ্বন্দ্বের সূত্রপাত।

একদিন কাজের সন্ধানে বেরিয়ে বাড়িতে ফিরে সিদ্ধার্থ দেখল সুলগ্না বাড়িতে নেই। টেবিলে তার লেখা একটা কাগজ পড়ে আছে। তাতে লেখা, আমি তোমাকে ছেড়ে, এমনকী এই শহর ছেড়েও চলে যাচ্ছি। আমাকে নিয়ে চিন্তা করা ছেড়ে দাও। আমি তোমার জীবনে ফিরে আসব কিনা এখনই বলতে পারছি না। তবে প্রতি মুহূর্তে তোমার কথা আমার মনে পড়বে এবং এটাই আমার বেঁচে থাকার জন্য যথেষ্ট। একটা কথা মনে রেখো সিদ্ধার্থ জীবন কাটানো খুব সহজ কাজ নয়। লড়াই ছাড়া কেউ প্রতিষ্ঠা পেতে পারে না। সোনাকেও আগুনে পুড়িয়ে হাতুড়ির বাড়ি মেরে তবেই আকার দেওয়া যায়। তুমিও চেষ্টা ছেড়ো না। পরিশ্রম করে যাও, ফল একদিন পাবেই, এই আমার বিশ্বাস। ভগবানের কাছে প্রার্থনা করি যাতে জীবনে তুমি সফল হও। তোমার জন্য রইল আমার শুভকামনা।

এত বড়ো আঘাতের জন্য সিদ্ধার্থ প্রস্তুত ছিল না। সুলগ্না কেন এই সিদ্ধান্ত নিল কিছুতেই বোধগম্য হল না সিদ্ধার্থর। বাবাকেও জিজ্ঞেস করল, সুলগ্না কিছু বলেছে কিনা কিন্তু বাবাও মাথা নাড়লেন। সিদ্ধার্থর মতো তিনিও সম্পূর্ণ অন্ধকারে।

আঘাতের উপর আঘাত। খড়কুটোর মতো একমাত্র বাবাকেই আঁকড়ে ধরল সিদ্ধার্থ, ডুবন্ত জাহাজের নাবিকের মতো। সুলগ্নার স্কুলে খোঁজ করেও তার কোনও ঠিকানা জোগাড় করতে পারল না। তার মনে আশা ছিল অন্য শহরের ব্রাঞ্চে হয়তো সে ট্রান্সফার নিয়েছে। কিন্তু সেখানেও আশাহত হতে হল। কাজে কিছুতেই মন বসাতে পারছিল না সিদ্ধার্থ। বাবা পরামর্শ দিলেন, এক কাজ কর সিদ্ধার্থ, কাজের ব্যাপারে এখন ভাবা ছেড়ে দে, বরং ম্যানেজমেন্ট-টা করেনে। গ্র‌্যাজুয়েশন তো করাই আছে, মাস্টার্স কমপ্লিট কর। তাহলে মাস্টার্সের পর অনেক দিক তোর কাছে খুলে যাবে। আমি, বাড়ি বন্ধক রেখে তোর পড়ার ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।

পড়াশোনায় বরাবরই সিদ্ধার্থ ভালো ছিল। সুতরাং কটা মাস প্রচণ্ড পরিশ্রম করার পর পরীক্ষা দিয়ে আহমেদাবাদে আইআইএম-এ ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেল। নিজেকে পড়াশোনার মধ্যে ডুবিয়ে দিল সে। পড়তে পড়তেই দ্বিতীয় বছরেই একটা নামি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে ভালো প্লেসমেন্ট পেয়ে গেল সিদ্ধার্থ। পড়া শেষ হতেই ছয় মাসের জন্য কোম্পানি তাকে লন্ডন পাঠাল ট্রেনিংয়ের জন্য। কোম্পানির নিয়ম অনুযায়ী ট্রেনিংয়ের পর ইচ্ছেমতো বিদেশে ওদের যতগুলো অফিস আছে, সেখান থেকে বেছে কোনও একজায়গায় সিদ্ধার্থ চাকরি করার সুযোগ পাবে।

লন্ডনে তিন বছর চাকরি করে সে আরও অনেক জায়গায় পোস্টিং পেল। দুই-তিন বছর পর পরই ওকে জার্মানি, ফ্রান্স, অস্ট্রেলিয়া পোস্টিং দেওয়া হল আর সঙ্গে প্রতিবারই প্রোমোশন। এভাবেই দশ-দশটা বছর কাটিয়ে ফেলল সিদ্ধার্থ। প্রথম প্রথম সুলগ্নার কথা খুবই মনে পড়ত। কিন্তু প্রোমোশনের সঙ্গে সঙ্গে টার্গেট পুরণ করার চাপে সিদ্ধার্থ তার নিজের জীবন সম্পর্কে ভাবার আর সময় পেত না। বাবার সঙ্গে ফোনে মাঝেমধ্যে কথা হতো।

দু-তিন বছর পর পর সময় করে বাবাকে এক সপ্তাহের ছুটি নিয়ে দেখে যেত। মনের মধ্যে শুধু একটা ক্ষীণ আশা বেঁচে ছিল যে, হযতো কোনও এক দিন সুলগ্না আবার তার জীবনে ফিরে আসবে।

সিদ্ধার্থদের কোম্পানি মুম্বইতে একটা নতুন ব্রাঞ্চ খোলার পরিকল্পনা নিলে, ঠিক হয় সিদ্ধার্থকে ওই অফিসের চিফ করে পাঠানো হবে। অফিস পুরো সেট-আপ হয়ে গেলে সিদ্ধার্থর এক জুনিয়র কলিগকে মুম্বই পাঠায় কোম্পানি, ওখানকার সব কাজ সুষ্ঠু ভাবে তদারকি করার জন্য। নতুন অফিসের জন্য কিছু সফ্টওয়্যার ইঞ্জিনিয়রের প্রয়োজন ছিল। এটার জন্য সিদ্ধার্থর জুনিয়র কলিগই প্রথম রাউন্ড ইন্টারভিউ নিয়ে তার সম্পূর্ণ ডিটেলস সিদ্ধার্থকে পাঠিয়েরাখত। ফোন এবং ভিডিও কনফারেন্সে ফাইনাল ইন্টারভিউ করার দায়িত্ব সিদ্ধার্থর উপরে ছিল।

মোট বারো জনের লিস্ট তৈরি করে সিদ্ধার্থকে পাঠানো হলে, লিস্ট দেখে ও চমকে উঠল। প্রথম নামটাই সুলগ্নার। বারোজনের মধ্যে সাতজনকে সিলেক্ট করার দায়িত্ব তার কাঁধে। প্রথমে সন্দেহ ছিল অন্য কোনও সুলগ্না হবে হয়তো কিন্তু সিভি দেখার পর সে নিশ্চিত হয়ে গেল, এ তারই সুলগ্না। সে এমসিএ করে গত ছবছর ধরে একটি কোম্পানিতে সফ্টওয়্যার ইঞ্জিনিয়র হিসেবে কাজ করছে।

সিদ্ধার্থ ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে সুলগ্নার ফাইনাল ইন্টারভিউ নিল। এই দশ বছরে সিদ্ধার্থ দাড়ি রাখতে আরম্ভ করেছিল, চোখে চশমা উঠেছিল। কানের পাশের চুলগুলো সব সাদা হয়ে গিয়েছিল। আগের সিদ্ধার্থকে চেনার কোনও উপায় ছিল না। অফিসকেও ইন্সট্রাকশন দেওয়া ছিল যেন সিদ্ধার্থের নাম প্রকাশ না পায়। শুধু চিফ এগজিকিউটিভ বলেই সুলগ্নাকে জানানো হয়।

বহুদিন পর সুলগ্নাকে দেখে সিদ্ধার্থ চোখের জল লুকোতে পারল না। সুলগ্না আগের মতোই সুন্দর আছে। নিজেকে খুব ভালো মেইনটেন করেছে। সিদ্ধার্থও সিলেকশন লিস্টের প্রথমে সুলগ্নার নামটাই রাখল। ওকে এখনও ভালোবাসে বলে নয় বরং পোস্টটার জন্য ওর যোগ্যতাই সবচেয়ে বেশি বলে।

মুম্বই অফিস সেট করার জন্য সিদ্ধার্থের যে-কলিগ গিয়েছিল, সে কোম্পানিতে জুনিয়র হলেও সিদ্ধার্থর অতীত সম্পর্কে সে সবই জানত। অফিসের বাইরে ওরা বন্ধুই ছিল। ওকে সিদ্ধার্থ জানাল যে, এই সুলগ্নাই তার এক সময়ের স্ত্রী। ভাগ্য আজ আবার দুজনকে মুখোমুখি এনে ফেলেছে।

তাকে অনুরোধ করল সিদ্ধার্থ, সুলগ্নার মনের কথা যদি কোনও ভাবে জানতে পারে, তাহলে যেন অবশ্যই তাকে জানায়। কিন্তু কাজটা এমন ভাবে করতে হবে যাতে সুলগ্নার মনে কোনও সন্দেহ না জাগে।

কিছুদিন পরেই সিদ্ধার্থ জানতে পারল, সুলগ্না আজও সিংগল। ওর ফ্যামিলি বলতে ও একাই। তবে সুলগ্না আজও নিজেকে বিবাহিতাই মনে করে। যদিও দশ বছরের উপর হয়ে গেছে স্বামীর সঙ্গে তার কোনও সম্পর্ক নেই। সে নাকি আজও সিদ্ধার্থকেই সম্মান করে, ভালোবাসে। সে চেয়েছিল সিদ্ধার্থ জীবনে অনেক উন্নতি করুক, যেটা তার জন্যই সম্ভব হচ্ছিল না। সে সিদ্ধার্থর উন্নতির পথে কাঁটা হয়ে উঠেছিল। তাই ভালোর জন্যই সিদ্ধার্থকে ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়েছিল। কিন্তু এই দশ-বারো বছরে দূরত্ব এতটাই বেড়ে গেছে যে, সিদ্ধার্থ কোথায় আছে, কী করছে জানার কোনও উপায়ই তার ছিল না,কারণ ততদিনে সিদ্ধার্থরা বাসস্থান বদলে ফেলেছে।

সুলগ্না শুধু এটুকুই জেনেছিল মুম্বই-তে তার যে ইন্টারভিউ নিয়েছে সেই ভদ্রলোক সিদ্ধার্থর পুরোনো বন্ধু। সুলগ্নাকে জিজ্ঞেস করেছিল সে, আমার বন্ধুর সঙ্গে যদি দেখা হয়ে যায় তাহলে আপনি কি তার কাছে ফিরে যাবেন? তাতে সুলগ্না বলেছে, আমার ছেড়ে যাওয়াতে যদি সিদ্ধার্থ নিজের পথ খুঁজে পেয়ে জীবনে সফল হয়ে থাকে, তাহলে বুঝব আমার এই ত্যাগ স্বীকারই সত্যি করে একজন মানুষের জীবন তৈরি করে দিতে পেরেছে। আমি নিজেকে ভাগ্যবান মনে করব।

কিন্তু সে কোথায় রয়েছে আজকাল? আমি শুনেছিলাম যে, এমবিএ করে বিদেশ চলে গেছে? সুলগ্না জানতে চেয়েছিল।

বন্ধুটির উত্তর ছিল, আমিও ঠিক জানি না। তবে কোনও খবর জানতে পারলে আপনাকে নিশ্চয়ই জানাব কথা দিচ্ছি। এরপর জয়েনিং লেটার তৈরি করে সুলগ্নার হাতে ধরিয়ে দিয়েছিল।

আজ শুক্রবার, আপনি সোমবার থেকে কাজে জয়েন করুন। আমাদের চিফ-ও উইক-এন্ডে মুম্বই পৌঁছোবেন। সোমবার থেকে উনিও এখানে অফিস জয়েন করবেন। শেষ অবধি এই কথাই হয়েছিল ওদের দুজনের মধ্যে।

সোমবার সিদ্ধার্থ নিজের কেবিনে বসেছিল।  তার পিএ ফোনে জানাল, স্যার, সুলগ্না ম্যাম হ্যাজ কাম। শি ইজ গোয়িং টু রিপোর্ট ইউ।

প্লিজ সেন্ড হার ইন।

গুড মর্নিং স্যার। দিস ইজ সুলগ্না, ইয়োর কোম্পানিজ নিউ সফ্টওয়্যার ইঞ্জিনিয়র, সুলগ্না জানাল।

ওয়েলকাম ইন আওয়ার ফ্যামিলি।

আমার কোম্পানিই আমার এখনকার ফ্যামিলি।

সুলগ্না এখনও সিদ্ধার্থকে চিনতে পারল না, এতটাই পরিবর্তন হয়েছিল তার চেহারায়। সিদ্ধার্থই বলল, আপনি আপনার কেবিনে গিয়ে বসুন। আপনাকে কাজ বুঝিযে দেওয়া হবে। কাল সকালে যখন আসবেন, আমি বাকি সব কাজ বুঝিযে দেব।

পরের দিন সিদ্ধার্থ কেবিনের সামনে নিজের নেমপ্লেট সিদ্ধার্থ সেন ঝুলিয়ে  দিয়ে চেয়ারে এসে বসল। আজ সে ক্লিন শেভ হয়ে অফিস এসেছে। সুলগ্না নক করে কেবিনে ঢুকতেই সিদ্ধার্থকে দেখে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল। আজ আর সিদ্ধার্থকে চিনতে কোনও অসুবিধাই হচ্ছে না। অস্ফুটে সুলগ্না বলে উঠল, সিদ্ধার্থ তুমি?

দরজার বাইরে নেমপ্লেট দ্যাখোনি?

ঠিক খেয়াল করিনি।

সুলগ্না, এটাই আমার কোম্পানি, আমার ফ্যামিলি। আজ থেকে তুমিও এই ফ্যামিলির একজন বিশিষ্ট সদস্য। আমার আশা ছিল একদিন না একদিন তুমি নিশ্চয়ই ফিরে আসবে। তোমাকে ছাড়া অন্য কারও কথা আমি কোনওদিন ভাবতেই পারিনি।

কিন্তু তুমি… সুলগ্না থেমে যায়।

হ্যাঁ সুলগ্না, আমার এই বন্ধুই তোমার সম্পর্কে সব জানায় আমাকে, বিশেষ করে আমাকে ছেড়ে চলে যাওয়ার কারণ। তোমার আত্মত্যাগের জন্যই আজ আমি সাফল্যের চূড়া, ছুঁতে পেরেছি। এর পুরো ক্রেডিট তোমার প্রাপ্য।

সিদ্ধার্থ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে সুলগ্নাকে কাছে টেনে নিয়ে ওর চুলে মুখ রাখে। কাচের দরজার বাইরে কলিগের সঙ্গে চোখাচোখি হতেই সিদ্ধার্থ আর ওর বন্ধুর মুখে হাসি ছড়িয়ে পড়ে। হাতে থামস আপ সাইন দেখিয়ে সিদ্ধার্থের কলিগ দুজনকে একটু একা থাকার সুযোগ দিয়ে ওই ঘরটা ছেড়ে চলে যায়।

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...