মনে মনে হাসে কস্তুরী। কোথায় রবি? কোথায় ওর মা? ওরা এখন কেমন আছে? বাচ্চাটা অমন করে তাকিয়ে আছে কেন? ও কী কস্তুরীকে চিনতে পেরেছে?

নাহ! ওই তো ওর মা ওকে সরিয়ে নিচ্ছে কস্তুরীর থেকে! ওরা তাহলে ওর চেনা নয়, অচেনা।

ওর এলোমেলো চুলগুলো পাতলা হাওয়ায় ছড়িয়ে পড়ে কপালের এপার থেকে ওপার। মিনমিনে একটা শব্দ ভেসে আসে কানে। ঠেসান দেওয়া পিলারটা থেকে হাত সরিয়ে নিয়ে আরও আলো আরও অন্ধকারের দিকে এগিয়ে যায় কস্তুরী। আর তখনই প্রচন্ড একটা শব্দ সজোরে এসে ধাক্কা খায় ওকে।

শরীরটা দুমড়ে মুচড়ে যেতে যেতেই প্রবল একটা টান অনুভব করে কস্তুরী।

( ১২ )

মন বলে যে একটা কিছু আছে। সেটাই আর নতুন করে অনুভব করতে পারছিল না কস্তুরী। এভাবে কোনও মানুষ অপমান করতে পারে, ওর তেত্রিশ বছরের জীবনে যা হয়নি আজ তা হচ্ছে। আজ তা হল।

শুনেছ খবরটা? দ্যাখো দ্যাখো রিপোর্টটা দ্যাখো। ওগো আমি তোমায় বলেছিলাম না এ মেয়ে সাক্ষাৎ লক্ষ্মী। শ্বশুরের দিকে তাকিয়ে কথাগুলো বলে পাতলা একটা কাগজ ওর দিকে এগিয়ে দেন শাশুড়ি।

দোতলার ঘর থেকে হাঁক দিয়ে তড়িঘড়ি ডেকে পাঠান কস্তুরীকে। তারপরই মনের অনাবিল আনন্দে নিজেদের ভালোলাগার প্রকাশ করতে থাকেন।

কস্তুরীর ছোটো জা প্রেগন্যান্ট। এটা তারই মেডিকেল রিপোর্ট। গোটা বিষয়টায় অদ্ভূত আনন্দের ছোঁয়া থাকাই স্বাভাবিক। কিন্তু কস্তুরীকে এভাবে চোখে আঙুল দিয়ে অপরের এগিয়ে যাওয়ার বিজয় পতাকা ওড়ানো দেখানোর মানে কী? হ্যাঁ তাছাড়া আর কী-ই বা বলা যায়? গলার কাছে কিছু একটা দলা পাকিয়ে আসছিল। মনকে যতই শান্ত করার চেষ্টা করছিল, ততই যেন অশান্ত সমুদ্রের ঢেউয়ে মতো উথালপাথাল হয়ে উঠছিল ওর বুকের ভেতরটা।

কী হল একেবারে যে থ মেরে গেলে? মুখে কুলুপ এঁটে থাকলে হবে? শ্রেষ্ঠা কী খায় না খায় সেসব তো দেখতে হবে? দেখো, মেযো ঘরে শুয়ে থাকলে রাতে কী খাবে একটু জিজ্ঞাসা করে এসো। আমি যাই একটা ফোন করে আসি। সবাইকে মিষ্টিমুখ করাতে হবে তো?

শাশুড়ি ড্রযিংরুম থেকে নিজের বেডরুমের দিকে উঠতেই তমালের বাবা বলেন, বউমা, আমাদের বংশপ্রদীপ আসছে, তুমি কিন্তু এভাবে মনমরা হয়ে সবসময় শ্রেষ্ঠার সামনে ঘোরাফেরা করবে না। তাতে ওর মন আর শরীর দুটোই খারাপ হয়ে পড়বে। হবু সন্তানের ক্ষতি। তোমার থেকে আমরা তো কিছুই পেলাম না। অন্তত এটুকু হেল্প পাব আশা করি।

হ্যাঁ বাবা। নিজের সম্মানের সবটুকু জলাঞ্জলি দিয়ে কস্তুরী ঘরে চলে এসেছিল। একটুও অবশিষ্ট ছিল না আর। ওর প্রয়োজন ফুরিয়েছে ওদের কাছে। হয়তো তমালের কাছেও। বিছানায় উপুড় হয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েছিল। শরীরের সমস্ত সংযম হারিয়ে বাঁধভাঙা জলের মতো একে একে নেমে আসছিল অভিমান, যাবতীয় কষ্ট।

এখন থেকে বৈধভাবে বাঁজা এই অভিধায় বেঁচে থাকতে হবে ওকে। এই অভিধা কখনও মুছবে না জানে কস্তুরী। আসল সত্যিটা কারুর সামনে আসবে না। তমাল ওর থেকে অনেকটা দূরে চলে গেছে। শুধু শরীর থেকে নয়, মন থেকেও। কস্তুরীর জীবনে কে এই সর্বনাশ করেছে তাও ও জানে না।

ঋজুদা…? নাকি বুম্বা…! নাকি অন্য কেউ। কিন্তু কস্তুরীর শরীরের এতটা নিখুঁত বর্ণনা কে দেবে? ঘেঁটেঘুঁটে তমালের প্রোফাইল বের করে কস্তুরীর গোপন জানাবে কে?

বিশ্বাস করে না। তমাল একেবারেই আর কস্তুরীকে বিশ্বাস করে না। দশ বছরের বেশি সম্পর্কটা এভাবে একটা ছোট্ট ঝড়ে উপড়ে যাবে স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারেনি। তাহলে সেই যে-ঝড়ে তমাল ওর হাত ধরেছিল, সবটাই কী দয়ার বশবর্তী হয়ে?

Tags:
COMMENT