পুজো পেরোতেই মনটা পাহাড় পাহাড় করতে থাকে। নভেম্বরের শেষে তাই একরকম বিনা প্ল্যানেই টিকিট কেটে ফেলি। এনজেপি-র। তখনও ঠিক করিনি কোথায় যাব? ট্রেন থেকে নেমে এক বন্ধুকে ফোন করে কথা বলতেই ও পরামর্শ দিল পূর্ব সিকিমের দোরগোড়ায় রংলি সাবডিভিশনের মধ্যে অবস্থিত নিরিবিলি, কোলাহলশূন্য এক জনপদ ‘আরিতার’-এ যাওয়ার। ব্রেকফাস্ট শেষ করে গাড়ি ঠিক করে তখনই রওনা দিলাম। অন্তত বেশ কিছুদিনের জন্য কলকাতার হট্টমেলা থেকে কিছুটা নিস্তার!

সবুজ মহানন্দা স্যাংচুয়ারির বুক চিরে কালো পিচ বাঁধানো রাস্তা ধরে চলেছি। হঠাৎ-ই পাহাড়ের এক বাঁক ঘুরতেই সঙ্গী হল ঘোলা জলের বিশালাকার তিস্তা নদী। একে একে কালিম্পং, আলগাড়া, পেডং-এর পাহড়ি বসতিকে পেছনে রেখে চলে এলাম পূর্ব সিকিমের কাছে। একদিকে পশ্চিমবঙ্গ এবং অপর পারে সিকিম। জায়গাটি রেশিখোলা। বিশাল ব্রিজের নীচ দিয়ে তির তির করে সরু ধারায় বয়ে চলেছে রেশি খোলা (খোলা মানে নদী)। এখান থেকেই শুরু হল সবুজের ঘনত্ব।

শরীরে ঠান্ডা বাতাসের মসৃণ স্পর্শ অনুভব করলাম রেশি থেকে। মনে হল যেন প্রকৃতির এয়ারকন্ডিশনারের মধ্যে ঢুকে পড়েছি। পরপর কয়েকটি পাহাড়ি বাঁক পেরিয়ে পৌঁছোলাম রেনক। ছোট্ট সুন্দর পাহাড়ি জনপদ। বেশ জমজমাট। জিপস্ট্যান্ড, বাসস্ট্যান্ড, এটিএম, দোকান, বাজার, হোটেল, ছোটো ধাবা সবই রয়েছে এখানে।

টুকিটাকি প্রয়োজনীয় জিনিস কিনে ডানহাতি চড়াই রাস্তায় আবার চলা শুরু।

রাস্তার দুই ধার জুড়ে দাঁড়ানো রঙিন, সাদা প্রেয়ার ফ্ল্যাগ, সবুজ গাছপালা, দূরে পাহাড়ের গায়ে লেগে থাকা টিনের চালের ঘর, ধাপচাষের নক্সা আঁকা ছোট্ট ছোট্ট গ্রাম আর রঙিন ফুলে ভরা গাছের আমন্ত্রণে যেন আমরা চলেছি। রেনক থেকে প্রায় আড়াই ঘন্টা জার্নি শেষে অবশেষে পৌঁছোলাম আরিতার।

Sikkim

ওহ… কী সুন্দর প্রাকৃতিক শোভা, বলতে বলতে গাড়ি থেকে নেমে পড়ল সকলে। ফোনে ঠিক করা হোটেলের মালকিন সহাস্যমুখে এসে ওয়েলকাম জানালেন সকলকে। এই মুহূর্তে আমরা রয়েছি ৫৪০০ ফুট উচ্চতায় চারপাশ ঢেউ খেলানো

সবুজ-নীল পাহাড়ে ঘেরা চোখ জুড়ানো প্রাকৃতিক শোভার মাঝে আরিতারে। অপূর্ব ছবির মতো ল্যান্ডস্কেপ। নীল আকাশের নীচে যেন এক ফালি স্বর্গ। তারই মাঝে গোটা কয়েক হোটেল, লজ, দোকানপাট নিয়ে সম্প্রতি গড়ে উঠেছে আরিতার। সিল্করুটের এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ জনপদ হয়ে উঠেছে আরিতার। যারা সবুজের মিছিলে হারিয়ে যেতে চান আর হানিমুন কাপল যারা প্রাণভরে তরতাজা অক্সিজেন নিয়ে দু-চারদিন নিরিবিলি কাটাতে চান, তাদের পক্ষে আদর্শ জায়গা হল এই আরিতার।

ইতিহাসপ্রসিদ্ধ রেশমপথের প্যাঁচানো রাস্তা মূলত শুরু হয়েছে এখান থেকে। লাঞ্চ সেরে যখন হেঁটে ঘুরতে বেড়িয়েছি তখন ঘড়িতে বিকেল তিনটে। নীল আকাশের নীচে দূরে পাহাড়ের মাথায় দেখা যাচ্ছে তুষারাবৃত কাঞ্চনজঙঘার পর্বতশৃঙ্গগুলো। পাহাড়ের পাদদেশের দুধারে নীলসবুজ লম্বা লম্বা পাইনের সারি। তারই মাঝখানে কালো পিচ বাঁধানো মসৃণ চড়াই উৎরাই রাস্তা। অসাধারণ পথশোভা।

চলতে চলতে চোখে পড়ল একটা বড়ো স্কুল আর রঙিন পতাকায় ঢাকা ছোট্ট গুম্ফা। গুম্ফায় সারিবদ্ধ ভাবে সাজানো ছোটো ছোটো প্রেয়ার হুইল। যা ঘোরালে নাকি পূণ্য অর্জন করা যায়। তাই পুণ্যলাভের আশায় আমরাও ঘুরিয়ে নিলাম হুইলগুলো। ছোট্ট শিশুরা ঘরমুখী হয়েছে স্কুল ছুটির পরে।

আমরা ঘুরতে ঘুরতে দেখে নেব এখানকার বিখ্যাত লামাপোখরি লেক বা আরিতার লেক। আগে এর নাম ছিল খাতি সো লেক। সোজা রাস্তায় কিছুটা ট্রেক করে ডানহাতি সরু রাস্তায় ঢুকেই এই লেকের শুরু। লেকের দু’পাশ রংবেরং-এর বাহারি ফুল গাছে সাজানো। বিশালাকার সবুজ টলটলে জলে ভরা লামাপোখরি এক কথায় নয়নলোভন। লেকের চারপাশে উঁচু উঁচু পাহাড় সবুজ বনানীতে ঘেরা। লেকের জলে তাদেরই প্রতিচ্ছবি দেখা যাচ্ছে। রঙিন প্রার্থনা পতাকা টাঙানো, লেকের একমাথা থেকে অন্য মাথায়। চারধার বাঁধানো ঘেরাটোপ। জলে প্যাডেল বোট রাইডিং-এর ব্যবস্থা আছে। ইচ্ছা করলে হ্রদের জলে ভেসে পড়া যায়।

হঠাৎ বৃষ্টি আসায় আমাদের সে শখ আর মিটল না। জলের মধ্যে কয়েকশো রঙিন মাছের দল। মুড়ি, ছোলা, শসাকুচি কিনে জলে ফেললে দেখা যায় তাদের খেলা। লেকের একপাশে ভাসছে পাহাড়ি রুডিশেল হাঁস। লেকের পাশেই রয়েছে ছোট্ট এক গুম্ফা। তার মধ্যে রয়েছে পথ্বাসনে উপবিষ্ট পথ্বসম্ভবার মূর্তি। লেকের পাশ দিয়ে প্রায় এক কিমি পথ হেঁটে উঠে এলাম এক জায়গায়। তার নাম মানখিম ভিউ পয়েন্ট বা মানখিমদাড়া। এখান থেকে নীচে লামাপোখরি লেক সমেত সমগ্র আরিতারকে দেখা যায় পাখির চোখে। পাশে পাহাড়ের ঠিক মাথায় দাঁড়িয়ে বিখ্যাত মানখিম মনাস্ট্রি। যা আরিতার গুম্ফা নামেও পরিচিত।

চারপাশ মন্ত্রযুক্ত রঙিন পতাকায় ঘেরা হলুদ সাদা গুম্ফার পরিবেশ যেন নীরবতা পালন করছে। ভগবান বুদ্ধের আরাধনায় ব্যস্ত লামারা। ঘন্টা আর ড্রামের ধবনি যোগে শুরু হল প্রার্থনা। আমরা বাইরে বেরিয়ে আসতেই শুরু হল পশ্চিম আকাশে অস্তরাগের খেলা। চলতে লাগল হলুদ লাল আর আগুন রঙের হোলি। স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে দেখলাম সে দৃশ্য। আরিতারের বুকে এই সূর্যাস্ত দেখে মন ভরে উঠল।

travel Sikkim

দূরে পাহাড়ের গায়ে দেখা গেল ঐতিহাসিক রেশমপথের সেই বিখ্যাত প্যাঁচানো রাস্তা। সন্ধ্যা হওয়ার আগেই নীচে নেমে এলাম। লেকের পাশে পাইন বনে তখন ঘরে ফেরা পাখিদের কলকাকলি। কী অদ্ভূত সুরে ডেকে চলেছে হিলময়না। তার ডাকে মন উদাস হয়ে যায়। মনে হয় যেন ও তার প্রিয়জনকে হারিয়েছে।

আরিতার থেকে দেখে নেওয়া যায় নির্মলা ধাম, চিরসবুজ নার্সারি, রামগৌরি সংগ্রহালয় এবং হাড্ডো ফল্স। যারা ট্রেকিং করতে ভালোবাসেন তাঁরা যেতে পারেন লুংচক ভ্যালি বা লোকদাড়াতে। এছাড়া রিচলা পাহাড়ে ট্রেকিং করা এক অসাধারণ রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা, যা আপনার সারা জীবনের সঙ্গী হয়ে থাকবে।

আমাদের এবার এগিয়ে যাবার পালা। তাই আরিতার-কে বিদায় জানাতে হল। পরের গন্তব্য পদমচেন। জুলুক যাবার পথেই পড়ে পদমচেন। জুলুক এখন ওভার হাইপড্। ফলে প্রচুর মানুষের ভিড় জুলুকে। নিরিবিলি পছন্দ বলে আমাদের ট্রাভেল প্ল্যানে স্থান পেয়েছিল পদমচেন। জুলুকের পথে যেতে হলে অবশ্য পারমিট লাগে। রংলি থেকে পারমিট করিয়ে ঘন্টাখানেক গাড়িতে পৌঁছোলাম লিংটাম। সিকিমের একটি পরিচ্ছন্নতম গ্রাম। ছোটো একটা দোকানে মোমো দিয়ে প্রাতরাশ সেরে গাড়ি এগোল কুয়োখোলা জলপ্রপাতের দিকে।

অপূর্ব নৈসর্গিক দৃশ্য আর জলপ্রপাত, ফোটো সেশনের আদর্শ স্থান। সিকিমের পথেঘাটে প্রেয়ার ফ্ল্যাগ, যেন রঙিন প্রজাপতির মতোই উড়তে থাকে হাওয়ায়। পাহাড় জোড়া সবুজ আর পাখির ডাকের মায়াময়তায় ডুব দেব বলে, গাড়ি নিয়ে এগিয়ে চলি পদমচেনের দিকে।

আরও এক ঘন্টার পথ পেরিয়ে পৌঁছোলাম জঙ্গলঘেরা এক নিভৃত গ্রামে। বার্ড ভিউইং-এর জন্য আদর্শ এ জায়গা। কুপুপ ও নাথাং যাবার আগে এখানে অ্যাক্লাইমেটাইজেশন করাটাও অন্যতম উদ্দেশ্য। জঙ্গল ঘুরে পাখির ছবি তোলাটা দ্বিতীয় আকর্ষণ। পরের দিনটা বরাদ্দ সিল্করুটের জিগজ্যাগ পথ পেরিয়ে ১১,২০০ ফিট উচ্চতার থাম্বি ভিউ পয়েন্ট থেকে কাঞ্চনজঙঘা দেখার জন্য। আরও কিছুটা এগোলেই জুলুক এবং আমাদের অন্যতম দ্রষ্টব্য, কালপোখরি লেক, কুপুপ লেক এবং আদি বাবা মন্দির।

কুপুপ লেকটা একটু উচ্চতা থেকে দেখলে হাতির মতো আকারটা স্পষ্টভাবে চোখে পড়ে। পৃথিবীর উচ্চতম গলফ্ কোর্সটাও কুপুপের অদূরেই। ওই পথেই জালেপলা পাস এবং ছাঙ্গুও যাওয়া যায়। কিন্তু এসব দেখতে হলে আমাদের থাকতে হবে নাথাং-এ।

পরদিন থাম্বি দেখতে রওনা দিলাম জুলুকের পথে। আধঘণ্টার রাস্তা। বহু হোমস্টে তৈরি হয়েছে এখন জুলুকে। রংবেরঙের ফুল আর পাইনের জঙ্গল পেরিয়ে এগোতে লাগল গাড়ি। মেঘ ঘিরে ধরল জুলুক পেরিয়ে থাম্বিতে নামতেই। পাহাড়ের মন বোঝা ভার। হঠাৎই এক পশলা ভিজিয়ে হয়তো মেঘ সরে যাবে। কিন্তু থাম্বির সৗন্দর্য ধরা দেয় না। মেঘের আস্তরণে ঢাকা। আমরা আরও উপরের দিকে উঠতে লাগলাম,

লাংথাং-নাথাং হাইওয়ে ধরে। পথে পড়ল স্ট্রবেরি লেক।

নাথাং-এর উচ্চতা প্রায় ১৩,৫০০ ফিট। চিন ও ভারতের সীমান্ত এটি। আর্ম বেস হওয়ার জন্য সেনা ছাউনির অতন্দ্র পাহারা গোটা অঞ্চল জুড়েই। নাথাং-এ হোমস্টে আমাদের রাত কাটানোর ঠাঁই। গরম গরম মুরগির ঝোল ভাতে ওরা করলেন অতিথি আপ্যায়ন।

রাতে বৃষ্টি নামল। সেই সঙ্গে শুরু হল বরফ পড়া। পরদিন যখন আমরা নাথাং থেকে কুপুপের পথে, পথ গিয়েছে ঢেকে বরফের চাদরে। সে এক অপরূপ মনভালো করা দৃশ্য। ক্যামেরার শার্টার টিপতে থাকি অক্লান্ত ভাবে। সিকিম যেন হঠাৎই বড়ো অপরূপ হয়ে ওঠে এই শ্বেতশুভ্র পোশাকে।

সেদিন রাত্রে হোমস্টে’র মালিক রাতে আমাদের জন্য বনফায়ার-এর ব্যবস্থা রেখেছিলেন। আগুন ঘিরে চলল বারবিকিউ আর আড্ডার মজা। রাত বাড়তেই

শীতের দামাল বাতাস বইতে থাকে। কলকাতার কথা মনে পড়ল। আমরা এখানে

রাতে লেপ-কম্বলের তলায় আর কলকাতায় এখনও তেমন ভাবে শীতের প্রকোপ শুরু হয়নি।

কীভাবে যাবেন – কলকাতা থেকে নিউ জলপাইগুড়ি বা শিলিগুড়ি নেমে গাড়ি বা বাসে রেনক। রেনক থেকে আরিতারের গাড়ি পাওয়া যায়। বাসের সংখ্যা খুবই কম। তাই সবচেয়ে ভালো নিজেরা গাড়ি ভাড়া করে আসা। গাড়ি ভাড়া পড়বে তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার টাকা।

কোথায় থাকবেন – এখানে খুব বেশি হোটেল নেই। প্রায় সব হোটেলেই থাকা-খাওয়া সমেত ১২০০-১৫০০ টাকা জনপ্রতি।

বেড়ানোর উপযুক্ত সময় -অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর মাস। এছাড়া বর্ষাকাল বাদে আর যে-কোনও সময়।

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...