শ্রাবণের ধারার মতো পড়ুক ঝরে, পড়ুক ঝরে… রিংটোন বাজছে মোবাইলের। কে ফোন করল এখন? রবিবার একটু বেশি বেলা পর্যন্ত ঘুমোতে চেয়েছিল প্রবাল। কিন্তু…। স্ক্রিনে দেখল তমাল। তমাল এত সকালে!

একরাশ বিরক্তি নিয়ে ফোনটা ধরল প্রবাল। ওপাশের কণ্ঠস্বরে অ্যাডরিনালিন রাশ টের পেল। দীর্ঘদিন বাদে কিছু ফিরে পাওয়ার আনন্দ যেন!

কি বন্ধু! এখনও আধেক ঘুমে নয়ন চুমে…?

কী হয়েছে বল না। রোববারের সকালটা দিলি মাটি করে।

না গুরু, আজ দেখো সোনা ফলবে, সোনা।

কেন রে? আবার কী হল? নতুন প্রেম?

না রে, ওটা আমার জীবনে নেই রে। কাজের চাপে ও তাপে এমন অবস্থা! মরারও সময় নেই।

মার খাবি। সক্কালবেলা এইসব বলবি বলে ফোন করলি?

সরি, সরি। বলব বলেই তো কাল রাত থেকে চেষ্টা করছি। কিন্তু তোমার ফোন নীরব।

প্রবালের মনে পড়ল। কাল সন্ধে থেকে শারদীয়ার লেখাটা নিয়ে পড়েছিল। সম্পাদক খুব তাড়া দিচ্ছিলেন। তমালকে কথাটা বলতেই ও আসল কথায় এল।

গতকাল পুলিশ বাজেট নিয়ে রিভিউ করতে লালবাজারে গিয়েছিল তমাল। ডিজি তন্ময় দত্ত ওকে আলাদা করে একটু সময়ও দিয়েছিলেন। ওনার ঘরে চায়েপে-চর্চা চলাকালীন হঠাত্ উনি জানতে চান, ওর মাস্টার্স কোথা থেকে? উত্তরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে কাঁটাকল ক্যাম্পাস বলতেই প্রশ্ন ছুড়ে দেন, উদ্ভব শর্মাকে চেনেন?

জোরসা ঝটকা। উদ্ভব! এতদিনে! মাস্টার্সের পর থেকেই ও লাপাতা। অনেক চেষ্টা করেও ওরা কোনও খবর জোগাড় করতে পারেনি। সেই উদ্ভবের খবর ডিজির মুখে। ফোনে সব কথা বলা যাবে না। তাই ও বিকেলে আসছে প্রবালের কাছে। তার মানে আজ ওর ডিনার এখানেই। ভালোই হল। কালই অফিস ফেরতা ইলিশ কিনেছে। মায়ের হাতের ইলিশ ভাপা লা জবাব। চেটেপুটে খায় তমাল। একটা সিগারেট ধরিয়ে প্রবাল এখন হেঁটে চলেছে স্মৃতির শহুরে পথে।

সাউথ সিঁথির অর্থনীতির পিজি হোস্টেল। দোতলার কোণার ঘরটায় ওরা তিনজন। প্রবাল, তমাল ও উদ্ভব। উদ্ভবের পৈতৃক বাড়ি দেহরাদুন। বাবা রাজধানী এক্সপ্রেসের চালক। মা ওখানকার একটি স্কুলের অঙ্কের শিক্ষিকা। ওর বেড়ে ওঠা দেহরাদুনেই। মায়ের ইচ্ছায় স্নাতক হতে আসা কলকাতায় প্রেসিডেন্সিতে।

মামার বাড়ি টালিগঞ্জে। তবু ও হিন্দু হোস্টেলে থেকেই পড়াশোনা করে। এক আজব ছেলে। সারাটা সময় শর্টস আর টি-শার্ট পরা। ফুল প্যান্ট পরতে কেউ ওকে দেখেনি। এভাবেই ও সারা কলকাতা চষে বেড়াত। মা বাঙালি বলে বাংলাটাও খুব ভালো বলত। ওকে অবাঙলি বলে বোঝাই যেত না।

ওদের বন্ধুত্ব জমাট হল। ক্যাম্পাসে ওদের নাম হল ত্রি কোণ! উদ্ভব খুব মেধাবী হলেও একদম পড়াশোনা করত না। শুধু ঘোরাঘুরি এদিক ওদিক। যেন কলকাতার ইতিহাস লিখবে। এরমধ্যে জুটে গেল প্রেমিকা। আর পায় কে! ওর চেহারায় একটা মাদকতা ছিল। চোখ দুটো ছিল গভীর। পুরো লেডি কিলার! দেবলীনা ছিল অত্যন্ত সুন্দরী। বড়োলোকের মেয়ে জিন্স আর টপ পরা। ইংরেজিতে তুখোড়। অসম্ভব বেপরোয়া। ভারী বুকের উদ্ধত্যে দেহটা সবসময় ঝড় তুলতে চাইত যেন! ওদের দুই বন্ধুর রাগ হতো খুব। উদ্ভবকে যেন দেবলীনা একপ্রকার কেড়েই নিল ওদের কাছ থেকে। কিন্তু ওরা মুখে কিছু বলত না। যদি ভাবে ঈর্ষা করছে।

উদ্ভবকে ওরা দুজন মজা করে উদ্ভট বলে ডাকত। ও উলটে ওদের দুজনের নামের প্রথম অক্ষর বাদ দিয়ে ডাকত। খুব লজ্জা লাগত ওদের। বিশেষত প্রবালের।

ওদের প্রেম যখন প্রচণ্ড আলোচিত ক্যাম্পাসে, তখনই হঠাত্ ব্রেক-আপ। চালাক ছেলে উদ্ভব। রাজধানীর চালক বাপের ছেলে ঠিক সময়ে প্রেমের গাড়ির ব্রেক লাগাল পার্ট ওয়ান পরীক্ষার দুমাস আগে। ওই কদিন শুধু অন্তরীন পড়াশোনা। দিনরাত এক তখন ওর কাছে। দুই বন্ধুর সাহায্যও ছিল ফল্গুধারার মতো। বন্ধুকে ফিরে পাবার আনন্দ বুক জুড়ে। রেজাল্ট বের হলে দেখল, ত্রিকোণ প্রথম বিভাগেই উত্তীর্ণ।

এক সন্ধ্যায় গোলবাড়ির কষা মাংস আর পরোটা খাওয়াল উদ্ভব ওদের। সেদিন গিরিশমঞ্চে সায়কের দায়বদ্ধ দেখল তারা। গল্প মজায় বাগবাজার থেকে হেঁটে সেদিন ফিরেছিল সাউথ সিঁথির হোস্টেলে।

এরপর পার্ট টু-র সময় উদ্ভব একদম বাধ্য ছাত্র। প্রতিটা ক্লাস করতে শুরু করল, অধ্যাপকরাও আশ্চর্য। সকলেই ওদের দুজনকে বাহবা দিতে লাগল, বন্ধুকে নিশ্চিত পতনের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য। পাখির ডানায় ভর করে যেন দিনগুলো কাটতে লাগল। রবিবার বা ছুটির দিনে গ্লোবে সিনেমা কিংবা আকাদেমিতে নাটক দেখা চলতে লাগল। পার্ট টু-তেও যথারীতি ফার্স্ট ক্লাস থাকল তিনজনেরই। মন যেন আনন্দের সাগর তখন। এবার জীবিকার সন্ধানে। হোস্টেল ছাড়ার আগে প্রতিজ্ঞা করল ইয়ে দোস্তি হম নেহি তোড়েঙ্গে। বন্ধুতায় মোড়া থাকবে ওদের আগামী।

কিন্ত হায়! দেহরাদুনে ফিরে গিয়ে উদ্ভব আর কোনও যোগাযোগ রাখল না। একরাশ অভিমান জমা হতে লাগল ওদের মনে। প্রবাল নেট পরীক্ষা দিয়ে কলেজ সার্ভিস কমিশনের সৌজন্যে বেলুড়ের লালবাবা কলেজে যোগ দিল। তমাল এক নামি দৈনিক সংবাদপত্রের মানি মার্কেট অ্যানালিস্ট হিসেবে কাজ শুরু করল। আজ কলকাতা তথা দেশের বুকে ওর রিভিউ যথেষ্ট প্রশংসিত ও জনপ্রিয়।

মায়ের ডাকে আবার প্রবাল বাস্তবে ফিরল। এই সময় মা ওর পাশে বসে কিছুক্ষণ গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দেন। ছোট্ট বাচ্চার মতো ও চুপ করে পড়ে থাকে মায়ের কোলে। বড়ো শান্তি তখন। এটা ওর ছেলেবেলার অভ্যাস। বদলায়নি। কারণ ও দেখেছে এই সময় মায়েরও সারামুখ জুড়ে প্রশান্তি। মাকে তমালের বিকেলে আসার কথা বলে সে বাথরুমে গেল।

বিকেল চারটে নাগাদ তমাল যথারীতি হাজির। সঙ্গে মায়ের প্রিয় নকুড়ের সন্দেশ। ও এবাড়ি এলে আনবেই। কোনও নিষেধ শুনবে না। প্রবালের বুকে তখন উদ্ভব-আলোড়ন। মাকে চা-পকোড়া বলে ওরা ব্যালকনিতে গিয়ে বসল। সামনের পার্কটায় বাচ্চারা খেলছে। পাখির কলরব যেন চারিদিকে। রবিবারের বিকেলের স্থাযী ঠিকানা এই ব্যালকনি, প্রবাল ও তার মাযে। বাচ্চাদের আনন্দ হুল্লোড় ওর ছেলেবেলা ফিরিয়ে দেয় কিছু সময়ে জন্য।

ইতিমধ্যে গরম গরম চা ও পকোড়া হাজির। মা তমালকে রাতে খেয়ে যাবার কথা বলতেই, ওর সারা মুখ জুড়ে সম্মতি। ইলিশের কথা শুনে একটু নেচে নিল মাকে জড়িয়ে ধরে। হাসতে হাসতে মা নীচে চলে গেলেন রাতের প্রস্তুতিতে। তমাল এবার শুরু করল উদ্ভটের থুড়ি উদ্ভবের রহস্য ফাঁস…

তমাল কাল লালবাজারে ডিজিকে উদ্ভবের সাথে ওদের বন্ধুত্বের কথা বলেছিল। অনেক অনুনয় বিনয়ে পর ডিজি একটা খবর দিলেন। অত্যন্ত সিক্রেট। কারণ উদ্ভবের ডেটাবেস একদম বলা যাবে না। তাতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের সাথে উদ্ভবও অসুবিধায় পড়তে পারে।

সোমবার মানে আগামীকাল বিকেল পাঁচটায় নারী ও শিশু কল্যাণমন্ত্রক এবং রাজ্য পুলিশ, যৌথ ভাবে চারজন আন্ডার কপ অফিসারকে সংবর্ধনা দেবে। হাতে গোনা কয়েকজনের উপস্থিতি। প্রেসের অনুমতি নেই। মোবাইল, ক্যামেরার অনুমতিও নেই। এমনকী ভবানীভবনে এ সময় সিসিটিভি ক্যামেরাও বন্ধ থাকবে, যাতে অফিসারদের ছবি বা অন্য কোনও তথ্য বেরিয়ে না যায়। তাই ডিজির মতে, ওখানে দেখা হবার সুযোগও খুব কম। কড়া নিরাপত্তার চাদরে মুড়ে ফেলা হবে এলাকা।

প্রবাল তমালের প্ল্যান বুঝতে পারছিল না। দেখা হবে না জেনেও এত আশা কেন? তমাল এক অদ্ভুত উত্তর দিল কার্টুন চরিত্র টিনটিনের সঙ্গী ক্যাপ্টেন হ্যাডক, পালিয়ে যাওয়া জলদসু্যদের চোঙা উঁচিয়ে গালাগাল দিত। টিনটিন কিছু বললেই বলত, শুনবে না মানে, শুনিয়ে ছাড়ব। সেই রকমই একটা প্ল্যান করছে ও। বলল, দেখা করেই ছাড়ব!

প্ল্যানটা শুনে তো প্রবাল হেসেই খুন। ভবানীভবনের গেটের দুদিকে কয়েকটা পোস্টার পড়বে কাল সকালে, উদ্ভবকে ওদের দেওয়া ভালোবাসার নাম দিয়ে ‘ওয়েলকাম উদ্ভট অফ্ ত্রি কোণ’। ওর উদ্ভট নাম কারও জানার কথা নয় ওরা দুজন ছাড়া। এতে পুলিশের সন্দেহ হবার কথা নয়। ভবানীভবনের মেন গেটের বাঁ দিকে যে-ফাঁকা জায়গাটা আছে সেখানে ওরা দাঁড়াবে। গাড়ি থেকে নামলে চোখ ওই জায়গায় যাবেই। আশা নিরাশার দোলায় দুলতে থাকল ওরা। তমালের আশাবাদ প্রবালকেও ছুঁয়ে গেল বেশ।

যথারীতি পরদিন বিকেলে ভবানীভবনের গেটে দাঁড়াল ওরা। তমাল সকালে পোস্টার লাগিয়েছে লোক দিয়ে প্রবাল দেখল দুদিকে বেশ কিছু পোস্টার লাগানো। খবরটা ফাঁস হয়নি। লোকজন জানে না, মনে হল। তাই ভিড় নেই। খুব একটা বিরোধিতার মুখে পড়তে হল না ওদের। এখন শুধু দুরুদুরু বুকে অপেক্ষা।

পাঁচটা ছুঁইছুঁই, চারটে গাড়ির কনভয় ঢুকল গেটে। প্রবালরা চিত্কার করতে থাকল ত্রি কোণ, ত্রি কোণ, উদ্ভট, উদ্ভট! হঠাত্ শেষ গাড়ির দরজা খুলতেই চমক। উদ্ভব, ওদের উদ্ভট! ওদের দিকে তাকিয়ে আপাত গাম্ভীর্য টেনে হাত নাড়ল একবার। ভেতরে ঢুকে গেল গটগট করে। ওরা বুঝল, কেল্লা ফতে। ডি লা গ্র্যান্ডি মেফিসটোফিলিস…! মনে যেন যুদ্ধ জয়ের আনন্দ।

মিনিট পাঁচেক পর দুজন পুলিশ এসে ওদের ভেতরে নিয়ে গেলেন। একটা ঘরে বসিয়ে রেখে ওরা ভেতরে গেলেন। কিছুক্ষণ পরেই ঢুকল উদ্ভব। উষ্ণ আলিঙ্গন, হো হো হাসি তখন ওদের ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে যেন। ত্রি কোণ যেন বাঁধ ভেঙেছে। এতদিনের অদর্শন আর অনুচ্চারিত আবেগ, যেন ফল্গুধারার মতো বেরিয়ে এসেছে হৃদয় ছিঁড়ে। গড়িয়ে পড়ছে সারা ঘরের মেঝে, দেয়াল সর্বত্র। কফির পর্ব সেরে ও বেরিয়ে গেল সংবর্ধনার জন্য। শুধু বলল হেথা নয়, হেথা নয়, অন্য কোথা অন্য কোনওখানে। ঠিক হল, পরদিন বিকেলে রবীন্দ্রসদন ফোয়ারার কাছে আবার দেখা হবে। এক আকাশ টাটকা বাতাস যেন মন ছুঁয়ে গেল। দুই বন্ধুর নির্ভার শরীর যেন ডানা মেলে উড়ে চলল গেটের বাইরে।

অনেকদিন পর রবীন্দ্রসদন। সেই ফেব্রুয়ারিতে লিটলম্যাগ মেলার পর। কফি নিয়ে ফোয়ারার পাশে বসল প্রবাল ও তমাল। উদ্ভবের আসতে দেরি হবে হয়তো। আজ জায়গাটাকে কী নতুন নতুন লাগছে! ফোয়ারার জল কি প্রাণের আনন্দে একটু বেশি ওপরে উঠে ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে? নিজেদের ভুল ভাবনায় ওরা হেসে উঠল জোরে জোরে।

সাতটার একটু পরে উদ্ভব এল। পরনে ওর প্রিয় নীল ডেনিম জিন্স আর লাল টি-শার্ট। চোখে অ্যাভিযোর সান গ্লাস। পেটানো চেহারায় পুরো সিলভেস্টার স্ট্যালোন। হাঁ করে তাকিয়ে রইল ওরা দুবন্ধু মিলে। লজ্জায় উদ্ভব সানগ্লাস খুলে জড়িয়ে ধরল ওদের। হাসির বাঁধ ভেঙেছে যেন। কফি হাতে এখন ও অনেক খোলামেলা। সতর্কতা নেই। প্রোটোকল নেই। বন্ধুকে এভাবে ফিরে পেয়ে ওরা দুজন খুশি। ওদের সব প্রশ্নের উত্তর দিয়ে চলল উদ্ভব আকাশে সিগারেটের ধোঁয়ার কুন্ডলী ছাড়তে ছাড়তে।

মাস্টার্সের পর উদ্ভব দেহরাদুনে ফিরে গিয়ে শুরু করল আর এক চর্চা। দাদু ছিলেন আইপিএস। দাদুই ছিল ওর রোল মডেল। কখনও বলেনি ওদের। ২০০৫ সালে ও বসল আইএএস পরীক্ষায়। প্রচুর পরিশ্রম ছিল ওর। বেশ শাণিত মেধার উদ্ভব প্রথম বারেই সফল। তালিকায় প্রথমদিকে নাম থাকায় আইপিএসে আসতে অসুবিধা হয়নি তার। এর মধ্যে দাদুর পরামর্শে শরীরটাকেও তৈরি করে নিয়েিল। ঘোড়ায় চড়া আর সাঁতার, জীবনে প্রাত্যহিকী হয়ে দাঁড়াল। ওর ডাকাবুকো মনোভাবের জন্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক ওকে আন্ডার কপ করল। ছোটো ছোটো কয়েকটা মিশনের পর ও দাযিত্ব পেল অপারেশন চাইল্ড ট্রাফিকিং এলিমিনেশন। শিশু পাচার দূরীকরণ।

পশ্চিমবঙ্গ-সহ নর্থ ইস্টের রাজ্যগুলোতে বেশ কয়েক বছর ধরে শিশু পাচার-সহ গাঁজা, হেরোইন, হাসিসের রমরমা। নেপাল ও ভুটানেও এর জাল বিস্তৃত। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের কাছে প্রচুর অভিযোগ আসতে থাকে মেয়েশিশু পাচারের। পাচারকারীরা দিল্লি, বম্বে, আরব এমনকী বেশ কিছু ইউরোপের দেশেও বাচ্চা মেয়ে পাচার করছে। আরবের উটের দৌড়ে বাচ্চা ছেলেদের পাচার করা হয়। আর মেয়েদের দিল্লি, বম্বে প্রভৃতি জায়গায় দেহ ব্যাবসায় নামানো হচ্ছে। আরব শেখদের কাছে আজকাল অল্প বয়সি মেয়েদের চাহিদা তুঙ্গে। ইউরোপের কিছু দেশেও অল্পবয়সী মেয়েদের চাহিদা আছে। ফলে পাচারকারীদের বাড়বাড়ন্ত।

বাচ্চা মেয়েদের সেক্স গ্রোথ হরমোন প্রয়োগ করে বড়ো করে তোলা হচ্ছে বেশি দাম পাবার লোভে। অনেক ক্ষেত্রে বাচ্চা ছেলেদের চোখ কানা করে, হাত পা কেটে ভিক্ষে করানো হচ্ছে। নারকীয় অবস্থা। দিনের শেষে খাবারের সাথে এক প্যাকেট ডেনড্রাইটও দেওয়া হচ্ছে। যাতে নেশার কবলে পড়ে আর বাহ্যজ্ঞান না থাকে।

শুধু তাই নয়, ভয়ংকর এক বিপদের দিকে সারা দেশকেও ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। বাচ্চা মেয়েদের নিয়ে যৌন আনন্দের সময় কোনও সতর্কতা নেওয়া হচ্ছে না। ফলে এইডসের প্রকোপ বাড়ছে ভয়াবহ হারে। গ্রামের ছেলেরা কাজের কারণে শহরে এসে যৌনপল্লীতে যায়। দেশে ফিরে গিয়ে তারাই ওই এইডস ছড়াচ্ছে স্ত্রীদের শরীরে। ফলে বাচ্চারাও আক্রান্ত। অর্থাত্ এক মারণযজ্ঞের মধ্যে দিয়ে চলেছে সময়।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের টনক নড়ে। বেশ ডাকাবুকো চেহারার চার আন্ডার কপ-কে পশ্চিমবঙ্গে পাঠানো হয়, প্রচণ্ড গোপনে। সেই দলে রাখা হয় উদ্ভবকে। এমনকী রাজ্যের কাছেও কোনও খবর ছিল না। পাচারকারীদের নিরাপদ যাতায়াতের জায়গা হল

শিলিগুড়ি-বর্ধমান-কলকাতার পথ। তাই দুজন গেল শিলিগুড়ি স্টেশনে। আর বাকি দুজন উদ্ভব ও এক মহিলা কপ জয়ন্তী নটরাজন গেল বর্ধমান স্টেশনে। পাগল সেজে উদ্ভব ও জয়ন্তী পড়ে রইল বর্ধমান স্টেশনে চার মাস। সঙ্গে রইল খুব সন্তর্পণে রাখা ওদের সার্ভিস রিভলবার। রাজ্য পুলিশ জানতেও পারেনি কিছু।

মাথার চুল বড়ো করে জেল লাগিয়ে কাদামাটি মাখিয়ে কৃত্রিম জট বানানো হয়েিল। গালে না কামানো দাড়ি। গায়ে কালো নোংরা জামা আর কোমরে দড়িবাঁধা একটা প্যান্ট। জয়ন্তীর সাজও পাগলির মতো। ওর নিরাপত্তার জন্য দুজনে কাছাকাছিই থাকার চেষ্টা করত। দেয়ালের জল যাবার পাইপের মধ্যে ওরা ওদের রিভলবার লুকিয়ে রাখত।

প্রথমদিকে কাজ ছিল ওয়াচ আউট। কোথায় কী হচ্ছে শুধু দেখে যাও। রাতে স্টেশনে পাচারকারীরা সক্রিয় হতো। দূরপাল্লার ট্রেনগুলোতেই পাচার হতো বেশি। সঙ্গে গাঁজা হেরোইন।

প্রথম দুমাস কড়া নজরদারির পর ওরা কয়েকজনকে সনাক্ত করল। উদ্ভব ও জয়ন্তীর কাছে নির্দেশ ছিল শুটআউটের। ভরা স্টেশনে শুটআউট কখনওই সম্ভব নয়। তাই স্টেশনের বাইরে লোকোশেডের দিকে পাচারকারীরা যখন কাজ শেষ করে মদের আসর বসাত, তখন ওদের শুটআউট চলত। এভাবে প্রায় এগারোজনকে নিকেষ করল ওরা। কাজ শেষ করে রাতের অন্ধকারে নির্জন শেডের পিছন দিয়ে আবার স্টেশনে ফিরে আসত সুনিপুণ ভাবে। সন্দেহ করার কোনও সূত্র থাকত না। পড়ে থাকা লাশ দেখে এলাকা দখলের লড়াই ছাড়া আর কিছু বলারও থাকত না পুলিশের।

স্টেশনে চলত ওদের পাগলের অভিনয়। কলেজের ফেস্ট-এ ম্যাকবেথ অভিনয়ের অভিজ্ঞতা উদ্ভব পুরো কাজে লাগাল বর্ধমান স্টেশনে। আপাত নিরীহ চেহারা আর সারাদিন নির্জীব হয়ে পড়ে থাকা শরীর দেখে, কারও সন্দেহ হয়নি। বরং ওরা দুজন স্টেশনের বাকি ভিখিরিগুলোর সাথে মিশে গিয়েছিল। তাই আলাদা করার উপায় ছিল না।

দূরপাল্লার ট্রেন ষ্টেশনে ঢুকলেই ওরা দুজন ট্রেনের জানালার কাছে গিয়ে ভিক্ষা চাইত। উদ্দেশ্য কামরার ভিতরের অবস্থা পর্যবেক্ষণ। বাচ্চা পাচারের একটু আভাস পেলেই, লুকানো ফোনে খবর যেত দিল্লিতে। দিল্লি থেকে হাওড়া বা শিয়ালদহ ষ্টেশনে নির্দেশ আসত আরপিএফের কাছে। তারপরের কাজটা সারত রেল পুলিশই। এই ভাবে গত কয়েক মাসে প্রায় চারশো বাচ্চা উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। হেরোইন ভর্তি ব্যাগও উদ্ধার হয়েছে কয়েকবার। শেষ মাসে তো সন্দেহজনক এক ব্যক্তির ব্যাগ থেকে কুড়িটা মেশিন গান ও ম্যাগাজিন উদ্ধার হয়েছে। সবার অলক্ষ্যে থেকে ওরা কাজ করে গেছে।

খুব অসুবিধাও হয়েছে ওদের। জামাকাপড়ের নোংরা ও দুর্গন্ধ তো ছিলই চুল দাড়ির জ্বালাতনও ছিল। শেষের দিকে তো মাথায় উকুন হয়ে গেল। সে আর এক জ্বালা। খাবার জোগাড়ের সমস্যা ছিল খুব। প্রথমদিকে স্টেশনের অন্য ভিখিরিদের সাথে খাবার জোগাড়ের প্রতিযোগিতা চলত। আস্তে আস্তে যখন সকলের সাথে মিশে গেল, তখন সমস্যা অনেকটা কমে এল।

জয়ন্তীর একবার মারাত্মক সমস্যা হয়েছিল। ট্রেনের ভেতরে ঢুকে ভিক্ষা করতে গিয়েছিল সেদিন। উদ্দেশ্য ভেতরে বাচ্চা পাচার হচ্ছে নাকি দেখা। উদ্ভব ছিল বাইরে জানলার ধারে। ওরা পালা করে এই কাজটা করত যাতে কেউ সন্দেহ না করে। জয়ন্তীর আলুথালু পোশাকের ফাঁক দিয়ে প্রকাশিত যৌবনের আভাস, এক যাত্রীকে উত্তেজিত করে তুলেছিল। আচমকাই ওকে বাথরুমের দরজা খুলে ভেতরে ঢুকিয়ে নেয় সে। প্রচণ্ড তত্পরতায় ক্যারাটে কাজে লাগায় জয়ন্তী। লোকটির নাকমুখ ফাটিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসে। সেই থেকে উদ্ভবই একা ট্রেনে উঠত।

শিলিগুড়ির দুজনও খুব ভালো কাজ করেছিল। শিলিগুড়ির পাচারকারীদের মাথাকে ওরা নিকেষ করেছিল অবলীলায়। কিছুদিন মালদা স্টেশনেও ওরা কাজ করেছিল। চারমাস পর শিলিগুড়ি-কলকাতা পথে পাচার একদম বন্ধ। অপারেশন শেষ করে ওরা সোজা দিল্লি। ওদের পৌঁছোনোর পরই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক রাজ্যকে জানায় অপারেশনের কথা। তারপরই কেন্দ্রের অনুমতি নিয়ে এই সংবর্ধনা। কাল সকালের উড়ানেই দিল্লি ফিরবে উদ্ভব।

 

উদ্ভবের রোমহর্ষক অভিজ্ঞতার কথা শুনে, স্তম্ভিত প্রবাল ও তমাল। এক ঘোরলাগা অনুভূতি ওদের সারা শরীরে। ওদেরই বন্ধু আজ দেশের জন্য প্রাণ হাতে লড়াই করেছে, বাচ্চা ছেলেমেয়েদের বাঁচাতে। কবির কথাটা মনে পড়ে গেল ওদের। এ পৃথিবীকে শিশুর বাসযোগ্য করে যাবার জন্য, যেন জীবনের কাছে ছিল বন্ধুর দৃঢ় অঙ্গীকার। দেশের জন্য, দশের জন্য নিজেকে বলি প্রদত্ত করেছে উদ্ভব।

কুর্নিশ বন্ধু। শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে এল ওদের। আবেগে চোখের কোণও গেল ভিজে। সিগারেটে জোর এক টান দিয়ে উদ্ভব উলটোদিকে তাকাল। আধো অন্ধকারে একে অপরকে জড়িয়ে থাকা প্রেমিক-প্রেমিকার চুম্বন দৃশ্য। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সেদিক থেকে মুখ ঘোরাল সে। ওর কি পুরোনো প্রেম মনে পড়ছে? না-পাওয়ার রং কি আজও ওর মন জুড়ে? মুখ তুলে আকাশের দিকে তাকাতেই প্রবাল শুকতারাটাকে জ্বলতে দেখল।

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...