শিশুকে ব্রেস্ট ফিড করানোর ব্যাপারে দ্বিধা জন্মায় আজকাল বেশিরভাগ স্বাধীনচেতা এবং শিক্ষিত মায়েদের মধ্যে, বিশেষকরে যারা নতুন ‘মা’ হয়েছেন। অথচ যেসব মায়েরা শিশুর জন্ম থেকেই তাকে ব্রেস্ট ফিডিং করাচ্ছেন তাদের সকলেরই মত যে, তাদের কাছে নিজের শিশুকে দেওয়া সর্বশ্রেষ্ঠ উপহার হল ব্রেস্ট মিল্ক।
শিশুর জন্মের পর তার প্রথম খাদ্য হল মায়ের দুধ, যাতে সঠিক তাপমাত্রায়, সঠিক পরিমাণে শিশুর বৃদ্ধির সবরকম পুষ্টি থাকে। এই অমৃত, শিশুর স্বাস্থ্যের জন্য রক্ষাকবচের কাজ করে এবং এর সুফল বহুদিন পর্যন্ত শিশুর উপর প্রভাব বিস্তার করে রাখে।
বৈজ্ঞানিক পরীক্ষায় এটা প্রমাণিত যে, যেসব শিশুরা ছোটো থেকে মায়ের দুধ খেয়েছে, তাদের আইকিউ লেভেল অনেক বেশি অন্যান্য শিশুদের থেকে যারা বাজারে পাওয়া দুধ খেয়ে বড়ো হয়েছে। মায়ের দুধে উপস্থিত প্রয়োজনীয় ভিটামিন, অ্যান্টিবডিজ্, নবজাতককে নানারকম অসুখ, সংক্রমণ, অ্যালার্জি, পেট ব্যথা ইত্যাদি থেকে যেমন সুরক্ষা দেয়, তেমনি শিশুর জঠরান্ত্র (ইনটেস্টিনাল ট্র্যাক্ট) কেও সুরক্ষিত রাখে।
ওয়ার্ল্ড হেলথ্ অর্গ্যানাইজেশন এক জরুরি বিগ্যপ্তি জারি করেছে যাতে নবজাতকের জন্য প্রথম ছয় মাস ব্রেস্ট ফিড করানোটা অত্যন্ত জরুরি বলে জানানো হয়েছে। শিশুর দু’বছর পর্যন্ত তাকে ব্রেস্ট ফিড করানো যেতে পারে। এবং তারপর ধীরে ধীরে এই অভ্যাস ছাড়াবার চেষ্টা করা উচিত। এর সঙ্গে সঙ্গে বাড়ির তৈরি অন্যান্য খাবার শিশুকে দিতে থাকলে শিশুর ব্রেস্ট মিল্কের ওপর নির্ভরতা ধীরে ধীরে কমতে শুরু করবে।
ব্রেস্ট ফিড করানো ব্যক্তিবিশেষের উপর নির্ভরশীল
কেউ তার সন্তানকে ব্রেস্ট ফিড করাবে কি করাবে না, সবটাই নির্ভর করে মায়ের উপর। তবে অনেক মহিলা-ই চান এই চয়েস-টা সম্পূর্ণ তাদের উপরেই ছেড়ে দেওয়া হোক। সমাজ যেন এই ব্যাপারে কোনও হস্তক্ষেপ না করে।
গৃহিণী সোমা মজুমদার দুটি সন্তানের মা। ওনার মতে শিশুকে ব্রেস্ট ফিড করানো মায়ের জন্য অনন্য অভিজ্ঞতা কিন্তু কোনও কারণে মা, সন্তানকে ব্রেস্ট ফিড না করালে, সেই মা-কে আনফিট বলে যেন ধরে নেওয়া না-হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মহিলারাই মহিলাদের দোষারোপ করে থাকে অথচ এটা সম্পূর্ণ একজনের ব্যক্তিগত ইচ্ছা। একটি প্রকাশনী সংস্থার সঙ্গে যুক্ত দীপা সাহা মনে করেন, শিশুর জন্যই মায়ের অস্তিত্ব। সুতরাং নবজাতককে ব্রেস্ট ফিড করানোটা কখনও মায়ের কাছে ম্যাটার অফ চয়েস হওয়া উচিত নয় কারণ ব্রেস্ট ফিড-এর মাধ্যমেই মা-ও সন্তানের সম্পর্কটা, বন্ডিং-টা আরও স্ট্রং হয়ে ওঠে।
অনেক মা-ই মনে করেন সন্তানকে ভালো ভাবে মানুষ করাটা মায়েদের সত্যিকারের কাজ। কীভাবে, কী খাইয়ে-পরিয়ে মানুষ করেছেন, সেটা কোনও বড়ো ব্যাপার নয়। অনেকেরই মনের ইচ্ছে ব্রেস্ট ফিড সম্পর্কে জনগণকে আরও সচেতন এবং শিক্ষিত করে তোলা উচিত, ব্যাপারটা পুরোপুরি তাদের নিজস্ব ইচ্ছার উপর ছেড়ে না দিয়ে। এই নেট, ইনফর্মেশনের যুগে অল্পবয়সি মেয়েরাও ব্রেস্ট মিল্কের উপকারিতা সম্পর্কে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল। শিশুর স্বাস্থ্য শুরু থেকেই যাতে সুরক্ষিত থাকে, এবং শিশুর ইমিউনিটি বাড়াবার লক্ষ্য স্থির রেখে মাতৃদুগ্ধই পান করানো ভালো।
ব্রেস্ট ফিডিং-এর অভিজ্ঞতা ভোলার নয়
সিজারিয়ান পদ্ধতির মাধ্যমে শর্মিলার ছেলের জন্মের পরই, নবজাতককে দু’দিনের জন্য অবজার্ভেশনে রাখা হয় হাসপাতালে। শর্মিলার অবস্থা এতটাই দুর্বিষহ হয়ে ওঠে সার্জারির কারণে, যে অসহ্য যন্ত্রণার মধ্যে সন্তানকে ব্রেস্ট ফিড করানোর চিন্তায় ও মনে মনে শিউরে ওঠে। তা-সত্ত্বেও নার্সদের সাহায্যে যখন শিশুকে মায়ের বুকে তুলে দেওয়া হয় স্তন্যপান করানোর জন্য, সেই অভিজ্ঞতা শর্মিলার জীবনে এক অবিস্মরণীয় অধ্যায় হয়ে রয়ে গেছে।
সেই অভিজ্ঞতার কথা জানতে চাইলে শর্মিলার উত্তর, ‘এই অভিজ্ঞতা বলে বোঝাবার নয়। আমার সন্তানের নরম, উষ্ণ শরীরের স্পর্শ, আমার বুকে লেপটে থাকা ছোট্ট শরীরটা আমাকে মা হওয়ার, সম্পূর্ণ নারী হয়ে ওঠার অনুভূতি দিয়েছে। পরম নিশ্চিন্তে, পরম বিশ্বাসে, পরম নির্ভরতায় ও যেন নিজেকে সঁপে দিয়েছে আমার জিম্মায়। সেই থেকে যখনই আমি সন্তানকে ব্রেস্ট ফিড করাই, এই একই ইমোশনে আমি ভেসে যাই। প্রত্যেকবার ব্রেস্ট ফিড করাতে করাতে অজস্র আদরে আমি ওকে ভরিয়ে তুলি।’
ব্রেস্ট ফিড করাবার সময় যখন শিশু মায়ের স্তন থেকে দুগ্ধ পান করে, তখন মায়ের শরীরে অক্সিটোসিন নামে হরমোনের নিঃসরণ হয়। এতে স্তনে দুধের ফ্লো বেড়ে যায়। এটাকে ‘লভ হরমোন’-ও বলা হয়। এই হরমোন শরীরের অন্যান্য হরমোনকেও অ্যাকটিভেট করে, যার ফলে ব্রেস্ট ফিড করাবার সময় মা সন্তানের সঙ্গে একাত্ম ও নিশ্চিন্ত বোধ করে এবং মায়ের স্নেহ সন্তানের প্রতি উদ্বেলিত হয়ে ওঠে। ফলে শিশুকে ব্রেস্ট ফিড করাবার সময় ‘মা’ অসম্ভব আনন্দ অনুভব করে।
ওয়ার্ল্ড হেল্থ অরর্গানাইজেশন-এর পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, সন্তানের জন্মের একঘণ্টার মধ্যেই মায়েদের ব্রেস্ট ফিড করানো শুরু করে দেওয়া উচিত। জন্মের পরেই শিশুর মায়ের সঙ্গে ত্বকের স্পর্শ হওয়া খুব জরুরি কারণ মায়ের থেকে শিশু কোলোস্ট্রাম পায় যা শিশুর ইমিউনিটি শক্তি বাড়ায় এবং শিশুমৃত্যু রোধ করতে সাহায্য করে।
কোলোস্ট্রামকে গলানো সোনা বলা হয়। শিশুর জন্মের পরেই মায়ের স্তন থেকে একধরনের চটচটে হালকা হলুদ রঙের তরল নিঃসরণ হয়। শিশুর জন্য এটি অমৃত বললেও ভুল হবে না যেটি সবরকম পুষ্টি, ভিটামিন ‘এ’ এবং জীবাণু প্রতিরোধী (অ্যান্ডিবডিজ) ক্ষমতায় ভরপুর। এটি শিশুর চোখ ভালো রাখতে সাহায্য করে এবং যে-কোনও সংক্রমণ রোধ করে। বাচ্চাকে যত ব্রেস্ট ফিড করানো হবে, ততই মায়ের শরীরে মিল্ক গ্ল্যান্ড কার্যকরী হয়ে উঠবে। বাচ্চার ইমিউন সিসটেম আরও শক্তিশালী হবে।
নতুন পরীক্ষায় প্রমাণিত হয়েছে যে, ব্রেস্টফিডিং শুধুমাত্র বাচ্চাদের পুষ্টি জোগায় এমন নয়। এটি মায়েদের মধ্যেও যে-কোনও ধরনের সংক্রমণ ও অসুস্থতা রোধ করতেও সাহায্য করে। মা এবং শিশুর মধ্যে ইন্টিমেসিও বাড়ায়। যে মায়েরা শিশুকে ব্রেস্ট-ফিড করান তারা ব্রেস্ট এবং ওভারিয়ান ক্যান্সার, অত্যধিক ওয়েট গেন, অস্টিওপোরোসিস, এনগর্জমেন্ট, ব্রেস্ট অ্যাবসেস এবং পোস্টপার্টাম হেমারেজ থেকে সুরক্ষিত থাকেন।
ব্রেস্ট ফিড – চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন
বহু পরীক্ষার দ্বারা প্রমাণিত যে মা এবং শিশুর জন্য ব্রেস্ট ফিডিং হল শরীর সুস্থ রাখার সবথেকে ভালো পন্থা। এর জন্য বিশাল কোনও কর্মযজ্ঞ অথবা দামি ওষুধপত্রের কোনও প্রয়োজন নেই। তা-সত্ত্বেও মাঝেমধ্যেই এই পন্থাকেও চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হয়। কখনও ডাক্তারি মতবিরোধ ঘটলেও বেশিরভাগ সময় সামাজিক চাপই চ্যালেঞ্জের মূল কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
সারাদিন সমস্ত কাজ ছেড়ে শিশুর জন্য লিটারাল অর্থে ‘মাদার ডেয়ারি’ হয়ে ওঠাটা কোনও মায়েরই কাম্য নয়। তাছাড়াও প্রপার পাম্পিং ফেসিলিটির অভাব, অন্যের রোপণ করা মানসিক দ্বিধা-দ্বন্দ্ব, শ্বশুরবাড়ির চাপ, বাচ্চা সামলানোর সঙ্গে সঙ্গে ঘর-গৃহস্থালির কাজও সামলানো ইত্যাদি মানসিক ভাবে নতুন মাতৃত্বের আনন্দকে চাপের মধ্যে ফেলে দেয়।
মেঘনা গত ২৫ বছর ধরে নিজের সংসার সামলাচ্ছেন। তিনি ছেলেকে যখন ব্রেস্ট ফিড করাতেন সেইসময় তাঁকেও চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হয়েছে। ‘আমি মন ভরে ছেলেকে ব্রেস্ট ফিড করাতে পারিনি। আমার ছেলের জন্মের চার মাসের মধ্যেই আমি আবার কনসিভ করি। ডাক্তার আমাকে ব্রেস্ট ফিড বন্ধ করে দেবার পরামর্শ দেন। ছেলেকে ফিড করাতে না পারায় আমি অপরাধবোধে ভুগতে থাকি এবং আমার নেগেটিভ থিংকিং ছেলেকে সঠিক ভাবে মানুষ করে তোলার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। অথচ শিশুর জীবনে মায়ের দুধ-ই হল সবথেকে ইমপর্টেন্ট অ্যান্টিডোট।’
অনেক সময় পরিবারেরও চাপ থাকে গৃহস্থালির কাজে বেশি সময় দেওয়ার সুতরাং নিজের সন্তানকে ফিড করানোর আনন্দটুকুও পাওয়া সম্ভব হয় না নতুন মায়েদের। সেক্ষেত্রে ব্রেস্ট ফিডিং-ও একটা কাজ হিসেবেই ধরা হয় যার জন্যে পাঁচ-দশ মিনিট সময় মাত্র বরাদ্দ করা থাকে।
অনেক মায়েরা, লো মিল্ক সাপ্লাই-এর মতো অসুবিধারও সম্মুখীন হন। এর অন্যতম প্রধান কারণ হল আর্টিফিশিয়াল বেবি মিল্ক খাওয়ানো শুরু করার জন্য, অথচ ডাক্তারি মতে এর কোনও প্রয়োজনই হয় না।
পাবলিক প্লেস-এ ব্রেস্ট ফিড করানোটাও অনেকে অসুবিধা বোধ করেন। তাই অনেকেই সঙ্গে বাচ্চাকে নিয়ে বাড়ির বাইরে বেরোতে চান না, যদি হঠাৎ করে জনসাধারণের সামনে শিশুকে ব্রেস্ট ফিড করাবার দরকার পড়ে। কিন্তু এই ধরনের অসুবিধা বোধ মায়েদের মন থেকে মুছে ফেলাই বাঞ্ছনীয় শিশুর শারীরিক সুরক্ষার কথা ভেবে।
সমাজে অগ্রগতি এবং শিক্ষার প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে ব্রেস্ট ফিড করানো সম্পর্কেও সাধারণ জনসাধারণকে শিক্ষিত করে তোলা একান্তই দরকার।