দরজাটা বন্ধ করে দাও রাজু…। অঙ্কিতা অফিস বেরোল। সিল্কির সঙ্গে পাজল গেম খেলছিল রাজু বারান্দায় বসে। শুনল কি শুনল না, রাতে রান্না বসাতে গিয়ে চোখ কপালে উঠল অনুর––কুকারটা গেল কোথায়! দরজার পাশে এঁটো বাসনের সঙ্গে ছিল যে!
টুলুর মেজে ধুয়ে রেখে যাওয়া বাসনের বাস্কেট, আরও যথা যথাস্থানে হাতড়ে না পেয়ে হতাশ অনু রাজুর সামনে চড়াও হল, দরজাটা তখন বন্ধ করেছিলে রাজু?
দিনভর বন্দিদশা কাটিয়ে গায়ে শার্ট চড়াচ্ছে রাজু। বেরোবে। কুকারের কথায় ভ্রূ কুঁচকে তাকাল,
–মানে… তখন সিল্কি এমন…।
– বাহ্। অনু স্পষ্টত বিরক্ত।
– তাই বলে দরজা বন্ধ হবে না! নতুন জায়গা অচেনা পাড়া, পাশের ফাঁকা মাঠ দিয়ে ময়লা কুড়োতে এসে উঁকিঝুঁকি মারে। একদিন তো ঢুকেই পড়েছিল, এসব তো জানোই…।
রাজু একটু ইতস্তত করে বলল,
– কিন্তু চোর কি শুধু কুকারটাই নেবে! খুঁজলে সব?
অনুর মুখ গনগনে। মিল্কি তার মা আসামাত্র গা লেপ্টেছে। রাজু নিজেও খুঁজতে শুরু করে। বিরক্ত অনু থামা দেয়-– হয়েছে। আর খুঁজে কী হবে! দরজার পাশেই ছিল, খোলা পেয়ে সহজেই নিয়ে সটকান মেরেছে।
ফলত এক অপরাধবোধ এখন। মোড়ের গুমটি থেকে সিগারেট কিনে খাওয়া, কি পাড়ার ছোট্ট ক্লাবঘরে এক চক্বর দিয়ে আসবে, সেই ফুরসতও তার নিজস্ব নয়। কখন কোন দিক থেকে হুকুম আসবে। কোনটা জরুরি হয়ে উঠবে তার ঠিক নেই। আপাতত মশার ধূপ জ্বেলে দিল রাজু। ঘরে পাখা চলছিল। অফ করল। সামান্য একটু অপেক্ষা করল কোনও ফরমায়েশের। পরে বাজারের থলিটা টেনে নিয়ে হাতে মুড়ল। চাল কেনার বাকি টাকাটা সকালে ফেরত
– যায় নি, যাহোক বাজার আনবে ওই থেকে।
নজর করে অনু বলল, ড্যাডিকে চা খেয়ে যেতে বলো মিল্কি।
চটি পরা স্থগিত থাকল। এমনটাই যেন চাইছিল রাজু। এইভাবে ডেকে চা বা আড়াইশো গ্রাম পেঁয়াজ এনো, বলার ভেতর দিয়ে অনুরও যেন কোথাও খানিক মেরামতির ছুতো থেকে যায়।
কাপ হাতে চেয়ারে বসেছে রাজু। সামান্য তফাতে অন্যমনস্ক অনু। অফিস ফেরত শাড়ি পালটে নাইটি পরেছে। কিন্তু চুলে চিরুনি পড়েনি। ঝুরো ক’গাছি চুল লেপটে আছে বাঁ-গালে। চিবুকের ডৗলটুকু বেশ আধখানা ডাঁসা পেয়ারার মতো। প্লাক্ড ভ্রূর নীচে টানা টানা চোখ দু’টো যেন গাত্রবর্ণকে অনেকটাই ছাড় দিতে পেরেছে। চেহারা কিছুটা ভারীর দিকে হলেও টান টান শাড়ির প্যাঁচে তন্বির চেষ্টা আছে। তবু নজর করলে ফরসা ঢ্যাঙ্গা রাজু ওর ছোটো না বড়ো ভাবতে হবে…।
কাপ নামিয়ে গলা ঝাড়ল রাজু
– অনু, দরজাটা বন্ধ করে দাও…।
সাড়ে ছ’শো স্কোয়ার ফিটের ছোট্ট বাড়িটা শান্তনু শুরু করলেও শেষ করে যেতে পারেনি। বাকি যা ছিল, শোক সন্তাপ কাটিয়ে অঞ্চিতা তাতে হাত দেয়। ভাড়া বাড়ির বসবাস মার মৃত্যুর সঙ্গেই চুকিয়ে, বছরখানেক হল তাদের এখানে আসা।
জায়গাটা এখনও নিরিবিলি। বাইপাস সন্নিকটে না হলেও, জমি ডোবার দ্রুত ভরাটে দোকান, বাড়ি, বাজার যা এগোচ্ছে, বাইপাস সংলগ্ন হতে বেশিদিন লাগবে না।
নতুন কালভার্টের কাজ চলছে, সেটা পেরিয়ে রাজু যেখানে এসে দাঁড়াল, ঝাঁ-চকচকে সুপার মার্কেট-এর এক মিনি মডেল। চতুর্দিকের আলো ঠিকরে ঝলমল করছে দোকানের সম্ভার। এখান থেকে একটি কুকার কিনে অনুর পাশে দাঁড়াতে পারলে পরিস্থিতিটা হয়তো পালটাত। কিন্তু তার পার্সে দু’শোরও কিছু কম পড়ে আছে।
– রাজুদা, তুমি কোথায়?
কানে মোবাইল তুলে নিয়েছে রাজু। নাম্বারটা দেখেও, কেটে না দিয়ে বলল, বল!
– এই আর কী! মানে বলছিলাম যে…।
শুনতে গরজ নেই রাজুর। চণ্ডীতলার বঙ্কা যে কি বলবে তার জানা। কেনা-বেচার কোনও চক্বরে সে আর নেই। অনেক হয়েছে। শেষে মূলধনেরই পুঁজি থাকে না, তো লাভ। পরে মহাজনের দ্বারস্থ হওয়া, সে এক শনির কোপ। পিছল সেই খানাখন্দে হাঁটার কথা ভাবলে এখনও গায়ে কাঁটা দেয় রাজুর। বস্তুত হিংস্রতার উগ্র আদি বীজ কি রক্তে ওর আদৗ ছিল!
বাপ যার নিরীহ ছা-পোষা রং মিস্ত্রি! তিনতলা বাঁশের ভাড়া থেকে পিছলে পড়ে থেঁতো হল! নেহাত পেটের দায়ে পথের বিচার সম্ভব হয়নি, তাই রাজু কোন পথে না হেঁটেছে। সম্মুখ যখন ধূধূ, দল-দ্বন্দ্বের হাতিয়ার হতেও পিছপা হয়নি। হাত পাকাতে ছোটোখাটো হাতাহাতি চলছিলই। বড়ো সংঘর্ষের সূচনায়, মানে, এলাকা দখলের ছুরি শান দেবার পর্বে পিছোতে হল রাজুকে। লাশ ফেলে দেওয়া যেখানে মুহূর্তের ডিসিশন মাত্র। নিমরাজি ইচ্ছাটা শেষতক সেখানেই ফনা গুটিয়ে নিয়েছিল ওর। বেরিয়ে আসা সহজ ছিল না। যদি না গাড়োল ভেবে নিয়ে তারা লাথি ঝাড়ত।
সেই টানাপোড়েন, সেই মরিবাঁচি সময়ের কতককাল পরে আজকের অধ্যায়টির সূচনা…। মা ভাই নিয়ে একত্র বসবাসের পাট চুকিয়ে তবেই না…। বঙ্কাকে জানিয়ে দিল, আমার সময় হবে না রে বঙ্কা… আমার মেয়ের কাল পোলিও আছে।
– তোমার মেয়ে। বলছ কী, সে আবার কবে হল? খুক খুক হাসছে বঙ্কা। নাকি রাজুরই মনের ভুল, কেটে দিয়ে বাজার ঢুকে পড়ল সে।
জাঁকিয়ে বসেছে সবজির সান্ধ্যহাট। বিট গাজর আলু কাঁকরোল, শেষে কিনল আড়াইশো পেঁয়াজ। মোচা কেনার ইচ্ছা থাকলেও সেটা তাকেই ছাড়াতে হবে ভেবে নিল না। ক’টা মুসম্বি রাখল সিল্কির জন্য। এই ফলের রসটুকু আর অফিস ফিরে মেয়ের পড়া, খাওয়া ছাড়া বাদবাকি যত হ্যাপা রাজুর। স্কুল ইউনিফর্ম পরিয়ে সাইকেলে স্কুলে ছেড়ে আসা, ঘড়ি ধরে ঘরে আনা থেকে খাওয়ানো, ঘুম পাড়ানো– সব। মেয়ে না ঘুমিয়ে বলল, কার্টুন চালাও। রাস্তার ডুগডুগি শুনে বাঁদর-নাচ দেখতে চাইল। বলল, মিউ ধরে আনো। কেক খাব। চাউ বানিয়ে দাও। বলল, আমার বন্ধু জিজা তো মার কাছে ঘুমোয়। ওর কোনও ড্যাডি নেই, বাপী আছে… হাজারো প্রশ্ন আর বায়না।
এসময় অদ্ভুত একটা তুলনা মনে এল রাজুর। মঙ্গলা হাট থেকে কিনে ট্রেনে রিকশায় কাপড়ের গাঁটরি বয়ে এনে দোকানে ধরানো, কি সাইকেল চাপিয়ে ফিরি করা, অন্যদিকে সর্বক্ষণ এক মেয়েলি ঘরকন্নার ঊনকোটি দায় সামাল দেওয়া, দুটো কাজের শ্রমগত লাভটা কোনদিকের বেশি।
চট করে একটা সিগারেট ধরিয়ে ফেলল সে। ভাবল, শ্রমের পাল্লা যেদিকেই ঝুঁকুক, এখানে তার আসা– বিপদে বিপথে বিপর্যস্ত এক যুবকের অবস্থার বিপাকে মাথা বিকানো হিসেবে। অন্যদিকে স্বনির্ভর, সসন্তান এক বিধবার সঙ্গহীন স্বেচ্ছাসমর্পণ। সেদিক দিয়ে দেখলে, প্রয়োজনের পাল্লাটি কোন দিকে কতটা ভারী, নাকি ভারসাম্যতা রাখছে, সেটা খতিয়ে ভাববার।
রাজু হিসাব গুলিয়ে বাড়ির পথ ধরল। ক্লাবে যাবার ইচ্ছা থাকলেও বুধবারে সেখানে তালা ঝোলে। মনটা গুমোট। বাড়ি ঢুকে ততোধিক গুমোট ঠেকল পরিপাশ। সাড়াশব্দহীন ঘর। টিভি। সিল্কিও। এমন উত্তুরে হাওয়া সতর্ক করল রাজুকে। মেয়েকে নিয়ে শুয়ে পড়েছিল অনু। দরজা খুলে দিয়ে আবার ঢুকে গেছে, আর এলই না। চুপচাপ বাজারের থলি চুবড়িতে উপুড় করল রাজু। প্যাসেজে আলো জ্বালাতেই চোখে পড়ল টেবিলে খাবার ঢাকা। ক্লাব থেকে ফিরতে দেরি হলেও তো এটা হয় না। আজ তো ক্লাবই নেই। ন’টাও বাজেনি এখনও। প্লাস্টিকের ঢাকা তুলে দেখল রুটি ডাল ডিমের কারি সাজানো একটাই প্লেট। অনুরটা কোথায়! আগে তো খায় না। না খেয়েই শুয়ে পড়ল নাকি!
খাবার দেখলে খিদে চাগাড় দেয় রাজুর। ক্ষুধা লজ্জাহীন। জীবনভর এই তাড়নাটা তাকে নানা ঘাটের জল খাইয়েছে। কত যে কঠিন সময় তাকে পেষাইকলের দাঁতের মতো চিবিয়েছে! প্রত্যয় হয়েছে, সব মানুষই ক্ষুন্নিবৃত্তির শর্তে বাঁধা।
ঝপ্ করে ঢাকনাটা নামিয়ে দিল প্লেটের। অনুকে বাদ দিয়ে খাওয়া ঠিক হবে না। মান-অভিমানের একটা বড়ো ভূমিকা আছে এই খাওয়ায়। সাধাসাধিতে সেটা ভাঙতে পারলে লাভ ছাড়া ক্ষতি নেই। কিন্তু কীভাবে এগোবে!
– তুমি খাবেনা অনু! শরীর খারাপ? শুয়ে পড়লে যে!
অনু হয়তো কথাই বলল না। বললেও দায়সারা গোছের, – তুমি খেয়ে নাওগে না। আমার ইচ্ছে নেই।
শুনেই হামলে পড়ে একা খাওয়া ভালো দেখায় না। হয়তো বলা উচিত, তোমাকে ছাড়া আমি একা কোনওদিন খেয়েছি, অনু! প্লিজ… ওঠো…! নিজের মনেই হাসল রাজু। কথাগুলো সাজিয়ে গুছিয়ে অনুর কাছে গিয়ে দাঁড়াল আদত বুঝি খিদের টানেই।
বাক্যব্যয়হীন দিন দুই পর ছুটির দুপুরে অনুকে সহজ হতে দেখা গেল।
ঘরের আসবাব ঝাড়পোঁছ করছিল রাজু। দেয়াল থেকে ল্যামিনেট করা দাম্পত্যের ছবিখানা নামিয়ে, সেখান থেকে ভোঁতা নাক, খুদি চোখ, পুরু ঠোঁটের পুরুষটিকে কি বাদ দিয়ে ধুলো মুছবে রাজু!
পাশের কনেবউ যেখানে আজকের অঙ্কিতা !
দুর্ঘটনার দু’মাস পর সিল্কির জন্ম না হলে আরও একখানি ছবি ঝুলত দেয়ালে। একইভাবে সে ছবি মুছত সে। এই ভবিতব্যের প্রথম দৃশ্য তাই মনে রয়ে গিয়েছে তার।
হসপিটাল থেকে ফিরছে প্রসূতি, ন্যাপিতে মোড়া শিশু। দুধেল গন্ধ মাখা প্রথম বিষণ্ণ মাতৃত্ব। সঙ্গে বৃদ্ধা মা, গলায় গুনগুনে কান্নার বিলাপ। রাজু ছিল ওই অটোর সহযাত্রি। গাড়ির চালক দীপক তার বন্ধু। উচ্চকিত মনটা রাজুর পড়ে ছিল অনিশ্চিত ফায়দার দিকে। বয়ে আনা জামাকাপড়ের গাঁটরির বিক্রি ব্যবস্থা করার আছে। দোকান মালিকের কিস্তিমাফিক টাকায় তেমন লাভ হয় না। নিজস্ব ফিরিতে থেকে যায় উশুলের একটা দুর্নিবার লোভ। দরদামের কচকচি। যেটায় রাজু তেমন পোক্ত নয়।
চিন্তাগুলো ঘোঁট পাকালেও চোখকান পিছলে যাচ্ছিল পাশ্ববর্তিনীর দিকেও। পুতুলের মতো লালচে বাচ্চাটা নজর কাড়ছিল। সেই শুরু…। আর কে না জানে, কোনও সূত্রপাতেরই গড়িয়ে যাওয়ার কোনো নির্দিষ্ট নিয়ম নেই। যাতায়াতে, সাহায্যে – সহযোগিতায়…। পাড়াটি যখন সংলগ্ন আর অটোড্রাইভার দীপক যার বন্ধু…।
ছবি মুছতে মুছতে দেখল রাজু, সামনে দাঁড়িয়েছে দেড়খানা মানুষ।
ভ্রূ নাচাল সে। সিল্কি না মা-কে? সিল্কি ছিল মার কোলে। মাঝেমধ্যে মেয়েকে সাধ করে কোলে নিয়ে ঘুরে বেড়ায় অনু। দিনভর সঙ্গহীনতার চাপা ভরতুকি!
রাজু বলল, কুকারের শোকপালন শেষ হল?
উত্তর এল না।
– তার মানে ওটা পাওয়া গেছে?
– অত সোজা। চোর যেন ফিরিয়ে দেবার জন্য নিয়েছে। সিল্কিকে নামিয়ে অনু মোড়া টেনে বসল। ঝাড় পোঁছে অনুর সঙ্গে শান্তনুকেও সমান মনোযোগ পেতে দেখেই কি এই প্রসন্নতা! মাথা ঝুঁকিয়ে রাজু যখন শান্তনুর চওড়া কপাল থেকে ধুলোর আস্তরণ তুলছিল, অনু ছিল পিছনে, নিঃশব্দ। এখন মুখোমুখি বসে বলল, রাজু, তুমি অনেক কিছুই বোঝো, আবার কিছু জিনিস বোঝার চেষ্টাই করো না।
চশমা ফোঁড় চেয়ে থাকল রাজু সেই বোঝার চেষ্টায়। অনু চোখ সরিয়ে নিয়ে বলল, দিনটা ছিল সেভেন্থ মার্চ…।
–তো! বলেই হঠাৎ মনেপড়ার উদ্ভাসে বলল সে, তাই তো! অনু চোখের জল সামলে বলল, কুকারটা শান্তনু আমাকে সেকেন্ড অ্যানিভার্সারিতে প্রেজেন্ট করেছিল। আমি মাংস রেঁধে খাইয়েছিলাম। অতীত স্মৃতির কাতরতা সামলে বলে, আসলে, যে সময় থেকে স্বামীরা বউকে শুধু বিছানাতেই নয়, রান্নাঘরেও দেখতে চায়, সেই সময়ের কেনা আর কি।
অধোবদন রাজু অনুর একটা দীর্ঘশ্বাস পড়তে শুনল। হাতটি বাড়িয়ে অনুকে ছুঁয়ে বলল, সরি অনু!
উঠে পড়ে দেয়ালে ছবিটা সেট করে রাজু হাত ঝাড়ল। এইভাবে যদি ঝেড়ে ফেলা যেত চোরা ক্ষোভ দ্বন্দ্বের মালিন্য, ধুলোবালির মতোই। তা কী আর হয়! গভীর কারও দুঃখ প্রকাশের সামনে বিমুখতা কী শোভন! জীবন যেখানে সহভাগে মিশেছে। যেজন্য নিজেকে জুড়েছে অনু। তারই পাশাপাশি নিবিড় মিলমিশের এই যে আয়োজন! উন্মুখতা যেখানে একই তৃষ্ণার তাগিদে একাকার! অনু কি তা জানে! নাকি সহজলভ্য দাম্পত্যে তার সেই খেয়াল দরকার পড়ে না! রাজু তার মুখের ভাব লুকোতে ঊধর্বমুখ উত্তর খোঁজে। হাতে তার ঝুলদন্ড।
ছুটির দিন সিল্কির স্নানখাওয়া মার হাতে। কিছুটা পাশ কাটাতে অন্য কাজে ব্যস্ত থাকে সে। কিন্তু মায়ের গল্পবিহীন ধমকভরা ভাতে সিল্কির গরজ নেই। শুরু হয়েছে ড্যাডির বায়না। এদিকে আলমারির পিছনে মস্ত এক মারড়সা রাজুর নজরবন্দি, ঝুলকাঠিতে জাল সমেত টেনে আনতে যাবে, অনু তার হাত থাবড়ে বলল, ওসব ছাড়ো তো এখন! আগে তোমার মেয়ে সামলাও…।
…সপ্তাহ শেষের দুপুরটা আজ অনুর পাশে গড়ানো গেল না। কাজের মেয়ে টুলু এসে গেল বিকেলের কাজ দুপুরে চুকোতে। রাজু ঠায় চেয়ারে তার পাহারাদার, যতক্ষণ না সে কাজ সেরে বেরিয়ে যাচ্ছে। ফলত ভাতঘুম-ছুট মাথাটার দখল নিল এমন কিছু চিন্তা, যা তার দিনগত আচরণে মিলবে না। অলস মস্তিষ্কের ধর্ম! হবে বা। রাজুর তো মনে হয় শর্তমাফিক রাজুতেই আছে সে। কালি মিশেল হু হু ধুম্র তবে কেন। কোন রন্ধ্র দিয়ে মাথায় ঢুকে তছনছ করে দেয় নিভৃত কুলুঙ্গিটি! যা হয়তো সময়ের অপেক্ষায় তুমুল হতে পারত– কিন্তু রাজুর সতর্কতায় তা হয়নি।
ল্যান্ডফোন বাজল…। কেটেও গেল। উঠতে গিয়ে ওঠা হল না। সদ্য কুকার খোয়া গেছে। ভাবল সে, টুলু গেলে দরজা বন্ধ করল কী! ঘুম থেকে উঠে এই নিয়েই হয়তো ধুন্ধুমার হবে অনু। যাকে যা মানায়। ওর লাইফ স্টাইলে এটাই স্বাভাবিক। শান্তনুর মৃত্যুবাবদ চাকরিটি ওর বেঁচে থাকা কায়েম করেছে। দ্রুত বৈধব্য ঘুচিয়ে রসে বসে রেখেছে আর একটি পুরুষ। রীতিমতো রেজিস্টার্ড স্বামী রাজেন্দ্র দাস। দাসানুদাস। দাসত্ব এমন যে, ছাড়তে হয়েছে রক্তবন্ধনও। মা ভাইয়ের ফোন এলে রাজু ফাঁপরে পড়ে যায়। অনুর ভ্রূ এলোমেলো হয়। মুখ তৗল করে বলে, কে এত ফোন করে বলো তো! তোমার কী ঘরসংসার বউবাচ্চা নেই? কথা বাড়বার আগেই ফোন কেটে দেয় সে।
সময়ের দখলদারিতে অনুর অধিকার, কি আদ্যন্ত নির্ভরশীল এক যুবকের এই অবনমন, রাজুর অস্বাভাবিক মনে হয় না। ক্ষুণ্ণতা তার অন্য জায়গায়। একটি পূর্ণবয়স্ক পুরুষশরীরে অদম্য হয়ে ওঠে যে প্রদানক্ষমতা, যার তাড়না একসময় তাকে প্রজন্মকামী করে তুলতেই পারে– এখানে তা নস্যাৎ করেছে অনু সিল্কিকে একক মনস্থ রেখে। রাজু সিল্কির ড্যাডি। বিনা বিস্তারে রাজুর বংশ? তা হলে…।
এই সময় সেই চারাগাছটির কথা মনে পড়ে রাজুর। কোনও একসময় সবজি চালানের ব্যাবসায় নেমেছিল যখন, মহিষবাথান থেকে জোগান আনতে বাসস্ট্যান্ডে নেমে মেঠোপথে খানিক হাঁটতে হতো খেতের দিকে। রাস্তার পাশে বুনো ঝোপঝাড়ে মিশে থাকা একটি ছোট্ট গাছ, যাকে সে জলধারায় ভিজিয়ে তখন প্যান্টের বোতাম আঁটছে, চকিত চেনায় মাথাজোড়াহীন সেই চারাগাছের দশা দেখে কে বলবে সেটি লংকাগাছ। বিশেষ ঝাঁজ ঝাল যার প্রকৃতিগত। কিন্তু ঘন সন্নিবেশিত কাঁটা ঝোপ তাকে বাড়বার পরিসর দেয়নি। বস্তুত অঙ্গ থেকেও অঙ্গহানি যার, মরণ কি শুধু মরণেই! মাথা নাড়ায় রাজু। পিছনের উত্তপ্ত দিনগুলোর কথা ভেঙে হৃৎপিণ্ড উত্তাল হয়ে ওঠে।
লোডশেডিং। সিল্কি কান্না জুড়েছে।
– একটা পাখা দাও তো…।
গ্রিল বারান্দা থেকে রাস্তার চলাচল দেখছে রাজু। হেলদোল নেই। সদ্য তৈরি ঝকঝকে রাস্তায় আড়াআড়ি একটা বেড়াল পেরোল। কিন্তু কালো নয়। তবু ব্রেক কষে থেমে পড়েছে হাই স্পিডের স্করপিওটি। নিজের মনেই হেসে ফেলল রাজু। …হায় জীবন…।
– কি গো একটা পাখা চাইছি যে…।
অনুর মেজাজ চড়ছে। কটু কথায় তিক্ত হচ্ছে রাজুরও জিভ, চাপা স্বরে বিড়বিড় করল, –দিচ্ছি রে বাবা দিচ্চি… আচ্ছা বে-শরম মেয়েছেল বটে, উঠে পাখাটাও আনতে পারে না! পাখা হাতড়ায় রাজু। কিন্তু কোথায় পাখা! কারেন্ট এলেই যার প্রয়োজন শেষ। খাদানের কুলির মতো খেটে খেটে আর ফুসফুস নিঙড়ে এদের হাওয়া দিয়ে রাজু হবে ডাঙার মাছ। খাবি খাবে।
এইভাবেই অভ্যস্ত আপোসনামা ছিঁড়ে মানুষেরও কখনও কখনও এনার্জিক কারেন্ট চলে যায়। ঘনঘোর অন্ধবোধ বড়ো দুর্বহ তখন, ঠিক এই মুহূর্তটির মতো।
আবার ল্যান্ডফোন…। বাজছে তো বাজছেই।
অনুর তিরিক্ষি নির্দেশ আসবার আগেই দৌড়োল রাজু, – হ্যা..লো..ও..। মুহূর্তেই তার স্বর নেমে এল একপরত – ধরুন, ম্যাডামকে দিচ্ছি…।
খাটের পাশে এসে দাঁড়াল সে প্রকৃত নফরের মতো, বলল, তোমার ফোন। গলার খন্দে আটকে থাকল বাকি কথা।
– কার? অনু চোখ কুঁচকে মাথা তুলেছে।
– ব্যাংকলোনের। চোখ সরিয়ে মাথা নামাল রাজু। রাজুর বিগত ধারদেনার জন্য ব্যাংকলোন নেওয়া আছে অনুর। কিন্তু সিল্কির এককালীন স্ল্যাডমিশন ফি জোগাতে আপাতত সেটা বাদ পড়েছে দু-মাস। অনুর এই অপারগতায় তার যথেষ্ট দুঃখবোধ হলেও, এখান থেকেই যে সুরক্ষাটি তাকে বর্তমান অবস্থানে এনেছে, সেই স্বস্তিসুখও এড়াতে পারে না। একের দায় অন্যে বহন করার মূল রসায়ন সম্বন্ধে আর একটু সচেতন হল কী সে! হয়তো বা। বিছানায় অনুর অনিচ্ছ উঠে বসা দেখতে দেখতে কেনই বা ভেসে উঠবে সেই রসায়নের ছবি। রাজুর পায়ে হোঁচট খেয়ে কবে একদিন পা ছুঁয়ে হাতটি মাথায় ঠেকিয়েছিল অনু। কাছে টানতেই মনোরম হয়ে উঠেছিল সেই সমর্পণ। রাজু বলেছিল, আরে, আরে, প্রণাম কেন। এসব আর চলে না অনু। উচ্ছ্বসিত হয়ে অনু বলেছিল, সময়টা দু’হাজার প্লাস বলেই তুমি এটা বলতে পারলে রাজু। আমাদের দিদিমণি বলতেন, রামায়ণের যুগে মেয়েদের তো পুরুষমানুষের নীচে রাখতে ঊনমানুষ বলা হতো।
দু’জনেই হেসেছিল খুব। সময়মতো সুখস্মৃতির উদ্ভাস যেন বিবেকের পালাগানের মতো সচেতন করে রাজুকে।
অন্তরঙ্গ এমন ঘেরাটোপের পিছনেই তার হিম স্থির এক অতীত, সে জানে। কত যে খণ্ডদৃশ্য। ফিরে ফিরে আসে জিতু রতন গিরিধারীরা…। ঘনশ্যাম দল পালটালেও মদের ঠেক ওকে ছাড়তে হয়েছিল পাবলিকের মারের চোটে। রতন ওয়াগন ব্রেকিং-এ পুলিশের তাড়া খেয়ে ট্রেনে কাটা পড়ল। পড়ে থাকল লাইনের ধারে। খবরটা রাজুকেই দিতে হয়েছিল ওর মাকে।
আর ছিল গিরিধারী। জ্যাংরা এলাকায় নির্মিয়মান ফ্ল্যাটে বিশিষ্ট একজনের জন্য মধুচক্রের ব্যবস্থা করে দিতে গিয়ে, মূল মেহমান ও অন্যান্যরা সটকালেও ধরা পড়ল শুধু গিরিধারী। পুলিশের মারে সে কী ফালাফালা পিঠ। রাজু গা-ঢাকা দিতে পেরেছিল– ক’দিন মাসির বাড়ি বাগনান পালিয়ে।
…সেইসব সহযাত্রীরা …দিকশূন্য বাজপাখিগুলি…। তাদের মুখ থুবড়ে পড়া থেঁতো রক্তাক্ত মুখ, রাতের ঘুম কেড়ে নেয় রাজুর আজও। অস্থির উত্তাল সেই দুর্বহ বোধই কী স্তিমিত হয়ে ফিরিয়ে আনে তাকে আপাত অবস্থানে! তাই যদি, তাহলে খেদ অসন্তোষের দিকগুলি বাদ দিয়ে বাকিটা রাজুর কেমন? কতটা ভাল?
না, প্রাপ্তির তলদেশ ঘাঁটতে আর ইচ্ছা হয় না। বরঞ্চ ভেবে নেওয়া যাক জল বাদ দিয়ে দুধ যেমন একা উথলোয় না, সংসারে দুঃখ সুখের অবস্থানও অনেকটা সেইরকম…। এটাই বোধহয় নিয়ম।
এরপর তার দীর্ঘসময়ের গুমোট নিশ্বাস মোচন, আর পরবর্তী সুখটানের মতো টেনে নেওয়া তাজা বাতাস, দু’টোই তাকে এমন আশ্চর্য সহায়তা দেয় যে, হঠাৎ খেয়াল হয় হাতপাখাটা খুঁজে পেয়ে হাতে নিয়েই তো দাঁড়িয়ে আছে সে। অনু খাট থেকে নামতেই ছিট্কে পড়া তার চপ্পলজোড়া পা দিয়ে টেনে এগিয়ে দেয় অনুর পায়ের নীচে। অবিন্যস্ত নাইটি সামলে, পায়ে চটি গলিয়ে উদভ্রান্তের মতো ফোন ধরতে যাচ্ছে অনু। অপলক রাজু সেই মুখ দেখতে দেখতে সিল্কিকে বাতাস দেয়। ভেবে রাখে, অনু এলে তাকেও দেবে…।