শারদোৎসবের গন্ধ তখনও মিলিয়ে যায়নি। সেই সময়ে আমাদের, রাবণ রাজার দেশ ভ্রমণের সুযোগ ঘটল। যাতায়াত, থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থাপনার ভার দেওয়া হয়েছে কলকাতারই এক নামি ভ্রমণসংস্থার ওপর। মিহিন লংকা এয়ার বাস ইন্ডাস্ট্রির সরাসরি উড়ান রয়েছে কলকাতা থেকে কলম্বো। তবে যাত্রা শুরু গভীর রাতে– রাত দুটো। কলম্বো পৌঁছোতে লাগবে তিন ঘণ্টার কিছু বেশি।

রাত বারোটার মধ্যে পৌঁছে গেছি কলকাতা বিমানবন্দরে। আমাদের দলে রয়েছে পাঁচজন। বিমানবন্দরের আনুষঙ্গিক কাজকর্ম সেরে বিমানে আরোহণ। ঠিক সময়েই বিমান ছাড়ল, বিমানসেবিকা সামান্য কিছু খাবারও পরিবেশন করল। তারপর বসে বসেই কিছুক্ষণের জন্যে ঘুমের দেশে চলে গেলাম।

রাতের অন্ধকার চিরে সাগর পেরিয়ে কলম্বোর বন্দরনায়েকে বিমানবন্দরে পৌঁছোলাম ঠিক ভোর পাঁচটায়। মালপত্র নিয়ে বেরোতে আরও ঘণ্টাখানেক। তারপর ভ্রমণসংস্থা নিয়োজিত গাইডের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করা গেল। শুধু গাইড নয়– ড্রাইভার কাম গাইড, নাম হেমন্ত একেবারে গাড়ি নিয়ে হাজির। প্যাকেজটুরে বুকিং করলেও স্বাধীনভাবে ঘোরাফেরার জন্য আমরা আলাদা গাড়ির বুকিং করেছি। এয়ারপোর্ট থেকে বেরোনোর আগে মানি এক্সচেঞ্জ কাউন্টার থেকে টাকা ভাঙিয়ে নিলাম। একশো মার্কিন ডলারের বিনিময়ে চোদ্দো হাজারেরও বেশি শ্রীলংকার রুপি।

কলম্বোর রাস্তাঘাট বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, খানা-খন্দ গর্ত একেবারে নেই। গাড়িতে যেতে যেতেই হেমন্তর কাছে শুনে নিয়েছি ‘কলম্বো’ শব্দের অর্থ। প্রচলিত অর্থ বন্দর তবে আর একটা অর্থও আছে। সিংহলি ভাষায় কোলাম্বা মানে আমগাছের পাতা। আর তার থেকে কলম্বো।

ঘণ্টাখানেকের মধ্যে পৌঁছে গেলাম আমাদের জন্য নির্ধারিত হোটেল পার্ল গ্র্যান্ড হোটেল। অবশ্য তার আগে পথে একটা রেস্তোরাঁয় আমরা ব্রেকফাস্ট সেরে নিয়েছি।

শ্রীলংকাতেও পাবলিক প্লেসে ধূমপান নিষিদ্ধ। তবে রাস্তায় কি কেউ ধূমপান করছে না? করছে তবে একটু আড়াল আবডালে। সেরকমই একটু আড়ালে ধূমপান পর্বটা মিটিয়ে নিলাম। স্টার ক্যাটেগরি হোটেল এই পার্ল গ্র্যান্ড। আমাদের স্থান হল চারতলা আর পাঁচতলায়। প্রত্যেক ঘরের ব্যক্তিগত বারান্দা থেকে ভারত মহাসাগরের এক ঝলক দেখা যায়। আর এক দিকে কলম্বোর রাস্তাঘাট, বাড়িঘর, হোটেল পাখির চোখে দেখা যায়। স্নানপর্ব শেষ করে ঘরেই রাখা সরঞ্জাম দিয়ে এক কাপ কফি বানিয়ে খেয়ে নিলাম। লিফটে করে নীচে নেমে এসে দেখি সবাই হাজির, হেমন্ত গাড়ি নিয়ে প্রস্তুত। একটি ভারতীয় রেস্তোরাঁয় পরোটা-চিকেন মশালা খেয়ে নেমে পড়লাম কলম্বোর সাইটসিইংএ।

কলম্বোতে ঘোরাঘুরি শুরু করার আগে তার ইতিহাস একটু জেনে রাখা ভালো। পঞ্চম শতাব্দী থেকে এশিয়া ও পশ্চিম দেশগুলির জলপথে ব্যাবসায় সিংহল ছিল এক গুরুত্বপূর্ণ বন্দর। অষ্টম শতাব্দীর গোড়ায় আরব ব্যবসায়ীরা বন্দরের কাছাকাছি বসতি স্থাপন করে প্রাধান্য বিস্তার করতে শুরু করল। পর্তুগিজদের আবির্ভাব সপ্তদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে এলাকার কর্তৃত্ব চলে আসে ওলন্দাজদের হাতে। তারা এখানে দারুচিনি চাষে নিয়োজিত করে স্থানীয় মানুষদের। তবে এলাকাটি শহর হিসাবে পরিগণিত হতে শুরু হয় ব্রিটিশদের আগমনের পর থেকে।

বেশ কয়েক বছর ধরে চলে অশান্তির রাজনীতি। সিংহলের নতুন নাম হয় শ্রীলংকা তবে এই শ্রী শব্দটি থেকেই শুরু অশান্তির। অতীতে সিংহল চারটি সাম্রাজ্যে বিভক্ত ছিল। দশম খ্রিস্টাব্দে রাজা পরাক্রমবাহু চারটি সাম্রাজ্যকে একত্রিত করে অখণ্ড রাষ্ট্রে পরিণত করেন– নাম হয় সিংহল। সিং অর্থে দেশ আর হাল অর্থে চার। ‘শ্রী’ একটি সিংহলী শব্দ যার অর্থ সম্পদ, সৌন্দর্য, সাফল্য।

সংখ্যালঘু তামিলরা এতে ক্ষুব্ধ হল, বঞ্চিত বোধ করল আর শুরু করল প্রতিবাদ। প্রতিকারের দাবিতে প্রভাকরণের নেতৃত্বে লিবারেশন টাইগার অফ তামিল এলাম অর্থাৎ এলটিটিই গঠিত হল ১জ্ঝজ্জ৩ সালে। তারপরে হিংসার রাজনীতির কথা তো সবাই জানে। তবে শ্রীলংকা আজ শান্ত, বিদেশি পর্যটকরা নির্ভয়ে ঘোরাঘুরি করতে পারছে।

আমাদের টয়োটা গাড়ি চলছে কলম্বোর তকতকে রাস্তা গল রোড ধরে। এখানে ছোটো গাড়ি সবই বিদেশি প্রধানত জাপান, কোরিয়া, জার্মানি, আমেরিকায় তৈরি। তবে বাস ট্রাক লরি ইত্যাদি বড়ো গাড়ি সবই ভারত থেকে আমদানি। অটোও চলছে প্রচুর তার রংও নানা রকমের– লাল, হলুদ, সবুজ, নীল। হেমন্ত জানাল লাল রঙের অটোর ভাড়া সব থেকে বেশি আর নীল সব থেকে সস্তা। এর কারণ অবশ্য তার কথায় বিশেষ পরিষ্কার হল না।

কলম্বোর ফোর্ট এলাকা শহরের সবচেয়ে ঐতিহ্যশালী এলাকা হিসাবে চিহ্নিত। ইউরোপীয় রাজত্বকালে ফোর্ট অঞ্চলে সত্যিই দুর্গ ছিল, তার দুদিকে সমুদ্র আর ডাঙার দিক ঘিরে পরিখা। বর্তমানে এই অঞ্চল কলম্বোর সমৃদ্ধির কেন্দ্রবিন্দু যেখানে প্রাচীন ঐতিহ্যশালী ইউরোপীয় প্রাসাদ সদৃশ অট্টালিকা নতুন করে মেরামত করে সাজানো হয়েছে তার সঙ্গে রয়েছে ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের মতো নব্য স্থাপত্য। গাড়ি প্রথম থামল সমুদ্রের তীরে গলফেস গ্রিনে।

TRAVEL
Beautiful location

সমুদ্রের তীরে ৫ হেক্টর জুড়ে বিস্তীর্ণ এক সবুজ মাঠ। হেমন্ত জানাল আগে এই জায়গা গল্ফ খেলা ও ঘোড়ার প্রতিযোগিতার জন্য ব্যবহূত হতো এখন ক্রিকেট, ফুটবল, টেনিস, রাগবি, পোলো সব কিছুর জন্য ব্যবহূত হয়। শুধু খেলা নয় সাধারণ মানুষের অবসর বিনোদনের জন্য এই পার্কের খ্যাতি। পারিবারিক পিকনিক বা যুগলের নিভৃত আলাপের জন্য এই স্থানটি যেন আদর্শ– জলের উচ্ছ্বাস দেখতে দেখতে কেটে যায় অনেকটা সময়।

সমুদ্রের তীরে হু হু করে হাওয়া বইছে সেই হাওয়ায় ভেসে বেড়াচ্ছে রং বেরঙের নানা আকৃতির ঘুড়ি। ঘুড়ি নিয়ে বিক্রেতারাও হাজির এই পার্কে। খাবারের স্টলও রয়েছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। সমুদ্রের ধারে বাঁধানো পাড় থেকে বাচ্চা ছেলেরা ঝাঁপিয়ে পড়ছে জলে– সমুদ্রের ঢেউ-এর তালে তালে। রাস্তার ওপারেই তাজ সমুদ্র হোটেল। তাও এক দর্শনীয় স্থাপত্য। হেমন্ত জানাল সপ্তাহান্তে বা ছুটির দিনে এখানে এলে মনে হবে একেবারে পিকনিক স্পট। তখন গাড়ি পার্ক করার জায়গাও পাওয়া যায় না।

গাড়ি আবার চলতে শুরু করল। চ্যাথাম স্ট্রিট ও কুইন স্ট্রিটের (জনধিপতি মওয়া) সংযোগস্থলে ক্লক টাওয়ার। আগে লাইটহাউস হিসাবে ব্যবহূত হতো। গাড়িতে চলতে চলতে দেখা হল পুরোনো পার্লামেন্ট, সেন্ট্রাল ব্যাংক বিল্ডিং, লয়েডস বিল্ডিং অ্যান্ড ওরিয়েন্টাল হোটেল– এগুলি সব ইউরোপীয় আমলের অট্টালিকা যা পরবর্তী সময়ে মেরামত করে অপরূপ স্থাপত্যকলায় হেরিটেজ বিল্ডিং হিসাবে ভূষিত হয়েছে।

শ্রীলংকায় বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, মুসলিম, হিন্দু সব ধর্মের মানুষের সহাবস্থান। তাই হেমন্তকে অনুরোধ করি কলম্বো বা তার আশেপাশে এই সব ধর্মের উপাসনা স্থল অন্তত একটি করে আমাদের দেখিয়ে দেওয়ার জন্য। প্রথমে সেন্ট অ্যান্টোনিস চার্চ। বাইরে থেকে একটি সাধারণ পর্তুগিজ ক্যাথলিক চার্চের মতো দেখতে যদিও অন্দরের ব্যবস্থাপনায় ইউরোপীয় রীতির তুলনায় এই উপমহাদেশীয় ধাঁচই বেশি। সামনেই সেন্ট অ্যান্টনির মূর্তি। এই চার্চ নাকি খুবই জাগ্রত– নানা ধর্মের মানুষ, তাদের আশা আকাঙক্ষা নিবেদন করতে এই চার্চে উপস্থিত হন, তাদের প্রার্থনা পূরণও হয়েছে বলে শোনা যায়।

শ্রীলংকার সবচেয়ে বড়ো চার্চ হল সেন্ট লুসিয়া ক্যাথিড্রাল। এই ক্যাথলিক উপাসনালয়টি অবশ্য আমাদের দেখা সম্ভব হয়নি।

যে বৌদ্ধ মন্দির কলম্বো সফরকারীর তালিকায় সবসময় স্থান পায় তা হল গঙ্গারামায়া বৌদ্ধমন্দির। শহরের মধ্যেই একশো বছরের প্রাচীন এই বৌদ্ধমন্দির। এই বৌদ্ধমন্দিরে প্রাচীন স্থাপত্যরীতির মিল খুঁজে পাওয়া ভার। আধুনিক রীতিতে নির্মিত এই মন্দিরে শ্রীলংকার স্থাপত্য রীতির সঙ্গে চিন, থাইল্যান্ড, বর্মা ও অন্যান্য বিভিন্ন দেশের স্থাপত্য রীতির মিশ্রণ হয়েছে। প্রবেশমূল্যও কম নয়, শ্রীলংকা টাকায় ৩০০ রুপি। এই মন্দির পরিচালনা করেন বৌদ্ধভিক্ষুরাই। এই মন্দিরে অন্তর্গত রয়েছে লাইব্রেরি। মিউজিয়াম আর অসাধারণ কিছু দামি পাথর ও সোনা-রুপার তৈরি উপহার সামগ্রী– যা উপহার দিয়েছেন নানা দেশের ভক্তবৃন্দ ও শুভানুধ্যায়ীরা। নবম পোয়াতে (পূর্ণিমায়) ফেব্রুয়ারি মাসে এখানে উৎসব হয়। বিশাল ঐতিহ্যমণ্ডিত বর্ণময় মিছিলের পথেই পড়ে এই বৌদ্ধমন্দির।

Travelogue
Beautiful location of Srilanka

হেমন্ত দেখিয়ে দিল পুরোনো ডাচ হসপিটাল। নামেই হাসপাতাল– অসাধারণ কারুকার্যময় অট্টালিকা যা ইদানীং কালে পরিমার্জন করা হয়েছে। অট্টালিকার নীচের তলায় দোকান কাফে রেস্তোরাঁর রঙিন হাতছানি। আমাদের তালিকায় আর এক বৌদ্ধমন্দির আছে– কেলানিয়া রাজা মহাবিহার। তবে তা কলম্বো শহর থেকে প্রায় ১২ কিমি দূরে। কেলানিয়া বিহার দর্শন পরের দিনের সূচীতে রেখে আমরা পরবর্তী গন্তব্যের দিকে এগিয়ে চলি। হেমন্ত এবার একটি মসজিদের কাছে গাড়ি দাঁড় করাল। আর সঙ্গে সঙ্গেই তাড়া লাগাল, তাড়াতাড়ি দেখে নিন। বাইরে থেকে ছবি তুলেই মসজিদ দেখা শেষ হল। তবে মসজিদটির অপূর্ব স্থাপত্যরীতি মনে দাগ কাটে।

কলম্বোর টাউন হল এক ঐতিহাসিক স্থাপত্য। টাউন হলের মোটা মোটা থামের সারি যেন পুরোনো কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বা কলকাতার জিপিও-কে মনে করিয়ে দেয়। বাইরে সবুজ লন তবে ভিতরে একটি দিকে কোনও সরকারি অফিস বসেছে আর অন্যদিক বন্ধ। তবে বাইরে থেকে টাউন হল ঘুরে দেখতেও মন্দ লাগে না। দুধসাদা এই স্থাপত্যের আর এক নাম হোয়াইট হাউস। টাউন হলের ঠিক বিপরীতে রাস্তার ওপারেই বিহারামহাদেবী পার্ক। কলম্বোর সব থেকে বড়ো পার্ক এটাই।

এই পার্কের নাম ছিল রানী ভিক্টোরিয়ার নামানুসারে– ভিক্টোরিয়া পার্ক। বর্তমানে রানি বিহারাম দেবীর (রাজা দুষ্টুগেমুনু) নামে পার্কটির নামকরণ হয়েছে। পার্কের মধ্যে দিয়ে অনেকগুলি আঁকাবাঁকা রাস্তা চলে গেছে কখনও সবুজ লনের মধ্যে দিয়ে বা কখনও ফুলের বাগানের মধ্যে দিয়ে। রয়েছে বেশ কয়েকটা ফোয়ারা, একটি সুন্দর বুদ্ধমূর্তি। ছোটোদের খেলার ব্যবস্থাও রয়েছে কলম্বোর এই বৃহত্তম পার্কে। বড়ো বড়ো গাছ তাদের ডালপালা ছড়িয়ে পাতার বিস্তারে প্রকৃতির হিল্লোলে জড়িয়ে রেখেছে এই উদ্যানটিকে। শহরের কেন্দ্রস্থলে প্রায় অফিসপাড়ার মধ্যে প্রকৃতি তার সঙ্গ থেকে বঞ্চিত করেনি শহরবাসীকে। বেইরা লেকের তীর ধরে হাঁটতে হাঁটতে চোখে পড়ল জোড়ায় জোড়ায় প্যাডেল বোট নিয়ে জলবিহার। হাঁসের দলও জলে ঘুরে বেড়াচ্ছে। যেন হাঁস আর নৗকাগুলি একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী।

গাড়ি এবার ঢুকল এক বিশাল গেট পেরিয়ে এক পাঁচিল ঘেরা চত্বরে। গাড়ি থেকে নেমে আমরা পৌঁছে গেলাম এক সুন্দর ফোয়ারার সামনে। ফোয়ারার তলায় জলের পুল সৃষ্টি হয়েছে, সেখানে বড়ো বড়ো মাছ খেলা করছে। কোনও খাবার ফেললেই উপরে ভেসে ওঠে। তবে এখানে ফোয়ারাই প্রধান দ্রষ্টব্য নয়, পিছনে রয়েছে এক অপূর্ব আধুনিক নির্মাণ স্থাপত্য– বন্দরনায়েকে কনফারেন্স সেন্টার। সরকারি, বেসরকারি স্তরে নানা বড়ো বড়ো কনফারেন্স, মিটিং, সেমিনার এখানে অনুষ্ঠিত হয়। তবে অনেকেই গাড়ি নিয়ে এটিকে বৈকালিক সান্ধ্য ভ্রমণের স্থান হিসাবে বেছে নিয়েছেন। বেশ কয়েকটা ছবি তোলাও হল এখানে।

আবার পথে বেরিয়ে গাড়ি থেকে দেখা গেল এক ফোটা ফুলের আকৃতির স্থাপত্য (পদ্ম) ‘নেতুম পাকুনা’ কনফারেন্স হল। এটির আর ছবি তোলার সুযোগ হল না। সূর্য পাটে নামছে, কলম্বোয় সন্ধ্যা নামছে। আমরা এসে পড়েছি আজকের শেষ দ্রষ্টব্য ইন্ডিপেন্ডেন্স্ মেমোরিয়াল হলে। এটি কলম্বোর ইন্ডিপেন্ডেন্ট স্কোয়ারে অবস্থিত। সান্ধ্য ভ্রমণের আর একটি নিরিবিলি স্থান। এখানে একটি মিউজিয়ামও আছে। সেখানে প্রদর্শিত হয়েছে ব্রিটিশ শাসনকালে স্বাধীনতা বিপ্লবীদের স্মৃতি। এমনকী তার পরবর্তীকালে আতঙ্কবাদীদের সঙ্গে যুদ্ধে যেসব মানুষ জীবন উৎসর্গ করেছেন, তাদেরও স্মরণ করা হয়েছে।

ইন্ডিপেন্ডন্ট স্কোয়ার থেকে বেরিয়ে আসার সময় দেখি নানা চিত্রে চিত্রিত হুড খোলা এক লাল রঙের ডবল ডেকার বাস। দেখেই স্মৃতিতে হাতছানি দেয় কলকাতার লালরঙের বাঘমার্কা ডবল ডেকার যা অধুনা বিলুপ্ত। শ্রীলংকার পর্যটন দফতর এই হুড খোলা ডবল ডেকার বাসে পর্যটকদের নিয়ে কলম্বোর সাইট-সিইং-এর (সিটি টুর) ব্যবস্থা করেন। ইন্ডিপেন্ডেন্ট স্কোয়ারে সেই সাইট-সিইং-এর শেষপর্ব চলছে।

হেমন্তর গাড়ি এখন হোটেলের পথে ফিরছে। তাকে মনে করিয়ে দিই– আমরা কিন্তু কোনও হিন্দু মন্দির এখনও দেখতে পাইনি তাছাড়া কেলানিয়া মহাবিহারও অদেখা রয়ে গেল। হেমন্ত কথা দেয় পরদিন সকালেই এগুলি দেখে তবেই অনুরাধাপুরের দিকে যাত্রা করবে। এরপর আমরা কলম্বোর বিখ্যাত ম্যাজেস্টিক মল একটু ঘুরে ফিরে দেখলাম। সেরকম আহামরি কিছুই মনে হল না। কেনাকাটা খুব একটা কিছু হল না। তবে পরবর্তী সময়ে শ্রীলংকার বিখ্যাত দামি পাথর আর চা-পাতা আমরা কিনেছিলাম।

ফিরে আসি পার্লগ্র্যান্ড হোটেলে। এইহোটেলে সব ব্যবস্থাই উত্তম। গরম জলে স্নান করে ফ্রেশ হয়ে রাত ৯টা নাগাদ আমরা ডাইনিং হলে এলাম। একটা গানের হালকা সুর বাজছে। ডিনার প্যাকেজের অর্ন্তভুক্ত। ডাইনিং হলে বসতেই সকলকে স্যুপ পরিবেশন করল। তারপর সবাইকে আলাদা ভাবে খাবারের পছন্দ জিজ্ঞাসা করল– কন্টিনেন্টাল, চাইনিজ, মোগলাই…। আমি একাই কন্টিনেন্টাল পছন্দ করলাম বাকিরা সবাই মোগলাই। খাবারের স্বাদ খুবই ভালো, পরিমাণ এতটাই বেশি যে দুজন খেয়েও শেষ করতে পারা যাবে না। সার্ভিসও বেশ তাড়াতাড়ি। ডিনার শেষ করেই যে যার ঘরে, আমরা আজ সত্যিই খুব ক্লান্ত। বিছানায় শোয়া মাত্রই ঘুমের দেশে চলে গেলাম।

পরের দিন সকালে কলম্বোকে বিদায় জানিয়ে মালপত্র নিয়ে সকাল সকাল ব্রেকফাস্ট সেরে বেরিয়ে পড়লাম। প্রথমে কেলানিয়া বৗদ্ধমহাবিহার। শহর থেকে প্রায় ১২ কিমি দূরে। ঐতিহ্যমণ্ডিত এই প্রাচীন বিহারটি প্রায় আড়াই হাজার বছরের প্রাচীন বলে দাবি করা হয়। বৌদ্ধস্তুপ ও মন্দির একই সঙ্গে রয়েছে এই চত্বরে। স্থাপত্যও অসাধারণ। মন্দিরের অন্দরে অপূর্ব কারুকার্য ও মূর্তি। তার মধ্যে শায়িত বুদ্ধের এক বিশাল মূর্তিও এক কথায় অনবদ্য। দেয়াল জুড়ে অসংখ্য পেন্টিং। বৌদ্ধ জাতকের গল্প অনুযায়ী এই সব চিত্রাবলি। চত্বরে রয়েছে এক বিশাল বৌধবৃক্ষ। তার নীচে বসে ভক্তরা প্রার্থনা করেন।

প্রধান ফটকের কাছে চেনে বাঁধা একটি বিশাল হাতি শুঁড় তুলে দর্শকদের সেলাম জানাচ্ছে। কথিত আছে গৌতম বুদ্ধ তৃতীয়বার সিংহলে যখন আসেন তখন এই মন্দিরে পদার্পণ করেছিলেন। এর পর কয়েকবার শত্রুর দ্বারা মন্দিরটি আক্রান্ত হলেও তা পুননির্মাণ করা হয়। প্রথমে ভারতীয় আক্রমণকারীরা মন্দিরটি ক্ষতিগ্রস্ত করে। আবার পুনর্নির্মাণের পরে ষোড়শ শতকে পর্তুগিজদের হাতে বিধবস্ত হয়। তবে অষ্টাদশ শতকে ওলন্দাজরা তা সারিয়ে দেয় স্থানীয় মানুষদের খুশি করে সুসম্পর্ক স্থাপনের জন্য।

প্রতি জানুয়ারি মাসে এখানে উৎসব হয়। হেমন্তর কাছে এই উৎসবের বিবরণ শুনতে থাকি। শ্রীলংকায় পূর্ণিমা, পোয়া নামে পরিচিত। সারাবছর প্রতিটি পোয়া বৌদ্ধদের ছুটির দিন। সেইদিনে তারা সাদা পোশাকে প্রার্থনা, উপাসনা করতে পবিত্র বৌদ্ধমন্দিরগুলিতে যায়। ডুরুমু পোয়া বৌদ্ধদের ক্যালেন্ডার অনুযায়ী প্রথম পোয়া– যা এই দেশে বুদ্ধের প্রথম পদার্পণ সূচিত করে। কেলানিয়া মন্দিরে এই উপলক্ষে ‘পেরাহেরা’ অর্থাৎ মিছিল করে উদ্যাপন করা হয়। মিছিল জুড়ে থাকে স্থানীয় পোশাকে সজ্জিত নৃত্যকুশলীরা, নাচতে নাচতে ড্রাম বাজাতে বাজাতে তারা মিছিলের পুরোভাগে থাকে। একদল পটকা ও আতসবাজি ফাটাতে ফাটাতে চলে আর এক দল নানারকম দৈহিক কসরত দেখায়। সবশেষে আর সবচেয়ে আকর্ষণীয় বোধহয় সুসজ্জিত হাতির মিছিল। এই উৎসব সত্যিই এক অপূর্ব দ্রষ্টব্য।

গাড়ি আবার এগিয়ে চলে অনুরাধাপুরার উদ্দেশ্যে। পথে আমাদের হিন্দু মন্দির দর্শন। হেমন্ত তার কথা রেখেছে। মন্দিরটি মুরুগান অর্থাৎ কার্তিকের। তবে মন্দিরটি নবীন। বাইরে কার্তিক, শিব ও হনুমানের মূর্তি। মন্দিরে অনেকেই দর্শন ও পুজো

দিতে আসছে। অন্দরে রয়েছে কার্তিক ছাড়াও গণেশ, শিব, দুর্গা, সরস্বতী, লক্ষ্মী, হনুমানের মূর্তি। তবে মন্দিরের ভেতরে ছবি তোলা নিষেধ।

মন্দির দর্শন শেষে গাড়ি এগিয়ে চলে আমাদের পরবর্তী গন্তব্য অনুরাধাপুরার দিকে।

প্রয়োজনীয় তথ্য

প্যাকেজ টুরে বিদেশ ভ্রমণ করতে চাইলে শুধু পাসপোর্ট থাকলেই চলবে বাকি সব দায়িত্ব পর্যটন সংস্থার।

বিভিন্ন ভ্রমণ সংস্থা শ্রীলংকা সফর করায় ৬ দিন থেকে ১০ দিনের মধ্যে। সেই অনুযায়ী ভ্রমণসূচী ও আর্থিক মূল্যও পরিবর্তিত হয়।

তবে শ্রীলংকা ভ্রমণে কলম্বো দিয়ে ভ্রমণ শুরু করতে হবে কারণ প্রধান বিমানবন্দর এই কলম্বোতেই।

শ্রীলংকা ভ্রমণে ভিসা করার হাঙ্গামা নেই, খরচও নেই পাসপোর্ট থাকলেই হবে।

প্যাকেজ টুরে হোটেল গাড়ি খাওয়াদাওয়া ইত্যাদি বিষয়ে মাথা ঘামাতে হবে না। ভ্রমণ সংস্থাই সব দায়িত্ব নেবে।

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...