ঝিরঝিরে বৃষ্টি ঝাপটা মারছে জিপের উইনডস্ক্রিনে। যতদূর চোখ যায় শুধুই দেবদারু আর পাইনে ছাওয়া পথ, আর খাড়াই পাহাড়। কলকাতা থেকে কাঞ্চনকন্যায় শিলিগুড়ি নেমে, এসএনটি বাসস্ট্যান্ড থেকে সওয়ার হোন জিপে। সেবক রোডের মসৃণ পথ পেরিয়ে মহানন্দার জঙ্গলের সবুজ শ্যামলিমা গায়ে মেখে পৌঁছে যাবেন সিকিমের প্রবেশদ্বার রংপোতে। পথে আর থামা নেই, সোজা জোড়থাং। পাহাড় ঘেরা ছোট্ট জনপদ। গরম মোমো দিয়ে দুপুরের খাওয়া সেরে এগিয়ে চলুন গেজিং-এর দিকে। পথের মাইল স্টোন জানিয়ে দেবে আপনার গন্তব্য পেলিং, খুব দূরে নয়।
কাঞ্চনজঙঘার মাথায় যদি সোনার মুকুট দেখতে চান, তবে পেলিং -এর চেয়ে আদর্শ জায়গা আর হতে পারে না। হোটেলের জানলা খুললেই যেন কাঞ্চনজঙঘা হুড়মুড় করে ঢুকে পড়বে আপনার ঘরে। তাই পরের দিনের সূর্যোদয় দেখুন হেলিপ্যাড গ্রাউন্ড -এ। আর সারাদিনটা রাখুন অপূর্ব কিছু লোকেশন দেখে নিতে।
আপনার প্রথম গন্তব্য হোক খেচিপেরি হ্রদ। পবিত্র হ্রদ, হয়তো সেইজন্যই পাখিরাও সদা সতর্ক, একটি পাতাও ফেলে না হ্রদের জলে। হ্রদের কোলে বিশাল পাহাড় যার ওপারে চিন। খেচিপেরি গুম্ফা ও লেক দেখে চলুন কাঞ্চনজঙঘা জলপ্রপাত দেখতে। সর্পিল পথ পেরোনোর সময় একটু যেন ভয় ভয় করে। রোমাঞ্চকর এই অনুভূতি নিয়েই হঠাৎই এসে পড়বেন এক পাগলা ঝোরার সামনে, যার নাম কাঞ্চনজঙঘা জলপ্রপাত। জলকণায় সাতরঙা রামধনুর খেলা আর নীচ দিয়ে বয়ে চলা অবাধ্য রিম্বিনদী।
আপনার দ্বিতীয় দিনের যাত্রা হোক পেমিয়াংশির উদ্দেশে। সাতহাজার ফুট উচ্চতার এক মনেস্ট্রি। তিব্বতীয় দেবদেবী আর অপূর্ব কাঠের প্যানেলগুলি দেখে এক আশ্চর্য প্রশান্তি নিয়ে চলে আসুন এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম ব্রিজ ‘সিনসোর’ দেখতে। সরু সুতোয় ঝুলতে থাকা ব্রিজটি দেখে বিস্ময়ের ঘোর কাটতে না কাটতেই পাড়ি দিন পাহাড়ের বাঁকে অবস্থিত সিকিমিজ গ্রাম ডেনথাম-এ।
পরদিন পায়ে পায়ে বেড়িয়ে নিন সাঙ্কাডেলিং মনেস্ট্রি। এটির ভিতরের অলংকরণ ও পদ্মসম্ভবের মূর্তি দীর্ঘদিন মনে থাকবে। এবার একটা ছোট্ট ট্রেক রাবডান্টসে -এর উদ্দেশে। সিকিমের প্রাচীন রাজপ্রাসাদের ধবংসাবশেষ। কাঞ্চনজঙঘার কোলে এই উচ্চতম স্থান থেকে পাখির চোখে দেখে নিন সিকিমের একটা বড়ো অংশ।
ধবংসাবশেষ দেখতে একটা অদ্ভুত শিহরণ হয়, রাজপাট গেছে, শুধু স্মৃতি হয়ে রয়ে গেছে রাজার পাথুরে সিংহাসন।
এ যাত্রায় সিকিমের সফর অসম্পূর্ণ থেকে যাবে যদি নিরিবিলি ছোট্ট পাহাড়ি জনপদ রাবাংলা না ঘুরে নেন। পেলিং থেকেই জিপে সওয়ার হয়ে চলে আসুন রাবাংলায়। টেমি চা-বাগানের ঢাল বেয়ে নেমে যাওয়া হরিয়ালি, দূরে সবুজ পাহাড়ের সারি অচিরেই মন কেড়ে নেবে। আর আছে হাতের কাছেই বুদ্ধ পার্ক। মনকাড়া পরিবেশ।
পায়ে জোর থাকলে আর বুক ভরা সাহস থাকলে, ট্রেক করে আসতে পারেন মৈনামের জঙ্গুলে পথ বেয়ে। বন্য জন্তু আর অচেনা গাছে ভরা পথের এই রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা, সারাজীবনের সঞ্চয় হয়ে থাকবে।
কীভাবে যাবেন – শিয়ালদহ থেকে দার্জিলিং মেল, তিস্তা তোর্সা, উত্তরবঙ্গ এক্সপ্রেস, কাঞ্চনকন্যা বা হাওড়া থেকে কামরূপ কিংবা সরাইঘাট এক্সপ্রেসে নিউ জলপাইগুড়ি। সেখান থেকে রিকশায় শিলিগুড়ি। সিকিমের বাসস্ট্যান্ড থেকে বাস বা জিপে সরাসরি পেলিং যেতে পারেন, অথবা নামচি হয়ে পাড়ি দিতে পারেন রাবাংলার উদ্দেশে।
কখন যাবেন – বর্ষাকাল বাদ দিয়ে যে-কোনও সময় যাওয়া যায় সিকিম। তবে এপ্রিলে গেলে রোডোডেনড্রন বা গুরাসের শোভা আপনাকে মুগ্ধ করবে।