উমার একটা বড়ো সমস্যা হল, তার ১০ বছরের ছেলে কনিষ্ক তার কথা শোনে না। অন্যান্য বাচ্চাদের মতো কনিষ্কও খেলাধুলা করতে ভালোবাসে। ঘরে একেবারেই তার মন বসে না, যার কারণে দিনের বেশিরভাগ সময়েই তাকে পাড়ার পার্ক-এ লাফালাফি-ছোটাছুটি করতে দেখা যায়। ঘরে ফিরে হাত না ধুয়ে, সেই নোংরা হাতেই বিস্কুট নয়তো অন্য কিছু খেতে থাকে সে। মায়ের বারবার মানা করা সত্ত্বেও সে শোনে না।
এই সমস্যা শুধুমাত্র উমার নয়, আমাদের আশেপাশে থাকা বেশিরভাগ বাচ্চাই কনিষ্কর মতো। তাদের মায়ের অথবা বাড়ির অন্যদের ‘হাইজিন’ সংক্রান্ত কথা না শুনে, বাড়ির সকলকে চিন্তায় ফেলে দেয়। খেলনা, ভিডিয়ো গেমস থেকে শুরু করে জুতোয় পর্যন্ত জীবাণু থাকে। বাড়িতে হাইজিনিক পরিবেশ তৈরি করার জন্য স্প্রে, অ্যান্টি-ব্যাকটিরিয়াল সাবান, ফিনাইল ইত্যাদি ব্যবহার করুন, যাতে পোকামাকড় মুক্ত হয়। এটাই সঠিক উপায় কিন্তু আপনাদের কি মনে হয় না যে, বাচ্চাকে সুস্থ এবং পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার জন্য হাইজিন সম্পর্কিত সঠিক পথগুলি বাতলে দেওয়া উচিত তাদের।
শিক্ষা জরুরি
যখন আপনার আদরের সোনা ছোটো ছিল, তখন তার ঘামের গন্ধও নাকে বড়ো মিষ্টি লাগত। সে যখন হাতে রুটির টুকরো নিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ত, তখন তার এই হেন আচরণও খুব ভালোলাগতো। গোটা গালে যখন জ্যাম মেখে আপনার সামনে হাজির হতো, তখন আপনি সেটিকে ক্যামেরাবন্দি করে রাখতেন। কিন্তু এখন আপনার আদরের সেই শিশুটি আগের তুলনায় বড়ো হয়েছে, বেড়েছে দুরন্তপনাও। এই রকম দুরন্ত বাচ্চাকে পরিষ্কার করানো ও স্নান করানো মায়েদের কাছে প্রায় যুদ্ধের-ই সমান।
‘হাইজিন’-এর মানে, আপনার বাচ্চাকে পরিষ্কার কাপড়জামায় সুন্দর আর ভালো দেখানোই নয়, রোগ থেকেও দূরে রাখা। স্কুল-এর বাচ্চাদের সঠিক হাইজিন হ্যাবিট তৈরি করা ভীষণ প্রয়োজন কারণ স্কুল যাওয়ার পর ওদের নাক, মুখ এবং হাত থেকে ছড়ায় জীবাণু। যদি শুরুতেই বাচ্চাদের হাইজিন সম্বন্ধে ধারণা দেওয়া যায় তাহলে বাচ্চারা সুস্থ, সবল থাকার চেষ্টাটা অন্তত করতে পারবে।
যখন আপনার বাচ্চা কৈশোরে পা রাখে তখন হরমোনাল কারণে ঘামের গন্ধ তীব্র হয় এবং ত্বক তৈলাক্ত হয়ে পড়ে। এই অবস্থায় হাইজিন মেনটেন করাটা খুব জরুরি।
সুন্দর হাসি
প্রত্যেকদিন বাচ্চাদের ব্রাশ করার অভ্যাস করান। যদি বাচ্চা ছোটো হয়, সেক্ষেত্রে আপনি নিজে দিনে একবার টুথব্রাশ দিয়ে বাচ্চার দাঁত পরিষ্কার করে দিন। ভালো কোম্পানির, মাথা ছোটো এবং নরম ব্রাশ দিয়েই দাঁত পরিষ্কার করা উচিত। তবেই সেটি দাঁতের কোনায় কোনায় পৌঁছে, ক্যাভিটিজ দূর করবে। বাচ্চা যখন আর একটু বড়ো হয়ে যাবে তখন তাকে দাঁতের পাশাপাশি জিভও পরিষ্কার করতে শেখাতে ভুলবেন না। ওদের বলুন, জিভ পরিষ্কার না করলে মুখে গন্ধ হবে, বন্ধুরা কেউ তোমার সঙ্গে মিশবে না। মুখের দুর্গন্ধ তাড়ানোর জন্য বাচ্চাদের কখনও মাউথওয়াশ কিনে দেবেন না। মাউথওয়াশ ব্যবহার করার জন্য নির্দিষ্ট বয়স থাকে, যেটা একজন দন্তচিকিৎসকই সঠিকভাবে বলতে পারেন।
হাত পরিষ্কার রাখা
জীবাণু সবথেকে বেশি ছড়ায় হাত থেকে। এইজন্য ঘরের প্রত্যেক সদস্যের হাত ধোয়ার গুরুত্ব জানা উচিত। কাশি হলে বাচ্চারা মুখে হাত দিয়েই কাশি আটকাবার চেষ্টা করে এবং সেই হাতই বিস্কুটের কৌটোয় ঢোকায়। খাওয়ার আগে এবং পরে, বাইরে থেকে এসে, বাথরুমের কাজ সেরে, পোষ্যদের সঙ্গে খেলার পর এবং নাক পরিষ্কার করার পর হাত ধোয়া বাধ্যতামূলক।
এর মানে এই নয় যে, আপনি আপনার বাচ্চাকে হ্যান্ড স্যানিটাইজার কিনে দেবেন অথবা সবসময় অ্যান্টি-ব্যাকটিরিয়াল সাবান দিয়ে হাত ধুতে বলবেন। সাধারণ সাবান আর গরম জল হলেই হবে। হাত ধোয়ার সময় এইটুকু খেয়াল রাখতে হবে যেন হাতে সাবান না লেগে থাকে। এরপরেই বাচ্চাকে পরিষ্কার ও শুকনো তোয়ালেতে হাত মুছে নিতে শেখান। বাথরুমে টিশু পেপারও লাগিয়ে রাখতে পারেন। মুখ ও নাকে হাত দিতে মানা করুন। নখ খাওয়া এবং নাকে আঙুল দেওয়া দৃষ্টিকটু তো বটেই, এটি হাইজিন-এরও সমস্যা ঘটায়।
অন্তর্বাস
গ্রীষ্মের তীব্র দাবদাহে বাচ্চারা যখন বাইরে খেলতে যায়, তখন তার অন্তর্বাস থেকেও দুর্গন্ধ বের হয়। কিছু মায়েরা বাচ্চাদের উপরের জামা বদলে দেন। কিন্তু অন্তর্বাসের দিকে নজর দেন না। বাচ্চাদের ভিতরের পোশাকও বদলানোর অভ্যাস করান।
চুলের পরিচর্যা
চার বছরের অহনা চুল আঁচড়াতে একদম পছন্দ করে না। সেই জন্য তার চুল সবসময় জটে ভর্তি থাকে। একদিন অহনার মা অহনাকে শ্যাম্পু করানোর সময় দেখলেন তার ত্বকের উপর সাদা রঙের একটি আস্তরণ জমেছে। ডাক্তার দেখানোর পরে অহনার মা জানতে পারে, চুল না আঁচড়ানোর ফলে তার মাথার ত্বকে সংক্রমণ হয়েছে।
অহনার মতো অবস্থা যাতে আপনার বাচ্চার না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখুন। রোজ চিরুনি দিয়ে চুল আঁচড়ে দিন আপনার বাচ্চার। রোজ চুল আঁচড়ালে বাচ্চার ত্বকে কোনও মৃত কোশ জমবে না, সঙ্গে চুলও জটমুক্ত ও সুন্দর দেখাবে।
যদি আপনি, আপনার বাচ্চাকে এটা রপ্ত করাতে পারেন তাহলে সপ্তাহে একদিন ভালো করে চুল ধুলেই হবে। বাচ্চাদের মাথায় মাইল্ড শ্যাম্পু-ই ব্যবহার করুন, যেটা স্পেশালি বাচ্চাদের জন্যই তৈরি। যেসব বাচ্চার কোঁকড়ানো চুল তাদের ক্ষেত্রে বাচ্চাদের কন্ডিশনারও ব্যবহার করতে পারেন। এছাড়া নারকেল তেল অথবা বাদাম তেলও ব্যবহার করতে পারেন। নিয়মিত চুল কাটাও জরুরি। এই প্রক্রিয়াটি ৩-৪ সপ্তাহ অন্তর চলতে পারে। মেয়েদের লম্বা চুলের ক্ষেত্রে মাসে একবার ট্রিমিং করানো উচিত। নিজের চিরুনি অন্যদের সঙ্গে শেয়ার না করারও পরামর্শ দিন। অন্যথায় মাথায় উকুন চলে আসার ভয় থাকে। মাসে একবার চিরুনি পরিস্কার করাটাও বাঞ্ছনীয়।
স্নান একান্ত প্রয়োজন
বেশ কিছু বাচ্চা রোজ স্নান করা পছন্দ করে না। স্নান না করার সবথেকে বড়ো কারণ হল, খেলায় বিঘ্ন ঘটা অর্থাৎ চান করতে গেলে সেই সময়টায় খেলতে পারবে না। সেইসব বাচ্চার মায়েদের জন্যও আছে কিছু উপায় যার দ্বারা আপনার বাচ্চার কাছে স্নান করাটাও একটা আনন্দের বিষয় হয়ে দাঁড়াবে।
যেমন, বাচ্চাদের স্নান সংক্রান্ত সুন্দর অ্যাক্সেসরিজ বা খেলনা বাথরুমে রাখতে পারেন। এছাড়া বাচ্চাদের জন্য তৈরি বিভিন্ন আকারের সাবান রাখতে পারেন, যেটা দেখে বাচ্চার খেলনাই মনে হবে। স্নানের সময় বাচ্চাদের বিভিন্ন ধরনের গল্পে ব্যস্ত রাখুন, যাতে সে একদম ভয় না পায়।
এছাড়াও প্রত্যেকদিন ভালো করে পা ধুয়ে, মুছে পরিষ্কার করে দিন। গরমের সময় ট্যালকম পাউডার খুব গুরুত্বপূর্ণ। স্নানের পর গায়ে পাউডার মাখলে বেশ ঠান্ডা অনুভূতিও হবে আর দুর্গন্ধের হাত থেকে বাঁচবে আপনার বাচ্চা। তবে, এইসব জিনিস ব্যবহার করার আগে জেনে নিন বাচ্চার কোনও কিছুতে অ্যালার্জি আছে কিনা।
খেলনা পরিস্কারও জরুরি
এমন কোনও বাচ্চা নেই,যে খেলনা পছন্দ করে না। কিন্তু এটা কি জানেন, যে– খেলনাটি নিয়ে আপনার বাচ্চা খেলাধুলা করছে তার মধ্যে জীবাণু আছে কিনা? যদি আপনি এখনও এটা নিয়ে ভেবে না থাকেন, তাহলে এখন ভাবুন। বেশিরভাগ জীবাণু সবথেকে আগে জিনিসপত্র এবং হাত থেকেই আসে। এগুলি থেকে বাচ্চাদের ফ্লু, হাঁপানি এবং বিভন্ন ধরনের অ্যালর্জি হওয়ার ভয় থাকে। এই রকম যাতে না হয়, তার জন্য কয়েকটি বিষয়ের উপর লক্ষ্য রাখুনঃ
- এমন খেলনা কিনুন, যেটা ধুতে পারবেন। যেসব খেলনা ধোয়া সম্ভব নয় সেগুলি ফেলে দিন। খেলনা মাঝে-মাঝে পরিষ্কার করুন, নয়তো আপনার বাচ্চার সর্দিকাশি ও জ্বর হওয়ার সম্ভাবনা থেকেই যাবে।
- যদি আপনার বাচ্চা খেলনা নিয়ে, কোনও অসুস্থ বাচ্চার আশেপাশেও যায়, সেক্ষেত্রে তাড়াতাড়ি খেলনাটি ধুয়ে ফেলুন। জলের মধ্যে ডেটল-এর মতো কিছু অ্যান্টিসেপটিক মিশিয়ে নিন ধোয়ার আগে।