ঘুসঘুসে জ্বরটা কিছুতেই ছাড়ছে না সনাতনের। প্যারাসিটামল দিয়েই চালাচ্ছে, খেলে জ্বর নেমে যায়, শরীরটা বেশ ঝরঝরে লাগে, মাথাটা হালকা আর ফাঁকা ফাঁকা। মনে হয় যেন অনেক দিন বৃষ্টির পর রোদ উঠেছে, মাথার ওপর ঝকঝকে নীল আকাশ। আবার সে আগের মতো ঝাঁপিয়ে কাজ করতে পারবে। আর কাজ তো মেলা। পুজোর মুখে এ পাড়ায় কেই বা বসে থাকে। সবাই একগাদা বায়না নিয়ে গলা অবধি ডুবে আছে। যেটুকু পয়সা ঘরে আসে তা তো এই বড়োপুজোতেই। সারা বছর পুজো লেগে আছে যদিও। কিন্তু লক্ষ্মী সরস্বতী বিশ্বকর্মা যতই জুলুস করে হোক, সে যেন পাড়ার ম্যাচ খেলা, দুর্গাপ্রতিমা না গড়লে কোনও পটুয়াই জাতে ওঠে না। তবে টাকাও নয়, জাতে ওঠাও নয়, আরও একটা কিছু থাকে যার জন্যে রাত জাগে কুমোরটুলি। শরীরের কোশে কোশে কী উত্তেজনা, ঝমঝম করে আনন্দ, সারা শরীরে যেন আবার নবযৌবন অনুভব, পার্টি যেদিন ঠাকুর ডেলিভারি নিয়ে যায়, সেদিন মনে হয় ঠাকুরের পায়ে অঞ্জলি দিয়ে যেন প্রসাদ খাওয়ার আনন্দ পাচ্ছে।

কিন্তু এ বছর একটা ঠাকুরও কি গড়ে শেষ করতে পারবে? তার প্রতিমা কি আলো করে থাকবে কোনও পুজোমণ্ডপ? একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে পাশ ফিরে শোয় সনাতন, জানলা দিয়ে চোখে পড়ে তার কাজের ঘর, এখনকার ছেলেরা বলে স্টুডিও, কিন্তু সনাতনের কাছে এটা মন্দির। একটাই ভালো কথা যে তার কাজের ঘর তার বাড়ির সঙ্গেই, বাইরে যেতে হয় না, কিন্তু আজ সেটুকু উঠে যাবার ক্ষমতাও সনাতনের নেই। তার একটা ছেলেও নেই যে হাতে হাতে কাজ করবে, দুটোই মেয়ে। বড়োটার বিয়ে হয়ে গেছে, গলায় ঝুলছে ছোটোটা, এগারো ক্লাসের পর তাকে আর পড়াতে পারেনি সনাতন। জানলা দিয়ে সনাতন দেখল কাজের ঘর শূন্য, আধগড়া এক মেটে প্রতিমার খণ্ড খণ্ড পড়ে রয়েছে এদিক ওদিক, রঙের বাটি, তুলি ছড়িয়ে ছিটিয়ে। কিন্তু ঘরটা যতটা লক্ষ্মীছাড়া থাকার কথা ছিল, তত তো লাগছে না। বরং সনাতন কাজ করার সময় যতটা অগোছালো থাকে, তার তুলনায় এখন অনেক পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। কে করল? কনুইয়ে ভর দিয়ে উঠে বসল সনাতন ভালো করে দেখবে বলে। যা দেখল তাতে সে অবাক হয়ে গেল। শুয়ে ঘরের ওই কোণটা দেখতে পাচ্ছিল না। এখন আধবসা হয়ে সে দেখল কাজঘরের একেবারে ওই কোণটায় তার মেয়ে শংকরী খুব মন দিয়ে মাটি ছানছে, তার সামনে একটা ছোট্ট, একহাত ঠাকুর, অর্ধেক বানানো হলেও ওটা যে মায়ের প্রতিমা তা এখান থেকেই বুঝতে পারল সনাতন। বিস্ময়ে সে একেবারে হতবাক হয়ে গেল। শংকরী বানিয়েছে ওই ঠাকুর? কে শিখিয়েছে? কখন শিখল সে? বরাবর সে একাই কাজ করে, একটা ফাইফরমাশের ছোড়া আছে, অর্ধেকদিন তার টিকি দেখা যায় না, রংটা এগিয়ে দেওয়া, মাটি ছানা সব সনাতনকে একা হাতেই করতে হয়। শংকরী আসে মাঝে মাঝে চা টিফিন দিতে। সনাতন টের পায় সে পেছনে দরজা ধরে দাঁড়িয়ে আছে। টের পেলেই সে খেদিয়ে দেয় ‘যা যা মেয়েমানুষের এখানে কী? দেখ মা কী করছে? আজ ভাতের মধ্যে কটা কাঁঠাল বিচি ফেলে দিস তো। নুন তেল কাঁচালংকা দিয়ে ভলো করে মাখবি’ শংকরী তবু যেত না এক তাড়ায়, দাঁড়িয়েই থাকত। স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে গেছে, যার মানে একটাই ভবিষ্যৎ তার। বিয়ে। বিয়ের কথা খুব একটা ভাবতে চায় না সনাতন। এক তো তার টাকার জোর নেই। দুই, মেয়ের বিয়ে হয়ে গেলে সংসার অচল হয়ে পড়বে। তিন, হ্যাঁ বিয়ের সবচেয়ে বড়ো বাধা তিন নম্বর কারণটা। আসলে শংকরীর মুখশ্রী যেমনই হোক চোহারাটা বড্ড দাম্বালে গোছের। যেমন লম্বা, তেমন চওড়া, খাটতে পারে সে কারণেই প্রচুর, শরীরে যেন বুনো মোষের তাকত, কিন্তু একটু নরমসরম মেয়েলি চেহারা না হলে বিয়ের বাজারে চালানো যাবে ও মেয়েকে?

বড়োটার চেহারাটা মেয়েলি ছিল, টুকটুকে ফরসা, পাতলা পাতলা গড়ন। মামাতো ভাইয়ের বিয়েতে পলতা গেছিল, সেখানেই পছন্দ করে ছেলের দিদি, শাঁখা সিঁদুরেই পার হয়ে গেছে বড়ো মেয়ে, এখন দিব্যি সংসার করছে। আর এ মেয়ের কপালে কী যে আছে। আস্তে আস্তে উঠে দেয়াল ধরে ধরে ওঘরে যায় সনাতন। শংকরী টের পায় না বাবা কখন এসে দাঁড়িয়েছে তার পেছনে। মাটি রং দিয়ে সে তখন আস্ত একটা পৃথিবী গড়তে ব্যস্ত। সনাতন মুগ্ধ হয়ে দেখে তার কাজ। একটা অপরাধবোধ তার মধ্যে কাজ করে, কখনও তো হাতে ধরে শেখায়নি মেয়েটাকে, সারাজীবন খেদিয়েছে শুধু। জ্বর বলেই নাকি অন্য কোনও কারণে তার চোখে জল এসে যায়। সে শংকরীর মাথায় হাত ছুঁয়ে ডাকে ‘মাগো, তুই নিজে, একা একা’ আর সে বলতে পারে না, গলা বুজে যায়। শংকরী চমকে উঠে দাঁড়ায়, ধরা পড়ে যাবার লজ্জা ও ভয়ে সে মাথা নিচু করে ঘামতে থাকে। তার দিকে না তাকিয়ে সনাতন ভালো করে তার গড়া ঠাকুরটি নিরীক্ষণ করে। প্রতিমার আসল জিনিস অঙ্গসংস্থান, সেটা যে আয়ত্ত করতে পারে, তার কাছে ছোটো বড়ো প্রতিমা কোনও ব্যাপার নয়। পারবে, শংকরী পারবে, এই তো তার উত্তরসূরি। কথাটা মনে হতেই সনাতনের ম্যাজমেজে ভাব কেটে যায়, শরীরে যেন তাজা রক্তস্রোত বয়ে যায়। হঠাৎ তার মাথায় একটা চিন্তা আসে। মেয়েমানুষের তো হাজারটা ফ্যাকড়া। সে গলা ঝেড়ে মেয়েকে বলে, ‘হ্যাঁ মা, তোর কাচা কাপড় তো? শরীর ঠিক আছে তো, মানে ওই ঋতুস্রাব…’

পরদিন তেড়েফুঁড়ে উঠল সনাতন। এতবছরের অপরাধ ও একদিনে স্খালন করবে এমন যেন সংকল্প তার। তার বউ অষ্টমী, বাতের ব্যথা আর নানা মেয়েলি অসুখে বারো মাস বিছানায় শোয়া, তার কানে গেল কথাটা। সে বিছানায় শুয়ে শুয়েই চিল্লিয়ে বাড়ি মাথায় করল।

‘ভীমরতি হয়েছে এই বয়সেই? মেয়েকে ঠাকুর গড়া শেখাবে? মেয়েকে ঠাকুর গড়া শেখাবে? মেয়েমানুষ পটুয়া হবে? একে ওইরকম হিড়িম্বা রাক্ষুসীর মতো চেহারা, ওর ওপর পটুয়া রটে গেলে ও মেয়ের আর বর জুটবে?’

সনাতন কান দেয় না ও কথায়। মেয়েমানুষ নাকি চাঁদে যাচ্ছে, তা আকাশের মাথায় উঠতে যদি পারে মাটি ঘেঁটে ঠাকুর বানাতে পারবে না? আরে মাটি মানে তো স্বয়ং জননী বসুন্ধরা। তা তিনি নিজেই তো মেয়েমানুষ। এসব কথা নিজের মধ্যেই রাখে সনাতন। এত কথা বলেই কি লাভ? অষ্টমী ওসব শোনার লোকই নয়। তাছাড়া সনাতনের সময় নষ্ট করার সময় নেই মোটে। পুজো এবার আগে পড়েছে। এতগুলো বায়না। চকগড়িয়া বারোয়ারি পুজো, টালিগঞ্জের সেভেন ফাইটার্স ক্লাব, সবচেয়ে চাপের ওই বেহালার মন্ত্রীর পুজোটা, দুম করে কোনদিন যে বলে বসবে ডেলিভারি নেব। তবু বুকের মধ্যে ভরসা টের পায় সনাতন। এবছর তার সঙ্গে শংকরী আছে। ভোর থেকে উঠেই কাজে লেগে পড়ে সনাতন, রান্নাবান্না সেরে সংসারের কাজ গুছিয়ে শংকরী আসে একটু পরে। সনাতনের কড়া নির্দেশ স্নান সেরে আসতে হবে আর মাসের ওই চারটে দিন সে কাজে হাত দিতে পারবে না। শংকরী এমনিতে কম কথা বলে। শক্ত চেহারার ঠোঁটটেপা মেয়ে সে। কিন্তু চারদিন কাজে হাত দিতে পারবে না শুনে সে আস্তে করে বলেছিল ‘মা দুগ্গাও তো মেয়েমানুষ বাবা, মহিষাসুরকে মারার সময় যে তাঁর মাসিক হচ্ছিল না, এ কথা কে বলতে পারে?’

সনাতনের মুখ লাল হয়ে উঠেছিল শুনে। আজকালকার মেয়েদের মুখে কিছুই আটকায় না। সে ঢোঁক গিয়ে বলেছিল ‘শোন ঠাকুর গড়া অত হতচ্ছেদ্দার কাজ নয় বুঝেছিস। জি পালের নাম শুনেছিস?’

জি পালের নাম বলার সময় কপালে হাত ঠেকায় সনাতন।

শংকরী হাঁ করে শোনে সে গল্প।

‘জি পাল মানে গোপেশ্বর পাল। বিলেতে গিয়ে সাহেবদের তাক লাগিয়ে দিয়েছিল।’ সনাতন বলে যায় গোপেশ্বর পালের জন্ম ১৮৯৫ সালে, তিন বছরে মা মারা যায়, মামার বাড়িতে মানুষ, কৃষ্ণনগরে মাটির কাজে হাতেখড়ি। সেখানে একবার ঘূর্নিতে এলেন স্বয়ং ছোটোলাট কারমাইকেল, তাঁর চোখে পড়ল গোপেশ্বরের প্রতিভা। সেটা ১৯১৫ সাল, গোপেশ্বর তখন কুড়ি বছরের যুবক। তারপর সে চলে এল কলকাতা। আর তাকে পেছনে ফিরতে হয়নি। ১৯২৮ সালে গোপেশ্বর পাল বিলেতে যায়। সেখানে পঞ্চম জর্জের ভাই ডিউক অব কনটের মূর্তি পাঁচ মিনিটে বানিয়ে ধন্য ধন্য ফেলে দেয়। সাহেবদের কাগজেও ছাপা হয়েছিল সে খবর।

‘জি পালের সঙ্গে জাহাজে চেপে বিলেতে আর কী গেছিল জানিস?’

এই অবধি বলে সনাতন খানিকটা কুইজমাস্টারের ঢঙে শংকরীর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর ওর জবাবের অপেক্ষা না করে নিজেই বলে ‘মাটি রে মাটি। বড়ো বড়ো দু-ব্যারেল ভর্তি বাংলার মাটি। তাহলে বুঝলি তো মাটি কত পবিত্র জিনিস। সবসময় এই মাটিকে প্রণাম করে কাজ শুরু করবি।’

শংকরী বলে ‘আমাদের নিজেদের লোক বিলেত গেলেন, সে তো কত আগে। কিন্তু আমাদের অবস্থা কি কিছু পালটাল? এই নোংরা গলি, প্যাচপ্যাচে রাস্তা, অন্ধকার ঘরে কাজ – এই চলছে।’

সনাতন একটু থমকে যায়, তারপর বলে ‘মা যদি তাঁর সন্তানের কপালে দুঃখ লিখে রাখেন, খন্ডাবে কার বাপের সাধ্যি? নে নে কার্তিকটা ধরে ফেল।’

‘কার্তিক?’ কেমন ধন্দে পড়ে যায় শংকরী। ‘আমি কার্তিক করব?’

‘কেন? পারবি না? খুব পারবি’ বলে সনাতনের খেয়াল হয় মেয়ের কোথাও একটা অস্বস্তি হচ্ছে। সে শংকরীর মাথায় হাত বুলিয়ে বলে ‘ওরে দেবতার যেমন নারী পুরুষ হয় না, শিল্পীরও নারী পুরুষ হয় না। মনে রাখবি, সব মূর্তিই তোর কাছে সমান।’

সনাতন আরো কিছু বলত হয়তো। কিন্তু কে যেন ডাকে তাকে বাইরে থেকে। বাইরে এসে দেখে নাড়ু। কারুভান্ডার দোকানটা ওদের। প্রতিমার চুল, চাঁদমালা, চুমকি, কিরণ, গোখরী, জামীর ভুরো, পাট, অস্ত্র সব ওরা সাপ্লাই দেয়। নাড়ু জানতে এসেছে কটা কী লাগবে। সনাতন ওর সঙ্গে কথা বলতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ঘরের মধ্যে তখন বাবার অর্ধেক গড়া কার্তিক মূর্তির সামনে অচঞ্চল হয়ে বসে থাকে শংকরী। পরম রূপবান পুরুষ তার সামনে। মূর্তির ঠোঁটে আঙুল ছোঁয়ায় শংকরী, ওর আঙুল আস্তে আস্তে মূর্তির শরীরময় ঘুরে বেড়াতে থাকে। আপাদমস্তক এক পুরুষশরীর প্রথমবার ছুঁয়ে শরীর-মনে কেমন এক জোয়ার অনুভব করে শংকরী। অনেক কষ্টে সে নিজেকে সামলায়। চোখ বুজে কী যেন ভাবে একটুক্ষণ। তারপর যখন চোখ খোলে, তখন সে দেখে কার্তিক কোনও পুরুষ নয়, সে শংকরীর সামনে একটি পরীক্ষা। সে পরীক্ষায় তাকে পাস করতে হবে এটুকুই জানে শংকরী।

পটুয়াপাড়ায় বছরের এই ক’টা মাস কখন সকাল সন্ধেয় গড়ায়, সন্ধে গভীর রাতে কেউ জানতেও পারে না। এ বছর তার সঙ্গে লেগেছে বৃষ্টি। প্রতিমাশিল্পীদের মাথায় হাত, মাটি শুকোচ্ছে না। রং লাগানো হবে কখন? গলি ভেসে যাচ্ছে সকাল থেকে। কী একটা দম বন্ধ করা গন্ধ উঠেছে। কাজ করতে করতে নাড়ুর গলা পেয়ে রাগ ওঠে শংকরীর। নাড়ু আজকাল বড্ড ঘন ঘন আসছে আর লাগাতার আনসান বকুনি। আজ ভিজে জাব হয়ে এসেছে। আর এসেই হাঁপাতে হাঁপাতে নাড়ু বলে, ‘ও কাকা, কী শুনে এলাম শোনো। রেনবো চ্যানেল থেকে আসবে শংকরীর ইন্টারভিউ নিতে!’

সনাতনের হাত থেমে যায়।

‘হ্যাঁ গো কাকা, মেয়েছেলে মূর্তি গড়ছে, চাউর হয়ে গেছে তো। ওরা দেখাবে টিভিতে।’

সনাতনের বুকে ধক্ করে লাগে কথাটা। এত বছর সে মাটিতে মুখ ঘষছে কেউ ফিরেও তাকায়নি, টিভি দূরের কথা কাগজেও ছবি ওঠেনি তার, আর তার মেয়ে দুদিন কাজ করেই এত মাতব্বর হয়ে গেল!

সে শক্ত মুখে বলে ‘না না, ওসব মাতনে মাতলে কাজবাজ মাথায় উঠবে। পুজো তো দোরগোড়ায় এসে গেল। মন্ত্রীর পুজো নিয়েই বেশি চিন্তা। কবে যে ফিতে কাটার দিন ফেলে।’

নাড়ু বোঝাতে চেষ্টা করে, ‘আরে কাকা, এসব এখন দরকার। প্রচার হবে, তাও ফ্রিতে। টিভিতে মুখ দেখাবার জন্যে সবাই হন্যে হয়ে ঘুরছে।’

সনাতন এবার ঝাঁঝিয়ে ওঠে, ‘নাড়ু, তুই এখন যা দিকিনি। এই তো ঘরের ছিরি, চারদিকে সব থইথই করছে, কোথায় বসতে দেব ওদের? আর আমাকে তুই টিভি শেখাচ্ছিস? আমি দেখিনি, বাবু পালের বাড়ি কতবার এল ওরা। একেবারে একগাড়ি লোক। কাজ নষ্ট সারাদিনের।’

‘হ্যাঁ, তা একটু হবে, তবে এই ঘরটাই তো তুলতে চাইছে ওরা। আবার বলছে একদিন শংকরীকে নিয়ে যাবে, রিয়েলিটি শো হয় না, লাগ ভেলকি লাগ? সেখানে পার্টিসিপেট করতে হবে ওকে। কত প্রাইজ আছে জানো?’

‘না না ওসব হবে না। মেয়েমানুষ একবার ঘরের বার হলে রক্ষে আছে? এই কাজ কি ও বারোমাস করবে নাকি? এবছর আমার শরীরটা যুতে নেই, ও বাড়ি বসে আছে, বিয়ের পর বাচ্চার কাঁথা কাচবে, না ঠাকুর গড়বে? যত পাগলের কাণ্ড। ভাগ তুই।’

‘দাঁড়া নাড়ু’ হঠাৎ কার গলা? চমকে তাকায় সনাতন, শংকরী এতক্ষণ মুখ নীচু করে কাজে মন বসাবার চেষ্টা করছিল, একটা রা-ও কাটেনি, মুখ তুলে অষ্টমীকে দেখতে পায়। অষ্টমী, বারোমাস বিছানায় পড়া মানুষটা উঠে এসেছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। সনাতন অবাক গলায় বলে ‘তুমি রুগি মানুষ উঠে এলে যে বড়ো? মেয়েমানুষ এসবের মধ্যে কেন আবার?’

‘মেয়েমানুষের মূর্তি গড়ে ভাত খাও আর ঘরের মেয়েমানুষদের দাবিয়ে রাখো, আমি বলছি আমার মেয়ে যাবে।’ অষ্টমী চ্যাঁচায় না, অদ্ভুত শান্তগলায় বলে ‘বিয়ে দিলেই সব মিটে গেল? ওর ভবিষ্যৎ নেই? দরজায় সুযোগ হেঁটে আসছে, উনি বলছেন যাবে না। বড্ড জ্বলুনি না? কেমন বাপ তুমি? মেয়েকে হিংসে করো?’

সনাতন রাগে থরথর করে কাঁপে। হাতের কাছে থাকা একটা মাটির খুরি ছুড়ে মারে, অষ্টমী মাথা সরিয়ে নেয় চট করে, দরজায় লেগে ভেঙে যায় খুরিটা। পা বাঁচিয়ে গিয়ে মাকে ধরে শংকরী।

দরজার পাশে ডাঁই করা অস্ত্র, নাড়ু রেখে গিয়েছিল কাল। সেখান থেকে একটা ত্রিশূল তুলে নিয়ে খুরির টুকরোগুলো একপাশে ঝেঁটিয়ে আনে শংকরী, তারপর সেই ত্রিশূল হাতে মার পাশে যখন দাঁড়ায়, সনাতনের তাক লেগে যায় দেখে। তার ভাঙা ঘরের নড়বড়ে দরজার চালচিত্রে তার অসুন্দর মেয়েটাকে অবিকল গর্জনতেল মাখা দুর্গাপ্রতিমার মতো দেখায়…

 

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...