সুপারমম মানেই ‘সুপারম্যান’ ধরনের একটা চরিত্র হবে এমন ধারণা ভুল। তবে আজকাল বেশিরভাগ মায়েদের মুখে একটা কথা প্রায়ই শোনা যায়, ‘আমার ছেলের (অথবা মেয়ের) সব থেকে ভালো বন্ধু হচ্ছি আমি। আমার সঙ্গে ও সবকিছু শেয়ার করে।’ স্কুলের টিচার অথবা পেডিয়াট্রিশিয়ানরা অভিভাবকদের বলেন বাচ্চাদের সবরকম অ্যাকটিভিটিতে সঙ্গ দেওয়ার জন্যে। কিন্তু সন্তানের সমস্ত কাজে ইন্টারেস্ট নিতে নিতে একসময় দেখা যায় শিশুর ইচ্ছেকে ছাপিয়ে মায়ের ইচ্ছেই প্রাধান্য পাচ্ছে বেশি। অভিভাবকদের মধ্যে মায়ের ক্ষেত্রেই এটা বেশি হয়ে থাকে।

মেট্রো শহরের শিক্ষিত মায়েদের মধ্যে এই ধরনের প্রবণতা চোখে পড়ে। অনেকে তো ভালো চাকরি ছেড়ে বাড়িতে থাকাটা উচিত মনে করেন, সন্তানকে আরও ভালোভাবে মানুষ করার জন্যে। কেউ কেউ অফিসের কাজ করার ডিসিপ্লিন বাড়িতেও বাচ্চার ঘাড়ে চাপাতে চান। এই ধরনের অভিভাবকরা সর্বক্ষণ বাচ্চার প্রত্যেকটা কাজ নিজের নখদর্পনে রাখতে চান।

কলকাতার নামি স্কুলের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র সায়ন্তন মায়ের প্রেজেন্স-এ কুন্ঠিত হয়ে ওঠে। ওর মনে হয় মায়ের এই আচরণে তার ভালো কিছু হচ্ছে না, এটা শুধু টর্চার-এর নামান্তর মাত্র। সকাল থেকে উঠে ক্যালোরি মেপে খাওয়া এবং সারাদিনে তার আর কতটা ক্যালোরি গ্রহণ করা উচিত, তার উপরেও মায়ের একটা ডেলি লেকচার। স্কুলে আসার সময়ও সঙ্গে মা। যাওয়ার পথে, সন্ধেয় পড়ে নেওয়া আগের হোমওয়ার্কগুলো ঝালিয়ে নেওয়া। একটুকু যা বাঁচোয়া, অন্যান্য অনেক বন্ধুদের মায়েদের মতো মা সারাদিন স্কুলের গেটের বাইরে বসে থাকে না। বাড়ি ফিরে যায়। ডট সাড়ে তিনটেয় মা আবার হাজির স্কুলের গেটে। ফেরার পথে সারাদিনের স্কুলের ডিটেলড রিপোর্ট ছেলের মুখ থেকে কীভাবে বার করতে হয়, তা সায়ন্তনের মা ভালোই জানেন।

স্কুলের খাতায় প্রত্যেকটা ভুলের চুলচেরা বিশ্লেষণ মায়েদের– এই সমস্যার মুখোমুখি অনেক বাচ্চাকেই পড়তে হয় বাড়িতে। অনেক মায়েদের নিজেদের মতামত এতটাই প্রধান হয়ে ওঠে যে, সামান্যতম কোয়্যারি নিয়ে প্রিন্সিপালের অফিসে পৌঁছে যেতেও কোনও দ্বিধা হয় না। অনেক মায়েরা টিচারদের সঙ্গে মিটিং-এ লম্বা অভিযোগের লিস্ট নিয়ে উপস্থিত হন, যতই সেটা স্কুল পলিসির বিরুদ্ধেই হোক না কেন।

মায়েদের এই ধরনের আচরণ শিশুর মানসিক বিকাশে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। শিশুর যে-কোনও অ্যাকটিভিটি-তে মায়ের অংশগ্রহণ, বাড়িতে পড়াশোনা, হোমওয়ার্ক সবকিছুতে অংশ নেওয়ার ইচ্ছে এবং সাহায্যের হাত বাড়ানো ভুল পদক্ষেপ নয়। কিন্তু সবকিছু অতিরিক্ত মাত্রায় হলে, তা খারাপ প্রভাব ফেলতে বাধ্য।

আচরণে পরিবর্তন

সন্তানের সব ব্যাপারে অতিরিক্ত নাক গলানো হয়ে যাচ্ছে, এটা বোঝা যাবে কী করে? সন্তানের ছোটো-খাটো ভুলেও অতিমাত্রায় চিন্তা নিষ্প্রোয়োজন। রাত জেগে অথবা ভোরে উঠে ভালো অভিভাবক হয়ে ওঠার উপায়ের উপর বই পড়া, নেট সার্ফ করা ইত্যাদি ইত্যাদি। এছাড়াও বাচ্চার প্রত্যেকটা ব্যাপারের মধ্যে থাকা, সারাদিন নিজেকে এবং বাচ্চাকে ব্যস্ত রাখা, ডান্স, স্পোর্টস, অভিনয়, আঁকা, গান ইত্যাদি শেখাতে বিভিন্ন জায়গায় নিয়ে যাওয়া– কোনওরকম চেষ্টাই তারা ছাড়তে চান না কারণ সবকিছুতেই বাচ্চাকে করে তুলতে হবে পারদর্শী। তাদের মতে সবকিছু শেখাতে পারলে তবেই তো বাচ্চা বুঝতে পারবে কোনটাতে সে সবথেকে ভালো। বই পড়ে আর নেট সার্চ করে এই শিক্ষাগুলিই অভিভাবকেরা পেয়ে থাকেন। এভাবেই হয়ে উঠতে চান আইডিয়াল পেরেন্ট।

এইসব মায়েরা নিজের সন্তানের ক্ষেত্রে একটু বেশি প্রোটেক্টিভ হয়ে ওঠেন। ছোট্ট থেকেই বাচ্চাকে হাঁটতে চলতে, যেখানে-সেখানে যেতে বাধা দেন, যাতে শিশু কোনওভাবে আহত না হয়। একটু বড়ো হলে স্কুলের পড়াশোনা, হোমওয়ার্ক নিয়ে চলে কন্সট্যান্ট রিমাইন্ডার। তারপর বিভিন্ন হবি জোরজবরদস্তি বাচ্চার উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়। এর বেশিরভাগ ইচ্ছেটাই মায়ের, বাচ্চার তাতে মত আছে কিনা জানার চেষ্টা করা হয় না। নিজেদের ইচ্ছা ও আকাঙক্ষা যা অপূর্ণ থেকে গেছে, সেগুলো বাচ্চার মধ্যে দিয়ে পূর্ণ করার আপ্রাণ চেষ্টা চলতে থাকে। বাসে-ট্রামে যাতায়াতে অনেক সময়ই কানে আসে, ‘আমার ছেলের পরীক্ষা না-তো, আমারই পরীক্ষা। পড়াতে পড়াতে ওর প্রশ্ন-উত্তর আমারই মুখস্থ হয়ে গেছে।’ সুতরাং ক্ষতিটা হচ্ছে কার? সন্তান যে তার কনফিডেন্স হারিয়ে ফেলছে সে ব্যাপারটা কি মায়েদের কাছে অজানা থেকে যাচ্ছে? তাই প্রথম থেকেই সাবধান হয়ে যান, কখন অতিরিক্ত অভিভাবকের বোঝা ঘাড়ে তুলে দায়িত্বের অপব্যবহার করে ফেলছেন।

সজাগ থাকুন

১) আপনি কি আপনার সন্তানের অনিচ্ছা সত্ত্বেও তার অ্যাক্টিভিটির মধ্যে অতিরিক্ত ইনভল্ভ হয়ে পড়ছেন?

২) সন্তানের হয়ে যুদ্ধজয় করার আকাঙক্ষা রাখেন এবং বাচ্চার স্কুলের প্রোজেক্ট নিজেই করে দেন?

৩) আপনি কি বাচ্চার অ্যাক্টিভিটি, পড়াশোনা, বন্ধু, খাবার অভ্যাস, সবকিছুই কনট্রোল করছেন?

৪) প্রত্যেকটা ছোটো ছোটো বিষয়ে (দোষ অথবা অন্যায়) আপনি কি সন্তানকে ব্ল্যাকমেল করেন?

৫) আপনি কি আপনার সন্তানের যে-কোনও ফেলিওর-এ লজ্জিত হন?

৬) কোনও সময়ই সন্তানকে একা ছেড়ে না দিয়ে, খেলা অথবা পড়ার জন্যে সর্বক্ষণ জোর করতে থাকেন কি?

উপরের প্রশ্নগুলির উত্তর যদি হ্যাঁ হয় তাহলে জানবেন বাচ্চার প্রতি অন্যায় করছেন আপনি।

 

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...