সকালের হাওড়া-রউরকেল্লা ইস্পাত এক্সপ্রেস-এ চড়ে বসেছি। খড়গপুর ছাড়াতেই ক্রমশ মাটি তার ধরন বদলাচ্ছে, মালভূমির অসমতলে পরিবর্তন হচ্ছে দৃশ্যপটের।
নিরিবিলি একফালি স্টেশন গালুডি। ঘাটশিলা পেরোনোর পরই আমরা লটবহর নিয়ে নামার জন্য প্রস্তুত। চতুর্দিকে টিলাপাহাড় আর মধ্যে পাথুরে ল্যান্ডস্কেপে এক প্রতিস্পর্ধী নদী, নাম তার সুবর্ণরেখা। বালি চিকচিক করছে অভ্রর আধিক্যে। রুয়াম পাহাড়ের কোল ঘেঁষে ঘুমিয়ে আছে কয়েকটা সাঁওতালি গ্রাম।
শহুরে কলরব ছেড়ে যারা দিন কয়েকের নিরুপদ্রব বিরতি চান, তাদের জন্য উপযুক্ত পালানোর ঠাঁই গালুডি। অনর্থক টুরিস্টের চাপ নেই। অথচ প্রকৃতির কোলে মন ভরে ডুব দেওয়ার পূর্ণ অবকাশ।
সুবর্ণরেখার ধারে পাথরের উপর বসে আনমনে কাটিয়ে দেওয়া যায় আস্ত একটা বিকেল। দূরে নদীর উপরের সেতু দিয়ে, রাখা মাইন্স-এর ট্রাক যাতায়াত করে। একদা হাওয়া বদলের আশায় বহু বাঙালির যাতায়াত ছিল এ তল্লাটে।
গেস্ট হাউসের চৌকিদার তাগাদা দেয় রাতের খাবারের জন্য। দিশি মুরগির ঝোল আর ভাত, রাতে যেন অমৃতের মতো মনে হয়।
পরদিন একটা অটো ভাড়া করে বেরিয়ে পড়ি বুরুডি ড্যাম-এর উদ্দেশ্যে। পাহাড়ের মাঝখানে একফালি হ্রদ যেন ছবির মতো সাজানো। হ্রদের পাশেই একটি খড়ের ছাউনির নীচে বসে একটি সাঁওতাল ছেলে ডিম ভাজছিল। কাঁচা শালপাতায় করে গরম ডিমভাজা এগিয়ে দিল নামমাত্র মূল্যে।
আমাদের পরের গন্তব্য ধারাগিরি ফলস্। গ্রামের পথে এঁকেবেঁকে এগিয়ে চলে অটো, ক্রমশ পথ পৌঁছোয় জঙ্গলের ভেতর দিয়ে ধারাগিরি প্রপাতের দিকে। অটো থেকে নেমে খানিকটা পায়ে হাঁটা পথে যেন এক প্রাগৈতিহাসিক ল্যান্ডস্কেপে এসে পৌঁছোই । জনমনিষ্যি নেই এমন নির্জনে গভীর বনানীর মধ্যে এই প্রপাত। সূর্যের তীর্যক আলোয় ঝিলমিলিয়ে ওঠে রুপোলি জল আর তাতে খেলা করতে থাকে অসংখ্য মাছ। জায়গাটা ছেড়ে আসতে যেন মন চায় না।
পরদিন আমরা বেরিয়ে পড়ি ট্রেনে করে, রাখা মাইন্স দেখতে যাব বলে। গালুডি থেকে ট্রেনে খুব দূরে নয় রাখা মাইনস। খনির ভেতর ঢুকতে বিশেষ অনুমতি লাগে। আমরা নিকটস্থ একটি ভাতের হোটেলে দ্বিপ্রাহরিক আহার সারি, তারপর রওনা দিই ঘাটশিলার উদ্দেশ্যে।
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্মৃতিবিজড়িত বাড়ি, ফুলডুংরি পাহাড় এসব নিয়ে দিব্যি জমজমাট এখনকার ঘাটশিলা। এখানে টুরিস্টের চাপ একটু বেশি হয় শীতে। বেশিরভাগই বাঙালি টুরিস্ট। মন্দ লাগে না জায়গাটা। গালুডি ফেরার পথে দেখি একজায়গায় আদিবাসীদের হাট বসেছে। হাটের এক কোণে মকর সংক্রান্তি উপলক্ষ্যে চলছে মোরগের লড়াই। পায়ে ছুরি আটকানো দুটি মোরগ পরস্পরের সঙ্গে লড়ছে বীরবিক্রমে, আর তাই নিয়ে চলছে গোপন জুয়া।
পরদিন আবারও অটো নিয়ে আমরা ঘুরে আসি জাদুগোড়া। মাইন এরিয়া পেরিয়ে পৌঁছোই রঙ্কিনিদেবীর মন্দির। এ অঞ্চলে দেবীর খুব নামডাক। মন্দিরের পেছনেই কাপড়গাদি পাহাড়। জঙ্গুলে পরিবেশে পাহাড় বেয়ে টপে উঠে যেতে বেশ লাগে। উপরে হনুমানজির একটি মূর্তি। উপর থেকে গোটা মালভূমিটাও এক নজরে দেখে নেওয়া যায়।
ছোট্ট জায়গা, তবু গালুডি ভোলার নয়। ছোট্ট ছুটিতে ছোট্ট ভ্রমণ মনপ্রাণ জুড়িয়ে দেয়। উইক-এন্ড-এ একবার যাবেন নাকি এই নিরালা সফরে?