মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে সীমা বরাবরই প্রচণ্ড স্টুডিয়াস। পরিবারে পড়াশোনার পরিবেশের মধ্যে সবসময় থাকার ফলে, নিজে পড়াশোনা এবং কেরিয়ার ছাড়া কোনও কিছু নিয়েই সীমা কখনও চিন্তা করেনি। গ্র্যাজুয়েশন শেষ করার পর এমবিএ পড়া শেষ করে একটি প্রাইভেট সেক্টর ব্যাংকে সীমা অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজারের পদে বহাল হয়। বাড়ি থেকেও শুরু হয় বিয়ের জন্য জোরাজুরি। কিন্তু সীমার কাছে চাকরি, পদ, কেরিয়ার ছাড়া অন্য কিছু ভাবার সময় কোথায়? তার ওপর বিয়ে মানেই সংসার, বাচ্চা সামলানো এসব তো সীমা স্বপ্নেও ভাবতে পারে না। সুতরাং তার মা-বাবার, মেয়ের বিয়ে নিয়ে চিন্তার সেখানেই বিরতি।
বছর পেরিয়েছে। আর্থিক স্বাধীনতা লাভের মোহ সীমাকে আরও পেঁচিয়ে ধরেছে। তা সত্ত্বেও সীমা বিয়ে করেছে। নিজের পছন্দেই করেছে। কিন্তু চাকরি ছাড়েনি এবং সন্তানের চিন্তাভাবনা তার মনে উঁকিও মারেনি। নিজের পছন্দমতো চাকরি পেয়েছে সীমা। মোটা মাইনে, সীমার জীবনকে উপভোগ্য করে তুলেছিল। হঠাৎ করে কেরিয়ার গ্রাফ যখন প্রগতির মুখে, তখনই এই ছেদ, সীমার জীবনে আনল আশ্চর্য পরিবর্তন।
সীমা সন্তানসম্ভবা হল এবং একটি শিশুপুত্রেরও জন্ম দিল। বাড়িতে দেখাশোনা করার কেউ নেই এবং বাইরের আয়ার ভরসায় বাড়িতে ওইটুকু বাচ্চাকে একা ছাড়া অসম্ভব। সুতরাং বাধ্য হয়েই সীমাকে চাকরি ছাড়তে হল।
সংসারের কাজকর্ম, সন্তানের যত্ন নেওয়া, তার ওপর মনের মতো বড়ো মাপের চাকরি ছাড়ার ব্যথা– সব মিলিয়ে নৈরাশ্যে ডুবে যেতে থাকে সীমা। সবসময় তার মনে হতে থাকে, সে নিজের জীবন, কেরিয়ার নিয়ে ছিনিমিনি খেলেছে এবং তারই ফলস্বরূপ কেরিয়ারে উন্নতির রাস্তা আজ তার কাছে সম্পূর্ণ বন্ধ।
ধীরে ধীরে তার মন এই পরিস্থিতির সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিল। সীমা নিজের মনকে বোঝাল। সন্তানকে বড়ো করা মায়ের দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে সুতরাং তাকে এই দায়িত্ব পালন করতেই হবে। তবে মনে মনে প্রার্থনা করতে থাকল, দিন তাড়াতাড়ি কেটে যাওয়ার জন্য এবং সন্তানও যাতে তাড়াতাড়ি বড়ো হয়ে ওঠে। সীমাও যাতে তাড়াতাড়ি চাকরিতে ফিরে যেতে পারে।
স্নেহের ছোঁয়ায় মাতৃত্বের বিকাশ
দেখতে দেখতে তিন মাস কেটে যায়। ছোট্ট শিশুটির সঙ্গে গল্প করতে করতে সীমার সময় কাটে, যেন দুধের শিশুটি মায়ের সব কথা বুঝতে পারছে। বাচ্চাকে খাওয়ানো, তোল মাসাজ করানো, স্নান করানো, কোলে দোল দিয়ে ঘুম পাড়ানো। পরিবর্তে শিশুর নিষ্পাপ মুখে হাসির ঝিলিক খেলে যাওয়া, নরম হাতে মায়ের আঙুল আঁকড়ে ধরা। এসবই ধীরে ধীরে সীমাকে অনেক বেশি আনন্দ দিতে আরম্ভ করল যার স্বাদ চাকরি জীবনে সীমা কোনওদিন অনুভব করতে পারেনি। ছেলের মুখের এক ঝলক হাসি সীমার জীবন থেকে নৈরাশ্য মুছে দিয়ে সূর্যের রাঙা আলোয় জীবনকে রাঙিয়ে তুলল। হঠাৎই সীমা উপলব্ধি করতে পারল, শুধুমাত্র কর্তব্যের খাতিরেই সে সন্তানের পুরো দায়িত্ব নিজের কাঁধে নিয়ে নেয়নি। নিজের হাতে বাচ্চার প্রত্যেকটা কাজ করতে তার আনন্দ হচ্ছে এবং এর পিছনে একটাই কারণ কাজ করছে সেটা হল মাতৃত্বের উপলব্ধি এবং সন্তানের প্রতি গভীর স্নেহ ও ভালোবাসা।
দেখতে দেখতে কেটে যায় আরও কয়েকটা মাস। সীমার ছেলের বয়স এখন দেড়। গানের তালে নাচতে নাচতে মায়ের হাত ধরে টানে। ছেলেকে পাশে শুইয়ে ছড়া, গল্প বলা সীমার এখন নেশার মতো হয়ে গেছে। সীমার গানের গলা খুব সুন্দর। মায়ের গান শুনে শুনে ছেলেও গান গাইতে শিখেছে। বাড়ির আশেপাশে পাড়া প্রতিবেশী সক্বলে ঈশানকে প্রচণ্ড ভালোবাসে।
পাড়ার সকলে এই পুরো কৃতিত্বটাই দেয় সীমাকে। সীমার জন্যই ঈশান এত ভালো ভাবে মানুষ হচ্ছে। বাচ্চার জন্য সীমা নিজের চাকরি, কেরিয়ার সব স্যাক্রিফাইস করেছে কিন্তু এর ভালো ফল আজ ও হাতেনাতে পাচ্ছে। সীমার মনে পড়ে, অফিসের ঊর্ধ্বতন বস-ও তার কাজের সাফল্যে এইভাবেই প্রশংসায় মুখর হতেন।
পাঁচ বছর পরে যখন সীমা পিছনে ফিরে তাকায় তখন একটা জিনিস ওর কাছে খুব পরিষ্কার হয়ে যায় চোখের সামনে। কোনও পরিমাণ অর্থ, কেরিয়ারের সাফল্য, ছোট্ট শিশুর মাতৃত্বের স্পর্শে বড়ো হয়ে ওঠার মুহূর্তগুলির আনন্দকে ম্লান করতে পারে না। দুটোর মধ্যে কোনও তুলনা করাই চলে না। সীমার মনে হয় এই কটা বছরে সত্যিই কি ও জীবন থেকে কিছু হারিয়েছে? চাকরি ছেড়ে ও কি খুব বড়ো ভুল করে ফেলেছে? উত্তরটাও আজ ওর কাছে খুব স্পষ্ট ও উজ্জ্বল। সেটা হল ‘না’। সে তো রীতিমতো লাইফ এনজয় করেছে।
ঈশান এখন বেশ কিছুটা বড়ো হয়েছে। সীমা এবার তার নিজের কেরিয়ারে ফিরতে চায়। একটা অধ্যায়ে ছেদ পড়েছে ঠিকই– কিন্তু কোনও কিছুই পুরোপুরি শেষ হয়ে যায় না। মাতৃত্বের দায়িত্ব ও পোশাদার জগৎ দুই-ই এবার সীমা নিশ্চিন্তে সামলাতে পারবে।