আজও আমরা মাতৃস্নেহের দৃষ্টান্ত দিতে গেলে হিন্দি ছবি ‘দিওয়ার’-এর প্রসঙ্গ টেনে আনি। ‘মেরে পাস মা হ্যায়’, ছবির এই অনবদ্য ডায়লগটি বহু ক্ষেত্রেই আমরা ব্যবহার করে থাকি। কিন্তু বাস্তবে সত্যিই কি মায়ের এই সম্মান আর গুরুত্ব সকলের কাছে রয়েছে? কারণ আমাদের সমাজ আজও পুরুষশাসিত।
সমাজ আজ অনেক এগিয়ে গেছে ঠিকই কিন্তু সিংগল মাদার হয়ে, সম্মানের সঙ্গে বেঁচে থাকা আজও কঠিন। ভারতায় সমাজে এখনও মায়ের থেকে বাবাকেই বেশি মর্যাদা দেওয়া হয়। তবে ভারতের উত্তরপূর্ব অঞ্চলে, হিমালয়ের পার্বত্য অঞ্চলে এবং কেরলে মেয়েদেরকে অনেক বেশি স্বীকৃতি ও মর্যাদা দেওয়া হয়। এখন সুপ্রিম কোর্টও সিংগল মাদারদের পক্ষে একটি গুরুত্বপূর্ণ রায় দিয়েছে।
কোর্টের রায় কতটা ঠিক
জুলাই, ২০১৫-তে সুপ্রিম কোর্ট, অবিবাহিত মহিলাদের পক্ষে এক ঐতিহাসিক রায় দেয়। অবিবাহিত মেয়েরা নিজের সন্তানের স্বাভাবিক অভিভাবক হতে পারবে, এর উপর সুপ্রিম কোর্ট স্বীকৃতির শীলমোহর লাগায়। কোর্ট জানিয়ে দেয় যে, কোনও সিংগল মাদার অথবা অবিবাহিত মা যদি নিজের বাচ্চার জন্মের প্রমাণপত্রের জন্য আবেদন করে তাহলে তৎক্ষণাৎ সেই আবেদন যেন মান্য করা হয়।
সুপ্রিম কোর্টের এই রায় সেইসব সিংগল মাদারদের জন্য কিছু বিশেষ সুবিধা লাভের পথ প্রশস্ত করেছে, যারা বিয়ের আগেই গর্ভবতী হয়েছেন। রায় অনুযায়ী পিতৃপরিচয় জানাতে তারা এখন বাধ্য নন। বিয়ের পবিত্র বন্ধন ছাড়াই অবিবাহিত মায়েরা এখন আইনত অভিভাবক হতে পারবেন। পুরুষের নাম অথবা তাদের সহযোগিতার এখন আর কোনও প্রয়োজন নেই। এইসব মায়েদের সন্তানরা মাতৃপরিচয়েই বড়ো হবার সুযোগ পাবে এবং সমাজও তাদের সমান মর্যাদায় স্বীকার করবে। অবিবাহিত মায়েদের জন্য আর একটি ভালো খবর যে, তারা নিজেদের গর্ভজাত সন্তানদের বার্থ সার্টিফিকেট নিতে চাইলে, উক্ত বিভাগ প্রয়োজনীয় তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহ করে জন্মের প্রমাণপত্র জারি করবে।
কোর্টের রায় অবিবাহিত মায়েদের জন্য আশীর্বাদ প্রমাণিত হলেও সমাজ কি স্বীকৃতি দিচ্ছে এই নবজাতকদের? মায়েরা কি বদনামের সম্মুখীন হচ্ছেন না? কোর্টে এই রায় বোরোবার জন্য কি মায়েদের আত্মবিশ্বাস আগের থেকে এখন অনেক বেশি? যদি এই ক্ষেত্রে সমাজের স্বীকৃতির হার বাড়তে থাকে তাহলে বুঝতে হবে কুমারী মায়েরা আইনের স্বীকৃতি পেয়ে উপকৃতই হয়েছেন।
প্রথমেই দরকার হয় পিতৃপরিচয়
কুমারী, অবিবাহিত মেয়েদের জন্য সুপ্রিম কোর্টের রায়, হয়তো কিছুটা শান্তিতে নিশ্বাস নেওয়ার সুবিধা করে দিয়েছে ঠিকই কিন্তু সমাজের চেহারাটা একটু আলাদা। চারপাশে তাকালেই দেখা যায় ছোটো থেকেই সন্তানের জীবনে বাবার ইমপর্টেন্স-ই বেশি। বাচ্চার পরিচয় জিজ্ঞেস করার জন্য সকলে বাচ্চার বাবার নাম সবথেকে আগে জানতে চায়, বাবার কী নাম, উনি কী করেন ইত্যাদি ইত্যাদি। মায়ের পরিচয় বেশিরভাগই কেউ-ই জিজ্ঞেস করে না।
স্কুলেও দেখা যায় বাচ্চারা অন্য বাচ্চার উপর চড়াও হবার জন্য মৌখিক বাবাকেই টেনে আনে যেমন, ‘জানিস আমার বাবার নাম কী?’ অথবা ‘গায়ে হাত দিয়ে দ্যাখ বাবাকে বলে দেব’ ইত্যাদি। হয়তো অনেক ক্ষেত্রেই এইসব বাচ্চাদের মায়েরাও কর্মরতা কিন্তু মা-কে নিয়ে কম সংখ্যক মানুষ প্রশ্ন তোলে।
বিয়ের পর জামাইয়ের আদর বেশি
যে-কোনও পরিবারে ‘হেড অফ দি ফ্যামিলি’ সাধারণত পুরুষ সদস্যরাই হয়ে থাকেন। সব জায়গায় তাদের পছন্দ-অপছন্দেরই খেয়াল বেশি রাখা হয়। বিয়ের পর মেয়েদেরও নিজের বাড়িতে আদর কম হয়ে যায়, বাড়ির সবাই ব্যস্ত হন জামাইকে নিয়ে। সে কী খাবে, কোথায় শোবে, তার পছন্দে বেড়াতে যাওয়া, সিনেমা দেখা ইত্যাদি ইত্যাদি। বাড়ির ভিতরেই যদি বাড়ির মেয়েদের আদর কমতে থাকে, তাহলে সমাজেও সেই হিসেবেই তার জায়গা চলমান হয়। সুতরাং পরিবর্তন আনতে চাইলে শুরু করতে হবে বাড়ির অন্দর থেকেই।
পশু এবং মানুষ উভয়ক্ষেত্রেই মা-ই প্রধান
মানুষ এবং পশুদের মধ্যে সামাজিক পরিবেশের তফাত রয়েছে। মানুষ যেখানে নতুন প্রজন্মকে, সমাজে এবং পরিবারের মধ্যে থাকার উপযুক্ত করে তৈরি করে সেখানে জন্তু জানোয়াররা নিজের সন্তানদের নিজের পায়ে দাঁড়াতে শিখিয়ে একে নিজের মতো চরে খাওয়ার জন্য ছেড়ে দেয়। অনেক সময় মানুষ পশুদের মতোই ব্যবহার করে। সমাজে অনেক পুরুষই নিজের সন্তানকে পিতৃপরিচয় দেওয়া থেকে বঞ্চিত রাখে। সেই পরিস্থিতিতে সন্তানের মা যদি বাচ্চাকে আপন করে নিতে না পারে, তাহলে বাচ্চার অসময়ে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে অথবা অনাথালয় তাকে লালনপালন করে। দেখা যায় এইসব ক্ষেত্রে মায়েরাই বেশিরভাগ এগিয়ে এসে বাচ্চার সব দায়দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেয় সমাজের পরোয়া না করে। জানোয়ারের সঙ্গে মানুষের এখানেই মিল। পশুদের ক্ষেত্রেও মায়েরাই সন্তানদের ভরণ-পোষণের ভার নেয়। এমনকী শিকার করে নিজের খাবারের জোগাড় করাও বাচ্চারা মায়ের থেকেই শেখে।
সমাজে অবিবাহিত মায়েদের সমস্যা
ভারতে সামাজিক যা পরিস্থিতি তাতে কোনও মেয়ে যদি বিয়ে না করে মাতৃত্বের স্বাদ নিতে চান অথবা মা হওয়ার ডিসিশন নিয়ে বসেন, তাহলে ভারতীয় সমাজ তাকে অপরাধ বলে গণ্য করে। অথচ বিদেশে কিন্তু এই ধরনের ঘটনা আকছার ঘটতে থাকে।
আমাদের সমাজ বিয়েতে পরিবারের মত থাকাটাকে সবথেকে প্রয়োজনীয় বলে স্বীকার করে। বহু ক্ষেত্রে দেখা যায় প্রেমিকযুগল একে অপরকে ভালোবেসেই সন্তানের জন্ম দেওয়ার কথা ভাবে অথচ পরিবারের ভয়ে বিয়ে পর্যন্ত করে উঠতে সাহস পায় না। সেই ক্ষেত্রে সন্তানের জন্ম দেওয়াটা মেয়েদের কাছে বিরাট একটা চ্যালেঞ্জ। আজও নবজাত শিশুকে আবর্জনার গাদায় কুড়িয়ে পাওয়ার ঘটনা হামেশাই শুনতে পাওয়া যায়। সুতরাং সমাজের চিন্তাধারা বদলালেই সিংগল মাদারের কনসেপ্ট যথার্থ অর্থে কার্যকরী হবে।
নিজের গর্ভজাত সন্তানই ঠিক
ভারতে পরিত্যক্ত, অসহায়, অনাথ বাচ্চার সংখ্যা প্রচুর কিন্তু তাসত্ত্বেও খুব কম সংখ্যক মানুষই দত্তক নিয়ে এইসব শিশুদের মানুষ করতে চায়। বংশ এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য আজও নিজের গর্ভজাত সন্তানকেই সকলে প্রাধান্য দেয়। অনেক পরিবারেই সন্তান না হলেও অনাথ শিশুকে তারা দত্তক নিতে চায় না। পরিবারে যারা গুরুজন তারা চান নবদম্পতিদের তাড়াতাড়ি সন্তান হোক বংশ রক্ষার্থে। এছাড়া ভারতে অবিবাহিত পুরুষ অথবা নারী কেউ যদি কোনও শিশু দত্তক নিতে চায়, সংস্থাগুলি দিতে রাজি হয় না।
ডিভোর্সের পর সমস্যার সম্মুখীন
সমস্ত দেশের তুলনায় আজও আমাদের দেশে বিবাহবিচ্ছেদের সংখ্যা অনেক কম। এর কারণ বিবাহবিচ্ছিন্না মহিলাদের প্রতি সমাজের বিরূপ দৃষ্টিভঙ্গি। ডিভোর্সি মহিলাদের আজও নীচু নজরে দেখা হয়। বিধবা মহিলারা পুনর্বার বিবাহ করলে সমাজে সকলের ভ্রুকুঞ্চিত হয়। স্ত্রীয়ের মৃত্যুর পর পুরুষদের দ্বিতীয়বার বিয়ে করতে কোনও অসুবিধে হয় না কিন্তু বিধবা মেয়েদের স্বামী পাওয়া মুশকিল হয়। বিদেশের তুলনায় ডিভোর্সের হার কম হওয়ার জন্য এবং স্বামীর বাড়ি থেকে স্ত্রীয়ের মরদেহই বেরোবে এই বিশ্বাস যতদিন এদেশে রাজত্ব করবে – ততদিন সিংগল মাদারের কনসেপ্ট দুর্বলই থেকে যাবে। এই একই কারণে শ্বশুরবাড়িতে হাজারো অত্যাচার সয়েও মেয়েরা বেরিয়ে এসে সন্তানদের একলা বড়ো করার সাহস দেখাতে পারেন না।
বিভিন্ন প্রশ্নের সম্মুখীন
ভারতে সিংগল মাদার হওয়া খুব সহজ নয়। সাহসী মনোভাব সত্ত্বেও সিংগল মাদারদের নানারকম প্রশ্নের সামনে পড়তে হয়। যেমন ‘বাচ্চার বাবা কে’ অথবা ‘আপনারা একসঙ্গে থাকেন না কেন’ ইত্যাদি ইত্যাদি। মনোবল ভেঙে দেওয়ার মতোও প্রতিক্রিয়াও দেখা যায়। যেমন একলা বাচ্চা বড়ো করা একটা মেয়ের পক্ষে খুব মুশকিল, মাথার উপর বাবার হাত থাকা খুব দরকার। এছাড়াও বাচ্চার স্কুল অ্যাডমিশনের সময় অথবা সরকারি, বেসরকারি কোনওরকম ফর্ম ভরতে গেলে অভিভাবকের বদলে বাবার নামই জিজ্ঞেস করা হয়।
কিছু ফ্যাক্টস এবং ফিগার্স
- ২০১৫-তে ভারতে দত্তক নেওয়া শিশুর সংখ্যা গত ৩ বছরের মধ্যে বৃদ্ধি পেয়েছে।
- ২০০৬-এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী ৮২ শতাংশের চেয়ে বেশি ভারতীয় শিশু নিজের মা-বাবার সঙ্গে থাকে। যারা কোনও একজন অভিভাবকের সঙ্গে থাকে তার সংখ্যা ৮.৫ শতাংশ। এখানে একজন অভিভাবক অর্থাৎ সিংগল মাদার।
- সুপ্রিম কোর্টের আদেশকে মহিলা অধিকার সমর্থকরা স্বাগত জানিয়েছেন।
- দিল্লি সরকারের মহিলা এবং শিশু বিকাশ বিভাগের পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০০৭ থেকে ২০১১ পর্যন্ত ছেলেদের থেকে মেয়েদেরই বেশি দত্তক নেওয়া হয়েছে। বেসরকারি সংস্থাগুলিতে ২০১১-র পরিসংখ্যান অনুসারে যেখানে দত্তক নেওয়া ছেলের সংখ্যা ৯৮ সেখানে মেয়েদের সংখ্যা ১৫০।
- এখনও পর্যন্ত ‘দ্য গার্জিয়ান অ্যান্ড ওয়ার্ডস অ্যাক্ট’ এবং ‘হিন্দু মাইনরিটি অ্যান্ড গার্জিয়ানশিপ অ্যাক্ট’ অনুযায়ী বাচ্চার লিগাল গার্জেন ঠিক করতে বাবার সম্মতির প্রয়োজন হতো। এখন সুপ্রিম কোর্ট পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছে, এর জন্য বাবার সম্মতি নেওয়ার কোনও প্রয়োজন নেই।
স্বামীর মৃত্যু অথবা বিবাহবিচ্ছেদের পর সন্তানের লালনপালন আবার অবিবাহিত অবস্থায় সন্তানের জন্ম দেওয়ার পর পুরুষসঙ্গীর সাহায্য ছাড়াই সন্তানকে বড়ো করা– সিংগল মাদারের এমন উদাহরণ বা কনসেপ্টকে ছাড়িয়ে এখন পুরুষের সঙ্গে দৈহিক সম্পর্ক ছাড়াই মাতৃত্বের স্বাদ পেতে চাইছেন অনেকেই। অ্যাক্টর এবং ডিরেক্টর অনিন্দিতা সর্বাধিকারীর সঙ্গে এই বিষয়টি নিয়ে কথা হল।
আপনি নিজে একজন সিংগল মাদার। কেন এই সিদ্ধান্ত?
মনের মতো জীবনসঙ্গীর অভাব। মাতৃত্বের স্বাদ পেতে চেয়েছি কিন্তু জোর করে শুধুমাত্র একটা বাচ্চার জন্য সম্পর্ক তৈরি করা যায় না। মা, বাবার মধ্যে যদি ছন্দ না মেলে তাহলে সবচেয়ে বড়ো ছন্দপতন ঘটে সন্তানের জীবনে। আনফরচুনেটলি মেয়েরা যদি নিজের গর্ভে সন্তান ধারণ করতে চান, তাহলে তার একটা সময় আছে। ৪০ এর পর মেয়েদের গর্ভধারণের ক্ষমতা কমে যায়। ৩০-এর পর থেকেই এটা কঠিন হতে শুরু করে। আমার ক্ষেত্রেও ৩০-এর পরও মনের মতো জীবনসঙ্গী খুঁজে না পেয়ে মনে হচ্ছিল মা হওয়ার সময়টা পেরিয়ে যাচ্ছে। আর আমি যতটা স্বাধীন, সবাই আমার সঙ্গে একমত নাও হতে পারেন। তখনই সিদ্ধান্ত নিই ভালোবাসা, প্রেম যে-কোনও বয়সে হতে পারে। প্রেমের কোনও বয়স নেই, ওটার জন্য অপেক্ষা করা চলে কিন্তু মা হওয়ার ইচ্ছেটাকেই আমি অগ্রাধিকার দিতে চেয়েছি। তাই বলে আমি পুরুষবিদ্বেষী বা সাংঘাতিক নারীবাদী নই। কোনও এক পুরুষই তাঁর স্পার্ম ডোনেট করেছেন বলেই আমি মা হতে পেরেছি।
এই সিদ্ধান্ত নিতে কতটা অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয়েছে আপনাকে?
১৮ বছর বয়সে গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মারকুয়েজের ‘লভ ইন দ্য টাইম অফ কলেরা’ পড়ে প্রচন্ড প্রভাবিত হয়েছিলাম। সেখানে ৭০ বছর বয়সের পর নায়ক-নায়িকার জীবনে প্রেম এসেছিল। আগে সন্তান পরে প্রেম, হয়তো এই মনোবলটা বইটা থেকেই পেয়েছিলাম। বিয়ের মতো পবিত্র বন্ধন ছাড়াই মা হওয়ার সিদ্ধান্ত যখন নিই, আমার মা-বাবাই তখন আমার প্রধান শিরদাঁড়া ছিলেন। ছোটো থেকেই তাঁদের প্রগতিশীল মানুষ হিসেবে দেখে এসেছি। সমাজকে বদলাবার অঙ্গীকার নিয়ে, জাতের বিচার না করেই তাঁরা ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন। সেই প্রজন্মের মানুষ হয়ে যদি তাঁরা এতটা এগিয়ে থাকতে পেরেছিলেন, তাহলে আজকের প্রজন্মের সাহস দেখানোয় বাধা কোথায়? আর সমাজে পরিবর্তন যদি আনতেই হয় তাহলে আমি বিশ্বাস করি নিজের জীবন দিয়েই সেটা আনতে হবে।
বিয়ে ছাড়াই ‘মা’ হওয়ার সিদ্ধান্তে, আপনাকে সমাজ মানসিক ভাবে কতটা শক্তি জোগাতে সাহায্য করেছিল?
আমি যে-পদ্ধতিতে ‘মা’ হতে চেয়েছি, সেইসময় ওই একই পদ্ধতিতে আর কেউ মা হয়েছেন কিনা সেটা জানবার জন্য অপেক্ষা করিনি। আমার মনের মধ্যে নানা প্রশ্ন উঠে এসেছিল এই সিদ্ধান্ত যখন নিই। কিন্তু উত্তর দেওয়ার মতো পাশে কেউ ছিল না। মনে হয়েছে সন্তান এই পৃথিবীতে আসার পর যখন বড়ো হবে তখন ও কী ধরনের প্রশ্নের মুখে পড়বে অথবা সন্তানের কাছে আমি কী প্রশ্নের মুখোমুখি হতে পারি? দেশের মাটি ছেড়ে বিদেশে বন্ধুবান্ধবদের কাছে এই উত্তরগুলো খুঁজেছি আর প্রচুর বই পড়ে শক্তি সঞ্চয় করেছি।
প্রেগনেন্সি পিরিয়ডে আপনার কী অনুভূতি ছিল?
আমি পৃথিবীতে একটা প্রাণ নিয়ে আসতে চেয়েছি এবং এটা কোনও হুজুগ নয়। একজন ইন্ডিভিজুয়াল হিসেবে তার পরিচিতি হবে সমাজে। নিজেকে মানসিক ভাবে তৈরি করেছি সন্তানকে আগলে রাখবার। কারণ জানতাম সমাজ ওর দিকে আঙুল তুললে, একটা বয়স পর্যন্ত তার লড়াইটা আমাকেই লড়তে হবে। গর্ভধারণ করার আগে অনেক ভেবেছি, যদি আমার সন্তানকে কেউ আঘাত দেওয়ার চেষ্টা করে, তাহলে আমি পারব তো তাকে সমাজের সব আঘাত থেকে রক্ষা করতে? ২-৩ বছর লেগে গিয়েছিল আমার সিদ্ধান্ত নিতে, মনস্থির করতে।
আইন কতটা সাহায্য করেছে আপনাদের মতো সিংগল মাদারদের সমাজে নিজস্ব পরিচিতি বাড়াতে?
সুপ্রিম কোর্ট এখন রায় দিয়েছে, সিংগল মাদারের পরিচয়ই তার সন্তানের পক্ষে যথেষ্ট। আমি যখন লড়াই শুরু করি তখন লড়াইটা একারই ছিল। তখনও জানতাম না আমার মতো আরও অনেক মা আছেন। সুপ্রিম কোর্টে একজন মা তার সন্তানের অধিকার পাওয়ার জন্য ৫ বছর ধরে একাই লড়াই চালাচ্ছিলেন। ঘটনাটা পড়ার পর সেই মায়ের লড়াইও কিন্তু আমার মনে শক্তি জুগিয়েছিল। এখন তো আইনও আমাদের হিতে রায় দিয়েছে এবং সমস্ত সিংগল মাদাররাই এতে উপকৃত হবেন। তবে আমার ক্ষেত্রে সবথেকে বড়ো ভূমিকা নিয়েছিল সংবাদমাধ্যম, সুন্দরভাবে পুরো জিনিসটাকে জনসমক্ষে নিয়ে এসে।
আপনার ক্ষেত্রে গর্ভধারণের পুরো পদ্ধতিটি আপনার ওপর কতটা প্রভাব ফেলেছিল?
প্রথমেই দরকার হয়েছিল, মানসিক, শারীরিক এবং অর্থনৈতিক প্রস্তুতি। শরীরের উপর ঝড় বয়ে যায়। হরমোনের ইঞ্জেকশন নিতে হয় ফলে হরমোনের ওঠাপড়ায় শরীর ও মনের উপর প্রচন্ড চাপের সৃষ্টি হয়। ডিপ্রেশন হয়। প্রথমবার সাফল্য আসেনি। ২০১৩-তে মিসক্যারেজ হওয়ার পর মানসিক ভাবে ভেঙে পড়েছিলাম। আমার পেশা তখন আমাকে সাহায্য করেছিল মনকে শক্ত করতে। নাটকের মাধ্যমে মেয়েদের কষ্টের, লড়াইয়ের কাহিনি দর্শকদের মধ্যে পেৌঁছে দিয়েছি। তখন অন্য অনেক মায়েদের লড়াইয়ের কাছে নিজের লড়াইকে অনেক নগণ্য মনে হয়েছে। শুধু তাদের থেকে আমার পার্থক্য এইটুকুই যে, পরিস্থিতির চাপে পড়ে নয়, নিজের চয়েস-এ আমি সিংগল মাদার হয়েছি। এই পুরো প্রসেস-টাতে মনকে আরও শক্ত করে গড়ে তুলেছি।
সমাজ-কে কী বার্তা দিতে চান?
দেখুন আমি, আপনি আরও অনেক মানুষ মিলেই এই সমাজ। আজ আমার ছেলে ২ বছরের। ওকে মানুষ করতে আমার কোনও অসুবিধে হচ্ছে না, মনের মতো মানুষ করছি। পৃথিবীতে একটা ভালো মানুষকে রেখে যাওয়ার মতো সমস্ত মূল্যবোধ আমার আছে। আমার বিশ্বাস, আমার লড়াইকে ছেলের মধ্যে দিয়ে আরও এক পা এগিয়ে নিয়ে যেতে পারব। পৃথিবীকে সকলের জন্যই একটা সুন্দর জায়গা হিসেবে গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখি।