সারা বিশ্বজুড়ে করোনায় আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা ক্রমশ বেড়েই চলেছে। আমাদের দেশেও এর ব্যতিক্রম নয়। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে নতুন আর একটি সংক্রমণ যার নাম কালো ছত্রাক বা ব্ল্যাক ফাংগাস। করোনার হাত থেকে বাঁচার জন্য এখন সোশ্যাল ডিস্ট্যানসিং এবং কোয়ারেন্টাইন-এ থাকা হল একমাত্র উপায়। দেশের সরকার সবদিক বিবেচনা করেই দেশজুড়ে লকডাউন পালন করার নির্দেশ দিয়েছেন।
লকডাউন চলাকালীন মানুষ গৃহবন্দি অবস্থায় দিনের পর দিন কাটাচ্ছে। খুব প্রয়োজন না হলে বাইরে ঘোরাফেরা করা এখন আইনত অপরাধ বলে গণ্য হচ্ছে। কাজকর্ম ছেড়ে, রুজি-রোজগার ছেড়ে বাধ্য হচ্ছে মানুষ বাড়িতে বসে থাকতে। ফলে অবসাদ বাড়ছে, একই সঙ্গে বাড়ছে নানা মানসিক সমস্যা। করোনার সংক্রমণ যেমন প্রাণঘাতী প্রমাণিত হয়েছে, তেমনি এটাও প্রমাণিত যে এই একই কারণে মানুষের মানসিক সমস্যাও লাগাতার বেড়ে চলেছে। খবরের কাগজ, টিভির নিউজ, আশেপাশের পরিস্থিতি একই সাক্ষ্য বহন করছে।
সম্প্রতি একটি রিপোর্টে দেখা গেছে, করোনা ভাইরাস না থাকা সত্ত্বেও শুধুমাত্র লকডাউনের কারণে মানুষ আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে। একাকিত্ব, করোনা সংক্রমণের ভয়, আর্থিক মন্দা, ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা মানুষকে বেশি করে আত্মহননের পথ বেছে নিতে বাধ্য করছে। মানুষ মানসিক ভারসাম্য হারাচ্ছে।
লকডাউনের কারণে নেশার সামগ্রী না পেয়ে মানুষের মধ্যে উইথড্রয়াল সিনড্রোমের মতো পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে। সহজে নেশার জিনিসগুলো হাতে না পাওয়ায় মানুষ পেইন্ট, ভার্নিশ, স্যানিটাইজার যা পাচ্ছে তাই খাচ্ছে। এতেও মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে সংক্রমণ ছাড়াই। বাইরে বেরোতে মানুষ যতটা ভয় পাচ্ছে, বাড়িতে থাকার ফলে অবসাদও ততটাই বাড়তে থাকছে। অবসাদ ভুলতে মানুষ নেশায় বেশি করে আসক্ত হয়ে পড়ছে। অবসাদের সঙ্গে রয়েছে ভবিষ্যতের চিন্তা। এই সব কিছুই প্রভাব ফেলছে মানুষের মেন্টাল হেল্থ-এর উপর।
নানা রকম রোগে ভুগছে বহু মানুষ। কেউ বিনিদ্র রাত যাপন করছে, কেউ দুঃস্বপ্ন দেখে ঘুম থেকে জেগে উঠছে। মানুষের সন্দেহ বাড়ছে, সমাজতন্ত্রের উপর বিশ্বাস হারিয়ে ফেলছে মানুষ। হাসপাতালে এই ধরনের রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। নেতিবাচক জীবনবোধ মানুষের মানসিক অস্থিরতা বাড়াচ্ছে বলেই মনে করছেন মনোবিজ্ঞানীরা। এর থেকে বেরিয়ে আসার একমাত্র উপায় হল পজিটিভ চিন্তাভাবনা। কনস্ট্রাকটিভ কাজের মাধ্যমে নিজেকে এবং বাড়ির সকলকে এই পরিস্থিতি থেকে বার করে নিয়ে আসার প্রয়াস করতে হবে।
সর্বক্ষণ ভয়ে পরিস্থিতি বাচ্চাদের মনে ফোবিয়া সৃষ্টি করতে পারে, যার পরিণাম ভবিষ্যতে সাংঘাতিক প্রমাণিত হতে পারে। সারাক্ষণ বাড়ির ভিতর করোনা নিয়ে চর্চা এবং সংক্রমণের শঙ্কা না করে নানা ধরনের গঠনমূলক কাজে বাচ্চা এবং বাড়ির বয়স্ক ব্যক্তিদের ব্যস্ত রাখতে পারলে সবথেকে ভালো হয়। বিভিন্ন হাসপাতালের ডাক্তারদের সঙ্গে কথা বলে একটা জিনিস পরিষ্কার, তাঁরা সারাদিনে মানুষের অসুস্থতা সংক্রান্ত বহু কল পাচ্ছেন। তার মধ্যে ৩০ শতাংশই মানুষ সারাদিনের রুটিন ঠিকমতো মানতে পারছে না বলে, নেগেটিভ চিন্তার শিকার হয়ে ডাক্তারদের সমস্যার কথা জানাতে কল করছে।
ক্লিনিকাল সাইকোলজিস্ট মীনাক্ষী ভট্ট-এর সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, বেশিরভাগ মানুষই তাদের দৈনন্দিন জীবনের এই আমুল পরিবর্তনের সঙ্গে কিছুতেই সামঞ্জস্য বজায় রাখতে পারছে না। লকডাউনের কারণে ব্যাবসা, চাকরি, রুজি-রোজগার এবং জমানো অর্থরাশি হারাবার ভয়ও মানুষকে অবসাদের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
ইন্ডিয়ান সাইকায়াট্রিক সোসাইটি-র দেওয়া জরুরি তথ্য অনুয়াযী করোনা ভাইরাসের কারণে দেশে মানসিক রোগীর সংখ্যা প্রায় ১৫ থেকে ২০ শতাংশ বেড়ে গেছে। নিজের পরিবারের কাছে ফিরতে না পেরে, করোনা হওয়ার ভয়ে ভবিষ্যত অনিশ্চয়তার দুশ্চিন্তায়, বহু মানুষ আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছেন। যেটা বিশ্বজুড়ে আজ সবথেকে চিন্তার বিষয়। এর জন্য দাযি হচ্ছে মানুষের মধ্যে সচেতনতা এবং সুযোগ সুবিধার অভাব।
ফেব্রুয়ারি-তে লন্ডনের কিমস কলেজ থেকে কোয়ারেন্টাইন-এর সঙ্গে যুক্ত বিভিন্ন কেস নিয়ে রিসার্চ করে ২৪টি পেপার জমা দেওয়া হয় এবং এগুলি মেডিক্যাল জার্নাল লেনসিপ-এ প্রকাশিত হয়। এই রিভিউ অনুসারে কোয়ারেন্টাইনে যারা রয়েছেন তাদের মধ্যে অর্ধেকের বেশি লোকের মধ্যে ডিপ্রেশন-এর লক্ষণ প্রকট হতে দেখা গেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে এক জায়গায় বদ্ধ হয়ে থাকার ফলে এবং সামাজিক সম্পর্ক কমে যাওয়ার কারণেই এই সমস্যাগুলি মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে।
করোনার কারণে মানুষ ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে উঠছে
কলকাতার বাসিন্দা তাপস ঘোষ রাত্রে ঘুমোতে পারছেন না। দুঃস্বপ্ন দেখে জেগে উঠছেন। লকডাউনের কারণে তাঁর নিজস্ব ব্যাবসা এখন বন্ধ অবস্থায় পড়ে আছে। ভবিষ্যতের দুশ্চিন্তা তাঁর ঘুম কেড়ে নিয়েছে। তিনি এই সমস্যা থেকে বেরোতে নিয়মিত সাইকায়াট্রিস্ট কনসাল্টটেন্ট-এর সাহায্য নিচ্ছেন। আত্মহত্যার প্রবণতা, বাইপোলার ডিসঅর্ডার বাড়ছে মানুষের মধ্যে। নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন এডস রোগীরা, বয়স্করা, বাচ্চার অভিভাবকেরা। একা যারা রয়েছেন বা পরিবার থেকে দূরে রয়েছেন, তারাও মানসিক সমস্যার শিকার হচ্ছেন বেশি। এছাড়াও সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়ানো গুজবও গোদের উপর বিষফোড়া হয়ে দাঁড়িয়েছে।
মানসিক ভাবে সুস্থ লোকও হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ছে
সাইকায়াট্রিস্ট রঞ্জন ঘোষ জানালেন, করোনার সংক্রমণের কারণে লোক ভিড়ে যেতে ভয় পাচ্ছে। লকডাউনের কারণে বহু মানুষ বাড়ি থেকে কাজ করতে বাধ্য হচ্ছে। তার মানে যে-জীবনটায় আমরা অভ্যস্ত ছিলাম সেটা পুরো বদলে ফেলে নতুন করে জীবনশৈলী গড়ে নিতে হচ্ছে। এর ফলে মনের উপর গভীর চাপ সৃষ্টি হচ্ছে। এছাড়া নানা গুজবও এইসময় মস্তিষ্ককে প্রভাবিত করছে। জীবনধারণের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনায় আক্রান্ত রোগী, কোয়ারেন্টাইন বা আইসোলেশনে থাকা ব্যক্তি, এমনকী মানসিক সমস্যা আগে থেকেই রয়েছে এমন মানসিক রোগীদের মস্তিষ্কের উপরেও, করোনার চিন্তা ও ভয় প্রতিকূল প্রভাব ফেলছে। এর ফলে দেশে অবসাদ, অ্যাংজাইটি, ডিপ্রেশন এবং মানসিক রোগীর সংখ্যা ২০ শতাংশ বেড়ে গেছে।
এই পরিস্থিতিতে নিজের মানসিক স্বাস্থ্যের খেয়াল রাখা খুব জরুরি হয়ে পড়েছে। বিশেষ ভাবে যারা আগে থেকেই মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছেন, তাদের বিশেষ খেয়াল রাখা খুব দরকার। লকডাউন চলাকালীন আরও একটা বড়ো সমস্যা হল শারীরিক স্থিতি হঠাৎ করে খারাপ হয়ে পড়লেও ডাক্তারের কাছে সঙ্গে সঙ্গে নিয়ে যাওয়া এই পরিস্থিতিতে সম্ভব নয়। সুতরাং সমস্যা থেকে কিছুটা মুক্তি পেতে এই ৫টি উপায় মেনে চলতে চেষ্টা করুন :
১) ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া করুন : স্ট্রেস, চিন্তা, অবসাদের কারণে খিদে কম পায়। খিদে থাকলেও খেতে ইচ্ছে করে না। সঠিক পুষ্টি না পাওয়ায় সমস্যা আরও বাড়ে। সুতরাং খাওয়া বন্ধ করবেন না কোনও অবস্থাতেই এবং পুষ্টিকর ডায়েট ফলো করার চেষ্টা করুন
২) এক্সারসাইজ ও যোগব্যায়াম : অবসাদ, চিন্তা দূর করতে এক্সারসাইজ করলে সুফল পাবেন। মন শান্ত থাকবে, পজিটিভ চিন্তাভাবনা করবেন। যোগব্যায়ামও লকডাউনে মন ও শরীর ফিট রাখতে সাহায্য করবে
৩) আপনজনদের সঙ্গে থাকুন : বাইরের লোকের সঙ্গে সোশ্যাল ডিসট্যান্সিং মেনে চলুন কিন্তু বাড়ির লোকেদের সঙ্গে বেশি সময় কাটান, কথা বলুন। বাচ্চাদের বেশি করে সময় দিন, পুরোনো ফটোগ্রাফ বার করে পুরোনো দিনগুলো মনে করুন। আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ রাখুন। অলস মস্তিষ্ক শয়তানের বাসা, চুপ করে বসে থাকলেই চিন্তা আর ডিপ্রেশন চেপে ধরবে। সবসময় পজিটিভ চিন্তা করুন
৪) বই পড়ুন, গান শুনুন, পর্যাপ্ত ঘুমোন : সোশ্যাল মিডিয়ায় ভুলভাল পোস্ট না দেখে, পছন্দের বই পড়ুন, এতে পজিটিভ এনার্জি বাড়বে। কিছুটা গান শুনে সময় কাটান। মনে শান্তি পাবেন, আত্মবিশ্বাসও বাড়বে। ঘুম সম্পূর্ণ না হলে দুশ্চিন্তা মনে বাসা বাঁধবে। অ্যাংজাইটির কারণে নেগেটিভ চিন্তাভাবনা মনের মধ্যে আসতে থাকে। সুতরাং ভালো করে ঘুমোন
৫) পজিটিভ চিন্তাভাবনা করুন এবং কোনওরকম নেশায় আসক্ত হয়ে পড়বেন না : করোনা সংক্রান্ত খবর জানাটা জরুরি কিন্তু সব খবরই যে সত্যি তার কোনও অর্থ নেই। সুতরাং সোশ্যাল মিডিয়ার খবর দেখে বিচলিত হবার দরকার নেই। চিন্তা ও সমস্যার কারণে মানুষ নেশায় আসক্ত হয়ে পড়ে। হয়তো কিছুটা সময় সব ভুলে নিশ্চিন্তেও কাটানো যায়। কিন্তু পরে আরও বেশি অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়তে হয় এবং ইমিউনিটিও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সুতরাং অবসাদ বোধ করলে ডাক্তারের সঙ্গে ফোনে কথা বলুন। ডাক্তার যদি ওষুধ প্রেসক্রাইব করেন অবসাদ ও অ্যাংজাইটির জন্য, তাহলে সেটা খান। ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া কোনও ওষুধ খাবেন না। খেলে সেটা আপনার শরীরের ক্ষতি করতে পারে।