হালসময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে লাইফ স্টাইল বজায় রাখতে গিয়ে সবাই এত কেরিয়ারিস্ট হয়ে পড়ছেন যে, জীবনের অন্যান্য আবেগ ও রসায়নের দিকে আর সেভাবে নজর দিয়ে উঠতে পারছেন না। সাংসারিক জীবনে যার সরাসরি প্রভাব মারাত্মক বিপদ ডেকে আনছে। একে-অপরকে সময় দিতে না পারার ক্ষতটা অঘোষিত ভাবে একটা দূরত্ব তৈরি করছে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে।

দুজন অচেনা-অপরিচিত মানুষ অনেক আশা নিয়ে একে-অপরের সাথে গাঁটছড়া বাঁধেন সুখ-দুঃখ ভাগ করে নেওয়ার দায়বদ্ধতা থেকে। তবে কখনও কখনও নতুন সম্পর্ককে ঘিরে তৈরি হয় হতাশা আর অবসাদ। আর এর থেকে বাঁচতে অনেকেই সেপারেশন-এর পথ বেছে নিচ্ছেন। এর একটা বড়োসড়ো কারণ হল অ্যাডজাস্টমেন্ট-এর অভাব, একে-অপরকে খাটো করে দেখা। বিশেষ করে স্বামী-স্ত্রী উভয়েই যদি চাকরি করেন এবং কমবেশি মোটা অঙ্কের বেতন পেয়ে থাকেন, সেক্ষেত্রে সমস্যা আরও প্রকট হয়ে দাঁড়ায়।

এমনটা কেন হয়?

বিয়ের পর উভয়েরই একে-অপরের প্রতি প্রত্যাশা অনেক বেড়ে যায়। কর্মব্যস্ততার কারণে যখন সেই প্রত্যাশা পূরণ হয় না, তখনই সম্পর্কে তিক্ততা নেমে আসে। পাওয়া না পাওয়ার ক্ষোভ থেকেই সৃষ্টি হয় অশান্তির। দীর্ঘদিনের এই লড়াইয়ে অনেকেই মানসিক অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়েন। কেউ কেউ আবার আশ্রয় নেন অ্যালকোহলের। ফলে স্বাভাবিক কারণেই তৈরি হয় দূরত্ব।

বিবাহ হল দুটি মানুষের শরীর-মনের মেলবন্ধন। তবে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া মানে এই নয় যে দুটি মানুষের চিন্তাভাবনা এক হবে। সেটা কখনওই সম্ভব নয়। চরিত্রগতভাবেও দুটো মানুষ ভিন্ন। কেউ হয়তো অতিমাত্রায় অন্তর্মুখী কেউ আবার কথা বলতে ভালোবাসেন। কারওর খরচের হাত বেশ লম্বা, কেউ বা আবার একটু সংযমী। সেক্ষেত্রে সঙ্গী যদি তার উলটোদিকের মানুষটাকে একটু সংযমী হতে শেখান, তাহলে ক্ষতিটা কোথায়? ঠিক সেইরকম হতেই পারে, পার্টনারের কেউ একজন অতিমাত্রায় সংবেদনশীল, আবার উলটোদিকের মানুষটি একটু রুক্ষ প্রকৃতির। তাতে কী! সংসারে ওঠা-পড়া, খুনশুটি একটু রাগারাগি তো থাকবেই। সেগুলিকে কাটিয়ে উঠে ভালো থাকার নামই তো হল সংসার। না হয় ভালো থাকার জন্য একটু কমপ্রোমাইজ করলেন-ই।

কোনও সম্পর্কে যদি অ্যাডজাস্টমেন্ট শব্দটার গ্রহণযোগ্যতা না থাকে সে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখা মুশকিল। আর সেখানে যদি ইগো মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে তাহলে তো কথাই নেই। বলাই বাহুল্য, এরকম সম্পর্ক ভাঙার জন্যই গড়ে ওঠে। শহরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এমন অনেক ঘটনার সাক্ষী আমরা নিজেরাও। উদাহরণস্বরূপ একটি ঘটনা তুলে ধরা হল আপনাদের সামনে।

রিয়া আর অনীশের সম্পর্ক দীর্ঘদিনের। প্রায় সাত বছরের সম্পর্ক। একই কোম্পানিতে চাকরি করতে করতে প্রেম গড়ে ওঠে তাদের মধ্যে। দীর্ঘ ছয় বছর প্রণয়ের পর তারা বিয়ের সিদ্ধান্ত নেয়। সেইমতো বিয়েও হয় তাদের। কিন্তু বিয়ের মাস চারেক যেতে না যেতেই, লাঠালাঠি কাটাকাটি। অথচ বিয়ের আগে পর্যন্ত তাদের সম্পর্ক ছিল চোখে পড়ার মতো। তাদের ভালোবাসা দেখে অনেকেই ঈর্ষান্বিত হতো। কিন্তু বিয়ের পরে পরেই সম্পর্কটা কেমন যেন তিক্ততার পর্যায়ে চলে যায়। এক্ষেত্রে অনীশের এক্সপেক্টেশন ছিল অনেক বেশি। বিয়ের পরে সংসারের সমস্ত দায়িত্ব নাকি মেয়েদেরই বহন করতে হয়। সে যেহেতু পুরুষ, তাই কখনওই বাসন মাজা বা রান্নার কাজ সে করতে পারে না, এতে নাকি তার পৌরুষত্বে বাধে। স্বাভাবিক কারণেই সারাদিন অফিস করে ফেরার পর সংসার সামলাতে রীতিমতো হিমশিম খেতে হয় রিয়াকে। মাসের পর মাস এভাবে আপোষহীন ভাবে চলতে থাকার ফলে হাঁপিয়ে ওঠে রিয়া। অবশেষে একদিন সংসারে ইতি টানা। কোর্টের দ্বারস্থ হওয়া।

আবার এমনও দেখা গেছে। মেয়েটির আয় ছেলেটির তুলনায় অনেক বেশি। বিয়ের আগে এই ব্যাপারটিই খুব সহজ ভাবে নেওয়া ছেলেটি, হঠাৎ করেই কেমন যেন ইগোতে নিতে শুরু করেছে। ছোটোখাটো কথাকেই গায়ে মাখতে শুরু করেছে সে। নিজের অজান্তেই কখন স্ত্রীকে নিজের প্রতিদ্বন্ধী ভাবতে শুরু করেছে। মেয়েটি বহু চেষ্টা সত্ত্বেও এই ইগো থেকে বার করে আনতে পারেনি স্বামীকে। একটা সময় পর ক্লান্ত হয়ে মেয়েটিও কেমন যেন গুটিয়ে নিতে থাকে নিজেকে। এভাবেই একটু একটু করে চোখের সামনে সম্পর্কটা শেষ হয়ে যায়। প্রথমে আলাদা থাকা। তারপর পাকাপাকি ব্যবস্থা করা। যেন এই সম্পর্কটা থেকে বেরিয়ে আসতে পারলে দুজনেই স্বস্তির নিঃশ্বাস নিতে পারবে।

ভাবলে অবাক হতে হয়, এই সম্পর্ককে নিয়ে বিয়ের আগে তারা কতই না স্বপ্ন দেখেছে। কতকিছু প্ল্যান করেছে আগে থেকে। এমনকী বহুক্ষেত্রে দেখা গেছে, নিজের ভালোবাসার সম্পর্ক বাঁচাতে গিয়ে বাড়ির লোকেদের সঙ্গে সম্পর্ক পর্যন্ত ছেদ করেছে তারা। অথচ সেই সম্পর্কের কী পরিণতি! শুধুমাত্র অ্যাডজাস্টমেন্ট-এর অভাবে সম্পর্কগুলো কেমন যেন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে।

সমস্যা যে শুধু পুরুষদের তরফ থেকেই হচ্ছে এমনটা কিন্তু নয়। এর জন্য সমানভাবে দায়ী মেয়েরাও। অতিরিক্ত উচ্চাশা, নতি স্বীকার না করা, পরিবার থেকে সরে গিয়ে আলাদা থাকার প্রবণতা– এগুলো ভীষণ ভাবে সংসারের উপর নেতিবাচক ছাপ ফেলে। পুরুষ-মহিলা নির্বিশেষে সকলকেই সংসারের দায়ভার বহন করতে হবে। তাহলে বোধহয় অনেকাংশে সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।

সমীক্ষায় দেখা গেছে, অ্যারেঞ্জড্ ম্যারেজের তুলনায় লভ ম্যারেজে বিবাহ-বিচ্ছেদ হওয়ার সংখ্যাটা অনেক বেশি। কারণ সেখানে অ্যাডজাস্টমেন্ট-এর জায়গাটা অনেক বেশি। তারা জানেন সারাজীবন একসাথে থাকতে গেলে, সম্পর্ক মধুর করতে হলে একে-অপরকে বুঝতে হবে, নতুন করে জানতে হবে, অজানা পরিবেশে, অপরিচিত মানুষের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে হবে। সুতরাং তাদের এই মানসিক পূর্বপ্রস্তুতিই তাদের অনেকটা এগিয়ে রাখে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে।

বলাই বাহুল্য, যে-সমস্ত পুরুষ এখনও সেই প্রাচীন চিন্তাভাবনা নিয়ে বসে আছেন, যে অর্থ উপার্জন করলেই সংসারের প্রতি তার সমস্ত দায়ভার শেষ– তারা অবিলম্বে নিজেকে বদলে ফেলুন। নিজের জায়গা থেকে সরে এসে স্ত্রী-য়ের সঙ্গে মিলেমিশে সংসারে হাত লাগান। দেখবেন সম্পর্কের ইক্যুয়েশনটাই চেঞ্জ হয়ে গেছে। সঞ্জীব কপূরের কথা ভেবে দেখুন, আজ তিনি ওয়ার্ল্ড ফেমাস শেফ। তিনিও একজন পুরুষ, এটা যদি নিতান্তই মহিলাদের-ই কাজ হতো, তাহলে তিনি কেন এটাকে প্রফেশন হিসাবে বেছে নিলেন। একটু অ্যাডজাস্ট করতে শিখুন, দেখবেন ভালো থাকবেন।

কী করবেন

১)  কেরিয়ারের কথা অবশ্যই ভাববেন, কারণ ভালোভাবে বাঁচতে গেলে, লাইফস্টাইল মেনটেইন করতে গেলে টাকাটা ভীষণ প্রয়োজন। তবে তার মানে এই নয় যে সংসার, স্বামী সবকিছু ভুলে টাকার পিছনে ছুটবেন। এমন অনেক মহিলাই আছেন যারা অফিস সামলেও সুন্দর ভাবে সংসার করছেন। আপনিও পারবেন। অযথা রাগারাগি না করে স্বামীকে বোঝান, দেখবেন ঠিক বুঝবেন। আপনাকে হেল্পও করবেন।

২)  স্বামী বা স্ত্রী যখন কোনও বিষয়ে কমেন্ট করে, শুরুতেই রিঅ্যাক্ট করবেন না। আগে বুঝুন কেনও কথাগুলো বলছেন। অনৈতিক মনে হলে বিতর্কে না গিয়ে বোঝান।

৩)  সংসার থাকলে টুকটাক অশান্তি লেগে থাকবে। এসব নিয়ে ডিপ্রেসড্ হয়ে যাওয়ার কোনও কারণ নেই। বরং জানবেন যেখানে যত বেশি প্রেম, ভালোবাসা, এক্সপেক্টেশন, সেখানে তত বেশি অশান্তি। তাই বলব অ্যাডজাস্ট করতে শিখুন।

৪)  কাজ ভাগ করে নিন।

৫)  সুযোগ পেলেই কাছে-দূরে বেড়িয়ে আসুন।

৬)  চেষ্টা করুন সপ্তাহে অন্তত একদিন রেস্টুরেন্টে খেতে যেতে।

৭)  আপনার কাছের মানুষটিকে মাঝেমধ্যে তার পছন্দমতো গিফ্ট দিয়ে তাকে অবাক করে দিন। আপনার পার্টনারের ভালো লাগবে।

৮)  মন খুলে তারিফ করুন।

৯)  মহিলা বলে নিজে থেকে এগিয়ে গিয়ে স্বামীকে আদর করবেন না বা কাছে টানবেন না, এরকম ধারণা থাকলে বদলে ফেলুন। সঙ্গীকে কাছে টেনে নিন।

১০)  অনেকে বাচ্চা সামলাতে গিয়ে স্বামীর কথা বেমালুম ভুলে যান। এটা একেবারেই উচিত নয়, স্বামীকে সময় দিন।

 

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...