মউপিয়া বছর আঠারোর এক তরুণী৷ সে বারে বারে ছেলেদের প্রেমে পড়ে এবং সঙ্গে সঙ্গে তা ভীষণ গভীর ও সিরিয়াস রূপ নেয়। প্রেমিকা হিসেবে সে প্রচণ্ড দাবিদার, যার ফলে ঘনঘন ঠোকাঠুকি, ঝগড়াঝাঁটি এবং তার ফলে ব্রেক-আপ। এই ব্রেক-আপ আবার সে নিতেও পারে না। এই সময়ে মারামারি এবং নিজেকে আঘাত করতে শুরু করে ব্লেড দিয়ে হাত কেটে, সিগারেট দিয়ে শরীরের এখানে ওখানে ছ্যাঁকা দিয়ে এমনকী মানুষজনকে (বিশেষ করে প্রেমিককে) শাসায়, ভয় দেখায় আত্মহত্যা করে ফেলার। শেষ ব্রেক-আপের সময় বাঁহাতের কবজির শিরা কেটে আত্মহত্যার চেষ্টাও একবার করেছিল।

মউপিয়া কাজকর্মে সিরিয়াস নয়, খুবই সামান্য ওর অ্যামবিশন।তার বাবা-মা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত কারণ সে কেরিয়ারের বিষয়েও একদমই সিরিয়াস নয় অথচ প্রেম-ভালোবাসার ব্যাপারে অত্যধিক বেশি সিরিয়াস। তাদের কোনও ধারণাই ছিল না যে ও বর্ডারলাইন পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডার নামে এমন এক অসুখে ভুগছে যার নিরাময় অত্যন্ত জটিল বিষয় এবং যা তার জীবনটাই ছারখার করে দিতে পারে।

বিপিডি একধরনের রোগাবস্থা– যার মূল বৈশিষ্ট্য তাৎক্ষণিক আচরণ, চটজলদি পরিবর্তনশীল মুড এবং গোলমেলে ভালোবাসার সম্পর্ক। রোগী সাধারণত একটার পর একটা ইমোশনাল ক্রাইসিসে ভুগতে থাকেন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই পরনির্ভরতা, বিচ্ছেদের কারণে অতি উদ্বেগ, নড়বড়ে সেলফ-ইমেজ, বহুদিন ধরে শূন্যতার অনুভূতি এবং নিজের ক্ষতি করার হুমকি দেওয়া, এই সব দেখা যায়। এই ধরনের মানুষেরা ছোটো থেকেই অনুভূতিগত ভাবে নড়বড়ে, রাগি, বদমেজাজি, আক্রমনাত্মক এবং হঠকারি। এভাবেই তারা বড়ো হয়ে ওঠে। এদের প্রেম-সম্পর্ক অত্যন্ত তীব্র, বদ্ধ কিন্তু ভঙ্গুর। এরা প্রেম সম্পর্ক-কে একবার মাথায় তুলে নাচে, আর একবার পায়ের নীচে দলে-পেষে। এরা একবার বলে ‘তুমিই আমার সব’, তো আর একবার গালাগাল দিয়ে ভূত ভাগিয়ে দিতে কসুর করে না।

এরা প্রকৃত বা কাল্পনিক বিচ্ছেদ এড়ানোর জন্য প্রাণপণ প্রচেষ্টা করে, এদের মধ্যে কতগুলো নেতিবাচক ভাবাবেগ থাকে যেমন অ্যাংজাইটি, ডিপ্রেশন, অপরাধবোধ, লজ্জা, দুশ্চিন্তা। এদের মেজাজ ঘনঘন পালটায় এবং এদের চণ্ডাল রাগ। এই তীব্র ভাবাবেগের ঘটনাগুলো কিন্তু মাত্র কয়েক ঘণ্টা চলে এবং কালেভদ্রে খুব বাড়াবাড়ি কেসে কয়েকদিন স্থায়ী হতে পারে।

বারবার আত্মহত্যার চেষ্টা এবং নিজেকে আঘাত করা একমাত্র গভীর রোগাক্রান্তদের মধ্যেই দেখা যায়। রোগীর ঘুমের প্রয়োজন কমে যায়, সে অতিসক্রিয় হয়ে ওঠে, দ্রুত কথা বলতে থাকে, অন্যের সঙ্গে অতিমাত্রায় জড়িয়ে পড়ে এবং অযথা আতিশয্য দেখাতে থাকে।

এই অসুখটির প্রকোপ যৌবনের শুরুতেই বেশি থাকে এবং বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ক্রমশ কমতে থাকে। রোগীরা চল্লিশোর্ধ হলে সম্পর্কে এবং কর্মজীবনে অনেকটা স্থিতি লাভ করে। আট থেকে দশ শতাংশ বিপিডি রোগী আত্মহত্যা সম্পূর্ণ করেন। কিন্তু এই রোগীদের মধ্যে কেটে, পুড়িয়ে, ছ্যাঁকা দিয়ে নিজেকে আহত করার প্রবণতা বা আত্মহত্যার হুমকি ও প্রচেষ্টা খুবই কমন। ঘনঘন চাকরি খোওয়ানো, শিক্ষায় ব্যাঘাত আর বিবাহবিচ্ছেদও খুব কমন।

চিকিৎসা

দীর্ঘদিন ধরে সাইকোথেরাপি, বিশেষ করে ডায়ালেকটিকাল বিহেভিয়ার থেরাপি এই বিপিডি রোগের চিকিৎসার পদ্ধতি।যারা এর সাথে ডিপ্রেশন এবং অ্যাংজাইটিতে ভুগছেন তাদের ক্ষেত্রে ওষুধও প্রয়োজন।

পরিবারের সদস্যদের কী করতে হবে?

  • লক্ষ্যস্থির করতে সাহায্য করুন৷মনে রাখবেন পরিবর্তন আনা কঠিন কাজ। কখনওই বলবেন না ‘তোমার প্রচুর উন্নতি হয়েছে’ বা ‘তুমি নিশ্চয়ই পারবে। উন্নতির কথায় পরিত্যক্ত হওয়ার আশঙ্কা জন্মাতে পারে।
  • আপনার প্রত্যাশা নামিয়ে আনুন, বাস্তব ভিত্তিক লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করুন যেগুলো পূরণ করা সম্ভব। বড়ো সমস্যাটিকে ছোটো ছোটো ধাপে সমাধান করুন, কারণ বড়ো বড়ো দীর্ঘ মেয়াদি লক্ষ্যমাত্রার ক্ষেত্রে ব্যর্থতা ও অসন্তুষ্টি আসতে পারে। এতে উদ্যম নষ্ট হতে পারে।
  • পারিবারিক পরিবেশ শান্ত রাখুন৷ সব কিছুতে  অবিচলিত থাকুন। প্রশংসা স্বাভাবিক হতে হবে। তার মাত্রা কমিয়ে আনুন। নিন্দাও স্বাভাবিক। তার মাত্রাও কমিয়ে আনুন।
  • রোগী যখন রাগের নিয়ন্ত্রণহীন অবস্থার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছেন তখন ধৈর্য ধরুন।
  • রোগীকে একা বোধ করার সুযোগ দেবেন না।
  • এদের ধারণাগুলো চূড়ান্ত ধরনের হয়, কিছু ভালো নয়, সব খারাপ এমনটাই ভেবে নেয়৷ এ বিষয়েও ধৈর্য ধরতে হবে।
  • রোগীর সঙ্গে হালকা, অবিতর্কিত বিষয় নিয়ে কথা বলার সময় বার করুন।
  • ক্রাইসিস সামলাতে ওর উপর নজর রাখুন কিন্তু শান্ত থাকুন
  • দোষারোপ বা নিন্দার মুখোমুখি হলে অফেন্সিভ হবার দরকার নেই, লড়ে যাবেন না।
  • বাবা ও মায়ের একমত হয়ে থাকাটা খুব জরুরি।
  • মারধর, থুতু ছেটানো, হুমকি ইত্যাদি খারাপ ব্যবহার বরদাস্ত করবেন না। তখনকার মতো চলে গিয়ে পরে ফিরে এসে বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করবেন।
  • আত্মহননকারি কাজ বা হুমকি উপেক্ষা করবেন না। চেপে না রেখে পরিবারের অন্য সদস্যদের জানান। চিকিৎসারত প্রফেশনালকে জানান।
আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...