কথায় বলে, ‘শুধু ভালোবাসায় চিঁড়ে ভেজে না’। তাই, পিতৃত্বের অহংকারকে সার্থক করতে হলে, সন্তান প্রতিপালনে মায়ের মতো বাবাকেও নিতে হবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। শিশু মাতৃগর্ভে থাকাকালীন এবং পৃথিবীর আলো দেখার পর, কীভাবে তার যত্ন নিতে হবে, তা এক শিক্ষণীয় বিষয়। আর এই জ্ঞান বা শিক্ষা যদি সঠিকভাবে শিশুর পিতার না থাকে, তাহলে কী করুণ পরস্থিতি হতে পারে, তা ‘শাদি কা সাইড এফেক্ট’ ছবিতে সার্থক ভাবে তুলে ধরা হয়েছে।

এখন পরিবার ছোটো হয়েছে কিন্তু স্বপ্ন বা ইচ্ছে বদলায়নি। সব দম্পতিই চান তাদের দাম্পত্যের অস্তিত্ব বা উত্তরাধিকারী। কিন্তু সন্তানের যত্ন নেওয়া এবং বড়ো করে তোলার গুরুদায়িত্বের কথা ভেবে অনেক মহিলাই দুর্ভাবনায় থাকেন। তাকে একা সমস্ত দায়িত্ব পালন করতে হবে, এই ভয়ে আজকাল মা হতে দেরি করেন অনেকে। আসলে, শুনতে অপ্রিয় হলেও সত্যিটা এই যে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সন্তানের যত্ন-আত্তির দায়িত্ব নিতে হয় মা-কেই, বাবা শুধু অর্থের জোগান দিয়ে কর্তব্য পালন করেন। তাই, বিয়ের বছর পাঁচের পর যদিওবা সন্তানলাভ হল, একা সমস্ত দায়িত্ব পালনের ঝামেলার কারণে, ‘এর থেকে আগের জীবনই ভালো ছিল’ এমন আক্ষেপও করতে দেখা গেছে অনেক মহিলাকে। আসলে আধুনিক জীবনশৈলীতে গ্রাম কিংবা শহর সর্বত্রই স্বামী এবং স্ত্রী দুজনেই কর্মজীবন নিয়ে ব্যস্ত। কাজেই, সন্তান প্রতিপালনের ক্ষেত্রে স্বামী যদি স্ত্রীর মতো সমানভাবে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে না দেন, তাহলে সংসারে অশান্তি বাধবেই এবং বাচ্চাও অবহেলিত হবে। অতএব, পিতৃত্বের অহংবোধ তখনই সার্থক হবে, যদি সন্তানের লালনপালনের অর্ধেক দায়িত্ব মাথায় তুলে নিতে পারেন। অবশ্য এরজন্য সঠিক পরিকল্পনা এবং তার বাস্তব রূপায়ণ করতে হবে।

বার্থ প্ল্যান

স্বামীকে প্রথমেই নিজের ‘মেল ইগো’ দূরে সরিয়ে রাখতে হবে। নতুন ‘অতিথি’কে আমন্ত্রণ জানানোর আগে, একা সিদ্ধান্ত না নিয়ে স্ত্রীকে শুভাকাঙক্ষী ভেবে আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। প্রথমেই গুরুত্ব দিতে হবে বয়সকে। খুব কম বয়সেও নয় এবং বেশি বয়সেও নয়, স্বামী-স্ত্রীর বয়স তিরিশের আশেপাশে হলেই বার্থ প্ল্যান বা ইস্যু প্ল্যান করা উচিত। দ্বিতীয়ত, স্বামী-স্ত্রীর মাসিক উপার্জনের বিষয়টিকেও গুরুত্ব দিতে হবে। কারণ, সন্তান হওয়ার আগে-পরে যে বিপুল অর্থের প্রয়োজন, সেই বিষয়ে যাতে কোনও সমস্যায় না পড়তে হয়, তারজন্য মাসে অন্তত তিরিশ হাজার টাকা পারিবারিক আয় থাকা বাঞ্ছনীয়।

বাজেট তৈরি করুন

বার্থ প্ল্যান বা ইস্যু প্ল্যান করার পরই তৈরি করতে হবে বাজেট।সংসারে তৃতীয় সদস্য আসার আগে স্বামী-স্ত্রী যেমন ইচ্ছে খরচ করলেও, ইস্যু প্ল্যান করার পর খরচ কমিয়ে সঞ্চয় বাড়াতে হবে। কারণ, আজকাল স্ত্রীর সন্তানধারণ করার পর থেকে সন্তান প্রসব করা পর্যন্তই শুধু খরচ করতে হয় এক থেকে দেড় লক্ষ টাকা। এরপর সন্তান প্রতিপালনের খরচ তো আছেই। অতএব, স্ত্রীর আয় থাকলেও, এই বিপুল পরিমাণ খরচের বেশিরভাগ অর্থ যোগান দিতে হয় সন্তানের পিতাকে। তাই, আদর্শ পিতা হওয়ার জন্য প্রথমেই দরকার আর্থিক প্রস্তুতি।

গুরুদায়িত্ব

নিজের সন্তানকে পৃথিবীর আলো দেখাবার জন্য গুরুদায়িত্ব নিতে হয় বাবাকে। স্ত্রীর গর্ভে সন্তান আসার খবর পাওয়ার পর থেকেই স্বামী হিসাবে এবং বাবা হিসাবে সর্বদা সতর্ক থেকে কর্তব্য পালন করতে হয়। স্ত্রীকে সবসময় আনন্দে রাখতে হয়, পুষ্টিকর খাবার খাওয়াতে হয়, স্ত্রী যাতে কোথাও পড়ে না যায়, সে ব্যাপারে সবসময় সতর্ক থাকতে হয়। এই সময় হালকা কাজ ছাড়া কোনওরকম ভারী কাজ করতে দেওয়া উচিত নয় স্ত্রীকে। রান্না করা, বাসন মাজা, বিছানা করা প্রভৃতি কাজগুলো হয় নিজে করুন, নয়তো বাড়িতে চব্বিশ ঘণ্টার কাজের মহিলা রেখে স্ত্রীকে বিশ্রাম নেওয়ার সুযোগ করে দিন। স্ত্রীর যদি সর্দি, কাশি, মাথা ধরা কিংবা পেট ব্যথার সমস্যা দেখা দেয়, তাহলে তা নিরাময়ের জন্য সাধারণ ওষুধ খেতে দেবেন না কিংবা খাওয়াবেন না। কারণ এই সময় স্ত্রীর রোগ নিরাময়ের জন্য যে-কোনও সাধারণ ওষুধ সেবনে গর্ভের ভ্রূণের উপর ক্ষতিকারক প্রভাব পড়তে পারে। তাই চিকিৎসকের পরামর্শ মতো ওষুধ খাওয়াতে হবে স্ত্রীকে।

স্ত্রীর গর্ভাবস্থায় শারীরিক মিলনের ক্ষেত্রে স্বামীকে সংযত থাকতে হবে। মনে রাখতে হবে, গর্ভাবস্থায় প্রথম তিন মাস এবং সাত মাসের পর শারীরিক মিলন একেবারে বন্ধ রাখতে হবে। খুব ইচ্ছে হলে শুধু মাঝের সময়টুকুতে হালকা সেক্স করতে পারেন, তাও নিয়ম মেনে এবং নির্দিষ্ট পশ্চারে। স্ত্রীর গর্ভাবস্থায় মেডিকেল চেক-আপ ভীষণ জরুরি। বাচ্চার পজিশন এবং হার্টবিট ঠিক আছে কিনা তা আল্ট্রাসোনোগ্রাফির মাধ্যমে চেক-আপ করাতে হবে। ডেলিভারির জন্য বাড়ির কাছের কোনও ভালো নার্সিংহোম কিংবা হাসপাতালে আগে থেকে সমস্ত ব্যবস্থা করে রাখতে হবে। যে-কোনও একজন গাইনিকোলজিস্ট-এর আন্ডার-এ রেখে স্ত্রীর চিকিৎসা করাতে হবে। অনেক মহিলা প্রসবকালীন যন্ত্রণার কথা ভেবে ভয়ে অস্থির থকেন। আপনার স্ত্রীরও যদি এমন পরিস্থিতি দেখেন, তাহলে আগে থেকে কাউন্সেলিং-এর মাধ্যমে ভয় কাটাতে হবে। আর এরপরও যদি ভয় না কাটে কিংবা স্ত্রীর যদি কোনওরকম হার্টের অসুখ থাকে তাহলে সিজারিয়ান ডেলিভারির সিদ্ধান্ত নিতে হবে। ডেলিভারির সময় এগিয়ে এলে নার্সিংহোম কিংবা হাসপাতালে সহজে নিয়ে যাওয়ার জন্য আগে থেকে কোনও গাড়ি কিংবা অ্যাম্বুলেন্স-এর ব্যবস্থা করে রাখতে হবে। ডেলিভারির আগের মুহূর্তে স্ত্রী যাতে অসহায়ত্ব অনুভব না করে, তারজন্য পাশে থেকে সাহস জোগাতে হবে। পুত্র কিংবা কন্যাসন্তান যেই আসুক, তাকে হাসিমুখে বরণ করে নিয়ে স্ত্রীর মাতৃত্বকে মর্যাদা দিতে হবে। এ প্রসঙ্গে জানিয়ে রাখি, শুধু প্রি-ডেলিভারি পর্বেই নয়, পোস্ট-ডেলিভারি পর্বকেও যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে। মা এবং বাচ্চার শারীরিক সুস্থতা, আহার এবং আরামের ব্যবস্থাও করতে হবে। রাতে বাচ্চাকে খাওয়ানো এবং ন্যাপি বদলানোর জন্য স্ত্রীকে যথাসম্ভব সাহায্য করতে হবে। এভাবেই প্রতি মুহূর্তে স্ত্রীর পাশে থেকে আন্তরিক সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়ে পিতৃত্বকে সার্থক করে তুলতে হবে।

পরামর্শ

  • শুধু জ্ঞানের বাণী নয়, স্ত্রী এবং সন্তানের সঠিক সেবাযত্ন করে ‘অভিভাবকত্ব’ শব্দটিকে মর্যাদা দিন
  • সন্তানের জন্ম দেওয়ার আগে পরে স্ত্রীকে কোনও ভারী কাজ করাবেন না
  • প্রেগন্যান্ট স্ত্রীকে কোনও ভয়ংকর দুর্ঘটনা কিংবা অস্বাভাবিক কিছুর গল্প শোনাবেন না কিংবা দেখাবেন না
  • প্রেগন্যান্ট স্ত্রীর সামনে ধূমপান করবেন না, এতে গর্ভস্ত সন্তানের ক্ষতি হবে
  • প্রেগন্যান্ট অবস্থায় কেউ-কেউ বেশি ইমোশনাল হয়ে পড়েন কিংবা মেজাজ খিট্খিটে হয়ে যায়। তাই স্ত্রীর এই বিষয়টিকে সহানুভূতির সঙ্গে দেখতে হবে এবং যতটা সম্ভব ভালো ব্যবহার করতে হবে
  • প্রি-ডেলিভারি এবং পোস্ট ডেলিভারির বাজেট করে অর্থ সঞ্চয় করুন। সন্তানের শিক্ষাখাতেও অর্থ বরাদ্দ রাখুন
  • নিজেকে আদর্শ স্বামী এবং সার্থক পিতা হিসাবে প্রমাণ করার জন্য সেবা ও ভালোবাসার হাত বাড়িয়ে দিন।
আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...