শৈশব অবস্থায় সন্তানের ‘ঘুম’ নিয়ে প্রায়শই মায়েদের আলোচনা করতে শোনা যায়। দৈনন্দিন মানসিক এবং সামাজিক চাপ, স্কুলের ব্যস্ত জীবনশৈলী, এসবের সঙ্গে শিশুর নিজেকে মানিয়ে নিতে পরিমাণমতো ঘুম খুবই সাহায্য করে। এছাড়াও মস্তিষ্কের সজাগ এবং সতেজ থাকার জন্যেও ঘুমের একান্ত প্রয়োজন রয়েছে শিশুর জীবনেও।

ঘুমের প্রয়োজন কতটা?

মায়েদের মনে এই প্রশ্নটা সবসময় থাকে। শিশুর জন্মের ১ বছর পর্যন্ত ঘুমটা পুরোপুরি শিশুর উপরই নির্ভর করে সে কখন কতটা ঘুমোবে? প্রত্যেকটি শিশু আলাদা আলাদা ভাবে নিজের একটা অভ্যাস তৈরি করে। একটা নির্দিষ্ট সময় ধরে ঘুমোনো এবং সময়মতো ঘুমের থেকে জাগার প্রত্যেকেরই নিজস্ব প্যাটার্ন তৈরি হয়। প্রত্যেকদিনই ওই একই সময়েই সাধারণত শিশুটি ঘুমোয় এবং জাগেও প্রায় একই সময়ে। এরকম ভাবেই কেউ হয়তো রাত্রে জাগে দিনে ঘুমোয় আবার কেউ দিনে জেগে থেকে রাত্রে ঘুমিয়ে পড়ে। এক বছর থেকে দেড় বছর পর্যন্ত সারদিনে বাচ্চারা দু’বারের বেশি ঘুমোতে চায় না এবং দেড় বছর হয়ে গেলে একবারের বেশি ওদের ঘুম পাড়ানোই অসুবিধেজনক হয়ে ওঠে। বয়স বাড়তে থাকার সঙ্গে সঙ্গে উত্তেজনা, নানা ধরনের চিন্তা, রাত্রে ঘুমোতে গেলে খারাপ স্বপ্ন দেখার ভয়, অন্যান্য ভাইবোনেদের সঙ্গে প্রতিযোগিতামূলক মনোভাব ইত্যাদি শিশুর ঘুমের সময়কে আরও কমিয়ে দেয়।

প্রত্যেকটি শিশুরই ঘুমের প্রয়োজন একে অপরের থেকে আলাদা। নির্ধারিত কোনও সময়ের গন্ডি তাদের জন্যে প্রযোজ্য নয়। স্কুলে ভর্তি হওয়ার বয়সের আগে পর্যন্ত, প্রতিদিন বাচ্চাদের ১০ থেকে ১২ ঘন্টার ঘুমের প্রয়োজন। স্কুলে যেতে শুরু করার পর বাচ্চাদের মধ্যে অদ্ভুত একটা পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। তাদের ঘুমোনো এবং জাগার ঘড়ির কাঁটা দু’ঘন্টার মতো পিছিয়ে যেতে দেখা যায়। এই সব বাচ্চারা একটু বেশি রাতে ঘুমোতে যায়, ফলে দিনের বেলা তাদের ঘুম ভাঙতেও দেরি হয়।

ঘুম কম হলে বাচ্চারা স্কুলে অমনোযোগী হয়ে পড়ে, স্মরণশক্তি কমে যায়, পড়াশোনা, খেলাধুলোর ক্ষেত্রেও আশানুরূপ ফল দেখাতে পারে না, অল্পতেই রেগে যায়, খিটখিটে স্বভাব শান্ত করতে ঘুমের ওষুধও দেওয়া হয়ে থাকে। বাচ্চারা যাতে রাত্রে ভালো ঘুমোতে পারে, তার জন্যে বাবা-মাকেও কিছু জিনিস খেয়াল রাখতে হবে। বাচ্চার জীবনে কী পরিবর্তন আনা যেতে পারে আর কী নয়, সেটা অভিভাবক হিসেবে আমাদের একটু ভালোভাবে জেনে নিতে হবে।

বাচ্চাদের দিনযাপনের নির্দিষ্ট প্যাটার্ন ঠিক করে দিতে হবে

সারা বিশ্বজুড়ে বহু পরীক্ষা করে দেখা গেছে যেসব বাচ্চারা রাত্রে তাড়াতাড়ি ঘুমোয় এবং তাড়াতাড়ি সকালে ওঠে তারা অনেক বেশি সজাগ, স্মার্ট হয় এবং মোটা হওয়ার প্রবণতা কম হয়। যত দিন যাচ্ছে ততই বাচ্চাদের রাত অবধি জাগিয়ে রাখার রাস্তা প্রশস্ত হচ্ছে, নানা সরঞ্জাম দিয়ে। টেলিভিশন, ইন্টারনেট, ঘন্টার পর ঘন্টা ফোনের মাধ্যমে কথা বলা, ভিডিও গেমস ইত্যাদি বাচ্চাদের চোখে ঘুমের পরিমাণ মারাত্মকভাবে কমিয়ে দিচ্ছে।

শহরে, মফসসলে এখন ট্রেন্ড হচ্ছে, বাড়ির অভিভাবকেরা সকলেই চাকুরিজীবী। সন্ধেবেলায় বাড়ি ফিরতে ফিরতে সাড়ে সাতটা আটটা। সুতরাং বাড়ি ফিরে বাচ্চাদের সঙ্গে কথা বলে, তাদের প্রয়োজনীয় পড়াশোনা করিয়ে, খাইয়ে বিছানায় ঘুমোতে পাঠাতে পাঠাতে ঘড়ির কাঁটা গভীর রাত্রি ছুঁই ছুঁই। সকালে তাড়াতাড়ি উঠেই আবার স্কুল, অফিস বেরোবার তাড়া। সুতরাং চাপ সৃষ্টি হয় ঘুমের সময়টার ওপরেই। তাড়াতাড়ি শোওয়াতে গেলে বাচ্চারা হয়তো প্রতিবাদ করতে পারে, চ্যাঁচাতে পারে কিন্তু মা-বাবার উচিত সপ্তাহের পাঁচ-ছটা দিন রাত্রে একটাই সময় ঠিক করে তাড়াতাড়ি বিছানায় শুইয়ে দেওয়া বাচ্চাদের। খেয়ালও রাখতে হবে তারা যেন জেগে না থেকে সঙ্গে সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়ে। তাহলেই ঘুমটা ওদের পর্যাপ্ত হবে। তবে সপ্তাহে একটা দিন ওদের কিছুটা ছুট দেওয়া যেতেই পারে এবং সেদিনটা একটু রাত্রে দেরি অবধি জাগার পারমিশনও দেওয়া চলতে পারে।

ঘুমোনোটাকে আনন্দদায়ক করে তুলুন

তিনটে জিনিস খেয়াল রাখুন। বাচ্চার ঘুমোবার জায়গা, ঘুমোবার সময় এবং সকালে ওঠার সময়। বাচ্চারা যখন ঘুমোয় তখন মা-বাবা আশেপাশে থাকলে ওরা নিজেদের খুব নিরাপদ মনে করে। তাই ওদের রাত্রে শোয়াবার একটা প্যাটার্ন ঠিক করে দিন। তাড়াতাড়ি নির্দিষ্ট সময়ে বাচ্চাকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে ওর কাছে ১৫-২০ মিনিট থাকুন। সম্ভব হলে ওই সময়টাতে ওকে গল্প বলুন অথবা গল্প পড়ে শোনান। মাথায় ধীরে ধীরে হাত বুলিয়ে দিন এবং ঘুমিয়ে পড়লে নিশ্চিত হয়ে ঘরের আলো নিভিয়ে দরজা ভেজিয়ে বেরিয়ে আসুন।

বদঅভ্যাসগুলি মেনে নেবেন না

টেলিভিশন, কম্পিউটার, মোবাইল ইত্যাদি যদি বাচ্চাদের নেশার বস্তু হয়ে ওঠে তাহলে সেগুলি বন্ধ করে দেওয়া আপনার দায়িত্ব। অন্য বদভ্যাসেও যেন সে অভ্যস্ত না হয়ে পড়ে, তার খেয়ালও আপনাদেরই রাখতে হবে। এছাড়াও স্ন্যাক্স, ক্যাফেন, ফাস্টফুড ইত্যাদি খাওয়া থেকে আপনার সন্তানকে বিরত রাখতে হবে।

বাচ্চাদের নিয়ম মেনে চলতে শেখান

বাচ্চাকে যদি একা শোয়াতে চান তাহলে হঠাৎ করে তাদের আলাদা ঘরে ব্যবস্থা না করে ধীরে ধীরে তাদের অভ্যাস গড়ে তুলুন। প্রথমে নিজের পাশে আলাদা একটি খাটে ওদের শোয়ানো শুরু করুন। রাত্রে একটা নাইট-লাইট জ্বালিয়ে রাখুন এবং তার মাথার কাছে একটা অ্যালার্ম বেল রাখুন যাতে রাত্রে ভয় পেলে তারা ওটা বাজাতে পারে। ধীরে ধীরে এভাবে অভ্যাস হলে আলাদা ঘরে ওকে শিফট করতে পারেন। ঘরটি সম্পূর্ণ বাচ্চাকে ছেড়ে দিন যাতে নিজের জিনিসপত্র সে নিজের ঘরে রাখতে পারে এবং একা যখন থাকতে চাইবে তাকে সেই অধিকারটুকু দিন একা থাকার। কিন্তু দু’জন শিশু একটা ঘরে হলে সাধারণত দু’জনেরই ইচ্ছে হবে একে অপরকে বিরক্ত করার এবং তাতে ওদের ঘুমেরও ব্যাঘাত ঘটবে।

কিছু রুটিন মেনে বাচ্চাকে শোয়ার অভ্যাস করান

রুটিনের মধ্যে, শোবার আগে ব্রাশ করা, হাত-পা-মুখ ভালো করে ধুয়ে বিছানায় ওঠা, গল্পের বই পড়া ইত্যাদি অভ্যাসগুলি বাচ্চাদের করাতে পারেন।

ঘুমের মধ্যে হাঁটা

৩ থেকে ৭ বছরের বাচ্চাদের ঘুমের মধ্যে হাঁটার অভ্যাস দেখা যায়। রাত্রেই এটা বেশি হয়ে থাকে। আগে থেকে সাবধান থাকুন। বাড়ির জিনিসপত্র এমন ভাবে গুছিয়ে রাখুন যাতে রাত্রে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে চলার সময় আপনার সন্তান যেন কোনওরকম আঘাত না পায়। ধীরে ধীরে হাত ধরে ওকে বিছানায় শুইয়ে দিন। সাবধান থাকবেন যাতে ওর ঘুম ভেঙে না যায়। হাঁটার মধ্যে ও যদি হঠাৎ করে জেগে যায় তাহলে মানসিক ভাবে ও আঘাত পেতে পারে।

রিল্যাক্স রাখার টেকনিক

যেসব বাচ্চাদের অমনোযোগী হওয়ার সমস্যা থাকে, তারা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে প্রচণ্ড হাইপারঅ্যাক্টিভ হয়, ফলে ঘুমেরও প্রবলেম হয় তাদের। চেষ্টা করুন সন্তানকে মেডিটেশন, যোগা ইত্যাদিতে ব্যস্ত রাখতে। এগুলি রিল্যাক্স থাকার নানান উপায়। এছাড়াও ৩০ মিনিটের ব্যায়াম করান নিজের সন্তানকে, যাতে ব্যায়াম শেষে সে ক্লান্ত হয়ে পড়ে। শারীরিক পরিশ্রম করলে শিশুর ঘুমের ব্যাঘাত হওয়ারও সমস্যা হবে না।

 

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...