এক
আমার ঠাকুরদার নাম হরিহর। হরিহর গঙ্গোপাধ্যায়। আমাদের বাড়িতে ঠাকুরদার কোনও ছবি নেই। কেন নেই কে জানে! সে আমলেও তো ভালো ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট ছবি তোলা হতো।
এইসব প্রশ্ন রুনা আমাকে করে। রুনা মানে আমার মাস তিনেকের বিয়ে করা নতুন বউ। ঠাকুমার কাছে শুনেছি দেশের বাড়ি তৈরির সময় টাটা স্টিলের লোহার বিম, এক মাইল রাস্তা ঘাড়ে করে বয়ে নিয়ে এসেছিলেন গাঙ্গুলিমশাই। এসব কথা রুনা অবাক হয়ে শোনে। গালে হাত রেখে প্রশ্ন করে,
– তুমি পারো?
– আমি? অবাক না হয়ে পারি না। কিন্তু ওই পর্যন্তই। সদ্য বিয়ে করা বউকে অবাক হয়ে দেখা ছাড়া আর কী-ই বা করতে পারি!
সেই শুরু। এরপর থেকে গাঙ্গুলিমশাই থেকেই গেলেন। আমার আর রুনার মধ্যে ছোট্ট হাইফেনের মতো। আমাদের শয়নে, স্বপনে, আহারে, বিহারে এবং সত্যি কথা বলতে কি, আমাদের একান্ত ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যেও।
একটা উদাহরণ দিলে সহজবোধ্য হবে ব্যাপারটা। নাইট শো’তে সিনেমায় গেছি আমরা দুজন। এলাকার প্রেস্টিজিয়াস এসি হল ‘মৌলি’তে। রুনার হাতে আমার হাত। আর স্বাধীনতা পেলে কী করতে পারে আমার হাত সে ভালোমতো জানা আছে। রুনাও সম্ভবত তেমনই কোনও প্রত্যাশায় কাঁপছে ভিতরে ভিতরে। স্ক্রিনে তখন ভালোই চলছে ‘মিস লাভলি’র নীরব অভিসার। আমাদেরও। হলের অন্ধকার ও নৈঃশব্দ্যে। হঠাৎ এক দৃশ্যে এক দাড়িওয়ালা বৃদ্ধ। ওই যেমন হয় আরকি, নায়ক কি নায়িকার দাদু বা অন্য কেউ। বুঝতে পারলাম ছটফটিয়ে উঠল রুনা।
হাতের মধ্যে ধরে থাকা ওর হাত না ছেড়েই জিজ্ঞেস করলাম,
– কী হল রুনা?
আর কিছু বলবার দরকার ছিল না। কানের পাশেই ফিসফিসিয়ে উঠল রুনা
– দাদু থাকলে খুব ভালো হতো, না গো!
বিশ্বসংসার তখন লুপ্ত আমার সামনে। স্ক্রিন ডাহা ফাঁকা। গান-গল্প বিষ লাগছে সব। নায়ক-নায়িকার চূড়ান্ত প্রেমও কেমন অভব্য লাগছে পর্দায়। অথচ ঠিক আমার পাশেই সেই মুখ, ঠোঁট আর পহলগাঁওয়ের পথের পাশের কাশ্মীরি আপেলের মতো টুকটুকে গাল। ওই গালে ঠোঁট ছোঁয়ানো যায় শুধু। হাত তোলা কক্ষনো নয়।
বাড়ি ফিরে খাওয়াদাওয়ার পর ঘরে চার দেয়ালের নির্জনে রুনাকে একেবারে নিজের করে পেয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
– আচ্ছা রুন, দাদুর কথাটা এবার থেকে একটু কম বলা যায় না কি?
রাতে বিছানায় উঠে আসবার আগে কন্ঠার কাছটায়, চোখের তলায় ক্রিম ঘষে রুনা। ফরাসি ক্রিম। ওরিগন। দশ মিলি সাড়ে সাতশো টাকা। ওর মাসির বাড়ি থেকে দিয়েছে। মামুলি প্রাইভেট ফার্মের কর্মচারী, আমার এসব সাধ্যের বাইরে।
ঠিক এই একটি কারণে রুনার বাবা শুভ্রজ্যোতিবাবুর, মেয়ের পছন্দ হওয়া সত্ত্বেও আমার নামের পাশে বিরাট এক ঢ্যারা মেরে দিতে প্রথমে একটুও দ্বিধা হয়নি। বড়ো চাটার্ড ফার্ম ‘মুখার্জি অ্যান্ড সরকার’-এর সিনিয়র পার্টনার মুখার্জি সাহেবের ছোটো মেয়ে রুনা। কীভাবে যে কলেজ সোশ্যালে আমার গলায় ‘রামধনু মন’ শুনে মজল, উঁহু শুধু মজল না গলা পর্যন্ত ডুবল, সেটাই এক রহস্য। আমার কাছে। মুখার্জি সাহেবের কাছে তো বটেই।
সেই রুনা এবং আশ্চর্য এক মায়াবী সুগন্ধ এখন উড়ে বেড়াচ্ছে আমার মুখের আশপাশে। ওর গলায় মুখার্জি দম্পতির দেওয়া পার্ল-এর হার লকেটসমেত। দোল খাচ্ছে আমার চোখের সামনে। আলতো করে জিভ দিয়ে সেই লকেট স্পর্শ করে চোখ বন্ধ করে ফেলি। তবুও সেই অবস্থায়ই জিজ্ঞেস করি,
– কী হল, কিছু বললে না যে?
আমার নাকে নিজের নাক দিয়ে ঘষতে ঘষতে রুনা হাসল। ঘরের আলোআঁধারিতে সেই সংক্রামক হাসি কতদূর পর্যন্ত নিয়ে যেতে পারে কোনও পুরুষকে তার কোনও ইয়ত্তা নেই। যুগ যুগ ধরে শুধু তথ্যই আহরিত হয়েছে ব্যাপারটা নিয়ে– আর কিছু নয়। বাস্তবে সেই অভিজ্ঞতা যাদের হয়েছে তারাই শুধু জানে।
– আচ্ছা, তুমি কেমন মানুষ গো! যে-মানুষটার কোনও ছবিই নেই বাড়িতে, তাকে তোমার এত হিংসে কেন? আমাকে নিজের শরীরের নীচে সম্পূর্ণ কুক্ষিগত করে দখলদারিত্ব দেখিয়ে বলল রুনা।
এই সুমধুর সময়ে, যখন নাইটির পাতলা আড়াল ছাড়া রুনার পাখির মতো হালকা নরম শরীরটা সম্পূর্ণ আমারই অধিকারে এবং সেই শরীরের সর্বত্র চলে বেড়াচ্ছে আমার চঞ্চল হাত, তখন এসব কথা জিজ্ঞেস করে কোন মূর্খ? তবু একবার প্রায় জড়িয়ে আসা গলায় বলবার চেষ্টা করলাম,
– উঁ…উঁ… হিংসের কথা উঠছে কেন?
– ন্– না– এসব কথা থাক এখন। বুকের উপর অহংকারী মরালীর মতো শরীর ছেড়ে রাখা রুনা, ঠোঁট দিয়ে আমাকে চুপ করিয়ে দিল। অগত্যা আমাকে চুপ করতেই হল।
দুই
রমেনের বাবা জীবনকাকু মিউনিসিপ্যালিটির কমিশনার। শুধু কমিশনার বললে ভুল হবে। রীতিমতো বাঘ আর গরুকেএকঘাটে জল খাওয়ানোর এলেমধারী বলতে যা বোঝায় জীবন রায় ঠিক তাই-ই।
ওঁকে বাদ দিয়ে মিউনিসিপ্যাল চেয়ারম্যান দিনে অন্ধকার দেখেন আর রাতে চোখে তারাবাজি। সেই জীবনকাকু আমাদের মিউনিসিপ্যালিটির আঠাশ নম্বর ওয়ার্ডের। এই ওয়ার্ডেই আবার এলাকার সবচেয়ে বড়ো মার্কেটিং কমপ্লেক্স ‘উত্তরায়ণ’। কেন ‘উত্তরায়ণ’ কেন ‘দক্ষিণায়ন’ নয় এসব জটিল কথার জবাব কাকুকে জিজ্ঞেস করলে সুন্দর দাঁতের প্রদর্শনী দেখান। তারপর হাত একটু কাত করেন উপর দিকে। অর্থাৎ চেয়ারম্যান জানতে পারেন কিংবা আর একটু উপরের, সব চেয়ারম্যানের লর্ড স্বয়ং ভগবান।
এই মানুষটির ছেলে রমেন আমার বন্ধু। সেই পাঠশালার দিনগুলো থেকে। তারপর সেন্ট জন্স এইচ এস স্কুল হয়ে কলেজ পর্যন্ত। সেই রমেন। রমেন রায়। তার ফুলশয্যা। আটশো থেকে হাজার লোকের অ্যারেঞ্জমেন্ট। মিছিলের মতো একদল ঢুকছে ‘কুশন্ডিকা’ লজে আর একদল বেরিয়ে আসছে। বাজারের যত কসাই আর মাছওয়ালাদের দেখলাম। সবাই বেশ ওদের স্বাভাবিক ড্রেস লুঙ্গি, গেঞ্জি আর রক্তমাংস মাখা ফতুয়া ছাড়াই সেজেগুজে এসেছে। অনেকের চোখে আবার সুরমা টানাও দেখলাম।
রুনা আর আমিও এসেছি খুব সেজেগুজে। হালকা নীল ফুলস্লিভ ব্র্যান্ডেড শার্ট পরেছি। ‘আবু জানি’র এই শার্ট শীতের তত্ত্বে দিয়ে পাঠিয়েছেন আমার শাশুড়ি মা। এসব কি গরিব জামাইকে কিছু শেখানোর জন্য? কে জানে? পরবার জন্য শার্ট এসেছে পরেছি। তার সঙ্গে মানানসই ট্রাউজার। কোটের বাটনহোল-এ লালগোলাপ সামান্য মাথা উঁচিয়ে জানান দিচ্ছে আমার স্বাতন্ত্র্য।
আর রুনা যা সেজেছে আজ দেবতারাও মনে হচ্ছে স্বর্গের ব্যালকনিতে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে দেখছেন ওকে। বাঙ্গালোর সিল্ক-এর উপর বিয়েবাড়ির আলো পড়ে পিছলে যাচ্ছে যেন। রামধনু-রঙা চোলি, ঠিক ব্যাকলেস নয় আবার তা বলাও যায়। অদ্ভুত এক রঙিন কাটাকুটি খেলায় মেতেছে পিঠের দিকটা।
নিজের বউকে এইসব সময়েই অন্য কারওর বলে মনে হয়। গলা থেকে অনায়াসে ঝুলছে বাপের বাড়ি থেকে দেওয়া মুক্তোর হার। কানে ম্যাচিং দুল। যেন ইশারায় ডাক পাঠাচ্ছে, ‘আয় আয় ছুঁয়ে যা’। হাতে সুগন্ধি ডোকরা প্রিন্টেড রুমাল। দেখেশুনে কার ফুলশয্যা হচ্ছে আমার না রমেনের বোঝা দায়।
কাজের বাড়িতে জীবনকাকু কারওর কোনও অসুবিধার জায়গাই রাখেননি। আদর-আপ্যায়ন, কফি, পকোড়া এবং অবশ্যই মাটনের সঙ্গে বিবিধ মাছের প্রিপারেশন (ইলিশ, চিংড়ি আর ভেটকি)। খাওয়াদাওয়া শেষ করে সকলে ধন্য ধন্য করতে করতে বেরিয়ে আসছে। ঘড়িতে রাত বারোটা। খাওয়াদাওয়ার পর সকলের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ সেরে রমেন আর পর্ণাকে ঘরে ঢুকিয়ে তবে অন্য বন্ধুদের সঙ্গে আমাদেরও ছুটি।
এত রাতে আবার বাড়ি ফেরা কেন রমেনদের বাড়ির সকলেই সেকথা জিজ্ঞেস করছিল। রুনা হেসে সকলকে বিদায় জানাল। হাসলে যে ওকে এত সুন্দর লাগে একান্নতম বার সেই সত্যটা আবিষ্কার করলাম একেবারে ওর পাশে দাঁড়িয়ে।
রমেনের বাবা ঘাড় ফিরিয়ে কাকে যেন একটা গাড়ির ব্যবস্থা করতে বললেন আমাদের পৌঁছে দেবার জন্য। তারপর কাজের বাড়িতে যা হয়। আরও গুরুতর কোনও কাজের তাড়ায় আমাদেরটা অনায়াসে হারিয়ে গেল।
অগত্যা শুধু আমরা দুজনে রাস্তায় নেমে এলাম। পিছন ফিরে একবার আলোয় ঝলমলে লজটার দিকে তাকিয়ে বিরাট একটা জাহাজের মতো মনে হল। টাইটানিক নাকি রে বাবা! মজা পেলাম খুব। বাতাসে ভাসিয়ে দিলাম রমেনের উদ্দেশে আমাদের যৌথ শুভেচ্ছাবাণী– ভাস রমেন, ভেসে যা ওই অথৈ সমুদ্রে!
সামনের দিকে রাস্তা পড়ে আছে রাস্তারই মতো শুনসান। অনুষ্ঠান বাড়ির গাড়িগুলো তীরবেগে ছুটে চলে যাবার পরই রাস্তা আবারও শুনসান। একটু তফাতে তফাতে হ্যালোজেন ল্যাম্পের আলো অন্ধকারের পরিধি কমিয়েছে কেবল। আলো আর অন্ধকারের সঙ্গে চোরপুলিশ খেলতে খেলতে কখন যে বেশ খানিকটা ফাঁকা রাস্তা ফেলে এগিয়ে এসেছি আমরা দুজনে একটুও বুঝতে পারিনি।
এমন ফাঁকা রাস্তায় আমার রুন-কে একলা পাবার আনন্দে মন গুনগুনিয়ে উঠল। চট করে ওর পাশে গিয়ে ডানহাত দিয়ে বেড় দিয়ে নিলাম ওর মোম আর মেদ দিয়ে তৈরি মসৃণ কোমরটাকে। নীচু হয়ে সেই কোমরে সবে ঠোঁট ছোঁয়াতে যাচ্ছি, এমন সময় যেন পায়ের আওয়াজ পেলাম পিছনে।
চমকে দাঁড়িয়ে এদিক ওদিক তাকালাম। কেউ কোথাও নেই। রাস্তা যেই কে সেই। একেবারে ফাঁকা। কেবল দূরে দূরে একটি দুটি কুকুর। সন্দেহজনক চোখে দেখছে আমাদের। উপযুক্ত পরিচালকের হাতে পড়লে এই সিন মারকাটারি হয়ে উঠতে পারে। এই স্তব্ধতা, এই নির্জন ল্যাম্পপোস্টের আলোয় ধোঁয়া ধোঁয়া আচ্ছন্নতা। তার সঙ্গে বিমূঢ় নায়ক-নায়িকা। ফ্যানটাস্টিক!
মাথার মধ্যে কোনও প্রতিবর্তী সংকেত পাবার আগেই রুনার ভয়ার্ত গলা শুনতে পেলাম,
– একটা লোক!
স্বর্গ থেকে যেন পতন হল আমার,
– কই– কোথায়?
– পিছনে। বলতে বলতে আমার শরীরে সেঁধিয়ে এল রুনা। আহ্ রুন, আমার রুনি! ওকে শক্ত করে এক হাতে জড়িয়ে বুকের মধ্যে নিয়ে পিছনে তাকালাম। কোনও তারতম্য নেই। নির্জন রাস্তা। ল্যাম্পপোস্টের আলো শুষে নিচ্ছে নিঃশব্দে।
– ধুস্ – ভুল দেখেছ। বিয়েবাড়িরই কেউ হবে হয়তো।
রুনাকে সাহস দিতে গিয়ে গলা কেঁপে গেল আমার। এত রাতে বেমক্বা রাস্তায় নেমে পড়বার কী খেসারত দিতে হবে কে জানে। কোনও অটো কিংবা অন্য যানবাহনও তো নজরে পড়ছে না। আচ্ছা ঝামেলায় পড়া গেল তো!
যাই হোক, এই পরিস্থিতি থেকে তো বেরোনোর চেষ্টা করতেই হবে। সঙ্গে আবার রুনাও রয়েছে। আমার যা হবার হোক। কিন্তু রুন– আমার রুন যেন নিরাপদে ঘরে ফিরতে পারে। কপালে বিন্ বিন্ করে ঘাম ফুটছে টের পেলাম।
আমার এমন প্রায়-অপ্সরা বউয়ের স্পর্শও নিশ্চিন্ত করতে পারল না একটুও। একবার মনে হল পায়ের আওয়াজ পেলাম পাশেই। চমকে তাকালাম। কেউ না। কিছু না। অথচ নিশ্চিতভাবেই পায়ের শব্দ। নির্ঘাত বদ মতলবেই লুকিয়েচুরিয়ে কেউ আসছে পিছু পিছু।
চিন্তাটা মাথায় আসতেই কেঁপে উঠলাম। মনে মনে খুব ধমকাতে লাগলাম নিজেকে। কেন যে অনুষ্ঠান বাড়ির বাইরে ওদেরই বাড়ির দু’চারজন ছোকরা যারা পা ফাঁক করে দাঁড়িয়ে রাস্তার অগুনতি সুন্দরীদের ঝাড়ি করছিল ফ্রাঙ্কো নিরো কি চার্লস ব্রনসন স্টাইলে, তাদের সঙ্গে করে নিয়ে এলাম না। আপশোশ হচ্ছিল খুব। রুনার সুগন্ধি কানের লতির পাশে মুখ নিয়ে এসে ফিসফিস করে বললাম,
– আর দেরি নয়। এবার দৌড় দিতে হবে।
রুনা হয়তো বলতও কিছু কিন্তু আমার হাতে বাঁধা পড়েছে ওর হাত। কুসুমকোমল যাকে বলে। সেই হাতে টান পড়ল। শুরু হল আমাদের সম্মিলিত দৌড়। রেডি-স্টেডি-গো।
পাশে পড়ে রইল ‘কমলা স্টোর্স’, ‘হিরন্ময় জুয়েলারি হাউস’। ঘাড় ফিরিয়ে আবার কাউকে দেখতে হবে, এখন আর এমন ভয় করি না। শক্ত করে রুনার হাত ধরে কাছে টানলাম ওকে। বললাম,
– এলাকায় এসে গেছি। আর কোনও ভয় নেই।
আস্তে আস্তে দুই পরাজিত সৈনিকের মতো বাড়ির দিকে এগিয়ে চললাম আমরা। পিছনে আর কোনও পায়ের শব্দ নেই। ওই তো সামনে হলুদ গেটওয়ালা অনিরুদ্ধ সিনহার বাড়ি। সিনহাদা’র পরই আমাদের সাতাশ’এর দুই, চণ্ডীতলা রোড-এর আস্তানা। বারান্দার আলো এখান থেকেও নজরে পড়ে বেশ।
তিন
রাতের ব্যাপারটাকে মনে মনে ধন্যবাদ না দিয়ে পারলাম না। তা নইলে রুনাকে কি আর অমন করে কাছে পেতাম কোনওদিন। একেবারে সর্বস্ব নিয়ে কাছে আসা বোধহয় একেই বলে।
ভোর সত্যিই যে কত মনোরম হতে পারে এমন ঘোরতর কোনও রাত না কাটলে তা বোঝা যেত না। রাতে ঘরের তালা খুলে কখন ঢুকলাম, কখন অনুষ্ঠানবাড়ির পোশাক ছেড়ে আবার বিছানার পোশাকে ফিরলাম এসব এই ভোরে আর মনে করতে ইচ্ছা হল না।
শেষরাতে টেলিফোনের শব্দে ঘুম ভেঙেছে এটুকুই শুধু মনে করতে পারলাম। রুনার মোবাইলে সুন্দর সুরেলা আওয়াজ। হাত বাড়াতে ইচ্ছা করছিল না বলে ধরিনি। তার থেকে ঘুমন্ত রুনার কবিতার মতো ঠোঁটদুটোর দিকে তাকিয়ে থাকতে বেশি ভালো লাগছিল।
বসে বসে সবে একটা সিগারেট ধরিয়েছি, আবার ক্রিং ক্রিং… এবার ল্যান্ডলাইনে।
হাত গেল। রুনারই পছন্দ করা প্রিয়দর্শিনী রিসিভার উঠে এল হাতে। কোনও কথা না বলে শুধু ‘শুনলাম’ বলাই ভালো।
– হ্যালো রুনা, আমি আকাশ।
কেবল ‘হুঁ’ দিয়ে গেলাম। কে আকাশ, কী বৃত্তান্ত সেসব কথা এই ভোরের রাজেন্দ্রাণী উঠে জানাবে আমায়।
অফিস বেরোবার সময় শুধু আমার রুনের স্বপ্নালু চোখ দুটিতে ঠোঁট ছুঁইয়ে বললাম,
– আকাশের ফোন এসেছিল।
– ওমা, সত্যি! কখন গো?
এত উচ্ছ্বাস ঝ’রে পড়ল রুনার গলায় যে না জিজ্ঞেস করে পারলাম না,
– কে আকাশ?
– সেকি তুমি আকাশকে চেনো না! রুনার চোখ গোল হয়ে গেল। যেন আকাশ রবিশংকরজি কিংবা রোনাল্ডো যে তাকে চিনতেই হবে। আরও হয়তো কথা বলতাম কিন্তু হাতের ঘড়ি এক মারাত্মক যন্ত্র। ঘাড় ধাক্বা দিয়ে অফিসে তাড়িয়ে নিয়ে গেল আমায়। বিয়ের পর এই কয়েক মাসের মধ্যে প্রথমবার দুপুরে আর বাড়িতে ফোন করলাম না।
সন্ধের একটু পরে অটো থেকে নেমে বাড়ির মধ্যে ঢুকে সিঁড়িতে পা রাখতে রাখতেই শুনতে পেলাম ড্রইংরুম থেকে ভেসে আসা রুনার হাসির শব্দ।
পর্দা সরিয়ে মুখ বাড়ালাম। সোফায় বসা রুনা তাকাল। অত্যন্ত রিল্যাক্সড ভঙ্গিতে এলিয়ে বসে আছে সোফায়। শরীরের আঁচল নামক বস্তুটি অজান্তে কিংবা স্বজ্ঞানেই কখন প’ড়ে লুটোপুটি খাচ্ছে মেঝেয়। আর সেই শরীরের প্রখর তাপে দগ্ধ হয়ে চলেছে রুনার পায়ের কাছে ভক্তের মতো বসে থাকা এক ঝাঁকড়া চুলের ছোকরা। গায়ে অসংখ্য তারা আঁকা ‘গোয়া’ লেখা টি-শার্ট আর পরনে ডেনিম।
আমাকে দেখে হই হই করে উঠল রুনা,
– দ্যাখো কে এসেছে! আরে এ-ই তো আকাশ। আকাশ ঘোষদস্তিদার। ফেমাস আর্টিস্ট। আসলে, ঠাকুরদার একটা ছবি আঁকানোর ব্যাপারে –
ছোকরা কথার মধ্যেই তার মুগ্ধ চোখদুটি আমার দিকে ফেরাল। আমার আর শুনতে ইচ্ছে করছিল না। পর্দা ছেড়ে সিঁড়িতে বেশ কয়েকধাপ উঠে গেলাম তাড়াতাড়ি।
‘গাঙ্গুলিমশাই’-এর ছবি যে আঁকা হবেই, সেটা বুঝতে আমার বিন্দুমাত্র ভুল হল না আর।