নারী জীবনের পূর্ণতা সম্ভবত মাতৃত্বে। তাই, নারীর জীবদ্দশায় মাতৃত্ব এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। আর মাতৃত্বের জন্য প্রয়োজন সুস্থ স্বাভাবিক গর্ভাশয়। এই গর্ভাশয় বা জরায়ুর মধ্যে থাকে ডিম্বাশয় এবং দুটি ডিম্বনালি বা ফ্যালোপিয়ান টিউব্স। কিন্তু গর্ভাশয়ে কোনও সমস্যা থাকলে গর্ভধারণের অসুবিধা হয় কিংবা মাতৃত্ব থেকে বঞ্চিত হওয়ারও সম্ভাবনা থাকে। আর গর্ভাশয়ের সমস্যাগুলির মধ্যে ফ্যালোপিয়ান টিউবের ব্লকেজ অন্যতম। সম্প্রতি এবিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছু প্রশ্নের উত্তর দিলেন ‘জেনোম’-এর বিশিষ্ট চিকিৎসক অজিতাভ শুক্লা।

ফ্যালোপিয়ান টিউব কী এবং প্রেগন্যান্সির ক্ষেত্রে ফ্যালোপিয়ান টিউবের গুরুত্ব কতটা?

ফ্যালোপিয়ান টিউব বা ডিম্বনালি সংযুক্ত থাকে জরায়ু বা গর্ভাশয়ের সঙ্গে। আর ডিম্বাশয় থেকে জরায়ুতে ডিম্বাণু আসে দুটি ডিম্বনালি বা ফ্যালোপিয়ান টিউব-এর মাধ্যমে। প্রত্যেক মেন্সট্রুয়াল সাইকেল-এ ডিম্বাশয় থেকে গর্ভাশয়ে একটি ডিম্বাণু আসে ডিম্বনালির মাধ্যমে। এরপর যৌনক্রিয়ার ফলে পুরুষের শুক্রাণু গর্ভাশয়ে গিয়ে ডিম্বাণুর সঙ্গে মিলিত হয় এবং ফার্টিলাইজ করে।

টিউবাল ব্লকেজ কী?

ফ্যালোপিয়ান টিউব-এ অর্থাৎ, ডিম্বনালির পথে যদি গাঢ় জলীয় পদার্থ জমে গিয়ে কোনও অবস্ট্রাকশন বা বাধা তৈরি করে, তাহলে তখন তাকে বলা হয় টিউবাল ব্লকেজ। আর যদি টিউবাল ব্লকেজ থাকে, তাহলে ডিম্বাণুর সঙ্গে শুক্রাণু মিলিত হতে বাধাপ্রাপ্ত হয় এবং বন্ধ্যাত্বকে মেনে নিতে হবে। ব্লকেজ দুটো টিউবেই হতে পারে। আসলে, বন্ধ্যাত্বের যতগুলি কারণ আছে, তারমধ্যে ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশ হয় টিউবাল ব্লকেজ-এর কারণে। আর যদি টিউবস-এ সামান্য ব্লকেজ থাকে, তাহলে তা আরও বিপজ্জনক। কারণ, তখন যদি শুক্রাণুর সঙ্গে ডিম্বাণুর মিলন ঘটে তাহলে ডিম্বনালিতে ভ্রুণ তৈরি হয়ে যেতে পারে এবং গর্ভবতী নারীর জীবনসংশয়ও হতে পারে। এই অবস্থাকে চিকিৎসা পরিভাষায় বলা হয় ‘একটোপিক প্রেগন্যান্সি’।

টিউবাল ব্লকেজ-এর কারণ কী এবং উপসর্গ-ই বা কী?

মূলত পেল্ভিক ইনফ্লেমেটরি ডিজিজ এবং সেক্সুয়ালি ট্রান্সমিটেড ডিজিজ বা এসটিডি-র কারণে হয় টিউবাল ব্লকেজ। শুধু তাই নয়, বারবার যদি গর্ভপাত করা হয় কিংবা অন্য কোনও সার্জারি হয়ে থাকে ইউটেরাস-এ, তাহলেও টিউবাল ব্লকেজ হতে পারে। আর এই টিউবাল ব্লকেজ থাকলে, নানারকম উপসর্গ দেখা দিতে পারে। তবে উপসর্গ যে দেখা দেবেই, এমন কোনও নিশ্চয়তা নেই। যদি উপসর্গ দেখা দেয়, তাহলে প্রথমে যা বোঝা যাবে তা হল– অ্যাবনর্মাল ভ্যাজাইনাল ডিসচার্জ। এছাড়া, ফ্যালোপিয়ান টিউব-এ ব্লকেজ থাকলে শরীরে হরমোনাল চেঞ্জ হবে এবং ব্লাড-ফ্লো বেড়ে যাবে। এর ফলে পেল্ভিক পেইন হতে পারে। লোয়ার ব্যাক পেইন হতে পারে এবং মূত্রত্যাগের সময় কিংবা যৌনক্রিয়াও পীড়াদায়ক হতে পারে। সেইসঙ্গে থাকতে পারে হেভি পিরিয়ডস্-এর সমস্যা।

ফ্যালোপিয়ান টিউব ব্লকেজ-এর রোগনির্ণয় পদ্ধতিটাই বা কী?

অ্যাবনর্মাল ভ্যাজাইনাল ডিসচার্জ, হেভি পিরিয়ডস্, লোয়ার ব্যাক পেইন, পেইনফুল ইউরিনেশন কিংবা পেইনফুল ইন্টারকোর্স-এর সমস্যার কথা যদি কোনও মহিলা জানান, তাহলে তিনি ফ্যালোপিয়ান টিউব ব্লকেজ-এর সমস্যায় রয়েছেন এমনটাই ধরে নেওয়া হয়। তাছাড়া, বন্ধ্যাত্বের অন্যান্য সমস্যা নেই অথচ মা হতে পারছেন না, তখনও ফ্যালোপিয়ান টিউব ব্লকেজ হতে পারে সন্দেহ প্রকাশ করা হয় এবং সঠিক রোগনির্ণয়ের পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়। এক্ষেত্রে হিস্টেরোসালপিঙ্গোগ্রাফি বা এইচএসজি-কে মাধ্যম করা হয়। এটি একটি স্পেশাল এক্স-রে। এর মাধ্যমে ফ্যালোপিয়ান টিউব-এ গাঢ় জলীয় পদার্থ জমে গিয়ে ব্লকেজ তৈরি করেছে কিনা তা দেখে নেওয়া হয়। তবে অনেকসময় এইচএসজি-র মাধ্যমে ব্লকেজ না বোঝা গেলে, ল্যাপারোস্কোপি-র সাহায্যে রোগনির্ণয় করা হয়।

টিউবাল ব্লকেজ-এর সমস্যায় কীভাবে সাহায্য করে ‘আইভিএফ’?

যদি একটি ফ্যালোপিয়ান টিউব অর্থাৎ একটি ডিম্বনালিতে ব্লকেজ থাকে, তাহলে মেডিসিন দিয়ে সমস্যামুক্ত করে গর্ভধারণের ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু যদি দুটি টিউবেই ব্লকেজ থাকে, তাহলে তা বড়ো সমস্যা ধরে নেওয়া হয় এবং সেক্ষেত্রে চিকিৎসায় সাফল্যের বিষয়টিও অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। মেজর সার্জারি করেও সেক্ষেত্রে চল্লিশ শতাংশের বেশি সাফল্যের সম্ভাবনা থাকে না। বয়স যদি পঁয়ত্রিশের বেশি হয়, তাহলে সাফল্যের সম্ভাবনা আরও কমে যায়। তখন টেস্টটিউব বেবি বা আইভিএফ-এর (ইনভিট্রো ফার্টিলাইজেশন) সাহায্যে মা হওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। এই আইভিএফ পদ্ধতিতে পুরুষের শুক্রাণু এবং নারীর ডিম্বাণু সংগ্রহ করে এক বিশেষ পদ্ধতিতে ফার্টিলাইজ করা হয় এবং ফার্টিলাইজ করার পরে তা সরাসরি ইউটেরাস-এ প্লেস করা হয়। আর এই কৃত্রিম গর্ভাধান পদ্ধতিতে সাফল্যের হার ভালো এবং পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার সম্ভাবনাও খুব বেশি থাকে না।

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...