আজকের মেয়েরা দুরন্ত গতিতে এগিয়ে চলেছে। পুরুষের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করছে। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ফেলছে দৃঢ় পদক্ষেপ। কিন্তু কিছু কিছু ব্যাপারে তাদের ধারণা এখনও আগের মতোই রয়ে গেছে। যেমন, মহিলারা আজও খরচের থেকে সঞ্চয়ে বেশি বিশ্বাসী। নিজেদের ইচ্ছা বা চাওয়ার উপরে তাদের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ আছে। এমনকী পুঁজি বিনিয়োগের ক্ষেত্রেও আজকের মেয়েরা সতর্কতার সঙ্গে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে।
কলকাতার এক প্রখ্যাত মনোরোগ বিশেষজ্ঞ জানালেন, ‘এখনও কিছু বিষয়ে মহিলাদের ভাবনাচিন্তা, পুরুষের সম্পূর্ণ বিপরীত। পুরুষেরা নিশ্চিত ভবিষ্যতের তুলনায় বর্তমান সময়ের সুন্দর উপভোগের দিকেই আগ্রহী হয়। অথচ মহিলারা ভবিষ্যৎ চিন্তা বেশি করে। সমস্ত কাজই ভবিষ্যতের কথা মাথায় রেখে করতে চায়। মহিলারা আরও চায় যে, পুরুষেরাও ভবিষ্যৎ ভাবনায় গুরুত্ব দিক, তারা যেন শুধুই বর্তমান নিয়ে পড়ে না থাকে।’
তিনি আরও বললেন, ‘মহিলারা সাধারণত অনিশ্চয়তা আছে, এমন কোনও কাজে উৎসাহ দেখায় না, বিশেষত Finance planning সংক্রান্ত কাজকর্মের ক্ষেত্রে। তাই মূলধন, সোনা বা রুপোর জিনিসে ইনভেস্ট করে। পুরুষেরা আবার অধিক লাভের আশায়, শেয়ার বা মিউচুয়াল ফান্ডে বিনিয়োগ করতে বেশি পছন্দ করে। কিন্তু এমন বিনিয়োগে রিস্কের সম্ভাবনা থাকে। মহিলারা তাই চায় যে, পুরুষেরা যেন কোনও প্রপার্টিতে, সোনা বা রুপোর মতো ধাতুতে অথবা ব্যাংকে অর্থ Investment করুন।’
Budget মেনে চলুক পুরুষেরাও
যে-কোনও পরিবারের গৃহকর্ত্রীই হল আসল ফিনান্স মিনিস্টার। কর্তা অর্থ উপার্জন করে মা বা বউ-এর হাতে তুলে দেয়। কিন্তু সেই অর্থের যথাযথ ব্যবহার এবং সামলে রাখার দায় কিন্তু পরিবারের গৃহিণীটিরই। হাউজ ওয়াইফ হোক বা কর্মরতা বধূ, ফ্যামিলির জীবনযাত্রার মান ধরে রাখতে বা অর্থনৈতিক স্থিতিকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে, সকলেই নির্দিষ্ট বাজেট প্ল্যান অনুযায়ী চলে। ভবিষ্যতের আর্থিক সুরক্ষা নিশ্চিত করতে বাজেট মেনে চলা খুবই জরুরি। মহিলারা চায়, বাড়ির পুরুষ ফ্যামিলি মেম্বাররাও একটু সহযোগিতা করুক, বাজেট প্ল্যানকে গুরুত্ব দিক।
সন্তানের পড়াশোনার Education Plan
বাচ্চাদের পড়াশোনার খরচ চালানো এখন সহজ নয়। সন্তানের পড়াশোনা নিয়ে মহিলারা পুরুষদের থেকে বেশি উদ্বিগ্ন থাকে। আজকের দিনে বাচ্চার জন্য সঠিক এডুকেশন প্ল্যান করা খুব জরুরি, যাতে ভবিষ্যতে পড়ার খরচ যোগাতে সমস্যা না হয়। অর্থের অপ্রতুলতার জন্য ভবিষ্যতে যাতে বাচ্চার পড়াশোনায় কোনও প্রভাব না পড়ে, তার প্রস্তুতি বর্তমানেই নেওয়া উচিত।
বিয়ের প্ল্যানিং
খরচ দিন দিন বেড়েই চলেছে। সাথে বেড়ে চলেছে চিন্তাও। গৃহবধূ বা চাকুরিরতা মহিলা উভয়েই ছেলেমেয়ের বিয়ে এবং তার খরচ নিয়ে যথেষ্ট উদ্বেগে থাকেন।
শহরের নামি এক আইটি কোম্পানির এইচআর ম্যানেজার, শ্রাবণী দে বললেন, ‘সবার মতো আমিও মেয়ের বিয়ে নিয়ে এখন থেকেই চিন্তাভাবনা করছি। বিয়ে সংক্রান্ত কিছু ইনশিয়োরেন্স প্ল্যান রয়েছে। মেয়ের জন্য তেমনই একটা প্ল্যানে কিছু টাকা ইনভেস্ট করেছি। তবে আমার মনে হয়, ছেলেমেয়ের বিয়ের চিন্তা আর দায়িত্ব শুধুই মায়ের নয়, বাবার ক্ষেত্রেও একইভাবে বর্তায়।’ এখন থেকে উপার্জনের কিছু অংশ বিয়ের বাজেট প্ল্যানে রেখে দিন। দেখবেন, ভবিষ্যতে সমস্যা অনেক কমে যাবে।
প্রয়োজন বুঝে কাজ
৩০ বছরের জয়শ্রী শিকদারের বিয়ে হয়েছিল বছর পাঁচেক আগে। জয়শ্রী তার হাজব্যান্ড আর ছেলে গুবলুর সঙ্গে লেকটাউনে ভাড়া থাকে। ওর নিজের বাড়ির খুব শখ! কিন্তু হাজব্যান্ড শুভর ইচ্ছা গাড়ি কেনার। জয়শ্রীর বক্তব্য, ‘যদি এখন ইএমআই-এ একটা ফ্ল্যাট কিনতে পারি, তবে ভবিষ্যতে ভাড়ার টাকা বেঁচে যাবে। বাড়ি ভাড়ার টাকায় যে সেভিংসটা হবে, তাতে ছেলেমেয়েদের পড়াশোনায় অনেক সুবিধা হবে। তাছাড়া, এখন ফ্ল্যাট কেনা মানেই, ভবিষ্যতের জন্য একটা দারুণ ইনভেস্টমেন্ট।’ কিন্তু এই বিষয়ে শুভর সঙ্গে জয়শ্রীর তীব্র মতানৈক্য।
জয়শ্রীর মতোই অন্য মহিলারাও একথা ভালোই বোঝেন যে, খরচ এবং জিনিসপত্রের দাম, বিশেষ করে রিয়েল এস্টেট প্রপার্টির দাম যে-হারে বাড়ছে, তাতে ভবিষ্যতে ফ্ল্যাট বা বাড়ি কেনার টাকা যোগাতে কতটা সমস্যা হবে! পরিবারের পুরুষ সদস্যটিও যেন এই সামান্য কথাটি বোঝে এবং সেই অনুযায়ী সেভিংস করে।
বিনিয়োগে মহিলাদের মতামত
আজকের মেয়েরা শুধুই স্বামী, পুত্রকন্যা বা পরিবারের কথা ভাবে না, তারা নিজেদের কথাও ভাবে। তাই তারা চায় যে পরিবারের পুরুষ সদস্যটি যেখানেই অর্থ ইনভেস্ট করে থাকুক না কেন, তার সম্পূর্ণ তথ্য যেন তারা জানতে পারে। ভবিষ্যতের যে-কোনওরকম প্রয়োজনে, স্বামীর অবর্তমানে তারা যেন ইনভেস্টমেন্ট-এর সুফল লাভ করতে পারে।
Home maintenance
হোম মেন্টেনেন্স সংক্রান্ত বিষয়ে পয়সা খরচ করতে মহিলারা কার্পণ্য করে না। কিন্তু বেশিরভাগ পুরুষই ভাবেন যে এইসব খরচ করা অপ্রয়োজনীয়, মহিলারা তাদের শখ মেটাতে এই বাড়তি ব্যয় বহন করে। বাস্তবে, মহিলারা এসব খরচ করে থাকে কারণ তারা একটা নির্দিষ্ট মাপকাঠির লাইফস্টাইল মেন্টেন করতে চায়। এই সিদ্ধান্তগুলি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। জীবনযাত্রার মান একটি পরিবারের ক্ষেত্রে কেমন, তার উপর বাচ্চার মানসিক গঠনও অনেকটা নির্ভর করে।
খরচ করুক পুরুষেরা
মহিলারা নিজেদের উপার্জনের অর্থ ভবিষ্যতের জন্য সঞ্চয় করে রাখতে চায়, যাতে যে-কোনওরকম অনিশ্চয়তার মোকাবিলা তারা সাহসের সঙ্গে করতে পারে।
কর্পোরেট ব্যাংকিং এক্সিকিউটিভ অজয় তালুকদারের বছর চারেক বিয়ে হয়েছে। তিনি অভিযোগের সুরে বললেন, ‘আমার স্ত্রী মিতা, মাস গেলে যা টাকা মাইনে পায়, সবটাই সেভিংস করে। আমরা দুজনেই উপার্জন করি। কিন্তু খরচের দায় একা আমার!’ অজয়ের মতো আরও যেসব পুরুষেরা মনে মনে এমন ধারণা পোষণ করেন, তাদের ভাবনা বদলানোর সময় এসেছে। কোনও লোভের বশবর্তী হয়ে মেয়েরা এমন করে না। তারা টাকা জমিয়ে রাখে ভবিষ্যতকে সুন্দর করতে।
পার্সোনাল হেলথ পলিসি
২৮ বছরের তৃণা সামন্ত সদ্য একটি পার্সোনাল Health Policy নিয়েছে। কিন্তু ওর আক্ষেপ, ‘ইএসআই বা চাকরি থেকে পাওয়া অন্যান্য মেডিকেল পলিসির সুবিধা এখন এতটাই বেড়ে গেছে যে, অধিকাংশ পুরুষ বন্ধুরাই পার্সোনাল মেডিকেল পলিসি নিতে উৎসাহ দেখাচ্ছে না। ওরা ভুলে যাচ্ছে যে, অফিস থেকে পাওয়া এসব পলিসি যতই সুবিধা দিয়ে থাকুক না কেন, তার স্থায়িত্ব ততক্ষণ, যতক্ষণ আপনার চাকরি আছে।’
সুতরাং নিজের এবং পরিবারের কথা ভেবেই, ভবিষ্যতের সুরক্ষাকে নিশ্চিত করতে পুরুষদের উচিত পার্সোনাল হেলথ পলিসিতে নিবেশ করা।
অকারণ খরচ থেকে বাঁচুন
এ যুগের এক তরুণী, ঝিলমিল সরকার কলকাতার একটি ট্র্যাভেল এজেন্সিতে চাকরি করে। সে জানাল, ‘আমার বর প্রতি বছরেই ফুল ফ্যামিলির সাথে অন্তত দুটো লম্বা টুর করে, ফলে আমাদের প্রচুর পয়সা খরচ হয়। কিন্তু কাছাকাছি কোথাও বেড়াতে গেলেও তো একইরকম আনন্দ হতে পারে। খরচাও বাঁচবে। ও আমার কথা শোনেই না।’
এই সমস্যা শুধু ঝিলমিলের নয়। বেড়াতে যাওয়ার নামে এমন অনেক অর্থ বিনা প্রয়োজনে ব্যয় হয়। ঝিলমিলের হাজব্যান্ডের মতো বাকি পুরুষদেরও এটা বোঝা উচিত যে, মেয়েরা সঞ্চয় করতে চায় ভবিষ্যতের কথা মাথায় রেখে, কৃপণতা করে নয়।
সুতরাং মেয়েদের মনের কথা বুঝতে চেষ্টা করুন। স্বামী-স্ত্রী দুজনে মিলে জীবনযুদ্ধে এগিয়ে চলুন।