টালিগঞ্জ-এ তাঁর আসাটা শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ে হাত ধরে। ইতিমধ্যেই বেশ কিছু ছবিতে কাজও করে ফেলেছেন তিনি। চল কুন্তল বা হামি ছবিতে যথেষ্ট প্রশংশিত হয়েছে তাঁর কাজ। রাতারাতি তাঁকে বিখ্যাত করেছে রঙ্গবতী আর লাল গেন্দা ফুল-এর নাচ৷কিন্তু এসবের বাইরে কেমন মানুষ দেবলীনা কুমার ? আসুন জেনে নেওয়া যাক৷
নানা সময়ে আপনি বলেছেন নাচ আপনার ধ্যানজ্ঞান। সেটাই কি আপনাকে অভিনয়ে ক্ষেত্রে নিয়ে এল?
হ্যাঁ নাচ আমি খুব ছোটোবেলা থেকে শিখেছি। একদম ছোটোতে ভরতনাট্যম শিখতাম অর্কদেব ভট্টাচার্যের কাছে। তারপর কিছুদিন ওডিশিও শিখেছিলাম সুতপা তালুকদারের কাছে। কিন্তু বেসিকালি মণিপুরি নিয়ে আমার মাস্টার ডিগ্রি। কলাবতী দেবীর ছাত্রী আমি, ওঁর কাছেই শিখেছি প্রায় ১০-১১ বছর। নাচই আমার মধ্যে পারফর্মিং আর্টস-এর প্রতি আগ্রহটা তৈরি করে।
আমাকে স্টেজে দেখে অনেকেই বলেছেন, আমি ভালো এক্সপ্রেস করতে পারি, ভালো ইমোট করতে পারি। সেটাই আমায় সাহস জুগিয়েছিল অভিনয়ে আসার। কলেজে আসার পর মনে হয়েছিল নতুন কিছু করে দেখাই যাক না। আমাদের বাড়িটা যদিও ভীষণই কনভেনশনাল, যেখানে শুধু পড়াশোনাকেই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। তাই অভিনয় শেখার বা সেভাবে প্রস্তুতি নেওয়ার সুযোগ তেমন হয়নি।
প্রথমবার অভিনয়ে সুযোগটা কীভাবে হয়েছিল?
আসলে আমার বাবা দেবাশিস কুমারের সঙ্গে অনেকেরই পরিচয় আছে ইন্ডাস্ট্রির। কিন্তু উনি কোনও দিনই আমায় কারও সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেননি। কেবল একবার শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় যখন বাড়িতে এসেছিলেন, তখন তাঁর সঙ্গে আলাপ হওয়ায় উনি রামধনু ছবিটার প্রিমিয়ারে যাওয়ার জন্য ইনভাইট করেন। সেখানে দেখা হওয়ায় আমি কথায় কথায় জানিয়েছিলাম যে, আমার অভিনয়ে ইন্টারেস্ট আছে।
তারও প্রায় ২-৩ বছর পর উনি আমায় ওঁর শর্টফিল্ম জয়ী-তে কাস্ট করেন। ওটাই আমার প্রথম কাজ, ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত যেখানে আমার টিচার-এর ভমিকায় ছিলেন।
প্রথম কাজেই ঋতুপর্ণা সেনগুপ্তর মতো একজন জনপ্রিয় অভিনেত্রীর সঙ্গে অভিনয় করার ক্ষেত্রে চাপ কতটা ছিল?
সত্যি বলতে কী ঋতুদি অসম্ভব ভালো একজন মানুষ। অফ দ্য স্ক্রিন এবং অন স্ক্রিনেও। প্রত্যেকটা শটের পরে ঋতুদি বলত খুব ভালো হয়েছে। হয়তো অত ভালো শট দিইনি, কিন্তু এই যে প্রশংসটা, আমায় ভীষণ মোটিভেট করত আরও ভালো করতে। আমি এর আগে কখনও টেলিভিশনেও কাজ করিনি, স্টেজে নাটকও না। একেবারে সরাসরি বড়ো পর্দায় কাজ। ফলে এই মোটিভেশন আমায় খুব হেল্প করেছিল। লকডাউন-এর আগেও যে-ছবিটায় কাজ করছিলাম দত্তা, তাতেও ঋতুদি আছেন। এখনও আমাদের সম্পর্ক ভীষণ ভালো।
আপনার ক্ষেত্রে রাজনীতিতে যাওয়া অনেক সহজ ছিল। বাবা রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব বলেই নয়, আপনি নিজেও ছাত্র রাজনীতি করেছেন। তাহলে সেটাকে নিয়ে ভাবনা চিন্তা করলেন না কেন?
রাজনীতিতে আমার ছোটো থেকেই আগ্রহ, কারণ বাড়িতে ওই পরিবেশটাই দেখে বড়ো হয়েছি। তো আমার মনে হয়েছিল জীবনের যে-কোনও পর্যাযে খুব সাবলীল ভাবেই আমি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হতে পারি। কিন্তু অভিনয় তুলনায় আমার কাছে নতুন একটা মাধ্যম, যেটা আমার মধ্যে আকর্ষণ তৈরি করেছিল। আমার বাবা অবশ্য বলেন, রাজনীতির ক্ষেত্রটাতে পা রাখার মতো ম্যাচিয়োর্ড এখনও আমি হইনি (হাসি)। ভবিষ্যতে কখনও অবশ্য যুক্ত হব কিনা সেটা এখনও ঠিক করিনি। আপাতত অভিনয়টাই ভালো লাগছে।
বাবা প্রভাবশালী এবং জনপ্রতিনিধি হওয়ার সুবাদে পরিচিতিটাও বেশি। এটা আপনাকে কী সুবিধা বা অসুবিধার মধ্যে ফেলে?
এর ভালো দিক খারাপ দিক দুটোই আছে। ভালোটা হল, অনেকেই যখন বলেন ও তুমি দেবাদার মেয়ে ওনাকে তো আমি চিনি তখন ভেতর থেকে একটা আন্তরিকতার ছোঁয়া পাই। তবে এর খারাপ দিকটা হচ্ছে, অনেক সময়ই আমার আইডেন্টিটিটা যেটা এত বছর ধরে চেষ্টা করছি তৈরি করার, সেটা ধাক্কা খায়। অনেক প্রোডিউসার কাজ দিতে ভয় পান, এই ভেবে যে, বাবা যদি কাজের মধ্যে ইন্টারফেয়ার করেন। কিন্তু আমার বাবা যে-ধরনের মানুষ, আজ অবধি কোনও কিছুতে ইন্টারফেয়ার করেননি। ইন ফ্যাক্ট অনেক জায়গায় আমি পরিচয় গোপন করলেও কিছু মনে করেন না।
প্রাক্তন-এ যেমন আমার কাস্টিং হওয়ার পর, অভিনয় করার কয়েকদিন পরে বুম্বাদা জানতে পারেন আমার বাবার কথা। তখন দেবাদার মেয়ে হিসাবে একটা বাড়তি স্নেহ পেতে শুরু করি। অর্থাৎ এই পরিচয়টা কোথাও গিয়ে ভালো একটা ফিলিংও দেয়। আবার কোথাও কোথাও দেবলীনা হিসাবে আমার নিজস্বতা প্রতিষ্ঠা করতে ডাবল এফর্টও দিতে হয়।
ইন্ডাস্ট্রির বাইরের একজন মানুষ হিসাবে, ইন্ডাস্ট্রিতে ফুট হোল্ড পেতে কতটা স্ট্রাগল–এর মধ্যে দিয়ে যেতে হয়?
আমাদের ইন্ডাস্ট্রিটা এতটাই ছোটো যে, এখানে বেশি সংখ্যক মানুষই বাইরে থেকে আসেন। এখানে কাজটা মূলত পি-আর-এর উপর ভিত্তি করেই চলে। আর এই ব্যাপারটাতে আমি খুব খারাপ। মানে আমি কোনও পার্টিতে যাই না, আমার বাড়িতে এখনও সময়ে বাড়ি ফেরার একটা ডিসিপ্লিন আছে। প্লাস আমি যেচে খুব বেশি মানুষের সঙ্গে মেলামেশা করতে পারি না। ফলে আমার স্ট্রাগলটা বা এফর্টটা অনেকটা বেশি।
কেরিয়ারের শুরুতে বাড়িতে কতটা সাপোর্ট পেয়েছিলেন?
আমার মা আমার বিরাট বড়ো সাপোর্ট। শি ইজ আ বিজনেস উয়োম্যান এবং লেখিকা। ওনার একটা নিজস্ব পরিচিতি আছে। তো মা-খুবই চান আমিও আমার যোগ্যতায় প্রতিষ্ঠা পাই। পড়াশোনার ব্যাপারেও অবশ্য বাড়ির সবাই সিরিয়াস, ছবি যেমন করছি তেমন আমি এখন পিএইচডি-টাও করছি সোশিওলজি অফ ডান্স নিয়ে৷
অ্যাকাডেমিক্স–এ গুরুত্ব দেওয়া হয় বাড়িতে, সেই জন্যই কি আপনি রবীন্দ্রভারতীতে ফ্যাকাল্টি হিসাবে কাজ করেন?
হ্যাঁ আমি রবীন্দ্রভারতীতে রবীন্দ্র নৃত্যের ফ্যাকাল্টি হিসাবে যুক্ত। হয়তো লোকে বাবার কাছে আমার কাজের খুব প্রশংসা করে, বাবা এতে খুশি হন কিন্তু বেশি খুশি হন রবীন্দ্র ভারতীর অধ্যাপিকা হিসাবে আমার পরিচয় করাতে৷
একদিকে গ্লামারাস একটা প্রফেশন, উত্তম কুমারের বাড়ির বৌমা, অন্যদিকে অধ্যাপিকা সত্তা। ব্যালেন্স–এ সমস্যা হয় না?
গ্ল্যামারের সত্তাটাতে আমি এখনও অ্যাফেক্টেড হতে পারিনি (হাসি)। আমি নিজেকে এখনও খুবই সাধারণ একটা মেয়ে মনে করি। কেউ সেলিব্রিটি ভাবলেই বরং অস্বস্তি হয়। তাই পড়ানোর ক্ষেত্রে তেমন অসুবিধা হয় না।
গৌরব চট্টোপাধ্যায় এবং আপনার বৈবাহিক সম্পর্ক এবং ওয়েভলেংথ–এর পজিটিভ সাইড কী?
বায়াসড না হয়ে বলছি ও খুব ভালো একজন হাজব্যান্ড৷ ভালো অ্যাক্টরও। সেটা উত্তম কুমারের নাতি বলেই হয়তো হবে। ওর সঙ্গে আমার ওয়েলেংথ, জীবনের প্রতি ভাবনা চিন্তা, খুব মেলে। হয়তো এগুলোই সম্পর্কটাকে অনেকটা ম্যাচিয়োর্ড করে তুলেছে।
কাজ করতে করতে শেখা ব্যাপারটা আপনার ক্ষেত্রে কতটা ফলপ্রসূ হয়েছে?
পুরোটাই, কারণ শুরুটা শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ে হাত ধরে। ওঁদের ওয়ার্কশপগুলো সেটা প্রাক্তন-এর ছোটো রোল-এই হোক বা হামি-তে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আমায় অনেক কিছু ইমপ্রুভ করতে সাহায্য করেছে। চল কুন্তল করার সময় সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ে মতো মানুষের সংস্পর্শে এসেছি, সেখানে অনেক কিছু শিখতে পেরেছি। এছাড়া তেমন পরিচিত না হলেও সৌমিক রায় চৌধুরীর সঙ্গে কাজ করলাম, ওখিয়াগাড়ি নামের একটি শর্ট ফিল্ম-এ, মীর-এর বিপরীতে। এটাতেও অনেক কিছু শেখার সুযোগ হয়েছে।
পরবর্তীকালে কোনও বিশেষ চরিত্রে অভিনয় করতে চান?
খুব ইচ্ছে করে হিস্টোরিক ক্যারেক্টার করতে। নটী বিনোদিনীর চরিত্রে অভিনয় করতে চাই সুযোগ পেলে।