গুয়াহাটি বিমানবন্দরে যখন প্লেন-টা নামল তখন এক পশলা বৃষ্টি যেন প্রস্তুত হয়েই ছিল, আমাদের স্বাগত জানাবে বলে। গুয়াহাটি থেকে গাড়িতে আমরা যাব ভালুকপং। দূরত্ব ১৯০ কিলোমিটার। চা-বাগিচার মধ্যে দিয়ে পিচ রাস্তা পেরিয়ে, অসম-অরুণাচলের সীমান্ত শহরে এসে পড়লাম। তোরণদ্বার পেরোলেই ওপারে অরুণাচল। জিয়াভরালি নদীর ধারে এই ছোট্ট জনপদ ভালুকপং, অচিরেই মন কেড়ে নেয়। পরদিনের যাত্রাসূচি তৈরি করে নিই, রাতের আস্তানা অরুণাচল সরকারের ইন্সপেকশন বাংলোয় বসে।

পরদিন রওনা দিলাম দিরাং হয়ে বমডিলার উদ্দেশে। ভালুকপং থেকে দিরাং-এর বাসে চড়ে বসি। কামেং নদী পথের সঙ্গী। অপূর্ব গাছগাছালি ঘেরা পাহাড়ি নিসর্গ। রূপা আর টেঙ্গি উপত্যকা পেরিয়ে একসময় পৌঁছে গেলাম মেঘ-কুয়াশা ঘেরা বমডিলায়। চা-বিরতির পর পাড়ি দিলাম দিরাং-এর পথে।

দিরাং নদীর পাড়ে ছোট্ট জনপদ। চাষের জমি, নাসপাতি খেত, এই নিয়েই দিরাং। কাছাকাছি একটি উষ্ণ প্রস্রবণও আছে। পাইনের জঙ্গল পেরিয়ে এই জায়গাটিতে পৌঁছে এক আশ্চর্য মায়াময় পরিবেশের ঠিকানা মেলে। দিরাং নদীর কোলঘেঁষা বাংলোয় আমাদের থাকার ব্যবস্থা। প্রকৃতির রূপ-রস উপভোগ করে আমরা তাওয়াং যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিই গাড়িতে।

ইতিমধ্যেই ‘কোয়লা’ ছবির দৌলতে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে তাওয়াং। একটানা চড়াই পথে উঠে সেলা পাস পার হয়ে পৌঁছোতে হবে তাওয়াং-এ। পাহাড়ের উচ্চতা বাড়ায় সবুজ ফিকে হতে থাকে ক্রমশ। রাস্তায় চোখে পড়ে সেনা ছাউনি। একটু এগোতেই গ্লেসিয়ার পয়েন্ট—যার নাম সেলা লেক। প্রকৃতির রূপ পাগল করা। মন চায় না যেতে, তবু চলে যেতে হয়।

আবার গাড়িতে উঠে বসলাম। পৌঁছে গেলাম জং নামের একটি গ্রামে। এখানে এক বিশাল জলপ্রপাতের সঙ্গে দেখা। অদ্ভুত এই পরিবেশ, যেন রূপকথার দেশে এসে পড়েছি বলে ভ্রম হয়।

এবার রওনা হলাম আমাদের আসল গন্তব্য ৪০ কিমি দূরে তাওয়াং-এর উদ্দেশে। তাওয়াং-এর উচ্চতা প্রায় ১০,৮০০ ফুট। টুরিস্ট লজ-এ আগে থাকতেই ঘর সংরক্ষণ করা ছিল। অদূরেই তাওয়াং মনাস্ট্রি। ভারতের বৃহত্তম এই মনাস্ট্রি ৪০০ বছরের চেয়েও পুরোনো। এখানে রাখা ২৬ ফুট উঁচু বুদ্ধমূর্তি। তাওয়াং-এ আমাদের দ্রষ্টব্য এক অপূর্ব লেক, যার নাম পিতি সো। পারমিট দেখিয়ে সেনা প্রহরার নিয়মনির্দেশিকা পার হয়ে বরফ আর কুয়াশা মোড়া পিতি সো পৌঁছে, স্তব্ধবাক হয়ে যাই সেই সৌন্দর্যে। আর কিছুটা পথ পার হয়ে, আরও একটি লেক যার নাম সংগীতসর। ‘কোয়লার’ শুটিং-এর পর থেকে এটি ‘মাধুরী লেক’ নামেই পরিচিত। বরফশৃঙ্গ আর লেক-এর অপূর্ব নিসর্গ মন কেড়ে নেয়। অরুণাচল সফরে এটি অন্যতম প্রাপ্তি।

আমাদের সফরের শেষ দিকে এসে পড়েছি প্রায়। সেলা পাস পেরিয়ে এবার আমাদের বমডিলা যাত্রা। পাহাড়ের ঘেরাটোপে বমডিলা এক রূপসি পর্যটন ক্ষেত্র। বৌদ্ধ গুম্ফা, বাজার, ইত্যাদি নিয়ে বেশ জমজমাট। মেঘ-বৃষ্টি-কুয়াশার এক রূপকথার দেশ অরণাচল। পাহাড় আর প্রকৃতিকে ভালোবেসে এপথে পাড়ি না দিলে, হয়তো সারাজীবন আক্ষেপ থেকে যাবে।

 

 

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...