যান্ত্রিক জীবন-যাত্রার শিকার হচ্ছে এ যুগের বৈবাহিক সম্পর্ক marital relation। ‘চট মঙ্গনি পট বিবাহের’ পুরোনো প্রবাদ বদলে গেছে, ‘চট ঝগড়া, পট বিচ্ছেদ’-এর অসুখে। ধুঁকছে আধুনিক সমাজ। আমেরিকা, ইউরোপীয় জীবনে ডিভোর্স ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গেছে। পপস্টার জেনিফার লোপেজ তিনবার বিবাহবিচ্ছেদ করেছেন। অ্যাক্টর মডেল ওজানি নোয়া-র সঙ্গে তাঁর বৈবাহিক সম্পর্ক এক বছরও স্থায়ী হয়নি। জনপ্রিয় ড্যান্সার ক্রিস জুড, গায়ক মার্ক এলেনির সঙ্গেও লোপেজের গাঁটছড়া বেশিদিন টেকেনি।

লোপেজ উদাহরণমাত্র। খুঁজতে বসলে গাঁ-উজাড় হয়ে যাওয়ার জোগাড়। ভারতেও রোগটা দ্রুতগতিতে বাড়ছে। কিছুদিন আগে খবরের শিরোনামে এসেছিল ভোজপুরের সুনীতার বিবাহবিচ্ছেদের ঘটনা। বিয়ের দু-দিনের মাথাতেই স্বামী না-পসন্দ হওয়ায় সোজা ডিভোর্স চেয়ে আদালতে। ফেসবুকে সপ্তাহখানেকের প্রেম এবং তারপর বিয়ে। যত দ্রুত বিয়ের মণ্ডপে বসেছিলেন উল্লিখিত দম্পতি, ঠিক ততটাই দ্রুত ভেঙে যায় তাদের সম্পর্ক। মধুচন্দ্রিমা কাটাতে গিয়ে ঝগড়ার জেরে ঘোর কেটে রূক্ষ বাস্তবের সামনে দাঁড় করিয়ে দেয় দুজনকে।

অস্থিরতা, অসহিষ্ণুতা এর জন্য দায়ী। বাড়ি, অফিস, কাজ, ব্যস্ততার চাপে সম্পর্কের বন্ধন আলগা হচ্ছে। সম্পর্ক হল গাছের মতো। নিয়মিত জল দিতে হয়, নাহলে ক্রমে তা শুকিয়ে যায়। কিন্তু সবকিছু ভুলে পারিপার্শ্বিক চাপে আমরা যান্ত্রিক হয়ে পড়ছি। উচ্চাকাক্ষার ইঁদুর দৌড়ে সামিল হতে গিয়ে নিজের অজান্তেই কখন অতিপ্রিয় সম্পর্কগুলিকে নষ্ট করে ফেলছি। ভুলে যাচ্ছি অগ্নিকে সাক্ষী রেখে স্ত্রীর সঙ্গে সারাজীবন কাটানোর অঙ্গীকার। ব্রেক-আপ এখন আর বড়োসড়ো প্রভাব ফেলা কোনও ঘটনা নয়। রিয়ালিটি শো বিগ বস-এর গত সিজনে গওহর খান-কুশল ট্যান্ডনের যুগলবন্দি দর্শকদের নজর কেড়েছিল। যদিও সেই সম্পর্কের পরিণতিও সুখকর হয়নি।

নেট যুগে সবই নাগালের মধ্যে। ফাস্ট ফুড, ফাস্ট ট্র্যাক ঘড়ি, স্পিডি বাইক, ২ মিনিট নুডল্স, হাইস্পিড ইন্টারনেটস, অনলাইন শপিং, অনলাইন পিৎজা অর্ডার, অনলাইন মুভি টিকিট বুকিং, রেস্তোরাঁর টেবিল বুক করা– এক ক্লিকেই সব কিছু মিলে যাবে। রূপচর্চাতেও ইন্সট্যান্ট গ্লো– গতিই এ যুগের রস ও রসদ। যুবসমাজ এতটাই ফাস্ট হয়ে গেছে যে একদিকে যেমন কোনও কিছু পাওয়ার জন্য উদ্গ্রীব হয়ে ওঠে, তেমনই আবার তাকে বাতিলের খাতায় ফেলে দিতেও কসুর করছে না তারা। যুব সমাজের বদলে যাওয়া ব্যবহার, দৃষ্টিভঙ্গির পিছনে কী কারণ রয়েছে, এর প্রভাবই বা তাদের জীবনে কতটা, সেদিকে একটু চোখ বুলিয়ে নেওয়া যেতে পারে।

ফাস্ট ফুড কা ফান্ডাঃ  জীবনধারণের গুরুত্বপূর্ণ খাওয়াদাওয়াতেও যুব সমাজের চটজলদি পাওয়ার মনোভাব। রান্নার জন্য সময় বা অপেক্ষার বদলে দ্রুত রসনা তৃপ্তিতেই নজর তাদের।

প্রযুক্তির কৃপাঃ  প্রযুক্তি যুব সমাজের স্পিড বাড়িয়ে দিয়েছে। চিঠির বদলে জায়গা নিয়েছে মেসেজ। সেখানেও পুরো ওয়ার্ডের বদলে শর্টফর্ম। সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটগুলি হয়ে উঠেছে টিন এজারদের জীবনচর্যার অঙ্গ। বন্ধুদের সঙ্গে জুড়ে থাকার বন্ধন। আবার দূরত্বেরও। বার্থ-ডে হোক বা অন্যান্য সেলিব্রেশন– সোশ্যাল সাইট-ই ভরসা। আজকের যুব সমাজ বাজারের ভিড় এড়াতে অনলাইন শপিং পছন্দ করে। ঘুরে ঘুরে জিনিসপত্র হাতে নিয়ে নয়, এক ক্লিকে বাজার সারতেই বেশি ওস্তাদ তারা। স্মার্টফোন আসার পর কাজ আরও সহজ হয়ে গেছে। ক্লিক করলেই বইয়ের ভাণ্ডার হাতের সামনে– প্রয়োজন নেই লাইব্রেরি যাওয়ার।

সম্পর্কেও গতিঃ  কোনও জিনিসের জন্য অপেক্ষায় নারাজ বর্তমান প্রজন্ম। সম্পর্কের ক্ষেত্রেও শর্টকাটে বিশ্বাসী তারা। সময়ের আগে বা দ্রুত সবকিছু পেতে হবে। শারীরিক সম্পর্কেও অধৈর্য, অসহিষ্ণুতা কখনও কখনও অপরাধের পথে ঠেলে দেয় তাদের। চাকরি, সম্পর্ক, বন্ধুবান্ধব, ফ্যাশন, বিউটি– সব কিছু তাড়াতাড়ি এবং রেডিমেড চায়। নীতিবোধ, দায়বদ্ধতা শব্দগুলি ক্লিকে হয়ে যাচ্ছে। যে গার্লফ্রেন্ডকে পাওয়ার জন্য একসময় ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় নষ্ট করেছে, নতুন কাউকে পেয়ে তাকে নিমেষে বাতিল করে দিতে সময় লাগে না একমিনিটও। ফ্রেন্ডশিপ যেমন দ্রুত হয়, তেমনই কোনও সাদামাটা কথাকাটাকাটিতেই তা খতম হয়ে যায়। পছন্দ নয় তো ক্লিক করে আনফ্রেন্ড করে দিলেই হল।

চাকরির ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা একই। যুব সমাজ এক চাকরিতে বেশিদিন থাকতে চায় না। আজ এখানে তো কাল ওখানে– মাইনের সঙ্গে আরও উঁচুতে পৌঁছোনোর তাগিদ সর্বদা ছুটিয়ে নিয়ে বেড়ায় তাদের। প্রভাব পড়ে কাজ ও অফিসের প্রতি দায়বদ্ধতায়। দ্রুত লাফ মারার প্রচেষ্টা কোনও কোনও সময় বুমেরাং হয়ে ফেরে। দ্রুত শর্টকাট পদ্ধতিতে পাওয়া সাফল্যের ভিতটা নড়বড়ে হয়। বেশিদিন স্থায়ী হয় না। সম্পর্কের গুরুত্ব না বোঝা বা ধৈর্যের অভাব বৈবাহিক জীবনকে অতিষ্ট করে তোলে। ইচ্ছেমাফিক চলা, চাইলেই সবকিছু হাতের সামনে ও দ্রুত পাওয়ার অভ্যাস তৈরি হয়ে গেছে। ফলে বিপরীত হলেই অসহিষ্ণু হয়ে ওঠে তারা। সামান্য ইস্যুতে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কে ফাটল দেখা যায়। যার পরিণতি বিবাহবিচ্ছেদ। সন্তানধারণেও শর্টকাট রাস্তায় হাঁটছে বর্তমান যুগ। ৯ মাস গর্ভধারণের বদলে সারোগেট মায়ের দ্বারস্থ হচ্ছে অনেকে।

যুগের সঙ্গে তাল মেলানোঃ

মনোবিজ্ঞানিরা যুবসমাজের চটজলদি পাওয়ার বাসনাকে, ‘ইন্সট্যান্ট গ্র্যাটিফিকেশন’ নাম দিয়েছেন। ‘পারিপার্শ্বিক আবহ যুব সমাজের এহেন স্বভাবের মূল কারণ। স্কুল, কলেজের চাপ, সন্তানদের সব বিষয়ে সেরা এবং এগিয়ে রাখার বাবা-মায়ের চাহিদা, এহেন মানসিকতা গড়ে তোলে। গতির যুগে থেমে থাকলেই হারিয়ে যেতে হবে। এগিয়ে যেতে হলে পাল্লা দিয়ে চলতে হবে গতির সঙ্গে। সন্তানদের দুধে-ভাতে রাখতে অভিভাবকরা তাদের হাতের সামনে সবকিছু তুলে দেন। চাওয়ার আগেই সবকিছু পেয়ে যায় তারা। এই দ্রুত পাওয়ার অভ্যাসটাই পরবর্তী জীবনে সমস্যা তৈরি করে। পছন্দমাফিক জিনিস না পেলে ফ্রাস্ট্রেশন তৈরি হয়। ডিপ্রেশনে চলে যায় অনেকে। তাই ধৈর্য না হারিয়ে সকলেরই উচিত সম্পর্ক-কে সময় দেওয়া। কাজ তো থাকবেই তার মাঝেই সময় বার করুন। একসঙ্গে সময় কাটান। সম্পর্কের marital relation পোক্ত হবে। সমাজ থেকেও ‘ডিভোর্স’ নামক অসুখ দূর হবে।

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...