বদলির চাকরি অনুজার। রিটায়ারমেন্ট-এর আর বছর ছয়েক বাকি। তার মধ্যে আবার নাগপুরে ট্রান্সফারের অর্ডার। চাকরির সুবাদে প্রায় তিরিশটা বছর ঘরসংসার, স্বামী-সন্তান ছেড়ে থাকতে হয়েছে তাকে। তিনবছর আগে কলকাতায় পোস্টিং হওয়ার সময়তেই ঠিক করেছিল এবার কলকাতার বাড়িতেই পাকাপাকিভাবে থেকে যাবে। হাজার হোক এখানেই তার পরিবার। ভিআরএস নেওয়ার ডিসিশন নিয়েই ফেলেছিল। সেইমতো আজ কদিন যাবৎ-ই অফিস আর ব্যাংক-এ ছুটোছুটি করতে হচ্ছে তাকে। স্বামী অলোক ইউনিভার্সিটি যাওয়ার পথেই তাকে ব্যাংক-এ ড্রপ করে দিয়ে গেছে। কাজ শেষ করে বাইরে বেরোতেই অনুজার চোখে পড়ে আকাশের ভয়ংকর করাল রূপ। রাশি রাশি কালো মেঘ সূর্যকে একেবারে গ্রাস করে ফেলেছে। মেঘ ভেদ করে বিদ্যুত্যের তীব্র ঝলকানি যেন মেঘের বুক চিরে বেরিয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে এক লহমায় আকাশটা ভেঙ্গে পড়বে মাটিতে।
আর এক মুহূর্তও দেরি না করে একটা রিকশা ধরে সোজা বাড়ির পথে রওনা দেয় অনুজা। মাঝপথেই তুমুল বৃষ্টি শুরু হয়ে যায়। সঙ্গে হাওয়ার ভীষণ রকম দাপট। বৃষ্টিকে উপেক্ষা করেই রিকশা কোনওরকমে এগিয়ে চলে বাড়ির দিকে। ততক্ষণে ভিজে একেবারে কাকস্নান অবস্থা। রিকশা থেকে নেমে কোনওরকমে তালাটা খুলে সোজা বাথরুমে ঢুকে যায় অনুজা। তখনই কলিং-বেল-এর আওয়াজ কানে যায় তার। একবার নয় একাধিকবার। যেনতেনপ্রকারে শাড়িটা জড়িয়ে আইহোলে চোখ রাখতেই নজর পড়ে দরজায় পাশের বাড়ির মায়া। বেশ অবাকই লাগল অনুজার। এরকম ঝড়-জল মাথায় করে… কিছু ঘটল নাকি…!
দরজা খুলতেই হাঁফাতে হাঁফাতে ঘরে ঢুকে আসে মায়া। তার শরীরের বেশ খানিকটা অংশ ভিজে গেছে। চোখ একেবারে রক্তবর্ণ। কোনও কিছু বলার আগেই সামনে থাকা একটা তোয়ালে মায়ার দিকে এগিয়ে দেয় অনুজা। ‘কী হয়েছে এরকম অবস্থা কেন তোমার?’
‘রিনিকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না অনুজা।’ শুনেই বুকটা ছ্যাঁৎ করে ওঠে অনুজার।
‘কী যা-তা বলছ?’
‘সেই কোন সকালে বাজার যাচ্ছি বলে বেরিয়েছে, আড়াইটে বাজতে চলল এখনও ফেরেনি। ফোনেও পাচ্ছি না, লাগাতার সুইচড্ অফ আসছে। আমি একা মানুষ কী করি বলোতো?’
মায়ার স্বামী অনেক বছর আগেই গত হয়েছেন।
সংসার বলতে ছেলে নীহার আর ওই বউমা রিনি। ছেলে মাস ছয়েক হল কর্মসূত্রে দুবাইতে। ওখানে সেটেল করেই বউকে নিয়ে যাওয়ার কথা। তার মাঝেই এই বিপত্তি।
‘দাঁড়াও দাঁড়াও এখনি এত ঘাবড়িয়ো না। ঝড়জলে কোথাও আটকে পড়েছে হয়তো। বৃষ্টি থামলেই চলে আসবে।’ সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করে অনুজা।
‘না গো প্রসূনরা পর্যন্ত খুঁজে এসেছে। আমি নিজে দু-বার বাজারের দিকটা দেখে এসেছি।’
‘কিন্তু বাজারের উপর দিয়ে তো একটু আগে আমি-ই ফিরলাম। কই কিছু চোখে তো পড়ল না। তবে বিশুর দোকানে একদল ছেলে কী যেন একটা বলা-বলি করছিল, কানে এল… কার বউ? কার বউ এরকম কিছু একটা… বৃষ্টির মাঝে ওইটুকু সময়ের মধ্যে আমিও ঠিক বুঝতে পারিনি।’ চোখেমুখে বিস্ময়ের স্পষ্ট ছাপ ফুটে ওঠে মায়ার। অনুজার মুখের দিকে হতভম্বের মতো তাকিয়ে থাকে মায়া। যেন ও-ই একমাত্র অবলম্বন। পারলে ও-ই পারবে তাকে উদ্ধার করতে। ফ্ল্যাট কালচারে অভ্যস্ত ব্যস্ত মানুষজন কেউ কারওর খোঁজ না রাখলেও এই তিন বছরে বেশ বন্ধুত্ব হয়েছে তাদের দুটির। তাই মায়ার আশার পারদটাও বোধকরি একটু বেশিই।
কয়েক সেকেন্ড চুপ থাকার পরে অনুজা আবার প্রশ্ন করে, ‘আচ্ছা রিনির বন্ধুবান্ধবদের ফোন করে খোঁজ নিয়েছিলে?’
‘এখানে ওর বন্ধুবান্ধব কে-ই বা আছে। এই তো কটাদিন হল বিয়ে হয়েছে।’
‘হ্যাঁ, সেটাও ঠিক। ঝগড়া-টগড়া কিছু হয়েছিল নাকি?’
‘তুমি তো জানো, আমি ওকে কীভাবে আগলে আগলে রাখি। নীহার থাকে না বলে উঁচু গলায় কথা পর্যন্ত বলি না। পাছে মেয়েটা কষ্ট পায়।’ বলতে বলতে থেমে যায় মায়া। কী যেন ভাবতে শুরু করে। হঠাৎই চমকে উঠে অনুজার হাতদুটো চেপে ধরে, ‘কোনও দুর্ঘটনা ঘটেনি তো?’ মুখে একরাশ যন্ত্রণা নিয়ে সামনে রাখা চেয়ারে সজোরে বসে পড়ে মায়া। দুচোখ দিয়ে অনবরত জল গড়িয়ে পড়ে তার।
‘না না বাজার তো মোটে মিনিট দশেকের রাস্তা। সেরকম কিছু ঘটলে এতক্ষণে খবর পাওয়া যেত। তাছাড়া আমি তো ওখান দিয়েই এলাম, কিছু ঘটলে অ্যাটলিস্ট কানে তো আসত।’
রাত পর্যন্ত রিনির কোনও খোঁজ পাওয়া গেল না। দশটা নাগাদ অনুজার স্বামী অলোকের সাথে মায়া থানায় একটা ডায়ারি লিখিয়ে এল। সেখানেও এক বিপত্তি, যিনি ডায়ারি লিখবেন তাঁর হাজারো রকম প্রশ্ন, ‘ছেলে-বউ কেন আলাদা থাকত? নিশ্চয়ই কোনও গড়বড় কেস… পণ দিতে পারেনি তাই বোধহয় আপনারা অত্যাচার করতেন? দেখুন কোনও ইয়ারের সঙ্গে পাত্তাড়ি গুটিয়ে বেমালুম ফুর্তিতে আছে। আপনারা অযথাই টেনশন করছেন আর রাতবিরেতে আমাদেরও টেনশন দিচ্ছেন।’
সকাল থেকে কেঁদে কেঁদে মায়ার বেহাল অবস্থা, তার উপর ওনার এইধরনের অপ্রত্যাশিত প্রশ্নবাণে যেন আরও ভেঙে পড়ে মায়া। এই নিয়ে পুলিশ অফিসারের সঙ্গে অলোকের প্রায় বচসা বাধতে বসেছিল।
‘এক্সকিউজ মি অফিসার। একজন মহিলার সঙ্গে আপনি এভাবে কথা বলতে পারেন না।’
‘আপনি কে মশাই? আপনি আমাকে বলে দেবেন আমি কার সাথে কীভাবে কথা বলব?’
‘অফকোর্স। প্রয়োজন পড়লে তা-ও করব।’ চ্যাঁচামেচি শুনে ভিতর থেকে আর এক উচ্চপদস্থ অফিসার সামনে আসতেই ব্যাপারটা সহজ হয়ে যায়। মেয়ের কলেজের প্রফেসার বলে কথা। ব্যাপারটা সেখানেই গুটিয়ে যায়। ওনাকে পার্সোনালি এই কেসটা দেখার জন্য অনুরোধও করে আসে অলোক।
বছর ঘুরে গেলেও এই কেসের কোনও সুরাহা করতে পারে না পুলিশ। এই ঘটনার পরে পরেই দুবাই থেকে মায়ার ছেলে এসে চার-পাঁচ মাস থানা-পুলিশ করে করে অবশেষে নিরাশ হয়ে সেও পুলিশের অনুমতি নিয়ে কাজের জগতে ফিরে যায়। রিনির বাপের বাড়ির লোকজনের সঙ্গে মায়াদের ভীষণ ভালো সম্পর্ক। তারাও খুব ভালো করেই জানত রিনির অন্তর্ধানের পিছনে অন্তত তার শ্বশুরবাড়ির লোকজনের বিলক্ষণ কোনও হাত নেই। প্রথম প্রথম সকলে ভেবেছিল অপহরণ হলেও হতে পারে। কিন্তু কয়েকদিন পরেই সে ভুল ভেঙে যায় সকলের। কারণ অপহরণ হলে অন্ততপক্ষে অপহরণকারীরা টাকার দাবি করত। সেরকম কিছু ঘটেনি।
এতদিনে তাদের বদ্ধমূল ধারণা হয়েছে হয়তো অ্যাক্সিডেন্ট হয়ে মারা গেছে মেয়েটা। ট্রেস না পেয়ে হয়তো মর্গ থেকে বার করে আর-পাঁচটা বডির সাথে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। আর নয়তো দুষ্কৃতীদের হাতে…।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে খোঁজখবর করা প্রায় ছেড়ে দিয়েছিল সকলেই। এমনকী পুলিশও হাত গুটিয়ে নিয়েছিল এই কেসটা থেকে। মায়া-ই মেয়েটার আত্মিক বন্ধন ছিঁড়ে বেরোতে পারেনি। মাঝে মাঝেই রিনিকে নিয়ে তার কপালে চিন্তার ভাঁজ ফুটে উঠত। রিনির বাবা-মা তো কবেই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে ওই একরত্তি মেয়েটাকে দাদা-বউদির ভরসায় ছেড়ে গিয়েছিল সেই দাদা-বউদিও বোধকরি মেয়েটাকে নিয়ে অত ভাবে না, যতটা মায়া। কথা বলতে বলতে কোনও না কোনও কারণে রিনির প্রসঙ্গে ঠিক টেনে আনবেই। ‘কত শখ করে বাড়ির বউ করে এনেছিলাম মেয়েটাকে। নিজের পছন্দ নিয়ে কত গর্ব ছিল আমার। কোনওদিন একা কোথাও যেত না, সবসময় আমাকে সঙ্গে নিয়ে…। কী যে হয়ে গেল…’ অনুজা বোঝানোর আপ্রাণ চেষ্টা করলেও মনে মনে খুব ভালো করেই জানত এই ঘা সারাজীবনেও যাওয়ার নয়।
একদিন বিকেলে অনুজা আর মায়ার কথা হচ্ছিল। ‘দ্যাখো মায়া, মনে হয় না রিনি আর কোনওদিন ফিরে আসবে। দেখতে দেখতে তো অনেকগুলো দিন-ই কেটে গেল। এবার ছেলের একটা বিয়ের বন্দোবস্ত করো। ওর তো সারা লাইফটা পড়ে রয়েছে। এভাবে তো আর একা একা…’ অনুজার কথাগুলো শুনেই মুহুর্তে মায়া-র চোখমুখ কেমন ফ্যাকাশে হয়ে গেল। কিছুক্ষণ স্থির থাকার পর একটা ক্ষীণ স্বর কানে গেল অনুজার। ‘রিনির জায়গায় অন্য কেউ….?’ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মায়া, ‘জানি নীহারের কথাও তো ভাবতে হবে। এখন ও যা ভালো বোঝে।’ মায়ার কথা শুনে একটুও অবাক হয়নি অনুজা। বরং মনে মনে ভেবেছে একটা মানুষকে কতটা ভালোবাসলে তবে তার থেকে এই ধরনের উত্তর আশা করা যায়। মায়ার মনের অবস্থা বুঝে প্রসঙ্গ এড়িয়ে যায় অনুজা। এদিক-ওদিককার নানারকম কথায় ব্যস্ত করে তোলে মায়াকে।
‘ওহ্ পাওলির বিয়ের গিফট-টা তোমাকে দেখানো হয়নি না?’
‘দেখেছ, একদম মাথা থেকেই বেরিয়ে গিয়েছিল, পাওলি-র বিয়েতে তোমার আবার দিল্লি যাওয়ার আছে না। কবে যেন বলেছিলে। ছাব্বিশ না সাতাশ কী যেন একটা…’ মনে করতে পারে না মায়া।
‘আরে সামনের সপ্তাহেই তো। বুধবার রাতে ট্রেন। দাঁড়াও তোমাকে জিনিসটা দেখাই।’ বলে মিনিট খানেকের মধ্যেই জিনিসটা নিয়ে এসে মায়ার হাতে ধরিয়ে দেয় অনুজা।
‘বাহ্, সেট-টা খুব সুন্দর হয়েছে। খুব ভালো মানাবে ওকে।’
সময়ের চাকা কখন যে কোনদিকে ঘোরে তা বোধকরি স্বয়ং উপরওয়ালারও বোধগম্যের বাইরে। অনুজার বড়দির ওই একমাত্র মেয়ে পাওলি। বাঙালি পরিবার হলেও বিগত বাইশ বছর দিল্লিতে থেকে ওখানকার রঙেই রাঙিয়ে নিয়েছে নিজেদের। অনুজারা দু’দিন আগেই বড়দির বাড়ি পৌঁছে গিয়েছে। আলাদা করে একটা মেহেন্দির অনুষ্ঠানও রাখা হয়েছে। ডিজে-র তালে তালে সকলে মেতে উঠেছে। অনুজারও বেশ ভালো লাগছিল। এমন সময় জনাকয়েক রব তুলল, ‘পাম্মি গেল কোথায়? এখনও এসে পৌঁছোয়নি? ও না এলে কী মেহেন্দির অনুষ্ঠান জমে?’
‘এই পাম্মি-টা আবার কে রে? বিশেষ কেউ?’ দিদি অনুভাকে প্রশ্ন করে অনুজা।
‘আরে না-না, দিল্লি, মুম্বইতে আজকাল মেহেন্দির অনুষ্ঠানে লাইভ গানের বেশ একটা চল হয়েছে। পাম্মি ওই একটা অর্কেস্ট্রা সেটের সঙ্গে গান করে। বেশ ভালো গলা মেয়েটার। একটা শোয়ের জন্য তিন হাজার টাকা করে নেয়।’ হাসতে হাসতে জবাব দেয় দিদি অনুভা।
মিনিট দশ বাদে বেশ একটা সুরেলা, মধুর কণ্ঠ কানে আসে অনুজার। সেই সুরকে লক্ষ্য করে দৃষ্টিনিক্ষেপ করতেই এক ঝটকায় মাথাটা ঘুরে যায় অনুজার। অনায়াসেই মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে, ‘রিনি’!
অনুভা মেহেন্দি লাগাতে লাগাতেই মুখটা ঘুরিয়ে বলে, ‘রিনি! সেটা আবার কে?’
‘এযে অবিকল রিনি। আমার পাশের বাড়িতে মায়া আছে না। তুই তো দেখেছিস। ওর বউমা, বছরখানেক হল নিখোঁজ। তারপর আর…’ অর্ধেক কথা মনের মধ্যেই চাপা রয়ে গেল অনুজার। সকলে মেহেন্দি আর গানবাজনার মধ্যে ডুবে রয়েছে। পাম্মিও গাইতে গাইতে পাওলির পরিবারের একএকজনকে স্টেজে ডেকে নিয়ে বেশ জমিয়ে নাচাচ্ছে। অনুজার দিকে এগিয়ে আসতেই পাম্মির অমন চাঁদপানা মুখটা কেমন যেন তামাটে হয়ে গেল।
অনুজার মুহূর্তও লাগেনি ব্যাপারটা আঁচ করতে। রিনি নিশ্চয়ই তাকে চিনে ফেলেছে। কিন্তু ও যদি সত্যি সত্যি রিনি-ই হয়ে থাকে, তাহলে এখানে কী করছে? ছোটোখাটো এরকম একটা অর্কেস্ট্রা গ্রুপ-এ…? এটা কীভাবে সম্ভব? এমন হাজারো প্রশ্ন ঘুরপাক খেতে থাকে অনুজার মনে। মনে মনে ঠিক করে যে ভাবেই হোক একবার মেয়েটার মুখোমুখি হতেই হবে। আসল ব্যাপারটা কী, তাকে জানতেই হবে। সেই সুযোগের অপেক্ষাতেই ছিল অনুজা। মেহেন্দি লাগাতে বসেও চোখ আটকে রইল সেই পাম্মির দিকেই।
মেহেন্দির পরেই খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। খাওয়ার ফাঁকেই মেয়েটা কোথায় যেন সরে পড়েছে। মেয়েটার খোঁজে অনুজার চোখ নিরন্তর এদিক-ওদিক করতে থাকে। অনুষ্ঠান শেষে যে-যার বাড়ির দিকেও রওনা দিয়েছে। এমন সময় হঠাৎ-ই দিদি অনুভাকে হন্তদন্ত হয়ে ঘোরাফেরা করতে দেখে অনুজা। ‘কি হল এভাবে এদিক-ওদিক করছ কেন?’
‘আর বলিস না। পাম্মিকে কোথাও দেখতে পাচ্ছি না। ওর টাকাটাও তো দেওয়ার ছিল। কত কাজ ওদিকে।’
‘ঠিক আছে তুমি যাও। আমি থাকছি এখানে। টাকা নিতে এলে দিয়ে দেব।’
কিছুক্ষণ পর একটা পায়ের শব্দ কানে আসে অনুজার। ধীর পায়ে কেউ এগিয়ে আসছে সেই ঘরের দিকেই। ধারণা একদম ঠিক।
‘ম্যাডাম, আমার টাকাটা।’
‘রিনি, টাকাটা আমার কাছে আছে। ভিতরে এসে নিয়ে যাও।’
একটু সাহস সঞ্চয় করে ঘরে ঢুকে পাম্মি জবাব দেয়, ‘আপনি বোধহয় ভুল করছেন, আমার নাম পাম্মি।’
‘হ্যাঁ, কিন্তু তবু কেন জানি না মনে হচ্ছে তুমি আমাদের সেই রিনি-ই। যার জন্য তার শাশুড়ি আজও পথ চেয়ে বসে আছে। যদি কখনও তার আদরের বউমা…’
‘এসব শোনার সময় আমার নেই। টাকাটা দিন তাড়া আছে।’ একটু কঠোর হওয়ার চেষ্টা করে পাম্মি। অনুজার হাত থেকে টাকার খামটা নিয়ে উদভ্রান্তের মতো বেরিয়ে যায় ঘর থেকে।
পাম্মি চলে যাওয়ার পরও অনুজা সেখানে দীর্ঘক্ষণ বসে রইল। মাথায় কতকিছু যে ঘুরপাক খাচ্ছে তার। মনটা কেমন যেন ভার ভার লাগছে। রাতেও ঠিক করে ঘুমোতে পারেনি অনুজা। চোখ বুজলেই সেই সরল সাধাসিধে মুখটা ভেসে উঠছে চোখের সামনে। বারবার যেন কেউ কানের কাছে বলে চলেছে, ‘ওর জায়গায় অন্য কেউ?’
সকালে একদম আলাদা পরিবেশ। বিয়ের দিন বলে কথা। চতুর্দিকে হইহুল্লোড়, ব্যস্ততা। সাজো সাজো রব। তার উপর সানাইয়ের সুর। মনটা বেশ ফুরফুরে হয়ে উঠেছিল অনুজার। সব ভুলে সেও বিয়েতে মেতে উঠেছিল। মেক-আপ করাতে বিউটিশিয়ানের পাশে বসতেই সে কানের কাছে ফিসফিসিয়ে উঠল, ‘দিদি ম্যায় রশ্মি। আপনি-ই অনুজা দিদি আছেন, না?’
অনুজা বেশ চমকে গেল, তাকে কী করে চিনল রে বাবা? এর আগে কোথাও। দেখতেও বেশ। বাঙালির সঙ্গে থেকে থেকে বাংলা হিন্দি মিশিয়ে একটা আলাদাই ভাষা তৈরি করেছে এরা। সাঁতপাঁচ ভাবতে থাকে অনুজা। এমন সময় সে আবার বলে ওঠে, ‘দিদি কাল দোপহর কো কুছক্ষণ কে লিয়ে বাহার আসতে পারেন কী? আপসে জরুরি কাম হ্যায়।’
‘আমার সাথে, মেরা মতলব হ্যায় কে মুঝ সে? ম্যায় তো ইহা রহতি ভি নেহি অউর কিসি কো পহচানতি ভি নেহি…’
‘দিদি উয়ো পাম্মি আছে না ও আপনার সাথে দেখা করতে চায়। উয়ো ভি আকেলে মে। একদম আমার পাশেই থাকে, আপনি যাবেন দিদি?’
মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানায় অনুজা। মনে মনে ভাবে পাম্মি দেখা করতে চেয়েছে মানেই– সে ঠিক তার অনুজা আন্টিকে চিনতে পেরেছে।
পরের দিন সময়মতো রশ্মির সাথে বেরিয়ে পড়ে অনুজা। এই নিয়ে আগে থেকেই দিদি অনুভার সঙ্গে সাঁট করে রেখেছিল সে। কথাই ছিল তারা বেরোনো মাত্রই ড্রাইভার সদানন্দ গাড়ি নিয়ে তাদের পিছু পিছু যাবে। যদি কিছু বেগতিক দেখে সদানন্দ সামলে নেবে। রশ্মির অটোতে ওঠার কথা বলতেই বেশ ভয় ভয় করছিল অনুজার, পাম্মি-র সাথে দেখা করতে যাওয়ার চক্বরে যদি কোনও ঝামেলায় ফেঁসে যায়। পরে সদানন্দের কথা ভেবে ভয় কেটে যায়। অটোতে উঠে বসে। মিনিট দশ পরে অটোটা একটা বস্তির সামনে এসে দাঁড়াতেই মুখে রুমাল চাপা দিয়েই রশ্মিকে জিজ্ঞাসা করে অনুজা, ‘তোমরা এখানে থাকো?’ রশ্মি ধীর গলায় জবাব দেয়, ‘দিদি, আমাদের মতো….’
‘ঠিক আছে।’ আরও কিছু বলার আগেই রশ্মিকে থামিয়ে দেয় অনুজা। অটো থেকে নেমে মিনিট পাঁচেক ভিতরে গিয়েই একটা দরজা ধাক্বায় রশ্মি। দরমার বাড়ি। একেবারে হাইড্রেনের গা ঘেঁষে রয়েছে। খানিকটা হেলেও পড়েছে। রাস্তার দুপাশে থরে থরে হাইড্রেন থেকে নোংরা তুলে রাখা। দুর্গন্ধে গা ঘিনঘিন করে ওঠে অনুজার। কোনওরকমে সামলে নেয় নিজেকে। অভিজ্ঞ চোখ পরখ করতে থাকে সবকিছু। ঠিক তখনই দরজাটা খুলে দেয় পাম্মি। হাত ধরে ভিতরে নিয়ে গিয়ে একটা ভাঙা চেয়ারে বসতে দেয়।
‘তাহলে আমার ধারণাই ঠিক। কী রিনি তাই তো?’ কোনও জবাব দিতে পারে না পাম্মি। মাথা নীচু করে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে অনুজার সামনে। চোখ দিয়ে টপটপ করে জল গড়িয়ে পড়ছে মাটিতে। রিনির হাতটা ধরে সামনের চৌকিতে বসায় অনুজা। মিনিট কয়েক এভাবেই কেটে যায়। কাঁদলে খানিক হালকা হবে এই ভেবে অনুজাও বাধা দেয়নি। এর মাঝে চা নিয়ে ঢুকে পড়ে রশ্মি। দু-জনকে দু-ভাঁড় চা দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায় সে। চা খেতে খেতে ঘরের ভিতরটায় ভালো করে চোখ বুলিয়ে নেয় অনুজা। আসবাব বলতে এই একটা চৌকি আর একটা আলনা। এক কোনায় রাখা রয়েছে একটা স্টোভ আর কয়েকটা বাসনপত্র। অনুজা তার ক্ষুরধার দৃষ্টি দিয়েই রিনির অবস্থাটা খানিক আঁচ করে ফেলে। চেহারাতেও দৈন্যতার ছাপ ফুটে উঠেছে। চোখের নীচে কালি পড়েছে। পরনের কামিজটাও দু-এক জায়গায় ছেঁড়া। নিজের মনটা ঘোরায় অনুজা। চায়ে চুমুক দিতে দিতেই প্রশ্ন করে, ‘এবার বলো তো এখানে কী করে এলে? কেউ কি জবরদস্তি…?’
ততক্ষণে পাম্মি নিজেকে খানিক সামলে নিয়েছে। খুব ধীরভাবে বলে ওঠে, ‘না কেউ জবরদস্তি করেনি। আমি স্ব-ইচ্ছায় চলে এসেছি।’
রিনির কথা শুনে অবাক হয়ে যায় অনুজা। বোকার মতো তাকিয়ে থাকে ওর মুখের দিকে। মেয়েটা এসব কী বলছে নিজের ইচ্ছায়…! মাথাটা গুলিয়ে যাচ্ছিল অনুজার। তাকে এতদিন সে যেভাবে চিনত, জানত– মেলাতে পারছিল না কিছুতেই। ওদিকে এতদিন পরে কাছের একজনকে পেয়ে জমাট বাঁধা আবেগগুলো ঝড়ের গতির মতো বেরিয়ে আসছিল রিনির মুখ দিয়ে। ‘ছোটো থেকেই ইচ্ছে ছিল বড়ো গায়িকা হব। স্কুলকলেজেও সবাই আমার গানের গলার খুব তারিফ করত। যতদিন বাবা-মা ছিল ততদিন একরকম ছিলাম, তারপর দাদা-বউদি একপ্রকার জোর করেই আমার মতের বিরুদ্ধে গিয়ে বিয়েটা দিয়ে দিল। ধরেই নিয়েছিলাম আর-পাঁচটা মেয়ের মতো আমার এত দিনের সাজিয়ে রাখা স্বপ্নটাও চারদেয়ালের মধ্যে আটকে রয়ে যাবে। ভাবলেই দম বন্ধ হয়ে আসত। কেমন যেন একটা জেদ চেপে বসেছিল। নিজেকে প্রমাণ করবার। সুযোগও পেয়ে গেলাম। বিয়ের পাঁচ মাস পরে নীহার দুবাই চলে গেল। সংসারে তখন মা আর আমি। তখনও ভাবিনি এরকম একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে বসব। ও যাওয়ার পর শূন্যতা যেন আরও ঘিরে ধরল আমায়। একাকীত্ব কাটাতে আঁকড়ে ধরলাম গানকে। দিনরাত ওই নিয়েই পড়ে থাকতাম। সময় তো কাটাতে হবে। ঠিক ওই সময়েই স্বাতীর সাথে আলাপ।’
‘স্বাতীটা কে?’
‘ওই যে দিনকতকের জন্য প্রসূনদাদের বাড়িতে এসেছিল না। মা তখন নিয়ে গিয়েছিল ওদের বাড়িতে। ওনার মুখেই শুনেছিলাম দিল্লিতে কোনও একটা বড়ো চ্যানেলে নাকি গানের অডিশন শুরু হচ্ছে। একবার সিলেক্ট হতে পারলেই আর পিছন ফিরে তাকাতে হবে না। টিভিতেও সেই অডিশনের সম্পর্কে জানতে পারি। আর ধরে রাখতে পারিনি নিজেকে। কিন্তু ভাগ্যের পরিহাস দেখুন, দুদিন ধরে দীর্ঘ লম্বা লাইনে অপেক্ষা করতে করতে হঠাৎই একজন অসুস্থ হয়ে পড়ে যাওয়াতেই বিপত্তি ঘটে গেল। উত্তেজিত জনতার মারামারি, পুলিশের লাঠিচার্জ– অডিশনটাই আর দেওয়া হল না।’ ঘরটার মধ্যে কেবল একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস শোনা গেল।
এতক্ষণ মন দিয়ে শুনছিল অনুজা। এবার আর নিজেকে ধরে রাখতে পারল না, ‘তোমার গানের গলা খুব সুন্দর, এটা অস্বীকার করার জায়গা নেই। কিন্তু তাই বলে তুমি যে পদক্ষেপ নিয়েছ সেটা কি ঠিক? তুমি তো শ্বশুরবাড়িতে থেকেও তোমার স্বপ্নপূরণ করতে পারতে। মায়াকে আমি যতদূর চিনি-জানি, ও কোনওদিন বাধা দিত না।’
‘তখন বুঝিনি, কতবড়ো ভুল সিদ্ধান্ত নিতে চলেছি। আমার জীবনটাই নষ্ট হতে বসেছে। কী যে হল সেদিন… না হলে ওইরকম স্বামীকে ছেড়ে মাকে ছেড়ে চলে আসি কখনও। নীহারও কতবার ফোনে বলেছে ‘আর ক’টা দিন একটু কষ্ট করো। আমি যত তাড়াতাড়ি পারি তোমাকে আমার কাছে নিয়ে চলে আসব।’ তবুও কেন যে… শুধু মনে হতো সংসারে থাকলে আমি জীবনে কিছু করতে পারব না। আমাকে এখান থেকে বেরোতেই হবে। আসলে সবই আমার নিয়তি।’
‘বুদ্ধিবিভ্রম বলো বা নিয়তি-ই বলো ভুল তো তুমি করেইছ। আচ্ছা একটা কথা বলো তো শুধুমাত্র অডিশন দেওয়ার জন্য একটা অজানা-অচেনা শহরে কোনও চেনাপরিচিতি ছাড়াই হুট করে চলে এলে? এটা ঠিক বিশ্বাসযোগ্য মনে হল না!’
‘আমার কলেজের এক বান্ধবী থাকে এখানে। ওর ঠিকানা সম্বল করেই বেরিয়ে পড়ি। এখানে এসে দেখি ওরাই একটা ঘরে কোনওরকমে দিন গুজরান করছে। সেখানে আবার বাড়তি আমি।
কষ্ট করে কটাদিন থেকে গেলাম ওখানে। একটু সুযোগের জন্য এই স্টুডিয়ো থেকে সেই স্টুডিয়ো– পাগলের মতো ঘুরে বেড়িয়েছি। তখনই বুঝেছি এই দিল্লি, মুম্বইয়ের মতো শহরে কিছু না দিলে কিছু পাওয়া যায় না। আর নয়তো নামিদামি বাবা-মায়ের ট্যাগ-টা গায়ে লেগে থাকতে হবে। তবেই এখানকার মাটিতে টিকে থাকা সম্ভব। যা টাকাপয়সা এনেছিলাম ততদিনে সব শেষ হয়ে গেছে। মাঝে সুনীতার থেকেও বারকয়েক টাকা ধার করেছি। আর কোনও রাস্তা না দেখে বারে গান গাওয়া শুরু করি। ওখান থেকেই অর্কেস্ট্রা গ্রুপ-এর সঞ্জয়ের সঙ্গে আলাপ। তারপর থেকে এভাবেই চলছে। এখন এটাই আমার ঠিকানা।’ নিরাশা ঘিরে ধরে রিনিকে।
‘এই জীবন তো স্বেচ্ছায় বেছেছ। এখন আর আপশোশ করে লাভ কী?’ জবাব দিতে পারে না রিনি। জবাব দেওয়ার মতো আছেটাই বা কী! তার ভুলের মাশুল যে তাকেই গুনতে হবে। মনে মনে ভাবে এখন শহরের প্রান্তে এই নোংরা বস্তি-ই তার ঠিকানা। জীবনের শেষ দিনটা পর্যন্ত এখানেই কাটাতে হবে তাকে। রিনির মনের অবস্থা বুঝে রাগ সংবরণ করে খানিক নরম হওয়ার চেষ্টা করে অনুজা। গলা নামিয়ে ধীর ভাবে বলে, ‘অডিশনের পরেও তো ফিরে যেতে পারতে?’
‘কোন মুখে যেতাম আন্টি, সব পথ যে আমি নিজে বন্ধ করে এসেছি। একবার অবশ্য বাড়িতে ফোন করেছিলাম। ফোনটা বেজে বেজে কেটে গেল। আর সাহস হয়নি করার।’
‘তা এবার কী করবে ভেবেছ?’
রিনির ঠোঁটের কোণায় এক চিলতে হাসি লক্ষ্য করে অনুজা। সে হাসি আনন্দের নয়, বিদ্রুপের। ‘ব্যস বাঁচা-মরা সব এখন এখানেই। আর কোনও রাস্তাও তো খোলা নেই আমার কাছে। মা আমার জন্য এখনও অপেক্ষা করে আছে জেনে, মনটা আনন্দে ভরে গেল। এ পৃথিবীতে কেউ তো আছে, যে আজও আমাকে মনে রেখেছে। তাতেই আমার শান্তি। মা-র কথা শোনার পর থেকেই আপনার সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে করছিল। প্লিজ আন্টি, এব্যাপারে ওনাকে কিছু জানাবেন না। আমি চাই না ওনার কাছে আমার ছবিটা বদলে যাক। জানেন আন্টি মাকেও দু-বার ফোন করেছি। কিন্তু সাহস হয়নি কথা বলার। মা হ্যালো বলতেই ভয়ে ফোনটা রেখে দিয়েছি। ভয় লেগেছে, মা যদি বলে দেয় মায়ের কাছে আমি মৃত…। নীহারকেও…শুধু একটু গলা শোনার জন্য… কতবার ভেবেছি সবকিছু খুলে বলি ওকে, সেই সৎসাহস দেখাতে পারিনি। ভয়ে আঁতকে উঠেছি, আমার গলা শুনলেই যদি আমার অস্তিত্বকেই অস্বীকার করে বসে। সহ্য করতে পারতাম না। একদিন তো ধরা পড়তে পড়তে বেঁচে ছিলাম। ফোন করি অথচ কথা বলি না। এতেই ও ধরে ফেলেছিল, ওটা আমি, তারপর থেকে আর…’, বলতে বলতে কেঁপে কেঁপে উঠছিল রিনি। অপরাধবোধের স্পষ্ট ছাপ তার চোখেমুখে ছেয়ে যায়। সান্ত্বনা দিতে রিনির হাতদুটো চেপে ধরে অনুজা। কী যেন চিন্তা করে বলে, ‘আর একবার চেষ্টা করে দ্যাখো না। হতে পারে ওরা তোমাকে গ্রহণ করবে না বা হয়তো… … কিছুই জানি না আমি। কিন্তু তবু বলছি এই আপশোশ তো অন্তত থাকবে না ‘ইস্ যদি একবার চেষ্টা করে দেখতাম।’ কাঁপা গলায় রিনি কোনওরকমে তার অনুজা আন্টিকে জিজ্ঞাসা করে, ‘ফিরে যেতে বলছেন আমাকে? কিন্তু কোন্ মুখে যাব?’
‘ঠিক যেমন করে বাড়ি ছেড়ে এসেছিলে, সেইভাবেই’ এইবার একটু রুক্ষ্ম শোনায় অনুজাকে। কেঁদে ফেলে রিনি। ‘রোজ যে তিলতিল মরছি, এটা তারই সাজা আন্টি।’
রিনিকে কাঁদতে দেখে তার মাথায় হাত রাখে অনুজা। ‘আমার কথাটা হয়তো শুনতে খারাপ লাগছে তোমার। কিন্তু আমি তোমার ভালোর জন্যই বলছি, ফিরে যাও। গিয়ে সব সত্যিটা খুলে বলো ওদের। তারপর সবই ভগবানের ইচ্ছে। অন্তত ভুল শোধরানোর একটা চেষ্টা তো করো। তোমাদের প্রতি একটা আন্তরিক টান আছে বলেই বলছি’, বলতে বলতে উঠে পড়ে অনুজা। তারও চোখে জল ভর্তি। ঘর থেকে বেরিয়ে রাস্তায় এসে গাড়িতে উঠে পড়ে। সদানন্দ গাড়ি ঘুরিয়ে নেয় বাড়ির দিকে। মনটা কেমন যেন উদাস হয়ে যায় তার। সারাক্ষণ মনের মধ্যে ঘুরতে থাকে, ‘মেয়েটা কী করবে, কে জানে।’ মিনিট দশেক পর বাড়ি ফিরলে সবাই তার উদাসীনতার কারণ জিজ্ঞেস করে। এড়িয়ে যায় সে।
বিয়ের পরেও আরও কয়েকটা দিন দিল্লিতে থাকার কথা ছিল অনুজার। তারপর ওখান থেকে গোয়া। কোথাও গিয়ে যেন শান্তি পাচ্ছে না সে। সারাক্ষণ ওই একই চিন্তা। কথাবার্তার মাঝে ফোন নাম্বার-টাও নিতে ভুলে গেছে। নিজেকেই দূষতে থাকে সে। নাম্বারটা নিলে অন্তত যোগাযোগ তো করা যেত। অবশ্য দিদির থেকে নিতে পারত। কিন্তু কাউকে আর ঘাঁটাতে চায়নি সে।
দিন পনেরো পর গোয়া থেকে বাড়ি ফিরে আসে অনুজা। ফিরেছে একেবারে কাকভোরে। তখনও কেউ ওঠেনি। বাড়িতে তেমন বাজার-দোকান না থাকায় প্রয়োজনীয় কয়েকটা জিনিস নিতে বেলার দিকে বেরোতেই মায়াকে দেখতে পেল সে। বাজার সেরে ফিরছে। বেশ হাসিখুশি লাগছে মায়াকে। অনুজাকে দেখে হাসিমুখে এগিয়ে আসে তার দিকে। ‘ঘোরা হল তোমার? তুমি জানো এর মাঝে কী হয়েছে? আমার বউমা গত পরশু বাড়ি ফিরে এসেছে।’ এক মুহুর্তে মনটা ভীষণ রকম ভালো হয়ে যায় অনুজার। মনে মনে ভাবে তার বোঝানো তাহলে বিফলে যায়নি। রিনি তার আন্টি-র কথা রেখেছে। সে পেরেছে জীবনের মূল স্রোতে ফিরে আসতে।
ভাবনায় বাধ সাধে মায়া। কানে কানে বলে ওঠে, ‘তুমি তো ঘরের লোক অনুজা, তোমার কাছে আর কী লুকোব। এমন মেয়ে, কাউকে কিছু না জানিয়ে চলে গিয়েছিল দিল্লি, গানের অডিশন দিতে। এরকম ভুল কেউ করে বলো? ছোটো মেয়ে। যদি কিছু একটা অঘটন ঘটে যেত, তাহলে তখন তুই কী করতিস! বাবুও আসছে। ও-ও বলেছে গান-টান যা করার সব এখান থেকেই করতে হবে। একা একা কোথাও যাওয়া চলবে না। তুমি বলো কী দুঃসাহস! একা একা…’ থেমে যায় মায়া। কী যেন ভেবে নেয়। তারপর আবার বলতে শুরু করে, ‘কিন্তু পাড়াপড়শিদের তো আর এসব বলা যায় না। এমনিতেই তো কম কুৎসা রটায়নি তারা। কানপাতা দায় হয়ে গিয়েছিল। ওদের সকলকে বলেছি অ্যাক্সিডেন্ট-এ স্মৃতিশক্তি চলে গিয়েছিল। মারাঠি একটি পরিবারের দয়ায় হাসপাতালে ছিল। সবকিছু মনে পড়তেই ফিরে এসেছে।’ অনুজা আশ্চর্যান্বিত হয়ে তাকিয়েছিল মায়ার মুখের দিকে।
আকাশটা আজ অনেক পরিষ্কার। ঝড়-ঝঞ্ঝা-মেঘ কাটিয়ে সূর্য যেন মাথার উপর আবার জ্বলজ্বল করছে।