ট্রেনটা আচমকাই ঘ্যাঁচ করে থেমে গেল। হুড়োহুড়ি পড়ে গেল যাত্রীদের মধ্যে। স্টেশন তো এখনও আসেনি। তাহলে? কী হল? নিশ্চয়ই কিছু একটা অঘটন ঘটেছে। কৌতুহলী কিছু যাত্রী দরজা থেকে উঁকি মারতে থাকল। কেটে গেল বেশ কিছুক্ষণ সময়। অধৈর্য হয়ে উঠল নীহার। এ শালা আচ্ছা জ্বালা হল তো। কী হবে এবার? এখান থেকে লিলুয়া স্টেশন খুব বেশি দূরে নয়, এখানটাই ফাঁসল! এদিকে মোবাইলে হোয়াটসঅ্যাপে ক্রমাগত মেসেজ এসে যাচ্ছে সুমনার। কী হল এখন কোথায়? প্লিজ তাড়াতাড়ি আসো। এতক্ষণ প্রতিটা প্রশ্নের উত্তর দিয়ে যাচ্ছিল নীহার। এই মেয়েটা বড্ড ক্রেজি। ভীষণ অধৈর্য। আজ সুমনার ফ্ল্যাটে যাচ্ছে নীহার। কারণ…। কারণ একটাই। সুমনা জানিয়েছে দুপুরে নীহারের নেমন্তন্ন।
প্রায় মিনিট পনেরো অপেক্ষা করার পর অনেকের মতোই ট্রেন থেকে লাফ দিয়ে নামল নীহার। আর অপেক্ষা করা যাচ্ছে না। এবার বাকি রাস্তাটুকু হেঁটেই মারতে হবে। তারপর অন্য ট্রেন ধরে হাওড়া পৌঁছোতে হবে। লাইন বরাবর হাঁটতে হাঁটতেই সহযাত্রীদের মুখে শুনতে পেল ট্রেন থামার কারণটা। একজন ট্রেনের সামনে ঝাঁপ দিয়েছে। শোনামাত্র গা ঝিনঝিন করে উঠল। তারপরেই বিরক্তি। শালা ঝাঁপ দেওয়ার আর টাইম পেল না। ওদিকে সুমনা বসে রয়েছে। ভাবামাত্র ফেসবুক প্রোফাইলে সুমনার মুখ আর বুকের ছবিটা চোখের সামনে ভেসে উঠল একঝলক। সবুজ চোখের মণি। ঘন চকোলেট কালারের লিপস্টিক। চওড়া কপাল। টাইট টি শার্টের আড়ালে ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাওয়া একজোড়া বুক। সুমনার প্রোফাইলে অন্তত দুটো ফটো আছে বিভিন্ন পোজে। তার মধ্যে ক্লিভেজওলা ছবিও রয়েছে বেশ কিছু। এবং প্রতিটি ছবিতে দুশো-র ওপর লাইক। তার মধ্যে ‘সো হট’। ‘ইউ আর মোস্ট বিউটিফুল’, ‘তুমি কবিতার মতো সুন্দর’-এর পাশাপাশি ‘গ্ল্যামার কুইন’, ‘ক্রেজি’, ‘সুপার সেক্সি’ থেকে বিশুদ্ধ বাঙালে একটি আদিরসাত্মক কমেন্ট-ও আছে। এবং মজার কথা কোনও কমন্টে-ই ডিলিট করেনি সুমনা। বরং একাধিকবার রিপ্লাইতে প্রশংসাকারীদের নাম ট্যাগ করে ‘থ্যাংক ইউ’ লিখেছে সে। সুমনার ফটো অ্যালবামে তার ফ্যামিলির কোনও ছবি নেই। পুরোটাই তার নিজের রাজত্ব। পরিবারের প্রবেশ নিষেধ। এবং ইনফোতে ম্যারিটাল স্টেটাসে কিছুই নেই। তবে ওয়ার্কস অ্যাট অ্যাক্ট্রেস, মডেলিং। মডেলিং-এর ছবি প্রায় নেই বললেই চলে। যে দুটো রয়েছে তা দেখলে উত্তেজনা তো দূরের কথা হাসি চেপে রাখা দায় এমনই ভঙ্গি।
যাই হোক এই সুমনার সঙ্গেই একদিন বন্ধুত্ব হয়ে গেল ওয়ার্কস অ্যাট সি্্ক্রপ্ট রাইটার নীহারেন্দু সেনগুপ্তর। আজকাল মানুষের বন্ধুত্ব খুব দ্রুত হয়। প্রযুক্তি এসে সম্পর্ক তৈরি অনেক সোজা করে দিয়েছে। চোখের পলক পড়ার আগেই ঝ্যাট করে আজকাল ‘রিলেশন’ তৈরি হয়ে যায়। অ্যাড ফ্রেন্ড আর আনফ্রেন্ড দুটোই যেহেতু খুব পাশাপাশি এবং মাত্র একটা ক্লিকে সিদ্ধান্ত হয়ে যায় তাই রিলেশনের চাপ অনেকটা কমে গেছে। দায়ও।
নীহার বাঙালি হিসেবে বেশ সুপুরুষ। হাইট, চেস্ট, ওয়েস্ট থেকে একজন পুরুষের শরীরে আর যা যা শক্তসমর্থ হলে সে মেয়েদের কাছে সর্বান্তে আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে তা সবই নীহারের রয়েছে। সুতরাং সেই সহজে বন্ধুত্ব করুন এর পৃথিবীতে নীহারের অনেক ফ্রেন্ড। বাংলা সিরিয়ালের নিরলস অন্তহীন চিত্রনাট্যের কলমকারি নীহারেন্দু বেশ কয়েকবছর ধরে টালিগঞ্জ পাড়ায় দুটো একটা রোলের জন্য বহু শ্রম পণ্ড করার পর হতাশায় যখন প্রায় ভেঙে পড়ছে, তখন তাকে এক শুভানুধ্যায়ী অলি পাব-এর এক সন্ধেয় বুঝিয়েছিল, দেখ সবাই জানে তুই দেখতে সুন্দর, ভয়েস ভালো। হয়তো সুযোগ পেলে অভিনয়টাও উতরে দিবি, কিন্তু কি জানিস এই লাইনে কোয়ালিটি কথা বলে না, কপাল কথা বলে। সুতরাং অন্যকিছু ভাব।
টালিগঞ্জ ছেড়ে দিতে বলছ?
না একেবারে ছাড়তে বলছি না, বলে একটু ভেবে নিয়ে সেই বন্ধু বলেছিল, তুই তো শখের কবি তাই না?
আজ্ঞে আমি নিজে বলতে চাই না। হেসে উত্তর দিয়েছিল নীহার।
শোন লিখতে যখন একটু আধটু পারিস তাহলে বিদ্যেটাকে কাজে লাগানোর চেষ্টা কর। বাংলা সিরিয়ালের স্ক্রিপ্ট লিখবি? কামাই মন্দ না।
কথাগুলো বছর দেড়েক আগের। তারপর একটা সময়ের পর টুকটাক কাজ পেতে শুরু করল। প্রচুর কিছু নয় তবে মোটামুটি নিজের খরচ চালিয়ে একটা বিয়ে করার স্বপ্ন দেখাই যেতে পারে এমন রোজগার মাস গেলে পকেটে ঢোকে।
ট্রেনের একেবারে সামনে আসতেই গা শিউরে উঠল নীহারের। রেলের লোক বডিটাকে লাইনের ভেতর থেকে টেনে বার করছে। তাকাব না ভেবেও স্বাভাবিক কৌতূহলে একবার চোখ পড়েই গেল শরীরটার দিকে। লাল রঙের শাড়ি আর ব্লাউজ পরা। বডিটাকে বার করে এনে কালো প্লাস্টিকে মুড়তে শুরু করল লোকগুলো। নীহার প্রাণপণে চাইছিল ওর নিজের পা দুটো সামনে এগোতে থাকুক আর চোখদুটো অন্যদিকে তাকাক। কিন্তু কিছুতেই পারছিল না। পাদুটো থেমে গিয়ে চোখদুটো সেই মেয়েটার শরীরে পড়ল। একঝলক দেখে মনে হল কোনও অঙ্গহানি হয়নি। মুখটাও অক্ষত। হয়তো মাথার পিছনে থেঁতলে গেছে। একগোছা চুল। মেয়েটার চোখদুটো খোলা, চওড়া কপালে খানিকটা লাল, রক্ত না সিঁদুর বোঝার উপায় নেই। আর তার চিবুকের সামনে একটা বড়ো আঁচিল। ওই অাঁচিলটাই মেয়েটার মুখের দিকে তাকালে সবার আগে চোখে পড়ে। অাঁচিলটা একবার উড়ে প্রমাণ করল, সে অাঁচিল নয় মাছি। বেশ বড়ো সাইজের মাছি। মহিলার সামনে একটা পাঁচ-ছয় বছরের বাচ্চা ছেলে প্রাণপণে চিৎকার করে কাঁদছে, ওকে জড়িয়ে ধরে রয়েছে আরপিএফ-এর একজন কর্মী। হয়তো ওই মহিলা ওই ছেলেটির মা ছিল। ছেলেকেও নিয়ে এসেছিল একসঙ্গে মরবে বলে। শেষ মুহূর্তে পারেনি। ওকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে নিজে লাইনে ঝাঁপ দিয়েছে। কান্নার মধ্যেও জ্বলছে ছেলেটার চোখদুটো। ওদের দুজনের পোশাক দেখে আন্দাজ করা যায় ভদ্র শিক্ষিত পরিবারের।
গা বমি বমি করতে থাকল নীহারেন্দুর। কেন্তু পেট তেমন ভর্তি নয় বলে শুধু ভেতর থেকে ঠেলা দিল, কিছু বেরোল না। কয়েক মিনিটের মধ্যে একটা জ্যান্ত মেয়ে কালো প্লাস্টিকে চালান হয়ে গেল মর্গে। ওরও কি ফেসবুক অ্যাকাউন্ট ছিল? এক সঙ্গে সক্বলকে আনফ্রেন্ড করে চলে গেল কোন অভিমানে?
লিলুয়া স্টেশন পর্যন্ত হেঁটে এসে কর্ড লাইনের ট্রেনে উঠে বসল নীহার। ভেতরটা খুব অস্থির করছে। ঘাম হচ্ছে খুব।
হাওড়া স্টেশন পেৌঁছে মনে হল বাড়ি ফিরে যাই। কিন্তু ফেরার উপায় নেই। ফিরলে লস। সাবওয়ে পেরিয়ে একটা এয়ারকন্ডিশন বাসে চেপে বসল। প্রায় ঘণ্টা খানেকের রাস্তা এবার। গন্তব্য রুবি হসপিটালের কাছে অভিষিক্তা অ্যাপার্টমেন্ট।
নির্দিষ্ট ফ্ল্যাটের সামনে এসে কলিংবেল বাজাতেই দরজা খুলতে সামনে সুমনার মুখ। ওহ মাই গড তুমি এসে গেছ! বলে নিজের দুগালে দুই হাত রাখল সুমনা। এসো এসো ভেতরে এসো। নীহার হাসি মুখে ফ্ল্যাটের ভেতর ঢুকতেই গা গুলিয়ে উঠল নীহারের। ভেতরটায় মাছের আঁশটে গন্ধে ভর্তি।
আমি ভাবতেই পারছি না তুমি সত্যি সত্যি আসবে। বলে সুমনা বলল বসো বসো। আর ঠিক নীহার খেয়াল করল সুমনার চিবুকের ঠিক নীচে একটা আঁচিল। এটা তো আগে ছিল না…! নাকি ছিল ঠিক মনে পড়ছে না। সাধারণত মানুষের মুখের কোনও বৈশিষ্ট মনে থাকে সব থেকে বেশি। ফটোয় সুমনার মুখে কি এমন অাঁচিল ছিল আদৌ? মনে পড়ছে না।
সোফায় বসার পর সুমনা বলল আমার হেব্বি আনন্দ হচ্ছে। ইস্স তুমি খুব ঘেমে গেছ। শার্টটা ছেড়ে রাখতে পারো।
না না ঠিক আছে।
এসি চালিয়ে দেব?
না থাক।
এমনি জল খাবে নাকি কোল্ড ড্রিংক্স দেব?
এমনি জলই দাও।
এই তুমি কিন্তু খুব আনইজি ফিল করছ। বুঝতে পারছি। রিল্যাক্স করো।
উত্তরে সামান্য হাসল নীহার। তারপর বলল আমাকে টয়লেটটা কোনদিকে বলো। সুমনার মুখের দিকে তাকাতেই আবার চমকাল নীহার। এ কি! আঁচিলটা কই গেল? এসব কী হচ্ছে? ভালো করে সুমনার মুখের দিকে তাকাল নীহার, না সত্যিই নেই অাঁচিলটা। আশ্চর্য! এতক্ষণ ভুল দেখল!
সুমনার দেখিয়ে দেওয়া টয়লেটে ঢুকে দরজা বন্ধ করে বেসিনের কল খুলে বেশ ভালো করে মুখে ঘাড়ে জল দিল। আয়নার দিকে তাকাল। মুখটা লাল হয়ে উঠেছে। পকেটের রুমাল দিয়ে মুখ মুছতে যেতেই আবার সেই রেললাইনের নীচ থেকে বার করা মেয়েটাকে মনে পড়ল। অসহ্য! কেন যে মনে আসছে বারবার! অস্বস্তি লাগছে খুব। এমনিতে কোনও মহিলার ফ্ল্যাটে আসা নীহারের কাছে প্রথম নয়। এমনটা ও আগেও বেশ কয়েকজনের কাছে গেছে। এবং কোনওবারই খালি হাতে ফেরেনি। আজও ফিরবে না। এখানে দুপুরে সুমনার বানানো চর্ব্যচূষ্য খেয়ে তারপর কিছুক্ষণ বিশেষ কাজকর্ম সেরে দুজনে সুমনার গাড়িতে ঘুরতে বেরোবে। মাল্টিপ্লেক্সে সিনেমা দেখে দামি কোনও রেস্তোরাঁতে বসে দুপেগ স্কচ-সহ দামি ডিনার সেরে বাড়ি ফেরা। পুরো খরচ সুমনার। এমনকী বাড়ি ফেরার সময়ে ওকে হাওড়া স্টেশন পর্যন্ত লিফট দিয়ে দেবে এমনও বলে রেখেছে সুমনা।
কিন্তু তাও আজ মনে হচ্ছে পালাই পালাই। মুখ মুছতে মুছতে আবার নিজের দিকে তাকাল নীহার। না নিজের পৌরুষে এতটুকু ঘাটতি নেই। সারাদিনে ও কতবার যে নিজেকে দেখে এবং মুগ্ধ হয়। আর কখনও মনে পড়ে, আর কতদিন? নীহার একেক সময় নিজেও ভাবে নিজেকে নিয়ে একটু বেশিই মুগ্ধ ও। যে কারণে স্বাতী একদিন ওকে ছেড়ে চলে যাওয়ার আগে বলে গেছিল, তুই নিজেকে এতটাই ভালোবাসিস, এতটাই ব্যস্ত নিজেকে নিয়ে যে অন্যের ভালোবাসা বোঝার ক্ষমতাটুকু পর্যন্ত হারিয়ে ফেলেছিস।
তা শুনে হেসেছিল নীহার।
টয়লেট থেকে বেরিয়ে নীহার দেখল সুমনা সোফাতে পা গুটিয়ে বসে রয়েছে। সামনে টি টেবিলে রাখা দুটো কাচের গ্লাসে কোল্ড
ড্রিংক্স।
ওর পাশ দিয়ে উলটোদিকের সোফাতে বসার আগে নীহার আড় চোখে দেখতে পেল সুমনার ডিপ নেক টপের ফাঁক দিয়ে ফরসা ধবধবে বুকের খাঁজ দেখা যাচ্ছে।
এই নাও বলে সামনে ঝুঁকে নীহারকে গ্লাস দিল সুমনা। বুকের আরও কিছুটা স্পষ্ট হল এবং নীহারের যে সেদিকে চোখ পড়ল সেটার নজর এড়াল না ওর।
গ্লাসে চুমুক দিয়ে সুমনা বলল কী দেখছ?
তোমাদের ঘরটা। সুন্দর সাজানো।
আরে এটায় আমরা সবসময় থাকি না। আমাদের মেন ফ্ল্যাটটা এ ব্লকে। সেটা অনেক বড়ো আর টপফ্লোরে। এটা আমরা মাঝে মাঝে ব্যবহার করি, তেমন ফারনিশড নয়।
ও আচ্ছা বলে ড্রয়িংরুমটায় চোখ বোলাল নীহার। পেল্লায় ডবলডোর ফ্রিজ, ঢাউস এলইডি টিভি, এয়ার কন্ডিশন, তুলতুলে নরম সোফাসেট, আরও যা যা সব থাকলে একটা ড্রয়িং রুম থেকে বড়োলোক বড়োলোক গন্ধ বেরোয় তার সবই মজুত এখানে, এটাই যদি ট্রেলর হয় তাহলে আসলি সিনেমায় কত কী আছে!
তুমি কি আগে রেস্ট করে তারপর লাঞ্চ করবে?
না না ঠিক আছে তুমি ব্যস্ত হয়ো না।
পাশেই বেডরুম রয়েছে, চাইলে একটু শুয়ে নিতে পারো, বলে হাসল সুমনা।
আমি… কথাটা কমপ্লিট করতে পারল না নীহার। সুমনার চিবুকের নীচে আবার সেই আঁচিলটা ফিরে এসেছে। শুধু তাই নয় অল্প অল্প নড়াচড়া করছে। নীহার কথা থামিয়ে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকল সেদিকে। আর তখনই সুমনা থুতনির সেই অাঁচিলে হাত রাখতেই অাঁচিলটা পালাল।
ধুউউসসস শালা মাছি! আশ্বস্ত হল নীহার। কী না কী ভাবতে শুরু করেছিল ও।
কিছু ভাবছ তুমি?
নাহ না তো।
আরে রিল্যাক্স করো বাবা। এই প্রথম তুমি এলে সহজে কিন্তু ছাড়ছি না।
থেকে যাব আজ?
থাকতেই পারো। নো প্রবলেম। আমার হাবি আসবে সেই পরশুদিন। বলে খিক খিক করে হাসল সুমনা।
সুমনার হাসিটা খেয়াল করল। একেবারে আকর্ণ হাসি যাকে বলে। দাঁতগুলো পরিপাটি কিন্তু আকারে বেশ বড়ো। নিয়মিত ফেসিয়াল করা চকচকে মুখ, তবু কপালে আড়াআড়ি শোওয়ানো তিনখানা ভাঁজ। আর স্লিভলেস টপের দুপাশ দিয়ে যে ফরসা হাতদুটো বেরিয়ে রয়েছে সেগুলো পেশল এবং শিরাওঠা, হাতের আঙুলগুলোও ছেলেদের মতো। এমন কেঠো হাত কোনও মেয়ের হয়? ভালো লাগায় হাতের মস্ত ভূমিকা রয়েছে। কিন্তু এই মেয়েটার হাতদুটো…। মনে মনে ঝিমোতে শুরু করে নীহার। সুমনার উপচে পড়া বুকও হাতের কাছে হার মানতে শুরু করে। কত বয়েস হতে পারে ওর? পঁয়তাল্লিশের কম তো নয়ই। নিয়মিত রূপচর্চা করে বোঝাই যায়, তবু বয়স এমনই, কীভাবে যেন নিজেকে নির্লজ্জের মতো জানিয়েই বসে।
নীহারের মন বসছে না। কিন্তু এমন হলে তো হবে না। শুধুমাত্র লাঞ্চের কারণে এই এতদূর উজিয়ে এখানে আসা নয়। পার্সের ভেতর দুখানা এক্সট্রাটাইম চকোলেট ফ্লেভারের প্যাকেট কচ কচ করছে, তারমধ্যে অ্যাটলিস্ট একখানা খরচ করতেই হবে।
এটা নীহারের নেশা। শুধু নতুন নতুন শরীর পাওয়া তা নয়, ও খুঁজে খুঁজে বার করে সেইসব মহিলাদের যারা নিঃসঙ্গ এবং ধনী। তারপর তাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব জমিয়ে পাল্সটা বোঝার চেষ্টা করে। ফাতনা ফেলে ওয়েট করে। কখনও মাছ লাগে, তখন বিনামূল্যে শরীর পাওয়ার পাশাপাশি দামি গাড়িতে চেপে একটু আউটিং, দামি দোকানের নামি গিফ্ট, শার্ট কিংবা পারফিউম। দিব্যি লাগে। একটা খেলার মতো। লোকে যেমন অবসরে মোবাইলে ভিডিয়ো গেম খেলে ঠিক তেমনই। নিউ আলিপুরের এক বছর পঁয়তাল্লিশের মহিলা নাম ছিল আনন্দি চট্টরাজ, তার স্বামী কাজের সূত্রে দুবাইতে থাকেন। মহিলা নীহারকে নিয়ে শুধু শপিং করতে বেরোতেন। তাতেই তার আনন্দ। টাকার কুমির। দোকানে কিছু একটা পছন্দ হলে নীহারকে এমনভাবে জিজ্ঞাসা করত অ্যাই দ্যাখো এটা কিনব? যেন নীহারই ওর বিয়ে করা বর। নীহার না বললে যেন উনি কিনবেন না। মহিলা সেক্স-এ খুব একটা আগ্রহ দেখাতেন না। বলতেন ওসব ইচ্ছে ঘুচে গেছে। দু-একটা চুমুটুমু ব্যস। ওতেই খুশি। নীহার অনেককিছু পেয়েছিল সেই মহিলার কাছে। তারপর আর ভালো লাগছিল না। ততদিনে গড়িয়ার অর্পিতা বসুকে পেয়ে গেছিল।
নীহার কেন এমনটা করে? কী লাভ এই নিয়ে নিজের সঙ্গে অনেক কথা বলার পর ও মোটামুটি একটা যুক্তি খাড়া করেছে তা হল, বেশ করি, করি। শুধু ছেলেরাই কেন মেয়েদের জন্য পয়সা ওড়াবে? কেন তাদের একটু ছোঁয়া পাওয়ার জন্য কুকুরের মতো লেজ নেড়ে ল্যাও ল্যাও করবে? এটা আমার প্রচলিত নিয়মের বিরুদ্ধে প্রোটেস্ট। আমার অবসর বিনোদন। আমার পৌরুষ ফুরিয়ে যাওয়ার আগে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তাকে এনজয় করা, ব্যস। নো আদার কোয়েশ্চেন প্লিজ।
বত্রিশ বছরের নীহার খুব চট করে বুঝে গেছে প্রেম, ভালোবাসা, বিবেক, নীতি এইসব শব্দগুলো আসলে এই যুগে কুসংস্কার।
তুমি কিন্তু হেবি হ্যান্ডসাম। কটা গার্লফ্রেন্ড আছে তোমার?
একটাও নেই?
বাজে কথা রাখো তো?
রিয়েলি নেই।
কেন?
কে অত হ্যাপা পোয়াবে?
তাও ঠিক। বলে হাসল সুমনা। তারপর বলল, তোমাকে ফেসবুকে যতটা সুন্দর দেখেছিলাম তার থেকেও বেশি সুন্দর তুমি।
থ্যাংক ইউ। অ্যান্ড সেম টু ইউ।
যাহ্ বাজে কথা! আমি মোটেও সুন্দরী নই।
কে বলে? তাকে একবার চিনিয়ে দেবে তো?
নীহারের কথায় হো হো করে হেসে উঠল সুমনা। গদগদ হয়ে বলল, আমার আগের ছবি দেখাব তোমাকে।
নীহার ড্রইং রুমে রাখা একটা কেয়ারি করা টেবিলের ওপর ফ্রেমে বাঁধানো ঘোড়ায় চাপা ছোটো ছেলের ফটোর দিকে আঙ্গুল তুলে জিজ্ঞাসা করল ওটা তোমার ছেলে?
হ্যাঁ ঠিক ধরেছ। তবে এখন আর অত ছোটো নেই। ক্লাস এইট হয়ে গেল। দার্জিলিঙে হোস্টেলে থাকে। আমার তো অনেক অল্পবয়সে বিয়ে হয়েছে। বলতে বলতে সুমনা উঠে এসে নীহারের পাশে এসে বসল। নীহার দেখল ফ্রেমের মধ্যে ঘোড়ায় চেপে বসা ছেলেটা ওর মায়ের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রয়েছে। নীহার অন্যদিকে চোখ ফেরাল।
আমার না খুব ফ্যাট হয়ে যাচ্ছে জানো। তুমি কী সুন্দর ছিপছিপে আছ।
কোথায়? আমার কিন্তু ঠিকই লাগছে তোমাকে।
উহু বেলি ফ্যাট জমেছে অনেকটা।
বাইরে থেকে বোঝা যাচ্ছে না কিন্তু।
ভেতরে আছে বাবু, দেখতে পাবে, বলে ফিক করে হেসে সুমনা বলল আমি খাবার গরম করব তুমি চাইলে বেড রুমে একটু শুয়ে নিতে পারো ততক্ষণ।
ইঙ্গিত স্পষ্ট। কিন্তু কেন কে জানে আজ শালা সব ডাউন লাগছে।
তোমার হাতগুলো খুব সুন্দর। বলে সুমনা ওর নির্লোম পেশল হাত বাড়িয়ে নীহারের হাতের ওপর রেখে আলতো করে বোলাল। নীহার কিছুই ফিল করল না উপরন্তু আবার দেখতে পেল সেই মাছিটা কোথা থেকে ঘুরে ফিরে আবার সুমনার চিবুকে এসে বসেছে। নীহারকে দেখছে।
হাজব্যান্ডের দিন রাত কাজ, ছেলে হোস্টেলে থাকে। আমার এখন কাজ হয়েছে ফেসবুক ফ্রেন্ড বানানো আর তাদের সঙ্গে গল্প করা। চিবুক থেকে অবাধ্য মাছিটাকে তাড়ানোর চেষ্টা করল সুমনা। ভালোই লাগে। দিব্যি সময় কেটে যায়। মাছিটা চিবুক থেকে সরে কপালের ওপর বসল।
তুমি এত স্টিফ হয়ে আছ কেন? দাঁড়াও তোমাকে একটা জিনিস দেখাই। বলে উঠে পাশের ঘরে গেল সুমনা। নীহার আপ্রাণ নিজের মধ্যে যৌন উত্তেজনা আনার চেষ্টা করে যাচ্ছিল। কিন্তু কিছুতেই সেই অনুভূতি আসছিল না। এমন নয় যে ওর প্রতিবারই অপ্সরা বিশেষ জোটে। অনেক সময়েই কিংবা বলতে গেলে…
ভাবতে ভাবতেই সুমনা ফিরে এল। হাতে মোটা একটা অ্যালবাম।
পাশে গা ঘেঁষে বসে বলল, আমার পোর্টফোলিও। দ্যাখো একবার।
দ্যাখাতে শুরু করল সুমনা। প্রতিটি ছবিই এত হাস্যকর এবং ভঙ্গিমায় এতটাই অশ্লীল যে সুমনার প্রতি করুণা লাগতে শুরু করল নীহারের। ফটো তো নয় যেন একেকটা কার্টুন। এত অখাদ্য কিন্তু সুমনা নিজের সেই ছবিগুলোর দিকে তাকিয়ে মুগ্ধ হয়ে একের পর এক বলে চলেছিল… দ্যাখো দ্যাখো এই ছবিটা। কী ভালো লাগছে না… আমার তো দারুণ প্রিয় এটা। আর এটা দ্যাখো কত স্লিম ছিলাম আমি…। আর এইটায় হাসিটা…
নীহার আবার চোখ তুলল সুমনার দিকে। মাছিটা চিবুকের ওপর বসে নীহারের দিকে তাকিয়ে রয়েছে একদৃষ্টে। ওটাকে এক থাপ্পড়ে শেষ করে দিতে ইচ্ছে করল। সেটা করতে গিয়েও কোনওরকমে চেক করল নিজেকে। আবার চোখ গিয়ে পড়ল ফ্রেমে বসে থাকা সেই হাফপ্যান্ট পরা ছেলেটার দিকে। চোখদুটো কি একটু বেশি জ্বলজ্বল করছে!
উফ্ কী বারবার অন্যদিকে দেখছ? এদিকে দ্যাখো না, ভালো লাগছে না তোমার? জিজ্ঞসা করল সুমনা।
উঁ লাগছে তো। খুব সুন্দর। প্রাণপণ ভালো লাগার অভিনয় করে যেতে থাকল নীহার। বাহ্ খুব সুন্দর। …এটা আরও ভালো হয়েছে।
অ্যাই তোমার তো এই লাইনে অনেক যোগাযোগ রয়েছে। আমি অ্যাড ফিল্ম করতে চাই, আমাকে প্লিজ একটু যোগাযোগ করিয়ে দাও না।
যোগাযোগ? প্রশ্নটা সমেত সুমনার সবুজ কনট্যাক্ট লেন্স পরা মণিদুটোর দিকে তাকাল নীহার। চোখদুটোতে অস্থির অপেক্ষা উত্তর পাওয়ার।
আচ্ছা দেখছি। বলে আবার টেবিলে রাখা সেই ফটোর দিকে তাকাল। বাচ্চাটার চোখদুটো যেন ধক ধক করে জ্বলছে।
এই তুমি এবার ওই ঘরে চলো তো। বেডরুমে আয়েশ করে বসে বাকি কথা হবে এবার। খুব খুশি হয়ে নীহারের হাত টানল সুমনা। ঠিক তখনই সেই মাছিটা সুমনার গোটা মুখে চক্রাকারে ঘুরতে শুরু করল। আর আচমকাই নীহারের মনে হল এটা সেই মাছি নয় তো যেটা সেই ট্রেনের তলা থেকে বার করা লাশের মুখের ওপর বার বার উড়ে উড়ে বসছিল। সুমনা হাত নাড়িয়ে বিরক্তিকর মাছিটাকে সরিয়ে দিতে চেষ্টা করছিল ক্যাজুয়ালি। নীহার তখনই উঠে দাঁড়িয়ে বলল, আমি চট করে একটু নীচ থেকে আসছি।
কেন কী হয়েছে?
আমার এক বন্ধু এখন নীচে দাঁড়িয়ে থাকার কথা, ও একটা স্ক্রিপ্ট দেবে আমাকে। ভুলেই গেছিলাম।
এখানে ডেকে নাও। এই গরমে আবার নীচে নামবে? বলে নীহারের হাত ধরল সুমনা। কনকনে ঠান্ডা হাত! শিউরে উঠে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিল ও। না না এখনি আসছি বলে দরজা খুলে বেরোনোর আগে আবার সেই ফটোটার দিকে তাকাল একঝলক। শান্ত হয়ে এসেছে আবার চোখদুটো। হুড়মুড় করে নীচে নামতে থাকল নীহার। প্রায় ছুটে রাস্তায় নেমে পড়ে বার বার পিছনে তাকাচ্ছিল। মাছিটা ওকেও মৃত বলে ঘোষণা করার আগে এখান থেকে যেভাবে হোক পালাতেই হবে।